নতুন জোটের উদ্যোগ

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী তোড়জোড় চলছে ছোট ছোট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। গড়ছে নতুন নতুন জোট ও দল, আবার ভাঙছেও। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী নির্বাচন কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করছে এসব দল ও জোটের ভবিষ্যৎ।

নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে ট্রুথ পার্টি, এনডিএম ও বাংলাদেশ জনতা পার্টি নামে তিনটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। ভেঙেছে খেলাফত আন্দোলনসহ চারটি দল। একই সঙ্গে চলছে নির্বাচনী জোট গঠনের তিনটি উদ্যোগ।

এর মধ্যে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়া অনেকটা এগিয়েছে। পাঁচটি দলের নতুন জোট গড়ার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে লিয়াজোঁ কমিটি হয়েছে। কমিটির সমন্বয়কারী হয়েছেন নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না। দল পাঁচটি হলো বিকল্পধারা বাংলাদেশ, গণফোরাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্য।

জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি যুক্তফ্রন্ট টাইপের একটি রাজনৈতিক মঞ্চ করতে। আলাপ-আলোচনা চলছে, ইতিমধ্যে আমরা লিয়াজোঁ কমিটি করেছি। আমরা আরও বসব, আলোচনা হবে।’

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অনেকটা তড়িঘড়ি নতুন জোট করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের অংশীদার এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টিও। ইসলামি ও
সাধারণ দলের দুই শ্রেণিবিন্যাস করা অভিনব এই জোটের নাম সম্মিলিত জাতীয় জোট। শরিক দলের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। তবে এই জোটে জাতীয় পার্টি ছাড়া মাত্র একটি দলের নিবন্ধন আছে নির্বাচন কমিশনে। যদিও গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ দাবি করেছেন, তাঁদের জোট জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের বাইরে থাকা ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যেও নির্বাচনী মোর্চা গড়ার সক্রিয় তৎপরতা আছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ছেড়ে আসা প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট। দলটির চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বিষয়টি স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইসলামি দলগুলো নির্বাচনভিত্তিক একটি সমঝোতা করতে চাইছি, যাতে একটি আসনে ইসলামি দলগুলোর একজন প্রার্থী থাকে।’

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের বাইরে সিপিবি-বাসদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাভুক্ত সাতটি দলের নতুন করে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে। এখন থেকে তারা বিভিন্ন বিষয়ে একসঙ্গে আন্দোলন করবে। এখনো এর নামকরণ হয়নি। সম্ভাব্য এই রাজনৈতিক মোর্চায় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টিসহ বাম প্রগতিশীল ধারার আরও তিনটি দল আছে।

জানতে চাইলে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে পাঁচ দফা ন্যূনতম দাবিতে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে আমরা সমাবেশ করেছি, আগামী ৯ আগস্টও আমাদের কর্মসূচি আছে।’

নতুন দল গঠনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে কিছু নতুন দল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টকে (বিএনএফ) আদর্শ ধরে এগোচ্ছে। গত নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনএফ নির্বাচন কমিশনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ চেয়ে আলোচিত হয়। পরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলটির প্রধান সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ ঢাকার গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে সাংসদ হন।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক দল গড়ার অর্থ আগে থেকে দোকান খুলে বসা। বিএনএফের মতো হয়তো কিছু ঘটেও যেতে পারে, এ রকম একটা সম্ভাবনা থেকে এটা করা হচ্ছে।’

এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে গোলাম হাবিব ও গোলাম মাওলা চৌধুরী ট্রুথ পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন। বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের ছেলে ববি হাজ্জাজ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) নামে দল করেন। অলি আহমদের এলডিপি ছেড়ে বাংলাদেশ জনতা পার্টি করেন মামদুদুর রহমান। নতুন দল গঠনের চেষ্টা করছেন বিএনপির সংস্কারপন্থী নেতা শহিদুল হক জামাল।

পাশাপাশি চলছে দল ভাঙাও। গত এপ্রিল মাসে ভেঙেছে ধর্মভিত্তিক দল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। ভেঙেছে নাজমুল হুদার বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সও (বিএনএ)। মার্চে ভাঙে শওকত হোসেন নীলুর (প্রয়াত) ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। একই সময়ে তাঁর গড়া ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ভেঙে ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স হয়েছে। এর আগে গত ডিসেম্বরে বিভক্ত হয় ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টিও (পিডিপি)।

এভাবে দল ভাঙাগড়ার নেপথ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধার কথা স্বীকার করেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ভেঙে গঠিত ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের প্রধান সমন্বয়কারী আলমগীর মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খোলামেলাভাবে বলতে গেলে এটি (ভাঙাগড়া) হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিক অবস্থান নেওয়া। কারও কারও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো ‘ফাও’ কিছু পাওয়ার মানসিকতা যে নেই, তা অস্বীকার করা যাবে না।

জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মীজানুর রহমান শেলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেবল সংখ্যাগত পার্থক্য দেখিয়ে মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলার জন্য যেসব জোট করা হচ্ছে, সেসবের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে বলে মনে করি না। মানুষ সবই বোঝে।’