আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের দুই দশক: একটি মূল্যায়ন

সারসংক্ষেপ

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের একটি মূল্যায়ন, তার পটভূমি, সিদ্ধান্ত প্রণয়ন-প্রক্রিয়া, যৌক্তিকতা, প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনার একটি নির্মোহ আলোচনা এ প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিগত দুই দশক ধরে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও সেনা প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া বিষয়ে সঠিক নীতি-সিদ্ধান্তের ওপর এ খাতের উন্নয়ন নির্ভরশীল। বাংলাদেশের জন্য শান্তিরক্ষা মিশনটি একই সঙ্গে রাজনৈতিক, নিরাপত্তাসম্পর্কিত, অর্থনৈতিক এবং সামরিক বাহিনীর মাননির্ধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক যৌক্তিকতার সঙ্গে জড়িত। শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা প্রেরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য দেশীয় ও বৈশ্বিক কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা বিশ্লেষণের পাশাপাশি ভবিষ্যত্ সম্ভাবনার দিকটি আলোকপাত করা হয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা ও পুলিশ, সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি

প্রারম্ভিক কথা

বাংলাদেশ গত দুই দশকের অধিক সময়কাল ধরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছে। এর মাধ্যমে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। এটি এ দেশের আগের যে নেতিবাচক রূপ, যা বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে প্রভাবিত, তা অনেকখানি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে জাতিসংঘের সর্ববৃহত্ সেনা প্রদায়ক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের জন্য গর্বের বিষয়। কীভাবে বাংলাদেশ এ রকম একটি নেতৃস্থানীয় অবস্থান অধিকারে সমর্থ হলো, তা আরও গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের কারণসমূহ কী? জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ধরনে যে আবশ্যিক পরিবর্তন সামনের সময়ে দৃশ্যমান, এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী ধরনের হতে পারে তা বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন। এই প্রবন্ধ বহুমুখী এই চ্যালেঞ্জসমূহ আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিতে এই অংশগ্রহণের ভবিষ্যত্ তাত্পর্য বিস্তারিত বিশ্লেষণের একটি প্রয়াস রেখেছে।

স্বাধীনতার ১৭ বছরের মধ্যে ১৯৮৮ সালে ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। তার পরের বছর, ১৯৮৯ সালে, ২৫ জন সেনা ও ৩৪ জন পুলিশ পর্যবেক্ষক ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশন্স অ্যাসিস্ট্যান্স গ্রুপ ইন নামিবিয়া মিশনে প্রেরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার দীর্ঘমেয়াদি অংশগ্রহণের সংকল্প ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া ১৯৯০-৯১ সালে প্রথম আরব উপসাগরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনীতে বাংলাদেশের ২১৯৩ জন সেনা সদস্য অংশগ্রহণ করে। সেটিই ছিল জাতিসংঘের বাইরে কোনো একক দেশের নেতৃত্বে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের প্রথম অংশগ্রহণ। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কম্বোডিয়া মিশনে প্রথমবারের মতো এক ব্যাটালিয়ন সেনা প্রেরণ করে। বাংলাদেশি সেনাদের পেশাদারি দক্ষতা, আন্তরিকতা ও পক্ষপাতশূন্যতা অল্পদিনের মধ্যেই এ দেশকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ মিশনে আরও বেশি মাত্রায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়।

জাতিসংঘ মিশনে প্রথম দশক

১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি মিশনে অংশ নেয়। কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, মোজাম্বিক, সোমালিয়া, হাইতি, অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন, কঙ্গো, পূর্ব তিমুর ও সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় পরিচালিত মিশনগুলো এর মধ্যে উল্লেখ্য। ১৯৯০-২০০০ স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী প্রথম দশকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মিশনে অংশ নেয়। এগুলো হলো রুয়ান্ডা (অক্টোবর ১৯৯৩-ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪), মোজাম্বিক (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩-ডিসেম্বর ১৯৯৪) এবং সোমালিয়া (জুলাই ১৯৯৩-ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫)।১ সোমালিয়া মিশনে বাংলাদেশের ১,৯৬৭ জন সেনা সদস্য অংশ নেন এবং তাঁরা সেখানে কৃতিত্বের সঙ্গে স্থানীয়দের সব সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একধরনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হন।২ সোমালিয়া মিশনে বাংলাদেশকে কোনো বড় ধরনের কৌশলগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু রুয়ান্ডা মিশনে বাংলাদেশি সেনাদের কিছু কার্যক্রম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু সমালোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ মিশনে কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত জেনারেল ডালায়ার বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের সেনাদের বিরুদ্ধে তাঁর আদেশ অমান্য করার গুরুতর অভিযোগ আনেন। জেনারেল ডালায়ার বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর ও নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে জানান যে বাংলাদেশি সেনারা অবিরতভাবে রুয়ান্ডার সাধারণ জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁর আদেশকে অবজ্ঞা করে এসেছে।৩ এই প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে একটি সাময়িক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। বিষয়টি জাতিসংঘ মিশনে বহুজাতিক সেনা দলগুলোতে চেইন অব কমান্ড নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তার অবতারণা ঘটিয়েছিল।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সিয়েরা লিওনে অবস্থিত জাতিসংঘ মিশনে (ইউএনএএমএসআইএল) অংশ নেয়। সিয়েরা লিওনের ভয়ানক পরিস্থিতিতে যখন অনেক রাষ্ট্র মিশন পরিত্যাগ করে দায়িত্বে চরম অবহেলার পরিচয় দেয়, বাংলাদেশ তখন সেখানে অল্প সময়ের নোটিশে এক ব্রিগেড সেনা দক্ষতার সঙ্গে মোতায়েন করে। বাংলাদেশি সেনা ব্রিগেড অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে গেরিলা-নিয়ন্ত্রিত জায়গাগুলো পুনরুদ্ধারে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।৪ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের এই ভূমিকায় মুগ্ধ সিয়েরা লিওন সরকার বাংলাকে সে দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০০৩ সালে এক সরকারি সফরে সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে আসেন এবং তাঁর দেশের শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশিদের ভূমিকা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।৫ এভাবে জাতিসংঘ মিশনের প্রথম দশকটিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের গতিধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এটি চড়াই-উতরাইয়ে পরিপূর্ণ ছিল। তবে নিঃসন্দেহে প্রথম দশকের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে এর পরবর্তী দশকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে আরও সমৃদ্ধ করেছিল।

