বর্তমান ১০ কাউন্সিলরসহ আ.লীগে ৭০ 'বিদ্রোহী'

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্তমান ২০ কাউন্সিলর এবার আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি। তাঁদের মধ্যে ১০ জন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। উত্তর সিটির ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ৪২টিতেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের সংখ্যা ৭০। বিদ্রোহী প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন সাংসদপুত্রও।

কাউন্সিলর পদে গত ২৯ ডিসেম্বর দলীয় সমর্থনের তালিকা প্রকাশ করার পর এখন পর্যন্ত উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) দুটি ওয়ার্ডে প্রার্থী পরিবর্তন করেছে আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় বিদ্রোহীদের অনেকে মনে করছেন, ঘোষিত তালিকাই চূড়ান্ত নয়। দলীয় সমর্থন বদলাতে পারে। পর্যালোচনা করে অধিকতর যোগ্য প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়ার সুযোগ এখনো রয়েছে। আবার বিদ্রোহীদের কেউ কেউ বলছেন, কয়েকটি ওয়ার্ডে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিতে পারে আওয়ামী লীগ।

তবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি ওয়ার্ডে দলের একক প্রার্থী নিশ্চিতের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ৯ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর আগেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানোর চেষ্টা চলছে। মহানগরের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন। আর এখন পর্যন্ত যা সিদ্ধান্ত, তাতে কোনো ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদ উন্মুক্ত করার সম্ভাবনা কম।

>উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ড
সাংসদপুত্রও রয়েছেন ‘বিদ্রোহীদের’ তালিকায়
৯ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোট হয় নির্দলীয়ভাবে। তবে ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলর পদেও প্রার্থীদের দলগত সমর্থন দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দলের সমর্থন না পেয়েও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যাঁরা নির্বাচন করেন, তাঁরা ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে পরিচিত।

সমর্থন না পেয়েও প্রার্থী ১০ কাউন্সিলর
৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে। ঢাকা উত্তরের ৫৪টি এবং দক্ষিণের ৭৫টি মিলিয়ে দুই সিটিতে মোট ১২৯টি সাধারণ ওয়ার্ড। গত বৃহস্পতিবার প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাছাই শেষ হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেলেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০ জন বর্তমান কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে এখনো নির্বাচনে রয়েছেন।

দলীয় সমর্থন না পাওয়া আওয়ামী লীগের ১০ জন কাউন্সিলর হলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জহিরুল ইসলাম, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে রজ্জব হোসেন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কাজী টিপু সুলতান, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ইকবাল হোসেন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে হুমায়ুন রশীদ, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে মো. নাছির, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে মোস্তাক আহমেদ, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ মুজিবুর রহমান, ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে ফারুক আহমেদ এবং ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে মাসুদুর রহমান দেওয়ান।

জানতে চাইলে ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাসুদুর রহমান দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল আমাকে প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে সমর্থন দেবে, এই প্রত্যাশা করছি। ৯ তারিখ পর্যন্ত দেখব। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।’

২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মোস্তাক আহমেদও দলের সমর্থন পাননি। তবে এখনো আশা ছাড়েননি তিনি। গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ৯ তারিখের মধ্যে অনেক কিছুই হতে পারে।

ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫২টি ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলরই আওয়ামী লীগ-সমর্থিত বা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। বাকি দুটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিএনপি ও জাতীয় পার্টি (জাপা) সমর্থিত। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। এবার ১২টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নেই।

ডিএনসিসির ১২ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মুরাদ হোসেন। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন। তিনি মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সদস্য। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ধারণা, নানা কারণে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় এবার দল ইকবাল হোসেনকে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু তিনি নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছেন।

এক ওয়ার্ডে একাধিক বিদ্রোহী
২৫ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মঞ্জুর। এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে বৈধ প্রার্থী রয়েছেন ১১ জন। এর মধ্যে বর্তমান কাউন্সিলর শেখ মজিবুর রহমানসহ পাঁচজন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।

আবদুল্লাহ আল মঞ্জুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল আমাকে সমর্থন দিয়েছে। অন্য প্রার্থীরা প্রত্যাহার করবেন, এই প্রত্যাশা করছি।’ তবে বর্তমান কাউন্সিলর মজিবুর রহমান বলেন, ‘দলের সমর্থন বদল হবে, এই প্রত্যাশা করছি। এরপরের সিদ্ধান্ত ৯ তারিখের পরে নেব।’

ডিএনসিসির ১১ নম্বর ওয়ার্ডে বৈধ প্রার্থী সাতজন। এই ওয়ার্ডে দলের সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গাজী আলিয়ার রহমান, মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনসুর আলী, মিরপুর থানা আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদুল হাসান ও মো. লিটন।

এ বিষয়ে দেওয়ান আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল আমাকে সমর্থন দিয়েছে। শুনেছি আরও একাধিক প্রার্থী দলীয় সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। আশা করছি, ৯ তারিখের পর এত প্রার্থী থাকবেন না।’

৮ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আবুল কাশেম। এই ওয়ার্ডে বিদ্রোহী রয়েছেন তিনজন। তাঁরা হলেন বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলর টিপু সুলতান, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান শেখ ও যুগ্ম সম্পাদক আনিছুর রহমান। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মইজউদ্দিন। এখানে বিদ্রোহী আছেন দুজন। বর্তমান কাউন্সিলর হুমায়ুন রশিদ ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল হক ভূঁইয়া। মইজউদ্দিন বলেন, ‘আশা করছি শেষ পর্যন্ত কেউ বিদ্রোহী থাকবে না।’

৪১ নম্বর ওয়ার্ডে শুরুতে দলের সমর্থন পেয়েছিলেন সাতারকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মতিন। পরে বর্তমান কাউন্সিলর সফিকুল ইসলামকে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়। আবদুল মতিন বৈধ প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ে রয়ে গেছেন। ডিএনসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ডে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কদম আলী। এই ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন।

৩০ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল হাসেম। এর বাইরে এখানে প্রার্থী হিসেবে আছেন ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি মাসুদ খান, আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রিয়াজ উদ্দীন খান ও আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন।

বিদ্রোহীর তালিকায় সাংসদপুত্রও
৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ হোসেন। এই ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফাহিম সাদেক খান। তিনি ঢাকা-১৩ আসনের বর্তমান সাংসদ ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদেক খানের ছেলে।

ফাহিম সাদেক খানের আশা, শেষ পর্যন্ত দলের সমর্থন বদলাতে পারে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইতিমধ্যে বলেছেন, অনেক জায়গায় এখনো প্রার্থী যাচাই-বাছাই চলছে। ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে। এর মধ্যে যদি তিনি দলের সমর্থন পান, তাহলে নির্বাচন করবেন। তা না হলে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও দলের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো নির্বাচনে শুরুতে একাধিক প্রার্থী থাকেন, এটা নতুন কিছু নয়। ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে যাঁরা দলের সমর্থন পাননি, তাঁদের অনেকে প্রার্থী হয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন বলে দল আশা করে। তিনি বলেন, কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থনে পরিবর্তন আসার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।