বাংলাদেশের সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপট

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

অ্যা হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ—ভেলাম ভ্যান সেন্ডেল কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস যুক্তরাজ্য ২০০৯ ৩৭৪ পৃষ্ঠা

ভেলাম ভ্যান সেন্ডেলের অ্যা হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ বইটি বাংলাদেশের প্রাক্-ঐতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান (২০০৭) পর্যন্ত বহুবিধ বিবরণকে এক সূত্রে গাঁথার এক উচ্চাভিলাষী প্রয়াস। ভূমিকাতে লেখক স্পষ্ট করে বলেছেন যে বইটি রচিত ‘সাধারণ পাঠক এবং এ বিষয়ে যাঁরা পড়াশোনার সূত্রপাত করতে যাচ্ছেন, তাঁদের লক্ষ করে’। এই সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখলে বইটিকে বেশ সর্বাঙ্গীণ মনে হবে। তথাপি, যে পরিপ্রেক্ষিতে এটি লেখা এবং এতে উঠে আসা লেখকের কিছু পর্যবেক্ষণ গভীর আলোচনা ও বিতর্কের দাবি রাখে।

বিগত কয়েক দশকে দক্ষিণ এশীয় চর্চা উল্লেখযোগ্য ব্যাপকতা অর্জন করলেও বৈশ্বিক বিদ্যায়তনে বাংলাদেশ অনেকটাই অনুচ্চারিত থেকেছে। নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ধারা আলোচনায় যেমন, তেমনি সাম্প্রতিক কালের ক্ষেত্রেও। সম্ভবত অ্যা হিস্ট্রি অব বাংলাদেশই এযাবত্কালের প্রথম বই, যেখানে এত বিস্তৃত কাল ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে দেশের ভেতর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই আছে কয়েকটি, তবে সেসব কাজের অধিকাংশই সম্পাদিত ও বিশ্বকোষ ধরনের। যদিও বা এসব গ্রন্থের দরকারি নিবন্ধ ও অনুচ্ছেদ রয়েছে, কিন্তু এগুলো থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনশীলতার কোনো সুসংগত বিবরণ পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বিদ্যমান লেখালেখির বড় অংশই কোনো না-কোনো জাতীয়তাবাদী আবেগতাড়িত। সেখানে অ্যা হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ দেশটির ঐতিহাসিক বিকাশের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বিস্তৃততর বিবরণী হাজির করে।

ভূতত্ত্ব, রন্ধনপ্রণালি প্রতিবেশ

এ বইয়ের লেখক তিন দশকের অধিক কাল ধরে এ অঞ্চলের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণা করে চলেছেন। এসব বিষয়ে তাঁর কয়েক ডজন পুস্তক ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লেখক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান কাজে লাগানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ বিষয়ে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখিরও দ্বারস্থ হয়েছেন। বইটির ২২টি অধ্যায়কে পাঁচ অংশে ভাগ করা হয়েছে: ‘প্রেক্ষাপট’, ‘ঔপনিবেশিক মোকাবিলা’, ‘পূর্ব পাকিস্তান হয়ে ওঠা’, ‘যুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ এবং ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’। অধ্যায়গুলোর মধ্যে লেখক ভৌগোলিক গড়ন থেকে শুরু করে রান্নাবান্নার রীতির মতো নানা প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এ বইয়ে উঠে আসা অসংখ্য বিষয়, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকে মোটা দাগে চারটি বর্গভুক্ত করা যায়—প্রতিবেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। এই সব কটি বর্গের গতিশীলতা যে কত ব্যাপক, তা লেখক দেখেছেন ‘সীমান্তের’ পরিপ্রেক্ষিত থেকে। ঘুরিয়ে বললে, বঙ্গীয় বদ্বীপ, যা আজকের বাংলাদেশের অনুরূপ, সেই অঞ্চলকে এখানে কেবল এক ভৌগোলিক সীমানা হিসেবে নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সীমানা হিসেবেও হাজির করা হয়েছে, যার মাধ্যমে এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক বিকাশ সবচেয়ে ভালোভাবে অনুধাবন করা সম্ভব। অ্যা হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ-এ প্রতিবেশ একটি প্রধান প্রসঙ্গ। বঙ্গীয় বদ্বীপ ও বাংলাদেশকে বিনিমেয় নাম হিসেবে ব্যবহারের মধ্যে এটা প্রতিফলিত। বইটিতে প্রতিবেশ কেবল সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ইতিহাসের ভূমিকাস্বরূপ আসেনি, বরং দেশে বৃহত্তর ঐতিহাসিক বিকাশের এক গতিশীল উপাদান হিসেবে এসেছে। নিখুঁতভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন, কীভাবে প্রতিবেশ এ অঞ্চলের গড়ন (ব্যাপক বিস্তৃত পানিব্যবস্থা, পলিবাহিত হয়ে জমি উর্বরা হওয়ার প্রক্রিয়া, প্রাণবৈচিত্র্য, যোগাযোগ বাহন প্রভৃতি নানারূপে) এবং ধ্বংস (ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের পরোক্ষ হস্তক্ষেপজনিত কতগুলো পরিবেশগত বিপর্যয়, যেমন—প্যাথোজেন বায়ুদূষণ, আর্সেনিক এবং ভারতে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব) উভয়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্রায়তন দেশের জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্বের সঙ্গে প্রতিবেশগত প্রতিবন্ধকতা যুক্ত হয়ে অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে, যার মধ্যে আছে অভ্যন্তরীণ ও দেশের সীমানা ছাপিয়ে প্রতিবেশ শরণার্থী হওয়ার বিষয়। পরিবেশের দ্বৈত গতিশীলতা এতটাই তীব্র যে এই বদ্বীপ ব্যাপক উন্নতির, না বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে—সে বিষয়ে লেখক কোনো মীমাংসায় যাননি। (পৃ. ২৫০)