সক্রিয় সশস্ত্র বাহিনী

হেলিকপ্টার

প্রতিরক্ষা বাজেট

 

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী

 

জাতিসংঘে অবদান (বিস্তারিত)

 

অন্যান্য মিশনে অবদান

 
১,৫৭,০৫৩

সর্বমোট-২৩ মাল্টিরোল ১৪

 

২০০৯-১০৳ ১.২১ বি.

 

৮৮৪৩

(নারী ২২৪)

 

MINUSTAH ৩১৯

 

নেই

বিশ্ব র্যাংকিং (আকার) ৩৪

এমএসই-১৭ এইচআইপি ১২

 

২০১০-১১৳ ১.৪৮ বি. (১.৫% জিডিপি)

[৩০ এপ্রিল ২০১৩ পর্যন্ত] সশস্ত্র ৭৮%

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী

 
 

UNMIL-১৪০৮

 
সেনা-১,২৬,১৫৩ নৌ-১৬,৯০০ বিমান-১৪,০০০

এমআই-১৭ ওয়ান ডি (VIP) ২

 ২০১১-১২৳ ১.৬ বি.(জিডিপির ১.৫%)

 

 

পুলিশ ২১% বিশেষজ্ঞ পরিদর্শক ১% র্যাংকিং-১ম

  

প্যারামিলিটারি ৬৩৯০০

ট্রান্সপোর্ট-৯ এমআই-১৭১ এসএইচ ৩ লাইট রেঞ্জ-৬

২ বেল ২০৬-এল (লংরেঞ্জ) ৪ বেল ২১২

 

 

   
      

সশস্ত্র খাতে ব্যয়/সেন্যসংখ্যা- ইউএস ডলার ৯৫০০ (বৈশ্বিক গড় ব্যয় ইউএস ডলার ৬৮,০০০)

শান্তিরক্ষা মিশনে দ্বিতীয় দশক

বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অন্যতম অগ্রগামী সেনা প্রেরক দেশ হিসেবে ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর জাতিসংঘ শান্তি মিশনের দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশের অবদান সেনা ও পুলিশ প্রদায়ক রাষ্ট্র হিসেবে সমগ্র অংশের আনুমানিক ১০ শতাংশ। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মিশনগুলোতে কর্মরত এবং এর মধ্যে আইভরি কোস্ট ও লাইবেরিয়ায় সর্বাধিকসংখ্যক বাংলাদেশি সেনা কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৮ সালে প্রথম সেনা প্রেরণের সময় থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বমোট ৪০টি দেশের ৫২টি মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬,৯২১ জন সেনা সদস্য ও সেনাবিশেষজ্ঞ এবং পুলিশ বাহিনীর ১,৮৫১ জন সদস্য জাতিসংঘ পরিচালিত বিভিন্ন শান্তি মিশনে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।৯ ২০০০ সাল-পরবর্তী সময়ে অর্থাত্ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের দ্বিতীয় প্রজন্মের এক দশকে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ২৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ৯৩ শতাংশ এবং পুলিশ বাহিনী ৭ শতাংশ অবদান রেখেছে। এই সময়কালে মিশনগুলোতে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ১১০ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন।

টেবিল-১ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ (৪০টি দেশে ৫২টি মিশন)১০

  বিবরণ                সেনা            নৌ          বিমান            পুলিশ            মোট

মিশন সম্পন্নকারী          ৯৪,৭৬৮       ২,০৩৯      ৩,২০৭            ৭,৪১৫          ১,০৭,৪২৯

সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা

মিশনে মৃত্যুবরণকারী             ৯১            ১            ৪            ১৪            ১১০

