ইয়াংকি বণিকদের বঙ্গবাণিজ্য ও প্রাচ্যচর্চা (১৭৮৫-১৮৩০)

সারসংক্ষেপ

এ প্রবন্ধে লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বঙ্গবাণিজ্য ও প্রাচ্যচর্চার বেশ কতগুলো বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন। ইয়াংকি বণিকদের বঙ্গবাণিজ্যের সূত্রপাত কীভাবে হলো, মার্কিন বাংলা বাণিজ্যের ফলে পুঁজিপতি শ্রেণীর উত্থানপ্রক্রিয়ার সঙ্গে নিউ ইংল্যান্ডে নতুন প্রাচ্যচর্চা আন্দোলন কীভাবে মার্কিন প্রাচ্যবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে, কলকাতার সঙ্গে মার্কিনদের বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যম, রপ্তানিপণ্যের সাংস্কৃতিক মূল্য, প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রতি ইয়াংকিদের দৃষ্টিভঙ্গি ও তা কীভাবে বাণিজ্যকে প্রভাবিত করেছিল, মার্কিন শিল্পায়নে বঙ্গবাণিজ্য কীভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে এবং সর্বোপরি মার্কিন বাণিজ্যের সাংস্কৃতিক দিকগুলো কী তা বিশ্লেষণাত্মকভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: ইয়াংকি, বঙ্গবাণিজ্য, প্রাচ্যবাদ চর্চা, মার্কিন শিল্পায়ন, শিল্পবিল্পব, ট্রান্সডেন্টালিজম, শিল্পপণ্য

প্রারম্ভিক কথা

খ্রিষ্টাব্দ পঞ্চদশ শতক থেকে ভৌগোলিক আবিষ্কার ও তত্পরবর্তী প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মধ্যে প্রথম ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও পরবর্তী সময়ে এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র স্থাপন প্রভৃতি ঘটনা বিদ্যমান বিশ্ব অর্থনীতি ও মানব সম্পর্ককে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এ প্রভাব বিস্তারে একটি সাধারণ উপাদান ছিল প্রাচ্যবাদ চর্চা। প্রাচ্যদেশে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুষঙ্গ হিসেবে প্রাচ্যচর্চা ছিল অবধারিত। তবে এর ব্যত্যয় দেখতে পাই মার্কিনদের মধ্যে। স্বাধীনতা লাভের পর পরই বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় মার্কিন বণিকদের আগমন ছিল কেবলই বাণিজ্যিক কারণে।১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইয়াংকি বণিকদের প্রাচ্যে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করে এ শর্তে যে তাঁরা কোনো অজুহাতেই সেখানে কোনো ঔপনিবেশিক বা অন্য কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পাববেন না। ইউরোপের বিভিন্ন বাণিজ্য গোষ্ঠী কর্তৃক প্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রাচ্যবিদ্যা।৩ মূলত, ইউরোপীয় বিভিন্ন একচেটিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রাচ্যে ঔপনিবেশিক প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনেই শুরু হয় প্রাচ্যবিদ্যার চর্চা, বিশেষ করে প্রাচ্য ভাষাচর্চা। তাই লক্ষ করি, প্রাচ্যবিদ্যার প্রথম ধ্বজাধারী হচ্ছে বিভিন্ন পাশ্চাত্য বণিক গোষ্ঠী। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপের প্রতিটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচ্যচর্চার নানাবিধ প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে প্রাচ্য ভাষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান। এ ধারার একমাত্র ব্যত্যয় দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্রে প্রাচ্যচর্চার বেলায়। মার্কিন বণিকেরা ব্যক্তিগতভাবে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে অবতীর্ণ হলেও সমষ্টিগতভাবে তাঁরা প্রাচ্য ভাষা ও সভ্যতার নানা উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং একপর্যায়ে তাঁরা সম্মিলিত হয়ে স্থাপন করেন প্রাচ্যবিষয়ক জাদুঘর ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান। উল্লেখ্য, প্রাচ্যদেশে বাণিজ্য পরিচালনার জন্য মার্কিন বণিকেরা ইউরোপীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদলে আমেরিকায়ও একটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু কংগ্রেস সে প্রস্তাব বাতিল করে দেয় এ যুক্তিতে যে এক দেশের ওপর আরেক দেশের একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকার স্থাপন মার্কিন রাজনৈতিক আদর্শের পরিপন্থী। অতএব, ‘একচেটিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ স্থাপনের পরিবর্তে কংগ্রেস তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে প্রাচ্যে বাণিজ্য পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে।৪ শর্ত থাকে এই যে মার্কিন বণিক গোষ্ঠী প্রাচ্যে কোনো ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা অন্য কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।৫ তবে কংগ্রেসের ওই প্রস্তাবে বণিকদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রাচ্যচর্চায় কোনো বাধা আরোপ করা হয়নি।

মার্কিন বণিকদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে প্রাচ্য সভ্যতার নিদর্শন সংগ্রহে লিপ্ত হন। তাঁরা এশিয়ার, বিশেষ করে ভারতের ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় নিদর্শন সংগ্রহ করে তা প্রথমে তাঁদের নিজস্ব সংগ্রহশালায় জমা রাখেন এবং ক্রমেই এগুলোর যথা সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন জাদুঘর নির্মাণ করেন। যেমন নিউ ইংল্যান্ডের সেলেম শহরে মার্কিন বণিকেরা যৌথভাবে একটি প্রাচ্যবিষয়ক জাদুঘর স্থাপন করেন, যা কিনা বর্তমানে প্রাচ্য সংস্কৃতি বিষয়ে আমেরিকার একটি অন্যতম এবং সর্ববৃহত্ জাদুঘর। নাম পিবডি মিউজিয়াম। এ জাদুঘরের প্রয়োজনে বরাদ্দ করা বিশাল জায়গাটির নাম দেওয়া হয় ইন্ডিয়া স্কয়ার, যা এখনো বিদ্যমান। এ ছাড়া নিউ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দর নগরে রয়েছে সমকালীন ইয়াংকি বণিকদের বঙ্গবিষয়ক প্রতিষ্ঠিত ছোট-বড় বেশ কয়েকটি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। তা ছাড়া নিউ ইংল্যান্ডের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে হার্ভার্ড ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমকালীন যুগে স্থাপিত হয়েছে প্রাচ্য সভ্যতাবিষয়ক অনেক আর্কাইভস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যা এখনো কোনো আলোচনায় আসেনি। মূলত এ সমস্যাই বর্তমান প্রবন্ধের প্রধান আলোচ্য বিষয়।