নবীন রাষ্ট্রের ব্যর্থতা

যদিও সেন্ডেল প্রাক্-ঔপনিবেশিক কালে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক বিকাশের উল্লেখ করেছেন, তবে ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে রাজনৈতিক গতিশীলতার বিবরণ তাঁর বইয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি স্পষ্ট ধারালো হয়ে ওঠে। অতিসাম্প্রতিক ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে আহরিত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ঘটনার ওপর পর্যবেক্ষণে তিনি একটি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, যা ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী ও কৈফিয়তমূলক ব্যাখ্যার মাঝামাঝি। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন, পূর্ব বঙ্গবাসী পাকিস্তানকে বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ শুধু একই ধর্ম নয়, বরং তারা চেয়েছিল অভিজাত ভূস্বামীর (যে কি না ভাগ্যচক্রে হিন্দু) অধীনে যে অর্থশোষণ চলছিল, তা থেকে মুক্তি। সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের মতো মুসলিম লীগ কিন্তু বাংলা ভাগের জন্য সংগ্রামে নামেনি: ‘নিশ্চয়ই, তারা (মুসলিম লীগ) মুসলমানদের জন্য নিজস্ব দেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছে, কিন্তু তাদের পাকিস্তানের স্বপ্নের মধ্যে ছিল সমগ্র বাংলা। কংগ্রেসই বাংলা ভাগের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে মুসলিম লীগকে দূর করার জন্য’ (পৃ. ৯৩)। একইভাবে, পাকিস্তান পর্বে কৃষকের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা ভাগাভাগি কিংবা ভাষা ও ধর্মের প্রশ্নের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল অর্থনৈতিক কল্যাণ (পৃ. ১১৬)। তবে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত বাঙালির দাবি ছিল ভিন্ন। তারা ১৯৪৭-উত্তর রাষ্ট্রকে আপন মনে করেনি (পৃ. ১১৬-১৭), আর তাই ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে, যেমন: আওয়ামী লীগ ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে করেছে। সেন্ডেলের মতে, এতে ‘সামাজিক পরিবর্তনের বাসনা মূর্ত হয়ে ওঠেনি’। রাষ্ট্রের ভূমিকার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ‘সামাজিকভাবে এই মাঝপথে চলা কিংবা রক্ষণশীল’ পথ গ্রহণ তাই অতি বামদের অধিকতর র্যাডিক্যাল পথের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না (পৃ. ১২৩), যদিও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় দফা দাবির পাশাপাশি ‘অগ্রসর’ র্যাডিক্যাল ছাত্র সংগঠনগুলোর ১১ দফা দাবি উত্থাপিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা রাষ্ট্র ও বৃহত্তর রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যকার দূরত্ব আরও ব্যাপকতর করে। এটা আজও বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। কল্যাণ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আকাঙ্ক্ষা জনগণের ছিল, তা ধারণ করার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শিক ভ্রান্তির চেয়ে বরং রাষ্ট্রের প্রাথমিক ব্যর্থতাই সামরিক শাসন আসার পথ করে দিয়েছে, যা এখনো রাজনৈতিক ক্রীড়নকদের প্রতি সম্ভাব্য আর কখনো কখনো প্রত্যক্ষ হুমকি হয়ে আছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ডেলের সিদ্ধান্ত এই যে সত্তরের দশক পঞ্চাশের দশকেরই পুনরাবৃত্তি (পৃ. ১৯৫)। একুশ শতকের এ সময়ে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, তার ক্ষেত্রেও হয়তো এ কথা একইভাবে প্রযোজ্য।

