বাঙালি জাতীয়তাবাদ: চার দশক পর

‘Your glory walks hand in hand with your doom.’ 
Homer ‘The Iliad’

সারসংক্ষেপ

বাঙালি জাতীয়তাবাদ আজ এক যুগসন্ধিক্ষণের মুখোমুখি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে মুখ্য আদর্শিক ভূমিকা পালন করার পর তার সংকট আজ ঘনীভূত হয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যখন তাকে ঘিরে চলেছে নানা সংকট আর বিভ্রান্তি। এ প্রবন্ধে সেই সংকট ও ব্যর্থতার কারণ পর্যালোচনা করা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ব্যর্থতার দুটি দিক এই প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে। একটি ধর্মীয় উপাদানের গুরুত্ব বৃদ্ধি, অন্যটি তার কাল্পনিক বা ইউটোপীয় চরিত্র। এই দুই সংকট বাঙালির জাতি-পরিচয়কে প্রশ্নবোধক করে তুলেছে এবং ধর্মীয় ভিত্তিতে নতুন জাতি-পরিচয়ের বীজ বপন করছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আত্মপরিচয়, নিয়ন্ত্রণবাদী, ধনাত্মকমূলক দ্বান্দ্বিকতা, কল্পনার জগত্, মিথ্যা চেতনা, উত্কট আত্মপ্রেম

প্রারম্ভিক কথা

আলোচনার শুরুতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য মনে রাখা প্রয়োজন। আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদ মানুষের আত্মপরিচয়গত সংগ্রামের অন্যতম একটি রূপ হতে পারে, কিন্তু তাকেই একমাত্র আদর্শ হিসেবে ভাবা সঠিক নয়। মানুষের আত্মপরিচয় জাতি-পরিচয়কে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে, কখনো শ্রেণী-পরিচয়ও দখল করে নেয় ওই আত্মপরিচয়ের স্থান। আবার কখনো বা বংশ, সংস্কৃতি, ধর্ম বা ভাষা-পরিচয়। তবে জাতীয়তাবাদী চেতনা হলো অতিমাত্রায় খেয়ালি এক আদর্শ। তার উদাহরণ হয়তো বা ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির শাহবাগ চত্বর। নতুন প্রজন্মের হাতে সেখানে নতুন আদলে সে আত্মপ্রকাশ পেল যখন, তার আগে আমরা ভেবেছিলাম জাতীয়তাবাদের ইতিমধ্যে সমাপ্তি ঘটে গেছে। ফলে জাতি-পরিচয়ের শক্তিকে কখনো একেবারে খাটো করে দেখা যায় না, আবার তাকে খুব শক্তিশালী ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়াও কঠিন। সবকিছু আসলে নির্ভর করে কোন শক্তি তার পেছনে দাঁড়িয়ে, কার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে জাতীয়তাবাদী স্লোগান, তার ওপর। ফলে দোষ-গুণটা আসলে জাতীয়তাবাদের নয়, বরং জাতি-পরিচয়ের অনুভূতিকে সমাজের কোন শক্তি কীভাবে ব্যবহার করছে তার। এর ব্যর্থতা সে কারণে রাজনৈতিক ও সাময়িক।

প্রসঙ্গটি কেন গুরুত্বপূর্ণ তা-ও এখানে বলে নেওয়া দরকার। আত্মপরিচয়ের দিক থেকে বাঙালি জাতি আজ এক যুগসন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে। আমরা লক্ষ করছি, জাতি-পরিচয়ের গা ঘেঁষে ধর্ম-পরিচয়ের প্রবল উত্থান। আর তাকে যারা প্রতিনিধিত্ব করে, তারাও নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। তারা নতুন শক্তি, শহরের আধুনিক সভ্যতার বাইরের এক জগত্ থেকে আসা। তাদের ব্যানার হেফাজতে ইসলাম হতে পারে, তারা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটিই তাদের আসল পরিচয় নয়। তাদের সামাজিক শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত গ্রামের দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে। এরা সেই কৃষকসমাজের বিশাল অংশ, যারা ধর্মকেন্দ্রিক আত্মপরিচয়ের যেমন মুখপাত্র, তেমনি একই সঙ্গে তারা গ্রাম-শহরের মধ্যকার বিদ্যমান গভীর বৈষম্যেরও প্রতীক। তারা রাষ্ট্রের অবহেলার প্রতীক। গ্রামকে দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় নজরের বাইরে রাখা, তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা, তার প্রতি উদাসীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ। অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিকমুখী একটি সমাজ গড়ে তোলা যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তাহলে সেটি কখনো উগ্র জাতি বা ধর্ম-পরিচয় দিয়ে সম্ভব নয়। এখানে আমাদের একটি মধ্যপথ খুঁজতে হবে। এই প্রবন্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা, কী কারণে সে আমাদের একটি আধুনিক বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরণে ব্যর্থ হলো, সেটিই খুঁজতে চেষ্টা করব। উগ্র ধর্ম-পরিচয় আজ বাঙালির জীবনে স্থান করে নিচ্ছে। স্থানস্বল্পতার কারণে এখানে সে আলোচনা করা সম্ভব হলো না।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ: পরাজয় এবং জয়

ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তিনটি ধাপ অতিক্রম করেছে। তার প্রথমটি ভারতে যখন ব্রিটিশ শাসনের শেষ অধ্যায় চলছিল, তখন। সে সময় সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে ভিন্ন একটি ধারা, তা সে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, স্থান করে নিয়েছিল। সেটি ছিল অখণ্ড বাংলাকে নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা। সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে সেটি পুষিয়ে নেওয়া হয় ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় দিয়ে। কীভাবে জাতীয়তাবাদী আদর্শ সফল হয় এবং তা থেকে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারে, তার তিনটি বিশ্লেষণ রয়েছে। এক. কোনো জাতি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নিতে পারে। যার দৃষ্টান্ত ইসরায়েল। ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল নামে এক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল সারা বিশ্বে বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদি জাতিকে একত্র করে। তারা একটি মাতৃভূমি দাবি করে এসেছিল বহুকাল ধরে। সেই দাবি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবেচিত হয়ে জন্ম নেয় ওই রাষ্ট্রের। ফিলিস্তিনি জাতির রাষ্ট্রগঠন বিষয়টিকেও ওই একই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা যায়। রাষ্ট্রগঠন তার পক্ষে এখনো সম্ভব না হলেও পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার স্বনিয়ন্ত্রিত এলাকায় যে সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে, সেটি অচিরেই একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে। দুই. কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আমলাতন্ত্রের সহায়তায় জাতি-ধারণাকে চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে এবং তার ফলেও জন্ম নিতে পারে এক ধরনের জাতীয়তাবাদের। উদাহরণ হিসেবে রাশিয়ার জার পিটার তাঁর দেশকে আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে রুশ জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সম্রাট নিকোলাসও ঊনবিংশ শতাব্দীতে সক্ষম হয়েছিলেন রুশ জাতীয়তাবাদের প্রবল ঢেউ জাগিয়ে তুলতে। ওই একই পথে জাপানের মেইজি ও তুরস্কের অটোমান শাসকেরাও জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিলেন তাঁদের নিজ নিজ দেশে, বিশুদ্ধ আমলাতান্ত্রিক উপায়ে।

এই দুই ধরনের জাতীয়তাবাদের তুলনায় অনেক বেশি কাছের সেই ধরনের জাতীয়তাবাদ, যা জন্ম নিতে পারে যখন কোনো জাতি সংখ্যালঘু থাকার কারণে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়। ওই নির্যাতনের কারণে একটি জাতি অধস্তনতার পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হতে পারে। এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে সফল হয়েছিল, তার দুটি কারণ ছিল। একটি হলো জাতির অভ্যন্তরীণ সংগতি গড়ে তোলায় সফলতা। দ্বিতীয়ত, অন্য জাতি থেকে তার ভিন্নতা নির্ণয় এবং জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে সাফল্য।১

কেন এবং কী কারণে পাকিস্তানের অন্যান্য জাতি থেকে বাঙালিরা আলাদা এবং কোন কোন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক কারণে তাকে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে ভিন্ন একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে, তা আপামর বাঙালির কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বাঙালি যে পৃথক একটি জাতি এবং বিচ্ছিন্নতা ছাড়া তার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, সেটি বাঙালির কাছে ক্রমে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’ এই বিভাজন-রেখা আদর্শ হিসেবে স্থান করে নেয়।২

এই পার্থক্যের দিকে তাকিয়ে বাঙালি সংগঠিত হতে থাকে। ওই বাস্তবতা থেকে দূরে সরে আসার বাসনা জাগে এবং এক নতুন স্বপ্ন-ভুবন সৃষ্টির সংগ্রামে মনোনিবেশ করে। ‘আমরা’ ও ‘তারা’—এই বিভাজন-রেখা জাতীয়তাবাদী চেতনার বিজয়কে বেগবান করে।৩

জাতীয়তাবাদের সংকট

জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ককে অনেকটা রূপক অর্থে আমরা তুলনা করতে পারি প্রেমের সঙ্গে। প্রেমের প্রথম পর্যায়ে আমরা দেখি আবেগ ও অনুভূতি। তাতে সিক্ত হয় নর-নারী। এবং তারই এক জটিল মিথস্ক্রিয়া থেকে পরবর্তী সময়ে সৃষ্টি হয় পরিণয়ের। পরিণয় শেষে জীবনের নিত্যনৈমিত্তিকতার প্রবল অভিঘাতে প্রেমের আকর্ষণে পড়ে ভাটা। ধীরে ধীরে প্রেমস্পৃহার অনিবার্য নির্বাসন ঘটে—কারও ক্ষেত্রে তা প্রবল বেগে, কারও ক্ষেত্রে দুর্বল বা ধীরভাবে। এই বিবর্তনের বিষয়টি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সত্য, তেমনি সত্য জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে। আত্মপরিচয়ের আবেগে জাতি প্রথমে আপ্লুত হয়। সংগ্রাম, আন্দোলন, সমষ্টিগত ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে সে তার অতি আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাও পেয়ে যায়। আবির্ভাব ঘটে জাতিরাষ্ট্রের। কিন্তু তারপরেই সুনামির প্রবল বেগের মতো সমস্যার ঢেউ তাকে আঘাত করে একের পর এক। তাকে সংগ্রাম করতে হয় অর্থনীতির কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে। সংকুচিত হতে থাকে তার জাতিকেন্দ্রিক আবেগ। কোনো এক সময় অনেকটা অজান্তেই ওই পরিচয়ের আবেগ হারিয়ে যায় জাতির মন থেকে।

এই বিবর্তনের ব্যাপারটি অন্যান্য জাতীয়তাবাদের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ভাবা যায়। আমরা জানি, নানা অগ্নিপরীক্ষা পেরিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিজয়ী হয়েছিল। তার মধ্যে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, এগারো দফা, ১৯৭০-এর নির্বাচনের রায় বাস্তবায়নে পাকিস্তানি শাসকদের অনীহাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অসহযোগ আন্দোলন অন্তর্ভুক্ত। এসব পর্যায় পেরিয়ে আমরা পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু বহুবিধ চ্যালেঞ্জের অভিঘাতে বিগত ৪২ বছরে তার আকর্ষণ-শক্তি ক্ষীণ ও স্তিমিত হয়ে এসেছে, ক্ষয় ঘটেছে তার প্রভাবের। যে জাতীয়তাবাদী আবেগ জাতিকে এককালে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ও মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আজ তার পক্ষে অনুরূপ কোনো সংগ্রামে আদর্শিক নেতৃত্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া কঠিন বলে মনে হয়। জনগণকে ওই আদর্শের পেছনে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করা তার পক্ষে কষ্টকর। প্রশ্ন হলো, কেন? একটি কারণ, যেকোনো জাতীয়তাবাদে দুটি বিপরীতমুখী স্রোতোধারা লক্ষ করা যায়। একটি স্রোত ইতিবাচক, অন্যটি নেতিবাচক। ইতিবাচক স্রোত বলতে জাতীয়তাবাদের বিশেষ আকর্ষণী শক্তিকে বোঝায়। সে জাতি-পরিচয়ের বাহক। তার ক্ষমতা ও দক্ষতা জাতীয় আশা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনগণের মধ্যে সে আবেগ সৃষ্টি করে। জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার থাকে প্রশংসনীয় অবদান।

এই গুণাবলির পাশাপাশি রয়েছে বিপদের সম্ভাব্য উত্স। জাতীয়তাবাদী আদর্শ গণমানুষকে তার পতাকার নিচে একতাবদ্ধ করে, সন্দেহ নেই। কিন্তু কেবল স্বাধীনতার আশা নিয়েই কোনো জাতি তৃপ্ত থাকে না। তাকে ঐক্যবদ্ধ করার পথে আরও নানা প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী সব দাবি পূরণের প্রতিজ্ঞা করে থাকেন জাতীয়তাবাদী নেতারা। সে কারণে জাতীয়তাবাদী আদর্শ জনপ্রিয় হয় বটে, কিন্তু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র যখন বাস্তবে রূপ নেয়, তখন ওসব দাবি পূরণের প্রচেষ্টা ও সক্ষমতায় ঘাটতি লক্ষ করা যায়। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। যেসব প্রতিশ্রুতি মানুষের মনকে প্রবল আশায় উদ্দীপ্ত করেছিল, সেগুলো পূরণে ওই আদর্শের অসহায়ত্ব মানুষকে মোহমুক্ত করে জাতীয়তাবাদের বলয় থেকে তাকে ক্রমে দূরে সরিয়ে দেয়। দেখা যায়, মানুষের খাদ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশল জাতীয়তাবাদের ধারায় সব সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। ওসব সমস্যা সমাধানের কোনো জাদুমন্ত্র তার হাতে নেই। সে কারণে অনেকে জাতীয়তাবাদকে তুলনা করে থাকেন দ্বিমুখী চরিত্রের সঙ্গে।

এরিক হবসবাম এই দ্বন্দ্বকে দেখেছিলেন এভাবে, আত্মপরিচয়ের জন্য মানুষের যে ক্ষুধা, সেটি মানুষের মন থেকে মুছে যায় দ্রুত। তার স্থান দখল করে নেয় আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রবল ইচ্ছা। মোহ এবং মোহমুক্তির এই অন্তর্বর্তীকাল জাতির জীবনে জন্ম দেয় গভীর হতাশার।৪ এই হতাশা অচল করে দেয় জাতিকে সমষ্টিগতভাবে, তার অভ্যন্তরীণ বিরোধকে উসকে দিয়ে। জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে গণসমালোচনা তার সব সাফল্যকে মুহূর্তের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করে তার ব্যর্থতার চিত্রকে বড় করে দেখে। এই দুর্ভাগ্য অধিকাংশ জাতীয়তাবাদের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদকেও বরণ করতে হয়। তার সেই অধোগতি শুরু হয়েছিল ঠিক তখনই, যখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সঠিক পথ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম চার বছর এই ব্যর্থতা প্রবল আকার ধারণ করে। সময়টি জাতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ওই কাল ছিল বাংলাদেশের জন্য হতাশারও এক অধ্যায়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনে ব্যর্থতা ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে, যদিও দেশের তত্কালীন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটটিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। ওই দুর্ভিক্ষ  লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থতা, স্বৈরতান্ত্রিকতার দাপট, সমাজতন্ত্রের পরীক্ষায় অর্থনীতির অপরিমিত ক্ষতি, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, সেই সঙ্গে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে জাতীয়তাবাদের সার্বিক ভাবমূর্তিকে।

জাতীয়তাবাদের এই দ্বান্দ্বিক চরিত্রটি নতুন কোনো ব্যাপার নয়। তার এই দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতার দিকটি সম্পর্কে আমরা বরাবরই অবহিত ছিলাম। মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক ধারায় জাতীয়তাবাদকে কখনোই বড় একটা আমল দেওয়া হয়নি, বরং দাবি করা হয়েছে, জাতিকেন্দ্রিক আন্দোলনের চরিত্র নিতান্তই বুর্জোয়া। জাতি-পরিচয়ের অনুভূতিকে সে ব্যবহার করে বুর্জোয়া শ্রেণীকে ক্ষমতায় বসাতে। সে কারণে সামাজিক মুক্তির প্রশ্নে মার্ক্সবাদীরা ভিন্ন পথ নির্বাচনের পক্ষপাতী। তাঁরা বলেন, ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে জাতীয় পরিচয়ের বদলে আন্দোলন হওয়া চাই শ্রেণীভিত্তিক। শ্রেণী-পরিচয় জাতি-পরিচয় থেকে ভিন্ন। শ্রেণীর মধ্যে আছে সর্বজনীনতা। সে বিশ্বের সব মানুষকে শোষিত শ্রেণীর পরিচয়ে একত্র করতে পারে। সেখানেই মানুষ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় বুর্জোয়া শ্রেণীকে প্রতিপক্ষ ভেবে। আর তাতেই রয়েছে প্রকৃত মুক্তি। সে তুলনায় জাতি-পরিচয়ে রয়েছে মানুষকে খণ্ডিত করে দেখার প্রবণতা। বাঙালি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, ব্রিটিশ, আমেরিকান ইত্যাদি পরিচয়ে শোষিত শ্রেণীর অভিন্ন দাবি সেখানে অবমূল্যায়িত হয়। জাতীয়তাবাদের প্রতি এই বিরোধিতা কেবল মার্ক্সবাদীদের মধ্যেই সীমিত থাকেনি। ধর্মীয় দিক থেকেও তার বিরোধিতা করা হয়েছে। সেই বিরোধিতা অনেকটা সমাজবাদীদেরই অনুরূপ। তাঁরাও মনে করেন, ধর্মবিশ্বাসের বিশ্বজনীনতার মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তা বিভেদ আনে। একক মুসলিম উম্মাহর কথা ভেবে মাওলানা মওদুদী পাকিস্তান আন্দোলনকালে মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেননি।

তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান ব্যর্থতা অন্য খানে। আধুনিক সমাজের যে অঙ্গীকার সে করেছিল, তার পক্ষে সম্ভব হয়নি তাকে বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া। আর এখানেই তার মৌলিক ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে এক বিপরীত প্রবাহ তাকে আক্রান্ত করে। তাকে ধর্মীয় শক্তির প্রতিরোধের মুখোমুখি আসতে হয়। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় regression বা পশ্চাদপসরণ। একে পশ্চাদপসরণ বলা হচ্ছে, কারণ আধুনিক বাংলাদেশের ধারণাকে বিপরীত বা উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়ার এই ধারাটিই জাতীয়তাবাদের স্থান দখল করে নিচ্ছে। কেন একটি আধুনিক রাষ্ট্রের সংগ্রাম এ দেশে ব্যর্থ হলো—এর কারণ একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের দুর্বলতা বা ভ্রান্ত রাজনৈতিক কৌশল, তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নিম্নস্তর, যা আধুনিক সমাজ নির্মাণের জন্য উপযোগী নয়। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, জাতীয়তাবাদী আদর্শের চেতনাগত দুর্বলতা বলতে কী বোঝায়, যার কারণে ধর্মীয় অনুভূতির উত্থান সম্ভব হলো?