সতেরো ও আঠারো শতকে পাশ্চাত্যের যেসব নৌ-জাতি ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক কারণে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে আগমন করেছিল তাদের মধ্যে সর্বশেষ জাতি ইয়াংকি নামে অভিহিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডের বণিকেরা।৬ স্বাধীনতা লাভের পরের বছরই অর্থাত্ ১৭৮৪ সালের শেষ নাগাদ ইয়াংকিরা ইউনাইটেড স্টেটস নামের একটি বাণিজ্যিক জাহাজ নিয়ে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়। এর পর থেকে বাংলা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাংলায় তাদের বাণিজ্য এত দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে পনেরো বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কলকাতা বন্দরের মোট ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণে খোদ ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমকক্ষ হয়ে ওঠে।৭ উল্লেখ্য, তখন ইউরোপ ও এশিয়ার প্রতিটি বাণিজ্যিক দেশ ছিল কলকাতা বাণিজ্যে সক্রিয়। আমেরিকার জন্য কলকাতা বাণিজ্যের বার্ষিক নিট মুনাফা ছিল এতই ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান যে অচিরেই এর যুগান্তকারী প্রভাব পড়ে নিউ ইংল্যান্ডের সার্বিক অর্থনীতিতে।৮ ১৮১৯ সালে সেলেমের বঙ্গবণিকেরা মার্কিন সিনেটকে এক স্মারকপত্রে জানান যে মার্কিন শিল্পবিপ্লবের নেপথ্যে রয়েছে কলকাতা বাণিজ্য থেকে আসা বিপুল মুনাফা। স্মারকপত্রের ভাষায়, ‘মার্কিনদের কলকাতা বাণিজ্যই সর্বপ্রথম আমেরিকায় বাণিজ্যিক পুঁজির বিকাশ ঘটিয়েছে। পুঁজি ছাড়া বাণিজ্য, পণ্যোত্পাদন ও সেবা প্রদান সম্ভব নয়। পুঁজি সৃষ্টি ও এর উত্পাদনশীল বিনিয়োগের জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছে আমেরিকার কলকাতা বাণিজ্য। এর ফলেই মার্কিন দেশে সর্বপ্রথম শুরু হয় পুঁজিবাদ বিকাশের যাত্রা। পুঁজিবাদ বিকাশের ফলে কৃষিপণ্যের চাহিদা ও তত্প্রসূত আয় অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এরই ফলে কৃষি খাতেও পুঁজির বিকাশ লক্ষ করা যায়। মানতে হবে, পুঁজির বিকাশসহ কলকাতা বাণিজ্যের নানাবিধ অনুকূল প্রভাবের ফলেই আমেরিকা এখন বিশ্বের একটি অন্যতম বড় নৌ-বাণিজ্যিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।’৯ বঙ্গবাণিজ্যকে কেন্দ্র করে যে পুঁজিপতি শ্রেণীটির উত্থান দেখতে পাই তাঁদেরই পুঁজি বিনিয়োগের ফলে আমেরিকায় ঘটল পৃথিবীর দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব।১০ এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস, যারা ছিল আমেরিকায় শিল্পবিপ্লবের পথিকৃত্।১১ এ গোষ্ঠীর সবাই ছিলেন কলকাতা বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। লক্ষণীয় যে এই নব্য পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রায় সবাই ছিলেন শিক্ষিত এবং প্রাচ্য সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁরা ১৭৯৯ সালে সেলেমে ইস্ট ইন্ডিয়া মেরিন সোসাইটি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে একটি ছিল ব্যবসার পাশাপাশি প্রাচ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। এ উদ্দেশ্যে প্রাচ্যগামী প্রত্যেক ব্যবসায়ী ও নাবিকের ওপর নির্দেশ থাকত তাঁরা যেন প্রত্যেকেই বঙ্গ সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রহ নিজস্ব দিনপঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত করেন।১২ তাঁদের ওপর আরও নির্দেশ ছিল তাঁরা যেন তাঁদের নিজস্ব জার্নাল, ডায়েরিসহ প্রাচ্যবিষয়ক গ্রন্থ, ভাস্কর্য, শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে নিউ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দান করেন। এ কর্তব্য পালন ছাড়াও তাঁরা নিজেরাও সম্মিলিত হয়ে সেলেমে স্থাপন করেন একটি প্রাচ্যচর্চা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রাচ্য সভ্যতা-সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া মেরিন মিউজিয়াম একটি অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান। ১৭৯৮ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া মেরিন মিউজিয়ামে প্রতিবছর একটি দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য প্রাচ্যমেলার আয়োজন করা হতো। এ বার্ষিক মেলায় ১৮৩০ সাল পর্যন্ত প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন জাতীয় নেতা। ১৮৩০-এর দশক পর্যন্ত মূলত ইয়াংকি বণিকেরাই মার্কিন একাডেমিশিয়ান ও লেখকদের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রাচ্যচর্চায় উত্সাহী করে তোলেন।

কলকাতায় মার্কিন বণিক

ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে ইতিপূর্বে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ দেশে আগত প্রতিটি পাশ্চাত্য বণিক গোষ্ঠী সরকার থেকে স্থায়ী ইজারা নিয়ে এক বা একাধিক বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেছে। অধিকাংশ কুঠি পরবর্তী সময়ে স্থায়ী ঔপনিবেশিক বসতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন: কলকাতায় ইংরেজদের বসতি, চন্দন নগরে ফরাসিদের বসতি, হুগলির অদূরে চুচুড়ায় ওলন্দাজদের বসতি ইত্যাদি। স্থায়ী বাণিজ্য বসতি স্থাপন এবং বসতিকে সময়মতো ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত করার ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিউ ইল্যান্ডের ইয়াংকিরা কোনো ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপন করবেন না এবং কোনো যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হবেন না, এ শর্তেই কংগ্রেস ইয়াংকি বণিকদের ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়।

১৭৯৫ সাল থেকে কলকাতা বন্দরের বার্ষিক আমদানি-রপ্তানি বিষয়ে দেশভিত্তিক তুলনামূলক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা শুরু হয়। ওই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইয়াংকি বণিকেরা কলকাতা বন্দরের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অচিরেই বঙ্গোপসাগর বাণিজ্যে ব্রিটেন ছাড়া অন্যান্য সব ইউরোপীয় দেশকে অতিক্রম করে যায়। বিস্ময়কর ব্যাপার, ইয়াংকিরা মাত্র সামান্য পুঁজির ওপর ভর করে একটিমাত্র মাঝারি আয়তনের জাহাজ নিয়ে ১৭৮৫ সালে কলকাতার আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় অংশগ্রহণ করেন এবং ১৭৯৫ সাল পর্যন্ত যাঁদের পুঁজির বেশির ভাগই ছিল তাঁদের স্থানীয় বানিয়াদের কাছ থেকে সুদে ধার করা, পরবর্তী এক দশকের মধ্যে তাঁদের বাংলা বাণিজ্য এমনই বিস্তার লাভ করে যে কলকাতা বন্দরের দেশভিত্তিক আমদানি-রপ্তানি হিসাবে ১৭৯৫ থেকে ১৮০৫ সালের মধ্যে মার্কিনরা ব্রিটেন ছাড়া কলকাতা বাণিজ্যে লিপ্ত বাকি সব ইউরোপীয় দেশের সম্মিলিত বাণিজ্যের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে যান।১৩ এমনকি, ১৮১০ সাল নাগাদ কলকাতা বন্দরের আমদানি-রপ্তানিতে ইয়াংকিরা বাংলায় ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের পরিমাণকেও অতিক্রম করে যান।১৪ অর্থাত্ ব্রিটিশ বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্যে সর্বোচ্চ স্থান দখল করে নেন ইয়াংকিরা। ইয়াংকিদের কলকাতা বাণিজ্য ক্রমেই নিউ ইংল্যান্ডে একটি শক্তিশালী বাণিজ্যিক পুঁজিপতি শ্রেণী সৃষ্টি করে এবং ওই শ্রেণীটিই রচনা করে প্রথম মার্কিন শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি।১৫

তবে এ উপস্থাপনায় আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো মার্কিনদের বঙ্গবাণিজ্যের আরেকটি তাত্পর্যপূর্ণ অবদান আলোচনায় নিয়ে আসা। আমরা দেখাতে চাই যে মার্কিনদের বাংলা বাণিজ্যের ফলে একদিকে যেমন নিউ ইংল্যান্ডে একটি পুঁজিপতি শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে এবং এ শ্রেণীর প্রচেষ্টায় নিউ ইংল্যান্ডে বিকাশ লাভ করেছে একটি শিল্পবিপ্লব, অপরদিকে একই সময়ে এই সদ্য সৃষ্ট পুঁজিপতি শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ ওরিয়েন্টালিজমের আদলে একটি নতুন প্রাচ্যচর্চা আন্দোলন, যাকে আমরা বলতে পারি মার্কিন প্রাচ্যবাদ (অ্যামেরিকান ওরিয়েন্টালিজম)।

মার্কিন প্রাচ্যবাদের বিকাশ

সদ্য স্বাধীন মার্কিন বণিকেরা যখন বাণিজ্য ব্যাপদেশে ভারত মহাসাগরের পথে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করেন তখন এ প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অনেক সংশয় ছিল। কেননা মার্কিনদের কাছে ভারত মহাসাগর ছিল একটি অজানা এলাকা। তদুপরি, তাঁদের হাতে পুঁজিও সীমিত। আরও সীমিত তাঁদের অভ্যন্তরীণ বাজার।১৬ ১৭৯০ সালে মার্কিন জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে তিন মিলিয়ন। যা হোক, ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে মার্কিন কংগ্রেস আপত্তি দেয় আরেকটি প্রধান কারণে। ইউরোপীয় মার্কেনটিলিস্ট বা একচেটিয়া বাণিজ্য অর্থনীতির অভিজ্ঞতায় আশঙ্কা করা হয়েছিল যে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতিযোগিতার পরিবেশে আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিগ্রহ অবশ্যম্ভাবী। এসব কারণে একপর্যায়ে ভারত মহাসাগর বাণিজ্য প্রকল্প মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক বাতিল করে দেওয়ার ওপর বিতর্ক চলছিল। ওই বিতর্কে মতামত দেন ইয়েল ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সেমিটিকস বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এজরা স্টাইলস (১৭২৭-১৭৯৫)। তিনি তাঁর দুই বন্ধু প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ও বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন উভয়কে ভারত বাণিজ্যের অনুকূলে তাঁর যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন যে মার্কিন-ভারত বাণিজ্য শুধু পণ্যের লেনদেন নয়, এ বাণিজ্যে নিহিত থাকবে মানব সভ্যতা বিষয়ে জ্ঞানের লেনদেনও। স্টাইলের ভাষায়, ‘ভারত বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে আমেরিকা সর্বপ্রথম নিজ গৃহ থেকে বিশ্বাঙ্গনে অনুপ্রবেশ করবে। প্রথমবারের মতো মার্কিন জাহাজ পাড়ি জমাবে প্রাচ্য জগতে। এর মাধ্যমে ওই অজানা জগতে পরিচিত হবে সদ্য স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে বিশ্বের পূর্ব গোলার্ধে উড়তে দেখা যাবে আমেরিকার ডোরা কাটা পতাকা। মার্কিন পতাকা উড়তে দেখা যাবে বাংলায়, গঙ্গায়, সিন্ধু ও চীনে। এর বিপরীতে বাণিজ্যের বিনিময়প্রক্রিয়ায় আমেরিকা লাভ করবে মুনাফার পাশাপাশি প্রাচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক তথ্য।’১৭ স্টাইলস মনে করেন যে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক দেশগুলো যদি প্রাচ্যের সান্নিধ্যে এসে তাদের নিজ নিজ দেশের অর্থনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নতুন উপাদান যোগ করে বিশ্ব সভ্যতার বিকাশে অবদান রাখতে পারে, তাহলে মার্কিনরাও বাণিজ্যের পার্শ্ব ফসল হিসেবে প্রাচ্য সভ্যতা থেকে অনুরূপ সুফল লাভ করতে পারে। যা হোক, অনেক যুক্তিতর্কের পর অবশেষে মার্কিন কংগ্রেস এশীয় বাণিজ্যের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তবে শর্ত থাকে এই যে ইউরোপীয় আদলে তাঁরা কোনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করতে পারবেন না। ১৭৮৪ সাল থেকে মার্কিন জাহাজ বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে আসতে শুরু করে, তবে বাংলার সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য নিয়মিতভাবে শুরু হয় ১৭৯০ সাল থেকে।

