কীভাবে আরম্ভ থেকে [ফের] শুরু করতে হয়

১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেনিন যখন তাঁর ক্ষুদ্র, অসামান্য রচনা ‘নোটস অব এ পাবলিসিস্ট’ লিখছেন, তখন বলশেভিকেরা কিম্ভূত সব ব্যাপার ডিঙিয়ে গৃহযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর কিছুটা পিছু হটে নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যেখানে বাজার অর্থনীতি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্য অনেক বেশি সুযোগ রাখা হয়েছে। এই রচনায় লেনিন একজন পর্বতারোহীর সাদৃশ্য টেনেছেন, যিনি নতুন পর্বতের শীর্ষে উঠতে আপাতত কিছুটা পিছু হটছেন। এই সাদৃশ্য টানার পেছনে লেনিনের উদ্দেশ্য, বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় পিছু হটার অর্থ কী এবং কীভাবে সেটা মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে ধান্ধাবাজি ধরনের গাদ্দারি না করে বাস্তবায়ন সম্ভব, সেটা বোঝানো:

আসুন এমন একজন লোকের কল্পনা করি যিনি খুবই উঁচু ও খাড়া এবং এখন অবধি অজেয় পর্বত বেয়ে ওপরে উঠছেন। ধরা যাক, তিনি যেসব বিপদ ও সমস্যা উতরে গেছেন তা নজিরবিহীন এবং ইতিমধ্যে এত দূর অবধি পৌঁছেছেন, যার কাছেধারে তাঁর আগে অন্য কেউ পৌঁছাতেই পারেননি; তবে কিনা এখনো তিনি শিখরে উঠতে পারেননি। তিনি আবিষ্কার করলেন, যেখানে তিনি পৌঁছেছেন, সেখান থেকে যে পথ তিনি মনে মনে ঠিক করেছিলেন, সে পথ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া কেবল দুর্গম আর বিপদসংকুলই নয়, বরং সদর্থেই অসম্ভব।

এই যখন পরিস্থিতি, লেনিন লিখছেন:

তিনি নিজের মধ্যে প্রবল তাড়না টের পেলেন পিছু হটার, নেমে গিয়ে অন্য কোনো রাস্তা খোঁজার, সে পথ হয়তো কিছু দীর্ঘ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে শিখর অবধি টেনে নিতে সক্ষম। অতটা উচ্চতা থেকে নেমে আসা—যদ্দুর কেউ কোনো দিন পৌঁছাতে পারেনি—সম্ভবত আমাদের এই কল্পিত পর্যটকের জন্য ওপরে ওঠার থেকেও কঠিন এবং বিপদসংকুল—এখন তো পিছলে পড়া আরও সহজ; পা রাখার জায়গা নির্বাচন করা খুব সোজা নয়; আর বিমলানন্দও তেমন নেই, একেবারে লক্ষ্যভেদীভাবে ওপরে ওঠার সময় যেমন আমাদের হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁকে তো দড়িদড়া দিয়ে নিজেকে বেঁধে রাখতে হবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতে হবে লোহার আঁকশি দিয়ে একটু পা রাখার জায়গা করে নেওয়ার জন্য, নয়তো তালাশ করতে হবে একটা অবলম্বন, যেখানে জুতমতো দড়িটি আটকে নেওয়া যাবে; তাঁকে এগোতে হবে শম্বুকগতিতে, আর নামতে হবে নিচে, নিজের লক্ষ্য থেকে ক্রমান্বয়ে নেমে যাওয়া; এবং তিনি জানেন না কোথায় এই চরম বিপজ্জনক ও বেদনাবিধুর অবতরণ শেষ হবে, অথবা আদৌ শিখরে ওঠার আরও জোরালো, দ্রুততর আর সরাসরি কোনো নিরাপদ বিকল্প পথ রয়েছে কি না।

কোনো পর্বতারোহী যিনি নিজেকে আবিষ্কার করেছেন এ রকম এক পরিস্থিতিতে, তাঁর জন্য যে মনোভাব স্বাভাবিক, সেটা হলো ‘নৈরাশ্যের মুহূর্ত’। সব ধরনের সম্ভাবনাতেই এসব মুহূর্ত আরও বিপুল এবং অসাধ্য হবে যদি তাঁকে শুনতে হয় তাদের কণ্ঠস্বর, যারা ‘নিচে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে টেলিস্কোপ ফিট করে তাঁর এই বিপদসংকুল অবতরণ চাক্ষুষ করছে’: নিচের কণ্ঠস্বরগুলো বিদ্বেষের আনন্দে রিনরিন বেজে উঠছে। তারা এটা গোপন করছে না; উল্লাসে মুখ টিপে হাসছে আর চেঁচাচ্ছে: ‘দেখো, আর একটু বাদেই সে পপাতধরণিতল! উচিত শিক্ষা হবে, বোকার হদ্দটার!’ আরেক দল তাদের বিদ্বেষে পরিপূর্ণ উল্লাস গোপন করার চেষ্টা করছে, তাদের ভাবভঙ্গি ‘ঠিক জুডাস গোলোভলোভের মতো’, যার কথা সালতিকভ-শেডরিনের উপন্যাস দি গোলোভলোভ ফ্যামিলির মধ্যে আছে:

তারা বিলাপ করছে এবং তাদের শোকে মুহ্যমান আঁখিতারা চেয়ে আছে আকাশপানে যেন তারা বলছে: ‘আমাদের ভয়টাই সত্যি হচ্ছে দেখে আমাদের শোকের আর অবধি নাই! কিন্তু আমরা যারা আমাদের যাবজ্জীবন ব্যয় করে ফেলেছি ওই পর্বতে ওঠার একটা বিচক্ষণ ফন্দি আঁটতে, তারা কি তখন বলিনি আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়া অবধি ওই সব আরোহণ-টারোহণ মুলতবি রাখতে? যদি আমরা ওই পথ ধরে যাওয়ার ব্যাপারে অমন খ্যাপার মতো প্রতিবাদ করে থাকি, যে পথে এই বোকার হদ্দ এখন ক্ষান্তি দিচ্ছে (দেখ, দেখ, এইমাত্র সে ঘুরে দাঁড়াল! এই তো সে নেমে আসছে! একটা ছোট্ট পদক্ষেপের জন্য তাঁকে কয়েক ঘণ্টার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে! যখন সময় ছিল তখনো আমাদের সোজাসুজি গালমন্দ খেতে হয়েছে কারণ আমরা সংযত হওয়ার কথা বলেছিলাম, সতর্ক করেছিলাম!), যদি আমরা এই হদ্দটাকে অমন তপ্তভাবে তিরস্কার করে থাকি, এবং তার অনুবর্তী এবং সহযোগী না হওয়ার ব্যাপারে সবাইকে সাবধান করে থাকি, আমরা তেমন করেছিলাম শুধু পর্বতে ওঠার একটি নিখুঁত পরিকল্পনার জন্য আমাদের অনুরাগ থেকেই, এবং এই মহাপরিকল্পনাকে সাধারণভাবে কলংকিত হওয়ার হাত থেকে রেহাই দিতে!’