প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজতে হবে জাতীয়তাবাদী চেতনার দুটি বিপরীত বা ভিন্নমুখী ধারার মধ্যে। বাঙালি হোক, ভারতীয় হোক কিংবা পাকিস্তানি, যে জাতীয়তাবাদই হোক না কেন, তার মধ্যে একদিকে থাকে আধুনিক সমাজ সৃষ্টির আগ্রহ ও উপাদান, অন্যদিকে থাকে তার বিরোধী উপাদানও। সে উপাদান হতে পারে ধর্মীয়, হতে পারে লোকজ সংস্কৃতি প্রভাবিত, হতে পারে আদি কোনো জাতি-পরিচয় থেকে উত্সারিত। এই দুই উপাদান বা শক্তির মধ্যে কোন শক্তির ভূমিকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রাধান্য পাবে, তার ওপর নির্ভর করে জাতীয়তাবাদের ভাগ্য—কোন ধারায় সে বেড়ে উঠবে, সমাজকে সে কি আধুনিকতামুখী করবে, নাকি নিয়ে যাবে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার ছত্রচ্ছায়ায় এক অনাধুনিক সমাজের পথে। এই দ্বন্দ্ব বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে ছিল। আমরা সেটিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছি। সেই ব্যর্থতার কারণেই আজ সে তার নিজের দখলি ভূখণ্ডটি ধর্মীয় শক্তির কাছে হারাতে বসেছে। এটিকে জাতি-পরিচয়ের নিজস্ব সংকট হিসেবে দেখতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে ওই ধর্মীয় প্রভাব কোথা থেকে এল, সেটি আমরা কখনো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সক্ষম হইনি। জনাব বদরুদ্দীন উমরই সম্ভবত প্রথম, যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় দিকটি উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাঁর একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরি মনে করেছিলেন। সেই উপলব্ধি থেকে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে হলিডে পত্রিকায় তিনি ‘The Basis of Bengali Nationalism’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।

তাঁর ওই প্রবন্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাঙালি জাতির চেতনাগত ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা সমীচীন মনে করেননি তিনি। তিনি তাঁর ধারণাকে তুলে ধরেছেন এভাবে—পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে ধর্মগত পার্থক্য রয়েছে। ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত হলে অবিভক্ত বাংলা পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয় এবং তারা দুটি পৃথক জাতিতে পরিণত হয়। বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণী পাকিস্তানি বুর্জোয়ার সঙ্গে এক কাতারে মিলে সে সময় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে জয়যুক্ত করে। এটিই বাঙালি জাতি-পরিচয়ের সবচেয়ে বড় সংকট। তা ছাড়া তাঁর মতে, ‘শোষক ও শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরে এক সাম্প্রদায়িক রূপান্তর ঘটে গেছে। ওই রূপান্তরের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মধ্যেকার পার্থক্য।’৫ এই তাত্ত্বিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে তিনি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, সেটি হলো এ রকম, ‘পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিতান্তই মুসলিম বাঙালির জাতীয়তাবাদ। কারণ, সেখানে পশ্চিম বাংলার হিন্দু বাঙালিরা অন্তর্ভুক্ত নয়।’ তাঁর এই অবস্থানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন অনেকে, তার মধ্যে বসন্ত চ্যাটার্জি অন্যতম। চ্যাটার্জির মতে, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ শতকরা ১০০ ভাগ নতুন এবং ১০০ ভাগ মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যত্ গতিপথ বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির ধারায় প্রবাহিত হবে।’৬ তা ছাড়া আরও উল্লেখ করা যায় ফরহাদ মজহারের দৃষ্টিভঙ্গি, যেটি অবশ্য বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিভঙ্গির ঠিক উল্টো দিক থেকে আসা। মজহারের অবস্থানটি এ রকম, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু সাম্প্রদায়িক নয়, বরং ঘোরতরভাবে অনৈতিহাসিক। ইতিহাসের বিপরীতে তার অবস্থান। যেন বাঙালির কোনো ধর্মীয় অতীত নেই, সনাতনী হিন্দু, ইসলাম, অথবা জৈন বা বৌদ্ধ—কারও সঙ্গেই যেন ধর্ম হিসেবে কোনো সম্পর্ক নেই, যেন ধর্মীয় উপাদান রূপ-রসে পুষ্ট হয়ে এর শরীর পরিগঠিত হয়নি। বাঙালি ব্যাপারটি যেন হাওয়াই জিনিস।’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৮)। তাঁর আরও দাবি, ইসলামের এই শক্তিশালী ভাবগত অবস্থান এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ‘মুসলমান’ বলে নয়, বরং তারা একদম খাঁটি বাঙালি বলেই ইসলামের সঙ্গে তাদের এই ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক মোকাবিলা (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৫)। অর্থাত্, বাঙালিত্ব ও ইসলাম তার কাছে সমার্থক।

বদরুদ্দীন উমরের মূল্যায়নটি নিঃসন্দেহে সঠিক, যখন তিনি দাবি করেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরে ধর্মীয় উপাদানের উপস্থিতির কারণে তাকে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবা যায় না। ফলে বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিমবঙ্গ নামে যে ভূখণ্ড আছে, সেটি বাঙালি ভাষাভাষী অধ্যুষিত হলেও সেখানে বসবাসরত মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাইরে থেকে গেছে। এই ভূখণ্ডটি অন্য এক জাতিরাষ্ট্রের অধীনে। তাদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা উপস্থিত থাকলেও সেটি সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের অধীন। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে, কিন্তু ওই সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবল আধিপত্য থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে অথবা বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে তারা অনিচ্ছুক। এই জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর সব বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করে না। আর সে কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শব্দটি ব্যবহার করাও তাঁর মতে যুক্তিযুক্ত নয়।

বদরুদ্দীন উমরের এই দাবির একটি প্রেক্ষাপট আছে, যদিও আমাদের পক্ষে জানা কঠিন তাঁর তত্ত্বগত অবস্থানটি প্রত্যক্ষভাবে তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কি না। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাংলা ভাষা অ্যাকশন কমিটি নামের একটি সংগঠন গড়ে ওঠে ঠিক সেই সময়, যখন জাতীয় ভাষার প্রশ্নটি বিশেষ ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে এই সংগঠন একটি আবেদনপত্র পেশ করে। ওই আবেদনপত্রে যে বক্তব্য ছিল, তার মধ্যে অনেকে সে সময়ে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পেয়েছিলেন। আর সেটি হতে পারে বদরুদ্দীন উমরের ওপরে বর্ণিত অবস্থানের পক্ষে একটি প্রধান যুক্তি। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে প্রদত্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তৃতার পর তাঁর সঙ্গে ওই কমিটির যে সভা হয়, তাতে কেন বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করা প্রয়োজন, তার সম্পর্কে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল। ওই আবেদনপত্রে দেখানো হয়, বাংলা ভাষা পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ জনগণের ভাষা এবং যেহেতু পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক দেশ, সেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, আধুনিক কালে যেকোনো রাষ্ট্রে এক বা একাধিক রাষ্ট্রভাষা থাকতে পারে। তার নমুনা হিসেবে অ্যাকশন কমিটি বেশ কয়েকটি দেশের উদাহরণ তুলে ধরে। যেমন: বেলজিয়ামে একটি নয় দুটি—ফরাসি ও ফ্লেমিশ ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। কানাডায় ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা ভোগ করে। সুইজারল্যান্ডে একই সাথে ফরাসি ও জার্মান ভাষা রাষ্ট্রভাষা। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংরেজি ও আফ্রিকান ভাষা রাষ্ট্রভাষা। মিসরে ফরাসি ও আরবি, থাইল্যান্ডে ইংরেজি ও থাই এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৭টি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত। তৃতীয় কারণ হিসেবে বাংলা ভাষা যে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্ ভাষা, সেটি উল্লেখ করা হয়। চতুর্থত, এবং জনাব বদরুদ্দীন উমরের অবস্থানের পক্ষে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো প্রতিনিধিরা তাঁদের দাবির সমর্থনে বলেন, এই ভাষার সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। আর তা প্রমাণে ওই কমিটি যুক্তি দেখায়, বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন মুসলমান কবি ও সাহিত্যিকেরা। যেমন আলাওল, নজরুল ইসলাম, সৈয়দ ইমদাদ আলী, ওয়াজেদ আলী, জসীমউদ্দীন প্রমুখ। তাঁদের মতে, এ ব্যাপারে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলা ভাষার অর্ধেক শব্দ ফারসি ও আরবি ভাষা থেকে নেওয়া। অর্থাত্, বাংলা ভাষার ভিত্তিমূলে রয়েছে শক্ত ইসলামি ঐতিহ্য। এই বিশেষ যুক্তি বদরুদ্দীন উমরের কাছে পছন্দনীয় মনে না-ও হতে পারে। বাংলা ভাষার পক্ষে বলতে গিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী কেন ইসলামের সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছিলেন, সেটি হতে পারে তাঁর ক্ষোভের প্রধান কারণ। আর এ কারণে তিনি ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাঙালিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে তত্কালীন পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে এই যুক্তি যতটুকু না তার প্রবক্তাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে তুলে ধরে, তার চেয়ে সম্ভবত তাতে বেশি প্রতিফলিত হয় বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য তাদের প্রবল ইচ্ছা। বিশেষ করে যখন বাংলা ভাষার পক্ষে তাদের সওয়াল-জবাব করতে হয়েছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো একজন চতুর উকিলের সামনে দাঁড়িয়ে।

কিন্তু তার পরও উমরের যুক্তির সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কম। তবে তাঁর মূল তাত্ত্বিক অবস্থানটি বুঝতে হলে ওই প্রবন্ধের আরও কিছু পাতা উল্টাতে হবে। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, ‘এটি কি সত্য নয় যে এই অতি উল্লেখযোগ্য বিবর্তন, শাসক এবং শোষক শ্রেণীর এই যে সাম্প্রদায়িক চরিত্র, তার ওপরই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাবাদী চেতনা? সেটি যদি ঠিক হয়, তাহলে কি বুঝতে হবে না যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হলো সাম্প্রদায়িকতার নির্ভুল বহিঃপ্রকাশ, যা কেবল লুকিয়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের লেবাসে? বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া আর কিছুই নয়, যার মূলে রয়েছে ধর্ম এবং তাকে দেখা উচিত নতুন এক প্রতারণার লেবাসে দ্বিজাতিতত্ত্বের পুনরুত্থান হিসেবে।’৭ বিতর্কটি এখানে একটু ঘোলাটে হয়ে ওঠে বলা বাহুল্য। প্রথমত, পূর্ব বাংলার উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণী পাকিস্তানি বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিল ধর্মীয় ভিত্তিতে একটি দেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে, এ কথাটা মিথ্যা নয়। সেখানে অন্য অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সামন্তবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া। কিন্তু সেটি যতটুকু না ছিল আঁতাত, তার চেয়ে বেশি তাকে বরং দেখা উচিত তাদের ওপর পাকিস্তানি আগা খাঁ এবং আদমজি বাওয়ানি গোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া একটি আদর্শ হিসেবে। ওই ‘আঁতাতের’ সঙ্গে পূর্ব বাংলার যোগাযোগ বলতে একদিকে ঢাকাকেন্দ্রিক নবাব পরিবারের হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের উত্সাহকে বোঝায়, যারা ছিল ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত প্রথার প্রতিনিধি এবং যাদের আদর্শের মূল ভিত ছিল ধর্ম বা মুসলিম জাতীয়তাবাদ। অন্যদিকে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে বাংলার কৃষকসমাজের যুক্ত হওয়ার কারণ ছিল, তারা মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবিকে শ্রেণী-শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হিসেবে দেখেছিল। পূর্ব বাংলায় সে সময় বুর্জোয়া শ্রেণী ছিল প্রায় অনুপস্থিত। শাসক বা শোষক হিসেবে শ্রেণীটি তখন কতটুকু বিকশিত হয়েছে, সে বিষয়ে তর্ক তোলা যেতে পারে। নিতান্তই মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা কিছু মানুষ, যারা বাংলাকে অখণ্ড রাখার পক্ষে কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েছিল ইতিহাসের ঘোরচক্রে, তাদের শাসক বা শোষিত হিসেবে হাজির করা একটু কঠিন বৈকি। তাদের চরিত্র ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন বা পাকিস্তান আন্দোলনে কতটা নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিল, তা নিয়েও মতদ্বৈধতা থাকতে পারে।

১৯৪৭ সালের পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ধারা আত্মপ্রকাশ করে, তা সে যত ক্ষুদ্র ও আপেক্ষিকই হোক না কেন। ওই ধারা থেকেই পরে মুসলিম আওয়ামী লীগ নামে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি আত্মপ্রকাশ করে। সে কারণে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণবাদী এবং essentialist  দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের গ্রহণ করা উচিত নয়, যে দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে একটি রাজনৈতিক দলকে হয় হতে হবে বিশুদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িক অথবা অসাম্প্রদায়িক। যেখানে সবকিছু হওয়া চাই সাদা-কালোর মতো স্পষ্ট, পরিষ্কার, সন্দেহমুক্ত। সেখানে ইতিহাস স্তব্ধ, চেতনা বিবর্তনহীন, স্থির ও অনড়। বিষয়টি যে মিশ্র হতে পারে এবং যেকোনো রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে নানাবিধ পরস্পরবিরোধী ধারার উপস্থিতি যে স্বাভাবিক একটি ব্যাপার এবং সেসব ধারার কোনটি কোন সময়ে সক্রিয় হতে পারে এবং কোন ধারা কোন সময়ে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে, সেটি যে নির্ভর করে নানাবিধ শক্তির মিথস্ক্রিয়ার ওপর, এই বিবেচনাটিকে একেবারে বাদ দেওয়া পদ্ধতিগতভাবে অনুচিত। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব্ব রাজনৈতিক দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য, যেমন বৈশিষ্ট্য তা মানুষের চেতনার। সেখানে সিদ্ধান্তের চরিত্র ভিন্ন সময়ে ভিন্ন হতে পারে। তার উদাহরণ দুর্লভ নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রারম্ভিককালে অঙ্কুরিত বাঙালি বুর্জোয়ারা কোনো একসময় সাম্প্রদায়িকতা কিংবা ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকে গিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে থাকতে পারে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ওই অপরাধের তিলক তার কপালে চিরকালের জন্য সেঁটে দিতে হবে এবং তা থেকে তার অব্যাহতির সব পথ সব কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। এই বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণীই কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে, যদিও ধর্মীয় দুর্বলতার ছাপও তার মধ্যে যে ছিল না, তা নয়। পূর্ব বাংলার অধিবাসীরা যদি বাঙালি সংস্কৃতির ধারক হয়ে থাকে, তাহলে ওই সংস্কৃতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সেই জাতীয়তাবাদকে বাঙালি হিসেবে মেনে নেওয়ায় তার কোনো দ্বিধা বা আক্ষেপ থাকা উচিত নয় বলেই মনে হয়।