মার্কিন ও বাঙালির প্রথম সাক্ষাত্

প্রশ্ন করা যায়, মার্কিনরা কলকাতার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপনের আগে বাংলার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না। থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। যেখানে ব্যাপক আকারে এবং নিয়মিত পণ্য যাবে, সেখানে বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষও যেতে পারে। যেমন আঠারো শতকে ‘আয়া’ পেশার অসংখ্য বাঙালি নারী ব্রিটেনে কর্মরত ছিলেন। একই সময়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন পর্যটকও ব্রিটেন পরিভ্রমণ করেছেন। এঁদের কেউ কেউ ব্রিটিশ কলোনি আমেরিকায়ও যেতে পারেন, এমনটি মনে করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যেমন ১৭৮৪ সালে বারো জন বাঙালি লস্কর (জাহাজের শ্রমিক) পেনসিলভানিয়ার নিউ হ্যাভেন বন্দরে আটকা পড়েন। এঁদের নিয়োগদাতা ও জাহাজের মালিক ওই বন্দরে গিয়ে তাঁর জাহাজ বিক্রি করে উধাও হয়ে যান বাঙালি লস্করদের পাওনা পরিশোধ না করেই। এমতাবস্থায় স্থানীয় লোকেরা নাচার বাঙালিদের উপদেশ দেন স্বদেশে ফেরার চেষ্টা না করে অন্যান্য বাসিন্দার মতো এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করতে। কিন্তু তাঁরা দেশে ফেরার জন্য অস্থির। এ মানবিক সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসেন মার্কিন জাতির প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের অন্যতম স্টেটসম্যান, চিন্তাবিদ, দার্শনিক বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন। তিনি নিজে চাঁদা তুলে আটকে পড়া বাঙালি খালাসিদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করেন।১৮

পাল যুগে আন্তদেশীয় পণ্যের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

পাল যুগে আন্তদেশীয় সাংস্কৃতিক যোগাযোগ হয়েছে প্রধানত বাণিজ্যিক পণ্যের মাধ্যমে। ভৌগোলিক কারণে মানুষে মানুষে সাক্ষাতের সুযোগ যেখানে সীমাবদ্ধ, সেখানে একে অপরকে আন্দাজে জানার একটি বড় মাধ্যম বাণিজ্যিক পণ্য। একটি দেশের উত্পাদিত পণ্য প্রতিনিধিত্ব করে এর অর্থনীতি, প্রাযৌক্তিক-কারিগরিক কৌশল, সংস্কৃতি, রুচি-অভিরুচি ও আরও অনেক কিছু। পাল যুগে ইউরোপীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বাংলার নানা পণ্য, বিশেষ করে বস্ত্র রপ্তানি হয়েছে বিশ্বের সব মহাদেশে। এ পণ্যের অভিভূত ভোক্তারা মানস চোখে অনুভব করেছেন বাংলার বস্ত্রের প্রাযৌক্তিক, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক তাত্পর্য। আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছবিসহ বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো বাংলা থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যের, বিশেষ করে বিভিন্ন সুতি ও রেশমি বস্ত্রের। মার্কিন গ্রাহক-ভোক্তারা স্বচক্ষে না দেখতে পারলেও কল্পনার মাধ্যমে আঁচ করতে পেরেছেন বাংলার তাঁতশিল্পের শৈল্পিক মুনশিয়ানা সম্পর্কে। উত্পাদনের নেপথ্যে যে শ্রম, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, প্রাযৌক্তিক কলাকৌশল, রুচি-অভিরুচি, পরিবেশ-প্রতিবেশ নিহিত তা বাস্তবে জানার বাসনা জেগেছিল অনেক মার্কিনের মনে। কলকাতায় দীর্ঘকাল বসবাসকারী বোস্টনের বণিক হেনরি লি-এর স্ত্রী যেমন লিখেছেন তাঁকে বিস্তারিত জানাতে কেমন করে, কেমন হাতে এবং কোন প্রযুক্তিতে তৈরি হয় ওই সব অবিশ্বাস্য ‘উটের লোমের শাল, শুভ্র শাল, ঢাকাই মসলিন’ ইত্যাদি। লি জানালেন, ‘তা যে বর্ণনার অতীত, কেননা তিনি কখনো জানার চেষ্টা করেননি কীভাবে তৈরি হয় ওই সব সূক্ষ্ম ও কারুকার্যমণ্ডিত মূল্যবান সূক্ষ্ম বস্ত্র। কেননা তিনি মনে করেন বঙ্গ সংস্কৃতির বাইরের কোনো ব্যক্তির পক্ষে এ বিষয়ে বেশি কিছু জানা সম্ভব নয়। অতএব, এসবের কারিগরি দিক জানার চেয়ে আমার একমাত্র কামনা হলো বাণিজ্যের মাধ্যমে অঢেল সম্পদ তৈরি করে দেশে ফিরে তোমাকে নিয়ে সুখে জীবনযাপন করা।’১৯

বাংলায় উত্পাদিত কাপড় ছিল বিদেশি বণিকদের কাছে একদিকে গুণে উত্তম এবং অপরদিকে টেকসই ও অকল্পনীয়ভাবে সস্তা। স্বাভাবিকভাবেই, আমেরিকায় বাংলার তাঁতশিল্পপণ্যের চাহিদা ছিল ব্যাপক।

১৮২০ সাল পর্যন্ত অর্থাত্ আমেরিকার প্রথম শিল্পবিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত বাংলার তাঁত ও রেশমশিল্পের বড় ক্রেতা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলা থেকে আমদানি করা সব সুতি ও রেশমি বস্ত্র মার্কিন অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মিটিয়ে আমদানিকারকেরা বাড়তি পণ্য পুনঃ রপ্তানি করত দক্ষিণ আমেরিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অন্যান্য স্থানে। যা হোক, মার্কিন বণিকেরা বাংলা থেকে যেসব রকমারি তাঁত ও রেশম বস্ত্র আমদানি করতেন সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কতিপয় ব্র্যান্ড, যেমন গুঁড়া, মৌ, মামুদি, বাফতা, সান্না, লঙক্লথ, চিনজ, চেক, গামছা, রুমাল, গিলাচাদর, লুঙ্গি, বন্দনা, শিরসাকার, সানা, চেক কাপড়, ইংলিশ রুমাল, মার্কিন রুমাল, চম্পা রুমাল, বন্দনা, মৌ-সানা, মামুদি, মোগা কোষা, মৌ-আমের্তি, চিতাবুলি, বাফতা, কোশা, হাতব্যাগ ইত্যাদি।২০ উল্লেখ্য, প্রত্যেক আমদানিকারক তাঁদের পণ্য স্থানীয় বাজারে নিলামে বিক্রি করতেন। নিলামের খবর ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রচার করা হতো। এসব বিজ্ঞাপনের সাধারণ ভাষা ছিল এমন বাহারি যে বাংলা যেন পৃথিবীর একটি স্বর্গরাজ্য, যে রাজ্যের সব পণ্যই গুণে সুন্দর, কিন্তু দামে সস্তা।

প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রতি ইয়াংকিদের দৃষ্টিভঙ্গি

১৮২০-এর দশকে দেখা যায়, মার্কিন বণিকেরা বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি কলকাতায় পাশ্চাত্য বইপুস্তক আমদানি করছেন। বইয়ের বিষয়বিন্যাস ছিল সাধারণত উপন্যাস, গল্প, ভ্রমণকাহিনি, সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম, সমুদ্র, প্রাকৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি।২১ ১৯২০-এর দশকে অনেক মার্কিন ধর্মযাজক খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আগমন করেন, অনেকেই এসেছেন সপরিবারে। সমকালীন পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়, প্রায়ই মার্কিন যাজকেরা মুসলিম ও হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন, এমনকি অনেক সময় কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে।

