মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী

হেফাজতে ইসলাম নতুন আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তা নিয়ে সংগঠনের কারও কারও মধ্যে সংশয় আছে। তবে তাঁকে নিয়ে সংগঠনে কোনো বিতর্ক নেই। নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে তিনি কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, সেদিকে এখন সংগঠনের সবার দৃষ্টি।

হেফাজত সূত্র বলছে, এখন সংগঠনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সারা দেশে কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্ত করা। পাশাপাশি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মাদ্রাসাগুলো খোলার পর শিক্ষায় মনোযোগ দেওয়াকেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে। হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস জানান, এখনো তাঁদের ১ হাজার বেশি নেতা-কর্মী কারাবন্দী রয়েছেন। মুক্তি পেয়েছেন কেবল ৪০-৪৫ জন।

সংগঠনের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী রাজনৈতিক সংশ্লেষহীন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আলেম। নিজের মাদ্রাসা, সেখানকার পড়াশোনা এবং ধর্মীয় বিষয় ছাড়া অন্য কিছুতে তাঁর বিশেষ আগ্রহ নেই। তাঁকে নিয়ে আলেমদের মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই। তাই হেফাজতের নেতারা আশা করছেন, মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্রিক সংগঠনটি একতাবদ্ধ হয়ে চলবে।

গত ১৯ আগস্ট হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী মারা গেলে ওই দিনই মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে নতুন আমির ঘোষণা করা হয়। এরপর ৩০ আগস্ট ঢাকায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার বৈঠকে এর অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রায় ৯০ বছর বয়সী মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এক নম্বর নায়েবে আমির পদে ছিলেন। জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে যে কমিটি হয়, তাতে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা এবং ৯ সদস্যের খাস (বিশেষ) কমিটিরও এক নম্বর সদস্য। তিনি প্রয়াত আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা।

হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিরের (জুনায়েদ বাবুনগরী) মৃত্যুর রাতেই আমরা হাটহাজারী মাদ্রাসায় সিনিয়র শিক্ষককের সঙ্গে বসে নতুন আমির ঘোষণা দিয়েছিলাম। এটা নিয়ে দু-একজন টুকটাক কথা বলেছেন। সে জন্য মুরুব্বিরা মজলিশে শুরার বৈঠক ডাকার পরামর্শ দেন। ৩০ আগস্ট শুরার বৈঠকে নতুন আমির (মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী) নির্বাচন অনুমোদন হয়।’

মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও তিনি হেফাজতকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তা নিয়ে দায়িত্বশীলদের কারও কারও সংশয় রয়েছে। কারণ, দারুল উলুম মঈনুল ইসলামকে (হাটহাজারী মাদ্রাসা) প্রধান কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠা হয়। এর আগে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফী এবং পরবর্তী আমির জুনায়েদ বাবুনগরী হাটহাজারী মাদ্রাসা মহাপরিচালক ও শিক্ষা পরিচালক ছিলেন। নতুন আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হাটহাজারী থাকেন না। তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। এই দূরত্ব সংগঠনেও দূরত্ব তৈরি করে কি না, সেটাই সংশয়ের কারণ।

এ ছাড়া সরকারি মহলের সঙ্গেও মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর বিশেষ যোগাযোগ আছে, এমন কিছু জানা যায় না। কিন্তু হেফাজতের বর্তমান কমিটির কারও কারও সঙ্গে সরকারির মহলের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে সংগঠনে আলোচনা আছে। ফলে শেষ পর্যন্ত সংগঠনে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর প্রভাব কতটা থাকে, তা নিয়েও অনেকের মনে সংশয় আছে।

ধর্মীয় এবং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার নীতি-আদর্শের কিছু কিছু বিষয়ে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর অবস্থান কট্টর বলে জানান তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা। তাঁরা জানান, একসময় তিনি মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোটের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি মুফতি আমিনীকে পছন্দ করতেন, সে কারণে তাঁর দলে যুক্ত হন, তবে কোনো কর্মসূচিতে থাকতেন না। আমিনীর মৃত্যুর পর ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির জোট ছেড়ে সরকারের দিকে ঝুঁকলে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী পদত্যাগ করেন। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার সনদের সরকারি স্বীকৃতির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে শাহ আহমদ শফীর ঘনিষ্ঠতায় অসন্তোষ জানিয়ে তিনি একবার হেফাজত থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর অনেক দিন চুপচাপ ছিলেন।

হেফাজত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, ভবিষ্যতে হেফাজতের কর্মসূচির ওপর নির্ভর করবে নতুন আমিরের নেতৃত্বে সংগঠনের গতি-প্রকৃতি। শিগগির সংগঠনের প্রয়াত আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর জীবন ও কর্মের ওপর ঢাকায় একটি স্মরণসভা করা হবে। এখনো তারিখ ঠিক হয়নি। এর বাইরে হেফাজতের এখন প্রধান লক্ষ্য কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্তির ব্যবস্থা করা এবং মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার পর শিক্ষায় মনোযোগী হওয়া। করোনাকালে স্কুল-কলেজে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও মাদ্রাসাগুলোতে তা হয়নি। কারণ, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় মাদ্রাসাগুলো অভ্যস্ত নয়।

হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমাদের মূল কাজ কারাবন্দীদের মুক্তি এবং মাদ্রাসাগুলো খোলার ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে সরকারকে একাধিকবার বলেছি। এর বাইরে আমরা আর কিছু নিয়ে ভাবছি না।’