প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বক্তৃতা চল্লিশ বছর ধরে: স্মৃতি ও ন্যায়বিচার

[বাংলাদেশের সঙ্গে ইয়ান মার্টিনের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। ১৯৭০ সালের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) এসেছিলেন। আর ১৯৭১ সালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হচ্ছে, তিনি তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের হয়ে কাজ করছেন ঢাকায়। ২৫ মার্চের কালরাত্রে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের গুলশান অফিসের ছাদে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে দেখেছেন পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ, কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ঢাকার নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন সেই বিভীষিকা। কিছুদিনের মধ্যেই চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে ঢাকা ছাড়তে হয়। এরপর গণহত্যার তদন্ত করতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই আবার ফিরতে চেয়েছিলেন এ দেশে, কিন্তু অনুমতি পাননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরের মাসেই, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, আবার ঢাকায় আসেন তিনি।

পেশাগত জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। একসময় ছিলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব। জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১১ সালের ২২ মার্চ তিনি ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। এখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও কথাবার্তা বলেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্তি ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে দেওয়া তাঁর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে তাঁর ভাষণের অনুলিখন প্রকাশিত হলো এখানে।]

এখানে আসার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। বিশেষত, কৃতজ্ঞ এ কারণে যে, এখানকার সবচেয়ে মহতীপূর্ণ ঘটনাবলির সাক্ষী হওয়ার ঠিক ৪০ বছর পর এ উপলক্ষ আমাকে আবার ঢাকায় নিয়ে এসেছে। একাত্তরের ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনের সামনে সমবেত মানুষের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন আমি তাঁর বাসার আঙিনায়। সেদিন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তান দিবসের নাম পাল্টে রেখেছিলেন প্রতিরোধ দিবস। সেই ২৫ মার্চে আমি সর্বশেষ যে মানুষটার সঙ্গে দেখা করতে যাই, তিনি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল। সেই সাক্ষাত্ ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারে। সেই সন্ধ্যায় গাড়ি চালিয়ে আমাদের থাকার জায়গা সেদিনের ছোট্ট শহর গুলশানে ফিরে আসতে আমার ও আমার সহকর্মীদের শেষ চেষ্টা বাধার মুখে পড়েছিল স্থানীয় মানুষের সড়ক অবরোধ করার কারণে। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়েছেন, আলোচনা ভেস্তে গেছে—এই খবরের প্রতিক্রিয়ায় এই অবরোধ। গাড়ি চালিয়ে গুলশানের দিকে যাওয়ার সময় আমরা দেখলাম, সেনানিবাস থেকে পাকিস্তাান সেনাবাহিনীর ট্যাংক বেরিয়ে আসছে। সেই রাতে আমরা গেস্ট হাউসের ছাদে উঠে অসহায় আতঙ্কে শুনছিলাম স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি আর বিস্ফোরণের আওয়াজ। আক্রমণের সাক্ষ্য বহন করছিল আকাশ। আমরা বুঝতে পারছিলাম, এই আক্রমণের লক্ষ্যস্থল বিশ্ববিদ্যালয় আর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ লাইনস। আমাদের কাছাকাছি এলাকায় এক নির্বাচিত আওয়ামী লীগারকে গ্রেপ্তার করতে পাঠানো সেনারা যখন তাঁর ঘরে তল্লাশি চালিয়ে পেল না, তখন বাসার এক কর্মচারীকে বিনা কারণে হত্যা করল। কাছেই এক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বুদ্ধিজীবীকে। সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়ার পরপরই আমরা আবার গাড়ি নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরতে বের হই। সেটাই আমাদের শেষ ঘুরতে বের হওয়া। সেদিন ছিল ২৫ মার্চ। আগে বহুবার রেসকোর্সের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়েছি মাঝখানের কালীমন্দিরের দিকে। এবার দেখলাম, সেটা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা জানলাম, কী ধরনের হামলা চালানো হয়েছে: হামলার লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের কেন্দ্র ইকবাল হল শুধু নয়, বরং সুচিন্তিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে হিন্দু শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের ওপরও। শহরের অন্যান্য জায়গায়ও একইভাবে হিন্দুদের ওপর হামলা চলেছে। দীর্ঘ নয় মাস পর ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আমি জানতে পারলাম, ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ঢাকার কাছে চলে আসার সময় যেসব বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়, তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরীও ছিলেন।

বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বহুবিস্তৃত কিংবা সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হামলার অংশ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞায়নের এক উপাদান। এটা গণহত্যার সংজ্ঞায়নেরও এক উপাদান। কেননা, তাতে একটা জনগোষ্ঠী, জাতি, বর্ণ ও ধর্মগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য ছিল। আমি বিশ্বাস করি, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের অভিযান শুরুর একেবারে শুরু থেকেই এসব উপাদান বিরাজমান ছিল। প্রথম যাঁরা ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকায় মার্কিন কনসুলেটের কর্মকর্তারা: একাত্তরের ৬ আগস্ট ভিন্ন মত জানিয়ে প্রশংসনীয় এক পত্রে কনসাল আর্চার ব্লাড এটা লেখেন। পরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞরা সেই পথ অনুসরণ করেন। আমি তাঁদেরই দলে, যাঁরা বিশ্বাস করেন ‘গণহত্যা’ শব্দটিকে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষা পর্যন্ত টেনে নেওয়া ঠিক নয়। আর জেনোসাইড কনভেনশন থেকে সুস্পষ্টভাবে সেটাই বাদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য যদিও এসব আদালতের ব্যাপার, তবু আমি মনে করি, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস ১৯৭২ সালের প্রতিবেদনে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা শুধু যে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে তা-ই নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ঘটনা ঘটানোরও জোরালো নজির আছে বলে যে উপসংহার টেনেছিল, তা যথাযথ।

একাত্তরের মার্চে ঢাকায় থাকার দিনগুলো নিয়ে আমার নোট পাকিস্তানি নিরাপত্তাকর্মীরা নিয়ে যায় ইসলামাবাদের ফিরতি বিমানে চড়ার আগমুহূর্তে। পরের কয়েক মাসে মাত্র একবারই আমি ঢাকায় যেতে পেরেছিলাম। আরেকবার গিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং মুজিবনগরে বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে। তবু ছোট্ট একটা ভূমিকা পালন করি। মার্কিন ও ব্রিটিশ দূতাবাসের অভ্যন্তরে যখন তাদের সরকারি নীতির প্রশ্নে তীব্র বিতর্ক দেখা দিতে লাগল, তখন বিদেশি ও বাঙালি সূত্র থেকে আসা তথ্য কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে চালান করি। সেই গ্রীষ্মে লন্ডনে ব্রিটিশ সাংসদদের কাছে ধরনা দিই এবং নিউ স্টেটসম্যান ম্যাগাজিনে একটা নিবন্ধ প্রকাশ করি, লেখক পরিচয় আড়াল করে ‘একজন পাকিস্তান প্রতিনিধি’ হিসেবে। আমার নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ড ফাউন্ডেশন দ্রুতই উপসংহার টানে যে, পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যত্ প্রয়োজনের কথা ভেবে নিজস্ব কৃষি গবেষণা প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং যেসব বাঙালি পণ্ডিত শরণার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের মার্কিন ও ব্রিটিশ শিক্ষায়তনিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা ও সমর্থন পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। আমার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল। তখন আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তদন্ত কমিশনের সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করি। এই তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস (আইসিজে)। পাকিস্তান সরকার কমিশনকে ঢুকতে দেয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতে গিয়ে শরণার্থীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করব। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধের ঘোষণা আসার সময়টাতে আমি ছিলাম নিউইয়র্কে; তদন্ত কমিশনের জন্য তহবিল উত্তোলনে সহায়তা করছিলাম। আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাটকীয় বক্তৃতা চাক্ষুষ করতে আমি হাজির ছিলাম জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের গণগ্যালারিতে। ভাবিনি, কয়েক দশক পর এই একই কক্ষে আমি নিরাপত্তা পরিষদের সামনে পূর্ব তিমুর ও নেপালের ঘটনাবলির সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরব। আইসিজের তদন্ত যে গতিতে চলছিল, ঘটনা ঘটছিল তার চেয়ে দ্রুতগতিতে। আইনি বিশেষণের দায়িত্ব আমি অন্যদের ওপর ন্যস্ত করলাম। তাদের সেই বিশেষণ পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়। সেটার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ফোর্ড ফাউন্ডেশন আমাকে ঢাকা সফর করতে বলেছিল প্রতিষ্ঠানটির এই দেশের কর্মীদের ও প্রকল্পগুলোর ভাগ্যে কী ঘটল, তা দেখার জন্য। আমার আগ্রহ সেটাই ছিল সবচেয়ে বেশি—বাঙালি বন্ধুদের কী অবস্থা তা জানার জন্য। দুই মাস পর একজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর সফরসঙ্গী হয়ে এসেছিলাম; ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সহায়তা পুনরায় চালু করাকে স্বাগত করার ব্যাপারে। সেবার আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর ১৯৭২ সালের বেশির ভাগ সময় আমার কাটে স্বাধীন বাংলাদেশে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অফিসগুলো চালু করে নতুন কাজ শুরুর জন্য প্রস্তুত করে তোলায়। সরকারের মনোযোগ তখন মানবিক ও পুনর্গঠনের বিপুল কাজের পরিধি ছাপিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের দিকে।