মার্কিন বণিকদের অনেকেই কলকাতা থেকে ভারতীয় ঔত্সুক্যে পণ্য সংগ্রহ করতেন। এসব সংগ্রহ দিয়ে অনেকেই তাঁদের নিজ বাড়িতে ব্যক্তিগত জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেলেমের পেস্টার বেন্টলি উইলিয়াম (১৭৫৯-১৮১৯) তাঁর বিখ্যাত ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন, সেলেমের নাবিক মি. পিয়ার্স বাংলা থেকে নানা বিরল পণ্য এনে সে যুগের প্রসিদ্ধ বন্দর নগর সেলেমে একটি সুন্দর ব্যক্তিগত জাদুঘর নির্মাণ করে সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁর সংগ্রহের প্রধান বৈশিষ্ট্য বাংলার পোশাক পরিচ্ছদ।২২ উল্লেখ্য, মার্কিন নাবিক ও বণিকেরা কলকাতা থেকে দৃষ্টি কাড়ে, এমন নানা পণ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে নিজেদের সংগ্রহশালায় রাখতেন এবং অনেক সময় তা সেলেমে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া মেরিন সোসাইটি মিউজিয়ামে ও অন্যান্য প্রাচ্য সাংস্কৃতিক সংগ্রহশালায় স্থায়ীভাবে জমা দিতেন। উল্লেখ্য, সেলেমের ভারত-বণিকেরা সম্মিলিত হয়ে ১৭৯৯ সালে সেলেমে একটি প্রাচ্যবিষয়ক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন এ উদ্দেশ্যে যে মার্কিনরা বাংলায় না এসেই যেন বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি চিত্র মানসপটে অঙ্কন করতে সক্ষম হন। জাদুঘরটির নাম সেলেম ইস্ট ইন্ডিয়া মেরিন সোসাইটি মিউজিয়াম।২৩ বর্তমানে এর পরিবর্তিত নাম পিবডি এসেক্স মিউজিয়াম, (ইস্ট ইন্ডিয়া স্কয়ার, সেলেম)।

১৭৯৫ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত সেলেমের ইস্ট ইন্ডিয়া বাণিজ্যে জড়িত বণিকেরা একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ওই অনুষ্ঠানে বণিকদের চেষ্টা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়ার সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কিত নানা আকর্ষণীয় সংগ্রহ প্রদর্শন করে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরা। ওই প্রদর্শনীর একটি আকর্ষণীয় বিষয় ছিল সোসাইটির অনুষ্ঠানে সব সদস্য কর্তৃক বাঙালি পোশাক পরা। প্রদর্শনীতে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে বাঙালি পোশাকে পথযাত্রার আয়োজন করা হতো। এই পথযাত্রায় শরিক হতেন তাঁরাই যাঁরা কোনো না কোনো সময় কলকাতায় অবস্থান করেছেন। ওই পথযাত্রায় প্রত্যেক যোগদানকারীর হাতে দেওয়া হতো এমন কোনো না কোনো আকর্ষণীয় বস্তু, যা বঙ্গ সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। এরই একটি অংশ ছিল ছয়জন নিগ্রোবাহিত একটি পালকি, যা তখনকার কলকাতায় ছিল একটি নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় বাহন। কলকাতায় বাঙালি ভদ্রলোকদের সাধারণ অভ্যেস ছিল পালকিতে চলাচল করা। অতএব কলকাতায় মার্কিনরা পালকিতেই চলাফেরা করতেন এবং সে পালকি ছিল অধিকাংশই তাদের নিজ মালিকানার। সেলেমের বণিকেরা কলকাতা থেকে একটি পালকি আমদানি করে মেরিন সোসাইটি জাদুঘরে সংরক্ষণ করেন। সোসাইটির বার্ষিক ভোজের শোভাযাত্রায় ওই পালকিটি ব্যবহার করা হতো। পালকিটি বহন করত চারজন নিগ্রো ভৃত্য। শোভাযাত্রার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল বাঙালি পোশাক প্রদর্শন। বাংলায় অবস্থান করেছেন এমন সব বণিক, নাবিক, কর্মকর্তা সবাই বাঙালি পোশাক পরে মিছিলে যোগদান করতেন এবং তাদের প্রত্যেকের হাতে শোভা পেত বাংলার কোনো না কোনো বাণিজ্যিক পণ্য, বিশেষ করে তাঁতবস্ত্র, যেমন বন্দনা, চিন্টস, গুঁড়া, মামুদি, আমের্তি, লুঙ্গি ইত্যাদি। পালকি মিছিলের পর শুরু হতো ইস্ট ইন্ডিয়া সংস্কৃতিবিষয়ক বক্তৃতা ও ভোজোত্সব, যেখানে যোগদান করতেন মহামান্য অতিথিরাও। যেমন ১৮২৫ সালের বার্ষিক উত্সবের প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কুইন্সি অ্যাডামস (১৮২৫-১৮২৯)। ভোজে প্রেসিডেন্ট অ্যাডামসের দেওয়া টোস্টিংগুলো ছিল:২৪

1. To the merchants of the United States–May they inherit the spirit of Cosmo de Medicis and learning and arts bear testimony to their munificence.
2. To our Navigators–They have been enlightened by distinguished men of all countries.
3. To trade to India–No commercial nation has been great without it–May the experience of ages induce us to cherish this rich source of national wealth.
4. To foreign commerce–The great civiliser of Nations.

টোস্টিংগুলোর বিষয় স্পষ্টভাবেই ইঙ্গিত করে যুক্তরাষ্ট্রের ধনাঢ্য শ্রেণীর জীবনযাত্রায় বঙ্গবাণিজ্য তথা প্রাচ্য বাণিজ্যের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব। উল্লেখ্য, আঠারো শতকের প্রথমার্ধ থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়কালকে গণ্য করা হয় অ্যামেরিকান এনলাইটেনমেন্টের যুগ। বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০), এজরা স্টাইলস (১৭২৭-১৭৯৫), টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯), টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬) প্রভৃতি মনীষী ছিলেন সে আলোকিত যুগের প্রাকৃতিক প্রতিনিধি। তাঁরা মার্কিনদের উত্সাহিত করেন ক্ষুদ্র আঞ্চলিকতা অতিক্রম করে সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে এককভাবে এবং আপন করে গ্রহণ করার জন্য। মার্কিন এনলাইটেনমেন্টের একজন প্রবক্তা হিসেবে প্রেসিডেন্ট কুইন্সি অ্যাডামস (১৮২৫-১৮২৯) ওপরে উল্লিখিত তাঁর ভোজ টোস্টিংয়ে তাগিদ দিচ্ছেন এই বলে যে বিশ্ব সংস্কৃতি ও বিশ্ব সভ্যতার সঙ্গে মার্কিনদের সম্পৃক্ত হওয়ার একটি বড় মাধ্যম বঙ্গবাণিজ্য, যা কিনা ভারত মহাসাগরীয় তথা বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। ইউরোপীয় বাণিজ্যিক দেশগুলোর নাম উচ্চারণ না করে তিনি তাঁর ওপরের ৩ নম্বর টোস্টিংয়ে উল্লেখ করছেন, বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্য ছাড়া আধুনিক কোনো দেশ শিল্পায়নের পথে পা বাড়াতে পারেনি। স্পষ্টতই তিনি ইউরোপের প্রথম শিল্পায়িত দেশ ইংল্যান্ডকেই ইঙ্গিত করেছেন। যা হোক, আমরা জানি যে একইভাবে বঙ্গবাণিজ্য ইয়াংকিদের হাতেও পুঁজির বিকাশ ও শিল্পায়নের পথে সরাসরি অবদান রেখেছে।২৫

