মুজিব হত্যায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতা: একটি ঐতিহাসিক অনুসন্ধান

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড—মিজানুর রহমান খান, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, তাদের জন্য মিজানুর রহমান খানের মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলত্জ, অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ও জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান যেসব গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড সেসব লেখায় প্রাপ্ত অনেক তথ্য, উপাত্ত ও ধারণাকে অনুসমর্থন করেছে। এই বইয়ের প্রথমে লেখক স্পষ্টভাবেই লিখেছেন যে শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা—যাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুণে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বাংলাদেশ নামে এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীনতা লাভের চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সশস্ত্র ও রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। এ রকম একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখক যথার্থই দাবি করেছেন, আরও বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যনির্ভর গবেষণার প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও খুব কম ইতিহাসবিদ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকই এগিয়ে এসেছেন। সেদিক থেকে চিন্তা করলে মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে গবেষণাধর্মী প্রকাশনার অভাব রয়েছে, মিজানুর রহমান খানের আলোচ্য গ্রন্থ সে অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে।

মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড একটু ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ করেছে। মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত অধিকাংশ লেখা যেখানে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাত্কার এবং অনুমাননির্ভর যুক্তি দিয়ে রচিত, মিজানুর রহমান খান সেগুলোর ওপর নির্ভর না করে মার্কিন মহাফেজখানা থেকে অবমুক্ত করা কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আলোকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সামরিক ক্যু-এর কুশীলব এবং এ নিয়ে তত্কালীন পরাশক্তি ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করেছেন। অবমুক্ত দলিল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা ও যথার্থতা নিরূপণে লেখককে যথেষ্ট সচেতন মনে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, বিবরণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যাঁরা লিখেছেন কিংবা অবগত আছেন তাঁদের শরণাপন্ন হয়েছেন। বইটিকে তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ করতে লেখকের যে প্রচেষ্টা, তার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো অনেক প্রসঙ্গের অহেতুক পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, যা তাঁর লেখার ধরন ও প্রাঞ্জলতাকে প্রায়শই ব্যাহত করেছে।

আলোচ্য বইটিতে ভূমিকা ও উপসংহারসহ মোট ১৫টি ছোট অধ্যায় রয়েছে। এ ছাড়া এতে ছয়টি তথ্যবহুল পরিশিষ্ট সংযুক্ত করা হয়েছে। মুজিব হত্যাকাণ্ডের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক তত্কালীন পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দুই আঞ্চলিক শক্তি ভারত ও পাকিস্তানের বাংলাদেশ নীতি আলোচনা করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সামরিক কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশিদ মুজিববিরোধী সামরিক ক্যু-এর নেতৃত্ব দিলেও মিজানুর রহমান খানের অনুসন্ধানের প্রধান লক্ষ্য স্পষ্ট। তিনি জানতে চেষ্টা করেছেন মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা ছিল কি না। মুজিব হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরই ভারতীয় গণমাধ্যম ও বামপন্থী দলগুলো মার্কিন সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সন্দেহের তির ছুড়ে দেয়। তাদের দাবি, ঢাকায় সিআইএ স্টেশন-প্রধান ফিলিপ চেরি বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে মুজিব সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেহেতু রিচার্ড নিক্সনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকার শুরু থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছিল এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার মার্কিন মিত্র রাষ্ট্র (পশ্চিম) পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, সেহেতু মুজিব হত্যায় সিআইএ-এর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছে বলে লেখক মনে করেন।

আলোচ্য বইটি আমাদের স্নায়ুযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৯০-এ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় পর্যন্ত প্রায় পাঁচ দশক স্থায়ী দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্বে একদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই পরাশক্তি তখন বিশ্বকে দুটো মতাদর্শগত জোটে বিভক্ত করেছিল—যার একটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের জোট, আর অন্যটি সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের জোট। বিশ্বব্যাপী তাদের ভূরাজনৈতিক প্রভাববজায় রাখার জন্য উভয় পরাশক্তিই অস্ত্র-বাণিজ্য, কূটনৈতিক চুক্তি, সামরিক জোট এবং বৈদেশিক সাহায্যসহ নানান ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। যদিও ভারত, চীন, পাকিস্তানসহ এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ একটি তৃতীয় জোট বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এরই ফলে ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে সোভিয়েত ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের প্রভাব বলয়ে প্রবেশ করে। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানের মার্কিন প্রভাবাধীন সেনটো (সেন্ট্রাল ট্রিয়েটি অর্গানাইজেশন) ও সিয়াটোয় (সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিয়েটি অর্গানাইজেশন) অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করা যায়। অন্যদিকে, ভারত-সোভিয়েত শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির কথা বলা যায়। বিশ্বরাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তানের এ বিপরীতমুখী জোটবদ্ধ হওয়ার কোনো প্রভাব কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর পড়েছিল, এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে—অবশ্যই হ্যাঁ। লেখকের বর্ণনায় বিষয়টি স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড বিরোধিতা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা ও সমর্থনের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ চলছিল।

