বাঙালি এক ইতিহাসবিদের আত্মকথনে সমসাময়িক সমাজ-রাজনীতি

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

(বাঙালনামা, তপন রায় চৌধুরী, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, মে ২০০৭।)

বাঙালনামা তপন রায় চৌধুরীর সমগ্র জীবনের স্মৃতিকথা। এ গ্রন্থে লেখক নিজেকে যতটা আলোচনা করেছেন, তার চেয়ে বেশি তিনি তাঁর চারপাশের মানুষগুলোকে তুলে ধরতেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। যা তাঁর স্মৃতিকথায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। লেখক এ গ্রন্থের কোথাও রাজনীতি, অর্থনীতি—এমনকি সমাজের ধারাবাহিক বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি কেবল নিজের জীবনের সঙ্গে যেসব আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা জড়িত, সেগুলো প্রসঙ্গক্রমে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। তাই বিশ শতকের প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময় থেকে একুশ শতকের আগ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ, ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য বিশ্বের নানা স্থানের সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতির বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে বিচরণ করে প্রত্যক্ষ দর্শন করেছেন, তাঁর এ উপলব্ধিগত বর্ণনায় আমরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সে সময়টাতে বিচরণ করব। এ গ্রন্থে লেখক মূলত তাঁর অবস্থানকালীন স্থান ও সময় এবং চারপাশের বিভিন্নমুখী চরিত্রগুলো সম্পর্কে অত্যন্ত চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তাঁর বয়সের সঙ্গে বহমান সমাজের নিয়ামকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনাগুলো এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত যে সহজেই পাঠকের দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হয়। এটি একটি স্মৃতিকথা হলেও লেখক একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টি ও অনুভূতি নিয়েই রচনাটি করেছেন। ভাবালুতার আতিশয্যে তিনি হারিয়ে যাননি। লেখক তাঁর বর্ণনার পরতে পরতে পাঠকদের উদ্দীপনা ও কৌতূহল সৃষ্টি করেছেন, যা রচনাটিকে অনবদ্য করে তুলেছে। তা ছাড়া লেখক একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে ইতিহাসের অনুদ্ঘাটিত বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা ভবিষ্যত্ গবেষকদের অনুপ্রেরণার উত্স।

তপন রায়ের ভাষায়, ‘ত্রিশ বা চল্লিশের দশকের বাঙালি সমাজের সঙ্গে আমার দৃষ্টিতে আজকের যুগের সমাজের সব চেয়ে বড় তফাত প্রধানত এক বিষয়ে। সে সময় জীবনের নানা ক্ষেত্রে কিছু মানুষ দেখেছি—যাঁরা আদর্শনিষ্ঠায় চরিত্রগুণে অনন্যসাধারণ। তাঁরা নানা পথের পথিক—কেউ দেশের বা সমাজের জন্য উত্সর্গীকৃত প্রাণ, কেউ জ্ঞানসাধক, কেউ সাহিত্য বা শিল্পপ্রেমিক, কেউ বা ধর্মপ্রাণ মানুষ। একটি ব্যাপারে এইসব বিভিন্নধর্মী মানুষ কিন্তু একই পথের পথিক ছিলেন। এঁরা সকলেই ব্যক্তিস্বার্থ আর দৈনন্দিনতার বাইরে এমন কিছু জিনিসকে জীবনের প্রধান অবলম্বন বলে আঁকড়ে ধরেছিলেন, সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ যাকে মূল্যবান মনে করেছে। এঁদের বেশির ভাগই আমাদের রাজনৈতিক, সংস্কৃতিগত বা ধর্মীয় ইতিহাসে পরিচিত নাম নন। কিন্তু এঁদের জীবনচর্যা বহু মানুষকে বেঁচে থাকা ব্যাপারটাকে একটু উঁচু তারে বাঁধতে উদ্বুদ্ধ করত। তখন জীবনে সুযোগ-সুবিধা, বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা নিতান্তই সীমিত ছিল। বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত মানুষ ফলে একটা অভাব বা ব্যর্থতাবোধে ভুগত। আমি যাঁদের কথা বলছি, তাঁরা শ্বাসরোধকারী পরিবেশের প্রভাব উপেক্ষা করে এক মহত্তর জীবনে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।’ (পৃ. ৭১-৭২)