আমার কর্তব্য ছিল অতি সামান্য। শিরোনামে যে ‘স্মৃতি’ শব্দ ব্যবহার করলাম, আমার নিজের প্রসঙ্গে বলার উদ্দেশ্যে নয়। এটা আমাদের সবার জন্যও ভালো। কেননা, ১৯৭১ সালে সাহসী সাংবাদিকেরা বিশ্বের কাছে যেসব সাক্ষ্য তুলে ধরেছেন আর যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এবং তাঁদের পরিবারের কাজ থেকে যে রেকর্ড পাওয়া গেছে, যার অনেকটাই এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে, সে তুলনায় আমার সেই সময়কার স্মৃতির তাত্পর্য নেই বললেই চলে অথবা থাকলেও অতি সামান্য। কিন্তু আজ এখানে সমবেতদের কয়েক দশকের হতাশায় আমিও কেন অংশীদার, তা স্পষ্ট করবে আমার সেই স্মৃতি। হতাশা এ জন্য যে, বাংলাদেশের বাইরের দুনিয়া একাত্তরে সংঘটিত অপরাধ বিচারের বিষয়টি এতই কম আমলে নিয়েছে অথবা সক্রিয় বিরোধিতা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সরকার যখন আন্তর্জাতিক চাপে পড়ল, তখন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হলো। আর বিচারব্যবস্থার তখন যে হাল, তাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাজার হাজার অভিযুক্ত সহযোগীর বিচার করার জো ছিল না। অভিযুক্ত সহযোগীদের বিনা বিচারে অব্যাহতভাবে আটকে রাখায় সমালোচনার মুখে পড়ল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে (পরে আমি এই সংস্থায় যোগ দিয়েছিলাম)। আর শিগগির মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন ঘটনা মোকাবিলার প্রশ্ন সামনে এল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় সরকারের সমালোচক বিপুলসংখ্যক বামপন্থীকে বিনা বিচারে আটক করে রাখার বিষয়ে। আজও সেই বিশেষ ক্ষমতা আইন বলবত্ আছে। তারপর জরুরি অবস্থাকালেও একই দশা। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর মেজর জেনারেল ও তত্কালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অধীনে সামরিক আইন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিতে পারতেন এবং অনেককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেনও। গোপন বিচার শেষে কর্নেল আবু তাহের এবং আরও শত শত ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ১৫ হাজার। এসব ফাঁসিকে যদি আইনসংগত হত্যাকাণ্ড বলি, তাহলে আইনের শাসনকে ছোট করা হয়। আজ হাইকোর্ট কর্নেল তাহেরের বিচার ও ফাঁসিকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করেছে। এতে আমি আনন্দিত। এ ধরনের আরও অনেক ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর। আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদের অধীনে সামরিক আইনের আরও সময় গেল। আবারও দেখা গেল সামরিক আদালত ও বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে গ্রেপ্তার করা বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক বন্দীকে বিনা বিচারে আটকে রাখা। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকার প্রশ্নে আরও উদ্বেগের জন্ম দিল।

সামরিক আইনের সময় লেবার পার্টির কর্মী হিসেবে আমি তখন অধিকার লঙ্ঘনের এসব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, অধিকার লঙ্ঘনের শিকার মানুষ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরতদের সঙ্গে সংহতির একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছিলাম। এই বিষয়টি তুলে ধরায় আমার সামর্থ্য আরও স্পষ্ট হয় ১৯৮৫ সালে আমি যখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হয়ে কাজ করতে যাই। কিছুদিন পর বাংলাদেশ সফর করা তখন আমার দাপ্তরিক দায়িত্বের অংশ। সে বছরের শেষ দিকে আমি আর আমাদের বাংলাদেশবিষয়ক গবেষণার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকর্মী সামরিক সরকারের অধীনে সেনা হেফাজতে রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নির্যাতনের বেদনাদায়ক সাক্ষ্য গ্রহণ করি। সেই দিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, যেদিন মারাত্মক নির্যাতনের শিকার ছাত্রদের আমরা যে বাড়িতে সাক্ষাত্কার গ্রহণ করছিলাম, সেখানে ডিজিএফআইয়ের (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স) কর্মকর্তারা ঢুকে পড়েছিল। নিশ্চিত করে বলতে পারব না, এতে কারা বেশি চমকে উঠেছিল—তাঁরা, না আমরা। তবে তাঁরা যে বিব্রত হয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। ১৯৮৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম মানবাধিকার মিশন নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম আমার নেতৃত্বে। এ ছাড়া তত্কালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও তাঁর সরকারের ব্যাপারে অ্যামনেস্টির অন্যান্য উদ্বেগের কথাও তুলে ধরেছিলাম।

