রাজনৈতিক দলীয় অর্থায়ন: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত

সারসংক্ষেপ

বর্তমানে রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব ব্যাপক হওয়ায় রাজনৈতিক দলীয় অর্থায়ন বিশ্বের সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে দলীয় সুশাসন, জবাবদিহি এবং গণতন্ত্র বিনির্মাণের ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোতে দৃশ্যমান। বাংলাদেশে গণতন্ত্র চালু থাকলেও সুষ্ঠু দলীয় কোনো অর্থায়ন ব্যবস্থা অনুসরণ করা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানের প্রকৃত অনুসরণ নেই এবং যথাযথ তদারকের অভাব রয়েছে। এ প্রবন্ধে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অর্থায়ন, দলীয় অর্থায়নের পর্যালোচনা ও প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ যুক্ত করা হয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: রাজনৈতিক অর্থায়ন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, গণপ্রতিনিধিত্বশীল আদেশ/ আরপিও, তহবিল সংগ্রহ, মনোনয়ন-বাণিজ্য, কাঠামোগত সংস্কার।

 ভূমিকা

বিশ্বজুড়ে দলীয় রাজনীতি এবং নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক অর্থায়ন এক বহুল আলোচিত বিষয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ-নির্বিশেষে সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অর্থায়নের দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়। গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বার্থে রাজনৈতিক অর্থায়নের প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, অবাধ এবং যথার্থ তদারকির আওতায় আনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বস্তুত, রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। তাই এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে এবং রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়।

প্রতিষ্ঠিত উদারনৈতিক পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দলীয় ব্যবস্থায় মনোনয়ন-প্রক্রিয়া, প্রচারণা ও আর্থিক কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ লক্ষণীয়। যেমন নিবন্ধীকরণ, যথাযথ নির্বাচনী বিধিমালা ও পাবলিক অর্থায়ন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক থেকে ওই দেশগুলোর রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারণাসহ দৈনন্দিন ব্যয়ে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চালু হওয়ার পর ইতিবাচক ফলাফলের দৃষ্টান্ত প্রণিধানযোগ্য। যার মধ্যে রয়েছে দলীয় সাংগঠনিক সবলতা প্রতিষ্ঠা, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ কমানো, দলীয় মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রায়ণ ঘটানো ইত্যাদি। বৈধ সূত্রে অর্থায়নের শর্তাবলির মধ্যে থাকে বিশেষত সম্পদের হিসাব দাখিল এবং আয়-ব্যয় নিরীক্ষণ, দলীয় মনোনয়ন-প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক করা ইত্যাদি।

সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিল ও অর্থ সংগ্রহে কোনো নিয়ন্ত্রণ লক্ষ করা যায়নি বা ছিল না। এসব দলের আর্থিক বিষয়াদি সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারে থেকে যায়। কারণ, দলীয় আয়ের উত্স, আয়-ব্যয় ও হিসাব বিবরণী সম্পর্কে আলোচনা বা উন্মুক্ত নিরীক্ষা করা হয়নি। স্বচ্ছ দলীয় অর্থায়নের অভাবে যেকোনো উত্স থেকে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে যায়। এভাবে অযৌক্তিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতে থাকে এবং অর্থ ও পেশিশক্তির রাজনীতিতে নির্বাচনী ব্যয়ের নির্ধারিত সীমা প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়। ১৯৯১-পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচনগুলোতে মনোনয়ন-প্রক্রিয়া ‘মনোনয়ন-বাণিজ্যে’ পরিণত হয় এবং দলীয় তহবিলে অর্থের জোগান দিয়ে প্রার্থিতা লাভের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। এভাবে দলীয় রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হতে থাকে।

ওই সময়ে নির্বাচনী ব্যবস্থায় আস্থার অভাব ও আন্দোলনের ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কয়েকটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তা প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সংঘাত নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেনি। রাজনীতি ও নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় পারস্পরিক সহিংসতা, অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার অব্যাহত থেকে যায়। মতাদর্শের সংঘাত তাই অস্ত্রের সংঘাতে রূপ নেয় এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডল হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

২০০৭ সালের এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি গৃহীত হয়। এভাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ তথা আরপিওতে সংশোধনী এনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাংগঠনিক ও আর্থিকভাবে দায়িত্বশীল রাখার বিধি চালু হয়। রাজনৈতিক দলের জন্য বাধ্যতামূলক নিবন্ধীকরণ ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিধান দলীয় রাজনীতি ও নির্বাচনে নতুন মাত্রা যোগ করে এবং সচেতন মহলে প্রশংসিত হয়।

বর্তমান প্রবন্ধে বাংলাদেশে দলীয় অর্থায়নের প্রসঙ্গে রাজনৈতিক অর্থায়নের গুরুত্ব, প্রচলিত বিধিবিধান, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চা, তথ্য প্রদান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

রাজনৈতিক অর্থায়নের গুরুত্ব

রাজনৈতিক অর্থায়ন নির্বাচনী ও অনির্বাচনী খাতে রাজনৈতিক দলকে সহায়তাদানের উদ্দেশ্যে নির্মিত। আমরা জানি, রাজনৈতিক দলের সুষ্ঠু পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা সাধারণ ব্যাপার নয়। একটি দলের বহুমুখী ব্যয় রয়েছে, যেমন: দৈনন্দিন পরিচালনা ব্যয় থেকে শুরু করে অফিস রক্ষণাবেক্ষণ, লজিস্টিক খরচ, বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ এবং সর্বোপরি নির্বাচনী ও প্রচারণা ব্যয়। এসব অত্যাবশ্যক খরচ রাজনৈতিক দলের ওপর প্রচণ্ড আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। বহুমাত্রিক গভর্ন্যান্স-প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন, বিশেষত রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইনপুট ও আউটপুট কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দলের জনবল এবং আর্থিক সংগতির ওপর। এর প্রভাব পড়ে দলের কার্যকারিতা, গতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিকায়নে। বর্তমানের গণতন্ত্রচর্চায় রাজনৈতিক দলগুলো একক বা যৌথভাবে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চায়। এ জন্য দলগুলোর জন্য জরুরি হলো প্রয়োজনীয় সম্পদ ও অর্থপ্রাপ্তি। নির্বাচনী খরচ মেটাতে দল ও দলীয় প্রার্থীরা বিভিন্ন উত্স থেকে অর্থ লাভ করেন বা লাভের প্রচেষ্টা চালান। বলা বাহুল্য, এখনকার নির্বাচন ও প্রচারণা ব্যয়বহুল হওয়ায় রাজনৈতিক অর্থায়ন বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।

বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে নির্বাচনী প্রচারণায় রাজনৈতিক দলগুলোই প্রধান ও সিংহভাগ ভূমিকা রাখে, তবে নির্বাচনী খরচ এবং নিত্যকার খরচের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কঠিন হওয়ায় দলীয় অর্থায়ন রাজনৈতিক অর্থায়ন হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অর্থায়ন গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায় এবং রাজনৈতিক দলের ব্যবস্থাপনাসহ প্রচারণা, মনোনয়ন, ভোটার আকর্ষণ ও সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। এটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে তাই সমভাবে প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে বিবেচ্য। বস্তুত, জনমত গঠন, নির্বাচকমণ্ডলী ও মিডিয়াকে প্রভাবিতকরণে দলগুলো সচেষ্ট হয় এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রকাশ ঘটায়। এ জন্য আলোচনা, সম্মেলন অনুষ্ঠান, সভা, র্যালি ও অন্যান্য কর্মসূচি নিয়ে তারা তত্পরতা চালিয়ে থাকে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে রাজনীতি ও অর্থ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। যার অর্থ হলো, রাজনীতি-চর্চা অর্থের নিত্য জোগান ছাড়া কঠিন হয় এবং সংগঠন ও নির্বাচনে ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও পাবলিক উত্স থেকে অর্থ সংগ্রহ অবশ্যম্ভাবী হয়। তবে রাজনৈতিক অর্থায়ন অসাধুতা, জালিয়াতিসহ অন্যান্য দোষে দুষ্ট হতে পারে।