দার্শনিক হেগেলের প্রতিপাদ্য, বিরোধী প্রতিপাদ্য ও সংশ্লেষণের (thesis-antithesis-synthesis) রৈখিক যুক্তি এ ক্ষেত্রে কিছুটা প্রাসঙ্গিক হলেও হতে পারে। উঠতি বাঙালি বুর্জোয়া যদি ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলনকালে সাম্প্রদায়িক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সেটিকে থিসিস হিসেবে ধরে নিতে পারি। ওই একই বাঙালি বুর্জোয়া কিন্তু ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে। তার এই চারিত্রিক পরিবর্তনকে ওই থিসিসের বিপরীত হিসেবে ধরে নিতে দোষ কী? কারণ, সেটি প্রথম থিসিসের বিপরীত। সে সময়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে স্বাধীনতার বীজ উপ্ত ছিল। সেদিন সেই আন্দোলনে পাকিস্তানি ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যতই শক্তিশালী হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি যতই গতি পায়, ততই একটি মিশ্র চেতনার জন্ম লক্ষ করা যায়, যার প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মীয় চেতনার মিলন ঘটে। এই মিশ্র রূপের মধ্যে দেখা উচিত বাঙালি উঠতি বুর্জোয়ার আধুনিক সমাজ নির্মাণের স্পৃহাকে। সেখানে যেমন অস্বীকার করা যায় না তার জাতীয় আবেগকে, তেমনি ধর্মীয় উপাদানের উপস্থিতিকেও। জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে আধুনিক ও অনাধুনিকতার এই দ্বন্দ্ব্ব বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে বাংলাদেশকে আধুনিক একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনায়। ওই প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল ধনাত্মক দ্বান্দ্বিকতা (positive dialectics)। তার মধ্যে বিকশিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল একটি আধুনিক সমাজের। কিন্তু কেন সেই প্রক্রিয়া বাংলাদেশকে উল্টো পথে নিয়ে গেল—এমন এক বিপরীত রৈখিক অধোগতির দিকে, যাকে থিওডর এডরনো ঋণাত্মক দ্বান্দ্বিকতা (negative dialectics) বলে বর্ণনা করেছেন—তার উত্তর পাওয়া সম্ভব বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরে ধর্মীয় উপাদানের উপস্থিতির বিশ্লেষণ থেকে।

চারটি মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ আধুনিক সমাজ নির্মাণের পথে পা বাড়ায় ১৯৭২ সালে। এই চার নীতির মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ সংগতির অভাব সত্ত্বেও স্বাধীনতাযুদ্ধ যে জাতীয় সংহতি ও দেশপ্রেমের জন্ম দিয়েছিল, তাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক সমাজ নির্মাণের কাজটি হয়তো বা ভালো করেই সম্পন্ন করা যেত। সেটিই ছিল জাতীয়তাবাদের প্রধান শক্তি। উত্তপ্ত লোহা পিটিয়ে কামারের পক্ষে যেকোনো আকৃতি দেওয়া যেমন সহজ, একইভাবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানুষকেও ঠিক যেকোনো দুঃসাহসী কাজে নিয়োজিত করা সম্ভব ছিল। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর অমার্জনীয় ব্যর্থতা তাতে বাদ সাধে। গণতন্ত্রকে তারা একনায়কতন্ত্রে পরিণত করে আর সমাজতন্ত্রের নামে আমলাতান্ত্রিক লুটেরা পুঁজিবাদের। ধর্মনিরপেক্ষতা ধীরে ধীরে মাথা নত করে ধর্মীয় অনুভূতির প্রচণ্ড প্রতাপের কাছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় উপাদান রূপান্তরিত হয় ইসলামি ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের মিশ্র এক ধারায়। তবে এই পশ্চাদপসরণের কারণ এই নয় যে এককালে পূর্ব বাংলার অতি দুর্বল বুর্জোয়া গোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের বুর্জোয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে ধর্মীয় আঁতাতে যোগ দিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য। এর কারণ বরং খুঁজতে হবে অন্য খানে। বাংলাদেশের দুর্বল, অপরিপক্ব বুর্জোয়া গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হয়নি ধর্মীয় উপাদানকে এড়িয়ে আধুনিক সমাজের ভিত গড়ে তোলা। তার কারণ নিহিত যতটুকু না বাঙালি ও মুসলিম—জাতি ও ধর্মীয়—এই দ্বৈত পরিচয়ের ডিলেমাতে, তার চেয়ে বেশি একটি নতুন হেজেমনিক আদর্শ প্রতিষ্ঠায় তাদের অক্ষমতাতে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্বাধীন রাষ্ট্র এনে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছিল। তার পক্ষে উদীয়মান এবং একেবারে নতুন বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণীর আদর্শিক দিকনির্দেশকের দায়িত্ব পালন সম্ভব হয়নি। এই নতুন বুর্জোয়া শ্রেণীটি বাংলাদেশের জনগণকে দেখেছে একাধারে বাঙালি ও মুসলিম হিসেবে। ওই দুই পরিচয়ের যৌথ উপস্থিতিতে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর কীভাবে সম্ভব, সেটি কখনো ভাবা হয়নি। যে ব্যাপারটি সম্ভব হয়েছে তুরস্কে, ইন্দোনেশিয়ায় ও মালয়েশিয়ায়। বাঙালি বুর্জোয়ার ওই ব্যর্থতার কারণে ধর্ম ও জাতি-পরিচয়কে এ দেশে বিপরীত মেরুতে প্রতিস্থাপন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই টানাপোড়েনের উগ্রতা একদিকে জাতি-পরিচয়কে বিসর্জন দিতে চায়, অন্যদিকে তেমনি আধুনিক সমাজ নির্মাণভাবনা ধর্ম-পরিচয়কে উপেক্ষা করে এগোতে চায়। এভাবে জাতি-পরিচয় ও ধর্ম-পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় পরস্পরের মুখোমুখি।

জাতীয়তাবাদের দুটি বিপরীত উপাদান

বদরুদ্দীন উমর ও বসন্ত চ্যাটার্জির আলোচনার মূল বক্তব্য হলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিরবচ্ছিন্নভাবে বাঙালি নয়। তার অভ্যন্তরে ধর্মীয় উপাদান রয়েছে আর সে কারণে তার চরিত্র কালিমালিপ্ত। ফলে বাঙালি জাতির জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাকে ওই নামে অভিহিত করা উচিত নয়। সে মিশে গেছে ধর্মীয় অনুভূতির মধ্যে। তার সঙ্গে ধর্মীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদের পার্থক্য নেই বললেই চলে। উমর ও চ্যাটার্জির এই দাবিটি অযৌক্তিক। এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে। সেটি হলো, জাতীয়তাবাদী আদর্শ মানুষের মনে কেন জাগ্রত হয় এবং সমাজের কোন উপাদান সেখানে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে, অর্থাত্ প্রশ্নটি জাতীয়তাবাদের আধুনিকত্বকে নিয়ে। বহুকাল আগেই প্রশ্নটি তাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল এবং সে সময়ে আলোচনাটিকে জাতীয়তাবাদের আধুনিক উপাদান বনাম প্রাচীন উপাদানের দ্বন্দ্ব্ব হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই পলেমিকের একদিকে ছিলেন ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী গেলনার, অন্যদিকে ছিলেন জন হাচিন্স প্রমুখ। বদরুদ্দীন উমর বা বসন্ত চ্যাটার্জির মতাদর্শগত অবস্থানকে বুঝতে এবং তার ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে এই আলোচনা কিছুটা হলেও সহায়ক হতে পারে।

গেলনারের দৃষ্টিভঙ্গিগত বিশ্লেষণ বেশ কয়েকটি রচনায় স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হলো Nations and Nationalism। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, যে বিশেষ কারণে জাতি-পরিচয়ের অনুভূতিকে কেন্দ্র করে মানুষ সংগঠিত হয়, তার মূলে একটি আধুনিক সমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য কাজ করে। ওই আধুনিক অনুভূতি সমাজে কতটুকু স্থান করে নিল, যার ফলে মানুষের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনা জোরদার হলো, সেটি জাতীয়তাবাদের সাফল্যের একটি পূর্বশর্ত হতে পারে। আধুনিক অনুভূতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায় কীভাবে? গেলনারের মতে, সমাজকে নিরিখ করতে হবে উচ্চ সংস্কৃতি ও নিম্ন সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে। সমাজ উচ্চতর সংস্কৃতির প্রভাবে বেড়ে না ওঠা পর্যন্ত সেখানে জাতীয়তাবাদী চেতনা সফল হতে পারে না। উচ্চতর সংস্কৃতি বলতে গেলনার মূলত বুঝিয়েছেন নাগরিক চেতনাকে। নগর আধুনিকতার পৃষ্ঠপোষক এবং গ্রামীণ জীবন নাগরিক জীবনের তুলনায় অনাধুনিক। একটি আধুনিক সমাজ বলতে এমন একটি সমাজ বোঝায়, যেখানে শিল্পায়নের মাধ্যমে উত্পাদন হয়। সে সমাজে প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক নিয়মে পরিচালিত হয়। শাসনব্যবস্থা নিরপেক্ষ থাকে। এক ধরনের বিশেষ আমলাতন্ত্রের সহায়তায় রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, যে আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষ এবং রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করে। উচ্চতর সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করে। বস্তুত ব্যক্তিপরিসরকে সামাজিক পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়। উন্নত সংস্কৃতিতে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং মানুষকে সচেতনভাবে সমাজ প্রগতিতে বিশ্বাসী করে তোলা হয়। আধুনিক সমাজের এই শর্তাবলি কখনোই পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই শর্তগুলোর অন্তত সিকি বা অর্ধেকও যদি কোনো সমাজে অনুপস্থিত থাকে, তাহলে সেখানে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটা এবং পরবর্তী সময়ে তার সাফল্য নিশ্চিত না-ও হতে পারে। অর্থাত্, জাতীয়তাবাদী অনুভূতির জন্ম এবং তার সাফল্যের ক্ষেত্রে আধুনিক উপাদানের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পুরোপুরি না হলেও আধুনিকতার পূর্বশর্ত হিসেবে দেশকে অন্তত কিছুটা হলেও শিল্পায়িত হতে হবে। বাকিগুলো শিল্পায়নের পর বিকশিত হতে পারে। সেই বাকিগুলো বিকশিত করার দায়িত্ব জাতীয়তাবাদের, তার সাফল্যের পর, অর্থাত্ একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠিত হলে।

আধুনিক উপাদানের ওপর গেলনার যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তার কারণ সম্ভবত এই যে তিনি ভেবেছিলেন, মানুষের জীবনযাত্রার মানকে কিছুটা আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত না করে কোনো সমাজে জাতীয়তাবাদী চিন্তা বিকশিত ও সফল হতে পারে না। জাতীয়তাবাদ কোনো বস্তু নয়, একটি চেতনা, যে চেতনার বিকাশে শিক্ষার ভূমিকা প্রধান। আধুনিক ও নাগরিক চেতনার পাশাপাশি গেলনার নিম্ন সংস্কৃতির দিকটির প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছেন। যদিও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিনির্মাণ ও বিকাশে তার ভূমিকা কিছুটা হলেও বিতর্কিত থেকে গেছে। নিম্ন সংস্কৃতির ধারক হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন গ্রামীণ সমাজ ও তার সংস্কৃতিকে। গ্রামীণ জীবন শহরের তুলনায় অনাধুনিক। জীবন সেখানে কৃষিভিত্তিক। গোত্রপ্রধানের ক্ষমতা সেখানে মূল ভূমিকা পালন করে। মানুষ তাঁর অধীনে বাস করে; ব্যক্তিস্বাধীনতা সেখানে অনুপস্থিত। গোষ্ঠী পরিচয়ের প্রাধান্য সামাজিক এবং ব্যক্তিপরিসরের বিভাজনকে বাধাগ্রস্ত করে। যোগাযোগের অপ্রতুলতা জন্ম দেয় সামাজিক বিচ্ছিন্নতার। প্রাধান্য পায় সেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা। ফলে দুই বিপরীতধর্মী ধারার মধ্যে সমতা আনার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় গ্রামকে শহুরে চেতনার পর্যায়ে উন্নীত করার। উভয়ে এক অভিন্ন পর্যায়ে না এলে জাতীয়তাবাদের বিজয় সম্ভব না-ও হতে পারে, অথবা হলেও পরবর্তী সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র আধুনিক জীবন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হতে পারে। অর্থাত্, গেলনার গ্রাম ও শহরের মধ্যে ভারসাম্যকে দেখেছেন জাতীয়তাবাদের বিজয়ের অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে। তাঁর আশঙ্কা, এই পূর্বশর্ত পূরণ না হলে জাতীয়তাবাদের মধ্যে গ্রামীণ প্রাচীন ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধি পেয়ে তার মূল উদ্দেশ্যকে ভণ্ডুল করে দিতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে ঘটতে পারে ওই পশ্চাদপসরণ, যেটি ইতিমধ্যে দেখানো হয়েছে থিওডর এডরনোর ঋণাত্মক দ্বান্দ্বিকতায় (negative dialectics)।

তবে যে উপায়ে গেলনার এই দুই চেতনার সমতা অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন, সেটি কোনো স্বল্পমেয়াদি প্রক্রিয়া নয়। দীর্ঘমেয়াদি সেই পথে শিক্ষার বিস্তার, সংবাদপত্র পাঠ, তথ্য সম্প্রচার, অর্থনীতি এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের পার্থক্য দূর করাকে প্রধান উপায় হিসেবে দেখতে হবে। শহর ও গ্রামের পার্থক্য ডিঙিয়ে কীভাবে গ্রাম ও শহরের এই সমতা অর্জন সম্ভব? যদি ওই সমতা অর্জিত না হয়, তাহলে কি জাতীয়তাবাদ নিয়ে চিন্তা করা একেবারেই বৃথা? সে প্রসঙ্গে গেলনারের বক্তব্য যে নেই, তা নয়। তাঁর নিরীক্ষণ এ ক্ষেত্রে দ্বিমুখী। শহর ও গ্রামের সমতা অর্জনের একটি পথ তাঁর মতে হতে পারে শহরের উন্নত সংস্কৃতিকে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া অথবা গ্রামের নিম্ন পর্যায়ের সংস্কৃতিকে যেভাবেই হোক শহরের পর্যায়ে উন্নীত করা। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘শিল্পায়িত সমাজের জন্য প্রয়োজন হয় শিক্ষাক্ষেত্রে সমান অগ্রগতি। ওই অগ্রগতির ফলে সমাজের উচ্চ ও নিম্ন সংস্কৃতির মিলন ঘটে। এটি সম্ভব হয় জনসাধারণের ওপর উচ্চ সংস্কৃতির উপাদান চাপিয়ে দিয়ে। অথবা নিম্ন সংস্কৃতিকে উন্নত করে উচ্চ সংস্কৃতির পর্যায়ে নিয়ে এসে। এভাবেই সম্ভব হয় জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঞ্চালন।৮ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব উপদেশের বাস্তবায়ন যেহেতু সময়সাপেক্ষ, সেহেতু জাতি-আকাঙ্ক্ষাকে কি সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না গ্রাম ও শহরের মধ্যে আদর্শগত এবং সংস্কৃতিগত পার্থক্য কমে আসছে অথবা সম্পূর্ণ বিমোচিত হচ্ছে?