অন্যান্য জায়গায় বহু ক্ষেত্রে মানবাধিকারগোষ্ঠী বর্তমানের অধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ যেমন করেছে, একই সঙ্গে তেমনি অতীত অপরাধের জন্য ন্যায়বিচারও দাবি করেছে। আসলে আমাদের মূল বিশ্বাস হলো অব্যাহত দায়মুক্তির, মানে আজকের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তি দুর্বল করা। তাই আমি ধাঁধায় পড়ে যাই, কেন মানবাধিকারগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বিষয়ে সম্পৃক্ততা এত কম। হয়তো এর আংশিক জবাব, আজ যেসব মানবাধিকার সংস্থা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করছে, সেগুলোর অল্প কয়েকটি মাত্র ১৯৭১ সালে কর্মকাণ্ড চালাত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও তখন খুব ছোট সংস্থা। সে বছরই কেবল তারা প্রথম দক্ষিণ এশিয়া গবেষক নিয়োগ দেয়। সংস্থাটির ম্যান্ডেট মূলত ছিল কারাবন্দীদের ঘিরে। আশির দশকের শুরুতেই কেবল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও জাতিসংস্থার মানবাধিকার ব্যবস্থা সরকার কর্তৃক আইনবহির্ভূত হত্যা কিংবা রাজনৈতিক হত্যার দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করে। এভাবে বেসরকারি মানবাধিকার ও রূপান্তরকালীন ন্যায়বিচার সংস্থাগুলোর জগত অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের প্রতিবাদ ও গবেষণার স্মৃতি নিজেদের মধ্যে সঞ্চিত রাখেনি; সাম্প্রতিক কালে তাদের তদারকের ক্ষেত্রগুলোতে তারা যেমনটা করে। কিন্তু আমি বিহ্বল হই, মানবাধিকারের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারসম্পন্ন সবচেয়ে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিটিকে বিংশ শতকের গণহত্যা ও গণবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের নাম করতে বলা হলে তারা পূর্ব বাংলা ১৯৭১ উল্লেখ করার কথা ভাবে না। গণহত্যা বিষয়ে ব্যাপক পঠিত সামপ্রতিক বই সামান্থা পাওয়ারের এ প্রবলেম ফ্রম হেল-এ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আছে মাত্র এক অনুচ্ছেদে, যদিও এমন নৃশংসতা ঠেকাতে মার্কিন সরকারের একের পর এক ব্যর্থতার মূলভাবের সঙ্গে সংগতি রেখে এর পূর্ণ বিশেষণের যথেষ্ট দাবি রাখে।

তাই সব কৃতিত্ব তাঁদের প্রাপ্য, যাঁরা একাত্তরের স্মৃতি সজীব রাখতে শ্রম দিয়েছেন। আজকের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা এবং যাঁরা তাঁদের এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। ২০০৮ সালের শেষে নির্বাচনের সময় ঢাকায় অবস্থানকালে আমি বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম একাত্তরের স্মৃতি কতটা এবং ন্যায়বিচারের দাবি কতটা জোরালোভাবে নির্বাচনে ইস্যু হয়ে উঠেছিল, তা অবলোকন করে। অনেক অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল; কারণ একাত্তরের ব্যক্তিগত স্মৃতি যাঁদের আছে, তাঁদের কাছে যেমন, তেমনি তরুণ প্রজন্মের কাছেও অনুরণন তৈরি করতে পেরেছিল। এমনকি নির্বাচনের এই লক্ষণীয় দিক এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে নির্বাচিত সরকারের অঙ্গীকারও বাংলাদেশের বাইরের দুনিয়াকে একাত্তরে কী ঘটেছিল, সেটা বিশেষ স্মরণ করাতে পারেনি। শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো লেখা প্রথম ছাপা হলো নিউইয়র্ক টাইমস-এ, কেবল এই মাসের শুরুতে। তবে এটাতে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু বানানো কিংবা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার উল্লেখ ছিল না।

সুতরাং আজ আমি প্রথম যে বার্তাটি দিতে চাই, তা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের উদ্দেশে। আমরা ক্রমবর্ধিতভাবে দাবি করি যে, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যায়বিচার হওয়া উচিত। সাবেক যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, পূর্ব তিমুর, সিয়েরা লিওন, কেম্বোডিয়ায় গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও বিচার এবং এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বারা তদন্ত ও বিচার সম্পাদনের জন্য প্রধান প্রধান সম্পদ নিয়োজিত করা হয়েছে। আইসিসির অনুপূরকতার নীতিতে প্রতিফলিত অনুমোদিত লক্ষ্য হলো, বিচার সম্পাদন করা হবে অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াবলির ভেতরে; কোনো রাষ্ট্র যেখানে এ ধরনের অপরাধ তদন্ত ও বিচার নিজে সম্পাদন করতে না চায়, কেবল সেখানে আন্তর্জাতিক বিচারের দিকে ধাবিত হবে। চর্চার জায়গায় আগামী বছরগুলোতে মাত্র অল্প কয়েকটা মামলার আইসিসিতে বিচার হবে। এবং আর কোনো এডহক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল হবে না। বিচার নির্ভর করবে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়াবলির ওপর। প্রায়ই দেখা যায়, জাতীয় সংকল্পের অস্তিত্ব নেই: নেপালে আমি কাজ করছিলাম জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। সেখানে মাওবাদীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের ১০ বছরব্যাপী সশস্ত্র সংঘাত শেষ হওয়ার পর কোনো পক্ষের একজনকেও বড় কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে বিচার করা হয়নি। আজকের বাংলাদেশে দৃঢ় জনসমর্থন নিয়ে শুরু করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া। একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের যে ব্যাপকতা, তাতে এর গুরুত্ব ঐতিহাসিক; কেবল জাতীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও। 