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান রচনাটি অনেকাংশেই বিস্মৃত বা লুপ্ত জগতের কাহিনি। লুপ্ত কী অর্থে? যে-ধরনের মানুষ একসময়ে দেখেছি, সেই ধরনের মানুষ তাঁদের বিশিষ্ট জীবনচর্যা, মনোভঙ্গি আর বিশ্বচেতনা নিয়ে পৃথিবী থেকে সরে গেছেন। তাঁদের পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে পূর্বগামীদের সাদৃশ্য কম। এটা ভালমন্দ বিচার বা উন্নতি/অবক্ষয়ের কথা না। গভীর অথচ প্রায় অদৃশ্য সামাজিক পরিবর্তনের ইতিহাস।...সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে মানুষের মূল্যবোধে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। যাঁদের কথা বলব, তাঁরা দোষে-গুণে ভরা রক্তমাংসের মানুষই ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মূল্যবোধ আজকের জীবনে বিশেষ দেখতে পাই না। ফলে তাঁদের জীবনচর্যার ধারাও লুপ্ত হয়ে গেছে মনে হয়।’ (পৃ. ১২৩) অর্থাত্ লেখকের জীবনস্মৃতি কোনো গল্প-উপন্যাস নয়, আবার সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনো ঘটনার ধারাবর্ণনাও নয়। মানবজীবনের অতিবাহিত বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রার বর্ণনা। তাই দৃশ্যপট কখনো খুব দ্রুত, কখনো আকস্মিকভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে। স্মৃতি কখনো পরতে পরতে সাজানো থাকে না। স্মৃতির ডালায় পরিপূর্ণ ঘটনাবলি থেকে বেছে বেছে তৈরি করা এ গ্রন্থে প্রসঙ্গান্তর তাই স্বাভাবিক জীবন-প্রক্রিয়ার মতোই। কেবল নিজের জীবনগাথা নয়, লেখক তাঁর জীবনের বাল্য থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত যথাসম্ভব ব্যক্তিত্বকে গেঁথে দিয়েছেন। তাই তপন রায় চৌধুরীর এ জীবনস্মৃতি খুঁজলে পাঠক শতাধিক ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাবেন, যা গ্রন্থটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

গ্রন্থটির প্রসঙ্গান্তরের একটি উত্কৃষ্ট উদাহরণ এর ৯৬ থেকে ৯৮ পৃষ্ঠা। প্রথম পৃষ্ঠাটিতে লেখক স্কটিশ চার্চ কলেজের বিচিত্র চরিত্রগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তার ধারাবাহিকতায় ইংরেজি সাহিত্যের আগ্রহ থেকে তিনি কীভাবে ইতিহাসে আগ্রহী হলেন, তার বর্ণনা দেন। এর পরই লেখক চলে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর কী দৃশ্য দেখেছিলেন, তার বর্ণনায়। পরের প্যারাতেই লেখক চলে যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং সেখান থেকে কংগ্রেসের রাজনীতি তথা ভারতীয় রাজনীতিতে। প্রসঙ্গের এই পরিবর্তনের অর্থ এটা নয় যে লেখক এলোমেলোভাবে তাঁর গ্রন্থ রচনা করেছেন, বরং তাঁর সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার বৈচিত্র্যকে লেখক চমত্কারভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন এবং পরস্পরবিচ্ছিন্ন এ ঘটনাকে তিনি নিজের প্রত্যক্ষ দর্শনের সূত্রে আবদ্ধ করে অসাধারণ পরম্পরা তৈরি করে গেছেন।                

মোট ২৩ পরিচ্ছেদে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে লেখক তাঁর জীবনের চালচিত্র তুলে ধরেছেন। তিন ধরনের জীবনপ্রণালি লেখকের জীবনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে—তাঁর জন্মস্থান পূর্ব বাংলা তথা বরিশালের জীবন, কলকাতা ও দিল্লিতে বসবাস এবং ইংল্যান্ড ও আমেরিকার প্রবাস। দেশ বিভাগ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা ও বিশ্বযুদ্ধের মতো উত্তাল সময় পেরিয়ে লেখক এক সর্বজনীন সভ্যতাকে গ্রহণ করেছেন, তা হলো মানবিকতা। মূলত মানুষের জীবনের সব নিষ্ঠুরতার আড়ালে থাকা প্রবল মানবিক চেতনাকেই লেখক সন্ধান করেছেন।