তাত্ত্বিক আলোচনা

রাজনৈতিক অর্থায়নকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে যেসব তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়, তার মধ্যে বহুত্ববাদী এবং বিনিয়োগ বা ইনভেস্টমেন্ট ধারণা দুটি অন্যতম। বহুত্ববাদী বক্তব্য হলো, parties are entrepreneurs in a profit seeking system who make the best use of maximizing votes for accomplishing targets. এভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো ইকোনমিক মার্কেটে নির্বাচকমণ্ডলীর কাছ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন লাভের জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। রাজনৈতিক দলের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার কর্মসূচি বিবেচনায় রেখে আগ্রহী নির্বাচকমণ্ডলী, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি তাদের পছন্দসই দলকে সমর্থন ও সম্পদ জোগায় এবং সংশ্লিষ্ট দল ও প্রার্থীরা অর্জিত অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহারে সচেষ্ট হয়। এখানে বাস্তবতা হলো, প্রচলিত ইকোনমিক মার্কেটে ক্ষমতা ও অর্থ অসমভাবে বিন্যস্ত থাকে এবং এই অনুকল্প অনুসরণ করে বহুত্ববাদীরা বলেন, রাজনৈতিক অর্থায়ন-সংক্রান্ত আইন দলগুলোর আর্থিক অসমতা ও অসম দলীয় সাংগঠনিক অবস্থান সামনে রেখে প্রণীত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অধিকার, সাংবিধানিক স্বাধীনতা এবং সম-সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সমস্যা তৈরি হতে পারে। সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রপঞ্চটি নির্বাচন ও প্রচারণার ক্ষেত্রে কোনো রকম ব্যয়-সীমা না রাখার পক্ষে এবং এতে একটি দল বা প্রার্থী নিজের ইচ্ছামতো খরচ করার সুযোগ পায়। অন্যদিকে রাজনৈতিক সমতার বিষয়টি বিভিন্ন দলের সম-সুযোগ লাভের এবং বৈষম্যহীন প্রচারণার পক্ষে অবস্থান নেয়।

বিনিয়োগ বা ইনভেস্টমেন্ট তত্ত্ব অনুসারে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে নির্বাচনে বিজয়ী হতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্য সব প্রতিযোগী বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও নির্বাচনী অর্থের ব্যবহার করেন, যাকে ‘স্বর্ণ সুযোগ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধারণা অনুযায়ী বলা যায়, যতক্ষণ পুরো নির্বাচনী প্রচারণা ও কর্মকাণ্ড কিছুসংখ্যক নির্দিষ্ট দাতার করায়ত্ত ও প্রভাবাধীন থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচকমণ্ডলী বা ভোটাররা এ প্রক্রিয়াকে সামান্যই প্রভাবিত করতে সক্ষম। প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক কাঠামো তখনই বিকশিত হয়, যখন সব প্রতিযোগী দলের রাজনৈতিক অর্থায়নে ও নির্বাচনী তহবিল গঠনে সম-প্রবেশাধিকার থাকে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের অর্থ সংগ্রহ এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তা বিশ্বে, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে এক বহুল কথিত বিষয়। এসব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র নির্মাণে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক দলের অধিকতর ভূমিকা পালন দলের জন্য অর্থ সরবরাহ প্রয়োজনীয় করে তোলে। এভাবে দলের নিজস্ব উত্স থেকে, বিশেষ করে সদস্যতা চাঁদা ও পাবলিক ডোনেশনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের পুরোনো ধারণাটি বদলে যেতে থাকে। দলীয় কর্মকাণ্ড নাগরিকের গণতান্ত্রিক জীবনের সব বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ির্কত থাকায় রাজনৈতিক দলের জবাবদিহি ও দায়িত্বশীল আচরণ সম্পর্কে জনসচেতনতা জাগ্রত হতে থাকে। এর ফলে জনগণ এবং নিজ নির্বাচনী এলাকার কাছে দলীয় দায়িত্ব পালন, জবাবদিহি ও জনচাহিদার প্রতি প্রয়োজনীয় সাড়াদান লক্ষণীয় হয়। এ প্রক্রিয়ায় দলের ভেতরে গণতন্ত্রচর্চা, অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা পায়। প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের এ জবাবদিহি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকায়নের প্রক্রিয়ায় স্থিতি লাভ করে। এ সঙ্গে রাজনীতির নিয়ম সম্পর্কে সাধারণ মতৈক্য, যথাযথ সংসদীয় কার্যক্রম ও বিধি প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যুক্তি রয়েছে যে, রাজনৈতিক দলগুলোর গঠন বা কার্যক্রমকে কোনো বৈধ ব্যবস্থাধীনে বা আইনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। কারণ, এতে সংগঠন করার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারটি ক্ষুণ্ন হতে পারে। এর বিপক্ষ মতটি হলো, দায়িত্বশীলতা বা জবাবদিহিকেন্দ্রিক এবং এর ঝোঁকটি নির্দেশ করে দলীয় কাঠামোর জবাবদিহি ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়াসংবলিত কর্মকাণ্ড। প্রকৃতপক্ষে উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক গণতন্ত্রেই ওই দ্বিতীয় মতটি প্রাধান্য পেয়েছে এবং এসব ব্যবস্থায় দলীয় সংগঠন পরিচালনায় সুস্পষ্ট বিধি ও নীতিমালা রয়েছে, যার লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক ও আর্থিক দুর্নীতিমুক্ত দলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এসব বিধিবিধান গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বা দলীয় প্রাতিষ্ঠানিকায়নের পরিপন্থী নয়, যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দলীয় সাংগঠনিক স্থিতিশীলতায়, নেতৃত্বের পরিবর্তনে ও বিকাশে এবং দলীয় গণতন্ত্রচর্চায়।

রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের জন্য রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য রয়েছে। এর বিপক্ষে যে যুক্তি দাঁড় করা হয়, তা হলো রাজনৈতিক অর্থায়ন দলীয় নেতৃত্ব, প্রার্থী এবং অনুসারী ও নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। দল ও প্রার্থীদের অর্থের বিভিন্ন উেসর ওপর নির্ভরতা আর্থিক অসমতাসহ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা প্রতিষ্ঠার কারণ হয়। এভাবে প্রার্থীদের নিজ নিজ দল ও নেতৃত্বের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা হ্রাসপ্রাপ্ত হলে দ্বিমুখী যোগাযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়ে। উপরন্তু রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন, বিশেষত বড় দলগুলো এবং চলমান ক্ষমতার কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে। এর ফলে নতুন এবং ছোট রাজনৈতিক দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং জাতীয় প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে তারা প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়। বস্তুত রাষ্ট্রীয় অর্থ হচ্ছে করদাতাদের প্রদত্ত অর্থ, যাদের এ ব্যাপারে পছন্দের কোনো সুযোগ নেই এবং গ্রহীতা দল ও প্রার্থীদের প্রতি তাদের সমর্থন না-ও থাকতে পারে। অধিকন্তু এ অর্থায়নের ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় রাখে না, যা মানবকল্যাণ ও অবকাঠামোর জন্য অধিক বা প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পরিমাণকে সীমিত করতে পারে। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নিজস্ব স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং সুশীল সমাজ ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংযোগের মাত্রা হ্রাস করে সুষ্ঠু প্রতিষ্ঠান গঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে।

উপরিউক্ত নেতিবাচক যুক্তি থাকা সত্ত্বেও ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে, রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন এক প্রয়োজনীয় ব্যয় এবং গণতান্ত্রিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন নয়। এ ব্যবস্থার সঙ্গে এক স্বচ্ছতার প্রক্রিয়া নির্মাণ করা হয়, যেখানে দলীয় সংগঠনগুলো তাদের অর্থের প্রয়োজনীয়তা মেটায় এবং পার্টির গভর্ন্যান্স সুষ্ঠু হয়। এ অর্থায়ন নির্বাচনী রাজনীতিতে অর্থ ও পেশিশক্তিকে দুর্বল করে এবং আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এভাবে দল ও প্রার্থী অর্থদাতাদের নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য চাপমুক্ত থেকে তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করে ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি এবং প্রভু-অধস্তন সম্পর্কের কুপ্রভাব দূর হয়। এর ইতিবাচক প্রভাব সংসদে ও সংসদীয় রাজনীতিতে লক্ষণীয় হয় এবং কাঠামোগত সংস্কার সাধন সম্ভবপর হয়। নিয়মিত দলীয় আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত হিসাব দাখিল এবং এতে জনপ্রবেশাধিকার থাকলে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন সুনিশ্চিত হয়। কাজেই কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন অধিক গ্রহণযোগ্য এবং উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে দৃশ্যমান হয়।

উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল ও প্রার্থীরা নিজস্ব উত্স ছাড়াও ব্যক্তি, সদস্যতা ফি, অর্থদাতা এবং রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন লাভ করে থাকে। ব্রিটেনে ঐতিহ্যিকভাবে রক্ষণশীল দল অর্থ সংগ্রহে তার নিজ নির্বাচনী এলাকাসহ ব্যক্তি এবং করপোরেট ডোনেশনের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন এ দলের আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ পূরণ করে। শ্রমিক দলের ডোনেশন আয় প্রায় ৬৫ শতাংশ, যা ট্রেড ইউনিয়ন ইনকাম ও দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য যেসব সুবিধা সরবরাহ করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে বিনা মূল্যে ডাক-সুবিধা ও বিভিন্ন সভাকক্ষের ফ্রি ব্যবহার, ইনহেরিট্যান্স ট্যাক্স রিলিফ, মিডিয়া, গণযোগাযোগের সুবিধা ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাবলিক ফান্ডিং তথা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের বিধান রয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরা প্রাইমারি ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রচারণার জন্য ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে লাভ করেন। জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের জাতীয় মনোনয়ন কনভেনশনের জন্য ফেডারেল অর্থ পেয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইলেকটোরাল কমিশনের বিধি মোতাবেক একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে থাকলে ফেডারেল সরকারের আর্থিক সহায়তা লাভ করবেন। এ ছাড়া প্রাইমারি ইলেকশনের জন্য ম্যাচিং ফান্ডের ব্যবস্থাও সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারণা অর্থায়নের এক অন্যতম উত্স হচ্ছে প্রাইভেট পর্যায়ের আর্থিক সহায়তা। জার্মানিতে রাজনৈতিক দলগুলো ৫০ শতাংশ আর্থিক ব্যয় রাষ্ট্রীয় ফান্ড থেকে গ্রহণ করে। ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা ৫ শতাংশ ভোট লাভকারী হলে নির্বাচনী আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় অর্থপ্রাপ্ত হন। কানাডাতেও যেসব দল ৫০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দেয় এবং ১৫ শতাংশ ভোট লাভ করে, তারা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের সুযোগ লাভ করে।

উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে যেভাবে রাজনৈতিক দলীয় অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে লক্ষ করা যায় না। এসব অনেক দেশেই রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আর্থিক ব্যয়ের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর তালিকাভুক্ত সদস্যতার সংখ্যাসহ হিসাব যথাযথভাবে রেকর্ড করা হয় না। প্রতিবেদন দাখিলের নিয়ম অনুসরণ করা হয় না বা অনুপস্থিত থাকে এবং এ ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও গাফিলতি রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয়-প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তা থাকে, যা সাধারণ দলীয় নেতৃত্বের করায়ত্ত থাকে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে নৈতিকতাহীনভাবে ভোট কিনতে এবং ভোটারদের প্রভাবিত করতে দেখা যায়। তা ছাড়া নির্বাচনী রাজনীতিতে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা, বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্ট হতে দেখা যায়, যাঁরা রাজনৈতিক দলের কাঠামোতে এবং সাংসদ পদে নির্বাচিত হতে পারেন এবং জাতীয় সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়াতে প্রভাব বিস্তার করে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন রকমের সুবিধা হাসিল করেন। বর্তমান সংসদে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫৬ শতাংশ (হাসানউজ্জামান ও আলম, ২০১০)। বিজনেস ম্যাগনেট ও ধনাঢ্য শ্রেণী দলে তাদের আর্থিক অবদানের বিনিময়ে জাতীয় নির্বাচনে নিজের ও পছন্দসই ব্যক্তির প্রার্থিতা আদায় করে এবং এ কারণে প্রায়ই নির্বাচনে নির্ধারিত ব্যয়ের মাত্রা অতিক্রম করে যায় ও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এই প্রবণতার ফলে দল ও প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা তাঁদের সাংগঠনিক স্বাধীনতা ও ক্রিয়াশীলতা হারিয়ে ফেলেন।

বাংলাদেশের চিত্র

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সদস্যতা ফি, অনুদান ও অন্যান্য উত্স থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর নির্ভর করে থাকে। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত দলীয় অর্থায়নের ক্ষেত্রে পরিষ্কার কোনো নিয়মনীতির অনুপস্থিতিতে দলগুলো উপরিউক্ত উত্স ছাড়াও অনৈতিক ও অবর্ণিত উপায়ে অর্থ ও তহবিল সংগ্রহ করেছে। সংঘাতময় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে প্রায়ই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। প্রতিযোগীকে পরাস্ত করার প্রাণান্ত প্রয়াসে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নির্বাচনী ব্যয় করা হয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে মূলত দ্বন্দ্বময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, পারস্পরিক অবিশ্বাস, সহিংস আচরণ, সন্ত্রাসের প্রশ্রয়দান ইত্যাদি নেতিবাচক উপাদানের উপস্থিতির কারণে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে গণপ্রতিনিধিত্বশীল আদেশের সংস্কার এবং সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক নিবন্ধীকরণ চালু হয়। কোনো কোনো দেশের সংবিধানে দল গঠন সম্পর্কে বিধি থাকলেও বাংলাদেশের সংবিধান দল গঠন বা পরিচালন সম্পর্কে নীরব। কাজেই এ ক্ষেত্রে আরপিওতে সংযুক্ত নববিধানকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলা চলে। এ বিধানমতে, নিবন্ধিত দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটিকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হতে হবে, যাতে দলের ভেতরে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতাসহ অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার নিশ্চয়তা থাকবে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হচ্ছে দলের মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রায়ণ ঘটানো, যাতে দলগুলো প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জন্য তৃণমূল পর্যায়ের কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত প্যানেল থেকে প্রার্থী বাছাই করবে।১ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার যোগ্যতাসম্পন্ন সত্ ও নিবেদিতপ্রাণ প্রার্থীরা যেন মনোনয়ন লাভের সুযোগ লাভ করেন এবং এ প্রক্রিয়া নির্বাচনী রাজনীতিতে ও প্রতিযোগিতায় অর্থের প্রভাব দূর করতে সহায়ক হবে। তবে ওই নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে, যার উদাহরণ বৃহত্ দলগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে। অতীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায়েই মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে, ফলে স্থানীয় কমিটির সুপারিশ উপেক্ষিত থেকেছে। জানা যায়, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরপিও বিধিটি যথাযথভাবে আওয়ামী লীগে অনুসারিত হয়েছে। পার্লামেন্টারি বোর্ডের কাছে পাঠানো নির্বাচনী এলাকার প্রার্থী তালিকা প্রেরণ করা হলেও ওই তালিকা থেকে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে শীর্ষ নেতৃত্ব নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

অপর দিকে বিএনপিতে তৃণমূল কমিটির মনোনয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা-সংক্রান্ত ওই বিধি অনুসরণ লক্ষণীয় হয়নি, বরং শীর্ষ নেতৃত্বই মূল ভূমিকা রাখে।

১৯৯১-পরবর্তী সময়ের নির্বাচনগুলোতে বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াকে ‘মনোনয়ন-বাণিজ্য’ হিসেবে মন্তব্য করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ‘অর্থ যার মনোনয়ন তার’ বিষয়টি যেন অগ্রাধিকার পেয়েছে। ফলে অর্থের এ প্রতিযোগিতায় বিত্ত-বৈভবহীন প্রকৃত বেশ কিছুসংখ্যক রাজনীতিক টিকে থাকতে পারেননি।

বাংলাদেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংবিধানে দলীয় অর্থায়নের উত্স সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ৪৭ ধারার (ক) থেকে (্ঞ) অংশে বর্ণিত এ দলের তহবিলের উত্স নিম্নরূপ: প্রত্যেক কাউন্সিলরের ১০০ টাকা হারে চাঁদা; কার্যনির্বাহী সংসদের সব কর্মকর্তা ও সদস্যের নির্দিষ্ট হারে মাসিক চাঁদা, আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্যদের প্রত্যেকের মাসিক ৫০০ টাকা হারে চাঁদা, প্রত্যেক জেলার মঞ্জুরি ফি বাবদ ১০০ টাকা, এ দলের প্রচারপত্র, পত্রপত্রিকা, পুস্তিকা, বুলেটিন ও বিভিন্ন প্রকাশনার বিক্রয়লব্ধ অর্থ, এককালীন দান-অনুদান, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ এবং প্রাথমিক সদস্য ও নবায়নের জন্য ত্রিবার্ষিক চাঁদা। এভাবে ৪৭(২), (৩), (৪) এবং ৪৮ ধারায় আওয়ামী লীগের জেলা ও মহানগর, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌর, ওয়ার্ড ও সংসদীয় দলের তহবিল এবং তহবিল পরিচালনার প্রসঙ্গে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। ওই সংগৃহীত অর্থ যেকোনো তফসিলি ব্যাংকে জমাকরণ এবং সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে ওঠানোসহ দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলে নিরীক্ষিত আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করার বাধ্যবাধকতা আছে (গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ২৪ জুলাই ২০০৯-এ অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিল কর্তৃক সংশোধিত ও অনুমোদিত, পৃষ্ঠা-২৭-২৯)।