সদস্য১৩

১৯৮৯ সালে নামিবিয়ায় পরিচালিত ইউএন ট্রানজিশন অ্যাসিস্ট্যান্স গ্রুপে (ইউএনটিএজি) সদস্য প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ জাতিসংঘ মিশনে তার যাত্রা শুরু করে। আজ অবধি সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ অধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতিসংঘের প্রায় সব মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের দশকে মিশনগুলোতে পুলিশের অংশগ্রহণ বেড়েছে ৯৬৮ শতাংশ, ২০১১-এ যা ২০০০ সংখ্যা অতিক্রম করে। বাংলাদেশ পুলিশ আইভরি কোস্ট, সুদান, দক্ষিণ সুদান, পূর্ব তিমুর, ডিআর কঙ্গো, হাইতি ইত্যাদি দেশে পরিচালিত মিশনগুলোতে বিশেষজ্ঞ ও ফর্মড পুলিশ ইউনিট (এফপিইউ) উভয় ক্যাটাগরিতে সদস্য প্রেরণ করেছে। বাংলাদেশ এখন অবধি সর্বাধিক বেশি সংখ্যায় নারী পুলিশ সদস্য প্রেরণে সক্ষম হয়েছে১২ এবং তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে মিশনগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন।

২০১০ সালের মে মাসে হাইতিতে বাংলাদেশ থেকে একটি মহিলা ফর্মড পুলিশ ইউনিট (এফপিইউ) প্রেরণ করা হয়। যেকোনো মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীর দেশ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ প্রথম এবং এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এর আগে শুধু ভারত থেকে ২০০৭ সালে এ রকম একটি মহিলা ফর্মড পুলিশ ইউনিট লাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। বাংলাদেশের নারী পুলিশ সদস্যরা হাইতিতে ভূমিকম্প-পরবর্তী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন। এ ছাড়া এই শান্তিরক্ষীর দলটি হাইতিতে প্রাথমিক শিক্ষা প্রচারণা, স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো উন্নয়ন এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এর ফলে এই দলটিকে ২০১২ সালে ইউনাইটেড নেশনস মেডেল প্রদান করার মাধ্যমে MINUSTAH-এ তাদের অবদানকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়।১৩

২০১১ সালের মে মাসে একটি নেভি ফ্রিগেট ও একটি বহিঃসমুদ্র পেট্রল নৌযানের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম দলটি জাতিসংঘ পরিচালিত ইন্টেরিম ফোর্সেস ইন লেবানন (ইউএনএফআইএল) মিশনে অংশগ্রহণ করে। এভাবে বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়।

মিশনে সেনা প্রেরণের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়া

২০০৭ সালে জাতিসংঘ স্ট্যান্ডবাই অ্যারেঞ্জমেন্ট সিস্টেমের (ইউএনএসএএস) আওতায় একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে বর্তমান কাঠামোয় সেনা ও পুলিশ সদস্য প্রেরণ করা শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকার অথবা এর বাহিনীসমূহের, অর্থাত্ সশস্ত্র বা পুলিশ—নির্দিষ্টভাবে লিখিত সেনা প্রেরণ নীতিমালা নেই। মূলত নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত অনুরোধের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রেরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেনা সদর দপ্তর, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ (এএফডি), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পুলিশ মূল কর্মকের ভূমিকা নিয়ে থাকে। বাস্তবে দেখা যায়, সেনা প্রেরণের সিদ্ধান্তসমূহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এবং এ বিষয়ে জনপ্রশাসন থেকে প্রকাশ্য কোনো বিরোধের সূত্রপাত হতে দেখা যায়নি।

প্রথমত, জাতিসংঘ থেকে নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সেনা প্রেরণের অনুরোধ জানানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন অনুরোধটি পাওয়ার পর বাংলাদেশের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতির এবং দেশটির অন্যান্য আন্তর্জাতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের আলোকে এর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করে থাকে। স্থায়ী মিশনের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা (ডিফেন্স অ্যাটাশে) মূলত এই অনুরোধপত্র নিয়ে যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পাদন করেন এবং তা বাংলাদেশে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করেন। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণকারী অধিদপ্তর হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ (এএফডি) সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য প্রেরণসংক্রান্ত যেকোনো ধরনের বিষয়াদি নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। ঢাকায় অবস্থিত সেনা সদর দপ্তরের ওভারসিজ অপারেশন ডিরেক্টরেট এ বিষয়টির যাবতীয় বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।১৪ একইভাবে নৌ ও বিমানবাহিনীর জন্য নির্ধারিত অনুরোধসমূহ নিজ নিজ সদর দপ্তরে এএফডি থেকে প্রেরণ করা হয় এবং তারা তখন তাদের বাহিনী-সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। মূলত এএফডি এবং ওভারসিজ অপারেশন ডিরেক্টরেট এই পুরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ার মধ্যে সেনাসদস্য নির্ধারণ, তাঁদের প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম এবং যাবতীয় লজিস্টিকস-সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

পুলিশ সদস্য প্রেরণসংক্রান্ত যেকোনো অনুরোধ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন থেকে সরাসরি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়ে থাকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রাথমিক তদারকির পর এটি ঢাকায় অবস্থিত পুলিশ হেডকোয়ার্টারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করে থাকে। এভাবে একটি কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সদস্য প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হয়ে থাকে।