আর ভারত উপমহাদেশের জনমানুষের মনোবৈকল্য বিশ্লেষণে তিনি বারবার ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটকে দায়ী করেছেন। আবার একই প্রেক্ষাপটে একদল ত্যাগী ও নিঃস্বার্থ মানুষের জীবনদর্শনও লেখকের বর্ণনায় উপজীব্য হয়েছে। তাই লেখকের জীবনের অভিজ্ঞতার মতোই তাঁর এই গ্রন্থও বিষয়বস্তু ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। সমগ্র গ্রন্থেই অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে এবং লেখক নিজের দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনা করে তাদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরেছেন। আর মাঝেমধ্যেই সামাজিক সমস্যার এবং সমঝোতার ছোটখাটো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সংযোজন করেছেন। গ্রন্থের মোটামুটি একটা বৃহত্ অংশজুড়ে আছে তাঁর সময়ে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পালাবদলের চিত্র এবং জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা যেমন: ভারত ছাড় আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশ বিভাগ এবং পরবর্তী ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাঁর স্মৃতিগুলো।

লেখক তপন রায় চৌধুরী বরিশালের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের সন্তান। জন্ম ১৯২৬ সালে নানাবাড়ি কুমিল্লাতে। তারপর বেড়ে ওঠা বরিশালে। বাবার অসুস্থতার কারণে সপরিবারে কলকাতায় গমন করেন। সেখানকার জগদ্বন্ধু স্কুলে লেখাপড়ার প্রথম পাঠ শুরু। এরপর বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে প্যারাটাইফয়েড ও নিজেদের জমিদারির অব্যবস্থাপনার কারণে তাঁর পরিবার বরিশালে ফিরে আসে। সেখানে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে মেট্রিক পাস করেন। তারপর ভর্তি হন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। থাকতেন ডাফ হোস্টেলে। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় ভারত ছাড় আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার হন এবং কারাগারে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন। জেল থেকে বের হয়ে পরীক্ষা দেন। ১৯৪৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসে ভর্তি হন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা। কলকাতার হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। এর পাশাপাশি প্রেসিডেন্সি কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এরপর মৌলানা আজাদ কলেজে শিক্ষকতা করেন। একই সময়ে লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ডি ফিল ডিগ্রির পর স্কলারশিপ নিয়ে অক্সফোর্ডে যান। উচ্চতর ডিগ্রি শেষে দেশে ফিরে দিল্লি আর্কাইভে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসে অর্থনৈতিক ইতিহাসের রিডার হিসেবে যোগ দেন। এরপর দিল্লি স্কুলে অধ্যাপক ও ডিরেক্টর হন। তত্কালীন ভারতে দিল্লি স্কুল ছিল মহারথীদের মিলনমেলা। কিন্তু লেখক সেখানে পেশাগত সন্তুষ্টি খুঁজে পাননি। কারণ, দিল্লি স্কুল হলো অর্থনৈতিক আলোচনার কেন্দ্র। তাই স্বাভাবিকভাবেই একজন ঐতিহাসিকের তৃপ্তি সেখানে মিটবে কেন? ফলে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন। ষাটের দশকে গবেষক বা শিক্ষক হিসেবে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকের যাতায়াত শুরু হয়। ১৯৬১-৬২ সালে লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে এক বছর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ছিলেন। ১৯৬৯-৭০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পড়ানোর জন্য আমেরিকায় যান। ১৯৯৩ সালে লেখকের অবসর জীবন শুরু হয়। কিন্তু অক্সফোর্ডের সঙ্গে লেখকের একটি যোগসূত্র রয়ে যায় সেন্ট অ্যান্টনিস কলেজে ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে।

লেখকের জীবনের প্রথম পর্ব বরিশালে কাটলেও তিনি শুরু করেন তাঁর জন্ম সাল ১৯২৬ এবং মাতুলালয় কুমিল্লা শহরের স্মৃতি দিয়ে। যদিও এ দুটি বিষয়ের স্মৃতি অনেকাংশেই তাঁর পরবর্তীকালে সংগৃহীত তথ্যের দ্বারা অলংকৃত, বর্ণনা দুটি রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক উপাদানসমৃদ্ধ। ১৯২৬, তাঁর জন্ম সালে ভারতে এসেছিল সাইমন কমিশন।১ সাইমন কমিশন কী, তা জানার আগেই লেখক কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ওপর ইংরেজ অত্যাচারের ক্ষতচিহ্নের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।

