আমাদের কালে বৈষম্য

ধনী ও দরিদ্র: পরস্পর-সংযোগ ও সহানুভূতিরহিত দুটি জাতি; দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চল বা উপগ্রহের অধিবাসীর মতো, পরস্পরের অভ্যাস, ভাবনা ও অনুভূতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

বেঞ্জামিন ডিজরেলি (১৮০৪-১৮৮১)

আমাদের কালে বৈষম্যের গতি-প্রকৃতি ও তার কারণ বিশ্লেষণ এই প্রবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য। বৈষম্য বহুমাত্রিক। এর একটি বিশেষ মাত্রা—জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য—আমাদের আলোচনার সীমিত বিষয়বস্তু। অবশ্য জীবনযাত্রার মানের সংজ্ঞাও বহুমাত্রিক। অধুনা সমাজবিজ্ঞানীরা জীবনযাত্রার মানের বহুমাত্রিক সূচক এবং তার বৈষম্য পরিমাপের পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু এই বহুমাত্রিক সূচকগুলো কেবল সাম্প্রতিক বছরগুলোর জন্য এবং স্বল্পসংখ্যক দেশের জন্য পরিমাপ করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে বৈষম্যের সীমিতসংখ্যক পরিসংখ্যানের ব্যবহার তাই একটি একমাত্রিক সূচকে—আয় বা ভোগ বণ্টনের বৈষম্যের সূচকে—সীমাবদ্ধ রাখা হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কে এই প্রবন্ধে আমাদের কাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার শুরুতে আমার প্রজন্মের মানুষেরা সদ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিল। বিশ্বব্যাপী বৈষম্য আমার আলোচনার লক্ষ্য। আমাদের দেশের বৈষম্য, যা নিয়ে আমি অন্যত্র বেশ কিছু আলোচনা করেছি, আমার মুখ্য আলোচনার বিষয় নয়।

এই প্রবন্ধের প্রারম্ভিক প্রতিপাদ্য এই যে আমাদের কালে বৈষম্য এবং সমাজের বৈষম্য-সহিষ্ণুতা প্রায় সর্বত্র উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কিন্তু আমাদের কালের দুটি ভিন্ন ভাগে বৈষম্যের গতিধারা ভিন্নমুখী ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রথম তিনটি দশকে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র বৈষম্য নিম্নগামী ছিল এবং মানব প্রজাতির যে স্বল্পাংশ বৈষম্যের নিম্নগামিতা থেকে এই সময়ে বঞ্চিত ছিল, সেখানেও বৈষম্য সামান্যই বেড়েছিল। পরবর্তী তিন দশকে—সত্তরের দশকের শেষ বা আশির দশকের গোড়া থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত—মানবসমাজের প্রায় সর্বত্র বৈষম্য লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রথম তিন দশকে মানবসমাজ অন্তত আপাতদৃষ্টিতে সর্বত্র বৈষম্য প্রশমনের উপায় উদ্ভাবনে নিয়োজিত ছিল। তুলনায় গত তিন দশকে মানবসমাজ সর্বত্র অনেক বেশি বৈষম্য-সহিষ্ণু হয়েছে। এ প্রবন্ধের আরও একটি প্রতিপাদ্য এই যে বৈষম্যের গতিধারা কোনো অনিবার্য প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক বা ঐতিহাসিক নিয়মে নয়, বরং রাজনৈতিক শক্তির সচেতন সিদ্ধান্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। উপসংহারে বক্তব্য এই যে সমাজতন্ত্র, অপুঁজিবাদী উন্নয়ন প্রমুখ বৈষম্যবিরোধী শক্তির বিলোপ এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের উত্থান সত্ত্বেও মানুষের সাম্যান্বেষণের ‘অন্তিম ইতিহাস’ রচিত হয়নি। বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমকালীন সমাজগুলোর সামনে অনেক পথ খোলা আছে।

১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বৈষম্য

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরের দশকগুলোয় বৈষম্যের পরিবর্তন

প্রথমে শিল্পোন্নত দেশগুলোর দিকে তাকানো যাক। এই দেশগুলো সবই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলেও এদের মোটামুটিভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। দুটি ভাগের দেশগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। একটি ভাগে রয়েছে সামাজিক গণতন্ত্র বা কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো; অন্যটিতে ‘নিখাদ’ বাজার অর্থনীতি অনুসারী দেশগুলো। নিখাদ বলার অর্থ এই নয় যে এই দেশগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজারের পাঠ্যবই নির্দেশিত সংজ্ঞার অনুসারী, বরং এই যে এই দেশগুলোতে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের সপক্ষে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ নিতান্তই বিরল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরবর্তী দশকগুলোতে বিশেষভাবে ইউরোপে সামাজিক গণতন্ত্র ও কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই দেশগুলোতে অনুসৃত মুখ্য পন্থাগুলো ছিল: রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত সামাজিক পরিষেবার অর্থায়নের জন্য উচ্চপ্রান্তিক হারে কর প্রবর্তন; রাষ্ট্রীয় সহায়তায় সর্বস্তরে শিক্ষার অবাধ সুযোগ; রেলপথ এবং বিদ্যুত্ সরবরাহের মতো স্বভাবজ একচেটিয়া উদ্যোগের (Natural Monopoly) ওপর সামাজিক (রাষ্ট্রীয়) নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন; অর্থায়ন সংস্থা ও বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ; এবং শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন। এই বর্গের দেশগুলো নিপুণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি খুবই উচ্চমাত্রার সমতাও অর্জন করেছিল। এদের মধ্যে বণ্টনসাম্যে সর্বাগ্রগণ্য দেশগুলোতে—যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়—বণ্টন পরিমাপের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত ‘জিনি’ সূচক প্রায়ই ছিল ২৫ বা তার কম।২

বাজার অর্থনীতির ‘নিখাদ’ রূপের সবচেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই কালপর্বে যুক্তরাষ্ট্রেও আয় ও মজুরি বণ্টনের বৈষম্যে স্বল্পহারে হলেও অবিরত নিম্নগতি অব্যাহত ছিল। এর কারণ অংশত এই যে সামাজিক গণতন্ত্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত কল্যাণমূূলক ব্যবস্থার কিছু কিছু এই দেশটিও অবলম্বন করেছিল। ত্রিশের দশকে গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্তদের ভাতা দেওয়া শুরু হলো; ষাটের দশকে বিধিবদ্ধ মেডিকেয়ার এবং মেডিকেইড কর্মসূচির মাধ্যমে বয়স্ক ও দরিদ্রদের চিকিত্সাবিমা দেওয়া হলো; শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষাকে আরও জোরদার করা হলো; এবং শক্তিশালী ইউনিয়নের অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধের সামরিক কর্মীদের শিক্ষার জন্য প্রণীত জিআই বিল এবং অন্যান্য সুবিধার ফলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারিত হলো। ত্রিশের দশকের ‘নিউ ডিল’ কর্মসূচির সময়ে বিধিবদ্ধ ব্যাংক, অন্যান্য অর্থায়ন সংস্থা এবং বাণিজ্যের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এই পর্বে বজায় ছিল। অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কর্মসংস্থান ও উত্পাদনের প্রবৃদ্ধিকে সহজতর করে তুলল। এসব পদক্ষেপের অধিকাংশই প্রবৃদ্ধির নৈপুণ্য বৃদ্ধিরও সহায়ক হয়েছিল, ফলে পরবর্তী দশকগুলোর তুলনায় এই কালপর্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও স্পষ্টতই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বেগবান ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশের অধিক মানুষ মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের পতাকাবাহী দেশগুলোর অধীনে আসে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদে উনিশ শতকে এই মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। এই ব্যবস্থাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নানা পার্থক্য সত্ত্বেও যে বৈশিষ্ট্যের নিরিখে এদের একটি স্বতন্ত্র বর্গ হিসেবে গণ্য করা যায় তা এই যে এই দেশগুলোতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ লোপ করে তার বদলে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা প্রবর্তন করা হয়; এই ব্যবস্থায় উত্পাদন ও বণ্টনের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ সরাসরিভাবে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই ব্যবস্থার অধীন দেশগুলোতে উত্পাদন ব্যবস্থার ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করে রাষ্ট্রীয় ও যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। উচ্চপর্যায়ের নেতা ও আমলাদের প্রচ্ছন্ন সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করলে এসব সমাজে মজুরি ও আয়ের বণ্টন ছিল সমতাভিত্তিক। বাস্তবে বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রধান সমস্যা ছিল একটি যুক্তিনিষ্ঠ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অভাব, যে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বাজারের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও উত্পাদন ও বণ্টনের একটি নিপুণ সংগঠন নিশ্চিত করতে সক্ষম। এর ফলে—কয়েকটি স্বল্পস্থায়ী পর্ব বাদ দিলে—এই দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার কখনো সম্ভাবনার প্রান্তসীমার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। এই দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর সমতা তাই অনেকটা সাম্যভিত্তিক দারিদ্র্যের সঙ্গে তুলনীয়; নিপুণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জীবনযাত্রার মান যা হতে পারত তার চেয়ে অনেকটা নিচে। তা ছাড়া, এসব দেশের আয় বণ্টনের বৈষম্য সামাজিক গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে যারা সর্বনিম্ন বৈষম্য অর্জন করেছিল, তাদের থেকে কম তো নয়ই, বরং বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও স্বীকার করা দরকার যে এই দেশগুলো প্রাক-বিপ্লবী যুগের চরম বৈষম্য দূর করে সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল এবং সেটা শুধু আয় বণ্টনের বিচারে নয়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান বণ্টনের বিচারেও।

বিশ্বের বাকি অংশগুলো উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ভুক্ত। এই কালপর্বে এই দেশগুলোতে বৈষম্যের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কিত তথ্য পরিমাণে এবং বিশ্বাসযোগ্যতায় সীমিত। এই সময়ে লাতিন আমেরিকা দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে প্রবর্তিত আমদানি-প্রতিস্থাপক শিল্পায়ননীতি অনুসরণ করছিল। অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো—যাদের অধিকাংশ এই কালপর্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল—অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন পথ বেছে নিয়েছিল।

ভূমি বণ্টনের বিপুল বৈষম্য ও অন্যান্য কাঠামোগত কারণে লাতিন আমেরিকার আয় বণ্টনের বৈষম্য বরাবরই বেশি ছিল। আমাদের আলোচ্য কালপর্বে এই অঞ্চলটি কিন্তু বৈষম্যের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ব্যতিরেকেই দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। বৈষম্যের কাঠামোগত কারণগুলো দূর করার অতিসীমিত উদ্যোগ সত্ত্বেও এসব দেশ সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে গৃহীত কিছু পদক্ষেপের ফলে বৈষম্যের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পরিহার করতে পেরেছিল।

দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহদাংশ একধরনের আমদানি-প্রতিস্থাপক শিল্পায়নের নীতি অবলম্বন করেছিল। এ অঞ্চলের বৃহত্তম দেশ ভারত একটি মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, অনেকে যাকে ‘সমাজতন্ত্রপ্রবণ’ বলে অভিহিত করেছেন, যেখানে যাতায়াত, যোগাযোগ প্রভৃতি গণ-পরিষেবামূলক ক্ষেত্র ছাড়াও বেশ কিছু মৌলিক শিল্প রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন করা হয়েছিল। শিল্প ও বাণিজ্যের ওপর ব্যাপক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিশেষত শহরাঞ্চলে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বণ্টনব্যবস্থায়ও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল। ভূমি পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রেও সীমিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশও কম-বেশি একই কৌশল অবলম্বন করেছিল। আলোচ্য কালপর্বে এই অঞ্চলগুলোতে আয় বণ্টন সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীলই ছিল। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বৈষম্যের মাত্রায় পার্থক্য ছিল এবং কতগুলো দেশে—যেমন পাকিস্তানে ও ফিলিপিনে—বেশ কয়েক বছর ধরে বৈষম্য বেড়েছিল; কিন্তু প্রধান দেশগুলোতে আয়-বৈষম্য খুব লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এ রকম প্রমাণ সামান্যই পাওয়া গেছে।

পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ—প্রথমত জাপান, পরে তার অনুগামী দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্র—একেবারে ভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করেছিল: সম্পদের পুনর্বণ্টন—জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে ভূমির এবং নগররাষ্ট্র দুটির ক্ষেত্রে জন-আবাসনের; কর্মসংস্থানবর্ধক পণ্যোত্পাদনভিত্তিক, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন; জনগোষ্ঠীকে মানব সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি; এবং অবকাঠামোতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। এই দেশগুলো নিম্নমাত্রায় স্থিতিশীল বৈষম্যের সঙ্গে অভূতপূর্ব দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

এই কালপর্বে ঔপনিবেশিকতামুক্ত আফ্রিকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার ছিল মাঝারি ধরনের। এসব দেশের বৈষম্যের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে তথ্য যথেষ্ট নয়। তবে যে স্বল্পসংখ্যক দেশের জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া যায়, তা বৈষম্যের ঊর্ধ্বগতির বিশেষ সাক্ষ্য দেয় না।

