আমার সাংবাদিকতা জীবন, দেশভাগ ও তত্কালীন সমাজ

আবু জাফর শাসসুদ্দীন, ছবি: বাংলাপিডিয়া
আবু জাফর শাসসুদ্দীন, ছবি: বাংলাপিডিয়া

[আবু জাফর শামসুদ্দীনের জন্ম ১৯১১ সালে গাজীপুর জেলার দক্ষিণবাগ গ্রামে। ১৯২৪ সালে স্থানীয় একডালা মাদ্রাসা থেকে জুনিয়র মাদ্রাসা পরীক্ষায় ও ১৯২৯ সালে ঢাকা সরকারি মাদ্রাসা থেকে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিছুদিন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়াশোনার পর কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন।

১৯৩১ সালে সরকারের সেচ বিভাগে কেরানির চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে এ চাকরি ছেড়ে নির্মীয়মাণ কটক বিমানবন্দরের তদারকি অফিসে হেড ক্লার্ক হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন পর এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে দৈনিক আজাদ-এর সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন।

১৯৪৮ সালে পত্রিকাটি ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনি এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালে দৈনিক আজাদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলে তিনি কিতাবিস্তান নামে পুস্তক ব্যবসা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫০-১৯৫১ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে সম্পাদক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্মলগ্ন সময় থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমীর অনুবাদ বিভাগের প্রধান অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। অবসর গ্রহণের পর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন। সত্তর ও আশির দশকে সংবাদ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন।

আবু জাফর শামসুদ্দীন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি, বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশ-আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়নের সহসভাপতি ও বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির সভাপতি ছিলেন। একজন প্রগতিশীল লেখক হিসেবে গল্প, উপন্যাস, মননশীল প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ১৯৮৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

১৯৮৮ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। সাক্ষাত্কারটি জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের আওতায় ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ড. সালাহউদ্দীন আহমদ ও ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম নিয়েছিলেন]

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: জাফর সাহেব, আপনার জন্ম কবে?

আবু জাফর শামসুদ্দীন: আমার জন্ম বাংলা ১৩৩৬ সনের ২৮ ফাল্গুন, শুক্রবার। ইংরেজি ১৯১১ সালের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনো একদিন।

আমার বাবার নাম মো. আক্কাস আলী ভূঁইয়া। গ্রাম: দক্ষিণবাগ, থানা: কালীগঞ্জ, এখন যেটাকে উপজেলা বলা হয়। জেলা বর্তমানে গাজীপুর। আগে ছিল ঢাকা।

মু নূ ই: সে সময়ে।

আ জা শা: সে সময় আমাদের পরিবার ছিল সামাজিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত পরিবার। আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। ঋণের ভারে ছিল ভয়ানকভাবে জর্জরিত। প্রায় অচলদশা তখন আমাদের। পারিবারিক এ রকম অবস্থার মধ্যেই আমার জন্ম। তবে আমার বাবা অতীত আভিজাত্যবোধ থেকে সাধারণ মানুষের প্রতি ঘৃণাবোধ বা তাদের হেয়জ্ঞান করতেন না। এ রকম কিছু তাঁর মধ্যে ছিল না। এর মূলে ছিলেন সম্ভবত আমার দাদা। তিনি মৌলভি ছিলেন। ১৮৫৭ সালে যখন ঢাকায় সিপাহি বিদ্রোহ১ শুরু হয়, তখনো তিনি এখানে পড়াশোনা করতেন। আমার দাদির মুখে শুনেছি, ওই সময় মৌলভিগোছের লোক দেখলেই ইংরেজ সেনারা তাদের ধরে ফাঁসি দিত। এ অবস্থায় তিনি গ্রামে পালিয়ে আসেন। তার আগে অবশ্য গ্রামে তিনি মসজিদ তৈরি করেছিলেন। আমার বাবার আচরণ ইত্যাদি দেখে আমার মনে হয়েছে, আমাদের পরিবারের ওপর ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রভাব ছিল। তাঁরা মানুষকে ঘৃণা করতেন না এবং আমাদের বাড়িতে যেসব লোক কাজকর্ম করত, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে, তাদের সঙ্গে বসে তিনি খাওয়া-দাওয়া করতেন। তাদের আদর-স্নেহ করতেন।

আমাদের পরিবার ছিল মূলত কৃষিনির্ভর। তবে আমাদের পরিবার মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কিছু অর্থকড়ি পেত।

মু নূ ই: আপনারা কি নিজেদের কৃষিনির্ভর মধ্যবিত্ত পরিবার বলে মনে করেন?

আ জা শা: মূলত আমরা ছিলাম কৃষিনির্ভর মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত একটি পরিবার। এভাবেই আমরা আমাদের পরিচয় চিহ্নিত করতাম।

মু নূ ই: আপনাদের পারিবারিক আবহাওয়ার একটু বর্ণনা দেন। এটা কি ধর্মভীরু বা ধর্মান্ধ একটি পরিবার? অথবা আপনারা কিছু পরিমাণে উদারও ছিলেন এবং আপনি যে ওয়াহাবির২ কথা বললেন, আপনার নিজের অভিজ্ঞতায় গ্রামে ওয়াহাবির প্রভাব কিছু দেখেছেন কি না?

আ জা শা: আমাদের পরিবারকে একদিকে যেমন খুব গোঁড়া ধর্মভীরু বলা যাবে, অন্যদিকে আবার উদারও বলা যাবে। কেননা, গোঁড়ামি বলতে যেসব অন্ধ কুসংস্কারকে বোঝায়, সেগুলো আমাদের পরিবারে ছিল না। যেমন ধরুন, মসজিদ ও মাজারে ফিরনি দেওয়া বা পীরগিরির মতো ব্যাপারস্যাপারের প্রতি আমাদের পরিবারের তেমন কোনো আগ্রহ বা প্রবণতা একেবারেই ছিল না। আমার বাবা এসবে বিশ্বাস করতেন না। মানতটানতের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ছিলেন কবর পূজারও ঘোর বিরোধী। এমনকি অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে মুরব্বিদের পায়ে ধরে সালাম করার যে প্রথা ছিল, তারও বিরোধী ছিলেন তাঁরা। আমাকে তিনি কখনো পায়ে সালাম করতে দেননি। তিনি ‘সালামু আলাইকুম’ বলে খাড়া হয়ে সালাম করতে বলতেন। বলতেন, আর একান্তই যদি পায়ে ধরে সালাম করতেই হয়, তাহলে খাড়া হয়ে বসবে। কখনোই মাথা নিচু করবে না।

মু নূ ই: আপনার নিজের শিক্ষা কীভাবে হয়েছে? আপনার শিক্ষাজীবনের কথা বলেন, বাল্যকাল থেকে আরম্ভ করে।

আ জা শা: আমাকে প্রথম লেখাপড়া শেখাতে শুরু করেন আমার বাবাই। আমার হাতেখড়ি তাঁর কাছেই হয়। অ, আ, ক, খ এবং আলিফ, বে, তে, ছে ইত্যাদি বর্ণের পরিচয় তাঁর কাছেই হয়। অর্থাত্, আমাকে তিনি মোটমুটি চারটি ভাষা শিক্ষা দিতে শুরু করেন—বাংলা, উর্দু, ফারসি ও আরবি।

মু নূ ই: সেটাই কি তখন রেওয়াজ ছিল?

আ জা শা: অন্তত আমাদের মতো পরিবারে এ রকমেরই রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এটা বেশি দিন চলেনি। কারণ, ফারসি ও আরবি—এই দুটোর মধ্যে শেষ পর্যন্ত একটা ভাষা বাছাই করে নিতে হয়েছিল। যা-ই হোক, পাঠশালায় আমার খুব বেশি দিন যাওয়া হয়নি। আমার যখন বাল্যকাল, তখন স্থায়ী কোনো পাঠশালা ছিল না। আমাদের এলাকায় প্রথম যে পাঠশালা হয়েছিল, সেটা হয়েছিল খুবই সম্পন্ন একটা গোয়ালাবাড়িতে। পাঠশালাটি চালু করেছিলেন প্রভাত গোপ নামের একজন জিটি পাস পণ্ডিত। কিন্তু বেশি দিন সেটা টেকেনি। আমি বেশি দিন সেখানে পড়তে যাইনি। দ্বিতীয় আরেকটা পাঠশালা চালু করেছিলেন এক ব্রাহ্মণ সন্তান। সেটা হয়েছিল একজন সম্পন্ন নমশূদ্রের বাড়িতে। সে পাঠশালাটাও খুব বেশি দিন টেকেনি। শেষ পর্যন্ত গৃহশিক্ষক রেখেই আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। বাবা নিজেও পড়াতেন। ওই সময় আমাদের গ্রামে একজন মুসলমান ছেলে, নিম্ন শ্রেণীর কৃষক পরিবারের ছেলে পড়াশোনা করতেন। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই। দুই ভাই কৃষিকাজ করতেন। তিনি একাই পড়তেন। কিন্তু তাঁর ওই পড়াশোনার ব্যাপারটা তাঁর বড় ভাইয়ের কাছে খুবই দৃষ্টিকটু ছিল। এ জন্য তাঁকে মারপিট পর্যন্ত করা হতো। এমনকি বড় ভাইয়ের স্ত্রী কেন ভাত রেঁধে খাইয়ে তাঁকে স্কুলে যেতে সাহায্য করেন, সে জন্য তাঁর ওপরও নির্যাতন করতেন তাঁর স্বামী। এক দিনের কথা আমার বেশ মনে পড়ে, হঠাত্ ওই ভদ্রলোক, তাঁর নাম ছিল নাসিরুদ্দিন আহমদ, তাঁর রক্তাক্ত হাত থেকে খুবই রক্ত পড়ছিল, সেই অবস্থায় আমার বাবার কাছে এসেছেন বিচারের জন্য।

কী ব্যাপার, বাবা জিজ্ঞাসা করলেন।

জবাবে তিনি অভিযোগের সুরে বললেন, তাঁর বড় ভাই তাঁর বাঁ ও ডান হাতের বাজু কামড়ে দিয়েছেন। দরদর করে রক্ত পড়ছে। দাঁত বসে গেছে। বাবা তাঁর বড় ভাইকে ডাকিয়ে এনেছিলেন, কিন্তু তাঁর কী বিচার করেছিলেন, আমার ঠিক মনে নেই। তবে তিনি নাসিরুদ্দিনকে বলেছিলেন, ‘নাসিরুদ্দিন, তুমি আমার এখানে থাকো। আর যে দুই বছর আছে, আমার এখানে থেকে পড়াশোনা করো। স্কুলে যাও, পরীক্ষা দাও। ওই বাড়িতে তোমার লেখাপড়া হবে না।’

সেই থেকে নাসিরুদ্দিন আমাদের বাড়িতেই থেকে যান এবং এখান থেকে খাওয়াদাওয়া করে চার মাইল দূরে কালীগঞ্জ হাইস্কুলে পড়তে যেতেন। পাশাপাশি সকাল, বিকেল, সন্ধ্যাবেলা আমাকে পড়াতেন। ইংরেজি ও বাংলা। এর মধ্যে অবশ্য বাবাও তাঁর অবসর সময়ে আমাকে পড়া দেখিয়ে দিতেন। আমাদের কালে এই জাতীয় গৃহশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এরপর নাসিরুদ্দিন, খুব সম্ভবত ১৯২৩ সালের কথা সেটা, ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় চলে যান, চাকরির উদ্দেশ্যে। ফলে, পড়াশোনায় আমার অসুবিধা হয়। সে সময় আশপাশে কোনো স্কুলও ছিল না। আমার বাবা সাত মাইল দূরে ডেমরা গ্রামের তারাগঞ্জ হাইস্কুলে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেন। ডেমরাতেই ছিল আমাদের আদি নিবাস। আমাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী লোকজন তখনো ওখানে বসবাস করতেন। এখনো অনেকেই আছেন। আমার মামার বাড়িও ওই গ্রামে। নতুন ভর্তি হওয়া তারাগঞ্জ হাইস্কুল ছিল নতুন প্রতিষ্ঠিত স্কুল। আমার চাচা ও ফুফা আবদুল গফুর ভুঁইয়া ছিলেন এলাকার একজন নামকরা লোক। আমি তাঁদের বাড়িতে থেকেই ওই স্কুলে পড়াশোনা করতে লাগলাম। ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস থ্রিতে। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর ওখানে আমার মন টেকেনি। আমি কান্নাকাটি করে বাড়িতে চলে আসি। আবার আমার জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়। উনি ছিলেন কুমিল্লার এক মৌলভি। তিনি এসে আমাকে আরবি পড়াতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি আমাকে বাংলা, উর্দু, ইংরেজি ইত্যাদিও পড়াতে থাকেন। তিনি নিউ স্কিম মাদ্রাসা থেকে পাস করা আলেম ছিলেন। বাড়িতে থেকে বছর দুয়েক পড়াশোনা করি। তারপর আমি ডেমরার কাছে একডাল বলে একটা গ্রাম আছে, সেখানে নিউ স্কিম মাদ্রাসায় ক্লাস ফাইভে ভর্তি হই এবং ১৯২৫ সালে জুনিয়র মাদ্রাসা পাস করে ঢাকায় এসে ক্লাস সেভেনে ঢাকা মাদ্রাসায় ভর্তি হই।

তখন আমাদের মতো পরিবারের ছেলেদের বেশির ভাগকেই মাদ্রাসায় পড়তে যেতে হতো। লিবারেল এডুকেশনে যাওয়া বেশ কঠিন ছিল। মুসলমান পরিবারের ছেলেরা হাই মাদ্রাসা পাস করে জেনারেল লাইনের কলেজে পড়াশোনা করতে পারত। যেমন আমি মাদ্রাসা লাইনে লেখাপড়া করে কলেজে চলে যাই। ফরমাল এডুকেশন বলতে যা বোঝায়, সেটা ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বছর খানেক পড়ার পর আমি আর লেখাপড়া করিনি।

১৯১৯-২০ সালের কথা বলতে হয়, আমার বাবা সে সময় আমাদের এলাকায় কংগ্রেস-খিলাফতের সভাপতি ছিলেন। আমাদের গ্রাম যে মুসলিমপ্রধান ছিল, সে কথা বলা যাবে না। আমরা হিন্দু-মুসলমান বোধ হয় সমান সমানই ছিলাম। তার মধ্যে বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল। মুসলমান অঞ্চল বা পাড়ার দিক থেকে প্রভাবশালী বলেন অথবা কিছু লেখাপড়া জানা লোকই বলেন, সেই বিচারে ছিলেন একমাত্র আমার বাবাই। আমার এক চাচাও প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয়েছিল বেশ আগেই।

আমি তখন বেশ ছোট। অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন৩ যে আমাদের গ্রামে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল, সে কথা আমার মনে পড়ে। আমাদের গ্রামে একবার একটি সভা হয়েছিল। একটি খালি ময়দানে কয়েকটা চৌকি একসঙ্গে করে একটা ডায়াস তৈরি করা হয়েছিল। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে সেই সভায় লোকজন মিছিল করে এসেছিল। পতাকাও ছিল তাদের হাতে হাতে। এখনো আমার স্পষ্ট মনে পড়ে একজন পাগড়ি পরা, আচকান, পাজামা পরা মৌলভি সাহেবের মতো দেখতে একজন লোক, খুব জোরালো বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং তাঁর মুখে আমি সর্বপ্রথম ‘ব্রিটিশ ব্যুরোক্রেসি’ শব্দটা শুনি। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড৪ এবং রাউলাট অ্যাক্টের৫ কথাও যে বলা হয়েছিল তাঁর ভাষণে, সে কথা এখন পর্যন্ত আমার মনে আছে। সভার পর আমার বাবা লোকাল কংগ্রেস-খিলাফত কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পরপরই তিনি কোথা থেকে যেন চরকা সংগ্রহ করে আনেন। বোধ হয় কংগ্রেসের কোনো অফিস থেকে এসব দেওয়া হতো। আমি ঠিক জানি না। আমাদের বাড়িতেও তিনি চরকা নিয়ে আসেন। পাড়ার অনেক বাড়িতেও তিনি চরকা এনে দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ, গোয়ালা, নমশূদ্র ও মুসলমানপাড়াতেও তিনি চরকা এনে দিয়েছিলেন।

আমার দাদি কোম্পানি আমলের মানুষ। আমার দাদার জন্ম ১৮১৬ সালে। কাগজপত্র থেকেই আমি এটা জেনেছি। আমার দাদি বোধ হয় তাঁর পাঁচ-ছয় বছরের ছোট ছিলেন। তাঁর জন্ম হয়ে থাকবে সেই হিসাবে ১৮২০-২২ সালের দিকে। তিনি চরকায় সুতা কাটতে জানতেন। আমার মায়েদেরও, আমার দুই মা ছিলেন, বড় মা নিঃসন্তান ছিলেন, তাঁদেরও তিনি চরকা কাটা শিখিয়েছিলেন। অন্য গ্রামের নারীরা তাঁর কাছে এলেও তিনি তাঁদের কীভাবে চরকায় সুতা কাটতে হয়, সেটা দেখিয়ে দিতেন। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল মসজিদ। ওই মসজিদে মুষ্টিভিক্ষা করা হতো কংগ্রেস-খিলাফত কমিটির তহবিলের জন্য। ব্যাপারটি বেশ মনে আছে। আমার দাদি মারা যান ১৯৩৩ সালে, ১১১ বছর বয়সে।

আমি ১৯২৪ সালে জুনিয়র মাদ্রাসা পাস করি। ১৯২৫ সালের ২০ জানুয়ারি সপ্তম শ্রেণীতে ঢাকা মাদ্রাসায় এসে ভর্তি হই। লেখাপড়া করতে আসার সুবাদে আমাকে ঢাকায় থাকতে গিয়ে পার করতে হয়েছিল এক বিচিত্র জীবন। কখনো জায়গিরে ছিলাম অনেক দূরে কাজলাতে। তারপর এখানে দয়াগঞ্জের এক বাড়িতে একবার কিছুদিনের জন্য জায়গির ছিলাম। বাবার খুব পরিচিত, বন্ধুস্থানীয় এক লোকের হোটেল ছিল। একটা আলাদা রুম নিয়ে আমরা তিনজন ছাত্র একসঙ্গে কিছুদিন সেখানে ছিলাম। কিছুদিন ছিলাম হোস্টেলে। আবার জায়গিরেও ছিলাম। অর্থাত্, ঢাকায় আমাকে পার করতে হয়েছে খুব বিচিত্র একটা জীবন। এক জায়গায় স্থায়ী হয়ে খুব বেশি দিন থাকিনি। তবে নারিন্দাতে একটা হোস্টেল ছিল, সেখানে মনে হয় টানা বছর দেড়েক ছিলাম। আমি তখন ঢাকায় ছিলাম ১৯২৫ সালের শুরু থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত।

আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন পুরান ঢাকায় মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা একরকম ছিল না বললেই বলা চলে। আমি কলতাবাজারে ছিলাম, দয়াগঞ্জে ছিলাম। তারপর কিছুদিন টিকাটুলীতে ছিলাম। এসব জায়গায় আমি যা দেখেছি এবং আগামসি লেনসহ এ রকম অন্যান্য পাড়া-মহল্লায় যাতায়াত করতে গিয়ে দেখেছি, এসব এলাকায় বসবাসকারী মুসলমানদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা গ্রামের চেয়েও কম ছিল। মুসলমানদের বেশির ভাগেরই ব্যবসা ছিল ঘোড়ার গাড়ির সহিসগিরি, পান-বিড়ির দোকানদারি ও রাজমিস্ত্রির কাজ। এই ছিল বেশির ভাগ মুসলমানের পেশা। সাংস্কৃতিক জীবন বলতে মুসলমানদের কার্যত কিছুই ছিল না। সেখানে কাদির সর্দারের ‘লায়ন’ সিনেমা হল ছিল। তখন পর্যন্ত ওটা অবশ্য সিনেমা নয়, লায়ন থিয়েটার। সেই থিয়েটারে পুরুষেরাই নারীর ভূমিকায় সেজে অভিনয় করতেন। অভিনীত নাটকের নাম হতো সাধারণত গুলে বাকওয়ালি ও শিরি-ফরহাদ। নাটকের নাম ও রকমের হলেও সেগুলোর সংলাপ বাংলাতেই হতো। মাঝেমধ্যে উর্দুর মিশেল দেওয়া হতো। গান থাকত। প্রবেশমূল্য ছিল বোধ হয় তিন আনা। মুসলমানরা ওসব নাটক দেখতে যেত। এরপর আরমানীটোলায় যখন একটা সিনেমা হল হলো এবং সদরঘাটে হলো, তখন তারা ওগুলোতেও যাওয়া-আসা করত। এর বাইরে তাদের আর কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক জীবন ছিল না। তবে ওস্তাদ, সংগীতজ্ঞ, ধ্রুপদি সংগীতে দক্ষ দু-চারজন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরা বিশেষ স্থানে বা জায়গায় হয়তো কখনো জলসা ইত্যাদি করতেন। আমার তখন এত অল্প বয়স যে ওসব জলসায় স্বাভাবিক কারণেই যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

বিশের দশকে আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, তখনকার ঢাকায় মহল্লাকেন্দ্রিক সরদারশাসিত জীবন, যেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি এবং যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সে সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, যে কয়েকটি মহল্লায় আমি ছিলাম, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি মহল্লার কথা বলছি। সেটা হচ্ছে কলতাবাজার। এই মহল্লায় সরদারি প্রথা দেখেছি। সরদার সাহেবের নাম ছিল ইলিয়াস সরদার। খুব ডাঁটের মানুষ ছিলেন তিনি। মহল্লার লোকজন বিচার-সালিস এবং অভাব-অভিযোগ নিয়ে সোজা তাঁর কাছে চলে আসত। মসজিদে লোকজনকে ডাকা হতো। সেখানে বসেই এই বিচার-সালিসের কাজ করা হতো। কখনো সরদার সাহেবের বাড়িতেও এমন করা হতো। এবং মহল্লাবাসী সেই বিচার মেনে নিত। সামাজিক একটা প্রথা হিসেবেই এটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। একে বলা হতো বাইশ পঞ্চায়েত। বাইশটি পঞ্চায়েতের বাইশজন সরদার বোধ হয় ছিলেন। তাঁদের প্রধান ছিলেন ঢাকার নবাব। বছরে একবার সবাই মিলিত হতেন এবং প্রায় ক্ষেত্রে অবশ্য একই ব্যক্তি সরদারি করতেন। তবে মাঝেমধ্যে বদলানো হতো। সেটা ঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে হতো কি না, কিংবা ঢাকার নবাব সাহেব তাঁকে মনোনয়ন দিতেন কি না, সেটা আমার জানা নেই। তবে মাঝেমধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারস্যাপার নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ যা কিছুই হতো, কোর্টে না গিয়ে সেসব কিছুর নিষ্পত্তি এই সরদারেরাই করতেন। আর যদি সরদারের বিচার কারও মনঃপূত না হতো, তাহলে বাইশ পঞ্চায়েতে, নয়তো শেষ পর্যায়ে নবাব সাহেবের কাছে আপিল করা চলত। আমি একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন হয়েছে। তাকে ঘিরে একটা আলাদা সমাজ, প্রধানত ছাত্রদের উদ্যোগে, অধ্যাপকও ছিলেন, গড়ে ওঠার চেষ্টা চলছিল। কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও চলছিল। হতো গান-বাজনা ইত্যাদিও। তার মধ্যে বিশেষভাবে আমার মনে পড়ে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর৬ কথা। ১৯২৬ সালে ঢাকায় সাহিত্য সমাজের প্রথম অধিবেশন হয় এবং সেই মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ছিল শিখা৭। মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্পর্কে পুরান ঢাকার লোকজনের প্রতিক্রিয়া বলতে গেলে বলতে হয়, প্রথম দিকে তারা এর গুরুত্ব বিশেষ কিছু বোঝেনি। পরে তারা বুঝেছিল। ১৯২৬ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম অধিবেশনে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দাওয়াত করা হয়। তাঁর আসার কথা ছিল সকালে। সেই খবর শুনে আমি ওখানে গিয়েছিলাম। বর্তমানে যেখানে মেডিকেল কলেজ, তার ওপরে ছিল মুসলিম হল (এসএম হল) ও নিচে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম গেট দিয়ে ঢুকলেই তার মুখ বরাবর একটা সম্প্রসারিত জায়গা ছিল, সেটাই ছিল বোধ হয় তাদের ডাইনিং রুম। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, অধিবেশনটা হয়েছিল ওখানেই। তবে কাজী নজরুল ইসলাম সকালে এসে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে, তাঁকে আমি তখন দেখতে পারিনি। তবে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়েছিল একটা রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। গানটা ছিল ‘দখিন-হাওয়া, জাগো জাগো, জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ’। উদ্বোধনী এই রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু। তিনি তখন খুব সম্ভব বিএ অথবা ল পড়ছিলেন। তাঁর গাওয়া গানটা বেশ আনন্দ দিয়েছিল আমাদের। এর পরপরই যখন থেকে শিখা পত্রিকা বের হতে শুরু করে, তখন তার মধ্যে ইসলাম ধর্মবিরোধী নানা কথাবার্তা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করল গোঁড়াপন্থীরা। বিশেষ করে, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন যখন শুরু হলো, তখন থেকে। পরবর্তীকালে আমি শুনেছিলাম, কাজী আবদুল ওদুদ৮ সাহেব ও অধ্যাপক আবুল হুসেনের৯ ওপর কিছুটা নির্যাতন হয়েছিল। ঢাকার নবাববাড়িতে এনে তাঁদের নাকি আটকে রাখা হয়েছিল এবং ক্ষমা চাওয়ার পর তবেই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এ রকম একটা ঘটনার কথা শুনেছিলাম।

আসলে আমরা তখন মাদ্রাসার ছাত্র হলেও আমাদের চোখ-মুখ তখন খুলে গেছে। বিশেষ করে, তখন ঢাকা মাদ্রাসায় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব ভালো একটা লাইব্রেরি থাকায় ছাত্রদের মন আলোকিত করার কাজে খুবই সহায়ক হয়েছিল। আজকাল তো অনেক লাইব্রেরি। পাবলিক লাইব্রেরি-জাতীয় লাইব্রেরি জেলায় জেলায়। আজকাল তো ছাত্রদের জন্য আলাদা ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠান। সেগুলোতে ছিল পৃথক লাইব্রেরি। আমাদের মাদ্রাসায় বাংলাদেশের সব উল্লেখযোগ্য মাসিক পত্রপত্রিকা আসত। আসত উর্দু পত্রপত্রিকাও। আমরা সেগুলো পড়তাম। তার ফলে আমাদের চিন্তাশক্তির কিছুটা উন্মেষ হয়। আমাদের মাদ্রাসায় ছেলেরা খেলাধুলাতেও খুব ভালো ছিল। আপনাদের একজন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম বলি। তাঁর নাম হাজি রমিজউদ্দিন। একসময় তিনি ভারতবিখ্যাত সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন। লিগে কলকাতায় খেলেছিলেন। তিনি এবং এখন রোববার-এর সম্পাদক আবদুল হাফিজ, তিনিও ঢাকা মাদ্রাসারই ছাত্র। তাঁরা ছাত্রজীবন শেষে ভালো খেলোয়াড় হয়েছিলেন। নামধাম করেছিলেন। হাজি রমিজউদ্দিন বোধ হয় পরবর্তীকালে সাংসদও হয়েছিলেন। কাজেই আমরা পিছিয়ে পড়াদের দলে ছিলাম না। মওলানা আবু নাসের ওয়াহিদ মাদ্রাসাছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তাভাবনার উন্মেষে অবদান রেখেছিলেন। আমরা মাদ্রাসার ছেলেরা নিজেরাও ডিবেটিং সোসাইটি ইত্যাদি গড়ে তুলেছিলাম। আরবি, উর্দু, বাংলা এমনকি ইংরেজি ভাষাতেও আমরা বিতর্কসভার আয়োজন করতাম। আমরা ছাত্ররাই এসবে অংশ নিতাম। শিক্ষকদের মধ্যে কিছু ভালো শিক্ষক ছিলেন। একজন ছিলেন ড. শহীদুল্লাহর১০ ভাই খলিলুল্লাহ সাহেব। তিনি বাংলা পড়াতেন আমাদের। মাস্টার ইউসুফ বলে আরেকজন ছিলেন ইংরেজিতে এমএ। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। এ রকম আরও কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষক ছিলেন।

সাধারণ্যে এ রকমের একটা ধারণা ছিল যে মাদ্রাসাগুলো রক্ষণশীলতার দুর্গ। আসলে সেটা ঠিক ছিল না। আমি মাদ্রাসাগুলোকে ঠিক রক্ষণশীলতার দুর্গ বলে মনে করি না, বরং আমরা এই ঢাকা মাদ্রাসার ছেলেরা ওল্ড স্কিম মাদ্রাসা যেটা, অর্থাত্ পুরোনো সোবের মাদ্রাসার ছাত্রদের খুব একটা ভালো চোখে দেখতাম না।

আমাদের সমকালে বাঙালি মুসলমানরা ঢাকা থেকে তখন শিখা ছাড়া অন্য আর কোনো পত্রিকা বের করেছিল কি না, আমার মনে পড়ে না। ঢাকা প্রকাশ১১, সোনার বাংলা এগুলো তো আরও পরের ব্যাপার। এ রকম আরও দু-চারটি পত্রপত্রিকা যেগুলো বের হতো, সেগুলোর বেশির ভাগেরই প্রকাশনার সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায় জড়িত ছিল। অর্থাত্, তাদেরই পত্রিকা ছিল এগুলো। ঠিক ঢাকা থেকে নয়, নারায়ণগঞ্জ থেকে ওসমান আলী সাহেব অভিযান নামের মাসিক একটি পত্রিকা বের করছিলেন। আর তো আমার খুব বেশি কিছু মনে পড়ে না।

১৯২৬ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তার প্রভাব ঢাকাতেও পড়েছিল। আমিও দাঙ্গার মধ্যে পড়েছিলাম। ঢাকাতেও দাঙ্গা হয়েছিল। তবে তার ব্যাপকতা কেমন ছিল, সে সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা নেই। আমি তখন নারিন্দার একটা মেসে থাকতাম। ওদিক থেকে ঢাকা মাদ্রাসায় আসতে হতো লক্ষ্মীবাজার ঘুরে। আমরা মাদ্রাসায় আসতাম লক্ষ্মীবাজার হয়ে পাঁচ ভাইঘাট লেনের১২ গলির ভেতর দিয়ে। এ পথে তো হিন্দুপাড়া ছিল। আমরা ভয়ে ভয়ে আসতাম। কিন্তু আমি বা অন্য যে ছেলেরা আসতাম, অন্ততপক্ষে তারা কোনো খানে আক্রান্ত হইনি। শুনতাম, কাগজিটোলা১৩ বা আগামসি লেনের১৪ দিকে বা অমুক জায়গায় আক্রমণ প্রতি-আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। তবে খুব বেশি একটা খুনখারাবি হওয়ার আগেই বোধ হয় সেটা মিটে গিয়েছিল। কিন্তু ওই সময় মফস্বলের অবস্থাটা সম্পূর্ণ অন্য রকম ছিল। আমার মনে পড়ে, আমাদের গ্রামে এবং পার্শ্ববর্তী কোনো গ্রামে সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমরা যা বুঝি, তেমন কিছু হয়নি বা তার তেমন অস্তিত্বও ছিল না। সে সময়ে গ্রামাঞ্চলে মানুষজন ঠিক তেমন শ্রেণীসচেতন না হলেও সামাজিক আচার-আচরণ কতকটা শ্রেণীভিত্তিক ছিল। আর সেটা এই অর্থে যে গ্রামে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে ঝগড়া হতো না, সেটা হতো আর দশটা ঝগড়া-ফ্যাসাদের মতোই। এসবই আমার বাল্যকালের সামাজিক চালচিত্র। বিশের দশকের ঘটনা। ১৯১৮ থেকে ১৯২৫-২৬ সাল এবং তার পরের কালের ঘটনাও আছে। তখন যে জমিদার ও তালুকদার শ্রেণী, অর্থাত্ হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে মধ্যস্বত্বভোগী যে অভিজাত শ্রেণী ছিল, তারা পরস্পর সমানে সমানে ওঠা-বসা করত এবং সাধারণ মানুষের তুলনায় তারা অবশ্যই আলাদা ছিল। হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে তারা ছিল সাধারণ গরিব মানুষ। তাদের ওপর নিপীড়ন বা শোষণ যেটা হতো, হিন্দু-মুসলমান উভয় অভিজাত শ্রেণীই সমানভাবে সেটা করত। আবার উভয় শ্রেণীর অভিজাত ব্যক্তিরা তাদের, অর্থাত্ সাধারণ মানুষজনকে হেয়জ্ঞান করতেন। হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা লাগলে, মজার ব্যাপার, উভয় পক্ষে উভয় শ্রেণীর ভেতর থেকেই সাক্ষী-সাবুদ পাওয়া যেত। এসব মামলা-মোকদ্দমা বা গ্রাম্য ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে ঠিক সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ছিল না। এসব ঘটনাকে সাম্প্রদায়িকভাবেও মোকাবিলা করা হতো না।

১৯১১ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে এ দেশে যে ভূমি জরিপ এবং এ-সংক্রান্ত যে আপসরফা হয়, তাতে করে ১৮৮৫ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের প্রভাব কিছুটা পরিলক্ষিত হয়। ওই সময় একদিন আমাদের বাড়িতে এক ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক এলেন। তাঁর সঙ্গে আরও পাঁচ-ছয়জনের মতো লোক ছিলেন। তাঁরা দুটো চেয়ার বা জলচৌকিতে বসেছিলেন। ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকটির নাম ছিল হেমন্ত কুমার ভট্টাচার্য। এসে তিনি আমার বাবাকে বললেন, ‘মুনশি সাহেব’, আমার বাবাকে তারা মুনশি সাহেব বলতেন, ‘এ তো বড় মুশকিলের ব্যাপার হলো। যে অবস্থা দেখছি, তাতে করে আমাদের পক্ষে তো আর মানসম্মান নিয়ে বাস করাই মুশকিল হয়ে পড়বে। সাধারণ লোকজন গাছটাছ সব কেটেকুটে নিয়ে যাচ্ছে। পুকুর নিতে এখন আর আমাদের অনুমতি লাগবে না। তারা আমাদের আর নগদ সেলামিও দিতে চায় না। আমাদের তো বড় মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। সাধারণ লোকজনই এসব করছে।’

আরেকটা ঘটনা আমার মনে আছে। ঘটনাটা ঘটেছিল হাটে। আমি সেখানে ছিলাম। কিছু কৈবর্ত বা জেলে মাছ বিক্রি করছিল। একজন কৈবর্তের কাছে কতগুলো বড় কই মাছ ছিল। মাছগুলোর গ্রাহক ছিল বেশি। তার মধ্যে একজন ব্রাহ্মণও দামাদামি করছিলেন। জেলে বেচারা তার মাছের দাম বোধ হয় বেশি চেয়েছিল। হঠাত্ ব্রাহ্মণ করলেন কী, তাঁর পা’টা কৈবর্তের ঘাড়ের ওপর, নাকি মাথার ওপর চাপিয়ে দিলেন। চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মাছগুলো দে।’ কৈবর্ত তখন নিরুপায়। তাঁর খলুইয়ের মধ্যে মাছগুলো তুলে দিল। তার জন্য দাম কত দিয়েছিলেন সেই ব্রাহ্মণ বা আদৌ দিয়েছিলেন কি না, সে কথা এখন আর আমার স্মরণে নেই। কিন্তু কৈবর্তের মাথায় যে পা তুলে দিয়েছিলেন সেই ব্রাহ্মণ, সেটা আমার বেশ মনে আছে।

মু নূ ই: আপনার বাল্যকালে এবং পরবর্তীকালে যখন মাদ্রাসার ছাত্র, আপনার বয়সী ছেলেরা কি বাধ্যতামূলকভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন? ইসলামি আচার-আচরণ অনুসরণ করতেন?

আ জা শা: বাল্যকালের আমাদের বাড়ির কথা স্বতন্ত্র। কেননা, আমাদের বাড়িতে তো দুই প্রজন্ম আগে থেকেই নিয়মিত ধর্মকর্মের প্রচলন শুরু হয়েছে। আমাকে বোধ হয় সাত-আট বছর বয়সেই নামাজ শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। বাবার সঙ্গে নামাজ পড়তে হতো। তবে মাঝেমধ্যে কাজাও করতাম। একটা ঘটনার কথা মনে আছে। সেটা ছিল রোজার দিন। রমজান মাসে সব ছেলেকে তারাবির নামাজে শামিল হতে হতো। জিঞ্জিরায় তখন এক হাফেজ সাহেব ছিলেন। তাঁকে মোটা হাফেজ বলা হতো। তিনি আমাদের মসজিদে পবিত্র কোরআন খতম করাচ্ছিলেন। পড়াচ্ছিলেন তখন তারাবির নামাজও। সেদিন ছিল বোধ হয় রোজার শেষ দিন। বেশি সওয়াব পাওয়ার দিন। আমি গিয়েছিলাম। আমার বড় চাচাতো ভাইও আমার সঙ্গে ছিলেন। আরবি উচ্চারণ শেখানোর ব্যাপারে ওই হাফেজ সাহেব খুবই দক্ষ ছিলেন। তিনি উচ্চারণ করছিলেন ‘আরাইতাল্লাজি...ইয়াউল ইয়াতিম’। এতটাই শুদ্ধভাবে তিনি আরবি কথাগুলো উচ্চারণ করছিলেন যে তাঁর বলার ধরনে পেছনে বসে থাকা আমরা কয়েকজন উচ্চহাসিতে ভেঙে পড়েছিলাম এবং দ্রুতই আমরা সেখান থেকে সরে পড়েছিলাম।

মু নূ ই: মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে নামাজ-রোজা আদায় করা কি তখন বাধ্যতামূলক ছিল? নাকি স্বেচ্ছায় পড়তেন?

আ জা শা: না, বাধ্যতামূলক এমন কিছু ছিল না। ঢাকায় আসার পরও নামাজ হয়তো পড়েছি। অনেক সময় পড়িওনি। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন বাধ্যতামূলক কিছু ছিল না। তবে জুমার নামাজে যেতাম, সে কথা মনে আছে। মেসে থাকার সময় বা জায়গির থাকতে অবশ্য ওয়াক্তের নামাজ নিয়মিত পড়তে হতো। তবে মেসে থাকার সময় খুব নিয়মিত নামাজ পড়েছি বলে মনে পড়ে না।

মু নূ ই: সে আমলের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কাদের কাদের কথা আপনাদের মনকে খুব আলোড়িত করত?

আ জা শা: প্রথমেই আমি রাজনীতির কথা বলেছি, আমার বাবা যে কংগ্রেস-খিলাফত কমিটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, সে কথা বলেছি। বলেছি তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতির কথা। ওই সময় আমরা সবচেয়ে বেশি শুনেছি মহাত্মা গান্ধী১৫, আলী ভাইদের নাম, শুনেছি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের১৬ নামও। আমার বাবা তখন একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা রাখতেন। প্রথম দিকে খুব সম্ভব রাখতেন সাপ্তাহিক হিতবাদী। বেশ বড় সাইজের পত্রিকা ছিল সেটা। পরে বোধ হয় তিনি রাখতেন সাপ্তাহিক মোহাম্মদী। একটা কাগজে, নাম ঠিক মনে নেই, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কামাল পাশা’ অথবা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছিল। খুব সম্ভব ‘কামাল পাশা’। কবিতাটি আসরের নামাজের পর আমার বাড়ির মসজিদের চত্বরে আমার গৃহশিক্ষক পড়ে শুনিয়েছিলেন। আমি শুনছিলাম, আমার বাবাও শুনছিলেন। কবিতাটি সাংঘাতিকভাবে আমাকে অধিকার করেছিল। আমার মনে একটা রোমান্সের সৃষ্টি করেছিল।

মু নূ ই: এরপর তো আপনি কলকাতায় চলে যান।

আ জা শা: আমি ১৯৩০ সালের শেষের দিকে কলকাতায় চলে যাই।

মু নূ ই: কলকাতায় গিয়ে আপনি যে পরিবেশে পড়লেন, সেখান থেকে যখন ঢাকার কথা মনে পড়ত, তখন ঢাকাকে আপনার কি খুব রক্ষণশীল বলে মনে হতো?

আ জা শা: আমি ঠিক এভাবে চিন্তা করিনি। কারণ, কলকাতায় আমি গিয়েছিলাম কিছুটা রোমান্টিক আইডিয়া থেকে। দেশের জন্য একটা কিছু করতে হবে, এই ভাবনা থেকে। কিন্তু কী করতে হবে, জানতাম না। দেশ ও সমাজের জন্য একটা কিছু করতে হবে। এ ধরনের একটা ধারণা মনের মধ্যে জন্মানোর মূলে ছিলেন আমার গুরু এবং আত্মীয় ও কবি বেনজীর আহমদ১৭। আমি পড়ালেখা ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলাম। গিয়ে এমন একটা পরিবেশে পড়লাম যে দিন কয়েকের ব্যবধানেই মনে হলো, জীবনটা অতটা সহজ নয়। কলকাতায় গিয়ে সেটা প্রথম বুঝি। হাজার খুঁজেও চাকরি পাই না। রোজগার করতে পারি না। এমনকি খালি পায়েও কলকাতা শহর ঘুরতে হয়েছে। অবশেষে কবি আশরাফ আলী খান১৮, তিনি তখন সোলতান-এর সম্পাদক, সেখানে ঢুকি আমি সাব-এডিটর হিসেবে। তবে আমাকে ইংরেজি থেকে নয়, উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে হতো। সোলতান-এর সঙ্গে কোনো নিউজ এজেন্সির যোগাযোগ ছিল না। পুরোনো কাগজ, আগের দিনের কাগজ থেকে অনুবাদ ইত্যাদি করে একটা যেমন-তেমন কাগজ বের করতেন। এই চাকরিতে আমার বেতন ছিল ৩০ টাকা। কিন্তু একসঙ্গে বোধ হয় দুই টাকার বেশি কোনো দিনই পাইনি।

মু নূ ই: এটা কোন সময়ের কথা?

আ জা শা: এসবই ১৯৩১ সালের কথা। ওই সময় আশরাফ আলী খান ছেড়ে দিলে আবুল কালাম শামসুদ্দীন১৯ সাহেব কিছুদিন সোলতান-এর এডিটর ছিলেন। এরপর সিলেট থেকে একজন এসেছিলেন। নামটা মনে নেই। নোয়াখালী থেকেও একজন এসেছিলেন। কিছুদিন পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি খুবই অসুবিধায় পড়ি। কলকাতায় বসে ঢাকার কথা তখন এভাবে স্মরণ করিনি যে কোনটা বেশি রক্ষণশীল, আর কোনটা কম রক্ষণশীল। তবে কলকাতা কসমোপলিটন সিটি হওয়ায় সেখানে এত রক্ষণশীলতা ছিল না। আমি প্রথম ৩৬ আপার সার্কুলার লেনে কবি আশরাফ আলী খান ও চৌধুরী শামসুর রহমানের২০ সঙ্গে থাকতাম। তাঁরা দুজনই মনেপ্রাণে মুসলমানের উন্নতি চাইলেও আচার-আচরণের দিক থেকে কোনো রক্ষণশীলতা তাঁদের মধ্যে দেখিনি, নামাজ-রোজা করতেন বলেও ঠিক মনে পড়ছে না।

মু নূ ই: আরেকটা কথা। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৩ সাল সময় পরিসরে অনেক রাজনৈতিক ব্যাপার ঘটে যায়। যেমন জিন্নাহ সাহেবের ১৪ দফা, মতিলাল নেহরুর ব্যাপার, গোলটেবিল বৈঠক২১, সূর্য সেনের২২ ফাঁসি। আপনারা তখন যাঁরা তরুণ, যাঁরা কলকাতায় সাংবাদিকতা ও সাহিত্যকর্মের দিকে ঝুঁকেছেন, এসব ঘটনা আপনাদের কীভাবে স্পর্শ করেছে বা কতটা গভীরে স্পর্শ করেছে?

আ জা শা: আমার ব্যক্তিগত কথা আমি বলতে পারি। আমাকে তখনকার সশস্ত্র আন্দোলন ভয়ানকভাবে রোমাঞ্চিত করত। যেমন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা, পরবর্তীকালে সরদার ভগত্ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত ও চন্দ্রশেখর আযাদের মতো বিপ্লবীদের কার্যকলাপ আমাকে ভয়ানকভাবে রোমাঞ্চিত করত। অন্যদিকে, গোলটেবিল বৈঠক হচ্ছে, জিন্নাহ সাহেবের ১৪ দফা দেখছি, মহাত্মা গান্ধীও সেখানে গিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে ১৪ দফাকে তখন মনে মনে সমর্থন করলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে আমি কংগ্রেসকে প্রাধান্য দিতাম এবং হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাক, মনেপ্রাণে সেটা চাইতাম। কিন্তু নেতৃত্বের দিক থেকে আমি মহাত্মা গান্ধীকে জিন্নাহর ওপরে স্থান দিয়েছি বলে এখনো মনে পড়ছে। আমি মুসলিম লীগের সদস্য কখনো হইনি। আমার কল্পনার মধ্যেও কখনো সেটা আসেনি। আমি ভুলেও চিন্তা করিনি যে ভারত বিভক্ত হবে কিংবা হওয়া উচিত।

সালাহউদ্দীন আহমদ: আমরা এতক্ষণ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আপনার কথাবার্তা শুনছিলাম। আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে, গ্রামীণ রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারে আপনার জন্ম, শৈশবে মাদ্রাসায় লেখাপড়া শিখেছেন, তা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে, বিশেষ করে কলকাতায় আসার পর সব ধরনের তথ্য, বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আপনাকে দেখতে পাই এবং আরও পরে আপনি এম এন রায়ের২৩ অনুসারী বিপ্লবী মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন। আপনার মধ্যে এই যে বিবর্তন, একটা রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে এসে একজন মুক্তমনের বুদ্ধিজীবী হিসেবে আপনার এই যে বিবর্তন, সেটা কী করে সম্ভব হয়েছিল?

আ জা শা: তাহলে আবার আমাকে আমার পরিবারের অন্দরে ঢুকতে হয়। আমার বাবার আচরণ থেকে আমি যা দেখেছি, সেটা হচ্ছে এই, তিনি গোঁড়া ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কারণ, আমাকে নিয়ে তিনি যখন ওই ব্রাহ্মণবাড়িতে ছোটবেলায় যেতেন, তারা আমাকে নাড়ু, মোয়া ইত্যাদি খেতে দিতেন। এসব কিছু যে আমি গ্রহণ করতাম, তাতে তাঁর কোনো আপত্তি ছিল না। আবার ঈদের চাঁদে আমার সমবয়সী সব না হলেও কিছু কিছু ব্রাহ্মণ ছেলে আমাদের বাড়িতে এসে কোরমা-পোলাও খেয়েছে, দু-একজন ব্রাহ্মণ নারী, বিশেষ করে একজন ব্রাহ্মণ নারী আমার মায়ের বন্ধু ছিলেন। বিধবা। তিনি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং আমার মায়ের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন। এ থেকে বুঝতে পারছেন, কিছুটা স্বাধীনতা, মানে চিন্তার স্বাধীনতা আমাদের ছিল। পরবর্তীকালে কলকাতায় যাওয়ার পর আমি আকৃষ্ট হই প্রধানত চলমান মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার ব্যাপারে। আসল কথা হলো, স্বাধীনতা অর্জনের অনুকূল যেকোনো আন্দোলন, সেটা যেদিক থেকেই হোক, অর্থাত্ ব্রিটিশবিরোধী যেকোনো আন্দোলনের প্রতি আমার সব সময় একটা বিশেষ রকমের পক্ষপাতিত্ব ছিল। প্রথমে আমি যখন কলকাতায় যাই, সংবাদপত্রজগতের সঙ্গে কিছু লোকের মাধ্যমে কবি বেনজীর আহমদ, আশরাফ আলী খান, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, পরবর্তীকালে আবুল মনসুর আহমদ২৪ প্রমুখের মতো অনেকের সঙ্গে পরিচিত হই। পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে এই যে কয়েকজনের কথা বললাম, তাঁরা ইউরোপীয় সাহিত্য, সেকালে হাতের সামনে যা পাওয়া যেত, তা-ই পড়তেন। বিশেষ করে, ইবসেন, বার্নার্ড শর লেখা তাঁরা নিয়মিত পড়তেন এবং আমাদেরও তাঁরা বলতেন এসব পড়তে। ফলে, তাঁদের পরামর্শমতো পড়াশোনা করতাম। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, কবি বেনজীর আহমদ খুব সম্ভব ১৯৩২-৩৩ সালের দিকে আমাকে কার্ল মার্ক্সের দুই খণ্ডের দাস ক্যাপিটাল (এ-জাতীয় বই তখন প্রকাশ্যে বেচাকেনা হতো না) এবং এম এন রায়ের ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন বইটি পড়তে দেন। তিনি বই দুটো কোথা থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন, জানি না।

ওই বয়সে দাস ক্যাপিটাল-এর ইংরেজি অনুবাদ, ইডেনের অনুবাদ ছিল বোধ হয়, পড়ে বুঝতে খুব কষ্ট হয়েছে। আমার বিদ্যা বলতে তো ওই ম্যাট্রিক পাস পর্যন্ত। তার বেশি নয়। তবে কষ্ট হলেও আমি পাঁচ-ছয় মাসে দুই খণ্ডের দাস ক্যাপিটাল ও ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন বইটিও পড়ে শেষ করেছিলাম। পড়ার পর, বিশেষ করে বার্নার্ড শ ও ইবসেনের বই পড়ার পর আমার মন অনেকটা মুক্ত হয়ে যায়। তবে একটা কনট্রাডিকশন যে মনের মধ্যে ছিল না, এমন নয়। মানে একদিকে যেমন মুসলিম সমাজের প্রতি, ইসলামের প্রতি ঝোঁক ছিল, অন্যদিকে তেমনি সর্বভারতীয় মানুষের সার্বিক উন্নতি এবং তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারেও আগ্রহ ছিল। এর মধ্যে এম এন রায় সম্ভবত ১৯৩৭ সালে জেল থেকে বের হন। কলকাতায় আসেন। তাঁর সান্নিধ্যে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন খুব সম্ভব বসুধা চক্রবর্তী ও বেনজীর আহমদ দুজনে মিলে। আপনারা জানেন, কবি বেনজীর আহমদ নওরোজ পত্রিকা বের করেছিলেন। তিনি সন্ত্রাসবাদী ছিলেন। সেকালে সন্ত্রাসবাদীদের ডাকাতও বলা হতো। তিনি ওই পথেই অর্থ সংগ্রহ করে তাঁর পত্রিকা বের করেছিলেন। সেকালে হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে যেসব পত্রপত্রিকা বের হতো, সেগুলোর মধ্যে নওরোজ ছিল প্রথম শ্রেণীর একটা পত্রিকা। তবে তার আয়ু ছিল মাত্র কয়েক মাসের।

সে সময় আমি ঢাকায়। নওরোজ পত্রিকা এখানে আসত। আমরা পড়তাম। নজরুল ইসলাম তাতে লিখতেন। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যাপার, কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য। নজরুল ইসলামের লেখা যেটা যখন পেয়েছি, পড়েছি। তিনি আমাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে যোগ দিতে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সাহিত্যটাহিত্য যা করছি, তার প্রথম অনুপ্রেরণা দিয়েছেন নজরুল ইসলাম। উদ্বুদ্ধও করেছেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামের খ্যাতি তখন আকাশসমান। হিজ মাস্টার ভয়েজে অন্য শিল্পীদের দিয়ে গান রেকর্ড করান। আমার সেই দৃশ্যটা এখনো মনে আছে। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিন। দোতলায় গিয়ে বসলাম। এটা খুব সম্ভব ১৯৩৫-৩৬ সালের বা তার আগেকার কথা। আমার কিছু গল্পটল্প তখন বেরিয়েছে। তবে, পরিত্যক্ত স্বামী বের হয়েছে কি না, মনে নেই।

মু নূ ই: আপনি কখন গল্প লিখতে শুরু করেন?

আ জা শা: আমার প্রথম লেখা বের হয় ১৯৩৩ সালে। প্রথম প্রকাশিত আমার রচনাটা ছিল ইংরেজিতে লেখা। বের হয়েছিল ১৯৩২ সালে স্টার অব ইন্ডিয়ায়। পরে প্রকাশিত হয় বাংলা রচনা। প্রথম বের হয় একটা প্রবন্ধ। তারপর গল্প। আমার রচনা প্রকাশের শুরু ১৯৩৩ সাল থেকে। তার কিছুদিন পর কাজী নজরুল ইসলামের বাসায় যাই। কবি আবদুল কাদির২৫ সাহেবের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। ঢাকায় নয়, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকা থেকে কলকাতায় যাওয়ার পথে। তিনি আমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। দৃশ্যটা মনে পড়ে। দোতলায় গিয়ে বসলাম। বসার পরই কিছু খাবার এল। মিষ্টি। কাজী বললেন, ‘আমি আসছি।’ নিচে থেকে তিনি সেজেগুজে এলেন। যখন এলেন, তখন তাঁর পরনে একটা সিল্কের পাঞ্জাবি ও ধুতি। মাথায় খদ্দরের টুপি এবং সারা গা থেকে বের হচ্ছে ভুরভুরানো সুগন্ধি। তিনি সুগন্ধি খুব ভালোবাসতেন। তাঁর তখন একটা গাড়ি ছিল। মোটরগাড়ি। আমাদের বললেন, ‘চলো।’ আমাদের তুললেন তাঁর গাড়িতে। ড্রাইভার চালিয়ে নিয়ে গেল।

পরে বললেন, ‘আমি হিজ মাস্টার্স ভয়েসে নেমে যাব। তোমাদের ওই পর্যন্ত নিয়ে যাই।’ তিনি ওখানে নামলেন। আমরা ওখান থেকে চলে আসি। এই হচ্ছে তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি। পরবর্তী জীবনে তাঁকে আমরা আরও অনেক জায়গায় দেখেছি। দেখেছি নবযুগ পত্রিকায়। ১৯৪২ সালের দিকে পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক ছিলেন। আমিও কিছুদিন নবযুগ-এ চাকরি করেছি। তারপর দু-একটি বাসায় তাঁর সঙ্গে আমি সংগীতের জলসায় উপস্থিত ছিলাম।

যে কথা বলছিলাম, এই যে আমি কিছুটা মুক্তচিন্তা করতে সক্ষম হয়েছি, তার স্থলে রয়েছে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে আমার মেলামেশার ফল। কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণা এবং শেষ পর্যায়ে এসে এম এন রায়ের সঙ্গে পরিচয় আমাকে আলোকিত হতে সাহায্য করেছে। এম এন রায় যে ইনডিপেনডেন্ট ইন্ডিয়া বের করেছিলেন, আমি ছিলাম সেই পত্রিকার কলকাতা সংবাদদাতা। পরে ডেইলি ভ্যানগার্ড দিল্লি থেকে বের করতেন, তারও কলকাতা সংবাদদাতা ছিলাম আমি। এম এন দীন ছদ্মনামে আমি তাঁর পত্রিকা ইনডিপেনডেন্ট ইন্ডিয়াতে কিছু প্রবন্ধ লিখেছি। যখন এম এন রায় এখানে আসতেন, তাঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যে কিছু আলাপ-আলোচনা হতো। তিনি যেসব রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতেন, সেগুলো শুনতাম। লক্ষেৗতে যুদ্ধের সময় একটা সম্মেলন হয়। র্যাডিকাল পার্টির ওই সম্মেলনে আমি যোগ দিয়েছিলাম। আমার মুক্তচিন্তা করতে পারার মূলে প্রধান অবদান রেখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। কবি বেনজীর আহমদও প্রথম দিকে বইপত্র দিয়ে সহায়তা করেছেন। আমার জীবনে কবি আবদুল কাদিরেরও প্রভূত অবদান রয়েছে। আর শেষের দিকে এসে আমার মানস গঠনে সাহায্য করেছেন এম এন রায়।

মু নূ ই: আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ১৯২৮ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলো আপনার ওপর কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল? এ ব্যাপারে অবশ্য আপনি নিজের কথা বলেছেন। কিন্তু তখনকার কলকাতার বাসিন্দা আপনাদের বয়সী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা মোটামুটিভাবে কি একই ধরনের চিন্তাভাবনা করতেন, নাকি তাঁদের চিন্তা অন্য রকম কিছু ছিল?

আ জা শা: ১৯২৮ থেকে ১৯৩৩ সাল অবধি মেসে থেকেছি। ওই সময়, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আমি যাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি, তাঁদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চিন্তা খুব বেশি একটা ছিল না। তাঁরা মুসলমান সমাজের উন্নতি কামনা করতেন। কিন্তু যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতা পরবর্তীকালে দেখা দিয়েছিল, তেমন কিছু ছিল না। তখনো পর্যন্ত বেশির ভাগ শিক্ষিত মুসলিম তরুণ ছিলেন কংগ্রেসপন্থী এবং ১৯৩৩ সালের আন্দোলনের সময় তাঁদের অনেকেই খদ্দর ধরেছিলেন। আমি নিজেও তখন খদ্দর ধরেছিলাম। সিগারেটের পরিবর্তে অনেকেই বিড়ি ধরেছিলেন।

ওই সময় রাজনৈতিক দিক থেকে, আমার মনে হয়, কংগ্রেসই সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। সে সময় অবশ্য বামপন্থী রাজনীতিও কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছে। কমিউনিস্ট পার্টি স্বনামে না থাকলেও ছিল ছদ্মাবরণে। তার নাম ছিল ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজেন্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া’। সে সময় আমাদের অনেকেই মুজফ্ফর আহমদ২৬ সাহেবের সঙ্গে, যেমন আমি নিজেও, পরিচিত হয়েছিলাম। কাদির সাহেবই আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুজফ্ফর আহমদ, হালিম, মোমেন প্রমুখ ছিলেন ওই পার্টির, মানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। এই সময় কাজকর্মের ভেতর দিয়ে তাঁরাও কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় তাঁদের উদ্যোগে অক্টারলনি মনুমেন্টের নিচে বড় বড় শ্রমিক-জমায়েত হতে দেখেছি। কাজেই মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে যে উত্কট সাম্প্রদায়িকতা, তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর থেকেই। ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালে ফজলুল হক সাহেব মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেই মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে বসলেন; যদিও তিনি কৃষক প্রজা পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। উত্কট সাম্প্রদায়িকতা বলতে গেলে তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়। অর্থাত্, ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট সাম্প্রদায়িকতার উত্স হিসেবে কাজ করেছে। কারণ, ওই অ্যাক্টের মধ্যে সেপারেট ইলেক্টোরেট ও সিডিউলকাস্টদের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ-সংক্রান্ত ধারা ইত্যাদিই ছিল। আমার ধারণা, ১৯৩৫ সালের ওই কনস্টিটিউশন, অর্থাত্ ভারত শাসন আইনের মধ্যেই ভারত বিভাগের বীজ উপ্ত ছিল।

মু নূ ই: আপনার কলকাতার জীবন শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবে। আজাদ পত্রিকা কীভাবে বের হয়, তার পেছনে কারা কারা ছিলেন? এবং ওই পত্রিকার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কীভাবে হয়, সে সম্পর্কে যদি কিছু আলোকপাত করেন...।

আ জা শা: আজাদ পত্রিকা যখন বের হয়, অর্থাত্ তার প্রাথমিক উদ্যোগ-আয়োজনের সঙ্গে আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না। ফজলুল হক সাহেব যখন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তখন ওই মন্ত্রিসভায় নলিনী সরকারও২৭ ছিলেন, অর্থমন্ত্রী তিনি। মওলানা আকরম খাঁ২৮ সাহেব তো সারা জীবন কংগ্রেসই করতেন। পরবর্তীকালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ওই সময় তিনি দরখাস্ত দিয়ে সরকারের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা পান। তা-ই দিয়ে তিনি কাগজটা বের করেছিলেন। এটা ছিল একেবারেই অভিনব একটা ব্যাপার এবং সাংবাদিকতার জগতে বোধ হয় সচরাচর ঘটে না, এমন একটা ব্যাপার।

মু নূ ই: আপনার সাহিত্যচর্চার বিষয়ে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আমার যত দূর মনে হয়, আপনি প্রধানত ছোটগল্পই লিখেছেন, কিন্তু আপনার খ্যাতির সূচনা উপন্যাস পরিত্যক্ত স্বামী থেকে। আপনার ওই উপন্যাসে যে ধরনের ঘটনা তুলে ধরেছেন, সে ধরনের জীবনধারা মুসলমান সমাজে তখন ছিল না। এই উপন্যাস লেখার প্রেরণা বা ইচ্ছা আপনার কী করে হলো?

আ জা শা: ওই সময় আসলে খুব চিন্তাভাবনা করেটরে যে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, সে কথা এখন আর খুব মনে পড়ে না। তবে ইবসেন আর বার্নার্ড শর বই-পুস্তক পড়ার প্রভাব যে আমার ওপর পড়েছিল, সে কথা অস্বীকার করা যাবে না এবং পরিত্যক্ত স্বামীতে বর্ণিত ঘটনার মতো ঘটনা যে ওই সময় সমাজে কিছু কিছু ঘটেনি, তা-ও নয়। তবে বুঝতেই পারেন, ওটা ছিল কাঁচা হাতের লেখা। আমি তো ঠিক ওই ধরনের সমাজের একজন ছিলাম না। কলকাতা আসলে কসমোপলিটন সিটি। হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে যে ধরনের সমাজে বসবাস করত, ওই উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনার মতো ঘটনা ঘটা সেখানে অসম্ভব কিছু ছিল না। আমি তো দূরে থেকে দেখেছি। বলতে পারি, তার সবটাই কল্পনা। ওই উপন্যাসে বাস্তব জীবনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বইটির খ্যাতির মূল কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, ওই সময় কোনো মুসলমান লেখকের কলম থেকে ও ধরনের কোনো বই লেখা হয়নি। হ্যাঁ, আপনাদের মতে দুঃসাহসিক লেখাই বলতে পারেন। তার পর থেকে তো লেখা চলতে থাকে। এই সময় আমার আরেকটা বই বের হয়। নাম ছিল মুক্তি। সেটা ছিল কিছুটা কাল্পনিক, কিছুটা দর্শননির্ভর। তার পর থেকে যত গল্প-উপন্যাস লিখেছি, প্রায় সব কটিই সজ্ঞানে, ভেবেচিন্তেই লিখেছি। লক্ষ্য-আদর্শহীন কোনো সাহিত্যে আমি বিশ্বাস করি না। ‘আমি আর্ট ফর আর্টস সেক’-এ বিশ্বাস করি না। আমি বরং টলস্টয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত। তিনি বলেছেন, যে সাহিত্যের পেছনে কোনো লক্ষ্যাদর্শ নেই, সেটা কোনো সাহিত্যই নয়। সে বিচারে আমি পরবর্তীকালে যা লিখেছি, অর্থাত্ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এমনকি তার পরও যতগুলো উপন্যাস বা গল্পের বই লিখেছি বা প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে আমার কিছু বক্তব্য, অর্থাত্ সামাজিক চিন্তাভাবনা, সমাজের লক্ষ্যাদর্শ কী হওয়া উচিত বা আমার কী লক্ষ্যাদর্শ, মোটামুটি তা আমার এসব সাহিত্যকর্মে স্থান পেয়েছে।

মু নূ ই: চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে রেনেসাঁ সোসাইটি হয়েছিল এবং তাদের একটা কনফারেন্সও হয়েছিল। সংগঠনটির সঙ্গে আপনি যুক্ত ছিলেন, এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

আ জা শা: ওটার নাম ছিল পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি। তার মিটিংয়ে আমি মাঝেমধ্যে যেতাম। একটা মিটিংয়ের কথা আমার মনে আছে। মুজীবর রহমান খাঁ২৯ বোধ হয় ওটার সেক্রেটারি ছিলেন। একটা মিটিংয়ে আমি ছিলাম। আমাদের জহুরও (জহুর হোসেন চৌধুরী, দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদক) বোধ হয় উপস্থিত ছিল। তখন ড. সাদেক বলে অর্থনীতির একজন অধ্যাপক ছিলেন। তিনি অর্থনীতির ওপর একটা প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান হলে টাকাকড়ির ব্যাপারে আমরা মোটেও আটকাব না। আমরা নিজেরাই সব নোট ছাপাব। এভাবে অর্থনীতিকে আমরা চাঙা করে তুলব। আমার মনে আছে, অর্থনীতির ছাত্র না হলেও আমি আগাগোড়া একজন স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলাম। আমি জনাব সাদেকের ওই বক্তব্যের ব্যাপারে একটা বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলাম। এটা যে একটা ফ্যান্টাস্টিক ননসেন্স ছিল, সে ব্যাপারে আলোচনা করেছিলাম। তর্ক-বিতর্কের সূচনা করেছিলাম। রেনেসাঁ সোসাইটির সভায় মাঝেমধ্যে প্রবন্ধ পড়া হতো। আমি কোনো কোনো মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতাম।

মু নূ ই: আপনি আজাদ-এ যোগ দিয়েছিলেন কখন?

আ জা শা: আজাদ-এ খুব সম্ভব ১৯৪১-৪২ সালের দিকে রাতের শিফটে সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দিই। সার্বক্ষণিক নয়, খণ্ডকালীন হিসেবে। ঘণ্টা তিন-চার কাজ করতে হতো। আমার কাজ ছিল ইংরেজি থেকে বাংলায় সংবাদ অনুবাদ করা। পরবর্তীকালে আমি একই সঙ্গে তিন-চার জায়গায় কাজ করতাম। ১৯৪৩ সালের শেষ ভাগ সেটা। ভয়ানক দুর্ভিক্ষ চলছে তখন। কাজ করতাম ইনডিপেনডেন্ট ইন্ডিয়া ও ভ্যানগার্ড-এর কলকাতা প্রতিনিধি হিসেবে। ওরিয়েন্ট প্রেস অব ইন্ডিয়া নামে একটা নিউজ এজেন্সি ছিল, মুসলিম লীগেরই প্রতিষ্ঠান ছিল সেটা, সেখানেও আমি মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহর৩০ সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। আবার রাতের শিফটে, আগেই বলেছি, দৈনিক আজাদ-এ কাজ করতাম। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি বিশ্রামের জন্য কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। এই সময় আজাদ পত্রিকার তরফ থেকে আমাকে চিঠি লিখে বলা হয়, ‘আপনি চলে আসুন।’ আমি ১৯৪৫ সালে আবার কলকাতায় চলে যাই। তখন তারা আমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিল। তখন বোধ হয় ইত্তেহাদ বেরিয়েছে কি বেরোয়নি, আমার ঠিক মনে নেই। ১৯৪৬ সালের দিকেই বোধ হয় সেটা বের হয়।

যা-ই হোক, আজাদ-এর তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরের প্রয়োজন ছিল। আমি বললাম, আমার শরীর এখনো খুব সুস্থ নয়। আমি তো স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকতে পারছি না। আরও কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে। তখন আজাদ কর্তৃপক্ষ আমাকে প্রস্তাব দিল, ‘আমরা ঢাকায় অফিস খুলছি। আপনাকে ঢাকা অফিসের দায়িত্ব দিচ্ছি। ঢাকার প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করছি। আপনি রাজি আছেন কি না?’

বলে দিলাম, ঠিক আছে। এটা আমার জন্য ভালোই হবে। ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি ঢাকায় এসে আমি আজাদ-এর স্থানীয় ঢাকা অফিস স্থাপন করি।

মু নূ ই: কোথায় ওটা হয়?

আ জা শা: তখন ঢাকায় বাড়ি পাওয়া মুশকিল ছিল। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তখন শেষ অবস্থা। মার্কিন সেনারা তখনো এখানে আছে। এদিকে সর্বপ্রথম আমি ফুলবাড়িয়া রোডে একটা রুম ভাড়া নিই। মাসিক ভাড়া ১০ টাকা। অপ্রশস্ত রুম। খুবই অসুবিধা হতো কাজকর্ম করতে। পরে ওটা বদল করি। ইংলিশ রোডে ইয়ার মোহাম্মদ খানের কাছ থেকে একটা রুম নিই। সেখানেও খুব অসুবিধা হয়। পরে ইয়ার মোহাম্মদ খান কলতাবাজারে একটা বাড়ি করেন। সেই বাড়ির তিনটা কামরা ভাড়া নিয়ে অফিস এবং আমার থাকার ব্যবস্থা দুটোই একসঙ্গে করি। ১৯৪৬ সালের দিকে কলতাবাজারে অফিস খুলতে সক্ষম হই।

মু নূ ই: ঢাকেশ্বরী রোডে পরে যে আজাদ অফিস হলো, সেটা কীভাবে হলো? আপনি তো ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এই জমি নেওয়া থেকে শুরু করে আজাদ অফিস খোলা পর্যন্ত, যা কিছু ঘটেছে, তার একটা বিবরণ যদি দেন।

আ জা শা: এ ব্যাপারে আমি গোড়া থেকেই জড়িত ছিলাম। যখন পার্টিশন হয়ে গেল, তখন আমাকে মাঝেমধ্যে কলকাতা যেতে হতো। আজাদ কর্তৃপক্ষ একদিন আমাকে বলল, বিশেষভাবে মওলানা আকরম খাঁর বড় ছেলে সদরুল আনাম খাঁ ও মওলানা আকরম খাঁ নিজেও বললেন, ‘আমরা ঢাকা থেকে কাগজ বের করব ঠিক করেছি। তুমি একটু চেষ্টা করো।’ আমি এসে চেষ্টা করতে লাগলাম। নাজিমুদ্দিন সাহেব ছিলেন। নূরুল আমীন৩১ সাহেব তখন খাদ্যমন্ত্রী। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে লাগলাম। কলকাতা থেকে আজাদ ঢাকায় আসুক, সে ব্যাপারে তাঁরা যে খুব একটা আগ্রহান্বিত ছিলেন, সে কথা বলা যায় না। হামিদুল হক চৌধুরীর তো আদৌ কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমরা কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগলাম। এর মধ্যে আবার খায়রুল কবির৩২ সাহেবকে আমার সঙ্গে কাজ করার জন্য ঢাকায় পাঠানো হলো। তিনি কলকাতায় আজাদ-এ যোগ দিয়েছিলেন। খায়রুল কবির ও আমি দুজন মিলে এখানকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা-চালাচালি করতে লাগলাম। এ ব্যাপারে নূরুল আমীন আমাদের যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন এবং ওদিক থেকে খলিল মিয়া, অর্থাত্ সদরুল আনাম খাঁ, মওলানা আকরম খাঁর ছেলে, ওই সময় তিনিও প্রায়ই ঢাকায় আসতেন। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বিঘা জমি লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকারের তরফ থেকে পাওয়া গেল। আমার যত দূর মনে পড়ে, প্রতি বিঘার তখন সেলামি ছিল চার কিংবা পাঁচ হাজার টাকা। এই সেলামি দিয়ে জমিটা লিজ নেওয়া হয়েছিল। লিজ নেওয়ার ওই সময়টায় মওলানা আকরম খাঁ কিছুদিন ঢাকায় ছিলেন। এসেছিলেন তিনি আমার কলতাবাজারের দোতলার বাসায়। ওই সময় আমাকে যেমন আজাদ পত্রিকার ঢাকার প্রতিনিধিত্ব করতে হতো, তেমনি পত্রিকাটির কার্যালয় প্রতিষ্ঠায় ইট-কাঠ সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে সব কাজই করতে হতো। তখন আমাকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। মওলানা আকরম খাঁ শেষ পর্যন্ত আমার ডেরা থেকে চলে গিয়ে ঢাকেশ্বরী রোডে থাকতে লাগলেন। এই তো ঢাকায় আজাদ অফিস চালু হওয়ার ইতিহাস। আমরা তো ঠিক চাকরি করলেও, আজাদ-এর কর্মচারী হলেও ভূমিকাটা ছিল উদ্যোগীর। যেখানে কোনো পত্রিকাই নেই, সেখানে অন্তত একটা পত্রিকা প্রতিষ্ঠা লাভ করুক, এটাই ছিল আমাদের একমাত্র কামনা। এবং সেদিক থেকে যতটা শ্রম দেওয়া সম্ভব, আমি ও খায়রুল কবির দুজনই ঠিক ততটাই দিয়েছিলাম। এভাবেই এখানে আজাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঢাকায় আজাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমাকে পদ দেওয়া হলো সহকারী সম্পাদকের। খায়রুল কবির হলেন বার্তা সম্পাদক। কিন্তু আমার সঙ্গে আজাদ-এর বেশি দিন বনিবনা হলো না। ১৯৫০ সালের জুন মাসে আমার টাইফয়েড হয়। আমি তখন আগামসি লেনে থাকি। এক মাসের ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটির পর এক মাসের বেতন পাওনা ছিল। বেতনটা চেয়েছিলাম। তারা সেটা না দিয়ে চিঠি পাঠাল এই বলে যে ইয়োর সার্ভিস ইজ নো লংগার রিকোয়ার্ড। ফলে, খুবই দুরবস্থায় পড়ে যাই। সেদিন আমার হাতে মাত্র তিন আনা পয়সা ছিল।

সা আ: আপনার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণটা কী ছিল?

আ জা শা: বনিবনা না হওয়ার মূলে ছিল একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এ সম্পর্কে অবশ্য তারা কখনোই কিছু বলেনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, মওলানা আকরম খাঁর যে ছোট ছেলে ছিল, সে ছিল একটু বাউন্ডুলে ধরনের। মওলানা আকরম খাঁর স্বাক্ষরে (কলতাবাজারের আমার বাসায় তখন ওই ছেলে থাকত) চেকের টাকা ভাঙানো হতো। চেক বইটা বোধ হয় নিচের অফিসরুমে ছিল। হঠাত্ একদিন দেখি, একটা চেক নেই, চেকের পৃষ্ঠাও কম। আমি সাংঘাতিকভাবে ভয় পেয়ে গেলাম। ব্যাপারটা অনতিবিলম্বে আমি ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে জানালাম। ওখানেই ছিল মওলানা আকরম খাঁর অ্যাকাউন্ট। আমি ওখানে টেলিফোন করে বললাম, ‘একটা চেক দেখছি না। আপনারা ওই চেকের এগেনেস্টে কোনো পেমেন্ট করবেন না।’ মওলানা আকরম খাঁকেও বললাম, ‘আপনি কি কোনো চেক সই করেছেন?’

তিনি জানালেন, না।

পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আসলে তাঁর ছোট ছেলেটাই মওলানা আকরম খাঁর স্বাক্ষর জাল করে চেকটা নিয়ে গেছে।

আমি খুব ক্ষুব্ধ হলাম। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি ছেলেটাকে গালমন্দ করার একপর্যায়ে তাকে বোধ হয় এ কথা বলেছিলাম, তোমাকে চড় মারা দরকার। তবে মুখে বললেও চড়টা মারা হয়নি। কথাটি বোধ হয় মওলানা আকরম খাঁকে জানানো হয়েছিল। একজন কর্মচারী তার মনিবের ছেলেকে, সে যত অপরাধই করুক না কেন, তার সঙ্গে এ রকম আচরণ করবে, এটা তো সহ্য করার কথা নয়। পরবর্তীকালে আজাদ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং তাদের কাছে আমার চাকরি বা সেবার কোনো প্রয়োজন আর থাকল না এবং আমিও তাদের সামনাসামনি নেই, টাইফয়েডে শয্যাশায়ী, এই সুযোগের সদ্ব্যবহারটাই করা হলো। ওই যে মওলানার ছেলেকে একদিন অপমান করেছিলাম, আমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে বোধ হয় তারই প্রতিশোধ গ্রহণ করা হলো। অবশ্য আমি একা ছিলাম না। মোহাম্মদ মোদাব্বেরও চাকরি পায়নি ওখানে। পরবর্তীকালে আবুল কালাম শামসুদ্দীনও বিতাড়িত হয়েছিলেন। চাকর-মনিবের সম্পর্ক এ রকমই হয়।

মু নূ ই: আপনি বললেন যে আজাদ যখন প্রথম ঢাকায় আসে, অর্থাত্ কলকাতা থেকে তার চলে আসার কথা হয়, তখন নাজিমুদ্দিন সাহেব, হামিদুল হক চৌধুরী খুব পক্ষে ছিলেন না। আমার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, কলকাতাকেন্দ্রিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির যে রাজনীতি ছিল, সেখানে তো একদিকে ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী, মওলানা আকরম খাঁ, নাজিমুদ্দিন, মোহন মিয়া প্রমুখ এবং অন্যদিকে ছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব, আবুল হাশিম সাহেব প্রমুখ। তাহলে আজাদ পত্রিকাকে ঢাকায় আনতে তাঁরা আপত্তি করছিলেন কেন?

আ জা শা: তাঁদের এই আপত্তির পেছনে একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ ছিল বলে আমি মনে করি। মওলানা আকরম খাঁ পশ্চিম বাংলার লোক। মুসলিম লীগের কাগজ নিয়ে এখানে (কাগজ তো একটা বড় অস্ত্র) এসে তাঁদের ওপর প্রভুত্ব করবেন, এটা বোধ হয় তাঁরা চাননি। মোহন মিয়া চাননি। হামিদুল হক চৌধুরীও চাননি। নাজিমুদ্দিনও চাননি। মুখে কিন্তু বলেছেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসা দরকার। কিন্তু তাঁদের দীর্ঘসূত্রতা থেকে আমাদের মনে হয়েছে, ব্যাপারটা তাঁরা চাননি। তবে নূরুল আমীন সাহেব এ ব্যাপারে একটু স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁদেরই দলের লোক। কিন্তু তিনি কেন জানি না, আজাদকে ঢাকায় আনার ব্যাপারে একটু বেশিই সহানুভূতিশীল ছিলেন। প্রধানত নূরুল আমীনের চেষ্টাতেই আজাদ-এর জন্য জমিটা পাওয়া গিয়েছিল।

মু নূ ই: আপনি রাজনৈতিক দিক থেকে এম এন রায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর লাহোর প্রস্তাবের পর থেকে আজাদ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষপাতী হয়ে গেল। আজাদই এই আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তখন এখানকার আজাদ অফিসে তার প্রাথমিক অবস্থায় সাব-এডিটর, পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আপনি অ্যাডজাস্ট করেছিলেন কীভাবে?

আ জা শা: অ্যাডজাস্ট করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা কাজ করেছে, সেটা হচ্ছে মওলানা আকরম খাঁ সরাসরি তাঁর নিজস্ব সম্পাদকীয় বা লেখাগুলো লিখে দিতেন। আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেবকে ওপরে ডেকে নিয়ে গিয়ে হয়তো কখনো আলোচনা করতেন। কিন্তু একটা লেখার ওপর ডাইরেক্টলি হস্তক্ষেপ তিনি করতেন না। আমি যখন সম্পাদকীয় লিখতাম, আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব সেগুলো দেখে দিতেন। মুসলিম লীগের পয়েন্ট অব ভিউ থেকেই সবকিছু লেখা হতো। তবে তার মধ্যে যতখানি সম্ভব, আমি নিজে একটু র্যাডিক্যাল মনোভাব বা যুক্তিনির্ভর সম্পাদকীয় লেখার চেষ্টা করতাম। একটা ঘটনার কথা আমার মনে আছে। আমি একটা সম্পাদকীয় লিখেছিলাম। আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব সেটা পাস করে দিয়েছিলেন। ছাপাও হয়ে গিয়েছিল। সম্পাদকীয়টা যখন লিখেছিলাম, তখন একটা ব্যাপার ভয়ানকভাবে চলছিল, মুসলিম লীগের তথাকথিত কর্মীদের গুন্ডামি ও দুর্নীতি তখন প্রায় আকাশচুম্বী। ঢাকায়ও চুরিচামারি, দুর্নীতি ইত্যাদি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রকমের একটা ধারণা ছিল যে দুর্নীতিবাজ আর চোর-বাটপার মুসলিম লীগারদের ধরে নিয়ে চালান দেওয়া হলো, কিন্তু থানাওয়ালাদের বলে-কয়ে, তদবির করে মুসলিম লীগের নেতারা তাঁদের কর্মী বলে বের করে আনতেন। এ সম্পর্কেই তখন আমি একটা কড়া এডিটোরিয়াল লিখেছিলাম, সেটা ছাপাও হয়েছিল।

ছাপা হওয়ার পর ব্যস, আর কোনো কথা নেই, বোধ হয় সৈয়দ আবদুস সেলিম বা সাহেব আলমসহ ঢাকার মুসলিম লীগের আরও জনপ্রিয় নেতা মওলানা আকরম খাঁর কাছে অভিযোগ নিয়ে যান। তিনি ব্যাপারটাকে তাঁর গ্রাহ্যের মধ্যে নেন। আমাকে ডেকে একটা কথা বলেছিলেন তিনি। বেশি কিছু বলেননি, কেবল বলেছিলেন, ‘তুমি একটা সাদাসিধে লোক।’ এর বেশি কোনো মন্তব্য তিনি করেননি। বলেছিলেন, ‘এ ধরনের লেখাটেখা ঠিক নয়।’

এ ধরনের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে আমার সঙ্গে তেমন একটা বনত না। তবে আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব লিখতেন মুসলিম লীগের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। কিন্তু আমরা যারা তাঁর সহকারী ছিলাম, তাদের লেখার ওপর তিনি খুব বেশি একটা হাত দিতেন না। তবে তাঁর একটা কথা আমার এখনো মনে আছে। তিনি একদিন বলেছিলেন, আমার একটা লেখা প্রসঙ্গে যে, ‘দেখেন, সাধারণ পাঠকসমাজেরও কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। তারাও নিজের ধরনে চিন্তাভাবনা করে থাকে। এ কথাটা মনে রেখেই লেখা লিখবেন এবং যতটা সম্ভব সংক্ষেপে লিখবেন। তাদের চিন্তাভাবনা করার সুযোগটাও রাখবেন।’

এভাবে কোনোমতে আজাদ-এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম। আসলে ওটা ছিল আমার চাকরি। এখনো তো একটাই যুক্তি। আজকের দিনেও একটাই যুক্তি, যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরাও প্রোগ্রেসিভ। কিন্তু চাকরি করি বলেই হুকুম মানতে হয়।

মু নূ ই: বাস্তব কারণেই খাপ খাইয়ে নিতে হয়। আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন, তেভাগা আন্দোলন৩৩ যখন বাংলাদেশের বেশ কতগুলো জায়গায় শুরু হয়, সেই আন্দোলন যদি সফল হতো, তাহলে মুসলমান চাষিরাই উপকৃত হতেন বেশি। সে সময় তো আপনারা কলকাতায় ছিলেন। আন্দোলনটা দেখেছেন। ওই সময় আজাদ পত্রিকার ভূমিকা কী ছিল?

আ জা শা: আমি ঠিক তখন কলকাতায় ছিলাম না বোধ হয়। তেভাগা আন্দোলনটা বোধ হয় ১৯৪৪-৪৫ সালের আগে থেকেই শুরু হয়। শুরু হয় ছেচল্লিশ সন থেকে। তখন আমি ঢাকায়। কারণ, ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি আজাদ-এর এখানকার প্রতিনিধি হিসেবে আমি ঢাকায় চলে আসি। তেভাগা আন্দোলন আমাকে খুবই আকর্ষণ করত। তবে সেটা ব্যক্তিগতভাবে এবং আমি ওটার সমর্থকও ছিলাম। কিন্তু আজাদ-এর ভূমিকা বোধ হয়, আমার মনে যত দূর পড়ছে, সর্বতোভাবে তেভাগা আন্দোলনের এবং তাতে অংশগ্রহণকারী জনগণের বিরোধীই ছিল। তাদের তো একমাত্র পুঁজি ছিল ইসলাম। তবে কখনো কখনো জনগণের কিছু দাবিদাওয়া তো সমর্থন করতেই হতো। সে রকমও তারা করত। আমার ঠিক এখনো এটা মনে পড়ছে না। তবে তেভাগা আন্দোলনকে তো সাংঘাতিকভাবে দমন করা হয়েছিল এবং রাজশাহী জেলে তো গুলি পর্যন্ত চালানো হয়েছিল। এতে অনেক লোকজনও মারা গিয়েছিল। তারপর হাজং-টংকদের নিয়ে মণি সিংহদের যেসব আন্দোলন, সেগুলোও সাংঘাতিকভাবে দমন করা হয়েছিল। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর তো সেই আন্দোলনকে আরও বেশি দমন করা হয়। অথচ এসবই ছিল জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। কিন্তু সে বিচারে জনগণের অধিকার আদায়ের বিরোধী ছিল মুসলিম লীগ, সে জন্য তাদের প্রতিষ্ঠা হয়নি। মুসলিম লীগ তো জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত বিভাগ করেনি। তারা সেটা করেছিল মুসলমানরা যে আলাদা জাতি, সেটা প্রমাণ করার জন্য। তাদের মধ্যে কোনো শ্রেণী নেই, এ রকমটাই তারা ভাবত। মুসলমানরা আলাদা জাতি যখন, জাতি হলেই হলো। আর লিডারশিপ সম্পর্কে এডমান বার্ক বলেছিলেন, চার্চ ও অভিজাত শ্রেণীই হচ্ছে ন্যাচারাল রুলার। তো মুসলিম লীগও ছিল চার্চ ও রুলিং ক্লাসের প্রতিনিধি। মি. জিন্নাহ তো ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন না। তাঁরা দেশ শাসন করবেন। আলাদাভাবে লুটপাট করবেন। এই মনোভাব ছাড়া তো আর কোনো মনোভাব কোনো রকম হাই ফিলোসফি বা মতাদর্শ তাঁদের ছিল বলে আমার মনে হয় না।

মু নূ ই: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আ জা শা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

কপি অনুলিখন: রীতা ভৌমিক

তথ্যসূত্র:

১. ১৮৫৭ সালে ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে প্রধানত সিপাহিদের নেতৃত্বে যে ব্যাপক সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটে, তা-ই সিপাহি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। একে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম বলে অভিহিত করা হয়। সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম সূচনা ঘটে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ মঙ্গল পাণ্ডে তাঁর বন্দুকের গুলি ছুড়ে প্রথম সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা করেন।

২.  অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মক্কায় আবদুল ওয়াহাব নামক এক ধর্মীয় সংস্কারকের নেতৃত্বে যে আন্দোলন পরিচালিত হয়, তা-ই ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন সৈয়দ আহম্মদ বেরলভী।

৩.  মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী প্রথম সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হচ্ছে অসহযোগ আন্দোলন। এর উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি ছিল সব বিদেশি পণ্য, বিদেশি খেতাব ও মাদকদ্রব্য বর্জন এবং বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে সব ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করা, চরকায় সুতা কাটা, খদ্দর পরিধান করাসহ সব বিষয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়া।

            মুসলিম দুনিয়ার খলিফা হিসেবে বিবেচিত তুরস্কের খলিফা ও তুর্কি খিলাফতকে রক্ষার জন্য ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানদের নেতৃত্বে ইংরেজবিরোধী যে আন্দোলন পরিচালিত হয়, তা-ই খিলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত।

৪.   পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের পূর্ব দিকে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক উদ্যানে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল নিরস্ত্র জনতার ওপর ইংরেজ সরকারের একদল সেনা বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়, তা-ই ইতিহাসে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।

৫.   রাওলাট অ্যাক্ট হচ্ছে সন্ত্রাসবিরোধী একটি কঠোর আইন। ভারতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমনের জন্য এ আইনে নানা কঠোর ব্যবস্থার বিধান করা হয়।

৬.  ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু (১৯০৩-১৯৫৯) একজন উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী। পিতা জাইদুল হোসেনের কাছ থেকে বাঁশিতে তালিম নেন। এ ছাড়া সংগীত সম্পর্কে বিভিন্ন ওস্তাদ, যেমন রংপুরের ওস্তাদ মেহেদী হোসেন খাঁ, মাতামহ জানে আলম চৌধুরী, ওস্তাদ নাসিরুদ্দীন খাঁ, ওস্তাদ কালে খাঁ, ওস্তাদ মঈজুদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ মসিত খাঁ, ওস্তাদ ওয়াজীর খাঁ, ওস্তাদ মোহাম্মদ আলী খাঁ, জদ্দান বাঈ, ওস্তাদ আল্লাদিয়া খাঁ প্রমুখ ব্যক্তির কাছ থেকে সংগীতের ওপর বিভিন্ন তালিম গ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। অর্জন করেছেন সংগীতাঙ্গনের বিভিন্ন পুরস্কার।

৭.  শিখা ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক আবুল হুসেন ছিলেন শিখা পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদক। শিখা পত্রিকা বছরে একবার প্রকাশিত হতো। প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয় চৈত্র ১৩৩৩ (৮ এপ্রিল ১৯২৭)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ও আবুল ফজল। শিখা ছিল সমকালের অন্যান্য সাময়িকপত্র থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সারা বছরের কর্মকাণ্ডের পরিচয় বহন করত শিখা। শিখার প্রতিটি সংখ্যায় শিরোনামে ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’ কথাটি মুদ্রিত থাকত। পাঁচটি সংখ্যার পর এটি আর প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। শিখা মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র হলেও এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আবুল হুসেন।