গেলনারের এই শর্ত অনেকের কাছে নিতান্তই একপেশে মনে হয়েছে। তাঁদের মতে, পূর্বশর্ত হিসেবে জাতীয়তাবাদী শক্তির অভ্যন্তরে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির একচেটিয়া আধিপত্য অর্জন কখনো সম্ভব নয়। বিশেষ করে অনুন্নত সমাজের ক্ষেত্রে যা লক্ষণীয়; সেখানে অর্থনীতি অনুন্নত। গ্রাম তো বটেই, শহরও ওই অনুন্নতির মধ্যে আটকা পড়ে থাকে। ফলে মানুষের মনকে নির্ভেজাল আধুনিক চিন্তায় গড়ে তোলা সেখানে সম্ভব না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে মানুষ দূরে থাকবে কিংবা তাদের জাতি-স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে চেপে রাখাই যুক্তিসিদ্ধ বা শ্রেয় মনে করবে? এই প্রশ্নটি মাথায় রেখেই অনেকে জাতীয়তাবাদের উত্থানে আধুনিক নয়, এমন প্রাচীন আদি পরিচয় কোনো ভূমিকা পালন করতে সক্ষম কি না, সে বিষয়ে কৌতূহলী হয়েছেন। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বস্তুত দুটি বিপরীত বা ভিন্নমুখী শক্তির যোগফল হিসেবে দেখতে হবে। যে জাতীয়তাবাদই হোক না কেন, তার মধ্যে একদিকে থাকে আধুনিক সমাজ সৃষ্টির উপাদান বা আগ্রহ; অন্যদিকে থাকে তারই বিরোধী উপাদান। সে উপাদান হতে পারে ধর্মীয়, হতে পারে লোকজ সংস্কৃতি-প্রভাবিত, হতে পারে আদি কোনো জাতি-পরিচয় উদ্ভূত। সুতরাং আমাদের এবার দেখতে হবে, ওই ধর্মীয় প্রভাব বাঙালি জাতীয়তাবাদের কোন অংশে লুকিয়ে ছিল এবং তার উত্থান কীভাবে সম্ভব হলো। ইতিহাস থেকে আমরা দেখি, প্রতিটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অনিবার্যভাবে আধুনিক সমাজের ধারণার পাশাপাশি প্রাচীন ঐতিহ্যের ভূমিকা ছিল। প্রতিটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রাচীন ধর্মীয় উপাদান সহাবস্থান করেছে আধুনিক চেতনার সঙ্গে। এমনকি দেখা গেছে, প্রাচীন অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনা বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে।

সেদিক থেকে বিবেচনা করলে গেলনার যতই দাবি করুন না কেন, তাঁর পক্ষে যুক্তি দেখানো কঠিন, কেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দুধর্মের প্রতীক যেমন কালী এবং হিন্দুধর্মীয় প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান মানুষের মনকে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারায় প্রবাহিত করায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল এবং সে সময় সেগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহারও করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত বিপিন চন্দ্রের বিশ্লেষণ এখানে যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ। জাতীয়তাবাদের আলোচনায় তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে হিন্দুধর্মের প্রতীক ও প্রথাকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ‘স্বরাজ’ শব্দটির বিশ্লেষণ করেছেন। দেখা যায়, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শব্দটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে, যদিও প্রত্যয়টি নিতান্তই ধর্মীয় এবং তার অর্থ হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ: নিজের মন ও আত্মার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা। এই আত্মনিয়ন্ত্রণ বলতে বোঝায় একজন ভক্তের মনকে পাপমুক্ত রাখা। কিন্তু সেটি যখন রাজনীতিতে প্রয়োগ করা হলো, তখন তার অর্থ আর ধর্মীয় থাকল না। তার মধ্যে মানুষ অনুভব করল ভারতবর্ষের পাপকে—ব্রিটিশ শাসন বা পরাধীনতা যার মূর্ত প্রতীক। এই আত্মোপলব্ধি মানুষের মনে পাপমুক্ত হওয়ার প্রবল আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল। ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সামাজিক ও ধর্মীয় উভয়ে একসঙ্গে মিলে যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল, সেটি অতি সহজেই মানুষের মনকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। হিন্দুধর্মে যে দেবীর গলায় ঝোলানো রয়েছে মানুষের মাথা, সেই মা কালীর প্রতীকও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে বলে দাবি করেন অনেকে।৯ একইভাবে গান্ধী নিজেও তাঁর অহিংস আন্দোলনে আধুনিক নয় এমন সব ধর্মীয় উপাদান ব্যবহারে কার্পণ্য করেননি। দেবদেবীর মাহাত্ম্য এবং তাঁদের ক্ষমতা ও ঐশ্বরিক গুণাবলির দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে তিনি অতি দ্রুত জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটাতে পেরেছিলেন জনগণের মধ্যে।

ধর্মীয় প্রতীক মানুষের মনের বিশেষ স্থানে আঘাত করে। মানুষের সুদীর্ঘ বিবর্তনে স্থান করে নেওয়া ধর্মীয়, প্রথাগত অথবা পূর্বপুরুষের কীর্তিময় কোনো মুহূর্ত জাগিয়ে তোলে গোত্রীয় সংহতিকে। ফলে তার পক্ষে মানুষের চেতনার গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। সম্ভব হয় জাতীয় সংহতি গড়ে তোলা। দক্ষিণ আমেরিকায় লিবারেশন থিয়োলজি বাইবেলকে মার্ক্সবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিল। নিকারাগুয়ার বিপ্লবে তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান আন্দোলনকেও এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে নিতে আপত্তি নেই। সেখানে ধর্মীয় প্রতীকের শক্তিশালী আবেদন প্রমাণ করেছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রাচীন অনুভূতির গুরুত্ব। যেসব সমাজে জাতীয়তাবাদের পূর্বশর্ত হিসেবে আধুনিক উপাদানের বিকাশ পরিপূর্ণভাবে ঘটেনি বা তার ঘাটতি রয়েছে, সেসব সমাজে প্রাচীন চেতনাকে জাতীয় জাগরণে ব্যবহার এমনকি অপরিহার্যও বোধ হতে পারে। জাতীয় সংহতিতে আধুনিক চেতনার ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তার অনাধুনিক অতীতের প্রভাবও। সে কারণে এই দুটির কোনোটিকেই একক কারণ হিসেবে বিবেচনা করা সমীচীন নয়। তাদের উভয়ের ভূমিকাই প্রণিধানযোগ্য, তা যত তীব্র ও আপসহীনই মনে হোক না কেন তাদের ভিন্নতা। কথাটা যে সত্য, তার প্রমাণ মেলে অতীত ইতিহাসে জাতীয়তাবাদের উত্স অনুসন্ধানে। সেখানে কেবল আধুনিকতা অথবা নিরঙ্কুশভাবে প্রাচীন সংহতি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সফলতার জন্য যথেষ্ট ছিল না কখনো। তার প্রমাণ মেলে জন হাচিন্সন ও অ্যান্থনি স্মিথের গবেষণায়।১০ তাঁরা দুজন দেখিয়েছেন, কত দীর্ঘ ছিল ইউরোপে জাতীয়তাবাদের পথ। একটি বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত মনের বিকাশ এবং জাতি অনুভূতি সৃষ্টিতে, তাঁদের মতে, প্রাচীন হিব্রু ও গ্রিক ভাষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ওই দুই প্রাচীন ভাষা রেনেসাঁস এবং পরে রিফর্মেশনের আমলে ইউরোপের সংস্কৃতিতে গুরুত্ব পায়। যার প্রভাবে জন্ম নেয় গ্রিক এবং রোমান দেশপ্রেম ও জাতি-পরিচয়।

ইংল্যান্ডে ক্যালভিনের নেতৃত্বে যে ধর্মীয় সংস্কার ঘটে, সেখানে ওল্ড টেস্টামেন্টকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী চেতনা জোরদার হয়েছিল। সেখানকার মানুষ ধর্মীয় অনুভূতিকে আপামর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে জন্ম দিয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীর বিপ্লবের। একইভাবে ১৭৭৫ সালে পোল্যান্ডের প্রথম ধর্মীয় বিভক্তি থেকে জাতীয়তাবাদী চেতনা জন্ম নিয়েছিল। ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসীদের ওপর সুদীর্ঘ নির্যাতন, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং পবিত্র ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও বাস্তুহারা জীবন তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে রেখেছিল বিশেষ অবদান। ১০০ বছরের যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ও ফরাসি জাতীয়তাবাদ ইউরোপে শক্তি অর্জন করে, যার ফলে জন্ম হয় দুটি পৃথক রাষ্ট্রের। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, পোল্যান্ডে জাতীয়তাবাদ দানা বেঁধে ওঠে ধর্মীয় বিভেদকে (ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট) পুঁজি করে। ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট পরিচয় সেখানে পালন করে প্রধান ভূমিকা। পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্পেনে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়, তার মূলে ছিল উগ্র মুসলিম বিরোধিতা ও উগ্র ক্যাথলিকবাদী বিশ্বাস। কোরিয়ায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে কনফুসীয় ধর্মের বিশুদ্ধতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক জাতীয়তাবাদ। একইভাবে জাপান ও চীনে জাতীয়তাবাদের উত্থানে বৌদ্ধধর্মের ভূমিকা উল্লেখ করা যায়। বস্তুত, ক্লিফোর্ড গিত্জ তাঁর রচনায় ধর্মীয় অনুভূতির এই দ্বৈত প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন (Clifford Geertz, একে টম নাইরন বলেছেন double inwardness)।

জাতীয়তাবাদ যে নিরবচ্ছিন্নভাবে আধুনিক কিংবা নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রাক-আধুনিক সংহতি দিয়ে প্রভাবিত হয় না, বরং তার সাফল্য নির্ভর করে তাদের দ্বৈত প্রভাবের ওপর, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আমরা দেখতে পাই, গেলনারের পূর্বশর্ত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক উপযুক্ত ছিল না। যদি তার কথামতো নাগরিকতার শর্তটি প্রধান হতো, তাহলে বেশ জটিল হয়ে দাঁড়াত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের বিষয়টি। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান একটি কৃষিপ্রধান প্রদেশ ছিল। এমনকি ঢাকা নগরী ও অন্যান্য মফস্বল শহরের সঙ্গে গ্রামের পার্থক্যের পরিধি আজকের তুলনায় শতগুণ কম ছিল। শহরগুলো ছিল মূলত গ্রামেরই সম্প্রসারিত রূপ। কৃষক, দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জীবনের অধিকাংশ সময়ে বিচ্ছিন্ন থাকতেন শহরের সামাজিক গতিধারা থেকে। শিক্ষাক্ষেত্রে গ্রাম-শহরের অসমতা ছিল চোখ-ধাঁধানো। শহরের উচ্চ সংস্কৃতি ও গ্রামের নিম্ন সংস্কৃতির মিলন ঘটেনি। গ্রামের নিম্ন সংস্কৃতির পক্ষে উচ্চ সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রশ্নই ছিল অবান্তর। একইভাবে উচ্চ সংস্কৃতির চুইয়ে পড়া প্রভাবে গ্রামের নিম্ন সংস্কৃতি উপকৃত হয়েছে, তেমন বিশেষ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে ছিল না। কিন্তু তার পরও শহুরে বাঙালি সমাজের চেতনা অতি দ্রুত জাতীয়তাবাদী খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ধারণা করা যায়, জাতিসত্তার পরিচয় ও অর্থনৈতিক দাবির কারণে এই শহুরে জাতীয়তাবাদী অনুভূতি গ্রামের মানুষকেও আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। ব্যাপারটা যদি তা-ই হয়, তাহলে কিন্তু ধরে নিতে হবে, দুই বিপরীতমুখী চেতনা আধুনিক ও অনাধুনিকের প্রভাব বাঙালি জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করেছিল কোনো না কোনোভাবে। তাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। কিন্তু সে কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না যে জাতীয় অনুভূতির প্রতি গ্রামীণ সমাজ ছিল নির্লিপ্ত এবং কেবল শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকার কারণেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম। হতে পারে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বাংলাদেশের কৃষকসমাজ তার অনুভূতি প্রকাশ করেছিল ভিন্ন ঢঙে, তার নিজস্ব মনসত্ত্ব ব্যবহার করে। অথবা তাদের সমর্থন ছিল নীরব ও পরোক্ষ। কিন্তু বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, আন্দোলন, জীবনদান ইত্যাদির অভিঘাত তাদের চেতনাকে উদ্বেলিত করেছে সন্দেহাতীতভাবে। ভাবের বহিঃপ্রকাশে হয়তো তারা শহুরে মানুষের থেকে ভিন্নতা দেখিয়েছে। আমাদের ইতিহাসচর্চা এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অবদানকে পরিপূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে, আর সে কারণে তা আজ অপরাধী হয়ে আছে এই গ্রামীণ মানুষের কাছে। জাতীয়তাবাদী চেতনার বৃহত্তর পরিসরে ওই বিশাল গ্রামীণ সমাজ কোন স্থান দখল করেছিল এবং তাদের চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল—এ প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব্ব এবং আজকের দিনের ধর্মীয় চেতনার উত্থানের পূর্বশর্ত।

শহুরে চেতনার সঙ্গে গ্রামীণ চেতনার সংযুক্তি হলো কীভাবে

আমরা দেখেছি, বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের সঙ্গে তার জাতিগত পার্থক্য এবং নিজেদের জাতীয় সংহতি গড়ে তোলার কাজে সুচিন্তিতভাবে দুটি প্রধান অস্ত্র ব্যবহার করে। তার একটি সোনার বাংলা নামে কাল্পনিক এক দেশের ধারণা, অন্যটি তার ভাষা। এ দুয়ের মধ্যে প্রতিফলিত হয় আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। সোনার বাংলার প্রতীকে রয়েছে আধুনিক উপাদানের উপস্থিতি, ঠিক একইভাবে বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনেও লক্ষ করা যায় আধুনিক উপাদানের প্রভাব। ভাষাকে সব কালেই আধুনিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়ে থাকে। ভাষা আধুনিক শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা নাগরিক জীবনকে সমষ্টিবদ্ধ সামাজিকতায় পরিণত করে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনসহ অন্যান্য গণমাধ্যম ওই প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নেয়। একইভাবে সোনার বাংলা বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে এবং তা বাঙালির সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সোনার বাংলা বাঙালির মনে নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছিল, পার্থ চ্যাটার্জি যাকে ‘সার্বভৌমত্বের একটি আধার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।১১ সোনার বাংলা বলতে একটি সমৃদ্ধিশালী সমাজকে বোঝায়, যে সমাজে মানুষের সার্বিক মঙ্গল ও ব্যক্তির সার্বিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা রয়েছে। সোনার বাংলায় জীবনের আরও বৃহত্ বৃহত্ এলাকাকে যুক্ত করার সম্ভাবনা নিহিত। অর্থাত্, সোনার বাংলার উদ্দেশ্য ছিল পুরোনো ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে সে সময় লেখা হয়েছিল, এই দল বর্তমানের অবিচারের কাঠামোকে বদলে দিতে চায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন ইশতেহার প্রণয়ন করে। এই গঠনতন্ত্রে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য দূর হবে, দূর হবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ।১২ ফলে যে দুটি অস্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানকে নিশ্চিত করেছিল, তারা উভয়েই বাঙালি জাতিকে আধুনিক এক সমাজের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বলে দাবি করা যায়।

তবে এই আধুনিক চেতনার বাহক ছিল সেকালের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বাংলা ভাষার পক্ষে-বিপক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা উভয়েই শহুরে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী থেকে আসা। সে কারণে যখন দাবি করা হয়, জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে ভাষা এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে, তখন সে কথার দ্বারা শহরের আধুনিক সমাজের অবদানকে বোঝানো হয়। এই দাবি যথার্থ। কারণ, ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র যে কতটা অযৌক্তিক ছিল, সেটি ভাষার প্রতি ওই রাষ্ট্রের আচরণ থেকে বোঝা গিয়েছিল, আর তা প্রথমেই বুঝেছিল শহরের মানুষ; বিশেষ করে তার অগ্রবর্তী অংশ—মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী।

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে করাচি শহরে অনুষ্ঠিত এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত প্রথম জাতীয় শিক্ষাবিষয়ক তত্কালীন সরকারের  মন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা ভাষার প্রতি অবমাননামূলক এক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আরবি এবং পার্সি ভাষাকে বিশেষ স্থান দিতে হবে। কারণ, তারাই পাকিস্তানের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্স।’ তিনি উর্দু ভাষার ওপরও বিশেষ জোর দিতে বলেন। কারণ, ওই ভাষা পাকিস্তানের জাতিগত ও ভাষাভাষী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্যের একমাত্র মাধ্যম হতে পারে। উর্দুর আছে অতিমাত্রায় উত্কৃষ্ট ঐতিহ্য, যার ভিত্তিমূলে রয়েছে অন্য ভাষা থেকে নেওয়া ভাব এবং শব্দ। সেই সঙ্গে তিনি আরও যোগ করেন, উর্দু ভাষার সঙ্গে রয়েছে পার্সি, আরবি ও সংস্কৃত ভাষার ঐতিহাসিক বন্ধন।১৩ ১৯২৭ সালেও লেখা হতো, ‘উর্দু ভাষা না থাকিলে আজ ভারতের মুসলমানদের জাতীয়তাবিহীন ও কিরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হইতে হইত তাহা চিন্তা করিবার বিষয়। বাংলাদেশের মুসলমানদিগের মাতৃভাষা বাঙলা হওয়াতে বঙ্গীয় মুসলমান জাতির সর্বনাশ হইয়াছে। এই কারণে তাহারা জাতীয়তাবিহীন নিস্তেজ দুর্বল ও কাপুরুষ হইয়া গিয়াছে।’ (আহমদ শরীফ, পৃষ্ঠা ৭২)। এসব তত্ত্বীয় প্রতিরোধ উপেক্ষা করে শহুরে মধ্যবিত্ত বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন গড়ে তোলে।

