পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেবে ইসলামি দলগুলো

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটে থাকা ইসলামি দলগুলো যার যার মতো করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে দুই জোটের বাইরে থাকা কয়েকটি দলের ভূমিকা কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তারা পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেবে। আর এখনো নীরব হেফাজতে ইসলামসহ আলোচিত ধর্মভিত্তিক কয়েকটি ইসলামি দল ও সংগঠন।

গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইসলামি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি আরও বেড়েছে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোটসহ কিছু দলের ওপর সরকারের চাপ ও নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার খড়্গ ঝুলছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে সরকার হেফাজতে ইসলামসহ কওমি আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান বদল হতে পারে।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনে প্রভাব রাখতে পারে—দুই জোটের বাইরে থাকা এমন কয়েকটি দল ও সংগঠন রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি বুঝে তারা আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ নির্বাচনের ব্যাপারে একটা অবস্থান নিতে পারে।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ। এবার এই তিন দলের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও নতুন পরিস্থিতি বিএনপির জন্য প্রতিকূল হতে পারে। অতীতে ইসলামি দলগুলোর বড় একটি অংশ নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে সক্রিয় থাকত। এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন।

ইসলামী ঐক্যজোট (নেজামী-ফয়জুল্লাহ) একা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির জন্য নতুন ভাবনার কারণ হয়েছে জামায়াত। তারা এই প্রথম জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সিলেটে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে। এ নিয়ে দুই পক্ষে বিরোধ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত যেতে পারে বলে বিএনপির নেতাদের অনেকে আশঙ্কা করছেন।

হেফাজতে ইসলামসহ কওমিপন্থীরা মোটাদাগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে বিভক্ত। এরই মধ্যে একাধিক ইসলামি দল বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তারা দলীয় প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ না থাকায় স্বতন্ত্রভাবে অংশ নেবে। আবার নারী নেতৃত্ব এড়িয়ে চলা চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও এবার এককভাবে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অবশ্য ইসলামি দলগুলোতে বিভক্তি ও অনেকের জোট ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের হিসাব-নিকাশ একেক সময় একেক রকম হয়। এক দিকে কমলে আরেক দিকে বাড়বে।

হেফাজতের ভূমিকা কী হবে
২০১৩ সালের ৫ মে উত্থান ঘটা হেফাজতে ইসলামকেও নির্বাচনী শক্তি হিসেবে দেখা হয়। নির্বাচনে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলোচিত এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় অবস্থান কী হয়, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের আগ্রহ আছে। যদিও একসময় হেফাজতের প্রকাশ্য অবস্থান ছিল বিএনপির পক্ষে। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে শাপলা চত্বর থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী, তাঁর ছেলে আনাস মাদানিসহ সংগঠনের একটি অংশের সঙ্গে সরকারের সখ্য গড়ে উঠেছে। তবে সংগঠনের আরেকটি অংশ তা পছন্দ করছে না। তারা আপাতত চুপচাপ আছে। অনুকূল পরিবেশ পেলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, এমন আলোচনা আছে।

তবে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। হেফাজত কাউকে ক্ষমতায় বসাবেও না, নামাবেও না। তবে বাংলাদেশ বৃহত্তম একটি মুসলিম দেশ। এ দেশে মুসলমানরা যেন স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালন করতে পারে, এমন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের নির্বাচিত করতে আমরা মেসেজ (বার্তা) দেব।’

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, হেফাজতের একটি অংশ যে সরকারের প্রতি বিরূপ, তা সরকারও জানে। কিন্তু সরকারের কৌশল হচ্ছে, নির্বাচনে হেফাজতকে বিএনপি থেকে দূরে রাখা এবং তাদের নিষ্ক্রিয় রাখা। এটা করা গেলেই নিজেদের সফল ভাববেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।

নিবন্ধিত ১০টি দলের কারা কোন দিকে
নির্বাচন কমিশনে এখন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০। এর মধ্যে ইসলামি বা ইসলামপন্থী দল ১০টি। দলগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট (নেজামী-ফয়জুল্লাহ), বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন (নজিবুল বশর), খেলাফত মজলিস (ইসহাক), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (হাবিবুর রহমান), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আতাউর রহমান), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), জাকের পার্টি (মোস্তফা আমীর) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (মোমেন)।

এর মধ্যে তরীকত ফেডারেশন ও ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ সরাসরি আওয়ামী লীগ এবং খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে আছে। ইসলামী ঐক্যজোট (নেজামী), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস আগে বিএনপির সঙ্গে ছিল। বর্তমানে তারা স্বতন্ত্র অবস্থান নিলেও বিভিন্ন সময়ে এ দল দুটির শীর্ষ নেতাদের অনেক বক্তব্য-বিবৃতি বিএনপির বিপক্ষে গেছে।

একইভাবে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও জাকের পার্টির অবস্থান সরকারের জন্য সহায়ক। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান) আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কারণ, তাতে বাদ সেধেছে তরীকত ফেডারেশন। ব্যর্থ হয়ে ইসলামী ফ্রন্ট এরশাদের নেতৃত্বাধীন ‘সম্মিলিত জাতীয় জোটে’ যোগ দিয়েছে। এই জোট গঠনের আগে এরশাদ ৩৪টি নামসর্বস্ব ইসলামপন্থী সংগঠনকে নিয়ে ‘জাতীয় ইসলামী মহাজোট’ করেন।

জানা গেছে, নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরীকত ফেডারেশনে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। দুই সাংসদ নিয়ে দলটি সরকারের সঙ্গে আছে। সম্প্রতি দলের মহাসচিব ও সাংসদ এম এ আউয়ালকে আকস্মিক অব্যাহতি দেওয়ায় তরীকতে এই বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। আউয়ালকে অব্যাহতি দেওয়ার পেছনে তাঁর নির্বাচনী এলাকা লক্ষ্মীপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের একজন ধনবান প্রার্থীর কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে।

বিভক্তির বিষয়ে এম এ আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তরীকত ফেডারেশনের অনেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। নতুন দল, না জোট করে নির্বাচন করব, ঠিক হয়নি। আলোচনা চলছে, সময় হলে জানাব।’

এ ছাড়া নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন—এই দল তিনটি গত দুই বছরে ভেঙে ছয়টি হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোটের মূল অংশটি বিএনপির জোট ছেড়ে গেলেও আবদুর রকিবের নেতৃত্বে খণ্ডিত একটি অংশ ২০ দলে থেকে গেছে। আর ভেঙে যাওয়া জমিয়তের দুটি অংশই এখনো ২০ দলে আছে। এ ছাড়া জাফরুল্লাহ খানের নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলনের ভগ্নাংশটি এখনো পরিষ্কার অবস্থান নেয়নি।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাদ্দারি না করলে কোনো আলেম বিএনপির সঙ্গে থাকার কথা নয়। কারণ, বিএনপি দীর্ঘদিন আলেমদের সামনে কওমি মাদ্রাসাশিক্ষার সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার মুলা ঝুলিয়ে ছিল। আওয়ামী লীগ সে দাবি পূরণ করেছে। এর সুফলও তারা পেতে শুরু করেছে। তা ছাড়া, কওমি আলেমরা জামায়াতকে পছন্দ করেন না। সব মিলিয়ে এবার ইসলামপন্থীদের ভূমিকা আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে বলে মনে করি।’

অবশ্য কওমি আলেমরা বরাবরই আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয় ছিল বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ভূঁইয়া মনোয়ার কবীর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন মাদ্রাসায় জঙ্গি খুঁজতে শুরু করল, তখন দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এখন আওয়ামী লীগ আবার নানাভাবে আস্থা ফিরিয়ে এনেছে।