সুখের বিষয় হলো, লেনিন জানাচ্ছেন, ‘আমাদের কাল্পনিক পর্যটক তাদের স্বর শুনতে পান না, যারা আরোহণ ব্যাপারটার “প্রকৃত বন্ধু”; যদি তিনি শুনতে পেতেন, তাহলে তারা হয়তো তাঁর মধ্যে বিবমিষা জাগিয়ে তুলত’—‘আর বিবমিষা, যেমনটি বলা হয়, কাউকে পদক্ষেপ দৃঢ় এবং মাথা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে না, বিশেষ করে কেউ যখন পাহাড়ের উঁচুতে থাকে।’

নিশ্চয়ই একটি রূপক কখনোই প্রমাণের সমান মর্যাদা পায় না: ‘যেকোনো সাদৃশ্যই আসলে পঙ্গু’। নবীন সোভিয়েত রিপাবলিক যে প্রকৃত পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, লেনিন আসলে তা-ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন:

রাশিয়ার প্রলেতারিয়েতরা বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকাণ্ড উচ্চতায় উঠে গেছে, সেটা কেবল ১৭৮৯ ও ১৭৯৩-এর তুলনায় প্রকাণ্ড নয়, যখন ১৮৭১-এর সঙ্গে তুলনা করা হয় সে ক্ষেত্রেও। আমাদের এখন অবশ্যই নিরাসক্তভাবে যাচাই করতে হবে, আমরা কী করেছি এবং কী করতে পারিনি—এ ক্ষেত্রে আমাদের যথাসম্ভব স্বচ্ছ এবং সুনির্দিষ্ট হতে হবে। যদি আমরা সেটা করতে পারি তবেই কেবল মাথা ঠান্ডা রাখা সম্ভব। আমাদের বিবমিষা, বিভ্রম অথবা হতাশায় ভোগা ঠিক হবে না।

১৯২২ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রের অর্জনগুলো একে একে বলে শেষ করে, লেনিন যেসব কাজ এখনো করা হয়নি সেগুলোর ফিরিস্তি দিচ্ছেন:

কিন্তু এখনো অবধি আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল ভিত্তিগুলো পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, আর মুমূর্ষু পুঁজিবাদের বিদ্বেষী শক্তি এখনো সেটা থেকে আমাদের বঞ্চিত রাখতে পারে। আমাদের অবশ্যই এটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে এবং খোলাখুলি স্বীকার করতে হবে; কারণ বিভ্রম থেকে ভয়ংকর কিছু নেই (এবং ভার্টিগো থেকে, বিশেষ করে উচ্চ অবস্থানে থাকলে)। আর এই তিক্ত সত্যটাকে কবুল করে নেওয়ার মধ্যে—চরম অর্থেই—ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ন্যূনতম হতাশার গোড়ায় বৈধ ভিত্তি দিতে পারে এমন কিছুই এখানে নেই; কারণ সব সময় আমরা সনির্বন্ধভাবে মার্ক্সবাদের এই প্রাথমিক সত্য পুনরাবৃত্তি করে এসেছি, সমাজতন্ত্রের বিজয়ের জন্য দরকার বেশ কয়েকটি প্রাগ্রসর দেশের শ্রমিকদের যৌথ শক্তিপ্রয়োগ। এখন পর্যন্ত একটা পশ্চাত্পদ দেশে আমরা একা, যে দেশ অন্যদের থেকে অনেক বেশি বিনষ্টির শিকার হয়েছে, কিন্তু আমরাই একটি মহান কাজ সিদ্ধ করেছি।

আরও বলতে গেলে, লেনিন লিখছেন, ‘বিপ্লবী প্রলেতারীয় ফৌজের সেনাদের আমরা অক্ষতভাবে সঞ্চিত রেখেছি; আমরা মজুদ রেখেছি এর কৌশলী পরিচালনার সামর্থ্য; আমাদের মাথা ঠান্ডা রেখেছি এবং আমরা ধীরস্থিরভাবে হিসাব করতে পারি কোথায়, কখন, কত দূর পর্যন্ত আমাদের পিছু হটতে হবে (সামনের দিকে একটা জোরে লাফ দেওয়ার প্রয়োজনে); যে কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে সেটার ধরন কোথায়, কখন, কীভাবে বদলে নিতে হবে।’ তিনি উপসংহার টানছেন:

সেসব কমিউনিস্ট ধ্বংস হয়ে গেছেন যাঁরা মনে করেছেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তোলার মতো নবযুগ সৃষ্টিকারী উদ্যোগ (বিশেষত যে-দেশে ক্ষুদ্র-কৃষকের সংখ্যা বেশি)—ভুল না করে, পিছু না হটে, যে কাজ অসমাপ্ত অথবা ভুলভাবে সম্পন্ন, সেখানে বেশুমার বদল না ঘটিয়ে কেউ বাস্তবায়ন করে ফেলতে পারে। আর যেসব কমিউনিস্ট বিভ্রমের কুহকে পড়েননি, যাঁরা হতাশার দুয়ারে মাথা কোটেননি, যাঁরা তাঁদের সামর্থ্য এবং নমনীয়তা মজুদ রেখেছেন চূড়ান্ত কঠিন একটি কাজ সম্পাদনে বারংবার ‘আরম্ভ থেকে [ফের] শুরু করার জন্য’—তাঁদের ধ্বংস নেই (এবং কিছুতেই তাঁরা লোপ পাবেন না)।

ভালোভাবে  পিছু  হটা

লেনিনকে সবচেয়ে ভালোভাবে বেকেটীয় বলে শনাক্ত করার পূর্বাভাস আছে ওয়ারস্টওয়ার্ড হোর* এই লাইনে: ‘আবার চেষ্টা করো, ব্যর্থ হও পুনর্বার, ব্যর্থতায় আরও ভালোভাবে পিছু হটতে শেখো।’ লেনিনের উপসংহার—আরম্ভ থেকে শুরু করা—এটা সুস্পষ্ট করে যে তিনি নিছক ধীরে চলো নীতি বা ইতিমধ্যেই যা অর্জিত হয়েছে তাকে পোক্ত করার কথা বলছেন না, তিনি আসলে বলছেন একেবারে শুরুর বিন্দুতে নেমে আসার কথা: শুরু করতে হবে একেবারে আরম্ভ থেকে, আগের প্রচেষ্টায় যদ্দুর পৌঁছানো গেছে সেখান থেকে নয়। কিয়ের্কেগার্দের ভাষায় বলতে গেলে, বিপ্লবী প্রক্রিয়া কোনো ক্রমানুমিক বিকাশ নয়, এটি একটি পুনরাবৃত্তিমূলক তত্পরতা—বারবার শুরু করার তত্পরতা, বারংবার।

জর্জ লুকাচ তাঁর প্রাক-মার্ক্সীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ থিওরি অব দ্য নভেল শেষ করেছেন এই বিখ্যাত বাক্য দিয়ে: ‘সমুদ্রযাত্রা শেষ হয়েছে, এখন ঘোরাঘুরির আরম্ভ।’ পরাভূত করে দেওয়ার মুহূর্তে এ রকম ঘটে: একটা নির্দিষ্ট বিপ্লবী অভিজ্ঞতার সলিলযাত্রা শেষ হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত যাত্রা, আবার গোড়া থেকে শুরু করার কাজ, মাত্র শুরু হলো। পিছু হটার এই প্রণোদনা যেন কেউ গোঁড়ামিমুক্ত হয়ে অন্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে—এমন আভাস দেয় না মোটেই, এটা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে এ রকম স্বীকারোক্তি নয়, ‘আমাদের ভুল হচ্ছিল, তোমাদের হুঁশিয়ারিই ঠিক ছিল, এখন তোমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের দলে ভারী হতে দাও’। বরং ঠিক তার উল্টো। লেনিন জোর দিয়ে বলছেন, এ রকম মুহূর্তে সব থেকে কড়া শৃঙ্খলা থাকা দরকার। এর কয়েক মাস পর ১৯২২ সালের এপ্রিলে, বলশেভিকদের একাদশ দলীয় অধিবেশনে তিনি যুক্তি দেখাচ্ছেন:

যখন একটি গোটা সেনাবাহিনী (আলংকারিক অর্থে বলছি) পিছু হটছে, তার কেবল ততটুকু মনোবল থাকলেই চলে না, যেমন থাকে আগুয়ান হওয়ার সময়। তখনকার প্রতিটি পদক্ষেপেই আপনি বিষাদের ভাবাবেগ খুঁজে পাবেন...এখানেই নিহিত আছে ভয়ংকর বিপদ; মহান এক বিজয় অর্জনের পর পিছু হটা ভয়াবহ কঠিন কাজ, কারণ সম্পর্কগুলো এখানে আমূল পাল্টে গেছে। বিজয়ের অভিমুখে যাত্রার সময় শৃঙ্খলা একটু ঝিমিয়ে গেলেও প্রত্যেকে নিজস্ব প্রণোদনায় সামনে এগিয়ে যায়। পিছু হটার ক্ষেত্রে কিন্তু শৃঙ্খলা আরও বেশি সজাগ রাখতে হয়, আর সেটা শতগুণ দরকারিও বটে, কারণ, একটা আস্ত সেনাবাহিনী যখন পিছু হটে, সে জানে না বা বুঝতে পারে না কোথায় তাকে থামতে হবে। সে দেখতে পায় শুধু পিছু হটে যাওয়া; এ রকম পরিস্থিতিতে কতিপয় আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরই কখনো কখনো সবকিছু ছত্রভঙ্গ করে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। বিপদ এখানে বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। একটি সত্যিকারের সেনাবাহিনী যখন পিছু হটে, মেশিনগান প্রস্তুত রাখা থাকে, আর যখন একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী পথভ্রষ্ট হয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে, তখন গুলি করার নির্দেশ দেওয়া থাকে, আর সেটা ন্যায্যভাবেই।

