বালুচদের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং বিজেঞ্জোর আত্মানুসন্ধান

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

ইন সার্চ অব সল্যুশন্স: অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অব মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো—মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো ইউনিভার্সিটি অব করাচি এবং পাকিস্তান লেবার ট্রাস্ট করাচি ২০০৯ ২৭০ পৃষ্ঠা

আজ যে ভূখণ্ডটি বেলুচিস্তান নামে পরিচিত, দেশ বিভাগের আগে যার নাম ছিল কালাত, তা কখনোই ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ ছিল না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করে, তখনো কালাতের অবস্থান ছিল অন্যান্য দেশীয় রাজ্য কিংবা ভারত ও পাকিস্তান ডমিনিকান থেকে ভিন্ন। ১৮৭৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী, কালাত একধরনের ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম’ রাষ্ট্রের মর্যাদা ভোগ করত।

যখন উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকার ছিল, কালাতের শাসকদের পক্ষে মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন এর বেতনভুক আইনি উপদেষ্টা। তিনি তখন কালাতের স্বাধীনতার পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহ কালাতের স্বাধীনতা খর্ব করতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেন; এমনকি সেনা অভিযান চালাতেও দ্বিধা করেননি।

পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পরদিন ১৫ আগস্ট কালাতের শাসক মির আহমেদ ইয়ার খান, যিনি খান সাহেব নামে অধিক পরিচিত ছিলেন, বেলুচিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যে কোয়েটা ও লাসবেলার শাসক নিজ নিজ রাজ্যকে কালাতের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে ৫ আগস্ট ১৯৪৭ কালাতের ভবিষ্যত্ নিয়ে দিল্লিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন, কালাতের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ রীতি অনুযায়ী, কালাতেও দারুল আওয়াম ও দারুল উমরাহ নামে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষ ছিল। দুই কক্ষেই সর্বসম্মত প্রস্তাব নেওয়া হয়, কালাত স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে, পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে না। এতে সমতার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি চুক্তি করার কথা বলা হয়, যদিও সেই চুক্তি কখনোই হয়নি। তার আগেই পাকিস্তান সরকার কালাতকে গ্রাস করতে নানা ফন্দিফিকির আঁটে।

২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কালাতের শাসক খান সাহেবকে পাকিস্তানে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি এখানে তুলে ধরা হলো:

আমার প্রিয় খান সাহেব,
আপনার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আজ কতিপয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে অত্যন্ত খুশি হয়েছি, যিনি আপনার পক্ষ হয়ে এসেছিলেন। আমরা বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেছি এবং তিনি আপনাকে আলোচনার ফল জানাবেন।

আপনার বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আমি আপনাকে পরামর্শ দেব অবিলম্বে পাকিস্তানে যোগ দিতে। আমি আশা করি, আপনি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করবেন এবং চূড়ান্ত উত্তর জানাবেন; করাচিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আপনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

আপনার অনুগত

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

এই অনুরোধের এক মাসের ব্যবধানে ১ এপ্রিল ১৯৪৮ পাকিস্তান সেনাবাহিনী কালাতে সামরিক অভিযান চালায় এবং খান সাহেবকে গ্রেপ্তার করে। তারা তাঁকে দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নেয়। কিন্তু তাঁর ভাই প্রিন্স আবদুল করিম কালাতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানের অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে বালুচ ন্যাশনাল লিবারেশন কমিটির (বিএনএলসি) নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫০ সালে গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। এরপর তিনি ২২ বছর বেঁচে ছিলেন, যার ১৬ বছরই কাটাতে হয় পাকিস্তানের কারাগারে।

আবদুল করিম খানের প্রত্যাশা ছিল, আফগানিস্তান তাঁদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানাবে। কেননা, আফগানিস্তান বরাবরই বালুচ ও পাঠান-অধ্যুষিত এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির বিরোধী ছিল। এমনকি তারা পাকিস্তানের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিরও বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তেমন সহায়তা তিনি পাননি। বালুচ জাতীয়তাবাদীরা যখন অন্য দেশে অন্তর্ভুক্তির চেয়ে স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তখন আফগানিস্তান সমর্থন প্রত্যাহার করে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তানে প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু করে বালুচরা, ১৯৪৮ সালে। বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু ১৯৭১ সালে এবং নয় মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। বালুচদের সংগ্রাম আজও পরিণতি পায়নি।

২.

বালুচদের স্বাধীনতাসংগ্রামের জানা-অজানা কাহিনি নিয়ে বেলুচের নেতা মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো লিখেছেন, In Search of Solutions: An Autobiography of Mir Ghaus Bakhsh Bizenjo. এটি ব্যক্তির জীবনী হলেও স্বাধীনতাকামী একটি জাতির সংগ্রামের কাহিনিই এতে বিবৃত হয়েছে।

পাকিস্তান বলতে অনেকের ধারণা, দেশটির সম্ভবত সবাই শোষক ও নির্যাতনকারী। কিন্তু বিজেঞ্জোর বই সেই ধারণা অনেকাংশে ভুল প্রমাণ করেছে। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে, বালুচ, পাঠান ও সিন্ধিরাও পাঞ্জাবিদের শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। তারা বাঙালিদের ছয় দফা আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়েছিল এ কারণে যে পাকিস্তানে সত্যিকার ফেডারেল-ব্যবস্থা চালু হলে তার সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানের ওই তিন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীও পাবে।

মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো ছিলেন কালাতের প্রথম রাজনৈতিক দল কালাত স্টেট ন্যাশনাল পার্টির (কেএলএফসি) সাধারণ সম্পাদক এবং দারুল আওয়াম বা কালাত জাতীয় পরিষদের প্রধান।

১৯৪৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর কালাত জাতীয় পরিষদে দেওয়া তাঁর ভাষণ আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন:

আমরা মুসলমান। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আমাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হবে এবং এই কারণে অন্য কারও সঙ্গে একীভূত হতে হবে। মুসলমান হওয়ার কারণে যদি আমাদের পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়া প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে আফগানিস্তান ও ইরানের মতো মুসলিম দেশগুলোরও পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতে হয়।...সম-সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আমরা ওই দেশটির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে প্রস্তুত আছি, কিন্তু একীভূত হতে নয়। যদি পাকিস্তান আমাদের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে গণ্য করে, তাহলে আমরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত আছি। আর পাকিস্তান যদি তা না করে এবং গণতান্ত্রিক নীতিমালা অগ্রাহ্য করতে থাকে, তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।...যদি আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে বাধ্য করা হয়, তাহলে প্রতিটি বালুচ সন্তান জাতীয় স্বাধীনতার জন্য জীবন উত্সর্গ করবে। [সূত্র: কালাত জাতীয় পরিষদে দেওয়া ভাষণ (১৯৪৭-১৯৪৮)]

