তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দুই ব্যক্তির ছায়া

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ধারণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি ক্রমবর্ধিষ্ণু মতবাদ। যদিও বাংলাদেশ মডেলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অচেনা। জামায়াতে ইসলামী ১৯৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকার এক রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশে ‘একটি নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি’ প্রবর্তনের ঘোষণা দেয়। এদিন তারা প্রথমবারের মতো অনির্বাচিত ব্যক্তি সমন্বয়ে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে (সংগ্রাম, ৮ ডিসেম্বর ১৯৮০)। এরপর ১৯৮৩ সালের ২০ নভেম্বর এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানে জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররম মসজিদসংলগ্ন এক জনসভায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ফর্মুলা দিয়েছিল (সংগ্রাম, ২১ নভেম্বর ১৯৮৩)। এমনকি পঞ্চম সংসদে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী প্রথম এ সংক্রান্ত বিল জমা দিয়েছিলেন। যদিও পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের (১৯৯৬-২০০০) আমলে সরকারিভাবেই দাবি করা হতো যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা শেখ হাসিনার উদ্ভাবন ও তাঁরই চিন্তার ফসল।

নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য পৃথিবীর নানা দেশে, এমনকি এ উপমহাদেশেও, দূর অতীতকাল থেকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আকাঙ্ক্ষা অনুভূত হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখাটি কী হবে, তা নিয়ে বিশ্বের নানা দেশে নানা মাত্রায় মতভেদ দেখা যায়। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি বোধগম্য এবং এটি সর্বজনীন হওয়াটাও অসম্ভব নয়।

উন্নত গণতন্ত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার একটি বিশেষ রূপ গড়ে উঠেছে, যা সুষ্ঠু নির্বাচন ও অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর অবিকশিত ও ভঙ্গুর গণতন্ত্রে আরেকটি বিশেষ রূপ গড়ে উঠেছে অন্তবর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের, যেটি নানা বিচারে  উপযুক্ত বা অনুসরণীয় বলে গণ্য করা চলে না। বর্তমান নিবন্ধের শুরুতে এ রকম কয়েকটি দেশের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার গোড়ার কথাগুলো বলে নেওয়া হচ্ছে। এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার একটি বিস্তারিত পর্যালোচনা করার চেষ্টা থাকবে এখানে। আর শেষের ভাগে পঞ্চদশ সংশোধনীর কেমন ফল বাংলাদেশের ওপর পড়তে পারে, সেটি তলিয়ে দেখা হয়েছে।

১. বিশ্বজুড়ে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে অনলাইন বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক হলো তারাই, যারা কোনো সরকারব্যবস্থায় অস্থায়ী ভিত্তিতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু তারা জানে যে তারা তাদের স্বপদে অল্প সময়ের জন্য বহাল থাকবে, দীর্ঘ মেয়াদের জন্য নয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একমত যে আস্থা ভোটে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর যে বিরতিকাল সৃষ্টি হয়, সেখানে আপনাআপনিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছায়া পড়ে।১ সে কারণেই পৃথিবীর নানা দেশে তত্ত্বাবধায়ক বা অনুরূপ বিভিন্ন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

শুরুতেই বলে রাখা দরকার, গণতন্ত্রের ভাবনার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার সম্পর্ক আছে। উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা যেভাবে গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে যেসব দেশে গণতন্ত্রের তেমন বিকাশ হয়নি সেসব দেশের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার মোটা দাগের ভিন্নতা আছে। অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার থেকে খুবই আলাদাভাবে এই ধারণা উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছে ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার যে রূপ আমরা নিচে তুলে ধরছি সেখানেও লক্ষ করলেই দেখা যাবে, উপমহাদেশে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্যার নামান্তর। আর বাংলাদেশেও একটি তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে গিয়ে অনাস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে। অবশ্য এটা প্রত্যক্ষ সেনাশাসন বা হস্তক্ষেপ রোধ কিংবা সাংবিধানিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া রোধে কতটা ভূমিকা রেখেছে সেটা বিবেচ্য। কিন্তু কোনো সাংবিধানিক বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ব্যবস্থা শক্তিশালী করেনি, বরং আরও দুর্বল করেছে।

ক. বিশ্বের বিভিন্ন দেশ

ব্রিটেন

ব্রিটেনে রেওয়াজ গড়ে উঠেছে যে নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার আপনাআপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তর লাভ করে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় এমন কোনো কাজ করে না বা করতে পারে না, যাতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে নিজের অনুকূলে তেমন সুবিধা নিতে পারে। কেবল দৈনন্দিন কাজ পরিচালনাই এ সরকারের কাজ। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো অন্য কয়েকটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশে বহু আগেই এমন রেওয়াজ গড়ে উঠেছে।

ব্রিটেনে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর ইতিহাস বেশ পুরোনো। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরাইলি ১৮৮১ সালে মারা যান। স্যার স্টাফফোর্ড নর্থকোট টরি পার্টির নেতা হলেন। ১৮৮৫ সালে লিবারেল পার্টির প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন অনাস্থা ভোটে পরাস্ত হন। রানি ভিক্টোরিয়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতিবেগ দেখে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ সময় তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লর্ড সালিসবারিকে বেছে নিয়েছিলেন। সংখ্যালঘু দলের (কনজারভেটিভ) নেতাও কখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ১৮৮৫ সালের ২৩ জুন থেকে ১৮৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সালিসবারি তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সালিসবারির পরে ১০০ বছরের ব্যবধানে ভারতের চরণ সিংও (চরণ সিংকে নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা আছে) তেমনই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।২

১৯৪৫ সালে স্যার উইনস্টন চার্চিলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। স্যার আইভর জেনিংস ১৯৫৯ সালে চার্চিলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বলছেন:

এই বই যখন কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশে ব্যবহূত হচ্ছে, তখন এটা ব্যাখ্যা করা উচিত যে একটি সাধারণ নির্বাচনের মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়োগ দেওয়া ব্রিটিশ রীতি নয়। ১৯৪৫ সালে এটা করা হয়েছিল। কারণ, যুদ্ধকালীন কোয়ালিশন সরকার (জাতীয় সরকার) ভেঙে গিয়েছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে এটা স্থির করা দরকার ছিল যে নতুন সরকারটি কনজারভেটিভ না লেবার হবে, আর এ সময়ে সরকারি কাজও চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সেটা একটা বিরাট ব্যতিক্রম।

কনস্টিটিউশনাল প্রসেসেস ফলোয়িং জেনারেল ইলেকশন (ফিফথ রিপোর্ট অব সেশন ২০০৯-২০১০) নামে ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের জাস্টিস কমিটির একটি প্রতিবেদন রয়েছে। এ থেকে দেখা যায়, ব্রিটেন কেয়ারটেকার সরকার প্রশ্নে অস্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করার কথা ভাবছে। কনভেনশনগত কেয়ারটেকার মেয়াদে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া নিয়ে তারা চিন্তিত। তবে ব্রিটেন যা এতকাল অনুসরণ করছে, তা এখন হয়তো তারা লিখে নেবে। তাই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রণালয়গুলো কেয়ারটেকার মেয়াদে সাধারণভাবে দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময় মনে রাখবেন, তাঁরা একটি কেয়ারটেকার পরিবেশ অতিক্রম করছেন। এ সময় তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষভাবে যত্নশীল হবেন। মন্ত্রিসভার সচিব এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে সচেষ্ট থাকবেন।’ কমন্সের ওই প্রতিবেদনমতে, ‘ব্রিটেন ওই রকম একটা কেয়ারটেকার কনভেনশন তখনই গ্রহণ করবে, যখন দেখা যাবে যে সদ্য ঘোষিত নির্বাচনের ফলাফলে কোনো দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্পষ্ট নয়। এ অবস্থা কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ হতে পারে।’

অস্ট্রেলিয়া

স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় সাধারণ নির্বাচনের আগে গভর্নর জেনারেল যখন পার্লামেন্ট ভেঙে দেন, তখন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়ে ওঠে, তাকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বলা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দীর্ঘ কনভেনশন গড়ে উঠেছে। যদিও নির্দিষ্ট কোনো আইন দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সচিবালয়ের আওতায় একটি সুসংজ্ঞায়িত কনভেনশন সেখানে গড়ে উঠেছে। সাধারণ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে নতুন কোনো নিয়োগের ঘটনা ঘটে না। ক্ষমতাসীন সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপ ধারণ করে। ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এক সাংবিধানিক সংকট দেখা দিয়েছিল। তখনকার গভর্নর জেনারেল স্যার জন কার বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মতো একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিলেন ম্যালকম ফ্রেশারের নেতৃত্বে। নতুন নির্বাচন দিয়ে তিনি বিদায় নেন। সেই থেকে সেখানে গড়ে ওঠে কেয়ারটেকার কনভেনশন। এই কনভেনশন বলেছে, এর আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এ ধরনের কনভেনশন কানাডা ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশেও রয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রশ্নে অস্ট্রেলিয়ারই রয়েছে একটি সুলিখিত রীতি। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী অ্যাডমন বার্টন। ১৯০১ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বার্টন সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তী ১০০ বছরের বেশি সময় অস্ট্রেলিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এমন একটি ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের আকাঙ্ক্ষার একটি মিল পাওয়া যায়। আইন না থাকলেও তাদের কনভেনশন আর অলিখিত নেই। ২০১০ সালে তারা সর্বশেষ কেয়ারটেকার কনভেনশন সংশোধন করে। এর সূচনাতেই বলা আছে, নির্বাচন-পূর্বকালে সরকার ‘তত্ত্বাবধায়ক ভূমিকা’ পালন করবে। প্রতিনিধি পরিষদ (হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস) বিলুপ্ত এবং পরবর্তী নির্বাচনের ফল স্পষ্ট হওয়ার কিংবা যদি সরকারের পরিবর্তন আসে, নতুন সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত এর মেয়াদ থাকবে সংক্ষিপ্ত। তত্ত্বাবধায়ক মেয়াদে বিদায়ী সরকার উল্লেখযোগ্য কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না। দেবে না কোনো উল্লেখযোগ্য নিয়োগ। দেশে বা বিদেশে কারও সঙ্গেই যাবে না কোনো উল্লেখযোগ্য চুক্তিতে।

প্রফেসর জর্জ উইন্টারটনের মতে, কেয়ারটেকার কনভেনশন অস্ট্রেলিয়ায় খুবই কার্যকরভাবে চলছে। অস্ট্রেলিয়ার ২০১০ সালের কনভেনশন গুরুত্বপূর্ণ। কেয়ারটেকার সময়ে বাজেট কী করে পাস হবে, সে সম্পর্কেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। সরকারি ও বিরোধী দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার মেটাতে রয়েছে ১৯৯৮ সালের চার্টার অব বাজেট অনেস্টি অ্যাক্ট। কেয়ারটেকার আমলের শুরুতে অর্থ বিভাগ গাইডলাইন জারি করে। বিরোধী দলের সঙ্গে নির্বাচন-পূর্ব আলাপ-আলোচনার জন্য ১৯৭৬ সালের সরকারি দল সংসদে গাইডলাইনের খসড়া উপস্থাপন করে। ১৯৮৭ সালে সিনেটে পাস হওয়া একটি গাইডলাইন বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। এটা আবার কেয়ারটেকার কনভেনশনস থেকে ভিন্ন। দি কনস্টিটিউশনাল সিস্টেমস অব দ্য অস্ট্রেলিয়ান স্টেটস অ্যান্ড টেরিটরিস (২০০৬) বইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেরার্দ কার্নে লিখেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় কনভেনশন হচ্ছে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরে বিদায়ী মন্ত্রিসভা অন্তর্বর্তীকালীন কেয়ারটেকার সরকার হিসেবে কাজ করবে। এ সময় সরকার কোনো বড় নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত, বড় কোনো চুক্তি বা জ্যেষ্ঠ পদে কোনো নিয়োগদান থেকে বিরত থাকবে। এই কনভেনশন থেকে বিচ্যুতি ঘটলে তার প্রতিক্রিয়া হবে রাজনৈতিক, আইনগত নয়।’ (পৃ. ৩০২)

যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সিনেটর অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য সিনেটরের ভূমিকা পালন করেন। যখন কোনো অঙ্গরাজ্যে সিনেটরের পদ কারও মৃত্যু বা পদত্যাগের কারণে শূন্য হয়, তখন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নর অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য সিনেটর নিয়োগ দেন। অনেক সময় গভর্নররাও পরবর্তী নির্বাচনে নিজেরাই সিনেটরের শূন্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ নেন। কিন্তু ওই পদে বহাল থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অস্বচ্ছতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে চান না। গভর্নররা অনেক সময় অন্তর্বর্তী মেয়াদে সিনেটর নিয়োগ দিতে গিয়ে লক্ষ রাখেন, তিনি আবার পরে কোনো মহলের দিক থেকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে অভিযুক্ত না হন। সে কারণে তাঁরা পরবর্তী নির্বাচনে সম্ভাব্য কোনো প্রার্থীকে নিয়োগদান এড়িয়ে চলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একটা সময় ছিল যখন রাজনীতিকদের বিধবা স্ত্রীদের তত্ত্বাবধায়ক সিনেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। আমেরিকার ইতিহাসে এ রকমের উদাহরণ আছে কিন্তু সেটা আধুনিককালে নয়। এটা পরিত্যাগ করা হয়েছে; কারণ, মার্কিন জনগণের একটি অংশ এই ব্যবস্থাকে স্বজনপ্রীতি হিসেবে দেখেছে। নেলসন রকফেলারের কথা উল্লেখ করা যায়। রকফেলার যুক্তরাষ্ট্রের অলিখিত তত্ত্বাবধায়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি তত্ত্বাবধায়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল ফোর্ড। নিক্সনের পদত্যাগের পর ফোর্ড প্রেসিডেন্ট হন এবং তিনি রকফেলারকে তত্ত্বাবধায়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেন। তবে নিয়োগের শুরুতেই রকফেলার এটা স্পষ্ট করেছিলেন যে অনেক ভাইস প্রেসিডেন্টের মতো ক্ষমতায় থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। এমনকি তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও পূর্ণ মেয়াদ পূরণে অনিচ্ছুক। রিপাবলিকান সমর্থক হয়েও দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা রকফেলার তাঁর কথা রক্ষা করেছিলেন। আর ফোর্ড ১৯৭৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য রানিংমেট হিসেবে রকফেলারকে বাদ দিয়ে রবার্ট ডোলকে বেছে নেওয়াকেই বৃহত্তম ভুল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

নিউজিল্যান্ড

তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে নিউজিল্যান্ডও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। উন্নত দেশগুলোও যে এ বিষয়ে ক্রমশ কনভেনশন ও আইনের দিকে ঝুঁকছে, নিউজিল্যান্ড তার দৃষ্টান্ত। তবে তারা তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সংঘাতমূলক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে না।

১৯৮৬ সালের দ্য কনস্টিটিউশন অ্যাক্টে নিউজিল্যান্ডের মন্ত্রিসভার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, বিদায়ী মন্ত্রিসভার যে মন্ত্রী পুনর্নির্বাচিত হননি, তাঁর সংসদ সদস্যপদ চলে যাওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করবেন। এই সময়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক মন্ত্রীকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। তবে তিনিও কেয়ারটেকার সামর্থ্য নিয়েই কাজ করবেন।

নিউজিল্যান্ডের সাংবিধানিক অবস্থান হচ্ছে: ‘কেয়ারটেকার সরকার একটি আইনানুগ নির্বাহী কর্তৃপক্ষ। এই সরকারের ক্ষমতা আগের নির্বাহী সরকারের মতোই থাকবে। যদি কোনো তাত্পর্যপূর্ণ বা বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার পড়ে, তাহলে তারা বিলম্বিত করবে বা একটি অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থান নেবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে।’

দক্ষিণ আফ্রিকা

কয়েক শ বছরের রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ১৯৯৩ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় যে প্রথায় নির্বাচন হলো, তাও কিন্তু হয়েছে একধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেখানে নির্বাচনের কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য ১৬ সদস্যের একটি কমিশন গঠিত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী পরিষদের পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ করেন। এতে দক্ষিণ আফ্রিকার ১১ জন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে পাঁচজন ছিলেন। কমিশনারদের যোগ্যতা সম্পর্কে শর্ত ছিল: ‘তাঁরা হবেন নিরপেক্ষ, শ্রদ্ধাভাজন, উপযুক্ত যোগ্য পুরুষ ও নারী, যাঁদের থাকবে না কোনো উঁচু দলীয় রাজনৈতিক অবস্থান। যাঁরা জনসংখ্যার কোনো উল্লেখযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্বও করবেন না।’

পাকিস্তান

বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রায়ই পাকিস্তানের প্রসঙ্গ উঠে আসে। পাকিস্তানের ১৯৭৩ সালের সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদে নির্বাচনকালে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর ‘কেয়ারটেকার কেবিনেট’ গঠনের বিধান রয়েছে। জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রবর্তিত এই বিধানের সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায় না। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে তাঁর খেয়ালখুশিমাফিক কেয়ারটেকার কেবিনেট গঠন করতে পারেন। নির্দলীয় নিরপেক্ষ লোক মনোনয়নের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানে মঈন কোরেশির নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি ব্যতিক্রম। ওই সরকারের কেউ নির্বাচনে অংশ নেননি।

খ. ভারতের তত্ত্বাবধায়ক বিতর্ক

ভারত নিয়ে আলোচনাটা একটু বিস্তারিত হওয়া দরকার। কারণ, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের উদাহরণ আমাদের দেশের ক্ষেত্রে নানা কারণে অধিকতর প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। উপমহাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চায় ভারতের অবস্থান শীর্ষে। কিন্তু ভারতও ভালো নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সব ব্যবস্থা এখনো পাকাপাকি করতে পারেনি। ভারতের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার স্বীকৃতি নেই। ভারতীয় রাজনীতিকেরা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র করতে যেসব ব্যবস্থার কথা ভাবছেন, তা কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছায়া ছাড়া কিছুই নয়। তবে সেখানে কখনো কোনো প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর অপসারণনির্ভর কোনো নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠেনি। কারণ, সেখানে কোনো প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো ক্ষমতার অনুশীলন করেন না। নির্বাচন সংস্কারে ভারতীয় লোকসভায় এই মুহূর্তে অনেক বিল বিবেচনাধীন। এসবের মূল কথাই হচ্ছে নির্বাচনকালে ক্ষমতাসীন দলটি যাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারে, তা নিশ্চিত করা।৩

ভারতীয় সংবিধানপ্রণেতারা গণপরিষদের আলোচনায় নির্বাচন-পূর্বকালে ক্ষমতাসীন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তর করতে সাংবিধানিক বিধান আনার কথা ভেবেছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রপতির কাছে এমন কিছু ক্ষমতা দেওয়া, যাতে তিনি নির্বাচনে ‘মন্ত্রীদের বেআইনি তত্পরতা’ বন্ধ করতে পারেন। শেষ মুহূর্তে তাঁদের পরিকল্পনা অবশ্য পরিত্যক্ত হয়। ভারতের গণপরিষদের এক খসড়ায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা সংযোজিত ছিল কিন্তু পরে তা বাদ পড়ে বলেও উল্লেখ করা হয় ওই নিবন্ধে।