সেন্ডেলের মতে, ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের পর এ অঞ্চলের অর্থনীতি নাটকীয় নিম্নগামিতার মধ্যে পড়ে। তিনি মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশদের শুরুতে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলার পথ করে দেয় যে পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭), সেটা বাংলার ইতিহাসের কোনো সন্ধিক্ষণ নয়, বরং মোগল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারেরই প্রবহমানতা (পৃ. ৪৯-৫০)। তথাপি, পুরো উপমহাদেশ জয় করতে ব্রিটিশরা বাংলার সম্পদ ব্যবহার করেছিল—এ কথা উল্লেখ করে লেখক এ অঞ্চলের প্রাক্-ঔপনিবেশিক দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমন্বয়তার প্রসঙ্গ টানেন। মোগল সাম্রাজ্যের বিরাট খাজনার বোঝা থাকার পরও যে গতিশীল কৃষি ও প্রাণবন্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছিল, তা ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করে ঔপনিবেশিক কালে। আধা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি, অলাভজনক বাণিজ্যিকীকরণ এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে শোষণ উদীয়মান মধ্যশ্রেণী ও কৃষকদের কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করেছিল। কিন্তু জনগণের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান। ১৯৫০-এর দশকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উঠিয়ে দেওয়া হলেও ভাগচাষিদের কোনো ভূমির অধিকার দেওয়া হয়নি। ফলে ১৯৬০ সাল নাগাদ ২০ শতাংশ ভূমিহীন দিনমজুরে পরিণত হয়। বিদেশি সাহায্যচালিত আধুনিকায়ন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটায়নি, বরং বিদেশি সাহায্য-সিক্ত অভিজাত গোষ্ঠীর বিকাশ ঘটিয়েছে, আর দেশীয় সম্পদের গতিহীনতায় ভূমিকা রেখেছে।

তাই, দ্বিতীয় এক ইউটোপিয়ার ডানায় ভর করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে কিছু কিছু সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবণতা আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পরই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ১৫ লাখের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার সময় বাংলাদেশ সরকার যদি ‘অদক্ষ, উদাসীন ও হূদয়হীন’ ভূমিকা নেয় আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সমপরিমাণ মানুষ প্রাণ হারিয়ে থাকে (পৃ. ৮১), তাহলে তো আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্ণনায় এসব বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক থাকে না। একমাত্র দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও); এরা, সেন্ডেলের দৃষ্টিতে, যতটা মুক্তিদাতা শক্তি, তার চেয়ে বেশি ‘রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্র’ সৃষ্টা, যা নিজেদের পেলেপুষে বড় করে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বদলায় না তাদের লাখ লাখ গ্রাহকের ভাগ্য (পৃ. ২২১-২২)। বয়স্ক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে লিঙ্গীয় সমতার মতো সামাজিক উন্নয়ন খাতগুলোতে সামান্য কিছু ঊর্ধ্বমুখী পরিবর্তন ঘটা সত্ত্বেও বৃহত্তর আর্থসামাজিক ময়দান ভাঙাচোরাই রয়ে গেছে। মূলত রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নগরায়ণ ঘটে চলেছে। কিন্তু লেখক দেখাচ্ছেন, এগুলো সমৃদ্ধ শিল্প উন্নয়নের লক্ষণ নয়, বরং বিপুলসংখ্যক গ্রামবাসীর জীবিকা প্রদানে কৃষি যে ব্যর্থ হচ্ছে, তারই চিহ্ন। এই সৌন্দর্যবর্ধক নাগরিকায়নের অমোঘ পরিণতি সেন্ডেলের ভাষায় এক বিস্ফোরণ—এতে আশ্চর্যের কিছু নেই (পৃ. ২৩৭-৩৯)।