৬২ বছর ধরে বালুচরা জীবন উত্সর্গ করা সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধেও তারা অস্ত্র ধরেছিল, যেমন ধরেছিল বাঙালিরাও। ১৯৫০ সালের মে মাসের শেষ দিকে আবদুল করিম খান কালওয়ান জেলার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযান চালান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এর প্রতিশোধ নেয়। এভাবে পাল্টাপাল্টি অভিযানের একপর্যায়ে সেনাবাহিনী বিদ্রোহী বালুচদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা আবদুল করিমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এই বলে এক চুক্তিতে সই করেন যে তাঁর পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তাঁরা কোরআন ছুঁয়ে চুক্তি মেনে চলার শপথ নেন। কিন্তু কালাত যাওয়ার পথে করিম খান ও তাঁর ১০২ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার সেই চুক্তির প্রতি অসম্মান দেখায়।

এ সম্পর্কে মির গাউস বক্স বিজেঞ্জোর ভাষ্য হলো: The accession was followed by banning of the KSNP and arrests of most of the leaders and active workers. I was among the arrested. I was then secretary of KSNP beside being the leader of the house in the Durul Awam.

আবদুল করিম খানের এই বিদ্রোহ দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো, বালুচরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি মেনে নেয়নি। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান সরকার চুক্তির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল। করিম খান ও তাঁর সহযোগীরা বালুচ স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছেন।

বালুচদের স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিণতি না পাওয়ার অন্যতম কারণ, তারা বিভিন্ন উপজাতি জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত। একসঙ্গে সব উপজাতি জনগোষ্ঠী লড়াই-সংগ্রাম চালাতে পারেনি। কোনো না কোনো উপজাতি জনগোষ্ঠী পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপস করেছে। সরকারও তাদের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে বশে আনতে সচেষ্ট থেকেছে।

আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করে বিজেঞ্জো লিখেছেন, ‘এতে যেসব উপাদান অনুপস্থিত ছিল, তা হলো উন্নত ও তীক্ষ জাতীয় মতৈক্য, স্বাধীনতার জন্য সর্বব্যাপী ও সুদৃঢ় প্রয়াস, সংগঠন, বস্তুগত শর্ত, নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্ব এবং সংগ্রামের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা।’ (পৃষ্ঠা ৬৯)।

বিজেঞ্জোর বই থেকে আমরা আরও জানতে পারি, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে কালাত স্টেট ন্যাশনাল পার্টির অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলে দলের নেতৃত্ব কৌশলগত কারণে মুসলিম লীগে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। বালুচ নেতারা পঞ্চাশের দশকে প্রকাশ্যে মুসলিম লীগের ব্যানারে কাজ করলেও গোপনে বালুচ রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র (বালুচ স্টেট ইউনিয়ন) গঠনের লক্ষ্যেই কাজ করছিলেন। তাঁদের স্বপ্ন ছিল কালাত, লাসবেলা, মাকরান, খারান নিয়ে এই ইউনিয়ন গঠিত হবে। বালুচদের এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কমিউনিস্টদের কাজের বেশ মিল আছে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় বাম নেতারা আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কিংবা শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে কাজ করতেন। তারও আগে কেউ মুসলিম লীগ ও কেউ কংগ্রেসের ব্যানারেও কাজ করেছেন। পার্থক্য ছিল কমিউনিস্ট নেতারা চেয়েছিলেন সমাজবিপ্লব, বালুচ নেতারা চেয়েছিলেন স্বাধীনতা। দুটোই অধরা থেকে গেছে।

পাকিস্তানের প্রথম দশকের রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো লিখেছিলেন,

The adoption of the 'Objectives Resolution' by the Constituent Assembly in 1949, opening a window for religious and sectarian elements to interfere in the process of constitution-making and eventual emergence of religious intolerance and violence in national politics and governance. (পৃষ্ঠা-৮৫).

তিনি আরও লিখেছেন, ‘১৯৫১ সালের তথাকথিত রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী, প্রগতিশীল ছাত্র, লেখক, সাংবাদিক ও শ্রমিকনেতাদের গ্রেপ্তার ও বিচার করে। তারা বামপন্থী সব সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালায়।’ (পৃষ্ঠা-৮৬)

উল্লেখ্য, ১৯৪৯-৫০ সালে পাকিস্তানের দুই অংশেই মুসলিম লীগবিরোধী দলের রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে নওয়াব মামদোতের নেতৃত্বে জিন্নাহ মুসলিম লিগ।

১৯৫৮ সালে সংঘটিত দ্বিতীয় বালুচ বিদ্রোহের সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে পূর্ববঙ্গের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যোগসূত্র ছিল। বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাঞ্জাবি শাসকেরা ভীত হয়ে সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে দুটি ইউনিট গঠন করে, যার একটির নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান এবং অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। এর আগে পূর্ব পাকিস্তান পূর্ববঙ্গ নামেই পরিচিত ছিল।

বালুচরা এক ইউনিট গঠনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। জেল থেকে বেরিয়ে আবদুল করিম খানও সেই আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁরা ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে দেখা করে কালাতকে এক ইউনিটের বাইরে রাখার পাশাপাশি উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান। দুই পক্ষের মধ্যে এই মর্মে সমঝোতা হয় যে কেউ কারও বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করবে না। দুর্ভাগ্যজনক যে এই সমঝোতা বেশি দিন কার্যকর থাকেনি। কেননা, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির আগেই সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেন, ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন শিখণ্ডী মাত্র। ৬ অক্টোবর ১৯৫৮ আইয়ুব খান কালাতে সেনা অভিযান চালান। বালুচরাও রাজনৈতিক কৌশল পাল্টে কঠোর অবস্থান নেয়। উপজাতীয় সর্দারেরা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। করিম খান গড়ে তোলেন নিজস্ব সমান্তরাল সেনাবাহিনী। এই প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী খান সাহেব ও তাঁর অনুসারীদের গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে সরকার। এ ঘটনা বালুচদের মধ্যে ব্যাপক ও লাগাতার প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, সর্বত্র দেখা দেয় বিদ্রোহ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গেরিলা-অধ্যুষিত এলাকায় নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে।

