রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গ এবং বাংলাদেশের অভিযাত্রা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১. 

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সবচেয়ে প্রতিভাবান সন্তান কনিষ্ঠ পুত্রকে বিয়ের দুই দিন আগে ২২ অগ্রহায়ণ ১২৯০ বঙ্গাব্দে একটি চিঠিতে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি লেখেন: ‘এইক্ষণে তুমি জমিদারির কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও; প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিতরূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশিস বাকী ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি-রপ্তানি পত্রসকল দেখিয়া তার সারমর্ম্ম নোট করিয়া রাখ।’ তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ২২। এই জমিদারির কিছু উড়িষ্যা ও বিহারে থাকলেও মূল অংশ ছিল পূর্ববঙ্গে, পদ্মাপারের বিস্তীর্ণ পল্লিবাংলায়। তাঁর জীবনপঞ্জিতে দেখা যায়, জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেতে পেতে আরও ছয় বছর কেটে যায়। ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে ২৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের জমিদারির দায়িত্ব পালন শুরু করেন। সে বছরের নভেম্বরে সপরিবারে শিলাইদহে নৌকাবাস করেন, যার উল্লেখ রয়েছে ছিন্নপত্র-এর তৃতীয় চিঠিতে, যা ছিন্নপত্রাবলীতে চতুর্থ চিঠি। পড়ে বোঝা যায়, প্রকৃতির এই অবাধ মুক্ত রাজ্যে তাঁর মন একদিকে বিশালতার বোধে পরিতৃপ্ত, অপর দিকে এর অনিশ্চয়তা ও বৈচিত্র্যের নাটকীয়তায় কৌতুকে-কৌতূহলে প্রাণবন্ত। এই চিঠি থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দেওয়া যাক:

... শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর—ধূ ধূ করছে—কোথাও শেষ দেখা যায় না—কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়—আবার অনেক সময় বালিকে নদী বলে ভ্রম হয়—গ্রাম নেই, লোক নেই, শুরু নেই, তৃণ নেই—বৈচিত্র্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি—পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নিচে অনন্ত পাণ্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূন্য, নিচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূন্যতা।

তবে প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর কাজ হয়েছে সেই শৈশবে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ২১ অগ্রহায়ণ (১৮৮২ বঙ্গাব্দ) তারিখে বোটে করে শিলাইদহ যাত্রা করেন। এ যাত্রায় তিনি চতুর্দশবর্ষীয় কনিষ্ঠ পুত্রকেও তাঁর সঙ্গী করেন। এই ভ্রমণের একটি বিবরণী তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যা রবিজীবনী প্রথম খণ্ডে উদ্ধৃত হয়েছে। এই সংবাদে লেখা হয়েছে, ‘স্বাধ্যায়ের পর প্রধান আচার্য্য মহাশয়ের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমধুর স্বরে একটি মনোহর ব্রহ্মসঙ্গীত করেন।’

একই বছর ফাল্গুনে আবারও শিলাইদহে যান রবীন্দ্রনাথ, এবার সঙ্গী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। বৃদ্ধ বয়সে ‘ছেলেবেলা’য় স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন:

পুরোনো নীলকুঠি তখনো খাড়া ছিল। পদ্মা ছিল দূরে। নীচের তলায় কাছারি, উপরের তলায় আমাদের থাকবার জায়গা। সামনে খুব মস্ত একটা ছাদ। ছাদের বাইরে বড়ো বড়ো ঝাউগাছ, এরা একদিন নীলকর সাহেবের ব্যবসার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল।

... সেদিনকার আর যা-কিছু সব মিথ্যে হয়ে গেছে, কেবল সত্য হয়ে আছে দুই সাহেবের দুটি গোর।

এই সময়ে রবীন্দ্র-কবির কুঁড়ি দল মেলতে শুরু করেছিল পূর্ণোদ্যমে। সে কথাও লিখেছেন তিনি:

একলা থাকার মন নিয়ে আছি। ছোটো একটি কোণের ঘর। যত বড় ঢালা ছাদ তত বড়ো ফলাও আমার ছুটি। অজানা ভিন দেশের ছুটি, পুরোনো দিঘির কালো জলের মতো তার থই পাওয়া যায় না। বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই, উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এই সঙ্গে সঙ্গে আমার খাতা ভরে উঠতে আরম্ভ করছে পদ্যে। সেগুলো যেন ঝরে পড়বার মুখে মাঘের প্রথম ফসলের আমের বোল—ঝরেও গেছে।

পূর্ববঙ্গে আসার আগেই রবীন্দ্রনাথ বারো বছর বয়সে বাবার সঙ্গে ভ্রমণে বেরিয়ে বোলপুর হয়ে হিমালয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি এর কিছু পরে এবং পরিণত মন নিয়ে এখানে আসার আগে, দুবার বিলেতও ঘুরে এসেছেন তিনি।

তবে ঠাকুরদের আদি নিবাস যশোহর খাঁটি পূর্ববঙ্গ না হলেও ’৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে এই বঙ্গেরই অংশ। সে হিসেবে রবীন্দ্রনাথের আদি নিবাস এই বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথদের পূর্বপুরুষ ‘পঞ্চানন (ঠাকুর) জ্ঞাতিকলহে দেশ ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় উপস্থিত হন।’ সেটা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ, অর্থাত্ জোব চার্নকের কলকাতা নগর পত্তনের সমসাময়িক কাল। সেই থেকে পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি তাঁদের ঠিকানা।

রবীন্দ্রনাথ বিয়েও করেছিলেন যশোহর থেকে, যদিও তাঁর শ্বশুরের বাস ছিল খুলনায়, দক্ষিণ ডিহিতে।

পূর্বপুরুষের বা আত্মীয়তার যোগ কখনো গভীরভাবে তাঁকে বাঁধতে পারেনি। বরং জমিদারি-সূত্রে বারবার যাতায়াতের ফলে পূর্ববঙ্গের পল্লিপ্রকৃতি ও পল্লিজীবনের সাথে তাঁর নাড়ির যোগ তৈরি হয়। নদীবিধৌত প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় প্রাণোচ্ছল রূপ তাঁকে মুগ্ধ করেছে আর তারই কোলে প্রবহমান জীবনের খুঁটিনাটি তাঁর জীবনবোধ ও দর্শনকে করেছে সমৃদ্ধ। সংবেদনশীল স্রষ্টাশিল্পীর মন বিচিত্র ধারায় আপন উপলব্ধিকে অপরূপে রূপায়িত করেছে শিল্পের নানা ধারায় বিচিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে।

১৮৮৮ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর বারবার তিনি জমিদারিতে এসেছেন, জমিদারি দেখার চেয়ে মনের ক্লান্তি কিংবা দেহের অবসাদ কাটানোর জন্যই তিনি ছুটে এসেছেন শিলাইদহ, পদ্মা, শাহজাদপুর, যমুনা, পতিসর, সোরাই, আত্রাই, চলনবিল। ১৯৩৭ সনে শেষবার পুণ্যাহ উপলক্ষে জমিদারি ঘুরে যান তিনি। তবে ১৯১৯ থেকে তিনি জমিদারির দায়িত্বের বাইরে বিশ্ববরেণ্য কবি ও বাঙালি সারস্বত সমাজের অগ্রনায়ক হিসেবে পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলায় নানা উপলক্ষে এসেছেন। ১৯০৭ সালে একবার চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সেবারে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা ও চাঁদপুর হয়ে আগরতলা যান। পরে সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী সফর করেছেন। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের সপ্তাহব্যাপী ঢাকা সফরের বিস্তারিত বর্ণনা আছে চিন্তাবিদ আবুল ফজলের আত্মজীবনী রেখাচিত্র-তে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পূর্ববঙ্গের অগ্রসর চিন্তার মুসলিম তরুণের মনে রবীন্দ্রনাথ কতটা গভীর রেখাপাত করেছিলেন, কী ব্যাপক আগ্রহ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে তারা গ্রহণ করেছিল, সেটা বোঝা যায় কবির সফরের আট পৃষ্ঠাব্যাপী উচ্ছ্বাসপূর্ণ অনুপুঙ্খ বর্ণনায়। সান্ধ্যসূর্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো কবির বক্তৃতা শুনতে শুনতে আবুল ফজলের মনে হয়েছে, ‘যে সূর্যের তখনকার কিরণের সঙ্গে তাঁর গায়ের রঙ একাকার হয়ে মিশে গেছে, সে সূর্যের দিকে চেয়ে, তার অস্তগমনের সঙ্গে নিজের অস্তগমনোন্মুখ জীবনের তুলনা দিয়ে এক অতুলনীয় ভাষায় বক্তৃতা শুরু করলেন তখন বিপুল জনতা কবি-মুখ-নিঃসৃত ভাষার সৌন্দর্যে ও কণ্ঠের মাধুর্যে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।’

২.

পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি এবং জীবনের চালচিত্র তাঁকে কীভাবে মুগ্ধ ও সমৃদ্ধ করেছিল, তার কিছু নমুনা তাঁরই লেখা থেকে চয়ন করা যাক।

আবারও ছিন্নপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি:

... দেখতে দেখতে কোথায় এক জায়গায় দুই ধারের ডাঙা উঁচু হয়ে উঠল, জলে স্থলে ভাগ হয়ে গেল—মাঝখানে নদী, দুই ধারে তীর, তীরে অঘ্রাণ মাসের হলদে ধানের ক্ষেত, উঁচু পাড়ের উপর এক মনে ঘাড় হেঁট করে গরু চরছে এবং তাদেরই মুখের গ্রাসের কাছাকাছি শালিখ পাখি নৃত্য করতে করতে কীট শিকারে প্রবৃত্ত—দ্বীপের মতো এক-এক খণ্ড উচ্চভূমির উপর গুটিকতক কলাগাছ এবং কুলগাছের মধ্যে কুষ্মাণ্ডলতার সমাকীর্ণ গুটি—দুই-তিন খোড়ো ঘর, তারই অঙ্গনে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ দুই শিশু এবং কৌতূহলী বধূগণ বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার বোট নিরীক্ষণ করছে—সাদা-কালো রঙের পাতিহাঁস জলের ধারে দল বেঁধে ঠোঁটের খোঁচা দিয়ে শশব্যস্তে পিঠের পালকগুলি পরিষ্কার করছে—দূরে বাঁশঝাড় এবং ঘন তরুশ্রেণী দিগন্ত অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে—খানিকটা দূরে দুই ধারে শূন্য মাঠ—আবার হঠাত্ এক জায়গায় ছেলেদের চেঁচামেচি, স্নানার্থিনী মেয়েদের কলহাস্যালাপ, শোকাতুরা প্রৌঢ়ার বিলাপধ্বনি, কাপড় কাচার ছপছপ—স্নানাভিহত জনের ছল্ছল্ শব্দ শুনে মুখ তুলে দেখি ঘনচ্ছায়া গ্রামের ধারে একটি ঘাট এসেছে। গোটা দুয়েক নৌকো বাঁধা আছে এবং অনিচ্ছুক রোরুদ্যমান ছেলের নড়া ধরে তার মা জোর করে স্নান করাচ্ছে।১০

ছিন্নপত্র থেকেই আমরা জানতে পারি, পল্লিবাংলার প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতা কীভাবে তাঁর ছোটগল্পে কাজে লাগছে, প্রকৃতির উদার সান্নিধ্য তাঁর অবকাশকেই বা কীভাবে মহত্ গভীরভাবে সমৃদ্ধ করে কখনো কবিতায় কখনো গানে প্রকাশ পেয়েছে। গল্পগুচ্ছ-এর অনেক গল্পেই পূর্ববঙ্গের প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। ‘পোস্টমাস্টার’, ‘ছুটি’, ‘সমাপ্তি’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘অতিথি’, ‘বোষ্টমী’, ‘দেনাপাওনা’, ‘গিন্নী’, ‘তারাপ্রসন্নের কীর্তি’, ‘ব্যবধান’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ এমনি অনেক গল্পের কথা বলা যায়।

সুজলা সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের গ্রামে বর্ষার আগমন কী রাজসিক, তার বর্ণনা জানা যাক ‘অতিথি’ গল্প থেকে:

আকাশে নববর্ষার মেঘ উঠিল। গ্রামের নদী এতদিন শুষ্কপ্রায় ছিল, মাঝে মাঝে কেবল এক একটা ডোবায় জল বাধিয়া থাকিত; ছোটো ছোটো নৌকা সেই পঙ্কিল জলে ডোবানো ছিল এবং শুষ্ক নদীপথে গরুর গাড়ি চলাচলের সুগভীর চক্রচিহ্ন ক্ষোদিত হইতেছিল—এমন সময় একদিন পিতৃগৃহ-প্রত্যাগত পার্বতীর মতো, কোথা হইতে দ্রুতগামিনী জলধারা উচ্চৈস্বরে নৃত্য করিতে লাগিল। অতৃপ্ত আনন্দে বারম্বার জলে ঝাঁপ দিয়া দিয়া নদীকে যেন আলিঙ্গন করিয়া ধরিতে লাগিল। কুটিরবাসিনীরা তাহাদের পরিচিত প্রিয়সঙ্গিনীকে দেখিবার জন্য বাহির হইয়া আসিল—শুষ্ক নির্জীব গ্রামের মধ্যে কোথা হইতে এক প্রবল বিপুল প্রাণহিল্লোল আসিয়া প্রবেশ করিল।১১

কবিতার প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই মনে পড়ে যাবে ‘সোনার তরী’র কথা। শিলাইদহে বোটে বসে কবিতাটি রচনা করেছিলেন তিনি। ফাল্গুন মাসে কবি লিখেছেন, ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’—স্থান ও পাত্রের কেমন সংযোগ হলে কালের বাস্তবতাকে ছাপিয়ে উঠতে পারে ভাবলোক! প্রথম জীবনের উল্লেখযোগ্য অনেক কবিতারই রচনাস্থান পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ—তাঁদের জমিদারি। শাহজাদপুরে বসে তিনি লিখেছেন ‘দুই পাখি’, শিলাইদহে বোটে লিখেছেন ‘মানসসুন্দরী’, ‘পুরস্কার’ শাহজাদপুরে, ‘বিদায় অভিশাপ’ লিখেছেন কালীগ্রামে, ছিন্নপত্র-এ উল্লেখ পাই জলপথে যেতে যেতে বোটে বসে ‘উর্বশী’ রচনার কথা, ‘আষাঢ়’ (নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে), ‘কৃষ্ণকলি’, ‘আবির্ভাব’, ‘নববর্ষ’সহ ক্ষণিকার অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন শিলাইদহে।

১৩০০ সালের আষাঢ় মাসে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে ‘বড়ো বেদনার মতো’ গানটি কীভাবে ধীরে ধীরে সুরসহযোগে রচিত হয়েছে, সে কথা লিখে জানালেন—‘এখানে আমি একলা খুব মুগ্ধ এবং তদ্গত চিত্তে অর্ধ্বনিমীলিত নেত্রে গেয়ে থাকি, এবং জীবন ও পৃথিবীটা একটি সূর্যকরোজ্জ্বল অতি সূক্ষ্ম অশ্রুবাষ্পে আবৃত হয়ে সাতরঙা ইন্দ্রধনুরেখায় রঞ্জিত হয়ে দেখা দেয়—প্রতিদিনের সত্যকে চিরদিনের সৌন্দর্যের মধ্যে তর্জমা করে দেওয়া যায়, দুঃখ-কষ্টও আভাময় হয়ে ওঠে।’১২

জীবন ও জগত্ বেদনার আলোয় কবির চিত্তে উদ্ভাসিত হয়ে সত্যের সুন্দর ভাষ্য রচনা করেছে সংগীতে। কত অসাধারণ সব গান এখানে রচনা করেছেন তিনি! এর কয়েকটি স্মরণ করি—‘আমি কেমন করিয়া জানাব’, ‘একমনে তোর এক তারাতে’, ‘তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার’, ‘অন্তর মম বিকশিত কর’, ‘তুমি নব নব রূপে’, ‘গায়ে আমার পুলক লাগে’, ‘যাত্রী আমি ওরে’, ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’, ‘বসন্তে কি কেবল’, ‘কে গো তুমি বিদেশিনী’, ‘যেদিন ফুটল কমল’, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, ‘কোলাহল তো বারণ হল’, ‘ঝরে যায় উড়ে যায় গো’, ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে’, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’, ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’, ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে’, ‘এ পথ গেছে কোনখানে গো’—এমনি আরও অসংখ্য গান এবং রাজা ও অচলায়তন-এর মতো সংগীত-সমৃদ্ধ নাটকও তিনি লিখেছেন পূর্ববঙ্গের জমিদারিতে, কখনো কুঠিবাড়িতে বসে, কখনো বা বোটে ভেসে। এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় সংগীতের কথাও যেন না ভুলি। রবীন্দ্রস্নেহধন্য শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন—‘“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটি তিনি রচনা করেছেন গগন হরকরার রচনা “আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে/হারায়ে সে মানুষে তার উদ্দিশে দেশ বিদেশে আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে” গানটির সঙ্গে মিলিয়ে।’১৩

৩.

১৯০৫ সালে রচিত এই গানের প্রথম দশ পঙিক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে গৃহীত হয়েছে। এই গানে বাংলা দেশমাতৃকা; মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, অঙ্গীকার ও চিরবন্ধনের প্রকাশ ঘটেছে এতে। আমাদের জাতীয় সংগীতের অংশটুকুতে একবার চোখ বুলিয়ে নেব আমরা:

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি

            ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,

                        মরি হায়, হায় রে—

ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি

                        কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—

                        কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।

মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,

                        মরি হায়, হায় রে—

মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি

পুরো গানটি জুড়ে যে প্রকৃতি বর্ণিত-চিত্রিত হয়, তা কবির অতিপরিচিত অতিপ্রিয় পদ্মাপারের পূর্ববঙ্গের পল্লিরূপ।

কিন্তু হঠাত্ এই ব্যগ্রতা, এই আকুলতা নিয়ে দেশমাতার রূপ বর্ণনা আর গুণ গাইতে ব্যস্ত হলেন কেন কবি? বিষয়টা আমাদের জানা। ঔপনিবেশিক ইংরেজ তার শাসনদণ্ড মজবুত করার জন্য এবং হিন্দু-মুসলমান বাঙালির মধ্যে স্বার্থের বিভেদ উসকে দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দিয়েছে তখন। এই ঘোষণার মধ্যে ঔপনিবেশিক শক্তির চাতুরী এবং বাঙালির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সর্বনাশা পরিণতি দেখে কবির সংবেদনশীল মন দারুণভাবে বিচলিত হয়েছে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় কবি প্রায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এতকাল জমিদারির গ্রামগুলি ছিল তাঁর ভাবজগতের বিষয়—শান্ত, সুন্দর, সুদূর। প্রকৃতি এবং প্রকৃতিরই সন্তান গ্রামের মানুষ ও তাদের সংসার থেকে জীবন ও জগত্ সম্পর্কে তাঁর মননে-মনে নানা ভাব ও ভাবনার খোরাক এসেছে। তিনি মন ভরে হাত খুলে লেখনী চালিয়েছেন। কিন্তু এবারে দেশ ও মানুষের ভবিষ্যতের সংকট তাঁকে ভাবিত ও বিচলিত করেছে। এতকালের ভাবলোক থেকে দেশ বাস্তবের মূর্তিমান সংকট রূপে আবির্ভূত হলো। তাঁর শিল্পচেতনার দেশ যেন ছিল কল্পলোকের সুন্দর, যেন আর্থরাজনীতির আস্ফাালনের মুখে তা রূপ নিল রাষ্ট্রভাবনায়। বাঙালির এক প্রাণ এক জাতি হিসেবে বিকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন কবি তীব্রভাবে।

এই পর্বে তাঁর মনের আকুতিময় অনুভূতি তীক্ষভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে গানে, তা শেষ হয়েছে এই কামনাটুকু ব্যক্ত করে:

বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন

এক হউক, এক হউক, এক হউক, হে ভগবান।

একসময় প্রকৃতির প্রাণোচ্ছল-সম্পন্ন সৌন্দর্যের পটভূমিতে চলমান জীবনের সত্যকে আবিষ্কার ও রচনা করেছিলেন কবি, এবারে চলার পথে বিদেশি প্রভুর তোলা বাধার সম্মুখীন হয়ে কূটকদর্য বাস্তবের ভিতর থেকে চিরায়ত সত্যের সুন্দরকে খুঁজতে বসলেন। স্বদেশ পর্যায়ের গান বাঁধলেন অনেক, জাতিকে জাগাতে আর অনুপ্রাণিত করতে লিখলেন অনুপ্রেরণাদায়ী গদ্য।

‘রাখিবন্ধন’ উত্সব প্রবর্তন করে হিন্দু-মুসলিমে সম্প্রীতি ও সান্নিধ্যের সুযোগ তৈরি করতে চাইলেন। নিজে পথে নামলেন, সাধারণ মুসলিম প্রবীণের হাতে রাখি পরালেন, মিছিলের পুরোভাগে থেকে গাইলেন—‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’।

তাঁর অন্তর্যামী সেদিন হয়তো অলক্ষ্যে মুচকি হেসেছিল।

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাঙালির এই প্রথম জাতীয়তাবাদী জাগরণের পেছনে রবীন্দ্রনাথ যে প্রেরণা দিয়েছেন, তা বঙ্গভঙ্গ রদে বা মূল আন্দোলনকে বেগ দিতে কার্যকর না হলেও বাঙালির স্বদেশ-সাধনায় ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে সুদূরপ্রসারী হয়েছে এর প্রভাব। তাঁর এবং অন্যদের তখনকার ভূমিকা বাঙালি মুসলমানকে উদ্বুদ্ধ করেনি, বরং বঙ্গভঙ্গকে নিজ স্বার্থের অনুকূল মনে হয়েছে অভিজাত মুসলমানের। রবীন্দ্রনাথ কখনোই উগ্র জাতীয়তাবাদ পছন্দ করেননি, বিলেতি পণ্য বর্জনের নীতির প্রতিও তাঁর সমর্থন ছিল না।

আন্দোলনের উগ্রতা আর উন্মাদনার বাড়াবাড়ি আঁচ করে বছরের শেষে ডিসেম্বরে রচিত পুস্তিকা শিক্ষার আন্দোলন-এর ভূমিকায় তিনি লিখলেন— ‘উত্তেজনায় কাজ হয় না। ... ভিত্তি হইতে আরম্ভ করিতে হইবে। ছোট হইতে বড়ো হইতে হইবে।’১৪ এবং কবিতায় লিখলেন—‘বিদায় দেহ, ক্ষম আমায় ভাই, কাজের পথে আমি যে আর নাই।’১৫জাতীয়তাবাদের উগ্রতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বন্ধু সন্দীপের যুক্তি খণ্ডান সৌম্য ঋতবান নিখিলেশ যে ঋজুভাষ্যে, তার অন্তর্নিহিত ভাব তো স্বয়ং লেখকের—‘আমি তোমাকে সত্য বলছি সন্দীপ, দেশকে দেবতা বানিয়ে যখন তোমরা অন্যায়কে কর্তব্য, অধর্মকে পুণ্য বলে চালাতে চাও, তখন আমার হূদয়ে লাগে বলেই আমি স্থির থাকতে পারি নে।’১৬ তবে এই হলো দেশকে ভালোবাসার ও দেশোদ্ধারের প্রক্রিয়ার কথা।

কিন্তু বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে স্বদেশি ভাবনায় রবীন্দ্রমানস ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, তা ছিল অখণ্ড বাংলাকে নিয়ে। তারই প্রকাশ ঘটেছে স্বদেশ পর্যায়ের গানে—‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে/সার্থক জনম, মাগো, তোমায় ভালোবেসে’ কিংবা ‘আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!’

৪.

কিন্তু এটি তাঁর দীর্ঘ সাহিত্যজীবন ও সংগীত সাধনার একটি সাময়িক অনুষঙ্গ, স্বল্পস্থায়ী ছোট পর্ব। তবে হ্যাঁ, সাময়িক হলেও তাঁর বোধের দিক থেকে গভীর আর বাঙালি চিত্তে প্রভাবের দিক থেকে সুদূরপ্রসারী ছিল এই অনুষঙ্গ ও এই পর্ব। তাঁর জাতি ও রাষ্ট্রভাবনার উদ্গম, বিকাশ ও উত্তরণের ইতিহাস ঘাঁটলেও এর সত্যতা মিলবে।

আমরা জানি, উনিশ শতকে যে হিন্দুমেলাকে ঘিরে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। প্রবোধচন্দ্র সেন জানাচ্ছেন, ‘সেকালে ঠাকুর পরিবারেও এই হিন্দু জাতীয়তার হাওয়া প্রবল ছিল। হিন্দুমেলা ও জাতীয়সভা স্থাপনের মূলে ছিল ঠাকুর পরিবারেরই সহায়তা ও সমর্থন।’১৭ হিন্দুমেলা বা জাতীয়সভার প্রথম দুই সম্পাদক ছিলেন ঠাকুরবাড়ির গণেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের পরম শ্রদ্ধেয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ।

স্বভাবতই কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনেও এই আদর্শের প্রভাব পড়েছিল। চৌদ্দ বছর বয়সে রচিত ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ কবিতায় স্বাধীন ভারতে রাম-রঘুপতি শাসিত প্রাচীন হিন্দু স্বর্ণযুগ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তবে এই মুগ্ধতার বীজ তাঁকে ভারতপথিক হতে সহায়তা করেছে। পরিণত বয়সে তাঁর মধ্যে যে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটেছে, তা বাংলাকেন্দ্রিক নয়, ভারতমুখী। আর এই ভারতমুখিতাই আবার তাঁর মধ্যে প্রথম জীবনের সংকীর্ণ ভাবাদর্শ কাটাতে সাহায্য করেছে। যেমন, ‘তিনি এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে শক-হুন পাঠান-মোগল উত্কল-দ্রাবিড়’ সবার মিলনকে স্বাগত জানিয়েছেন, তেমনি আবার অনুপুঙ্খে গিয়ে বুঝেছেন যে জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের অবসান ঘটাতে হবে।

তাঁর এই পরিণত মানস-অর্জনের পেছনে তিনজন পূর্বসূরি বাঙালি মনীষীর ভূমিকা স্বীকার করতে হবে—রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাঙালি মনীষীদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রকেই ইতিহাসবোধ ও ইতিহাসচেতনার দিক থেকে এগিয়ে রাখতে হবে। হিন্দু জাত্যভিমানের কিছু ন্যায্য সমালোচনা ও কিছু অন্যায় অপবাদের মেঘ সরিয়ে লেখার ভিত্তিতে যাচাই করলে দেখা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর অগ্রণী চিন্তানায়কদের মধ্যে বঙ্কিমই ভারতীয় সভ্যতা যে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ নির্মাণ তা সর্বপ্রথম স্পষ্টভাবে বলেছেন—‘বাঙ্গালা হিন্দু-মুসলমানের দেশ, একা হিন্দুর দেশ নহে। বাঙ্গালার প্রকৃত উন্নতির জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে, হিন্দু মুসলমানে ঐক্য জন্মে।’ এ কথাও তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যের মূলে ভাষার একতা।’১৮

পশ্চিমের অধ্যাত্ম চেতনা ও সমাজদর্শন রামমোহন রায়কে প্রভাবিত করেছিল। তিনিই ইউরোপীয় শিক্ষা ও চিন্তার সাথে এ দেশীয় সারস্বত সমাজের সেতুবন্ধের চেষ্টা করেছেন প্রথম। তাঁর সেই সূচনাকর্ম যথার্থই ফলপ্রসূ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ বরাবর রামমোহনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধে লিখেছেন—‘রামমোহন রায় যে পশ্চিমের ভাবকে আত্মসাত্ করিতে পারিয়াছিলেন তাহার প্রধান কারণ পশ্চিম তাঁহাকে অভিভূত করে নাই, তাঁহার আপনার দিকে দুর্বলতা ছিল না। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠাভূমির উপর দাঁড়াইয়া বাহিরের সামগ্রী আহরণ করিয়াছিলেন। ভারতবর্ষের ঐশ্বর্য কোথায় তাহা তাঁহার অগোচর ছিল না এবং তাহাকে তিনি নিজস্ব করিয়া লইয়াছিলেন। এই জন্যই যেখান হইতে যাহা পাইয়াছেন তাহা বিচার করিবার নিক্তি ও মানদণ্ড তাঁহার হাতে ছিল। কোনো মূল্য না বুঝিয়া তিনি মুগ্ধের মতো আপনাকে বিলাইয়া দিয়া অঞ্জলি পূরণ করেন নাই।’১৯ আর বিদ্যাসাগর সম্পর্কে প্রথমেই মনে পড়ে যায় মাইকেলের অবিস্মরণীয় মূল্যায়ন: ‘প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের মত প্রজ্ঞা, আধুনিক ইউরোপীয়দের মত সাহস ও বাঙ্গালী মায়ের মত হূদয়।’ এর সঙ্গে যোগ করতে চাই রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন—‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’২০ রবীন্দ্রনাথ জানতেন বাঙালির স্বভাবের বাগাড়ম্বর ও আলস্য, পরচর্চা ও পরশ্রীকাতরতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার মূর্তিমান এক বিপরীত বিপ্লবী চরিত্র ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই সব চিন্তানায়কের লেখনী ও কর্ম আর নিজের ভাবনা ও সৃজনশীলতার পথ বেয়ে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছালেন হিন্দু-মুসলিমের মিলিত ভারতবর্ষীয় রাষ্ট্র ও সমাজসাধনায়।

৫.

