একটি বৃক্ষের 'বেঁচে' ওঠার গল্প এবং....

গুলশান লেক পার্কের হেলে পড়া জলপাই গাছটি উঠানোর চেষ্টা চলছে। ছবি: ফারুখ আহমেদ
গুলশান লেক পার্কের হেলে পড়া জলপাই গাছটি উঠানোর চেষ্টা চলছে। ছবি: ফারুখ আহমেদ

জলপাই গাছটি ঠিক রেলিং ঘেঁষে না হলেও একটি বেঞ্চ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। গাছটি কে রোপণ করেছিল সেই ইতিহাস নাই-বা জানলাম। তবে এখানে আসা লোকজন যারা বেঞ্চটিতে বসতেন তারা গাছের ছায়া পেতেন, প্রতিবছর গাছটির ফল খেয়ে তৃপ্ত হতেন অনেকে। গাছটি দাঁড়িয়েই ছিল কিন্তু দুই মাস আগের হঠাৎ এক ঝড়ে হেলে পড়ল গাছটি। 

এত দিন নিঃস্বার্থ ছায়া, অক্সিজেন, ফল আর ফুলের সৌন্দর্য যে গাছটি বিলিয়ে চলেছিল গুলশান লেক পার্কের সেই গাছটি উদ্ধারে কেউ এগিয়ে এলেন না, তার প্রাণের আকুতি কেউ শুনতে পেলেন না। সবাই ভুলে গেলেন গাছটির দীর্ঘ নিঃস্বার্থ সেবা দানের কথা। গাছটিকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করলেন না কেউ। এভাবেই একদিন শুরু হল হেলে পড়া গাছটি থেকে ডাল-পালা কেটে নেওয়ার তোড়জোড়, এখানেও কোনো প্রতিবাদ ছিল না!

গুলশান লেক পার্কের হেলে পড়া জলপাই গাছটি উঠানোর চেষ্টা চলছে। ছবি: ফারুখ আহমেদ
গুলশান লেক পার্কের হেলে পড়া জলপাই গাছটি উঠানোর চেষ্টা চলছে। ছবি: ফারুখ আহমেদ

ভদ্রলোক আর সবার মতো প্রতিদিন প্রাতর্ভ্রমণে আসেন। ব্যক্তিগত কাজে গত দুই মাস মালয়েশিয়া থাকায় প্রাতর্ভ্রমণে আসা হয়নি। দেশে ফেরার পরই তার নজরে আসে গাছটি হেলে পড়েছে। একদিন তিনি খুব কাছে থেকে গাছটি লক্ষ্যে করে দেখেন ডালপালা কেটে নিলেও অবশিষ্ট যা ছিল তা থেকে নতুন পাতা গজাচ্ছে। এমন দৃশ্যে লোকটির আশা বেড়ে যায়। আমরা কিছু করার আগে ভাবি, কিছু একটা উদ্যোগ নেবার আগে অনেক চিন্তা করি। লোকটি ও সবের ধারে কাছেও গেলেন না। প্রথমে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। তারপর ‘গাছটা মরেনি, মরেনি’ বলে চিত্কার শুরু করে দিলেন। অনেকেই কৌতূহলী হলো। গাছ নিয়ে এমন চিত্কার দেখে ব্যাপারটা অনেকের কাছে খুবই হাস্যকর ঠেকলো, পাগলের কাণ্ড ভেবে একটু চোখে বুলিয়ে চলে গেলেন কেউ কেউ। আবার দু’একজন এগিয়ে এলেন এবং গাছটি বেঁচে আছে দেখতে পেয়ে লোক-জন জড়ো করার চেষ্টা করলেন। এদের মধ্যে অন্যতম কাজী মামুন আর পারভেজ দারাইন। আর মৃত প্রায় গাছটিতে যিনি প্রথম প্রাণের ছোঁয়া দেখেছিলেন তিনি উলফাত কাদের।