খান সাহেবের অনুসারী জাশওয়ান সর্দারেরা নওসেবা ও ওয়াদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। জাশওয়ানে জেহার উপজাতীয়দের প্রধান নওরোজ খান মিরঘাট পাহাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাঁদের প্রতি অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানান। তাঁরা কোরআন হাতে নিয়ে এই প্রতিশ্রুতি দেন যে অস্ত্রবিরতি করলে নওরোজ খান ও তাঁর সহযোগীদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে এবং সবাই সাধারণ ক্ষমার সুযোগ পাবেন। কিন্তু নওরোজ খান ও তাঁর দুই ছেলে অস্ত্রসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে সরকার তাঁদের জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। এরপর ১৯৬০ সালের জুলাইতে নওরোজের দুই ছেলেকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে কোহলু জেলে তাঁর আকস্মিক ও রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। এসবের মাধ্যমে আইয়ুব খান বালুচদের এই বার্তাই দেন যে অনুগত না হলে তিনি তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতেও দ্বিধা করবেন না।

১৯৫৮ সালের বিদ্রোহের পর বেলুচিস্তানের একেবারে গহিনে সেনাবাহিনীর একটি নতুন গ্যারিসন স্থাপন করে পাকিস্তান সরকার। এতে বেলুচিস্তানে সশস্ত্র বিদ্রোহ আরও ছড়িয়ে পড়ে, যার একটির নেতৃত্ব দেন শের মোহাম্মদ মারি। তিনি চিরায়ত গেরিলা যুদ্ধের চেয়ে চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নেন। দক্ষিণে কালওয়াশ এলাকার মেঙ্গল উপজাতি এবং উত্তরে মারি ও বাগতি উপজাতিদের মধ্যে তারা গেরিলা নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে। গেরিলারা যানবাহনে গুপ্ত হামলা ও ট্রেনে বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। এর জবাবে সেনাবাহিনী নৃশংস অভিযান চালায়, যাতে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল টিক্কা খান। এ কারণেই তাঁকে বেলুচিস্তানের কসাই বলা হয়। একাত্তরে যিনি বাংলাদেশের কসাই নামে কুখ্যাতি পেয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে এক ইউনিট প্রথা ভেঙে দেওয়া পর্যন্ত বালুচদের এই যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। এরপর বালুচরা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ‘যুদ্ধবিরতি’তে সম্মত হয়।

তৃতীয় বালুচ বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে সত্তরের দশকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে জয়ী হলেও বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে একটি আসনও পায়নি। দুটিতেই জয়ী হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও তাদের সমর্থকেরা। তখন ন্যাপের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল ওয়ালি খান ও মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো। তাঁরা পাঞ্জাবি ও সিন্ধির আধিপত্য ঠেকাতে ছয় দফার আদলে অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। তাঁদের প্রত্যাশা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফা কার্যকর হলে পশ্চিম পাকিস্তানে ছোট প্রদেশগুলোও স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা পাবে। কিন্তু ভুট্টোর একগুঁয়েমির কারণে সেই সংবিধান রচনার প্রয়াস সফল হয়নি। তার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ ভুট্টো খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পিপিপির সমর্থন না থাকায় ভুট্টো প্রাদেশিক সরকার গঠন নিয়ে টালবাহানা করেন। অনেক দেনদরবারের পর ভুট্টো গণরায়ের কাছে নতি স্বীকার করেন। ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিলে গাউস বক্স বেলুচিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ নেন। ১ মে ন্যাপের নেতা আতাউল্লাহ মেঙ্গলের নেতৃত্বে গঠিত হয় বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক সরকার। এরপর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও মুফতি মাহমুদের নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাপ-জমিয়াতুল উলেমার কোয়ালিশন সরকার। কিন্তু ভুট্টো মনেপ্রাণে তা মেনে নিতে পারেননি। তিনি দুই প্রাদেশিক সরকার উত্খাত করতে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেন।

ইতিমধ্যে বালুচদের মধ্যে পাঞ্জাববিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে এবং কোয়েটাসহ কয়েকটি স্থানে হামলা হয়। ইসলামাবাদে ইরাকি নিরাপত্তা অ্যাটাচের বাসভবন থেকে ৩০০ সোভিয়েত সাব-মেশিনগান উদ্ধার করা হয়। পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ, সোভিয়েতের সহায়তায় এসব অস্ত্র আনা হয়েছিল বালুচ বিদ্রোহীদের জন্য। অভিযোগ প্রমাণের আগেই ভুট্টো বেলুচিস্তানের মেঙ্গলের ন্যাপ সরকারকে বরখাস্ত করেন। প্রতিবাদে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সরকার পদত্যাগ করে। পরে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। এসব অস্ত্র আনা হয়েছিল ইরানে তৈরি কুর্দিদের প্রতিরোধ লড়াইয়ে সহায়তা করতে, যার সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দারা জড়িত ছিল।

মেঙ্গলের সরকার বরখাস্ত হওয়ার পর আবার বালুচ গেরিলারা সংগঠিত হয় এবং ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে সেনা কনভয়ে গুপ্ত হামলা চালায়। জবাবে ভুট্টো বেলুচিস্তানে ফের সেনা অভিযান চালান এবং তিন বালুচ নেতা মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো, আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল ও খায়ের বক্স মারিকে জেলে পাঠান। পরবর্তী চার বছর বেলুচিস্তানে সশস্ত্র লড়াই চলতে থাকে। গেরিলাদের মোকাবিলার একপর্যায়ে পাকিস্তান সরকার সেখানে ৮০ হাজার সেনাসদস্য পাঠায়। অন্যদিকে বালুচদের প্রতিরোধের মাত্রা বেড়ে যায়। ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে গেরিলারা অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে বেলুচিস্তানের সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে বেলুচিস্তান থেকে পাঞ্জাবে কয়লার চালান যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বালুচ বিদ্রোহীরা খনিজ কূপগুলোতেও হামলা চালায়। ভুট্টোর বালুচবিরোধী অভিযানে ইরানের শাহ ৩০টি মার্কিন কোবরা হেলিকপ্টার পাঠান; যা দিয়ে প্রতিরোধ ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয় ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে, যে সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালের শীতকালে চামালংয়ে শত শত বালুচ যখন বার্ষিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য সপরিবারে সমবেত হয়, তখনই বিমান থেকে বোমা ফেলে তাদের হত্যা করা হয়। বালুচরাও এর পাল্টা জবাব দেয়। কিন্তু সেনা অভিযানের মুখে তারা টিকতে না পেরে অধিকাংশ বালুচ গ্রুপ আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয়। ভুট্টো বালুচ বিদ্রোহ নির্মূল করার দাবি করলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ১৯৭৬ সালে মির খায়ের বক্স মারির নেতৃত্বে বেলুচিস্তান পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (বিপিএলএফ) দল গঠিত হয়।

