যেকোনো পটপরিবর্তনে থাকতে চায় জাপা

জি এম কাদের
ছবি: প্রথম আলো

এরশাদ-পরবর্তী জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনৈতিক চরিত্র কী রূপ নেবে, শক্তি-সামর্থ্যে দলটির অবস্থানই–বা কেমন হবে—এমন কিছু প্রশ্নে কৌতূহলী দৃষ্টি রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি খুব বদলায়নি। অভ্যন্তরীণ ঝড়–ঝাপটার পর দলে জি এম কাদেরের নেতৃত্ব অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইদানীং নেতাদের কথাবার্তায়ও ধার বেড়েছে।

জাপার উচ্চপর্যায়ের নেতারা বলছেন, তাঁরা যে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল, সে​টি মাথায় রেখেই মাঠে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চান। কিন্তু নানা বাধায় তা হয়ে উঠছে না। এরশাদের অবর্তমানে এখন তাঁদের দৃষ্টি সারা দেশে নতুন করে দল গোছানোর দিকে। পাশাপাশি বক্তৃতা-বিবৃতিতে চারপাশের বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও এতে সরকারি মহলে কী প্রতিক্রিয়া হয়, সে ব্যাপারেও তাঁদের সতর্ক থাকতে হচ্ছে।

জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি। আর দেখালেও আমাদের যেটা কাজ, সেটা তো করতে হবে। এটা আপস করার বিষয় নয়, হয়তো কৌশলের বিষয় থাকতে পারে।’

চলতি মাসেই জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেন। তিনি বলেছেন, দেশে আইনের শাসন নেই। সুশাসনের অভাবেই খুন, ধর্ষণ এবং অনাচার-অবিচার বেড়ে গেছে।

এ ছাড়া সরকারের উন্নয়ন বিষয়েও জাপার আলাদা পর্যবেক্ষণ আছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের অভিমত হচ্ছে, রাস্তাঘাট, সেতু বা বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ অবশ্যই উন্নয়ন। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। এখনো মানুষ দারিদ্র্য, বৈষম্য, দলবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস থেকে মুক্তি পায়নি।

জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উপলব্ধি করছি, একটা রাজনৈতিক দলকে জনগণের পক্ষে কথা বলতেই হবে এবং এর মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। নইলে আমরা কাকে নিয়ে রাজনীতি করব।’

যদিও জাতীয় সংসদে ও সংসদীয় কমিটিতে এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে কার্যকর ভূমিকায় দেখা যায়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা সরকারি দলের পক্ষেই থাকছে। বিষয়টি এমন যে দশম ও একাদশ সংসদে কাগজে–কলমে বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা দেখা যাবে। কিন্তু আদতে এই সংসদ ছিল সমঝোতার।

সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি। আর দেখালেও আমাদের যেটা কাজ, সেটা তো করতে হবে। এটা আপস করার বিষয় নয়, হয়তো কৌশলের বিষয় থাকতে পারে।
জি এম কাদের

সংসদের কার্যক্রম নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ নামে সময় সময় গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জাতীয় পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দশম সংসদে জাতীয় পার্টি আত্মপরিচয়ের সংকটে ছিল। তারা একসঙ্গে সরকারেও ছিল, আবার বিরোধী দলেও ছিল। বর্তমান সংসদে তারা আনুষ্ঠানিকতার বিরোধী দল। কারণ, তারা নিজেরাও জানত না, তাদের বিরোধী দলে বসতে হবে। তবে এই দুই সংসদে অকার্যকর বিরোধী দলের যে বিড়ম্বনা, সেটি কাটানো গেছে। কিন্তু বিষয়টি এমন যে মাথাব্যথা বন্ধ করতে মাথা কেটে ফেলার মতো।