এগারো শতক নাগাদ আর্য সাংস্কৃতিক প্রভাব যখন প্রাক্-আর্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে অবশেষে বোঝাপড়া আরম্ভ করল, তত দিনে ইসলাম বঙ্গীয় বদ্বীপের সৈকতে চলে এসেছে, আর এটা বিশেষভাবে ঘটেছে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। যদিও লেখক পরিষ্কারভাবে বলেননি, তাঁর বর্ণনায় আভাস পাওয়া যায়, বাংলাদেশের সমকালীন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, এর উদারতা সবই এই ত্রিপক্ষীয় সাংস্কৃতিক সম্পর্কের সম্পৃক্ততা ও বিরোধ থেকে উত্সারিত। তবে সেন্ডেল বাঙালি সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অতি বর্ণনার পদাঙ্ক অনুসরণ না করে অবাঙালি সমাজ, তথা চাকমাদের—যারা মূলত প্রান্তস্থ পাহাড়ি এলাকায় বাস করে, তাদের—বিশেষ জায়গা দিয়েছেন এই বইয়ে। এসব জনগোষ্ঠীর মানুষ ইসলামে দীক্ষা নেয়নি, ইসলামও পাহাড় ডিঙিয়ে তাদের কাছে যায়নি (পৃ. ৩)। সেন্ডেল ইঙ্গিত দিচ্ছেন, বাংলাদেশের জনগণ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান যুগে যথাক্রমে হিন্দু ও উর্দুভাষী অভিজাত মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ভেতরে একটি মধ্য জমিন গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, এই ‘মধ্য জমিন’ অত্যন্ত উগ্র জাতীয়তাবাদীরূপে দেখা দিল সব অবাঙালি জাতিসত্তাকে বৃহত্তর বাঙালি জাতির মধ্যে মিশে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে। এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা করেন সেন্ডেল। মুজিব ও জিন্নাহ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে জাতিরাষ্ট্রের সব নাগরিকের ওপর তাদের সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও অনুশীলন-নির্বিশেষে আধিপত্যিক ভাষা-সাংস্কৃতিক হেজামনি আরোপ করতে চেয়েছিলেন (পৃ. ১৮৪-৮৫)। একটি বিমূর্ত সমজাতিক জাতিরাষ্ট্র গঠনকে কেন্দ্র করে এ ধরনের সাংস্কৃতিক বিতর্ক তৈরি হওয়া সত্ত্বেও সেন্ডেল সবিস্তারে দেখাচ্ছেন, আজকের বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আধার।

