বাংলাদেশে রাজনৈতিক উন্নয়ন কেন ঘটে না?

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাটির লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি ধাঁধার ওপর আলোকপাত করা। আলোচনার এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ধাঁধাটির পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ তো সম্ভব নয়ই, বরং আমি সন্তুষ্ট থাকব বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রেক্ষাপটে ধাঁধাটিকে পাঠকের কাছে তুলে ধরা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু তত্ত্বের অবতারণা করা, যাতে করে ধাঁধাটিকে পর্যালোচনা করা যায়। বিষয়টির মূলে যাওয়ার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার ধারণা পাঠকের কাছে খোলাসা করে নেওয়া দরকারি বলে মনে করছি। ‘রাজনৈতিক উন্নয়ন’ বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি? ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ ধারণাটি যেমন অনেকের কাছে কমবেশি স্পষ্ট (যদিও পণ্ডিতদের ও সমাজ সংগঠকদের ভেতর এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই), রাজনৈতিক উন্নয়ন কথাটি অনেক পাঠকের কাছে হয়তো তেমন স্পষ্ট নয়। এই ধারণাটির বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্ভব ও বিকাশের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়া এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভব নয়। যাঁরা আধুনিক কালপর্বের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বাবলির খোঁজখবর একটু-আধটু রাখেন, তাঁরা হয়তো জানবেন, পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকটায় এবং ষাটের দশকজুড়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দুনিয়ায় অনেক দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছেন এমন একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যাঁরা ‘আধুনিকায়ন তত্ত্ব’-এর পতাকাতলে সংগঠিত হয়েছিলেন। তাঁরাই রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারণাটির উদ্ভব ঘটান। তবে ধারণাটির সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক পরিণতি ঘটে স্যামুয়েল হান্টিংটনের হাত ধরে, যার প্রভাব ও রেশ বর্তমান কালের অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আমি রাজনৈতিক উন্নয়ন ধারণাটি বর্তমান আলোচনার জন্য ধার করেছি তাঁর কাছ থেকে নয়, বরং তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি (সরাসরি ছাত্র) আরেক প্রখ্যাত (এবং দারুণভাবে বিতর্কিত) সমাজবিজ্ঞানী বা দার্শনিক ইয়োশিহিরো ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার কাছ থেকে। ফুকুইয়ামা তাঁর সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত প্রভাবশালী গ্রন্থ অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অর্ডার-এ (২০১১) রাজনৈতিক উন্নয়ন বলতে বুঝিয়েছেন তিনটি দিকের মধ্যে স্থিতিশীল ভারসাম্য অর্জনকে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে রাষ্ট্রনির্মাণ (স্টেট বিল্ডিং), আইনের শাসনের সুসংহতকরণ (কনসলিডেশন অব রুল অব ল) এবং গণতন্ত্রে উত্তরণ (ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশন)। এ তিনটি দিক পৃথক ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

আমি বর্তমান লেখাটি স্বল্প পরিসরের কথা ভেবে ফুকুইয়ামার ওই তিনটি ধারণাকে সংক্ষিপ্ত পরিধিতে আলোচনা করব। রাষ্ট্র নির্মাণের অর্থ হলো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যক্তি নিরপেক্ষতার (ইমপার্সোনালিজম) উদ্ভব এবং রাষ্ট্রের ‘বৈধ সহিংস ক্ষমতা’ প্রয়োগের সুসংহতকরণ (কনসোলিডেশন অব লেজিটিমেট ভায়োলেন্স কেপাবিলিটি অব দ্য স্টেট)। আইনের শাসন সুসংহতকরণের বিষয়টি এই লেখার অনেক সীমিত পরিসরে বিবেচনা করছি, অর্থাত্ সীমিত থেকেছি শুধু রাজনৈতিক এলিটদের ভেতরে আইনের শাসনের উদ্ভব ও সংহতকরণের প্রশ্নের মধ্যে। একইভাবে গণতন্ত্রের ধারণাটিও খুব সীমাবদ্ধ অর্থে এই লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে। গণতন্ত্র এখানে শুধু ‘রাজনৈতিক এলিটদের মাঝে অবাধ প্রতিযোগিতা’ হিসেবেই বোঝানো হচ্ছে।  এই ন্যূনতম প্রণালিগত গণতন্ত্রের (মিনিমালিস্ট প্রসিডিউরাল ডেমোক্রেসি) সংজ্ঞাধীনে গণতন্ত্রের সফলতা বা বিফলতার মূল্যায়ন হয় শুধু গ্রহণযোগ্য (অর্থাত্ সবার কাছে বা ন্যূনপক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী এলিটদের কাছে) ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠু ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে কি না তার ভিত্তিতে। নির্বাচন-উত্তর ‘গণতন্ত্রের মান’ আমাদের এ আলোচনার বিবেচ্য বিষয় নয়।

লেখার শুরুতে উত্থাপিত ধাঁধার বিষয়টিতে এবার ফিরে আসা যাক। বাংলাদেশের বর্তমান ধাঁচের গণতন্ত্রের বয়স দুই দশক ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু লক্ষ করুন, কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক উন্নয়নের কোনো দেখা নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের বেলায় চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ নিয়ে বাংলাদেশে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। আমরা সেই আলোচনায় যাব না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক উন্নয়ন যে ঘটছে না, তা আমার কাছে একটি ধাঁধার মতো মনে হয়। একটি দেশে বিস্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক (সমাজ সংগঠন, নারী উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার, সংস্কৃতির বিকাশ, মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশ ইত্যাদি) উন্নয়ন ঘটে চলেছে, অথচ রাজনৈতিক উন্নয়ন অনেকটা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমরা কম করে হলেও একটা আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভেতরেই আছি। অবশ্য মাঝখানে ২০০৭-০৮ কালপর্বে যখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল সেটা বাদ রেখে মোটা দাগে কথাটা বলছি। তবে মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক উন্নয়নের যে তিনটি বিষয়ের কথা আমরা উল্লেখ করেছি, সেগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য বেশ কিছু ভালো কাজ সেনাসমর্থিত সরকার করে গিয়েছিল, যার অধিকাংশই আবার রাজনীতিবিদগণ রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে এসে কমবেশি ধ্বংস করেছেন। অনেক সময় ধরে অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটছে, সমাজের পরিবর্তন ঘটছে, আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রও টিকে রয়েছে, অথচ রাজনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে না। এটা অনেক দেশ, যারা আমাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করেছিল, তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক ডাকসাইটে সফল তত্ত্বের সঙ্গেও এটা মেলে না। যেমন বাস্তব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে কিছু নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদ দিলে সব দেশেই বর্তমানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের অধীনে থেকেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে। আমাদের মতো তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি লাগছে না। তত্ত্বের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, কোনো কোনো তত্ত্ব, যেগুলো গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে মধ্যবিত্তের বিকাশ ও অর্থনীতির একটি পর্যায়ের উন্নয়নকে আবশ্যিক বলে বিবেচনা করে, (যার প্রমাণ যেমন পাওয়া যায় দক্ষিণ কোরিয়া অথবা তাইওয়ানের বর্তমান রাজনৈতিক উন্নয়নের অভিজ্ঞতায়) সেই সফল তত্ত্বগুলোও বাংলাদেশের বেলায় খাটছে না। প্রসঙ্গত, এ দুটো দেশই বাংলাদেশের মাত্র কয়েক বছর আগে গণতান্ত্রিক উত্তরণ-প্রক্রিয়া শুরু করেছিল।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের আলোচনায় আসা যাক। এই আলোচনার বর্ণনামূলক দিকটি অতি সংক্ষিপ্ত রাখব। কেননা, আমি ধরে নিচ্ছি, এ লেখার বাঙালি পাঠকের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের আলোচনা (এর গতিশীলতা, আপেক্ষিক উন্নয়ন ও সামগ্রিক অনুন্নয়ন) মূলত বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে করার চেষ্টা করব এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক (পলিটিক্যাল ইকোনমি) তাত্ত্বিক ফ্রেমের ভেতরে থেকেই আলোচনায় অগ্রসর হব। এ তাত্ত্বিক ফ্রেমটি (নিচে দেখুন) সমাজব্যবস্থার (অথবা সীমিত অর্থে রাজনৈতিক উন্নয়ন, যেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয়) পরিবর্তন বা উত্তরণে এলিটদের প্রণোদনা বুঝতে বিশেষভাবে উপযোগী বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তাত্ত্বিক চিন্তাটি জটিল, তাই এর বর্ণনায় কিছুটা সময় আমাদের দিতেই হচ্ছে।

প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা: তত্ত্ব

তাত্ত্বিক কাঠামোটির প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে access order বা প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার ধারণাটি।লেখকত্রয় নর্থ (North), ওয়েনগাস্ট (Weingast), ও ওয়ালিস (Wallis) (সংক্ষেপে এখন থেকে এদের NWW বলব) তাঁদের বিশ্লেষণের মূল কেন্দ্রে রেখেছেন সামাজিক ব্যবস্থার (সোস্যাল অর্ডার) ধারণাটি। লেখকদের মতে, সামাজিক ব্যবস্থার অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উদ্ভব ও বিন্যাস ঘটার প্রক্রিয়া এবং এই সংগঠনগুলোতে কার প্রবেশাধিকার থাকবে, বা কার থাকবে না, তা নির্ধারিত হওয়ার প্রক্রিয়া। এই সমাজব্যবস্থায় সম্ভাব্য নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা নিজেদের সম্পদ ও ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার সহিংস প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ সংগঠনগুলো কার নিয়ন্ত্রণে আছে অথবা নেই। অর্থাত্, কে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে আর কে পাচ্ছে না। তাই এ সামাজিক ব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা (বা access order)। NWW-এর তাত্ত্বিক কাঠামোতে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে’ ক্ষমতাধারী এলিটদের মাঝে বিদ্যমান সহিংসতা কমানো বা বৃহত্তর অর্থে সহিংসতার ব্যবস্থাপনা (এলিট ভায়োলেন্সকে ‘ম্যানেজ’ করা)। যারা ক্ষমতাসীন তারা উপরোক্ত ও সংগঠনগুলোর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারুক বা না পারুক, তারা কার্যত এলিট গোষ্ঠীকে কী প্রণোদনা দিয়ে বা কী পদ্ধতিতে সহিংসতাকে একটা সীমার ভেতর রাখতে পারছে (বা পারছে না), সেটাই এখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। প্রণোদনার ধরন বা সহিংসতা কমানোর পদ্ধতির তারতম্যের ওপর নির্ভর করে প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন: সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা (limited access order) ও উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা (open access order)। এই দুটি ব্যবস্থা আসলে দুই ধরনের সামাজিক ভারসাম্যের (সোস্যাল ইকুইলিব্রিয়াম) রূপ এবং এগুলো টিকে থাকে অথবা পুনরুত্পাদিত হয় ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম (মেকানিজমস) ব্যবহার করে।

সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় এলিটদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অথবা দ্বন্দ্ব নিষ্পন্ন হয় ব্যক্তিক পর্যায়ে ‘বিশেষ বিবেচনার’ (ডিসক্রিশেনারি) অধীনে। এভাবেই দ্বন্দ্ব হয় চলতে থাকে অথবা তা সমঝোতার দিকে অগ্রসর হয়। এতে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে অথবা অবাধ প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থাকে অতিমাত্রায় সীমিত করে সচেতনভাবে বিশেষ rent পাইয়ে দেওয়ার সুযোগের সৃষ্টি করা হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কোনো খাতই এই বাড়তি সুবিধা (rent) বণ্টনের বাইরে থাকে না। এলিটদের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দেনদরবার ও দর-কষাকষি চলে এই ‘বাড়তি’ সুবিধা পাওয়াকে কেন্দ্র করে। একেই ‘বাড়তি সুবিধা’ বা rent-এর উত্পাদন ও বণ্টনের ব্যবস্থা বলা হয়েছে। এই বণ্টন-প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের লাভ দুই ধরনের। এর মাধ্যমে এলিটদের ভেতর সহিংসতা কমানো বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলে এবং প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি তাদের আনুগত্য বাড়াতে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এই আনুগত্য বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে অটুট রাখতে অনেকটা আঠার মতো কাজ করে।

উপরিউক্ত ব্যবস্থার বিপরীতে রয়েছে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা, যা মূলত বর্তমানে বহুল প্রচলিত সুশাসন (গুড গর্ভনেন্স) ধারণার অনুরূপ। এর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুত্ববাদী (প্লুরালিস্টিক) এবং উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেটি আইনের শাসন ও সর্বজনীন সম্পত্তি তথা মালিকানার অধিকারসমূহকে নিশ্চিত করে। এ ছাড়া এই ব্যবস্থায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলো বা ‘ট্রানজাকশনস’ মূলত নৈর্ব্যক্তিকভাবে চলে। এই ব্যবস্থার আর দুটো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো— পরিচিতি-নির্বিশেষে সংগঠন গড়ে তোলার অধিকার (যে সংগঠনের অস্তিত্ব তার কর্তৃত্বধারী ব্যক্তিদের বিশেষ রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে না) ও সর্বোপরি সহিংসতার বৈধ ব্যবহারের ওপর রাষ্ট্রের একচেটিয়া কর্তৃত্ব (মোনোপলি ওভার লেজিটিমেট ইউজ অব ভায়োলেন্স)।১০

লক্ষ করে দেখুন, আমি লেখার গোড়াতেই ‘রাজনৈতিক উন্নয়নের’ যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছি, তার দুটোই (রাষ্ট্র বা সংগঠনের ব্যক্তি নিরপেক্ষতা ও বৈধ সহিংসতা প্রয়োগে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব) উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থারও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অর্থাত্, আমি দাবি করছি যে রাজনৈতিক উন্নয়ন বাংলাদেশে ঘটতে হলে আমাদের রাষ্ট্রকে বর্তমানের সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে। বাংলাদেশ সেদিকে এগোচ্ছে কি না, না হলে কেন এগোচ্ছে না ইত্যাদি প্রশ্নে যাওয়ার আগে আরও কিছু রক্তমাংসহীন তাত্ত্বিক বিষয় খোলাসা করে নিতে চাই।

প্রথমেই NWW-এর তাত্ত্বিক কাঠামোর আরও তিনটি শ্রেণীবিন্যাসমূলক বিভাজনের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। দেখা যাচ্ছে, সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার মধ্যেও স্তরভেদ রয়েছে। যেমন, NWW সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থাকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন—ভঙ্গুর (ফ্রেজাইল), মৌলিক (বেসিক) ও পরিণত (ম্যাচিউর)। ‘ভঙ্গুর ব্যবস্থায়’ রাষ্ট্র (যতটুকুই বিদ্যমান) সংগঠনগুলোকে তেমন কোনো প্রতিরক্ষা দিতে পারে না, প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র নিজেকেই ভেতরের কিংবা বাইরের সহিংস আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে খুব কমই সক্ষম হয়। এর তুলনায়, ‘মৌলিক ব্যবস্থায়’ রাষ্ট্র অনেকটা সংগঠিত এবং সাধারণভাবে সহিংস আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এ ছাড়া সংগঠনগুলোকে রাষ্ট্র কিছু মাত্রায় প্রতিরক্ষা দিতে পারে কিন্তু নিজের প্রতিষ্ঠানের বাইরে রেখে নয়। অর্থাত্, এখানে সামাজিক এলিটদের অধিকার ও সুবিধাগুলো দারুণভাবে রাষ্ট্র দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত।

‘পরিণত’ সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় রাষ্ট্র যথেষ্ট সংগঠিত এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংগঠনের বাইরে, অর্থাত্ তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও অনেক উন্নত স্তরের ও বিশেষায়িত সামাজিক বা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে পরিচালিত হতে সমর্থন দিয়ে থাকে। কিন্তু তার পরও এ ব্যবস্থায় এই সামাজিক বা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনভাবে চলার বা স্বাধীন হয়ে ওঠার একটা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক দৃশ্যমান বা অপ্রত্যক্ষ সীমারেখা আছে। রাষ্ট্র তার বাইরের সংগঠনগুলোর ওপর এমনভাবে তদারকি ব্যবস্থা চালু রাখে বা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, যাতে করে রাষ্ট্র প্রতিযোগিতা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে রাষ্ট্র ‘বাড়িত সুবিধা’ বা ‘রেন্ট’ সৃষ্টি করতে পারে না। আর ‘রেন্ট’ সৃষ্টি ও তার বণ্টন করতে না পারলে রাষ্ট্রের পক্ষে প্রভুত্বকারী এলিট জোটের (ডমিন্যান্ট এলিট কোয়ালিশন) চাহিদা—যেমন: এলিটদের নিজেদের মধ্যে সহিংসতা কমানো, সামাজিক ব্যবস্থা অটুট রাখা, সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি এলিটদের আনুগত্য বজায় রাখা ইত্যাদি শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয় না।১১

প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা: রাষ্ট্রতত্ত্ব

আরও দুটো খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত, NWW-এর রাষ্ট্রচিন্তা বা আরও বিশেষ করে বললে তাঁদের রাষ্ট্রের স্বরূপ ও রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাভাবনা বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রীতিমতো অভিনব। প্রথাগত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে রাষ্ট্রকে একক কর্তৃত্বসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয়। এতে করে রাষ্ট্রকে সমাজ থেকে বিযুক্ত করেও দেখা হয়। রাষ্ট্রসম্পর্কিত এ প্রথাগত চিন্তা NWW সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছেন। রাষ্ট্রসম্পর্কিত এ যাবত্কালের প্রাধান্যশীল ধারণা রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বহু দশক ধরে। অর্থনীতিবিদ বুকানন এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক তত্ত্বে যেমন ‘পাবলিক চয়েস ইকোনমিকস’, ‘রেন্ট সিকিং থিওরি’ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যান্য তত্ত্বে যেমন মার্গারেট লেভির ‘রেভিনিউ ম্যাক্সিমাইজিং স্টেট’ এবং নব্বইয়ের দশকের বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তারকারী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তত্ত্ব যেমন মানসুর ওলসনের (Mancur Olson) ‘স্টেশনারি ব্যান্ডিট’-এর তত্ত্ব ইত্যাদি সুশাসন ও অর্থনীতি বিষয়ে অনেক গবেষণাকে গোটা দশক ধরেই প্রভাবিত করেছে। এগুলো রাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বসম্পন্ন ধারণারই কয়েকটি প্রতিনিধিত্বকারী উদাহরণ।

NWW জানাচ্ছেন এবং যেটা আমাদের আলোচনার জন্য বোঝা জরুরি, রাষ্ট্র সমাজ থেকে বিযুক্ত একক কর্তৃত্ব সম্পন্ন সংগঠন নয়। বরং রাষ্ট্র হচ্ছে, একই সঙ্গে এলিটদের মধ্যে জোট গঠনের এবং এলিট সংগঠনের সমাহার। অর্থাত্, রাষ্ট্র হচ্ছে একটি সম্পর্কনির্ভর (রিলেশনাল) ধারণা, অর্থাত্ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মধ্যেকার আন্তসম্পর্কের প্রতিফলন। এই নিক্তিতে রাষ্ট্র কখনোই সমাজ থেকে বিযুক্ত হয়ে একক উদ্দেশ্যে পরিচালিত কোনো রাষ্ট্রীয় আয়-বর্ধনকারী (রেভিনিউ ম্যাক্সিমাইজিং) সংগঠন হয়ে উঠতে পারে না অথবা স্বাধীনভাবে ‘দস্যুবৃত্তির’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সামাজিক এলিটদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারে না। রাষ্ট্র কখন এবং কীভাবে ওই ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে বা হতে পারবে না, তা নির্ভর করবে রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও প্রভুত্বকারী এলিট গোষ্ঠীর (ও তার বিভিন্ন বর্গের) জটিল ও গতিশীল আন্তসম্পর্কের ওপর।