ভারত ক্রমশ অস্ট্রেলিয়ার আদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে। ভারতীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও এ নিয়ে সাম্প্রতিককালে লেখালেখি করছেন। জে সি জোহারি ২০০৭ সালে তাঁর কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া: এ পলিটিকো-লিগ্যাল স্টাডি বইয়ে লিখেছেন:

তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো অস্থায়ী (অ্যাডহক) ব্যবস্থা নয়। এমনকি নয় কোনো অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা যুদ্ধাবস্থার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো শূন্যস্থান পূরণধর্মী ব্যবস্থা। এটা একটা অনন্য ব্যবস্থা এই অর্থে যে, এ সময় বিদায়ী মন্ত্রীদের স্বপদে বহাল রাখা হয় উল্লেখযোগ্য নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা (ব্যতিক্রম বাদে) প্রয়োগ ছাড়াই সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। (পৃ. ১৩৮)

ব্যক্তির প্রভাব বেশি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা সমাজে বৃদ্ধি পায়, সেটা জোহারিও উল্লেখ করেন। তিনি লিখেছেন, ভারতে নেহরুর জমানাতেও প্রকাশ্য বিতর্ক ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েম হয়ে গিয়েছিল। এরপর ইন্দিরা গান্ধীর প্রভাব বৃদ্ধি পেলে সেটা ভারতীয় রাজনীতির ছাত্ররা সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন।

লক্ষণীয় যে, ভারত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছায়াকল্প চিন্তায় আনে সত্তর দশকের গোড়াতেই। ১৯৭৪ সালে প্রখ্যাত রাজনীতিক জয়প্রকাশ নারায়ণ বেসরকারিভাবে বিচারপতি ভি এম তারাকুণ্ডের নেতৃত্বে নির্বাচনী সংস্কার কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিটির রিপোর্টে বর্ণিত প্রণিধানযোগ্য সুপারিশটি ছিল নিম্নরূপ: ‘আইন দ্বারা সমর্থিত কনভেনশন যা নিচে উল্লেখ করা হলো সেটা এমনভাবে বিকশিত হওয়া উচিত যে, ক্ষমতাসীন সরকারকেই সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার দিন থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।’ ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, নির্বাচনকালীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে কাজ করবে। তারা নির্বাচন সামনে রেখে: ক. নতুন নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ বা অঙ্গীকার করবে না। খ. নতুন প্রকল্প বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেবে না বা নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু করবে না। গ. বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ঘোষণা দেবে না। ঘ. মন্ত্রীরা কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে হাজির হবেন না (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০)।৪

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটরমন তাঁর মাই প্রেসিডেনশিয়াল ইয়ারস-এ লিখেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো নীতি নির্ধারণ করতে পারে না কিংবা এমন প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না, যার সঙ্গে ভবিষ্যত্ সরকারের বিরাট অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত’ (পৃ. ৫০৪)। কিন্তু ভারতের অনেক প্রধানমন্ত্রীই এই আচরণবিধি মানতে রাজি হননি। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখর ও তাঁর আইনমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম স্বামী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়েছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে সংবিধানে কিছু নেই। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা নরসীমা রাও সরকারের তৈরি করা দুটো অধ্যাদেশে সই করতে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালও ১৯৯৮ সালে মিজোরাম ও গোয়ার গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন নির্বাচন সামনে রেখে, নতুন সরকার এসে তা উল্টে দেয়। পাঞ্জাবের জলন্ধরের আসনে গুজরাল যখন লড়ছিলেন, তখন তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পাঞ্জাব প্রদেশের নেওয়া কোটি কোটি রুপির ঋণ মওকুফ করেছিলেন। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন চরণ সিং। তিনি প্রকাশ্যে তর্ক করেন যে, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকার কারণে রাষ্ট্রপতি তাঁর দায়িত্ব পালনে কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারেন না। চন্দ্রশেখর ও চরণ সিং উভয়ে মনে করতেন যে, তাঁরা নির্বাচনকালেও যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে উপযুক্ত ছিলেন।৫

২. বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার ইতিহাসের কথা উঠলে তিনটি ব্রাহ্ম-মুহূর্ত শনাক্ত করা যায়: নব্বইয়ের নির্দলীয় সরকার, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং পঞ্চদশ সংশোধনী অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার ‘বিতর্ক-সাপেক্ষ’ বিলোপ। এই তিনটি প্রসঙ্গ আমরা বিস্তারিত আলোচনা করতে পারি। কারণ, এই আলোচনার মধ্য দিয়েই তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা ও সুুষ্ঠু নির্বাচনকে ঘিরে উদ্ভূত অনেকগুলো সংকটের উত্স খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ক. তত্ত্বাবধায়কের জনপ্রিয়তার কারণ

কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ও সত্ চিন্তা থেকে বাংলাদেশ মডেলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার উদ্ভাবন ও তার বিলোপ ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনীতিকেরা নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা বা কেয়ারটেকার কনভেনশন তৈরির সময় ও সুযোগ পাননি। সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার এলএফওর অধীনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় হয়েছিল ১৯৭০ সালে। এর পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, তিয়াত্তরের সাধারণ নির্বাচন, জেনারেল জিয়ার ‘এলএফও’র অধীনে নির্বাচন ও ১৯৮২ সালে এরশাদের প্রলম্বিত সামরিক শাসনের সূচনা ঘটে। এর পরের আট বছর আরও নানামুখী ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই-উতরাইয়ে ভরপুর। সুতরাং এর মধ্যে অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ইস্যু নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা বা মনোযোগী হওয়ার অবকাশ মেলেনি। বরং জেনারেল এরশাদের ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যু-এর রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষের মনে নির্বাচনকালে ‘দলীয় সরকার’কে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে। আর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাফল্য মানুষের মনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি গভীর আস্থা সৃষ্টি করে। এক অর্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত বিরোধী দল তৈরি হওয়ার পরে সম্পূর্ণ বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে সাহাবুদ্দীন আহমদের নির্বাচনই ছিল প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর তাই বিএনপি যখন দেশ শাসনে অদক্ষতা দেখাল, জাতীয় পার্টির প্রতি প্রতিহিংসার রাজনীতি তীব্র করল, তখন আওয়ামী লীগ সহজেই জামায়াতসহ সব বিরোধী দলকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে এককাট্টা করতে সক্ষম হলো। ব্যাপকভিত্তিক নির্বাচনকেন্দ্রিক আইনকানুন সংস্কারে বিএনপি সরকারের ওপর ছিল ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কিন্তু তারা তা পালন করতে অস্বীকার করল কিংবা ব্যর্থ হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জিতে বিরোধী দলের সরকার গঠন করার কোনো নজির সৃষ্টি হয়নি। এমনকি ক্ষমতাসীন দল বিশ্বাসও করে না যে সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা হেরে যেতে পারে।

ক্ষমতাসীন তা প্রশাসনের যে স্তরেই হোক এবং বিশ্বের যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলেই তার একটা বাড়তি সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসে যায়। আর যেখানে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেখানে দুই ব্যক্তি টানা দুই দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী কিংবা পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় (বিরোধী দলের নেতা) নির্বাচন করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির জনপ্রিয়তা স্বাভাবিক। কিন্তু তা একই সঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি বটে। আমাদের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাকে ঘিরে যে সমস্যার জাল বিস্তৃত হয়েছে সেটা বুঝতে হলে নব্বইয়ের নির্দলীয় সরকার নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।

খ. নব্বইয়ের নির্দলীয় সরকার

শুরুতেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সরকারটি সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর বিলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সরকারকে নির্দলীয় সরকার বলা হয়েছে। সেখানে কিন্তু ‘তত্ত্বাবধায়ক’ শব্দটির উল্লেখ নেই। তা ছাড়া আরেকটি বিষয় খুবই তাত্পর্যপূর্ণ যে একাদশ সংশোধনীর প্রস্তাবে এরশাদ সরকারকে ‘অবৈধ’ বলা হয়েছে। ইতিপূর্বে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতার হাতবদল হলেও এরূপে ‘অবৈধতার’ একটা সিলমোহর কেবল জাতীয় পার্টিই পেয়েছিল। এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশে বিদ্যমান লিখিত সংবিধান নয়, জনগণের কার্যকর সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।৬ এ কারণেই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নির্দলীয় সরকারটি অসাংবিধানিক হলেও তা নিয়ে কেউ সেদিন সেভাবে আইনগত প্রশ্ন তোলার অবকাশ পাননি। একাদশ সংশোধনী পাসের পর অবশ্য আইনগত প্রশ্ন তোলার পথ সাংবিধানিকভাবেই রুদ্ধ হয়ে যায়।

সাংবিধানিক শুদ্ধতার প্রশ্নে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এখানে আমরা দেখব, একজন ব্যক্তি এরশাদের হাতে যেহেতু সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল, সে কারণে তাঁকে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্দোলনরত জোটগুলো ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না।৭

আবার এরশাদবিরোধী সাড়ে নয় বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকালে ব্যাপকভিত্তিক নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সংস্কার, যার যৌক্তিক সারকথা হওয়া উচিত ছিল নির্দিষ্ট সময় অন্তর দলের শীর্ষ নেতৃত্বে নির্বাচিত নতুন মুখ আসা, সে বিষয়ে কোনো আলাপ-আলোচনাই ছিল না। ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি এ সময় ‘দলের অভ্যন্তরীণ’ গণতন্ত্রের সংকটের কথা বলে দুই বড় দলকে বিব্রত করতে চেয়েছে। কিন্তু বোধগম্য কারণেই তাতে কর্ণপাত করার কেউ সমাজে ছিলেন না। তত্কালীন সংবিধানের আওতায় উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদের পদত্যাগের পর তাঁর শূন্য আসনে রাষ্ট্রপতি এরশাদ প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়োগ করেন এবং রাষ্ট্রপতি এরশাদ উপরাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে পদত্যাগ করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে যান। কিন্তু তত্কালীন সংবিধানের ৫৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নিয়োগটি বিদ্যমান সংসদ কর্তৃক অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তা আর সম্ভব হয়নি। সাবেক ৫৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, উপদেষ্টা পরিষদের গঠনও সংবিধানসম্মত ছিল না।

আওয়ামী লীগের নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কথায় কথায় নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখার উদাহরণ টেনে আনতেন তাঁদের যুক্তি তীক্ষ করতে। রাজনৈতিকভাবে এটি মুখরোচক হলেও এ যুক্তি দেওয়ার বিপদ ছিল। এভাবে বলার একটা মস্ত ক্ষতিকর দিক হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যার এখনো শৈশব উত্তরণ ঘটেনি, সেই গণতান্ত্রিক শাসন বা নির্বাচিত সরকার যে অবান্তর, সেটি প্রমাণ করা। আগেই বলেছি অবাধ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আকাঙ্ক্ষা বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও প্রবল। সংজ্ঞা ও রকমের যা পার্থক্য—এই যা। তাই কেবল রাজনৈতিকভাবেই নয়, সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তোলা যায়। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা যেমন ঠিক, তেমনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে বিরোধী দলের সন্দেহ-সংশয়ের যৌক্তিকতাও ষোলআনাই খাঁটি এবং কেবল নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেই সেই সন্দেহ দ্রুত পুরোপুরি মুছে দেওয়া সম্ভব নয়।

‘চরণ সিং’ বিতর্ক

নব্বইয়ের পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে এখনকার তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার রূপরেখা কল্পনা করার কিছু বিপদ আছে। নব্বইয়ের নির্দলীয় সরকার গড়ে উঠেছিল একটি বিশেষ জরুরি পরিস্থিতিতে। জরুরি সময়ের জন্য যা দস্তুর, সাধারণ পরিস্থিতির বেলাতেও সেটা খাটানো যায় না। খাটানোর বিপদ থাকে। জরুরি পরিস্থিতির ফলে উদ্ভূত ঘটনা সাধারণ পরিস্থিতি ও সময়ের ওপর কেমন অভিঘাত ও প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তার একটি ক্লাসিক উদাহরণ ভারতের সংখ্যালঘু দলের প্রধানমন্ত্রী চরণ সিং ও তাঁর সরকারকে ঘিরে আবর্তিত ঘটনাপ্রবাহ। আমরা সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি। কারণ এখানে আমরা দেখব, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যদি রাজি থাকে তা হলে সংসদে আস্থা ভোটে অংশ না নেওয়া একজন নির্বাচিত ব্যক্তিও তত্ত্বাবধায়ক-প্রধান হিসেবে কাজ চালাতে পারেন।

কোনো সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে পারেন। শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ চালাতে পারে। তবে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন সে বিষয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা থাকতে হবে। চরণ সিং অধ্যায় বিস্তারিত বলার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, সংসদে আস্থা ভোটে অংশ নেওয়ার শর্ত পূরণ করা সব পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলক নয়। অন্তত তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। ভারতীয় সংবিধানের আওতায় একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত মন্ত্রী পদে টিকে থাকতে পারেন। ছয় মাসের মধ্যে কোনো আসনে জিতে আসতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানেও এই বিধান ছিল। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের মূল সংবিধানেও এই বিধান ছিল। বাংলাদেশে সামরিক শাসনামলে এই বিধান পাল্টে দেওয়া হয়। এখন এক-দশমাংশ অনির্বাচিত ব্যক্তি মন্ত্রী হতে পারেন। পুরো পাঁচ বছর মেয়াদে তাঁদের কখনো জনগণের কাছে যেতে হয় না।

আইনগতভাবে বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায় চরণ সিংয়ের মতো একটি পরিস্থিতি কল্পনা করা অবাস্তব মনে হলেও অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। একটি জাতির রাজনৈতিক জীবনে ভারতের মতো অবস্থা সৃষ্টি হতেই পারে। তাই ঘটনাটি খুলে বলা।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি ৯ জুলাই ১৯৭৯ লোকসভার অধিবেশন ডেকেছিলেন। কিন্তু এর পর পরই ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে চমকপ্রদ সব ঘটনা শুরু হয়। জনতা দলের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা ১৫ জুলাই পদত্যাগ করেন। দেশাই লোকসভায় কোনো আস্থা ভোটের মুখোমুখি না হয়েই এ সিদ্ধান্ত নেন।

রাষ্ট্রপতি তাঁর এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। তবে তাঁর মন্ত্রিসভাকে নতুন সরকার গঠন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেন। এর মধ্যে জনতা দলের সংসদীয় দলের নেতা পরিবর্তন হয়। দেশাইয়ের পরিবর্তে এলেন জগজীবন রাম। রাষ্ট্রপতি রেড্ডির সামনে তখন প্রথম সাংবিধানিক দায়িত্ব বর্তাল নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ। তিনি জনতা দলের নতুন নেতা জগজীবন রামের সঙ্গে আলাপ করলেন, কিন্তু সন্তুষ্ট হলেন না। এরপর তিনি বৈঠক করলেন বিরোধীদলীয় নেতা ওয়াই বি চ্যাবনের সঙ্গে। কিন্তু চ্যাবন অপারগতা জানান। রাষ্ট্রপতি পরবর্তীকালে কথা বলেন অপর এক সংখ্যালঘু নেতা চৌধুরী চরণ সিংয়ের সঙ্গে। কিন্তু এখানেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

দ্বিধা-দ্বন্দ্বমূলক এই জটিল পরিস্থিতি সামনে রেখে রাষ্ট্রপতি বিরোধী দলের গ্রুপগুলোর কাছে তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য পৃথকভাবে তালিকা আহ্বান করেন। যথাসময়ে রাষ্ট্রপতি এই তালিকাপ্রাপ্ত হন। রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি এই তালিকা যাচাই করে তাঁর বিবেচনায় এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে, চৌধুরী চরণ সিং তুলনামূলক বিচারে লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন হতে পারেন।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি এই উদ্যোগ গ্রহণের পর সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় জনতা দল ও চরণ সিংয়ের দলই কেবল আগ্রহ দেখায়। রাষ্ট্রপতি এ সময় চরণ সিংকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে তাঁকে সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য অনুযায়ী সংসদে আস্থা ভোট মোকাবিলার জন্য চিঠি দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চরণ সিং ও তাঁর মন্ত্রিসভা লোকসভায় আস্থা ভোটের মোকাবিলা না করেই ১৯৭৯ সালের ২০ আগস্ট পদত্যাগ করেন। এবং লোকসভা ভেঙে দিয়ে নতুন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন।

রুদ্ধশ্বাস এ রাজনৈতিক ঘটনার এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু শোরগোলের দামামা বেজে উঠল তখনই, যখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে ওই তারিখেই চরণ সিংকে লিখলেন: ‘আমি আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করছি। কিন্তু “অন্যান্য ব্যবস্থা” গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপনি দায়িত্ব চালিয়ে যান।’ রাষ্ট্রপতির এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কার্যত চরণ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তর লাভ করে। রাষ্ট্রপতির ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাদ্রাজ, কলকাতা ও সর্বশেষ দিল্লি হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করা হয়। প্রতিটি মামলাতেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চৌধুরী চরণ সিংয়ের নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। কিন্তু হাইকোর্টগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চরণ সিংয়ের নিয়োগের বৈধতা সমুন্নত রাখেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের সংবিধান ও আইনবিষয়ক পণ্ডিতেরা পরবর্তীকালে কোর্টের ওই রায়ের যথেষ্ট সমালোচনা করেছেন। ৫৪৪ সদস্যের লোকসভায় তখন জনতা দলের সদস্যসংখ্যা ছিল ২০৫ জন এবং চরণ সিংয়ের দলের মাত্র ৭৫ জন।

তবে হাইকোর্টের রায়ে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রিসভা কেবল দৈনন্দিন কার্যাবলি পরিচালনা করবে, কোনো নীতিনির্ধারণী বিষয় নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা কিন্তু সব পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দিতে গিয়ে এই দৈনন্দিন কার্যাবলির কথা উল্লেখ করেছেন এবং এখনো করছেন। ২৭ জুন, ১৯৯৪ রূপরেখার সংশ্লিষ্ট দফাটি নিম্নরূপ: ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব হবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন সুনিশ্চিত করা এবং সংবিধানে প্রদত্ত সাধারণ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন ছাড়া শুধু জরুরি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা।’

দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি দেশপান্ডে তাঁর রায়ের শুরুতেই প্রশ্ন করেন যে ডিম আগে, না বাচ্চা? এর মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে রাষ্ট্রপতির সংবিধান স্বীকৃত একক কর্তৃত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এর অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রপতি যাঁকে আস্থাভাজন মনে করবেন, তাঁকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। পরে আস্থা ভোটে যে ফলাফলই বেরিয়ে আসুক না কেন। রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতার বৈধতা আদালতে বিচার্য নয়।