বৈষম্য-পরিহারী প্রবৃদ্ধির কয়েকটি কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে মানবসমাজের পুনরুত্থান হয় বৈষম্য কমানোর শক্তিশালী অঙ্গীকার নিয়ে। এর দীর্ঘ ঐতিহাসিক শিকড় ছিল। পশ্চিমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচার সম্পর্কিত ধারণা থেকে সমতার অন্বেষণ শুরু হয় এবং উনিশ শতকে তা নানা মতের সমাজতান্ত্রিক রচনা ও সমাবেশের মধ্য দিয়ে ক্রমে একটি সুস্পষ্ট তাত্ত্বিক রূপ লাভ করে। মার্ক্স এই তত্ত্বের চরম ও চূড়ান্ত প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান। সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক আন্দোলন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময় ভাঙনের মুখে পড়ে; এর লেনিনপন্থী অংশটি ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে, আর এর সামাজিক-গণতন্ত্রবাদী অংশটি নির্বাচনী গণতন্ত্রের পদ্ধতিতে লড়াই চালিয়ে যায় এবং সাময়িকভাবে দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে বেশ কয়েকটি দেশে নিরঙ্কুশ বা আংশিক ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ত্রিশের দশকে শিল্পোন্নত দেশগুলো যখন ‘মহামন্দা’য় নিমজ্জিত, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্রুত প্রবৃদ্ধি এই সমাজব্যবস্থার প্রতি বিশ্বব্যাপী সমীহ সৃষ্টি করে, অন্তত স্ট্যালিনীয় নৃশংসতার সত্যিকার মাত্রা যত দিন অনতিজ্ঞাত ছিল তত দিন পর্যন্ত। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার ইউরোপীয় প্রতিরোধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক কর্মীর বিপুল আত্মত্যাগ সমাজতন্ত্রের নৈতিক ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করেছিল। উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাদের পক্ষে সমাজতন্ত্রের এই নৈতিক আবেদন উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। সমাজতন্ত্রের এই আবেদনের একটি নির্দেশক এই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ক্ষণে বিজয়ের অন্যতম স্থপতি উইনস্টন চার্চিলকে পরিত্যাগ করে ব্রিটেন গ্রহণ করল ব্যক্তিগতভাবে বৈশিষ্ট্যহীন অ্যাটলিকে, যাঁর নেতৃত্বাধীন শ্রমিক দল ছয় বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে ব্যাপক সামাজিক-গণতন্ত্রমূলক সংস্কার প্রবর্তন করেছিল। সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর ব্যাপারে ব্যাপক মতৈক্যের আরেকটি নিদর্শন এই যে ১৯৫১ সালে চার্চিলের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ফলে যে দীর্ঘকালীন রক্ষণশীল শাসন প্রবর্তিত হয়েছিল, তার আমলে শ্রমিক দলের সংস্কারগুলো মোটামুটি অপরিবর্তিত ছিল। এই একই ধারা গোটা ইউরোপে বহাল ছিল, রক্ষণশীলরা পর্যায়ক্রমে ক্ষমতা দখল করলেও সামাজিক-গণতন্ত্রমূলক সংস্কারগুলো মোটামুটি অব্যাহত রাখা হচ্ছিল।

যুদ্ধোত্তর পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কেইন্সীয় নীতির প্রবর্তন, যার ফলে মুদ্রানীতি এবং সরকারি আয়-ব্যয়নীতির যথাযোগ্য ব্যবহার করে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ বা প্রায়-সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে। এ ক্ষেত্রেও সামাজিক-গণতান্ত্রিক, রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় যে রক্ষণশীল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমিলন এবং হিথ্ উভয়েই কেইন্সীয় তত্ত্বে প্রগাঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। এই নীতি অনুসরণের ফলে উচ্চ সামষ্টিক চাহিদা এবং কর্মসংস্থান শ্রমিকদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।

সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব অবশ্য কর্তৃত্বপরায়ণ সমতাবাদী কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। কিছুকালের জন্য স্ট্যালিনোত্তর সময়ে অর্থনৈতিক প্রণোদনামূলক সংস্কারের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাটিকে অধিকতর উত্পাদন-নিপুণ করার চেষ্টা হয়েছিল। বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের স্বৈরপ্রকৃতি যুদ্ধোত্তর কালপর্বের শুরু থেকেই যথেষ্ট পরিষ্কার হয়ে ওঠা সত্ত্বেও সত্তরের দশকের আগে পুঁজিবাদী বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি গুরুতর প্রতিযোগী হিসেবে দেখার চাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী গণ-আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি ছিল সর্বসাধারণের সমতাভিত্তিক শ্রীবৃদ্ধি। পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের সমতাবাদী ভূমি সংস্কারের পেছনে সম্ভবত চীন বিপ্লবের ছায়ার প্রভাব ছিল। আরও অনেক সদ্য স্বাধীন দেশ জনকল্যাণ প্রসারে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকার লক্ষ্যে মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিল। বাস্তবে এই দেশগুলোর কর্মপন্থা প্রায়ই স্থায়ী ভিত্তিতে সমতাবাদী বণ্টন প্রবর্তনে ব্যর্থ হয়েছে। আমদানি-প্রতিস্থাপক শিল্পায়ন এবং ‘প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়’-এর বিভিন্ন পন্থা এসব দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিত্তবান ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর হাতে অতিমাত্রায় সম্পদ পুঞ্জীভূত করে; কিন্তু আংশিক ভূমিসংস্কার, পণ্য বণ্টনে সরকারি উদ্যোগ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচারের জনতুষ্টিবাদী অঙ্গীকার বৈষম্য সীমিত রাখার ক্ষেত্রে কিছু কাজ করত, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নৈপুুণ্য হ্রাস করার বিনিময়ে।

২. গত তিন দশকে বৈষমের উত্থান

গত তিন দশকে বৈষম্যের গতি-প্রকৃতির কয়েকটি উদাহরণ

১৯৮০ সালের দিকে ওপরে বর্ণিত পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় এবং সামগ্রিকভাবে পৃথিবী ব্যাপকতর বৈষম্যের দিকে অগ্রসর হয়। উন্নত পুঁজিবাদী দেশ, সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশ—এই তিন বর্গের দেশের প্রতিটি থেকে নেওয়া উদাহরণের মধ্যে আমরা আলোচনা সীমিত রাখব। প্রতিটি প্রধান অঞ্চলের প্রতিটি বর্গের দেশেই বৈষম্যের মাত্রা বেড়েছে।

পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে ‘নিখাদ’ বাজার অর্থনীতির উপবর্গের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। ১৯৬৭ সালে পরিবারসমূহের আয়-বৈষম্যের জিনি সূচক ছিল ৩৯.৭। ১৯৭০ সালে এই সূচক কিছুটা নেমেছিল। সেন্সাস ব্যুরোর হিসাবে ২০০৫ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৯-এ, অর্থাত্ বৈষম্য খুব উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কংগ্রেসের বাজেট অফিসের একটি প্রতিবেদনে ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছে তার আরও স্পষ্ট হিসাব পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদন থেকে মোট করোত্তর আয়ে জনসংখ্যার বিভিন্ন অংশের ভাগ কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তার নিম্নোক্ত পরিমাপ পাওয়া যায়:

১. আয়ের বিচারে জনসমষ্টির সর্বোচ্চ ১ শতাংশের ভাগ ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, ১৭ শতাংশে।

২. জনসমষ্টির সচ্ছলতম পঞ্চমাংশের ভাগ বেড়েছে ৪৩ থেকে ৫৩ শতাংশ।

৩. দরিদ্রতম পঞ্চমাংশের ভাগ কমেছে ৭ থেকে ৫ শতাংশ।

৪. অন্তর্বর্তী তিন-পঞ্চমাংশকে মোটামুটিভাবে মধ্যবিত্ত বলা যায়; এদের ভাগ ৫০ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে।

বাস্তবে বৈষম্য বৃদ্ধি হয়েছে আরও অনেক বেশি। পরিবারে রোজগেরে লোকের সংখ্যা, বিশেষত নারী-রোজগেরের সংখ্যা বেড়েছে; পারিবারিক ঋণের বোঝা বেড়েছে; সম্ভাব্য অবসর-ভাতার পরিমাণও অনেক কমেছে এবং এতত্সত্ত্বেও মোট আয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর ভাগ কমে গেছে। এসবই ঘটছে এমন একটি সমাজে, গণতন্ত্র যার ঘোষিত ভিত্তি, যেখানে নীতিনির্ধারকেরা নিয়মিত সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হচ্ছেন—বিষয়টি বুদ্ধি-ঘুলিয়ে দেওয়া প্রহেলিকা ছাড়া আর কী! প্রাগ্রসর পুঁজিবাদী বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রেই বৈষম্য সর্বাধিক এবং এই বর্গভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গত তিন দশকে বৈষম্য বৃদ্ধির সবচেয়ে কদর্য অভিজ্ঞতাও এ দেশেরই। তবে এই বর্গভুক্ত প্রায় সব দেশেই একই ধরনের পরিবর্তন হয়েছে।

সামাজিক-গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এই দেশগুলোর বৈষম্য এই কালপর্বের শুরুতে বেশ নিচু ছিল এবং এদের বৈষম্য বৃদ্ধির হারও ছিল সীমিত। ফলে এই দেশগুলোর বর্তমান বৈষম্য সহনীয়। প্রাচীনতর সামাজিক-গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে—যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার—আয় বণ্টনের সামগ্রিক বৈষম্য এখনো নিচুতেই রয়েছে, তাদের জিনি সূচকগুলো ২৫-এর আশপাশে ওঠানামা করেছে।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আগ পর্যন্ত এই ব্যবস্থাধীন দেশগুলোতে জিনি সূচকের যে পরিমাপ পাওয়া যায়, তার সঙ্গে অন্যান্য দেশের জিনি সূচকের তুলনাযোগ্যতা নিয়ে নানা রকম সংখ্যাতাত্ত্বিক সমস্যা আছে, তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটা ছিল ৩০-এর মতো এবং চীনের ক্ষেত্রে এর চেয়ে কিছু কম। রাশিয়ায় পুঁজিবাদে রূপান্তর ঘটেছিল একটি বিশেষ শ্রেণী কর্তৃক বিত্ত ও সম্পদ লুণ্ঠনের ফলে উদ্ভূত ব্যাপক ও তীব্র বৈষম্যায়নের মাধ্যমে। সিআইএর প্রতিবেদন অনুসারে, জিনি সূচক ছিল ২০০১ সালে ৩৯.৯ এবং ২০০৯ সালে ৪২.২। নিঃসন্দেহে বলা চলে, বৈষম্যের প্রকৃত ঊর্ধ্বগতি এর চেয়ে বেশি ছিল। বিশেষত কালোবাজার থেকে লব্ধ বিপুল পরিমাণ আয় এই হিসাবে বাদ পড়েছে; ত্রুটিপূর্ণ হলেও যে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী সমাজতন্ত্রের আমলে বিদ্যমান ছিল, তা ভেঙে পড়ার ফলে জনজীবনে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল তার সামান্যই ধরা পড়েছে তথ্য-পরিসংখ্যানে। চীনের আয় বণ্টনের জিনি সূচক, বিশেষ করে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতির বিশ্বায়ন শুরু হওয়ার কাল থেকে, নিরবচ্ছিন্নভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৫ সাল নাগাদ ৪১.৫-এ পৌঁছেছে।

এই তিন দশকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও এসব ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধির প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। সন্দেহের অবকাশ নেই যে ভারতে বৈষম্য গুণগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলশ্রুতির নিদর্শন এমন এক বীভত্স ও অপব্যয়ী সম্পদ প্রদর্শন, যা অল্প কয়েক দশক আগে অকল্পনীয় ছিল। লাতিন আমেরিকার বৈষম্য সর্বত্রই বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সূচনা চিলিতে সত্তরের দশকে জেনারেল পিনোশে প্রবর্তিত বর্বর পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে। তারপর সমগ্র মহাদেশে এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে, বিশেষত ‘হারিয়ে-যাওয়া’ আশির দশকে যখন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অজুহাতে সামষ্টিক চাহিদার গুরুতর সংকোচন এবং বিশ্বায়নের প্রবাহে প্রতিষ্ঠিত উদ্যোগগুলো থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের ফলে জাতীয় উত্পাদন নিম্নগামী এবং কর্মাভাব ও বৈষম্য ঊর্ধ্বগামী ছিল। এই প্রবণতা লাতিন আমেরিকায় বর্তমান শতকের প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাতিন আমেরিকার প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের দিক পরিবর্তন হয়েছে, যা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার যে স্বল্পসংখ্যক দেশ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, সেখানেও বৈষম্য তীব্রভাবে বেড়েছে। এই প্রসঙ্গে মিসরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের বৈষম্য নিয়ে আমি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছি। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশে আয় বণ্টনের বৈষম্য নিয়মিতভাবে বেড়েছে। লক্ষণীয় এই যে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির সঙ্গে জাতীয় আয়ের বৈষম্যপ্রবণ অঙ্গগুলোর ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় আয়ের এই ‘কাঠামোগত’ পরিবর্তনই বৈষম্য বৃদ্ধির মূল উত্স। প্রবৃদ্ধির কাঠামোর মধ্যে নিহিত এই বৈষম্যপ্রবণতাকে প্রতিহত করার মতো সমতাবর্ধক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ খুব সামান্যই নেওয়া হয়েছে।

কিছু বহু-কথিত পাল্টাযুক্তি

ওপরে বর্ণিত প্রবণতা নিয়ে দুর্ভাবনা নেই এমন লোকেরা যুক্তি দিয়ে থাকেন যে দেশের অভ্যন্তরে বৈষম্য বাড়লেও সারা বিশ্বের সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর বৈষম্য সম্ভবত বাড়েনি। যুক্তিটা এ রকম: পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের বাসভূমি চীন এবং ভারতে যে অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে, তার ফলে এই দুই দেশের একজন গড় অধিবাসীর জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে শিল্পোন্নত বিশ্বের একজন গড় অধিবাসীর জীবনযাত্রার মানের দূরত্ব কমেছে। ‘আন্তদেশীয়’ বৈষম্যের সম্ভাব্য হ্রাস এবং ‘দেশের ভেতরের বৈষম্য’ বৃদ্ধি এই দুই পরস্পরবিরোধী প্রবণতা পরস্পরের প্রতিপূরক হিসেবে কাজ করেছে; ফলে হয়তো সারা বিশ্বের জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো বৈষম্যায়ন হয়নি।