রায় চৌধুরী শৈশবের বর্ণনায় বরিশালের তথা বাংলার সামাজিক ইতিহাসের বহু উপকরণের সন্ধান দিয়েছেন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক, বর্ণ বিভেদ, নারীদের অবস্থান এবং এ প্রসঙ্গে লেখক তাঁর খেলার সাথি ১০ বছর বয়সী ‘সন্না’র কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র বাবা অর্থের বিনিময়ে চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তির কাছে মেয়েকে বিক্রি করে দেয়। এ ধরনের সামাজিক বিপর্যয়ের ঘটনা শিশুর মনে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে ও লেখকের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, তা বর্ণনা করেছেন।

লেখক তাঁর পরিবারের কয়েকজন ভৃত্যস্থানীয় মানুষের বর্ণনা করেন, যা নিম্নবর্গের ইতিহাসের উপাদান জোগায়। ‘যতি’ নামের এক নারী চরিত্রের বর্ণনা দেন, যিনি কোনো সম্পর্ক সূত্রে আবদ্ধ না হয়েও লেখকের পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার জীবনের করুণ কাহিনি এবং পরিণতি এ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। এর মধ্য দিয়ে সমাজের নারীদের অবস্থার পাশাপাশি ঘৃণ্য একটি প্রথার কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। যতি ছাড়া আরও দুটি চরিত্র ‘ধর্ম’ এবং ‘নগা’—এদের বর্ণনা রয়েছে। ভৃত্য শ্রেণীর প্রায় নিরক্ষর এ মানুষগুলো ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতির এমনকি সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে মোটেই নিরক্ষর ছিল না। মহাভারত ও রামায়ণের কাহিনি এবং নীতিবোধ ছিল তাদের চেতনাগত। লেখকের পরিবারের শিশুরা সাক্ষর হওয়ার আগেই পারিবারিক আবহে নিম্নশ্রেণীর এসব লোকের কাছ থেকে সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করত।

ভারতবর্ষের বৃহত্তর রাজনৈতিক চেতনায় নিম্নবর্গের সম্পৃক্ততার উত্কৃষ্টতর উদাহরণ লেখকের পারিবারিক ভৃত্য ‘নগা’ বা নগেন্দ্র পরিডা। সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয় নগেন্দ্র পরিডা। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন তার কাছে মুক্তির দেবতা। ইংরেজ নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিতে গান্ধীজি একদিন ঘোড়ায় চড়ে যোদ্ধার বেশে মহাযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। আর সে যুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ নগেন্দ্র পরিডা। (পৃ. ৩৪)

এ সময়ে বাংলা তথা ভারতীয় মানসজগতে ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা এক বিচিত্র রূপ লাভ করেছিল। জাতিভেদ, ধর্মীয় মতভেদ, ছোট-বড়, উঁচু-নিচু জাতভেদ সবকিছু মানুষের আধ্যাত্মিক জগতে এসে মিলেমিশে এক হয়ে যেত। তাই নানা ধর্মবৈচিত্র্যের এ দেশে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় ছিল। কিন্তু ইংরেজ উপনিবেশের অস্থিরতা এ সামাজিক ঐক্যে ভাঙন ধরায়। দেশ বিভাগ সমাজের সামাজিক সম্প্রীতির মূলে আঘাত হানে। যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, উপমহাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আজও সেই অস্থিরতার হাত থেকে মুক্ত হয়নি।