এ রকম দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল খুবই স্পষ্ট ছিল লেনিনের কাছে। এনইপি [ন্যাশনাল ইকোনমিক পলিসি] প্রসঙ্গে প্রচারণায় মেনশেভিক এবং সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীদের এই ‘নসিহত’—‘বিপ্লব দূরাগত। এখন আপনারা যা বলছেন সেটা আমরা সব সময় বলে আসছি, সেটা আবার উচ্চারণ করার অনুমতি আমাদের দিতে হবে’—এর জবাবে একাদশ দলীয় সম্মেলনে তিনি বলছেন:

আমরা উত্তরে বলি: যা বলেছেন সে জন্য একটা ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে আপনাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়ার অনুমতি দিন। আপনারা হয় নিজস্ব মতামত প্রকাশ থেকে বিরত থাকুন, নয়তো বর্তমান পরিস্থিতিতে—হোয়াইট গার্ডরা যখন সরাসরি আমাদের আক্রমণ করছিল তার থেকেও আমাদের অবস্থান যখন আরও অনেক বেশি কঠিন—যদি আপনারা জনসমক্ষে আপনাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি খোলাসা করতে বেচইন হয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে যখন আমরা আপনাদের হোয়াইট গার্ডের সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং ক্ষতিকর অংশ বলে বিবেচনা করব, তখন শুধু নিজেদেরই দুষতে হবে।

এসব সত্ত্বেও, এই ‘লাল আতঙ্ক’কে স্টালিনীয় ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবাদ’ থেকে পৃথক করতে হবে। সানদোর মারাই (Sándor Márai) তাঁর স্মৃতিকথায় এই প্রভেদের একটি যথাযথ সংজ্ঞা দিয়েছেন। লেনিনবাদী একনায়কতন্ত্রের সবচেয়ে প্রবল পর্যায় যখন চলছে তখন বিপ্লবের যারা বিরোধিতা করেছে তাদের স্বাধীনভাবে (জনসমক্ষে) কথা বলার অধিকার বর্বরোচিতভাবে হরণ করা হয়েছে, কিন্তু তাদের নীরব থাকার অধিকার অপহূত হয়নি: তারা চাইলে নিজের ভেতরে নির্বাসন নিতে পারত। ১৯২২ সালের শরত্কালের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যখন লেনিনের প্ররোচনায় বলশেভিকরা কুখ্যাত ‘ফিলসফারস স্টিমারে’র বন্দোবস্ত করছিল। তিনি যখন জানলেন, দেশ থেকে বহিষ্কৃত বুদ্ধিজীবীদের তালিকাভুক্ত বুড়ো একজন মেনশেভিক ইতিহাসবিদ গুরুতর অসুস্থতার কারণে নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন—যেন তিনি শান্তিতে মরতে পারেন, লেনিন কেবল তাঁকে তালিকা থেকে বাদ দিলেন তা-ই নয়, তার জন্য অতিরিক্ত খাবার কুপন দেওয়ার আদেশ দিলেন। যখন শত্রু রাজনৈতিক লড়াই থেকে ইস্তফা দেয়, তখনই লেনিনের রাগ-বিদ্বেষ পড়ে যায়।

স্টালিনবাদের ক্ষেত্রে এ রকম নীরবতাও বড্ড আওয়াজ তৈরি করেছে। কেবল আমজনতাকেই তখন নিজেদের সমর্থন প্রমাণ করতে বিরাট পাবলিক র্যালিতে যোগ দিতে হতো, তা-ই নয়, শিল্পী ও বিজ্ঞানীদেরও সরকারি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর, স্টালিন এবং মার্ক্সবাদের সরকারি সংস্করণে মুখে হলেও প্রতিশ্রুতি (paying lip-service) দেওয়ার আপস নিতে হতো। লেনিনীয় একনায়কতন্ত্রে কেউ যদি কিছু বলার অপরাধে খুন হতে পারতেন, তাহলে স্টালিনবাদে কিছু না বলার অপরাধেই খরচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই নিয়ম একেবারে চরম পর্যায় পর্যন্ত অনুসৃত হতো: নীরবতায় ইস্তফা নেওয়ার সবচেয়ে মরিয়া উপায় আত্মহত্যাকে পর্যন্ত স্টালিন পার্টির বিরুদ্ধে সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ বিশ্বাসঘাতকতা বলে নিষিদ্ধ করেছিলেন। লেনিনবাদ ও স্টালিনবাদের মধ্যকার এই পার্থক্যের মধ্যেই সমাজের প্রতি তাদের গড় মনোভাবের প্রতিফলন আছে: প্রথমটির ক্ষেত্রে, সমাজ হচ্ছে ক্ষমতার জন্য এক নিষ্ঠুর লড়াইয়ের ময়দান, যে লড়াই খোলাখুলিভাবে স্বীকৃত; পরেরটির ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্বের নতুন ব্যাখ্যা দাঁড়াল, কখনো কখনো প্রায় বুদ্ধির অগম্যভাবে, একটি স্বাস্থ্যকর সমাজের সঙ্গে যারা পরিত্যক্ত হলো—যেমন দুর্বৃত্ত, কীটতুল্য ও বিশ্বাসঘাতক যারা আসলে অবমানব—তাদের লড়াই।

ক্ষমতার সোভিয়েত পৃথক্করণ?

লেনিন থেকে স্টালিন পর্যন্ত এই নিষ্ক্রমণ (Passage) কি অনিবার্য ছিল? হেগেলীয় ব্যাখ্যায় সেটা আসতে পারে অতীত পর্যালোচনার আবশ্যকতা হিসেবে: একবার যখন এই প্রস্থান ঘটে, স্টালিন যখন একবার জিতে যান, তখন এটা অনিবার্য ছিল। একজন দ্বান্দ্বিক ঐতিহাসিকের কাজ হচ্ছে একে ‘হয়ে ওঠা’র মধ্যে স্থাপিত করা, লড়াইয়ের মধ্যে এমন সব অনিবার্যতা পয়দা করা যা খুবই অন্যভাবেও শেষ হতে পারত, যেমনটি মোশে লুইন তাঁর লেনিনস লাস্ট স্ট্রাগল-এর মধ্যে করার চেষ্টা করেছেন। লুইন প্রথমত আঙুল তুলেছেন যেসব জাতীয় অনুষঙ্গ সোভিয়েত রাষ্ট্র তৈরি করেছে সেগুলোর পূর্ণ সার্বভৌমত্বের ওপর লেনিনের ঝোঁকের দিকে—এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে স্টালিন ১৯২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পলিটব্যুরোর কাছে লেখা চিঠিতে লেনিনকে প্রকাশ্যে ‘জাতীয় উদারনৈতিকতাবাদে’র অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন লেনিনের লক্ষ্যের ব্যাপারে সংযমী থাকার এই ঝোঁকের দিকে: সমাজতন্ত্র নয়, বরং সংস্কৃতি, সর্বজনীন শিক্ষা, দক্ষতা, টেকনোক্রেসি, সমবায় সমিতি— যেগুলো কৃষকদের এনইপির পরিপ্রেক্ষিতে ‘সাংস্কৃতিক বণিক’ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। নিশ্চিতভাবেই এটা ‘এক দেশের সমাজতন্ত্র’ থেকে খুবই আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি। এই পরিমিতি মাঝেমধ্যে আশ্চর্য রকম খোলাখুলি ছিল: লেনিন ‘সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’র সব রকম প্রয়াস নিয়ে মশকরা করেছেন। দলীয় খামতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি পৌনঃপুনিকভাবে পরিহাস করেছেন এবং সোভিয়েত পলিসির উদ্ভাবনী প্রকৃতির ওপর এত দূর জোর দিয়েছেন যে নেপোলিয়নের এই বাক্য উদ্ধৃত করেছেন, ‘On S’engage... Et Puis, On Voit’.’.*

রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লেনিনের অন্তিম লড়াই সবারই জানা কথা; কিন্তু যেটা লোকে অল্পই জানে সেটা হচ্ছে, লুইনের প্রাঞ্জল ভাষায়, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশন নামে একটি নতুন কর্তৃত্বকারী পরিষদের প্রস্তাবের মাধ্যমে লেনিন তাঁর পার্টি-স্টেটের একনায়কতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের বৃত্তকে সামঞ্জস্য বিধানের কোশিশ করছিলেন। সোভিয়েত শাসনের একনায়কসুলভ প্রকৃতি পুরোপুরি স্বীকার করেও তিনি চেষ্টা করছিলেন এর শীর্ষ পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে, ‘পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণের এমন একটি ব্যবস্থা যা ঠিক সেই একই ভূমিকা রাখবে—এই তুলনা অনুমানের থেকে বেশি কিছু নয়—ক্ষমতার পৃথক্করণ যে ভূমিকা রাখে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে।’ একটি পরিবর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটি নীতিনির্ধারণের মোটা দাগগুলো নির্ধারণ করবে এবং পুরো দলের অ্যাপারেটাসকে তত্ত্বাবধান করবে। এই পরিসরের ভেতর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশন:

কেন্দ্রীয় কমিটি এবং এর বিভিন্ন শাখা দপ্তরের—যেমন পলিটিক্যাল ব্যুরো, সচিবালয়, সাংগঠনিক ব্যুরো—নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবে...এর স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে পলিটব্যুরো এবং এর প্রশাসনিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যস্থতা ছাড়াই দলীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে।

নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, ক্ষমতার বিভাজন, পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ—লেনিন এ রকমই বেপরোয়া উত্তর দিয়েছিলেন এই প্রশ্নের: নিয়ন্ত্রণকারীকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশনের এই ধারণার মধ্যে একটা স্বপ্ন-স্বপ্ন, আরও ঠিক হয় যদি বলা যায় অলীকতা আছে: একটি স্বাধীন, শিক্ষিত, ‘অরাজনৈতিক’ ধারবিশিষ্ট নিয়ন্ত্রণ-সংঘ, ‘রাজনৈতিক’ কেন্দ্রীয় কমিটি এবং এর সমস্ত অঙ্গকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা গঠন করা হবে সেরা সব শিক্ষক আর টেকনোক্র্যাটদের নিয়ে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরা দলীয় নির্বাহীদের সুপথে রাখবেন। এর সবকিছুরই কেন্দ্রবিন্দু দাঁড়াচ্ছে দলীয় কংগ্রেসের প্রকৃত স্বাধীনতা—কার্যত যা ইতিমধ্যেই দলাদলি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে, যা পার্টি অ্যাপারেটাসের ওপরতলার নেতাদের কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ এবং সমালোচকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে খারিজ করার পথ করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ওপর ইমান রাখার লেনিনের এই নিরীহ প্রস্তাব আরও বেশি ধন্দ লাগায় যখন আমরা মনে রাখি, এ কথা শোনা যাচ্ছে এমন এক নেতার মুখে যিনি অন্যত্র রাজনৈতিক সংগ্রামের সর্বপরিব্যাপ্ত চরিত্রের ব্যাপারে পুরো হুঁশিয়ার ছিলেন, যেখানে কোনো নিরপেক্ষ অবস্থানের জায়গা থাকে না।

হাওয়া কোন দিকে বইছিল সেটা প্রতীয়মান হয় ১৯২২ সালে স্টালিনের এই প্রস্তাবনায় যেখানে সরাসরি রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের সরকারকে রিপাবলিক অব ইউক্রেন, বেলারুশ, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার সরকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে:

এই সিদ্ধান্ত যদি আরসিপির [রাশান কমিউনিস্ট পার্টি] কেন্দ্রীয় কমিটি দ্বারা অনুমোদিত হয়, সেটা সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হবে না, বরং প্রজাতন্ত্রগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো হবে, যাতে তারা সর্বরাশান কংগ্রেস সম্মেলন শুরুর আগেই এই সিদ্ধান্ত সোভিয়েত অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি বা কথিত প্রজাতন্ত্রের সোভিয়েতগুলোর কংগ্রেসে জানিয়ে দেয়। পরে ওই সম্মেলনে প্রজাতন্ত্রের জনগণের আকাঙ্ক্ষার দলিল হিসেবে এসব সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবে।

মাঠপর্যায়ের সঙ্গে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের মিথস্ক্রিয়া এভাবে শুধু ধ্বংস হলো তা-ই নয়, এতে করে উচ্চতর কর্তৃপক্ষ সহজেই নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারবে—বরং, আঘাতের সঙ্গে যুক্ত হলো অপমান, একে ঠিক বিপরীতভাবে সাজানো হলো: সিসি-ই (কেন্দ্রীয় কমিটি) নিজের মতো করে নির্ধারণ করে দিচ্ছে মাঠপর্যায়ের ইচ্ছা হিসেবে কী উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো হবে।

সুবিবেচনা  এবং  ভয়-দেখানো

লেনিনের শেষ যুদ্ধের আর যে বিষয়ের প্রতি লুইন আমাদের মনোযোগী করেছেন সেটা হচ্ছে সৌজন্য এবং সুশীলতার প্রতি তাঁর অপ্রত্যাশিত আগ্রহ। দুটো ঘটনায় লেনিন নিদারুণভাবে আহত হয়েছিলেন: একটি রাজনৈতিক বাহাসে, জর্জিয়ায় নিযুক্ত মস্কো প্রতিনিধি সেরগো অরদোনিকিজে (Sergo Ordzhonikidze) জর্জিয়ান কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সভ্যকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিলেন; আর স্টালিন স্বয়ং ক্রুপস্কায়াকে গালমন্দ করেছিলেন (এই ঘটনা জানতে পেরে যে তিনি লেনিনের একটি চিঠি পাচার করেছিলেন ট্রটস্কির কাছে, যেখানে স্টালিনের বিরুদ্ধে একটি চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে)। এর পরের ঘটনাটি লেনিনকে তাঁর বিখ্যাত আবেদনটি লিখতে তাড়িত করে:

স্টালিন অত্যন্ত কর্কশ। তাঁর এই ত্রুটি আমাদের মধ্যে ও কমিউনিস্টদের সঙ্গে লেনদেনের বেলায় সহনীয়, কিন্তু সাধারণ দপ্তরে (Secretary) সেটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। সে কারণেই আমার মনে হচ্ছে, কমরেডরা চান ওই পদ থেকে স্টালিনকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় এমন কাউকে বসাতে যিনি সমস্ত বিচারে শ্রেষ্ঠত্বের অর্থে কমরেড স্টালিন থেকে পৃথক হবেন—তিনি হবেন আরও সহিষ্ণু, অনুগত, মার্জিত এবং কমরেডদের প্রতি আরও বেশি বিবেচনাপূর্ণ, নিজের মর্জিমতো নয়।

কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশনের জন্য লেনিনের প্রস্তাব এবং শিষ্টতা বজায় রাখার ব্যাপারে মনোযোগ কোনোভাবেই উদারনৈতিক নমনীয়তা নয়। সেই একই সময়ে কামেনেভের (Kamenev) কাছে লেখা এক চিঠিতে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাচ্ছেন: ‘এটা ভাবা খুবই বড় ধরনের ভুল যে এনইপি সন্ত্রাসকে থামাতে পেরেছে; আমাদের আবারও দৃষ্টি ফেরাতে হবে সন্ত্রাস এবং অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের দিকে।’ তা সত্ত্বেও, এই সন্ত্রাস—চেকা (স্টেট সিক্রেট পলিসি অর্গানাইজেশন) এবং রাষ্ট্রীয় অ্যাপারেটাসের পরিকল্পিত কাটছাঁটের পরও যা টিকে যাবে—বাস্তবে আরও বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। লুইন এ ক্ষেত্রে যেমন বলছেন, ‘লেনিন এমন একটি উপায় খুঁজছিলেন যার মাধ্যমে যারা এখন [এনইপির অধীনে] রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যবসায়ীদের ওপর আরোপিত সীমা ছাড়িয়ে যেতে চায়, তাদের “বিচক্ষণ এবং মার্জিতভাবে” এই ব্রহ্মাস্ত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাবে।’ লেনিন এ ক্ষেত্রে সঠিক ছিলেন: একনায়কতন্ত্র (রাষ্ট্র) ক্ষমতার আত্যন্তিক বাড়াবাড়ির প্রতি নির্দেশ করে, আর এই পর্যায়ে নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে গুরুতর প্রশ্ন হলো কার বাড়াবাড়ি? যদি এটা আমাদের না হয়, তাহলে এটা হবে ওদের বাড়াবাড়ি।

সিসিসির কাজের ধরন কী হবে সেটা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে কথাটা লেনিনের নিজের জবানিতেই আছে, ১৯২৩ সালে তাঁর শেষ লেখা ‘বেটার ফিউয়ার, বাট বেটার’-এ তিনি এই পর্ষদ কীভাবে কাজ করবে সেটা বাতলে দিচ্ছেন:

কিছু আধা-কৌতুককর চাল, ধূর্ত ফন্দি, ধোঁকাবাজি অথবা ও রকমই কিছু কিছু [পন্থা অবলম্বন করবে]। আমি নিশ্চিত, পশ্চিম ইউরোপের রাশভারি ও রক্ষণশীল পরিবেশে এ রকম একটি আইডিয়া সবাইকে ভীতিবিহ্বল করে ফেলবে এবং কোনো ভদ্র আমলাই এর থেকে মজা লুটতে পারবে না। আমি আশা রাখি, সে যেভাবেই হোক, আর সবার মতো অতটা আমলাতান্ত্রিক আমরা হয়ে যাইনি, এবং আমাদের মধ্যে এই ভাবনার আলোচনা কৌতুক ছাড়া অন্য কিছুর উদ্রেক করবে না।

কার্যত, উপযোগের সঙ্গে একটু ফুর্তি জুড়ে দিই না কেন? হাস্যাস্পদ কিছু, যা ক্ষতিকর, যা আধা হাস্যাস্পদ, আধা ক্ষতিকর—এসব উন্মোচন করতে কিছু হাস্যকর, আধা কৌতুককর চালের আশ্রয় নিই না কেন?

এটা কি কেন্দ্রীয় কমিটি আর পলিটব্যুরোতে ঘনীভূত হওয়া ‘রাশভারী’ নির্বাহী ক্ষমতারই প্রায় দ্বিগুণ একটি অশ্লীল রূপ নয়? ধূর্তামি, বুদ্ধির মারপ্যাঁচ—দুর্দান্ত এক স্বপ্ন, কিন্তু তবুও সেটা ইউটোপিয়া। লেনিনের দুর্বলতা হলো, লুইন যুক্তি দেখাচ্ছেন, তিনি আমলাতান্ত্রিকতার সমস্যাকে ঠিকই বুঝেছিলেন, কিন্তু এর ভর ও প্রকৃত মাত্রাকে তিনি খাটো করে দেখেছেন: ‘তাঁর সমাজ-বিশ্লেষণ মাত্র তিনটি সামাজিক শ্রেণীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল—শ্রমিক, কৃষক আর বুর্জোয়া—স্টেট অ্যাপারেটাসকে একটি স্বতন্ত্র সামাজিক উপাদান বা শ্রেণী হিসেবে বিবেচনার মধ্যে না এনে, এমন একটি দেশে যেখানে অর্থনীতির মূল খাতটির জাতীয়করণ ঘটেছে।’১০

বলশেভিকদের খুব দ্রুতই চেতন হয়, তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার কোনো বিশিষ্ট সামাজিক ভিত্তি নেই: শ্রমিক শ্রেণীর যাদের ওপর ভর করে তাদের শাসন চলত, তাদের অধিকাংশই গৃহযুদ্ধে বিলুপ্ত হয়েছে, তাই সামাজিক প্রতিনিধিত্বের একরকম শূন্যতার মধ্যে তাদের শাসন চলছিল। সে যাই হোক, সমাজের ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার মতো একটি খাঁটি রাজনৈতিক ক্ষমতা হিসেবে নিজেদের কল্পনা করতে গিয়ে তারা উপেক্ষা করে কীভাবে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র—যেহেতু এটি কার্যত উত্পাদন শক্তিগুলোর তদারকি করে, বা অন্য কোনো মালিকানার অনুপস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে—ক্ষমতার প্রকৃত সামাজিক ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে:

একেবারে কোনো রকম সামজিক ভিত্তিনিরপেক্ষ ‘খাঁটি’ রাজনৈতিক শক্তি বলে কিছু নেই। যেকোনো শাসনব্যবস্থাকেই তার দমন-পীড়নের অ্যাপারেটাসের বাইরে অবশ্যই সামাজিক ভিত্তি খুঁজে নিতে হবে। সোভিয়েত শাসন যে ‘শূন্যতা’র মধ্যে ভাসছে বলে মনে হচ্ছিল, অচিরেই তা ভরাট হয়ে গিয়েছিল, এমনকি বলশেভিকরা যদি সেটা না-ও দেখে বা দেখতে না চায়।১১

তর্কসাপেক্ষে বলা যেতে পারে, এই ভিত্তিই লেনিনের সিসিসি প্রকল্পকে থামিয়ে দিতে পারত। এটা সত্যি যে লেনিন অর্থনীতিবাদবিরোধী এবং নির্ধারণবাদী এ দুইভাবেই রাজনৈতিক বিষয়ের সার্বভৌমত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যা লক্ষ করেননি সেটা বাদিয়্যুর (Badiou) ভাষায় বললে, এই নয় যে সব রাজনৈতিক শক্তিই কিছু কিছু সামাজিক শক্তি বা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে, বরং তার অলক্ষে রয়ে গিয়েছিল এই প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক শক্তি নিজেই কেমন করে যে স্তরের সে প্রতিনিধিত্ব করে তাতেই সরাসরি কায়েমী স্বার্থবাদী হয়ে যায়, একটি স্বাধীন সামাজিক শক্তি হিসেবে। স্টালিনের বিরুদ্ধে লেনিনের শেষ লড়াইয়ের মধ্যে তাই একটি আদর্শ ট্র্যাজেডির সব রকম লক্ষণই ছিল। এটা কোনো মেলোড্রামা ছিল না যেখানে ভালো ছেলেরা দুষ্টু লোকের সঙ্গে জেহাদ করে; এটা ছিল ট্র্যাজেডি, যেখানে নায়ক ক্রমে উপলব্ধি করেন তিনি লড়ছেন নিজের ঝাড়বংশের বিরুদ্ধে, অতীতে যেসব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার অবধারিত ক্রমপরিণতি ঠেকানোর সময় ফুরিয়ে গেছে।

