বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

ভূমিকা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে সাম্প্রতিক কর্মচাঞ্চল্য এই সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে জনমনে গভীর কৌতূহল ও আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। নিকট প্রতিবেশী সম্পর্কের গভীরতা ও জটিলতা যেন তার সমস্ত অবয়ব নিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। বস্তুত, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে দুই দেশের মানুষের ইতিহাস, ভূগোল, ভাবাবেগ, মূল্যবোধ ও স্বার্থের এক অপূর্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে এক বিশেষত্ব দান করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ভারতীয় সরকার ও জনগণ এবং বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে অপূর্ব সমন্বয় ও সমঝোতা কালক্রমে আমলাতান্ত্রিকতার বেড়াজালে আটকে গেছে, পথ হারিয়েছে অবহেলা আর সন্দেহের চোরাগলিতে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হামেশাই ঝড় তুললেও দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে বাংলাদেশ যেন শুধু চলমান ইতিহাসে কখনো কখনো একটি পাদটীকা আবার কখনো কখনো সাময়িক বিড়ম্বনামাত্র। প্রাতিষ্ঠানিক বা সরকারি যোগাযোগ ও আদান-প্রদানে শিষ্টাচার ও আগ্রহ বজায় থাকলেও জনগণের পর্যায়ে দুই দেশের অস্তিত্ব যেন অচেনা ঠিকানায়। কখনো কখনো মনে হয় যেন আমরা বিপরীত গন্তব্যের যাত্রী।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সাম্প্রতিক কালের কর্মচাঞ্চল্যও ভারতের সরকারি কাঠামো ও জনগণের মধ্যে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য দাগ কাটতে পেরেছে বলে মনে হয় না। প্রায় একই চিত্র বাংলাদেশেও। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরের পরে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা গেছে, এমন দাবি করা কঠিন। কোনো কোনো ভারতীয় বিশ্লেষক একে ভারতবিরোধী প্রচারণার ফল বলে মনে করেন। অনেকে মনে করেন, এটি বাংলাদেশের বিভাজিত রাজনীতির অবদান। আবার অনেকে এতে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের গন্ধও আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হন। অনেক বাংলাদেশি বিশ্লেষকও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের মনোভাবে একই ধরনের উপাদান খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছেন। এ কথা সত্য যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে এ ধরনের কিছু উপাদানের উপস্থিতি থাকতেই পারে। তবে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের জন্য যা প্রয়োজনীয় তা হলো, এ ধরনের ধারণাগুলো বাইরে গিয়ে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক রোডম্যাপ তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিশেষ মনোযোগ প্রত্যাশা করে, তার মধ্যে সরকার ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক, ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা এবং কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে দুই দেশের আপেক্ষিক অবস্থান। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আবেগ বা আদর্শিক অবস্থানের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষণীয়। কখনো কখনো তা ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়কে ঘিরে, কখনো কখনো তা ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, দুই দিক থেকেই এমন প্রবণতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে প্রভাবিত করে চলেছে। এর অর্থ এই নয় যে প্রায়োগিক উপযোগিতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনোই অবদান রাখেনি। তবে বিবর্তনশীল সম্পর্কে তা যে পরিমাণে ক্রিয়াশীল হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা যে হয়নি, সে কথা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা চলে; যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একধরনের ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তবে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, বিশ্বায়নের প্রভাবে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়গুলোর মধ্যে বিভাজন ক্রমহ্রাসমান হওয়া নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের আবির্ভাব, সহযোগিতামূলক নিরাপত্তা কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা এবং সর্বোপরি জনগণের মধ্যে যোগাযোগের গভীরতা বৃদ্ধি দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এ অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককেও নতুন কাঠামোয় বিন্যস্ত করার জরুরি প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: অতীত অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভিত রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের জনগণ সেসময়ে দেওয়া ভারতের সমর্থন ও সাহায্যের কথা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। সেই সঙ্গে এ কথাও ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধের মহান দিনগুলোতে বাংলাদেশের আপামর জনগণ যে চেতনা ও দৃঢ়তা নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক অভিযানকে পরাস্ত করে এবং অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল, তার মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক কঠিন আত্মপ্রত্যয় ও আত্মপরিচয়। তত্কালীন বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ এবং সেই সঙ্গে ভারতের সরকার ও জনগণের মধ্যে চিন্তা ও কর্মের যে গভীর সাযুজ্য তৈরি হয়েছিল, সেই নিরিখে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কয়েকটি বিষয় দৃশ্যমান ছিল। প্রথমত, ভারত মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন সত্তাকে স্বীকার করে নিতে দেরি করেনি। বিনিময়ে বাংলাদেশও তার প্রতিদান দিতে কার্পণ্য দেখায়নি। একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কাঠামোকে অবলম্বন করে বাংলাদেশ জাতি হিসেবে তার যাত্রা শুরু করে। ভারত গণতান্ত্রিক ও বন্ধুভাবাপন্ন বাংলাদেশকে তার আঞ্চলিক স্বার্থের সহচর বলে মনে করে। ফলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের নিরাপত্তাসংক্রান্ত আগ্রহগুলো আমলে নিয়ে ১৯৭২ সালে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্ব ও নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অনেক নীতিনির্ধারক ও গবেষক বিষয়টিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তার স্বাধীন সত্তার প্রকাশ এবং ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশকে তার প্রভাববলয়ে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস হিসেবে মনে করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সহযোগিতা যথার্থ ছিল বলেও অনেকেই মনে করেন। ভারত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতার হাতও প্রসারিত করে রাখে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জটিলতা ও সংকট এবং তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ভারতের অব্যাহত সমর্থন বাংলাদেশের জনগণের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। বস্তুত, দুই দেশের সম্পর্কে সমস্যার বীজও নিহিত ছিল বাংলাদেশের জনগণের আত্মসম্মান অর্জনের প্রয়াসের মধ্যে। তবে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে বাংলাদেশ ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত লক্ষ্যসমূহ অর্জনে ভারতের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হলেও স্বাধীনভাবে পথ চলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে বাংলাদেশ মেনে নিতে রাজি ছিল না এবং এ ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই ভারতের পছন্দের বাইরে গিয়ে কাজ করতেও দ্বিধা করেনি। যেমনটি দেখা গেছে ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনে যোগদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ পদক্ষেপে। এই সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দুই দেশের সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে, যার নেতিবাচক প্রভাব দুই দেশের সম্পর্কের ওপরেও এসে পড়ে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা-উত্তরকালে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্নতা একই সঙ্গে পরিলক্ষিত হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে দুটি ঘটনার কথা বলা যায়। এর মধ্যে একটি হলো ১৯৭৪ সালে স্থলসীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্ভূত জটিলতা। আর একটি হলো ১৯৭৫ সালের ফারাক্কা বাঁধের ঘটনা। ভারতের প্রতিশ্রুতি ছিল, ফারাক্কা বাঁধ চালু হবে অন্তর্বর্তীকালীনভাবে (৪১ দিনের জন্য)। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সেটা পুরোদমে চালু থেকে যায়। ফলে এ বিষয়ে দুই দেশের মতের ভিন্নতা প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং তত্পরবর্তী পর্যায়ে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের ফলে মূল্যবোধ ও স্বার্থ—এ দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ও ভারত ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করে। এখানে যা লক্ষণীয় তা হলো, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে ভাবনার যে সাযুজ্য তৈরি হয়েছিল, তা সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে তিরোহিত হয়। সরকারি বা নীতিগত পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকতা বজায় থাকলেও জনগণের পর্যায়ে এসে দুই দেশের মধ্যে এক বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়, যা পরবর্তীকালে দুই দেশের সম্পর্ককে কখনো কখনো প্রায় বৈরিতার পর্যায়ে ঠেলে দেয়। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৬-৭৭ সালের ঘটনাবলির কথা মনে করা যেতে পারে। পরে ১৯৭৭ সালে ভারতে কংগ্রেস সরকারের পতন হলে দুই দেশের সম্পর্কের খানিকটা উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে গঙ্গা নদীর স্বল্পমেয়াদি পানিবণ্টন চুক্তি এবং ১৯৮০ সালের দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তি একধরনের উন্নতির ইঙ্গিত বহন করে। তবে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের বিষয়গুলো যতই প্রাধান্য পেতে থাকে, ততই দুই দেশ তাদের মৌলিক স্বার্থ অর্থাত্ নিরাপত্তার প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে পড়ে এবং সম্পর্কের ভিত্তি ও প্রাধান্য পরিবর্তিত হয়ে ভূরাজনৈতিক বিষয়ে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। ভারতে ১৯৮০ সালে কংগ্রেস সরকার ফিরে এলে এবং ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে সরকারের পরিবর্তন ঘটলেও এ পার্থক্য বিরাজমান থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তিবাহিনীর প্রতি ভারতের কথিত সহযোগিতাকে অনেকে তারই একটি প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেন। গত শতকের আশির দশকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের খানিকটা উন্নতি ঘটলেও নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য বজায় থাকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে গড়ায়। এই সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নীতিতে কয়েকটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। প্রথমত, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ও পাক-ভারত সম্পর্কে একটি কালো ছায়া নিপতিত হয়। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত বিশ্লেষণ করে ভারতীয় বিশ্লেষকদের অনেকেই বাংলাদেশকে ভারতের হুমকির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হন। দ্বিতীয়ত, এ কারণে ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে তার আগ্রহও হারাতে থাকে এবং নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের অবস্থান কঠোর করতে থাকেন। তৃতীয়ত, একই সঙ্গে ভারত বাংলাদেশের প্রতি আদর্শভিত্তিক অবস্থান থেকে সরে এসে বাস্তবভিত্তিক সহযোগিতাকে সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। বাংলাদেশও ভারতের অবস্থানকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সচেষ্ট হলে সম্পর্কের উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেনি। বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতাকে জোরদার করার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের একটি নতুন কাঠামো গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সার্কের প্রতিষ্ঠা তারই একটি প্রকাশ।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কারের এক বড় সুবিধাভোগী হয়ে ওঠে ভারত এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের এজেন্ডায় প্রধান বিষয় হিসেবে উঠে আসে। তবে নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ে ধারাবাহিকতার বাইরে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তার অনুযোগ, যেমন: অবৈধ অভিবাসন ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদদানের অভিযোগ উত্থাপন অব্যাহত রাখে। এই সময়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে মোটামুটি স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি গঙ্গা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তারই ফল হিসেবে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়ে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের নতুন বিন্যাসকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের নতুন সরকার পানির হিস্যা অর্জনে মোটামুটি সফল হয়। পশ্চিমবঙ্গের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর অসাধারণ অবদানের কথা এ ক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হয়। এই সময়ে নিরাপত্তা বিষয়েও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে চুক্তি ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া সম্ভব হতো না বলে অনেকেই মনে করেন। বলা বাহুল্য, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার বাতাবরণ তৈরি হয়, যদিও চুক্তির অনেক বিষয় বাস্তবায়নই এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এর পরও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে বিদ্রোহীদের নিয়ে ভারতের অনুযোগ কম-বেশি বজায় থাকে। দুই দেশের সীমান্তেও একধরনের উত্তাপ বিকিরিত হতে থাকে, যার ফলে ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে পাদুয়া ও রৌমারী অঞ্চলে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলে সীমান্তে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। তত্পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার বিষয়টিকে এ ঘটনার পরম্পরা বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। তা সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশকে ভারতে বাংলাদেশের কূটনীতি সচল ও সরব ছিল; খানিকটা সৃজনশীলতাও বাংলাদেশ দেখাতে পেরেছে এই সময়ে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট

২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকারের জয়লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়নে একটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। কয়েকটি বিষয় এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রথমত, ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকারের আদর্শগত নৈকট্যের বিষয়টি লক্ষণীয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ভারতের নৈতিক সমর্থনের বিষয়টিও ভারতের প্রতি বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। সম্প্রতি ব্রিটেনের বিখ্যাত পত্রিকা ইকোনমিস্ট এ বিষয়ে কয়েকটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের জোরালো সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান ভারতের জন্য তিনটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। এর একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ উত্থানের সম্ভাবনাকে শক্ত হাতে দমন করায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, যা ভারত তার স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করে এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে নৈতিক সমর্থন ও পরামর্শ প্রদান করে। আরো একটি সুযোগ হলো, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার এক দুর্লভ সুযোগ লাভ করে। এ ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে করিডর বা ট্রানজিটের সুবিধা লাভও ভারতের স্বার্থের অনুকূল বলে বিবেচিত হয়। বস্তুত, বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে এবং এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারকে সব রকম সহযোগিতা প্রদানে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের উদ্যোগ সন্দেহাতীতভাবে ভারতীয় সরকারি পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একধরনের বিশ্বাসের ওপর দাঁড় করাতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে অবশ্য ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তির প্রত্যাশাকেও উত্সাহিত করে।

২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অনেক বিষয়ে মতৈক্য পোষণ করেন। সেই প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবিরোধী কাজ এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। অনেকটা অপ্রত্যাশিত ও একপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রানজিটের সুুবিধা এবং ভারতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধাদানে রাজি হয়। সীমান্ত সমস্যা সমাধানেও নেতারা রাজি হন। বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নয়নেও তাঁরা নতুন ক্ষেত্র নিয়ে মনোযোগী হন। বাংলাদেশ কর্তৃক ভারত থেকে বিদ্যুতের আমদানি এবং ভারত কর্তৃক এক মিলিয়ন ডলারের ঋণদান উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর অন্যতম। এখানে লক্ষণীয় যে যৌথ ঘোষণায় ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরেও অনেকগুলো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বিষয়ে আগ্রহী হলেও ভারত তার বৈশ্বিক বিষয়ে বাংলাদেশের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়। যৌথ ঘোষণায় নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধাদানে বাংলাদেশ ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভারতের কোনো সুস্পষ্ট অঙ্গীকার তাতে প্রকাশ পায়নি। তবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে সম্পর্কোন্নয়নের সমন্বয়কের দায়িত্বে নিয়ে আসায় এসব প্রক্রিয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। দুই দেশের সুশীল সমাজ, বিশেষ করে মিডিয়া, দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের প্রক্রিয়ায় জোরালো সমর্থন জ্ঞাপন করে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখানে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশলের তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, বাংলাদেশ তার অপেক্ষার নীতিমালা থেকে সরে এসে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারত ও বাংলাদেশ স্বল্পমেয়াদি বা ইস্যুভিত্তিক সমাধানের বাইরে গিয়ে দুই দেশের সম্পর্ককে একটি বড় কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। ভারতীয় চাহিদার বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভারতকে কৌশলগত সুবিধাদানে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের মোটামুটি একটি ইতিবাচক বাতাবরণ তৈরি হয়, যদিও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে দীর্ঘসূত্রতার অতীত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে দ্বিধাদ্বন্দ্বের উপস্থিতিও কম নয়। সম্ভবত এ ধরনের নেতিবাচক সম্ভাবনা মাথায় রেখেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে দুই দেশের উঁচু পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় সফরের মধ্য দিয়ে আস্থা তৈরির জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে মিশ্র বক্তব্য বিভিন্ন ইস্যুতে, বিশেষ করে, ট্রানজিট বিষয়ে জটিলতার জন্ম দেয়। এই সম্পর্কে যথাযথ গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনার অভাব ও বিপরীতমুখী মন্তব্য একদিকে যেমন জনমনে বিভ্রান্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, তেমনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে অনেকটা ইচ্ছা করেই প্রত্যাশার ফানুসও তৈরি করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের অভাব ও অস্বচ্ছতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে জনমনে সন্দেহ ঘনীভূত করে।

এই প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬-৭ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর। দুটি দিক দিয়ে এই সফরকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। প্রথমত, প্রতীকী দৃশ্যমানতার দিক থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে, বিশেষ করে, বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে দেখা করে এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তার সফরকে গভীরতা দিতে চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া কতগুলো মৌলিক দ্বিপক্ষীয় বিষয়েও অগ্রগতির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। যেমন, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষর; ১৯৭৪ সালের স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণে চুক্তির সমর্থনে প্রটোকল