ওই রিট পিটিশনে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে, নতুন সরকার ১৯৭৯ সালের ২০ আগস্ট বা তার পরও লোকসভায় আস্থা অর্জন করেনি। অর্থাত্ যে সরকারটি সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিতই হলো না, সে সরকার কীভাবে লোকসভা বাতিল ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারে? মন্ত্রিসভাকে তো লোকসভার কাছে যৌথভাবে ‘রেসপন্সেবল’ থাকতে হবে।

প্রধান বিচারপতি জবাব দিয়েছেন, আবেদনকারীর এই যুক্তি সঠিক যে মন্ত্রিসভা লোকসভার কাছে দায়ী এবং তাকে লোকসভার আস্থা অর্জন করতে হবে। কিন্তু আবেদনকারীর এই যুক্তি ঠিক নয় যে, নতুন সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে লোকসভার আস্থা অর্জন করতে হবে (এআইআর ১৯৮০, দিল্লি, পৃ. ১১৪)।

কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে কেন মোরারজি দেশাইয়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জগজীবন রামকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহ্বান জানানো হলো না, সে প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, মোরারজি দেশাই লোকসভায় আস্থা ভোটের মুখোমুখি না হয়েই পদত্যাগ করেছিলেন এবং তিনি লোকসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেননি। পরিবর্তিত অবস্থায় জনতা দল নেতা পরিবর্তন করেছে মাত্র (এআইআর ১৯৮০, কলকাতা, পৃ. ৯৫)।

চরণ সিংয়ের সরকার প্রশ্নে মাদ্রাজ হাইকোর্টে দুটি রিট মোকদ্দমা দায়ের করা হয় (রিট নং ৩৬৭১ ও ৩৭৪২ অব ১৯৭৯)। মাদ্রাজ হাইকোর্টের সাত সদস্যের ফুল বেঞ্চ এ মামলার রায় দেন ১৯৭৯ সালের ১০ অক্টোবর। এতে চরণ সিংয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন করে বলা হয়, ‘ভারতের সংবিধান যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা উল্লেখ করেনি, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং নতুন সরকার গঠনের মধ্যবর্তী সময়ে গড়ে ওঠে, সেটা বোঝা যায়।’ ১৯৭৯ সালের ২৩ আগস্ট দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় দেখা যায়, রাষ্ট্রপতি রেড্ডি বলেন, ‘চরণ সিংয়ের সরকার বড় কোনো নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবে না। কিন্তু তাই বলে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঠেকে থাকবে না।’ আবার এও সত্য যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ে চরণ সিংয়ের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য দেখা গিয়েছিল। রেড্ডি তাঁর উইদাউট ফিয়ার অর ফেভার বইয়ে বর্ণনা করেন, ‘যদি তাঁর সরকার জোরাজুরি করে, তাহলে আমি শুধু তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত উল্টে দিয়েই ক্ষান্ত থাকব না, অন্যবিধ কঠোর ব্যবস্থাও নেব।’ এই বিতর্ক ব্রিটেনেও আছে। স্কটিশ সাংবিধানিক আইনজীবী ও সংস্কৃত পণ্ডিত আর্থার বেরিডেল কিথ (১৮৭৯-১৯৪৪) লিখেছেন, ‘অবশ্যই আমরা এটা মেনে নেব যে নতুন সরকার তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কখন কী করবে সেটা শুধু সেই সরকারই নির্ধারণ করবে’ (ব্রিটিশ কেবিনেট সিস্টেম, ১৯৫২, পৃ. ৫৫)। ভারতীয় বিচারপতি দুর্গাদাস বসুও প্রশ্ন রাখেন, ‘কোনো সশস্ত্র বিদ্রোহ কিংবা বহিস্থ আক্রমণেও কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে?’৮

ভারতের খ্যাতিমান সংবিধান বিশেষজ্ঞ এইচ এম সিরভাই (১৯০৬-১৯৯৬) অবশ্য পরবর্তীকালে জনতা দলের ২০৫ সদস্যের আস্থাভাজন জগজীবন রামকে বাদ দিয়ে ৭৫ জনের আস্থাভাজন চরণ সিংকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী করার রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকে ভুল বলে বর্ণনা করেন।৯

ডকট্রিন অব নেসেসিটি

২০১১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের একটি পরিহাস হচ্ছে, এই রায় প্রকারান্তরে ডকট্রিন অব স্টেট নেসেসিটির বাস্তবতা কবুল করেছে। ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যান্স কেলসন প্রথম ডকট্রিন অব নেসেসিটি এবং বিপ্লব মানেই সফল বিপ্লব বলে এক তত্ত্ব খাড়া করেন, যা এই উপমহাদেশে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রথম গ্রহণ করেন।

ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি স্ববিরোধী। কারণ, সামরিক শাসনকে চিরকালের জন্য অবৈধ ঘোষণা করার জন্য তাঁকে আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম। পাকিস্তানের প্রথম সেনাশাসনকে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ দিয়ে বৈধতাদান করে প্রধান বিচারপতি মুনির বিতর্কিত হন। আসমা জিলানি মামলায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় উল্টে দিয়ে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র কবর দেন। সেই রায়ের নীতি ঢাকায় আনতে তিন দশকের বেশি সময় কেটে যায়।

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী মামলায় ওই নেসেসিটি-তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সেই তত্ত্বই বরণ করেন। এবং দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন বাতিল করে দেওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে অনুষ্ঠানের উপায় নির্দেশ করেন।

এ প্রসঙ্গের দিকে আমরা দৃষ্টি দেব দুটি কারণে। প্রথমত, সাংবিধানিক সরকার কখনো ভেঙে পড়লে বা অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে তখন সংবিধানের চেয়ে সামাজিক আকাঙ্ক্ষা বড় হয়ে উঠতে পারে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নির্বাচন পরিচালনা প্রথাগত অর্থে অসাংবিধানিক ছিল। কিন্তু প্রকৃত বিচারে তা সংবিধানের অক্ষরের চেয়ে মহত্তম হয়ে উঠেছিল। ২০০৭ সালে ৯০ দিনের পর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবিধানের আক্ষরিক সমর্থন ছিল না। কিন্তু হাইকোর্ট এর সপক্ষে অভিমত দেন। ভুয়া ভোটারসর্বস্ব ভোটার তালিকার চেয়ে অনেকের কাছেই ভোটার আইডি করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রত্যাশিত হয়ে ওঠে। তাই ওয়ান-ইলেভেনের কারণে গঠিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের বৈধতার প্রশ্নটিও একই আলোকে বিচার্য। কিন্তু এর বিপদ হচ্ছে সামরিক বাহিনীও কিন্তু এ ধরনের যুক্তি দিয়ে ক্ষমতা জবরদখল করে।

‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র সুর এখান থেকেই আহরিত। ১৯৭৯ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত সাংবিধানিকভাবে চ্যালেঞ্জড হয়েছিল। সে ধরনের পরিবেশ ভারতের আদালতে ও সমাজব্যবস্থায় বিরাজমান ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের শাসনসংকট এতটাই গভীর ও ভঙ্গুর থাকে, সংকটকালে ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি’ মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সামনে অন্য বিকল্প থাকে না। ইয়াজউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার বৈধতার প্রশ্ন প্রধান বিচারপতি যেদিন স্তব্ধ করেছিলেন, সেদিনই সাংবিধানিক চেতনার মৃত্যু ঘটেছিল।

১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়, তাতেও সংবিধান ও গণতান্ত্রিক চেতনার মৃত্যু ঘটে। এখন দেখার বিষয়, এই সিদ্ধান্তের জন্য জাতিকে কতটা খেসারত দিতে হয়। ভারতের ওই অচলাবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের ১৯৯০ বা এক-এগারোর অচলাবস্থার তুলনা করা যাবে না। ভারতের বা অন্য কোনো দেশের উত্তরাধিকারের রাজনীতির সঙ্গে বস্তুত বাংলাদেশের উত্তরাধিকারের রাজনীতির একটা সামান্য খোলসগত মিলই চোখে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা অত্যন্ত বিরল। এমনকি কোনো রাজতন্ত্রেও তা অনুপস্থিত। বিশ্ব ইতিহাসে এর তুলনা মিলবে না যে দুজন মানুষ দুটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান নির্বাহী হিসেবে একাদিক্রমে প্রায় তিন দশক পার করেছেন। তাঁদের প্রকৃতপক্ষে কোনো নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয়নি। এই সময়ে তাঁদের কাছেই রাষ্ট্রক্ষমতা ঘুরপাক খেয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এমন একটি পদ্ধতি, যা মূলত এই দুজনের সর্বময় ক্ষমতা ধরে রাখার কার্যকারণ থেকে উদ্ভব ঘটেছে। এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোতে তাঁরা যতক্ষণ তাঁদের প্রভাব-বলয় টিকিয়ে রাখবেন, তত দিন ক্ষমতা হাতবদলের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো ত্রুটিপূর্ণ বিধানের একটা গ্রহণযোগ্যতা হয়তো থেকেই যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, এই জটিলতা এখন একটি ‘ব্যবস্থায়’ পরিণত হয়েছে। দুই ব্যক্তি পরস্পরবিরোধী দুই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। বাংলাদেশ যে একটি সমগোত্রীয় সমাজ সে কথা ক্রমশ অপাঙেক্তয় হয়ে পড়ছে। সে কারণে আক্ষরিক অর্থে দুই ব্যক্তিই বাধা নয়, কোনো কারণে দুই ব্যক্তি প্রভাবশালী না থাকলেও দৃশ্যত আদর্শিক গোষ্ঠীগত সংঘাতের কারণেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহালের আন্দোলন এই জাতিকে পুনরায় দেখতে হতে পারে। তাই সত্যি বলতে কি, দুই ব্যক্তির প্রভাবসর্বস্ব বাংলাদেশের শাসনগত এবং দলীয় ও জাতীয় শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এতটাই নাজুক এবং পূর্বানুমান অযোগ্য যে, তা দুই ব্যক্তির নির্বাচন করা বা না করার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ওঠানামা করে।

গ. ত্রয়োদশ সংশোধনী

সাহাবুদ্দীন আহমদের নির্দলীয় সরকার তার জাতীয় ভূমিকা সফলভাবে পালন করতে পারায় তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা সব মহলেই কম-বেশি অনুভূত হতে থাকে। কিন্তু বিতর্ক চলছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে।

নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাস হলো ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি এক মধ্যরাতে। এ বিলটি পাস করতে গণভোটের প্রয়োজন হবে কি হবে না, সে ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল গোড়াতেই। গণভোটের বিধান মূল সংবিধানে ছিল না। তা ছাড়া গণভোট যেহেতু এ দেশে সামরিক শাসনের বৈধতায় ব্যবহূত হয়েছে, তাই এ বিধানের প্রতি আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধা কখনোই ছিল না। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে সামরিক ফরমান দিয়ে এটি সংবিধানে সংযোজিত হলেও দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময় মতৈক্যের ভিত্তিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৯৪ সালের গোড়ার দিকে বাংলাবাজার পত্রিকায় শীর্ষ সংবাদ হিসেবে এই মর্মে লেখকের একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল: সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধন করলেই শুধু হবে না, এরপর গণভোটেও যেতে হবে। ওই সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ফোন করেছিলাম। তখন তাঁর মত ছিল, তাহলে শাসক বিএনপিকে সে কথা বলতে দিন। গণভোট অনুষ্ঠানই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথে বাধা। বিএনপি রাজি হলে গণভোটে বাধা নেই। এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কতই না বিচিত্র! বহু কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর ২০০৩ সালে বিএনপি বলেছিল, উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী গণভোট অনুষ্ঠানে তারা রাজি।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তখনো বিএনপিতে যোগ দেননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন দানা বাঁধার শুরুতে দেওয়া এক বিবৃতিতে এই পদ্ধতি প্রবর্তনের ধারণাকে তিনি ‘বর্বরতার’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানও বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে এ রকম অসন্তোষ ব্যক্ত করেছিলেন। যেদিন সংসদে বিলটি পাস হয়েছিল, সেদিন আমি সংসদে হাজির ছিলাম। রাত ১২টার দিকে স্পিকার বিরতি দিলেন। তত্কালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ফ্লোর থেকে বেরিয়ে অতিরিক্ত সচিব খন্দকার আবদুল হকের কক্ষে প্রবেশ করেন। তিনি ফোনে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলেন। আমি স্পষ্ট শুনলাম—আইনমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে গণভোট অনুষ্ঠান নিয়েই কথা বলেছিলেন। কয়েক মিনিটের আলোচনা মাত্র। আইনমন্ত্রী ফিরে গেলেন সংসদ কক্ষে। তখনো বোঝা যাচ্ছিল না বিলটি ওই রাতে পাস হবে কি হবে না। তাই এ তথ্য ‘স্কুপ’ হতে পারে ভেবে আমি কিছুটা রোমাঞ্চিত ছিলাম। কিন্তু তার এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে অবলোকন করলাম ভিন্ন দৃশ্য। অনেক সংশোধনী এসেছিল। সেগুলোর ওপর আলোচনা তেমন কিছুই হলো না। নাটকীয়ভাবে পাস হয়ে গেল বিলটি। তখন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এমনই যে সংবিধানের চেয়ে বড় আকারে আবির্ভূত হলো বিএনপি-আওয়ামী লীগ বা দুই নেত্রীর বোঝাপড়ার বিষয়টি।

পঞ্চম সংসদের সচিবালয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রশ্নে প্রথম বিল জমা দিয়েছিল জামায়াত। তারা অবশ্য ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময়ই এই বিধান সংবিধানে সংযোজনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। তখন তাঁদের কেউ সমর্থন করেননি। আমাদের রাজনীতিকদের দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে যাঁরা ব্যথিত হন, তাঁদের কেউ কি বলবেন দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময় কেন তাঁরা মাগুরার কারচুপিপূর্ণ উপনির্বাচনের মতো পরিস্থিতি রোধে জামায়াতের ফর্মুলাটি লুফে নিতে আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দেননি? মাগুরার একটি উপনির্বাচনই কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভব ঘটিয়েছে? কোনো সন্দেহ নেই ওই উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের সূত্র ধরেই বিরোধী দল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এটাই সত্য যে এই দাবি কেন উঠেছিল তার কোনো সুচিন্তিত ও বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ ও যৌক্তিকতা আন্দোলনরত দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এমনকি জামায়াতে ইসলামীর তরফেও নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ জানুয়ারি ২০১২ বলেন, ‘এক কোটি ভুয়া ভোটার থাকার জন্য আমরা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছিলাম তখন তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া দেশে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ লোক নেই।’ উভয় পক্ষই এ ধরনের বাকবিলাস ও বাগাড়ম্বরের রাজনীতির মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ-বিপক্ষ চিহ্নিত করে আসছে। এরা খুবই সতর্কতার সঙ্গে দলীয় স্বৈরশাসন ও সাংবিধানিক ভারসাম্যহীনতার প্রশ্ন যাতে জনগণের সামনে উন্মোচিত না হয় সেদিকে সতর্ক থাকে। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রবক্তা জামায়াত হলেও তারাও কখনো দলীয় স্বৈরতন্ত্র নিয়ে দুই বড় দলের সমালোচনা করেনি। কারণ, তারাও দলের অভ্যন্তরে মজলিশে শুরার নামে স্বৈরশাসন চালিয়ে আসছে। যদিও তারাই প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ফর্মুলা দিয়েছিল।

লক্ষণীয় যে স্থানীয় নির্বাচন না হয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, এ নিয়েই গত দুই দশকের বড় আন্দোলনগুলো দানা বেঁধেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও বিজয়ী-বিজেতা গণতন্ত্রের শর্ত পূরণ করেনি। বিশেষ করে পরাজিত দল নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারেনি। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ রাজনৈতিক দলের তরফে কোনো চাপ বা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়নি। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র না থাকার কারণে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বা দায় তৈরি হয়নি। সংসদে যেতে নির্বাচিত সাংসদকে চাপ দিতে এলাকার জনগণ কোথাও সংঘটিত হতে পারেনি। কারণ, সংশ্লিষ্ট দলের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা সৃষ্টির অবকাশ তৈরি হয়নি। দেখা গেছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও সরকারি দল সুশাসন দিতে মনোযোগী হয়নি। বিরোধী দল তক্কে তক্কে থেকেছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। এক নেত্রীর কথায়, ‘ধাক্কা মেরে গণতন্ত্র শেখানোই তাঁর লক্ষ্য।’ অন্যদিকে নির্বাচনকেন্দ্রিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে দৃশ্যত বিরোধী দল তথাকথিত জনপ্রিয়তার তকমা পরতে পারছে। এভাবে তারা নিজেদের ব্যর্থতা বা দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দায় থেকে জনগণের দৃষ্টি আড়াল করতে পেরেছে। পঞ্চম সংসদে গোলাম আযম ও তাঁর দলের সবচেয়ে বড় লাভ ছিল তাঁদের উদ্ভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগকে কিংবা ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের প্রয়াসে কার্যকর সহায়তা দিতে পারা।

এখানে লক্ষণীয় যে গোলাম আযম দেশে ফিরে আনুষ্ঠানিকভাবে আমিরের দায়িত্বভার গ্রহণের আগেই ‘নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি’ বহালের কথা বলে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। ১৯৭৩ সালের পাকিস্তান সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচনকালে রাষ্ট্রপতিকে ‘কেয়ারটেকার কেবিনেট’ গঠনের ক্ষমতা দেওয়ার একটা মডেল জামায়াতের সামনে ছিল। কিন্তু সেখানে নির্বাহী প্রধানের নির্দলীয় থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচনের মঞ্চে টেনে আনার প্রশ্ন তো নয়ই। সেদিক থেকে জামায়াত সত্যিই একটি ‘নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি’ আবিষ্কার করেছিল। ১৯৭৯ সালে ‘অবাধ’ নির্বাচনে নির্বাচিত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অপসারণ করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন সম্পর্কে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সেই সময়ের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সরকার গড়ার ফর্মুলা ১৯৮৩ সালে জামায়াতই দিয়েছিল। আজ আর সন্দেহ নেই যে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে এই ব্যবস্থা বহালের কারণে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পঞ্চম সংসদে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী স্বাক্ষরিত বিলে কিন্তু প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। জামায়াতের ফর্মুলা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি তাঁর সন্তোষ অনুযায়ী একজন সিনিয়র উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। জাতীয় পার্টির মনিরুল হক চৌধুরীর দেওয়া বিলেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কথা ছিল না। ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন জাতীয় সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তথাকথিত নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা ঘোষণা করেন। লক্ষণীয় হচ্ছে, এই রূপরেখায় কিন্তু প্রধান বিচারপতির প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কথা একেবারেই বলা হয়নি। এতে বলা ছিল, রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করার জন্য জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শক্রমে একজন নির্দলীয় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন এবং সেই প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করবেন। সংসদ থেকে বিরোধী দলের পদত্যাগের পর কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে, সে সম্পর্কে ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ওই তিনটি দল পৃথক জনসভা থেকে সাতটি দাবিসংবলিত একটি অভিন্ন ফর্মুলা দেয়। এতেও কিন্তু প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার প্রস্তাব করা হয়নি। বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের একজন গ্রহণযোগ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অথবা একজন নির্দলীয় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। অথচ ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের পর তাড়াহুড়ো করে পাসকৃত ত্রয়োদশ সংশোধনীতে প্রথমবারের মতো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের বিধান করা হলো। তত্কালীন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা যে আলোচিত ফর্মুলার জন্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাতে অবশ্য তিনি দেশের শাসনভার আপিলেট ডিভিশনের হাতে পুরোপুরি ন্যস্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি পালন করবেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। অন্য চারজন বিচারপতি কাজ করবেন কেবিনেট সদস্য হিসেবে। এটা গ্রহণ করা হলে বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণের মাত্রা হয়তো আরও বৃদ্ধি পেত।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে বিএনপি জাতীয় সংসদে চারটি বিকল্প (জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত দুই প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের দুই অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও তাঁদের কাউকে না পাওয়া গেলে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা) সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল এনেছিল।

তত্ত্বাবধায়ক বৈধ, না অবৈধ?

