সেবা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

পদিপাড়া মিজি বাড়িতে আসতে আসতে খাঁ খাঁ দুপুর হয়ে গেল। মাথার ওপর নুয়ে থাকা গনগনে সূর্যের তাপে আমার ঘর্মাক্ত চেহারা দেখেও এ বাড়ির কারও মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। এটা আমার বাবার বাড়ি। এতটা বছর পর এখানে এসেছি। তবুও কোনো প্রাণীর মাঝে কোনো আগ্রহ নেই আমাকে দেখে। কী বিচিত্র সবাই।
দাদাজান গত হয়েছেন বছর তিনেক আগে। দাদিজান তারও সাত বছর আগে। এ বাড়ির বড় সন্তান আবদুল জলীল, যিনি আমার বাবা। তিনি তো মানসিক রোগী বলে জীবনে অবহেলিত হয়ে উঠেছেন। কিছুক্ষণ পর স্বয়ং দেখতে পেলাম আমার বাবাকে। গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। পায়ে লোহার শিকল বাঁধা। কী অসহায় না দেখাচ্ছে বাবাকে। প্রয়োজনীয় সেবার অভাব তো আছেই, তার ওপর যথেষ্ট পুষ্টির অভাব বলে বুকের হাঁড়গুলো কি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেন টোকা দিলেই মুহূর্তে নেতিয়ে পড়বে।
বাবাকে দেখে চোখে পানি চলে এল আমার। এই মানুষটি আজ পাগল বলে তাঁকে এখন আর কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ তাঁর রোজগারের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় নির্মিত এই পদিপাড়া মিজি বাড়ির বিশাল দালানটি। বাড়িময় তাঁর শ্রমের পয়সায় সব গড়া।
আমার মায়ের যখন এই বাড়িতে বিয়ে হয়, তার সুপুরুষ স্বামীটি ছিল সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। জন্ম হয় আমার। একদিন কী যেন হয়ে গেল। মাঝরাতে বাবার খিঁচুনি দিয়ে জ্বর। জ্বর বাড়তে থাকে আর বাবা আবোলতাবোল বকতে থাকেন।
সেই আবোলতাবোল বকা আর থামে না। ডাক্তার জানালেন এই রোগের নাম সিজোফ্রেনিয়া। রোগ দিন দিন জটিল হয়। একজন পাগল স্বামীকে আর সেবা করা দূরের কথা, মা সিদ্ধান্ত নিলেন পাগল মানুষের সঙ্গে আর সংসার করবেন না।
বাবাকে তালাক দিয়ে মা আমাকে নিয়ে চলে এলেন নানাজানের বাড়ি। আমি বড় হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এসব গল্প শুনলাম। তখন থেকে বাবার জন্য আমার গোপন টান। রক্তের সম্পর্ক বলে।
গোপনে গোপনে খবর নিতাম বাবার। জানলাম বাবাকে সেবা করার মতো কেউ নেই মিজি বাড়িতে। তার ভাইয়ের স্ত্রীরা বেশ অবহেলায় রাখেন তাঁদের ভাশুরকে। এসব শুনে আমার খুব কষ্ট হতো।
আজ আমি বড় হয়েছি। বাবার মতো আমিও আজ সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আজ আমার বল হয়েছে। আমি বাবাকে এই মিজি বাড়ি থেকে নিয়ে যাব। আমি তার সেবা করব। যে মানুষটি অসুস্থ বলে স্ত্রী আর পরিজনদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবা পাননি, আজ সে মানুষটিকে সেবা করবে তাঁরই ছেলে।
সে জন্যই তো আমি এখানে এসেছি। মিনিট দশেক পর চাচিরা দলে দলে আমার সামনে হাজির। আমি যেন এ বাড়িতে আমার বাবার পাওনা সম্পত্তির ভাগ নিতে এসেছি, এমন আতঙ্কে ছোট চাচি বলল, ‘কেন এসেছ?’ আমার সরল জবাব, বাবাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনারা তো তাঁর সেবা করেন না। করেননি আমার মা–ও। কিন্তু আমি ঠিকই আমার বাবার সেবা করব। সে জন্য এখানে এসেছি।’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ছোট চাচি তিরস্কারের ভঙ্গিমায় বললেন, ‘যাক, বাঁচা গেল।’
আমি বাবার পা থেকে শিকল খুলে দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম, চলেন, এই অবহেলার আস্তানা থেকে আপনাকে নিয়ে যাই। আমি যেন কোনো কঠিন কথা বলেছি, এমন চেহারায় বাবা আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তাঁর সারা শরীর কাঁপছে। মুখ থেকে দুর্গন্ধময় লালা ঝরছে। রক্তবর্ণ চোখে পানি পড়ার আশঙ্কা। গায়ে ছেঁড়া পাঞ্জাবি। সব মিলিয়ে বাবাকে এত করুণ দেখাচ্ছে যে আমার ভেতরটা ভাঙতে ভাঙতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠল। কাঁপা গলায় বললাম, আজ থেকে আমিই আপনার সেবা করব। আমার কথা না শুনে বাবা শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর সেই তাকিয়ে থাকার মাঝে কেমন যেন হতাশা আর বেদনা জড়িয়ে আছে।