পরাধীন দেশে স্বাধীনতার ভাবনা খুবই প্রাসঙ্গিক, আর সেই সূত্রে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতা, সমাজের স্বাধীনতা এবং জাতির স্বাধীনতা নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাবুক ও কবির ধারাবাহিক ভাবনার নান্দনিক প্রকাশ আমরা পেয়েছি। এতে যেমন বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি বাঙালির জাতীয় অগ্রযাত্রার পথনির্দেশও তাতে মেলে। আমরা সেটি নিতে পেরেছি কি না, সে প্রসঙ্গ বাংলাদেশের আলোকে বুঝে দেখার চেষ্টা করব আমরা।

১৯৪৭-এ উপমহাদেশ থেকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বিদায় নেয় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে দুটি স্বাধীন দেশ ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হয় দেশভাগের, বিশেষত পশ্চিমে পাঞ্জাব আর পুবে বাংলা বিভাজনের মধ্য দিয়ে। দেশভাগ ব্রিটিশ আমলা সিরিল র্যাডক্লিফের প্রণীত মানচিত্র অনুসারে হয়েছে, তাতে কোটি মানুষের জীবনে বয়ে আনল মর্মান্তিক ভয়ংকর ট্র্যাজেডি আর উপমহাদেশের ইতিহাসকে করে রাখল ভাগ্যবিড়ম্বিতের ক্ষুব্ধ সত্তার আবেগের কাছে বিপন্ন, জাতীয় জীবন হয়ে রইল অনিশ্চয়তার ঘোলাটে হাওয়ায় দিশেহারা, অস্থির। এরই রেশ ধরে ইতিহাসের পথ পাড়ি দিয়েছে পূর্ব বাংলার সচেতন মানুষ। সেই অভিযাত্রায় তারা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। অথচ যাত্রাটা শুরু হয়েছিল উল্টো পথে।

১৯৪৬-এর গণভোটে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভেঙে মুসলমানের দেশ পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে একাট্টা হয়ে রায় দিয়েছিল। ১৯৪৫ ও ’৪৬-এ অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম আসনে একমাত্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া সর্বত্র বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে মুসলিম লীগ ও নেতা জিন্নাহ এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সক্ষম হয়েছিল—জিন্নাহর মুসলিম লীগই যে ভারতীয় মুসলমানদের যথার্থ বৈধ প্রতিনিধি, সেই স্বীকৃতির পক্ষে অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন এবং পাকিস্তান দাবির যাথার্থ্য প্রতিষ্ঠা।

দীর্ঘ রাজনৈতিক কূট-সংগ্রাম চালিয়ে একটি মানচিত্র আদায় করা সম্ভব হলেও তার আবশ্যিক শর্ত জাতি, রাষ্ট্র এবং এমনকি দেশ গঠন সহজ কাজ নয়, কারণ এসবের উপাদান ইতিহাসে, সংস্কৃতিতে এবং জীবনে এমন ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকে যে সেখানে জবরদস্তি চলে না, কূটকৌশল খাটে না। বাংলায় সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মনে বর্ণহিন্দুর জাত্যভিমানজাত উপদ্রব এবং শিক্ষা ও উপার্জনের শ্রেয়তার জন্য তাদের অগ্রবর্তিতার কারণে গভীর ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েই জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে ধর্মীয় জাগরণের উপাদান ছিল বেশ গভীর ও সজীব এবং পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার জের ধরে তা উত্তরোত্তর উত্তেজক তপ্ত আবহ তৈরি করেছিল। ফলে সাধারণ শিক্ষিত হিন্দু ভারত ভাগ বা পাকিস্তানের উদ্ভব ঠেকানোর গরজ বোধ করেনি আবার পাকিস্তানে থাকার ভরসাও পায়নি। আর সাধারণ মুসলিম তাদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রকে উদ্দীপনার সাথে স্বাগত জানিয়েছে, তাতে বাঙালি মুসলিম ব্যতিক্রম ছিল না বরং অগ্রণী ভূমিকাই নিয়েছিল। অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এর স্রষ্টা জিন্নাহকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাগিদে নিজের এত দিনকার বক্তব্য ও অবস্থান খারিজ করে দিয়ে পাকিস্তানিদের একটি জাতিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতে হয়। ১৯৪৭ সালে গণপরিষদে প্রদত্ত জিন্নাহর বহুল আলোচিত ভাষণটি এখানে আর উদ্ধৃত করছি না। কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি ধর্মাচরণ নিয়েও দেখা দেয় বিভেদ, তার ওপর একদিকে ছিল উচ্চতর শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর অন্যদিকে সদ্য বিদায়ী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের এবং তার নব্য দোসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ উপমহাদেশভিত্তিক ভবিষ্যত্ পরিকল্পনার অংশীদার থাকার চাপ। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিভ্রান্তিকর টানাপোড়েন ও দুর্বলতার মধ্যেই পূর্ব বাংলা ভাষার প্রশ্নে খোদ গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ তথা কেন্দ্রীয় সরকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি চেতনার শিকড় কত গভীর হয় এবং বিকাশের দিক থেকে এ যে নাড়ির যোগ, তা আঘাত আসার আগে বাঙালিও বুঝতে পারেনি। তবে পাকিস্তান হওয়ার আগে বাঙালির পরিচয়, ভাষার প্রশ্ন নিয়ে কিছু লেখালেখি যে হয়নি তা নয়। এস ওয়াজেদ আলী ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ প্রবন্ধে (১৯৩০) ভাষা-সংস্কৃতিগত স্বকীয়তা ও ঐক্যের কারণে বাঙালির স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, ‘গৌরবময় ভবিষ্যতের চিন্তাই হল বাঙালির দেখবার মতো স্বপ্ন; এই গৌরবময় ভবিষ্যতের চিন্তাই হল বাঙালির মনের উপযুক্ত চিন্তা, আর এই গৌরবময় ভবিষ্যতের জন্য সাধনাই হল বাঙালির শক্তির উপযুক্ত সাধনা!’ সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করতে ভোলেননি যে এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ও সাধনাকে সার্থক করতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ‘হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য’।২১

১৯৩২ সালে নজরুল নবযুগে লিখলেন ‘বাঙালীর বাংলা’। তাতে স্বভাবসিদ্ধ চড়া সুরেই বললেন—‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও—এই পবিত্র বাংলাদেশ/বাঙালীর—আমাদের... বাংলা বাঙালীর হোক বাংলার জয় হোক! বাঙালীর জয় হোক।’২২ পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ভাষার প্রশ্নে বিরোধ ও বিতর্কের ফলে সৃষ্ট তপ্ত আবহের মধ্যে বহুভাষাবিদ পণ্ডিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে আরও স্পষ্ট ও ব্যাপ্তভাবে প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।’২৩

এর বিপরীতে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যের দাবি নিয়ে ভাষা ও সংস্কৃতির আমূল সংস্কার করে ইসলামীকরণের চাপ দিয়ে গেছেন একদল বুদ্ধিজীবী ও লেখক। মওলানা আকরম খাঁ, গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ফররুখ আহমদ এই ধারার অগ্রণী কয়েকজন। এই ধারাটি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে এবং বিরোধ সূচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এঁরা রাষ্ট্রের সহযোগিতায় পাঠ্যবই, পত্রপত্রিকা, বেতার, তথ্য বিভাগসহ নানা সরকারি দপ্তরের মাধ্যমে রীতিমতো সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করে দিলেন। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারেননি যে প্রতাপশালী রাষ্ট্রযন্ত্র পক্ষে থাকলেও জনগণের আদালতে তাঁদের মামলা খারিজ হতে বাধ্য, কারণ ভাষা ও সংস্কৃতি মানুষের প্রাণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়। ধর্ম বা রাজনীতির সাম্প্রতিক চাহিদার কাছে তা নতিস্বীকার করবে না, যদি সেটা হয় আরোপিত, কৃত্রিম।

যে বিরোধের প্রকাশ ঘটেছিল কার্জন হলে, মুষ্টিমেয় শিক্ষিতজনের সামনে, তা দ্রুত পূর্ববঙ্গের জনজীবনে ছড়িয়ে পড়ল। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে তার স্বাতন্ত্র্যের দাবির ন্যায্যতা প্রমাণের জন্যই স্বতন্ত্র পাকিস্তানি তমদ্দুন তৈরির তাগাদা পূরণ করতে হচ্ছিল। নয়তো কেন দেশভাগ, কেন পাকিস্তান—এই প্রশ্নগুলো উত্কটভাবে দেখা দেবে। ফলে পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্নে জবরদস্তির পথ ধরল, যা সংগত কারণেই সচেতন বাঙালির মনে হলো—হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলা যায়—‘পাকিস্তানি রাজনীতির সারকথা হলো বাঙালিদের আহত ও পঙ্গু করা।’২৪

পাকিস্তান সৃষ্টির পাঁচ বছরের মধ্যে বাঙালি মানসের রূপান্তর লক্ষণীয়ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। একদিন যারা ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল, তারাই আজ ভাষা-সাংস্কৃতিক চেতনায় সঞ্জীবিত হয়ে সেই পাকিস্তানকে চ্যালেঞ্জ জানাতে মাঠে নামতে শুরু করল। বায়ান্ন থেকে সূচিত বাঙালি মুসলমানের আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মবিকাশের এই সংগ্রাম যতই ব্যাপ্ত রূপ নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে ও রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে অনিবার্য সংঘাতে মুখোমুখি হচ্ছিল, ততই এই পক্ষকে নামতে হয়েছে আত্মপরিচয় সন্ধানে আর খুঁজে নিতে হয়েছে আত্মবিকাশের উপযুক্ত রসদ।

আমরা লক্ষ করি, পূর্ব বাংলায় গত শতকের পাঁচের দশক থেকে রবীন্দ্রচর্চায় আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। সংগীতসাধনা ও সংস্কৃতিচর্চা এবং গবেষণা ও প্রবন্ধসাহিত্যে এর প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। কারণ, কী আত্মপরিচয়, কী আত্মবিকাশ—উভয় ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পুষ্টি আর কে জোগাতে পারবে বাঙালিকে—তাঁর ধর্মবিশ্বাস যা-ই হোক।

পাঁচের দশক থেকেই ছোট পরিসরে, সীমিত আয়োজনে রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রসাহিত্যের চর্চা প্রকাশ্যে শুরু হয়। এই সময়ে চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পটভূমিতে বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা এবং নৃত্যনট বুলবুল চৌধুরীর অকালপ্রয়াণে তাঁর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ঢাকা বেতারকেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তত্পরতা এবং কলকাতা থেকে সুগায়ক কলিম শরাফী ও রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষক ভক্তিময় দাশগুপ্তের আগমন ইত্যাদি মিলে রবীন্দ্রচর্চার সীমিত কিন্তু স্বাস্থ্যকর সূচনা হয়। এরই জের ধরে ১৯৬১ সালে আইউবের সামরিক স্বৈরশাসনের অচলায়তন ভেঙে ঢাকা-চট্টগ্রামে রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা শিক্ষিত বাঙালির মনে নতুন উদ্দীপনার জোয়ার বয়ে আনে।

