বিএনপিতে ভুঁইফোড়দের সেই ‘রমরমা’ নেই

টানা ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। রাজপথের আন্দোলন বা দলীয় রাজনীতিতেও খুব একটি সুবিধাজনক অবস্থানে নেই দলটি। দলের ‘দুরবস্থা’ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তবে এ অবস্থার মধ্যেও সুবিধাবাদীরা বিএনপি, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নামে সংগঠন করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিএনপির নাম ব্যবহার করে নামসর্বস্ব ভুঁইফোড় সংগঠন করা থেমে না থাকলেও দলটিকে কেন্দ্র করে ভুঁইফোড়দের সেই ‘রমরমা’ অবস্থা এখন আর চোখে পড়ে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগপর্যন্ত এসব সংগঠনের ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেলেও ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। বিএনপির নেতারাই বলছেন, এ সংগঠনগুলো মূলত দলের সুসময়ে তৎপরতা দেখায়। কিন্তু খারাপ সময়ে এরা থাকে না। ওই নির্বাচনের পর এদের দৌরাত্ম্য কমতে থাকায় এগুলো নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথার আর কারণ ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি ‘শহীদ জিয়া ছাত্র পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা এবং এদের কর্মকাণ্ডে দলটিকে, বিশেষ করে তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে বিব্রত হতে হচ্ছিল বলে কেন্দ্রের কাছে অভিযোগ আসতে থাকে। এরপর গত সোমবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, ওই সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

বিজ্ঞপ্তিতে প্রিন্স বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি, “শহীদ জিয়া ছাত্র পরিষদ” নামে একটি সংগঠন তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানানো যাচ্ছে, সংগঠনটির সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক বা সংশ্লিষ্টতা নেই। সংগঠনটি বিএনপির অধিভুক্ত কোনো সংগঠন নয়। বিএনপি ও এর অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নামসর্বস্ব ভুঁইফোড় এসব সংগঠনের কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দলীয় নেতারাও বিভ্রান্ত হন। কেউ দলের নামে সংগঠন করতে চাইলে তার জন্য অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু তা না করেই এসব সংগঠন গড়ে উঠছে। এতে মূল দল ও এর সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনগুলোর কাজে সমস্যা হয়। তিনি আরও বলেন, দলীয় নেতারা সতর্ক থাকলে এরা সুবিধা করতে পারবে না।

ভুঁইফোড়দের রমরমা নেই

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে চাপে পড়ায় এবং দেড় বছর ধরে চলা করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে বিএনপির নাম ব্যবহার করে গড়ের ওঠা ‘ভুঁইফোড়’ সংগঠনগুলোর সময় খারাপ সময় যাচ্ছে। অর্থ জোগানদাতার অভাবে সভা-সমাবেশ নেই বললেই চলে।

সভা-সমাবেশের নামে অর্থ আয় করা, দলীয় নেতাদের কাছে গুরুত্ব পাওয়া এবং বিএনপি ক্ষমতায় এলে লাভবান হওয়ার চিন্তা থেকেই সংগঠনগুলো গড়ে ওঠে। এর পেছনে দলটির কিছু কেন্দ্রীয় নেতারও ভূমিকা ছিল। তবে এখন এসবের কিছুই না থাকায় বিএনপির নামে করা ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব অনেকটাই সংকটে।

বিএনপির সমর্থক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠা প্যাডসর্বস্ব ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর তৎপরতা মূলত ছিল জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে ও সামনের সড়কে এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিকেন্দ্রিক। এরা বিভিন্ন বিষয়ে মানববন্ধন, সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এ-জাতীয় নামসর্বস্ব সংগঠন বাড়তে থাকে। বিএনপির সমর্থক উল্লেখ করা এ ধরনের অন্তত ৬১টি কাগুজে সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া পায়।

এসব সংগঠনের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকায় এবং এদের কর্মকাণ্ড নিয়ে দলের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ২০১২ সালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অন্তত ৪০টি সংগঠনের নাম উল্লেখ করে সেগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে দলীয় নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ‘জাতীয়তাবাদী তরুণ দল’ নামে একটি সংগঠনের ব্যাপারে সতর্ক করতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়।

তবে ‘জি-নাইন (গ্রুপ-২০০৯)’ ও ‘শত নাগরিক কমিটি’ নামে দুটি সংগঠনকে দলের ‘থিঙ্কট্যাংক’ হিসেবে মর্যাদা দেয় বিএনপি। পাশাপাশি নব্বইয়ের দশকের ছাত্রনেতাদের করা সংগঠনটিকেও গুরুত্ব দেয় বিএনপি।

বিএনপির নাম ব্যবহার করে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর মধ্যে আছে ‘স্বাধীনতা ফোরাম’, ‘নাগরিক ফোরাম’, ‘জিয়া ব্রিগেড’ ‘দেশপ্রেমিক মঞ্চ’, ‘দেশনেত্রী পরিষদ’ ‘জিয়া ফোরাম’, ‘স্বদেশ জাগরণী ফোরাম’, ‘তারেক জিয়া ফোরাম’ ইত্যাদি।

সংগঠনের নামের শুরুতে জাতীয়তাবাদী লাগিয়ে নামকরণ করা সংগঠনগুলো হলো ‘নাগরিক দল’, ‘মানবাধিকার ফোরাম’, ‘সেবাদল’, ‘বাস্তুহারা দল’, ‘প্রজন্ম দল’, ‘মঞ্চ’, ‘কর্মজীবী কল্যাণ পরিষদ;, ‘তৃণমূল দল’, ‘ভূমিহীন দল’, ‘বন্ধুদল’, ‘নতুন বাংলাদেশ’। এ ছাড়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নামে নামকরণ করা সংগঠনগুলো হলো ‘জিয়া নাগরিক ফোরাম’, ‘জিয়া সেনা’, ‘জিয়া ব্রিগেড’। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নামে আছে ‘দেশনেত্রী পরিষদ’, ‘খালেদা জিয়া পরিষদ’, ‘তারেক জিয়া ফোরাম’, ‘তারেক পরিষদ’।

ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর মধ্যে ৩৮টি সংগঠন মিলে ‘বিএনপির সহযোগী সংগঠন ঐক্য পরিষদ’ গঠন করেছিল ২০১৪ সালের আগস্টে। তবে এর কোনো অস্তিত্ব এখন বিএনপিতে নেই। ঐক্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন মো. হানিফ নামের বিএনপির এক সমর্থক। তবে তাঁকে বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা।

বিএনপি নেতা এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, দলের নাম ব্যবহার করে করা কিছু সংগঠনের কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিএনপি এ ধরনের সংগঠনগুলোকে বৈধতা দেয় না।