এই তর্কটির প্রেরণা এসেছে দুজন ইউরোপীয় অর্থনীতিবিদ—বুরগুইনোঁ ও মরিসন—এর গবেষণা থেকে। তাঁরা দুজনে ১৮২০ থেকে শুরু করে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কালপর্বের কয়েকটি বছরের জন্য বিশ্বের সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর আয় বণ্টনের জিনি সূচক পরিমাপ করেছেন। তাঁদের হিসাব অনুযায়ী, এই কালপর্বের গোড়ার তুলনায় শেষে বৈষম্যের মাত্রা অনেক বেশি হয়েছে। লক্ষণীয় যে এই পরিমাপ অনুসারে ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব বৈষম্য হ্রাস পেয়েছিল কিন্তু তার পর থেকে তা অব্যাহতভাবে বেড়েছে। আরও লক্ষণীয় এই যে দেশের অভ্যন্তরীণ বৈষম্য ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল অবধি স্থিতিশীল ছিল এবং এরপর বাড়তে শুরু করেছে। এই তথ্যগুলো আমাদের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে। ওদের হিসাব থেকে আরও দেখা যায় যে আন্তদেশীয় বৈষম্যের অবিরাম ঊর্ধ্বগতি ১৯৬০-এর পর থেকে অব্যাহত ছিল।

আন্তদেশীয় বৈষম্য হ্রাসের ফলে অভ্যন্তরীণ বৈষম্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও বিশ্ব বৈষম্য স্থিতিশীল রয়েছে, অতএব বৈষম্য বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের দুর্ভাবনার কারণ নেই—এই যুক্তির মধ্যে আমি স্বস্তি খুঁজে পাই না। মানুষের কল্যাণ, সম্ভ্রম, আত্মমর্যাদা এবং কর্মোদ্যম নিজস্ব সমাজের বৈষম্যের প্রভাব দিয়ে নিরূপিত হয়। এই বৈষম্য যখন আকাশচুম্বী, তখন নিজস্ব সমাজ ও দূরান্তরের সব অচিন সমাজের সম্মিলিত বৈষম্যের কোনো দুর্বোধ্য সূচকের স্থিতিশীলতার মধ্যে সান্ত্বনা খোঁজার অবকাশ থাকে না। বিশ্বজনের সামগ্রিক বৈষম্যের সম্ভাব্য নিম্নগতির মধ্যে স্বস্তি অন্বেষণের বিরুদ্ধে এই মৌলিক আপত্তি ছাড়াও প্রশ্ন রয়েছে যে বুরগুইনোঁ-মরিসন প্রণীত সূচকটি যদি বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রসারিত করা যেত, তবে তাতে গত দুই দশকে বিশ্ববৈষম্যের নিম্নগতি দেখা যেত কি না। গত দুই দশকে চীনা/ভারতীয় এবং উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের মধ্যকার গড় বৈষম্য যথার্থই হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু তা থেকে নিশ্চয় করে বলা যায় না যে আন্তদেশীয় বৈষম্য কমেছে। প্রথমত, অনেক দরিদ্র দেশের নাগরিকদের সঙ্গে যুগপত্ উন্নত বিশ্ব ও চীন/ভারতের আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তদুপরি, চীনের জাতীয় আয়ের প্রবল ঊর্ধ্বগতির তুলনায় পরিবারবর্গের ‘ব্যক্তিগত আয়’ বেড়েছে অনেক শ্লথগতিতে। দ্বিতীয়ত, চীন, ভারতসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে অভ্যন্তরীণ বৈষম্য এমন বিপুল হারে বেড়েছে যে আন্তদেশীয় বৈষম্যের অনিশ্চিত নিম্নগামিতা তার প্রভাবকে অতিক্রম করবে, এ নিতান্ত দুরাশা মাত্র।

বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলো প্রায়ই আরেকটি যুক্তি উপস্থাপন করে যে দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব হলে বৈষম্য বৃদ্ধি নিয়ে বিশেষ উদ্বেগের কারণ নেই; দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থিত জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি পেলে আয় বণ্টনের বৈষম্য বৃদ্ধি নিয়ে ভাবনা অকারণ। এই তত্ত্বের একটি চরম রূপ চীনে সংস্কার প্রবর্তনের গোড়ার বছরগুলোতে জনপ্রিয় হয়েছিল, এতে দাবি করা হয়েছিল যে বৈষম্য বৃদ্ধি দারিদ্র্য বিমোচনের সহায়ক। এমন তত্ত্বের সমর্থনে বলা যায় যে মাওবাদী আমলের চরম ও খামখেয়ালি সমতাবাদ উন্নয়নকে এমন বিঘ্নিত করছিল যে তার অবসান দরিদ্রসহ সব মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এটা বড়জোর প্রণোদনাবিনাশী খেয়ালি সমতাবাদের অবসানের পক্ষের যুক্তি; এ ধরনের সমতাবাদী নীতিগুলো নির্মূল করার জন্য চীনের সমাজের বিপুল বৈষম্যায়ন অপ্রয়োজনীয় ছিল। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্যায়ন হওয়ার ফল এই যে অন্যদের তুলনায় দরিদ্রদের আয় বাড়ে ধীরগতিতে, দারিদ্র্য হ্রাস হয় সম্ভাবনাসীমার চেয়ে শ্লথ হারে। সমাজের সামষ্টিক কল্যাণের অহেতুক ক্ষতিস্বীকার ছাড়া একে আর কিছু ভাবা যায় না।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে আরও মৌলিক আপত্তি এই যে প্রবৃদ্ধির সুফলের কিয়দংশ দরিদ্র জনগণের ভাগে পড়লেও সীমাহীন বৈষম্য ন্যায় বিরুদ্ধ, সামাজিক দুর্গতিসূচক এবং স্থায়ী প্রবৃদ্ধির অন্তরায়। সীমিত বৈষম্য স্বীকারযোগ্য, এমনকি কাঙ্ক্ষিত হতে পারে যদি তা প্রবৃদ্ধি-সহায়ক নৈপুণ্য ও প্রণোদনার জন্য প্রয়োজনীয় পুরস্কার থেকে উদ্ভূত হয়। সাম্প্রতিককালে সর্বোচ্চ সম্পদশালী দেশগুলোর মধ্যে অনেকে যে উচ্চমাত্রার সমতা রক্ষা করতে পেরেছে, তাতে প্রমাণ হয় যে ‘সামাজিকভাবে আবশ্যিক’ বৈষম্যের মাত্রা বেশি নয়। এই মাত্রার ঊর্ধ্বে সীমাহীন বৈষম্যায়ন সামাজিক সংহতিতে ভাঙন ধরায়, যে সংহতি সুখী মানবসমাজের অস্তিত্বের অপরিহার্য পূর্বশর্ত (এই প্রবন্ধের শুরুতে উদ্ধৃত উনিশ শতকের একজন অগ্রগণ্য রক্ষণশীল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য লক্ষ করুন)। মাত্রাতিরিক্ত বৈষম্য অন্যায্য। এটা মিথ্যা যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও বাংলাদেশের মতো দেশে বিদ্যমান বৈষম্য বাজার অর্থনীতির ফল। উদাহরণ হিসেবে নেওয়া এই তিনটি ভিন্ন ধরনের দেশে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের অধীনে উচ্চমাত্রায় ক্রমবর্ধমান বৈষম্য উদ্ভূত হতে পারার কারণ এই যে এই দেশগুলোতে শক্তিধর এবং বিত্তবানদের স্বার্থে বাজারকে বিকৃত করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়: রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সুফল সর্বত্রই অধিক হারে ধনীদের কুক্ষিগত হয়েছে; সম্পদশালী যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন-ব্যবস্থা বিত্তবান ও তাদের দালালদের (lobbyist) আর্থিক ক্ষমতা দ্বারা এত দূর প্রভাবিত হয়েছে যে সেখানকার সবচেয়ে ধনী শতকোটি পতিদের অনেকে এখন মধ্য আয়ের লোকদের চেয়ে কম আনুপাতিক হারে কর দেয়; একদিকে ব্যাপক ফাটকাবাজিতে দেউলিয়া ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রীয় তহবিলের সহায়তায় সক্ষম করা হয় আর অন্যদিকে ফাটকাবাজির ফাঁদে পড়া নিম্নবিত্তরা গৃহ-ঋণ পরিশোধে অসমর্থ হলে তাদের বাসস্থান নিলামে ওঠে; রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে দহরম-মহরমের সুবাদে সামাজিক পরজীবীরা রাষ্ট্রীয় ব্যয়-প্রকল্পে ঠিকাদারির অব্যাহত সুযোগ পায়। আকাশচুম্বী বৈষম্যের চাপে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের শ্বাস রোধ হয়। চীন অবশ্য খোলাখুলিভাবেই একদলীয় রাষ্ট্র, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রও কার্যত একটি একদলীয় ব্যবস্থা এই কারণে যে দুই দলের অধিকাংশ কংগ্রেস সদস্যই তাঁবেদারি করেন ধনকুবেরদের, যাঁরা তাঁদের নির্বাচনের ব্যয় বহন করেন। (জেফ্রি স্যাক্স্-এর সাম্প্রতিক একটি গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়: ‘প্রায়ই রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের একমাত্র পার্থক্য বলে যা প্রতীয়মান হয় তা হলো রিপাবলিকানদের মালিকানা বৃহত্ তেল কোম্পানিদের হাতে এবং ডেমোক্র্যাটদের মালিকানা ওয়ালস্ট্রিটের হাতে।’)

সবশেষে বলা দরকার, অতিরিক্ত বৈষম্য সামষ্টিক চাহিদা নিরোধক এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণ। বৈষম্যবর্ধক প্রবৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ ভোগচাহিদা বৃদ্ধির গতি অতি মন্থর; বৈষম্যবর্ধক প্রবৃদ্ধিজাত মন্থর অভ্যন্তরীণ ভোগের ফলে উদ্ভূত ব্যাপক উদ্বৃত্ত আয় ব্যবহার করে চীন যুক্তরাষ্ট্রে এমন সব বিনিয়োগ করছে, যার মুনাফা নগণ্য—পৃথিবীর দুই বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির সমস্যার একই মৌলিক ব্যাখ্যা।

৩. বাঁক-পরিবর্তনের কারণ

বৈষম্যের গতিধারায় বাঁক-বদলের সঙ্গে তিনটি সমকালীন পরিবর্তনের যোগ রয়েছে: বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের পতন; প্রাগ্রসর বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন যাকে আপাতত সংক্ষেপে ‘গোঁড়া বাজারনীতি’ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে; এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দীর্ঘকালীন আমদানি-প্রতিস্থাপক নীতি পরিত্যাগ করে মুক্তবাণিজ্য ও বাজার অর্থনীতির দিকে পদক্ষেপ। কালান্তর সূচক এই পরিবর্তনগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো কীভাবে ব্যাপকতর বৈষম্যায়নের কারণ হয়েছে, এখানে আমি সে সম্বন্ধে আমার নিজস্ব ধারণার কিছুটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা করব।

সমাজতন্ত্রের পতন

মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিকেরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে অভ্যন্তরীণ অসংগতির কারণে পুঁজিবাদের চূড়ান্ত ও অনিবার্য পতন ঘটবে। ইতিহাসের পরিহাস এই যে, সে কারণেই তার নিজের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থার স্থলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের আদেশে পরিচালিত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার প্রবর্তন এই অসংগতির উত্স। অর্থনীতির তাত্ত্বিকদের বর্ণনায় বাজারব্যবস্থা উত্পাদনের উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও ভোক্তাদের মধ্যে ‘সংলাপের’ সুযোগ সৃষ্টি করে, যার ফলে কী, কতটুকু, কী প্রক্রিয়ায় উত্পাদিত হবে এবং উত্পাদিত সম্পদের বণ্টন কীভাবে হবে তা স্থির হয়। এর দুটি প্রয়োজনীয় ফলশ্রুতি: চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং সম্পদের নিপুণতম ব্যবহার নিশ্চিত করা। বাজারব্যবস্থা পুঁজিবাদের অধীনে নিশ্চয়ই একটি শোষণের হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু সে জন্য দায়ী সম্পদ, তথ্য ও ক্ষমতার অসম মালিকানার মতো বাড়তি পুঁজিবাদী প্রবর্তনা। বাজারের এই সংলাপমূলক ও শোষণমূলক ভূমিকার পার্থক্য উপলব্ধি করা অত্যাবশ্যক। সংলাপমূলক ভূমিকায় প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের মতো বাজার নিতান্তই একটি নিপুণ উত্পাদন ও বণ্টনব্যবস্থা কার্যকর করার হাতিয়ার। বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বাজারের শোষণমূলক ভূমিকার কারণগুলো দূর করা কর্তব্য, কিন্তু বাজারের সংলাপমূলক ভূমিকা অব্যাহত রাখা একান্তই আবশ্যিক।৩ বিদ্যমান সমাজতন্ত্র বাজারের এই ভিন্ন ভূমিকা দুটির পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারেনি। এর দৃষ্টিতে পুঁজিবাদী শোষণের অস্ত্র ছাড়া বাজারের অন্য কোনো ভূমিকা অসম্ভব। গোড়া থেকেই এরা সম্পূর্ণভাবে বাজারকে প্রত্যাখ্যান করে এবং উত্পাদন, বণ্টন ও তত্সম্পর্কীয় যাবতীয় কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রীয় আমলাদের সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণাধীন করে। ফলে সম্পদ ব্যবহারের নৈপুণ্য অর্জন এমনকি চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য রক্ষার মতো প্রাথমিক কর্তব্য সম্পন্ন করা অসম্ভব হয়েছিল। গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অনুপস্থিতি, নৃশংসভাবে ভিন্নমত দমন, সমাজতান্ত্রিক ‘সাম্রাজ্যের’ অভ্যন্তরীণ দেশগুলোর স্বায়ত্তশাসনহীনতা ইত্যাদি যেসব বিষয়ের ওপর দোষ আরোপ করা হয়, আমি তাদের গুরুত্ব অস্বীকার করছি না। আমি বলতে চাই, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাব্যবস্থা যে নৈপুণ্যহীন উত্পাদন ও বণ্টন প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা জনগণের বস্তুগত আকাঙ্ক্ষা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল এবং বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ হিসেবে এটাই যথেষ্ট হতে পারত।