১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে জেনারেল জিয়াউল হক বালুচ জাতীয়তাবাদীদের ভুট্টোবিরোধী মনোভাব কাজে লাগান। তিন বালুচ নেতা মির গাউস বক্স, আতাউল্লাহ মেঙ্গল ও আকবর খান বাগতিকে মুক্তি দিয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে আপসরফার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মারি জনগোষ্ঠীর একটি বিদ্রোহী গ্রুপ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যায়। ১৯৯০-এর দশকে বালুচ স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (বিএসইউ) পুনর্গঠিত হয় এবং তারাও প্রতিরোধে অংশ নেয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রধান হাতিয়ার ছিল ধর্ম। মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই রাষ্ট্র কেমন হবে, তার রূপরেখা ছিল না। যে কারণে ভারতীয় মুসলমানদের একটি বড় অংশ পাকিস্তানের বাইরেই থেকে যায়।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে কৌশলগত কারণে বালুচ নেতারা একপর্যায়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন গাউস বক্স বিজেঞ্জো, মির আহমেদ খান প্রমুখ। কিন্তু কিছুদিন পরই তাঁরা বুঝতে পারেন, মুসলিম লীগ কখনো তাঁদের অধিকার মেনে নেবে না। ১৯৫৫ সালে প্রদেশগুলো একীভূত করে পশ্চিম পাকিস্তানকে এক ইউনিটের অধীনে আনা হলে বালুচ জাতীয়তাবাদীরা তা মানতে পারেনি এবং তারা কালাত পিপলস পার্টি গঠন করে। ১৯৫৬ সালে বেলুচিস্তানের, পশতুন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খোদাই খিদমতগার পাঞ্জাবের আজাদ পাকিস্তান পার্টি, সিন্ধুর মাহাজ ও সিন্ধু হারি কমিটি মিলে গঠন করা হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল পার্টি (পিএনপি), যাতে জাতীয়তাবাদী, বামপন্থী ও কমিউনিস্টরাও ছিলেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করলে পিএসসির নেতারা সেই দলে একীভূত হন এবং সেটি দেশের বৃহত্তম বিরোধী দলে পরিণত হয়।

মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো বহুবার কারাভোগ করেছেন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আইয়ুব খানের আমলে জেলখানায় তাঁর ওপর নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছেন সহযোদ্ধা মির জুলখান নাসির এভাবে:

তাঁরা গাউস বক্স আমাদের থেকে আলাদা করে ফেলে এবং নির্যাতন চালায়। যখন তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়, আমি চিনতে পারছিলাম না। তিনি প্রাণে বেঁচে ছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হয়েছিল, বুড়ো হয়ে গেছেন। তাঁকে দেখে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ি। তখন তিনি সান্ত্বনা দিলেন, ও কিছু নয়।

১৯৬৬ সালে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান শেষে বিজেঞ্জো কোয়েটা ফিরে যাচ্ছিলেন। বালুচ নেতা নওয়াব বাগাতি কাগজের মুদ্রায় ‘ওয়ান ইউনিট টোর দো’ বা এক ইউনিট ছুড়ে ফেলো স্ট্যাম্পে লিখে ছাপ দিতেন। একদিন বাগতির ঘরে বসা ছিলেন বিজেঞ্জো ও সাইফুর রহমান মাজারি। এবং আরও কেউ কেউ। নওয়াবের কর্মচারী রেলওয়ে স্টেশন থেকে টিকিট কিনতে যান। এরপর টিকিট-ফেরত অর্থ পকেটে রাখেন। বিজেঞ্জো এর পরের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: ‘সকালে পুলিশ হোটেলে অভিযান চালায় এবং আমার সঙ্গে থাকা মুদ্রা দেখতে চায়। আমি যখন নোট বের করি, দেখি ৫০ টাকার একটি নোটে “ওয়ান ইউনিট টোর দো” লেখা। তারা নোট আটক করে এবং আমাকে গ্রেপ্তার করে কোয়েটা জেলে পাঠায়।’

সেই ঘটনাটি বরাবর বিজেঞ্জোর কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছে। নওয়াব বাগাতি কেন সোত্সাহে তাঁর কর্মচারীকে দিয়ে তাঁর ট্রেনের টিকিট আনালেন? মুদ্রায় ওয়ান ইউনিট টোর দো আন্দোলন সে সময়ে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। এ ঘটনায় বিজেঞ্জোর ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

৩.

মার্চের সেই অসহযোগের দিনগুলোতে অচলাবস্থা কাটাতে যে পাকিস্তানি রাজনীতিক বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর সাহায্য লাগবে কি না জানতে চেয়ে টেলিগ্রাম করেছিলেন এবং প্রত্যুত্তর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন, তিনি মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান আবদুল ওয়ালি খানকে নিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন ১৩ মার্চ। ১৪ মার্চ বাঙালি নেতার সঙ্গে তাঁদের কথোপকথনের সারাংশ বিবৃত হয়েছে বিজেঞ্জোর বইতে। সেই বৈঠকে বিজেঞ্জো ও ওয়ালি খান পাকিস্তান না ভাঙার অনুরোধ জানান। জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমরা কেন পাকিস্তান ভাঙব, আমরা তো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।’

পশ্চিম পাকিস্তানি দুই নেতা জানান, পরিস্থিতি খুবই জটিল। তিনি (শেখ মুজিব) যদি অনমনীয় অবস্থান নেন, তাহলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। আর যদি একত্রে থাকার কথা চিন্তা করেন, তাহলে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বসতে হবে। আমরা মনে করি, আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পথ বেরিয়ে আসবে; যেটি তাঁর (শেখ মুজিব) ও তাঁর দলের আইনগত অধিকার।