বরিশালের গ্রামগুলোতে তখন প্রায় প্রতিটি সম্পন্ন শিক্ষিত পরিবারে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল। এসব পরিবার এবং গ্রামের স্কুলগুলোকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে উঠেছিল। তাই লেখক বরিশালকে অভিধা দিয়েছেন ‘ভদ্রজনের বাসা’। ‘উনিশ শতকে যে পশ্চিমি শিক্ষার শুরু হয়—বাঙালিজীবনে তার একটি মহত্ দান বিশ্ব সংস্কৃতি সম্বন্ধে অন্তহীন কৌতূহল। ১৯১৭ সালে স্যাডলার কমিশন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে মন্তব্য করেন যে, শিক্ষিত বাঙালি যুবক শুধু নিজের দেশে কি হচ্ছে জেনে তুষ্ট না, লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্কে জ্ঞানের জগতে কি হচ্ছে সে খবর জানার জন্য দুরন্ত আগ্রহী। বরিশালের শিক্ষিত মহলে এই প্রবণতা স্পষ্টতই নজরে আসত।’ (পৃ. ৭৪) বরিশালের স্থানীয় দোকানগুলোতেই প্রাচীন ভারতের ইতিহাসসহ বিদেশি ভাষার বই পাওয়া যেত। ফরাসি ভাষার বই এবং ফরাসি জানা লোকও বরিশালে দুর্লভ ছিল না। বহু বিদ্যাব্রতী ব্যক্তি জাগতিক সব দুঃখ-কষ্ট মেনে নিয়ে কেবল জ্ঞানচর্চাকেই তাঁদের জীবনের লক্ষ্য বানিয়েছিলেন। সমাজকাঠামোর মূলে এ ধরনের মানুষের অস্তিত্ব সমাজের ভিতকে মজবুত করেছিল, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। উর্বর ভূমি বরিশালের মানুষের হাতে অবসর ছিল আর সে অবসর কেবল গল্প-আড্ডায় কাটত না। উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি—সবই ছিল আড্ডার আলোচ্য বিষয়।

কিন্তু চল্লিশের দশকে এসে রাজনৈতিক হাওয়া বদল হতে থাকে। কংগ্রেসের রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং মুসলিম লীগের উত্থান বরিশালসহ সমগ্র ভারতবর্ষে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিল। লেখক বলেন, ‘ইস্কুলের জীবনে এই পরিবর্তনের ছায়া পড়েছিল। সরকারি ইস্কুল, কিন্তু হিন্দু এবং মুসলমান ছাত্রদের জন্য আলাদা দুটি লোহার ট্যাঙ্কে জলের ব্যবস্থা ছিল। কোনও কোনও মুসলিম সহপাঠী আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন যে, তাঁরা হিন্দুদের ছোঁয়া খান না। সত্যিতে মুসলমানরা ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে মাথা ঘামাত না। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক তথা সাম্প্রদায়িক চেতনার যুগে হিন্দুদের ছুত্মার্গের পাল্টা জবাব হিসাবেই ওঁদের মধ্যে এ জাতীয় ব্যবহারের সূচনা হয় বলে আমার বিশ্বাস।’ (পৃ. ৭৭) এরূপ আরও কিছু ঘটনা ঘটে, যা সাম্প্রদায়িকতার ভাব-তাপের জানান দেয়।

১৯৪২ সালে লেখক বরিশালে ভারত ছাড় আন্দোলনে২ যোগ দেন। প্রথম এবং দ্বিতীয় সারির নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ায় কিশোর-তরুণেরা আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে অন্য অনেক কিশোরের সঙ্গে লেখকও গ্রেপ্তার হন এবং ব্রিটিশ ভারতের জেলজীবনের নারকীয় অবস্থার বর্ণনা তাঁর লেখায় উঠে আসে। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘যেসব অনাচার অত্যাচারের কথা বললাম, ইংরেজদের জেল ব্যবস্থাসংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে তার কোথাও কোনও উল্লেখ কেউ পাবে না। বোধ হয় এই জাতীয় কারণেই সরকারি দলিলপত্রের ভিত্তিতে লেখা ইংরেজ শাসনের ইতিহাস পড়লে শাসকশ্রেণিকে অনেক সময়ই এত শিশুর মতো নিষ্পাপ মনে হয়।’ (পৃ ১০৭) জেলে বসেই লেখক আইএ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন এবং জেল থেকে বেরিয়ে বরিশালে বসে পরীক্ষা দেন। পরীক্ষা শেষে  কলকাতায় চলে যান এবং এখানেই লেখকের বরিশাল জীবনের বর্ণনার সমাপ্তি।