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলটি পাস হওয়ার পর এর বৈধতা নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি বিতর্ক দেখা দেয়। ২১ জুলাই ২০০৩ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। এই মৌলিক চেতনাটি হলো, স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনা করবেন।১০ তাই রাষ্ট্রপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ ভোটের পরিবর্তে সাংসদদের দ্বারা নির্বাচনের নিয়ম করা হলে তখন আওয়ামী লীগ উচ্চ আদালতে গিয়েছিল।

বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও বিচারপতি আবদুল আওয়ালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য প্রথা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠান। এর আগে একই ইস্যুতে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটির বৈধতা কবুল করে নিয়েছিলেন, তাই তৃতীয় বেঞ্চে এখন এর চূড়ান্ত শুনানি হবে। সেই তৃতীয় বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বৈধ বলে রায় দেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ বলে রায় দেন।

ড. কামাল হোসেন ২০০৩ সালেই বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করে এর মৌলিক চেতনায় কোনো আঘাত করা হয়নি। অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদের মন্তব্য ছিল, ‘সংবিধান সংশোধনের জন্য একান্তই যদি গণভোটের প্রশ্ন ওঠে, তাহলে বলতে হবে গণভোট হয়ে গেছে। এ জন্য আনুষ্ঠানিক গণভোটের প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি না।’ তাঁর যুক্তি, যেহেতু এ বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে, তাই এটা জনগণের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ড. কামাল হোসেন এই অবস্থাকে বলেছেন জাতীয় মতৈক্য। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরুদ্ধ আদালতের দেওয়া অভিমতকে ‘উচিত হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। আমাদের এই বিজ্ঞ আইনজীবীদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্ন। কিন্তু তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে ২০০৩ সালে আদালতের অভিমতের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়েছিলেন।

ঘ. পঞ্চদশ সংশোধনী

আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক-ভাবনার বিবর্তন

অবশেষে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করা হলো। এই বিলুপ্তির ঘটনাটিকে ঠিক তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে আওয়ামী লীগের এযাবত্কালের দাবি-দাওয়া, প্রকাশ্য চিন্তাভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলা যায় না। পঞ্চম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংসদ সচিবালয়ে দুটো বিল জমা দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদের দাবির বিষয়টি কখনো কখনো আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে বা এর পক্ষে দলটির কোনো স্বচ্ছ বা সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল বলে জানা যায় না।

১৯৯৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের এমপি এম আবদুল রহিম স্বাক্ষরিত প্রথম বিলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরে তিনি আরেকটি বিল জমা দিয়েছিলেন। এতে অবশ্য ১৫ বছরের মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা এবং রাষ্ট্রপতির আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বা জাতীয় সংসদে বিদ্যমান সব দলের মতৈক্যে যেকোনো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নের সুপারিশ করা হয়। আর ১৯৮০ সাল থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবক্তা কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতিভূ জামায়াতে ইসলামী।

১০ সেপ্টেম্বর ২০০৩ জাতীয় সংসদে তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের লালদীঘির জনসভায় প্রথম বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা বদলাতে হবে। রূপরেখা বদলের রূপরেখা তিনি অবশ্য তখন দেননি। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখায় এমনভাবে পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যত্ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে (যুগান্তর, ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৩)। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে কার্যত অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অসারতাকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে তিনি আরও বলেছিলেন, ভবিষ্যত্ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে যথার্থ নিরপেক্ষ করা এবং এর কাঠামো উন্নততর করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি দাতা সংস্থার সঙ্গে কথা হচ্ছে (প্রথম আলো, ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৩)। কিন্তু এবার এই ব্যবস্থা বিলোপ করতে গিয়ে এ ধরনের কোনো আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে বলে জানা যায় না।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২৫ জুলাই ২০০৩ এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি আদালতের দরজা বা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে আসেনি। যাঁরা এ ধারণাকে আদালতে নিয়ে গেছেন, তাঁদের দুরভিসন্ধি রয়েছে। তাঁর কথায়, সব আইনের পেছনে জনমত বা জনশক্তি থাকে। জনমত না থাকলে তা আর আইন থাকে না। সেনগুপ্ত নিশ্চয় স্বীকার করবেন, ইনডেমনিটি আইনের পেছনে জনমত না থাকলেও সেটি দুই দশকের বেশি সময় টিকে ছিল। সুতরাং সব আইনই আইন নয়, অর্থাত্ সব আইনের পেছনেই জনমত থাকে না, তদুপরি টিকে থাকে। ১৫তম সংশোধনীর ক্ষেত্রেও এ কথা খাটবে। ২০১১ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিকেরা সেদিনের সেই অবস্থান ধরে রাখতে অত আগ্রহী নন আর। সেনগুপ্ত ২০১১ সালে আপিল বিভাগের রায়ে দুরভিসন্ধি নয়, আইনের শাসনের বিজয় দেখেন। এ রকমই আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিকের অবস্থান। ২০১১ সালের মে মাসে প্রথমে বললেন, আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ না পাওয়া পর্যন্ত বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। ১০ দিনের ব্যবধানে তিনি বললেন, সিদ্ধান্ত তাঁরা নেবেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করবেন না।

গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলেও অতীতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেক উন্নত ছিল। কিন্তু এখন তা নেই। এ কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ একটি বইয়ের প্রকাশনা উত্সবে দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর কথা হচ্ছে: শালীনতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও পরমতসহিষ্ণুতার সেই অতীত সংস্কৃতি অনুসরণ করলে এখন তাঁকে নানা কৈফিয়ত দিতে হয়, নিজ দলের বাইরে ও ভেতরে তির্যক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি তাঁর দলীয় আনুগত্য, রাজনৈতিক অবস্থান ও আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। আসলে মুখ্য রাজনৈতিক দলগুলো মিলে অনাস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ষোলকলা পূর্ণ করতেই কেয়ারটেকার মডেলের জন্ম দিয়েছিল।

তত্ত্বাবধায়ক বিলোপ: নির্বাচিত-অনির্বাচিত

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আপিল বিভাগে বাতিল হওয়ার পর সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় না পাওয়া পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট মন্তব্য করা চলে না। উপরন্তু আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশে, তাঁর কথায়, যে ‘অসামঞ্জস্য’ রয়েছে, সেদিকেও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তদুপরি আদালতের দোহাই দিয়ে এ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে যা করার করতে হবে।’ কিন্তু শুধু এটুকু বক্তব্য যথেষ্ট নয়। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অন্যতম স্পর্শকাতর প্রশ্ন হলো, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী কী করবেন? প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন? সুতরাং পদ্ধতি নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায়ও ব্যক্তির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত ব্যক্তির সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গড়তে কি সত্যিই চান? তা হলে তাঁকে বাহাত্তরের সংবিধান মানতে হয়। কিন্তু তিনি তা মানবেন না। বর্তমানে এক-দশমাংশ অনির্বাচিত ব্যক্তির মন্ত্রিসভায় থাকার বিধানটি মূলত সামরিক শাসনের ফসল। অনির্বাচিত ব্যক্তিরা (শফিক আহমেদ, দিলীপ বড়ুয়া প্রমুখ) এখন মন্ত্রিত্ব করছেন। এটা যদি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত না করে, তাহলে ৯০ দিনের জন্য অনির্বাচিত ব্যক্তির মন্ত্রিত্ব মানা যাবে না কেন?

সরকারের তিন বছর নিয়ে আলোচনায় চ্যানেল আইয়ে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও বিএনপির উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী। জনাব চৌধুরী যুক্তি দেন যে, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত ব্যক্তি হওয়ার কৌলীন্য দাবি করতে পারেন না। কারণ, পদত্যাগের পর তাঁরা তাঁদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির চরিত্র হারান।

ত্রয়োদশ সংশোধনীই অনির্বাচিত ব্যক্তিদের অন্দরমহলে প্রথম ঢুকিয়েছে তা নয়। পঞ্চম সংশোধনীতে বাহাত্তরের বিধানমতে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই প্রধানমন্ত্রী করার নিয়ম পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। তবে শর্ত ছিল, অনির্বাচিত ব্যক্তিরা মন্ত্রিসভার এক-পঞ্চমাংশের বেশি হবেন না। বর্তমানে মন্ত্রিসভায় ‘অনধিক এক-দশমাংশ’ অনির্বাচিত থাকতে পারেন। সেদিক থেকে বর্তমান টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীরা জেনারেল জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীর রূপকল্পের সুবিধাভোগী।

সুতরাং নির্বাচিত ও অনির্বাচিত প্রসঙ্গ বাংলাদেশে নতুন নয়। বাংলাদেশ রাজনীতিতে এর চমক আগেও আমরা দেখেছি। আওয়ামী লীগ চতুর্থ সংশোধনীতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিধানগুলো সংবিধান থেকে ছেঁটে দিয়েছিল। প্রায় দেড় দশক তা লুপ্ত থেকেছে। এ নিয়ে দেশে কোনো আন্দোলন ছিল না। নির্বাচিত-অনির্বাচিত প্রসঙ্গ তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ঠাঁই দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অন্তত দুটি মাইলফলক মামলা আছে, যেখানে নির্বাচিত-অনির্বাচিত তর্ক পাত্তা পায়নি। আবদুর রহমান বিশ্বাস পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। আবদুস সামাদ আজাদ রিটে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি জয় পাননি। কুদরত-ই-ইলাহি পনির মামলায় উপজেলাব্যবস্থা বিলোপের বৈধতা পরীক্ষিত হয়। আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে ওই মামলায় যে মাইলফলক রায় দেন তাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত অনির্বাচিত তত্ত্ব সমর্থন করে না। সেই একই অনির্বাচিত তর্ক তুলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। হাইকোর্ট তা নাকচ করেছিলেন।

১৯৯২ সালে কুদরত-ই-ইলাহি পনির বনাম রাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্ট অনধিক ছয় মাসের মধ্যে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিয়োগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই রায়ের প্রতি দুই দলই শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হয়। পদ্ধতিগতভাবে দুই দলের সুপ্রিম কোর্টের রায় উপেক্ষা করার এটা এক দুর্ভাগ্যজনক দৃষ্টান্ত।

বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৫৫(৪) অনুচ্ছেদটি ফিরে এলে যেকোনো সময় যেকোনো সংখ্যক অনির্বাচিত ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া যাবে। তার মানে, এটা কিন্তু অগণতান্ত্রিক নয়। অবশ্যই এই অনির্বাচিত আর আমাদের উদ্ভট তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থায় ঠাঁই পাওয়া অনির্বাচিতরা এক নন। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ভাবনাকে বাহাত্তরের কাঠামোতে খাপ খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ। ওই অনুচ্ছেদের আওতায় নিয়োগপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের ছয় মাসের মধ্যে কোনো আসন থেকে নির্বাচিত হতে হবে। এই বিধান সংসদীয় গণতন্ত্রে সর্বজনীন। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের আমরা পাঁচ বছর মন্ত্রী মানব। আর নির্বাচিত ধুয়া তুলে অনির্বাচিতদের ৯০ দিন বা একটা নির্বাচন করার সুযোগও দেব না। এই দুই অবস্থান দ্বন্দ্বপূর্ণ। ওপরের চরণ সিং-সংক্রান্ত আলোচনাতেও আমরা কিন্তু নির্বাচিত-অনির্বাচিত তর্কটাই খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধানে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীপদ সৃষ্টির বিধান প্রবর্তনের সুবিধাভোগীদের অন্যতম। তিনি আমাদের বলছেন, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন অতিশয় অগণতান্ত্রিক।

পাঁচ বিশেষজ্ঞের মত

খালেদা জিয়া আদালতের রায় প্রশ্নে ৪ ও ১৬ জুন ২০১১ সংবাদ সম্মেলনে দুটি লিখিত বিবৃতি দেন। এতে ‘এই রায় সংসদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়’ কথাটি যে অর্থে তিনি বলেছেন, তা ঠিক নয়। সংসদ চাইলে নতুন করে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। তেমন দরকার হলে আদালতের রায়কে অসারও করতে পারে। খালেদা জিয়ার কথায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বর্তমান আঙ্গিক ঠিক রাখতে হবে। এরপর তাঁরা আলোচনায় বসবেন।

ডেইলি স্টার ১৭ জুন ২০১১ প্রথম পাতায় খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছাপে। যার শিরোনাম ছিল ‘প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন’। তার নিচেই পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞের মতামত ছাপা হয়। যার শিরোনাম ‘রায়ের মুহূর্ত থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ’। নিচে উপশিরোনামে শীর্ষ আইনবিদেরা প্রসপেকটিভলি বা ভবিষ্যসাপেক্ষ কথাটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শীর্ষ আইনবিদদের বরাতে ডেইলি স্টার-এর শিরোনাম থেকে অনেকের মনে ধারণা হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে মর্মে যে অভিমত দিয়েছেন, সেটিই সঠিক।

ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদনটি শুধু প্রসপেকটিভ কথাটির সংজ্ঞানির্ভর। তারা ঠিকই ধরেছে এবং খালেদা জিয়াও ওই শব্দের ওপর দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘রায়ে ঘোষিত অবৈধতা এখন থেকে নয়, বরং আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক বহাল থাকার পর তা কার্যকর হবে।’ অবৈধতা ও ‘কার্যকর অবৈধতার’ মধ্যে পার্থক্য আছে। অবৈধ ওই তারিখ থেকেই, তবে তা কবে থেকে ও কীভাবে কার্যকারিতা পাবে, তা রায়ে স্পষ্ট নয়। তবে এটা খুবই স্পষ্ট, ত্রয়োদশ সংশোধনী তিন তালাক পায়নি। ঝরে গিয়েও তিন শর্তে টিকে আছে। সংসদ নেতা ও বিরোধী দলের নেতার রায় ব্যাখ্যার মধ্যে কোনটি আপাতত অধিকতর গ্রহণযোগ্য? উত্তর হবে, বিরোধী দলের নেতার; যদিও তা নিরঙ্কুশ অর্থে নয়। সংসদ নেতা বলেন, বাতিল হয়ে গেছে, আর কোনো সুযোগ নেই। এর প্রথম অংশ ঠিক, দ্বিতীয় অংশ ঠিক নয়।

ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদনে বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, মাহমুদুল ইসলাম, এম জহির, শাহ্দীন মালিক ও মাহবুবে আলম মতামত দিয়েছেন। তাঁদের মতগুলো সন্দেহাতীত কোনো ধারণা দেয় না। বিচারপতি মোস্তাফা কামালের মতে, ভবিষ্যসাপেক্ষ কথাটির অর্থ রায় ঘোষণার দিন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে। তবে আগামী দুটি নির্বাচন বিদ্যমান ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনেই করা যাবে। সংবিধান সংশোধনের কোনো দরকার নেই। তাঁর বক্তব্যে বিরোধী দলের নেতার অবস্থানই সমর্থিত হয়েছে।

অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় দুই মেয়াদে বৈধ নির্বাচন কী করে হবে? এটা কি স্ববিরোধী? জবাবে সাবেক প্রধান বিচারপতি আমাকে বলেন, ‘না, এটা হলো পার্মিসেবল জুরিসডিকশন (অনুমতিযোগ্য এখতিয়ার)।’

বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, মাহমুদুল ইসলাম, এম জহির, শাহ্দীন মালিক ও মাহবুবে আলম আমাদের একটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন যে ‘রায় ঘোষণার দিন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে।’

বিশেষজ্ঞ মতের ফারাক দেখুন। শাহ্দীন মালিক মনে করেন, সুপ্রিম কোর্ট কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে তাঁর রায়ে ভবিষ্যসাপেক্ষ কথাটি ব্যবহার করেছেন। যেহেতু বাতিল হয়ে গেছে, তাই আগামী দুটি নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধন লাগবে। মাহমুদুল ইসলামের ‘রায় ঘোষণার দিনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে’ কথাকেও বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না। অ্যাটর্নি জেনারেলও কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায়। তিনি বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় না পাওয়া পর্যন্ত এটা বলা যায় না যে আগামী দুটি নির্বাচন কীভাবে হবে।

আমি উল্লিখিত পাঁচ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে দুটো বিষয়ে তাঁদের মোটামুটি মতৈক্য দেখেছি। প্রথমত, রায় দ্ব্যর্থবোধক। দ্বিতীয়ত, পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে চূড়ান্ত মন্তব্য করা চলে না। আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশমতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত রায় দিতে গিয়ে বিচারকেরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। একজন বিচারক ভিন্ন মত দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নাম কিংবা তাঁর ভিন্নমতের কারণ জানা যায় না। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলে ডকট্রিন অব প্রসপেকটিভ ওভাররুলিং নামের একটি মতবাদ অনুসরণ করা হয়েছে। সাধারণত কোনো আইন বা সংবিধানের সংশোধনী যখন আদালত বাতিল করেন তখন তা গোড়া থেকে অর্থাত্ সংশোধনীটি যে তারিখে কার্যকর হয়েছে, সেই তারিখ থেকে বাতিল বা অবৈধ বলে গণ্য হয়। কিন্তু এতে একটা অসুবিধা হয় যে, ইতিমধ্যেই যত কাজ করা হয়েছে তার বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় ১৯৯৬ সাল থেকে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনগুলোর বৈধতা বজায় রাখতে সুপ্রিম কোর্ট সে কারণে তার সংক্ষিপ্ত আদেশে ভবিষ্যসাপেক্ষে ওই সংশোধনী বাতিল করেন। কিন্তু পাঁচ বিশেষজ্ঞের মতামতসংবলিত ডেইলি স্টারের ওই প্রতিবেদনটি ত্রুটিপূর্ণ বার্তা বহন করেছে কি না সেই প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, কোনো রায়কে ব্যাখ্যা করতে হলে তাকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। রায়ে শুধু দুই মেয়াদে শব্দটি নয়, নির্দিষ্টভাবে দশম ও একাদশ নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। এখানে লক্ষণীয়, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেছিলেন, এটা হলো অবিটার ডিকটা বা আদালতের পর্যবেক্ষণ, এটা মেনে চলা ঐচ্ছিক, বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু বিচারপতি আবদুল মতিন এই লেখককে বলেছিলেন, ব্রিটিশ ভারতে এলাহাবাদ হাইকোর্টের একটি রায় আছে, এমনকি অবিটার ডিকটাও বাধ্যতামূলক যদি তা সর্বোচ্চ আদালতের কাছ থেকে আসে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় দেখেও মনে হয়, এটা অবশ্যপালনীয় হিসেবে মনে করাই সংগত।