কিন্তু শেখ মুজিবের জবাব ছিল এ রকম: ‘আমি তোমাদের বলছি, তারা (ইয়াহিয়া অ্যান্ড কোম্পানি) আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এমনকি তাতে যদি পাকিস্তান ভেঙেও যায়। পাঞ্জাব কখনোই আমার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর মেনে নেবে না।’

১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বিজেঞ্জো ও ওয়ালি খানকে গভর্নর হাউসে আমন্ত্রণ জানান। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে তাঁরা বলেন, ‘আমাদের ধারণা, শেখ মুজিব বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো কিছু চান না। তিনি চান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। তাঁর এ দাবি অত্যন্ত ন্যায়সংগত।’

এরপর আমরা সবাই জানি, ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাও ঢাকায় এসে পৌঁছান। পরিস্থিতি বিপজ্জনক মোড় নিতে থাকে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারী বাঙালির সংঘর্ষ হয়। সেনানিবাসের বাইরে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সবকিছু চলত শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নির্দেশে।

শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিমা নেতাদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের সাংসদদের পৃথক অধিবেশন ডাকার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইয়াহিয়া অভিন্ন অধিবেশন ডাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন। বিজেঞ্জো আপস প্রস্তাব হিসেবে পাঁচটি প্রদেশের জন্য পাঁচটি সাংবিধানিক কমিটি গঠন করার কথা বলেন, যারা পরবর্তীকালে জাতীয় পরিষদের অভিন্ন অধিবেশনে বসবে। আলোচনা চলতে থাকে। ইতিমধ্যে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও ঢাকায় আসেন।

ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনার পর বিজেঞ্জো ও ওয়ালি খান ফের শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, ‘জেনারেলের মন ঘন ঘন পরিবর্তন হচ্ছে। এবং তাঁর প্রতি আস্থা রাখা যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আর এক বা দুটি অধিবেশন ডাকার কথা বলব না। আমি অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানাব। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আমিই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকব। মূল বিষয় হলো, সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং আমার দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।’

এরপর বিজেঞ্জো ও ওয়ালি খান যখন শেখ মুজিবের বার্তা নিয়ে ইয়াহিয়া খানের কাছে যান, তখন আর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের কারিগরি বিষয় নিয়ে ভাবছেন না। বিজেঞ্জোর ভাষ্য: তিনি আমাদের বললেন, ‘যদি তোমাদের বন্ধু মুজিব কথা না শোনে, আমার সেনাবাহিনী জানে তাকে কীভাবে কথা শোনাতে হয়।’ তিনি যোগ করেন, জেনারেল কথা বলে যাচ্ছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি কি মনে করেন, এই জটিল সমস্যার সমাধান সামরিক শক্তি দিয়ে হবে?’ তাঁর বিস্ময়কর উত্তর ছিল ‘না’।

এরপর বিজেঞ্জো লিখেছেন, ‘২৪ মার্চ যখন আমরা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করি, তিনি সতর্কতামূলক বার্তাটি জানিয়ে দিলেন।’ বললেন, ‘এখন তোমাদের দুজনেরই ঢাকা ছেড়ে যাওয়া উচিত। আগামী দুই দিনের মধ্যে সেনাবাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমাদের উপস্থিতি কোনো সুফল বয়ে আনবে না।’ তাঁরা দুজন বিস্ময় ও নির্বাক হয়ে সেখান থেকে ফিরে গেলেন।

ওই দিন রাতেই ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের সব নেতা ও জাতীয় পরিষদের সদস্যকে গভর্নর ভবনে ডাকেন। বিজেঞ্জো সেখানে না গিয়ে ন্যাপের নেতা মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে দেখা করে বামপন্থীদের মনোভাব জানতে চান।

বিজেঞ্জোর বই থেকে আমরা আরও জানতে পারি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যেসব গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, সে সম্পর্কে পাকিস্তানি জনগণ কিছুই জানত না। সরকার বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম জানতে দেয়নি। বিদেশি পত্রপত্রিকার খবরকে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে মনে করত।

এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো যে বিবরণ দিয়েছেন, আমাদের ধারণা, অন্যান্য পাকিস্তানি রাজনীতিক থেকে তা ভিন্ন। ২৫ মার্চের অভিযান সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য:

এটি ছিল নিরস্ত্র নারী-পুরুষ ও শিশুর ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা। এর বিরুদ্ধে ৩০ হাজার বাঙালি সেনা, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল ও পুলিশ সদস্য যে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন, তাঁদের অনেকে জনগণের সঙ্গে মিশে যান, অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। দলত্যাগী সেনা কর্মকর্তারা হাজার হাজার বাঙালি যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেন।

বিজেঞ্জো এক জায়গায় লিখেছেন,

Howsoever dedicated and strong willed the Mukti Bahini might be, they were obviously no matches to the well-trained and well-equipped modern regular army of Pakistan. Through brute force and all-embracing terror, the Pakistan army kept toying in vain to regain control over East Pakistan, but this 8 crore Bengalis to the last man and woman, had turned into rebels with a cause - freedom.

একজন স্বাধীনতাসংগ্রামীই অন্য দেশের বা জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামকে এতটা আবেগ ও দরদ দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন।

৪.

বইয়ের নাম In search of Solutions. সমাধানের অনুসন্ধান। কিসের অনুসন্ধান? আপন জাতিসত্তার এবং স্বাধীনতার। সংঘাতের পথ ছেড়ে তিনি বারবার সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। যে রাষ্ট্র তাঁর হূদয়ে বহমান, কখনো দৃশ্যমান হয়নি, সেই রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন আজীবন, বারবার জেল খেটেছেন, অত্যাচার-নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিন্তু নীতির সঙ্গে আপস করেননি। একজন ব্যতিক্রমী ও মানবদরদি রাজনীতিক হিসেবে তাঁর নিজের দেশের এবং বহির্বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে থেকেছেন।

মির গাউস বক্স বিজেঞ্জোর জন্ম ১৯১৮ সালে। বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি কংগ্রেসের মাধ্যমে। কেননা, সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের চেয়ে সেক্যুলার কংগ্রেসই তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করত।