প্রাণোচ্ছলতার উত্তরাধিকার

কতগুলো বিষয় লেখক উল্লেখ করেছেন, যেগুলো আমার বিবেচনায় সমালোচনা সাপেক্ষ। প্রথমত মনে হতে পারে, সেন্ডেল এ অঞ্চলের ভেতরকার সাংস্কৃতিক ভিন্নতার ব্যাপারে কিছুটা অতিসংবেদনশীল। উদাহরণস্বরূপ, তিনি লিখেছেন, ‘এমনকি আজও বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এবং বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সাংস্কৃতিক ও অ-সাংস্কৃতিকের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়’ অথবা বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের থেকে পূর্বাঞ্চলের মানুষ অধিকতর গোঁড়া (পৃ. ২০, ৩৮)। এমন পর্যবেক্ষণ সাবধানতার সঙ্গে নেওয়া উচিত। অপেক্ষাকৃত গোঁড়া ‘আহলে হাদিস’ আন্দোলনের—যার একাংশ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ধারণা করা হয়—সবচেয়ে শক্তিশালী শিকড় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। দ্বিতীয়ত, লেখক পরিবেশগত আন্দোলনের বৃহত্তর মূল্যায়ন করলে ভালো হতো। এ আন্দোলন এখন পর্যন্ত কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের গভীর পরিবেশগত গতিশীলতাকে আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তৃতীয়ত, লেখক মঙ্গা বা মৌসুমি খাদ্যাভাবকে বর্ণনা করেছেন অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের আলোকে। মঙ্গার কারণে এটা ঘটে। কিন্তু ধান উত্পাদন যখন সর্বোচ্চ বেড়েছে, সে সময় কেন অনাহারের সমস্যা—সে আলোকে লেখক মঙ্গাকে দেখেননি। চতুর্থত, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে লেখকের মন্তব্য: ‘প্রথমে লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা হিসেবে এবং তারপর মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার আবির্ভাব ছিল খুব অসংগত।’ তাঁর যুক্তি, বাংলাদেশের সব মানুষ তো বাংলা বলে না কিংবা বোঝে না, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত কিছু কিছু সম্প্রদায়। উগ্র জাতীয়তাবাদী বাঙালি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিত থেকে লেখকের এ মন্তব্য বোধগম্য। কিন্তু এ মত খুব রূঢ় মনে হতে পারে। এ অঞ্চলে বাংলা ভাষার প্রাধান্য সব সময় শাসকগোষ্ঠী ও অধিপতি ক্ষমতা দ্বারা টিকিয়ে রাখা হয়নি। বাংলা ভাষার নিজস্ব নিম্নবর্গীয় আত্মিক বৈশিষ্ট্য ও স্থানিকতা আছে। পঞ্চমত, বাংলাদেশের প্রথম দিককার নেতৃবৃন্দের তাঁদের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থতা তাঁদের দেশজ মডেলের (ঔপনিবেশিক ভদ্রলোকের কিছু শোধন এবং জনপ্রিয় বাঙালি পন্থার মিশেল তৈরি) আবেদন দুর্বল করে দিয়েছে। এ কারণে তিনি ‘মফস্বলীকরণের’ এক নতুন প্রজন্মের উত্থান দেখতে পান, যেখানে স্থানীয় মাস্তানরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে (পৃ. ২৫১-২৫২)। এই পর্যবেক্ষণ জবরদস্ত এবং বাস্তব। কিন্তু এটা হয়তো যতটা না সাংস্কৃতিক গতিশীলতার, তার চেয়ে বেশি প্রখর পৃষ্ঠপোষক-গ্রহীতা (প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট) সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। ষষ্ঠত, সাংস্কৃতিক সীমানায় ‘নতুন ইসলামী সংবেদনা’ হয়তো সেক্যুলার-উদারনৈতিক সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির শুধুই বিরোধী কোনো বস্তুর চেয়ে অনেক পৃথক। উদাহরণস্বরূপ, নবীনতর প্রজন্মের কোনো কোনো শিল্পীর সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যালবামে একটি-দুটি ধর্মীয় গান থাকতে দেখা যায়। নতুন যেসব সাহিত্যকর্ম আসছে, তাতেও তথাকথিত উদারনৈতিক সেক্যুলার লেখকদের সাহিত্যিক রীতি ও ঢং অনুসরণ করার প্রচলন দেখা যায়, কিন্তু সেক্যুলার কিংবা ধর্মীয় তত্ত্ব নিয়ে তর্ক থেকেই যায়।

প্রাচীন যুগের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজবংশগুলোর ওপর দৃষ্টি দেননি সেন্ডেল। আজকের বাংলাদেশ কী করে গড়ে উঠল, সেই ইতিহাসের গতিধারা দেখতে চাইলে প্রাচীনবঙ্গের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিস্তারিত উল্লেখ থাকা অতীব জরুরি। রমেশ চন্দ্র মজুমদারসহ বাংলার প্রধান ঐতিহাসিকদের এ অঞ্চল নিয়ে আগ্রহের ঘাটতি আব্দুল মোমিন চৌধুরীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মনোগ্রাফ ডাইন্যাস্টিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল-এ এ অঞ্চলের ওপর বিশেষ দৃষ্টি দিতে। পাল সাম্রাজ্যের পাশাপাশি এ অঞ্চলে ছোট ছোট রাজ্যের উপস্থিতি এ অঞ্চলের প্রতিবেশ, ধর্ম, বাণিজ্য ও রাজনৈতিক ধরনের নিদর্শন। এ বিষয়ে আলোচনা অ্যা হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ-এর জন্য জুতসই হতে পারত।

মোগল শাসনামল যতটা গুরুত্বের দাবি রাখে, সেভাবে এ বইয়ে আসেনি। মোগল আমলেই ঘটেছিল বড় আকারের ভূমিশাসন; ধর্মীয়-সামাজিক গড়ন এবং আরও স্পষ্ট বৈশ্বিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল, যা বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরেছেন রিচার্ড ইটন তাঁর ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার্স বইয়ে। বারো ভুঁইয়ার প্রতিরোধের ঘটনার মধ্য দিয়ে মোগল যুগ-উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যিক অভিলাষের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক প্রতিরোধেরও দৃষ্টান্ত বহন করে। মোগল সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সত্ত্বেও এটি সুস্পষ্ট, প্রশাসনিক, স্থাপত্যিক ও বাণিজ্যিক ধরন দাঁড় করাতে পেরেছিল। ঢাকার বর্তমান অবস্থার বীজও রোপিত হয়েছিল এ অঞ্চলে মোগল আবির্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে।