ডকট্রিন অব প্রসপেকটিভ ওভাররুলিং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাঁর ইতিহাসে কোনো রায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেননি। এই মতবাদ বাংলাদেশে প্রায় অচেনা। একমাত্র অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে ওই নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল কিন্তু সেখানে কোনো আলোচনা ছিল না। মতবাদটির উদ্গাতা মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট। ভারতের ইতিহাসে ১৯৬৭ সালে বিখ্যাত গোলকনাথ মামলায় প্রথম এই মতবাদটির ব্যবহার ঘটেছিল। এতে তাঁরা বলেছিলেন, এই মতবাদ শুধু সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। আর শুধু সুপ্রিম কোর্টই তা ব্যবহার করবে। কিন্তু সম্প্রতি মনুপত্র নামের ভারতীয় আর্কাইভে দেখলাম, সেই থেকে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট দুই শতাধিক রায়ে এই ডকট্রিন ব্যবহার করেছেন। ২০০৪ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে বলেন, যখনই যেখানে এই মতবাদ ব্যবহার করা হবে তখন তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে হবে। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় আবেদনকারীর মুখ্য আইনজীবী এম আই ফারুকী লেখককে নিশ্চিত করেন যে আমাদের আপিল বিভাগে শুনানিকালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গোলকনাথ মামলাটি একবার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। সংক্ষিপ্ত আদেশেও এর উল্লেখ নেই। সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম লেখককে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলায় “প্রসপেকটিভলি” কথাটি গোলকনাথ মামলার আলোকেই বুঝতে হবে।’ তবে দেশ থেকে দেশে এই মতবাদের প্রয়োগ ভিন্নতর হতে পারে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মণ্ডল মামলায় বাতিল ঘোষিত একটি আইনের আওতায় তাঁর কার্যক্রম পাঁচ বছর পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া অনুমোদন করেছেন। সেদিক থেকে বলা যায়, রায়ের পূর্ণ বিবরণে আগামী দুই মেয়াদের সংসদ নির্বাচন বাতিল হওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনী অর্থাত্ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে করার নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা মিলতে পারে। ড. কামাল হোসেন লেখককে বলেন, ‘আমি প্রয়োজনে পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করতে পারি।’

দীর্ঘ নীরবতার পর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় নিয়ে সংবাদপত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন। মানবজমিন  সম্প্রতি ‘এপ্রিলে পূর্ণাঙ্গ রায়, রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ফর্মুলা থাকছে’ শীর্ষক খবর ছাপে। পরদিন যুগান্তরকে সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এপ্রিলে রায় মিলবে। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান থাকবে না। সংসদ সুপ্রিম কোর্টকে কিংবা সুপ্রিম কোর্ট সংসদকে কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারে না। এই নিয়ম তিনি মেনে চলবেন।’ এর আগে তাঁর দেওয়া প্রকাশ্য পরামর্শের ভিত্তিতেই পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের ভিত্তিতে নতুন করে সংবিধান ছাপা হয়েছিল। আর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব অব্যাহতভাবে দাবি করে আসছেন যে তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। সে কারণে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে এর স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের রায়ের কারণে তাঁরা বাধ্য হয়ে এ ব্যবস্থা বিলোপ করেছেন। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের এপ্রিলে রায় লিখে এ বি এম খায়রুল হক জমা দিলেই তা পাওয়া যাবে বলে ধরে নেওয়া যায় না। কারণ, রায়টি সর্বসম্মত নয়। কে বা কারা ভিন্নমত পোষণ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট তা প্রকাশ করেননি। তাঁর বা তাঁদের কাছ থেকেও পৃথক রায় প্রত্যাশিত।

অপ্রকাশিত দলিলগুলো

প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংস্কারের যে রূপকল্প দিয়েছিলেন, তা বিশেষ কমিটি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধারণ করেছিল বলে আমরা বিশ্বাস করি। খবরের পেছনে খবর থাকে। সংবিধানের আরও কতিপয় প্রস্তাবিত সংশোধনীর কথা আমরা জেনেছি, যা নিয়ে পর্দার আড়ালে আলাপ-আলোচনার দাবি রাখে। আদালতের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীন দল যে ভুল করেছে, সেটা শোধরানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রথমেই বলে নিই ৩৬ ঘণ্টা হরতাল উদ্রেককারী ইস্যুতে বিশেষ কমিটির ভাবনা: ‘৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হবে। পদত্যাগী মন্ত্রিসভা পুনরুজ্জীবিত হবে। এবং তারা তখন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।’

৩০ মে ২০১১ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের মাত্র চার দিন আগেও বিশেষ কমিটি এভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রেখে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশসংবলিত খসড়া প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছিল।

প্রথম আলোর সংগ্রহে বিশেষ কমিটির দুটি খসড়া প্রতিবেদন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের এমনকি ২৪ ঘণ্টা আগে সংশোধিত খসড়ায়ও দেখা যায়, কমিটি ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটি সূত্রের ব্যাখ্যা এ রকম, ‘ওটা বাঁচাতে সরকারের সিদ্ধান্ত তো ছিলই। কিন্তু আদালতের রায়ের কারণে তা বাদ দিতে হয়েছে।’ কিন্তু আগেই বলেছি আপিল বিভাগ ১০ মে ২০১১ ত্রয়োদশ সংশোধনী ‘ভবিষ্যত্ সময়ের জন্য’ বাতিল বলে রায় দেন। বিশেষ কমিটির ওই দুটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরির তারিখ যথাক্রমে ২৬ ও ২৯ মে ২০১১।

২৮ মে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ কমিটির ২৬তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, কমিটির সভাপতি হয়েও তিনি বলছেন, ‘আশা করি, মতৈক্যের ভিত্তিতে আমরা আমাদের কাজ শেষ করে মাননীয় নেত্রীর কাছে পেশ করব।’ ফজলে রাব্বি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আমির হোসেন আমু প্রমুখের অবস্থান ছিল: রাষ্ট্রধর্ম, বিসমিল্লাহ ও তত্ত্বাবধায়ক—এই তিনটি বাকি রেখে এ বিষয়ে ‘মাননীয় নেত্রী যেটা করবেন, সেটা আমরা মেনে নেব’।

তাঁর কথাই ঠিক প্রমাণিত হয়। প্রধানমন্ত্রী এককভাবে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্য বলেন, পরে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আগে আমরা বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত করি। এবং ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেওয়া হয়।

আমাদের জানামতে, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আবদুল মতিন খসরু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রেখে তা সংশোধনের পক্ষে ছিলেন।

সংসদের নেতা শেখ হাসিনার প্রস্তাবক্রমে সংসদে সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। সরকারি দল বলেছিল, পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধনকল্পে বিশেষ কমিটি গঠিত হয়েছে। এ জন্য সংবিধান পুনর্মুদ্রণের জন্য তাদের কার্যক্রম স্থগিতও রেখেছিল। অথচ সাজেদা চৌধুরীর সংসদে উত্থাপিত প্রতিবেদন সাক্ষ্য দিচ্ছে, ওই কমিটির কার্যবিধিতে কোনো আদালতের রায়ের কথাই বলা হয়নি। বরং তিনি বলেছেন, আদালতের কয়েকটি রায় কমিটি বিবেচনায় নিয়েছে। সুতরাং কমিটির এই প্রতিবেদনই প্রয়োজনে আদালতেও সাক্ষ্য দেবে যে আদালতের রায়ের কারণে কমিটি ত্রয়োদশ সংশোধনী বিলোপের সুপারিশ করেনি। যদিও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা মুখে অমনটাই দাবি করছেন। কমিটির প্রতিবেদন ও আদালতের সংক্ষিপ্ত রায় সাংঘর্ষিক নয়।

আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদ কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী বিলের উদ্দেশ্য ও কারণসংবলিত বিবৃতিতে আদালতের রায়ের উল্লেখ করেননি।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এই  লেখককে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কারণেই আমরা অবস্থান বদল করিনি। তিনি কিছু করতে চাইলে তা মন্ত্রিসভায়ও পারবেন। তাঁর সঙ্গে কমিটির বৈঠকটি “অনানুষ্ঠানিক” ছিল।’

২৭ এপ্রিল ২০১১ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কমিটির আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। তখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন। তখনো রায় হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ‘না’-এর পরেই বিশেষ কমিটির অবস্থান বদলের ঘটনা প্রকাশ্য। এর দালিলিক প্রমাণও পাচ্ছি। কখনো এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ হলে সংসদ নেতাকেও বলতে হবে, রায় ব্যাখ্যায় তিনি তাঁর ‘অনানুষ্ঠানিক’ মত দিয়েছিলেন মাত্র।

খসড়া ২৬ মে ২০১১

২৬ মে তারিখে তৈরি প্রতিবেদনের ২১ দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকালে জরুরি অবস্থা ও অধ্যাদেশ জারি করতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রহিতের সুপারিশ ছিল। এ ছাড়া ৫৮খ অনুচ্ছেদে বিধান করা হয় যে নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘নির্দলীয় সরকার বিলুপ্ত হইবে এবং পূর্ববর্তী সংসদের মেয়াদ অবসানের অব্যবহিত পূর্বে এবং অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করিবে’। এমনকি ৫৮ঘ অনুচ্ছেদে নতুন (৩) দফা যুক্ত করা হয় যে, ‘নির্দলীয় সরকার কোন রাষ্ট্র, দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে কোন প্রকারের চুক্তি সম্পাদন কিংবা ইতিপূর্বে সম্পাদিত কোন চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করিবেন না।’ বিএনপি নির্দিষ্টভাবে এই খসড়ার ভিত্তিতে একটা পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দিতে পারে। ওই প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা ছিল না যে অন্তর্বর্তী সরকার কিসের ভিত্তিতে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে।

এটাও লক্ষণীয় যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের এক দিন আগে ২৯ মে প্রস্তুত খসড়ায় কমিটি শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকাল ৯০ দিন নির্ধারণ করে একটি নিতান্তই নির্দোষ সুপারিশ এনেছিল। এই প্রতিবেদনটিই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো হয় বলে জানি। এতে শুধু ৫৮খ অনুচ্ছেদের সংশোধন চেয়ে বলা হয়েছিল, ‘৫৮খ-এর দফা (১)-এ “মেয়াদে” শব্দের পর “অনধিক ৯০ দিনের জন্য” শব্দগুলি সন্নিবেশিত হইবে।’

৩. যেসব কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী সংকটের সমাধান দেবে না

পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর এটা নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষত বিরোধী দলগুলো নিজেদের এ রকম অবস্থানের কথাই জানান দিচ্ছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে তারা কোনো জাতীয় নির্বাচনে যাবে না। এটা নিয়ে দেশে একটা বড় অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার জোর আশঙ্কা তো আছেই। এই দিকটা বাদ দিলেও, আমাদের অনুমান, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যেভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে তা দিয়ে সংকটের কোনো সুরাহা হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি ত্রয়োদশ সংশোধনী অবিকল ফিরিয়ে আনলেও সংকট ঘুচবে না। কারণ, কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন, সেটা নিয়ে বিরোধ অব্যাহত থাকতে পারে। এর পেছনে আরও বেশ কয়েকটি কারণ আছে। কিন্তু সম্ভবত মূল কারণটা হচ্ছে: দুই ব্যক্তির ছায়া, যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। সব ক্ষমতা দুজন ব্যক্তির কাছে কুক্ষিগত থেকে যাওয়ায় অন্যান্য দেশে বা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে যে ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে সে রকম ব্যবস্থাও এখানে প্রায় অচল হয়ে পড়ে। বিশ্বের কোথাও বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতেও এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ মডেলের নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার গঠনের কথা জানা যায় না।

বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন করা এবং সেই নির্বাচন নিয়ে সব দল ও মতের সন্তোষ আশা করা যেসব কারণে অসম্ভব হয়ে উঠছে তার কয়েকটি নিয়ে এখন আলোচনা করতে যাচ্ছি। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে, এই সংকটগুলো উদ্ভূত ও বিকশিত হওয়ার পেছনে মূল কারণ একটাই: ব্যক্তির অসীম আধিপত্য।

ক. ব্যক্তির ছায়া

বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নটিকে সাধারণত মূলধারার দলীয় রাজনীতি ও তার সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হয়। কিন্তু আসল সংকট দুই বড় দল, যাদের মধ্যে ১৯৯১-পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনের ফলাফল আবর্তিত হয়েছে, তার শীর্ষ নেতৃত্ব। এ জন্যই বাংলাদেশ তার অজান্তেই এমন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অচেনা। কোনো দেশের মডেলের সঙ্গে একে খাপ খাওয়ানো যায় না। এই রাজনীতি ও তার বিকাশ, বিলুপ্তি ও পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন দুই ব্যক্তির ছায়ায় চক্রাকারে ঘুরছে। এর অর্থ এই নয় যে, দুই ব্যক্তি সরে গেলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আকাঙ্ক্ষা লোপ পাবে। সেটা পাবে না। তখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার পড়বে। কিন্তু তা ত্রয়োদশ সংশোধনীর মডেলে নয়। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীকে আক্ষরিক অর্থেই বিদায় করার পথে নয়।

বাংলাদেশে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চরম রূপ না থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এতটা মাতম উঠত না। আজ যদি প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা ঘোষণা দেয় যে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে এবং সে কারণে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না; তা হলে দেখা যাবে উত্তেজনার পারদ অনেকটাই নিচে নেমে গেছে। এমনকি শুধু প্রধানমন্ত্রী যদি ঘোষণা দেন যে তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না কিংবা যদি বলেন তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন, কিন্তু ওই সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তাঁর দলের অন্য কারও কাছে ন্যস্ত করবেন, তা হলেও পরিস্থিতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো আলোচনা বিএনপির পক্ষ থেকেও আসবে না। তার কারণ, একটা বিষয়ে তাদের মতৈক্য আছে যে ব্যক্তির ‘কালজয়ী’ অবস্থান ও তাঁর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার বিষয়টি যেন কখনোই গণমাধ্যমের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না হয়। এটা যে দলের যে-ই যখন করবে, তাকে কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হতে হবে। সত্যি বলতে কি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে তাঁরা কিন্তু প্রকারান্তরে মাইনাস টু ফর্মুলার একটা পরোক্ষ গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে চলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মানে মাইনাস ওয়ান। দলীয় প্রধানমন্ত্রীকে অপসারিত করতে হবে। ঠিক এ কারণেই স্যার স্টিফেন নিনিয়ান ব্যর্থ হয়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস না করে কোনো সমাধানে যেতে চায়নি আওয়ামী লীগ। ত্রয়োদশ সংশোধনী রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যে মোটেই উন্নত করেনি, তার বড় প্রমাণ আজও সমাজে মাইনাস ওয়ান অর্থাত্ নির্বাচনকালে দলীয় প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের আকাঙ্ক্ষা অটুট।

বাংলাদেশ-রাজনীতির সাংস্কৃতিক চরিত্র হচ্ছে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য বা ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখা। অনেকেই মনে করেন, এক ব্যক্তির ভাবমূর্তিই দলের জন্য বড় পুঁজি এবং সেটা নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগাতে পারলে কেল্লাফতে।১১ সে কারণে দুই ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন লেখালেখি স্পর্শকাতর হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। গণমাধ্যম এ কারণেই যত দূর সম্ভব এ দুই ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে সাংবাদিকতা করে।

ব্যক্তির প্রভাব-বলয় থেকে বেরোতে হলে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও দলের প্রধান—এই তিনজন কোনো অবস্থাতেই এক ব্যক্তি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনরত দেশগুলোতে যেভাবে নির্বাচন হয়, সেভাবে আগামী নির্বাচনও হবে।’ কিন্তু বিশ্বের কোনো সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে নির্বাহী ক্ষমতা শুধু প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়নি। সেসব সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের মতো কালাকানুনও নেই। উপরন্তু উল্লিখিত তিনজন উন্নত দেশগুলোর প্রায় সর্বত্র তিনজন ভিন্ন ব্যক্তি। আওয়ামী লীগকে তার ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও মন্ত্রিত্ব একসঙ্গে আগলানোর রেওয়াজ আগে ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম যখন মন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে অপশন দেওয়া হলো। দলের পদ, না-হয় মন্ত্রিত্ব—একটি রাখতে হবে। তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রয়াত জাতীয় নেতা কামরুজ্জামানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে শিল্পমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছিল।

শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব ছাড়ার আগে বলেছিলেন, ‘২০০১ সালের ১৭ এপ্রিলের পর কেয়ারটেকার সরকার গঠন হলেই তবে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন।’ এমনকি সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরও তিনি ইউরোপের একটি দেশে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগদানের আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এ থেকে পরিষ্কার যে তিনি স্ব-আরোপিত সংযম দেখাতেও সতর্ক ছিলেন না। সংবিধানের বিলুপ্ত ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘সংসদ ভেঙে দেয়ার বা ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্ত হবেন এবং যে তারিখে সংসদ ভেঙে দেয়া হয় বা ভঙ্গ হয় সেই তারিখ থেকে যে তারিখে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন সেই তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে সংসদ ভেঙে দেয়ার বা ভঙ্গ হওয়ার অব্যবহিত আগে দায়িত্ব পালনরত প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভা তাদের দায়িত্ব পালন করতে থাকবেন।’ সুতরাং প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে দু-চার দিন দেরি হলে সেই সময়েও বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর ‘ক্ষমতায়’ থাকা দাবি করার সুযোগ ছিল।

আইন ও বিচারসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হঠাত্ করেই ১৫তম সংশোধনী বিল পাসের পর ঘোষণা দেন যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা ভাবতে পারে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা অন্যত্র যে অর্থে তত্ত্বাবধায়ক শব্দটি ব্যবহার করা হয়, সেটিকে তারা বলে অন্তর্বর্তীকালীন। যেমন—কানাডীয় রাজনীতিতে যখন কোনো দলের নেতার পদত্যাগ বা মৃত্যুজনিত কারণে আকস্মিক পদ শূন্য হয়, তখন অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে যে নেতাকে নির্বাচন করা হয়, তাকে বলা হয় অন্তর্বর্তীকালীন নেতা। এখন আকস্মিকভাবে ‘একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ কথা বলা হলেও এর কোনো সাংবিধানিক তাত্পর্য নেই। কারণ একটিই, একজন সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থেকে যাবেন। সামরিক শাসক কিংবা রাষ্ট্রপতিরা নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছিলেন। সেটা তাঁরা পেরেছিলেন কারণ তাঁরা সর্বশক্তিমান ছিলেন। দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রব্যবস্থা ফিরে এলেও ওই ব্যক্তির অসীম ক্ষমতা থেকে বাংলাদেশ বেরোতে পারেনি।