কলকাতার সঙ্গে লেখকের প্রথম পরিচয় ঘটে শৈশবে চিকিত্সার উদ্দেশ্যে আগমনের সময়। তখন কলকাতার প্রতি লেখকের একধরনের ভয় মেশানো কৌতূহল ছিল। দ্বিতীয়বার আসেন লেখকের বাবার চিকিত্সার উদ্দেশ্যে। তাই দীর্ঘ সময় থাকতে হয়েছিল। তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাও শুরু কলকাতায়, কিন্তু তখন কলকাতা লেখকের ভালো লাগেনি। স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়ে লেখক কলকাতার জীবনের সঙ্গে মিশে যান। কলকাতার জীবনেই লেখক প্রথম প্রত্যক্ষ করেন বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা বাংলার ইতিহাসে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত।৩ ’৪৩ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ কলকাতার ফুটপাতে গ্রাম থেকে আসা মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। প্রথম দিকে শহরের মানুষ এদের সাহায্য করলেও চালের দাম অসম্ভব রকম বেড়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব ছিল না। রাস্তার দুধারে মৃত মানুষ পড়ে থাকা নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। কিছু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান লঙ্গরখানা খুললেও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের তুলনায় তা ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। ক্রমেই মানুষ চাল ভিক্ষার বদলে ফ্যান ভিক্ষা চাইতে শুরু করল। দুর্ভিক্ষকালীন কলকাতার সামাজিক চিত্রের বর্ণনায় লেখক বলেন, ‘...কলকাতার ফুর্তি-আমোদে দুর্ভিক্ষের জন্য একটুও ভাটা পড়েনি, বরং ফুর্তির জোয়ার ফেঁপে ফুলেই উঠেছিল। চাল এবং আর সব ভোগ্যবস্তুর দাম বাড়ায় কালোবাজারের কৃপায় অনেকের পকেটেই প্রচুর কাঁচা পয়সা। সে পয়সা নানা বিলাসব্যসনে খরচ করার উপায় শহর কলকাতায় অজস্র। রেস্তোরাঁয় কথাই ধরুন না কেন। কোনও রহস্যজনক কারণে চালের দাম হু-হু করে বাড়া সত্ত্বেও রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম প্রায় একই ছিল।’ (পৃ. ১২৭)

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলে ভারতীয় রাজনীতি নতুন মোড় নেয়। ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই কলকাতা শহর নিমজ্জিত হলো আরেক বিভীষিকায়। ’৪৬-এর দাঙ্গা। দেশ বিভাগ নিয়ে দর-কষাকষির একপর্যায়ে মুসলিম লীগ দেশব্যাপী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়। সংগ্রামের প্রথম স্থান ছিল কলকাতা। ১৬ আগস্টের দিনই ঘটে নারকীয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। দাঙ্গা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী মতামত থাকলেও একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লেখক বলেন, ‘দাঙ্গা বাধার আগে কলকাতাবাসী হিন্দু-মুসলমান কেউই নিজের বাসস্থান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। সকলেই জানেন শহর কলকাতার আবাসনে একটা বিশেষ ছক আছে। মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলিতে অল্প কিছু হিন্দু এবং হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে সামান্য সংখ্যায় মুসলমানের বাস। যে কলকাতাবাসীরা জাপানি বোমার আশঙ্কায় প্রায় মুক্তকচ্ছ হয়ে মফস্বলে পালিয়েছিল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা করলে তারা যে নিশ্চিন্তে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।’ (পৃ. ১৫০-১৫১) যাই হোক, তিন দিনের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের পর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ হয়, যদিও তার রেশ আরও কিছুদিন চলে।৪ এর কিছুদিন পর কংগ্রেস পাকিস্তান দাবি মেনে নেয়। নানা দেনদরবার আর কূটনৈতিক তত্পরতার মধ্য দিয়ে দেশ ভাগ হয়। বিভক্ত দেশে লেখকের পরিবার বরিশালে অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানে এবং তিনি রয়ে যান ভারতে। আটচল্লিশের জুলাই মাসে এ দূরত্ব ঘুচে যায়। লেখকের পরিবার কলকাতায় চলে আসেন।