প্রশ্ন হলো, ভাষাকে রক্ষা এবং সোনার বাংলা পুনরুদ্ধার—এই দুই সংগ্রাম যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান উত্স হয়ে থাকে,১৪ তাহলে সেই আন্দোলনের সঙ্গে গ্রামের মানুষ যুক্ত হলো কীভাবে? কীভাবে শহুরে মধ্যবিত্তের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের চেতনার সংযুক্তিকরণ ঘটল এবং সৃষ্টি হলো শহর-গ্রামের অভিন্ন বাঁধন। এই ঐক্যের প্রশ্নটি অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমরা এতকাল বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখাইনি। দেশের বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ, হিসাবটি যদি ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ধরা হয়, যারা গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয়তাবাদের সাফল্য আশা করা বৃথা ছিল। কিন্তু তার পরও প্রসঙ্গটি জাতীয়তাবাদীদের আলোচনায় ঊহ্য থেকে গেল কেন, সে প্রশ্ন আজ আমাদের তোলা উচিত। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অবশ্য একসময় লিখেছিলেন, ‘বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজনীয়তার কথাটা বুদ্ধিজীবীরাই প্রথমে তুলেছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের সে দাবিতে প্রাণ ছিল না। প্রাণ দিয়েছে ছাত্ররাই। ছাত্ররাও পারত না যদি না সাধারণ মানুষকে পেত তাদের সঙ্গে।’ (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০০২, পৃষ্ঠা ২০৫)। বুদ্ধিজীবী বা ছাত্রসমাজকে এখানে শনাক্ত করা কঠিন নয়। কিন্তু যখন জনগণ নামে এক বিশাল সংখ্যার (quantity) প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, তখন এই জনগণ কারা এবং কীভাবে তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রাণের সঞ্চালন করেছিল, সেটি পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। জনগণকে বিমূর্ত কোনো গোষ্ঠী হিসেবে আমরা ভাবতে পারি না। তারা হতে পারে শহরের শ্রমিক, পেশাজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যাদের নৈতিক সমর্থন ছাড়া কোনোভাবেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় সম্ভব হতো না। কিন্তু জনগণ বলতে যদি শহরের এই কিয়দংশকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে বাকি থাকে গ্রামের ওই বিশাল জনসংখ্যা। গ্রামীণ সেই জনতার অংশগ্রহণ বলতে কী বোঝায় এবং তাদের ভূমিকার ধরন কেমন ছিল, সেটি ‘জনগণ’ এই বিমূর্ত ধারণাটির মধ্যে ধরা পড়ে না। এই গ্রামীণ জনগণ সভা-সমাবেশে অংশ নেয়নি  সত্য। প্রতিবাদের প্রকাশে তাদের অংশগ্রহণ হয়তো নিতান্তই ক্ষীণ অথবা একেবারেই ছিল না। কিন্তু এই বিশাল পশ্চাদ্ভূমির নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সমর্থন ব্যতীত ২৫ বছর দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী ধর্মীয় প্রতিরোধকে পরাভূত করা কতটুকু সম্ভব হতো, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একপর্যায়ে নিশ্চয় শহরের চেতনার সঙ্গে গ্রামীণ চেতনার এক অভিন্ন কারণে মিলন ঘটেছে এবং উভয়ের চেতনা এসে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তাল তরঙ্গ। সেই চেতনা কী, তার কোনো বিশেষ অংশ শহুরে চেতনার সঙ্গে মিলিত হলো কি না এবং তাদের উভয়ের যৌথ ভূমিকা কীভাবে গড়ে উঠল, যা পুরো বাঙালি জাতিকে অভিন্ন এক সুতায় বাঁধতে সক্ষম হয়েছে, প্রশ্নটি সেখানে।

এই প্রশ্নের উত্তর কী হবে, তার ওপর নির্ভর করবে বদরুদ্দীন উমর বা বসন্ত চ্যাটার্জির বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে অভিযোগের একটি সত্ বিশ্লেষণ এবং মীমাংসা। বস্তুত, সেখানে লক্ষ করা যাবে, যে মুসলিম ধর্মীয় উপাদানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা উভয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্পৃশ্য ভাবছে, সেটি যতটুকু না বাঙালির মধ্যবিত্ত শ্রেণী অথবা যাকে বদরুদ্দীন উমর শোষক ও শোষিত হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন তাদের ভ্রান্তি, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী এই বিশাল গ্রামীণ জনগণের অনাধুনিক চেতনার প্রভাব, যে গ্রামীণ জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতীত বাংলায় জাতীয়তাবাদ ও ভাষা আন্দোলন সফল হতো না। আবার তাদের কারণেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি ধর্মীয় চেতনার এক অভূতপূর্ব উত্থান। ১৯৪৭ সালের বাঙালি মধ্যবিত্ত ধর্ম নিয়ে যেটুকু মাতামাতিটা করেছিল এবং যার ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সম্ভব হয়েছিল, তা ছিল হিমশৈলীর চূড়া মাত্র (tip of the iceburg)। বরফ পাহাড়ের বিশাল দেহ, যার মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মূল শক্তি নিহিত ছিল, সেটি ছিল ওই কৃষকসমাজের মধ্যে। এখানে প্যারাডক্সটা হলো, এই কৃষকশ্রেণীর ধর্মীয় চেতনাই সেদিন শহুরে চেতনার সঙ্গে মিলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রক্ষা করেছিল। সম্ভব করেছিল তার বিজয়কে। আবার এই গ্রামীণ ধর্মীয় চেতনাই ৪২ বছর পর নতুন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্সভূমি পরিণত হতে চলেছে আমাদের সবার অলক্ষ্যে, যেহেতু এই অংশটির প্রতি আমাদের অবহেলা ৪২ বছর আগে যেমন ছিল, আজও তেমনই আছে।

আধুনিকতার মূল উত্স ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, উঠতি শিল্পপতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চেতনা। গ্রাম থেকে আধুনিকতার জন্ম হতে পারে না। শহরের মানুষের মনন আধুনিকতার স্পর্শে বেড়ে ওঠে। গ্রামীণ মানুষ সনাতনী প্রথাগত চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। সে কারণে পার্থ চ্যাটার্জি গ্রামীণ সমাজে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে প্রতীকের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ‘মানুষ যখন অদ্ভুত আচরণ করে এবং নিজের আত্মপরিচয়ের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হয় না, তখন ওই কাজকে প্রতীকী হিসেবে দেখা উচিত। এই প্রতীকী জগত্ হয়তো বা তার দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। কিন্তু ওই প্রতীকী জগতের ওপর নির্ভর করে সে প্রকৃতি সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণা গড়ে তোলে, প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করে এবং ওই সম্পর্ক যে নিয়মে বাঁধা, সেটিও তার মধ্যে নিহিত থাকে।’১৫ বাংলাদেশের কৃষকসমাজের ক্ষেত্রে ওই প্রতীকী চেতনাটি কী হতে পারে, যদি আমরা বিষয়টিকে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করি? যদি এটি সঠিক হয় যে, কৃষকসমাজ তাদের অনুভূতি প্রকাশ করে এক বিশেষ উপায়ে এবং সে উপায়টি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল, তাহলে জীবন বাঁচানোর প্রাত্যহিক সংগ্রামে লিপ্ত থাকায় বিমূর্তের চেয়ে বাস্তব এবং অনুভবযোগ্য বস্তুর মাধ্যমে তার অনুভূতি প্রকাশ করা স্বাভাবিক। তাহলে ধরে নিতে হয়, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, যেমন ভাষা আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন তার চেতনায় আঘাত করেছে পরোক্ষভাবে এবং সেভাবেই সে সম্পৃক্ত হয়েছে জাতীয়তাবাদী চেতনার বৃহত্তর ধারার সঙ্গে।

ভাষা আন্দোলনের শহীদ কিংবা সোনার বাংলাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় আত্মদান, এ দুয়ের পেছনেই একটি শক্তিশালী মানবিক অনুভূতি লক্ষ করা যায়—সেটি হলো হারানোর অনুভূতি। বাঙালি তরুণ যখন নিজের জীবন আত্মাহুতি দেয় বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায়, তখন সেখানে অন্যরা বেদনা ও হারানোর ব্যথা অনুভব করে। সেটিই মানুষ নিজের মনে প্রধান অনুভূতি হিসেবে গেঁথে রাখে। সেই বেদনামিশ্রিত অনুভূতির সঙ্গে গ্রামীণ সমাজ একাত্ম হয়েছিল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক স্মৃতি বা memories-এর প্রভাবে। আবেগধর্মী ওই দুই ঘটনার একটি পলাশীর যুদ্ধ, অন্যটি কারবালায় হোসেনের করুণ মৃত্যু। এই দুই চেতনা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকসমাজের কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী চেতনা, ওই চেতনা গ্রামীণ মানুষের মননের প্রধান খোরাক, ওই দুই চেতনা গ্রামীণ কৃষকসমাজের চেতনার উত্স—জাতীয়তাবাদী অনুভূতি প্রকাশে যার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে মুখ্য। এই চেতনা গ্রামীণ মানুষকে সংযুক্ত করেছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে, যদিও পরোক্ষভাবে। পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর হাতে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুকে বাংলার মানুষ সমীকরণ করেছিল সোনার বাংলাকে হারানোর সঙ্গে। ওই হারানোর ব্যথা তার একমাত্র সঞ্চয় ছিল, যদি জাতি-পরিচয়ের দিক থেকে ভাবা হয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলার স্বাধীন অস্তিত্ব সব কালেই সাধারণভাবে স্বীকৃত হয়ে এসেছে। সে কারণে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়নি। খুঁজতে হয়নি বাঙালি জাতির সংজ্ঞা বা অস্তিত্বকে। গ্রামবাংলায় মানুষের মনে সোনার বাংলার ধারণা দীর্ঘকাল ধরে বাসা বেঁধে ছিল, যে ধারণা আদিকাল থেকে মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসন পেরিয়ে পৌঁছেছে আধুনিক যুগে। বাংলার কৃষক নিশ্চয় লক্ষ করেছে, বখতিয়ার খিলজির সময়কাল (লক্ষ্মণ সেনের পরাজয়ের পর) থেকে দিল্লির সালতানাতের ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করে বাংলা কীভাবে তার স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখে এসেছে। তার সেই অস্তিত্বে রয়েছে কৃত্তিবাসকৃত রামায়ণের পৌরাণিক উপাখ্যানের বাংলায় অনুবাদ অথবা কবি পরমেশ্বরের মহাভারত অনুবাদ। পরবর্তী সময়ে মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে এবং ব্রিটিশ ভারতের পরাধীনতার পরিবেশেও বাংলা তার আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এক অভিন্ন অতীতকে কেন্দ্র করে সোনার বাংলা নামে এক কাল্পনিক জন্মভূমির ধারণা বিকশিত হয়েছে তার মনে, যেখানে বাংলা স্থান করে নিয়েছে সম্পদশালী ও দুঃখহীন এক অঞ্চল হিসেবে।

আর সে কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় সোনার বাংলার প্রতীক জাতি-পরিচয়ের প্রধান উপকরণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পরিচয়টি অতীত থেকে পাওয়া হলেও তার মধ্যে বাঙালি স্বপ্ন দেখে এক আধুনিক বিত্তশালী পৃথক আবাসভূমির। হতে পারে নবাব সিরাজউদ্দৌলা একজন দুর্বল শাসক ছিলেন। কিন্তু তাঁর পরাজয়ের সঙ্গে যে ট্র্যাজেডি যুক্ত, তার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের একাত্ম হওয়া কঠিন ছিল না। তাঁর পরাজয়ের কারণ তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতা। তাঁর মৃত্যু ঘটে ইংরেজ সেনাবাহিনীর হাতে, যাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন মীর জাফর। অর্থাত্ এই ট্র্যাজেডির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁর আপনজনেরা। সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘসেটি বেগম এই ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা, যিনি তাঁর ছেলে শওকত জংকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিলেন। এই ষড়যন্ত্র ব্রিটিশ ও বাঙালি বণিক শ্রেণীর অশুভ আঁতাতের ফসল ছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার যুদ্ধ ছিল একদিকে ক্ষমতাসীন বাঙালি এলিট শ্রেণীর বিরুদ্ধে, অন্যদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে। নবাবের পরাজয় বাংলার স্বাধীনতার সমাপ্তি টানে, আর সে কারণে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরিণত হন স্বাধীনতার প্রতীকে। নবাব ওই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য চূড়ান্ত আত্মত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু বাঙালি কৃষকসমাজের মনে গেঁথে আছে একটি শোকাবহ মুহূর্ত হিসেবে। সেটি হারানোর শোক, ভাষাশহীদদের জন্য যেমন। বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশকে রক্ষা করেছিলেন।

পলাশীর পরাজয়ের ওই বেদনাবিধুর মুহূর্তটিকে কৃষকের চেতনায় পরিণত করার ক্ষেত্রে বাংলার লৌকিক ও ঐতিহ্যবাহী সনাতনী সাংস্কৃতিক মাধ্যমের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। যার একটি ছিল যাত্রা। একধরনের ফোক অপেরা হিসেবে এই যাত্রা খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রচলন ছিল এবং এককালে গ্রামীণ জীবনের অবিভাজ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। খোলা মঞ্চের সামনে মিলিত হয়ে সিরাজউদ্দৌলার করুণ কাহিনির সঙ্গে শ্রোতাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, তাদের হাসি, কান্না এবং অসহায়ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় সংগীত, নৃত্য, অর্কেস্ট্রা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রবল আওয়াজ। আর তা থেকে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয়, সেটি ভালো ও মন্দের সংঘর্ষ দিয়ে প্রকাশ পায়। গ্রামের মানুষ দুয়ের পার্থক্যকে বোঝে অনেক সহজ-সরলভাবে। সুন্দর বর্ণনা, দর্শক-অভিনেতাদের অতি নিকট সম্পর্ক, নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন-বর্ণনায় নাটকীয়তা এবং ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে তাঁর নিগৃহীত হওয়া ও পরিশেষে মৃত্যুবরণ নিয়ে ছিল গ্রামীণ জীবনের এই কথকতা। এই করুণ ইতিহাস যেটি সঞ্চিত হয়েছে তার চেতনায় বারবার পুনরাবৃত্ত হয়ে, সেটি তার নিজের, তার দেশের আর সে কারণে পাকিস্তানের হাতে নিহত একুশের শহীদেরা অতি দ্রুত রূপান্তরিত হয়ে যায় জাতীয় দুঃখের প্রতীকে। সেখানে গ্রামীণ চেতনার সরলতা কোনো বাধা হয়ে দেখা দেয় না। বাঙালি কৃষকসমাজ এই চেতনাকে পাশ কাটিয়ে যায়নি। সে পরোক্ষভাবে সংহতি প্রকাশ করেছে তাদের শহুরে ভাইবোনদের সঙ্গে তাদের আন্দোলনে।

কৃষকসমাজের দ্বিতীয় স্মৃতি এবং সে কারণে তার চেতনার অপর উত্স হিসেবে আসে কারবালার করুণ বেদনাবিধুর কাহিনি। কারবালা কাহিনির মূল বিষয় ইমাম হোসেনের করুণ মৃত্যুর বর্ণনা। সেই বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে পুঁথি সাহিত্যে। দীর্ঘকাল ধরে পুঁথিপাঠ গ্রাম-বাংলার অন্যতম মাধ্যম ছিল। বাগদাদের গভর্নর মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদের হাতে ফোরাত নদীর তীরে ইমাম হোসেনের সপরিবারে মৃত্যুর ঘটনা বহুবার পঠিত হয়েছে, সন্ধ্যায়, রাতে, কাজের অবসরে। গ্রামীণ জীবনের এটি তেমনি এক মুহূর্ত, যার প্রভাব মানুষের চেতনায় গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে যায় অতি দ্রুত। হাসান ও হোসেনের ভাগ্য যে নির্ধারিত ছিল এবং তাঁদের মৃত্যু যে অবধারিত ছিল, সেটি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। পুঁথির বর্ণনা পাঠকদের জানিয়ে দেয়, কী ঘটতে যাচ্ছে। হোসেন তাঁর পরিবার নিয়ে কুফার দিকে রওনা হলে কারবালার ময়দানে তাঁর মৃত্যু হবে। নামাজ পড়ার সময় এবং পানি পান করার সময় তাঁকে তিরবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। গ্রামীণ মানুষের কাছে এটি এক মহা রহস্যের মতো। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো তাদের কাছে মনে হয়, কেন নিজের ভাগ্য সম্পর্কে জানার পরও মানুষ তার ভাগ্যের পরিবর্তনে অক্ষম। কেন সে পারে না ঘটনার ফলাফলকে পরিবর্তন করতে। তাদের দুঃখ আরও গভীর হয়। সাধারণ মানুষ পুঁথিপাঠ থেকে আভাস পায় হোসেনের জীবনের করুণ পরিণতি তাঁর তাঁবুতে বাস করা এবং পানির অভাব। এখানে নারী চরিত্র জীবন দিয়ে যুদ্ধ করে এবং মৃত্যুবরণ করে। আত্মদানের এই তুলনা করা যায় ভারতবর্ষের আদি গ্রন্থ মহাভারতে গান্ধার দ্রোপদী অথবা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতার অবদানের সঙ্গে। কারবালার সন্ত্রাসের সঙ্গে বর্তমানকালের পাকিস্তানি সন্ত্রাসের মিল খুঁজে পায় মানুষ।