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রেও অগ্রণী হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। এ দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ প্রণীত হয়েছিল। প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে সেটা করা হয়েছিল। 

আইনশাস্ত্র বিশারদ সুজান্নাহ লিনটন লিখেছেন, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ যে এমন আইন বেছে নিয়েছিল, সেটি আসলেই ‘চমকপ্রদ ও প্রশংসনীয়’। সেই সময়ের সাপেক্ষে এটি ছিল প্রগতিশীল আইন। আন্তর্জাতিক বিচারে যৌন সহিংসতার অপরাধগুলো যতটা গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে, সেটা পেতে অনেক সময় লেগেছে; অথচ ১৯৭৩ সালের আইনের খসড়া প্রণেতারা সঠিকভাবেই ধর্ষণকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিচারের তালিকাভুক্ত করেছিলেন। একাত্তরে নানা অপরাধের মধ্যে ধর্ষণের যে ব্যাপকতা ছিল, সেই দিক দেখলে একাজটি আসলেই অপরিহার্য ছিল। বাংলাদেশের আইনজীবীরা ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় তৃতীয় আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন সম্মেলনের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত গঠনের আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অবদান রেখেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে রোম সংবিধির অংশীদার হয়েছে।

কিন্তু আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে গত ৩৭ বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারব্যবস্থায় যে বিরাট অগ্রগতি ঘটেছে, তার সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিচ্ছুক হওয়া উচিত নয়। সুতরাং আমার দ্বিতীয় বার্তা বাংলাদেশের জন্য: যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে আইনি কাঠামোয় এবং আটক রাখা, তদন্ত ও বিচারকাজের অনুশীলনে সম্পূর্ণভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া ও মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রতিফলন যেন ঘটে। আমি আইনজীবী নই, তবে জানি, এবারের আইনের সংশোধনের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা স্তরের উন্নতি করা হয়েছে। তার পরও রূপান্তরকালীন বিচার ও মানবাধিকার সংস্থার, যাঁরা একাত্তরে সংঘটিত গণ-অপরাধসমূহের ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে পুরোপুরি সঙ্গে আছেন—আইনজীবীদের অনেকগুলো গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। বিদ্যমান আইন এখন পর্যন্ত মৌলিক অধিকারসমূহের নিশ্চিত নিরাপত্তা পুরোপুরিভাবে দিতে পারেনি, যা কিনা আন্তর্জাতিক আইনে ন্যায্য বিচারের জন্য ন্যূনতম মানদণ্ড। এসব উদ্বেগ অপরাধ ও গ্রহণযোগ্য কৈফিয়ত এবং বিচারসংশ্লিষ্ট আইনি কার্যক্রমের যেকোনো দিকের বিচারিক পর্যালোচনা চাওয়ার অধিকারসম্পর্কিত। এসবের ভেতরে পড়ে, খেয়ালমাফিক আটকের বিরুদ্ধে সুরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা; ন্যায্য বিচারের নিশ্চয়তা, যেমন বিচার-পূর্ববর্তী ও বিচারকালীন পুরোটাব্যাপী কার্যকর আইনি পরামর্শ পাওয়ার অধিকার; সাক্ষ্যের প্রক্রিয়া ও মানের প্রশ্ন এবং যথাযথ আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পর্যাপ্ত সময়, সম্পদ ও কার্যপ্রণালিগত সুরক্ষা প্রদান। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে মার্কিন দূত স্টিফেন র্যাপ, যিনি আইনজীবী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারকাজে সম্পৃক্ত থাকার বিপুল অভিজ্ঞতার অধিকারী, সম্প্রতি বাতলান যে, এসবের মধ্যে বেশ কয়েকটি ইস্যু মিটিয়ে ফেলা যাবে ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালিবিধির অগ্রগতি সাধনের মাধ্যমে। আমিও বুঝতে পারি, সাক্ষীর সুরক্ষা ও আদালতের কার্যক্রমে ক্ষতিগ্রস্তদের, বিশেষত যৌন সহিংসতার শিকারদের, প্রতিনিধিত্ব কেমন করে জোরদার করা যায়, সেই বিবেচনা কাজ করেছে। অভিযোক্তা ও তদন্তকারীদের মধ্যে নারীরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে, এটা একটা সুসংবাদ।

যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়ায় সহায়তা ও এর উন্নতিকল্পে সিভিল সমাজের প্রচেষ্টায় এই জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, এ কথা আমি জানি। আমি খুব আশা করি, বিচার-প্রক্রিয়ার আরও উন্নতি ঘটানো হবে। যাঁরা ন্যায়বিচারের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা থেকে এই বিচারের সাফল্য কামনা করেন, তাঁরাই যদি বাধ্য হন এই বিচারের সমালোচক হয়ে উঠতে এবং অব্যাহত জাতীয় বিতর্ক আরও উসকে দেয়, তাহলে তা আজ এখানে উপস্থিত সবার জন্য এবং সমগ্র বাংলাদেশের জন্য হবে মর্মান্তিক। আর আমরা যারা মানবাধিকার গোষ্ঠীভুক্ত, তাদের অনেকের জন্য আরেকটি বাধা আছে, সেটা মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাব্য ব্যবহারের প্রশ্ন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব হিসেবে আমি শর্তহীনভাবে সব দেশে, ইরান থেকে যুক্তরাষ্ট্র অবধি, মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছি, তা যে অপরাধের শাস্তিই হোক না কেন। আমি স্বীকার করি, নিকৃষ্টতম সাধারণ অপরাধের শাস্তি হিসেবে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড অব্যাহত আছে; বহু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও অন্যরা একাত্তরের জঘন্যতম অপরাধগুলোর জন্যও এই শাস্তির বিধান থাকা প্রয়োজন বোধ করবেন। তবে বিলক্ষণ, বাংলাদেশ অত্যন্ত বেশি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছে এবং আমার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণে উঠে আসা দেশটির দুঃখজনক মানবাধিকার ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, অনেকগুলো মৃত্যুদণ্ড আসলে ছিল শুধুই রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ড। এমনকি যারা নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী নয়, তাদের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া কি সেই হত্যাকাণ্ডের বিশেষ গুরুত্বের ওপরই জোরারোপ করত না? আর জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নতুন দিগন্ত খুলে দিত না?

যুদ্ধাপরাধ বিচারের বাতাবরণ নিয়ে একটা কথা আমি যোগ করতে চাই। অভিযোগ উঠবে, এটা একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া—এমন অভিযোগ উঠেছেও। এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে খণ্ডণ করা কেবল যুদ্ধাপরাধ বিচারে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে চলার ওপরই নির্ভর করবে না, বরং বাংলাদেশে বিদ্যমান সাধারণ পরিবেশ কতটা অতীত ও বর্তমানের রাজনৈতিক পার্থক্যের প্রতি সহিষ্ণু, বহুত্ববাদিতার নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও স্বাধীন সিভিল সমাজের ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধাবান হিসেবে দেখা হচ্ছে, তার ওপরও। আর অতীত অপরাধের অব্যাহত দায়মুক্তি যেমন বর্তমানের আইনের শাসনের ভিত্তি দুর্বল করে, তেমনি আজকের মানবাধিকারের লঙ্ঘন অতীত অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাও দুর্বল করবে। আমি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ছাড়ার প্রায় দুই দশক পরও পড়তে হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন ও হত্যা অব্যাহত থাকার খবর, অথচ যা যথাযথ স্বাধীন তদন্ত এবং অধিকার হরণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ দাবি করে। এই পরিস্থিতি আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে। আর বাংলাদেশের জনগণকে অনেকগুলো সরকারের অধীনে বাস করতে হয়েছে, যাদের সমর্থকেরা আইনের ঊর্ধ্বে থেকে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। আইনের শাসনের প্রতি কোনো সরকারের দায়বদ্ধতার পরীক্ষাক্ষেত্র হলো সমর্থক ও প্রতিপক্ষ-নির্বিশেষে সবার প্রতি যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে নিরপেক্ষভাবে আইন প্রয়োগ।

একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে বর্তমানের যুদ্ধাপরাধের বিচার একাত্তরের অপরাধের দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে সত্যিই অসমর্থ। আর এর কারণ, যাদের সবচেয়ে বড় দায়, তারা নাগালের বাইরে। ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুরের জাতিসংঘ কার্যালয় প্রাঙ্গণে ঘেরাও হয়ে ছিলাম। ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনী ও পূর্ব তিমুরীয় মিলিশিয়ারা আমাদের চারপাশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে। সুতরাং, আমি এক অসুখকর সমান্তরাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি। সেটা হলো: বহু আগে তিমুরবাসীকে দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল, স্বল্প সময়ের জন্য কারাবন্দী করা হয়েছিল, যাদের অপরাধ ছিল সামান্য; অথচ যেসব ইন্দোনেশীয় কর্মকর্তা সেসব অপরাধের নির্দেশনা দিয়েছিল কিংবা অপরাধ রোধ করতে চেষ্টা করেনি, তাদের ধরা হয়নি। অবশেষে তারা ইন্দোনেশিয়ায় মানবাধিকার আদালত থেকে খালাস পেয়ে যায়। সেই বিচার জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ কমিশনের বর্ণনামতে ‘স্পষ্টতই অপ্রতুল’। পাকিস্তানে তো সেটাও করা হয়নি। হামুদুর রহমান কমিশন অপরাধসমূহকে ছোট করে দেখিয়েছে; পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা হত্যার শিকার মানুষের সংখ্যা কমিয়ে উপস্থাপন করেছে। তবে এটি অন্তত সুপারিশ করেছিল যে, ‘একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আদালত কিংবা তদন্ত কমিশন গঠন করে পূর্ব পাকিস্তানে একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন চলাকালে তাদের যে নৃশংসতার অভিযোগ উঠেছে, তা তদন্ত করা হোক এবং যারা এমন নৃশংসতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের বিচার করা হোক। এসব ঘটনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য দুর্নাম বয়ে এনেছে। আমাদের নিজস্ব মানুষের বিরুদ্ধে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত নিষ্ঠুরতা ও অনৈতিক আচরণ স্থানীয় জনগণের সহানুভূতি নষ্ট করেছে।’ এটা ১৯৭৪ সালের কথা। এমন কোনো পদক্ষেপ যে নেওয়া হয়নি, সে তো সবারই জানা।

এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমার শেষ ভাবনাটি তুলে ধরছি। ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে সফল কতগুলো বিচার সম্পন্ন করা হলেও তা একাত্তরে কী ঘটেছিল, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ হাজির করতে শুরু করা কষ্টসাধ্য। যেসব অপরাধী পাকিস্তানে থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে, তারা ছাড়াও অনেকেই আর বেঁচে নেই। অনেক ক্ষেত্রে তদন্তকারীরা যখন বধ্যভূমির তালিকা আর কী ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই সাক্ষ্য সংকলন করছেন, তখন কারও অপরাধের ব্যক্তিগত দায় প্রতিষ্ঠা এবং তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণাদি থাকবে না। কার্যত গুটি কয়েক অপরাধীর বিচার করা যাবে। আদালতে যে প্রমাণ উপস্থাপিত হবে, তা অনেকাংশেই ব্যক্তির কর্মের মধ্যে আটকে থাকবে। যদিও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কিংবা গণহত্যার দায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য বৃহত্ প্রেক্ষিত অবশ্যই তুলে ধরতে হবে। পূর্ণ চিত্র তুলে আনা সম্ভব হবে না। এ জন্য আমি মনে করি, বিস্তৃততর সত্যানুসন্ধান প্রক্রিয়ার দিকে যাওয়া উচিত।

আবারও আমি তিমুর-লেসতের প্রসঙ্গ টানব, যেখানে একটি ট্রুথ কমিশন ১৯৭৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার আক্রমণের আগের সময় পর্যন্ত মানবাধিকার-সংক্রান্ত অপরাধের অসাধারণ ইতিহাস খাড়া করতে পেরেছে। অপরাধ লঙ্ঘনের শিকার হয়ে কম মানুষ নিহত হয়েছে, তারও সবচেয়ে প্রামাণিক হিসাব হাজির করেছে। সেই ঘটনার কতগুলো বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেও বিবেচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব আফ্রিকার মতোই সেখানেও প্রকাশ্য শুনানি ব্যাপকভাবে সম্প্রচারিত হয়েছে। বাইরের দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে তারা আলোচনা তুলেছে। এতে বিদেশে অবস্থানরত পূর্ব তিমুরিরা, ইন্দোনেশিয়া ও তাদের এককালের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পর্তুগাল শুধু নয়; জাতিসংঘ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও উঠেছে। পূর্ব তিমুরের প্রক্রিয়াটির আকর্ষণীয় দিক হলো, ইন্দোনেশীয় দখলদারির আগে তিমুরবাসীর নিজেদের ভেতর পারস্পরিক হত্যা ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্বীকৃতি। বাংলাদেশে একাত্তরের সত্যকে মানতে হলে তাতে থাকতে হবে নিরীহ বিহারি ও পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযুক্ত সহযোগীদের হত্যাকাণ্ডের কথা। তবে কোনোভাবেই এগুলোকে সমতুল্য হিসেবে দাঁড় করানো যাবে না পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে। ট্রুথ কমিশনের সুপারিশগুলো অনুসরণের ক্ষেত্রে তিমুর-লেসত সরকার ও সংসদ দুঃখজনকভাবে ঢিলেমি করেছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির অধিকার এবং কমিশনের তদন্তেও ফলাফল শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহারের মতো বিষয়গুলোতেও সরকারের মন্থরগতি দেখা গেছে। তবে সিভিল সমাজ এ ব্যাপারে জনসাধারণের শিক্ষা অব্যাহত থাকা নিশ্চিত করছে। আর কমিশন যে জায়গাটি কাজে লাগিয়েছিল, সেটি ছিল একটি ঔপনিবেশিক কারাগার, যেখানে স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীদের বন্দী করে রাখা হতো, তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো—সেটি একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। নানা দিক থেকে এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে সেটির সাদৃশ্য আছে।

