লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের অবস্থান, প্রশাসনের মামলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে গতকাল সকাল থেকেই স্টাম্প, লাঠিসোঁটা বস্তায় ভরে মোটরসাইকেলে শোডাউন করেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায়
ছবি: সাজিদ হোসেন

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে আসতে পারেন, এমন ধারণা থেকে গতকাল বুধবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানে ছিল ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসের মধুর ক্যানটিন, টিএসসি ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় স্টাম্প, কাঠ ও লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। ছিল মোটরসাইকেলের ‘শোডাউনও’।

গতকাল সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান করা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ছাত্রদল বা ছাত্রদলের সমর্থক বলে কাউকে সন্দেহ হলে আটকে জেরা ও মারধর করছিলেন। এমনকি চলন্ত রিকশা আটকে ‘সন্দেহজনক’ ব্যক্তিদের জেরা ও মারধর করেন তাঁরা। তবে যাঁদের জন্য ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের এত প্রস্তুতি, সেই ছাত্রদল গতকাল ক্যাম্পাসে যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে মঙ্গলবার সকালে ছাত্রদলের একটি সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। মিছিল নিয়ে সেখানে যাওয়ার পথে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে তাঁদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। হামলায় সংগঠনটির অন্তত ৩০ নেতা-কর্মী আহত হন। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের সামনে ও দোয়েল চত্বরে ছাত্রলীগকে ধাওয়া দেয় ছাত্রদল। পরে ছাত্রলীগ পাল্টা ধাওয়া দিলে ছাত্রদল ক্যাম্পাস ত্যাগ করে।

এদিকে মঙ্গলবারের ধাওয়া-সংঘর্ষের ঘটনায় সেদিন রাতেই রাজধানীর শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এস্টেট কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বাদী হয়ে অভিযোগটি করেছেন। অভিযোগটি পুলিশ মামলা হিসেবে গ্রহণ করেছে। সরকারি কাজে বাধা, সরকারি কর্মচারীকে মারধর, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ভাঙচুর ও ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলার অভিযোগে করা এই মামলায় ৩০০-৪০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া মঙ্গলবার আটক তিনজনের মধ্যে ছাত্রদলের দুজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের করা মামলায় গতকাল আদালতে পাঠানো হয়। অভিযোগের সঙ্গে আটক অন্য ব্যক্তির কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তাঁকে তাঁর অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।

মামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা করা হয়েছে। সেদিন কার্জন হলের একজন নিরাপত্তাকর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে, বাইরে থেকে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার ঘটনা ঘটেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়া করা বিআরটিসির দুটি বাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পাওয়ার স্টেশন ভাঙচুর করা হয়েছে। এই চারটি অভিযোগে শাহবাগ থানায় মামলা করেছি।’

ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করার জন্যই মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে, এমন দাবি করেছেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আকতার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ধারালো ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছাত্রদলের ওপর হামলা করেছেন, তাঁরাই জানমালের ক্ষতিসাধন করেছেন। এর সুস্পষ্ট দালিলিক প্রমাণ সামনে থাকার পরও অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করার জন্য। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ আসলে একই।’

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা মামলায় ছাত্রদলের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দেখতে চান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ যারা বিনষ্ট করতে চায়, সেই সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রদলের সবার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়ার দায়বদ্ধতা রয়েছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেদিন (মঙ্গলবার) সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ফলে অভিযোগের সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

‘ছবি-ভিডিও থাকলেও গ্রেপ্তার নেই’

মঙ্গলবারের ধাওয়া-সংঘর্ষের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিমধ্যে বেরিয়েছে। তবে ধাওয়া-সংঘর্ষের ঘটনার ছবি-ভিডিওতে মারমুখী অবস্থায় থাকা কাউকে গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। গতকাল পর্যন্ত ছবি-ভিডিও বিশ্লেষণ করে দোষীদের চিহ্নিত করার কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা উদ্‌ঘাটন ও দোষীদের চিহ্নিত করার কাজটি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে অনুরোধ করেছি। কোনো অপরাধের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কেউ জড়িত থাকলে প্রচলিত আইনে যেমন বিচার হবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ব্যবস্থা নেবে।’

শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার বলেন, তাঁরা তদন্ত শুরু করেছেন। দোষীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।

‘আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি ছাত্রদল’

এদিকে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হামলার অভিযোগ করলেও মঙ্গলবারের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি ছাত্রদল। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছেও তারা কোনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি।

ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রাকিবুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের শাসনামলে বিচারব্যবস্থার ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারছি না। তাই মঙ্গলবারের হামলার ঘটনায় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে থাকা শিক্ষকদের আমরা মৌখিকভাবে হামলার বিষয়টি জানিয়েছি। যদিও লিখিত আকারে অভিযোগ দেওয়া হয়নি। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়া চলছে। এ কারণে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। মূলত সে কারণেই লিখিত অভিযোগ দিতে দেরি হচ্ছে।’

রাকিবুলের অভিযোগের জবাবে ছাত্রলীগের নেতা সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘স্লোগান-মিছিল ও লেখাপড়াকে যদি ছাত্রদল অস্ত্র মনে করে, তাহলে আমরা বলব যে এগুলো আমাদের অস্ত্রই।’

রাবিতে মামলা করবে না ছাত্রদল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলার ঘটনায় মামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি। ছাত্রদলের নেতারা বলছেন, মামলা করলে এ ঘটনার কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না। উল্টো আরও হামলার আশঙ্কা থাকে।

সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বৃদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের পেছনে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালান ছাত্রলীগের ১০-১২ জন নেতা–কর্মী। এতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ তাহের রহমানসহ কয়েকজন আহত হন। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ওই দিন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ছাত্রদল। পদ্মা সেতু ইস্যুতে খালেদা জিয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে ওই কর্মসূচি দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ বলেন, এর আগে দলীয়ভাবে অনেক মামলা হয়েছে, সেগুলোর কোনো বিচার হয়নি। তাঁরা মামলা করবেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই একদিন বিচার করবে।

সিলেটে ধারালো অস্ত্র নিয়ে মহড়া, শনাক্ত হয়নি কেউ

সিলেটে প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মহড়া দিলেও গত তিন দিনে কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় থানায় মামলাও হয়নি।

সোমবার বিকেলে নগরের চৌহাট্টায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র, রড, পাইপ ও লাঠি নিয়ে মহড়া দেওয়ার অভিযোগ করেছেন ছাত্রদলের নেতারা। এ ঘটনায় ধারালো অস্ত্র হাতে থাকা একজনের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

সিলেট মহানগরের কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ দাবি করেন, ওই দিন পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় ধারালো অস্ত্র হাতে কাউকে মহড়া দিতে দেখা যায়নি। তাই পুলিশ মামলা করেনি। ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রদলের পক্ষ থেকেও কোনো মামলা হয়নি।

সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ধারালো অস্ত্র হাতে থাকা যুবকের ছবিটি দেখেছি, তবে ওই যুবক কে, সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।’

ছাত্রদল সিলেট মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী এহসান বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র হাতে সেদিন মহড়া দিয়েছেন। উল্টো এখন তাঁরা ছাত্রদলকে দোষারোপ করতে চাইছেন। ছাত্রলীগই ধারালো অস্ত্রসহ লাঠিসোঁটা নিয়ে অতর্কিতে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেছেন।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ও প্রতিনিধি, রাজশাহী]