পরিবার প্রতিপালনের জন্য এমএ পাসের পর লেখকের কর্মজীবন শুরু হয়। সদ্য স্বাধীন দেশে চাকরি পাওয়া মোটেই সহজ বিষয় ছিল না। তার ওপর লেখক শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফলে চাকরিজীবনে তাঁর অভিজ্ঞতার পাল্লাটা একটু বেশিই ভারী হয়েছিল। নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে লেখক তাঁর জীবনের সাফল্যগুলো অর্জন করেন। মাঝেমধ্যেই সেখানে তিক্ততার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তেমনি একটি উদাহরণ দিল্লিতে জাতীয় অভিলেখাগার। এখানে লেখক আবিষ্কার করেন সদ্য স্বাধীন একটি দেশে আমলা-মন্ত্রীরা পরস্পরের সহযোগী হয়ে ‘দেশের স্বার্থ’-এর নামে কীভাবে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করেন। দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি হয় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ ছিল লেখকের কাঙ্ক্ষিত স্থান। দিল্লির স্কুল অব ইকোনমিকসে যে কারণে তিনি সুখী হতে পারেননি। ইতিহাসবিদ হিসেবে ইতিহাস বিভাগেই তাঁর মেধার প্রকৃত বিকাশ হতে পারে। কিন্তু সে অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে লেখক জানান, ‘বর্তমান লেখাটি ব্যক্তিগত কাহিনীর চেয়ে সামাজিক ইতিহাসের অন্যতর দলিল হিসেবেই পাঠকদের কাছে আমি উপস্থিত করছি। সে ইতিহাসের কৃষ্ণবর্ণ দিক সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং ক্ষমতাশালী মানুষদের নিরঙ্কুশ দলবাজি।’ (পৃ. ৩২০) স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এ সমস্যা কেবল ভারতে নয়, সমগ্র ভারত উপমহাদেশে সংক্রমিত হয়েছিল, তা উপমহাদেশের অধিবাসীমাত্রই জানেন। লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এ বিবরণ সমাজের মূলের অবক্ষয়ের এক প্রামাণ্য গাথা।

পেশাগত জীবনের এসব অভিজ্ঞতার মধ্যেই লেখকের জীবনের আরেকটি পরিণতি আসে এবং লেখক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বাভাবিকভাবে এ স্মৃতি সুখের হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তত্কালীন সমাজের অপসংস্কারের কিছু দলিল। ১৮৫৬ সালে বহুবিধ আন্দোলন ও যুক্তিতর্কের পর হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। লেখকের বর্ণিত ঘটনা তার ১০৪ বছর পর। শত বছর পর এ অঞ্চলের সামাজিক চিন্তাচেতনার কতটা পরিবর্তন ঘটেছিল, তার স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় লেখকের জীবনের অভিজ্ঞতায়। লেখক যাকে পত্নী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তিনি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিধবা পুত্রবধূ। পুত্রবধূর শ্বশুরবাড়ি এবং তাঁদের আত্মীয়-পরিজনেরা এ বিবাহ বন্ধ করতে সম্ভাব্য সব উপায়ই অবলম্বন করেছিলেন। এ সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘বিদ্যাসাগর মশায়কে ঘিরে উনিশ শতকীয় সংস্কার আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর এমন চিন্তা বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের মস্তিষ্কে এসেছে এ ধরনের নজির নেই। ব্যতিক্রম যা দেখা যায় তা ব্যতিক্রমই। সুতরাং বিধবা বিবাহ করছি দেখে পরিচিত-অপরিচিত সবাই আমাকে মাথায় তুলে নাচবে, এমন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু বস্তুত যা ঘটল, তাও আমার কল্পনার বাইরে ছিল।’ (পৃ. ৩১০) সেসব অকল্পনীয় ঘটনায় লেখক এবং তাঁর হবু পত্নীকে বহু লাঞ্ছনা ও অপবাদের শিকার হতে হয়েছিল; যা লেখক এ গ্রন্থে অকপটে বর্ণনা করেছেন। পরিশেষে লেখক বলেন, ‘নিন্দাটা হয়েছিল প্রধানত হাসির (লেখকের স্ত্রী)। আমাদের সমাজে পুরুষ কখনও বিশেষ দোষী হয় না।’ (পৃ. ৩২০)