মার্কিন শিল্পায়নপ্রক্রিয়ায় বঙ্গবণিক

ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের পর বিশ্বে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঐতিহাসিকভাবে এ ঘটনা খুবই অপ্রত্যাশিত, কেননা মার্কিনরা আদর্শগতভাবে ছিল ফিজিওক্রেসি বা কৃষি অর্থনীতিতে বিশ্বাসী, যেমন ছিল ফ্রান্স ও স্পেন। রাষ্ট্রীয় নেতা জর্জ ওয়াশিংটন, জন অ্যাডামস, জেফারসন, মেডিসন সবাই ছিলেন ফিজিওক্রেসি তত্ত্বে বিশ্বাসী এবং তাঁদের নেতৃত্বে মার্কিন অর্থনীতি পরিচালিত হয়েছে ফিজিওক্রেসি তত্ত্বানুসারেই। কৃষির সঙ্গে ব্যাপক প্রাচ্য বাণিজ্য মার্কিন অর্থনীতিকে যখন ক্রমেই শক্তিশালী করে তুলছিল, তখন ইউরোপে দেখা দিল ফরাসি বিপ্লবোত্তরকালের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ। এর অভিঘাতে শুধু যুদ্ধে লিপ্ত ইউরোপীয় দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, যুদ্ধে নিরপেক্ষ আমেরিকার বঙ্গবাণিজ্যও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। মার্কিন বণিকদের ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য ক্রমেই আমেরিকাকে যুদ্ধে ঠেলে দিতে পারে, এই ভয়ে মার্কিন সরকার আন্তমহাদেশীয় বাণিজ্য অর্থাত্ মার্কিনদের ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য একটি ঘোষণার মাধ্যমে (এমবার্গো অ্যাক্ট, ১৮০৭) বন্ধ করে দেয়। ফলে বঙ্গবাণিজ্যে বিনিয়োজিত কোটি কোটি টাকার মার্কিন বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়, অলস হয়ে পড়ে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে বিনিয়োজিত বিপুল পুঁজি ও অসংখ্য বাণিজ্যিক জাহাজ। এদিকে, ইউরোপে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সংঘাতময় পরিবেশে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় মার্কিন সরকার এক ঘোষণা দিয়ে ইয়াংকি বণিকদের বঙ্গবাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গ ব্যবসায় রত বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি পুঁজিপতি গোষ্ঠী বাণিজ্যের বদলে পুঁজি বিনিয়োগের বিকল্প ক্ষেত্র হিসেবে দেশে শিল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশ্যে ১৮১৩ সালে তাঁরা বোস্টন কোম্পানি অব ওয়ালথাম নামে একটি শেয়ারভিত্তিক যৌথ কোম্পানি স্থাপন করেন। এ কোম্পানির মূল মালিক ১১ জন বঙ্গবণিক, যাঁরা ১৭৯০-এর দশকে বঙ্গ ব্যবসায় যোগদান করেন এবং ১৮১০ পর্যন্ত এ ব্যবসা থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন করে এঁদের প্রত্যেকেই আমেরিকার প্রথম কোটিপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।২৬

কিন্তু নেপোলিয়নিক যুদ্ধের অভিঘাতে এঁদের ভারত ব্যবসা দুরূহ হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে পুঁজি বিনিয়োগের বিকল্প পন্থা হিসেবে তাঁরা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্তটি এমন যে তাঁদের পুঁজি ঝুঁকিপূর্ণ বঙ্গবাণিজ্য থেকে প্রত্যাহার করে তা দেশের শিল্পায়নে বিনিয়োগ করবে। এ চিন্তাধারার নেতৃত্ব দেন বোস্টন বন্দরের ইন্ডিয়া হুয়ারফ ও ইন্ডিয়া স্টোরের মালিক এবং ভারত বাণিজ্যে বিনিয়োগকারী কোটিপতি বণিক ফ্রান্সিস কেবল লয়েল (১৭৭৫-১৮১৭)। তাঁর এ পরিকল্পনায় প্রধান পুঁজিদাতা হিসেবে যোগদান করেন তাঁর শ্যালক কলকাতা বণিক পেট্রিক ট্রেসি জ্যাকসন (১৭৮০-১৮৪৭) ও জ্যাকসনের অন্যান্য তিন ভাই, যাঁরা সবাই ছিলেন কলকাতা বাণিজ্যের কোটিপতি বণিক। লয়েলের এ পরিকল্পনায় আরও শরিক হন কলকাতা বণিক নাথান এপলটন (১৭৭৯-১৮৬১), চার্লস জেমস ও এবট লরেঞ্চ। মার্কিন শিল্পবিপ্লবের অন্যতম ঐতিহাসিক ভেরা শ্লেকম্যান এসব বঙ্গবণিক প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের নাম দেন বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস।২৭ এঁদেরই যৌথ উদ্যোগে এবং যৌথ পুঁজিতে ১৮১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বোস্টন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি নামে আমেরিকার প্রথম একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। এ কোম্পানির উদ্যোগে ১৮১৪ সালে বোস্টনের অদূরে ওয়ালথামে স্থাপিত হয় এর প্রথম বস্ত্র কারখানা। এ কারখানায়ই সর্বপ্রথম এর উত্পাদনপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ বিদ্যুত্-চালিত যন্ত্রে শুরু থেকে শেষ পর্ব পর্যন্ত একই ভবনে সম্পাদিত হয়। অচিরেই এর অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত হয় আরও কয়েকটি কারখানা, যার উদ্যোক্তা ছিলেন সবাই বঙ্গবণিক। এমনিভাবে আমেরিকার বঙ্গোপসাগরীয় বণিকদের উদ্যোগে ও পুঁজিতে শুরু হলো আমেরিকার প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব।২৮ মার্কিন শিল্পায়নপ্রক্রিয়া ছিল এমনই দ্রুত ও ব্যাপক যে ১৮১৭ সালের মধ্যে নিউ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্টেটে বিভিন্ন সেক্টরে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রায় আঠারো শত লাইসেন্স ইস্যু করা হয় এবং এর অধিকাংশই ইস্যু করা হয়েছে ম্যাসাচুসেটসের প্রাক্তন ‘ইন্ডিয়া ট্রেডার্সদের অনুকূলে’।২৯

নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সময় আমেরিকার শত শত বাণিজ্যিক জাহাজ গভীর সমুদ্রের বুকে যুদ্ধরত ইউরোপীয়দের হাতে লুট হয়। ক্ষতিগ্রস্ত বণিকেরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন সাগরবক্ষে তাঁদের নিরাপত্তা বিধানে একটি ফ্রিগেট পাঠানোর জন্য। সরকার এ সার্ভিস দিতে রাজি হয় একটি শর্তে যে ওই ফ্রিগেট নির্মাণের ব্যয় বহন করতে হবে বণিকদেরই। বণিকেরা এ প্রস্তাবে রাজি হন। তাঁদের অর্থায়নে নির্মিত হয় এসেক্স নামের যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম ফ্রিগেট।৩০ প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন এই ফ্রিগেটের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন সেলেমের বিখ্যাত বঙ্গবণিক ও একজন তুখোড় নাবিক কাপ্তান জেকব ক্রাউনিনশিল্ডকে। বঙ্গবাণিজ্যকে কেন্দ্র করে এভাবেই প্রথম শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর অভিযাত্রা।৩১

মার্কিন বঙ্গবাণিজ্যের সাংস্কৃতিক উপাদান

স্বাধীনতা লাভের পর পরই মার্কিনদের বাংলায় আগমন শুধু যে একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ ছিল তা নয়। এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিল সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক অভিলাষও। এ ব্যাপারে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এজরা স্টাইলস প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে লেখেন যে, ‘বাণিজ্যোপলক্ষে মার্কিনদের প্রাচ্যযাত্রা শুধু বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধাই সৃষ্টি করবে না, পণ্যের সঙ্গে এ সম্পর্ক লাভ করবে প্রাচ্যের জ্ঞান ও সাহিত্যও, যা কিনা হবে মার্কিন এনলাইটেনমেন্টের এক বড় দিক।’৩২ তাঁর মতে, এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার ফলে মার্কিন এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলন বিশ্বজ্ঞান লাভের পথে এক নতুন মাত্রা যোগ হলো। আমরা লক্ষ করি যে মার্কিন চিন্তাবিদ, লেখক ও সংগ্রাহকেরা বণিকদের মাধ্যমে প্রাচ্য সভ্যতাসম্পর্কিত তাত্ত্বিক ও তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান সংগ্রহের ব্যাপারে কয়েকটি বড় ইয়াংকি পরিবারকে অসাধারণভাবে উদ্যোগী হতে দেখি, যেমন: পিবডি, গার্ডনার, লয়েল, হিগিনসন, ক্রাউনিনশিল্ড, থর্নডাইক প্রভৃতি পরিবার। এঁরা সবাই বঙ্গবাণিজ্যে লিপ্ত আমেরিকার প্রথম কোটিপতি। প্রাচ্য সভ্যতা সম্পর্কে তাঁরা সবাই ছিলেন সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের আর্থিক সহযোগিতায় হার্ভার্ড, ইয়েলসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্য সভ্যতাবিষয়ক ফ্যাকাল্টি প্রবর্তন করে। এসব ফ্যাকাল্টি প্রাচ্য গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি, মুদ্রা, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূর্তি প্রভৃতি উপাদান সংগ্রহে ছিল সক্রিয়। এ ছাড়া জাহাজের অনেক মালিক ও কাপ্তানদেরও দেখা যায় প্রাচ্য সভ্যতা বিষয়ে নানা উপাদান সংগ্রহ করতে। এদের সংগ্রহ তালিকার শীর্ষে ছিল বাংলার নানা মনিহারি বস্ত্র। বস্ত্রের শিল্পশৈলী ও স্থান অনুসারে ছিল নানা চিত্তাকর্ষক নাম। যেমন: বন্দনা, মামুদি, আমের্তি, চিতাবুলি, লুঙ্গি, রুমাল, গিলাপ ইত্যাদি। এগুলোর সস্তা মূল্য ও বর্ণাঢ্যতা আলোচনার বিষয় ছিল ভোক্তা, সংগ্রাহক ও দর্শকদের মধ্যে।