আরও একটি পরিহাস এই যে, প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্বে ও পরে বাজারের বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রপরিচালিত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাব্যবস্থার ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল এবং তাতে মোটামুটিভাবে এই ব্যবস্থার অপারঙ্গমতা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘বাজারসদৃশ’ বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার একটি সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, যাতে ভোক্তা, শ্রমিক ও সামাজিক মালিকানাধীন উদ্যোগগুলো অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উত্পাদন ও বণ্টনসম্পর্কিত সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কেন বিদ্যমান সমাজতন্ত্র কখনো এই বিকল্পকে গভীরভাবে বিবেচনা করেনি এবং ‘যদি করত তবে কী হতে পারত’ তার যথাযোগ্য উত্তর আমার জানা নেই।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের ভাঙন শুরু হয়। পরিবর্তন সবার আগে শুরু হয় চীনে, মোটামুটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে তারা ক্রমেই সংস্কারের যে পথ গ্রহণ করেছিল তার পরিণতি হয় একদলীয় শাসনাধীন পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার ইউরোপীয় ও মধ্য-এশীয় ‘সাম্রাজ্য’ এক দশক বা তার চেয়ে কিছু সময় পরে বিপুল বিশৃঙ্খলার পথে পুঁজিবাদী রূপান্তর ঘটায়। বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে এর খেয়ালি সমতাবাদভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থারও ইতি ঘটে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কিছু সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র পূর্ব ইউরোপ ও এশীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বৈষম্যপ্রবণ দেশ হয়ে দাঁড়ায়। তুলনায় কিছুটা ধীরগতিতে, পরিবর্তন শুরু হওয়ার পঁচিশ বছরের মধ্যে, চীন এশিয়ার সবচেয়ে সমতাবাদী দেশ থেকে সবচেয়ে বৈষম্যপ্রবণ দেশের একটিতে রূপান্তরিত হয়।

বৈষম্য সীমিত রাখার লক্ষ্য সম্বন্ধে পুঁঁজিবাদী দেশগুলোর মতৈক্যের অবসান

যুদ্ধোত্তর দশকগুলোতে পুঁজিবাদী বিশ্বের বৈষম্য-পরিহারক সমৃদ্ধির অর্থ এই নয় যে এই দেশগুলো নিজেদের পুঁজিবাদী চরিত্র ত্যাগ করেছিল। এই দশকগুলোতে বেশ কিছু পুঁজিবাদী দেশে আয় বণ্টনে শ্রমিকদের অংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং পুঁজিপতিদের অংশ হ্রাস পেয়েছিল। পুঁজিপতিদের পক্ষে প্রতি-আক্রমণ অনিবার্য ছিল। এই যুদ্ধের প্রথম শিকার হয়েছিল পূর্ণ কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার, যা মজুরি ও জীবনযাত্রা নিয়ে দর-কষাকষিতে শ্রমিকশ্রেণীর শক্তিবৃদ্ধির সহায়ক। ১৯৭০-এর দশকে এসে মুদ্রাস্ফীতি-নিরোধের লক্ষ্যের ওপর পূর্ণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য অর্জনের প্রাধান্যের পূর্বতন প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। ক্রমবর্ধমান হারে রক্ষণশীল মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্য এবং খোলাখুলিভাবে ব্যাপকতর কর্মাভাব-সহনশীলতা রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হয়ে দাঁড়াল। শ্রমিক ইউনিয়নের শক্তি খর্ব করতে এটা যথেষ্ট ছিল না। মজুরি নিয়ে দর-কষাকষি হয়ে থাকে চলতি ক্রয়ক্ষমতার মুদ্রায়। অতএব, পুঁজিপতিদের পক্ষে আয়ের স্বকীয় ভাগ অপরিবর্তিত রাখার সহজ পথ ছিল উত্পাদিত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। এই পথ অনুসরণ করার সমস্যা এই যে, এতে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের মুদ্রার প্রকৃত বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি পায়, যার ফলে দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতাসক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও দেশীয় মুদ্রার প্রকৃত বিনিময়মূল্য স্থিতিশীল রাখার উপায় অবমূল্যায়ন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রেটনউডেস গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিন্যাসের ভিত্তি ছিল বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা; ঘন ঘন অবমূল্যায়নের নীতিকে কঠোরভাবে নিরুত্সাহিত করা হয়েছিল এবং বিনিময় হার স্থির রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। সত্তরের দশকের গোড়াতে সোনার মাপে ডলারের মূল্য নির্ধারণের অবসানের ফলে কার্যকরভাবে স্থিতিশীল বিনিময় হারের ব্রেটনউড্স-নির্ধারিত ব্যবস্থাটির সমাপ্তি ঘটে। ফলে দেশগুলোর পক্ষে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিধানের জন্য মুদ্রার বিনিময় হারের হ্রাস-বৃদ্ধিকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। কিন্তু পুঁজিপতিদের পক্ষে শ্রমিকদের ক্ষমতা দুর্বল করে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হলো বিশ্বব্যাপী পুঁজির অবাধ বিচরণ, যেখানে শ্রম সংগঠিত এবং ব্যয়বহুল, সেখান থেকে যেখানে শ্রম অসংগঠিত এবং সস্তা, সেখানে চলে যাওয়ার স্বাধীনতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে অবাধ বিশ্ববাণিজ্যের ক্রমপ্রসার অব্যাহত ছিল; নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতির বিশ্বায়নে একটি গুণগত ঊর্ধ্বগতির সূচনা হলো সেবার ক্ষেত্রে মুক্তবাণিজ্য, মুক্ত আন্তর্জাতিক পুঁজি সঞ্চরণ, মেধাস্বত্বের সুরক্ষা ইত্যাদি ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে। রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্রিটেনে ১৯৭৯ সালে মার্গারেট থ্যাচারের এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮০ সালে রোনাল্ড রেগানের বিজয়ের ফলে শিল্প-বাণিজ্য-অর্থায়নে নিয়ন্ত্রণ-শৈথিল্য, বিরাষ্ট্রীয়করণ ও ব্যক্তিমালিকানার প্রসার, রাজস্ব কর হ্রাস, পুনর্বণ্টনমূলক ব্যবস্থার সংকোচন, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ হ্রাস ইত্যাদি পরিবর্তনের যুগ সূচিত হয়।

অনেক বিশ্লেষক ক্রমবর্ধিষ্ণু বৈষম্যের জন্য দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং তার ফলে উদ্ভূত দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীদের আয়-পার্থক্যের বিস্তারকে দায়ী করেছেন। বৈষম্য বিস্তারে হয়তো এর কিছু ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু কোনোক্রমেই স্বীকার করা সম্ভব নয় যে, এ ধরনের অপ্রতিরোধ্য ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াই বৈষম্য বৃদ্ধির মূল কারণ। আমরা দেখেছি, ধনাঢ্যতার শিখরের ১ শতাংশের আয় বৃদ্ধি হয়েছে সর্বোচ্চ হারে। একে কোনোক্রমেই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন দিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে না, এই আয় শ্রমদক্ষতার ফসল নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ-শৈথিল্য, কর হ্রাস এবং ধনাঢ্যদের স্বার্থে প্রবর্তিত অন্যান্য পুনর্বণ্টন-সংক্রান্ত নীতির ফল। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রযুক্তিগত শিক্ষার সম্প্রসারণ দ্বারা দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীদের মধ্যকার আয়-বৈষম্যকে সীমিত রাখা সম্ভব ছিল। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি।

এই কালপর্বে সামাজিক গণতন্ত্রেও বৈষম্য বৃদ্ধি হয়েছে। এর কারণ কী? সামাজিক গণতন্ত্রও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যদিও পুঁজিবাদ সেখানে ব্যাপক সামাজিক নিয়ন্ত্রণাধীন। বিশ্বায়ন-সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনের সঙ্গে এদের অর্থনীতিকেও সমন্বিত করতে হয়েছে। বিশেষত অর্থনীতির আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা রক্ষা করার জন্য উত্পাদন ব্যয়ে শ্রমের মূল্যকে সীমিত করতে হয়েছে, শ্রমিকদের অবসর গ্রহণের বয়স বাড়াতে ও সুযোগ-সুবিধা কমাতে হয়েছে, দেশত্যাগের প্রবণতা নিবারণের জন্য পুঁজির মুনাফার ওপর কর হ্রাস করতে হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থার সপক্ষে শক্তিশালী মতৈক্যের ফলে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তন এড়ানো গেছে।

উন্নয়নশীল বিশ্ব

ব্যতিক্রমী ধারার বৈষম্যবিরোধী, উন্মুক্ত উন্নয়ননীতি অনুসারী মুষ্টিমেয় পূর্ব এশীয় দেশ বাদে বাকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেকাংশে একধরনের আমদানি-প্রতিস্থাপক শিল্পায়ন (import-substituting industrialization, যাকে সংক্ষেপে অন্তর্মুখী উন্নয়ন নামে অভিহিত করছি), আর সেই সঙ্গে নানা মাত্রার রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রচলিত ছিল। অন্তর্মুখী উন্নয়নের অকার্যকারিতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আগে বাইরে থেকে আমদানি করা হতো এমন সব পণ্য ও সেবার অভ্যন্তরীণ উত্পাদনকে প্রণোদিত করার জন্য এটি যে প্রতিরক্ষার প্রাচীর সৃষ্টি করে, তার ফলে রপ্তানির প্রতি বৈষম্য এবং ভিন্ন ভিন্ন পণ্য ও সেবার প্রতিরক্ষার হারে উচ্চমাত্রায় হেরফের অবশ্যম্ভাবী। ফলশ্রুতি হিসেবে উত্পাদনের নৈপুণ্য হ্রাস পায়। ভোক্তা ও প্রাথমিক রপ্তানির উত্পাদক স্বল্পবিত্ত কৃষকদের জন্য হানিকর এবং শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধাজনক এই উন্নয়ননীতির প্রভাব সামগ্রিক আয় বণ্টনের ওপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিকূল। এসব দেশের শাসকদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ সমতাবাদ প্রায়ই ভূমি সংস্কারের নামমাত্র উদ্যোগ, খাদ্য ভর্তুকি, উত্পাদক দ্রব্যসমূহের জোগানে সরকারি উদ্যোগ এবং অন্যান্য ছোটখাটো পুনর্বণ্টনমূলক পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ থেকেছে।

ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে অর্থনীতিবিদদের সমালোচনায় অন্তর্মুখী শিল্পায়নের অনির্ভরযোগ্যতা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো উন্নয়ন সংস্থাগুলো এই ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য সুপারিশ শুরু করে। আশির দশকে এসব সংস্থা এবং শিল্পোন্নত দাতা দেশগুলো ঋণ-সংকটে কাবু লাতিন আমেরিকার ওপর ‘কাঠামোগত সংস্কার’ নামক একধরনের ঋণের শর্তাবলির মাধ্যমে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পায়। ক্রমশ উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিরক্ষার প্রাচীর উঠিয়ে নিতে শুরু করে এবং শুল্ক ও অন্যান্য আমদানি-প্রতিরোধক বাধা অনেক কমিয়ে আনে। বৈদেশিক বাণিজ্য সংস্কারের সঙ্গে আসে তথাকথিত ‘ওয়াশিংটন মতৈক্যের’ অন্যান্য উপাদান: বিরাষ্ট্রীয়করণ, নিয়ন্ত্রণ-শৈথিল্য, ভর্তুকি হ্রাস, বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য ইত্যাদি। একদিকে যেমন ঋণ সংগ্রহের প্রয়োজনে কিছু দেশ বাধ্য হয়ে ঋণের শর্ত হিসেবে সংস্কার মেনে নিয়েছিল, অন্যদিকে চিলি, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ অন্তর্মুখী উন্নয়ননীতির অকার্যকারিতা এবং বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুবিধা অনুধাবন করে স্বেচ্ছাপ্রসূত হয়ে সংস্কার গ্রহণ করেছিল।

শ্রমশক্তির প্রাচুর্য এবং পুঁজির অপ্রতুলতা দ্বারা চিহ্নিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রথাগত অর্থনীতিতত্ত্ব দাবি করে যে, প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা থেকে অবাধ বাণিজ্যে উত্তরণের ফলে উত্পাদন নৈপুণ্য বৃদ্ধি ছাড়াও বণ্টন-বৈষম্যের হ্রাস হয়। অবাধতর বাণিজ্যের ফলে এসব দেশে উত্পাদন ও রপ্তানিতে অধিকতর শ্রমনিবিড় পণ্য ও সেবার অংশ বাড়বে। ফলে শ্রমের চাহিদা বাড়বে এবং শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার পুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির হারের চেয়ে দ্রুততর হবে। লক্ষণীয় যে পুঁজি-সমৃদ্ধ ও শ্রম-অপ্রতুল শিল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বিপরীত; এই দেশগুলো অবাধতর বাণিজ্য অবলম্বন করলে মজুরি বৃদ্ধি হবে মুনাফা বৃদ্ধির চেয়ে শ্লথহারে। দেখা যাচ্ছে, যুগপত্ বৃহত্তর উত্পাদন নৈপুণ্য ও সমতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থনীতিতত্ত্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে অবাধ বাণিজ্যের সপক্ষে অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য রেখেছে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, যেসব উন্নয়নশীল দেশ অন্তর্মুখী নীতি বর্জন করে বিশ্বায়নের পথে অবাধ বাণিজ্যের পদক্ষেপ নিয়েছে, সেসব দেশে আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রায়ই নাটকীয়ভাবে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অনুমানবিরুদ্ধ ফলাফল ব্যাপকভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। আমার কিছু রচনায় এর যে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তার একটি সংক্ষিপ্তসার দিচ্ছি।