১৯৮৭ সালে এক বিস্তারিত সাক্ষাত্কারে প্রদত্ত ঢাকা কমিটির সম্পাদক অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদের বক্তব্য সেদিনের শিক্ষিত বাঙালির আবেগ ও চেতনাকে বুঝতে সাহায্য করবে। তিনি বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের বর্ণাঢ্য বিচিত্রমুখী অবদান বাঙালি সত্তাকে ঋদ্ধ করেছে। পাকিস্তানি হয়েও আমরা তাঁর অংশীদার। সুতরাং সে মহত্ সাহিত্য আমার। এবং আমার উত্তরাধিকারীকে আমি তা থেকে বঞ্চিত হতে দেব কেন? নিষেধ কেন? অন্যায় নিষেধ, বিশেষ করে স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রণ সহ্য করা, অমার্জিত কল্পনাহীন অহংকারের হুকুম তামিল করা আমার পক্ষে অসহনীয় ছিল।’২৫

এ সময় পাবনা-ময়মনসিংহসহ আরও কোনো কোনো জেলা শহরেও রবীন্দ্রজয়ন্তী আয়োজিত হয় জাঁকজমকের সঙ্গে। সরকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, আগে-পরে উদ্যোক্তাদের ভয় দেখানোর কৌশলও নিয়েছিল। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার কান্ডারি হয়ে ওঠা সন্জীদা খাতুন জানাচ্ছেন, ‘অনুষ্ঠানের (শতবার্ষিকী) আগে আগে উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদককে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল আর সভাপতি বেগম সুফিয়া কামালকে তলব পেয়ে যেতে হয়েছিল চিফ সেক্রেটারির কাছে—কৈফিয়ত্ দিতে।’২৬

কিন্তু তত দিনে শিক্ষিত বাঙালির অন্তর বাঙালি হিসেবে আত্মবিকাশের প্রেরণায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। ফলে পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের সব বাধা—বেতারে-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তাঁর রচনার গুরুত্ব হ্রাস করা—কেবল প্রতিরোধের শক্তিকেই উসকে তুলেছে। তাই আমরা দেখি, ষাটের দশকজুড়ে রবীন্দ্রচর্চার প্রসার ঘটেছে—শতবার্ষিকীর পর পর ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের প্রতিষ্ঠা এ দেশে রবীন্দ্রচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করে। এ সময় রবীন্দ্রবিষয়ক গবেষণা ও প্রবন্ধের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।২৭তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, জাতীয় পর্যায় থেকে পাড়া পর্যায়ে পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের কথা—সংগীত প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে আয়োজনের বহর দিন দিন বেড়েছে, বেড়েছে রবীন্দ্রসংগীতচর্চা ও এর রসজ্ঞ শ্রোতার সংখ্যা।

পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির জাগরণ আরও স্পষ্ট, ব্যাপ্ত ও তীব্র হয়ে উঠছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছয় দফার সংগ্রাম যখন ’৬৭-৬৮-৬৯ সাল নাগাদ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধিকার ও এক দাবি স্বাধীনতায় রূপ নিচ্ছিল, তখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় পুষ্টি জুগিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। চিন্তাবিদ সনত্ সাহা তাই বলেন, ‘এ দেশে গত ষাটের দশকে বাঙালিচিত্তে মানবতার উদ্বোধন ঘটেছিল তাঁর প্রেরণায়। নৌকায় পাল খাটিয়ে তাঁকেই বেঁধেছিলাম আমরা মাস্তুলে।’২৮

জাতীয় জাগরণের এই পর্বে মুসলিম জাতীয়তাবোধের বিপরীতে জায়মান অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার রাজনীতিকে বেগবান করা ও ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদও জোরালো হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বেতার-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিলে এর বিপক্ষে শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গন থেকেই কেবল জোরালো প্রতিবাদ ওঠেনি, খোদ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকেও প্রতিবাদী বক্তব্য আসছিল। এ ব্যাপারে বর্ষীয়ান নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা ছিল স্পষ্ট এবং অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে তিনি যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে পূর্ববঙ্গের মুসলিম-মানসের পরিবর্তনের স্বরূপটিও বোঝা যায় পরিষ্কার। বিবৃতিতে তিনি বলেন:

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য, সাহিত্য, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক ও উপন্যাস এবং সংগীতের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে নতুন গৌরবে অভিষিক্ত করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের আবেদন সর্বজনীন।

ইসলাম সত্য ও সুন্দরের জয় ঘোষণা করেছে। এই সত্য ও সুন্দরের পতাকাকে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই যাঁরা ইসলামের নামে রবীন্দ্রনাথের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন, তাঁরা আসলে ইসলামের সত্য ও সুন্দরের নীতিতে বিশ্বাসী নন।

তাই আমি এই দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের এই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার আহ্বান জানাচ্ছি।২৯

ছয়ের দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণের সময় শিক্ষিত বাঙালির চিন্তাজগতে রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রভাব ফেলেছিলেন, তার চিত্র মেলে সেলিনা হোসেনের মহাকাব্যিক উপন্যাস গায়ত্রী সন্ধ্যায়। লেখক ও সাহিত্যিক আলী আহমদ এই উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। রবীন্দ্রসংগীত বিতর্ক নিয়ে প্রবন্ধটি লিখতে লিখতে ‘অনেক রাত হয়ে গেলে একসময় আলী আহমদের চিন্তা গাঢ় হতে থাকে। বাঙালি জাতীয়তাবোধ বড় তীব্র হয়ে উঠছে। তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো আপোস নেই।’৩০ তখন এমনটাই ছিল শিক্ষিত নাগরিক বাঙালির চেতনা। বাঙালির ঐক্য ও বাঙালির ভবিষ্যত্ নিয়ে কবির অন্তরের যে আকুতি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় গানে ও প্রবন্ধে প্রকাশ পেয়েছিল, সেই আরব্ধ কাজটি যেন ষাটের দশকের বাংলাদেশ একটু ভিন্ন বাস্তবতায় পরিবর্তিত আঙ্গিকে সম্পন্ন করার দায় হিসেবে কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের গান বাঙালির জাগরণের এই উত্তাল সময়ে ব্যাপকভাবে গীত হয় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এভাবেই বঙ্গভঙ্গের সময়ে রচিত বাউলাঙ্গের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ আমাদের জাতীয় সংগীতের দাবি নিয়ে জনমানসে স্থান করে নেয়।

এখানে বলা দরকার রবীন্দ্রসংগীতের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা। দেখা গেল সাধারণ মানুষ, যার জীবন হতদরিদ্রের নিঃস্বতায় জর্জরিত নয়, একটুখানি মানবিক সুবাতাস গ্রহণের সামান্য অবকাশটুকু আছে, সে যেন রবীন্দ্রনাথের গানে ঠিকই তার মনের পুষ্টি পেয়ে যায়। বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যে বলেন, ‘বাংলার পথে, ঘাটে, হাটে, মাঠে, এমনকি সুদূর নিভৃত পল্লির ঘরে প্রাঙ্গণে তাঁহার গানের সুর বাজিয়া উঠিতেছে।’ কারণ তিনি জানেন, ‘রবীন্দ্রনাথ খাঁটি বাঙালি কবি। রবীন্দ্রনাথের যে সত্যকার কবি-মূর্তি, তাহা সেই বাংলার বৈষ্ণব কবিরই প্রতিচ্ছবি। ... তাঁহার প্রেম ও ধর্মবিষয়ক সংগীতগুলিতে বৈষ্ণবভাব কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় নাই।’৩১ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা’, যা সাধারণের অতি পরিচিত। অধিকাংশ গানের সুরও তাদের নিতান্ত ঘরের জিনিস। আর যেসব গানে স্বদেশি ভাবকে আবেগে ও তেজে রূপ দিয়েছেন, তা যেকোনো বাঙালির মনে দেশপ্রেমের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। যেসব গানে মানবমুক্তির প্রতিজ্ঞা নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে, সেগুলোতেও সংকটকালে প্রতিরোধ ও অভিযাত্রার প্রেরণা পাওয়া যায়। এভাবে ষাটের দশকে বাঙালির জাতীয়তাবাদী জাগরণ, আত্মবিকাশ ও রাষ্ট্রসাধনায় রবীন্দ্রনাথ তার বড় সহায়রূপে পথের দিশারি হয়ে ওঠেন।

আর রবীন্দ্রনাথ নিজে যখন বঙ্গভঙ্গ, অসহযোগ ও বিপ্লব সাধনার রাজনৈতিক ঝঞ্ঝার ভেতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছিলেন, তখন বারবার সমাজ, দেশ, স্বাধীনতা, রাষ্ট্র তাঁর চিন্তাজগেক ব্যস্ত রাখে। এ সময়ে লেখা স্বদেশ, সমাজ, কালান্তর, রাজা প্রজা, ‘স্বদেশী সমাজ’, ‘দেশনায়ক’, ‘পথ ও পাথেয়’ প্রভৃতি নিবন্ধ ও গ্রন্থ থেকে ষাটের দশকে, এমনকি একালেও, বাংলাদেশের মানুষ পথনির্দেশ পায়, এগিয়ে চলার ভাবনাপাথেয় লাভ করে।

৬.