দ্বিতীয়ত, যে কথাটি আমি গোড়াতেই ‘রাজনৈতিক উন্নয়নের’ ব্যাখ্যায় বলেছি, কেবল রাষ্ট্রেরই রয়েছে একচ্ছত্র বিধিবদ্ধ সহিংস ক্ষমতা ধারণের ও তা প্রয়োগের বৈধতা। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। রাষ্ট্রসম্পর্কিত এই মহামূল্যবান পর্যবেক্ষণটি করেছিলেন বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার। ওয়েবার-পরবর্তী রাষ্ট্রচিন্তা এটাকে স্বতঃসিদ্ধ প্রত্যয় হিসেবে ধরে নিয়েছে। আধুনিকতাবাদী রাষ্ট্রচিন্তায় এ নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। তবে এ যাবত্ রাষ্ট্রচিন্তায়, বিশেষ করে নীতিভিত্তিক (নর্মেটিভ) ঘরানায় ধরেই নেওয়া হয়েছে, যেকোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা ‘বাস্তবে রয়েছে’ (যেহেতু থাকা উচিত এবং এই ঔচিত্যবোধের ধারণাটি নীতিভিত্তিক সমাজচিন্তার একটা মূল বৈশিষ্ট্য)। সে জন্য অর্থনীতিবিদ মানসুর ওলসন সহজেই রাষ্ট্রকে ‘ব্যান্ডিট’ বা ক্ষমতাধর দস্যু হিসেবে ধরে নিতে পারেন, কেননা তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা তো রয়েছেই। NWW-এর রাষ্ট্রচিন্তার একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হলো, রাষ্ট্রের কাছে বৈধ সহিংসতা প্রয়োগের ক্ষমতা ‘রয়েছেই’—এ ধারণাটিকে তাঁরা বর্জন করেছেন। লক্ষ করুন NWW কিন্তু বলছেন না রাষ্ট্রের কাছে এই ক্ষমতা না থাকুক। প্রকৃতপক্ষে, একটু পরেই আমি দেখাব, তাঁরা মনে করেন যে কেবল উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার সমাজব্যবস্থাতেই (যেটা তাঁদের পছন্দের সামাজিক ব্যবস্থা) রাষ্ট্রের কাছে বিধিবদ্ধ সহিংস ক্ষমতা প্রয়োগের প্রায় একচ্ছত্র অধিকার আছে। সীমিত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের এই বিধিবদ্ধ সহিংস ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার কাগজে-কলমে থাকলেও এর ন্যায্যতা সীমিত—রাষ্ট্রের বাইরের সংগঠনগুলো তা সহজে মেনে নিতে চান না। NWW দাবি করছেন, প্রচলিত রাষ্ট্রচিন্তার ভুলটা হচ্ছে, এটি রাষ্ট্র কীভাবে বৈধ সংহিসতা প্রয়োগের একাধিপত্য পেল তা ব্যাখ্যা না করে আগেভাগেই ধরে নেয় যে ওই ক্ষমতা আসলে রাষ্ট্রের রয়েছে। অথচ বিশ্লেষকদের কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের ভেতর ওই ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কেন্দ্রীভূত হওয়ার সামাজিক প্রক্রিয়াটাকে ব্যাখ্যা করা। এখানেই চলে আসে NWW-এর রাষ্ট্র গঠন ও সামাজিক উত্তরণের মৌলিক ধারণাটি: সীমিত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় সহিংসতার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কাছে খুব অল্পই থাকে। এটা বরং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষমতাধারী এলিটদের কাছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্র সহিংসতাকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আনার লক্ষ্যে (যাতে করে সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির সংগঠনগুলো কার্যকর থাকতে পারে) সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রের ভেতর কেন্দ্রীভূত করার প্রয়াস চালায় না, বরং প্রচলিত সহিংস ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভূত অবস্থাকে মেনে নিয়ে ক্ষমতাধারীদেরও দেনদরবারের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারত্ব দিয়ে অযথা সহিংসতায় লিপ্ত না হওয়ার প্রণোদনা সৃষ্টি করে। ক্ষমতাধারী এলিটদের এই সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্ট আন্তসম্পর্কিত ক্ষমতার বিন্যাস বা পুনর্বিন্যাসই (প্যাটার্ন অব ইন্টারলকিং পাওয়ার) হচ্ছে সীমিত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের স্বরূপ। এই ক্ষমতার বিন্যাস যতটা পরিমাণে সংশ্লিষ্ট এলিটদের প্রণোদনা দিতে পারবে, রাষ্ট্রও ততটা পরিমানেই স্থিতিশীল হবে। রাষ্ট্র এই অর্থে মূলত এলিট প্রণোদনার সামাজিক ভারসাম্যমূলক অবস্থা (সোশ্যাল ইকুইলিব্রিয়াম)। ম্যাক্স ওয়েবারের— বৈধ সহিংসতার ওপর রাষ্ট্রের একাধিপত্য- রাষ্ট্রচিন্তাটি বরং খাটে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকারের সমাজব্যবস্থার বেলায়।

তবে ‘পরিণত’ সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার লক্ষণ হচ্ছে ক্রমান্বয়ে এ বৈধ সহিংসতা সমাজ থেকে রাষ্ট্রের বিশেষায়িত (ভায়োলেন্স স্পেশালিস্ট) সংগঠনে—যথা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী ইত্যাদিতে—কেন্দ্রীভূত হওয়া। অর্থাত্, সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা যতই পরিণত হবে, ততই বৈধ সহিংসতা প্রয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানে বা প্রতিষ্ঠানসমূহে কেন্দ্রীভূত হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পরিণতি হচ্ছে, সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা ক্রমশ পরিণত স্তর পার হয়ে সমাজ উত্তরণের একপর্যায়ে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হবে এবং এতে রাষ্ট্রের কাছে বৈধ সহিংসতার সবটাই কেন্দ্রীভূত হবে। অর্থাত্, এখানে এসে ম্যাক্স ওয়েবার বর্ণিত রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন আমরা সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঘটতে দেখব। তবে মনে রাখতে হবে, এই উত্তরণের কোনো গ্যারান্টি নেই। উত্তরণ উল্টোমুখীও হতে পারে অথবা একটি পর্যায়ে আটকেও থাকতে পারে অনেক দিন। আমার ধারণা, এই দুটোরই সংমিশ্রণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যাবে।

তবে সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় যে পরিণতমুখী উত্তরণ ঘটানোর প্রবণতা, তা বিশেষভাবে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাধারী এলিটদের প্রণোদনার ওপর। যেকোনো পরিবর্তন অতি আবশ্যিকভাবে হতে হবে প্রতিটি এলিট গোষ্ঠীর নিজ নিজ স্বার্থের অনুকূলে, নয়তো এলিট প্রণোদনার ভারসাম্য হারিয়ে যাবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হলো, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাকামী এলিট গোষ্ঠীর বিধিবদ্ধ সহিংস ক্ষমতা প্রয়োগের সঙ্গে তাদের অন্যবিধ অর্জনের (অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে) ভারসাম্য বজায় রাখার প্রশ্নটি। এ বিষয়টি থেকে জন্ম নিয়েছে দ্বৈত ভারসাম্যের (ডাবল ব্যালেন্স)১২ধারণা। এই ‘দ্বৈত ভারসাম্যের’ ওপরেই নির্ভর করে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়—এলিট সমঝোতার (এলিট সেটেলমেন্ট) সম্ভাবনা বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে—এলিট রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা। সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার অভ্যন্তরে প্রতিটি পরিবর্তনকেই (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আদর্শিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে) অতি আবশ্যিকভাবে ‘এলিট রাজনৈতিক সমঝোতার’ ভিত্তিতে হতে হবে। শুধু পরিবর্তন নয়, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার বিষয়টিও এই সমঝোতানির্ভর।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান হাল

আমি মনে করি, বাংলাদেশ সত্তরের দশকে সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার ইতিপূর্বে সংজ্ঞায়িত ‘মৌলিক’ পর্যায়ে ছিল (স্মরণ করুন বাকশাল ও তার পরবর্তী মিলিটারি শাসনের সময়কাল)। আমার ধারণা, আশির দশকের গোড়া থেকেই বাংলাদেশ ‘মৌলিক স্তর’ অতিক্রম করে অতিদ্রুতই ‘পরিণত’ সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় ঢুকতে পেরেছে। তবে এটা একদমই পরিণত পর্যায়ের প্রাথমিক স্তর, যেমন এক থেকে দশের মাপকাঠিতে (১ কম ১০ বেশি) হয়তো দুই বা তিনে এর অবস্থানে ছিল। ন্যূনতম প্রণালিগত গণতন্ত্র না থাকা সত্ত্বেও এত দ্রুততার সঙ্গে এই উত্তরণের কারণ হিসেবে বলব ব্যক্তিমালিকানাধীন অর্থনীতির অতি দ্রুত বিকাশ (সত্তর দশকের গোড়ায় অর্থনৈতিক উদারীকরণ এর পেছনে কাজ করেছে) এবং এনজিও সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রাষ্ট্র দ্বারা নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েও এবং রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থেকেও এ দুই সেক্টর রাষ্ট্রের সঙ্গে আপেক্ষিক স্বাধীনতা বজায় রেখেই সমাজ-অর্থনীতির উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পেরেছে। গণতন্ত্র না থাকায় এই সময়কালের সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অনুপস্থিত ছিল তা হলো সবচেয়ে প্রভাবশালী এলিট শ্রেণীর (সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক দলসমূহ) ভেতরে রাজনৈতিক সমঝোতা। অর্থাত্, এলিট প্রণোদনায় ভারসাম্য ছিল না, যার পরিণতিতে আশির দশকের সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, যেটির প্রতিফলন ঘটেছে ওই সময়ের ক্রম-বিক্ষুব্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের টালমাটাল অবস্থায়। নব্বইয়ের দশকে এসে কমপক্ষে দুটি কারণে ১. ন্যূনতম প্রণালিগত গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং ২. অতি ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি এলিট গ্রুপের (সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক দলসমূহ) মধ্যে সমঝোতা এই সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আমার ধারণা, এই সময়ের পরিণত পর্যায়কে এক থেকে দশের মাপকাঠিতে প্রায় পাঁচ দেওয়া যাবে। আমি এটাকে ‘অর্ধপরিণত’ (সেমি-ম্যাচিউর) প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা বলতে চাই। এই প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থাটি নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে বর্তমানে কমবেশি টিকে আছে। এটি টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক এলিটরা নানাবিধ কৌশলের অবলম্বন করেছে, যেমন বল-প্রয়োগ, ‘দলে ভেড়ানো’ বা আত্তীকরণ এবং সাধারণ জনগণের কাছে রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন ও উন্নয়নের বৈধতা নির্মাণ। এ ছাড়া এই ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখার পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তিরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এই কৌশলগুলো ও তাদের ফলাফলের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র নিচের সারণিতে তুলে ধরা হলো।

সারণি-১: বর্তমানের ‘অর্ধপরিণত’ সীমিত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে এলিটদের কৌশলসমূহ

প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে কৌশলসমূহ*

ক্ষেত্র ও প্রক্রিয়া

 

বল-প্রয়োগ (কোয়ের্শন)

বর্তমান এলিট ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে

  • ‘প্রচলিত’ অনুদার ব্যবস্থার সীমার মধ্যেই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণ;

     

  • আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে উন্নয়ন এনজিওগুলোর ‘রাজনৈতিক পরিসর’ (পলিটিক্যাল স্পেস) সীমিত করা;

     

  • প্রচলিত ব্যবস্থাবিরোধী ইসলামি ও বাম দলগুলোকে সহিংসভাবে দমন।                                          

বর্তমান এলিট ভারসাম্যে সংকট তৈরি করছে**

  • বৃহত্ বৈধ ইসলামি দলকে সহিংসভাবে দমন— জামায়াতে ইসলামী;

     