৮ ডিসেম্বর ২০০৯-এ সংশোধিত বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১০ নম্বর ধারায় দলের কোষাধ্যক্ষের ফান্ড সংগ্রহ ও পরিচালনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংগঠনের হিসাব যেকোনো কমার্শিয়াল ব্যাংকে জমা ও উত্তোলনে কোষাধ্যক্ষ, দলীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যৌথ স্বাক্ষরের প্রয়োজন। এই দলের হিসাব প্রতিবছর নিরীক্ষণসহ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন পেশ আবশ্যক। তহবিল সংগ্রহে সদস্যদের চাঁদা, চার্জ, অনুদান ও মনোনয়নপত্র বিক্রি হবে প্রধান মাধ্যম।

উপরিউক্ত প্রধান দুটি দলের তহবিল সংগ্রহে সমরূপতা লক্ষণীয়। উভয় দলের কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনা, ইউটিলিটি সার্ভিস, বিভিন্ন চার্জ, বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার জন্য বর্ণিত উত্সসহ দেশ-বিদেশে দলের শুভানুধ্যায়ী, মন্ত্রী ও সাংসদেরা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের দেয় ডোনেশন ও দান উল্লেখযোগ্য। ধারণা করা হয়, দল দুটি ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর সভা ও সমিতির সম্মেলন, সেমিনার, র্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বর্তমান ও প্রয়াত নেতাদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন, রাজপথে আন্দোলন ও হরতাল কর্মসূচিতে বাত্সরিকভাবে শতকোটি টাকা বা তার বেশি পরিমাণ খরচ হয়ে থাকে। দল দুটি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত অর্থও ব্যবহার করেছে। দলীয় অর্থায়নে ডোনেশন অন্যতম এক উত্স হলেও এর পরিমাণ যথাযথভাবে কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। সদস্যতা চাঁদা অপ্রতুল ও অনিয়মিত বলে জানা যায়। দলের ধনী দাতাদের দেয় বড় বড় ডোনেশন অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অঘোষিত অর্থ বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দলীয় নেতা-কর্মী এবং প্রতিযোগী প্রার্থীরা বিভিন্ন উপায়ে যে অর্থ সংগ্রহ করেন, তার ব্যাপক ব্যবহার হয় প্রধানত মনোনয়ন লাভে ও প্রচারণার কাজে। সাম্প্রতিক কালের তথ্য অনুসারে, প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের অর্থায়নের বেশির ভাগ অর্জিত হয় করপোরেট ব্যবসাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বা ধনিক শ্রেণীর কাছ থেকে। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো রকম ‘প্রাপ্তি রিসিট’ প্রদানের খবর জানা যায়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষত নির্বাচনী রাজনীতিতে, অর্থের ব্যাপক সমাগম ও প্রতিযোগিতা এ ক্ষেত্রটির বাণিজ্যিকীকরণ করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এভাবে পেশিশক্তির ব্যবহার এবং প্রতিযোগীদের ভোট ক্রয়ের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে।

১৯৯১-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে একধরনের দ্বিদলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। মাঝারি ও ছোট দলগুলো এ দল দুটির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বড় দলের ছত্রচ্ছায়ায় নিজ নিজ ও জোটের তত্পরতা চালায়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ও নির্বাচনী মাঠে বড় দল দুটি নিজস্ব প্রাধান্য বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং দলীয় ফান্ডে বিশাল/ বড় ধরনের আর্থিক অবদানের বিনিময়ে অরাজনীতিক শক্তির অনুপ্রবেশ দলীয় কাঠামোতে লক্ষ করা যায়। মূলত এ কারণে নির্বাচনী কার্যক্রমে বিধি মোতাবেক নির্ধারিত আর্থিক খরচের সীমারেখা লঙ্ঘিত হয়েছে। রাজনীতি তাই ক্ষমতাপ্রাপ্তি এবং বিত্তবান শ্রেণীর দলীয় কাঠামোতে অবস্থান করে রাষ্ট্রীয় পেট্রোনেজ লাভের হাতিয়ারে পরিণত হয়। রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী এবং নব্য রাজনীতিক ধনী গোষ্ঠী এ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ব্যবহার কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধনী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। নব্বই-পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থীকে ওই গোষ্ঠীগুলো থেকে মনোনয়ন দিতে দেখা যায় এবং পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদে নব্য ধনিক শ্রেণী তথা Nouveau riche একক বড় গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমান নবম সংসদে নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ১৬৯। রাজনৈতিক দলগুলোর এ গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাতের মূল কারণ হলো আর্থিক ডোনেশন, যা নির্বাচনী রাজনীতি ও প্রতিযোগিতার প্রধানতম উপাদান। সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনগুলোতে আরপিও যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় বড় দলগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ অর্থ সংগ্রহে কোনো দ্বিধা থাকে না, যার প্রভাব ‘মনোনয়ন-বাণিজ্যে’ প্রত্যক্ষ করা যায়। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের নাগরিকেরা জাতীয় সংসদে বর্ণিত গোষ্ঠীর প্রাধান্য বিস্তার লক্ষ করছে, যা প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে গুণগত বা ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে তিরোহিত করেছে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন বা তার পরিমাণ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্যে ঘাটতি লক্ষণীয়। ধারণা করা যায়, এই কর্মকাণ্ডে অস্বচ্ছতা রয়েছে এবং বিভিন্ন উত্স থেকে তহবিল সংগ্রহ দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কাঠামোর মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। এ ছাড়া সাংসদ, দলীয় শুভানুধ্যায়ী, দলের বিত্তবান নেতা-কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দলীয় প্রধানের কাছে তাঁদের দেয় অর্থ পেশ করে থাকেন। দলীয় অর্থায়নের এ ‘মোডাস অপারেন্ডি’ কম-বেশি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে লক্ষ করা যায়। মন্তব্য করা হয়েছে, এ দেশে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া বিদ্যমান। আর্থিক প্রতিবেদন ও নিরীক্ষিত ব্যালান্সশিটের যথার্থতা নেই এবং নির্বাচন কমিশনে প্রদত্ত তথ্য অপর্যাপ্ত। দাখিল করা প্রতিবেদন সার্বিক নয় এবং অগভীর। এ জন্য দল ও প্রার্থীর দেয় হিসাব বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে না। আরপিওতে নির্দেশিত দণ্ডের ব্যবস্থা কদাচিত্ অনুসারিত হয়েছে। রাষ্ট্রসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষ, সিভিল সমাজ, মিডিয়া ও সংশ্লিষ্টজনের তদারকি অদ্যাবধি গঠনমূলক হতে পারেনি। দলীয় অর্থায়ন, বিশেষত নির্বাচনী প্রচারণার বাণিজ্যিকীকরণ এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে দলীয় কাঠামোর সম্পর্ক ও মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় অর্থনির্ভর বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এ প্রক্রিয়ার ঝোঁক অর্থ ও সম্পদমুখী হওয়ায় নব্য রাজনীতিক ও বহিরাগত ব্যক্তিদের রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার প্রেক্ষাপট রচনা করে। ক্রয়-বিক্রয়ের এ বাস্তবতায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক অর্থ ব্যয়সহ দলের প্রত্যয়ন ও দলের পক্ষে অবশেষে মনোনয়ন লাভ সম্ভবপর হয়। প্রচারণার এই বাণিজ্যিকীকরণের মূল কারণ নিহিত রয়েছে দলীয় সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীকরণ ও দলীয় কাঠামোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার অভাব।

বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্নীতি, সংসদীয় কার্যকারিতার অপ্রতুলতা এবং আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে ফারাক বাংলাদেশে দলীয় অর্থায়নে দায়িত্বশীলতার অভাব নির্দেশ করে। দলের অভ্যন্তরে ভারসাম্যের অনুপস্থিতি আর্থিক স্বচ্ছতা নির্মাণে বাধা সৃষ্টি করে, যেখানে আর্থিক কর্মসম্পাদনে এবং ডোনেশনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নেতৃত্ব দায়িত্বশীলতার ঊর্ধ্বে থাকে। দলীয় অর্থায়নের প্রসঙ্গটি স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয় এবং দলীয় নেতারা অর্থ বা তহবিলের উত্স সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করে যান। দলীয় ক্ষমতাকে তাই অর্থ সংগ্রহ ও সমর্থকগোষ্ঠীকে পুরস্কৃত করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক অর্থায়ন এখনো প্রকাশ্য বিষয় হতে পারেনি। দলের অভ্যন্তরে অর্থসংক্রান্ত তথ্য প্রদানের উদাহরণ বিরল।

রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক চর্চার ক্ষেত্রে অর্থায়ন বা তহবিল উন্মুক্তকরণ এবং রিপোর্টিং এ দেশে এক নতুন বিষয়। অতীতে আয়-ব্যয়ের যথার্থ নথিকরণ লক্ষণীয় ছিল না। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর প্রায় ৯৫ শতাংশ সাংসদ তাঁদের ব্যক্তিগত খরচের বিবরণ প্রদান করেননি। একইভাবে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কোনো দলই নির্বাচনী খরচ সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিল করেনি। ২০০৮ সালে আরপিও অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত হয় এবং তাদের বাত্সরিক হিসাব/ প্রতিবেদন দাখিল করতে বাধ্য থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে যথাযথভাবে বিধি অনুসরণে ঘাটতি ও শিথিলতা লক্ষ করা গেছে। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেশির ভাগ প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী হিসাবের প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পেশ করে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিধি মেনে চলা এবং প্রতিবেদনের জন্য নির্ধারিত নির্দেশনা পালনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক অর্থায়ন: তথ্য প্রকাশের মাত্রা

উল্লেখ্য, সুশাসন ও গণতন্ত্র নির্মাণের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সব পাবলিক কর্মকাণ্ড এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা আনা। একইভাবে দলীয় ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দলীয় অর্থায়নের বিষয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ নিশ্চিতকরণ খুবই জরুরি। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন-আস্থা নির্মাণ করার জন্য মুখ্য, যেখানে অর্থ ও রাজনীতির মধ্যে এক পারস্পরিক বন্ধনজনিত সম্পর্ক বিদ্যমান। বস্তুত, আর্থিক বিষয়ে কোনো গোপনীয়তা অবলম্বন এবং অনির্দেশিত অর্থ পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে এবং বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিকে উত্সাহিত করে। বলা হয়, গোপন অর্থ ও দুর্নীতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আঘাত করে এবং সেই সঙ্গে রাজনীতিকদের আচরণকে নীতিহীন করে উন্নয়নকে শ্লথ করতে ভূমিকা রাখে, আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনবিশ্বাসের অভাবসহ জনবিচ্ছিন্নতা ঘটায়।

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র সুষ্ঠু রাজনৈতিক অর্থায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব সিস্টেমিক রাজনৈতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তা ছাড়া জাতিসংঘ, দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো সংস্থাগুলো এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী। উদাহরণ হিসেবে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে প্রার্থীদের অর্থায়নে অধিক স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠাকরণ, রাজনৈতিক দলের অর্থায়নে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনামা জারির সুপারিশ করেছে। দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপ রাজনৈতিক অর্থায়নের প্রাইভেট ও পাবলিক উেসর মধ্যে সুষ্ঠু ভারসাম্য রাখার জন্য আইন প্রণয়ন এবং ডোনেশনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বা গোপন ডোনেশন বন্ধ করার পরামর্শ দেয়, যাতে রাজনৈতিক দলের সংগঠনের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত দূর হয়ে দলীয় স্বাধীনতা ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আফ্রিকান ইউনিয়ন কনভেনশনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রাজনৈতিক দলের তহবিল গঠনে অনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট অর্থ সীমিতকরণ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে, যার ভিত্তি হবে স্বচ্ছতা। কারণ, প্রাইভেট-অর্থায়ন দুর্নীতির সহায়ক এবং গণতন্ত্রের জন্য প্রতিবন্ধক হতে পারে।

উপরিউক্ত পদক্ষেপ ছাড়াও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনসহ বিশ্বব্যাংক ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল রাজনৈতিক অর্থায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দল ও প্রার্থীদের আয়, ব্যয় ও সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশকরণ; নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সময় ও খরচ নির্দিষ্টকরণ; প্রাইভেট ডোনেশনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ; জনজীবনে নৈতিকতার মান নিশ্চিতকরণে কৌশল নির্ধারণ এবং স্বাধীন তদারকি সংস্থাগুলোর তত্পরতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ। রাজনৈতিক অর্থ নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে বলা হয়েছে, আর্থিকভাবে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনামূলক সুবিধা সীমিতকরণে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলের জন্য পাবলিক ফান্ডের সরবরাহ করা দরকার। আর্থিক দুষ্টচক্রের প্রভাব মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রাইভেট ডোনেশন, করপোরেট ডোনেশন এবং বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন উেসর ওপর খবরদারিকরণসহ রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা এনে নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা বাড়ানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যে জিনিসটি বিচার্য, তা হলো দলীয় অর্থায়ন নিজেই কোনো লক্ষ্য নয় বরং গণতন্ত্রের গুণগত মান উন্নয়নের বড় লক্ষ্য অর্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। বর্তমানের গণতন্ত্রে উদ্বেগের অন্যতম এক উপাদান হচ্ছে দলীয় অর্থায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি আর এ দুর্নীতি প্রতিরোধে দলীয় আচরণে, বিশেষত এর আর্থিক বিষয়সংক্রান্ত তথ্য উন্মুক্তকরণে, নিয়ন্ত্রণকারী আইনি পদক্ষেপ জরুরি। কারণ, এ ক্ষেত্রে তথ্য প্রকাশ আবশ্যকীয় না হলে যেকোনো অর্থ যেকোনো পরিমাণে গ্রহণ করা যাবে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ছাড়াও তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা গণতন্ত্রের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক তথ্য প্রকাশ সার্বিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা আনয়নে ভূমিকা রাখে এবং ভোটারদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ সৃষ্টি করে, যাতে তাঁরা তাঁদের সচেতন সিদ্ধান্তটি ভোটের মাধ্যমে পেশ করতে পারেন। তথ্য প্রকাশের আবশ্যকতায় দল ও প্রার্থীরা তহবিল গঠনে এবং নিজস্ব সম্পদের ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে নৈতিক হতে পারে, যা ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিমুক্ত থাকে। অধিকন্তু, এ প্রক্রিয়া নীতি বাস্তবায়নকারী সংস্থাসহ সিভিল সমাজ, মিডিয়া ও সংশ্লিষ্টদের প্রদত্ত তথ্য যাচাই করার সুযোগ এনে দেয়।

কিছুকাল আগে ইউএস এইডের এক গবেষণায় লক্ষ করা যায়, পৃথিবীর ১১৮ দেশের মধ্যে ২৮টির তথ্য প্রকাশের কোনো আইন ছিল না এবং এর মধ্যে শুধু ১৫টিতে দল ও প্রার্থীদের আয়-ব্যয়ের হিসাব ও তাদের দাতাদের পরিচয় প্রকাশের ব্যবস্থা ছিল। তবে উল্লেখ্য, দলীয় অর্থায়ন বা খরচের তথ্য প্রকাশের নমুনা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্নতর হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও জার্মানিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্যদান এবং পাবলিক ডিসক্লোজার-সংক্রান্ত বিধি প্রয়োগ করা হয়। কানাডায় এ ক্ষেত্রে তদারকি সংস্থার কাছে গোপন প্রতিবেদন দাখিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাচন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্টিংয়ের বিধি চালু আছে। ২০০৮-০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় তথ্য প্রকাশ ১০ হাজার ডলারের অতিরিক্ত পরিমাণের জন্য নির্ধারিত থাকে। এভাবে রাজনৈতিক দলের বার্ষিক রিটার্ন দাখিলে প্রাপ্ত অর্থের সর্বমোট অঙ্কও পরিশোধের পরিমাণ উল্লিখিত হয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও অন্যান্য সংস্থা থেকে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি অর্থ, লোন, উপহারসামগ্রী ইত্যাদি দানকারীর নাম ও ঠিকানা প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকে; যা নথিভুক্ত করা হয় এবং নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণের জন্য পেশ করা হয়।