ঔপনিবেশিক যুগের আলোচনায় সেন্ডেল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন, বাংলার অধিকাংশ ঐতিহাসিক যেমন সচরাচর করে থাকেন। সেন্ডেলের বিশেষ দৃষ্টি ছিল সামাজিক গড়ন ও প্রতিরোধ রচনায় এটি কী প্রভাব ফেলে, তার ওপর। অবশ্য কৃষিভিত্তিক বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা নতুন বোঝাপড়া সামনে নিয়ে আসছে। মধ্যবর্তী কৃষক সমাজের উদ্ভব এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভূমি ব্যবস্থাপনা উদ্ভূত সমৃদ্ধি ও কল্যাণকে বঙ্গীয় বদ্বীপের প্রতিবেশ পরিপ্রেক্ষিতের ভেতরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেয়ে বরং এর অনুপস্থিতির ওপর দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে (ইফতেখার ইকবাল, দ্য বেঙ্গল ডেল্টা: ইকোলজি, স্টেট অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ, ১৮৪০-১৯৪৩)। অধিকন্তু, বইটিতে ঔপনিবেশিক যুগের শেষ ভাগে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষয়কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কাঠামোগত গতিশীলতার আলোকে, অথচ প্রতিবেশগতসহ অন্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

এসব ছোটখাটো দুর্বলতা যতটা না লেখকের অনবধানতা থেকে উদ্ভূত, তার চেয়ে বেশি বইটির পরিসর থেকে। এগুলো পাশে রেখে বলা যায়, আজকের বাংলাদেশের আদল গড়ে তুলেছে যেসব অগণিত বিষয় ও অগ্রগতি, সেসবের অসাধারণ সংশ্লেষণ করেছেন সেন্ডেল। লেখক যে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশকে দেখেছেন, তা ভালোভাবে উপলব্ধি করা হলে, মনে হবে, ‘প্রেক্ষাপট’ অংশে আলোচিত বঙ্গোপসাগরের পথ ধরে ভারত মহাসাগরের দিকে মুখ করে থাকা এ অঞ্চলের প্রাক্-ঔপনিবেশিক কাল ব্রুডেলের ক্ষুদ্র-ভূমধ্যসাগরের মতো। এই প্রাক্-ঔপনিবেশিক পরিবেশে রোমান্টিক ও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে যায়। লেখকের কাছে ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক কাল ‘প্রেক্ষাপট’-এর থেকে সাধারণভাবে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের, যেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বয়ম্ভরতার সাধারণ চেতনা প্রকাশিত। বিদ্যমান লেখালেখিতে ভিন্ন ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কালিক সীমার উভয় পাশে ঐতিহাসিক পথরেখার আরেকটু কম শাণিত গুণাবলি আরোপ করলে খুশি হতাম। সহজেই বোধগম্য যে আধুনিক কালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার উত্স ঔপনিবেশিক কাল, আর পাকিস্তান পর্বে তার ওপর নতুন রং চড়েছে। সামরিক বাহিনীর হুমকি, সামাজিক অসমতা, সুশাসনের ঘাটতি প্রভৃতি নানা প্রবণতা সমকালীন বাংলাদেশেও অব্যাহত রয়েছে।

তবু, সেন্ডেল সমকালীন অনেক পর্যবেক্ষকের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন না যে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। তাঁর প্রস্তাবনা: ‘অনিশ্চিত আরম্ভ থেকে বহু বিন্যাস উতরে এসে রাষ্ট্র বেড়ে উঠেছে এবং বঙ্গীয় বদ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে’ এবং ‘বঙ্গীয় বদ্বীপের বর্তমান অধিবাসীরা নমনীয়, প্রাণবন্ত প্রাণোচ্ছলতার দ্বারা—অনেক সময় দারুণভাবে—মানিয়ে নেয়, যা এ অঞ্চলের অন্যতম মূল্যবান ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার’ (পৃ. ২১৮, ২৬৯)। আর এই বইটির শক্তি—আপাতদৃষ্টিতে বিপর্যস্ত একটি জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির দিকে নজর দেওয়া, এবং জাতীয়তাবাদের বাগাড়ম্বরের যে অন্তঃসারশূন্যতা সেটা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা—এই দুটো বিষয়ের মধ্যে নিহিত।

অনুবাদ: আহসান হাবীব