সবার চেষ্টায় গুলশান লেক পার্কের হেলে পড়া জলপাই গাছটি ‘উঠে’ দাঁড়াচ্ছে। ছবি: ফারুখ আহমেদ
সবার চেষ্টায় গুলশান লেক পার্কের হেলে পড়া জলপাই গাছটি ‘উঠে’ দাঁড়াচ্ছে। ছবি: ফারুখ আহমেদ

প্রথমে তারা তিনজন মিলে কিছু টোকাইর সহযোগিতায় হেলে পড়া গাছটিকে দাঁড় করানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাদের কয়েক জনের পক্ষে এভাবে গাছটি দাঁড় করানো সম্ভব ছিল না। অনেক চেষ্টার পর তারা সেদিনের মতো চলে আসেন। সেদিনই উলফাত কাদের গাছটি নিয়ে কথা বলেন পরিবেশকর্মী শাহজাহান মৃধা বেনুর সঙ্গে, কথা হয় মিহির বিশ্বাসের সঙ্গে। সবাই তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং আশ্বাস দেন সব ধরনের সহযোগিতার। তারপরও কারও অপেক্ষায় বসে না থেকে এক সকালে উলফাত কাদের নিজেই তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়ে আর যারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল তাদের মোবাইলে খবরটি জানিয়ে একটা ক্রেন ভাড়া করে চলে আসেন গুলশান লেক পার্কে। শুরু হয় জলপাই গাছটি দাঁড় করানোর চেষ্টা। এভাবেই এক সময় হেলে পড়া বা আংশিক মাটিতে লুটানো গাছটিকে দাঁড় করানো সম্ভব হয়।

সবার প্রচেষ্টায় গুলশান লেক পার্কের হেলে পড়া গাছটি ‘উঠে’ দাঁড়াচ্ছে। ছবি: ফারুখ আহমেদ
সবার প্রচেষ্টায় গুলশান লেক পার্কের হেলে পড়া গাছটি ‘উঠে’ দাঁড়াচ্ছে। ছবি: ফারুখ আহমেদ

প্রকৃতি প্রেমী ও প্রকৃতি রক্ষায় যারা কাজ করেন তারা খুব ভালো জানেন এসব ব্যাপারে আমরা কতটা উদাসীন, নির্বিকার। ক্রমাগত প্রকৃতি, গাছপালা, বন ধ্বংস হচ্ছে এই নিয়ে কোনো বিকার নেই। নিজেদের কথাই ভাবছি না, পশুপাখি তো অনেক দূরের কথা। প্রকৃতির প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছি না, ভাবছি না আমাদের অনিবার্য ধ্বংসের কথা। ঠিক সেই সময় জলপাই গাছটি গুলশান লেক পার্কের কিছু প্রাতর্ভ্রমণকারীদের সঙ্গে নিয়ে উলফাত কাদেরের প্রচেষ্টায় যেভাবে জীবন ফিরে পেলো, তা একটি দৃষ্টান্ত বটে। এবার আমরা আমাদের আশায় প্রাণ সঞ্চার করাতেই পারি। প্রকৃতির প্রতি এমন প্রগাঢ় ভালোবাসা আমাদের সবার মাঝে সম্প্রসারিত হোক। জলপাই গাছটি বেঁচে গেল। আসুন, এই উদাহরণকে সামনে রেখে প্রকৃতি সুরক্ষার বাস্তব সম্মত আন্দোলন গড়ে তুলি। এই সময় সারা দেশে সবুজের রক্ষক খুবই জরুরি!

হেলে পড়া গাছটি ‘উঠে’ দাঁড়ানোর পর উচ্ছ্বসিত সবাই। ছবি: ফারুখ আহমেদ
হেলে পড়া গাছটি ‘উঠে’ দাঁড়ানোর পর উচ্ছ্বসিত সবাই। ছবি: ফারুখ আহমেদ