একটি  ভিন্ন পথ

তো ১৯৮৯ সালের ‘অব্যাখ্যাত দুর্যোগে’র (désastre obscur) পরে আমরা আজ কোথায় আছি? ১৯২২ সালে যেমন নিচে থাকা কণ্ঠস্বরগুলো আমাদের চারপাশে বিদ্বেষের আনন্দে বেজে উঠেছিল: ‘উচিত শিক্ষা হয়েছে বোকার হদ্দগুলোর, যারা তাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়!’ অন্যরা তাঁদের বিদ্বেষভরা উল্লাস গোপন করার চেষ্টা করছে; তারা বিলাপ করছে, শোকাতুর চোখে তারা আকাশপানে চাওয়া, যেন সে চোখ বলছে: ‘আমাদের ভয়টাই সত্যি হচ্ছে দেখে আমাদের শোকের আর অবধি নেই! একটা ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার কত মহত্ স্বপ্ন ছিল তোমাদের! তোমাদের তালে তালে স্পন্দিত হচ্ছিল আমাদের হূদয়, কিন্তু যুক্তি আমাদের বলে দিচ্ছিল এই পরিকল্পনার শেষ হবে দৈন্যে আর নতুন ধরনের শেকলপনায়!’ যখন আমরা এ রকম মনোলোভা বচনের সঙ্গে আপসের চিন্তা বাতিল করব, সেই সময়েই আমাদের অবশ্যই আরম্ভ করতে হবে একেবারে গোড়া থেকে—বিশ শতকের বিপ্লবী যুগের বুনিয়াদের ওপর নতুন সৌধ নির্মাণের কাজ নয়, যে যুগের আয়ুষ্কাল ছিল ১৯১৭ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত, বা আরও নির্দিষ্ট করা বললে ১৯৬৮ পর্যন্ত। বরং আমাদের নামতে হবে একেবারে তলানিতে, একটা ভিন্ন রাস্তা বাতলাতে হবে।

কিন্তু কীভাবে? পশ্চিমা মার্ক্সবাদের মূল সমস্যা ছিল বিপ্লবী কর্তার (subject) অভাব: এটা কীভাবে হয় যে, শ্রমিক শ্রেণী নিষ্ক্রিয় সত্তা (in-itself) থেকে সক্রিয় সত্তা (for-itself) অবধি পৌঁছানোর পুরো রাস্তাটা হাঁটল না এবং নিজেদের বিপ্লবী কারিন্দা (agent) হিসেবে তৈরি করল না। এই সওয়ালই পশ্চিমা মার্ক্সবাদের সঙ্গে মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের গাঁটছড়া বাঁধার প্রধান Raison d’être* (reason for being) জুগিয়েছে। এই গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছিল অচেতনের লিবিডো-তাড়িত কলকবজা ভালোভাবে বুঝে নিতে, যা শ্রমিকশ্রেণীর একেবারে সারসত্তার মধ্যে বা সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে খোদাই হয়ে আছে, যা শ্রেণীচেতনার উত্থান প্রতিহত করে রেখেছে। এই উপায়েই মার্ক্সীয় সামাজিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের সত্যকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল: মধ্যবিত্তের উত্থানবিষয়ক সংশোধনবাদী তত্ত্বের গোড়ায় জল ঢালার কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছিল না। এই একই কারণে পশ্চিমা মার্ক্সবাদ বিরতিহীনভাবে একটি অপর খুঁজে মরছিল, যারা বিপ্লবী কারিন্দার ভূমিকা পালন করতে পারে, যেন পরাঙ্মুখ শ্রমিকশ্রেণীর বদলি নট হিসেবে অভিনয় করবে তারা: তৃতীয় বিশ্বের কৃষক, শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীরা, বাদপড়া লোকেরা। এটা খুবই সম্ভব যে বিপ্লবী কারিন্দা খোঁজার এই মরিয়া তত্পরতা আসলে এর একেবারে বিপরীত কিছুর অবয়ব: একে খুঁজে পেয়ে যাওয়ার ভয়, যেখানে এটা ইতিমধ্যে সচল সেখানে চোখ পড়ে যাওয়ার ভয়। আমাদের নিজের কাজ অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাবে, সে জন্য সবুর করা আসলে নিজেদের নিষ্ক্রিয়তাকেই যৌক্তিক করার একটা উপায়।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অ্যালে বাদিয়্যু (Alain Badiou) নিদান দিচ্ছেন আমাদের কমিউনিস্ট প্রকল্প আবার ঘোষণা করতে হবে। তিনি লিখছেন:

এই প্রকল্প যদি আমাদের পরিত্যাগ করতে হয় তাহলে যৌথ কর্মের ক্ষেত্রে আর কোনো কিছু করারই কোনো মানে নেই। এই কমিউনিস্ট দিগন্তকে বাদ দিয়ে, এই আদর্শে ক্ষান্তি দিয়ে কোনো রকম ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক সংঘটনের আকাঙ্ক্ষাই দার্শনিকের কাছে স্রেফ অর্থহীন।

তার পরও, বাদিয়্যু আরও জানাচ্ছেন:

এই আদর্শ আঁকড়ে ধরে থাকা, এই প্রকল্পের অস্তিত্ব থাকার অর্থ এই নয় যে রাষ্ট্র ও সম্পত্তি ব্যাখ্যার যে আদি রূপ এই প্রকল্পে পাওয়া গিয়েছিল তাকে অবিকৃতভাবে রক্ষা করতে হবে। আসলে দার্শনিক কাজ হিসেবে যা আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, যা আসলে একটা দায়িত্ব, সেটা হলো অস্তিত্বের এই প্রকল্পকে বাস্তবায়নের জন্য নতুন সাধনপ্রণালি উদ্ভাবন করা।১২

এই লাইনগুলো পড়ার সময় সাবধান থাকা দরকার যেন আমরা কান্টীয় ধরনে এর অর্থ না করি যেখানে সাম্যবাদকে একটি নিয়ন্ত্রিত আদর্শ বলে কল্পনা করা হয়, এবং এভাবে ‘নৈতিক সমাজতন্ত্রে’র বিপদ ডেকে আনা হয়, যেখানে সমতাকে পূর্ব-নির্ধারিত (a priori) মানদণ্ড বা স্বতঃসিদ্ধ বলে ভাবা হয়। বরং আমাদের একে বুঝতে হবে একঝাঁক সামাজিক বৈরিতার নিরিখে, যা সমাজতন্ত্রের জরুরত উত্পাদন করে; সাম্যবাদকে একটি অনড় মঙ্গলবাদী প্রথাগত মার্ক্সীয় ধারণা হিসেবে না দেখে এমন একটি তত্পরতা হিসেবে দেখা দরকার, যা প্রকৃত অসংগতিগুলোর সামনে রুখে দাঁড়ায়। সাম্যবাদকে শাশ্বত ভাব হিসেবে জাহির করতে গেলে এ কথাও মানতে হয়, যে পরিস্থিতি একে তৈরি করে সেই পরিস্থিতিটাও কিছু কম অনড় নয়। আমাদের মানতে হয়, বৈরিতার সঙ্গে বিক্রিয়া করে যে মার্ক্সবাদ, সেটা চিরকাল একই রকম অনড় থাকবে। এটা তাই আসলে মার্ক্সবাদের বিনির্মাণবাদী (Deconstructionist) পাঠ থেকে মোটে এক কদম দূরে, যেখানে সাম্যবাদকে দেখা হয় সম্ভাব্য অস্তিত্বের স্বপ্ন হিসেবে, সমস্ত বিচ্ছিন্নতার রিপ্রেজেন্টেশনের ধ্বংস হিসেবে; এমন এক স্বপ্ন, যা নিজের আষাঢ়ে-কল্পনার জোরেই সমৃদ্ধ হয়।

ফুকুয়ামার ‘ইতিহাসের প্রান্ত’ ধারণাটি নিয়ে মশকরা করা ভারি সহজ, তবু আজ সিংহভাগ লোকই ফুকুয়ামাবাদী। উদার গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ সব সম্ভাবনার বিচারে শ্রেষ্ঠ সমাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে; এখন যা করার আছে সেটা কেবল এই সমাজকে ন্যায্যতর করে তোলা, আরও সহিষ্ণু বা এ রকম কিছু কিছু উন্নতি করা। এখানেই সাদামাটা কিন্তু মোক্ষম প্রশ্নটা ওঠে: যদি উদার গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ সবচেয়ে ভালো নাই বা হলো, অন্তত সমাজের সবচেয়ে লঘু-দুষ্ট গড়ন হয়, কেন আমরা সাবালকের মতো ইস্তফা দিয়ে এই দলে জুটে যাই না, এমনকি একে কায়মনোবাক্যে গ্রহণ করি না কেন? কেন এত সব অস্বাভাবিকতার মধ্যেও জোর দিতে হবে সাম্যবাদী প্রকল্পের ওপর?

