গণতন্ত্র, উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রশক্তি ও রাজনৈতিক উন্নয়ন: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের বিশ্লেষণই এই প্রবন্ধের মুখ্য বিষয়। এ প্রবন্ধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রশক্তি, রাজনৈতিক উন্নয়নের অবস্থা পর্যালোচনা, ক্ষমতার যুক্তিসংগত বিন্যাস, রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নিয়মতান্ত্রিকতা, রাজনৈতিক জগত্ ও সামাজিক জগতের যোগসূত্র বা আন্তসম্পর্কের মান ইত্যাদি মাপকাঠিতে বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক উন্নয়নব্যবস্থার একটি মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, তার অনুসন্ধানের প্রচেষ্টাটি প্রবন্ধে রয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক উন্নয়নের বিশ্লেষণ কাঠামোর ঘাটতির দিকটিকে প্রবন্ধে গুরুত্ব দিয়ে তুলে আনা হয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: রাজনৈতিক উন্নয়ন, ক্ষমতাকাঠামো, বিশ্লেষণী কাঠামো, রাজনৈতিক উন্নয়নের সূচক, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

সূচনা

বাংলাদেশকে নিয়ে আজ অনেকে চিন্তিত। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখনো অনেকে চিন্তিত ছিলেন, তবে চিন্তার কারণ ছিল ভিন্ন। স্বাধীনতার প্রাথমিক পর্বে দুশ্চিন্তা ছিল মূলত অর্থনৈতিক ভবিষ্যেক ঘিরে। ৪২ বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যপীড়িত, সংকটাপন্ন ভঙ্গুর অর্থনীতি দৃশ্যমানভাবে অগ্রসর হয়ে এক ভিন্ন সক্ষমতা ও সবলতায় উপনীত হয়েছে। এই অর্জন এক দিনে আসেনি। কারও একক প্রচেষ্টায়ও নয়। তবে সে এক ভিন্ন গাথা। অর্থনীতি এগোলেও রাজনীতি রয়ে গেছে তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর। বিষয়টি আরও মূর্ত হয়ে উঠেছে এই জন্য যে তিন-তিনবার—১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০৮—রাজনৈতিক নবযাত্রার সুযোগ পেয়েও দেশ ও রাষ্ট্র আজ এক নতুন এবং সম্ভবত গভীরতর সংকটের সম্মুখীন। আজকের দুশ্চিন্তা তাই রাজনীতি ও রাজনৈতিক গতিধারাকে ঘিরেই।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের ডিসকোর্স

বাংলাদেশের এই সংকট রাষ্ট্রবিজ্ঞান ডিসকোর্সের কাছে বিষয় হিসেবে অপরিচিত নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসনের পশ্চাদপসরণের সময় থেকেই অনুন্নত দেশসমূহ তথা তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক বিবর্তন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে অন্যতম একটি আলোচ্য বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। নানা দৃষ্টিভঙ্গি ও নানা টানাপোড়েনে প্রভাবিত এই ডিসকোর্সের বিকাশ অবশ্য কোনো সরলরেখায় হয়নি। প্রাথমিকভাবে আধুনিকায়ন তত্ত্বের অতি আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য থাকলেও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জটিল ও অনিশ্চিত সমীকরণই বিতর্ক ও ব্যাখ্যার মুখ্য উপজীব্য হয়ে ওঠে। হান্টিংটনের ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘পলিটিক্যাল অর্ডার ইন চেইনজিং সোসাইটিজ’, এখানে ডিসকোর্সের অন্যতম পরিবর্তনের বাঁক হিসেবে ভূমিকা রাখে।১ বিশেষ করে রাজনৈতিক উন্নয়নের (political development) পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষয়িষ্ণুতার (political decay) সম্ভাবনাও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।

বাস্তবেও উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনৈতিক বিবর্তন কোনো ঐকিক রেখায় অগ্রসর হয়নি। বিশ্বায়ন, মাল্টিপোলার অর্থনৈতিক ও শক্তি কাঠামোর আবির্ভাব, প্রযুক্তি বিপ্লব, প্রাকৃতিক ভূসম্পদ বিশেষ করে তেল-গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অসম প্রতিযোগিতাসহ আরও অনেক কাঠামোগত ও গভীর নতুন উপাদানের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনৈতিক বিবর্তনের বিষয়টি হয়ে উঠেছে আরও জটিল ও পূর্বাভাসের (prognosis) দৃষ্টিকোণ থেকে আরও কঠিন। এই জটিলতার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথাগত সীমানা অতিক্রম করে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব (political sociology), কালচার স্টাডিজ ইত্যাদি নতুন নতুন জ্ঞান- ক্ষেত্র (domain) নির্মাণে উদ্যোগী হয়।২ তবে এ-ও সত্যি যে, অনেক বিশ্লেষক সারগর্ভ ব্যাখ্যার চেয়ে নিছক নতুন নতুন বিশেষণ প্রয়োগেই ঝুঁকে পড়েন, যথা ছদ্ম গণতন্ত্র, নির্বাচনী গণতন্ত্র, অনুদার গণতন্ত্র, নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ ইত্যাদি।৩ অন্যদিকে ১৯৮৯-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কিছু কিছু অতি উত্সাহী পশ্চিমা তাত্ত্বিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে এই সিদ্ধান্ত টেনে রাজনৈতিক বিবর্তনের পুরো বিষয়টি সমাপ্ত বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যা পরবর্তী সময়ে ভুল প্রমাণিত হয়।৪ ফুকুয়ামা, যিনি উপরিউক্ত ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অবশ্য পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনবিষয়ক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ নতুন উপাদান সংযোজন করেন।৫

রাজনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

সমকালীন ডিসকোর্সে রাজনৈতিক উন্নয়নের নানা সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ঘুরেফিরে তিনটি মৌলিক সূচক রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারণাকে সুনির্দিষ্ট করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রথমটি হচ্ছে ক্ষমতার যুক্তিসংগত বিন্যাস বা হান্টিংটনের ভাষায় রেশনালাইজেশন অব অথরিটি। এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতা প্রয়োগের নিয়মতান্ত্রিকতা ও ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে প্রয়োজনীয় ভারসাম্য। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সূচকটি হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সবলতা ও বিকাশ বা রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া (state building)। এখানে নিছক আমলাতন্ত্রের বিকাশের কথা বোঝানো হচ্ছে না। বরং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রশ্নটিকেই মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। তৃতীয় সূচকটি হচ্ছে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের (political participation) পরিধির বিস্তার। এখানেও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলতে শুধু ভোটাধিকারের বিষয়টি একমাত্র বিবেচ্য হিসেবে ধরা হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিবিধ ক্ষেত্রে সুযোগ ও প্রবেশাধিকারের প্রশ্নগুলোর দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে। উপরিউক্ত তিনটি মৌলিক সূচকের বাইরে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক এখানে বিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমত, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নিয়মতান্ত্রিকতা ও দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক জগত্ ও সামাজিক জগতের যোগসূত্র বা আন্তসম্পর্কের মান।

রাজনৈতিক উন্নয়নের উপরিউক্ত সূচকসমূহের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের বাস্তবতা, বিশেষ করে ১৯৯০-পরবর্তী সময়কালের মূল্যায়ন কী হবে? প্রথমেই ধরা যাক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সূচকটি। এখানে অবশ্যই রাজনৈতিক উন্নয়নের একটি ন্যূনতম অগ্রগতি লক্ষ করা যায় যে গত ২০ বছরে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল একটি টেকসই দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এটি অবশ্যই একধরনের অর্জন, তবে রাজনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে শুধু এই অর্জনই বিবেচনায় রাখলে খুবই একপেশে একটি মূল্যায়ন হবে। এখানে অন্যতম বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে নির্বাচনী প্রতিযোগিতাসংক্রান্ত নিয়মাবলি তথা রুলস অব দ্য গেম নিয়ে প্রতিযোগীদের মধ্যে মতৈক্য ও এসব নিয়মের সুস্থিততা। এ ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা কী?

১৯৯০ থেকে চার-চারটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও নির্বাচনী রুলস অব দ্য গেম নিয়ে আমরা কোনো সুস্থির অবস্থানে উপনীত হতে পারিনি। প্রতি নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল চেষ্টা করেছে রুলস অব দ্য গেম নিজের মতো করে সাজাতে। এই প্রবণতার ফলে প্রথম ধাক্কা আসে ১৯৯৬ সালে, যার সমাধান হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। ২০০৬-এ কিন্তু এই সমাধানও সংকট রোধ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এই সংকটের সমাধান হয় এক-এগারো খ্যাত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ২০০৮-এর নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় আবারও নির্বাচনী প্রতিযোগিতার রুলস অব দ্য গেম সংক্রান্ত সংকট। এই যে বারবার সংকট তৈরি হচ্ছে, আমরা ঠেকনা দেওয়ার মতো কিছু চটজলদি সমাধান খুঁজে বের করছি, এর থেকেই রাজনৈতিক উন্নয়নের এই অন্যতম সূচকের বেহাল দশা বোঝা যায়।

রাজনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম আরেকটি সূচক হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সবলতা বৃদ্ধি তথা রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া। অর্থাত্ রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব এবং যেসব কাঠামোর ওপর এই অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, যেমন: বিচারব্যবস্থা, সংসদ, আমলাতন্ত্র, স্থানীয় সরকার ইত্যাদির ধারাবাহিক মানোন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অগ্রগতি রয়েছে।৬ কিন্তু গত নির্বাচনী গণতন্ত্রের দুই দশকের বেশি অভিজ্ঞতায় রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়ার এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সূচকে একটি নেতিবাচক প্রবণতা ধারাবাহিকভাবে গেড়ে বসতে দেখা গেছে, যার ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন মৌলিক প্রতিষ্ঠানের মান ক্রমাগতভাবে নিম্নমুখী। এই প্রবণতা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কৌশল হিসেবে পক্ষপাতদুষ্ট নিয়োগের প্রবণতা ও তারই সুযোগে নিয়মের ব্যত্যয় ও অযোগ্যদের ব্যাপকভাবে প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বে সুযোগ করে নেওয়া। প্রথমে এটি কিছুটা লুকোছাপা ছিল। এখন কিছুই তোয়াক্কা না করার মানসিকতা এসে গেছে। আগে হয়তো আমলাতন্ত্রের একটি অংশ নিয়ে সমস্যা ছিল। এখন ধাপে ধাপে এই সমস্যা সর্বজনীন হয়েছে। বিচারব্যবস্থাতেও এই রোগ সংক্রমিত হয়েছে। আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাঙ্গন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান—কোনো ক্ষেত্রই যেন এই সর্বনাশা প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়। এই সর্বশেষ নির্বাচনী চক্রে (cycle), অর্থাত্ ২০০৯-২০১৩ সালের সময়কালে নিয়োগ-সিদ্ধান্তের মানের ধস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সবলতার জন্য এ এক কাঠামোগত বিপর্যয়ের সমান। এই নেতিবাচক প্রবণতার মধ্যেও কিছু কিছু খাত, যেমন ব্যাংকিং, কার্যকারিতার দিক থেকে উন্নতিই লাভ করেছিল। কিন্তু এবার এসব খাতও বিপর্যয় এড়াতে পারেনি। বর্তমান ব্যাংকিং সেক্টরের বেহাল অবস্থা থেকেই বাস্তবতা কোথায় দাঁড়িয়েছে সহজে অনুমান করা যায়।

রাজনৈতিক উন্নয়ন মূল্যায়ন করার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে যুক্তিসংগত ভারসাম্য ও জবাবদিহির নিশ্চয়তা। এক দিক থেকে বলতে গেলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো বাংলাদেশে বিদ্যমান আছে। নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা বা সংসদ, বিচার বিভাগ ছাড়াও বেশ কয়েকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি রয়েছে, যথা নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি। ভারসাম্য ও জবাবদিহির এই প্রাতিষ্ঠানিক অবয়বের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি থাকলেও স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অব্যাহত প্রবণতা হয়েছে ক্ষমতার বিন্যাস ও প্রয়োগে নিরন্তর এককেন্দ্রিকতা। এই প্রবণতা সর্বশেষ নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনামলেও শুধু যে অব্যাহত ছিল তা নয়, এককেন্দ্রিকতা কার্যত রাষ্ট্রের মৌলনীতিতে উপনীত হয়েছে। এই প্রবণতা সর্বোচ্চ রূপ পেয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী একাধারে নির্বাহী প্রধান, আইনসভা প্রধান (সংসদ নেতা), নিয়োগ ক্ষমতা ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন অনুমতির ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার সুবাদে বিচার বিভাগের একচ্ছত্র প্রভাবের অধিকারী ও দলীয় প্রধান। এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অসম্ভব ক্ষমতাধর এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে, যার প্রভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিছক আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্ষমতার এই এককেন্দ্রিকতা আরও উত্সাহিত হয়েছে পুরো রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক জগতে এক মনস্তাত্ত্বিক আবহ তৈরি হওয়ার মাধ্যমে, যেখানে তোষামোদি দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে সহজাত প্রবণতা এবং ভিন্নমত প্রদর্শনের সাহসিকতা একেবারে অনুপস্থিত। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান-প্রধানেরা জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আজ্ঞাবহ হওয়া ও তার মাধ্যমে পদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়তা তৈরিতেই মনোনিবেশ করেছেন।

রাজনৈতিক উন্নয়নের এই সূচকে তাই দেখা যাচ্ছে দুই দশকেরও বেশি সময়কাল ধরে বিদ্যমান সংসদীয় গণতন্ত্রে ভারসাম্যহীন ও চরমভাবে কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাকাঠামোই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জোরদার হয়েছে এবং তা শুধু রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরে নয়, রাজনৈতিক দল পরিচালনার ক্ষেত্রেও। রাজনৈতিক প্রতিযোগীর উপস্থিতি এবং গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজে ভিন্নমত প্রকাশের একটি প্রবণতা সচল থাকায় বিদ্যমান রাজনৈতিক শাসনকে চিরায়ত স্বৈরতান্ত্রিক মডেলে রূপান্তরিত হতে হয়তো কিছুটা বাধা দিচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে ক্ষমতার বিন্যাস ও প্রয়োগের প্রবণতা দেখলে এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশ রাজনৈতিক উন্নয়নের এই সূচকের ক্ষেত্রে উল্টো পথেই হাঁটছে।