  • বৈধ ক্ষুদ্র ইসলামি দল এবং ইসলামি নাগরিক সমাজ, যারা নির্দিষ্ট সামাজিক (শিক্ষানীতি, মাদ্রাসা পাঠ্যক্রমের যথোপযুক্ত স্বীকৃতি, নারী উন্নয়ন নীতি ইত্যাদি) নীতির সঙ্গে শরিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য দাবি করছে, তাদের সহিংসভাবে দমন।               

আত্তীকরণ (কো-অপ্টেশন)                           

 

বর্তমান এলিট ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে:    

    • বৃহত্ উন্নয়নমূলক এনজিওগুলোকে সাব-কন্ট্রাক্ট এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন দিয়ে রাষ্ট্রের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে নিয়োজিত করা (সহযোগিতা/আত্তীকরণ/ ‘দলে ভেড়ানো’)

       

    • নাগরিক সমাজের কিছু অংশকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তাদের মধ্যে একতা এবং সংহতি দুর্বল করার চেষ্টা;
    •    
    • ক্ষুদ্রতর ইসলামি দল এবং গোষ্ঠীগুলোকে রাজনৈতিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা;

 

  • স্থানীয় রাজনৈতিক এলিটদের (উপজেলা পর্যায়ের যারা) মধ্যে দলগত বিভাজনের সুবিধা নিয়ে এবং কিছু অংশকে আত্তীকরণের  মাধ্যমে তাদের দুর্বল করার প্রচেষ্টা;

     

  • দলীয় মালিকানার মাধ্যমে বেসরকারি মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ/ আত্তীকরণের প্রচেষ্টা। কিন্তু বাস্তবে এমন কৌশল রাজনৈতিক এলিটদের পক্ষে যায়নি।দর্শক-শ্রোতাদের চাহিদার কারণে দলীয় মিডিয়াও বাধ্য হয়েছে অনুদার রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার এবং এলিট দুর্নীতির ব্যাপারে সমালোচনা করতে। মিডিয়া রাষ্ট্রের বা রাজনৈতিক এলিটদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবেই রয়ে গেছে।

বর্তমান এলিট ভারসাম্যে সংকট তৈরি করছে**

  • উচ্চ আদালতের ক্রমাগত রাজনীতিকীকরণের প্রচেষ্টা।

     

  • সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের ক্রমাগত রাজনীতিকীকরণের প্রচেষ্টা।

রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন (পলিটিক্যাল লেজিটিমেসি বিল্ডিং)  

বর্তমান এলিট ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে:

  • প্রভুত্বকারী রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক (ইলেক্টরাল)গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈধতা টিকিয়ে রাখা; 

     

  • পরিবারতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের ক্যারিশম্যাটিক বৈধতা টিকিয়ে রাখা এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়ানো;     
  • বৃহত্ রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বোচ্চ নেতাদের ক্যারিশমা টিকিয়ে রাখা এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়ানো;
  •  
  • প্রতিষ্ঠাতাদের ও নেতৃত্বের এসব ক্যারিশমা দলীয় স্থিতিশীলতা রক্ষা করে যাচ্ছে।                              

বর্তমান এলিট ভারসাম্যে সংকট তৈরি করছে**

  • মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতা (রাজনৈতিক দল ও পরিবারতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা কী ছিল/এখন কোন দল বেশি মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনা’ ধারণ করে ইত্যাদি প্রসঙ্গ);   

     

  • ভারতের সঙ্গে দলগুলোর রাজনৈতিক এবং আদর্শগত সম্পর্কের প্রোপাগান্ডা (কোন দল বেশি মাত্রায় ভারতপন্থী? কোন দল ভারত থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা যথা, পানি, বাণিজ্য-সুবিধা বা ট্রানজিট নিশ্চিত করতে পারবে এবং পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারবে?                              

উন্নয়ন বৈধতা নির্মাণ (ডেভেলপমেণ্টাল লেজিটিমেসি বিল্ডিং) 

 

বর্তমান এলিট ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে

  • ম্যাক্রো-পরিসরে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা;

     

  • দরিদ্রদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার প্রদানে সফলতা;

     

  • মোটামুটিভাবে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হার রক্ষা করা।

বর্তমান এলিট ভারসাম্যে সংকট তৈরি করছে**

  • তাত্পর্যপূর্ণ কোনো সংকট নেই।

আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা                          

 

  • নির্বাচনে বৈধতা প্রদানের মাধ্যমে সুষ্ঠু এলিট পালাবদল (এলিট সাকসেশন) সম্ভব করছে;
  •      
  • সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ঠেকানো।

 

* বাম কলামে নির্দেশকগুলো পার্কস ও কোল (২০১০) থেকে নেওয়া।

** বিদ্যমান (real) এবং সম্ভাব্য (potential)।

 এ লেখার শুরুতেই বলে নিয়েছিলাম, বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের বিকাশ ও গতিময়তার বিশদ তথ্যবিবরণীতে যাওয়ার অবকাশ এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সম্ভব হবে না। এ প্রসঙ্গে আমি দ্রুত কিছু তথ্য পর্যবেক্ষণ পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চাই। রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রথম বিষয়টি ছিল ‘রাষ্ট্র নির্মাণ’। এর দুটো দিকের কথা আমি উল্লেখ করেছিলাম: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বা আরও বিস্তৃত করে বলা চলে প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় ব্যক্তি-নিরপেক্ষতার উদ্ভব ও রাষ্ট্রের (এবার মূলত সংগঠন অর্থে) ভেতরে বৈধ সহিংস ক্ষমতার প্রয়োগের সুসংহতকরণ। এ দুটো বিষয়েই বাংলাদেশের অবস্থান শুধু স্থবির হয়ে থাকেনি, বরং আমি দাবি করব, নব্বইয়ের দশকের তুলনায় এ ব্যাপারে বর্তমান সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র আরও পিছিয়েছে। শুধু ভাবুন আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কথা। পরিবারতন্ত্র সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে, অদূর ভবিষ্যতে যা থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়ার কথা কেউ ভাবতেও পারছে না। ব্যক্তি-নিরপেক্ষতার উদ্ভব ও সংহতকরণ প্রক্রিয়া শুধু রাজনীতিতেই অনুপস্থিত তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয় সংগঠনেও (প্রশাসন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে) এর কোনো হদিস মেলে না। এনজিওগুলোতেও একই চিত্র; এমনকি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানেও করপোরেট শাসনের বদলে পারিবারিক শাসনই প্রধান। আমাদের আলোচনার জন্য অবশ্য রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ টানাটাই যথেষ্ট ছিল।

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বৈধ সহিংসতার কেন্দ্রীভবন ও সুসংহতকরণ প্রক্রিয়ায় মিশ্র গতিময়তা লক্ষণীয়। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীভবন ও সুসংহতকরণের মূর্ত প্রকাশ হচ্ছে রাষ্ট্রের বৈধ সহিংসতা প্রয়োগের বিশেষায়িত সংগঠনগুলোর (যেমন: সেনাবাহিনী, বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনী এবং সর্বোপরি পুলিশ) ভূমিকা। এগুলো কি সর্বতোভাবে রাষ্ট্র সংগঠনে কেন্দ্রীভূত, নাকি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সমাজের পরাক্রমশীল এলিট গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ? বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক অর্থে প্রথম পর্যবেক্ষণটি প্রধানত সত্য। সেনাবাহিনীর ব্যাপারে কথাটি প্রায় সর্বতোভাবে সত্য। গত দুই দশকে রাজনীতির অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেলেও কার্যত সেনাবাহিনী রাষ্ট্র সংগঠনে কেন্দ্রীভূত ও সংহত একটি প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি সম্ভবত আরও জটিল,  যার আলোচনায় আমি এই লেখার শেষের দিকটায় আবার ফিরে আসব। অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর বেলাতেও এই পর্যবেক্ষণটি সত্য। পুলিশের বেলায় পর্যবেক্ষণটি খানিকটা জটিল। আনুষ্ঠানিক অর্থে এটি রাষ্ট্র সংগঠনে কেন্দ্রীভূত হলেও বাস্তবে এর দলীয়করণ যে পর্যায়ে গেছে, এটিকে আর প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র সংগঠনে কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান বলা দুষ্কর হয়ে পড়ছে। এটি বাস্তব অর্থে রাষ্ট্রসংগঠনের বাইরে সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার অধীনে সমাজে বিরাজিত ন্যূনপক্ষে দুটি রাজনৈতিক এলিট গোষ্ঠীর (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) আজ্ঞাবহ সহিংস ক্ষমতা প্রয়োগের বিশেষায়িত সংগঠনে পরিণত হয়েছে। পুলিশের দলীয়করণের সঙ্গে যোগ করা যাবে কার্যত বিশেষায়িত সহিংস ক্ষমতা প্রয়োগের আরও কিছু ‘প্রতিষ্ঠানের’ নাম, যারা বর্তমান কালের অনুদার শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপক। আমি এখানে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন ফ্রন্ট সংগঠনের কথা বলছি: ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠন। একবার ভাবুন, হরতালের সময় কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে চাঁদা আদায়ের বেলায় এদের বাস্তব ভূমিকার কথা। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক এলিটরা পুলিশের চেয়েও এদের ওপর বেশি নির্ভর করে হরতাল ব্যবস্থাপনায় অথবা বিরোধী শক্তি দমনে। এতে করে রাজনৈতিক এলিটরা সহিংসতার ব্যক্তিকরণ (প্রাইভেটাইজেশন অব ভায়োলেন্স) ঘটিয়েছে।

ওপরের এ আলোচনার ভিত্তিতে আমরা এ পর্যবেক্ষণে পৌঁছাতে পারি যে পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং ‘সহিংসতার ব্যক্তিকরণ’ রাষ্ট্র সংগঠনে বৈধ সহিংসতার কেন্দ্রীভবন ও সুসংহতকরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। রাজনৈতিক উন্নয়নের এ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশকটি গত দুই দশকের গণতন্ত্রে শুধু স্থবির থাকেনি, সম্ভবত অনেক পিছিয়েও গেছে। আইনের শাসন বাংলাদেশে সাধারণভাবে যে সংহত হয়নি, সেটা নিয়ে মতভেদ অল্প। তবে যেটা কৌতূহলোদ্দীপক সেটা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক উন্নয়নের দুই দশক পার হয়ে যাওয়ার পরও রাজনৈতিক এলিট শুধু নিজেদের জন্যও সীমিত আকারে আইনের শাসন কার্যত সংহত করতে পারেনি। পুলিশের দলীয়করণ, এলিট গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক আন্তসম্পর্ক বছরের পর বছর ধরে অনুদার প্রক্রিয়ার ভেতর আটকে রাখা, নিম্ন আদালতের কার্যক্রম দলনিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ না পাওয়া এবং বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, উচ্চ আদালতেরও নির্দিষ্ট কার্যক্রম (যেগুলো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট) অনেক ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবমুক্ত না হতে পারাটা এসব রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে আইনের শাসনের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার জন্মানোর ইঙ্গিত বহন করে না। মোদ্দা কথা যা দাঁড়াল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে, এমনকি রাজনৈতিক এলিটদের মাঝেও, আইনের শাসনের বদলে যেটা সৃষ্ট হয়েছে এবং কার্যত যা সংহত রূপ ধারণ করেছে তা হলো, আইনের শাসন নয়, বরং আইন দ্বারা শাসন (রুল বাই ল)।