শ্রেণী ও এজমালি মালিকানা

সাম্যবাদী প্রকল্পের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা—এটুকুই কেবল যথেষ্ট নয়: আমাদের ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্যে সেসব বৈরিতার সুলুক সন্ধান করা লাগবে, যা এই প্রকল্পকে একটা বাস্তবিক জরুরত করে তুলেছে। আজকের দিনে একমাত্র সত্যিকারের প্রশ্ন হচ্ছে: বৈশ্বিক পুঁজিবাদের মধ্যেই তার অনির্দিষ্ট পুনরুত্পাদন ঠেকাতে কোনো শক্তিশালী বিরোধিতা আছে কি না? এ ক্ষেত্রে চারটি সম্ভাব্য বৈরিতার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে: প্রতিবেশ বিপর্যয়ের লতিয়ে ওঠা আতঙ্ক; তথাকথিত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণার অনুপযোগিতা; নয়া প্রযুক্তি-বিজ্ঞানগত উন্নয়নের সামাজিক-নৈতিক সংশ্লেষ, বিশেষত বায়োজেনেটিকসের ক্ষেত্রে; এবং শেষত যদিও কোনোভাবেই খাটো নয়, সামাজিক বর্ণবাদের নতুন রূপ—নতুন দেয়াল, নতুন বস্তি। এই শেষ বৈশিষ্ট্য—যেখানে ‘অন্তর্ভুক্ত’দের থেকে ‘বাদ পড়া’দের মধ্যকার দূরত্ব আলোচিত হচ্ছে—আগের তিনটি বৈশিষ্ট্যের থেকে গুণগতভাবেই পৃথক। প্রথম তিনটি বৈশিষ্ট্য পড়ে সেই গ্রুপে যাকে হার্ডট ও নেগরি বলেছেন ‘এজমালি মালিকানা’—যা আমাদের সামাজিক সত্তার যৌথ সারবত্তাকে ধারণ করে, যাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করাটা হবে একটা বর্বরোচিত কাজ এবং দরকার পড়লে যেটাকে গায়ের জোরে প্রতিরোধ করা উচিত।

প্রথমত, আছে সাংস্কৃতিক এজমালি মালিকানা, জ্ঞানগত পুঁজির প্রত্যক্ষ সামাজিকীকৃত রূপ: প্রাথমিকভাবে ভাষা, আমাদের যোগাযোগ এবং শিক্ষার বাহন, কিন্তু এর সঙ্গে যোগ হবে যৌথ অবকাঠামো যেমন গণপরিবহন, বিদ্যুত্, সীমান্তচৌকি ইত্যাদি। যদি বিল গেটসকে একচেটিয়া ব্যবসার খত লিখে দেওয়া হতো, আমরা এই অর্থহীন পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকতাম যেখানে আমাদের যোগাযোগের মূল নেটওয়ার্কের সফটওয়্যার টিস্যুর মালিকানা থাকত একজন ব্যক্তির হাতে। দ্বিতীয়ত, এজমালি-স্বত্ব আছে বহিঃস্থ প্রকৃতির ওপর, যা এখন দূষণ এবং শোষণের ফলে হুমকির মুখে—তেল থেকে আরম্ভ করে অরণ্য, এবং স্বয়ং প্রাকৃতিক আবাসভূমি যার ভেতরে পড়ে, আর, তৃতীয়ত, আমাদের অন্তঃস্থ প্রকৃতির এজমালি অধিকার, মানবজাতির বায়োজেনেটিক উত্তরাধিকার। এসব ধস্তাধস্তির মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য সবখানেই পাওয়া যায় সেটা হলো পুঁজিবাদী যুক্তি মেনে নিয়ে এসব এজমালি সম্পদকে ব্যক্তি খাতের লাগামহীন লুণ্ঠনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ধ্বংসাত্মক সম্ভাবনার ব্যাপারে সচেতনতা আনা। ‘এজমালি অধিকারে’র এই দোহাই থেকেই সাম্যবাদী ধারণার পুনরুজ্জীবনকে ন্যায়সংগত বলে মানতে হয়: এটা আমাদের দেখিয়ে দেয় এই প্রগতিশীল বেড় আসলে সেসব মানুষকে প্রলেতারিয়করণ করার প্রক্রিয়া, যারা নিজেদের সারবত্তা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে; এই প্রক্রিয়াও শোষণকেই নির্দেশ করে। এই শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতির নবায়নই হচ্ছে আজকের কাজ—দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, বিভিন্ন কোম্পানিতে খেটে চলা নামহীন ‘জ্ঞানশ্রমিক’দের কথা।

শেষ পর্যন্ত এটা আসলে চতুর্থ বৈরিতা—বাদ পড়াদের যেখানে নির্দেশ করা হচ্ছে, যা সাম্যবাদ পদটির ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে। যে রাষ্ট্রীয় সম্প্রদায় তার ‘বাদ পড়া’দের একটি হুমকি হিসেবে দেখে এবং এই দুশ্চিন্তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে যে কীভাবে তাদের হক নিরাপদ দূরত্বে ঠেলে রাখা যায়, এর থেকে ব্যক্তিক অভিপ্রায় আর কিছুই হতে পারে না। অন্য কথায় বলতে গেলে, এই চারটি বৈরিতার ধারাবাহিকতার মধ্যে যেটির বিষয় হচ্ছে অন্তর্ভুক্ত এবং বাদ পড়াদের সম্পর্ক সেটিই আসলে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ: একে বাদ দিলে বাকি সব কটি তাদের অন্তর্ঘাতমূলক কিনারা হারায়। এটা বাদ পড়লে স্থিতিশীল উন্নয়নের পথে প্রতিবেশ নিছক একটি বিঘ্ন হয়ে দাঁড়ায়, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হয়ে পড়ে একটি আইনগত চ্যালেঞ্জ মাত্র, আর বায়োজেনেটিকস হয়ে ওঠে শুধু একটি নৈতিক ইস্যু। কেউ ইচ্ছে করলে অন্তর্ভুক্ত এবং বাদ পড়াদের মধ্যকার বৈরিতাকে মোকাবিলা না করেই আন্তরিকভাবে পরিবেশের জন্য লড়াই করতে পারে, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে আরও ব্যাপ্ত ধারণার পক্ষ নিতে পারে, জিনের স্বত্ব তৈরির বিরোধিতা করতে পারে। এমনকি, কেউ হয়তো এ রকম কিছু কিছু লড়াইকে অন্তর্ভুক্তদের বিরুদ্ধে বাদ পড়া দূষিতদের হুমকি হিসেবে সূত্রবদ্ধ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায়, আমরা কোনো সত্যিকারের সবর্জনীনতায় পৌঁছাতে পারি না, শুধু কান্টীয় অর্থে ‘ব্যক্তিগত’ সমস্যা হিসেবেই ভাবতে পারি। হোল ফুডস বা স্টার বাকসের মতো করপোরেশন উদারনৈতিকদের সমর্থন পেতেই থাকে যদিও তারা দুজনেই ইউনিয়ন-পরিপন্থী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত; এখানে চালাকিটা হলো, তারা একধরনের প্রগতিশীল চয়নে তাদের মাল বেচে: ‘ন্যায্য বাণিজ্যে’ উপযুক্ত মূল্যে কেনা কফির দানা থেকে তাদের কফি উত্পাদিত, ব্যয়বহুল মিশ্র বীজের ব্যবহার করা হয়েছে ইত্যাদি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, অন্তর্ভুক্ত এবং বাদ পড়াদের মধ্যকার বৈরিতাকে এড়িয়ে চিন্তা করলে আমরা হয়তো নিজেদের আবিষ্কার করব এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে বিল গেটস সব থেকে পেল্লাই মানবতাবাদী, দারিদ্র্য এবং রোগ-শোকের বিরুদ্ধে এক লড়াকু যোদ্ধা; আর রুপার্ট মারডক যেখানে মহত্তম পরিবেশবাদী, নিজের গণমাধ্যমের সাম্রাজ্যকে কাজে লাগিয়ে শত শত মিলিয়ন লোককে একত্র করছেন।