রাজনৈতিক উন্নয়নের সর্বশেষ যে সূচকটি নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গতিধারার মূল্যায়ন করা যায়, তা হলো রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে সামাজিক জগতের আন্তসম্পর্ক। এই আন্তসম্পর্ক থাকার অর্থ হলো, রাজনীতি একটি সুস্থ সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যোগাযোগটা ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক যে তৈরি হচ্ছে না সেটার পেছনেও কাজ করছে প্রথম সমস্যাটা, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নিয়মগুলো কেউ মানছে না। এখন যেমন তত্ত্বাবধায়ক মানা হচ্ছে না, নিজের সুবিধামতো নিয়ম ঠিক করা হচ্ছে। এতে সুস্থ প্রতিযোগিতা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অথচ প্রতিযোগিতা তো চলবেই সমাজে। রুলস অব দ্য গেম স্থির না হওয়ার ফলে প্রতিযোগীরা বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী; যেমন: নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, ধর্মীয় গোষ্ঠী, তরুণ প্রজন্ম; এদের দলে টানার চেষ্টা করছে। ফলে এত দিন ধরে রাজনৈতিক পরিসরে মারামারি-কাটাকাটির পাশে আমাদের যে একটা সান্ত্বনা ছিল, সামাজিক জগত্টা অন্তত শান্ত আছে, সেই সান্ত্বনাটুকুও নষ্ট হচ্ছে। অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে পেশাজীবী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এখন নানা রকম বিভাজন—একজন এই দলের, তো অন্যজন আরেক দলের। শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি, আমলাদের মধ্যে দলাদলি। এটা আইনজীবী, বিচারপতি এদের মধ্যে আগে ছিল না, এখন আদালত প্রাঙ্গণেও এই সংকীর্ণ দলীয় বিভাজনের সংস্কৃতি গেড়ে বসেছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার অব্যাহত অবনতি ঘটাচ্ছে। এর ফলে সামাজিক জগত্ বাইরে থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রটিকে নিয়মতান্ত্রিক হওয়ার যে প্রণোদনাটি দিতে পারত, সেটার ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। রাজনীতির ময়দানের অগ্রহণযোগ্য প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি সমাজের মধ্যে ঢুকে গেছে।

বিশ্লেষণী কাঠামোর ঘাটতি

রাজনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের যেসব ঘাটতি ও অবনতি পূর্ববর্তী আলোচনায় ফুটে উঠেছে, তার নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষকেরা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এসব ব্যাখ্যা মূলত এসেছে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি (institutional economics), মার্ক্সীয় শ্রেণী ব্যাখ্যা ও তুলনামূলক রাজনীতির (comparative politics) তাত্ত্বিক ধারা থেকে।৭ এসব বিশ্লেষণ রাজনৈতিক অনুন্নয়নের যেসব ব্যাখ্যা তুলে ধরছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর অনুপস্থিতি, এলিট সমঝোতার ব্যর্থতা ও সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি। এসব ব্যাখ্যা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দুটি বড় ঘাটতি লক্ষ করা যায়।

প্রথম ঘাটতি শুধু বাংলাদেশ অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ নয়। বরং অন্যান্য অনেক উপনিবেশোত্তর প্রেক্ষাপটেও সমভাবে প্রযোজ্য। পশ্চিমা বিশ্বের জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) গঠন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন (nation-formation) ও রাষ্ট্র নির্মাণের প্রশ্ন (state-formation) মৌলিকভাবে একে অপরের সম্পূরক প্রক্রিয়া হিসেবে কার্যকর ছিল।৮ এটি সম্ভব ছিল এই কারণে যে, একই রাজনৈতিক শক্তি আত্মপরিচয় নির্মাণের ‘রাজনৈতিক’ কাজটি ও রাষ্ট্র নির্মাণের ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ কাজটি একটি অভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র দর্শনের আওতায় সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অনেক উপনিবেশোত্তর দেশে জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণের এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় একটি মৌলিক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।৯

ঔপনিবেশিক শাসনের পশ্চাদপসরণের দীর্ঘ সময়কালে ঔপনিবেশিক শক্তি চাপের মুখে উদীয়মান জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের জন্য রাজনীতির একটি ক্ষেত্র (space) ক্রমাগতভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও রাষ্ট্র নির্মাণের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রটি, অর্থাত্ রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব ও এর মৌলিক চরিত্রের প্রশ্নে সমান্তরালভাবে পিছু হটেনি।১০ এখানে উল্লেখ্য যে ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় নির্মিত রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র ছিল মূলত নিয়ন্ত্রণমূলক। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ছাড় কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে নয়, এই দ্বৈত প্রবণতার ফলে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সুযোগ, আগ্রহ ও পরিশ্রম একতরফাভাবে নিয়োজিত হয় আত্মপরিচয় নির্মাণের রাজনৈতিক কাজটিতে। তুলনামূলকভাবে জাতি-রাষ্ট্র বিকাশের অন্যতম অন্যদিক, অর্থাত্ রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও মৌলিক চরিত্রের যুগোপযোগী পরিবর্তনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের আগ্রহ ও নাগালের বাইরে থেকে যায়। কিছু কিছু উপনিবেশোত্তর জাতি-রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পরবর্তী সময়ে এই কৌশলগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠে, অর্থাত্ জাতি-পরিচয় নির্মাণ ও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিকাশ এই দুই মৌলিক প্রক্রিয়াকে সমগুরুত্বে ও সমান্তরালভাবে নিজেদের আয়ত্তে আনতে সফল হয়। এ ধরনের সফল উত্তরণের অন্যতম উদাহরণ মালয়েশিয়া। কিন্তু উপনিবেশোত্তর অনেক জাতি-রাষ্ট্রে এই সফলতা প্রতিষ্ঠা পায়নি।১১

জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় এই বিপরীতমুখী প্রবণতা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অতি-আগ্রহ ও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও বিকশিত করায় নিষ্ক্রিয়তা বা অপারগতা, যে উপনিবেশোত্তর ইতিহাস রচনাকে প্রভাবিত করেছে তাতে দেখতে পাই একদিকে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি তথা identity politics কে স্বাধীনতা সুসংহতকরণ ও উন্নয়নের সমার্থক হিসেবে দেখার প্রবণতা ও অন্যদিকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক চরিত্রের উপনিবেশোত্তর সময়কালেও অক্ষুণ্ন ধারাবাহিকতা। আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে অতি আগ্রহের ফলে উপনিবেশোত্তর সময়কালে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক উপস্থিতির উন্নতি ও পরিশীলিত করার ধারাবাহিক কাজটি সময়ের পরম্পরায় গৌণই থেকে গিয়েছে। এরই ফলে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক উপস্থিতির সময়কাল বাড়তে থাকলেও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সবলতা মৌলিকভাবে দুর্বল থেকে গেছে।

রাষ্ট্রের রূপক হিসেবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরলে বিষয়টি বোঝাতে সুবিধা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষা ও এর মান। শিক্ষা ও এর মান বৃদ্ধির এই মৌলিক কাজটির জন্য অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবসম্পদ কাঠামোর কার্যকারিতার ধারাবাহিক উন্নতি ও বিকাশ। এখন সেখানে যদি একটি ছাত্রাবাসের নাম কী হবে, সেটাই সর্বোচ্চ সমস্যা ধরে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন চলতে থাকে, তাহলে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মূল উদ্দেশ্য—শিক্ষার মান—তার অবস্থা দাঁড়িয়েছে অত্যন্ত করুণ পর্যায়ে। এ রকম সমন্বয়হীন সমাজেই আত্মপরিচয় ইস্যুগুলো নিত্যনতুন অস্থিরতার জন্ম দেয়।

শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, উপনিবেশোত্তর আফ্রিকাতেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে একসময় বড় একটা রাজনৈতিক প্রবণতা দেখা গেল, নতুন নামকরণের মাধ্যমে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে সমাধানের একটি পথ হিসেবে গ্রহণ করা। কঙ্গো নামের দেশটিকে ওই সময়ে নতুন নাম দেওয়া হয় জাইয়ের। মোবুতু বলে এক চরম দুর্নীতিবাজ শাসক বেশ ঘটা করে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির এই নাটক করেছিলেন। দেশের নাম বদলে রাখলেন জাইয়ের, নিজের নামও বদলে করলেন মোবুতু সেসে সেকো। অবশ্য ইতিহাস দেখিয়েছে, এতে দেশের ভাগ্য বদলায়নি। আজ কঙ্গো সম্ভবত আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল দেশের মধ্যে অন্যতম।

আত্মপরিচয়ের এই একপেশে ও অস্থির রাজনৈতিক প্রবণতারই আরেকটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পক্ষপাতদুষ্ট ও অপেশাদারি ইতিহাস-বিতর্ক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম স্পর্শকাতর বিতর্ক তৈরি হয়েছে আমাদের মুসলিম সত্তা ও বাঙালি সত্তা আত্মপরিচয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে সাংঘর্ষিক কি না? এখানে অনেকে ভুলে যান আত্মপরিচয় সব সময় একটি বহুমাত্রিক বিষয় এবং এই বহুমাত্রিকতার জোরপূর্বক সমাধান কোনো সঠিক চিন্তা হতে পারে না।১২ একটি বক্তব্য আজকাল শোনা যায় যে ১৯৪৭-কে ভুল প্রমাণিত করেছে ১৯৭১। অর্থাত্ ১৯৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের ঐতিহাসিক যুক্তি নাকচ করেছে। ইতিহাসের নির্মোহ ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণে এই বক্তব্য কতটুকু সঠিক? সার্বিক বিবেচনায় সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, সাতচল্লিশের ভেতর দিয়েই একাত্তর জন্ম নিয়েছে। ১৯৪৭-এর প্রেক্ষাপটে মুসলিম পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া রাজনৈতিকভাবে যুক্তিসংগত ছিল, যদিও দেশ বিভাগের যে ভৌগোলিক পরিণতি শেষ অব্দি হলো তা অবশ্যম্ভাবী ছিল না। ১৯৪০-এর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অধিবেশনে শেরেবাংলা কর্তৃক উত্থাপিত সুবিখ্যাত লাহোর প্রস্তাবে তত্কালীন বেঙ্গলকেও আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়ার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।১৩