জাতিসংঘ শান্তি মিশনগুলোতে সেনা প্রেরণসংক্রান্ত প্রায়োগিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের বিষয়াদি ছাড়াও বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শান্তিরক্ষা মিশন সংক্রান্ত সব সভায় বাংলাদেশি কূটনীতিকদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ জাতিসংঘের পিস বিল্ডিং কমিশনের সভাপতির গুরুদায়িত্ব পালন করেছে এবং এ দায়িত্বের অংশ হিসেবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি, Review of Peace Building Architecture 2010 এবং Review of International Civilian Capacity 2010 প্রণয়নে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের মতো তাত্পর্যপূর্ণ বিষয়গুলোকে এই নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে লেখকদ্বয়ের আলোচনায় বাংলাদেশের আরও কিছু কূটনৈতিক সাফল্য সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। বাংলাদেশ ২০০১-০২ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিভিন্ন সাংগঠনিক এবং বাজেট সভাগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার মাধ্যমে একজন শান্তিরক্ষীর মাসিক বেতন এক হাজার ২৮ ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হয়।১৫ জি-৭৭সহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন-সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে অবদান রাখার অনুপ্রেরণা জোগায়।

বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত সেনা ও পুলিশ সাধারণত দুই ধরনের কাজে নিযুক্ত হয়ে থাকে—বর্তমানে চলছে এ রকম কোনো মিশনে পর্যায়ক্রমিক পদায়ন এবং একেবারে নতুন শুরু হওয়া মিশনে প্রথমবারের মতো পদায়ন। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিবিড় প্রশিক্ষণ এবং মিশন সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ভবিষ্যতে মিশনে সব সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী সেনা ও পুলিশ সদস্যকে মিশনের প্রাথমিক অগ্রগামী দলের উপদেশ অনুসারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই মিশন সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ মিশনের বিশেষ চাহিদার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। যেকোনো বিদ্যমান মিশনে পর্যায়ক্রমিক পদায়ন অপেক্ষা নতুন জায়গায় সেনা প্রেরণ সব সময় চ্যালেঞ্জিং এবং এ উপলক্ষে প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রস্তুতি সময়সাপেক্ষ ও কঠিন একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে কৃতিত্বের সঙ্গে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (বিপসট) ভবিষ্যত্ শান্তিরক্ষীদের এ-সংক্রান্ত বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেসের পরিচালনায় পিস কিপিং অপারেশনস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিকেওটিসি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। ২০০২ সালে নতুন সামর্থ্য ও সম্পদ নিয়ে এই স্টেট অব দ্য আর্ট প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান নামে যাত্রা শুরু করে। বিপসট নিয়মিতভাবে শান্তিরক্ষী প্রদান-পূর্ববর্তী প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া মিলিটারি অবজারভারদের জন্য রয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ। বিপসট বিভিন্ন ধরনের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, যাতে বর্তমান সময়ের শান্তিরক্ষা মিশনের চাহিদার প্রতিফলন রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বমানের এই ট্রেনিং ইনস্টিটিউট পাঁচ সহস্রাধিক শান্তিরক্ষীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যাতে ২৫টি দেশের নয় শতাধিক বিদেশি প্রশিক্ষণার্থীও রয়েছেন।১৬

পুলিশ সদস্যরাও বিপসটে বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। তবে সারদায় অবস্থিত পুলিশ ট্রেনিং একাডেমিতে দুই সপ্তাহব্যাপী প্রবেশিকা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা শান্তিরক্ষা মিশনে তাঁদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। বহুমুখী এই প্রশিক্ষণে পুলিশ সদস্যদের মিশন দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, শান্তিরক্ষা-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কৌশল—যেমন মধ্যস্থতা ও আলোচনা, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন ও জনমানুষের নিরাপত্তা প্রদানসংক্রান্ত নানা বিষয়ে সম্যক জ্ঞান প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশ সম্ভাব্য শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণ প্রদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পুলিশ একটি পরিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। এই লক্ষ্যে পুলিশ অদূর ভবিষ্যতে একটি স্টেট অব দ্য আর্ট প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ করতে আগ্রহী।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ উভয় বাহিনীর সদস্যকে আরও বেশি উপযুক্ত করে তুলতে বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্র ও তাদের দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডি এবং যুক্তরাজ্যের ইউকেএআইডি (ডিএফআইডি) শান্তিরক্ষীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। যদিও সিভিল সোসাইটির সদস্যদের এবং এ ধরনের সংস্থাগুলোর অনুপস্থিতি এই প্রক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সিভিল সোসাইটির অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনযোগ্য।

শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা/পুলিশ প্রেরণের যৌক্তিকতা

বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক ইতিহাস এবং এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে নিয়ত চ্যালেঞ্জসমূহ পর্যালোচনা করলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া সম্ভব। আপাতত সাধারণ পর্যালোচনায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের একটি ত্রিমুখী কারণ আলোচনা করা যেতে পারে। এগুলো হলো নিম্নরূপ:

ক. জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছে এবং একই সঙ্গে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পেরেছে।

খ. বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর জন্য এ রকম একটি বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করার সুযোগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এ ধরনের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামরিক খাতে বৈশ্বিক অগ্রগতির কারণে সংগঠিত সব নীতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রত্যক্ষ অংশীদার হতে পারছে। এতে বাহিনীগুলোর পেশাগত দক্ষতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