নাতিদীর্ঘ এই বইতে লেখক নিজের বেড়ে ওঠার সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের চালচিত্র তুলে ধরেছেন। আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল, একদা কালাত বা বর্তমান বেলুচিস্তান বরাবর পাকিস্তানেরই অংশ ছিল (লন্ডনে পাকিস্তানি ছাত্রনেতা রহমাত আলী প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান নাম উচ্চারণ করেন, তাতে বেলুচিস্তান থেকে ‘স্তান’ নেওয়া হয়েছিল কোনো বালুচকে না জিজ্ঞেস করেই। আর বাংলার কোনো স্থানই ছিল না)। ধারণাটি একেবারেই ভুল।

কীভাবে পাকিস্তানি শাসকেরা বেলুচিস্তান দখল করে নেয়, সেখানকার স্বাধীনতার যোদ্ধাদের কী নির্মমভাবে দমন করে, তার সংক্ষিপ্ত অথচ বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ আছে এই বইতে। আরও আছে পাকিস্তানি শাসকদের অপশাসন, নীতি ও অদর্শহীন কর্মকাণ্ড, সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের ষড়যন্ত্রের কথা। ক্ষমতার জন্য মরিয়া রাজনৈতিক দলগুলো ও নেতাদের ঝগড়া-বিবাদ ও ব্যর্থতার সুযোগ নিয়েই বারবার সেখানে সামরিক শাসন জেঁকে বসে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালি-ভীতিকে ব্যবহার করেছেন। এরপর কখনো পাঠান, কখনো বালুচ, কখনো মুহাজির-ভীতিকে। আসলে শুরু থেকে পাকিস্তানি রাজনীতিতে যে পাঞ্জাবি শোভিনিজম ছিল, এখনো তা বহাল আছে।

বিজেঞ্জোর বই থেকে আমরা পাকিস্তানের সামরিক শাসক তো বটেই, বেসামরিক শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাত বছরের নিষ্ঠুর শাসনের কথা জানতে পারি। জানতে পারি, তিনি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে কীভাবে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছেন তা-ও।

বইতে বিবৃত হয়েছে কীভাবে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক হয়ে আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদলে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। যে মুজাহিদ ও তালেবানের বিরুদ্ধে এখন যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার, পাকিস্তানের মাটিতে সেই মুজাহিদ ও তালেবান তৈরি হয়েছিল তাঁরই আর্থিক ও আস্ত্রিক সহযোগিতায়। বিভিন্ন দলে ও গ্রুপে বিভক্ত ওই মুজাহিদরা যখন দেশ শাসনে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প শক্তি হিসেবে তালেবান তৈরি করে। এসব পুরোনো কথা সবাই জানেন, বিজেঞ্জো আরও একবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

আমরা বইটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগে দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত, দ্বিতীয় ভাগে অখণ্ড পাকিস্তানি আমল এবং সবশেষে একাত্তর-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ।

আইয়ুব খানের আমলের অত্যাচার, নির্যাতন প্রবাদবাক্য হয়ে আছে। সেখানকার শত শত বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে মাসের পর মাস কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। যখন আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন, তখনই প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাকে গ্রেপ্তার করেন এবং বিভিন্ন মেয়াদে জেল দিয়ে নির্বাচনে তাঁদের অযোগ্য ঘোষণা করেন।

এই বইতে আরও কিছু চমকপ্রদ তথ্য-উপাত্ত আছে, যা ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হবে। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন আইয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহ। ন্যাপের নেতা মওলানা ভাসানী, যিনি ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী হতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর স্থলে আইয়ুব খানকে সমর্থন জানান। আইয়ুবের প্রতি ভাসানীর ছিল বিশেষ সহানুভূতি। আবার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁর ব্যাপক প্রভাব ছিল। ভাসানী পরে আইয়ুব খানকে সমর্থন জানানোর কথা স্বীকার করেছিলেন এবং তাঁর এই সমর্থনের পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছিলেন।

এ সময় মওলানা প্রকাশ্যে বলতে থাকেন, ‘আমাদের আইয়ুবের বিরোধিতা করা উচিত নয়, কেননা তিনি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করেছেন।’ তাঁর প্রবাদতুল্য সেই উক্তি ‘ডন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’—আইয়ুবকে বিব্রত কোরো না?

গাউস বক্স বিজেঞ্জো বিষয়টিকে মোটেই ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশ বলে মনে করেন না। তাঁর বিশ্লেষণ হচ্ছে,  ‘Somehow it had become a fashion for some of our leftists to give preference to external legalities over the imperative needs of our own country and its people.’

মওলানা ভাসানীকে যখন এর বিপক্ষে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক দিতে বলা হয়, তিনি রাজি হননি বরং আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেন। নোটিশ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন বিজেঞ্জো। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সদস্য একটি সভা আহ্বানের দাবি জানালেও মওলানা ভাসানী রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি তলবি সভা আহ্বানের মধ্য দিয়ে ন্যাপ ভাগ হয়ে যায়। বামপন্থীদের এই বিভাজনের সুযোগে পূর্বাংশে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিমাংশে পিপিপি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পেছনে পড়ে যান বামপন্থীরা।

পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে বিজেঞ্জোর পর্যবেক্ষণ হলো: পাকিস্তানি সামরিক চক্র নির্বাচনী ফলাফলে হতাশ হলো। ‘গতকাল’ আগরতলা ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার ঘটনা ছিল তাদের কাছে বজ্রাঘাতের মতো। তিনি আরও লিখেছেন, ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার ঘোষণা দিলে পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট দলগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। (পৃষ্ঠা ১৪২)

‘ইয়াহিয়া সরাসরি নির্বাচনী কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু বিভিন্ন দল ও গ্রুপকে আর্থিক এবং অন্যান্যভাবে সাহায্য করেছেন, যাতে ভোট ভাগ হয়ে যায় এবং কেউ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়। (পৃষ্ঠা-১৪১)

আমরা এ-ও জানি, ১ মার্চের অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যরা যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভুট্টো তার বিরোধিতা করেন এবং করাচি থেকে খাইবার পর্যন্ত সবকিছু অচল করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর জবাবে বিজেঞ্জো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পিপিপির নেতা যা-ই বলুন না কেন, ন্যাপের জাতীয় পরিষদের সদস্যরা অবশ্যই ঢাকার অধিবেশনে যোগ দেবেন।’