১৯৪৭-এর দেশ বিভাগে মুসলিম পরিচয় প্রাধান্য পেয়েছিল বটে, তবে সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের চালিকাশক্তি কারা ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই, কৃষকসমাজ ও তার ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই কৃষকেরা, এই মধ্যবিত্তরা কারা ছিল? এরা ছিল বাংলারই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। তারা তাদের শ্রেণী অবস্থান থেকে স্বপ্ন দেখেছিল আলাদা একটি রাষ্ট্রসত্তার ভেতর দিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদলানোর। তখনকার প্রেক্ষাপটে মুসলিম সত্তাই তাদের আত্মপরিচয়ের অবস্থানটি তুলে ধরতে সহায়ক ছিল। কিন্তু মুসলিম সত্তা সামনে থাকলেও পেছনের শ্রেণী বাস্তবতা ক্রিয়াশীল ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোতে যখন পাঞ্জাবি এলিটদের নিয়ন্ত্রণ আমাদের প্রাদেশিক ও সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা অস্বীকার করতে চাইল ও এই এলিট নিয়ন্ত্রকের সুবিধাভোগী তাত্ত্বিকেরা জোর করে একমাত্রিক আত্মপরিচয় চাপিয়ে দিতে চাইল, তখন সেই একই কৃষক/মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও তার বংশধরেরা নিজেদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি সত্তাকে সামনে নিয়ে এসেছিল। বহুমাত্রিক আত্মপরিচয়ের একেক দিক একেক সময় নিয়ামক হয়ে ওঠে, তখন অন্য দিকগুলো অবৈধ হয়ে গেল তা কিন্তু নয়। এখানেই পক্ষপাতদুষ্ট ও একপেশে আত্মপরিচয় বিতর্কের সমস্যা। এ ধরনের বিতর্ক ও রাজনীতি যখন মুখ্য হয়ে ওঠে, তখন রাজনৈতিক ম্যানিপুলেশনের সুযোগগুলোও অনেক বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনুন্নয়নের প্রচলিত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় আরও একটি ঘাটতি প্রতীয়মান, যেটিও আলোচনার দাবি রাখে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন সুদীর্ঘ সময়কাল ধরে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তার অন্যতম এবং মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার বিন্যাসে প্রশাসনিক ও পুলিশি কর্তৃত্বের বিপরীতে বিচার বিভাগের তুলনামূলক দুর্বলতর অবস্থান।১৪ প্রশাসনিক-পুলিশ কর্তৃত্বের এই আধিপত্য গড়ে উঠেছিল যে চারটি উপাদানের ভিত্তিতে সেগুলো হলো: ক. বিচার বিভাগীয় উপস্থিতির তুলনায় কাঠামোগতভাবে পুলিশের গভীরতর উপস্থিতি, খ. ফৌজদারি বিচার এবং প্রশাসনিক কার্যের সম্মিলন, গ. ফৌজদারি আইনের ব্যাপক প্রয়োগের সুযোগ এবং ঘ. ১৮৫৯ থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে জেলায় দেওয়ানি বিচার ছাড়া আর সব কার্যক্ষমতা একটি মাত্র নির্বাহী প্রধান অর্থাত্ সর্বব্যাপী জেলা কর্মকর্তার হাতে কেন্দ্রীভবন।

ওপরে বর্ণিত রাষ্ট্রক্ষমতার গতিধারা সম্পর্কে যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা থেকে আইন দ্বারা পবিত্রকৃত এক ‘প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের’ চিত্রই ফুটে ওঠে। ঔপনিবেশিক সময়কালে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সূচনালগ্ন থেকে সুুুুুুুুুুুুনির্দিষ্ট দাবি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ জেলা প্রশাসনের কাঠামোর পরিবর্তন। প্রথমত, প্রশাসনিক ও ফৌজদারি বিচার বিভাগের পৃথক্করণ এবং দ্বিতীয়ত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর প্রসার। কিন্তু বাস্তবে এই দাবি পূরণ হয়নি। এই দাবির সপক্ষে যুক্তি ছিল যে প্রশাসন এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সম্মিলনের কার্যত অর্থ হলো, ‘পুলিশের তদন্ত, ম্যাজিস্ট্রেটের জিজ্ঞাসা এবং আদালতের বিচার বাস্তবে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত এবং প্রায়ই এক ব্যক্তির মধ্যে সমন্বিত হয়।১৫ অভিশংসক বা আদালতে অভিযুক্তকারী এবং বিচারকের কার্যের এই আইনগত সম্মিলনের মধ্যে ছিল শাস্তিদাতা শক্তি যাকে আমরা প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছি এবং এটা বোধগম্য যেকোনো জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যে এই ক্ষমতাকে পৃথক করার দাবি ওঠা উচিত। ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই দাবি পূরণ করা হয়নি। তার পরিবর্তে চাপের মুখে ঔপনিবেশিক শাসকেরা এমনভাবে পদক্ষেপ দিল এবং কর্মনীতি উদ্ভাবন করল যার ফলে নির্বাচিত আইনসভার জন্য সীমিত রাজনৈতিক সুযোগ দেওয়া হলো কিন্তু জেলার বিচার এবং বিভিন্ন কার্যসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের ওপর জেলা প্রশাসন এবং প্রশাসনিক-পুলিশি কর্তৃপক্ষের শাস্তিদানমূলক আধিপত্য বহাল রাখা হলো। এই অবস্থা ১৯৪৭-এ ক্ষমতার ‘শান্তিপূর্ণ’ হস্তান্তরের দিন পর্যন্ত প্রায় সম্পূর্ণরূপে অপরিবর্তিত থাকল।১৬ কম-বেশি এই একই অবস্থা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও অপরিবর্তিত রইল।