অন্যান্য অধিকাংশ অর্থনৈতিক তত্ত্বের মতো বাণিজ্যতত্ত্ব-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি রূপান্তরকালীন সমস্যা ও ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করে। অন্তর্মুখী দেশগুলোর উত্পাদনের বৃহদংশই নানাবিধ অনৈপুণ্যতায় ভুগে থাকে। উদাহরণ হিসেবে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের উল্লেখ করা যেতে পারে। মাওবাদী আমলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনীয় কর্মীর চাইতে অনেক বেশি ছিল। ‘সমাজতন্ত্রে বেকারী অসম্ভব’—এই তত্ত্বকে সত্য প্রমাণ করার দায়ে রাষ্ট্রের উদ্যোগসমূহে কর্মসংস্থানকে দেখা হতো বেকার-ভাতার গোপন বিকল্প হিসেবে (একই ঘটনা ভারতের মতো বহু মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঘটেছে, এসব দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে নিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা উত্পাদনের প্রয়োজনকে প্রায়ই অনেক ব্যবধানে ছাড়িয়ে গেছে)। অন্তর্মুখী নীতি বর্জনের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার যুগে নতুন রপ্তানিমুখী শিল্পোদ্যোগের উদ্ভব হলো, যা সংগতভাবেই শ্রমনিবিড় এবং দ্রুতহারে কর্মসংস্থানে সক্ষম। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এদের সঙ্গে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার চাপে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া উদ্বৃত্ত কর্মীদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হলো। বিশাল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিপুল উদ্বৃত্ত কর্মীর ছাঁটাইয়ের সংখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল নতুন শিল্পোদ্যোগে নিয়োজিত কর্মসংস্থানের চাইতে বেশি। ফলে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে উত্পাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও সামগ্রিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতি ছিল অত্যন্ত ধীর, কখনো নেতিবাচক। রূপান্তরের এই কর্মসংস্থানক্ষীণ কাল চীনে কয়েক দশক স্থায়ী ছিল, যখন বিপুল প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও স্বল্পবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা সামান্যই উন্নত হয়েছিল।

উন্নয়নশীল দেশগুলো অন্তর্মুখী নীতি বর্জন করার সন্ধিক্ষণে প্রায়ই মুদ্রাস্ফীতি, রাষ্ট্রীয় ঋণাধিক্য, বহির্বাণিজ্যে ঘাটতি—সামষ্টিক অর্থনীতির এই সব ভারসাম্যহীনতায় আক্রান্ত ছিল। এই সময়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসমূহ এবং দাতা দেশগুলোর চাপের মুখে এই দেশগুলো রাষ্ট্রের ব্যয় সংকোচ ও মুদ্রাসংকোচনের নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সামষ্টিক ভারসাম্য বিধানের পদ্ধতিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল প্রবৃদ্ধি অপহারক, এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থে প্রবর্তিত ব্যবস্থাগুলোর অর্থায়নেও বাধা পড়ত। খুব কম ক্ষেত্রেই জাতীয় নীতিনির্ধারকেরা দরিদ্রদের সুবিধাগুলো সংরক্ষণ করতে সক্ষম হতেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সুবিধাগুলো হ্রাস করা অনিবার্য হয়ে যেত, যেমন: খাদ্য ভর্তুকি ও ক্ষুদ্র উত্পাদনের ভর্তুকি হ্রাস করা এবং প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সংকোচ করা।

এসব দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অন্তঃপ্রবাহও ছিল ব্যাপক বৈষম্যপ্রবণ। এর ঝোঁক ছিল তুলনামূলকভাবে সম্পদশালী অঞ্চলে পুঞ্জীভূত হওয়ার দিকে, যেখানে উন্নত অবকাঠামো ও দক্ষ শ্রমের জোগান রয়েছে। আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধির ফলাফল হিসেবে সামগ্রিক আয় বণ্টনের বৈষম্যও বেড়ে যায়।

সবশেষে, কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের জন্য বিভিন্ন দেশে বিশ্বায়নের ফলে বৈষম্যায়নের মাত্রা অর্থনীতিবিদদের তাত্ত্বিক ধারণাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। ভারতের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তাত্ত্বিক ধারণাকে নস্যাত্ করে দিয়ে বিশ্বায়নের কালে ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধির বৃহদংশ ছিল কর্মসংস্থান-প্রতিকূল পণ্য ও সেবার সমষ্টি, যে পণ্য ও সেবা উত্পাদনে অদক্ষ ও দরিদ্র শ্রমিকদের অল্পই ব্যবহার করা হয়। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত রপ্তানির বৃহদংশ ছিল দক্ষ শ্রমনিবিড় পণ্য ও সেবার সমষ্টি। এই সব শ্রমকর্মী ছিল আয় বণ্টন-সোপানের শীর্ষে। এ ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়ে গেল বৈষম্যবর্ধক। এর কারণ বোঝা কঠিন নয়। বিশ্বায়নের অনেক আগেই ভারত সুদক্ষ মানবসম্পদের উদ্বৃত্ত জোগান অর্জন করেছিল। এর কারণ নেহরু আমল থেকে প্রযুক্তিগত উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ, যা অতীতে সমালোচনার বিষয় হয়েছিল। প্রযুক্তিগত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানবসম্পদের প্রাচুর্য এবং ইংরেজি ভাষার ব্যাপক প্রচলনের ফলে তথ্যপ্রযুক্তির মতো পণ্য ও সেবায় ভারতের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আগেই। বিশ্বায়নের কালে এই সব পণ্য ও সেবার চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ ভারত তাই সহজেই নিতে পেরেছিল।

যথাযোগ্য জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রোদ্যোগের মাধ্যমে ওপরে বর্ণিত চাপগুলোর প্রভাব থেকে আয় বণ্টন-বৈষম্যকে রক্ষা করা যেত: প্রবৃদ্ধির কর্মসংস্থান-বিদ্বেষকে পুষিয়ে নেওয়া যেত বড় মাপের গণকর্মসংস্থানকারী রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ দিয়ে, যদি রাষ্ট্রীয় বাজেটে ভারসাম্যের চাপকে শিথিল করা যেত অথবা চীনের ক্ষেত্রে জাতীয় সঞ্চয়ের যে বিপুল অংশ মার্কিন সরকারকে ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়, তার একাংশ এ ধরনের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে নিয়োগ করা হতো; রাষ্ট্রীয় আয় ও ব্যয়ের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে যদি স্বল্পবিত্তদের সেবা ও সুবিধা সংরক্ষণ করা যেত। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু দেশে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, আমরা নিচে তা আলোচনা করব। কিন্তু গত তিন দশকের অধিকাংশ সময়ে বর্ধিষ্ণু বৈষম্যের গতিরোধের লক্ষ্যে সামান্যই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

ব্যাপক বৈষম্য-সহিষ্ণুতার কারণ

‘শ্রেণীসংগ্রাম অবশ্যই চলছে। কিন্তু এই সংগ্রাম পরিচালনা করছে আমাদের ধনিক শ্রেণী এবং এই সংগ্রামে আমাদের জয় হচ্ছে’—কথাটা বলেছেন আমেরিকার অগ্রগণ্য উদ্যোক্তা এবং বিশ্বের ধনাঢ্যতম ব্যক্তিদের অন্যতম ওয়ারেন বাফেট। এই অর্থবহ বক্তব্য একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন-চতুর্থাংশে শ্রমজীবী মানুষ পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ অবিচারের প্রতিরোধে সমাজের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ক্রমান্বয়ে সাফল্য অর্জন করেছিল। গত তিন দশক সময়ে দলগুলোর ভূমিকা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে: সুবিধাভোগী বিত্তবান শ্রেণী এই সংগ্রামে আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আয় ও সম্পদ বণ্টনে তাদের হূত অংশ পুনরুদ্ধার করেছে। যাকে একসময় পুঁজিবাদ উচ্ছেদের, অন্ততপক্ষে পুঁজিবাদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার, ঐতিহাসিক গতি মনে করা হতো, তাকে তারা কেমন করে স্তব্ধ করে পাল্টে দিতে পারল? প্রসঙ্গটি বিরাট। এর সদুত্তর খুঁজে পাওয়া কেবল একক ব্যক্তির নয়, সমাজবিজ্ঞানের কোনো একক শাখার সাধ্যাতীত। আমি কয়েকটি প্রাথমিক ভাবনার উল্লেখ করব।

সমাজতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জের সমাপ্তি

আমি এই অবস্থান নিয়েছি যে বিদ্যমান ‘মার্ক্সীয়’ সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলো ছিল সমাজতন্ত্রের ধারণার বিকৃতি; সমাজতন্ত্রের ধারণা বাস্তবায়িত হওয়ার আরও অনেক মহতী পন্থার অস্তিত্ব থাকা উচিত ছিল। বিদ্যমান সমাজতন্ত্র ছিল অর্থনীতিতে নৈপুণ্যহীন, সামাজিকভাবে অরাজক, নান্দনিকতায় বন্ধ্যা এবং রাজনীতিতে নিপীড়ক। তা সত্ত্বেও এই বিশ্বাসের শক্তি এবং দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে মন্দায় আক্রান্ত পুঁজিবাদী বিশ্বের সমস্যার তুলনায় বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের তত্কালীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আবেদন এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে ষাটের দশকের মতো অধুনাতন সময় পর্যন্ত অনেক প্রভাবশালী পাশ্চাত্য অর্থনীতিবিদ এই ব্যবস্থাটিকে পুঁজিবাদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করতেন। এই ধারণার প্রভাব পুঁজিবাদী বিশ্বের আচরণকে অনেকটা সংযত করে তুলেছিল। যুদ্ধোত্তর ইউরোপের পুনর্গঠন, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পূর্ণ কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার, বৃহত্তর জনসাধারণের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশ বণ্টনের রাজনৈতিক প্রয়োজনবোধ, তৃতীয় বিশ্বের অসমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য আর্থিক সাহায্য—এ সবই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধোত্তর পূর্ব এশিয়ার সমতাবাদী ভূমি সংস্কারে দখলদারী মার্কিন সামরিক শাসন উত্সাহ জুগিয়েছিল, এমনকি জাপানের ওপর ভূমি সংস্কার চাপিয়ে দিয়েছিল। সক্ষম অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি সত্তরের দশকে, এই ব্যবস্থার পতনের অনেক আগেই, ক্রমশ উবে যায়। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী বিশ্বের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সংযমেরও ক্রমাবসান ঘটে। শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অস্ত্র হিসেবে পূর্ণ কর্মসংস্থান লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বস্ততা পরিত্যক্ত হয়, বিশ্বায়নের প্রস্তুতি শুরু হয়। পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বত্র এই শ্রেণীসংগ্রামের তীব্রতা সমান ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো গোঁড়া বাজারনীতির দেশগুলোতে এর রূপ ছিল চূড়ান্ত, কিন্তু সামাজিক গণতন্ত্রের দেশগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে আয় বণ্টনের ব্যাপারে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার এবং শ্রমজীবীদের সুযোগ-সুবিধার সীমিত সংকোচনের চেষ্টা ছিল।

সমাজতন্ত্রের পতন উন্নয়নশীল বিশ্বেও গভীর প্রভাব ফেলে। ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত এই দেশগুলোর অনেকেই বিশ্বযুদ্ধের পর অপুঁজিবাদী উন্নয়নের পথ খুঁজছিল। ভারতের মতো দেশে মুখ্যত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তিত থাকলেও সমাজতন্ত্রের প্রতি একধরনের মৌখিক আনুগত্য চালু ছিল। বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের বিলোপের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিমুখীনতায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়। এদের অধিকাংশ এই অসমর্থনযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের পতন ব্যাপক পুনর্বণ্টন ও সমতাবাদী নীতির পরিসমাপ্তির সূচক। সমাজতন্ত্রের পতনের এটি একটি বাড়তি নেতিবাচক ফলশ্রুতি, এমনকি ‘সমাজতন্ত্র’ বহুজনের কাছে একটি নোংরা শব্দে পরিণত হওয়ার ফলে সাধারণভাবে সমাজতান্ত্রিক ধারণায় অনুপ্রাণিত যারা বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের বিকৃত রূপটির সমালোচক এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমতাবাদের অনুসারী, তাদেরও বড় মূল্য দিতে হয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে যেসব শক্তি দীর্ঘকাল ধরে আমদানি-প্রতিস্থাপক শিল্পায়ন এবং রাষ্ট্রবাদী নীতির ঘোর সমালোচক ছিল, তারা অভ্যন্তরীণ উন্নয়ননীতিতে ব্যাপক মাত্রায় পরিবর্তন নিয়ে আসার এই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করল। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো বিশ্বায়নের সঙ্গে এসব দেশকে যুক্ত করা, বিরাষ্ট্রীয়করণকে উত্সাহিত করা, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে কমিয়ে আনা ইত্যাদি লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায় এসব শক্তির মধ্যে তাদের অভ্যন্তরীণ মিত্র খুঁজে পেল।