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন দলের জাতীয় পরিষদের সদস্যরা ঢাকায় আসেন ৩ মার্চ নির্ধারিত অধিবেশনে যোগ দিতে। কিন্তু ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। সে সময়ে ঢাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বিজেঞ্জো লিখেছিলেন: ‘The Bengalis were furious. For 23 years, despite being in majority, they were denied access to the orbit of real power and decision-making.’ (১৪৫)

১৯৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জুনেজো আফগানিস্তান সংকট নিয়ে সর্বদলীয় সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেই সম্মেলনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো বলেছিলেন:

ভারতীয় হস্তক্ষেপের কারণেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটছে বলে যাঁরা মনে করেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। সত্য হলো, আমাদের শাসকদের অন্যায়-অবিচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ভারতীয়দের আমন্ত্রণ জানানো ছাড়া বাঙালিদের হাতে বিকল্প ছিল না এবং ভারত তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছে।

বাঙালির আলাদা হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি উল্লেখ করে বিজেঞ্জো বলেছেন, ‘আপনারা যেহেতু এই দেশে বাস করেন, সেহেতু সিন্ধ দেশ, স্বাধীন বেলুচিস্তান, স্বাধীন পাখতুনখাওয়া প্রভৃতি স্লোগান না শুনে পারেন না।’

৫.

মির গাউস বক্স বিজেঞ্জোর জন্ম ১৯১৮ সালে, সে বছর তাঁর জন্মভূমি তালাতে মরণঘাতী ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই দুর্যোগ কেটে গেলেও স্বগোত্রীয়দের মতো গাউস বক্স বিজেঞ্জোকেও আরেক দুর্যোগ আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রাখে, তার নাম রাজনৈতিক দুর্যোগ। বিজেঞ্জোর জন্ম শাংক শাওয়ে, করাচি থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, হিংগাল নদীর পারে। মাত্র এক বছর বয়সে বাবা মারা যান। বিজেঞ্জোর বয়স যখন মাত্র চার বছর, তখন তাঁর মা কালাতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি কর্নেল কিসকে সন্তানের পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করতে বলেন। তিনি কথা রেখেছিলেন। তাঁর সহায়তায় বিজেঞ্জো পড়াশোনা করেছেন কোয়েটার সানডিমান হাইস্কুলে (১৯২৫-১৯৩৫)। এরপর কোয়েটায় ভয়াবহ ভূমিকম্প হলে অধিকাংশ বাসিন্দা মারা যান, মাকে নিয়ে বিজেঞ্জো চলে যান করাচিতে। ভর্তি হন সিন্ধ মাদ্রাসা হাইস্কুলে। সানডিমান হাইস্কুলে পড়াশোনা করার সময়ই বিজেঞ্জো একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কালাতের বাইরে করাচি ও কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে যেতেন ফুটবল খেলায় অংশ নিতে।

একটি খেলা দেখতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন বিজেঞ্জোকে সেখানে ভর্তি হওয়ার আমন্ত্রণ জানালে তিনি রাজি হন। আলীগড়ে থাকতে তিনি ফুটবলের পাশাপাশি রাজনীতিতেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মুসলিম লীগের পরিবর্তে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিজেঞ্জো তাঁর বইয়ে লিখেছেন, তিনি এমন এক অঞ্চলের বাসিন্দা, যেখানে পণ্য কেনাবেচার জন্য মুদ্রার বদলে পণ্য বিনিময়প্রথা চালু ছিল। তিনি এমন এক অঞ্চলের বাসিন্দা, যেখানে শাসকের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল না, যেখানে কিছুদিন আগেও দাসপ্রথা চালু ছিল, হত্যার বদলে ক্ষতিপূরণ বা ব্লাড মানি দেওয়ার নিয়ম ছিল। বিশ ও ত্রিশের দশকে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যেখান থেকে হাজার হাজার মানুষ সিন্ধু, পাঞ্জাব এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও পাড়ি জমিয়েছে। এমনকি বিদেশে গিয়ে তারা নিজেদের বালুচ পরিচয় দিতেও কুণ্ঠিত ছিল।

বালুচরা বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা কখনোই অন্যের বশ্যতা মেনে নেয়নি। যে কারণে ব্রিটিশরা ১৮৭৬ সালের চুক্তিতে কালাতকে (বেলুচিস্তানকে) একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নেয়। তবে ব্রিটিশরা পরবর্তীকালে সেই চুক্তির শর্ত মানেনি। বেলুচিস্তান মূলত নানা উপজাতীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। তারা একতরফা কালাতের শাসকের কাছ থেকে কোয়েটা, নাওসবি ও নাসিরাবাদ নিয়ে নেয়। ১৮৭৯ সালের চুক্তি অনুযায়ী, সোয়ালাট গিনিজ, চ্যামন ও নিবির দখল করে নেয়। অন্যদিকে মারি-বাগতি উপজাতীয় এলাকাও অধীন করে ফেলে। এর মাধ্যমে ব্রিটিশরা বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় করে এ এলাকা থেকে।

বেলুচিস্তানের প্রথম রাজনৈতিক উদ্যোগ আনজুমানে ওয়াতান বা ফাদার ল্যান্ড পার্টি। ১৯৩৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় কালাত ন্যাশনাল পার্টি (কেএসএনসি)। মির আবদুল করিম কুদতের সভাপতি এবং মালিক সৈয়দ মুহাম্মদ হক সাধারণ সম্পাদক হন। এ দুই পার্টি একই সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক এবং দেশীয় সরদারদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

আমরা বিজেঞ্জোর বইয়ে আরও জানতে পারি, মুসলিম লীগ ভারতের মুসলমানদের একমাত্র সংগঠন দাবি করলেও প্রায় সব মুসলিম ধর্মীয় ও ধর্মীয় রাজনৈতিক গ্রুপ এবং ধর্মীয় নেতারা তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৩৫ সালের ভারত আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সারা ভারতে মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ৪৮৪টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেয়েছে ১০৮টি এবং অন্যান্য মুসলিম সংগঠন ও কংগ্রেস পেয়েছে ৩৭৬টি। (পৃষ্ঠা-৫১)

