মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড—মিজানুর রহমান খান, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩।বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, তাদের জন্য মিজানুর রহমান খানের মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলত্জ, অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ও জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান যেসব গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড সেসব লেখায় প্রাপ্ত অনেক তথ্য, উপাত্ত ও ধারণাকে অনুসমর্থন করেছে। এই বইয়ের প্রথমে লেখক স্পষ্টভাবেই লিখেছেন যে শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা—যাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুণে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বাংলাদেশ নামে এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীনতা লাভের চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সশস্ত্র ও রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। এ রকম একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখক যথার্থই দাবি করেছেন, আরও বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যনির্ভর গবেষণার প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও খুব কম ইতিহাসবিদ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকই এগিয়ে এসেছেন। সেদিক থেকে চিন্তা করলে মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে গবেষণাধর্মী প্রকাশনার অভাব রয়েছে, মিজানুর রহমান খানের আলোচ্য গ্রন্থ সে অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে।মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড একটু ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ করেছে। মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত অধিকাংশ লেখা যেখানে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাত্কার এবং অনুমাননির্ভর যুক্তি দিয়ে রচিত, মিজানুর রহমান খান সেগুলোর ওপর নির্ভর না করে মার্কিন মহাফেজখানা থেকে অবমুক্ত করা কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আলোকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সামরিক ক্যু-এর কুশীলব এবং এ নিয়ে তত্কালীন পরাশক্তি ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করেছেন। অবমুক্ত দলিল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা ও যথার্থতা নিরূপণে লেখককে যথেষ্ট সচেতন মনে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, বিবরণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যাঁরা লিখেছেন কিংবা অবগত আছেন তাঁদের শরণাপন্ন হয়েছেন। বইটিকে তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ করতে লেখকের যে প্রচেষ্টা, তার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো অনেক প্রসঙ্গের অহেতুক পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, যা তাঁর লেখার ধরন ও প্রাঞ্জলতাকে প্রায়শই ব্যাহত করেছে। আলোচ্য বইটিতে ভূমিকা ও উপসংহারসহ মোট ১৫টি ছোট অধ্যায় রয়েছে। এ ছাড়া এতে ছয়টি তথ্যবহুল পরিশিষ্ট সংযুক্ত করা হয়েছে। মুজিব হত্যাকাণ্ডের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক তত্কালীন পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দুই আঞ্চলিক শক্তি ভারত ও পাকিস্তানের বাংলাদেশ নীতি আলোচনা করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সামরিক কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশিদ মুজিববিরোধী সামরিক ক্যু-এর নেতৃত্ব দিলেও মিজানুর রহমান খানের অনুসন্ধানের প্রধান লক্ষ্য স্পষ্ট। তিনি জানতে চেষ্টা করেছেন মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা ছিল কি না। মুজিব হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরই ভারতীয় গণমাধ্যম ও বামপন্থী দলগুলো মার্কিন সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সন্দেহের তির ছুড়ে দেয়। তাদের দাবি, ঢাকায় সিআইএ স্টেশন-প্রধান ফিলিপ চেরি বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে মুজিব সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেহেতু রিচার্ড নিক্সনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকার শুরু থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছিল এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার মার্কিন মিত্র রাষ্ট্র (পশ্চিম) পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, সেহেতু মুজিব হত্যায় সিআইএ-এর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছে বলে লেখক মনে করেন।