পুঁজিবাদের পরিবর্তিত চরিত্র

আমার প্রজন্মের যারা তরুণ বয়সে পুঁজিবাদ সম্বন্ধে সংশয় পোষণ করা শুরু করেছিল, তাদের কাছে এই ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ছিল অনেকটা এ রকম: একদিকে ঝাঁক বেঁধে বিভিন্ন কারখানায় রয়েছে বিপুলসংখ্যক শোষিত শ্রমিক, অন্যদিকে গুটিকয়েক পুঁজিপতি, যাদের শোষণক্ষমতার উত্স হচ্ছে উত্পাদনযন্ত্র তথা পুঁজির নিরঙ্কুশ মালিকানা। পুঁজিপতিদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্পাদনযন্ত্রের ওপর কর্তৃত্ব করায়ত্ত করার লক্ষ্যে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধই হচ্ছে পুঁজিবাদী অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূল অস্ত্র।

পুঁজিবাদের এই চিত্রটি বহুকাল যাবত্ ছিল একটি অতি সরলীকরণ। সময়ের পরিবর্তনে এই চিত্রটি আরও বেশি বাস্তবতাবিবর্জিত হয়ে গেছে। এর একটি কারণ এই যে, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে কারখানায় নিয়োজিত শিল্পশ্রমিকদের আনুপাতিক সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। সর্বোচ্চ থাকাকালীন এসব দেশে শিল্পে নিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা ছিল মোট শ্রমশক্তির অর্ধেকের কাছাকাছি। তুলনায় এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে এই হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি, ফ্রান্সে ১৩ শতাংশ আর উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এ দিক থেকে ব্যতিক্রমী জার্মানিতে ২০ শতাংশ। কর্মসংস্থানের একটি বিশাল অংশজুড়ে এখন রয়েছে এমন সব সেবা খাত, যেখানে প্রথাগত শ্রমিক সংহতি গড়ে তোলা খুবই কঠিন। শিল্পায়নের ঐতিহাসিক পথ ধরে এগোনোর পথে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিল্পশ্রমিকদের সংখ্যা মোট শ্রমশক্তির অন্তত ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উঠবে, এই স্বাভাবিক প্রত্যাশা পূর্ণ হচ্ছে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালের সফল শিল্পায়নের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে এই সূচক ৩০ শতাংশের কাছাকাছি ওঠার পর থেকেই নিম্নাভিমুখী হতে শুরু করেছে।

পুঁজির মালিকানা ও পুঁজি থেকে উদ্বৃত্ত গ্রাস করার ক্ষমতার মধ্যে বিচ্ছেদ শুরু হয়েছে অনেক কাল আগে। আজকের পুঁজিবাদের স্টক-শেয়ারের মালিকানা বহু বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় অর্ধেক পরিবার এ ধরনের মালিকানা ভোগ করে; যদিও এসব সম্পত্তির মালিকানা অত্যন্ত অসম। উচ্চস্তরের ব্যবস্থাপকদের আয় প্রায়ই আকাশচুম্বী এবং এই আয়ের পরিমাণ ব্যবস্থাপকদের হাতে উদ্যোগগুলোর মালিকানার পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়। পুঁজির মালিকানা নয়, বরং পুঁজি-ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্বই উচ্চস্তরের ব্যবস্থাপকদের ক্ষমতার উত্স, যে ক্ষমতা তাদের নিজস্ব আয় নির্ধারণের প্রধান নিয়ামক। ব্যাংক, বিমা ও সংশ্লিষ্ট (finance) ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে সত্যি; সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নিয়ন্ত্রণ শৈথিল্যের ফলে এটি আয় ও সম্পদের পুঞ্জীভবনের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্টক-শেয়ারের পরিব্যাপ্ত মালিকানা শ্রমিকশ্রেণীকে কোনো ক্ষমতায় ভূষিত করেনি, বরং নির্বিত্ত হিসেবে তাদের শ্রেণীগত সংহতিকে দুর্বল করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিরন্তর জনগণকে এই ভ্রান্ত ধারণা দিচ্ছে যে, এ দেশে শ্রেণী উত্তরণের ঊর্ধ্বমুখী সচলতা অনেক বেশি। বাস্তব এই যে, স্বল্পবিত্তদের পক্ষে ওপরে ওঠা ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে কঠিন হয়ে উঠেছে। ২০১০ সালের একটি ওইসিডি (OECD) প্রতিবেদন অনুযায়ী সচলতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইউরোপের সামাজিক-গণতন্ত্রবাদী দেশগুলোর চেয়ে অনেক নিচে, বস্তুত কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ার চেয়েও নিচে। ব্রিটেন আর ইতালিই একমাত্র ইউরোপীয় দেশ, যেখানে শ্রেণী উত্তরণের ঊর্ধ্বমুখী সচলতা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম। সে যাই হোক, নিম্নবিত্তদের আত্মপরিচয়বোধের পরিবর্তন ক্রমবর্ধিষ্ণু বৈষম্য-সহিষ্ণুতার সহায়ক হয়েছে। মনে পড়ে জন স্টাইনবেকের গভীর অন্তর্দৃষ্টিসূচক বক্তব্য: ‘আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের শিকড় পুঁততে না পারার কারণ এই যে, এখানকার দরিদ্ররা নিজেদের শোষিত নির্বিত্তশ্রেণী মনে করে না, বরং সাময়িকভাবে বিব্রত ক্রোড়পতি মনে করে।’

উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে বৈষম্য প্রশমনের গুরুত্ব হ্রাস

উন্নয়ন পরিভাষার একটি পরিবর্তন কালক্রমে উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহের তুলনামূলক অগ্রাধিকারে পরিবর্তন এনেছে। সত্তরের দশকের শেষদিকে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো দারিদ্র্য বিমোচনকে প্রধান উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে গ্রহণ করে। ক্রমশ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যকে বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার সপক্ষে একটি যুক্তি গড়ে ওঠে। বাস্তবে উন্নয়ননীতি প্রণয়নের আলোচনা থেকে বণ্টনবৈষম্যের প্রসঙ্গটি একেবারে উবে যায়। চীনে মাও-পরবর্তী সংস্কারবাদীদের ‘সমতাবাদ ঠেকাও’ ধ্বনি পর্যন্ত না গেলেও, উত্তরোত্তর কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে হলেও তর্কটা এই দাঁড়িয়েছিল যে বৈষম্য অনেক ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির সহায়ক এবং প্রবৃদ্ধি দারিদ্র মোচন ত্বরান্বিত করে; অতএব বৈষম্য-সহিষ্ণুতা প্রার্থিত হতে পারে। ‘দারিদ্র্য হটাও’, ‘চরম দারিদ্র্য হটাও’, ‘দরিদ্রদের ক্ষমতা বাড়াও’, ‘সবার জন্য উন্নয়ন’—এই অন্তহীন স্লোগানের মিছিলে এসব লক্ষ্যের সঙ্গে বৈষম্য হ্রাসের আবশ্যিক সম্পর্কটির কথা প্রায়শই অনুল্লিখিত থেকে গেছে।

৪. ভবিষ্যত্

মহামন্দার প্রথম বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বস্তরের মানুষের আয় হ্রাস হয়েছিল, যেমনটি বেশির ভাগ শিল্পোন্নত দেশের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। ২০১০ সাল থেকেই ধনীরা ধাক্কা সামলে নিয়েছে, ওয়ালস্ট্রিটের সমৃদ্ধি এবং উঁচু হারে বোনাস ফিরে এসেছে, আর সেই সঙ্গে দরিদ্র ও স্বল্পবিত্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। উচ্চমাত্রার বৈষম্য এ সমস্ত দেশের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোগ-চাহিদার হ্রাস মন্দার একটি প্রধান কারণ। যুক্তরাষ্ট্রে ভোগ-চাহিদায় অচলাবস্থা আয় বণ্টনের সর্বস্তরে ঘটেনি: ২০১১ সালের গোড়ায় প্রকাশিত অতিক্রান্ত ছুটির মৌসুমের তথ্য নির্দেশ করে যে অভিজাত পণ্যের বিক্রেতারা চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল যখন সাধারণ পণ্যদ্রব্যের চাহিদা গুরুতরভাবে কমে গিয়েছিল। অর্থাত্ বিপুল বণ্টনবৈষম্য অর্থনৈতিক পুনরুত্থান ও প্রবৃদ্ধির গতিরোধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আশা করা সমীচীন ছিল যে নীতিনির্ধারকেরা ব্যাপক জনসাধারণের আয় বৃদ্ধি ও কর্মাভাব হ্রাসের প্রতি মনোযোগী হবেন। অথচ তাঁরা পরিবর্তে এলিসের কল্পপৃথিবীতে হাবুডুবু খাচ্ছেন: রাষ্ট্রীয় দেনা কমানোর নামে সামষ্টিক চাহিদাকে আরও কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন।

বৈষম্য সহিষ্ণুতা প্রান্তসীমায় পৌঁছেছে। ‘নিজের দেশের চেয়ে বিশ্বের সান্নিধ্যে অধিকতর স্বচ্ছন্দ নগর’ নিউইয়র্কে৪ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ওয়ালস্ট্রিট দখল’ আন্দোলনের জন্ম হয় দুঃসহ বৈষম্যের বিরুদ্ধে; ব্যাংক, বীমা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের উঁচুতলার নির্বাহীদের লুণ্ঠনমূলক উদ্বৃত্ত হরণ এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সর্বনাশ সাধনের প্রতিবাদে। তিন দশক আগে ধনিক শ্রেণী শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে যে শ্রেণী-সংগ্রাম শুরু করেছিল তার বিরুদ্ধে প্রথম বড় মাপের পাল্টা আক্রমণ হিসেবে খুব দ্রুত এই আন্দোলন বিশ্বের অনেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের পরিণতি সম্বন্ধে এখনো নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও, এর ফলে বিশ্বব্যাপী বৈষম্য-সচেতনতা গড়ে ওঠার বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। ২০১২ সালে বৈষম্যের সমস্যা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ, প্রকাশ হয়েছে বিশিষ্ট পত্রপত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ ক্রোড়পত্র, যার কিছু নমুনা এই প্রবন্ধের সংযোজনে উল্লেখ করা হয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তুলনায় আন্তর্জাতিকভাবে কম দৃশ্যমান হলেও, প্রচুর অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়েছে। কৌতূহলোদ্দীপক এই যে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সর্বাধিক দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশ চীন ও ভারত যেখানে সরকার ও বিশ্বব্যাংক উভয়েরই হিসাব অনুযায়ী সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস হয়েছে। তা সত্ত্বেও, ভারতের বিস্তৃত ভূখণ্ড কার্যত বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে, চীনে প্রতিদিন বিচ্ছিন্ন সহিংসতার খবর শোনা যাচ্ছে। দুই ক্ষেত্রেই বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য বৈষম্যের দুঃসহ বৃদ্ধি।

ভবিষ্যতে বৈষম্যের গতিধারা সম্বন্ধে আলোচনার আগে বর্তমানকালের আশাব্যঞ্জক কিছু ব্যতিক্রমের উল্লেখ করা প্রয়োজন। ইউরোপের সামাজিক গণতন্ত্রের দেশগুলো তাদের সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী মোটামুটি অটুট রেখেছে, যদিও ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে বিশ্বায়নের মোকাবিলা করতে গিয়ে তারা যেসব পরিবর্তন গ্রহণ করেছে তাতে সর্বত্রই বৈষম্য কিছুটা বেড়েছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পুরোনো সামাজিক গণতন্ত্রগুলোতে আয় বণ্টনের সমতা এখনো মোটামুটি ২৫ জিনি সূচকের আশপাশে রয়েছে। এসব দেশেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু গত তিন দশকের সমস্যাগুলোর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে সীমিত রাখার লক্ষ্যে এরা একটি সামাজিক মতৈক্যে পৌঁছাতে পেরেছে। যে স্বল্পসংখ্যক পূর্ব এশীয় দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বৈষম্য পরিহারী, রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধির পথ অবলম্বন করেছিল তাদেরও বণ্টনসমতার ক্ষেত্রে অল্পই পিছু হটতে হয়েছে।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশাপ্রদ অতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা। এই অঞ্চলটি ২০০৮-০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকট ভালোভাবেই প্রতিহত করতে পেরেছে। তুলনামূলক মানদণ্ডে বৈষম্যের মাত্রা খুব বেশি হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে বৈষম্য কমতে শুরু করেছে। বিষয়টি নিয়ে এখন গবেষকদের অনুসন্ধান চলছে। প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে যে এই প্রবণতার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে দেশে দেশে পার্থক্য থাকলেও কিছু উপাদান সর্বত্র কাজ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয় নীতিনির্ধারণে দরিদ্রদের অগ্রাধিকার, দরিদ্রদের সুবিধার্থে অধিকতর ব্যয় বরাদ্দ। চিলি ও ব্রাজিলের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা-সম্পর্কিত তথ্য ভালোভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে নিম্নগামিতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের ইতিবাচক পরিবর্তন এই প্রবণতার সহায়ক হয়েছে।

প্রতিরোধ ও ইতিবাচক পরিবর্তনের পদক্ষেপগুলো কি তিন দশকের বৈষম্য-প্রবণতাকে শেষ পর্যন্ত রোধ করতে এবং পালটে দিতে পারবে? যদি পারে তবে তখনকার পরিবর্তিত চেহারাটা কেমন হবে? স্বল্পতর বৈষম্যের সমাজে বিবর্তনের পথের বিস্তৃত বিবরণ এবং তা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় নীতির খুঁটিনাটি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা অর্থহীন। বরং উপসংহারে এমন কয়েকটি প্রধান বিষয়ের ওপর দৃষ্টিক্ষেপ করতে চাই বৈষম্য হ্রাসের ভবিষ্যত্ রূপরেখা নির্ণয়ে যা নিয়ে ভাবনা অপরিহার্য।

সাবেকী মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন গ্রহণযোগ্য বিকল্প নয়