এবারে আমি রাজনৈতিক উন্নয়নের অন্য নির্দেশকটি, অর্থাত্ রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে ন্যূনতম প্রণালিগত গণতন্ত্রের সুসংহতকরণের প্রশ্নে কিছু মন্তব্য রাখব। লক্ষ করুন, লেখার শুরুতেই যা আমি বলেছি, গণতন্ত্রের সুসংহতকরণ বলতে বর্তমানের অনুদার গণতন্ত্র থেকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে উত্তরণের কথা বলা হচ্ছে না। এখানে কেবল রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের কথা বলা হচ্ছে। গণতন্ত্র মানে সংশ্লিষ্ট এলিটদের মধ্যে বাধাহীন প্রতিযোগিতা— এর মধ্যে সীমিত থেকেই বিচারের প্রয়াস পাচ্ছি। গণতন্ত্রের ন্যূনতম সংজ্ঞা বলতে এখানে অনুসৃত হচ্ছে প্রতিযোগিতা বা গণতন্ত্রের বিখ্যাত তাত্ত্বিক রবার্ট ডল (Dahl) যেটাকে বলেছিলেন ‘কনটেসটেসন ওপেন টু পার্টিসিপেসন’ বা যাকে বলা যায়, অংশগ্রহণমূলক প্রতিযোগিতা।১৩ ন্যূনতম গণতন্ত্রের এ ধারণায় রাজনৈতিক উন্নয়নের ওপর আলোচিত নির্দেশকগুলো টেনে আনার প্রয়োজন নেই, যেহেতু অনুদার থেকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে উত্তরণের বিষয়টা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। পুলিশ নিরপেক্ষভাবে চলছে কি না, আদালত রাজনৈতিক দলের চাপমুক্ত থেকে কাজ করতে পারছে কি না বা দলীয় ছাত্রফ্রন্ট বাস্তব অর্থে আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় পরিণত হলো কি না, তা আমাদের এই গণতন্ত্রের ধারণায় বিবেচ্য বিষয় নয়। নির্বাচনটা সংশ্লিষ্ট এলিটদের বাধাহীন বা গ্রহণযোগ্য মনে হলো কি না, সেটাই এখানে প্রাসঙ্গিক। এটি একটি গণতন্ত্রের অত্যন্ত সীমিত নির্ধারক। এই সীমিত সংজ্ঞার মধ্যে থেকেই কয়েকটি কথা বলা যেতে পারে।

গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটিকে যত ‘সহজ’ ও সংকীর্ণভাবে আমরা উপস্থাপনা করি না কেন বাস্তবে এর অনুসরণ যে কত কঠিন, তা আমাদের রাজনৈতিক এলিটরা গত দুই দশকে চার চারটি নির্বাচনে তা প্রমাণ করেছে। এর সাম্প্রতিক ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা সবাই জানেন, তাই বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি না। তৃতীয় পক্ষের তত্ত্বাবধান ছাড়া (অর্থাত্, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া) নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না। তার পরও নির্বাচনের ফলাফল কোনো পরাজিত দলই স্বেচ্ছায় মেনে নেয় না (সেনাবাহিনী, বিদেশি চাপ ইত্যাদি ফলাফল মেনে নিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে, যদিও সেই সম্মতিও সাময়িক)। এবং মোটামুটিভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ বা স্বচ্ছ হবে, তা বিরোধী দল কল্পনাও করতে পারে না। এগুলোর অর্থ হলো, গেম থিওরির ভাষায় বললে দুই দশক ধরে গণতন্ত্রের ‘খেলা’ পুনরাবৃত্ত (রিপিটেড গেম) হলেও এটি এখনো পর্যন্ত কোনো স্বয়ং-প্রযুক্ত (সেলফ-এনফোর্সিং) ভারসাম্যে উপনীত হতে পারেনি। বিষয়টি বিরোধী দলের দিক থেকে দেখলে যৌক্তিকই মনে হয়। বিরোধী দলের যুক্তি হচ্ছে, ‘আমি ভালো করেই জানি (কেননা, আমি দেখছি এখন কী ঘটছে) নির্বাচনসংশ্লিষ্ট আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠান, আনুষ্ঠানিক অর্থে যে পর্যায়েই থাকুক না কেন, বাস্তবে তার অপপ্রয়োগ ঘটবে। তাই দলীয় তত্ত্বাবধানে নির্বাচন আমি মানব কেন?’ তবে ক্ষমতাসীন এলিটদের দিক থেকে দেখলে প্রচলিত এলিট প্রণোদনার রূপটি কিছুটা রহস্যজনকই মনে হয়। ক্ষমতাসীন এলিটরা তো এটাও ভাবতে পারতেন যে ‘আমি যদি মনে করি ন্যূনতম প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখাটা আমাদের (সব রাজনৈতিক এলিটদের) জন্য জরুরি, তাহলে আমি আইন বা প্রতিষ্ঠানের অপপ্রয়োগ (সুযোগ আছে বলেই) কেন করব এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের বর্তমান ভারসাম্যটাকে যুগ যুগ ধরে কেন টিকিয়ে রাখব? আমি তো জানি, এই ভারসাম্যের পরিণতি কী হতে পারে (সব রাজনৈতিক এলিটের জন্যই তা আত্মবিধ্বংসী, যেটি ২০০৭-০৮ সালে আমরা দেখেছি)।’ এ সত্ত্বেও এলিটদের ন্যূনতম প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র যে এ দেশে স্বয়ং-প্রযুক্ত হলো না, তার একটা মৌলিক কারণ সম্ভবত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটদের দিক থেকে এ ধরনের গণতন্ত্রের একটা বিশেষ শর্ত মেনে না নেওয়া। প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রের মধ্যে সংজ্ঞাগতভাবেই—একটি অন্তর্নিহিত ‘অনিশ্চয়তা’ রয়ে গেছে।১৪ এর অর্থ হলো, ‘নির্বাচনে আমি হেরে যেতে পারি এবং সংশ্লিষ্ট আইনকানুন বা প্রতিষ্ঠান সবার জন্য একই আছে, এ বিশ্বাস রেখে গণতন্ত্রের অনিশ্চয়তায় নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়া চাই। ভোটার বা জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কী চায়।১৫ এবং আমি আরও জানি, ভবিষ্যতেও ক্ষমতাসীন দল একই অনিশ্চয়তার গ্যারান্টি দিয়ে নির্বাচন দেবে এবং আমার দল ক্ষমতাসীন যদি না-ও থাকে, তবু আমার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। আমি এখন এবং ভবিষ্যতেও গণতন্ত্রের এ খেলায় নির্দ্বিধায় অংশগ্রহণ করব।’ এ রকম যেখানে ভাবা হয় সেখানেই গণতন্ত্রের স্বয়ং-প্রযুক্ত ভারসাম্যে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো ‘বাইরের’ তৃতীয় পক্ষের (তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সেনাবাহিনী অথবা বিদেশি শক্তি) প্রয়োজন হয় না গণতন্ত্রকে চালু রাখার জন্য বা পারস্পরিক বিশ্বাসের একটি শুভ চক্রের মধ্যে গণতন্ত্রকে সুসংহত করে ফেলার জন্য। 

কিন্তু শুভ চক্রের গণতন্ত্রের যে চিত্রটির বর্ণনা আমি এখানে করলাম, সেটা শুধু যৌক্তিক সম্ভাবনার, বাস্তবের নয়। খুব সংক্ষেপে বললে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির বাস্তবতা অনেকটা এই রূপ: ন্যূনতম প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তা সুসংহতকরণের দুটি মৌলিক শর্তই আজকের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। এই দুটো শর্ত হচ্ছে—(ক) এলিটদের ভেতরে নিজে বাঁচো ও অন্যকে বাঁচতে দাও নীতি (লিভ অ্যান্ড লেট লিভ পলিসি) এবং (খ) রাজনৈতিক এলিটদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা বদলের সর্বগ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি। এর ফলাফল: সবার সঙ্গে সবার ‘হবসিও যুদ্ধ’ (Hobbesian war of all against all) অর্থাত্, একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি, এবং রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের শুভ চক্রের সৃষ্টির বদলে ক্রমাগত পারস্পরিক অবিশ্বাসের দুষ্টচক্রের জন্ম ও তার সংহতকরণ।

বাংলাদেশে কেন রাজনৈতিক উন্নয়ন হয় না?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের নির্দেশকগুলোর বর্তমান অবস্থার চিত্রটি আমি বর্তমান লেখায় একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছি। বিশ্লেষণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ‘কী হচ্ছে’ তার বর্ণনা দেওয়ার চেয়ে ‘কেন হচ্ছে’ তার সদুত্তর খোঁজা। এখানে লেখার শুরুতেই যেমনটা বলা হয়েছে, উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই বেশি করব এবং ভবিষ্যত্ আলোচনার একটা তত্ত্বগত রেখাচিত্র দেওয়ার চেষ্টা করব। আলোচনায়, তাত্ত্বিক ফ্রেম বা কাঠামো হিসেবে প্রধানত NWW বর্ণিত সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার ধারণাটি ব্যবহূত হবে।

শুরুতেই রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রথম দুটো নির্দেশকের ওপর আলোকপাত করব। এগুলো হলো: রাষ্ট্র নির্মাণ ও আইনের শাসনের সুসংহতকরণ। এই আলোচনায় আগেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্র নির্মাণ বলতে বোঝানো হচ্ছে দুটো নির্দেশককে: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যক্তি-নিরপেক্ষতার উদ্ভব এবং বিধিবদ্ধ বা বৈধ সহিংস ক্ষমতা প্রয়োগের সুসংহতকরণ। আর আইনের শাসনের বিষয়টি এখানে সীমিত অর্থে ব্যবহূত হচ্ছে, অর্থাত্ শুধু রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে আইনের শাসনের প্রয়োগ ও তার বৈধতাকে বিচার করা হচ্ছে।

আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের রাজনৈতিক এলিটদের (সব পক্ষের কথাই বলছি) মধ্যে একটি নীরব রাজনৈতিক সমঝোতা (পলিটিক্যাল সেটেলমেণ্ট) বিরাজ করছে, আর সেটি হলো রাজনৈতিক সমাজে (পলিটিক্যাল সোসাইটি) ও রাষ্ট্রসংগঠনে ব্যক্তি-নিরপেক্ষতার উদ্ভবের প্রক্রিয়াকে যত দিন সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা। ঠিক একই সমঝোতা আছে রাষ্ট্রসংগঠনের অভ্যন্তরে বৈধ সহিংস ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, ও সুসংহতকরণ প্রক্রিয়াটাকেও বাধা দেওয়া এবং এলিটদের মধ্যে আইনের শাসনের বদলে ‘আইন দ্বারা শাসন’ প্রক্রিয়াটিকে চালু রাখা। গণতন্ত্রে উত্তরণের পর্বে রাজনৈতিক এলিটরা খুব সফলতার সঙ্গে এসব কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনসমূহকে আটকে রাখতে পেরেছে। এলিট সমঝোতার মানেই হচ্ছে এলিট প্রণোদনার ভারসাম্য। সংশ্লিষ্ট পক্ষের কারও এ ভারসাম্যের কারণে বিশেষ কোনো ক্ষতিসাধন না হলে বিদ্যমান ভারসাম্যও বদলাবে না। কেননা, ভারসাম্য সংজ্ঞার্থেই স্থিতি পরিবর্তনের অভ্যন্তরীণ কারণাভাব। ভারসাম্য না পরিবর্তনের অর্থ হলো প্রচলিত সমাজ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না ঘটা। প্রচলিত এ ভারসাম্য সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক এলিটদের জন্য শুভকর হলেও (কেন, তার ব্যাখ্যায় একটু পরেই যাচ্ছি) বাংলাদেশের সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার গতিময়তার পরিপ্রেক্ষিতে ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটি বেশ অশুভ। সে জন্য বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষিত থেকে দেখলে এটি একটি দুষ্টু ভারসাম্য (পারভার্স ইকুইলিব্রিয়াম) ।

প্রচলিত ভারসাম্যটি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক এলিটদের জন্য শুভকর কেন? এর প্রধান কারণ ভারসাম্যটি অনুদার শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখছে। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক এলিটদের জন্য এ ব্যবস্থা টিকে থাকার লাভ অনেক। এটা টিকে থাকলেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাস্তবে শুধু ন্যূনতম প্রনালিগত গণতন্ত্রে বা আরও সীমিত অর্থে, নির্বাচনী প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রের বৃত্তেই ঘুরপাক খাওয়াতে পারে এলিটরা। অনুদার ব্যবস্থা থেকে উদারনৈতিক ব্যবস্থার গণতন্ত্রে উত্তরণের বিষয়টিকে প্রান্তিকীকরণ করা যায় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ডিসকোর্সে। এতে করে কার্যকরভাবে, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার বিভিন্ন নাগরিক সমাজের গ্রুপগুলোকেও সফলতার সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অপাঙেক্তয় করে রাখা সম্ভব। গত দুই দশকে এই এলিট সমঝোতাভিত্তিক অনুদার প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্যের রাজনৈতিক ভাবাধিপত্য (হেজিমনি), নাগরিক সমাজের প্রায় সব গ্রুপকে অতি সফলতার সঙ্গে প্রান্তিকীকরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশে রাজনৈতিক উন্নয়নের অসফলতার এটি একটি বড় কারণ।

দুই দশকের বেশি গণতান্ত্রিক উত্তরণের পর্বে আমরা লক্ষ করছি, সার্বিক অনুদার শাসনব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক এলিট বর্তমানের সাময়িক কষ্ট বা অত্যাচার মেনে নিয়েছে। আদালত বা পুলিশের অন্যায়, অবিচারমূলক ব্যবহার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ফ্রন্টগুলোর জুলুম বা সহিংসতা ইত্যাদি সহ্য করা বা প্রতিবাদ হলেও তাকে তাত্ক্ষণিক দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা (আটক ব্যক্তির মুক্তি চাওয়া, বেইল চাওয়া, ইত্যাদি)—এই ছিল মোটামুটিভাবে বিরোধী এলিটের অনুদার শাসনের বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিক্রিয়া। লক্ষ করুন, বিরোধী এলিট কখনোই পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধের স্থায়ী পদক্ষেপের দাবি জানায়নি। সহিংস রাজনৈতিক ফ্রন্টগুলো যে আইনের ঊর্ধ্বে থেকে তত্পরতা চালায়, তা স্থায়ীভাবে বন্ধের দাবি তোলেনি অথবা আদালতের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধের জন্য বিচারব্যবস্থার সার্বিক স্বাধীনতা দাবি করেনি।১৬ শুধু অপেক্ষা করেছে ক্ষমতায় এসে একই অনুদার-ব্যবস্থার পরিপূর্ণ সুযোগ নেওয়ার। অনুদার-ব্যবস্থার এই পৌনঃপুনিক (অ্যাড ইনফিনিটাম) ব্যবহারের ফল যে একটি এলিট দ্বৈত-ভারসাম্য তাকেই প্রমাণ করে; সক্রিয় ভারসাম্যের যুক্তিই বলে যে এটা ভেতর থেকে সহজে ভাঙার নয়। এটা ভাঙবে বাইরের কেউ, নীতিভিত্তিক অর্থে নাগরিক সমাজের গ্রুপগুলো। তবে বাস্তবে, গত দুই দশকে, এটা সীমিত সময়ের জন্য হলেও হয়তো একবারই শুধু ভেঙেছে ২০০৭-০৮ সালের মিলিটারি-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে—অন্তত কিছু সময়ের জন্য। ২০০৯-এর নির্বাচনোত্তর গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ অনুদার এলিট ভারসাম্যটি তেমন কোনো পরিবর্তন ছাড়াই কার্যত অর্থে অতিদ্রুতই ফিরে এসেছে।

আমি দাবি করছি, এই অনুদার এলিট ভারসাম্য রাজনৈতিক এলিটদের জন্য শুভকর হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন ও সীমিত প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার গতিময়তার জন্য এর প্রভাব অতি ঋণাত্মক। এর নীতিভিত্তিক যুক্তির ব্যাখ্যায় যাওয়ার দরকার নেই। আমরা সবাই উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এবং উদার শাসনব্যবস্থায় থাকতে চাই বা যেতে চাই। নাগরিক বা মানুষ হিসেবে এতটুকু মৌলিক অধিকার সংবিধান আমাদের দিয়েছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদেও আমাদের এই অধিকার সংরক্ষিত আছে। বিশেষ ক্ষতির দিক হলো, এই অনুদার এলিট ভারসাম্য প্রচলিত সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার প্রগতিশীল গতিময়তার সম্ভাবনাতেও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থা যে অনেক দিন ধরে ‘অর্ধপরিণত’ অবস্থায় আটকে আছে, পরিণত হওয়ার মাপকাঠিতে যে এটি পাঁচের মাত্রাকে অতিক্রম করতে পারছে না, তার জন্য প্রধানত দায়ী বর্তমানের এলিট অনুদার ভারসাম্যটি। সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় বৈশ্বিক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে NWW দেখিয়েছেন যে এ ব্যবস্থাকে যদি অধিকতর পরিণত হতে হয় তার জন্য তিনটি শর্ত (যাকে তাঁরা বলছেন-doorstep conditions) পূরণ হতে হবে, যা এলিটদের নিজেদের ভেতর ব্যক্তি-নিরপেক্ষতার প্রসার ঘটাতে প্রণোদনা জোগাবে। এই শর্ত তিনটি হলো: এলিটদের মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রসংগঠন ও রাজনৈতিক সমাজে এমন প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানসমূহের  উদ্ভব, যা ব্যক্তির বা দলের পরিচিতি নিরপেক্ষ এবং সেনাবাহিনীর ওপর রাষ্ট্রসংগঠনের কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সুসংহতকরণ। আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের প্রচলিত এলিট অনুদার ভারসাম্য, তিনটি শর্তের প্রথম দুটির উদ্ভব ও সুসংহতকরণের পথে বিরাট বাধা। রাজনৈতিক দলে ব্যক্তি প্রাধান্য বা পরিবারতন্ত্র বর্তমানে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। রাষ্ট্রের সংগঠনগুলা (আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ) ব্যাপক অর্থে ব্যক্তি বা দলনিরপেক্ষ নয় এবং এ দুটির প্রভাবও আগের চেয়ে অনেক বেশি। তৃতীয় শর্তের বিষয়টি কিছুটা জটিল। আগেই আলোচনা করা হয়েছে,  সেনাবাহিনী কার্যত রাষ্ট্রীয় সংগঠনে কেন্দ্রীভূত ও সংহত একটি প্রতিষ্ঠান। তবে কথাটা হয়তো সর্বতোভাবে সত্য নয়। এটি এই অর্থে সত্য যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান (মনে রাখবেন, আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই এবং ভৌগোলিকভাবে আমাদের কাছের দেশ আফগানিস্তান বা নেপালে সেনাবাহিনী এখনো সম্পূর্ণভাবে জাতীয় প্রতিষ্ঠান নয়)। অবশ্য খুব সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক এলিটদের ক্ষমতা বদলের পদ্ধতির অনেক দিনের সমঝোতা বিনষ্ট হওয়ায় (যার পরিণতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপ করা হয়েছে) সেনাবাহিনীর ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সুসংহতকরণের বিষয়টি আর স্পষ্ট নয়। এক-এগারোর ভূত আজ যেভাবে রাজনৈতিক আলোচনাকে (জনপ্রিয় এবং একাডেমিক বলয়ে) তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে NWW  প্রদত্ত তৃতীয় শর্তটি বাংলাদেশে প্রযোজ্য—এ কথাটি আর হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না।১৭ হয়তো বলা চলে শর্তটি বাংলাদেশে আংশিক অর্থেই প্রযোজ্য। এ যাবত্ আলোচনায় তাহলে এই দাঁড়াল যে বর্তমানের এলিট সমঝোতাভিত্তিক অনুদার ভারসাম্যটি সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থার অধিকতর পরিণত হওয়ার প্রগতিশীল সম্ভাবনার পথকে রুদ্ধ করে রেখেছে। যার ফলাফল বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে হয়েছে অতিমাত্রায় ঋণাত্মক।