সত্যানুসন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু করার আগে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করার আছে। প্রথমত, স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, যেখানে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা সম্ভব, সেখানে এটা বিচারের কোনো বিকল্প নয় এবং বিচারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। অবশ্য, যখন বিচারকাজ ও সত্যানুসন্ধানের প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলে, সেখানে কতগুলো প্রায়োগিক বিষয় মোকাবিলা করতে হয়। যেসব দেশে এমন ঘটেছে, যেমন সিয়েরা লিওন ও তিমুর-লেসত, সেগুলোর অভিজ্ঞতা তাই বলে। ট্রুথ কমিশনের প্রচুর পরিমাণ সম্পদ লাগে। অব্যাহত, সর্বদলীয় অঙ্গীকারবিহীনভাবে এটা শুরু করার নয়। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কমিশনারদের গ্রহণযোগ্যতা। তাঁরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হিসেবে গণ্য হতে হবে। আর শুধু সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক বলয় থেকে নিলে চলবে না। কমিশনার বাছাইয়ের প্রক্রিয়া, যা কমিশনারদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে, তার উপকারী অভিজ্ঞতাসুলভ। দুটি দেশের সরকার—হাইতি ও সিয়েরা লিওন, ট্রুথ কমিশন গঠন করার সময় আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তিমুর-লেসত নিজের ট্রুথ কমিশনের গণ্ডি ছাপিয়ে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে কমিশন অব ট্রুথ অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ প্রতিষ্ঠা করে। কেন এটা একটা ভালো দৃষ্টান্ত, সেই সব নানা কারণ এখানে তুলব না। তবে এটা অন্তত ঠিক যে, ইন্দোনেশিয়া সেনাবাহিনীর অপরাধের প্রকৃতি সম্পর্কে ইন্দোনেশিয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি তাতে পাওয়া যায়। এরূপে কোনো এক সময় পাকিস্তান কিংবা অন্তত পাকিস্তানের কিছু নাগরিক সত্য স্বীকার করে নেওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে কি না, সেই প্রশ্নটিকে প্ররোচিত করে। সুতরাং, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যে উদ্দেশ্যে নিবেদিত, সেটা ট্রুথ কমিশন গঠিত হলে আরও ভালোভাবে পালন করা যাবে কি না, সেই বিতর্কে হয়তো নেতৃত্ব দিতে পারে।

যাই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশে স্মৃতিকে জাগরুক রেখে এবং একাত্তরের অভিজ্ঞতা যে প্রজন্ম সরাসরি পায়নি, তাদের কাছে সত্য প্রকাশ ও ন্যায়বিচারের দাবি পৌঁছে দিয়ে আপনাদের যে অসাধারণ অর্জন, সেখান থেকে আপনারা আরও এগিয়ে যেতে পারেন। এটা আসলেই এমন এক অর্জন যে আমি আপনাদের কাছে আর্জি জানাই, বিশ্ববাসীর কাছে বিশ্লেষণ তুলে ধরুন, তাদের কাছে ব্যাখ্যা করুন, এটা কেমন করে ঘটল। বাঙালি সংস্কৃতির শক্তি ও সমৃদ্ধির কারণে কতটা, আর কতটা শিল্প, নাটক, সাহিত্য ও সংগীতের ভূমিকার কারণে; কতটা পরিবারের ভেতরকার স্মৃতির কারণে আর কতটা একাত্তরের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথার মাধ্যমে বৃহত্তর শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে পৌঁছে দেওয়া স্মৃতির কারণে; কতটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের (যা সত্যকে লুকিয়ে রাখা দিনে দিনে কঠিন করে তুলছে) কারণে, যা আজ রাজনৈতিক অভিজাতেরা আবিষ্কার করছেন সারা দুনিয়ায়।

জবাবের যে একাংশের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত সেটা হলো, এই অর্জনের পেছনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্মৃতি ও ন্যায়বিচারের প্রতি আপনারা নিবেদিত থাকার ১৫ বছরে আপনাদের জনসমক্ষে অভিনন্দিত করতে পেরে নিজেকে সত্যিকারের সৌভাগ্যবান মনে করছি।

অনুবাদ: আহসান হাবীব