মার্কিনদের প্রাচ্য বাণিজ্যের সাংস্কৃতিক উপাদানের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে যখন বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে সম্পৃক্ত সেলেমের বণিকেরা সম্মিলিত হয়ে ১৭৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রাচ্যবিষয়ক একটি সাংস্কৃতিক জাদুঘর, নাম ইস্ট ইন্ডিয়া মেরিন সোসাইটি অ্যান্ড মিউজিয়াম। ১৮৬৭ সালে এর এক আদি পৃষ্ঠপোষক ও বঙ্গবণিক যোসেফ পিবডির (১৭৫৭-১৮৪৪) সম্মানে এর নতুন নামকরণ করা হয় পিবডি মিউজিয়াম। এর বর্তমান নাম পিবডি এসেক্স মিউজিয়াম। যা কিনা বর্তমানে প্রাচ্য সভ্যতা-সংস্কৃতি বিষয়ে বিশ্বের একটি অন্যতম বৃহত্ জাদুঘর। এ জাদুঘরের আদি সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে সমকালীন পূর্ব ভারতের ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প, ভাষা, সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থরাজি, শিল্পকর্ম, বস্ত্র, ভাস্কর্য, তৈজসপত্র ও অন্যান্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন।

বঙ্গ সংস্কৃতির যে দিকটি ইয়াংকি বণিকদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটি হলো ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি। মার্কিনরা লক্ষ করেছেন যে বাঙালি জীবনব্যবস্থায় ধর্ম সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের (১৮৮৫-৮৯) দাদা ভারত বণিক রিচার্ড ফ্রি ক্লিভল্যান্ড ১৭৯২ থেকে ১৭৯৯ পর্যন্ত বহুবার কলকাতায় অবস্থান করেছেন এবং প্রত্যক্ষ করেছেন বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘The most striking feature in the character and culture of the people is their veneration for the customs, traditions and institutions of their ancestors. Their food, their dress, their marriages and production systems are all under the jurisdiction of religion.”৩৩ ক্লিভল্যান্ড বিস্ময় প্রকাশ করছেন ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনতা ও পরিপক্বতা নিয়ে, কিন্তু একই সঙ্গে ম্রিয়মাণ হচ্ছেন তাঁর নিজ জাতি মার্কিনদের মধ্যে গর্ব করার মতো এমন কিছু না থাকার জন্য। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে প্রাচ্যের সান্নিধ্যে আসার ফলে মার্কিন সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ হবে।

ভারতীয় ভেষজ ওষুধ বিষয়ে গবেষণার জন্য হার্ভার্ড অধ্যাপক জ্যাকভ বিজেলো কলকাতায় আসেন। ভেষজ ওষুধবিদ্যায় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অর্জন দেখে তিনি বিস্মিত হন, তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন ধর্মের নামে সামাজিক সম্পর্কে বর্ণবৈষম্য সৃষ্টি করার জন্য।৩৪ বোস্টনের লি বিজনেস হাউসের কলকাতা বাণিজ্য দেখাশোনা করার জন্য চার্লস এলিয়ট নর্টন (১৮২৭-১৯০৮) কলকাতায় আসেন ১৮৪৯ সালে। পরবর্তীকালে তিনি ছিলেন প্রভাবশালী নর্থ অ্যামেরিকান রিভিউয়ের সম্পাদক (১৮৬৩-১৮৬৮) এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্ট্রি অব ফাইন আর্টসের অধ্যাপক (১৮৭৪-১৮৯৮)। বঙ্গ সংস্কৃতির বৈপরীত্য সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, বাঙালি গুণীরা যে ধর্মেরই হোন না কেন দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তাঁরা একাধারে পালন করেন কিছু আদি বর্বর প্রথা প্রতিষ্ঠান, অপরদিকে প্রদর্শন করেন সাহিত্য, অর্থনৈতিক উত্পাদন, শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঔত্কর্ষ।৩৫ নর্টনের বন্ধু কবি হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলো (১৮০৭-১৮৮২) তাঁর কাছে জানতে চান বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের মান সম্পর্কে। উত্তরে নর্টন জানান, ‘হিন্দুদের মধ্যে যোগ্য লোকের খুবই অভাব এবং সাহিত্য ব্যাপারে তাদের যোগ্যতা খুবই সীমাবদ্ধ। এখানে ইয়ং বেঙ্গল নামে একটি ছোট ও তরুণ সাহিত্য গোষ্ঠী আছে। কিন্তু এরা এমনই বুরবক যে নিজের ভাষায় ও নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে সাহিত্য চর্চা না করে এরা ইংরেজি ভাষায় নিম্নমানের কবিতা ও গল্প লেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করছে।’৩৬

নিউ ইংল্যান্ডের ভারত বণিকদের গর্ব ছিল যে তাঁরা ঘর ছেড়ে প্রাচ্যদেশে গিয়ে বিত্তশালী হয়েছেন, অর্জন করেছেন বিপুল সামাজিক প্রভাব। তাঁরা রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের কৃষি অর্থনীতিকে বেগবান করার উপাদান জুগিয়েছেন। নিউ ইংল্যান্ডে তাঁদের উত্থান ঘটে একটি সংগঠিত ধনী অভিজাত শ্রেণী হিসেবে। ১৮১৫ সাল থেকে পরিবারগতভাবে এই বণিক শ্রেণীর শীর্ষে ছিল ক্রাউনিনশিল্ড, পিকম্যান, রজার্স, লিজ, কেবটস, মেকে, কুলিজে, পিবডি, স্টোন, সিলসভি, লি, গার্ডনার, লয়েল, হিগিনসনস, বুলার্ড, ব্রাউন, থর্নডাইক ও পিকারিং পরিবার। এঁদের সবাই কোটিপতি হয়েছেন বঙ্গবাণিজ্য থেকে এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়েছেন বঙ্গবাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই। বিখ্যাত সমকালীন জনপ্রিয় মার্কিন লেখক অয়েনডেল হোমস তাঁদের সামাজিক, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রভাবের নিরিখে নাম দিলেন ‘Brahmin Caste of New England’, যেমন ইংল্যান্ডে বেঙ্গল ফেরতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের ডাকা হতো ‘নবাব’ বলে। বেঙ্গল ফেরতা সমকালীন মার্কিন বণিকদের বিপুল সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে হার্ভার্ড ঐতিহাসিক স্যামুয়েল এলিয়ট মরিসন মন্তব্য করেন:

‘An East India merchant in Boston before 1812, possessed social kudos to which no cotton millionnaire could pretend, unless previously initiated through Federalist commerce to have an office on India Wharf, Boston, or to live in the India Row that comprised the fine old square–built houses of many a sea-port town, conferred distinction. Among sailors, the man who had made an East India voyage took no back-wind from any one; and on Cape Cod it used to be said of a pretty, well bred girl, ‘She’s good enough to marry an East India Captain.’৩৭

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে লিপ্ত অনেক ইয়াংকি বণিক বিভিন্ন স্থানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। যেমন ১৮০৪ সালে নিকোলাস ব্রাউন তাঁর নামে স্থাপন করেন ব্রাউন ইউনিভার্সিটি। উনিশ শতকের প্রথম সিকিতে ইয়াংকি বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত হয় অনেক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর। হার্ভার্ড, ইয়েল, মিসিসিপি প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় নিয়মিত অনুদান লাভ করেছে ইয়াংকি ভারত-বণিকদের থেকে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভারত বণিক জোসেপ পিবডি ও তাঁর ছেলে জর্জ পিবডি অনুদান দিয়েছেন কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটিকে।৩৮ পিবডিদের প্রস্তাব ও অর্থায়নেই প্রথম অ্যামেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে। পিবডির সুপারিশ ও অর্থায়নে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে একটি চুক্তি হয় যৌথভাবে সংস্কৃত ভাষাসংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ ও আদান-প্রদানের।৩৯ ইয়াংকিদের মধ্যে কলকাতা ব্যবসায় অন্যতম ধনী ব্যক্তি ফিলাডেলফিয়ার এডওয়ার্ড হল। একপর্যায়ে তিনি ব্যবসার পাশাপাশি কলকাতায় সংস্কৃত ভাষা শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। তিনি কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির সংস্কৃত ভাষার একটি গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করেন। এ প্রকল্পেরই একটি শর্ত ছিল সোসাইটির পণ্ডিতেরা তাঁকে সংস্কৃত ভাষা শেখাবেন। হল তাঁর ব্যবসা ছেড়ে কয়েক বছর কলকাতায় সংস্কৃত ভাষার চর্চা করেন। উল্লেখ্য, আমেরিকার প্রাচ্যবিদ সংস্কৃতজ্ঞদের মধ্যে হলই প্রথম সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ।৪০ উইলিয়ম ডুয়ান নামে নিউইয়র্কের এক ব্যবসায়ী তাঁর বঙ্গ ব্যবসা পরিত্যাগ করে কলকাতায় দ্য ওয়ার্ল্ড নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন (১৭৯১)। এর প্রথম ইস্যুতে তিনি ঘোষণা দেন যে তিনি বাঙালিদের সেবা করতে চান একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বৈরতান্ত্রিকতার সমালোচনা করার অভিযোগে সরকার তাঁর পত্রিকাটি বন্ধ ঘোষণা করে (১৭৯৪), তাঁকে বঙ্গ থেকে বহিষ্কার করে।৪১