গ. বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক প্রণোদনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত অর্থসম্পদ এ দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ভবিষ্যত্ সম্ভাবনা বিবেচনায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর জন্য নতুন সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই চলমান প্রক্রিয়া বাহিনীসমূহের আধুনিকায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। এটি হলো বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রসূত হুমকি বা প্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। বাংলাদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মূলত অভ্যন্তরীণ হুমকিগুলো মুখ্য এবং এগুলো জাতিসংঘে সেনা প্রেরণের ক্ষেত্রে কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। তবে বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় জাতিসংঘ মিশনগুলোতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে চলায় এক প্রকার কেন্দ্রাতিগ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যৌক্তিকতার অবতারণা ঘটেছে। এই যৌক্তিক বাস্তবতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংঘটিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধারাবাহিক ঘটনাবলির সংমিশ্রণে উত্পন্ন এবং তা বর্তমানে জাতিসংঘে সেনা প্রেরণের ক্ষেত্রে বহির্মুখী বলপ্রয়োগে সচেষ্ট।

রাজনৈতিকভাবে গত দুই দশকের অধিককাল ধরে গণতান্ত্রিক শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় সেনাবাহিনী তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে অধিক মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ে একটি পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ এবং কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তা ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নতি মিশন সম্পর্কে সশস্ত্র/পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এভাবে অর্থনৈতিক ও পেশাগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাহিনীসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের অপার সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সুতরাং বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর ধরন ও প্রকৃতি নব্বইয়ের দশকের পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন। এখানে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের পরিবর্তে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা সশস্ত্র বাহিনীর প্রকৃতি ও ধরনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে।

নিম্নরূপ আলোচনায় আরও বিশদভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা আলোচনা করা হয়েছে।

রাজনীতিক এবং নিরাপত্তা যুক্তিসমূহ

বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক ইতিহাস জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণের পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে যে সেনাবাহিনীর জন্ম হয় তা স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন ছিল। এই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সেনাবাহিনী ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০—এই দীর্ঘ ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে রাখে এবং ১৯৯০ সালে গিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্রের পুনঃ আবির্ভাবের অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়েছে। সত্যি বলতে, আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনী একটি শক্তিশালী নিয়ামক। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহ সশস্ত্র বাহিনীর শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে এই ধরনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ফলে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হবে, যা বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুসংগঠিত করতে সহায়তা করবে। উপরন্তু, বৃহত্ শক্তিসমূহ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সহায়তায় শান্তি মিশনসমূহে অংশগ্রহণের ফলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরামগুলোতে বাংলাদেশের পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।

অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা

বাংলাদেশ একটি নিম্ন আয়ের উন্নয়নশীল দেশ, যার স্থূল জাতীয় মাথাপিছু আয় ৭০০ মার্কিন ডলার (২০০৭ থেকে ২০১১-এর মধ্যে)।১৭ গত দুই দশকে যথেষ্ট অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও দেশটি উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদের ফলে এখনো কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক সুযোগ সন্ধান করার ব্যাপারে তত্পর এবং স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের বেতন-ভাতা এবং ক্ষতিপূরণের হার বাংলাদেশি সেনা এবং পুলিশদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই শান্তিরক্ষীদের দ্বারা অর্জিত আর্থিক সুবিধা দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারি সূত্র মতে, ২০০১-১০ সময়ে বাংলাদেশ সেনা মোতায়েন, কন্টিনজেন্টের মালিকানাধীন সরঞ্জাম এবং অন্যান্য খাত বরাবর জাতিসংঘ থেকে ১.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে।১৮ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণের ফলে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় এবং ব্যবহার, সেনাসদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে, যা স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের প্রদান করা সম্ভব হতো না। শান্তিরক্ষা মিশনসমূহ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পরোক্ষ আর্থিক সুবিধাও তৈরি করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য কৃষি ও ওষুধ খাতগুলোতে নতুন বাজার সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কৃষিজমি লিজ নিয়ে খামার স্থাপন করা, যা বাংলাদেশ এবং হোস্ট দেশ উভয়ের খাদ্যচাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

মাননির্ধারক যৌক্তিকতা

বাংলাদেশ সব সময় আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণসহ জাতিসংঘের নীতির প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে এসেছে। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী প্রদান করে বাংলাদেশ বিদেশে দেশের ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করার জন্য শান্তিরক্ষীদের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।১৯ একই সুরে কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন।২০ লন্ডন থেকে প্রকাশিত স্বনামধন্য সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট ২০০৭ সালে এই প্রসঙ্গে বলে, শান্তিরক্ষীদের নীল হেলমেট পরিধান করে বাংলাদেশিরা বিশ্বের কাছে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনীতি এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বাইরেও যে বাংলাদেশের একটি পরিচিতি আছে তা তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছে।২১

প্রাতিষ্ঠানিক যৌক্তিকতা

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামরিক বাহিনী বড় ভূমিকা পালন করে এবং এই সহযোগিতা দেওয়ার পেছনে সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি সেনারা বিদেশি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পান এবং নিজেদের পেশাদারি দক্ষতার উন্নয়ন করার সুযোগ পান। দ্বিতীয়ত, শান্তিরক্ষার ফলে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সরঞ্জাম এবং অস্ত্র প্ল্যাটফর্ম ক্রয় করা সম্ভব হয়েছে, যা অন্যথায় বাংলাদেশের ক্রয়ের নাগালের বাইরে থাকত। তৃতীয়ত, শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সেনাসদস্যরা কর্মসূত্রে বিদেশি সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পান। এর ফলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ভাষাগত উন্নতি, সামরিক পেশাদারি দক্ষতা এবং আন্তব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষে প্রশিক্ষিত শান্তিরক্ষীদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং (বিপসট) স্থাপন করেছে।২২ এই মর্যাদাপূর্ণ ইনস্টিটিউটে বিদেশি ও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বিপসট প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এই রকম মর্যাদাপূর্ণ ও বিশ্বমানের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলে সেনাবাহিনীর পেশাদারি ভাবমূর্তি বিশ্বে বৃদ্ধি পেয়েছে।