ব্যক্তিবিশেষের অসীম ক্ষমতার বিধানটি কী করে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেল সেটা নিয়ে আরেকটু আলোচনা করা যাক। আগেই বলেছি, সংবিধান প্রণয়নের মাত্র আট বছরের মাথায় জামায়াতে ইসলামী সরকারপ্রধান অপসারণের বিধানসংবলিত তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার ফর্মুলা দিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান চতুর্থ সংশোধনীতে প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা বহাল রেখেছিলেন। তবে পঞ্চম সংশোধনীর রাষ্ট্রপতি আর দ্বাদশ সংশোধনীর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে মৌলিক কোনো ফারাক নেই। সিএমএলএ জিয়া-এরশাদ এবং রাষ্ট্রপতি জিয়া-এরশাদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-বেগম খালেদা জিয়ার শাসন কৌশলের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে বড় কোনো পরিবর্তন চোখে পড়বে না। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সাম্প্রতিক সংলাপ উদ্যোগের পর সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় ইসি নিয়োগে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। বস্তুত এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। এ ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টির কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ‘উদার’ চেষ্টা বাংলাদেশের সিএমএলএ, রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রিত্বে আগে কখনো দেখা যায়নি।

১৯৭২ সালেই সংবিধানের ৫৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হলো, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে।’ লক্ষণীয়, এই উপধারাটির ঠিক আগেই ১ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকবে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভাকে বাদ দিয়ে কেবল একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি করা হলো। আবার ৫৫(৩) অনুচ্ছেদে ঠিকই বলা হলো, ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকবেন’ অর্থাত্ জবাবদিহির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভা শব্দটি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ভারতীয় মডেল ও অন্যান্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধানাবলির নিবিড় পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে নির্বাহী ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সংবিধানের বাহাত্তরের কাঠামো একটি দুর্ঘটনা বা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে সংবিধানে সেদিন এই বিশেষ অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণপরিষদের তিনজন সদস্য লেখককে এ কথা নিশ্চিত করেন। তা ছাড়া বিজি প্রেস থেকে মুদ্রিত মূল সংবিধানের দুষ্প্রাপ্য খসড়াগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘ফার্স্ট অ্যামোং দ্য ইকুয়ালস’—এই নীতি গোড়াতেই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। মন্ত্রিসভার সদস্যরা যাতে কেউ কখনো নিজেদের প্রধানমন্ত্রীর সমকক্ষ না ভাবতে পারেন সে চেষ্টাও চলেছিল। সে জন্য একটি বিধান আনা হয়েছিল, মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করবেন। পরে সেটি বাদ পড়ে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তা টিকিয়ে রাখা হয় বা টিকে থাকে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি আজও বহাল। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা ফৌজি শাসকদের মধ্যে তেমন কোনো তফাত্ আমরা দেখি না। তবে একটা জাতিগত কপটতা হলো স্বৈরতন্ত্র বা গোষ্ঠী শাসন যে আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে, সেটা আমরা পারতপক্ষে প্রকাশ্যে স্বীকার করি না। অবশ্য এ বিষয়টি যে বিদগ্ধজনেরা তাঁদের আলোচনায় একেবারে দূরে সরিয়ে রাখছেন তা কিন্তু নয়।

প্রথম আলোর সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সংবিধানে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে রাশিয়ার অত্যাচারী শাসনের প্রতিভূ জারের ক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করেন। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও এম হাফিজ উদ্দিন খান দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত পৃথক নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সমালোচনা করেছেন। ড. আকবর আলি খান তাঁর ইউপিএল প্রকাশিত হাম্পটি ডাম্পটি বইয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতাকে ভারতের মুঘল, রাশিয়ার সর্বশেষ সাম্রাজ্যবাদী রাজবংশ এবং ফরাসি রাজন্যের (১৫৫৫-এ শাসন শুরু, ১৭৯২-এ ফরাসি বিপ্লবে পতন) ক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করেন। বাংলাদেশের প্রত্যেক শাসক গণতান্ত্রিক দাবি করলেও তাঁরা কখনো তাঁদের সাংবিধানিক ক্ষমতাকে গণতান্ত্রিক করতে সচেষ্ট হননি। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ সিএমএলএ ছিলেন। পরে নিজেদের নির্বাচিত খোলস পরানোর মাধ্যমে যে ক্ষমতা তাঁরা সাংবিধানিকভাবে লাভ করেন তাতে সিএমএলএ হিসেবে তাঁদের যে ক্ষমতা ছিল সেটা তেমন খর্ব হয় না। কারণ, বাহাত্তর ও চতুর্থ সংশোধনী-পরবর্তী বাংলাদেশ সংবিধান তাঁদের সাহায্য করেছে। বাহাত্তরের সুলিখিত সংবিধানের সবচেয়ে বড় গলদ, এটা ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। নির্বাচন কমিশনারদের মতো সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ দিতে আইন করার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল সংবিধান। এসব আইন করার উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার রাশ টানা। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধান সিইসি নিয়োগে নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রপতিকে ‘ডিসক্রিশন’ বা একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়েছিল। পাকিস্তানের সাংবিধানিক ইতিহাসে তাই আমাদের ১১৮ অনুচ্ছেদের মতো কোনো আইন করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কথা বলা নেই। এর উত্পত্তি ভারতের সংবিধান। ১৫ জুন ১৯৪৯। ভারতের মূল খসড়া সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার পরামর্শেই সিইসি নিয়োগের বিধান ছিল। কিন্তু প্রফেসর সাক্সেনা এ মর্মে ভিন্নমত দেন যে সিইসি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করতে হবে। সে জন্য তিনি এদিন সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিইসি নিয়োগের বিধান যুক্ত করে একটি সংশোধনী আনেন। গণপরিষদ সভাপতি ড. ভিমরাও রামজি আম্বেদকার (১৮৯১-১৯৫৬) প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় লাগাম পরাতে হবে। তবে সে জন্য তিনি সংসদকে একটি আইন তৈরির বিধান করে নতুন প্রস্তাব দেন এবং সেটিই গৃহীত হয়।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন সংবিধান প্রণয়ন কমিটি প্রজাতন্ত্রের সবটুকু নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে দেয়নি। তারা অন্তত মন্ত্রিসভার কাছে তা ন্যস্ত করেছিল। কিন্তু বাহাত্তরের ৪ নভেম্বর বিনা আলোচনায় তা মুছে দিয়ে রহস্যজনকভাবে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেওয়া হয়েছিল। এই গলদ আর কখনো দূর করা হয়নি। বাংলাদেশে তাই প্রধানমন্ত্রী কখনো রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, রাষ্ট্রপতি কখনো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সিএমএলএ কখনো বেসামরিক লেবাস পরেছেন। কিন্তু ব্যক্তির হাতে এই ক্ষমতা নিরঙ্কুশ থেকেছে। আর সে কারণেই আজ ওই দলীয় ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর অপসারণ ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের সাধারণ সামর্থ্য অর্জনে অপারগ থাকছে। উল্লেখ্য যে, দ্বাদশ সংশোধনীর পর রুলস অব বিজনেস সংশোধন করে মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়সমূহের প্রধান নির্বাহী করা হয়েছে। অথচ সংবিধানেই সরাসরি তাঁদের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সংসদের মূল কাজ অবাধে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে যথেষ্ট সক্ষম থাকা। কিন্তু সে সুযোগ অনেকটা সাংবিধানিকভাবেই রুদ্ধ। 

সুতরাং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সংসদের কাছে দায়ী থাকা বা না থাকার মধ্যে রাজনৈতিক দিক ছাড়া আইনগত তেমন কোনোই ফলাফল নেই। সে কারণে সাংবিধানিকভাবে সরকার বদলের কিংবা সরকারের ইচ্ছার বিপরীতে সংবিধান সংশোধন বা আইন তৈরির কোনো পথই সংসদের সামনে খোলা নেই। সে কারণেই সংসদ অচল রেখে ২০১২ সালের ১২ ও ১৪ মার্চের মতো সহিংস কর্মসূচির পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত করতে পঞ্চম সংসদে গত দুই দশকের ইতিহাসের একমাত্র অনাস্থা প্রস্তাবটি এনেছিলেন। ভোটাভুটিতে পরাস্ত হওয়ার পটভূমিতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা বা মাইনাস ওয়ান আন্দোলনে ঝুঁকেছিলেন। এ কথাও ঠিক যে কমজোরি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকারে থাকা বিএনপির বেপরোয়া মনোভাব ও সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফের দুর্বল ভূমিকায় মাগুরার বিতর্কিত ও অস্বচ্ছ উপনির্বাচন এরূপ আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছিল। ১৫তম সংশোধনীতে ৭০ অনুচ্ছেদের শক্ত বাঁধনটা আগের চেয়ে ঈষত্ শিথিল করা হলেও তাতে প্রধানমন্ত্রী কিংবা ছায়া প্রধানমন্ত্রী তেমন কোনো চাপ বা হুমকি অনুভব করবেন বলে মনে হয় না। কাজেই পঞ্চদশ সংশোধনীর ভেতর দিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কোনো সুরাহা হওয়ার একদমই আশা নেই। আর সে কারণেই সুষ্ঠু নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াতে যে সংকট আগে ছিল সেটা বরাবরের মতোই বজায় থেকে যাবে।

বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজার যেকোনো যৌক্তিক প্রয়াসে অবশ্যই দুই নেত্রীর অব্যাহত ও অপরিবর্তনীয় ব্যক্তিগত উপস্থিতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতার কাঠামোটি একসঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির নেপথ্যে কার্যত ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর সরে দাঁড়ানোর প্রশ্নটি সর্বাধিক গুরুত্ববহ। তাই স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের ফর্মুলা (৫+৫+১) আওয়ামী লীগ মেনে নিতে পারেনি। যদিও কমনওয়েলথের বিশেষ দূত হিসেবে বাংলাদেশে তাঁর আগমনকে আওয়ামী লীগ স্বাগত জানিয়েছিল। স্যার নিনিয়ান সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই ফর্মুলা দেওয়াকে হয়তো যুক্তিসংগত মনে করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব ও সাংবিধানিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়াকে স্বপদে বহাল রেখে নির্বাচনে যাওয়াকে নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক ভাবতে পারেনি। পঞ্চম সংসদ থেকে গণপদত্যাগের আগে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সব ছাড়লেও চেয়ার ছাড়তে চান না’ (ভোরের কাগজ, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৪)। ১৮ বছর পর বাংলাদেশের রাজনীতি সম্ভবত একই বৃত্তে ফিরে আসছে।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত একাদিক্রমে চারটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও বাংলাদেশের নির্বাচন পরিচালনার রাজনীতি ও সংস্কৃতিগত কোনো উন্নয়ন বা আস্থার জায়গা সৃষ্টি হয়নি। ২০১১ সালে এসে আওয়ামী লীগ যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা দিচ্ছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে স্যার স্টিফেন নিনিয়ানেরই ফর্মুলা। এর মানে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীকে স্বপদে বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। কারণ বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনাকে বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে নিরাপদ মনে করতে পারছে না। অবস্থা এতটাই অবনতিশীল রয়ে গেছে যে আজ প্রধানমন্ত্রী সরে গেলেও বিএনপি শেখ হাসিনার মনোনীত রাষ্ট্রপতির অধীনেও নির্বাচনে যেতে অনাগ্রহ দেখাবে। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচন আওয়ামী লীগই শুধু নয়, নাগরিক সমাজও কিন্তু গ্রহণযোগ্য মনে করেনি।

সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদকে সরে দাঁড়াতে তাঁরা যে দাওয়াই (তিনজোটের রূপরেখা) দিয়েছিলেন, সেটাই তাঁরা সব নির্বাচনের আগে নিজেদের জন্যও ধন্বন্তরী মনে করে চলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চলমান আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম নয়। একজন অনির্বাচিত জবরদখলকারীর সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছিল, ঠিক একই আচরণ তাঁরা পরস্পরের নির্বাচিত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গেও করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

খ. নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা

বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও বিশ্বের বহু দেশেই এই মেয়াদ মোটামুটি চার বছরেই স্থির হয়েছে। ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় লোকসভার মেয়াদ অবসানের আগেই। সংবিধানের ৫৮ঘ অনুচ্ছেদে বলা ছিল: ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সংসদ সদস্যগণের সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠানের জন্য যেরূপ সাহায্য ও সহায়তার প্রয়োজন হবে, নির্বাচন কমিশনকে সেরূপ সকল সম্ভাব্য সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করবেন।’

তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতেও সুষ্ঠু নির্বাচনের মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেবল তার সহায়ক ছিল। উপদেষ্টারা রাষ্ট্রপতির কাছে জবাবদিহি করতেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনারদের জবাবদিহি ছিল সব সময় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছেই। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে এমন কোনো বিধান আনা হয়নি, যাতে কমিশনের স্বাধীনতা কোনোভাবে খর্ব হয়। সে কারণেই অবাধ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে কাগজে-কলমে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অসীম, যার উত্স শুধু সংবিধান নয়, সমাজ-সংস্কৃতিতেও নিহিত। আর সেটাই নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের বিকল্প হিসেবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্বকে নিষ্প্রভ করে রেখেছে।

তবে নির্বাচন কমিশন সংস্কার ও নির্বাচনকালে রাজনীতিবিদদের অসততা রোধে কার্যকর কোনো আইনই এ পর্যন্ত সংসদ প্রণয়ন করেনি। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও তার নিরীক্ষিত হিসাব দাখিলের নিয়ম চালু করা সম্ভব হলেও নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে তেমন কোনো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। প্রার্থীরা তাঁদের নির্বাচনী ব্যয়ের যে রিটার্ন দাখিল করেন তা যদি অসত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে দোষী ব্যক্তিকে সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে এখনো কোনো মামলা দায়ের করার কথা ভাবতেই পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার উদ্ভাবন, রদ এবং এখন তা পুনরুজ্জীবনের ডামাডোলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আড়াল করে রাখা সম্ভব হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে ১৯৯৪ সালে একটি আইন পাস হয়। এ আইনের মাধ্যমে ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটিকে নির্বাচন-পূর্বকালের অনিয়ম অপরাধ তদন্তের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এটা শুনতে ভালোই লাগছে, কিন্তু বাস্তবে জনসাধারণ ও আইনের শাসনের ধারণার সঙ্গে একে বলা চলে এক প্রতারণা। কেন, সেটা একটু বিস্তারিত করে বলছি।

পঞ্চম সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠলে বিএনপি নির্বাচনী আইন সংশোধন করে নির্বাচনের আগে প্রাক নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু কমিটিকে নির্বাচনের প্রতিযোগিতা থেকে যেকোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা খারিজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ওই আইনে আরোপিত মাত্র পাঁচ হাজার টাকার জরিমানার ভয়ে রাজনীতিক ও তাঁদের সমর্থকেরা যে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন ও ভোট কারচুপির সর্বাত্মক অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকেন না, তা আওয়ামী লীগ ঠিকই ধরতে পেরেছিল। ওই একই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে ১৫তম সংবিধান সংশোধনী বিল পাসের ঘটনায়। ক্ষমতাসীনেরা সতর্ক থাকেন যাতে যেকোনোভাবেই নির্বাচন কমিশন বাড়তি ক্ষমতা, দায়িত্ব কিংবা এখতিয়ারপ্রাপ্ত না হয়। নির্বাচনে জিতে একবার যদি গেজেট করানো যায়, তাহলে আর ঠেকায় কে—এই অশুভ প্রবণতা এখনো তুঙ্গে। কারণ, নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিভাগীয় সদরে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠন ও পরে সরাসরি হাইকোর্টে মামলা করার বিধান করেও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন আনা যায়নি। কারণ বিচার বিভাগ পৃথক হয়নি। বিচার বিভাগ স্বাধীন হতে পারেনি। কিন্তু এটাই বাস্তব যে, বিরোধী দলের জনপ্রিয় ভাষ্যে এর কোনো স্বীকৃতি আগেও মেলেনি, এখনো মিলছে না। অথচ অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে পরোক্ষভাবে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকর বলেই বিবেচিত হতে বাধ্য। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক যখন ‘উচ্চ আদালত ব্যক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে রায় দেন’ কিংবা ‘হাওয়া বদলে গেলে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার বদল ঘটে’ জাতীয় মন্তব্য করেন, তখন আমরা সমাজে এর মৌন সম্মতি লক্ষ করি। আর এ ধরনের  হাওয়া বদলের পূর্বশর্ত হচ্ছে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ। কারণ, জাতীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনে এ রকমের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যাতে এ সন্দেহ জাগে যে সর্বশক্তিমান সরকারের ইচ্ছার কাছে সাংবিধানিক সংস্থাগুলো কোনো না কোনো মাত্রায় অসহায় হয়ে পড়ে। এটা কখনো দৃশ্যত, কখনো কার্যত। কাজেই আগামী সংসদ নির্বাচনেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন তার যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারবে, এমন ভাবনায় নাগরিক সমাজ দ্বিধান্বিত। বিদায়ী সিইসি ড. এ টি এম শামছুল হুদা কতিপয় মন্ত্রণালয়ের (জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, মন্ত্রিসভা বিভাগ) কার্যক্রম নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করার কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য: কতিপয় শর্ত পূরণ করা হলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব। আবার বলেছেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়, কিংবা কঠিন। বিদায়ী নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে প্রেরিত এক সংশোধনী প্রস্তাবে ওই চারটি বিষয় আইন সংশোধন করে ইসিকে দিতে বলেছেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী সব ক্ষমতার উেস আছেন একজন প্রধানমন্ত্রী। আইন বা বিধি করে সংবিধানের বিধানকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই সামগ্রিকভাবে বলা চলে, এই প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিকতাই নির্বাচন অনুষ্ঠানে যেমন, তেমনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথেও এক বিরাট বাধা। সে কারণে সময় টিভি কতিপয় মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য কাউকে দিলেই তো সমস্যা মিটে যায়।

 গ. ঠুঁটো জগন্নাথ রাষ্ট্রপতি

কেন নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণই শেষ কথা হতে পারে না? এই প্রশ্নের জবাব ‘কেয়ারটেকার রুলস ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধে ভারতীয় ভাষ্যকার ও আইনবিদ এ জে নুরানী সম্ভবত যথার্থভাবেই দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: ‘যথার্থভাবে নির্বাচিত সরকারের পদত্যাগের দাবি স্পষ্টতই অগ্রহণীয়। কিন্তু বিশ্বাসের যে সংকট, তাকে মোটেই উপেক্ষা করা যায় না। আর ক্ষমতাসীন সরকার, সে যত জনপ্রিয়ই হোক না কেন, নির্বাচনে তাকে বিশ্বাস করার উপায় নেই; আর ঠিক এ কারণেই ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় স্বাধীন নির্বাচন কমিশন হওয়া সত্ত্বেও তা যথেষ্ট বলে গণ্য হয়নি।’ ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ ভারতের দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিবন্ধে মি. নুরানী বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কনভেনশন গড়ে তুলতে রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিলেন। ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচন-প্রক্রিয়াতে যাতে কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে, সে জন্য তিনি প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের কথাও বলেন।

সাধারণত নির্বাচনকালে রাষ্ট্রপতি একটা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু ‘কবরস্থানে ফাতেহা পাঠের’ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকালেও কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন না। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি ঠুঁটো জগন্নাথ ছিলেন না। এর আওতায় কিন্তু মোটে দুটি (১৯৯৬ ও ২০০১) নিয়মতান্ত্রিক সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। এর পরই এটা ভেঙে পড়ে। জন্মলগ্নেই এর অন্যতম বড় গলদ ছিল রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া। খালেদা জিয়ার ‘ইয়েসম্যান’ অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনকে ঘিরে ২০০৬ সালে যে সংকট হয়, সেটা ২০০১ সালে হতে পারত না, তা নয়। কিন্তু সেটা যেসব কারণে হয়নি, তার অন্যতম ছিল রাষ্ট্রপতি পদে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের বহাল থাকা। তিনি কোনোভাবেই ‘ইয়েসম্যান’ হতে না চাওয়ার সুফল দেশবাসী পেলেও আওয়ামী লীগ মনে করে তারা তাঁকে নিয়োগ করে সুফল পায়নি। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতিকে তিনি কিছু ক্ষমতা প্রদানের পরামর্শ দিলে তাঁর কথায় উভয় নেত্রী তা না দিতে একমত হন।

আমাদের সংবিধান প্রণয়নকালে ভারতের মূল সংবিধানের ৫৩(১) ও ৭৪(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে অধিকতর ক্ষমতাধর মনে করা হতো। ভারতের সংবিধানের ৫৩(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, The executive power of the union shall be vested in the President and shall be exercised by him either directly or through officers subordinate to him in accordance with this Constitution. ৭৪(১) অনুচ্ছেদ ছিল নিম্নরূপ: There shall be a council of ministers with the Prime Minister at the head to aid and advice the President. ৫৩(১) অনুচ্ছেদ আজও অবিকল রয়েছে। কিন্তু ১৯৭৬ ও ১৯৭৮ সালে সংবিধানের ৪২ ও ৪৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে ৭৪(১) অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়। ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ৭৪(১) অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে এক তুমুল রাজনৈতিক বিতর্কের সূচনা করেছিলেন। পরিবর্তিত ৭৪(১) অনুচ্ছেদটি এরূপ দাঁড়ায়: There shall be a Council of Ministers with the Prime Minister at the head to aid and advise the President who shall, in the exercise of his functions, act in accordance with such advice.