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় মার্কিন-কলকাতার বণিকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার প্রভাবে আমরা অচিরেই নিউ ইংল্যান্ডে একটি উদারমনা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উত্থান দেখতে পাই। উল্লেখ্য, ধর্মীয়ভাবে নিউ ইংল্যান্ড ছিল একটি রক্ষণশীল সমাজ। কিন্তু প্রাচ্য সভ্যতার সান্নিধ্যে এসে অনেক ইয়াংকি বণিক ধর্মকে নতুনভাবে বিচার করার প্রয়াস পান। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিলনে সনাতন সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নতুন প্রবাহ সৃষ্টি হোক, এ বাসনা নিয়ে অনেক ইয়াংকি বণিক প্রাচ্যচর্চায় উদারভাবে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন। এর প্রভাবে অচিরেই নিউ ইংল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিকশিত হয় একটি নতুন শ্রেণী, যাদের স্লোগান হলো মুক্তচিন্তার মাধ্যমে মানুষের সনাতন জীবনের বাঁধন থেকে মুক্তিলাভ। এ আন্দোলনকে সার্বিক সহযোগিতা দান করে নিউ ইংল্যান্ডের বঙ্গবণিক গোষ্ঠী। তাঁদের আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতায় অচিরেই বিকশিত হয় একটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-দার্শনিক গ্রুপ, যাদের প্রাচীনপন্থীরা ব্যঙ্গ করে উপাধি দেয় New England Brahmin. নিউ ইংল্যান্ড ব্রাহ্মণদের নেতৃত্ব দেন দার্শনিক রালফ ওয়াল্ডো ইমারসন (জ. ১৮০৩)। অন্যান্য সহযোগী ‘ব্রাহ্মণ’ ছিলেন নাথানিয়েল হোথর্ন (জ. ১৮০৪), হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলো (জ. ১৮০৭), হেনরি ডেভিড থরো (জ. ১৮১৭), ওয়াল্ট হুইটম্যান (জ. ১৮১৯) ও আরও অনেকে। নিউ ইংল্যান্ড ব্রাহ্মণদের প্রত্যেকেই মার্কিন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ছিলেন একেকজন গুরু, যাঁদের চিন্তাধারা ছিল মৌলিক ও সাহসিক। সামগ্রিকভাবে নিউ ইংল্যান্ড ‘ব্রাহ্মণদের’ চিন্তাধারার দার্শনিক নাম দেওয়া হয় ট্রান্সডেন্টালিজম। এ তত্ত্বের দার্শনিক প্রেরণা জোগায় প্রাচীন হিন্দু দার্শনিক শংকর আচার্যের মায়াবাদ দর্শন।৪২ শংকরের মায়াবাদ দর্শন আর ইমারসনের ট্রান্সডেন্টালিজম তত্ত্বের মধ্যে মিল লক্ষণীয়। পণ্ডিতেরা একমত যে শংকরের মায়াবাদ তত্ত্ব ইমারসনের ট্রান্সডেন্টালিজম মতবাদকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে এবং তা ইমারসন নিজেই তাঁর জার্নালে বহুবার উল্লেখ করেছেন।৪৩

সিদ্ধান্ত

এ আলোচনায় আমরা লক্ষ করি, মার্কিনরা সমকালীন অন্যান্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মতো এ দেশে কোনো ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেননি। বাণিজ্যই ছিল তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। মার্কিন কংগ্রেস ইয়াংকি বণিকদের প্রাচ্যে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেছে এই শর্তে যে ইউরোপীয়দের মতো প্রাচ্যে তাঁরা কোনো উপনিবেশ স্থাপন করতে পারবেন না এবং স্থানীয় কোনো শক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন না। সরকার প্রাচ্যে বাণিজ্য করার জন্য অনুমতি দেয় ব্যক্তিকে, কোনো কোম্পানিকে নয়। তবে দেখা যায় যে ভারত বাণিজ্যের সার্বিক প্রতিযোগিতায় ক্রমেই প্রাচ্য বাণিজ্য নিউ ইংল্যান্ডের কতিপয় পরিবারের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ে। নিউ ইংল্যান্ডে তাঁদের উত্থান ঘটে একটি সংগঠিত ধনী অভিজাত শ্রেণী হিসেবে। ১৮১৫ সাল থেকে পরিবারগতভাবে এই বণিক শ্রেণীর শীর্ষে ছিল ক্রাউনিনশিল্ড, পিকম্যান, রজার্স, লিজ, কেবটস, মেকে, কুলিজে, পিবডি, স্টোন, সিলসভি, লি, গার্ডনার, লয়েল, হিগিনসনস, বুলার্ড, ব্রাউন, থর্নডাইক, পিকারিং প্রভৃতি পরিবার। এঁদের সবাই কোটিপতি হয়েছেন বঙ্গবাণিজ্য থেকে এবং নিউ ইংল্যান্ডে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়েছেন আবার বঙ্গবাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই। বিখ্যাত সমকালীন জনপ্রিয় মার্কিন লেখক অলিভার অয়েনডেল হোলমস তাঁদের সামাজিক, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রভাবের নিরিখে নাম দিলেন Brahmin Caste of New England। যেমন ইংল্যান্ডে বেঙ্গল ফেরতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের ডাকা হতো ‘নবাব’ বলে। এসব পরিবারের নেতৃত্বে ইয়াংকিদের বঙ্গবাণিজ্য পরিচালিত হয় ১৮৩০ সাল পর্যন্ত। এর পর থেকে ইয়াংকিদের বঙ্গবাণিজ্য নানা বৈশ্বিক কারণে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে এবং উনিশ শতকের শেষ নাগাদ এসে তা তাত্পর্যহীন হয়ে পড়ে।

তবে বাণিজ্যিক দিক থেকে মার্কিন-বাংলা সম্পর্ক তাত্পর্যহীন হয়ে পড়লেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে তা তেমন স্তিমিত হয়নি কখনো। মার্কিন বঙ্গবণিকদের স্থাপিত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এখনো বিদ্যমান এবং বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুকূলে পালন করছে শক্তিশালী ভূমিকা।

 তথ্যসূত্র ও টীকা

১. মার্কিন কংগ্রেস ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করে এই শর্তে যে মার্কিন বণিক গোষ্ঠী কোনো অজুহাতেই সেখানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বা ঘাঁটি স্থাপন করতে পাববে না। বিস্তারিত বিবরণের জন্য, দেখুন  Sirajul Islam, Golden Jubilee Lecture on ‘America’s Maritime Contact with Bengal 1785-1870: Commerce, Competition, Knowledge,’ 24 October 2002, at Asiatic Society of Bangladesh.

২. বিশদ বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য, Susan S. Bean, Yankee India, American Commercial and Cutural Encounters with India in the Age of Sail 1784-1860, (Peabody Essex Museum, 2001, Salem, M.A., USA. ; G. Bhagat, Americans in India 1784-1860, (New York University, 1970); William Milburn, Oriental Commerce, (London 1819); and Amales Tripathi, Trade and Finance in the Bengal Presidency, 1790-1833, (Calcutta 1956).

৩. দেখুন, ‘Collections of Massachussetts Historical Society,’ 7th Series, vol. X, Commerce of Rhode Island, vol. V11 (1775-1800), Boston MDCCCCXV, p.207.

৪. US Congress, American State Papers: Commerce and Navigation, 1790-1836.

৫. যেহেতু নিউ ইংল্যান্ডের ইয়াংকিরাই বঙ্গবাণিজ্যে বরাবর লিপ্ত ছিল, তাই বর্তমান প্রবন্ধে মার্কিন বলতে ইয়াংকিদেরই চিহ্নিত করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব কোণের ছয়টি স্টেটসকে শাসনতান্ত্রিকভাবেই বলা হয় নিউ ইংল্যান্ড। স্টেটসগুলোর নাম কানেটিকাট, মেইন, ম্যাসাচুসেটস, নিউ হ্যাম্পশায়ার, রোড আইল্যান্ড ও ভার্মন্ট। এ স্টেটসগুলোর শ্বেতাঙ্গ বাসিন্দাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মূলে ব্রিটিশ। নিউ ইংল্যান্ড নামে এই অঞ্চল শাসনতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃত। নিউ ইংল্যান্ডের বাসিন্দাদের বলা হয় ইয়াংকি।

৬. British Parliamentary Papers, ‘Fourth Report, 1812,’ Appendix 47, Supplement no. 6, p. 43.

৭. উল্লেখ্য যে সে সময়ে আমেরিকার অধিকাংশ স্টেট ছিল কৃষি অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। স্বাধীনতার পর শুধু নিউ ইংল্যান্ডের কয়েকটি স্টেট বাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বোস্টন ও সেলেম বন্দর ছিল বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে সবচেয়ে উদ্যমী। এ প্রবন্ধে আমেরিকা বলতে আমরা মূলত বুঝিয়েছি নিউ ইংল্যান্ডকে।

৮. The Memorial of the Merchants of Salem and its Vicinity to the Congress of the United States of America, 31 December 1819, (Baker Business School Library, Harvard), pp. 3-4.