প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে অর্থায়ন বিধিবিধানের সুষ্ঠু প্রয়োগে কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের দলিল, আয়-ব্যয়ের নথি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সম্পর্কে খবরদারি করার এখতিয়ার রয়েছে এবং কথিত তথ্যদানের ব্যর্থতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে পারে। তা ছাড়া এ কমিশন বিচারিক প্রত্যয়ন ছাড়াই রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয়ে প্রবেশ এবং বইপত্র, নথি ও দলিলাদি পর্যবেক্ষণ করতে পারে। জার্মানিতে সংসদ, বুনডেসটাগের স্পিকার রাজনৈতিক অর্থায়নের বিধি ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল থাকেন এবং নিজেই এ জন্য ফেডারেল অডিট কোর্টের তদারকির অন্তর্ভুক্ত হন। ওই কোর্ট এভাবে নিশ্চিত করতে প্রয়াসী হন যে জন-অর্থায়ন বিতরণের আইন যেন কোনোভাবে লঙ্ঘিত না হয় এবং স্পিকার নিজস্ব দলকে এ ব্যাপারে যেন পক্ষপাতিত্ব করতে না পারেন। অন্যান্য কিছু দেশে নির্বাচন কমিশন, সংসদের রাষ্ট্রীয় হিসাব কমিটি, দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশন, এজেন্সি ও সরকারের অডিট কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন এবং তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কর্মরত থাকে। এবং এ-সংক্রান্ত তথ্যে জনগণের প্রবেশাধিকার ও পর্যালোচনার অধিকার নিশ্চিত করা হয়, যাতে জন-আস্থার ও রাজনৈতিক বৈধতার প্রকাশ ঘটে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন ও সংশ্লিষ্ট হিসাব সম্পর্কে সাংবিধানিক তদারকি সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনবিধি, ২০০৮ এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ২০০৮-এ রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থ, আয়-ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ এবং তদারকি সম্পর্কে নির্দেশনা রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার খরচ সম্পর্কে আরপিও (সংশোধিত) আইন, ২০০৯-এ উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিটি মনোনয়নপত্রে আবশ্যিকভাবে বিবরণ দিতে হবে প্রার্থীর পেশা, আয়ের উত্স, সম্পত্তির বর্ণনা, তার নিজের বা পোষ্যদের ঋণের পরিমাণ, যেকোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের নামে বা যৌথ নামে অথবা নিজ পোষ্যদের নামে গৃহীত ঋণ বা লোনের পরিমাণ ও বিভিন্ন উত্স থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ।

ওই বিবরণীর সঙ্গে নির্ধারিত ফরমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের সম্পদ/ সম্পত্তি ও দেনা এবং বাত্সরিক আয়-ব্যয় এবং করদাতা হয়ে থাকলে বাত্সরিক কর রিটার্নের বিবরণ দিতে হবে। এ বিবরণীর একটি কপি যথারীতি নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পেশ করা আবশ্যক। জনপ্রতিনিধিত্বশীল আদেশে প্রতিযোগী প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, যা ১৫ লাখ টাকার অধিক হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর যেখানে নিজেদের প্রার্থীসংখ্যা দুই শতাধিক, সেখানে নির্ধারিত খরচের পরিমাণ হবে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা; প্রার্থীসংখ্যা শতাধিক কিন্তু দুই শ নয়, সেখানে তিন কোটি টাকা; প্রার্থীসংখ্যা শতাধিক নয়, সেখানে এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং প্রার্থীসংখ্যা পঞ্চাশের অধিক কিন্তু এক শ নয়; সেখানে খরচ করা যাবে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা।

আরপিও অনুসারে প্রার্থী মনোনয়নদানকারী প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত নিজস্ব আয়-ব্যয়ের যথার্থ হিসাব রাখতে হবে। এ হিসাবে পরিষ্কারভাবে প্রাপ্ত পাঁচ হাজার টাকার অতিরিক্ত ডোনেশন এবং দেয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নাম, ঠিকানা ও ডোনেশনের পরিমাণ এবং রিসিটের উল্লেখ থাকতে হবে। এ রকম প্রতিটি দলের অর্থ যেকোনো তফসিলি ব্যাংকে জমা ও পরিচালনা করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলই ২০ হাজার টাকার অধিক ডোনেশন গ্রহণ করতে পারবে না, যদি না তা চেকের মাধ্যমে দেওয়া হয়।

একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বছরে যেকোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা এনজিওর কাছ থেকে ডোনেশন লাভ করতে পারবে। তবে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ডোনেশনের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকা, সম্পদ বা সেবার অধিক হবে না এবং কোম্পানি বা সংগঠনের ক্ষেত্রে এটি ২৫ লাখ টাকার অধিক হবে না। কোনো নিবন্ধিত দলকেই অন্যান্য দেশ, বিদেশি দাতার সহায়তাপ্রাপ্ত এনজিও অথবা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে কোনো রকম উপহার, দান, ডোনেশন বা অর্থ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নদানকারী প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সব নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৯০ দিনের মধ্যে বর্ণিত সময়ে ব্যয়কৃত সব খরচের বিস্তারিত বিবরণী নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষণের জন্য পেশ করতে হবে। ওই খরচের মধ্যে নিজ প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় এবং পৃথকভাবে দলীয় মেনিফেস্টো, নীতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রচারণার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আরপিওতে বিধি অমান্যকারী দল ও প্রার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিদানের বিধান রয়েছে। এভাবে যদি কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ওই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিজ ব্যয়ের হিসাব দাখিলে ব্যর্থ হয়, তবে কমিশন ওই দলকে ৩০ দিনের মধ্যে বিবরণী দাখিল অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারে। ওই ডেডলাইন ১৫ দিন বাড়ানোর পর দল পুনরায় ব্যর্থ হলে নির্বাচন কমিশন দলের নিবন্ধন বাতিল করে দিতে পারে।

বর্ণিত বিধানে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর বিবরণী, রিটার্ন ও দলিলাদি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ওয়েবসাইটে তা প্রকাশের উল্লেখ রয়েছে।

নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী খরচের হিসাব নিম্নের সারণি থেকে লক্ষ করা যাবে।

সারণি-১: ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী খরচের বিবরণী

ক্রমিক নম্বর                দলের নাম            সর্বমোট খরচ (টাকার অঙ্কে) ২০০৮ সালে

১.            বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল)            ৫,৩৭,০০০ 

২.            বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)        ১১,৯৮,২৬৬

৩.            বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ                         ৩,৬০,২৬,৯৪৭

৪.             বিএনপি                                             ৪,৪৯,৫০,০০০

৫.            গণতন্ত্রী পার্টি                                              ৯৯,০০০

৬.            বাংলাদেশ ন্যাপ                                          ১১,৭০০

৭.            বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি                       ১২,৩৫,০০০

৮.            বিকল্পধারা বাংলাদেশ                            ১৭,৮৪,০০০

৯.            জাতীয় পার্টি                                       ১৩,৬৭,০০০

১০.          বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী                  ৭৪,৭২,৪০৮

১১.           জাকের পার্টি                                        ৪,৫০,০০০

১২.           বিএসডি                                            ১,৬১,০০০

১৩.          বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন                ১৭,২৯,০০০

১৪.           বাংলাদেশ খিলাফত আন্দোলন                 ৩,৮০,০০০

১৫.           বাংলাদেশ মুসলিম লীগ                           ১৬,০০০ 

১৬.           ন্যাশনাল পিপলস পার্টি                         ৩,০৩,০০০ 

১৭.            গণফোরাম                                        ৯,৯৫,০০০ 

১৮.           বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি              ৫,০০০

১৯.           বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি                             ১৫,৪৭০

২০.           বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস                      ৩,৩৬,৯৬০ 

২১.           ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ                    ২,৪,৮০,১৪২

২২.           বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট                         ১,৬৬,৩৮৫

২৩.           বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি                              ৬৪,৩০০ 

উত্স: নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ, ২০১০।

ওই বিবরণীতে যেসব খাত দেখানো হয়, তার মধ্যে রয়েছে প্রার্থীকে দেয় এককালীন অর্থ, প্রচারণার জন্য ব্যয়, যাতায়াত খরচ, পাবলিক বা জনসভা অনুষ্ঠান, কর্মচারী-সংক্রান্ত খরচ, বাসস্থান ও প্রশাসনিক খরচ এবং বিবিধ খরচ।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোতে সর্বদাই লিখিত নিয়মকানুন এবং নিয়মের প্রকৃত চর্চার ক্ষেত্রে গ্যাপ থেকে যায়। এ পার্থক্য একইভাবে নির্বাচনী চর্চার জন্য জনপ্রতিনিধিত্বশীল আদেশের বিধিবিধান এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নির্বাচনী আচার, আচরণ, তথ্য প্রকাশ ও হিসাব দাখিলের বেলায়ও প্রযোজ্য। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে লক্ষ করা যায়, আরপিও অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলো যথারীতি নিবন্ধিত হয় এবং দল ও প্রার্থীরা তাঁদের নির্বাচনী খরচের বিবরণ এবং হিসাবের প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পেশ করেন। তবে সচেতন গোষ্ঠী ও বহিঃস্থ তদারকি মহল বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্যদান এবং হিসাবের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সামগ্রিকতা নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন। দলীয় সাংগঠনিক পর্যায়ে যথাযথভাবে তাদের হিসাবের নথিভুক্তকরণে এবং আর্থিক বিবরণীর যথার্থ নিরীক্ষণে ঘাটতি ছিল বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলকে তাদের সমগ্র আর্থিক প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও নিয়মমাফিক করার আরপিও বিধিবিধানের প্রকৃত অনুসারী হতে লক্ষ করা যায়নি। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনও ওই ক্ষেত্রে তার নির্ধারিত তদারকিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সবলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।

রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের তথ্যদানের জন্য যে নিয়ম রয়েছে, তা দায়িত্বশীলতা অর্জনে সহায়ক হলেও পূর্ণাঙ্গ নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ‘ফরম-২০’ ও ‘ফরম-২১’২-এ প্রদত্ত তথ্য যাচাই করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টতা নেই।

প্রার্থীর নিজস্ব সঞ্চয় এবং কীভাবে তা সঞ্চয় করা হলো তা বা দায়দেনা এবং ব্যক্তিগত আবশ্যকীয় আটটি তথ্যের সঙ্গে সংযুক্ত কাগজপত্র ও অসত্য তথ্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট যাচাই-সংক্রান্ত আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের তদারকি সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ের এক সেমিনারে সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার মন্তব্য করেন, ভোট গ্রহণের দিন ভোটারদের ভোট ক্রয় বা প্রভাবিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিযোগী প্রার্থীদের মুঠোফোনে ফ্লেক্সিলোডের মাধ্যমে টাকাদান এবং বিভিন্ন খাদ্যের মধ্যে, যেমন শিঙাড়ার ভেতরে টাকা গুঁজে পরিবেশনের উল্লেখ করেন, যা নির্ণয় করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কঠিন এবং এ রকম সংস্কৃতিতে সাধুতা প্রদর্শন ভ্রান্তিসংকুল।

২০০৮ সালের আরপিও নির্দেশনা মোতাবেক সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিবছরের জুলাই মাসের শেষে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষিত নিজ নিজ বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে জমাদান বাধ্যতামূলক। এ প্রতিবেদনের সঙ্গে দলীয় আয়, ব্যয়, বিল, ভাউচারসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমা দেওয়ার বিধান বর্তমানে রয়েছে। নির্বাচন কমিশন মারফত জানা যায়, ৩১ জুলাই ২০১৩ তারিখের মধ্যে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ১৯টি দল তাদের ২০১২ সালের জন্য প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন যথারীতি কমিশনে জমা দেয়। তবে কয়েকটি নিবন্ধিত দলকে প্রতিবেদন দাখিলে নিয়মনিষ্ঠ হতে দেখা যায়নি। এভাবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগসহ অন্য কয়েকটি দলের প্রতিবেদন দাখিলে সময় বৃদ্ধির আবেদন লক্ষণীয়। দলীয় প্রতিবেদন পেশ করা হলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বর্ণিত আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ অদ্যাবধি সব সাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা হয়নি বা হচ্ছে না। যা-ই হোক, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের বরাত অনুযায়ী বার্ষিক আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে শাসক দল আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। ২০১২ সালের জন্য আওয়ামী লীগ প্রদর্শিত আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ১০.১ কোটি টাকা ও ৯.২ কোটি টাকা, জামায়াতের আয় ৬ কোটি ৪ লাখ এবং ব্যয় ৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, জাতীয় পার্টির আয় ৪.৮১ কোটি ও ব্যয় ২.২৬ কোটি টাকা এবং বিএনপির আয় ১.৭৯ কোটি এবং ব্যয় ২.২৬ কোটি টাকা। আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উদ্বৃত্ত আয় বিএনপিসহ জামায়াত ও জাতীয় পার্টির ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এসব দলের আয়ের ক্ষেত্রে বর্ণিত উেসর মধ্যে রয়েছে সদস্যতা চাঁদা, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফি, ডোনেশন, কুপন, বুকলেটসহ বিভিন্ন পুস্তক, সাময়িকী, বিক্রয়লব্ধ অর্থ ও ব্যয়ের খাতে দলীয় প্রশাসনিক খরচ, ইউটিলিটি চার্জ, বিল, মিছিল, র্যালি, শোভাযাত্রা, সভা অনুষ্ঠানসহ দৈনন্দিন খরচের উল্লেখ আছে। শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রধানতম খরচের মধ্যে রয়েছে নিজস্ব দলীয় কার্যালয়ের জন্য ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের জমি ক্রয়।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোর বার্ষিক আয়-ব্যয়ের গত্বাঁধা যে বিবরণের কথা জানা যায়, তা বর্তমানের নিরিখে বাস্তবসম্মত নয় বলে প্রতীয়মান হয়। অর্থাত্, প্রদর্শিত তথ্যের সঙ্গে প্রকৃত চিত্র অসামঞ্জস্যপূর্ণ। দৃষ্টান্ত হিসেবে সারা বছরে প্রধান দলগুলোর দৈনন্দিন, ইউটিলিটি ও প্রশাসনিক খরচ বাদে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী যেসব আড়ম্বরপূর্ণ কর্মসূচি, সভা, সম্মেলন, র্যালি, শোভাযাত্রা, হরতাল, মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রকৃত খরচ প্রদর্শিত খরচের তুলনায় অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয় (নিবন্ধ, প্রথম আলো, ৫ আগস্ট, ২০১৩)।

উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে রাজনৈতিক দলসমূহের আয়-ব্যয়ের মাত্রা যাচাইকরণ নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত। তবে এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে যাচাই বা তদারকি তত্পরতা দৃশ্যমান হচ্ছে না। কমিশনে পেশকৃত দলীয় বিস্তারিত আয়-ব্যয়ের বিবরণীকে অপ্রকাশিত রাখায় এ তথ্যে জনপ্রবেশাধিকার নেই। ফলে, অর্থসংক্রান্ত ব্যাপারে রাজনৈতিক দলসমূহের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ সুদূরপরাহত থেকে যায়।

উপসংহার

রাজনৈতিক দলগুলোর দৈনন্দিন বিষয়াদি পরিচালনা, সাংগঠনিক কার্যাবলি, দলীয় কার্যক্রম ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন, নির্বাচনী রাজনীতির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রচারণা কর্মকাণ্ডের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সংগতি, সম্পদ এবং সার্ভিস প্রাপ্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এসব কার্যক্রমকে অর্থবহ, কার্যকর ও সুষ্ঠু করার জন্য স্বচ্ছ দলীয় আর্থিক ব্যবস্থার বিশেষ আবশ্যকতা রয়েছে বা এর কোনো বিকল্প বর্তমানের গণতন্ত্রে নেই।

বস্তুত, যথার্থ রাজনৈতিক অর্থায়নের সংস্কৃতি গড়ে তোলা যেকোনো ধরনের গণতন্ত্রের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোতে গত শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় থেকে রাজনৈতিক দলীয় অর্থায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের মাধ্যমে দলীয় সংগঠনগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ ও দায়িত্বশীলতার দাবিতে বিভিন্ন কৌশল ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে সংসদে যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং তথ্য প্রকাশের জন্য বিধিবিধান জারি। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল গণতন্ত্রেও এ ব্যাপারে সংসদীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। তদারকি কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে অর্থায়ন ও ব্যয়ের প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা, নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ, তথ্য প্রকাশ, খরচ ও আর্থিক প্রতিবেদন এবং হিসাব নিরীক্ষণ ও হিসাব দাখিলের বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি। তবে এসব আইনি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এসব রাষ্ট্রের চলমান বাস্তবতা ইতিবাচক অর্জনের চিত্র উপস্থাপন করে না।

বাংলাদেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক অর্থায়ন ব্যবস্থার বিনির্মাণ বিশেষভাবে জরুরি। এ জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।