স্বাক্ষর; ৪৭টি বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্তভাবে ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার প্রদান; দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুত্, পানিসম্পদ, খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ বিস্তৃতি, জলবায়ু ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে যৌথভাবে কাজ করা এবং প্রয়োজনে পানিসম্পদ ব্যবহারে নদীর অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের বিষয়ে দুই দেশের নেতারা একমত হন। এ ছাড়া, যৌথ ঘোষণায় অন্য বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সম্পর্কের গণ্ডি ও গতি বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়নি এবং সে কারণেই ট্রানজিট সম্পর্কেও কোনো মতৈক্যে পৌঁছানো যায়নি। তবে এ কথা জোর দিয়েই বলা চলে যে বাংলাদেশের জনগণ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়াকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি এবং এর কারণে সফরের অন্যান্য উপাদানও অনেকাংশে তাদের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে মালদ্বীপে সার্ক সম্মেলনের সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় মিলিত হন। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টিও তাঁদের আলোচনায় স্থান পায়। তবে ভারতের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি উত্থাপন করলেও কোনো অগ্রগতির ইঙ্গিত মেলেনি। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও সংস্থার মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ ঘটনা টিপাইমুখ বিষয়ে ভারতের অঙ্গীকার ও বাস্তবায়নের মধ্যে ফারাক জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। বলা বাহুল্য, এতে করে দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি আরও গভীর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সফলতা ভারতের জন্য গুরুত্ব বহন করে নানা কারণে। কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক, যা গত ৪০ বছরে চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে, তাকে একটি ধারাবাহিকতার মধ্যে নিয়ে আসার সফলতা দেখানোর ব্যাপারে দুই পক্ষই আগ্রহী ছিল। কৌশলগত দিক থেকেও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা ভারতের জন্য জরুরি ছিল। এ ছাড়া একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে তার কূটনৈতিক সফলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করতেও সচেষ্ট ছিল। কিন্তু সফরের মিশ্র ফলাফল ভারতের ভাবমূর্তিকে নেতিবাচক অবস্থায় ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের বাইরেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের কাছে এটি প্রতীয়মান হয় যে ভারত যখন বিশ্বাঙ্গনে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তখনো সে তার অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করতে অপারগ। এ বিষয়ে অনেক ভারতীয় বিশ্লেষকও মনে করেন, বাংলাদেশ সফরের অসম্পূর্ণতা বহির্বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশ সরকারের জন্যও এ সফর একই ধরনের ফলাফল বয়ে এনেছে। নীতিনির্ধারক মহলের কূটনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে বাংলাদেশ যা পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি দিয়ে ফেলেছে, এমন ধারণাটিও গভীরতা লাভ করে। ফলে ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের মধ্য দিয়ে যে ইতিবাচক যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে আংশিক পূর্ণতা লাভ করে। অনেকেই মনে করেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর প্রক্রিয়াগতভাবে সফল মনে করা হলেও ফলগতভাবে অপূর্ণ। ইতিমধ্যে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অস্থিরতার যে ইঙ্গিত মিলছে, তাতে সম্পর্কের উদ্যোগ কতখানি বাস্তবায়ন সম্ভব, তা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে শুরু করেছে।

এই বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইতিমধ্যে ভারত ১৯৭২ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন চুক্তির আওতায় আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের জন্য বিনা মাশুলে পণ্য পরিবহন শুরু করে। কয়েক সপ্তাহের জন্য পরিচালিত এ ধরনের পণ্য পরিবহনকে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট বলা হলেও এ নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, এ ধরনের ট্রানজিট বিষয়ে যখন কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি, ঠিক হয়নি পণ্য পরিবহনের কোনো হার এবং ভারী পণ্য পরিবহনের উপযোগী কোনো পরিকাঠামো নেই, তখন এ ধরনের তাড়াহুড়া জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। ভারতের এ ধরনের প্রয়াস এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নীতিগত অস্পষ্টতা পরিষ্কারভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনকি যাঁরা ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের সপক্ষে জোরালো যুক্তি উত্থাপন করে এসেছেন, তাঁরাই এ ধরনের পরীক্ষামূলক প্রয়াসকে সন্দেহের চোখে দেখছেন এবং বাংলাদেশে কাঠামোগত সক্ষমতা অর্জনের আগে এ ধরনের সুযোগদানের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন। এই পথে ট্রানজিট-সুবিধার ফলে ভারত যে আর্থিক সাশ্রয় অর্জন করবে, তা থেকে বাংলাদেশকে ভাগ দেওয়ার দাবিও তাঁরা জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করছেন। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ ধরনের ট্রানজিট-ব্যবস্থাকে ‘চালবাজি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর নেতিবাচক পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন। প্রথম দিকে খানিকটা গ্রহণযোগ্যতা প্রকাশ করলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের চুক্তি সম্পাদনের আগে এ ধরনের ট্রানজিট প্রদানকে অগ্রহণযোগ্য বলা হচ্ছে। বস্তুত, তাত্ত্বিকভাবে ১৯৭২ সালের নবায়িত অভ্যন্তরীণ নৌ ট্রানজিট প্রটোকলের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের মাল্টিমডাল ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহন যৌক্তিক হলেও সাম্প্রতিক কালের এ বিষয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনা ও সংবেদনশীলতা আমলে না নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার দৃশ্যত একধরনের অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করে। সংগত কারণেই ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, জনসম্পৃক্ততার অভাবে এ ধরনের উদ্যোগে দীর্ঘ কোনো কল্যাণ বয়ে আনার সম্ভাবনা কম। বস্তুত, স্বাধীনতা-উত্তর কালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মিসিং লিংক হচ্ছে সরকার ও জনগণের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতা বা বোঝাপড়ার অভাব। এর ফাঁক দিয়ে একদিকে তৈরি হয়েছে খানিকটা অবহেলা, অন্যদিকে তৈরি হয়েছে খানিকটা সন্দেহ এবং খানিকটা বৈরিতা।

ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে তিনটি বিষয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রথমত, ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় দৃশ্যত তার প্রভাববলয় বিস্তার করতে বরাবর আগ্রহী হলেও ভারতের নেতাদের ও বিশ্লেষকদের ধারণা, তাঁদের নিজস্ব অর্থনৈতিক বিকাশ এবং বহির্বিশ্বে তাঁদের স্বীকৃতি তেমন পরিস্থিতিকে আরও সহজ করে তুলেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এই কাজে সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তাঁরা মনে করেন। এটি তাঁদের আঞ্চলিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার অংশও বটে। স্বল্প ও মধ্য মেয়াদের ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করতে বাংলাদেশের সহযোগিতা অপরিহার্য বলেই মনে করে। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বিস্তারের আলোকে এ বিষয়ে ভারতের মনোযোগ আরও বেড়ে গিয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। দ্বিতীয়ত, ক্রমবর্ধমান আর্থিক উন্নয়নের আলোকে ভারত বাংলাদেশকে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে গণ্য করে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ভারতের অংশগ্রহণের সুযোগ ভারতের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ী নেতারা হালকাভাবে নিচ্ছেন না। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে এবং অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ এখন অনেকাংশেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্যের উত্স হিসেবে ভারত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যেও ভারতের উপস্থিতি বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। যোগাযোগের মাধ্যমে বিনিয়োগ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এ সম্পর্ক জোরদার হবে, তার নমুনাও দৃশ্যমান। প্রাকৃতিক সম্পদের বণ্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার বিষয়ে দুই দেশ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। কূটনৈতিক দর-কষাকষি ও পেশাগত উত্কর্ষের মাধ্যমে এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশই লাভবান হবে বলে অনেকে মনে করেন। তবে যে বিষয়টি নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে, তা হলো নিরাপত্তা। বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারই ভারতের নিরাপত্তার সংবেদনশীলতার বিষয়টি মাথায় রেখে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পরিচালনা করেছে। তবে অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ-ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ে সংবেদনশীল ও ইতিবাচকভাবে বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হলেও বাংলাদেশকে ভারতের নিরাপত্তা কাঠামোতে ভারতের মতো করে আত্মীকৃত করা সহজ হবে না। কারণ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতি হিসেবে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে বরাবরই আগ্রহী থাকবে। সরকারি পর্যায়ে ভাবনা যা-ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ-ভারতের গত ৪০ বছরের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাস এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রা ইতিমধ্যেই সংযোজন করে রেখেছে। বিশেষ করে, তরুণ সমাজ এ বিষয়ে অধিকতর স্পর্শকাতর, সে কথা জোর দিয়েই বলা চলে। ভারতের দৃশ্যত একপক্ষীয় আচরণ কখনো কখনো বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে অপেশাদার প্রস্তুতি বাংলাদেশের নেতৃত্বের কূটনৈতিক দুর্বলতাকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নীতি ও কাঠামোগত দুর্বলতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক অবস্থা সম্পর্কে যেমন জ্ঞান ও তথ্য