তারা ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে যুবশ্রেণীর আত্মত্যাগের সঙ্গে কারবালার করুণ কাহিনির মিল খুঁজে পায়। এখানে সে সন্ধান খোঁজে তার জাতীয় পরিচয়ের উেসর। মীর মশাররফ হোসেনের লেখা বিষাদ সিন্ধু ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার মুসলমান চেতনার এক প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছিল এই কারণে। পুঁথিপাঠের মধ্যে সেকালের মুসলিম মনের কিছু পরিচয় মেলে। এসব পুঁথিতে রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্য, আদমের জন্মরহস্য, শয়তান ও আল্লাহর সম্পর্ক, মহানবীর জীবন, নবীর মেরাজ-রহস্য, মুসা নবীর গল্প, কারবালার ট্র্যাজেডি, ফাতিমার জীবনগল্প, আলীর জীবন, ইউসুফ-জোলেখার ভালোবাসার গল্প ইত্যাদি। এসব লোকগাথা গড়ে উঠেছে বাংলার কৃষকসমাজের চেতনার পরিমণ্ডলকে ঘিরে, যে চেতনা দিয়ে সে বিশ্বকে দেখে, মেলাতে চায় তাদের আপন জীবন ও বাস্তবতার সঙ্গে। তাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় প্রমাণিত হয় হাসানের বিষপানের অংশটি। সেটি মানুষের মনে দাগ কাটে। কাসেম-সখিনার জারি, কাসেম-সখিনার বিয়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে কাসেমের মৃত্যু, সিমার কর্তৃক হোসেনের মস্তক বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি ঘটনার সঙ্গে মানুষ খুঁজে পায় তার জাতীয় ইতিহাসের সংযোগ। এসব ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় উপাদান বাঙালি গ্রামীণ সমাজের চেতনার মূল ভিত। বিভিন্ন লৌকিক সাহিত্যের প্রভাব সেখানে নিয়ামক, যার মধ্যে আরও রয়েছে যাত্রাগান। সেখানে দুই দলের মধ্যে বিবরণমূলক বিতর্ক ও প্রতিযোগিতা এবং সেই আবৃত্তি, পীরের জীবনবৃত্তান্ত, তাঁদের জীবনের সারকথা, নানা ধরনের ধর্মীয় বিতর্ক স্থান করে নিয়েছে কৃষক-চেতনায়। পীরের অলৌকিক ক্ষমতার প্রদর্শনী গাজির গান, গাজির যাত্রা, গাজির পাঠ, সত্য পীরের গান, সত্য পীরের যাত্রা, মানিক পীরের পাঁচালি, মানিক যাত্রা, পুঁথিপাঠ, সওয়াল-জবাব, বিষাদ সিন্ধু পাঠ সেখানে অতীব গুরুত্ববহ (সৈয়দ জামিলের লেখা In Praise of Niranjan: Islam Theatre and Bangladesh, Dhaka: Pathak Somabesh-এ বাংলার গ্রামীণ জীবনের আরও অনেক ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে সুনিপুণভাবে)।

কারবালা কাহিনিতে ইমাম হোসেনের মৃত্যু, ফোরাতের পাড়ে পানির অভাবে শিশুদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া—এই দৃশ্যগুলো চলচ্চিত্রের মতো মানুষের সামনে ফুটে ওঠে। এসব মানস-অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করেই একদা সৃষ্টি হয়েছিল জাতি-চেতনার এক বিশেষ ঐতিহ্য (the invention of tradition)। গ্রামীণ চেতনার এই উপাদানগুলো নিঃসন্দেহে শহুরে চেতনার ধরন থেকে ভিন্ন। এখানে মানুষ সোনার বাংলা ও ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে আবেগের ভিত্তিতে। তার সঙ্গে শহুরে চেতনার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। আবেগের পরিবর্তে শহুরে মানুষ সোনার বাংলার মধ্যে পেয়েছে নতুন আধুনিক সমাজ নির্মাণের বার্তা। ভাষার জন্য জীবনদানও একইভাবে আধুনিক সমাজের প্রতিশ্রুতি হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্রামীণ চেতনা ও শহুরে চেতনার ভিন্নতা সত্ত্বেও এই দুই বিপরীত চেতনার মিলন থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ফল্গুধারা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রভাব বৃদ্ধিতে এই দুই বিপরীতমুখী চেতনা অনেকটা তেল-জলের মতো হলেও একত্র হয়ে গড়ে তুলেছিল এক অভিন্ন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট।

এখানেই, অর্থাত্ এই প্রাচীন জাতি-চেতনার মধ্যেই নির্মিত হয়েছিল গ্রামীণ সমাজের লৌকিক অথচ জনপ্রিয় ধর্মীয় চেতনার এক বিশাল ভূখণ্ড। তার গুরুত্ব উপলব্ধিতে আমাদের শহুরে মধ্যবিত্ত মানসিকতা ব্যর্থ হয়েছে। অনেকের দৃষ্টি কেবল শহরের মধ্যবিত্তকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের চেতনায় ধর্মীয় উপাদান অনুসন্ধান করেছে এবং তার প্রতিফল নিয়ে শঙ্কিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জোয়ারের মতো গ্রামীণ মানুষ শহরে এসে শহরায়ণ-প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে, কিন্তু তারা সঙ্গে করে এনেছে তাদের পুরোনো মূল্যবোধ ও আদর্শকে। এভাবে গ্রাম-শহর একাকার হয়ে গেছে অন্তত চেতনার দিক দিয়ে। ফলে জনগণ বলতে শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ধরে নিয়ে বাঙালি আলোচনায় গ্রামীণ লৌকিক এবং জনপ্রিয় ধর্মীয় চেতনার কোনো স্থান রাখা হয়নি। হয়তো সে কারণে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধুনিক সমাজ নির্মাণের প্রবক্তাদের বিচ্ছিন্নতার এক দেয়াল সৃষ্টি হয়েছিল, আর সেই বিচ্ছিন্নতার পুরো সুযোগ গ্রহণ করেছে রাজনৈতিক ইসলাম। এখানে উল্লেখ করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে সমাজ পরিবর্তনে  ইতালীয় মার্ক্সবাদী আন্তোনিও গ্রামসি এই অজৈবিক চেতনার প্রতি কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাকে তিনি ভেবেছিলেন সেই নিয়ামক শক্তি হিসেবে, যাকে সমাজ প্রগতির পক্ষের শক্তির দিকে টেনে আনা আবশ্যক। গ্রামীণ সমাজের প্রাচীন চেতনা, যার মূল ভিত লৌকিক ধর্মীয় চেতনা এবং শহুরে মানুষের আধুনিক চেতনার ঐক্য জাতীয়তাবাদী শক্তির মূল আধারে পরিণত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু নিয়তির পরিহাসের মতো ওই প্রাচীন চেতনাই তার প্রতি অবহেলার কারণে ধীরে ধীরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংকটের অন্যতম প্রধান উেস পরিণত হয়। আমাদের আজকের সংঘাতের একটি বড় কারণ নিহিত রয়েছে এখানে।

এই ধর্মীয় চেতনা বাংলাদেশে এত যে শক্তি অর্জন করল, এর মূলে রয়েছে ভিন্ন এক কারণ। প্রাক-আধুনিক জাতি-পরিচয়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেই। কৃষিভিত্তিক মধ্যযুগীয় সমাজে জাতি-পরিচয়ের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিবন্ধিত হয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অথবা সেটি যুক্ত থাকে রাজা বা সম্রাটের বংশপরিচয়ের সঙ্গে। আধুনিক জাতি-পরিচয়ের আছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। জাতীয়তাবাদী এই প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে রাষ্ট্র অন্তর্ভুক্ত, সেই প্রাচীন চেতনার বিরুদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের হুমকির কারণে তারা খোঁজে নতুন আশ্রয়। আর সেই সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহারে মৌলবাদী ধর্মীয় শক্তি কার্পণ্য করে না, করেনি কখনো। তারা মসজিদের মতো প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় হিসেবে পেয়েছে এবং তাকে ব্যবহার করেছে। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ আজ আর কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জ নয়। তারা আজ কেবল অভ্যন্তরীণ জাতিরাষ্ট্রের ক্ষমতা-কাঠামোর মধ্যেই সংযুক্ত নয়, একই সঙ্গে তারা বিশ্বসমাজের সঙ্গেও যুক্ত—মুঠোফোন, ইন্টারনেট, যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি কারণে। বিশ্বায়নের প্রভাবে আজ নানা চেতনা তাদের আঘাত করে, তাদের প্রভাবের অধীনে তারা আসে। এ কথা আজ ভাবার কোনোই কারণ নেই যে এককালের পুঁথিসাহিত্য অথবা যাত্রা অথবা বিষাদ সিন্ধু তাদের আজকের মনের খোরাক জোগায়। তারা বরং পরিচিত আরও জটিল চেতনার সঙ্গে। যার মধ্যে মৌলবাদী ইসলাম, সালাফি, ওহাবি ইসলাম, জঙ্গিবাদী ইসলাম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। হেফাজতে ইসলামের উত্থান তারই এক বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বিশাল গ্রাম-বাংলাকে যুগে যুগে উপেক্ষা করা, তার পুনর্গঠনে প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্য এবং অবজ্ঞার ফল আজ কেবল মধ্যবিত্তের ঘাড়ে চাপবে না; তার মাশুল দিতে হতে পারে সারা দেশকে, যদি না এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া যায়।

জাতি-পরিচয় ও ইউটোপিয়া

বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংকটের দ্বিতীয় উত্স হলো একটি কল্পনাশ্রয়ী সোনার বাংলার ধারণা, আসলে যা ছিল বালির প্রাসাদ। কল্পনাশ্রিত ধারণার বিপদ সম্পর্কে সমাজে একটি সাধারণ সতর্কবাণী আছে। সেই সতর্কবাণী কল্পনা ও বাস্তবের অসামঞ্জস্যতা বিষয়ে। সমাজপতি ও রাজনীতিবিদেরা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে ঠিক সাধারণ মানুষের মতোই দুই বিপরীত জগতে বাস করে। একদিকে তাঁরা কল্পনার (world of ideas, subjective world) জগত্ নিয়ে মগ্ন থাকেন; অন্যদিকে তাঁদের মুখোমুখি হতে হয় বাইরের কঠোর বাস্তবতার (outside world, physical world) সঙ্গে। প্রথম জগত্ কল্পনার—ভাবনা বা মতবাদের, যেটি স্বপ্ন দিয়ে গড়া এবং বাস্তবতার সঙ্গে যার মিল নগণ্য। একে ইউটোপিয়ার জগত্, কল্পনাপ্রসূত জগত্ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে, ঠিক সোনার বাংলার স্বপ্নের মতো। সোনার বাংলায় বাঙালির এককালের ঐশ্বর্যের প্রতীকী উপস্থিতি আছে। সেখানে রয়েছে ব্রিটিশ শাসনপূর্ব একটি ঐশ্বর্যপূর্ণ সমাজের ধারণা। সেই সোনার বাংলার ছবি মানুষকে আশা দিয়েছিল। দিয়েছিল দারিদ্র্যমুক্ত একটি সমাজের প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতীক সামাজিক মুক্তির পথনির্দেশক হয়েছিল। সেই সোনার বাংলা পরিণত হয়েছিল উপনিবেশবিরোধী চেতনায়। কিন্তু তা ছিল এক জগত্। কল্পনার ধ্যানে ক্ষণিকের জন্য মানুষ বাস্তবের কঠিন পরিবেশ থেকে পলায়নের সুযোগ পেয়েছিল বটে। আর এভাবে সেটি পরিণত হয়েছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রয়োজনীয় এক সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে, যা মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, কিন্তু ওই স্বপ্ন থেকে মানুষের পাওয়ার আসলে কিছুই ছিল না।

কাউকে এ কথা মনে করিয়ে দেওয়াও প্রয়োজন হয় না যে বাস্তব জগত্ সুখ-দুঃখ, কল্পনা ও কঠোরতা দিয়েই গড়া। সেখানে জীবন সাদা-কালো এভাবে ভাগ করা নয়, জীবন সেখানে এগিয়ে চলে স্বপ্ন ও বাস্তবের জটিল মিথস্ক্রিয়া দিয়ে। এই মিথস্ক্রিয়ায় স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে ন্যূনতম সমন্বয় না হলে বিপদ। কেবল কল্পনা নিয়ে জীবনকে গড়া যায় না। আবার কেবল বাস্তবতার ফ্রেমে জীবনকে বন্দী রাখলে জীবন হয়ে পড়ে শুষ্ক, অতিমাত্রায় দুর্বিষহ। ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে এই সমন্বয়ের প্রশ্নটি যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক জীবনে ওই সমন্বয় থেকে যেকোনো বিচ্যুতি আনতে পারে সমূহ বিপদ। বাস্তব ও কল্পনার সমন্বয়ের অভাবকে প্রখ্যাত ইংরেজ চিন্তাবিদ Edward Hallett Carr সে কারণে রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির প্রধান উত্স হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি তাঁর চিন্তার সারবস্তু তুলে ধরেছিলেন এভাবে: ‘তাহলে এখানেই হলো জটিলতা। এখানেই রাজনীতির সব ধরনের আকর্ষণ এবং ট্র্যাজেডি। রাজনীতি সৃষ্টি হয় দুটি দিক নিয়ে—একদিকে ইউটোপিয়া, অন্যদিকে বাস্তবতা। এরা দুটি ভিন্ন জগত্, তাদের কখনো মিলন হয় না। তাদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে ব্যর্থ হলে স্বচ্ছ রাজনৈতিক চিন্তা লোপ পায়। আদর্শকে যদি ধরা হয় ইউটোপিয়া হিসেবে এবং প্রতিষ্ঠানকে যদি ধরা হয় বাস্তবতা হিসেবে, তাহলে তাদের পার্থক্য নিরূপণ করা এবং ওই পার্থক্য সম্পর্কে সচেতনতা যেকোনো সুস্থ রাজনীতির পূর্বশর্ত।’১৬

কারের এই সতর্কবাণী—বাস্তব ও অবাস্তবের ভেদরেখা সম্পর্কে সজাগ থাকা এবং ওই দুইয়ের মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের প্রশ্নটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল বাংলাদেশের জন্য ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর। যে কাল্পনিক সোনার বাংলার ধারণা নিয়ে বাংলাদেশ তার যাত্রা শুরু করে, সেই ধারণার কাল্পনিক দিকটি আমরা ভুলে বসেছিলাম। আমরা স্বাধীনতাকে দেখেছিলাম নিতান্তই প্রত্যক্ষণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, কার্যকারণের ছাঁচে। ছয় দফা, এগারো দফা আন্দোলন, মিটিং-মিছিল, প্রতিরোধ, যুদ্ধ এবং তা থেকে স্বাধীনতা—ঘটনাপ্রবাহের এই ধারাবাহিকতা দিয়েই আমরা তাকে বুঝেছি কেবল। সেখানে অতীন্দ্রিয়, বাস্তববহির্ভূত কোনো কল্পনার প্রভাব নিয়ে ভাবিনি। সোনার বাংলার ইউটোপিয়া বা কাল্পনিক দিকটি কী ক্ষতি করতে পারে, সেটি আমাদের বিবেচনায় উপেক্ষিত থেকে গেছে। তার বিপদের দিক সম্পর্কে আমরা নিজেদের সচেতন করতে পারিনি। আর সে কারণে ইউটোপীয় এক সমাজ গড়তে গিয়ে প্রগতির বদলে পেয়েছি সংঘাতময় এক বাস্তবতা। সোনার বাংলার কল্পনাশ্রয়ী রূপ সংঘাত সৃষ্টিতে কী ভূমিকা পালন করেছিল, তার একটি চিত্র এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।১৭