মিশনে সেনা প্রেরণের ‘সম্ভাব্য’ বাধাসমূহ

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অস্থিতিশীলতা এ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রায়ণের পথে নিঃসন্দেহে একটি বাধা, কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ কোনো বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়নি। জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতির বহু বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও দুটি বৃহত্ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণে এক ধরনের নিরঙ্কুশ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এমনকি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী বাম দলগুলো যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রাসন ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে তাদের ‘নব্য সাম্রাজ্যবাদী’ আচরণের বড় সমালোচক, সেখানে জাতিসংঘের মিশনগুলোতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে তাদের কখনো সমালোচনামুখর হতে দেখা যায়নি।

তবে জাতিসংঘে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের যে বিষয়টি লক্ষ রাখতে হয় তা হলো, এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর সমর্থন না থাকে বা তাদের অনুভূতিতে আঘাত হানে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ২০০৩-এর ইরাক দখল-পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট থাকা সত্ত্বেও ইরাক শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেনি। এ সিদ্ধান্তের পেছনে জনমত একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী মহল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন এবং এতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে গভীর চিন্তালব্ধ জ্ঞানপ্রসূত রচনা ও প্রকাশনায় কখনোই মনোনিবেশ করেনি। এখনো পর্যন্ত সীমিত সংখ্যক নিবন্ধ আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, যা এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছে এবং রাজনীতিতে এই মিশনের প্রভাব ও সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কে এর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে।২৩তবে জাতীয় পর্যায়ে কিছু জার্নালে এবং পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা প্রকাশ করা হয়েছে, যেগুলো পুরো বাস্তবতাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি। এই ক্ষেত্রে জ্ঞান বিস্তারের অপ্রতুলতা ভবিষ্যতে সঠিক ও সময়োপযোগী অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে।

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হওয়ায় জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এই বাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য এখনো পর্যন্ত কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। রাজনীতিবিদেরাও মনে করেন এই মিশনসমূহে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর যে সুখ্যাতি তৈরি হয়েছে তা তাদের ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা বা রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণের দুরভিসন্ধি থেকে দূরে রাখবে।

চ্যালেঞ্জ এবং ইস্যুসমূহ

অভ্যন্তরীণ ইস্যুসমূহ: বাংলাদেশের সামরিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহ প্রচণ্ড রকম প্রভাব রেখেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং ডিসকোর্সে আজ শান্তিভিত্তিক মডিউল এবং যুদ্ধোত্তর রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির বিষয়সমূহ স্থান করে নিয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে এই বিষয়গুলো সাধারণ ‘জাতীয়’ নিরাপত্তা এবং যুদ্ধের প্রস্তুতির ধারণা থেকে ‘মানব নিরাপত্তা’ ধারণার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। এই বিষয়সমূহ স্বাভাবিকভাবে সেনাবাহিনীর প্রচলিত ধ্যান-ধারণা এবং কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।২৪ ফলে অনেকে আজ মনে করেন পঁচিশ বছর একটানা শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণের পর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ঐতিহ্যগত জাতীয় প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ও শান্তিরক্ষা—এই দুই ভূমিকার মধ্যে একটি ভারসাম্য আনা প্রয়োজন।২৫দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাধারণ যুদ্ধকালীন দায়িত্বের ওপর শান্তিরক্ষা মিশনসমূহের প্রভাব কেমন তা নিয়ে এখন পর্যন্ত অতি সামান্য কিংবা একেবারেই কোনো চিন্তাভাবনা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

শান্তিরক্ষার বিষয়টি প্রতিরক্ষা বাজেট তৈরি এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়-প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের একটি অস্ত্র ক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে বৃহদাকার এমআই-১৭ হেলিকপ্টার, যুদ্ধ প্রশিক্ষক বিমান, পন্টুন সেতু, ব্যক্তিগত সাঁজোয়া বাহক এবং ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয় করবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এই ক্রয়কে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে২৬ এবং আরও জানায় যে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে তার শান্তিরক্ষীদের জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবের পেছনে মূল কারণ হিসেবে বলা হয় যে বিশ্বের যেসব সংঘাতময় এলাকায় শান্তিরক্ষীরা কাজ করছেন, সেখানে বিবদমান সশস্ত্র দল কিংবা জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে তা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ব্যবহূত অস্ত্রের তুলনায় বেশি আধুনিক।