শিল্পোন্নত দেশগুলোতে, যেমনটি প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে, এই বিকল্পটি মোটের ওপর পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশে এই লক্ষ্য অর্জনের অবাস্তব প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নেপালে মাওবাদী অভ্যুত্থান এবং ভারতের নানা ধরনের গণবিদ্রোহ থেকে শুরু করে অনেক দেশে বিদ্যমান মার্ক্সবাদী দল ও উপদলের মধ্যে এর প্রভূত উদাহরণ রয়েছে। এরা যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করতে পেরেছে তার প্রমাণ সামান্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছে ব্যবস্থাটির অভ্যন্তরীণ অসংগতিকে নয়, বরং অতীতের পরিহারযোগ্য ভুলভ্রান্তিকে, সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকে, যেন বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যের পূর্বশর্ত ছিল সাম্রাজ্যবাদের সদাশয় প্রশ্রয়! দক্ষিণ এশিয়ার এ ধরনের কিছু কিছু দলের সদস্যদের যদি প্রশ্ন করা হয় যে কোনো অকল্পনীয় পথে তারা যদি নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করে তবে যৌথ কৃষি ব্যবস্থা, শিল্প ও সেবা খাতের সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় মালিকানা এবং আমলা নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার মতো নীতিগুলো সম্বন্ধে তারা কী করবে, তবে তাদের উত্তরে নতুন ভাবনার চিহ্ন থাকে অতি সামান্য; প্রায় অনিবার্যভাবেই তাদের উত্তর হয় যে তারা একই নীতি প্রয়োগ করবে, যদিও প্রয়োগের পন্থায় অতীতের ভুলভ্রান্তি পরিহার করা হবে, যেমন সহিংস বলপ্রয়োগের পরিবর্তে যুক্তি ও আলোচনার ব্যবহার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা স্বীকার করে যে গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যানের নীতিটি ভুল ছিল; কিন্তু বাজারব্যবস্থার বিলোপ নিয়ে তাদের অনুশোচনার চিহ্ন বিরল। ভবিষ্যতে এই মার্ক্সবাদীদের পক্ষে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা সামান্য। কিন্তু অবাস্তব লক্ষ্যের পেছনে ছোটা অকারণ শক্তিক্ষয়। বড় মাপের সংগঠিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ ধরনের শক্তিক্ষয় পরিহারযোগ্য সামাজিক অপচয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, মূলধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া নেপালের মাওবাদীদের পক্ষে একটি সদর্থক পদক্ষেপ। একই কথা ভারতের বিদ্রোহী আন্দোলনগুলো সম্বন্ধেও সত্যি, বৈষম্য ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের আত্মত্যাগ দৃষ্টান্তমূলক, কিন্তু অতীতের বিপ্লবের অসার্থকতার কারণ সম্বন্ধে তারা যথার্থ উপলব্ধি অর্জন করেছে এমন নিদর্শন অতি সামান্য।

বিংশ শতাব্দীর তিন চতুর্থাংশ—এরিক হব্স্বমের ভাষায় ‘সংক্ষিপ্ত বিংশ শতাব্দী’—জুড়ে বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের চেহারা নানা দেশে নানা রকম হলেও, তার কতগুলো বৈশিষ্ট্য সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল: আমলা পরিচালিত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে বাজারের জায়গায় প্রতিস্থাপন, উত্পাদনশীল সম্পদের ওপর একচ্ছত্র রাষ্ট্রীয় ও যৌথ মালিকানা এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা। যৌথ মালিকানাধীন উদ্যোগ, ভোক্তা ও শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার যে বিকল্প সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব তিরিশের দশকে উদ্ভাবিত হয়েছিল তা অসম্পূর্ণ নীল-নকশা হিসেবে রয়ে গেছে, বাস্তবায়নের চেষ্টা আজও হয়নি। অতীতের সমাজতান্ত্রিক নিরীক্ষাগুলো যেভাবে অপযশের গর্তে তলিয়ে গেছে তাতে এ জাতীয় তত্ত্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য যে বিশাল সংগঠিত উদ্যম প্রয়োজন তা কল্পনা করা কঠিন।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বৈষম্য হ্রাসের পথ খোঁজা নিরর্থক

আমাদের যে প্রজন্ম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর দশকগুলোতে পুঁজিবাদকে একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শনাক্ত করে তার বিকল্প অনুসন্ধান করা শুরু করেছিল, তাদের কাছে এটি একটি পরাভব-জ্ঞাপক উপলব্ধি মনে হতে পারে। কিন্তু এটা নিতান্তই বাস্তবের স্বীকৃতি, মতবাদ-প্রণোদিত পছন্দ নয়। বাস্তব কাঠামোকে অস্বীকার করে, বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক ক্রিয়াকর্মে বিকল্পের সন্ধান অথবা বাস্তব ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদক কোনো কল্পলোকি বিকল্পের অন্বেষণ কোনো কাজের কথা নয়। একে পুঁজিবাদকে পাশ কাটানোর লেনিনবাদী মাওবাদী প্রয়াসের শতাব্দী বিলম্বিত সংশোধন মনে করে সান্ত্বনা খোঁজা যেতে পারে। পুঁজিবাদ ইতিহাসের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যাকে পাশ কাটানো অসম্ভব। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদকে পাশ কাটিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ফলাফল ‘সামন্ততান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’-এর বেশি কিছু নয়।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনেকগুলো বিকল্প রূপের মধ্যে প্রার্থিত সমাজব্যবস্থার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা সম্ভব, এই ভাবনার মধ্যে হতাশা অতিক্রম করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। পূর্বোল্লিখিত উক্তির পুনরাবৃত্তি করে বলছি যে বণ্টনসমতা, মানবিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে, সমস্ত সমাজব্যবস্থার মধ্যে, সামাজিক গণতন্ত্রের অর্জন সর্বাধিক। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি মালিকানা এবং বাজারের মতো পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বীকার করা হয়, কিন্তু উত্পাদনের নিয়ন্ত্রণ, জনগণের জন্য মৌলিক সেবাসমূহের সংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সংরক্ষণ, শ্রেণী উত্তরণ সচলতার প্রাতিষ্ঠানিকতা বিধান ইত্যাদির লক্ষ্যে শক্তিশালী সামাজিক তত্ত্বাবধান আরোপ করা হয়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিশাল ব্যাপ্তির ব্যয় নির্বাহ হয় উচ্চপ্রান্তিক হারে করারোপের মাধ্যমে। ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে আছে সামাজিক মতৈক্যের শক্ত ভিত্তির ওপর। ব্যবস্থাটি অসংখ্য সমস্যার মুখে অবিচল থেকে, সমতাবাদী লক্ষ্য অক্ষুণ্ন রেখে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় নিজস্ব সক্ষমতা বজায় রেখেছে।

জাপানে এবং কিছু পূর্ব এশীয় দেশে পুঁজিবাদের আরও একটি রূপভেদ আছে যাকে সামাজিক গণতন্ত্রের শ্রেণীতে ফেলা যায় না, কিন্তু যেখানে তুলনামূলকভাবে আয়ের সমতাবাদী বণ্টন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে বেশ কিছু পূর্বশর্ত পালনের ফলে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সমাজের শ্রমক্ষম সদস্যদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান, পুঁজিবাদী প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমজীবীদের মজুরি ও সুবিধা বৃদ্ধির ঐতিহ্যের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, উন্নয়নের প্রারম্ভিক পর্যায়েই সম্পদের, বিশেষত জমির ব্যাপক পুনর্বণ্টন এবং মানবসম্পদ বিকাশের বিস্তৃত সুযোগ সৃষ্টি।

সমবায়মূলক মালিকানা, ক্ষুদ্রায়তন উদ্যোগের বাধা অতিক্রম করার রাষ্ট্রীয় সহায়তার পটভূমিকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও সেবার প্রসার—ইত্যাদি নতুন নতুন সম্ভাবনা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ আছে। পরিশেষে স্মরণযোগ্য যে লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয় পুনর্বিন্যাসের মতো ‘নিরীহ’ নীতি অনুসরণ করে কোনো রকম অভ্যুত্থান ছাড়াই, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে বৈষম্য হ্রাস সম্ভব। ব্যবস্থাটির কার্যক্রমে আরও বড় ধরনের পরিবর্তনের মাধ্যমে নিশ্চয়ই আরও দ্রুত হারে সমতা অর্জন সম্ভব।

সমতাবাদী পরিবর্তনের জন্য ভবিষ্যতে সমাবেশের ভিত্তি পাল্টাতে হবে

পুঁজিবাদের পরিবর্তিত চরিত্র পুঁজিবাদী অবিচারের প্রতিরোধে সমাবেশেও পরিবর্তনের প্রয়োজন নির্দেশ করে। ‘শেকল ছাড়া হারাবার মতো’ আছে আরও অনেক কিছু আজকের শ্রমিকশ্রেণীর। উনিশ এবং বিশ শতকের সমাজ বিপ্লবের যে অগ্রণী ভূমিকা তাদের ওপর আরোপিত ছিল, শ্রমিকশ্রেণীর আত্মপরিচয় বোধের গভীর পরিবর্তন তার ভিত্তি নষ্ট করে দিয়েছে। আজকের দিনে অধিকাংশ পুঁজিবাদী সমাজেই আয় বণ্টনে গুণগত পরিবর্তনের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐক্যবদ্ধ জোট আদৌ সম্ভব কিনা তা নির্ণয় করা কঠিন। ছোট পরিসরে প্রান্তিক পরির্তন আনা হয়তো সম্ভব, কালক্রমে এ ধরনের পরিবর্তনের ক্রমসঞ্চয় বৃহত্ পরির্তনের আকার নিতে পারে। উন্নয়নশীল বিশ্বে মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে ব্যাপক গণসমাবেশের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য; ২০১১-এর ‘আরব বসন্ত’ এর উদাহরণ। এ ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে উদ্ভূত সমাজটি যে সহজে সম্পদ, আয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার বণ্টনের ব্যাপারে একমত হবে তার সম্ভাবনা অনিশ্চিত।

বৈষম্য প্রশমনে কর্মসংস্থানের কেন্দ্রস্থ ভূমিকা

‘কাজ করতে চাওয়া মানুষের কর্মাভাব সম্ভবত ভবিতব্য নির্ধারিত বৈষম্যের সবচেয়ে বিষণ্ন দৃশ্য’, দেড় শ বছর আগে টমাস কার্লাইল প্রথমবার বলার সময় কথাটি যতটা সত্যি ছিল আজও ঠিক ততটাই আছে। সমতা ও দ্রুত প্রবৃদ্ধির যুদ্ধোত্তর দশকগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল পূর্ণ কর্মসংস্থানের রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি। আমি যাকে শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের নেতৃবর্গ কর্তৃক পরিচালিত শ্রেণীযুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছি তার ফলে এই প্রতিশ্রুতি পরিত্যক্ত হয়। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে কেইনেসর অনুবর্তীরা ‘আয় বণ্টন নীতি’র মাধ্যমে পূর্ণ কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির সামষ্টিক স্থিতিশীলতার সামঞ্জস্য বিধানের যে চেষ্টা করছিলেন তাকে প্রতিস্থাপন করা হলো ‘সহজাত কর্মাভাবের’ তত্ত্ব দিয়ে। আমার প্রজন্মের মূলধারার অর্থনীতিবিদদের তাত্ত্বিক ক্রিয়াকর্ম এই ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করার অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে গেছে। উনিশ শতকের যে রক্ষণশীল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে এই প্রবন্ধটির শুরু হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরিরা এখন সে দেশের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীতে ব্যাপক কাটছাঁট করতে ব্যস্ত। যদিও মুষ্টিমেয় খালি পদের জন্য শত শত বেকারের লাইন তাকালেই চোখে পড়ে, তবু তাঁরা ‘কর্মবিমুখ বেকারদের’ কাজে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টায় মগ্ন হয়ে এসব ‘সংস্কারে’ ব্যস্ত।

পূর্ণ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে আনা জরুরি। কর্মসংস্থানের উঁচু হার এবং দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তার সমাধান করা উচিত ‘আয় বণ্টন নীতি’র মতো সামাজিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে, বেকারত্বের অস্ত্রধারী পুঁজিপতিদের শ্রেণী-সংগ্রাম দিয়ে নয়। অবশ্যই স্বীকার্য যে সমগ্র জনশক্তির জন্য শোভন জীবনযাপনের উপযুক্ত কর্মসংস্থান করতে হলে কর্মসংগঠন, প্রশিক্ষণ, বাণিজ্য এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে।

গণতন্ত্র সমতাবাদ সহায়ক

বৈষম্য বৃদ্ধি রোধে লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক সাফল্য ওই মহাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাছে ঋণী। নিছক নির্বাচনিক ধারণাকে ছাপিয়ে এই গণতন্ত্র এমন ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে যা জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম। পৃথিবীর অনেক দেশেই গণতন্ত্রের পুনর্গঠন অত্যাবশ্যক। চীনের মতো দেশে সহজে শনাক্তযোগ্য হলেও গণতন্ত্রের অনতিলক্ষ্য অনুপস্থিতি বহুব্যাপ্ত। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নির্বাচন জনগণকে ক্ষমতাসীন সরকারকে অপসারিত করার সামর্থ্য দিয়েছে, কিন্তু ভিন্ন নামের ছত্রচ্ছায়ায় একই অপশক্তিসমূহের প্রত্যাবর্তনকে প্রতিহত করার সামর্থ্য দেয়নি। দরিদ্র ও ‘নিচু’ জাতের জনগোষ্ঠীকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে ভারতের গণতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের নানা কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: কংগ্রেসের উভয় দলের সদস্যদের ওপর বিত্তবান শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ; ‘যুদ্ধোত্তর দশকগুলোতে যে সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্রমোন্নত সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল’, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সেই একই কোর্টের ‘দক্ষিণপন্থী হিম বৃষ্টির’ দিক পরিবর্তন;৫ সর্বোপরি দরিদ্র গোষ্ঠীসমূহের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের নির্লজ্জ চলমান প্রয়াস। গণতন্ত্রের অবক্ষয় যেমন বৈষম্য বর্ধক, তেমনি গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন গ্রহণযোগ্য সমতা অর্জনে সহায়ক হতে পারে।