ভারতের উল্লিখিত সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা হয়েছিল। আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়ার কথা বললে অনেকে ভড়কে যান। ভারতের গণপরিষদেও তা-ই হয়েছিল। এ রকম এক প্রশ্নের জবাবে পণ্ডিত নেহরু বলেছিলেন, এটা তো ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের শর্ত। রাষ্ট্রপতি তো নির্বাহী ক্ষমতা অনুশীলনের মালিক নন। মন্ত্রিসভা যদি রাষ্ট্রপতিকে তাঁর মৃত্যু পরোয়ানায় সই দিতে বলে তা হলে অভিশংসন এড়াতে চাইলে তিনি তা-ই তামিল করতে বাধ্য। বাংলাদেশ সংবিধানের ত্রুটি হলো, রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানে সাজানো হয়েছে অবিকল ভারতীয় রাষ্ট্রপতির মডেলেই কিন্তু তাঁকে নির্বাহী ক্ষমতা না দিয়ে রিক্ত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ সর্বমহলে প্রশংসিত হওয়া প্রমাণ করে যে জাতির সামনে এমন ক্রান্তিকাল আসতে পারে, যখন রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হওয়ার দরকার পড়তে পারে।

১৯৭৮ সালে ভারতের জনতা সরকার তাই তাদের রাষ্ট্রপতির ওই নাজুক অবস্থানকে একটু শক্তিশালী ও সংহত করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাতে আসল অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। সংবিধানের ৪৪তম সংশোধনীতে বিধান করা হয় যে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভাকে কোনো সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করতে পারবেন কিন্তু মন্ত্রিসভা সেটা গ্রহণ না করলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতিকে তা মেনে নিতে হবে।

এই অবস্থাটি বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এই ক্ষমতাবলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ যেকোনো বিষয় বিবেচনা ও আলোচনার জন্য মন্ত্রিসভার কাছে প্রস্তাব রাখতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ অনেকেই আশা করবেন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি রুগ্ণ, এটা তারও একটা প্রতিফলন। সাংবিধানিক পদধারীরা রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর, বিশেষ করে সরকারপ্রধানের স্বার্থ যেখানে চরমতম, সে সব ক্ষেত্রে তাঁরা যথাদায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে থাকেন। তাঁরা কেউ কেউ যথেষ্ট নৈতিক পীড়ন অনুভব করতে পারেন, কিন্তু জনগণের অনুভবে তা স্পষ্ট হতে পারে না। সাংবিধানিক পদধারীরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে যে সম্ভাব্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, সেটা সামাল দিতে অনেক সময় অপারগ থাকেন। এর অন্যতম কারণ অবশ্য উপযুক্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ঘাটতি। সম্ভবত একই কারণে ভারতের টিএন সেশনের মতো কোনো ব্যক্তিত্ববান প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় একই ধরনের ক্ষমতাবান হয়েও সেভাবে দায়িত্ব নির্বাহ করতে পারেন না কিংবা সে ধরনের শক্ত প্রচেষ্টাও অব্যাহতভাবে কাউকে চালাতে দেখা যায়নি।

রাষ্ট্রপতিকে রেখে সংকটের সমাধান খোঁজা সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ভারতের সংবিধানে কেয়ারটেকারের বিধান না থাকলেও সংকটে তারা রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে। বুলগেরিয়ার সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে কোনো নির্বাচনের পর সরকার গঠন সম্ভব না হলে রাষ্ট্রপতিকে একটি কেয়ারটেকার কেবিনেট গঠনের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর নির্ভর করে কাদের নিয়ে কেয়ারটেকার সরকার করা হবে তাও বলা আছে। এটা সংসদের ওপর নির্ভর করে না। তখন অবশ্য সংসদও থাকে না।১২

কিন্তু বাংলাদেশে ১৫তম সংশোধনীর পরেও রাষ্ট্রপতির অবস্থা আগের মতোই নাজুক। রাষ্ট্রপতি যতই সরকারপ্রধানের অনুগত ও বিশ্বস্ত হন, সাংবিধানিকভাবে ‘কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ’ই তাঁর নিয়তি। এখানে আসলে দুই নেত্রীর প্রভাববলয়কে ঘিরে সাংবিধানিক, সামাজিক ও কিছুটা সাংস্কৃতিকভাবেও একটি স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীটি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে তাঁদের দুই বড় দলের শীর্ষে এবং একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী/বিরোধী দলের নেতা পদে বহাল থাকার ক্ষেত্রে গত প্রায় তিন দশকের ধারাবাহিকতায় কোনো বিঘ্ন না ঘটে। সুতরাং দুই ব্যক্তির শাসনগত ওই স্থিতাবস্থা অব্যাহত। বিএনপি বলছে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে ১৫তম সংশোধনী বাতিল করবে। কিন্তু ওই স্থিতাবস্থা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনটা একবারেই ভাবা যায় না।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দ্বাদশ সংশোধনীকালে রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু ক্ষমতা দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা উপেক্ষা করতে দুই নেত্রী একমত ছিলেন বলে সাহাবুদ্দীন আহমদ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। অনেক প্রবীণ রাজনীতিককে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা থাকার বিপদ সম্পর্কে পাকিস্তানি অভিজ্ঞতার (রাষ্ট্রপতির দ্বারা গণপরিষদের সভাপতি মৌলভি তমিজউদ্দিনের অপসারণ) কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পছন্দ করেন। কিন্তু এতে সত্য চাপা পড়ে। আমাদের অনেক বরেণ্য চিন্তাবিদ সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রীর অস্তিত্ব যে গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি, সেটা (তাঁরা) তাঁদের বইয়ে সতর্কতার সঙ্গে উল্লেখ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা এই বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে জনতার সামনে আলোচনা করতে চান না। কারণ, এটা তাঁরা বাস্তবে অপ্রীতিকর এবং অর্জন-অযোগ্য বলেই মনে করেন। নাগরিক সমাজের পলায়নপরায়ণতা ও রাজনীতিকদের আনুগত্যহীনতা কিংবা দ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হতে শঙ্কিত থাকার পটভূমিতে বাংলাদেশে যে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের চাষাবাদ ঘটে, সেটারই অনিবার্য পরিণতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ওঠা। সহজ কথায়, অনির্দিষ্টকাল ধরে দুই নেত্রীর দুই দলের নেতৃত্ব ধরে রাখা এবং তাঁদেরই ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী/বিরোধী দলের নেতার পদে বহাল রাখার মাশুলের অপর নাম সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিক বিপর্যয়।

সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলন করেও ভারত কেন রাষ্ট্রপতি নামের এক ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত রেখেছে এবং কেন সেই নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একটি মন্ত্রিসভা দ্বারাই সব পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, সেদিকে বাংলাদেশকে তাকাতে হবে। এ ধরনের প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মাথা ঘামালে কখনো কোনো টেকসই সমাধান নাও মিলতে পারে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেব না, মহাহিসাব নিরীক্ষা দপ্তর শ্বেতহস্তি বানিয়ে রাখব, পিএসসির কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করব, কিন্তু শুধু নির্বাচন কমিশনকে বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার আলাপ-আলোচনা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ থাকতে বাধ্য।

শাসক আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হঠাত্ বাতিল করে এবং বিরোধী বিএনপি তা অবিকল পুনরুজ্জীবনের জিগির তুলে বাংলাদেশের জনগণকে আবারও ধোঁকায় ফেলতে বসেছে। তবে এও ঠিক যে বিরোধী দল তাদের দাবিকে অধিকতর জনপ্রিয় করে তুলতে পারবে। কারণ, শাসকগোষ্ঠীর অধীনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য সাধারণ নির্বাচন হতে পারে না বলে জনমনে ব্যাপক ধারণা চালু রয়েছে। যদিও ২০০৯-২০১২ পর্বে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্ষমতাসীন দলের ঘোষিত সমর্থকেরা হেরেছেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন লেখককে বলেছেন, তাঁর ধারণা, বিরোধী দল সমর্থকেরা এত বিপুল সংখ্যায় এর আগে কখনো কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হননি। এসব নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যভাবেই পরিচালিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন দেখাচ্ছে, সরকার সেনা মোতায়েনে ইসির অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছে, আবার সেনা মোতায়েন না করেও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দলনেতার বা সরকারপ্রধানের ফ্রন্টলাইন রাজনৈতিক সৈনিক নন। তাঁদের ক্ষমতাও সীমিত। উপরন্তু উপজেলা নির্বাচনে যখন বিরোধী দলের সমর্থকেরা প্রাধান্য বিস্তার করেছেন, তখন তাঁদের ওপর ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সাংসদদের খবরদারি নিশ্চিত করা হয়েছে। জেলা পরিষদগুলোতে দলীয় এজেন্ট নিয়োগ করে একটা স্থানীয় পর্যায়ে দলগত শক্তির ভারসাম্য আনার চেষ্টাও লক্ষণীয়। নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েন না করার বিষয়টি সুচিন্তিত ও কৌশলগত বলেও অনেকের ধারণা, তাঁরা মনে করেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাকে দূরে রাখা হতে পারে।

অন্যদিকে কারও কাছেই এমন কোনো জাদুমন্ত্র নেই, যেখানে দুই নেত্রী মতৈক্যের ভিত্তিতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানোর কোনো ‘স্বয়ংক্রিয়’ ফর্মুলা উদ্ভাবন করতে পারেন। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির বদলে সংবিধানে যাঁকেই পদাধিকারবলে বসানোর বিধান করবে, তাঁকে ঘিরেই মেরুকরণ চলবে বলে শঙ্কা থাকবে। সুতরাং দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, শীর্ষ নেতৃত্বের স্বাভাবিক পরিবর্তন (বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান চিহ্নিত করেছেন যে ব্রিটেনে লেবার দলে গত তিন দশকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা এলেও বাংলাদেশে দুজন থেকেছেন), সুশাসন, সাংবিধানিক সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কৃতির সামন্ততান্ত্রিকতার প্রতি চোখ বন্ধ রেখে বা এ ধরনের বিষয়কে দূরে ঠেলে রেখে বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে একটি ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ স্বপ্ন দেখা অন্তর্গতভাবেই একটা ঝামেলাপূর্ণ বিষয়। আসলে ওই ধরনের সীমাবদ্ধতা বা বিকলাঙ্গ অবস্থা সব পরিস্থিতিতে অবশ্যই বজায় রাখা সাপেক্ষে শুধু পাঁচ বছর অন্তর একটি নির্ভেজাল শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করা সোনার পাথরবাটির মতোই একটি কল্পনাবিলাস। বর্তমানে সরকারি দলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব বা বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে আসার সঙ্গে সুশাসনবিরোধী ওই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার যোগসূত্র অবশ্যম্ভাবী। এবার যদি কোনোমতে সংবিধানের কাঠামোর বিচ্যুতি বা ওয়ান-ইলেভেনের মতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সামনের সাধারণ নির্বাচনটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়, আর তাতে বর্তমান বিরোধী দল সরকার গড়তে পারে, তাহলে আজকের আওয়ামী লীগকেই ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহাল তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবতীর্ণ হতে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রস্তুত ও তার অনুশীলন চিন্তা করার সামর্থ্য অর্জন করা থেকে এখনো অনেক দূরে।

ঘ. বিচারপতিদের জড়ানো

বিচারপতিদের রাজনীতিতে টেনে আনা একটি সামরিক ও অনুন্নত দেশের সংস্কৃতিজাত চিন্তা। একটা পাকিস্তানি ভূত। কী পরিহাস দেখুন, বিতর্কিত সিইসি এম এ আজিজের মামলায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের ইসি-প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা অসাংবিধানিক বলে ঘোষিত হয়েছে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সেই রায় আওয়ামী লীগাররা সন্তুষ্টচিত্তে সমর্থন করেছেন। কিন্তু যখন ইসি পুনর্গঠনে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রশ্ন এল, তখন হুট করে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের দুই কর্মরত বিচারককে যুক্ত করলেন। তাঁরা প্রমাণ করলেন, এ দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই সবচেয়ে অপাঙেক্তয় ও অনুপযুক্ত। সবগুলো নির্দিষ্ট সাংবিধানিক ও আধাসাংবিধানিক পদে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক, বেসামরিক ও বিচার বিভাগীয় আমলাদের কদরই সর্বাধিক। নেতারাই প্রমাণ রাখছেন, কোনো দলে টানা কয়েক দশক যুক্ত থাকলে সেই ব্যক্তি প্রশাসনিক বা অন্যবিধ দায়িত্বশীল কাজের জন্য (অন্তত আমলার চেয়ে) উপযুক্ত বলে গণ্য হন না। দলের পরিচালিত পদ্ধতিগত এই বিরাজনৈতিকীকরণের বিপদ এই সমাজে সবচেয়ে কম অনুচ্চারিত সত্য।

যেসব সমাজে সামরিক শাসন বাসা বেঁধেছে, সেখানে বিচারপতি নিয়ে টানাটানি বেশি। হোসে লিং হারেজ ছিলেন ব্রাজিলের প্রধান বিচারপতি। ১৯৪৫ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ব্রাজিলের অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিচারপতি সাত্তারকে যেভাবে এরশাদ উত্খাত করেছিলেন, সেভাবে হাইতির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বারট্রান্ড এরিস্টিডকে উত্খাত করেছিলেন তাঁরই মনোনীত সেনাপ্রধান জেনারেল রাউল সেড্রাস। বাংলাদেশের মতো হাইতির সংবিধানেও বিচারপতিদের ত্রাতা করা আছে। বিচারপতি এমিল ১৯৯৪ সালে পাঁচ মাস অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে হাইতিতে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ ঘটে। বাংলাদেশের সেনা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তখন টেলিফোনে কথা বলেছিলেন তত্কালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, যিনি বাংলাদেশের দুই নেত্রীর বিরোধ সামাল দিতে ২০০৬ সালে ঢাকায় এসেছিলেন, তিনিও দূতিয়ালি করতে গিয়েছিলেন হাইতিতে। এই হাইতির চেয়ে বাংলাদেশকে অধঃপতিত মনে হতে পারে। কারণ, হাইতির সংবিধানে একাদিক্রমে দুবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আছে। বাংলাদেশের দুজন ব্যক্তি মাত্র একটি মেয়াদের জন্যও না দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব, না নির্বাচন করার প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার কথা ভাবতে পারেন। সমাজও ভাবতে পারে না। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালের পরাজয়ের পর নাটকীয়ভাবে পদত্যাগ ও তা প্রত্যাহার এবং আরও পরে ৫৭ বছর বয়সে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তা কার্যকর হয়নি। এরিস্টিড কিন্তু প্রমাণ করেছেন, রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিয়ে দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন না করেও পুনরায় রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব।

সামরিক শাসনে এককালের বিধ্বস্ত উত্তর আমেরিকাতেও প্রধান বিচারপতিকে রাজনৈতিক সংকটকালে টেনে আনার উদাহরণ আছে। এডোয়ার্ডো রড্রিগেজ ভেলচ (Eduardo Rodriguez Velteze) ছিলেন বলিভিয়ার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। ২০০৫ সালের কয়েক সপ্তাহের টানা গণ-অসন্তোষের নেতৃত্বে ছিলেন ইভা মোরালেস। বলিভিয়ার তত্কালীন রাষ্ট্রপতি কার্লোস মেসা পদত্যাগ করেছিলেন। তখনকার বলিভিয়ার অবস্থাটি বাংলাদেশের ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের সঙ্গে তুলনীয়। কারণ, বলিভিয়ার সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পর দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ ছিল যথাক্রমে সিনেট এবং চেম্বার অব ডেপুটিজের প্রেসিডেন্টের। মোরালেসের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভকারীদের চাপে মওদুদের মতো তাঁরা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানান। এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০০৫ সালের ১০ জুন প্রধান বিচারপতি রড্রিগেজ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। পরের জানুয়ারিতে তিনি নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মোরালেসের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে সরে দাঁড়ান।

উন্নত গণতন্ত্রে রাজনীতিতে বিচারপতিদের আনা হয় না। রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতিকে এমনভাবে রাখা হয়, যাতে বিপদে কাজে লাগানো যায়। সাংবিধানিক ও সামাজিক প্রস্তুতি এমনভাবে রাখা হয়, যাতে সংকটে তথাকথিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ লোক খুঁজতে প্রধান বিচারপতিদের টেনে আনতে না হয়।

ফরাসি সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের মৃত্যু কিংবা পদত্যাগে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সিনেটের প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখানেও কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছায়া স্পষ্ট।

ত্রয়োদশ সংশোধনীতে একজন প্রধান বিচারপতিকে সম্পৃক্ত করায় বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কথায়, সুপ্রিম কোর্টে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল (এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা আগে করা হয়েছে)। পুরো আপিল বিভাগকে মন্ত্রিসভা করা হলে কে জানে সেটা হয়তো এত দিনে সুনামিতে রূপ নিত।

তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার মধ্যেও আমরা দেখেছি, ব্যক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন সেটা সুষ্ঠু নির্বাচন ও সব দলের মতৈক্যের জন্য অতি জরুরি সমস্যা। ত্রয়োদশ সংশোধনীর বেলায় অনেক জল ঘোলা করে শেষমেশ প্রধান বিচারপতিকে টেনে আনা হয়েছিল। কিন্তু তার ফল শুভ হয়নি। পাঁচ বছর ধরে সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র এমনকি নির্দিষ্ট করে বিচার বিভাগ পর্যন্ত ছকমাফিক সাজানোর কলুষিত রাজনীতি প্রধান বিচারপতির নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এর ফলে সংকটকালে প্রধান বিচারপতিকে ডেকে এনে ক্রান্তিকাল উতরানোর চিন্তাভাবনা একপ্রকার বিদায় নিয়েছে। অন্যদিকে, স্যার নিনিয়ানের ফর্মুলা মেনে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদে অধিষ্ঠিত রাখার চিন্তাটাও বাস্তবসম্মত নয়। তেমনটা করা হলে বড় ধরনের সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কাজেই প্রধান বিচারপতিকে অন্তর্ভুক্ত করার ভেতর দিয়ে যে আস্থার সংকটের সূচনা হয়েছিল, সেটা গত কয়েক মেয়াদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে আরও ঘনীভূত হয়েছে।

ঙ. সামরিক শাসনের আশঙ্কা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার

ক্যু কথাটি সামরিক নয়, একটি রাজনৈতিক পরিভাষা। সামরিক শাসনের যেসব ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব রয়েছে তার অন্যতম হলো, সেনাশাসন টিকিয়ে রাখতে হলে রাজনৈতিক মদদ অপরিহার্য। বাংলাদেশের ইতিহাসও সেই সাক্ষ্য দেয়। সামরিক ইতিহাসবেত্তা এডওয়ার্ড লুত্তক তাঁর ক্যুদেতা: এ প্রাকটিক্যাল হ্যান্ডবুক বইয়ে বলেন, ‘একটি ক্যুদেতার সঙ্গে রাষ্ট্রের যাবতীয় শক্তির একটি ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশের সন্নিবেশ ঘটে।’ অনলাইন উইকিপিডিয়া বলেছে, এর অর্থ হলো সশস্ত্র বাহিনী (সামরিক বা আধাসামরিক) কোনো ক্যুদেতার একক বৈশিষ্ট্য নয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট অভ্যুত্থানের পর ক্যু নায়কেরা ক্ষমতা ভোগ করতে পারেনি। কিন্তু ওত পেতে থাকা রাজনৈতিক কুশলীবেরা ছিলেন প্রস্তুত। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকেরা দ্রুত জোট বাঁধেন, যার ধারাবাহিকতায় সেনাছাউনিতে রাতের অন্ধকারে জন্ম নেয় বিএনপি। কিন্তু মূল ক্যুদেতার একটা রাজনৈতিক খোলস অতি ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন হলেও তা আওয়ামী লীগের বলেই দৃশ্যমান ছিল সে সময়ে।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগের মুখপত্র বাংলার বাণীতে বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছিল। যে আওয়ামী লীগ ২৩ বছর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করেছে, তার পক্ষে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র আট বছরের কম সময়ের ব্যবধানে জেনারেলদের শাসনের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে বাধেনি। ১৯৯৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেপথ্যেও রাজনৈতিক মহলের মদদ ছিল না, সেটা কেউ হয়তো হলফ করে বলবেন না। ২০০৭ সালে সৈয়দ আবুল মকসুদ বর্ণিত ‘তিনোদ্দিনের’ অভিষেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার উজ্জ্বল উপস্থিতি এক-এগারোর সামরিক-বেসামরিক কুশীলবদের শক্তি জুগিয়েছিল। বিরাট নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছিল, আর প্রধানমন্ত্রিত্বের মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকার মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখনই। উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া গোপন নথিগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে দুই প্রধান দলের শীর্ষ নেতৃত্ব পরস্পরের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চেয়ে সামরিক বাহিনীকেই অভিন্ন বিকল্প মনে করে থাকেন।

আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের পক্ষে এক-এগারোর পুনরাবৃত্তি রোধের একটি যুক্তি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে জরুরি অবস্থায় জেল খাটার স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সংবিধানবহির্ভূত শক্তির বাড়বাড়ন্ত বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই পাকিস্তানের দিকে তাকাতে হবে। কাকতালীয়ভাবে হোক বা না হোক, বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। ভুট্টো ১৯৭৩ সালে ক্ষমতা জবরদখলকে ‘হাইট্রিজন’ (চরম বিশ্বাসঘাতকতা) হিসেবে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য শাস্তি ঘোষণাদানের অব্যবহিত পরেই জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়ার শাসনকে অবৈধ বলে ঘোষিত আসমা জিলানির (এখন যিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি আসমা জাহাঙ্গীর) নন্দিত রায়টি মুখ থুবড়ে পড়ল। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রসিকতা করেছিলেন এই বলে যে আসমা জিলানি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ‘অবৈধ’ বলেছিলেন এমন সময়ে, যখন ইয়াহিয়া ক্ষমতায় ছিলেন না। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলগুলো যত দিন চেয়েছে ঠিক তত দিন পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী আরাম-আয়েশে টিকে ছিল। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়া হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে ‘পাকিস্তান’ কথাটি কয়েক ডজন বার উল্লিখিত হয়েছে।

মাও সে তুং-এর একটি উক্তি হচ্ছে, পলিটিকস মাস্ট বি ইন কমান্ড। এই রাজনৈতিক শূন্যতা যখন সৃষ্টি হয়, তখন ক্ষমতা আপনাআপনি প্রধানত বন্দুকওয়ালাদের কাছেই চলে যায়। সে কারণেই হয়তো নির্বাচিত নেতৃত্বকে অপসারিত করার মতো বিধান বিশ্বের ‘আত্মমর্যাদাশালী জাতিগুলো’ গ্রহণ করেনি।

শেষকথা

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানসর্বস্ব কোনো বিষয় নয়। এর সঙ্গে পুরো সাংবিধানিক কাঠামো এবং তার আওতায় সুশাসন দিতে না পারার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতার প্রশ্নও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার কর্তৃক ভারতের সংবিধানের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়ে ওপরে আলোচিত সংশোধনীটি আনার পেছনে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ের প্রভাবও ছিল। কারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কেবল অরফ ধহফ ধফারপব কথাটি দিয়ে মন্ত্রিসভার যেকোনো সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির পক্ষে ষোলআনা অপরিহার্য বলে মত দিতে একমত কিংবা যথেষ্ট বলে গণ্য করেননি। কিন্তু বাংলাদেশে এটাই অপ্রিয় সত্য যে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের শীর্ষ নেতারা এখনো পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে শুধু এক দিনের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সমস্যা হিসেবে দেখতে সচেষ্ট।

আমাদের নাগরিক সমাজ এখনো দুই দলের একই শীর্ষ পদে প্রায় তিন দশক থাকার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না তুলে বিরোধী দলকে আরেকটি ব্লাঙ্ক চেক লিখে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো অঙ্গীকার আদায়েরও কোনো তোড়জোড় নেই। সংবিধান সংস্কার নামের কোনো শব্দ বর্তমান সরকারি ও বিরোধী দল এবং তাদের মিত্রদের অভিধানে নেই। অবশ্য তারা অঙ্গীকার করলেও হয়তো রক্ষা করতে পারবে না। কারণ, তারা এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না বা নিতে অপারগ থাকবে, যাতে দল ও শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববলয় কোনোভাবে বিনষ্ট বা ম্লান হয়। সে কারণে বিদগ্ধ নাগরিক সমাজ যখন বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে কথা বলার সুযোগ পান, তখন তাঁরা ‘কবরস্থানে ফাতেহা পাঠের’ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতির জন্য দুই মেয়াদের বেশি নির্বাচিত হওয়ার বিধান সংবিধানে কেন নিষিদ্ধ থাকে, আর সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রীর বেলায় তা কেন প্রযোজ্য হয় না, তা নিয়ে একটা নিষ্ফল প্রশ্ন তুলতেও ভুলে যান।

শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা ও তাঁর দলের ওয়ান-ইলেভেনজাত সংস্কারপন্থীদের যে গতি হয়েছে, তার চেয়ে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দলের সমর্থক সংস্কারপন্থীদের অবস্থা আরও খারাপ করতে পারেন। প্রায় ওয়ান-ইলেভেনের মতো আরেকটি প্রেক্ষাপটও দুই প্রধান দলের এই স্থিতাবস্থা বা অচলায়তন ভেঙে দেবে বলে আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই এ মুহূর্তে। প্রয়োজনে তথাকথিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের পুরোভাগে তাঁরাই থাকবেন। সুতরাং বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আন্দোলনের সঙ্গে সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়ার একটা হুমকি পিছু ছাড়ছে না।

আমাদের অনেক বরেণ্য চিন্তাবিদ সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রীর অস্তিত্ব যে গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি, সেটা (তাঁরা) ঘরোয়া আলোচনাতেও সতর্কতার সঙ্গে উল্লেখ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা এই বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে জনতার সামনে আলোচনা করতে চান না। কারণ, এটা তাঁরা বাস্তবে অপ্রীতিকর এবং অর্জন-অযোগ্য বিষয় বলেই মনে করেন। নাগরিক সমাজের পলায়নপরায়ণতা ও রাজনীতিকদের অন্ধ আনুগত্য কিংবা দ্রোহী হতে শঙ্কিত থাকার পটভূমিতে বাংলাদেশে যে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের চাষাবাদ ঘটে, সেটারই অনিবার্য পরিণতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ওঠা। যে দাবির মূল কথা হলো দলীয় প্রধানমন্ত্রীকে উত্খাত করা, তাঁকে জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করা। সহজ কথায়, অনির্দিষ্টকাল ধরে দুই নেত্রীর দুই দলের নেতৃত্ব ধরে রাখা এবং তাঁদেরই ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী/বিরোধী দলের নেতার পদে বহাল রাখার কারণে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। এই অবস্থাটি শুধু কেন্দ্রে ঘটছে তা নয়, আশীর্বাদপুষ্টরা দেশের বহু বড় শহরে শীর্ষ নেতৃত্বের আসন ধরে রেখেছে। এর ফলে শহরগুলোতেও স্থানীয় সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টাতেও বিঘ্ন ঘটছে।

সুপ্রিম কোর্ট, সরকারি কর্মকমিশন, নির্বাচন কমিশন—সর্বত্র আমরা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক নিয়োগ দেখতে পাই। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য সুচারুরূপে সম্পন্নের প্রয়োজনে নির্দলীয় সরকারের মতো কোনো দাবি ওঠে না। ওঠে শুধু নির্বাচন কমিশনের একটি দিনের কাজ তদারকির জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। কারণ একটাই, এর সঙ্গে ক্ষমতার পালাবদলের, মসনদের রাজনীতি জড়িত। তবে অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে নির্দলীয় সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন কতটা প্রবল ও সর্বব্যাপী হতে পারে, সেটা আমরা ওয়ান-ইলেভেনের প্রথম প্রহরে দেখেছি। কিন্তু সেটা যদিও আশা নয়, প্রহেলিকা। জনগণের মনের গহিনে, তাদের কল্পনার রাজ্যে সতত সুশাসনদাতা কোনো দরদি সরকারের আকাঙ্ক্ষা খেলা করে, ভর করে। সুতরাং বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনরুজ্জীবনকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে বাংলাদেশের দ্বিনেতাভিত্তিক শাসনসংকট থেকে উত্তরণের পথ আমরা কখনো খুঁজে পাব না। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বড়জোর একটা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু অবশ্যই তা সুশাসনের গ্যারান্টি দেবে না।

বাংলাদেশের দুই বড় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নিয়মিত বদল সম্ভব কি সম্ভব নয়, তার সঙ্গে ভবিষ্যত্ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র কী হবে, তা অনেকটা নির্ভর করে। তবে ধরে নিতে হবে যে দুই ব্যক্তি কিংবা তাঁদের উত্তরসূরিরাই দুই দলের ‘মূলধারা’র নেতৃত্ব দেবেন। আর সে ক্ষেত্রে বাদবাকি বিশ্বের দৃষ্টান্ত বা কনভেনশন তেমন কাজ দেবে না। প্রধান বিচারপতি বা যেকোনো পদাধিকারবলে প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ বিধান অকার্যকর কিংবা উত্তেজনাকর হবে বলেই ধরে নিতে হবে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের একটি জিন্দা লাশ দাফন করেছে। এটি বাঁচিয়ে তোলা হলেও সংকট ঘুচবে না। কে এবং কীভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা বাছাই করতে একটি একান্ত বাংলাদেশি ফর্মুলা উদ্ভাবন করতে হবে। বারবার ব্যক্তির খেয়ালের বশে সাংবিধানিক বিচ্যুতির ঘটনা চলমান থাকলে, তা হয়তো বাংলাদেশকে আরও দীর্ঘ সময় অকার্যকর রাষ্ট্রের তালিকাতেই রেখে দেবে। ২০১১ সালের দি ইকোনমিস্ট-এর আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশকে স্বৈরশাসন ও গণতন্ত্রের মিশেলে এক হাইব্রিড বা সংকর গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সূচক অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায় নির্বাচিত সরকারের আমলগুলোতেই বাংলাদেশে শাসনগত এক ধাপ অবনতি ঘটেছে। মার্কিন ফরেন পলিসির সূচকেও বাংলাদেশ রয়ে গেছে এক ডিজফাংশনাল বা অকার্যকর রাষ্ট্র।

 তথ্যসূত্র ও টীকা

১. এই ছায়া বাহাত্তরের সংবিধানেও ছিল। দ্বাদশ সংশোধনী পাসের পর বাংলাদেশ সংবিধানেও অনুরূপ একটি ছায়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্পষ্ট অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, যেটি ত্রয়োদশ সংশোধনীতে লুপ্ত হয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীতে আবার ফিরে এসেছে। [সংবিধানের ৫৭(৩) ও ৫৮(৪) দ্রষ্টব্য]

২. ১৫তম সংশোধন-পরবর্তী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ শেষে পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তখন যেকোনো সাংসদকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন। এটা সংবিধানসম্মত হলেও এটা বাস্তবসম্মত হয়তো হবে না। এর মূল বাধা আমাদের সংস্কৃতি ও স্বভাবে নিহিত, যা আলোচ্য দুই নেত্রীর বিশাল প্রভাবে বিপন্নভাবে বিকশিত ও বাধাগ্রস্ত হয়ে চলেছে।

৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘিরে এটি একটি বড় আশঙ্কা। কারণ, এই সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয় না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের লতিফুর রহমানের অধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সেই সময় আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রয়োজনে বাংলাদেশের জল, স্থল ও আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

৪. বাংলাদেশে এতটুকুতে চলে না। কারণ, ক্ষমতাসীন দল সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র পুরো পাঁচ বছর ধরে নির্বাচনকে লক্ষ রেখে সাজিয়ে থাকে। ফেডারেল কাঠামোতে তা এমন মাত্রায় সহজ বা সম্ভব নয়।

৫. বিস্তারিত দেখুন, এম ভি পিলে, দি কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট: হোয়াট অ্যান্ড হোয়াই ইন পলিটিক্স ইন্ডিয়া, নিউ দিল্লি, এপ্রিল ১৯৯৮, পৃ. ১৯

৬. এ রকম পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার অবশ্য ঝুঁকি আছে। সাধারণত এ জাতীয় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতেই ডকট্রিন অব নেসেসিটি কথাটা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর অপব্যবহারটাও আকসার দেখতে পাই আমরা। বিশেষত এই যুক্তিটি সামরিক শাসকদের বেশ প্রিয়।

৭.  তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার এখনকার জনপ্রিয়তার মূলেও কিন্তু এই একই কার্যকারণ। জাতীয় ও দলীয় সংবিধানে ব্যক্তির হাতে সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রত্যাশা অসম্ভব। কাজেই ক্ষমতাসীন সরকার ও বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে যেতে সব দলের মধ্যেই বরাবরের মতো ভয়টা থেকে গেছে।

৮. বিস্তারিত দেখুন, কমেন্ট্রি অন দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, ভলিউম ই, ১৯৮১, পৃ. ৪১১-১৪

৯. এইচ এম সিরভাই, কনস্টিটিউশনাল ল অব ইন্ডিয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, ভলিউম-৩, প্যারাগ্রাফ ৩৩(সি) ৪০।

১০. পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার ‘ভবিষ্যসাপেক্ষ’ বিলোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনেও কাজ করেছে এই একই যুক্তি: অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দেওয়া সংগত নয়।

১১. কিন্তু ব্যক্তির ওপর এই অকুণ্ঠ নির্ভরতা সব সময় যৌক্তিক নাও হতে পারে। ব্যক্তির সাফল্য ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধ-জয়ী ইন্দিরা উইনস্টন চার্চিলকে পেছনে ফেলেছিলেন। সব বড় দল নিয়ে চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৮ মে ১৯৪৫ যুদ্ধ শেষ হয়। ২৩ মে কোয়ালিশন সরকার ভেঙে যায়। ৫ জুলাই অনুষ্ঠেয় নির্বাচন সামনে রেখে রানি চার্চিলের নেতৃত্বেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডেভিড লয়েডের নিরলস জয়ের পুনরাবৃত্তি আশা করেছিলেন ওয়্যার হিরো চার্চিল। কিন্তু তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। এর কারণ সম্পর্কে বিবিসিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ড. পল এডিসনের ভাষ্য হচ্ছে, জনমত জরিপে চার্চিলের জয়ের সম্ভাবনা কখনো ৭৮ শতাংশের নিচে নামেনি। পুরো মিডিয়ার পূর্বাভাসও ছিল তেমনই। ব্যক্তিগতভাবে জাতিকে যে অর্জন তিনি এনে দিয়েছিলেন, তা আজও অতুলনীয়। কিন্তু চার্চিল দলকে ইতিহাসের অন্যতম শোচনীয় পরাজয়ের স্বাদ দেন। এর ৩০ বছর পর ড. রডনি ব্রাজিল তাঁর কনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস বইতে লিখেছেন: ‘সরকারপদ্ধতি, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীদের পদত্যাগ এবং সংসদের বিলুপ্তির কারণে উদ্ভূত বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে থাকে। একজন প্রধানমন্ত্রী, যাঁর কর্তৃত্ব সংসদের বিলোপে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাঁর পক্ষে সরকারের রুটিন বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়াই অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এবং এও সত্য যে যদিও আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঠিক সেভাবে স্বীকৃতি দিতে পারি না কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো ব্রিটেনে ভালোভাবেই দায়িত্ব পালন করছে।’

১২. বিস্তারিত দেখুন: Constitutional law of 2 EU member states: Bulgaria and Romania, 2007. By Evgeni Tanchev, Martin Belov, Cristian Ionescu, C. A. J. M. Kortmann, J. W. A. Fleuren,p-1-75