জাপার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তিন বছর পর ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন হবে, সেটি আর ২০১৪ বা ২০১৮ সালের আদলে হবে না। তাই এখন থেকেই দলের সব পরিকল্পনা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং আগামী সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক। এ ছাড়া জাপা এখন জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল। এই অবস্থান ধরে রাখতে কৌশলী ভূমিকা থাকার পাশাপাশি যেকোনো পটপরিবর্তনে দলকে সম্পৃক্ত রাখার বিষয়েও নীতিনির্ধারকেরা সতর্ক রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনীতিতে বিরোধী দল হিসেবে পরিচয় ধরে রাখার ক্ষেত্রে জাপার জন্য বড় বাধা বিএনপি। সে কারণে সরকারি দলের মিত্রশক্তি হয়েও বক্তৃতা-বিবৃতিতে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা প্রদর্শন করতে হয়। পাশাপাশি বিএনপির বিরুদ্ধেও বলতে হয়। জি এম কাদের গত বুধবার দলের এক মতবিনিময় সভায় মন্তব্য করেন, বিএনপির আপসহীন নেত্রী আপস করেই জেল থেকে বের হয়েছেন। তাঁদের আরেক নেতার (তারেক রহমান) প্রতি বিএনপির নেতা-কর্মীদেরই আস্থা নেই। এসব কথাবার্তার মাধ্যমে জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব এমন ধারণা দিতে চাইছেন যে হতাশা ও নেতৃত্বশূন্যতায় বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ​ নেই। এরশাদও জীবিত থাকাকালে বিএনপিকে নিয়ে এ রকম নেতিবাচক মন্তব্য করতেন।

রওশন চুপচাপ

এরশাদের মৃত্যুর পরপরই দলের নেতৃত্ব নিয়ে তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ভাই জি এম কাদেরকে কেন্দ্র করে দলটিতে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছিল। সেটা এখন আর দৃশ্যমান নেই। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় রওশন এরশাদও এখন দলের সবকিছুতে মাথা ঘামান না। তিনি ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদকে দলে ভালো পদে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরে সন্তুষ্ট বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। রংপুরে এরশাদের আসন থেকে সাংসদ হয়ে সাদ এরশাদ দলের যুগ্ম মহাসচিব পদে আছেন।

সাদ এরশাদ প্রথম আলোকে বলেন, দল খারাপ চলছে না। চাচার সঙ্গেও (জিএম কাদের) কথাবার্তা হয়। তিনি দলের প্রয়োজনে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছেন।

‘এখন দল সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। নেতৃত্বে কোনো কোন্দল নেই।’
জি এম কাদের

দলীয় সূত্র জানায়, এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তি নিয়ে জি এম কাদেরের সঙ্গে রওশনের যে মতবিরোধ হয়েছিল, তাতে আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ কয়েকজন র​ওশন এরশাদের পক্ষ নিয়েছিলেন। সেটা পরে আত্মীয়তার সূত্রে জিয়াউদ্দিন আহমেদের মধ্যস্থতায় মিটমাট হয়। আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে দলের সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান করা হয়। পরবর্তী সময়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদের মহাসচিব হওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারি মহলের সায় নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বরাবরই এ দুজন জাপার নীতি-কৌশল গ্রহণে কলকাঠি নাড়েন বলে আলোচনা আছে। এখন দল পরিচালনায় জ্যেষ্ঠ নেতাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। যদিও দলের সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা চুপচাপ আছেন।

তবে জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন দল সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। নেতৃত্বে কোনো কোন্দল নেই।’

জাপার নেতারা বলছেন, নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন এমন অনেককে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বনানী কার্যালয়ের কিছু পুরোনো কর্মীও বাদ পড়েছেন। এখন শীর্ষ নেতৃত্বের মনোযোগ মাঠপর্যায়ে সংগঠন গোছানোর দিকে। এ লক্ষ্যে দলের আটজন অতিরিক্ত মহাসচিবের নেতৃত্বে আটটি সাংগঠনিক দল গঠন করে সফর শুরু করেছেন। জাপার সাংগঠনিক জেলা ৭৭টি। এগুলোর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে ৪৬টিতে। বাকিগুলো আহ্বায়ক কমিটি। মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলাগুলো সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করা হচ্ছে।