রাষ্ট্রক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসে এই ‘প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের’ বাস্তবতার বিপরীতে স্থানীয় সরকারগুলো একটি শাসনক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাকারী (counter vailing) কাঠামো হিসেবে গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামলে তো নয়ই, উপনিবেশোত্তর শাসনামলেও এমনকি নির্বাচনী গণতন্ত্রের আমলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের পছন্দ রয়ে গেল ভারসাম্য রক্ষাকারী স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় নয়, বরং সেই প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র ব্যবস্থাপনায় যেখানে পুলিশি ও ফৌজদারি ক্ষমতা কার্যকরভাবে নির্বাহী নেতৃত্বের আওতাভুক্ত ও যেখানে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহারের ওপর বিচার বিভাগের অর্থবহ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত সীমিত।

রাজনৈতিক অনুন্নয়নের বিশ্লেষণের প্রশ্নে উপরিউক্ত প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের এই বিষয়টি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য এই অর্থে যে এই ‘প্রশাসনিক স্বৈরতান্ত্রিক’ ক্ষমতা আজ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনী জয়ের পর প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের বাস্তবতার বিপরীতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে জয়ী দলের সহজাত প্রবণতা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রতিযোগীকে ঘায়েলের জন্য ‘প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র’ কাঠামোর ক্রমাগতভাবে যথেচ্ছ ব্যবহার, এমনকি এ ধরনের ক্ষমতাকাঠামোর আরও বিপজ্জনক বিস্তার। মিথ্যা মামলা, পুলিশি হয়রানি, পক্ষপাতদুষ্ট ফৌজদারি বিচার, পুলিশি ক্ষমতার পরিধি বিস্তার—এগুলো হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক শাসনের অন্যতম পরিচায়ক এবং তা এই গণতান্ত্রিক শাসনামলেই। প্রতিটি নির্বাচনী চক্রে আমরা এই প্রবণতার অবনতি দেখছি, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে অনেকটা কাঠামোগতভাবে অমোঘ করে তুলেছে।

উপসংহার: বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ভবিষ্যত্

বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ভবিষ্যত্ মূল্যায়ন সহজ ব্যাপার নয়। ৪২ বছরে বাংলাদেশের ঝুলিতে বেশ কিছু শক্তির দিক সঞ্চিত হয়েছে। অর্থনীতির একটি ভিত্তি তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে এবং নিজেদের আয়নাতেও দারিদ্র্যপীড়িত আশাহীন একটি দেশের পরিবর্তে অগ্রসরমান দেশ (a country on the move), এই ভাবমূর্তিতে অধিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়েছে। একই সঙ্গে ১৯৭১-এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে বাংলাদেশে একধরনের আকাঙ্ক্ষার বিপ্লব চলমান হয়েছে, যা ধাপে ধাপে সমাজের দরিদ্রতম অংশকেও প্রত্যয়ী (assertive) করে তুলেছে।

এসব আশাব্যঞ্জক প্রবণতার বিপরীতে রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে একধরনের কাঠামোগত অস্থিতিশীলতা দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিয়েছে। ১৯৯১-এ নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের পর এই বাস্তবতায় তেমন পরিবর্তন হয়নি, বরং কিছু কিছু দিক থেকে গভীরতর অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে। তিনটি প্রবণতা এখানে বিশেষভাবে বিবেচ্য। প্রথমত, নির্বাচিত নেতৃত্বের দেশ পরিচালনক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ তথা একনায়কতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা থেকেই হচ্ছে। অন্যদিকে মাঠ-বাস্তবতা বলছে, এখানে একনায়কতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা চিরস্থায়ী করার সক্ষমতা শেষ বিচারে কোনো পক্ষেরই নেই। বাংলাদেশের ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে চারটি প্রধান গোষ্ঠীর কথা চিন্তা করা যায়: দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের মাঠ-বাস্তবতা হচ্ছে, এদের মধ্যে কোনো একটি গোষ্ঠীর পক্ষে অন্য তিনটি গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদি করার কোনো সম্ভাবনা নেই, নিছক রাজনৈতিক শক্তির (brute force) দৃষ্টিকোণ থেকে এত সক্ষমতা একক কোনো পক্ষের নেই।

বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অনেক উপাদান, যেমন: ধর্মীয় উত্তেজনা, আঞ্চলিক বিরোধ ইত্যাদি থাকলেও অনগ্রসরতা ও অস্থিতিশীলতার প্রশ্নে সবচেয়ে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে নির্বাচনী প্রতিযোগীদের নির্বাচনোত্তর একনায়কতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও এই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থে উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রশক্তির জনকল্যাণমুখী পরিবর্তন না ঘটিয়ে সেই নিয়ন্ত্রণমূলক রাষ্ট্রকাঠামোকে আরও নিপীড়নমূলক পথে নিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। পরিহাসের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রগতির সূচক এটুকুতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে, যেখানে একনায়কতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা চিরায়ত করার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত টেকসই হচ্ছে না এবং প্রতি নির্বাচনী সাইকেলে বিরোধী দল পরের বার ক্ষমতাসীন দলে আবির্ভূত হচ্ছে।

এই ‘মন্দের ভালো’ই কি বাংলাদেশের নিয়তি? ফিলিপাইনের মতো একসময়ের সম্ভাবনাময় দেশ এই ধরনের ‘মন্দের ভালো’ নিয়তিতেই দীর্ঘকাল আটকে পড়ে আছে। এর একটি পরিণতি হচ্ছে অর্থনীতি থেমে না থাকলেও মৌলিকভাবে উন্নততর স্তরে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ক্রমাগত নাগালের বাইরে থেকে যায়।

‘মন্দের ভালো’ নিয়তি বাংলাদেশের জন্য অবশ্যম্ভাবী নয়। তবে এখানে গুণগত উত্তরণের পথ খোঁজা যতটা জরুরি, ততটা জরুরি গুণগত উত্তরণের প্রয়োজনীয়তার বিশ্লেষণাত্মক উপলব্ধি। রাজনৈতিক ও সামাজিক উভয় মহলেই এই উপলব্ধির আলোচনার বিস্তার ঘটানো জরুরি। তবে শেষ বিচারে ‘মন্দের ভালো’ নিয়তি থেকে উত্তরণের নিশ্চয়তা আসবে সুচিন্তিত রাজনৈতিক উদ্যোগ থেকেই। সেই উদ্যোগ রাজনৈতিক মহল থেকেই হোক অথবা বিভিন্ন শক্তির কোনো বৃহত্তর কোয়ালিশন থেকেই হোক।

তথ্যসূত্র:

১. Samuel P. Huntington, Political Order in Changing Societies, (Yale University Press, 1968).

২. Kate Nash and Alan Scott, The Blackwell Companion to Political Sociology, (Blackwell Publishing, 2001).

৩. এই সমালোচনার জন্য দেখুন আলী রীয়াজ, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও ভবিষ্যত,’ প্রতিচিন্তা, ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-নভেম্বর সংখ্যা, ২০১২, পৃষ্ঠা ৫৩।

৪. Francis Fukuyama, End of History and the Last Man, (Free Press, 1992).

৫. Francis Fukuyama, Origins of Political Order, (London: Profile Books, 2011). বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে ফুকুইয়ামার তাত্ত্বিক কাঠামো নিয়ে বিশ্লেষণের জন্য দেখুন, মির্জা হাসান, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক উন্নয়ন কেন ঘটে না?’ প্রতিচিন্তা, ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা, ২০১৩।

৬. The World Bank, ‘Bangladesh Government that Works : Reforming the Public Sector,’ Report 

No- 15182, Country Development 1- South Asia Region, 1996.

৭. Mushtaq Khan, ‘Markets, States and Democracy: Patron-Client Networks and the Case for Democracy in Developing Countries,’ Democratization 12(5), 2005; William B. Milam, Bangladesh and Pakistan: Flirting with Failure in South Asia, (Dhaka: UPL, 2010); মির্জা হাসান, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক উন্নয়ন কেন ঘটে না?’ প্রতিচিন্তা, ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৩।

৮. Charles Tilly (Ed.), The Formation of Nation-States in Western Europe, University Press, 1975.

৯. Anthony D. Smith, State and Nation in the Third World, (UK: Wheat sheaf Books, 1983).

১০. 

Hossain Zillur Rahman, ‘Landed Power and the Dynamic of Instability: Bengal State Formation under Colonial Rule and its Contemporary Significance,’ Manchester University, UK, Ph.D Thesis, Department of Sociology, 1986.

১১. Ayesha Jalal, Democracy and Authoritarianism in South Asia: A comparative and Historical Perspective, (Cambridge University Press, 1995).

১২. Benedict Anderson, Imagined Communities, (UK: Verso, 1983).

১৩. Muhammad Aslam Malik, The Making of the Lahore Resolution, (New Delhi: Oxford University Press, 2001). 

১৪. হোসেন জিল্লুর রহমান, ‘বাংলার ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সমাজতত্ত্ব,’ মিরান্দা, ৩য় বর্ষ, ৩য় ও ৪র্থ যুগ্ম সংখ্যা, কলকাতা, ১৯৯১।

১৫. B.B. Misra, ‘The Administrative History of India 1834-1947,’ (New Delhi: Oxford University Press, 1970).

১৬. হোসেন জিল্লুর রহমান, ১৯৯১।