ভোটের আগে মাঠ খালি করতে আবারও মামলা: মির্জা ফখরুল
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা এবং অন্য যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে তাঁরা কেউই পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা এবং আইনগতভাবে বিপদগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে বরকতউল্লার বিরুদ্ধে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম এ দাবি করেন। এ সময় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান ও আবদুস সালামসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির মহাসচিব অভিযোগ করেন, দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে পূজামণ্ডপে হামলা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোর পেছনে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ আছে। সরকারের এজেন্সিগুলো এর পরিকল্পনা করেছে। এর উদ্দেশ্য মূল সংকট থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরানো এবং নির্বাচনের আগে মাঠ একদম খালি করে ফেলা।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে ‘গায়েবি’ মামলার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো ঘটনা ঘটলেই তারা বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দেয় এবং তাদের গ্রেপ্তার করা হয়, হয়রানি করা হয়। শুধু তা–ই নয়, অনেক সময় গায়েবি মামলাও করা হয়, যেটা আমরা গত নির্বাচনের আগে দেখেছি।’
এর মাধ্যমে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার–বাণিজ্যের অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এবারও আমরা লক্ষ করলাম যেটা আমাদের সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবীরাও বলছেন। এই যে গ্রেপ্তার–বাণিজ্য করার জন্য এবং প্রকৃত অপরাধীরা যাতে ধরা না পড়ে, তাদের যেন ধরতে না হয়, সে জন্য তারা বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মীর নাম দিয়ে মামলা দেয় একটা পুরোপুরি মিথ্যাচারের মাধ্যমে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, পূজা উপলক্ষে মন্দির ভাঙা এবং লুটপাটের বিষয়ে মোট মামলা হয়েছে ৬০টি। আসামির সংখ্যা হচ্ছে ১৫ হাজার ৯৬ জন। ইতিমধ্যে বিএনপির ১৪৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে ২৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৭ হাজার ৯৬১ জনকে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রশ্ন তোলেন, এই মামলা কবে শেষ হবে। হবে কোনো দিন শেষ? ৭ হাজার ৬১ জনের মামলা যদি চলতে থাকে, মামলা তো শেষ হবে না। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ ঘটনাগুলো ঘটিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের জড়িয়ে তাঁদের হয়রানি করা, গ্রেপ্তার করা ও গ্রেপ্তার–বাণিজ্য করা এবং মূল জায়গা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়া।
এবার দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ঘটনার পেছনে সরকারি দলের ইন্ধন ছিল বলে দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, রংপুরের যে ঘটনা ঘটেছে পীরগঞ্জে। সেখানে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা সৈকত ও রেজাউল তারাই এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। তারা ঘটনার সূত্রপাত ঘটাল, এরপর দেখা গেল মামলায় অনেক বিএনপির নেতা-কর্মীর নাম দিয়ে দিয়েছে। রংপুরে চারটি মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপির অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, রংপুরের ঘটনা ঘটেছে কখন। একদিকে পুলিশ, ইউএনও যাঁরা প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করছিলেন মাঠের মধ্যে। তখনই একই সময় রাস্তার ওই পাশে পাড়ার মধ্যে গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেটা ইউএনও বলেছেন, ওসিও বলেছেন যে পরবর্তীকালে যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘কুমিল্লাতেও তারা পাগল ইকবাল বলে একজনকে সাজিয়েছে। সে নাকি পবিত্র কোরআন শরিফ নিয়ে মণ্ডপে রেখেছে এবং সেখান থেকে মসজিদে গেছে—যেগুলো কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা অত্যন্ত পরিকল্পিত ঘটনা। আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম, সরকারের এজেন্সিগুলো এ পরিকল্পনা করেছে।’ তিনি বলেন, এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণের যে সমস্যা সংকট, অর্থাৎ ভাতের সংকট, ভোটের সংকট, বাক্স্বাধীনতার সংকট, তার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধির যে সংকট—সেই সংকট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্যই এই ঘটনা ঘটিয়ে মামলাগুলো দেওয়া হয়েছে।