মার্কিন দলিলে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বর্ণনা করেন যে হেনরি কিসিঞ্জার এবং নিক্সন প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তা পাকিস্তানের ভাঙন রোধের জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং এমনকি ভারত মহাসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর ও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের হুমকি দেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব প্রতিহত করা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের এক মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং এর সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত-নিয়ন্ত্রিত জোটে এর পরোক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আর্থসামাজিক উন্নয়ন, দুর্নীতি ও দারিদ্র্য হ্রাস এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পাশাপাশি দলের মধ্যকার মার্কিনপন্থী বনাম সোভিয়েতপন্থী নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করতে হয়। অস্বাভাবিক দুর্নীতি, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা, স্বজনপ্রীতি বন্ধে শেখ মুজিব যখন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হন এবং সোভিয়েত আদলে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে একদলীয় ও কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থার সূচনা করেন, তা দেশকে এক গভীর রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দেয়। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে অন্য যে বিষয়গুলো শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা হলো দেশি-বিদেশি চক্রান্ত।

মজার বিষয় হলো, যদিও লেখক ঘুরেফিরে মুজিব হত্যায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অনুসন্ধানে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছেন, আলোচ্য বইটিতে তিনি স্বতন্ত্রভাবে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে মার্কিন সরকার কিংবা এর গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএ-এর সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়। অবমুক্ত করা মার্কিন দলিলে যদিও প্রমাণ মেলে যে মুজিব হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে ফারুক ও রশিদ ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে একাধিক বৈঠক করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র ক্রয়, তথাপি অবমুক্ত দলিলে এর বেশি কিছু নেই অথবা লেখক খুঁজে পাননি যাতে মুজিব হত্যায় মার্কিন সরকারের ষড়যন্ত্র কিংবা ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণের পক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণাদি পাওয়া যায়। এ রকম অকাট্য প্রমাণাদির অনুপস্থিতিতে যে বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে, তা হলো মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলেজর লেখা ও বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি। লিফশুলত্জ ছাড়া অন্য যেসব লেখক ও গবেষকের বিশ্লেষণকে অবলম্বন করে মিজানুর রহমান খান মুজিব হত্যায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত প্রদান করেন, তাদের মধ্যে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস, মতিউর রহমান ও ক্রিস্টোফার হিচেন্সের নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আর যে প্রখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিকের নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি হচ্ছেন সৈইমুর হার্শ, যাঁর লেখায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মার্কিন প্রভাব বিস্তারে সিআইএ-এর গোপন কার্যকলাপের প্রমাণ ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।

মুজিব হত্যায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতা ও সম্পৃক্ততার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু মুজিব হত্যাকে কি গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলা যাবে? দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি মুজিবের প্রাণনাশের হুমকিসম্পর্কিত কোনো আগাম সতর্কতা জারি করেছিল? কিংবা সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়ে কোনো পূর্বাভাস কি ছিল? থাকলে মুজিব আত্মরক্ষায় এবং তাঁর শাসনব্যবস্থা রক্ষায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কি? গোয়েন্দা ব্যর্থতাসম্পর্কিত এই প্রশ্নসমূহের উত্তরে মিজানুর রহমানের বিশ্লেষণ খুবই পরিষ্কার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের প্রধান বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (RAW) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রামেশ্বর নাথ কাওয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক উল্লেখ করেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে শেখ মুজিবকে তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত অন্তত দুবার—প্রথমে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে এবং পরে ১৯৭৫ সালের মার্চে—সরকারবিরোধী সামরিক অভ্যুত্থানের বিষয়ে আগাম সতর্ক করে দেয়।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পূর্ব সতর্কতামূলক (early warning) প্রতিবেদন ছাড়াও শেখ মুজিবের পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দিন দাবি করেন যে সুইডেনে প্রকাশিত এক রিপোর্টের আলোকে তিনি শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর মধ্যকার ব্যাপক অসন্তোষ ও সম্ভাব্য ক্যু-এর বিষয়ে অবহিত করেন। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ এক সাক্ষাত্কারে দাবি করেন যে কর্নেল ফারুক রহমানের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর ট্যাংক রেজিমেন্ট যে একটি সম্ভাব্য শোডাউন বা শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করতে পারে, সে ব্যাপারে তিনি মুজিবকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এমনকি তত্কালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহও রাষ্ট্রপতি মুজিবকে সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। মিজানুর রহমানের লেখায় এ বিষয়টি স্পষ্ট যে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়, চোরাচালান দমনে ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জনে মুজিব ব্যর্থ হয়েছেন। তদুপরি রক্ষীবাহিনী নামে ভারতের সহায়তায় একটি নতুন প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন এবং সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন উপেক্ষা করে রক্ষীবাহিনীর সম্প্রসারণের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল।

সেনাবাহিনীর মধ্যকার চরম অসন্তোষ এবং অভ্যুত্থানচেষ্টার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও মুজিব কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি? কেন তাঁর জীবননাশের এবং তাঁর সরকারবিরোধী হুমকিসম্পর্কিত আগাম সতর্কতার রিপোর্টগুলোকে মুজিব অগ্রাহ্য করেছিলেন? আলোচ্য গ্রন্থে লেখক এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর প্রদান করেননি। বরং এখানে মুজিবকে একজন উদার মনের মানুষ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, যিনি কখনোই চিন্তা করতে পারেননি যে তাঁর দেশের জনগণ তাঁকে হত্যা করতে পারে।