অবশ্য পরবর্তী ১০ বছরে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কংগ্রেস ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই নিশ্চয়তা চায় যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করবে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন জানানোর নীতি গ্রহণ করে। তাদের সম্মতি ছাড়া সাংবিধানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতা করে। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ লাহোর প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৪২ সালে জাতীয় কংগ্রেস ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং মহাত্মা গান্ধীসহ বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। মুসলিম লিগের নির্বাহী কমিটির আইন অন্যান্য আন্দোলনকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রোহ হিসেবে অভিহিত করে। এতে মুসলমানদের যোগ না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

গাউস বক্সের বইতে বিস্তারিত না হলেও সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে ১৯৫১ সালের রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্রের কথাও। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ৯ মার্চ প্রথম ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জনসমক্ষে আনেন। এই অভিযোগে বহু সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই সঙ্গে সারা দেশে গ্রেপ্তার হন বহু কমিউনিস্ট ও বামপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী।

বালুচ, সিন্ধ বা বাঙালিদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল শুরু থেকেই। বিজেঞ্জোর ভাষায়, পূর্ব পাকিস্তানে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের (১৯৫৪) পরদিন থেকেই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো তাঁকে উত্খাত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে এবং চূড়ান্তভাবে তারা সেই সুযোগের ব্যবহারও করে।

বালুচ ও বাঙালির জাতিগত সংগ্রামের মধ্যে মিল-অমিল দুটোই আছে। বাংলাও ধর্মের ভিত্তিতে একাধিকবার ভাগ হয়েছে, কিন্তু বালুচরা ধর্মের চেয়ে জাতিসত্তাকেই তাদের সংগ্রামের হাতিয়ার করেছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে বাঙালি নেতা সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম-শরত্ বসু প্রমুখ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছিলেন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানের ভেতরে তাদের ভবিষ্যত্ ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল। আবার বাঙালি হিন্দু সংখ্যালঘুর শঙ্কা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে না পেরে বাংলা ভাগের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। ফলে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। ভারতীয় গবেষক-ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, যে বাঙালি হিন্দু ১৯০৫ সালের ধর্ম বিভাগের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করেছে, সেই বাঙালি হিন্দু বাংলা ভাগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

অন্যদিকে বালুচরা কখনোই পাকিস্তানকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। সবশেষ আকবর বাগাতি জীবন দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামের স্বাক্ষর রেখেছেন। শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব বালুচ নেতার অধিকাংশ সময় কেটেছে কারাগারে।

মির গাউস সাক্ষ্য দিচ্ছেন: 'Associating the people with the government and administration of the state', the Khan had promulgated a 'constitution' through what was called the Government of Kalat State Act 1947 (পৃষ্ঠা-৫৯)

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ববঙ্গের মানুষ ভাষার জন্য জীবন দেয়। একই সালের মার্চে কালাত, মাকরান, খামান ও লাসবেলাকে নিয়ে স্বাধীন বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নেন বালুচ নেতারা।

১৯৫৫ সালে আগা সাহেব মুহাম্মদ হোসেন আনসা, মির গুল ও বিজেঞ্জো মিলে জেল থেকে বেরিয়ে কীভাবে উস্তামান গুল (পার্টি অব দ্য পিপল) গঠন করলেন, এক ইউনিটের বিরুদ্ধে তাঁর পর্যবেক্ষণ: The wave of protest against One Unit and parity formula began to spread from one end of the country to the other - from Quetta to Chittagong. (পৃষ্ঠা-৮৪)

বিজেঞ্জো আরও লিখেছেন: Iskander Mirza was growing uneasy over Suhrawardy's high profile national and international stature as a veteran politician of the subcontinent. (পৃষ্ঠা-৯৪)

বিজেঞ্জো বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেন, পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালিবিদ্বেষ মনোভাব। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান বিজেঞ্জোকে বলেছিলেন, আজ বা আগামীকাল পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। যদি তা-ই ঘটে, তাহলে আমরা কেন তাদের আমাদের রক্তপান করতে দেব? গাউস বক্স বিজেঞ্জো ও তাঁর অনুসারীরা বরাবর জোর দিয়েছেন ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। তাঁদের কথা হলো, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে এক বা একাধিক ফেডারেল স্টেটই কেবল সব জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে পারে।

গাউস বক্স মনে করেন, একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য ধর্মই মূল উপাদান হতে পারে না। তাদের মধ্যে ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক মিল থাকতে হবে। নির্বাচনী প্রচারণা সম্পর্কে বিজেঞ্জো লিখেছেন: In Baluchistan and NWFP, national autonomy was the key issue in the election campaign. (পৃষ্ঠা-১৪২)

অনেকে ভাবতে পারেন, পাকিস্তানি শাসকেরা কেবল বাঙালি রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তাঁদের জেলে পুরেছে। কিন্তু বিজেঞ্জোর বই পড়লে আমাদের গা শিউরে ওঠে। কী বীভত্স ও নিষ্ঠুর নির্যাতন! পাকিস্তানি শাসকেরা সাধারণ বন্দী নন, রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর কী অমানুষিক আচরণ করতেন, তার বিবরণ আছে বিজেঞ্জোর বইতে। তিনি লিখেছেন:

হাত বাঁধা অবস্থায় দিনের পর দিন দাঁড় করিয়ে রাখা, খালি গায়ে প্রবল বাতাসের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা, সিলিং থেকে শরীর নামানোর সময় শরীর ক্যানিং করা, উপুড় করে শুইয়ে পিঠের ওপর অবিরাম বুটের লাথি মারা, বন্দীদের ক্ষুধার্ত রাখাও ছিল নির্যাতনের আরেক কৌশল।

ন্যাপের ভাঙন সম্পর্কে বিজেঞ্জো লিখেছেন, The Maulana's deviation from the basic political stance of Nap was responsible for the unfortunate split in the party. (পৃষ্ঠা-১২৭-২৮)

দুই সামরিক শাসনের তুলনা করে বলেছেন, Yahya Khan imposed martial law but did not ban political parties unlike Ayub Khan and there were no mass arrests of political leaders. (পৃষ্ঠা-১৪১)

গাউস বক্স বিজেঞ্জো ইতিহাসবিদ নন। তিনি ইতিহাস লেখেননি। লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। একটি জনগোষ্ঠীর মরণ-বাঁচন লড়াইয়ের কথা। তিনি যে জনমণ্ডলী থেকে উঠে এসেছেন, তাদের কখনোই ভুলে যাননি। বালুচদের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি জানতে বিজেঞ্জোর In Search of  solution আকর গ্রন্থ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে।