গণজাগরণ মঞ্চ: আত্মপরিচয়ের পুনঃ অনুসন্ধান

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, গুণগত এক নতুন প্রপঞ্চ যোগ করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা এ আন্দোলনেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, রাজনৈতিক ও সিভিল—উভয় সমাজই ঐক্যবদ্ধভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে একটি প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য হলো এ ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করা। প্রবন্ধে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে মূলত চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী এলিটদের ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স প্রতিষ্ঠা করতে না পারা, যার পরিণতিতে একই জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে দুটো সমান্তরাল জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে জাতীয় মৌলিক ইস্যুতে ন্যূনতম ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংলাপ পরিচালনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: গণজাগরণ মঞ্চ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, দ্বিজাতিতত্ত্ব, সেক্যুলার মূল্যবোধ ও ন্যূনতম জাতীয় ঐক্য।

ভূমিকা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগতভাবে একটি নতুন প্রপঞ্চ (phenomenon) হলো শাহবাগকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, যা কিনা শাহবাগ ছাড়িয়ে সারা দেশে এবং দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পর গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন হলো এ ধরনের দ্বিতীয় আন্দোলন, যা কিনা প্রচলিত নেতৃত্বের বাইরে, কিছুদিন আগেও যাঁরা অপরিচিত ছিলেন, এমন কিছু তরুণের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে—যাঁদের লক্ষ্য শুধু একাত্তরের ঘাতকদের বিচারই নয়, এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন ছিল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সেটি গড়ে তোলা।১ অর্থাত্, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪২ বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে আত্মপরিচয়ের সংকট রয়ে গেছে, সেই সংকটের উত্স চিহ্নিত করা এবং যে জাতীয়তার পরিচয় ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই পরিচয় ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে।

আত্মপরিচয়ের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পর ৪২ বছর অতিক্রান্ত হলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পাশাপাশি গণমানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার সমতা (Equitable capability) অর্জিত না হওয়ায় এ দেশের সিভিল সমাজের যে অংশ মনে করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে শুধু বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার সমতা প্রতিষ্ঠিত করবে তা নয়, বরং ক্রমান্বয়ে এটি লিঙ্গীয় ও আন্তশ্রেণীর সক্ষমতার সমতা (gender and inter-class equitability) প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করবে, সিভিল সমাজের সে অংশের বর্তমান প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফল হলো আজকের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন।২ কিন্তু পাশাপাশি যে বিষয়টি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সেটি হলো জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সময় যেমন, বর্তমানেও তেমনি সিভিল ও রাজনৈতিক সমাজের যে অংশটি মনে করে রাষ্ট্রকাঠামোয় ধর্ম বা আরও স্পষ্ট করে বললে ইসলাম ধর্মের ন্যূনতম হলেও ভূমিকা পালন করা উচিত—তারা সযত্নে নিজেদের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, যেমনটি রেখেছিল জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সময়ও।

বর্তমান নিবন্ধের লক্ষ্য গণজাগরণ মঞ্চের সম্ভাবনা বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা নয়, অথবা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কী কী ব্যর্থতার কারণে সিভিল সমাজের অসাম্প্রদায়িক অংশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সক্রিয় হতে হয়েছে তরুণদের নেতৃত্বে, সেটি নিয়েও বিচার-বিশ্লেষণ করা নয়। এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য হলো, স্বাধীনতার পর ৪২ বছর অতিক্রান্ত হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সিভিল সমাজ কেন ঐক্যবদ্ধভাবে একটি প্ল্যাটফর্মে আসতে পারছে না তার উত্সমূল অনুসন্ধান করা। উত্সমূলের কারণ হিসেবে জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ (National identity) করার ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনৈতিক এলিটদের (National political elites) সমগ্র জাতির পক্ষ নিয়ে ভূমিকা (Speak for the nation) পালন করার ব্যর্থতাকে বর্তমান নিবন্ধে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ব্যর্থতার নির্ণায়ক কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ১৯৪৭ সালের দিকে, যে সময় থেকে আমাদের জাতিসত্তার নির্মাণ (Construction), পুনর্নির্মাণ (Reconstruction) ও বিনির্মাণের (Deconstruction) প্রক্রিয়াটি শুরু হয়, যার অনিবার্য পরিণতি হলো বাংলাদেশ নামের একটি ইউনিক জাতি-রাষ্ট্রের (Nation-state) উদ্ভব, যেখানে বিশ্বের অন্য জাতি-রাষ্ট্রগুলোর বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করে একটি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে দুটি সমান্তরাল জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছে যথাক্রমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ভাষাকে কেন্দ্র করে, অপর দিকে ভূমি (Territory) ও ইসলামি আলংকারিক ভাষাকে ধারণ করে। এ দ্বৈত সমান্তরাল জাতীয়তার প্রভাব মোটা দাগে দুটি সমান্তরাল সিভিল ও রাজনৈতিক সমাজের জন্ম দিয়েছে। এ দুটি সমাজের চিন্তা, চেতনা, মনন, মানসিকতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের মধ্যে যে ফারাক ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে, তার ফল হচ্ছে রাজনৈতিক ও সিভিল সমাজের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে পারার ব্যর্থতা। এরই ধারাবাহিকতার প্রতিফলন হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও সমন্বিত অবস্থান বা পদক্ষেপ নিতে পারার ব্যর্থতা। এ সম্পর্কে আলোচনার আগে চোখ ফেরানো যাক ১৯৪৭ সালের দিকে।

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও ‘দ্বিজাতি’তত্ত্ব

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, যাকে তালুকদার মনিরুজ্জামান ‘বাংলাদেশ বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন, সেই বিপ্লব বা স্বাধীনতাযুদ্ধকে ডান ও বাম উভয় শিবির থেকে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে (Historiograph) অসাম্প্রদায়িক (Secular) এলিট জাতীয়তাবাদী প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।৩ অর্থাত্, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল জাতীয়তাবাদী এলিট শ্রেণীর নেতৃত্বে, যাঁরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করতেন এবং এ রূপকল্পের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।৪ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী এলিটদের সঙ্গে উদীয়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক এলিটদের মূল দ্বন্দ্বের জায়গাটা ছিল রাষ্ট্রকাঠামোর চরিত্র নিয়ে, অর্থাত্ সেটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের হবে, নাকি ধর্ম সেই রাষ্ট্রকাঠামোয় এবং জাতীয় পরিচয় নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জাতীয়তাবাদী পাকিস্তানি এলিটরা অবিভক্ত ঔপনিবেশিক ভারতে বসবাসকারী সব মুসলিম জাতিগোষ্ঠীকে এক জাতি হিসেবে কল্পনা (Imagined as a nation) করেন; তাঁদের ভিন্ন ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জাতিসত্তা এবং ভিন্ন ইতিহাস হওয়া সত্ত্বেও।৫ তাঁদের এই কল্পিত জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশ ভারতে বসবাসরত সনাতন ধর্মের অনুসারী (হিন্দু) সব জাতিগোষ্ঠীকে একটি ভিন্ন, একক জাতি হিসেবে কল্পনা করে নেন, যাঁরা কিনা মুসলিম ‘জাতিসত্তা’ থেকে ভিন্ন (Other) এবং তাঁদের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে দ্বান্দ্বিক (Antagonistic) সম্পর্ক বিরাজ করার কারণে এ দুই ধর্মের অনুসারী জনগণের পক্ষে একই রাষ্ট্রে বসবাস করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন। এই বোধ থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করার কথা ভাবা হয়। যা হোক, মুসলিম জাতীয়তাবাদ ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে পরিণত হয় এবং মুসলিম রাজনৈতিক এলিটরা ক্রমান্বয়ে নিজেদের পরিচয় রূপান্তর করে পাকিস্তানি এলিট হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন।

তত্কালীন পূর্ববঙ্গের মুসলিম এলিট সমাজ পাকিস্তানি বা মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এলিটদের সঙ্গে মানসিক সংহতি বোধ করার কারণে ঔপনিবেশিক ভারতে বসবাসকারী সব মুসলিম জনগোষ্ঠীকে একক জাতি হিসেবে কল্পনা করে নেন এবং সনাতন ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী এবং আদিবাসীদের (Indigenous people) জাতি গঠন রূপকল্পের বাইরের, অপর জনগোষ্ঠী হিসেবে ভাবেন, যাঁদের পক্ষে তাঁদের ভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য তাঁদের কল্পিত জাতি পরিচয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে মুসলিম প্রাকৃত জনগণ নিজেদের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্র (Autonomous political domain) গড়ে তুলতে পারার ব্যর্থতার কারণে মুসলিম এলিট সমাজের জাতীয়তার রূপকল্পকে নিজেদের রূপকল্প হিসেবে ভেবে নেন এবং তাঁদের ধর্মভিত্তিক জাতীয় পরিচয়কেই নিজেদের জাতীয় পরিচয় হিসেবে ভেবে নেন, যদিও জাতি-সংক্রান্ত এই ভাবনার জন্ম হয়েছে এমন একটি কার্যক্ষেত্রে (Domain), যেটি তাঁদের নিজস্ব নয় বা যেখানে তাঁদের প্রবেশাধিকার বা বিচরণের অধিকার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।৬ অন্য কার্যক্ষেত্রে গড়ে ওঠা রূপকল্পকে নিজেদের কল্পনা বা রূপকল্প হিসেবে মনে করা Gayatri Spivak-এর প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর মানসকাঠামো সম্পর্কে যে ধারণা, সেটিকে প্রমাণিত করে। Spivak-এর ভাষায়, ‘(the) subaltern conscience (was) subject to the cathexis of the elites,’ আর এই নির্ভরশীলতার ফলেই বঙ্গীয় প্রাকৃতজনের পক্ষে, এলিট সমাজের কার্যক্ষেত্র থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে জাতি, জাতীয়তাবাদ ও আত্মপরিচয়ের রূপকল্প গড়ে তুলতে পারা সম্ভব হয়নি।৭

পাকিস্তান তৈরির অল্প কিছুদিন পরই দ্বিজাতিতত্ত্ব পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা হারায়। পাকিস্তানি জাতীয় এলিটরা পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সমাজে এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন, যেটি পরিণামে রণজিত্ গুহ যেমনটি বলেছেন, ‘dominance without hegemony’, সেটি প্রতিষ্ঠা করে।৮ যেসব সম্ভাব্য মূল কারণে তাঁরা হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন, তার অন্যতম কয়েকটি হলো গণতান্ত্রিক আদর্শ ও চর্চার অভাব, যার ফল হলো দীর্ঘমেয়াদি সামরিক শাসন, পূর্ব পাকিস্তানের এলিট ও প্রাকৃত জনগোষ্ঠী উভয়ের জনমানসে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় শ্রেণী কর্তৃক অর্থনৈতিক শোষণের ধারণা এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের ভিন্নতম সংস্কৃতির প্রথা। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান জাতীয় রাজনৈতিক এলিটরা, যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাল্পনিক সংহতি অনুভব করেছিলেন, পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর অল্প দিন পরে তাঁরাই অনুভব করতে লাগলেন যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের এলিটদের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন, যা তাঁদের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে প্রান্তীয় অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো বজায় রেখে তাঁদের পক্ষে উত্তরণ সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতার ধারণা তাঁদের পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষা করার জন্য দ্বিজাতিতত্ত্বকে মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা সামনে হাজির করে, যার অনিবার্য ফল হলো নতুন একটি রাজনৈতিক আদর্শ (Counter political ideology) নির্মাণ করা। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মোকাবিলা করার এই প্রয়োজনীয়তাই পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক এলিটদের একটি বড় অংশকে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে অনুপ্রাণিত করে, যা পরে আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিত হয়। এই নতুন বাস্তবতায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এলিটরা তাঁদের সাংস্কৃতিক কার্যক্ষেত্রে (Cultural domain) ও ভাবজগতে পূর্ব বাংলায় বসবাসরত সব জনগোষ্ঠীকে তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় পরিচয় সত্ত্বেও একটি জাতি হিসেবে পুনরায় কল্পনা (Reimagined as a nation) করেন। এই কল্পনার বহিঃপ্রকাশ হলো পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত সব জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয়তাবাদের ধারণার নতুন রূপকল্প উপস্থাপন করা, যেটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ভাষাভিত্তিক, নৃতাত্ত্বিক, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর মধ্যে (In subaltern domain) খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী এলিটরা খুব সহজেই অর্থনৈতিকভাবে শোষিত এবং রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত প্রাকৃত জনগোষ্ঠীকে এটা বোঝাতে সমর্থ হন, তাঁদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন দেশের জন্ম দিতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজন মুক্তিসংগ্রাম সংঘটিত করা।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার (Internal colony) বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিরোধ গড়ে তুললেও গ্রামসি যেমনটি বলেছেন সচেতন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে (multiple elements of concious leadership) পারার ব্যর্থতা, ফলে প্রাকৃত জনগোষ্ঠী স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্র গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে জাতীয়তাবাদী এলিটদের জাতিসংক্রান্ত ভাবনাকে নিজেদের বলে ধরে নেয়।৯ জাতি, জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ধারণার ব্যাপারে এলিট মনস্তত্ত্বের ওপর মানসিক নির্ভরতা থাকা সত্ত্বেও ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাভিত্তিক যে নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর ধারণা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক এলিটরা উপস্থাপন করেন, সেই রাষ্ট্র নির্মাণে এলিট ও প্রাকৃত জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন লক্ষ্য সামনে নিয়ে নির্মাণ করতে উদ্যত হয়। প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর লক্ষ্য বা স্বপ্ন যেখানে ছিল এমন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে তাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতার তুলনামূলক সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানে এলিট শ্রেণীর মূল লক্ষ্য ছিল তাদের নিজ শ্রেণীস্বার্থ নিশ্চিত করা। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এলিট ও প্রাকৃত জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণভাবে দুটি বিপরীত ও দ্বান্দ্বিক আকাঙ্ক্ষা সামনে নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে শামিল হয়েছিল, যদিও এ দুই গোষ্ঠীরই একটি সাধারণ লক্ষ্য ছিল ভাষাভিত্তিক, নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ বিপ্লব একটি ঐক্যবদ্ধ একক স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রকল্প ছিল না। এলিট ও প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ভিন্ন শ্রেণী-অবস্থানের কারণে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার সমতা অর্জনের ধারণার প্রশ্নে ভিন্ন স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল। পাশাপাশি Emile Durkheim যেমনটি বলেছেন, সামষ্টিক চেতনা (Collective consciouness), কোনো শ্রেণীবর্গে অবস্থিত মানুষ সামষ্টিক চেতনার পাশাপাশি নিজস্ব ব্যক্তিচেতনা (Subjective consciouness) দ্বারাও পরিচালিত হয়।১০ এই ব্যক্তিচেতনা দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষা মার্ক্সবাদী তত্ত্বের যে সারকথা, একটি শ্রেণীবর্গে অবস্থিত মানুষ তার নিজ শ্রেণীচেতনা ধারণ করে সামষ্টিক চিন্তা দ্বারা পরিচালিত হয়, এ ধারণাকে নাকচ করে দেয়। মার্ক্সীয় তত্ত্ব যে বিষয়টিকে উপেক্ষা করে, তা হলো একটি শ্রেণী-কাঠামোর মধ্যে অবস্থিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের দিকটি (Intra-class contradiction), আর এই দ্বন্দ্বের কারণেই একই শ্রেণী-কাঠামোতে অবস্থান করেও ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা করেন বা ভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করেন। তাই ভবিষ্যত্ বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় ধর্মের ভূমিকা কী হবে—সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ, কোন পথে রাষ্ট্রকে গড়ে তোলা হবে—এসব প্রশ্নে এলিট ও প্রাকৃতজনদের যাঁরা স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যেও মতদ্বৈধতা দেখা যায়। এলিট ও প্রাকৃতজনদের একটি বড় অংশ চেয়েছিল রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ বিয়োজিত করে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। এই অংশটি গত শতাব্দীর ষাটের দশকের সোভিয়েত বা চৈনিক মডেলের না হলেও অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক দর্শনের মূল নীতিমালার আলোকে এমনভাবে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিল, যা সমাজতান্ত্রিক নীতিমালাকে সমর্থন করবে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন, তাঁরা প্রাথমিকভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যেখানে পুঁজিবাদ হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। যদিও পরবর্তী সময়ে তাঁরা দলের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ বামপন্থীদের প্রভাবে সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে দলের অন্যতম মূলনীতি ও চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অপর দিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে যাঁরা বামপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ‘মস্কোপন্থী’ বা ‘পিকিংপন্থী’ উভয়েই সমাজতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাসানী ন্যাপের মতো সে সময়কার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল মনে করত, ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করেই বাঙালির নতুন জাতিসত্তা গঠন করা উচিত এবং এই জাতিসত্তার ওপর গড়ে ওঠা ভবিষ্যত্ রাষ্ট্রকাঠামোতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। অবশ্য এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহার ভাসানী ন্যাপ শুধু জিন্নাহর মুসলিম লীগের মতো ভাষার আলংকারিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। ধর্মভিত্তিক ইসলামপন্থী দলগুলোর মতো যাঁরা মনে করতেন শরিয়া আইন হওয়া উচিত পাকিস্তানি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র, এ ধরনের কোনো শরিয়া আইন বা ব্যবস্থা ভাসানী ন্যাপ চায়নি। অপর দিকে, ইসলামপন্থী সব রাজনৈতিক দল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কেননা, তারা মনে করত যে অসাম্প্রদায়িক মতবাদের ওপর গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা ধর্মীয় বা ইসলামি জাতীয়তাবাদের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, আর এ কারণে এ ধরনের আদর্শ ইসলামবিরোধী।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সমাজে ধর্মভিত্তিক পরিচয় (Religion-based identity) ও রাজনীতি অনেকটা প্রান্তীয় অবস্থানে চলে এলেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক এলিটরা মনে করতেন, যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা লালন ও চর্চা করেন, সেটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও চর্চার সঙ্গে যুক্ত। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক এলিটরা এবং তাঁদের অনুসারী প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর একটি অংশ বাংলাদেশ রূপকল্পকে মনে করত ভারতীয় ষড়যন্ত্র, যার মূল লক্ষ্য হলো ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক সুবিধার জন্য পাকিস্তানকে বিভক্ত করা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, হিন্দু ও কমিউনিস্টরা এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাস্তবায়নে সবচেয়ে অগ্রগামী সৈনিক। এ ধরনের ভাষ্যতে বিশ্বাস স্থাপন করার ফল হলো, ১৯৭১ সালে সব ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও তাদের অনুসারীদের পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং পাকিস্তানি জাতীয় পরিচয়কে মুসলিম আত্মপরিচয়ের সমার্থক করে ফেলা। সার্বিকভাবে ইসলামপন্থীদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পাকিস্তান সার্বক্ষণিক হুমকির মধ্যে আছে এবং সেক্যুলার ভারত হলো এই হুমকির মূল কারণ। তারা আরও মনে করে, অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ওপর নতুন রাষ্ট্র গড়ে উঠলে নতুন মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে ইসলামি আত্মপরিচয় বজায় রাখা কঠিন হবে। ফলে ধর্মভিত্তিক দলগুলো যেটা মনে করত, তা হলো ইসলামি আত্মপরিচয় বজায় রাখতে হলে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখতে হবে। এ ধারণার ফলে তাদের মধ্যে মাওলানা মওদুদীর ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষা সমার্থক—এ ধারণা ব্যাপ্তি লাভ করে।১১

ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মধ্যে উপরিউক্ত ধারণা ব্যাপ্তি লাভ করার ফলে আমরা দেখি, ১৯৭১ সালে সব ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলই অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায় এবং সামরিক জান্তার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনকে ইসলাম ও পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার নামে সমর্থন জানায়। তবে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম দমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তাদের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক, নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্ম হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শগত ভিত্তিকে সম্পূর্ণ চূর্ণ করে দেয়। এটা তাদের কল্পনার অতীত ছিল যে ভাষাভিত্তিক, নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোয় যেখানে তাদের তাত্ত্বিক ধারণা ও রাজনীতি সব সময়ই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করত, নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যুদয় সাময়িকভাবে হলেও তাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক ধারণাকে প্রান্তে নিক্ষেপ করে, যা নতুন বাস্তবতায় কী করে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি অগ্রসর করে নেওয়া যাবে, এই প্রশ্নে তাদের বিচলিত করে তোলে।

বাংলাদেশ: এক রাষ্ট্র, দুই জাতীয়তাবাদ

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় অসাম্প্রদায়িক এলিটদের সামনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে জাতিকে পুনর্গঠনের ক্ষেত্র তৈরি করে। গ্রামসি ও অন্য চিন্তাবিদেরা যেমনটি দেখিয়েছেন যে যেকোনো আধিপত্যবাদী চেতনাকে চ্যালেঞ্জ করে সব সময় একটি বিপরীত চেতনার জন্ম হয়, তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা তাঁদের চেতনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শুরুতেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। এ ক্ষেত্রে প্রথম চ্যালেঞ্জটি আসে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের কাছ থেকে, যারা বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর আত্ম-অপরিচয়কে স্বাধীন দেশের শুরু থেকেই নিজেদের আত্ম-অপরিচয় বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে। পাশাপাশি বিভিন্ন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের পরাজিত কর্মী ও হতাশ সমর্থকেরা জাতি পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় পরিচয় যাতে অন্তর্ভুক্ত হয়, সে ব্যাপারে তাঁদের প্রান্তীয় অবস্থান থেকেই সোচ্চার হন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা দ্বিজাতিতত্ত্বকে নতুন করে বিনির্মাণ করেন জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় পরিচয়কে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।১২

নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রাথমিকভাবে চরম কোণঠাসা অবস্থানে থাকার কারণে ইসলামপন্থীদের পক্ষে বিনির্মিত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সামনে এগিয়ে নেওয়া দুরূহ ছিল। এ পরিস্থিতিতে ন্যাপ (ভাসানী) সামনে এগিয়ে আসে তাদের অতল সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য। ন্যাপ (ভাসানী) নতুন জাতি-রাষ্ট্রের নাম মুসলিম বাংলা রাখার দাবি জানায়। আদর্শগত পার্থক্য-নির্বিশেষে সব ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল এই দাবিকে সমর্থন জানায়। স্বাধীন বাংলাদেশে এটি ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতি প্রথম গুরুতর চ্যালেঞ্জ (Counter hegemonic challenge) এবং ভবিষ্যত্ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভ্রূণ, যা বাংলাদেশি বিপ্লবের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ট্র্যাজিক হত্যাকাণ্ডের অল্প কিছুদিন পর পূর্ণতা লাভ করে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা এলিট ও প্রাকৃত উভয় কার্যক্ষেত্রে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে, বিশেষত তাঁদের মধ্যে, যাঁরা মনে করতেন নতুন জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় পরিচয়কে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়।

বাঙালি শাসক জাতীয়তাবাদী এলিটরা ব্যাপক দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি কারণে সিভিল সমাজের ওপর তাঁদের আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। পাশাপাশি বিভিন্ন ‘চীনপন্থী’ রাজনৈতিক দল ও জাসদ শাসনব্যবস্থার প্রতি একধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ ছাড়া অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরুদ্ধে আদর্শগত চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবিলা করতে হয় বিভিন্ন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল, ভাসানী ন্যাপ ও বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে; যদিও বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতি ও জাতীয়তাবাদী ধারণাটি ইসলামপন্থীদের থেকে ভিন্ন ছিল এবং তাঁদের এ-সংক্রান্ত ধারণায় ধর্ম বা ধর্মীয় আত্মপরিচয় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী এলিটরা পাকিস্তানি মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মতো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একই ধরনের নিপীড়নমূলক পন্থা অবলম্বন করেন, যে নিপীড়নমূলক পন্থার বিরুদ্ধে তাঁরা অখণ্ড পাকিস্তানের পুরো সময়টা আন্দোলন করেছেন। গণতান্ত্রিক পন্থায় নতুন জাতি-রাষ্ট্রের সিভিল সমাজের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে তাঁদের শাসনক্ষমতা বজায় রাখার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী এলিটরা একদলীয় একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন, যা পরিণতিতে সেই একই আধিপত্যবিহীন কর্তৃত্ব অবস্থার জন্ম দেয়, যে অবস্থার সম্মুখীন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী এলিটরা হয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে সংসদে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রস্তাব পাস করে এবং দলের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) রাখে। এই প্রস্তাবের ফলে বাকশাল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং ‘মস্কোপন্থী’ হিসেবে পরিচিত সিপিবি ও ন্যাপ (মুজাফ্ফর) তাদের দল বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগ দেয়। প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও নিপীড়নমূলক পন্থার ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচেষ্টার কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদী এলিটরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, যা তাঁদের জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সের বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে এবং অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী এলিটদের সম্পর্ক আরও দ্বান্দ্বিক অবস্থানের দিকে নিয়ে যায়। প্রাকৃত জনগোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্রকে এলিট রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের অনুকরণে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ—এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে।

প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর না করে অসাম্প্রদায়িক এলিটরা সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন তাঁদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য। কিন্তু যে বিষয়টি তাঁরা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন, তা হলো এই আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো ও ভাবধারার মধ্যে, যাঁরা নিজেরা পাশ্চাত্য জীবনধারায় অভ্যস্ত এবং পশ্চিমা গণতন্ত্রের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করলেও একই সঙ্গে পাকিস্তানের জন্য এ ধরনের গণতন্ত্র উপযুক্ত নয় বলে মনে করতেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর মতো তাঁদের বেশির ভাগই মনে করতেন, জাতীয় আত্মপরিচয় নির্মাণ ইসলামকে ভিত্তি করে হওয়া উচিত। যদিও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অনেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শুধু ভাষাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান ভেঙে একটি নতুন জাতি-রাষ্ট্র গঠনের বিরোধী ছিল। এই অংশটি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে বাংলাদেশি মুক্তিসংগ্রামকে দমনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুজিব সরকার তাঁদের অতীত বিবেচনা না করে সবাইকে প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে আমরা যেটা প্রত্যক্ষ করি, তা হলো এলিট ও প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর মতো সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের জাতীয়তাবাদ এবং নতুন জাতির আত্মপরিচয় প্রশ্নে বিভাজিত হয়ে পড়া। আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ও শৃঙ্খলার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও নতুন জাতি পুনর্গঠনের প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিভাজন জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সেনা আমলাতন্ত্রের মধ্যে এই আদর্শগত দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী রূপ লাভ করে, যখন একদল জুনিয়র ইসলামপন্থী অফিসার বলপূর্বক অসাম্প্রদায়িক এলিটদের ক্ষমতাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেন, যার করুণ পরিণতি হলো শেখ মুজিব, তাঁর পরিবারের সব সদস্যসহ অন্য অনেককে নৃশংসভাবে হত্যা করা। এই ক্যু ও পাল্টা ক্যুর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ইসলামপন্থী সামরিক অফিসারদের মুখপাত্র হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা, জাতীয় আত্মপরিচয় ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইসলামপন্থীদের বিনির্মিত দ্বিজাতিতত্ত্বকে রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রয়োগ করেন নিজের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে। পাশাপাশি তিনি নিজেকে সেই অংশটির মুখপাত্র হিসেবে উপস্থাপন করেন, যারা মনে করত নতুন জাতীয় আত্মপরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকা উচিত। জেনারেল জিয়ার জাতীয় আত্মপরিচয় পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলী রীয়াজ লিখছেন: ‘it involved both the manipulation/modification of constitutional procedure and the construction of a new ideology that would undermine the ideology of the former regime and justify its takeover.’১৩

অসাম্প্রদায়িক, ভাষাভিত্তিক নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদকে মোকাবিলা করার জন্য জিয়া দ্বিজাতিতত্ত্বের বিনির্মিত রূপ হিসেবে ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদী তত্ত্বকে সামনে নিয়ে আসেন, যেখানে ইসলামি মূল্যবোধ জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যাকে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হিসেবে অভিহিত করেন। তত্কালীন সরকারের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে এই জাতীয়তাবাদে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, আদিবাসী এবং বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তাকে এই প্রকল্পের বাইরের সত্তা হিসেবে মনে করা হয়। ফলে বিনির্মিত দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে উত্সারিত জাতি পুনর্নির্মাণ এবং রাষ্ট্র ও সিভিল সমাজের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করা সম্ভব নয় বলে মনে করা হয়। জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা অফিশিয়ালি এলিট ও প্রাকৃতজনদের কার্যক্ষেত্রকে অসাম্প্রদায়িক ও ইসলামপন্থী এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে এবং তখন থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালি ও ইসলামপন্থীরা নিজেদের বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে। মূলত আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন ঘরানার বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণভাবে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেয়। অপর দিকে বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি, যে দলটি জিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এবং একই সঙ্গে ইসলামি আত্মপরিচয়কে অন্তর্ভুক্ত করে জাতি পুনর্গঠনের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য, নিজেদের সাধারণভাবে বাংলাদেশি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

জিয়াউর রহমান তাঁর জাতি পুনর্গঠনের প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নিজের ক্ষমতা দখলের বৈধতা অনুসন্ধানের পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পূরক উন্নয়নের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া নিজের ক্ষমতা সংহত করার জন্য সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে যেসব সেনা অফিসার বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন, তাঁদের বড় একটি অংশকে হত্যা করেন। জিয়ার শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও জাসদের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী নিপীড়নের শিকার হন। এর পাশাপাশি জিয়া কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিবি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, নেতাদের গ্রেপ্তার করেন এবং তাঁর জাতীয়তাবাদী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য রফিউদ্দিন আহমেদের ভাষায়, ‘overtly pro-Islamic stance’ গ্রহণ করেন, যার ফল হলো মুজিবের আমলে নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীকে পুনরায় রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান এবং দলটির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন।১৪ বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম তাঁর সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে জিয়ার গণতান্ত্রিক ছদ্মাবরণের সময়কালের ইসলামি ভাবধারাকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতি পুনর্গঠনের এই প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন সেক্যুলার মূল্যবোধ থেকে ইসলাম পন্থার দিকে অগ্রযাত্রা হিসেবে।১৫

যা-ই হোক, বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় রাজনৈতিক দলই তাদের জাতীয়তাবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করেছে অপর রাজনৈতিক দলকে এবং বাংলাদেশে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর কিছু অংশকে দুটি জাতীয়তাবাদী প্রকল্পই এর বাইরে রেখেছে। এ দুটি রাজনৈতিক দলের একটি যখন ক্ষমতায় থেকেছে, তখন অপর রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যা দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের মাত্রাকে আরও সম্প্রসারিত করেছে। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দুই দল যৌথভাবে গণ-আন্দোলন গড়ে তুললেও তা পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে পারেনি। এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানের পর দুই বছর বাদ দিয়ে বাকি সময় এ দুটি দলই বাংলাদেশ শাসন করে এলেও, তাদের জাতীয়তাবাদী সর্বাত্মক প্রকল্প (Totalizing claim of nationalism) বাস্তবায়নের প্রচেষ্টার ফলে অপর পক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষই মূলত তাদের দলীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যুক্তিবাদের ওপর সংঘাতকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাদের এই সাংঘর্ষিক সম্পর্ক শুধু গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি, পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতীয়তাবাদ বিতর্কটি শুরু হয়েছিল এলিট কার্যক্ষেত্রে এবং জাতীয়তাবাদী এলিটদের পুরো জাতির পক্ষে কথা বলতে পারার ব্যর্থতা বাংলাদেশে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীকে তাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে বিভক্ত করে ফেলে। রাজনৈতিক এলিটদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ন্যূনতম আদর্শিক মতৈক্যে পৌঁছাতে পারার ব্যর্থতা এই বিভাজনকে আরও গভীর করেছে। আর এই বিভাজনের প্রতিফলন আমরা দেখি সিভিল সমাজের কিছু তরুণ যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার, জামায়াত নিষিদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় ফিরে যাওয়ার দাবি জানান গণজাগরণ মঞ্চ থেকে, তখন দেশে-বিদেশে বিপুল সাড়া সত্ত্বেও জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, যারা নিজেদের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তারা এই আন্দোলন থেকে দূরে থেকেছে। তাহলে যে প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে, তা হলো জনগোষ্ঠীর, বিশেষত প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে আন্দোলনের বাইরে রেখে আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কতটুকু অর্জন করা সম্ভব হবে বা অর্জিত হলেও সেটি স্থায়ী হবে কি না। এ কথা মনে করার কারণ নেই যে, প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর যে অংশটি জাতীয় আত্মপরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্মের অন্তর্ভুক্তি চায়, তারা সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্র বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এলিটদের কার্যক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করার ফলে তাদের পক্ষে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের প্রশ্নে স্বাধীন অবস্থান নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু যেটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, একটি শ্রেণীবর্গে অবস্থান করেও একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে স্বাধীন ও স্বকীয় অবস্থান নেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চের সামনে যে কর্তব্যটি হাজির করে, তা হলো আরও ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে এর লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য আন্দোলনের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি সংলাপের আয়োজন করা।

তৃণমূল সংলাপ: ন্যূনতম জাতীয় মতৈক্যের সন্ধানে

তৃণমূল সংলাপ এই লক্ষ্য নিয়ে হওয়া উচিত, কী করে এলিট কার্যক্ষেত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে প্রাকৃত জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে ন্যূনতম জাতীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তৃণমূল সংলাপের কথা এ প্রবন্ধে বলা হচ্ছে; কেননা, জাতীয় মৌলিক বিষয়গুলোতে মতৈক্যে পৌঁছানোর মতো কোনো অবস্থানে পৌঁছাতে জাতীয় এলিটরা ব্যর্থ হয়েছেন। ৪২ বছরেও ন্যূনতম মৌলিক বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারার ব্যর্থতা এটি নির্দেশ করে যে, তাদের বিভাজিত শ্রেণীস্বার্থ এলিট নেতাদের মৌলিক বিষয়ে মতৈক্যে আসতে দিচ্ছে না বা তাদের সংকীর্ণ শ্রেণীস্বার্থের কারণে পুরো জাতির পক্ষে তারা কথা বলতে অক্ষম। তাদের এই অক্ষমতা বিভিন্ন প্রান্তীয় (ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, জেন্ডার ও জাতিগতভাবে প্রান্তীয়) প্রাকৃত জনগোষ্ঠীকে এলিট কার্যক্ষেত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের জাগরণ এ ধরনের একটি উদাহরণ—কীভাবে এলিট কার্যক্ষেত্র থেকে মুক্ত হয়ে প্রাকৃত জনগোষ্ঠী নিজস্ব নেতৃত্বে আন্দোলন করতে পারে, নিজেদের কণ্ঠস্বর (Voice) শোনাতে পারে, এলিট নেতাদের তাঁদের বক্তব্যকে বিবেচনায় নেওয়ার অবস্থা তৈরি করতে পারে (সমর্থন বা বিরোধিতা যে অর্থেই হোক)। সুতরাং, বিষয়টিকে মাথায় রেখে গণজাগরণ মঞ্চ, স্থানীয় সিভিল সমাজ ও নারী গ্রুপসমূহের মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শ বাস্তবায়ন এবং সব যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ গণদাবিতে ন্যূনতম মৌলিক মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য তৃণমূল পর্যায়ে, যথা গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন প্রান্তীয়, প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সংলাপ পরিচালনা করা উচিত।১৬ এ ধরনের সংলাপ বিপরীতমুখী দ্বান্দ্বিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীকে মৌলিক জাতীয় আদর্শসমূহ পুনর্মূল্যায়নের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দেবে। এই সংলাপের দূরবর্তী লক্ষ্য হওয়া উচিত ন্যূনতম মৌলিক জাতীয় ইস্যুতে এলিট কার্যক্ষেত্রের বাইরে প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কার্যক্ষেত্রে মতৈক্য গড়ে তোলা।

এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি সংলাপ চালানোর সময় এটা মনে রাখা দরকার যে কোনো মতবাদ, চর্চা, উদাহরণ ও ব্যবস্থা স্থায়ী নয়; সবকিছু নিয়েই আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক চলতে পারে; এসব বিষয়ই চলমান বা গতিশীল এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সবকিছুই পরিবর্তিত হয়। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, খোলা মন নিয়ে সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করা, যেখানে মোহাম্মদ কাসিম জামানের ভাষায়, ‘creative engagement with a rival’ সম্ভব হবে।১৭ প্রান্তীয় প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এ ধরনের সংলাপে তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদেরও যুক্ত করা যেতে পারে, যেখানে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক করতে পারবেন। এ ধরনের চর্চা যেমন তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের ধারণাকে ব্যাপ্তি দেবে, তেমনি রাজনৈতিক কর্মীদের পাশাপাশি প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী (Politically empowered) করে তুলবে। তৃণমূল সংলাপ এলিট কার্যক্ষেত্রের বাইরে তাদের নিজস্ব কার্যক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এ দুটি দলের অভ্যন্তরেই গণতন্ত্রচর্চার অনুপস্থিতির কারণে দল দুটির অভ্যন্তরে কর্মীদের অবস্থান একেবারে প্রান্তে, যার কারণে কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। ফলে দলের অভ্যন্তরে এলিট নেতাদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক হলো ‘মিয়া-মক্কেল’ সম্পর্ক (Patron-client relation); যেখানে দলীয় কর্মীদের ভূমিকা হলো মক্কেলের, যা David Crocker-এর ভাষায় তাঁদের রাজনৈতিকভাবে দরিদ্র (Politically poor) করে রেখেছে।১৮ কর্মীদের এই ভূমিকা এ দুটি দলের অভ্যন্তরে তাঁদের দলীয় নেতৃত্বের আজ্ঞাবাহী সেবকে পরিণত করেছে, যাঁরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পরিবর্তে দলীয় নেতৃত্বের হুকুম তামিলের মধ্যে তাঁদের ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন। তৃণমূল পর্যায়ে প্রান্তীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণে এ ধরনের সংলাপ প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে (Political capabilities of individuals) সাহায্য করবে এবং এলিট কার্যক্ষেত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে স্বাধীন রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্র প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্ম নেবে। প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্র তৈরি হলেই জাতীয়তাবাদ বিতর্কের অবসান হবে সেটি নয়; কিন্তু এ ধরনের কার্যক্ষেত্র যেটি করবে, তা হলো প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে এলিট কার্যক্ষেত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করবে। প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন (Political empowerment) যুদ্ধাপরাধ ও জামায়াতের ইস্যুতে হয়তো তৃণমূল পর্যায়ে ন্যূনতম মতৈক্যের সম্ভাবনা তৈরি করবে। তৃণমূল পর্যায়ে কিছু মৌলিক ইস্যুতে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলে জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতীয় পরিচয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও সংলাপ শুরু করার ক্ষেত্র তৈরি হবে। প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং তৃণমূলে ন্যূনতম ঐক্য এলিট কার্যক্ষেত্রকে প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর কার্যক্ষেত্রের ওপর নির্ভরশীল না করলেও তাকে অন্তত প্রভাবিত করার আবহ তৈরি করবে।

উপসংহার

এলিট ও প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ অন্যান্য মৌলিক ইস্যুতে মতদ্বৈধতার মূল কারণ হলো এলিট কার্যক্ষেত্রে জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতীয় আত্মপরিচয় প্রশ্নে ভিন্ন চেতনার লালন, যা কিনা প্রাকৃত জনগোষ্ঠীকে একইভাবে প্রভাবিত করেছে, তাদের নিজস্ব স্বাধীন রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্র গড়ে তুলতে পারার ব্যর্থতার কারণে। ফলে একই জাতি-রাষ্ট্রের ভেতরে দুটি সমান্তরাল ‘জাতিসত্তার’ উদ্ভব হয়েছে, যা কিনা জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্মের ভূমিকা কী হবে, এই মৌলিক প্রশ্নে পুরো দেশবাসীকে দুটি শিবিরে বিভক্ত করে ফেলছে। এ অবস্থায় যে কর্তব্য গণজাগরণ মঞ্চসহ এলিট কার্যক্ষেত্রের বাইরে সিভিল সমাজে যেসব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারীবাদী গ্রুপ রয়েছে, তাদের সামনে হাজির করেছে, তা হলো এলিট কার্যক্ষেত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে তৃণমূল পর্যায়ে প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আন্দোলনের পাশাপাশি মৌলিক ইস্যুগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সংলাপ পরিচালনা করা। এলিট কার্যক্ষেত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন ও সংলাপ একসঙ্গে চালাতে পারলে হয়তো প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্রে বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয় মৌলিক ইস্যুতে ন্যূনতম ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি করবে। আর এ ধরনের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারলেই গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সফল হবে এবং জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতীয় আত্মপরিচয় নিয়ে যে বিতর্ক, তাকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যাবে।

তথ্যসূত্র

১. এখানে সম্প্রদায় বলতে ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়কে বোঝানো হয়েছে, যদিও শুধু ধর্মকে কেন্দ্র করে একটি সম্প্রদায় গড়ে উঠতে পারে কি না, সে বিতর্ক থেকে যাচ্ছে। সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ—এ দুটি শব্দকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেননা, যাঁরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করেন না, তাঁরা সব সময় উল্লিখিত শব্দ দুটিকে ধর্মহীনতার সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থেকেছেন। যদিও পার্শ্ববর্তী ভারতসহ যেসব দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘিষ্ঠ, সেসব দেশ সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন না করলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সেসব দেশে কীভাবে রক্ষিত হবে, সে প্রশ্নে তাঁরা নীরব থেকেছেন।

২. সক্ষমতার ধারণাটি অমর্ত্য সেন যে অর্থে ব্যবহার করেছেন, সেই আলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত ধারণার জন্য দেখুন, Amartya Sen, ‘Human Rights and Capabilities,’ Journal of Human Development, 6 (2005): pp.151-166; আরও দেখুন, Amartya Sen, Commodities and Capabilities, (India: Oxford University Press, 1999)। সেন সক্ষমতার ধারণাকে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলার বিরোধী। কারণ, তাঁর মতে, এতে মানুষের সক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অপর দিকে Martha Nussbaum মনে করেন, সামাজিক ন্যায়বিচার (Social justice) ও নৈতিক বিচার (Ethical judgement) নিশ্চিত করার জন্য সক্ষমতার ধারণার বিষয়ে অত্যন্ত সুস্পষ্ট (Concrete) অবস্থান নেওয়া উচিত। কেননা, তিনি মনে করেন, শুধু সক্ষমতার বিমূর্ত (Abstract) ধারণার ওপর নির্ভর করলে এর প্রায়োগিক বিষয়টি উপেক্ষিত থাকবে, ফলে এটি ব্যক্তিস্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে না। সক্ষমতার প্রায়োগিক বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য তিনি ১০ ধরনের সক্ষমতার উল্লেখ করেছেন, যাকে তিনি ‘Central Human Functional Capabilities’ বলেছেন। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, M, Nussbaum, Women and Human Development: The Capabilities Approach, (United Kingdom: Cambridge University Press, 2000), pp. 78-80.

সিভিল সমাজের ব্যাপ্তি কতটুকু হবে বা কোন সংগঠনসমূহ সিভিল সমাজের অন্তর্ভুক্ত হবে, তা নিয়ে যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন, তাঁদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে সরকারি সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন সংগঠন এবং স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিদের সিভিল সমাজ হিসেবে চিহিত করা হয়েছে। তবে এটি উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে Antonio Gramsci যেমনটি বলেছেন, রাজনৈতিক সমাজের সঙ্গে সিভিল সমাজের পার্থক্যের জায়গাটি ধারণাগত এবং দুটি বাস্তব ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে প্রায়ই ‘Overlap’ করে। সিভিল সমাজসংক্রান্ত ধারণার জন্য দেখুন, Anthony Gramsci, in Quintin Hoare and Geoffrey Nowell Smith (Eds.), Selections from the Prison Notebooks of Antonio Gramsci, (New York: International Publishers, 2011), p. 160. সিভিল শব্দটির বাংলা ‘সুশীল’ ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেননা, বাংলাদেশের সিভিল সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা সুশীল শব্দটির প্রতি একধরনের নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।

৩. T, Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution and Its Aftermath. (Dhaka: University Press, 1980).

৪. এলিট বলতে ক্ষমতাবান (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক) গ্রুপ, শ্রেণী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুঁজিপতি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী, চিকিত্সক, আমলা, টেকনোক্র্যাট—এঁদের সাধারণভাবে এলিট বলা হয়।

৫. Benedict Anderson জাতিকে কাল্পনিক সম্প্রদায় (Imagined Community) হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দেখুন, B Anderson, Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism. (London: Verso, 1991).

৬. এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাকৃত জনগোষ্ঠী বলতে বিভিন্ন প্রান্তীয় গ্রুপ ও শ্রেণীবর্গ, শ্রমজীবী, দিনমজুর, মাঝারি ও ছোট কৃষক, গ্রামীণ সর্বহারা, নারী, আদিবাসী ও বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা এবং ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহকে সাধারণভাবে বোঝানো হয়েছে। উল্লেখ্য, ধারণাগতভাবে প্রাকৃতজন প্রত্যয়টি আপেক্ষিক এবং সম্পর্কযুক্ত, অর্থাত্ কোনো বিশেষ স্থান, অঞ্চল বা প্রেক্ষাপটের যাঁরা প্রাকৃতজন, তাঁরা ভিন্ন স্থান, অঞ্চল বা প্রেক্ষাপটে এলিট হিসেবে বা এলিটদের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে পারেন। ধারণাগতভাবে এলিট প্রত্যয়টিও আপেক্ষিক এবং সম্পর্কযুক্ত; অর্থাত্ কোনো এক স্থান, অঞ্চল বা প্রেক্ষাপটে যাঁরা এলিট, তাঁরা ভিন্ন অঞ্চল স্থান বা প্রেক্ষাপটে প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ভূমিকা পালন করতে পারেন।

৭. G. C. Spivak, ‘Subaltern Studies: Deconstructing Historiography,’ in R. Guha & G. C. Spivak (Eds.), Selected Subaltern Studies. (New York: Oxford University Press, 1988), p. 11.

৮. R. Guha, Dominance without Hegemony: History and Power in Colonial India. (Cambridge: Harvard University Press, 1998).

৯. A. Gramsci, ‘The Modern Prince,’ in Quintin Hoare and Geoffrey Nowell Smith (Eds.), Selections from the Prison Notebooks of Antonio Gramsci, (New York: International Publishers, 2011), p. 196. অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতা-সংক্রান্ত ধারণা সম্পর্কে জানতে দেখুন, P. Gonzalez-Casanova, ‘Internal Colonialism and National Development,’ Studies in Comparative International Development, 1 (1965): pp. 27-37.

১০. Durkheim সামষ্টিক চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ‘The totality of beliefs and sentiments common to average members of the same society... it is an entirely different thing from particular consciences, although it can only be realized through them.’ E. Durkheim, The Division of Labor in Society. (New York: Free Press, 1997), pp. 38-39.

১১. H. Haqqani, Pakistan: Between Mosque and Military. (Washington, D.C.: Carnegie Endowment for International Peace, 2005), p. 24.

১২. Rupert Emerson-এর জাতি গঠনের ধারণাকে এই প্রবন্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, R. Emerson, From Empire to Nation: The Rise of Self-Assertion of Asian and African People. (Cambridge: Harvard University Press, 1960).

১৩. A. Riaz, God Willing: The Politics of Islamism in Bangladesh, (Lanham: Rowman and Littlefield, 2004), p. 25.

১৪. R. Ahmed, ‘Redefining Muslim Identity in South Asia: The Transformation of the Jama’at-I Islami,’ in M. E. Marty & R. S. Appleby (Eds.), Accounting for Fundamentalisms: The Dynamic Character of Movements, pp. 669-705. (Chicago: University of Chicago Press, 1994), p. 692.

১৫. W. B. Milam, Bangladesh and Pakistan: Flirting with Failure in South Asia, (New York: Columbia University Press, 2009), p. 11.

১৬. মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শের কথা বলা হচ্ছে এ কারণে যে, কিছু আদর্শ যেমন সমাজতান্ত্রিক ধারণার বাস্তবায়ন আজকের বাস্তবতায় অনেকটা ইউরোপীয় চিন্তার মতো এবং এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবায়নযোগ্য নয়।

১৭. M.Q. Zaman, The Ulama in Contemporary Islam: Custodians of Change, (New Jersey: Princeton University Press, 2002), p. 5.

১৮. D. Crocker, ‘The Capability Approach and Deliberative Democracy,’ Maitreyee 4, February, (2006), p. 6.