থাকা দরকার, তেমনি প্রয়োজন স্থানীয় অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের ধারণা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। ফলে যেকোনো সম্পর্ক গড়তে বা কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে আমরা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছি না। উদীয়মান শক্তি ভারতকে যে গভীরতা নিয়ে বোঝা দরকার, তার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ধারাকে যেভাবে উপলব্ধি ও নীতির প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন ছিল, তা পেশাদারির সঙ্গে করা সম্ভব হয়নি বলে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ভবিষ্যত্ চেহারা কেমন হতে পারে, তা দেখার আগে বুঝে নেওয়া দরকার ভারত ও বাংলাদেশ কেন একে অপরের জন্য অপরিহার্য। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারত অনেকগুলো ইতিবাচক সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই গণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্রকেই তারা তাদের রাষ্ট্রীয় সংগঠনের কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছে। ভারতের গণতন্ত্র যেমন গভীরতা অর্জন করেছে, তেমনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রও প্রমাণ করেছে যে সে ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়েও বরং সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশ ঐতিহাসিক যোগাযোগের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে একে অপরের সম্পূরক হতে পারে, হতে পারে পারস্পরিকভাবে অর্থবহ। একই সঙ্গে দুই দেশই প্রাকৃতিক সম্পদের, বিশেষ করে পানি, জ্বালানি ও জলবায়ুর অংশীদার এবং এই সম্পদের সুষম বণ্টন ও ব্যবহারের মাধ্যমে পারস্পরিকভাবে লাভবান হতে পারে। ভারতের পূর্বমুখী নীতি, যা ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ইতিবাচক অবদানের সুযোগও খাটো করে দেখার উপায় নেই। এই প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই বাংলাদেশ ও ভারতের আগামী দিনের সম্পর্ক গড়ে তোলা যেতে পারে।

প্রথমত, বাংলাদেশ ও ভারতের মূল্যবোধ ও স্বার্থের সাযুজ্যের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে এর ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সাধারণ মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া ও সহযোগিতার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। সামাজিক শক্তির সঞ্চালনের মধ্য দিয়ে মানুষকে ক্ষমতায়িত করার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ স্থাপন করেছে, তা ভারতের জন্যও শক্তির উত্স হতে পারে। সম্ভবত সেই সম্ভাবনা সামনে রেখেই গান্ধী পরিবারের ছেলে ও ভারতের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী রাহুল গান্ধী সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনে সুশীল সমাজের ভূমিকাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে গেছেন। সামাজিক মূলধন তৈরিতে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। অশিক্ষা ও রোগবালাই দূরীকরণে, খাদ্য উত্পাদন ও জলবায়ুসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করার বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের সহযোগিতা দুই দেশের জনগণের মধ্যে বোঝাপড়া ও সম্পর্ক সৃষ্টিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যা এই মুহূর্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কাঠামোতে প্রায় অনুপস্থিত। এ ছাড়া এ ধরনের বোঝাপড়া পারস্পরিক বিশ্বাস সৃষ্টি এবং সহযোগিতামূলক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। দ্বিতীয়ত, সহযোগিতামূলক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। তবে এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ ও ভারতকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নিরাপত্তা ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অতিমাত্রায় নিরাপত্তাকেন্দ্রিক সম্পর্কের অসারতা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত শান্তি ও নিরাপত্তা চুক্তির কথা মনে করা যেতে পারে। পাক-ভারত দ্বন্দ্বকেন্দ্রিক সম্পর্কের বাইরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন মডেল নিয়ে ভাবতে হবে। ভারতকে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে হবে এবং সেই ভিত্তিতে সম্পর্কের নতুন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও ভারতের যুক্তিসংগত নিরাপত্তা শঙ্কাগুলোকে আমলে নিয়ে যেকোনো ধরনের অস্বচ্ছ ও প্রায়ই অকার্যকর নেতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে নতুন মডেল হিসেবে উপস্থাপন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। তা বাস্তবায়িত হলে শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কেই নতুন মাত্রা যোগ হবে না, তা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্যও আকর্ষণীয় ইঙ্গিত হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারে। মনে রাখা দরকার, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যখন তথ্য ও বিশ্বাসের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে, তখন তাকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যেকোনো ধরনের তাড়াহুড়া বা সংক্ষিপ্ত পথ চূড়ান্ত বিবেচনায় হঠকারিতায় রূপান্তরিত হতে পারে।