শিক্ষা এবং পেশাগত কারণে লেখক জীবনে বেশ কয়েকবার প্রবাসী হয়েছিলেন। আত্মীয়-পরিজন এবং শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে ডিগ্রি লাভ করেছিলেন, তাঁদের কাছে গল্প শুনে লেখকের মনে শৈশবেই তেমন স্বপ্ন বাসা বাঁধে। ১৯৫৩ সালে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে লেখক ইংল্যান্ডে যান। পরবর্তী জীবনে তিনি একাধিকবার পাশ্চাত্যের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, গবেষক হিসেবে গবেষণা ও শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেছেন। ১৯৭৩ সালে শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে তিনি ভারত ত্যাগ করেন। প্রবাসজীবনের দীর্ঘ বর্ণনায় লেখক ইউরোপ-আমেরিকার সমাজ-সংস্কৃতির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষ করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সামাজিক সম্পর্কের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইউরোপে অনেক সময় শুনি যে মার্কিনদের বন্ধুত্বে কোনও গভীরতা নেই, চোখের আড়াল হলেই সৌহার্দ্যের সমাপ্তি।...মানুষে মানুষে যে সহজ সম্পর্ক শুধু ইংল্যান্ডে না, ইউরোপের সংস্কৃতিগর্বী অনেক দেশেই দুর্লভ, আমেরিকায় তা বারেবারেই অপর্যাপ্ত পরিমাণে পেয়েছি।’ (পৃ. ২৯৮)

স্মৃতিকথা শেষে লেখক নিজেই নিজের সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন করেছেন, ‘অনেক আশা, কিছু শিখবার ইচ্ছে নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম। তার শতকরা দশ ভাগ পূর্ণ হয়েছে। আশাতীত সৌভাগ্যও হয়েছে। আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে অফুরন্ত ভালবাসা যা পেয়েছি তার কোনও পরিমাপ হয় না।’ (পৃ. ৪০১)

বাঙালনামা স্মৃতিকথার সময়কাল প্রায় এক শতাব্দী। বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে প্রায় বর্তমান সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। এ শতকটি ভারত উপমহাদেশ ও বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় সময়। ব্রিটিশ শাসনামলে এবং পরবর্তীকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ সময়কে নিয়ে বহু স্মৃতিকথা, প্রামাণ্য গ্রন্থ ইত্যাদি রচিত হয়েছে। কিন্তু বাঙালনামা এ অগণিত রচনা থেকে ভিন্নধর্মী। এর লেখক তপন রায় চৌধুরী একজন খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। তাই এ বিস্তৃত সময়কাল সম্পর্কে জানতে তপন রায়ের সুবিস্তৃত গ্রন্থটি এক অমূল্য সংযোজন। পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন, একটি বিস্তৃত সময়কালকে লেখক এ গ্রন্থে কী চমত্কারভাবে ধরে রেখেছেন।

টীকা ও তথ্যসূত্র

১. সাইমন কমিশন গঠিত হয় ১৯২৭ সালে। ভারতবর্ষ দায়িত্বশীল সরকার গঠনে কতটা প্রস্তুত হয়েছে, ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ কতটা সৃষ্টি হয়েছে এবং কোন ধরনের শাসনতন্ত্র ভারতের সব ধরনের জনমতকে সন্তুষ্ট করতে পারবে ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনার জন্য ইংরেজ সরকার সাইমনের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করে তাই সাইমন কমিশন নামে পরিচিত। বিস্তারিত দেখুন- শেখর বন্দোপাধ্যায়, পলাশি থেকে পার্টিশন আধুনিক ভারতের ইতিহাস, ওরিয়েন্ট লংম্যান প্রাইভেট লি., কলকাতা, ২০০৬।

২. ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গান্ধী যে তিনটি সর্বভারতীয় গণ-আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, তার মধ্যে ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন ছিল অন্যতম। ভারত ছাড় আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন। গান্ধী বলেছিলেন, এ আন্দোলন হবে খোলাখুলি বিদ্রোহ, সংক্ষিপ্ত ও বিদ্যুত্গতিসম্পন্ন, যেনতেন প্রকারে দেশ থেকে বিদেশী শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। হয় কর, নয় মর। বিস্তারিত দেখুন— সুমিত সরকার, আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোং, কলকাতা, ১৯৯৩।

৩. বিস্তারিত দেখুন— M Mufakharul Islam, An Economic History of Bengal 1757-1947, Adorn Publication, Dhaka, 2012.

৪. বিস্তারিত দেখুন—  Suranjan Das, Communal Riots in Bengal 1905-1947, Oxford University Press, Delhi, 1991.

Harun-or Rashid, Foreshadowing of Bangladesh: Bengal Muslim League and Muslim Politics, 1936-1947, Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka, 1987.

            এ ছাড়া লেখক তাঁর রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা (আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ১৯৯৩) গ্রন্থে পৃ. ৯৫-৯৭ তে দাঙ্গার বর্ণনা দিয়েছেন।