প্রথমত, যেকোনো কাল্পনিক ধারণা নিজেকে বিশুদ্ধ রাখতে চায়, আর সেই বিশুদ্ধতার প্রশ্নকে ঘিরে জন্ম নেয় রাজনৈতিক বিভেদ। একটি বিশুদ্ধ সমাজ নির্মাণের ভাবনা কীভাবে বিভেদের জন্ম দিয়েছিল, সেটি দেখা যেতে পারে সোনার বাংলার উদাহরণ থেকেই। সোনার বাংলা কীভাবে গড়ে তোলা হবে, তার একটি কর্মসূচি আওয়ামী লীগের সরকার স্বাধীনতার প্রথম বছরে গ্রহণ করেছিল। সেই কর্মসূচির অন্যতম একটি দিক ছিল বাংলাদেশকে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথে এখানে কী কী বাধা থাকতে পারে, সেই ভাবনাগুলো কোনো গুরুত্ব পায়নি। কারণ, ইউটোপিয়াকেন্দ্রিক যেকোনো চিন্তার প্রধান একটি প্রবণতা হলো যে সে প্রথমেই কল্পনা ও বাস্তবতার তফাতটিকে গুলিয়ে ফেলে। সেখানে কল্পনাকে বাস্তব মনে করা হয়, বাস্তবতাকে কল্পনার মতো করে ভাবা হয়। ফলে সে চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয় একধরনের মধ্যবর্তী অবস্থান ‘between illusion and reality’। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতিমালা প্রণয়নে সোনার বাংলার আক্ষরিক অনুবাদ প্রাধান্য পেয়েছিল। সোনার বাংলা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক এলিটদের কাছে বাস্তবায়নযোগ্য একটি প্রত্যয়। তবে ইউটোপিয়ার আদর্শিক বিশুদ্ধতার প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যেই দেখা দিয়েছিল বিরোধ ও সংঘর্ষ। কে সোনার বাংলা নির্মাণের সত্যিকার কারিগর, কে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিশুদ্ধ অনুসারী, সমাজতন্ত্রের কোন মডেলটি বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় এবং কোনটি নয়, এ প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। ঠিক যেমনটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের অভিজ্ঞতায়। সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে কেন্দ্র করে বিভেদের পর বিভেদের জন্ম হয়েছে। লেনিনকে মার্ক্স থেকে ভিন্ন ভাবা হয়েছে, প্লেখানভ থেকে ট্রটস্কি ভিন্ন, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের সঙ্গে ইউরো কমিউনিজমের ভিন্নতা, এম এন রয় থেকে লেনিন পৃথক—এসব তাত্ত্বিক বিভেদ কেবল বিভেদে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা সংঘাত সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। পৃথিবী দেখেছে ওই আদর্শিক সংঘাতের ভয়াবহ ফল। বাস্তবায়নের দিকে থেকে দেখলেও সেখানে জন্মেছে বিভেদের পর বিভেদ। সোভিয়েত-চীন বিভেদ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তাদের মধ্যে যুদ্ধও দেখেছি। ইউরোপীয় পথের সঙ্গে সোভিয়েত পথের বিভেদ, এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বিভেদ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে সোভিয়েতের বিভেদ কেবল তাত্ত্বিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছোট-বড়-মাঝারি— এসব বিভেদ বা মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে জন্ম নিয়েছে অসহিষ্ণুতা এবং তা থেকে ঘটেছে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা-কাঠামোর আবির্ভাব। নিজের অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন হয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্যের। সেই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সংঘাত ব্যতীত সম্ভব হয়নি কখনো।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ওই বিভেদ ছিল রক্তক্ষয়ী। কেবল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক মডেলের সঙ্গে চীনা মডেলের নয়, নতুন নাম নিয়ে হাজির হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দাবিদার এক ভিন্ন দল, যারা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে (বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বিভেদ সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে) তাদের বিরোধিতার কথা জানিয়ে দেয় দেশবাসীকে। পাশাপাশি সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন আরেক উপদল—তারাও নিজেদের সমাজতন্ত্রের সত্যিকার অনুসারী হিসেবে দাবি করে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় হক, তোয়াহা, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি-মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী ইত্যাদি নানা দল-উপদল। এরা সবাই নিজেদের সমাজতন্ত্রের সাচ্চা অনুসারী বলে দাবি করে। এরা প্রত্যেকেই একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক। ইতিমধ্যে বিশ্ব পরিসরে সোভিয়েত-চীন বিরোধ তীব্র রূপ ধারণ করে এবং ইউরো-কমিউনিজমও হাজির হয় বিশুদ্ধতার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে। এই কলহে আওয়ামী লীগের মতো জাতীয়তাবাদী আদর্শে পরিচালিত একটি দল কেন সমাজতান্ত্রিক ব্র্যান্ড নিয়ে রাজনীতিতে উত্সাহী হবে, সে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। আওয়ামী লীগের এই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তাকে ঘায়েল করার সহজ এবং মস্ত সুযোগ হাতছাড়া করতে কেউ পিছপা হয়নি। মোট কথা, আলোর চারদিকে যেমন মথ আকর্ষিত হয়, তেমনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ঘিরে বহু বর্ণের ও বহু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের শক্তি শ্রেণী-সংগ্রামের নামে এক অভূতপূর্ব রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় বাংলাদেশের সূচনালগ্নে।

এই প্রতিযোগিতার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল প্রতিপক্ষের ওপর নিপীড়ন। প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সে সময়ের আধিপত্যকারী এই দল আওয়ামী লীগ নিপীড়নের পথ বেছে নেয়, সেটি যেমন জাসদের বিরুদ্ধে, তেমনি পরিচালিত হয় সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত অন্যান্য দল-উপদলের বিরুদ্ধে। ফলে দেখা গেল, একটি ইউটোপিয়া নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও (সোনার বাংলা) মাত্র তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ বহু ইউটোপিয়ার দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। সেটি কাউকে যে খুব বেশি অবাক করেছিল, তা নয়। কারণ, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন পথে ইউটোপিয়া বাস্তবায়নের চিন্তা করে। তার পেছনে থাকে প্রতিটি গ্রুপের নিজস্ব আবেগ। সেই আবেগের তাড়না থেকে জন্ম নেয় অভ্যন্তরীণ বিভেদ। এই বিভেদ দখল করে নেয় রাজনীতির ক্ষেত্রকে। কীভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়, সেটিই তখন পরিণত হয় রাজনীতির ধ্যানে। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকেন্দ্রিক বিতর্কের স্থলে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয় নিজের অনুসৃত পথের সঠিকতার দিকটিকে, তাঁর বিশুদ্ধতার প্রশ্নটিকে। বাংলাদেশে এক জাতীয় অগভীর রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্মের সঙ্গে এর রয়েছে ওতপ্রোত সম্পর্ক। সমাজে বহু ইউটোপিয়ার উপস্থিতি সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে জন্ম দেয় সংঘাতের। বহু ইউটোপিয়া প্রভাবিত যে রাজনীতি, তা রাজনীতি ব্যাপারটিকেই দেখে এক চিন্তার উত্থান অথবা অন্যটির পতন হিসেবে, এক দলের ক্ষমতায় যাওয়া, অন্যকে ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করার সংগ্রাম হিসেবে। চারটি সামরিক অভ্যুত্থান—১৫ আগস্ট ১৯৭৫, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫, ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ও ১৯৮১ সাল এবং দুই রাষ্ট্রপতির নিহত হওয়ার সঙ্গে ১৯৭২ সালের সোনার বাংলার কাল্পনিক সমাজের দায়বদ্ধতার সম্পর্কটিকে অস্বীকার করা যায় না।

দ্বিতীয়ত, ইউটোপিয়ার ওপর ভর করে গড়ে ওঠে মিথ্যা চেতনা (false consciousness)। এই মিথ্যা চেতনা সোনার বাংলার কল্পনাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। কেন এই মিথ্যা চেতনা আওয়ামী লীগের মধ্যে জন্ম নেয়, এখানে তার অন্তত তিনটি কারণ উল্লেখ করা যায়। এই কারণগুলো প্রতিটিই একে একে আওয়ামী লীগকে একটি স্বৈরাচারী শক্তিতে পরিণত করেছিল। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হাতে পাওয়া এবং তা-ও মাত্র নয় মাসের মাথায়, আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশাল মাপের পরিবর্তন আনে। ক্ষমতাসীন দলের অনেক রাজনীতিবিদের মনে এই মিথ্যা আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয় যে এমন কিছু নেই, যা তাঁদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়, ঠিক যেভাবে তাঁদের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এই বিশ্বাস রাজনীতিতে বাস্তববাদী ধারা গড়ে তোলার পথে প্রধান বাধা হয়ে দেখা দেয়। অবাস্তববাদী প্রত্যাশা রাজনীতিবিদদের আচার-আচরণে আমূল পরিবর্তন আনে। দেশের স্বাধীনতাকে আওয়ামী লীগ একধরনের রাজনৈতিক ট্রফি হিসেবে দেখতে শুরু করে। তারা দাবি করে, তারাই সেই দল, যে দল বাংলাদেশের জন্মের পুরো কৃতিত্বের দাবিদার। আর তারাই পারে বাংলাদেশকে স্বল্প সময়ের মধ্যে সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে। এ ধরনের একটি মিথ যখন তৈরি হয়, তখন রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলার মানসিকতাও লোপ পায়। রাজনৈতিক নিশ্চয়তা (certainty) ও গোঁয়ার্তুমি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান উপধারায় পরিণত হয়। অতিমাত্রায় কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতা থেকে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করে বসেছিল। ওই মানসিকতা তাদের অগ্রাহ্য করতে শিখিয়েছিল অন্য সব রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকাকে। আর সে কারণে তারা সর্বদলীয় সরকার গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল।

দ্বিতীয় কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটা অপ্রত্যাশিত ছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে দেশকে স্বাধীন করার কোনো চিন্তা বাঙালিদের মনে স্থান করে নেয়নি। সে চিন্তা বিক্ষিপ্ত বা বিচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক ত্যাগের মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালের প্রথম দুই মাস আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিয়েই ভেবেছে। ওই নির্বাচনে ১৫৩ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৫১টি লাভ করে। ৯ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব ছয় দফায় স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি সংবিধান প্রণয়নের দাবি রাখেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাত্কারকে মওদুদ আহমদ এভাবে বর্ণনা করেছেন: ‘ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে মুজিবকে শুধু “পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ প্রধানমন্ত্রী” হিসেবেই সম্বোধন করলেন না। উপরন্তু ইঙ্গিত দিলেন যে খুব শিগগির তিনি সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। ঢাকা ত্যাগের আগে ইয়াহিয়া মুজিবকে আশ্বাস দিলেন যে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে।’ (মওদুদ আহমদ, ২০১০, পৃষ্ঠা ১৭১)। কিন্তু ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হলে সর্বস্তরের জনগণের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ধাপে ধাপে দানা বেঁধে ওঠে। ২ ও ৩ মার্চ হরতাল ডাকা হয়েছিল। ১০ মার্চ ইয়াহিয়া সব দলের সংসদীয় গ্রুপের নেতাদের যে মিটিং ডাকেন, সেটির বর্ণনা দিয়ে মওদুদ লেখেন, ‘মুজিব এই আমন্ত্রণকে নিষ্ঠুুর প্রহসন বলে বর্ণনা করেন। মুজিব সে সময় ছিলেন অসহায়। স্বাধীনতার ঘোষণা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার অর্থ ছিল সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং মূলত একজন নিয়মতান্ত্রিক নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় অক্ষম। তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক নীতিমালা ও শাসনতান্ত্রিক রাজনীতির অনুসারী। উদারপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন। কাজেই বাঙালিরা যা প্রত্যাশা করেছিল, তা তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে বসে সমঝোতার মাধ্যমে অর্জন করার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।’ (মওদুদ আহমদ, ২০১০, পৃষ্ঠা ১৮৬)।

জাতীয় পরিষদ গঠন, তার অধিবেশন ডাকা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং একটি গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের ভিত্তি গড়ে তোলা। সেই সাংগঠনিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পর নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে অনেকটা পরিস্থিতির চাপে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়। স্বাধীনতার প্রশ্নটি এভাবে আওয়ামী লীগের সামনে এসে যাবে, সেটি তাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে ছিল। সেই সঙ্গে নয় মাসের মতো স্বল্প সময়ে স্বাধীনতা লাভও ছিল তাদের জন্য অকল্পনীয়। নয় মাসের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম সুশৃঙ্খল এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব ছিল না, যদি না ভারতের সামরিক ও মানবিক সহায়তা পাওয়া যেত। ভূ-স্ট্র্যাটেজিক পরিবেশ সম্পর্কে সজাগ ভারত পাকিস্তানের বিভক্তিকে মনে-প্রাণে কামনা করত বললে ভুল হবে না। এটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন, ওই নয় মাস যুদ্ধকালীন আত্মনিবেদিত, ত্যাগী রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও মুক্তিযোদ্ধা ব্যতীত অনেকেই ভারতে বসে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের অপেক্ষায় দিন গুনেছে। সকল অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বাংলাদেশের জন্ম হলেও তা আওয়ামী লীগের কাছে সহজলভ্য এক বিজয় হিসেবেই প্রতীয়মান হয়েছে।

কাল্পনিক একটি সমাজ গড়ার প্রয়াস আধিপত্যের মানসিকতা ও স্বৈরাচারী সরকারের জন্ম দিতে বাধ্য। সে অভিজ্ঞতা কেবল বাংলাদেশের বেলায়ই ঘটেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে তার বহুবিধ উদাহরণ রয়েছে। প্লেটোর রিপাবলিকে যে কাল্পনিক ও বিশুদ্ধ সমাজ গড়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে এলিটদের শাসন নিশ্চিত করা হয়েছিল। এই এলিটদের দায়িত্ব কথাটার দ্বারা তিনি কেন্দ্রীভূত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং একনায়কতান্ত্রিকতাকে উত্সাহিত করাকে বুঝিয়েছিলেন। প্রতিটি ইউটোপিয়া একধরনের নিয়ন্ত্রিত, বদ্ধ সমাজব্যবস্থার ধারণাকে উত্সাহিত করে। ফলে তার মধ্যে proto-Fascism-এর উপস্থিতি রয়ে যায়। সেখানে নিয়মগুলো অনমনীয় ও অপরিবর্তনীয় থাকে, যার উদাহরণ হিসেবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আওয়ামী লীগের কথা ভাবা যেতে পারে। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি পাওয়ার ফলে তাদের মনে এক উত্কট আত্মপ্রেমের জন্ম হয় (extreme form of narcissism)। তার ফলাফল কী হয়েছিল, সেটি আমরা সবাই জানি। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর, ১২ জানুয়ারি তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ এবং ২২ মার্চ ১৯৭২ দেশের আইন প্রণয়নের একচেটিয়া অধিকার লাভ পরপর এই ব্যাপারগুলো ঘটে। অন্যদিকে আইন পরিষদের একমাত্র দায়িত্ব হয় শাসনতন্ত্র পাস করা। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে শাসনতন্ত্র বিল পাস হয়। অতঃপর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর আইন পরিষদ বাতিল করা হয় এবং ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি-ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থা জারি করা হয়, যদিও জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা ছিল ৩০০-এর মধ্যে ২৯৩ (এটি এক অদ্ভুত স্ট্র্যাটেজি বললে ভুল হবে না)। এই প্রভুত্ব (হেজেমনি) আওয়ামী লীগের চরিত্রে গভীর রূপান্তর ঘটায়। সেখানে লক্ষ করা যায় দুটি প্রবণতা—একদিকে সংকীর্ণ ও উত্কট আত্মপ্রেম (শোভিনিজম), অন্যদিকে অপরাজেয় মনোভাব।

অথচ দেশে সুস্থ এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পক্ষে ওই সময়টাই উপযুক্ত ছিল। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের মূল কথা হলো সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা। কিন্তু আত্মগরিমায় মুগ্ধ আওয়ামী লীগ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে, যারা তাদের সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদেরকে অবজ্ঞা করে। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করে। যেখানে রাজনীতিতে বিরোধী দলের উপস্থিতি অপরিহার্য, সেখানে সংখ্যাগত দিককে উল্লেখ করে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের ভূমিকাকে অস্বীকার করা হয়।১৮ সেদিন শক্তিশালী বিরোধী দলের (সংসদে বিরোধী সদস্যের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য ছিল যদিও) প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। এবং সেই নগণ্য সংখ্যাকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়ে হয়তো বা গড়ে তোলা যেত গণতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত। সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি নিশ্চিত হলে সামরিক বাহিনীর সংবিধানবহির্ভূত ক্ষমতা দখল ও সামরিক অভ্যুত্থানের সুযোগও হয়তো অনেকাংশে কমে যেত। তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টে বাকশাল নামে একদলীয় ক্ষমতা-কাঠামো সৃষ্টি করে বিরোধী শক্তির বিকাশকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত করার লক্ষ্যে। বাকশাল ছাড়া অন্য সব দলকে বেআইনি ঘোষণার ফলে অনেকেই একে স্বৈরাচারী মনোভাব হিসেবে বিবেচনা করে। ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদের রাজনীতি গুরুত্ব পায়। গণতন্ত্রকে রক্ষা এবং তাকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে সমাজের এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে সহযোগিতার অপরিসীম গুরুত্বকে উপেক্ষা করে কেবল যে একটি মুকুলিত গণতন্ত্রের বিকাশের পথকেই সেদিন রুদ্ধ করা হয়েছিল, তাই নয়, সেই সঙ্গে অতিশয় অপরিপক্ব রাজনৈতিক এলিট শ্রেণী, যাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, তাঁরাও বঞ্চিত হয়েছিলেন রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে। কারণ, সেই দক্ষতা অর্জন সম্ভব ছিল জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিকে নিশ্চিত করে। কিন্তু সেই পথও সেদিন রুদ্ধ হয়ে যায়। আজকের দিনে সংঘাতময় সমাজের যে বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে, তার শিকড় রয়ে গেছে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের রাজনীতিতে।

শেষ কথা

বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল স্রোত ৪২ বছর আগে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় স্থান করে দিয়েছিল। আজ সে দেশ একটি সংঘাতময় দেশ হিসেবে পরিচিত। মধ্যবিত্ত জীবনের সীমানায় যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের জন্য দেশের এই পরিচয় এক অদ্ভুত বিড়ম্বনার জন্ম দিচ্ছে। তারা দেখছে কীভাবে সংঘাতের ঋজুতা রাজনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। দুই বৃহত্ রাজনৈতিক জোট দেশের বিধাতা হলেও তাদের মধ্যে সহযোগিতা বা সমঝোতা নেই। তারা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নিয়োজিত রয়েছে। কৌশল হিসেবে তারা কারণে-অকারণে সংসদ বর্জন করে। গালভরা স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে। অবরোধ, ভাঙচুর, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সভ্য-অসভ্য ভাষায় গালিগালাজ, রাজনৈতিক হত্যা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতাকে তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে এখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো হয়। সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারই পরিণতিতে এখানে যেমন অন্তঃসারশূন্য ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি স্থান করে নিয়েছে, তেমনি গড়ে উঠেছে সংঘাতের এক  সংস্কৃতি। সেই সংঘাতে বাঙালির প্রধান দুই আত্মপরিচয়, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়কে, মূল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত করা হয়েছে। ৪২ বছর পার হলেও ওই দুই পরিচয় কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। দুই পরিচয়ের দ্বন্দ্ব সে কারণে এখানে তীব্র ও রক্তাক্ত। জাতি পরিচয় বিগত ৪২ বছরে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে। উগ্রধর্মপন্থা সহিংসতার মাধ্যমে সমাজে পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি আজ বিভক্ত ও সংঘাতপূর্ণ। এমনই  বিষাক্ত যে তাকে বিষমুক্ত করা না গেলে এ দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কা আছে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে?