রাজনৈতিক উন্নয়নের ৩ নম্বর নির্দেশকটিতে এবার আসা যাক: গণতন্ত্রে উত্তরণ। অর্থাত্, ন্যূনতম প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্রের সুসংহতকরণ। এখানে প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক এলিটদের পক্ষে নির্বাচনী গণতন্ত্রের অন্তর্নির্হিত অনিশ্চয়তাকে মেনে নেওয়ার ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা বোঝার জন্য আমরা একাডেমিক আলোচনার একটি বিশেষ তাত্ত্বিক ঘরানার সাহায্য নিতে পারি। এটি হচ্ছে এলিটকেন্দ্রিক বা ‘এজেন্সিকেন্দ্রিক’ তত্ত্ব। এর মূল কথাটি হলো এই: গণতন্ত্রের সুসংহতকরণ অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক এলিটদের কৌশলগত সমঝোতার একটা রূপ। সেটাই যদি হয়, তাহলে গণতন্ত্র সংহতকরণ হবে কিছু সময়ের ব্যবধানে। যুক্তিটা হচ্ছে এরূপ: সময়ের পরিসরে রাজনৈতিক এলিটরা একে অন্যের সংস্পর্শে বারবার আসে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কর্মপ্রক্রিয়ার বদৌলতে। এতে করে গণতন্ত্রের স্বয়ংপ্রযুক্ত গুণাবলির (যেমন: গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক বিশ্বাস ইত্যাদি) উন্মেষ ঘটে যায় সংশ্লিষ্ট এলিটদের ভেতর। এর মানে দাঁড়ায়, সময়ের ব্যবধানে, বর্তমানের গণতান্ত্রিক ‘উত্তরণের’ পর্যায় (যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এলিটদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব) থেকে এলিটরা সরে গিয়ে গণতন্ত্রের অভ্যাসগত পর্যায়ে উপনীত হয় (যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধাবোধ)।১৮

বাংলাদেশে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক এলিটরা এ তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ‘উত্তরণ’ পর্যায় থেকে ‘অভ্যাসগত’ পর্যায়ে উঠে আসতে পারেনি। স্পষ্টতই এ তত্ত্বের মূল অনুমানটি— সময়— প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে বোধ করি উপযোগী নির্ধারক নয়। তা ছাড়া এ তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুমান— গণতন্ত্র জন্মায় এলিটদের ইচ্ছায় ও সিদ্ধান্তে— যারা এ ব্যাপারে খুব অল্পই প্রভাবিত হয় ‘কাঠামোগত’ (একটু পরেই ব্যাখ্যা দেব) বিষয় দ্বারা— এটিও সম্ভবত গণতন্ত্র সুসংহতকরণের ব্যাখ্যার উপযোগী নয়।

বাংলাদেশের এলিটদের মধ্যে গণতন্ত্রের ‘অভ্যাসগত’ পর্যায়ে উপনীত না হওয়ার কারণ বোধ হয় এলিট বা এজেন্সিকেন্দ্রিক অতিমাত্রায় ব্যক্তি-ইচ্ছা-নির্ভর তত্ত্বে না খুঁজে  গণতন্ত্রের ‘কাঠামোগত’ তত্ত্বে খোঁজা যেতে পারে।১৯ খুব সহজ করে বললে এ ঘরানার তত্ত্ব দাবি করে যে সমাজে ও অর্থনীতিতে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে গেলে তা গণতন্ত্র নির্মাণে সহায়ক হয়। গণতন্ত্র দারিদ্র্যের মাঝে বা অনুন্নত সমাজব্যবস্থায় জন্মায় না, বরং তা বিকশিত হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের হাত ধরে। শিল্পায়ন, শিক্ষার প্রসার, নগরায়ণ এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামাজিক শ্রেণীসমূহের উদ্ভব ও বিকাশ (বুর্জোয়া, শ্রমিকশ্রেণী, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী) সমাজে জটিলতা বাড়ায়, যা গণতন্ত্র জন্মানোর উর্বর জমি হিসেবে কাজ করে। গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য অর্থনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে প্রবৃদ্ধি ঘটা খুব জরুরি, কেননা এতে করে একটি সামাজিক অবকাঠামো (সামাজিক শ্রেণীর কোয়ালিশন, যাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া দাবি করার ও প্রয়োজনে সেগুলো রক্ষা করার প্রণোদনা ও সক্ষমতা রয়েছে) তৈরি হয়, যা গণতন্ত্রের সুসংহতকরণের জন্য প্রয়োজন।

গণতন্ত্রের কাঠামোগত তত্ত্বকে অনুসরণ করলে আমরা কিন্তু প্রত্যাশা করতে পারি বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে যে দ্রুত ও সুদৃঢ় (রোবাস্ট) অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটে চলেছে, তাতে করে গণতন্ত্রের জন্য জরুরি ওই সামাজিক কাঠামোটি একটা মোটামুটি ভালো পর্যায়ে সম্ভবত সংগঠিত ও সংহত হয়েছে। আমার এ ধারণা যদি সত্য হয়, তাহলে গণতন্ত্রে উত্তরণ ও তা সুসংহতকরণ বা সার্বিকভাবে রাজনৈতিক উন্নয়নের ওপর ওই সামাজিক কাঠামোটির শুভ প্রভাব এখনো কেন আমরা লক্ষ করছি না? তাহলে কাঠামোগত তত্ত্বটিও কি এলিট বা এজেন্সিকেন্দ্রিক তত্ত্বটির মতো বাংলাদেশের বাস্তবতা ব্যাখ্যায় অকার্যকর? কাঠামোগত তত্ত্বের প্রতি আমার ব্যক্তিগত সহানুভূতি আছে এবং এ ব্যাপারে আমি এতটা চূড়ান্তধর্মী মন্তব্য করব না। আমার কাছে মনে হয়, কাঠামোগত তত্ত্ব বাংলাদেশের বাস্তবতার আংশিক ব্যাখ্যার উপযোগী। বাকিটার জন্য অন্যান্য তত্ত্বেরও খোঁজ করতে হবে। অর্থনীতি ও সমাজ-প্রক্রিয়া রাজনীতির ওপর অভিঘাত ফেলে এবং রাজনীতির প্রকৃতি ও গতিময়তাকে প্রভাবিত করে সত্যি, কিন্তু তার ফলাফল কোনো সরলরৈখিক কার্যকারণ দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং ফলাফলের পেছনে বহু রৈখিক কার্যকারণ সক্রিয় থাকে। লক্ষ করে দেখবেন, বাংলাদেশের এলিট অনুদার ভারসাম্যের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্তের একাংশই প্রধানত (অধিকার দাবিভিত্তিক নাগরিক সমাজে যারা সংঘবদ্ধ এবং বেসরকারি মিডিয়া) মোটামুটিভাবে উচ্চকিত—বুর্জোয়া ও শ্রমিকশ্রেণী নয়। এটা যদিও সমগ্র বিশ্বের গণতান্ত্রিক উত্তরণের তৃতীয় স্রোত এবং সম্ভবত চতুর্থ স্রোতের (মধ্যপ্রাচ্যে যা এখন চলছে) তার বেলাতেও সত্য (Bellin 2000; Diamond et.al, 1996)। এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন।

বাংলাদেশে লক্ষ করবেন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল (মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) গোটা সমাজ এমনকি রাষ্ট্রসংগঠনের ওপরও প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য এবং ভাবাধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। সে অনুযায়ী এ দেশের সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থাটির গতিময়তার একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হচ্ছে দলতন্ত্র (partyarchy)।২০ এ দেশের নাগরিকত্ব (সিটিজেনশিপ) ও তার সামষ্টিক উদ্যোগের (কালেকটিভ অ্যাকশন) গতিময়তার ভেতরেও দারুণভাবে দলতন্ত্রের গভীরতর প্রভাব লক্ষণীয়। পরিবারতন্ত্র এবং এটির ভাবাদর্শগত প্রভাব এবং তার সঙ্গে যদি মেলাই দলতন্ত্রের বিষয়টিকে তাতে করে যে রাজনৈতিক ভাবাধিপত্যের উন্মেষ ঘটেছে, তা এ দেশের নাগরিক সমাজের স্বাধীনতার পরিসরকে দারুণভাবে সংকুচিত করেছে। এটা শুধু বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের প্রক্রিয়াকেই বাধাগ্রস্ত করছে না (যেটা অতি আবশ্যিকভাবেই বিকল্প ভাবাধিপত্যের জন্ম ও বিকাশের জন্য জরুরি), একই সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণীর ও মধ্যবিত্তের এবং এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রফেশনাল শ্রেণীর স্বাধীন রাজনৈতিক পরিসরের উন্মেষ ও বিকাশকে নানাভাবে আটকে রাখছে। এর ফলাফল বাংলাদেশের বর্তমান কালের ‘অর্ধপরিণত’ সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের বাইরে ব্যক্তি খাত, অর্থাত্ ব্যবসায়ী ও প্রফেশনাল জগত্ যে ক্রমপ্র্রসারমাণ স্বাধীন পরিসর অবজেকটিভ অর্থে (অর্থাত্ ব্যক্তি খাত-চালিত অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের বদৌলতে) উপভোগ করছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক সাবজেকটিভ শর্তটি একই মাত্রায় বিকশিত হতে পারছে না। রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্লায়েন্টিলিস্টিক (clientelistic) নির্ভরশীলতার জালে আটকে পড়া বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষে রাজনৈতিক সাবজেকটিভ শর্তের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না (এফবিসিসিআই-এর যৌথ কর্মকাণ্ডের গতিময়তার কথা ভাবুন এবং চিকিত্সক, শিক্ষক ইত্যাদি পেশাজীবীদের দলতন্ত্রে আটকে পড়া ‘অ্যাসোসিয়েশন রাজনীতির’ কথা মনে করুন)। গণতন্ত্রের দুই দশকেও লক্ষ করবেন, এ পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়নিই, বরং অবনতির সব চিহ্নই স্পষ্ট। অর্থনীতিবিদ মুশতাক খান২১ যখন বলেন, ক্লায়েন্টিলিস্টিক বলয়ে  উদারনৈতিক গণতন্ত্র বিকশিত হয় না, তার জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির প্রাক-ধনতান্ত্রিক ইনফরমাল পর্যায় থেকে ধনতান্ত্রিক বা ফরমাল পর্যায়ে উত্তরণ, তখন তিনি কাঠামোগত গণতন্ত্রের তত্ত্বের মূল বিশ্লেষণাত্মক পরিপ্রেক্ষিতটিই তুলে ধরেন। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা হচ্ছে, যেটাকে আমি ধাঁধা বলছি, উল্লেখযোগ্য ধনতান্ত্রিক বিকাশ সত্ত্বেও কেন তাহলে গণতন্ত্রের এই সমাজকাঠামোটি (আধুনিক অর্থনীতির ও সমাজ বিকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর উদ্ভব ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের সক্রিয় উদ্যোগ) ন্যূনতম গতিশীলতা পাচ্ছে না? এর জন্য আমার ধারণা, কাঠামোগত তত্ত্বের কিছুটা বাইরে গিয়ে, বাংলাদেশে দলতন্ত্রের উন্মেষ ও বিকাশ, ভাবাদর্শ, ভাবাধিপত্যের উত্থান ইত্যাদি বিষয় বিশ্লেষণের ফ্রেমে নিয়ে আসা জরুরি। লক্ষ করবেন, আমার বিশ্লেষণে বারবার যে অনুদার এলিট ভারসাম্যের কথাটি চলে এসেছে, সেটি কিন্তু একই সঙ্গে কাঠামোগত ও ভাবাদর্শগত প্রত্যয়। এটি রাজনীতি ও সমাজের গতিময়তাকে শুধু কাঠামোগতভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে না, এলিটদের প্রয়োজনীয় ভাবাদর্শের বৈধতাও প্রদান করে।