এই আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস সৃষ্টি এবং সম্পর্কোন্নয়নে একটি রোডম্যাপের কথা ভাবা যেতে পারে। সময়ের ব্যাপ্তিতে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ এই কাজে সহায়ক হতে পারে। স্বল্প মেয়াদে সহজে সমাধানযোগ্য বিষয়সমূহ যেমন স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণসহ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সীমান্ত সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভিসা-পদ্ধতি সহজীকরণ, চালু যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে গ্রাহকবান্ধব করে তোলা, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এ ধরনের অনেক বিষয়েই ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারত চুক্তি সম্পাদন করেছে। এখন যা প্রয়োজন, তা হলো একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এগুলো বাস্তবায়িত করা। মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশ, ভারতসহ প্রাকৃতিক সম্পদের অংশীদার অন্যান্য আঞ্চলিক দেশকে সম্পৃক্ত করে, বিশেষ করে, অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন ও ব্যবহার, জ্বালানি নিরাপত্তা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশেষ করে, স্থল ও জলপথে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে পারস্পরিক সুবিধা লাভের জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে ভৌগোলিক কারণে ভারত এক অনন্য অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এবং ভারতের কাছেই এসব ক্ষেত্রে উদ্যোগ প্রত্যাশা করা যেতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত বিপর্যয় ঠেকাতে যথোপযুক্ত সহযোগিতার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের আলোকে অন্যান্য জটিল বিষয়কে এ ধরনের কাঠামোর আওতায় এনে বাংলাদেশ ও ভারত আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্পর্ককে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারে।

অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের উত্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি সুসংবাদ। এই প্রক্রিয়ায় ইতিবাচকভাবে সব প্রতিবেশী দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকেও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। এতে করে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে বলে ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। অপর দিকে বাংলাদেশকেও ভারতের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের ধারাকে বুঝতে হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় ক্রিয়াশীল সব শক্তির সঙ্গে সমন্বয় ও বন্ধুত্ব গড়ে তুলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশের কূটনৈতিক কাঠামোকে আরও বেশি কার্যকর ও শক্তিশালী করা এবং একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পেশাদার সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভারতনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া। বলা বাহুল্য, আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বিষয়টি ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং এটি একটি গভীর স্বার্থের বিষয়। এখানে প্রয়োজনে ছাড় দিতে হবে, প্রয়োজনে কূটনৈতিকভাবে দর-কষাকষি করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর জন্য দরকার একটি সামাজিক কূটনৈতিক বাতাবরণ ও কাঠামো তৈরি করা। বিভাজিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশে এটি আপাতদৃষ্টিতে কঠিন মনে হলেও  তা একেবারেই অসম্ভব নয়।

উপসংহার

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে ভারতের কাছ থেকে অবজ্ঞার অবগুণ্ঠন থেকে বেরিয়ে এসে অনেকটা আবেগ নিয়েই ভারতের প্রতি একধরনের গেইম চেঞ্জিং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাক-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্কের বাইরে একটি নতুন সম্পর্ক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। ভারতকে বাংলাদেশ সেই অবস্থানে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। ভারত বলছে, তারা বাংলাদেশকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সম্পর্কের নতুন মডেল তৈরি করতে চায়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের কি সেই পরিমাণ মনোযোগ আছে? নাকি তারা বাংলাদেশকে তাদের আঞ্চলিক কৌশলগত লক্ষ্যের পথে একটি অংশীদার হিসেবে মনে করে? গত কয়েক মাসে ভারতের অনেক বিশ্লেষক এই নিরিখে ভারতের দক্ষিণ এশীয় নীতিকে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, দক্ষিণ এশিয়া ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কতটুকু প্রাধান্যের বিষয়, যা ভারতের আঞ্চলিক কৌশলগত লক্ষ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ? এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রত্যাশা, ভারত গভীরভাবে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাববে। সহজ কথায় বলা যায়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক নতুন সম্পর্কের ভিত গড়ে দিতে পারে, যদি তা সৃজনশীল ও ভবিষ্যত্মুখী ভাবনা ও নীতি-কাঠামোর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। সে ক্ষেত্রে অতীত ও বর্তমান যেমন উপস্থিত থাকবে, তার চেয়ে বড় আহ্বান নিয়ে দাঁড়াবে ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের মানুষ।