প্রথমত, চলমান প্রশ্নবোধক তহবিল গঠন এবং প্রচারণার অর্থ সংগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে এখন সময় হয়েছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে সংশ্লিষ্ট দল ও প্রার্থীদের জন্য সমসুযোগ সৃষ্টি হয়। এসব দলের জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থানুকূল্য তাদের নিত্যনৈমিত্তিক খরচ ছাড়াও নির্বাচনী ব্যয় মেটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল করে, যা দলীয় সাংগঠনিক দক্ষতা আনয়নে অবদান রাখে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে ফারাক দূর করে, দলীয় মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার গণতন্ত্রায়ণ ঘটায়, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ দূর করে এবং আর্থিক ও অর্থায়ন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের ব্যাপারে সুপারিশ রয়েছে, জাতীয় বাজেট থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাজনৈতিক দলীয় অর্থায়নের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় সংসদীয় কাঠামোকে সংশ্লিষ্ট করা যায় এবং সংসদের রাষ্ট্রীয় হিসাব নিরীক্ষা কমিটিকে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের সহায়তাক্রমে রাজনৈতিক দলগুলোর নিরীক্ষিত হিসাব পরীক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত করা সম্ভব। যেহেতু আয়ের বৈধ উত্স ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা দলের ভেতর ব্যক্তিগত ও কায়েমি স্বার্থ প্রতিরোধ করে, সেহেতু অর্থায়নকে যত দূর সম্ভব স্বচ্ছ রাখা দরকার।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন সেসব দলের জন্য ক্রিয়াশীল হতে পারে, যেসব দল সাধারণ/ সংসদীয় নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট লাভ করে বা সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয়। যেসব দল রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে, তাদের জন্য কর সুবিধাদান এবং মিডিয়া-সহায়তা সহজলভ্য করা যেতে পারে। নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রকৃত রিসিট প্রদান সাপেক্ষে দান/ অনুদান ও ডোনেশনের ব্যবস্থা চালু থাকবে। দলের জন্য কারণিক সুবিধাদান এবং লজিস্টিক সহায়তা প্রদানও বিবেচ্য হবে। ব্রিটেনের অনুকরণে পরোক্ষ অর্থায়নের ব্যবস্থা, যেমন: দলীয় প্রার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে ডাক-সুবিধা, মিলনায়তন ব্যবহার ও রেডিও-টেলিভিশনে সম্প্রচারের সুযোগ চালু করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর কনভেনশন অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠান আয়োজনেও প্রয়োজনীয় সহায়তা দান আবশ্যক।

চতুর্থত, নির্বাচন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য জনপ্রতিনিধিত্বশীল আদেশ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আরপিও-এর ৯১-ই ধারা সংরক্ষণসহ যথাযথভাবে কর্তৃত্বপূর্ণকরণ একান্তভাবে জরুরি। অপ্রদর্শিত বা অবৈধ অর্থের ব্যবহার বন্ধে এবং দলীয় আয়-ব্যয়ের যথার্থতা যাচাইয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরিপূর্ণভাবে ক্ষমতায়িত করা দরকার।

রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামোকেও নিজস্ব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারির ব্যাপারে শক্তিশালী করা উচিত, যাতে আর্থিক ভ্রান্তি পরিহার করে বিধান অনুযায়ী নথি সংরক্ষণে, হিসাব নিরীক্ষণে ও প্রতিবেদন দাখিলে পেশাদারি বিধি অবলম্বন করা যায়।

পঞ্চমত, অন্য যেসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা হচ্ছে দলীয় অর্থায়নে বহিঃস্থ তদারকির ব্যবস্থা, ব্যক্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে উন্মুক্তভাবে ডোনেশন গ্রহণ, নিরীক্ষাকৃত হিসাব ও প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ, ইন্টারনেট ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহ সম্প্রসারণ ইত্যাদি।

সিভিল সমাজ, সিভিক গ্রুপ এবং সংগঠিত আন্দোলনের ধারায় সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রয়োজনীয় চাপের মধ্যে রাখা, যাতে জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অনুসরণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। এই সামাজিক শক্তি একইভাবে রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক সংস্কার আনয়নে বাইরে থেকে অনুপ্রেরণা ও সমর্থন জোগাতে পারে। রাজনৈতিক দলীয় কাঠামো চর্চার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রসম্মত না হলে এবং আর্থিকভাবে দায়িত্বশীলতা প্রমাণ না করলে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক দলীয় অর্থায়নে কাঠামোগত সংস্কারসহ দলীয় বিষয়াদির ওপর নিয়মিত গবেষণা পরিচালনা এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞানের বিস্তার আবশ্যক। কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাসহ নির্দিষ্ট সময় অন্তর পর্যালোচনা ও বহিঃস্থ স্টেকহোল্ডাররা (সিভিক গোষ্ঠী, মিডিয়া ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী) নিয়মিত তদারকি দলের অবৈধ অর্থায়নের বিরুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। দলীয় অর্থায়নে নৈতিকতার মানদণ্ড অনুসরণ একান্তভাবে প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ বিশেষভাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ ও এর স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং বিচারিক কাঠামোর যথাযথ ভূমিকা পালন রাজনৈতিক অর্থায়নে দুর্নীতি প্রতিরোধে এবং দলে ও দেশের অরাজনৈতিক তস্কর শ্রেণীর অনুপ্রবেশ বন্ধে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত রাখতে পারে।

টীকা

১. ২০০৯ সালে আরপিওতে তৃণমূল পর্যায়ে (ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা/উপজেলা বা জেলা কমিটি পর্যায়) প্রস্তুতকৃত প্যানেল থেকে প্রার্থী বাছাইয়ের বাধ্যতামূলক অংশটি বাতিল করা হয়।

২. ফরম-২০: [বিধি ২৯(১)]-এ নির্বাচনী ব্যয় নির্ধারণের জন্য অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাব্য উেসর বিবরণী উল্লেখ করা আবশ্যক। এ ফরমের ছয়টি অংশে প্রার্থীর নিজস্ব আয়, আত্মীয়স্বজন থেকে ধার-কর্জ ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দান, আত্মীয়স্বজন ব্যতীত অন্যান্য ব্যক্তি থেকে ধার-কর্জ বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দান এবং এসব উত্স থেকে সম্ভাব্য অর্থপ্রাপ্তি-সংক্রান্ত তথ্যদানের বিষয় রয়েছে।

   ফরম-২১: [বিধি ২৯(২)]-এ প্রার্থীর সম্পদ ও দায় এবং বার্ষিক আয় ও ব্যয়ের বিবরণী চাওয়া হয়। এ ফরম গৃহসম্পত্তি ব্যতীত অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি, গৃহসম্পত্তি, অন্যান্য সম্পদ, দায়সমূহের প্রকৃতি ও পরিমাণ এবং মোট আনুমানিক বার্ষিক আয় ও ব্যয়ের সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান আবশ্যক।

তথ্যসূত্র

Bangladesh Country Report, December 2004, pp. 7-8.
Corruption and Funding of UK Political Parties, The Coalition Against Corruption, TI, UK, October 2006.
Federal Election Commission of the USA, Washington DC.
‘Funding and Disclosure Guide for Political Parties,’ Australian Election Commission, Australia, Version-1, July 2009, p. 3.
Gene Ward, ‘Overview of Disclosure and Transparency in Political
Funding in Latin America,’ Vancouver, Canada, 5-6 December 2002.
Hasanuzzaman and Alam, Political Management in Bangladesh, (Dhaka: AH Development Publishing House, 2010).
Marcin Walecki, ‘Challenging the Norms and Standards of Election Administration: Political Finance’, in Challenging the Norms and Standards of Election Administration (IFES, 2007), pp. 75-93.
ibid, p. 1.
Menachem Hofnung, ‘Public Financing, Party Membership and Internal Party Competition,’ European Journal of Political Research, Jan. 2006.
Money and Politics: The Case of Party Nomination in Kenya (mimeo), pp. 1-3. http://www.ndi.org/files1880_ke_cgdnominations.pdf
Muzaffer Ahmad, ‘Political Party Finance’, The Daily Star, Dhaka, 02 Feb. 2010.
National Democratic Institute Paper, 2001.
Oonagh Gay, Richard Kelly and Isobel White, ‘The Funding of Political Parties,’ Research Paper 07/34, 10 April, 2007, London, pp. 23-24.
Shari Bryan and Denise Baer, eds., ‘Money in Politics: A Study of Party Financing Practices in 22 Countries,’ National Democratic Institute, 2005, pp. 1-10.
Steve Gibbs, ‘Bangladesh Political Party Assessment,’ International Republican Institute, May, 2008, pp. 4-7.
Sunday Opinion: New Thoughts on Political Parties’ Funding (mimeo).
Transparency International, ‘Working Paper Number-10,’ 2008, p. 1.
Transparency International Bangladesh, ‘Transparency in Political Party Finance in Bangladesh,’ October 2009, pp. 15-16.
Transparency International Policy Brief, Number-1/2005, p.1.

জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অধ্যায় ৩ অ, ইলেকশন এক্সপেনসেস, ৪৪ এএ, ৪৪ বিবি, ৪৪ সিসি।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যমে গৃহীত তথ্য রিজিওনাল স্টাডিজ ভলিউম ঢঢঢ নম্বর-১, ২০১১-১২, পৃ. ৮৯-১১৬।