মুজিব হত্যায় সিআইএ-এর সম্পৃক্ততার বিষয়টি আলোচ্য গ্রন্থের প্রধান অনুসন্ধানী লক্ষ্য হলেও লেখক মুজিব হত্যাপরবর্তী ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াকে সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন। অবমুক্ত করা কূটনৈতিক যোগাযোগ থেকে জানা যায় যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্যু-এর পর ভারত তার সীমান্তরক্ষীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেয় এবং মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে যেন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কোনো অত্যাচার বা নিপীড়ন না হয়, সে বিষয়ে সজাগ ছিল। অন্যদিকে, মুজিব হত্যায় পাকিস্তান তার সন্তুষ্টি গোপন রাখতে পারেনি এবং শিগগিরই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং বাংলাদেশ যেন একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সে আশা পোষণ করে।

আলোচ্য গ্রন্থের যে বিষয়টি ধাঁধার মতো মনে হয় তা হলো, এতে মুজিব হত্যায় বহিঃরাষ্ট্রের ব্যক্তিরা ও সংস্থার সম্পৃক্ততার বিষয়টি যতটা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তির ও সংস্থার সম্ভাব্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ততটাই উপেক্ষিত হয়েছে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের মধ্যে মুজিব হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে মেজর ফারুক রহমান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মেজর আবদুর রশিদের কথা উল্লেখ আছে খুব সামান্যই। অবমুক্ত করা মার্কিন দলিলের আলোকে যদিও দেখা যায় যে ফারুক ও রশিদ শেখ মুজিবকে হত্যার আগে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে কমপক্ষে দুবার অনির্ধারিত বৈঠক করেছেন, যে বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে গেছে তা হলো সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেনাপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব কি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে জুনিয়র সামরিক অফিসারদের এসব অনির্ধারিত বৈঠক সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? যদি ফারুক-রশিদের এসব সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত থাকতেন মুজিব, তাহলে কী প্রতিক্রিয়া দেখাতেন?

সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান হয় যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছিল। মুজিব হত্যায় সেনাসদস্যের অংশগ্রহণ সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারি রক্ষার ক্ষেত্রে একটি হুমকি হিসেবেই বিবেচিত হবে। যদিও মুজিব হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বেশ কয়েকটি ক্যু এবং পাল্টা ক্যু সংঘটিত হয়, আলোচ্য গ্রন্থের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো এই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়া। এ ছাড়া মুজিবের নিরাপত্তা রক্ষায় সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর এবং অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তার ভূমিকার বিষয়টি ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত এই গ্রন্থে। যদিও তত্কালীন উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুজিব হত্যা-পরবর্তী রাজনীতির প্রধান ‘সুবিধা গ্রহণকারী’ (beneficiary) হিসেবে উল্লেখ করা হয় আলোচনা গ্রন্থে। এ প্রসঙ্গে কোনো ব্যাখ্যা নেই যে জিয়া কি মুজিববিরোধী ক্যুকে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছেন, না পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছেন? মুজিব হত্যায় সশস্ত্র বাহিনীর তত্কালীন হাইকমান্ডের ভূমিকা নিয়ে যে তথ্যশূন্যতা আলোচ্য গ্রন্থে ফুটে উঠেছে, তা কি অবমুক্ত করা দলিলে প্রাপ্ত তথ্যের অভাবে হয়েছে, নাকি লেখক এ বিষয়ে কোনো বিতর্কে জড়াতে চান না বলে তা আলোচনা করেননি?

শেষ কথা

কিছু তথ্যশূন্যতা ও তথ্য পুনরাবৃত্তির মতো ছোটখাটো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের জন্য মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড একটি মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। আলোচ্য গ্রন্থের ছোট অধ্যায়, ঘটনাপ্রবাহের সুলিখিত বিবরণ ও বিশ্লেষণ স্বাধীন বাংলাদেশের এক তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত ঘটনা তথা মুজিব হত্যা ও ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে অনেক আগ্রহ উদ্রেক করবে। এ ছাড়া এই বইয়ে যে ছয়টি পরিশিষ্ট আছে, তা গবেষকদের জন্য এক স্বর্ণখনি বলে বিবেচিত হবে। পরিশিষ্ট অংশে মুজিব হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর ফারুক রহমান, সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলত্জ এবং সাবেক মার্কিন কূটনীতিবিদ ইউজিন বোস্টার ও সিডনি সোবারের সঙ্গে যেসব সাক্ষাত্কারে উদ্ধৃতাংশ ছাপা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে মুজিব হত্যাকাণ্ডের পারিপার্শ্বিক অবস্থার অনুধাবন ও বিশ্লেষণে সহায়ক হবে। পরিশেষে বলা যায়, মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড ইতিহাসবিদদের অবশ্যই উত্সাহিত করবে, যাতে তাঁরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থান এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশি-বিদেশি কুশীলবদের ভূমিকা নিয়ে তথ্যানুগ অনুসন্ধানে আগ্রহী হন।