 বিশ্বায়ন শত্রু নয়

বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে কখনো কখনো বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে এক করে ফেলা হয়। এটি একটি বিরাট ভ্রান্তি। উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত বিশ্ববাজার শ্রমনিবিড় রপ্তানি ও উত্পাদনের দ্রুত প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে বৈষম্য-পরিহারক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করে। গত দুই দশকের বিশ্বায়নের কালে এই তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে বাস্তবক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি হওয়ার কারণ আমরা আলোচনা করেছি এবং দেখিয়েছি যে তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে অপ্রত্যাশিত এই ফলশ্রুতি মোটেও অনিবার্য ছিল না। বিশ্বায়ন যে প্রবৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে পরিবর্তনকালীন সমস্যাসমূহ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যেন বিশ্বায়নের চাপে সৃষ্ট অবাধ বাণিজ্য উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হয়ে না ওঠে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক ‘শিশুশিল্প’ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে সময় নেয়। বিবর্তনকালে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা না দিতে পারলে তাদের পক্ষে সাবালক হয়ে ওঠা এবং আন্তর্জাতিক সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হয় না। বিশ্বায়িত বাজারে যুক্ত হওয়ার পথে শিশুশিল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রদানের অধিকার অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। কিন্তু বিশ্বায়নকে বর্জন করে আমদানি-প্রতিস্থাপক ব্যবস্থার অসাম্য এবং অনৈপুণ্যকে বরণ করা অর্থহীন।

অর্থনৈতিক তত্ত্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিশ্বায়ন ও অবাধ বাণিজ্যের ফলে শিল্পোন্নত দেশে তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল শ্রমিকদের আয় হ্রাস পাবে এবং তুলনামূলকভাবে অপর্যাপ্ত পুঁজির আয় বৃদ্ধি পাবে। বাস্তবে এ ধরনের প্রবণতার সপক্ষে কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। যদি এই প্রবণতা প্রকট হয়ে ওঠে তবে উন্নত দেশে, বিশেষভাবে শ্রমজীবীরা, বিশ্বায়নের বিরুদ্ধাচরণে আরও সবাক হবে। বিশ্বায়নের এই সম্ভাব্য বাধা দূর করার জন্য ধনী দেশগুলোর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। প্রশিক্ষণ দ্বারা শ্রমজীবীদের দক্ষতা বাড়ানো এবং উত্পাদন কাঠামোকে অধিকতর পুঁজি-নিবিড়তা ও দক্ষতা-নিবিড়তার দিকে পরিচালিত করা এ ধরনের পদক্ষেপের অন্যতম উদাহরণ।

টীকা

১. মূল্যবান পরামর্শ ও সহায়তার জন্য অধ্যাপক কিথ গ্রিফিন ও আর্থার ম্যাকেওয়ানের কাছে আমি গভীরভাবে ঋণী। বিভিন্ন তথ্যের সূত্র স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ না করে প্রবন্ধের শেষের সংযোজনে প্রধান তথ্যাদির সূত্রগুলো সংক্ষেপে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সংযোজনে বৈষম্য পরিমাপের প্রধান সূচকের একটি ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে।

২. প্রবন্ধ শেষের তথ্যসূত্রে জিনি সূচকের একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

৩. প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, অমর্ত্য সেন বাজারের বিলুপ্তিকে সংলাপের অবসান বলে বর্ণনা করেছেন। ওপরের বিভাজনের নামকরণে আমি তাঁর বর্ণনা অনুসরণ করেছি।

৪. নিউইয়র্ক সম্বন্ধে এই মন্তব্যটি টোনি জাড রচিত Memory chalet গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত।

৫. উদ্ধৃতিটি Ronald Dworkin এর Is Democracy Possible Here গ্রন্থ থেকে।

তথ্যসূত্র

জিনি সূচকগুলো নেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংক, আমেরিকান সেন্সাস ব্যুরো, সিআইএ এবং অন্যান্য উল্লিখিত উত্স থেকে। এসব তথ্য উদ্ধারের সহজ উপায় গুগলে এদের ওয়েবসাইটগুলো খোঁজা। বুরগুইনোঁ-মরিসনের রচনাটি ২০০২ সালের American Economic Review-তে পাওয়া যাবে। লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক বৈষম্য হ্রাস-সম্পর্কিত আলোচনা পাওয়া যাবে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের Wider Angle নামক পত্রিকায়। বাংলাদেশের বৈষম্য সম্পর্কে আমার কিছু গবেষণার বিবরণ পাওয়া যাবে ২০০১ ও ২০০৬ সালের Bangladesh Development Studies-এ প্রকাশিত বিনায়ক সেনের সঙ্গে আমার যৌথ নিবন্ধে। উল্লিখিত অন্যান্য অধিকাংশ উপাত্ত বিশ্বব্যাংকের World Development Indicators-এর বিভিন্ন সংখ্যায় পাওয়া যাবে।

বৈষম্যের সূচক

Wikipedia-র ‘List of Countries by Income Inequality’ নামের নিবন্ধ থেকে কয়েকটি দেশের জন্য বৈষম্য পরিমাপের তিনটি সূচক নিচে উদ্ধৃত হলো। (নিবন্ধটিতে উল্লিখিত উপাত্ত থেকে নিম্নোক্ত কোনো কোনো উপাত্ত ভিন্ন এই কারণে যে সেগুলো ভিন্ন কোনো বছরের বা ভিন্ন কোনো উত্স থেকে গৃহীত।):

দেশ       দশাংশ অনুপাত            পঞ্চমাংশ অনুপাত            জিনি সূচক

সুইডেন   ৬.২            ৪.০            ২৩.০

দক্ষিণ কোরিয়া            ৭.৮            ৪.৭            ৩১.৪

ইন্দোনেশিয়া            ৭.৮            ৫.২            ৩৬.৮

যুক্তরাষ্ট্র            ১৫.৯            ৮.৪            ৪৫.০

দক্ষিণ আফ্রিকা            ৩৩.১            ১৭.৯            ৬৫.০

‘দশাংশ অনুপাত’ শীর্ষক কলামে দেখানো হয়েছে সবচেয়ে ধনী দশাংশ মানুষের আয় সবচেয়ে দরিদ্র দশাংশ মানুষের আয়ের তুলনায় কতগুণ বেশি। ‘পঞ্চমাংশ অনুপাত’ কলামে দেখানো হয়েছে সবচেয়ে ধনী পঞ্চমাংশের আয় সবচেয়ে দরিদ্র পঞ্চমাংশের আয়ের তুলনায় কতগুণ বেশি। শেষ কলামটিতে করাদো জিনি (Corrado Gini 1884-1965) নামের ইতালীয় পরিসংখ্যানবিদ কর্তৃক উদ্ভাবিত সূচকটি দেখানো হয়েছে; উদ্ভাবকের নামাঙ্কিত এই জিনি সূচকটি সম্ভবত বৈষম্য পরিমাপের সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত পদ্ধতি।

প্রথম দুটি কলামের অনুপাত দুটি প্রায়ই বৈষম্য পরিমাপের জন্য ব্যবহূত হয়; এগুলো সহজবোধ্য কিন্তু পরিমাপক হিসেবে দুর্বল। এদের ভিত্তি কেবল দুটি চরম আয়ের গোষ্ঠীর মধ্যে তুলনা। দশাংশ অনুপাতটি মধ্যবর্তী আটটি দশাংশকে এবং পঞ্চমাংশ অনুপাতটি মধ্যবর্তী তিনটি পঞ্চমাংশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। সামগ্রিক আয় বণ্টনের বিচার সবার আয়ের তুলনার ওপর ভিত্তি করেই হওয়া উচিত। তা না করার সমস্যাটির উদাহরণ: দশাংশ অনুপাত অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার সমকালীন আয়-বৈষম্য তুলনীয়, যদিও মোটামুটিভাবে সর্বজনগ্রাহ্য বিচার এই যে দক্ষিণ কোরিয়া ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে সমতাবাদী। দশাংশ অনুপাতের সীমাবদ্ধতার কারণ এই যে এই সূচকটি আয়গোষ্ঠীর ব্যাপক অংশকে অগ্রাহ্য করেছে। জিনি সূচক এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের পার্থক্য সঠিকভাবে পরিমাপ করেছে। সূচকটির ভিত্তি হচ্ছে প্রতিটি আয়গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিম্নতর ও উচ্চতর আয়গোষ্ঠীর তুলনা।

জিনি সূচকের মাত্রাটি বিচার করার সহজবোধ্য একটি চেষ্টা করা যেতে পারে। এই সূচক অনুযায়ী শূন্য হচ্ছে চূড়ান্ত বৈষম্যহীনতা (যখন সবার আয় সমান) এবং ১ বা ১০০ হচ্ছে চূড়ান্ত বৈষম্য (যখন একজন সমস্ত আয়ের অধিকারী এবং সমাজের বাকি সবার কোনো আয় নেই)। এই পরিমাপ অনুপাত হিসেবে দেখালে এর সীমা শূন্য থেকে এক পর্যন্ত হয় এবং (অনুপাত ১০০ দিয়ে গুণ করে) সূচক হিসাবে দেখালে শূন্য থেকে ১০০ পর্যন্ত। আমরা এই প্রবন্ধে সূচকের পরিমাপ ব্যবহার করেছি, ইচ্ছা করলে অনুপাতের পরিমাপও ব্যবহার করতে পারতাম, সে ক্ষেত্রে ওপরের তালিকায় সুইডেনের জিনি হতো ০.২৩, যুক্তরাষ্ট্রের ০.৪৫ ইত্যাদি।

বৈষম্য-সূচক বিচারের মানদণ্ড—কোনটা কেমন অসম বলে বিচার করা উচিত—ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। আমার বিচারে, ওপরের তালিকার জিনি সূচকের মানদণ্ডে, সুইডেন সমতার পরাকাষ্ঠা, দক্ষিণ কোরিয়া উঁচুমাত্রায় সমতাবাদী, ইন্দোনেশিয়ার সমতা বা অসমতা মাঝারি মাপের, যুক্তরাষ্ট্রের বৈষম্য ব্যাপক এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বৈষম্য দুঃসহ।

বৈষম্যবিষয়ক সাম্প্রতিক প্রকাশনার কয়েকটি উদাহরণ

গত দু-এক বছরে বিশ্বব্যাপী বৈষম্য বৃদ্ধি সম্বন্ধে সচেতনতা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সম্বন্ধে গবেষণা এবং প্রকাশনার সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে এমন তিনটির উল্লেখ করছি। Timothy Noah রচিত The Great Divergence একটি সহজবোধ্য কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন গ্রন্থ; বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের বৈষম্য এবং এর নিরসনের উপায়। Joseph Stiglitz-এর The Price of Inequality বৈষম্যের প্রবৃদ্ধি বিরোধিতা এবং সামাজিক অবিচার সম্বন্ধে একটি সুচিন্তিত আলোচনা। পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন এবং বাজার অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা The Economist সাপ্তাহিকটি ১৩ অক্টোবর সংখ্যায় ‘For Richer For Poorer’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বিশ্বের সব অঞ্চলে অসাম্যের সাম্প্রতিক গতিবিধি এবং তার রাশ আটকানোর উপায় এর আলোচ্য বিষয়।

পরিভাষা

পরিভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বীকৃত ও ব্যবহূত বিধি অনুসরণ করার চেষ্টা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের প্রয়োজন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘দক্ষ’ শব্দটি ইংরেজি skilled এবং efficient দুটি শব্দেরই স্বীকৃত প্রতিশব্দ। কিন্তু অর্থনীতিশাস্ত্রে efficiency-র একটি বিশেষ অর্থ আছে। আমি skilled-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘দক্ষ’ (যেমন skilled worker, দক্ষ শ্রমিক) এবং efficient-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘নিপুণ’ (যেমন productive efficiency, উত্পাদন নৈপুণ্য) ব্যবহার করেছি। Unemployment-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘বেকারী’ বহুল ব্যবহূত। আমার মনে হয়েছে যে দৈনন্দিন ব্যবহারে ‘বেকারী’ শব্দটি দিয়ে চাকরির (মজুরি শ্রম) অভাব বোঝানো হয়। আমি সব ধরনের উত্পাদন কর্মের অভাব অর্থে unemployment-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘কর্মাভাব’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। এ ধরনের আরও কিছু শব্দের ভাষান্তর নিচে উল্লেখ করা হলো:

Actually Existing Socialism            (বাস্তবে) বিদ্যমান সমাজতন্ত্র

Aggregate Demand                        সামষ্টিক চাহিদা

Billionaire                                     শতকোটি পতি

Financial Institution                       অর্থায়ন সংস্থা

Incomes Policy                               আয় বণ্টননীতি

(International) Competitiveness      (আন্তর্জাতিক) প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা

Natural Monopoly                             স্বভাবজ একচেটিয়া উদ্যোগ

Primitive Capital Accumulation         প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়

Production Possibility Frontier          উত্পাদন সম্ভাবনার প্রান্তসীমা

Proletariat                                         নির্বিত্ত

Social Democracy                            সামাজিক গণতন্ত্র

পরিশেষে উল্লেখ্য যে এই শব্দগুলোর ব্যবহারে মৌলিকতা দাবি করা হচ্ছে না। এর অধিকাংশের ব্যবহার ইতিপূর্বে অন্যরাও করেছেন বা করে থাকবেন। যেহেতু এই শব্দগুলোর বিকল্প সমার্থক প্রয়োগ প্রায়শই চোখে পড়ে, তাই আমার ব্যবহূত ব্যতিক্রমের প্রধান উদাহরণগুলোর একটি তালিকার প্রয়োজন বোধ করেছি।