৮. কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) একজন লেখক ও চিন্তাবিদ। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত তরুণপত্র পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন। ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর অন্যতম নেতা। বিশ দশকে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি একজন সজাগ বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও লেখক হিসেবে সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ে নিজের প্রজ্ঞা ও সংবেদনশীলতাকে সক্রিয় রেখেছিলেন।

৯.  আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮) একজন চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক। বাংলার বিধানসভা কর্তৃক গৃহীত ওয়াক্ফ আইনের মূল খসড়ার রচয়িতা। ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র শিখার প্রথম বর্ষের সম্পাদক। একজন মননশীল ও যুক্তিনিষ্ঠ প্রাবন্ধিক হিসেবে খ্যাত।

১০. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) একজন ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি, আল এসলাম পত্রিকা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকাসহ বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তিনি কিছুদিন বাংলা একাডেমী ও পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটিতেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। পেয়েছেন বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ইমেরিটাস অধ্যাপক। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সম্পাদনা তাঁর জীবনের প্রধান একটি কাজ। বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ও প্রাচ্যের অন্যতম ভাষাবিজ্ঞানী। একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য: ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে, না বাংলা হবে—এ বিতর্ক সৃষ্টি হলে তিনি জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

১১. উনিশ শতকের ষাটের দশকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হওয়া পত্রিকা হচ্ছে ঢাকা প্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালের ৭ মার্চ এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ব্রজসুন্দর মিত্র, দীনবন্ধু মৌলিক ও ঈশ্বরচন্দ্র বসু। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। পত্রিকাটি প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতো।

১২.  পুরান ঢাকার রোকনপুরের কাছে পাঁচ ভাইঘাট লেন অবস্থিত। একসময় এ লেনের মাথায় ছিল ধোলাই খাল। এ খালে স্থানীয় মহল্লার এক পরিবারের পাঁচ সন্তান একটি বাঁধানো ঘাট নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। সে থেকে এই নামে পরিচিতি পায়।

১৩. পুরান ঢাকার কুলুটোলার পাশেই কাগজীটোলার অবস্থান। ঢাকায় মোগলযুগে এই অঞ্চলে একসময় কাগজীরা বসবাস করত। মোগল দপ্তর, বিচার-আদালত ও বাণিজ্যিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ এই কাগজীরা হাতে তৈরি করত। ঢাকায় তাদের জন্য নির্ধারিত বাসস্থানটি কাগজীটোলা নামে পরিচিতি লাভ করে।

১৪.  জমিদার আগা বাকের খানের অন্যতম পুত্রের নামে নামকৃত একটি এলাকা। আগামসি আঠারো শতকের মাঝামাঝি ঢাকায় বাস করতেন এবং তিনি ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন।

১৫.   মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) ভারতের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতাসংগ্রামের একজন নেতা। গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকারের নানা অন্যায়-অত্যাচার ও বিধিবিধানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। ১৯১৫ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করতে থাকেন। ১৯১৭ সালে তিনি ভারতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে গান্ধীজির নেতৃত্বে প্রথম জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এ সময় তিনি মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনকেও সমর্থন করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৩২ সালে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেন। ১৯৪২ সালে গান্ধীজির নেতৃত্বে শুরু হয় ভারত ছাড় আন্দোলন। গান্ধীজির আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয় এবং ভারত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।

১৬.  চিত্তরঞ্জন দাস (১৮৭০-১৯২৫) ভারতের একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। দেশের জন্য সর্বত্যাগী এই নেতা ‘দেশবন্ধু’ নামে সুপরিচিত। তিনি একজন কবি হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন ও কারাবরণ করেন। ১৯২২ সালে তিনি ‘স্বরাজ্য দল’ গঠন করেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় স্বরাজ্য দল চেষ্টা করে এবং এর ফলে ১৯২৩ সালে মুসলমানদের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয় যা ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। রাজনীতিতে অতিরিক্ত ব্যস্ততা ও পরিশ্রমের ফলে চিত্তরঞ্জনের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে, যার কারণে অকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৭.  বেনজীর আহমদ (১৯০৩-১৯৮৩) একজন কবি। অল্প বয়সে স্কুল ত্যাগ করে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যোগদান। খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ। দীর্ঘদিন কারাগারে অবরুদ্ধ জীবন কাটান। পরবর্তীকালে মুসলিম রেনেসাঁ আন্দোলনে যোগদান করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নওরোজ পত্রিকা, দৈনিক আজাদ পত্রিকা ও দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় কাজ করেন। তিনি একজন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী কবি। কাব্যরীতির ক্ষেত্রে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের অনুসারী।

১৮.  আশরাফ আলী খান (১৯০১-১৯৩৯) একজন কবি ও সাংবাদিক। ছাত্র অবস্থায় অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯২৭ সালে তিনি সাপ্তাহিক বেদুইন নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯২৮-১৯২৯ সালে সোলতান পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকায় যুব আন্দোলন, মসজিদ রক্ষা আন্দোলন ইত্যাদিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় নও-জোয়ান প্রকাশিত হয়। তিনি বিপ্লবের বেদনার ও সাম্যের কবি হিসেবে পরিচিত।

১৯.  আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮) একজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ। কংগ্রেসের আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। দৈনিক মোহাম্মদী পত্রিকা, সাপ্তাহিক মুসলিম জগত্, ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য মুসলমান, নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত সওগাত, দৈনিক আজাদ, দৈনিক জেহাদ ও দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় কাজ করেন। ত্রিশের দশকে মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলমান সমাজের সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত্।

 ২০.  চৌধুরী শামসুর রহমান (১৯০২-১৯৭৭) একজন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তিনি দৈনিক সুলতান, সাপ্তাহিক মুসলিম বাণী, সাপ্তাহিক হানাফী, বাংলার কথা, বেঙ্গল উইকলিতে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। লিখেছেন জীবনী, উপন্যাস, গল্প, অনুবাদ সাহিত্য।

২১.  ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে লন্ডনে ভারতে সংবিধান সংস্কার ও ভারতীয়দের দাবিদাওয়া নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ১৯৩০-৩২ সময়কালে যে আলোচনা হয়, তা গোলটেবিল বৈঠক নামে পরিচিত। লন্ডনে মোট তিনটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকগুলোর সব সিদ্ধান্ত ও আলোচ্য বিষয় ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করে।

২২. মাস্টারদা সূর্য সেন (১৮৯৩-১৯৩৪) একজন বিপ্লবী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল সংগঠনের কাজ শুরু করেন। যুগান্তর দলের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে গোপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদ পাহাড়ে সংঘটিত যুদ্ধে নেতৃত্বদান। তারপর পলাতক জীবন। ১৯৩৩ সালে আত্মগোপনরত অবস্থায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য সূর্য সেন নিজের জীবন উত্সর্গ করেছিলেন।

২৩. মানবেন্দ্রনাথ রায় (১৮৮৭-১৯৫৪) ব্রিটিশ ভারতের বিপ্লবী ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতা। বাঘা যতীনের সহকর্মী হিসেবে গুপ্ত সংগঠন সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এরপর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত হন। ১৯১৪ সালে ইংরেজদের প্রধান শত্রু জার্মানদের সঙ্গে যোগাযোগে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। গোপন কার্যক্রমের জন্য ছদ্মনামে বাটাভিয়া, ফিলিপাইন, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। আমেরিকার র্যাডিক্যালদের প্রভাবে মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী হন এবং সোশ্যালিস্ট ভ্রাতৃসংঘের প্রথম ভারতীয় সদস্য হন। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংস্থার বিশিষ্ট সদস্য এবং বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত এই সংস্থার বিভিন্ন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বের ১৭টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা আনুমানিক ৬৭।

২৪.  আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। তিনি সাপ্তাহিক সোলতান, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, দ্য মুসলমান পত্রিকা, দৈনিক কৃষক পত্রিকা, দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি কংগ্রেসের আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, মুসলিম লীগের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচির প্রণেতা। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় থেকে সুযোগ্য রাজনীতিবিদ হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির আদর্শের অনুসারী ও তাঁর একজন নিষ্ঠাবান ভক্ত। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পূর্ব বাংলার স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে আপসহীন ভূমিকা পালন করেন। রচনা করেছেন গল্প, প্রবন্ধ, ব্যঙ্গ রচনা, শিশুসাহিত্য, স্মৃতিকথা ও আত্মকথা।

২৫.  আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) একজন কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, ছান্দসিক ও সম্পাদক। তিনি সওগাত, মাসিক পত্রিকা জয়তী, নবশক্তি, যুগান্তর, নবযুগ, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, অর্ধসাপ্তাহিক পয়গাম, মাসিক মাহে নও পত্রিকায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতৃত্বে ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন হয় তার তিনি অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি বার্ষিক শিখা পত্রিকার প্রকাশক ও লেখক। রচনা করেছেন বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম। পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা ও পদক।

২৬. মুজফ্ফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩) একজন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও লেখক। ১৯১৮ সালে কলকাতায় রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ, সাপ্তাহিক ধূমকেতু, গণবাণী পত্রিকা, সাপ্তাহিক গণশক্তি, দৈনিক স্বাধীনতা ইত্যাদি পত্রিকায় সম্পাদক ও সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন। ১৯২০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর বিভিন্ন সময় কারাবরণ করেন। ১৯৪০-৪২ সময়কালীন আত্মগোপনে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দেন। চীন ও রাশিয়ার আদর্শগত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে তিনি সিপিএমের পক্ষাবলম্বন করেন। রচনা করেছেন স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী। কৃষক শ্রমিক তথা সমাজের সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সারা জীবন আপসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন।

২৭. নলিনীরঞ্জন সরকার (১৮৮২-১৯৫০) একজন অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ। শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯১১ সালে যোগ দেন হিন্দুস্তান কো-অপারেটিভ ইনস্যুরেন্স সোসাইটিতে। ১৯২৩-২৮ সাল পর্যন্ত স্বরাজ পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, কলকাতা করপোরেশনে ও সর্বভারতীয় বণিক সভায় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭ সালে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত বঙ্গীয় সরকারের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৪৯ পর্যন্ত রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিভিন্ন বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২৮. মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। পড়াশোনার পাট শেষ করার পর তাঁর সম্পাদনায় মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এ ছাড়া তিনি মাসিক আল এসলাম, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক আজাদ-এ সাংবাদিকতা করেন। একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, স্বরাজ আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আকরম খাঁ বাংলা গদ্য সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট শিল্পী। একই সঙ্গে তিনি রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজচিন্তামূলক গ্রন্থ রচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। অবিভক্ত বঙ্গে মুসলিম জাগরণের আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের সাংবাদিকতার পথিকৃত্ ছিলেন।

২৯. মুজীবর রহমান খাঁ (১৯১০-১৯৮৪) একজন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। ১৯৩৯-১৯৬৫ পর্যন্ত দৈনিক আজাদ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। কলকাতার সাপ্তাহিক কমরেড, ঢাকার মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক পয়গাম, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি, পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা।

৩০. মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ (১৯০৭-১৯৭৮) একজন সাংবাদিক ও লেখক। আর্থিক সংকটের কারণে কলেজের পাঠ ত্যাগ করে রেঙ্গুনের ডেইলি নিউজ-এর ক্যাজুয়াল রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে কলকাতার স্টার অব ইন্ডিয়া, দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় কাজ করেন। ছাত্র অবস্থায় কংগ্রেসের রাজনীতি করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। লালকোর্তা ছদ্মনামে তিনি পত্রপত্রিকায় সমালোচনামূলক প্রবন্ধ ও লেখালেখি করতেন।

৩১. নূরুল আমীন (১৮৯৩-১৯৭৪) একজন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিরোধিতা করেন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন শুরুর আগ পর্যন্ত মুসলিম লীগের রাজনীতির একজন বিশিষ্ট নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে আইয়ুব সরকারের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হন। ১৯৬৯ সালে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।

৩২. খায়রুল কবির (১৯২১-১৯৯৭) একজন সাংবাদিক ও ব্যাংকার। কর্মজীবনে দৈনিক আজাদ, পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েট প্রেস, দৈনিক জিন্দেগী, দৈনিক সংবাদ, পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়, বার্তা সংস্থা এপিপি, ইউনাইটেড ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। একজন সাংবাদিক ও ব্যাংক-বিমা ব্যবসায়ের অগ্রকর্মী ছিলেন। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাব স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

৩৩. তেভাগা আন্দোলন বাংলার ইতিহাসের একটি কৃষক আন্দোলন। ১৯৪৬ সালে বাংলার রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহসহ উত্তরবঙ্গে এ কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল উত্পন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবেন চাষি এবং এক ভাগ পাবেন মালিক। তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ‘জান দেব তবু ধান দেব না’।