ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সরকার কার্যত নাকচ করে দিলেও এখনই হাল ছাড়ছে না বিএনপি। প্রস্তাবের সারবস্তু মাঠপর্যায়ে পৌঁছাতে ও জনমত গঠনে সভা-সেমিনার শুরু করেছে দলটি।
গতকাল রোববার সিলেটে এ নিয়ে ‘নির্বাচন কমিশন গঠন এবং শক্তিশালীকরণ: বিএনপির প্রস্তাবলি’ শীর্ষক এ আলোচনা সভা করেছে স্থানীয় বিএনপি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এরপর পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সভা-সেমিনার হবে। এরপর জনসভার মাধ্যমে ভোটাধিকার পুরুদ্ধারের এই আন্দোলন জনগণের আরও কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।
বিএনপির সূত্র জানায়, নিজের ও দলের নেতা-কর্মীদের মামলা-মোকদ্দমা এবং আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের শীর্ষ
নেতৃত্ব শিগগির সারা দেশে একটি ‘অহিংস’ আন্দোলন গড়ার চিন্তা করছে। দলটির নেতারা মনে করছেন, গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলনে নামলে জনসমর্থন পাওয়া যাবে। এতে অহিংস আন্দোলন গড়া গেলে সরকারের ওপর প্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। একই ইস্যুতে ২০-দলীয় জোটের শরিকদেরও পৃথক কর্মসূচি নিতে বলা হয়েছে।
একটি স্বাধীন ও সাহসী নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ১৩ দফা প্রস্তাবের কপি ইতিমধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন–সহযোগীদের অনেকের কাছেও এই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। মানুষের মাঝে বিলি করার এই প্রস্তাবকে পুস্তিকা আকারে ছাপানো হচ্ছে। প্রথম দফায় ছয় হাজার কপি ছাপানো হয়েছে। আরও ছাপানো হবে।
জানা গেছে, নতুন ইসি গঠন–প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন–সহযোগীরা যাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, সে জন্য দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব যোগাযোগ রক্ষা করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ ভোটারদের আস্থা তৈরি করতে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে বলেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদলও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার কথা বলে গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্ব সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ বা মধ্যস্থতার আশাও এখনো ছাড়েননি। এ বিষয়ে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,‘...রাষ্ট্রপতি যে পদক্ষেপ নেবেন, সেটাই হবে। এখানে আমাদের বলার কিছু নেই।’
বিএনপির নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী যে অর্থেই কথাটি বলে থাকুন না কেন, এতে রাষ্ট্রপতির ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির প্রধানের প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির হাতে দিতে তাঁর সাক্ষাতের সময় চাইলেও এত দিন বঙ্গভবন থেকে সাড়া মেলেনি। নেতারা এখন মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এখন রাষ্ট্রপতি বিএনপির প্রতিনিধিদলকে সাক্ষাতের সময় দেবেন।
খালেদা জিয়া গত ১৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে ১৩ দফা প্রস্তাবসহ একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবে তিনি বলেন, নতুন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। দলগুলো বাছাই কমিটির কাছে নাম দেবে। যে নামগুলো সব দল থেকেই এসেছে, সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে দুজন ও প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনারের বিপরীতে দুজনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে কমিটি। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে সিইসি ও ইসি নিয়োগ করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত দলগুলোর দেওয়া নামের প্রস্তাবে মিল না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাছাই কমিটি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
পরদিনই বিএনপি এ বিষয়ে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ চেয়ে তাঁর সামরিক সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সাড়া না পেয়ে পরদিন লিখিতভাবে আবেদন জানায়। কিন্তু এখনো সময় পায়নি। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যদি সাক্ষাৎ দেওয়ার প্রয়োজন মনে না করেন, আমরা ডাকযোগে প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দেব। তিনি যদি দেখা না দেন, এটাও রেকর্ডে থাকল।’
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন–প্রক্রিয়া শুরুর আগে খালেদা জিয়া আরেক দফা সংবাদ সম্মেলন করবেন। সেখানে স্বাধীন ইসি গঠনে তাঁর প্রস্তাব আরও সুনির্দিষ্ট করে উপস্থাপন করতে পারেন। দলের চিন্তাশীল একটি গোষ্ঠী এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিশিষ্ট নাগরিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন।
সরকার ‘নার্ভাস’: প্রথম আলোর সিলেট প্রতিনিধি জানান, গতকাল সিলেটে আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মতো কোনো প্রসঙ্গ সরকারি দল খুঁজে পাচ্ছে না। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে সরকারি দল এখন নার্ভাস ফিল করছে।’
সিলেটে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের শহীদ সুলেমান হলে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন।
আমীর খসরু বলেন, কোনো দল বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, দেশের জনগণকে মাথায় রেখে বিএনপির চেয়ারপারসন কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে আলোচনার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে বিএনপি, আমরা আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধান চাই।’