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হবে সার্বিক জাতীয় সমঝোতা গড়ে তোলা। জাতীয় সমঝোতা ছাড়া এই সংঘাতের কোনো আশু সমাধান নেই। জাতীয় সমঝোতা বলতে বুঝতে হবে এক ধরনের চার্টার। সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোর মধ্যে জাতীয় মূল বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে একটি মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা চুক্তিনামা তৈরি করা। যে চুক্তিনামার কথা বলা হচ্ছে, সে ধরনের জাতীয় সমঝোতা দলিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণয়ন করা যেত। সেটি প্রণয়নের পথে সে সময়ে কোনো বাধা ছিল না। বরং তার সব পূর্বশর্ত সে সময় উপস্থিত ছিল। কিন্তু তা হয় নি। পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতিতে জাতি-পরিচয়, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পিছনে হেঁটেছে; রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিরোধপূর্ণ অবস্থান ক্রমাগত ধাপে ধাপে আরো গভীরতর হয়েছে। ফলে জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আজ সময় এসেছে সেই ধরনের চুক্তিপত্রে সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা, যার প্রতি সকল ব্যক্তি আনুগত্য দেখাবে এবং দলীয় গঠনতন্ত্রে স্থান দিয়ে অলঙ্ঘনীয় হিসেবে বিবেচনা করবে। তিনটি প্রধান দিক ওই চুক্তিনামায় অলঙ্ঘনীয় হিসেবে বিবেচিত হবে:

১. বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে পরিচালিত হবে, যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে না দেখে কারও পক্ষে এখানে নৈতিকভাবে রাজনীতি বা সমাজনীতির কোনো ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা যায় না।

২. এ দেশে নানা ধর্ম ও জাতির মানুষ বাস করে। হিন্দু, মুসলিম বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান তো আছেই, সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, গারো, খাসিয়া ইত্যাদি রয়েছে। মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা অধিকাংশ হলেও অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীর সমাধিকার নিশ্চিত না করে বাংলাদেশ এগোতে পারে না। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে হলে ইসলাম ধর্ম অবমাননার জন্য শাস্তিও যে আইনের বিধি আছে, সেটি অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও বৈষম্যমূলক আচরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। বৈষম্যবিরোধী আইন এবং জাতিধর্মসংক্রান্ত বৈষম্যবিরোধিতা জাতীয় ঐক্য চুক্তির অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে।

৩. বাংলাদেশ হবে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী আজ এক অভূতপূর্ব বিল্পব চলছে। এই বিপ্লব আধুনিক ধ্যান-ধারণাকে লালিত করে। মানবাধিকার নিশ্চিত করে। উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণার লালন এখানে আজও অত্যন্ত নগণ্য পর্যায়ে রয়েছে। এটি সমাজে এককভাবে প্রভুত্বকারী কোনো দর্শন নয়। পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার প্রতি সদয় ও সহনশীল ব্যক্তিদের অভাব না থাকলেও জাতিগতভাবে সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা খুব পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।

আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ বলতে আমরা বুঝি নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্রকে, তার অধীনে রাষ্ট্রের নির্বাহী কাজ সম্পন্ন করাকে, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও নির্বাহী ক্ষমতার হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকাকে। সেখানে আরও বোঝায় সুস্থ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ গড়ে তোলার স্থায়ী ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে। আধুনিক সমাজ বলতে আরও বোঝায় নাগরিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের পরিবেশ, সমাজকে প্রগতিমুখী করে তোলা, নারী-পুরুষ বিভেদ কমিয়ে আনা ইত্যাদি। বাংলাদেশের ৪২ বছরের ইতিহাসে নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। যে কটি ঘটেছে সেগুলো হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। নির্বাচন সুস্থভাবে পরিচালনার জন্য এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেটি ক্ষমতাসীন দলের উদ্যেগে সংবিধানবিরোধী বলে বাতিল করা হয়েছে, যদিও শাসকগোষ্ঠী ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। সে কারণে ক্ষমতার বৈধতার প্রশ্নটি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে আছে। এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি প্রয়োজন, যেন তাকে কেন্দ্র করে দেশকে সংঘাতের ক্ষেত্রে পরিণত করা না হয়। তা ছাড়া দেখা গেছে, জাতীয় সংসদ বা পার্লামেন্ট প্রতিনিধিত্বকারী গণতন্ত্রের মূল প্রতীক হলেও বাংলাদেশে সে কখনো দুই পায়ের ওপর ভর করে পূর্ণ উদ্যমে হাঁটার সুযোগ পায়নি। দুই পায়ের বর্ণনাকে এখানে প্রতীকী অর্থে বুঝতে হয়। সুস্থ মানুষ যেমন দুই পায়ের ওপর ভর করে হাঁটে, তেমনি গণতন্ত্রের পূর্ণতা লাভে প্রয়োজন হয় সরকারি ও বিরোধী দলের দায়িত্বশীল উপস্থিতি। তর্ক ও বিতর্কের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকে আমরা গণতন্ত্র হিসেবে ধরে থাকি। রাষ্ট্রপরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তিতর্ক, জনগণের কাছে প্রতিনিধিত্বকারীদের নৈতিক দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে পালিত হলেও বাংলাদেশে তার প্রতিটির অনুপস্থিতি প্রকটভাবে ধরা পড়ে ওই একপেয়ে গণতন্ত্রের কারণে। জাতীয় ঐক্যভিত্তিক চুক্তিনামায় এর নিরসনের ব্যবস্থা থাকবে।

প্রয়োজনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদের কথা চিন্তা করা যেতে পারে, যেখানে নিম্ন চেম্বার প্রতিনিধিত্বমূল ভোটে গঠিত হবে এবং উচ্চ চেম্বার সমাজে অভিবাবক স্থানীয় শ্রদ্ধেয় মানুষ, দক্ষ পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ভোট দ্বারা নির্দিষ্ট হবে। নিম্ন চেম্বার পরামর্শ করবে উচ্চ চেম্বারের সঙ্গে এবং বিল পাস হবে উচ্চ চেম্বারের পরামর্শসাপেক্ষে। জাতীয় সংসদ পাঁচ বছর মেয়াদের পরিবর্তে চার বছরের যে প্রস্তাব বিভিন্ন চিন্তায় দেখা যায়, সেটিও এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।

নিরপেক্ষ ন্যায়পাল প্রথা চালু করার চিন্তা স্থান পেতে পারে ওই চুক্তিনামায়, যারা নাগরিক অভিযোগের মীমাংসা করবে। এটি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হতে হবে।

একটি নিরপেক্ষ পেশাভিত্তিক আমলাতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্র দুরভিসন্ধিগ্রস্ত ও অকার্যকর। উন্নয়নের সহায়ক শক্তির পরিবর্তে প্রগতির পথে সে বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে প্রয়োজন পরিবর্তনের। আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিমুক্ত করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সর্বোচ্চ পেশাদারি কীভাবে অর্জন করা সম্ভব সেটির জন্য বিশেষ পরিকল্পনা প্রয়োজন।

জাতীয় চুক্তিনামায় এগুলোকে উপস্থাপন করে এবং পরিপূর্ণভাবে পালন করলে বাংলাদেশ সংঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারে।

 তথ্যসূত্র ও টীকা

১.‘Formation in praxis always involved both processes- the articulation of group boundaries that excludes others, and the development of internal criteria for solidarity’ (Cynthia Talbot p. 90)

২. পিটার অলটার লেখেন, ‘Common structural component or feature of nationalism include ‘consciousness of the uniqueness or peculiarity of a group of people, particularly with respect to their ethnic, linguistic or religious homogeneity; emphasising of shared socio-cultural attitudes and historical memories; a sense of common mission’ (Alter, 1985: 7).

৩. জাতীয়তাবাদ কেন ব্যর্থ হয়, অলটারের মতে তার অন্যতম কারণ হলো এই যে এটি একাধারে বিপদের সংকেত দেয়, অন্যদিকে সুযোগ ও সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে। acts simultaneously as ‘a repository of dangers and opportunities’ (Alter, 1985:5).

৪. Hobsbawm লেখেন, ‘The hunger to belong quickly fell out of favor and was ‘no more a moving force’ compared to the hunger for ‘law and order’, (Hobsbawm, 1991: 177) which became an equally important agenda for people in a new post liberated Bangladesh.

৫. ‘There has happened a communal transformation of the exploiting and ruling classess and this is what marks the difference between West Bengal and Bangladesh.’ (Badruddin Umar 1987: 118)

৬. ‘Bangladeshi nationalism is a cent percent new and a cent percent Muslim nationalism whose future course of evolution is along the line of Bengali Muslim culture.’ (Chatterjee, B. 1973: 152)

৭. উমর লেখেন, Is it not true that this significant transformation, this communal character of the ruling and the exploiting classes is the foundation on which the nationalism of the people of Bangladesh can be said to stand. If this be so then does it not mean that in a very real sense the standard of Bangladeshi nationalism is the unmistakable standard of communalism hidden under the garb of a secular state? The basis of Bangladeshi nationalism is nothing but communalism based on religion and a revival of the two nations theory under a new and a far more deceptive garb. (Badruddin Umar, 1987: 118)

৮. ‘Industrial society requires a homogeneous system of education that merges high and low culture, either by imposing the high culture on the population or by upgrading a low culture to a high culture, during which nationalism is generated.’ (p.4) In Stein Tonnesson and Hans Antlov (ed), Asian Forms of the Nation, (London: Routledge, 2003) p. 362.

৯. ‘

In fact, in Hinduism, the social and the spiritual are strangely blended together. Consequently, the new national spirit has found apt vehicles for expressing itself in the current religious rites and formulas of the people.’ Pal himself gives a very good instance of this politicization of originally religious notions. The word Swaraj is today commonly taken to mean self-government and is inseparably associated with the struggle with the congress party to overthrow British rule. (John Hutchinson and Anthony D. Smith, (Ed.), Nationalism, Oxford, Oxford University Press, 1994) p. 206.
The word was originally a Hindu philosophical term and meant to the state of self-rule or self-control in which a man abstains from action and escapes from the painful and evil cycle of perpetual reincarnation. From Elie Kedourie Dark Gods and their rites.
‘How the cult of Kali and the modalities of this cult were exploited for political ends may again be illustrated by a speech of Pal’s at a political rally in which he recommended the worship of Rahbha Kali which is white not black and to which a sacrifice of white, not black goat was acceptable. If at every new moon 108 white goats were sacrificed, this, Pal said, would be a good thing. The theme was taken up by another speaker whose words made clearer the allusion to the white goats: for this speaker advised his audience to go abroad and learn the manufacturing of bombs and other destructive weapons and then to come back to their country and sacrifice at every new moon 108 whites.’ Elie Kedourie, ‘Dark Gods and their Rites,’ in Nationalism, edited by J. Hutchinson, and Anthony D Smith, (Oxford: Oxford University Press, 1994) pp. 205-209.

১০. ‘Some of the conceptual haze is burnt away, however, if it is realized that the people of the new states are simultaneously animated by two powerful, thoroughly independent, yet distinct and often actually opposed motives- the desire to be recognized as responsible agents whose wishes, acts, hopes, and opinions matter, and the desire to build an efficient, dynamic modern state. The one aim is to be noticed; it is a search for an identity, and a demand that that identity be publicly acknowledged as having import, a social assertion of the self as ‘being somebody in the world’. The other aim is practical; it is a demand for progress, for a rising standard of living, more effective political order, greater social justice and beyond that of ‘playing a part in the larger area of world politics, of exercising influence among the nations’ (Geertz Clifford, ‘Primordial and Civic Ties,’ p. 30, in Nationalism, edited by John Hutchinson and Anthony D. Smith, Oxford, Oxford University Press, 1994. pp. 29-34)

১১. Chatterjee এটিকে ‘a domain of sovereignty’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন (Chatterjee, 1966: 217)।

১২. আওয়ামী লীগের ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়, ‘the present structure of injustice by a new constitutional, political, economic and social order, in which justice between the regions and between man and man, would prevail’ (See in Bhattacharjee, 1973: 325)

১৩. Arabic and Persian would have to be given prominent positions because they were the sources of Pakistan’s religious and cultural heritage. He [Fazlur Rahman] also mentioned the role and importance of Urdu which he said was well-equipped to serve this role of unification among the different provinces and regions of Pakistan, as Urdu has a rich tradition of borrowing and assimilating words and ideas from other languages as well as from aborad. He highlighted the historical relation of Urdu with Persian, Arabic and Sanskrit. (Anwar Dil and Afifa Dil, 2011, p. 322)

১৪. সাধারণত ভাষা আন্দোলনকে দেখা হয় জাতীয়তাবাদের উত্থানের প্রধান কারণ হিসেবে, ‘The Pakistani troops laid down their arms and that was the end of East Pakistan- the culmination of the Bangla Bhasha (Bengali language) Movement leading to the creation of Bangladesh.’ (In Anwar Dil and Afia Dil, Bengali Language Movement and Creation of Bangladesh, San Diego: Intercultural Forum, 2011, p. 136)

১৫. 

The behavior of people acting apparently strangely that is to sacrifice life for the cause of identity ‘should be interpreted as symbolic acts’ and their ‘meaning should be sought for in terms of their place within an entire symbolic pattern, whose fundamental structure may also be latent in consciousness, by which man’s perception of nature, of his relations with nature and with other men, are ordered’ (Chatterjee, 1986: 12)

১৬. ই. এইচ. কার আমাদের সতর্ক করে দিয়ে লেখেন, ‘Here then, is the complexity, the fascination and the tragedy of all political life. Politics are made up of two elements- utopia and reality- belonging to two different planes, which can never meet. There is no greater barrier to clear political thinking than failure to distinguish between ideals, which are utopia, and institutions, which are reality.’ (E. H. Carr, The Twenty Years’ Crisis 1919-1939, NY Palgrave 2001, p. 87)

১৭. There will not be one kind of community existing and one kind of life led in utopia. Utopia will consist of utopias, of many different and divergent communities in which people lead different kinds of lives under different institutions. Some kinds of communities will be more attractive to most than others; communities will wax and wane. People will leave some for others or spend their whole lives in one. Utopia is a framework for utopias, a place where people are at liberty to join together voluntarily to pursue and attempt to realize their own vision of the good life in the ideal community but where no one can impose his own utopian vision upon others. R. Nozick, 1974, Anarchy, State, and Utopia, p. 311 Totowa, NJ: Rowman & Littlefield Publishers.

১৮. হাসানউজ্জামান লেখেন, ‘

A parliamentary system of government replaced the revolutionary government immediately after the triumphant return of Sheikh Mujib from Pakistan prison on January 10, 1972.’ (Hasanuzzaman 1998, 39)
Sheikh Mujib took prompt steps and promulgated on March 23, 1972 the presidential order 22. This order provided for the establishment of a constituent assembly comprising the members elected in 1970 from East Pakistan to Pakistan’s National Assembly and East Pakistan’s provincial Assembly. (Hasanuzzaman, 1998, 40) 
Constitutional Committee was formed comprising of 34 members where only Suranjit Sen Gupta was from the opposition.

গ্রন্থপঞ্জি

Ahmed, J. Syed. In Praise of Niranjan: Islam Theatre and Bangladesh. Dhaka: Pathak Somabesh, 2001.
Chatterjee, Partha. ‘The Second Partition of Bengal,’ in Partition of India Why 1947? edited by Kaushik Roy, pp 146-163. Oxford University Press, 2012.
Dallmayr, Fred., and Devy, G. N. (ed.). Between Tradition and Modernity: India’s Search for Identity. New Delhi: Sage Publications, 1998. 
Dil, Anwar., and Dil, Afia. Bengali Language Movement and Creation of Bangladesh. San Diego: Intercultural Forum, 2011.
Gellner, Ernest. Nation and nationalism. Oxford: Blackwell, 1983.
Giddens, Anthony. The Nation State and Violence. Cambridge: Polity Press, 1985.
Geertz, Clifford (ed). Old Societies and New States. New York: Free Press, 1963.
Hasanuzzaman, Al-Masud. Role of Oppostion in Bangladesh Politics. Dhaka: University Press Limited, 1998. 
Hutchinson, John. Modern Nationalism. London: Fontana, 1994.
Hutchinson, John., and Smith, Anthony. (eds) Nationalism. Oxford and New York: Oxford University Press, 1994. 
Carr, E. H. The Twenty Years’ Crisis 1919-1939. New York: Palgrave, 2001. 
Kohn Hans ‘Western and Eastern Nationalism,’ in Nationalism, edited by John Hutchinson and Anthony D. Smith, pp 162-165. Oxford: Oxford University Press, 1994. 
Smith, Anthony D. Nationalism and Modernity. London and New York: Rutledge, 1998.

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মারক গ্রন্থ ঢাকা: ১৯৮৭।

মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ: স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১০।