এখানে কেউ চাইলে আরও কিছু কথা যোগ করতে পারে। কান্টকে ছাড়িয়ে গিয়ে, সামাজিক থাকবন্দী কাঠামোর ‘ব্যক্তিগত’ বিন্যাসে এ রকম সামাজিক দলও রয়েছে যাদের সুনিশ্চিত কোনো অবস্থান নেই, যারা সরাসরি সর্বজনীনতার পক্ষে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে: এরা হলো সমাজদেহের সেই অংশ যাকে জাঁক রানসিয়ের (Jacques Rancière) বলেছেন ‘অংশহীনতার অংশ’। সত্যিকারের সমস্ত গণমুক্তির রাজনীতি উদ্ভূত হয় আমজনতা ব্যবহূত সর্বজনীন যুক্তি এবং ‘অংশহীনতার অংশ’-এর সর্বজনীনতার মধ্যকার বিস্ফোরক মিলনে (Short Circuit)। তরুণ মার্ক্সের এটাই ছিল সাম্যবাদী স্বপ্ন—দর্শনের সর্বজনীনতার সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের সর্বজনীনতাকে এক কাতারে নিয়ে আসা। প্রাচীন গ্রিসের সময় থেকেই, আমরা সমাজ-রাজনীতিক পরিসরে বাদ পড়াদের অনধিকার প্রবেশের একটি নামই পেয়েছি: সেটা হচ্ছে গণতন্ত্র।

গণতন্ত্রের প্রভাবশালী উদারনৈতিক ধারণাও বাদ পড়াদের নিয়ে চিন্তা করে, কিন্তু একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে: এটা জোর দেয় তাদের অন্তর্ভুক্তির ওপর, সংখ্যালঘুদের স্বর হিসেবে। সব রকম অবস্থানের স্বরই শুনতে হবে, সব ধরনের স্বার্থকেই আমলে আনতে হবে, সবার মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে, জীবনযাপনের সব পথ, সব সংস্কৃতি এবং চর্চাকেই শ্রদ্ধা করতে হবে এবং এ রকম অনেক কিছু। এ-জাতীয় গণতন্ত্রের একটি প্রবল আসক্তি হলো সব ধরনের সংখ্যালঘুর হেফাজত করা: সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, যৌন এ রকম নানা সংখ্যালঘু। এখানে গণতান্ত্রিক প্রণালি গঠিত হচ্ছে সহিষ্ণু সমঝোতা এবং আপসরফার ভিত্তিতে। কিন্তু এর মধ্যে যা হারিয়ে যাচ্ছে সেটা হলো বাদ পড়াদের মধ্যে প্রথিত সর্বজনীনতার অবস্থান। মুক্তির নতুন রাজনীতি আর সুনির্দিষ্ট কোনো সামাজিক কারিন্দার কর্মকাণ্ড হবে না, বরং সেটা হবে ভিন্ন ভিন্ন কারিন্দার এক বিস্ফোরক মিশেলে। আমাদের যা একত্র করে সেটি হচ্ছে, প্রলেতারিয়েতের ‘নিজেদের শেকল ছাড়া কিছুই হারানোর নেই’ এই ধ্রুপদি ভাবমূর্তির বিপরীতে, এই বোধ—আমরা সবকিছু হারিয়ে ফেলার ঝুঁকির মধ্যে আছি। এখানে বিপদটা হলো আমরা পর্যবসিত হব একটি বিমূর্ত ফাঁকা কার্তেজীয় বিষয়ীতে, যে তার সব ধরনের প্রতীকী উপাদান হারিয়ে ফেলেছে, আমাদের জেনেটিক ভিত্তি কেউ কাজে লাগাচ্ছে, আর আমরা নিশ্চেষ্ট জীবনযাপন করছি একটি বসবাসের অযোগ্য পরিবেশে। এই ত্রিমুখী হুমকি আমাদের সবাইকে বানিয়ে তুলেছে প্রলেতারীয়, পর্যবসিত করেছে ‘সারবত্তাহীন বিষয়ী’তে, যেমন মার্ক্স বলেছেন তাঁর গ্রুন্ড্রিজ (Grundrisse) গ্রন্থে। ‘অংশহীনতার অংশ’-এর মূর্তি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের প্রকৃত অবস্থানের মুখোমুখি এবং এখানে নৈতিক-রাজনীতিক চ্যালেঞ্জটি হলো এই মূর্তিতে নিজেদের আবিষ্কার করতে পারা। এক অর্থে বলতে গেলে, আমরা সবাই বাদ পড়াদের দলে, আমরা বাদ পড়েছি আমাদের প্রকৃতি থেকে যেমন, তেমনি আমাদের প্রতীকী সারবত্তা থেকেও। আজ আমরা সবাই সম্ভাব্য হোমো-সসার (homo sacer)* এবং সত্যিই তেমন হয়ে ওঠার নিয়তি এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো এখনই প্রতিষেধমূলক কিছু করা।

তথ্যসূত্র

১. ভ. ই. লেনিন: ‘নোটস অব এ পাবলিসিস্ট’, তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় Pravda, ১৬ এপ্রিল ১৯২৪; কালেক্টেড ওয়ার্কস, ভলিয়ুম ৩৩, মস্কো ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ২০৪-৭

২. স্যামুয়েল বেকেট: ‘ওয়ারস্টওয়ার্ড হো’, Nohow লন্ডন ১৯৯২, পৃষ্ঠা ১০১

৩. লেনিন, ‘ইলেভেনথ কংগ্রেস অব দি আরসিপি (বি)’, কালেক্টেড ওয়ার্কস, ভলিয়ুম ৩৩, পৃষ্ঠা ২৮১-৩

৪. সানদোর মারাই: মেমোয়ার অব হাঙ্গেরি: ১৯৪৪-১৯৪৮, বুদাপেস্ট ১৯৯৬

৫. মোশে লুইন: লেনিনস লাস্ট স্ট্রাগল [১৯৬৮], Ann Arbor, MI, ২০০৫। পৃষ্ঠা ১৩১-১৩২

৬. উদ্ধৃতি লুইন: লেনিনস লাস্ট স্ট্রাগল, পরিশিষ্ট ১, পৃষ্ঠা ১৪৬-৭

৭.  লুইন: লেনিনস লাস্ট স্ট্রাগল, পৃষ্ঠা ৮৪

৮. লুইন: লেনিনস লাস্ট স্ট্রাগল, পৃষ্ঠা ১৩৩

৯. লেনিন: ‘বেটার ফিউয়ার, বাট বেটার’, কালেক্টেড ওয়ার্কস, ভলিয়ুম ৩৩, পৃষ্ঠা ৪৯৫

১০.লুইন: লেনিনস লাস্ট স্ট্রাগল, পৃষ্ঠা ১২৫

১১. লুইন: লেনিনস লাস্ট স্ট্রাগল, পৃষ্ঠা ১২৪

১২. অ্যালে বাদিয়্যু: দি মিনিং অব সারকোজি, লন্ডন এবং নিউইয়র্ক ২০০৮, পৃষ্ঠা ১১৫

*তারকা-চিহ্নসংবলিত টীকাগুলো বর্তমান অনুবাদকের।

* স্যামুয়েল বেকেটের গদ্য রচনা। চার্লস কিংসলির ওয়েস্টওয়ার্ড হো-র ব্যঙ্গ করে লেখা রচনা (১৯৮৩)।

* First engage in a serious battle and then see what happens (আগে একটা গুরুতর লড়াই করো, তারপর দেখো কী হয়)—লেনিন তাঁর ‘আওয়ার রেভ্যুলেশন’ প্রবন্ধে এ রকম অর্থে উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছেন।

* কোনো কিছুর অস্তিত্বশীল থাকার মূল কারণ বা লক্ষ্য। যা কোনো কিছুর অস্তিত্বের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে।

* হোমো-সসার: লাতিন এই কথার অর্থ পবিত্র মানুষ। এটি রোমান আইনের একটি দুর্বোধ্য ব্যাপার। কথাটি দিয়ে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যে আসলে নিষিদ্ধ। এই ব্যক্তিটি সব রকম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। একই সঙ্গে তার জীবনকে এক রকম নেতিবাচক অর্থে ‘পবিত্র’ গণ্য করা হয়।

(ইংরেজি থেকে অনূদিত)

অনুবাদ: তৈমুর রেজা