কিন্তু এত আলোচনার পরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়—রবীন্দ্রনাথ কি এই বাংলাদেশ চাইতেন? তিনি বঙ্গভঙ্গে ব্যথিত-ব্যাকুল হয়ে স্বদেশবন্দনায় মেতে উঠেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ‘ভারততীর্থ’ তাঁর দেশধ্যানের আরাধ্য। আর্য-অনার্য, হিন্দু-মুসলমান, ইংরাজ-খ্রিষ্টান, ব্রাহ্মণ-পতিতজন সবাইকে ডাক দিয়েছেন—‘মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, মঙ্গল ঘট হয় নি যে ভরা/সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে—/আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’

মহাজাতি সদনে রবীন্দ্রনাথ বললেন—‘বাংলার যে জাগ্রত হূদয়-মন আপন বুদ্ধির ও বিদ্যার সমস্ত সম্পদ ভারতবর্ষের মহাবেদিতলে উত্সর্গ করবে বলেই ইতিহাসবিধাতার কাছে দীক্ষিত হয়েছে, তার সেই মনীষিতাকে এখানে আমরা অভ্যর্থনা করি। আত্মগৌরবে সমস্ত ভারতের সঙ্গে বাংলার সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য থাকুক, আত্মাভিমানে সর্বনাশা ভেদবুদ্ধি তাকে পৃথক না করুক—এই কল্যাণ ইচ্ছা এখানে সংকীর্ণচিন্তার ঊর্ধ্বে আপন জয়ধ্বজা উড্ডীন রাখে।’৩২

এই সূত্রে আমাদের মনে পড়ে যায় গোরার আত্মবিশ্বাসী উপলব্ধির উচ্চারণ: ‘আজ আমি ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকল জাতই আমার জাত। সকলের অন্নই আমার অন্ন।’৩৩

আর তিনি যখন বলেন, ‘আমি যে শতভাগ একশো হারে বাঙালি নই, আমি যে সমান পরিমাণে য়ুরোপেরও, এই কথাটা প্রমাণ হোক আমার ছবি দিয়ে।’৩৪ তখন তিনি কি ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বরাষ্ট্রের চিন্তায় মেতেছিলেন ভাবব? না, এ আসলে মানবতাবাদী কবির উদার হূদয়ের কল্যাণচিন্তারই বহিঃপ্রকাশ।

১৯৪১ সালে আশি বছর বয়সে জীবনাবসানের কালে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তাঁর যৌবন ও মধ্যবয়সের বিচরণভূমি, সাহিত্য ও সংগীতশিল্পের বীজতলা পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে দুই যুগের ব্যবধানে সেই বঙ্গভঙ্গের ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী জাগরণ এবং তারই ভিত্তিতে ইতিহাসের রক্তাক্ত পথ মাড়িয়ে আর চরম অনিশ্চয়তায় ভরা সব বাঁক ফিরে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বাস্তবতা কল্পনা করাও কঠিন ছিল।

এস ওয়াজেদ আলী সেই ১৯৩০ সালে ভারতবর্ষে ভাষা-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে একাধিক রাষ্ট্রের সম্ভাবনার কথা বলে স্বাধীন বাংলার যে আর্জি তুলে ধরেছিলেন, তাও কিন্তু এই বাংলাদেশ নয়, বৃহত্তর বঙ্গ। আর দেশভাগের  অব্যবহিত পূর্বে শরত্ বসু-সোহ্রাওয়ার্দীদের বাংলাকে এক রাখার শেষ মুহূর্তের ব্যর্থ প্রয়াসের কথাও আমরা জানি।

বায়ান্ন থেকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের দীর্ঘ সংগ্রাম আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার আমাদের অপরাপর বাংলাভাষী অঞ্চল ও সেখানকার অধিবাসীদের কাছ থেকে রাজনৈতিক চেতনায় এবং অধিকারের দিক থেকে আলাদা করে দিয়েছে। বিভাজন বলি কি দূরত্ব বলি, তা ঘুচবে কি না, সেটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। আবারও অনেক উত্থান-পতন ও অনিশ্চয়তায় ভরা অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে জাতি ও ইতিহাস কোন দিকে কতটা বাঁক নেয়, তার ওপর নির্ভর করবে সে পরিণতি।

তবে ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতাযুদ্ধ এ দেশের ইতিহাসের মূলধারা যদি হয়ে থাকে, তবে আমাদের যাত্রাপথের মূল দিশারি থাকছেন রবীন্দ্রনাথ, যদিও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা ছিল ভিন্ন—ভারতকেন্দ্রিক। এই বৈপরীত্যের কারণটি ইতিহাসের আলোকেই বিচার করতে হবে।

৭.

পাল আমলের বর্ধিষ্ণু সময় কিংবা স্বাধীন সুলতানি আমলের বিকাশের পর্ব পেরিয়ে আকবরের সময় বাংলা মুঘল শাসকদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। আর মুঘল আমলের শেষ দিক থেকে সুবে বাংলা দিল্লির চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে প্রায় উপনিবেশে পরিণত হতে থাকে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, ‘মোগল শাসনের শেষভাগে ভারতীয় সমাজের সর্বত্র গভীর ও ব্যাপক ভাঙন আরম্ভ হইয়া যায়। সেই সময় প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যেও একটা গভীর সংকট দেখা দেয়। গ্রাম-সমাজের কর আদায়কারী “প্রধান ব্যক্তিগণ” ব্যাপক ক্ষমতার বলে ক্রমশ উত্পীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে থাকে।’৩৫ উত্পীড়নের এই চাপ কতটা প্রবল ছিল তা বোঝা যায় একদিকে এ সময় সংঘটিত অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ থেকে আর অন্যদিকে সমকালীন বিদেশি পর্যটকদের রচনা থেকেও। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে (১৭৬৩) ব্রিটিশ আমলের অবসান পর্যন্ত অন্তত ৪০টি বড় আকারের কৃষক বিদ্রোহের বর্ণনা আছে সুপ্রকাশ রায়ের ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং বিদ্রোহী ভারত বই দুটিতে। এদিকে ইতালীয় পর্যটক মানুচ্চি লিখেছেন, ‘তাদের (কৃষকদের) গাছের সঙ্গে বাঁধা হত এবং ঘুষি ও কোড়া মারা হত। ... শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় এক ইঞ্চি গভীর দাগ বসে যেত ও চামড়া ফেটে যেত।’৩৬ দীর্ঘকালের একতরফা শোষণ এবং ক্ষয়িষ্ণু জাতির গণ্ডিবদ্ধ জীবনের ফলে অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ বাঙালি, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘তাহার গ্রাম্য জীবনের ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে খুশি হইয়াই থাকিত।’৩৭ বাঙালির এই ‘গ্রামের সীমার মধ্যে বদ্ধ’ সমাজের স্থবিরতা ও ক্ষয়ের কথা রবীন্দ্রনাথ সম্যক জানতেন। তিনি সেই বদ্ধ ভঙ্গুর আড়ষ্ট জনগোষ্ঠীকে তার গ্রাম্যতা ও প্রাদেশিকতার গণ্ডি কাটিয়ে পরিশীলিত আধুনিক নাগরিক জীবনের সংস্কৃতিটি গ্রহণের পথ দেখিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় ভারত এবং বিশ্ব তাঁর চিন্তায় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। আর তাঁর ঔপনিষদিক শিক্ষায় তিনি তো বরাবর ব্যক্তিকে তার সব ক্ষুদ্রতা ও বদ্ধতার গণ্ডি কাটিয়ে বিশ্বলোকে এবং তার অতিনশ্বর অতি স্বার্থকেন্দ্রিক জীবনের মোহাবরণ ছিন্ন করে অমৃতলোকে উন্নীত হওয়ার শক্তি জোগাতে চেয়েছেন। হয়তো সে কারণেও তাঁর রাষ্ট্রভাবনা বাংলা ছাপিয়ে ভারতবর্ষকে আশ্রয় করে স্বস্তি পেয়েছে।

তিনি যে বাংলাকে স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে ভাবতে নারাজ, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এক জায়গায়। ১৯২৩ সালের ৩ মার্চ কাশীতে অনুষ্ঠিত উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন—‘বাঙালিকে নেশন বলা যায় না। কেননা, বাঙালি এখনো আপন রাষ্ট্রীয় ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠেনি।’৩৮

কবির এই উক্তি ধরে আমরা বাংলাদেশের আর্জিটি কিন্তু সমকালীন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জোরালোভাবেই দাঁড় করাতে পারি। ১৯৪৮ থেকে ধাপে ধাপে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিকাশমুখী এবং পরে স্বাধীনতাকামী বাঙালির যে সংগ্রামমুখর অভিযাত্রা, তাতে জাতির চেতনালোকের উজ্জ্বলতম প্রদীপটির নাম রবীন্দ্রনাথ। এই বন্ধুর পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে ত্যাগে ও বীরত্বে বাংলাদেশ কেবল পাকিস্তানকে বা পাকিস্তানি রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেনি, একটি জাতি হিসেবে আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, জেগে উঠেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বহু শতাব্দীর ইতিহাসে সৃষ্টি করেছিল অবিস্মরণীয় ঐক্য—দেশ, ধর্ম, অবস্থান—কিছুই বাধা হতে পারেনি, সব বাঙালি সেদিন জয়বাংলার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল দেশজননীর কল্যাণে, রাষ্ট্রসাধনার ব্রতে। সেদিন স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত লড়াকু জাতিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আর সেই জাতির অন্তরে জাগরণের মন্ত্র ও বাঁধভাঙার প্রেরণা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের পর সেই উদ্দীপনা ম্রিয়মাণ হয়েছে যখন দেশটি, রাষ্ট্রটি তার ক্ষমতা আর স্বাধীনতার প্রাপ্তিটুকু বুঝে নেওয়ার আগেই পরাভূত-রাজনীতির নিষ্ঠুর প্রত্যাঘাতে দেশে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানপন্থী মুসলিম জাতীয়তার রাজনীতি। ফলে বাঙালি মুসলমানের ফিরে বাঙালি হওয়ার, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ বিনির্মাণের কাজ আরব্ধ থেকে যায়। স্বাধীনতার পরে, বিশেষত পঁচাত্তরের পর থেকে, এটিই সচেতন বাঙালির মূল সংগ্রাম ও সাধনা হয়ে ওঠে। আর এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় চেতনা ও প্রেরণা, ধারণা ও ভাবনা, পথনির্দেশ ও চলার পাথেয় জুগিয়ে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। এইভাবে একাত্তরের স্বাধীনতার পরেও রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মূলধারার সংগঠক-কর্মীদের সহযাত্রী হয়ে থাকলেন।

৮.