৯. এ গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা নেতা ছিলেন ফ্রান্সিস কেবট লয়েল (১৭৭৫-১৮১৭) এবং অন্যান্য প্রধান প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পেট্রিক ট্রেসি জ্যাকসন, নাথান এপলটন, চার্লস জেমস, এবট লরেঞ্চ। এঁরা সবাই পুঁজি তৈরি করেছেন কলকাতা ব্যবসা থেকে এবং এঁরা সবাই কলকাতায় অবস্থান করেছেন।

১০. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য, Robert F. Dalzell, Enterprising  Elite: The Boston Associates and the World They Made, (Harvard University Press, 1987).

১১. American Neptune, vol. 4, No. 1, 1944.

১২. দেখুন Amales Tripathi, Trade and Finance in the Bengal Presidency 1793-1833, (Calcutta, 1979), Appendix- Countrywise Charts,273-289 ; Susan S. Bean, Yankee India: American Commercial and Cultural Encounters with India in the Age of Sail 1784-1860, (Peabody Essex Museum, 2001), p. 7; and Sirajul Islam,  ‘America’s Maritime Contact with Bengal, 1785-1870,’ pp.151-180, Golden Jubilee Volume, Asiatic Society of Bangladesh (1952-2002), pp 130-151.

১৩. এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যানের জন্য দ্রষ্টব্য, Amales Tripathi, Trade and Finance in the Bengal Presidency 1793-1833; Appendix, pp. 273-290; G.A. Prinsep, Remarks on the External Commerce of and Exhanges of Bengal with Appendices and Accounts and Estimates (London, 1823); H.H. Wilson, A Review of the External Commerce of Bengal from 1813-14 to 1827-28, (Calcutta, 1830); and H. Furber, John Company at Work, (Cambridge, Mass., 1948).

১৪. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য, Sirajul Islam, ‘Contributions of Asian Trade to the Early Transformation of the United States of America,’ Journal of the Asiatic Society of Bangladesh (Hum.), vol. 54, No. 1, June 2009, pp.1-25; ‘The Yankee Maritime Merchants in India Trade: Their Contributions to American Industrial  Revolution 1790-1830”, Asiatic Society of Bangladesh Presidential Lecture 29 December 2011.

১৫. ১৭৯০ সাল থেকে আমেরিকায় দশ-বার্ষিকী লোকগণনা ব্যবস্থা শুরু হয়। প্রথম এই গণনায় আমেরিকার মোট লোকসংখ্যা ছিল চার মিলিয়নের একটু নিচে (৩৯২৯২১৪)।

১৬. উদ্ধৃত, James McCutcheon, “The Asian Dimension in the American Revolutionary Period”, in Cedric B. Cowing (ed.), The American Revolution: Its Meaning to Asians and Americans, (Hawaii 19770) p. 89.

১৭. Proceedings of the Supreme Executive Council of Pennsylvania, November 3, 1785, Colonial Records of Pennsylvania, vol. X1V, p.569.

১৮. Henry Lee’s Memorandum, Calcutta, October 16, 1812 in Lee Family Papers, Massachusetts Historical Society, হেনরি লি (১৭৮২-১৮৬৭) ব্যবসায় সব পুঁজি খুঁইয়ে অবশেষে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসে হাজির হন এবং একটানা পাঁচ বছর  ব্যবসা করেন।

১৯. Auction sales list by the auction firm T.K. Jones and Co Auctioneer, Baker Library, Harvard.

২০. Vaughan Family Papers, Manuscript No. 83, Massachusetts Historical Society Collections.

২১. The Diary of William Bentley, (Salem, Mass. Essex Institute), vol. 3,  p. 52.

২২. East India Marine Society, Salem; Susan S. Bean, Yankee India: American Commercial and Cultural Encounters with India in the age of Sail, 1784-1860, (Peabody Essex Museum, Salem, 2001), pp. 27-28.

২৩. Essex Register, 17 October 1825.

২৪.  আরও বিস্তারিত তথ্যের জন্য দ্রষ্টব্য, সিরাজুল ইসলাম, ‘The Yankee Maritime Merchants in India Trade: Their Contributions to American Industrial Revolution, 1790-1830,’ (Presidential Lecture at Asiatic Society of Bangladesh, 29 December 2011); ‘The Cargo and Culture of the New Englanders’ Voyages to Calcutta, 1785-1850,’ Journal of the Asiatic Society of Bangladesh; ‘America’s Maritime Contact with Bengal 1785 – 1870: Commerce, Competition, Knowledge,’ Golden Jubilee Lecture 24 October 2002.’

২৫. For names of Boston Associates, see Robert F. Dalzell, Enterprising Elite: Boston Associates and the World They Made, (Harvard University, 1987), pp 28-29.

Lowell (owner of India Wharf), Patrick Tracy, Jackson (brother in law of Lowell), James (Jackson’s brother), James (Jackson’s brother), Charles (Jackson’s brother), Nathan Appleton, Samuel Appleton, John Gore, Israel Thorndike (senior), Meria Gotting (Lowell’s partner in IndiaWharf).
Authorised limit of capital 400,000.00 Dollars

২৬. Vera Shlakmen, Economic History of a Factory Town: A Study of Chicopee, (Massachusetts, 1935).

২৭. Kenneth Wiggins Porter, The Jacksons and the Lees, vol. 1, pp. 765-768; (Harvard University Press, 1937), pp. 765-768.

২৮. Bernard Bailyn et.al., The Great Republic, (Heath and Company, 1977), p.395.

২৯. এ ফ্রিগেট নির্মাণে অর্থ দান করেন ১৩ জন ভারত বণিক। দানের পরিমাণ অনুসারে তাঁদের নাম যথাক্রমে বেঞ্জামিন পিকম্যান, উইলিয়ম গ্রে, ইলিয়াস হাসকেট ডার্বি, জন সরিস, ইশাবোধ নিকোলাস, জন ডার্বি, ইজেকেল ডার্বি, ই এইচ ডার্বি (জুনিয়র), নেথানিয়েল ওয়েস্ট, রিচার্ড ডার্বি, ক্লিফোর্ড ক্রাউনিনশিল্ড, বেঞ্জামিন হজেজ ও স্যামুয়েল পোপস। Source: Howard Corning, ‘Salem Men in the Early Nineteenth Century’, Essex Institute Historical Collections, LXXV (January 1939). 

৩০. দেখুন Crowninshield’s memorandum   to U.S. President Thomas Jefferson, January 29, 1805,  in Jefferson MSS, State Department Archives, 1805.

৩১. James McCutcheon, ‘The Asian Dimension in the American Revolutionary Period’, in The American Revolution: Its Meaning to Asians and Americans,  edited by  Cedric B Cowing (Honolulu, Hawaii, 1977), p. 89.

৩২. Richard Feffrey Cleveland, Voyages and Commercial Enterprises of Sons of New England, (First published, New York 1857, reprinted edition, 1968), pp.124-25.

৩৩. Jacob Bigelow’s Journal, 1811-12, at Massachusetts Historical Society, Boston.

৩৪. Norton to Charles H. Mill, 10 February 1850, See Norton Papers at Houghton Library, Harvard.

৩৫. Norton to Longfellow, Calcutta 21 October 1849, Norton Papers. Peabod Museum, Salem.

৩৬. Samuel Eliot Morison, The Maritime History of Massachusetts, 1783-1860, (Harvard University Press, 1921), p.285.

৩৭. Norton to Longfellow, Calcutta 21 October 1849, Norton Papers, Peabod Museum, Salem.

৩৮. Abu Taher Majumdar, Sir William Jones: Glimpses into Eighteenth Century Critical Thoughts, (1992), p. 28.

৩৯. George Baghot, Americans in India (1784-1860 ), (New York, 1970), pp.117-18.

৪০. Samarjit Chakraborti, The Bengali Press (1818-1868): A Study in the Growth of Public Opinion, (Calcutta, 1976), p. 7.

৪০. Louis K. Harnett, ‘Emerson and the Bhagavad-Gita,’ Ariel, VII (May 1907); Arthur Christy, The Orient in American Transcendentalism, (New York, 1932).

৪১.Satya S. Pachori, Emerson’s Essay on “Illusions” and Hindu Maya, Kyushu American Literature, No. 18, October 1977, pp.45-51.