রাজনৈতিক উন্নয়নসংশ্লিষ্ট ধাঁধাটির সমাধানের খোঁজ করতে আমাদের প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ও রাজনৈতিক অর্থনীতির আরও তত্ত্বের প্রয়োগ, যেগুলো আলোকপাত করবে রাজনৈতিক দলের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়ায়, রাজনৈতিক দল ও সমাজের সম্পর্কে, রাজনৈতিক শ্রেণীর সমাজে ভাবাধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়, রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্ভব ও বিকাশে ও পেট্রন-ক্লায়েন্টিলিজমের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর। এ বিষয়গুলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের সঙ্গে রাজনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্কের বিন্যাসকে নানাভাবে প্রভাবিত করে এবং আমাদের অনেক সহজ প্রত্যাশার ব্যত্যয় ঘটায়। রাজনৈতিক উন্নয়নের ব্যাখ্যায় নানা তত্ত্বের জটিল প্রয়োগের ও বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমাদের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পটভূমিতে রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্রমাগত ব্যর্থতার ধাঁধাটিকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

তথ্যসূত্র ও টীকা

১. স্যামুয়েল হান্টিংটনের পলিটিক্যাল অর্ডার ইন চেঞ্জিং সোসাইটি (১৯৬৮) আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় একটি চিরায়ত গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।

২. গণতন্ত্রের এই ধরনের ধারণার বিশ্লেষণাত্মক বর্ণনার জন্য দেখুন অ্যাডাম সেভরস্কি (Adam Prezworski), ১৯৯১ ।

৩. বিশ্বব্যাংক, ২০০৮; বিশ্বব্যাংক, ২০১৩; মাহমুদ, আহমেদ ও মহাজন, (২০০৮)।

৪. প্রণোদনা শব্দটি ইংরেজি incentive শব্দের অনুবাদ। এলিনিয়র ওস্ট্রম এটির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: ‘The rewards and punishments that are perceived by individuals to be related to their actions and those of others.’ (Ostrom cited in McLoughlin, and Bately, 2012: 6)

৫. দেখুন, নর্থ, ওয়ালিস, ওয়েনগাস্ট (২০০৯)।

৬. এই লেখায় আমি ‘ইকুইলিব্রিয়াম’-এর বাংলা অনুবাদ হিসেবে ‘ভারসাম্য’ শব্দটি ব্যবহার করছি। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি গ্রন্থটিতে অবশ্য শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে ‘সমস্থিতি’ হিসেবে। আমি পাঠকের কাছে অধিক পরিচিত ‘ভারসাম্য’ শব্দটিই রাখলাম।

৭. NWW Rent-এর সহজ সংজ্ঞা ও যে অর্থে তাদের তত্ত্বে এটিকে ব্যবহার করা হয়েছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে: ‘...return to an asset that exceeds the return which the asset can recieve in its best alternative...rents can be created or increased by limited access- for example, when the state grants an individual monopoly privileges over an activity’ (NWW 2009, p- 68). 

৮. মালিকানার অধিকারসমূহের (প্রপার্টি রাইটস্) মধ্যে রয়েছে তিনটি প্রধান অধিকার, যথা সম্পত্তি পরিচালনার অধিকার, সম্পত্তি পরিচালনার সূত্রে প্রাপ্তব্য আয়ের উপর অধিকার এবং সম্পত্তিকে সংরক্ষণের অধিকার (‘রাইট টু ম্যানেজ’, ‘রাইট টু ইনকাম’ ও ‘রাইট টু প্রটেকশন’ হিসেবে অভিহিত)।

৯. ‘...where the identity of the organization is independent from the identity of its individual members’ (NWW 2009, p- 46).

১০. উল্লেখ্য, NWW-র মূল লেখায় ‘হিউম্যান অর্গানাইজেশনস’্-এর ভাষান্তর হিসেবে আমি সর্বত্র ‘সংগঠন’ বা সংগঠনগুলো শব্দাদি ব্যবহার করেছি। এই ‘সংগঠন’ সমাজিক, পারিবারিক, গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তি পর্যায়ের সংগঠন হতে পারে অথবা হতে পারে তা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানসমূহ।

১১. এই শ্রেণিবিন্যাসকে বাস্তব দুনিয়ায় উদাহরণ হিসেবে দেখাতে লেখকত্রয় কতিপয় দেশের নাম উল্লেখ করেছেন। ভঙ্গুর শ্রেণীতে রয়েছে: হাইতি, ইরাক, আফগানিস্তান, সোমালিয়া ও আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের কতিপয় দেশসমূহ। মৌলিক শ্রেণিতে রয়েছে: বার্মা, কিউবা, উত্তর কোরিয়া এবং অনেক আরব ও সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশ। পরিণত শ্রেণীতে দেখিয়েছেন ল্যাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতকে।

১২. NWW 'double balance' ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে: ‘The incentives embedded in...organizations produce a double balance: a correspondence between the distribution and organization of  violence of potential and political power on the one hand, and the distribution and organization of the economic power on the other hand. The idea of double balance suggests not only that all of the social system in a soceity must have an internal balance of interest but also that the political, economic, cultural, social and military systems must contain compatible systems of incentives across the system if the society is to remain stable’ (NWW 2009, p- 20).

১৩. Dahl, 1989.

১৪. অ্যাডাম সেভরস্কি যেমনটা বলেছেন: ‘...Outcomes of the democratic process are uncertain, inderminate, ex ante.’ (সেভরস্কি ১৯৯১, পৃ. ১০)।

১৫. স্পেনে গণতন্ত্রের প্রারম্ভে পার্লামেন্টে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এডলফো সুয়ারেজ গণতন্ত্রে জনগণের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন: [এখন থেকে] ...The future is not written because only the people can write it." (Prezworski 1991: থেকে উদ্ধৃত)। আমাদের প্রধানমন্ত্রীগণ মুখে এ ধরনের কথা বললেও প্রাণে তা বিশ্বাস করেন কি না, সে সম্পর্কে সন্দেহ জনমনে থেকেই যায়।

১৬. এলিট রাজনৈতিক সমঝোতার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের স্বাধীনতার অভাব। বিরোধী দল প্রায় নীরবে হজম করে এর মিথ্যাচার এবং ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করে ক্ষমতায় গিয়ে এই প্রপাগান্ডা যন্ত্রের দখলের। এর স্বাধীনতা কেউ-ই চায় না।

১৭. এক এগারোর পুনরাবৃত্তির প্রতিরোধমূলক স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ভাবা যেতে পারে যে রাজনীতিবিদেরা সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করতে আরও তত্পর হবেন । এতে রাষ্ট্রসংগঠনে সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীভবনের ও সংহতকরণের বদলে প্রচেষ্টা চলবে সমাজে বিরাজিত রাজনৈতিক এলিটদের বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে আত্মকরণের  (অনানুষ্ঠানিক অর্থে)।

১৮. Rustow, 1970.

১৯. গণতন্ত্রে উত্তরণের দুই তাত্ত্বিক ঘরানার (অর্থাত্, এলিট/এজেন্সিকেন্দ্রিক ও কাঠামোগত) ওপর খুব উপকারী ও উঁচুমানের পর্যালোচনার জন্য দেখুন Acemoglu, Robinson (2006) এবং Moore (1996).

২০. দলতন্ত্রে নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্র দুটিই কার্যত রাজনৈতিক সমাজের অধীনস্থ হয়ে পড়ে।

২১. মুশতাক খান (২০০৫)।

গ্রন্থপঞ্জি

Acemoglu, Daron and Robinson, James. 2006. Economic Origins of Dictatorship and Democracy. Cambridge: Cambridge University press.

Bellin, E., 2000, 'Contingent Democrats: Industrialists, Labor, and Democratization in Late-Developing Countries', World Politics, Vol. 52, No.2, January, pp. 175-205.

Dahl, Robert. 1989. Democracy and Its Critics. New Haven: Yale University Press.

Diamond, Larry, M. Platter, Y. Chu and H. Tien. 1997. Consolidating the Third Wave Democracies. Baltimore and London: John Hopkins University Press.

Fukuyama, Francis. 2011. The Origins of Political Order. Profile Books, London.

Huntington, Samuel. 1968. Political Order in Changing Societies. New Haven: Yale University Press.

Khan, Mushtaq. 2005. 'Markets, States, and Democracy: Patron-Client Networks and the Case for Democracy in Developing Countries,' Democratization, 12 (5).

Mahmud, Waheeduddin, Ahmed, Sadik and Mahajan, S. 2008. 'Economic Reform, Growth and Governance: The Political Economy Aspects and Bangladesh's Development Surprise', World Bank.

McLoughlin, Claire and Bately, Richard. 2012. 'The Politics of What works in Service Delivery: An evidence-based Review', ESID Working Paper 06, University of Manchester: UK.

Moore, M. 1996. 'Is Democracy Rooted in Material Prosperity?' in Luckhan, Robin and White, Gordon, (eds) Democratization in the South. New York: Manchester University Press.

North, Douglas, Wallis, John, and Weingast, Barry. 2009 A. Violence and Social Order. Cambridge: Cambridge University Press.

North, Douglas, Wallis, John, and Weingast, Barry. 2009 B. 'Violence and the Rise of Open Access Orders', Journal of Democracy, 20 (1), January.

Olson, Mancur. 1993. 'Dictatorship, Democracy and Development', American Political Science Review, 87 (3).

Prezworski, Adam. 1991. Democracy and the Market. Cambridge University Press.

Park, Thomas and Cole, William. July 2010. 'Political Settlements: Implications for International Development Policy and Practice', The Asia Foundation, Occasional Paper, No 2.

Rustow, Dunkwart. 'Transition to Democracy: A Dynamic Model', Comparative politics 2: 337-63.

World Bank. 2008. 'Bangladesh Strategy for Sustained Growth', Bangladesh Development Series, Paper no 18, World Bank, Dhaka.

World Bank. 2013. World Development Report: Jobs, World Bank, Washington D.C.