চৌমুহনীর ঘটনার উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) নোয়াখালীর পুলিশ সুপার খুব জোরেশোরে বলেছেন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসভাপতি ফয়সাল এনাম ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এখানে আসামি ফয়সালকে দিয়ে বিএনপির নেতা বরকতউল্লা নাম বলিয়েছেন, যিনি এ এলাকা থেকে বারবার নির্বাচিত এমপি। তাঁর নাম বলেছে ১ নম্বরে। এটা ওই এলাকার মানুষ, সারা দেশের মানুষ, কেউই বিশ্বাস করবে না যে প্রগতিশীল রাজনীতি থেকে উঠে আসা বরকতউল্লার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা থাকবে।
চৌমুহনীর ঘটনায় করা মামলার ৩ নম্বর আসামি বাবু কামাক্ষা চন্দ্র দাসের নাম উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, কামাক্ষা চন্দ্র দাসও গিয়েছিলেন পূজামণ্ডপে ভাঙতে—এটাই হচ্ছে গল্প। তিনি বলেন, ‘কামাক্ষা চন্দ্র দাস উপজেলা বিএনপির সভাপতি। ঘটনার পর তিনি আমার পাশে বসেই প্রেসের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং সেটাই হচ্ছে তাঁর অপরাধ। তিনি একটা ভিডিও সবার কাছে তুলে ধরেছিলেন, তাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল যে তাঁদের ধারণা, সরকারি দলের লোকেরাই এটা করেছে। পুলিশকে ডাকার পরও পুলিশ সময়মতো আসেনি। ছয় ঘণ্টা তাণ্ডব চলেছে, লুটপাট হয়েছে, কিন্তু পুলিশ কোনো হস্তক্ষেপই করেনি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমান যে সরকার, এরা নির্বাচিত সরকার নয় এবং জনগণের আস্থা তাদের ওপর থেকে চলে গেছে। এখন সেটা যে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের তা নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা, বৌদ্ধ ধর্মের নেতারাও পরিষ্কার করে বলেছেন যে এ সরকারকে আর বিশ্বাস করা যায় না। কেন? তারা প্রতারণা করে, কথায় বলে একটা কাজ করে আরেকটা। একই সঙ্গে তারা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে—যেটা আমরা মনে করি আওয়ামী লীগ সব সময় করে এসেছে এবং এটা করে তারা রাজনীতিতে থাকতে চায়।’
কুমিল্লার ঘটনায় ইকবালের ভিডিও চিত্র প্রকাশের পরও সেটি কেন বিএনপির কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, কী কারণে বিশ্বাস করব? কুমিল্লার ঘটনার ব্যাপারে কুমিল্লার যাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাঁরা আগেই বলেছেন এবং ভিডিওতে বলেছেন যে এটা আসলে কুমিল্লা আওয়ামী লীগের নিজস্ব দ্বন্দ্ব। সেখানে দুটো গ্রুপ আছে, সে গ্রুপের দ্বন্দ্বের ফলে এ ঘটনাগুলো ঘটেছে।
এ সময় পাশে বসা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘কুমিল্লার ঘটনায় যে ইকবালকে পাওয়া গেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য না এই কারণেই যে সরকার একবার বলে ইকবাল উন্মাদ, ভবঘুরে, পাগল। আসলে ইকবাল যতটা না পাগল, তার চেয়ে বেশি পাগল হলো সরকার। পাগল দিয়ে যদি এমন একটা দুর্ঘটনাকে এড়িয়ে যায়, বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর চাপিয়ে পার পাওয়া যায়, তারা সে চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সে পাগলামিটা তো বিশ্বাসযোগ্য না।’
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কৌশল কী, জানতে চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এবার আমরা নির্বাচন নিয়ে চিন্তাই করছি না, এটা পরিষ্কার। আমরা এ সরকারের পতন চাই। সরকারকে যেতেই হবে এবং যাওয়ার পরে একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করে একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে, এটাই চূড়ান্ত।’