একটা কথা এখানে বলা যায়। বাঙালির সমাজ, ইতিহাস, জাতি এবং নেশন ও রাষ্ট্র গঠন নিয়ে যত আলোচনা, যুক্তি-বক্তব্য এসেছে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে তা মূলত মননশীল প্রবন্ধেই প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্কিমের সৃজনশীল সাহিত্যে হিন্দু জাতীয়তার চেতনা লালিত হয়েছে। এক বন্দেমাতরম মন্ত্র-সংগীতের স্রষ্টা হিসেবে তিনি ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজের কাছে ঋষির মর্যাদায় আদৃত হয়েছেন। এই প্রভাব এতই গভীর এবং এতটাই দুর্ভেদ্য যে তা কাটিয়ে মুসলমান তাঁর যুক্তিবাদী মনের ঔদার্য, সমন্বয় ও মানবতাকে আমলে নেয়নি। তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের মন্ত্রদাতা হিসেবেই পরিচিত হয়ে রইলেন। রামমোহন আরবি ও ফারসি ভাষা জানতেন এবং ইসলামি শাস্ত্রেও সুপণ্ডিত ছিলেন, তাঁর ব্রাহ্ম ধর্ম-ভাবনার মধ্যে খ্রিষ্টীয় ও ইসলামি একেশ্বরবাদের ধারণার প্রভাব থাকলেও তিনি মূলত হিন্দুধর্মের সংস্কারক হিসেবেই সমাজে পরিচিত থাকলেন। বিদ্যাসাগরকে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী যথার্থই আখ্যায়িত করেছেন ট্র্যাডিশনাল মডার্নিস্ট হিসেবে। কিন্তু তাঁর আধুনিকতা মূলত সমাজ সংস্কারে নিবদ্ধ ছিল, আর ব্যবহারিক ও মনন সাধনায় ঐতিহ্যকে যেটুকু বহন করেছেন, তা ইসলামের আবির্ভাব-পূর্ব হিন্দু ঐতিহ্যেরই অংশ। তবু বিদ্যাসাগর তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অসাধারণ মানবিকী ঘটনাবলীর জন্য, বাংলা গদ্যের নির্মাতাদের অন্যতম হিসেবে, শিক্ষাবিস্তারে অনন্য ভূমিকার জন্য এবং সাধারণভাবে নারীমুক্তির অগ্রদূতরূপে সব বাঙালির কাছেই শ্রদ্ধেয়, আদৃত।৩৯ কিন্তু জাতীয়তাবাদী প্রেরণার যা উত্স, তা মূলত সৃজনশীল সাহিত্য, আর বিশেষভাবে কাব্য ও সংগীত।

জনসাধারণের প্রাণ স্পর্শ করে, দেশপ্রেমে ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় তারা উজ্জীবিত হয়ে থাকে মূলত গানে, যে ভান্ডারের গরিষ্ঠাংশই রবীন্দ্রনাথের রচনা। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি গান যেমন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী যুক্তবাংলার প্রেরণায় রচিত, তেমনি নজরুলসহ মুকুন্দ দাস, রামপ্রসাদ, নিধুবাবু, অতুল-দ্বিজেন্দ্র-রজনীকান্ত—যাঁদেরই গান গেয়ে আমরা স্বদেশ চেতনাকে রাঙাই, বাড়াই—তার সবই যুক্তবাংলার গান।

কিন্তু পাকিস্তানের কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে যে বাংলাদেশ, তার মনস্তত্ত্বের গভীরে যেমন ভারত ও হিন্দু নিয়ে সংশয় কাটেনি, তেমনি পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তানি পরিচয়ের এই বাংলা ও তার মুসলিম জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ভারতীয় বাঙালিদেরও সংশয় ও দূরত্বের বোধ কাটার মতো কোনো কাজ তো হয়নি। বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের পরস্পরকে জানার ও বোঝার ক্ষেত্রে যে বিপুল সমস্যা, তা রবীন্দ্রনাথের কাছে অস্পষ্ট ছিল না এবং তা রেখে বাঙালির অগ্রযাত্রা যে সম্ভব নয়, সেটা তিনি বুঝতেন। আর তাই তীব্র ভাষায় এ নিয়ে তিনি আক্ষেপ করেছেন:

আর মিথ্যা কথা বলিবার প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ।

আমরা বহুশত বত্সর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা ঘোষণা করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না।৪০

এখানে এ কথা না বললে ভুল হবে, হিন্দু-মুসলিমের মিলিত অসাম্প্রদায়িক জাতিসাধনার ক্ষেত্রে বিদ্রোহী কবি নজরুলের লেখনী এক কথায় অতুলনীয়। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ এই বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী চেতনায় জাগানোর কাজে নজরুলের ভূমিকা ছিল খুবই কার্যকর। ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ী রক্ষণশীল মোল্লাদের বিরুদ্ধে সব্যসাচীর দাপটে কবিতা ও গদ্যে কশাঘাত করে গেছেন তিনি। ফলে পূর্ব বাংলায় একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি ও বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথের সাথেই প্রায় নজরুলের নাম উচ্চারিত হওয়া স্বাভাবিক। আর এ অভিযাত্রা যতই বন্ধুর ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে, ততই সংগ্রামী বাঙালিকে তার আরও সহায়কশক্তিকে খুঁজে নিতে হয়েছে। এভাবেই লালনসহ লোকগানের বিরাট ভান্ডার থেকেও আমাদের যাত্রাপথের রসদ সংগৃহীত হয়েছে।

কিন্তু এতত্সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, রবীন্দ্রোক্ত পাপ আমরা মোচন করতে পারিনি, এর দায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে অর্থাত্ ভারতে হিন্দুকে ও বাংলাদেশে মুসলমানকেই নিতে হবে।

কেবল এটুকু সান্ত্বনা যে এই ব্যর্থতার মধ্যেও, বিপুল অন্যায় ও অবিচারের মধ্যেও, প্রবল ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে ইতিহাস এখানে এগিয়ে যাওয়ার পথের দিশাও দিয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে উদার ও বিবেকী মানুষের কামনার সেই হিন্দু-মুসলিমের যৌথ সাধনায় নির্মিত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যে দেশ দারিদ্র্যের সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতাকেও জয় করবে, তার আদর্শিক ভিত্তি নির্মাণে বাংলার ভাবুকসমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তো রবীন্দ্রনাথ। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের মূল অভিযাত্রা যে ভাবাদর্শকে ধারণ করে চলেছে, তার ভূমিকা যেন সৌরমণ্ডলের মতো—কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথ আর কক্ষপথে-মহাকাশে নজরুল-লালন-অতুল-দ্বিজেন্দ্র-জীবনানন্দ-জসীমসহ অসংখ্য কৃতী বাঙালি যেন গ্রহ-নক্ষত্রের মতো আপন মহিমায় ভাস্বর।

৯.

এইখানে রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করে। তাঁর অসামান্য প্রতিভার ফসল—কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটকের মতো সৃজনশীল সাহিত্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে প্রাদেশিকতার গণ্ডি ছাপিয়ে বিশ্বদরবারে পৌঁছানোর যোগ্যতা ও মান এনে দিয়েছে। রুচিবিকারে ও ক্ষয়িষ্ণুতায় আক্রান্ত সেকালের নাগরিক গানকে তাঁর সংগীত-স্থূলতার গণ্ডি ভেঙে কেবল পরিশীলনের মুক্তিপথ দেখায়নি, সর্বভারতীয় নাগরিক সংগীতনন্দনের অগ্রবর্তী অবস্থানে উন্নীত করেছে বাংলা সংগীতকে। আর বিভেদ, অবক্ষয়, সংকীর্ণতা, কুসংস্কারসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত সমাজকেও তিনি কখনো ত্যাগ করেননি। রোগাক্রান্ত এই সমাজকে তিনি সংস্কারের ও নবায়নের জন্য প্রাণপাত করেছেন। কখনো তীক্ষ সমালোচনায়, কখনো সরস ব্যঙ্গে, কখনো স্পষ্টকথনে, কখনো বা অকাট্য যুক্তির বিন্যাসে এই দুর্বল, ভঙ্গুর, বিভক্ত, কলহপ্রবণ সমাজকে তার সব কলুষ-তামস ভেদ করে উন্নত মানুষ হিসেবে দাঁড়ানোর প্রেরণা দিয়ে ও পথ দেখিয়ে গেছেন।

প্রয়োজনে কী রকম কঠিন বিদ্রূপ এবং অকাট্য মন্তব্য তিনি করতে পারতেন, তার একটা নমুনা ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ প্রবন্ধ থেকেই পড়া যাক:

... আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহঙ্কার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স্, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।৪১

আবার তিনিই সত্যের নিরাসক্ত শক্তিতে তাঁর দেশবাসীকে জেগে ওঠার, প্রতিরোধের প্রেরণা জোগান, এগিয়ে চলার পথ দেখান:

আমরা প্রশ্রয় চাহিনা—প্রতিকূলতার দ্বারাই আমাদের শক্তির উদ্বোধন হইবে। আমাদের নিদ্রার সহায়তা কেহ করিয়ো না—আরাম আমাদের জন্য নহে, পরবশতার অহিফেনের মাত্রা প্রতিদিন আর বাড়িতে দিয়ো না। বিধাতার রুদ্রমূর্তিই আজ আমাদের পরিত্রাণ। জগতে জড়কে সচেতন করিয়া তুলিবার একইমাত্র উপায় আছে—আঘাত অপমান ও অভাব, সমাদর্শ নহে, সহায়তা নহে, সুভিক্ষা নহে।৪২

বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাঁর উদ্দিষ্টজন এই বঙ্গদেশের জনগণ, কারণ এই বক্তব্যের উপলক্ষ তো বঙ্গভঙ্গ।

স্বদেশি পর্যায়ের গানে মানুষকে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহত্ কল্যাণ চেতনায় সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। ‘এবার ফিরাও মোরে’, ‘ঐকতান’, ‘ত্রাণ’, ‘প্রার্থনা’র মতো কবিতা এবং ‘স্বদেশ’ ও ‘পূজা’পর্বের গান কিংবা ঘরে-বাইরে, চার অধ্যায়-এর মতো উপন্যাস সংবেদনশীল পাঠকের মনে যে মহত্ ভাবের উন্মেষ ঘটায়, তা যেমন একটি জাতির অস্তিত্ব অনুভব করায়, তেমনি একটি দেশচেতনায় তাকে আপ্লুতও করে। সেটা সর্বতোভাবেই বাংলা, বাঙালি এবং তাই বাঙালির একটি দেশকে ঘিরেই তৈরি হয়।

হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ও মিলন, সামাজিক ব্যাধির আলোচনা ও নিদান, নেশন ও দেশ-ভাবনা যখন যুক্তি ও বিশ্লেষণের পথে এগিয়েছে, তখন রবীন্দ্রনাথেরও মাধ্যম ছিল মননশীল গদ্য—প্রবন্ধ, পত্র, ভাষণ। কিন্তু কবিতা ও গান এবং ছিন্নপত্র ও ব্যক্তিগত কিছু গদ্যে তিনি এই বাংলা এবং সমগ্র বাঙালিকে দেশচেতনার আধার ও সম্পদ উভয়ই দিয়েছেন। আর মহত্ কবির ভাবলোক বরাবরই সব ক্ষুদ্রতার গণ্ডি ছাপিয়ে উচ্চতর, ব্যাপ্ততর, মহত্তর জগতের সন্ধান দিয়ে গেছে। তাই তাঁর এসব লেখনী মানুষের মনে আপনাকে ছাপিয়ে উঠে বড় হওয়ার প্রেরণা দেয়। বড় কিছুর সান্নিধ্যে যাওয়ার আকুলতা তৈরি করে। সেই বড় কিছু প্রায়শ ঈশ্বর, কখনো বিশ্বমানবতা, কিন্তু অনেক সময় সুস্পষ্টভাবে দেশ ও বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সুনির্দিষ্টভাবে নিজের দেশ ও জাতির প্রসঙ্গে একই রকম প্রেরণা লাভ খুবই সংগত ও স্বাভাবিক। তাঁর গানে যেমন ঈশ্বর ও বিশ্বমানবের চেতনা একাকার হয়ে যায়, তেমনি বাংলা ও ভারত, এমনকি স্বদেশ ও বিশ্বের চেতনাও ওতপ্রোত হয়ে ওঠে—কখনো গানে, কখনো গদ্যে।

আর তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশসাধনা ও সাহিত্যসাধনার ভূমিকা এতটা ওতপ্রোত, এতটাই প্রত্যক্ষ। রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে এবং স্বাধীনতাকে তাত্পর্যময় করে তোলার জন্য বাংলাদেশকে আরও দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে আর সে জন্য অনুক্ষণ যে চেতনার প্রদীপটি জ্বালিয়ে রাখা দরকার, তার পুষ্টি প্রধানত আসছে রবীন্দ্রনাথ থেকে। মনে হয় আরও বহুকাল এ-ই হবে বাস্তবতা।

এই পথে এগিয়েই এ দেশবাসীকে প্রমাণ করতে হবে যে ইতিহাস পরিক্রমা করে সে একাত্তরের পথ তৈরি করেছিল, তা ঘটনাপরম্পরার আপতিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ফসল নয়, তারই সচেতন অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ। রাজপথের আন্দোলন সেই অভিপ্রায়কে রূপ দিতে ব্যর্থ হবে, যদি না অভিপ্রায়টি বিচার-বিশ্লেষণে উত্তীর্ণ হয়ে যথাযথভাবে আমাদের অন্তরে-মননে অংকুরিত-মুকুলিত হয়ে ওঠে। কেননা, ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার পাশাপাশি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে লালন, বহন ও নবায়নের প্রশ্নগুলো জড়িত। সেভাবেই আমাদের নেশন হওয়া এবং রাষ্ট্রগঠন সার্থক হবে। বাংলাদেশের জাতি ও রাষ্ট্রসাধনা আজও চলমান-নির্মীয়মাণ, আর তাই রবীন্দ্রনাথ উত্তরোত্তর জোরালোভাবে আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক থাকছেন।

তাই বলব, বাংলাদেশের অভিযাত্রা যদি বাংলাদেশের দিকেই, অর্থাত্ যে চেতনা বায়ান্ন থেকে সূচিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে মূলধারা হয়ে উঠেছিল, সেই অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক আধুনিক বাংলাদেশের দিকেই হয়ে থাকে, তবে রবীন্দ্রনাথ হবেন তার এই অভিযাত্রায়, তার এই অভিযাত্রী-জীবনের ধ্রুবতারা।

তথ্যসূত্র

১. উদ্ধৃত, প্রশান্তচন্দ্র পাল: রবিজীবনী, তৃতীয় খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৯) ১১৯।

২. ঐ, ১২৭।

৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ছিন্নপত্রাবলী, নূতন সংস্কারণ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯), ১৭।

৪. উদ্ধৃত, প্রশান্তচন্দ্র পাল: রবিজীবনী, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৭) ২১৪।

৫. ‘ছেলেবেলা’, রবীন্দ্ররচনাবলী, ১৩শ খণ্ড, দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১), ৭৭১-৭৭২।

৬. ঐ, ৭৭২।

৭.  উদ্ধৃত, প্রশান্তচন্দ্র পাল: রবিজীবনী, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৭), ২১৪।

৮. সতীশচন্দ্র মিত্র: যশোহর-খুলনার ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: দেজ পাবলিশিং, ২০১০), ২২৩।

৯. আবুল ফজল: রেখাচিত্র, তৃতীয় সংস্করণ (চট্টগ্রাম: বইঘর, ১৯৮৫), ১৪২।

১০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ছিন্নপত্রাবলী, নূতন সংস্করণ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯), ৩৪৩-৩৪৪।

১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: গল্পগুচ্ছ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, শ্রাবণ ১৩৭৫), ৩৪০।

১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ছিন্নপত্রাবলী, নূতন সংস্কারণ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯), ১০৬।

১৩. শান্তিদেব ঘোষ: রবীন্দ্রসংগীত (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বাংলা ১৩৭৬), ১২৭-১২৮।

১৪. ‘শিক্ষার আন্দোলন’, রবীন্দ্ররচনাবলী ষষ্ঠ খণ্ড দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১), ৭৫৭।

১৫. ‘খেয়া’, রবীন্দ্ররচনাবলী পঞ্চম খণ্ড দ্বিতীয় মুদ্রণ ঐ, ১৮৯।

১৬. ‘ঘরে-বাইরে’, রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্থ খণ্ড দ্বিতীয় মুদ্রণ ঐ, ৫০২।

১৭.  প্রবোধচন্দ্র সেন: ‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’, রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রবন্ধ সংকলন, সম্পাদনা: ক্ষুদিরাম দাস ও অন্যান্য (কলকাতা: তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বৈশাখ ১৩৯৫), ৭।

১৮. ঐ, ১০।

১৯. ‘পূর্ব ও পশ্চিম’, সমাজ, রবীন্দ্ররচনাবলী ষষ্ঠ খণ্ড, দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১), ৫৭০।

২০. ‘বিদ্যাসাগর চরিত’, চারিত্রপূজা, রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, ঐ, ৮৩৭।

২১. এস ওয়াজেদ আলী: ‘ভবিষ্যতের বাঙালি’, দুশ বছরের বাংলা প্রবন্ধসাহিত্য, দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা: অলোক রায়, পবিত্র সরকার, অভ্র ঘোষ (কলকাতা: সাহিত্য আকাদেমি, ২০০৭), ১৭৬।

২২. আবদুল কাদির (সম্পাদিত): নজরুল রচনাবলী চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় প্রকাশ,  (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪), ৭১২।

২৩. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে প্রদত্ত মূল সভাপতির ভাষণ, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮। সেরা সুন্দরম, সম্পাদনা: মুস্তাফা নূর উল ইসলাম (ঢাকা: ইউপিএল, ২০০৪), ৩১-৩২।

২৪. হুমায়ুন আজাদ: বাংলা ভাষা প্রথম খণ্ড (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪), ৪৫।

২৫. খান সারওয়ার মুরশিদ: কালের কথা, (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০১) ১০৯।

২৬. সন্জীদা খাতুন: ‘রবীন্দ্রচর্চা এবং বাংলাদেশ’, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ (ঢাকা: অন্য প্রকাশ ২০০৫), ৬১।

২৭.  সন্জীদা খাতুনের পূর্বোক্ত প্রবন্ধে প্রদত্ত বাংলাদেশে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কিত গ্রন্থের তালিকা দ্রষ্টব্য।

২৮. সনত্ সাহা: ‘সঙ্কটকালে রবীন্দ্রনাথ’, কথায় ও কথার পিঠে, (ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৮), ৪।

২৯. উদ্ধৃত, সৈয়দ আবুল মকসুদ: পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স ২০০৭) ৭৪।

৩০. সেলিনা হোসেন: গায়ত্রী সন্ধ্যা ২য় মুদ্রণ (ঢাকা: সময় প্রকাশনী, ২০০৭), ৪০৭।

৩১. প্রফুল্লচন্দ্র রায়: ‘রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রীতি’ রবীন্দ্র বিচিত্র, সম্পাদনা: বিশ্বনাথ দে (কলকাতা: সাহিত্য, বাংলা ১৩৯৭), ২৯।

৩২. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: ‘রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা’, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ২০১০), ৮০।

৩৩. ‘গোরা’, রবীন্দ্ররচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১) ৭৩০।

৩৪. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: ‘রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা’, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ২০১০), ৮১।

৩৫. সুপ্রকাশ রায়: ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, তৃতীয় সংস্করণ (কলকাতা: র্যাডিকেল পাবলিশার্স, ১৯৬৬), ৬।

৩৬. উদ্ধৃত, আবুল মোমেন: বাংলা ও বাঙালির কথা, (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ ২০১০), ৮৮।

৩৭.  সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়: সাংস্কৃতিকী, চতুর্থ খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, ১৯৯৩),

৩৮. রবীন্দ্ররচনাবলী পঞ্চম খণ্ড দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১), ৮৫৪।

৩৯. রবীন্দ্ররচনাবলী ষষ্ঠ খণ্ড দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১), ৮১৯-৮২০।

৪০. ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’, পরিশিষ্ট রবীন্দ্ররচনাবলী পঞ্চম খণ্ড ঐ, ৮৫৪।

৪১. ঐ, ৮৩৭।

৪২. ঐ, ৭২৯।