নিঃসন্দেহে এই নতুন অধিগ্রহণের কিছু জাতিসংঘ মিশনগুলোতে নিয়োজিত বাংলাদেশি কন্টিনজেন্টদের প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মসম্পাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। তথাপি এই ধরনের ক্রয় সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের জন্য উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা ক্রয়সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। এ ধরনের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে ও ভবিষ্যত্ সম্ভাবনাসমূহ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি এক সমীক্ষায় প্রতিরক্ষা ক্রয়ে দুর্নীতি হতে পারে এমন উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকেও চিহ্নিত করেছে।২৭ উপরন্তু, অস্ত্র চুক্তির জন্য আত্মপক্ষ সমর্থন হিসেবে যদিও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহকে যুক্ত করা হয়েছে, কয়েকজন বিশ্লেষক২৮ মনে করেন রুশ অস্ত্র ক্রয়ের জন্য জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা একটি বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি নয়, বরং অন্যান্য জটিল সমীকরণ এর পেছনে কাজ করছে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় দেশের অন্যান্য অগ্রাধিকারমূলক খাতে ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং তা বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর প্রতিকূল প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। সর্বশেষে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে ব্যবহারের পরে এসব দামি সরঞ্জামের ভবিষ্যত্ ব্যবহার কী তার সঠিক দিকনির্দেশনাও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ কর্তৃক নির্দেশিত হয়নি।

যদিও বাংলাদেশে একটি ব্যাপক মতৈক্য বিদ্যমান যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে অংশগ্রহণের ফলে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা হ্রাস পাবে, এই মত সর্বগ্রহণযোগ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী পরোক্ষভাবে তত্কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সরিয়ে তার পছন্দসই বিকল্প অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় স্থাপন করে। ওই সময় সেনাবাহিনী সক্রিয়ভাবে একটি অরাজনৈতিক মন্ত্রিসভা গঠনে সহায়তা প্রদান করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল সব রাজনৈতিক দলের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। এই পুরো প্রক্রিয়াতে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয় এবং সম্পূর্ণ অধ্যায়টি বাংলাদেশে বেসামরিক শাসনের ভঙ্গুর অবস্থার একটি নিদর্শন ছিল।২৯যদিও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তথাপি ২০০৭-২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা এবং প্রভাব সম্পর্কে নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। সামরিক বাহিনীর ওপর জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণও হ্রাস পাচ্ছে, যার উদাহরণস্বরূপ প্রতিরক্ষা বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নিষ্ক্রিয় ভূমিকাকে উল্লেখ করা যায়।৩০ উপরন্তু, বেসামরিক প্রশাসন এবং কার্যক্রমে সামরিক ব্যক্তিদের উপস্থিতি ১৯৭৫-৯০ সালের সামরিক স্বৈরাচারী যুগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি। এসবের ফলে বাংলাদেশে সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ঐতিহ্যগত বিভাজন ক্রমাগতভাবে এক ধরনের অস্পষ্টতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়ছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের অংশগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে এই দুই বাহিনীর অফিসার ও সদস্যরা শান্তি মিশনগুলোতে অংশগ্রহণে আগ্রহী, কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁদের এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অনুমতি বাংলাদেশ সরকার প্রদান করেনি। প্রশ্ন জাগে, যদিও এই দুই বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষ ও সুশৃঙ্খল, তবু সরকারের এই অবস্থান ভবিষ্যতে হয়তো এই দুই বাহিনীর মনোবল ও কর্মক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

আর্থিক বিষয় অন্যভাবেও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ওপর প্রভাব ফেলতে থাকবে। ব্যষ্টিক পর্যায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াই সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রাথমিক কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর ফলে অনেক দক্ষ মানবসম্পদ (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) সামরিক বাহিনীর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, যারা হয়তোবা সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারত। আবার সামরিক বাহিনীর ভেতরে শান্তিরক্ষা মিশনের অংশগ্রহণ অন্য যেকোনো দায়িত্বের তুলনায় অধিক লাভজনক হিসেবে পরিগণিত হয় এবং বেশ অধিকসংখ্যক অফিসার শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণের পর চাকরি ছেড়ে যান অথবা অতি দ্রুত অবসরের জন্য আবেদন করেন, যা সশস্ত্র বাহিনীতে একধরনের দক্ষ জনবলের অভাবের আবহ তৈরি করে। শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অর্জিত অর্থ দেশের বিদ্যমান বৈদেশিক অর্থের প্রবাহে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দেশীয় অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর স্থাপন করে। এতত্সত্ত্বেও জাতীয় অর্থনীতিতে শান্তিরক্ষা মিশনের প্রভাব সঠিকভাবে চিহ্নিত করা বেশ দুরূহ। সাবেক শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, মিশনসমূহ থেকে প্রাপ্ত অর্থ অনেক সময় অর্থনৈতিকভাবে অনুত্পাদনশীল খাত যেমন: বিলাসী ভোগ্যপণ্য ক্রয়, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ এবং উচ্চ মুনাফার আশায় পুঁজিবাজারে লগ্নি করা হয়।

বর্তমানে যদিও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দেশের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের বিরোধিতা নেই বললেই চলে, তথাপি ভবিষ্যতে এই অবস্থা বিদ্যমান থাকবে কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। সামনের দিনগুলোতে শান্তিরক্ষা মিশনসমূহ আরও অনেক বেশি বিপজ্জনক এবং প্রতিকূল হয়ে উঠলে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে যদি শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সে ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণ কতটুকু ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবে তা ভেবে দেখতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতির মারপ্যাঁচে শান্তিরক্ষা ইস্যু আটকে পড়ার আশঙ্কাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অতিসম্প্রতি দেশের প্রাক্তন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দাবি করে যে তার দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত পুলিশি অভিযানের ফলে জাতিসংঘ মিশনসমূহে বাংলাদেশি পুলিশ সদস্যদের মোতায়েনের ব্যাপারে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।৩১অপরপক্ষে বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এই আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে দাবি করে, প্রকৃতপক্ষে মিশনসমূহে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা বরং ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।৩২সরকার আরও জানায়, অতিসম্প্রতি জাতিসংঘ বাংলাদেশকে মালিতে ৬০০ সেনা প্রেরণের অনুরোধ জানিয়েছে।৩৩ এসব দাবি এবং পাল্টা দাবি এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক বাস্তবতার ফলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে অংশগ্রহণ যেকোনো সময় দলীয় রাজনৈতিক সংকীর্ণতা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।

সর্বশেষে, বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য এলাকায় জাতিগত সংখ্যালঘু এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও অন্যদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকে৩৪—এই ধরনের অভিযোগ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল, সেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে এবং ভবিষ্যতে শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

এটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা ও তার প্রচারের যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তার অভাব প্রচণ্ড রকমভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার আন্তবিরোধ থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি রাজনৈতিক দল এ বিষয়টিকে জাতীয় গর্বের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-নিয়ন্ত্রিত থিঙ্ক ট্যাংক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ৩৫ ২০১০ সালে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে এবং বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ওপর বেশ কিছু সেমিনার পেপার বিতরণ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটি একটি নিয়মিত ইভেন্টে পরিণত হতে পারেনি।

বাংলাদেশে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বর্তমান উত্থান নিঃসন্দেহে একটি বড় বিবেচনার বিষয়। এই মিডিয়াগুলোকে প্রায়ই বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে সমালোচনামুখর হতে দেখা যায়। আশ্চর্যজনকভাবে এই একটি বিষয়ে মিডিয়াগুলোকে কখনোই তেমন সমালোচকের ভূমিকায় দেখতে পাওয়া যায় না। তবে নিয়মিতভাবে এই মিডিয়াতে জাতিসংঘে অংশগ্রহণের শুধু ইতিবাচক দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। জাতিসংঘ মিশনে প্রকৃতি পরিবর্তন বা অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যত্ চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে মিডিয়াগুলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অভাব রয়েছে।৩৬

বৈশ্বিক ইস্যুসমূহ: বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তনসমূহ প্রত্যহ রাষ্ট্রসমূহকে নতুন নতুন পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়। শান্তিরক্ষা মিশনসমূহ এ রকম পরিবর্তন দ্বারা প্রায়ই প্রভাবিত হয় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে নিজেদের অবস্থান নির্ণয় এবং প্রয়োজনবোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সম্মুখে এ রকম কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান।

আঞ্চলিক সংগঠনসমূহের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এখন বিশ্ব রাজনীতির একটি অত্যাবশ্যকীয় ধারা। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়সমূহে আঞ্চলিক সংগঠনসমূহ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমরা জানি, বর্তমানে বেশির ভাগ শান্তি মিশন আফ্রিকা মহাদেশে পরিচালিত হয়ে আসছে এবং এই মহাদেশের রাষ্ট্রসমূহ খুব স্বাভাবিকভাবেই চাইছে তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক সংগঠন, বিশেষ করে আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং পশ্চিম আফ্রিকান রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক সংগঠন (ইসিওডব্লিউএএস) এই অঞ্চলের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে গঠনমূলক ও প্রধান ভূমিকা পালন করুক। সুদানের দারফুর অঞ্চলে জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের যৌথ মিশন (২০০৭) এবং বর্তমানে মালিতে পশ্চিম আফ্রিকান রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া দরকার যে আফ্রিকান আঞ্চলিক সংগঠনসমূহ বিবিধ সমস্যা যথা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, কাঠামোগত ত্রুটি, আর্থিক স্বল্পতা ও পরিকল্পনা সীমাবদ্ধতা দ্বারা আক্রান্ত। তথাপি ভবিষ্যতে আমরা আফ্রিকা ও অন্যান্য সংঘাতময় এলাকায় আঞ্চলিক সংগঠনসমূহের কার্যক্রম বৃদ্ধি হতে দেখব এবং শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে এ রকম ব্যবস্থা আরও বৃহত্তর ভূমিকা পালন করবে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের প্রশ্ন করতে হবে, এ রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী হতে পারে এবং এ ধরনের হাইব্রিড মিশনসমূহে বাংলাদেশের কতটুকু দেওয়ার আছে।

জাতিসংঘ ক্রমেই শান্তিরক্ষাসংক্রান্ত বহুবিধ বিষয় বেসরকারি খাত, বিশেষ করে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করছে।৩৭ এ কথা অনস্বীকার্য যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ অদূর ভবিষ্যতে শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে রাষ্ট্রীয় সেনাদলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারবে না রাজনৈতিক ও আইনি কারণে। তবু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো মাইন অপসারণ এবং অন্যান্য বিস্ফোরক অপসারণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ আরমোর গ্রুপ, রোনকো কনসালটিং এবং ডাইনকর্প ইন্টারন্যাশনাল এই খাতে বড় ভূমিকা পালন করছে। মাইন অপসারণ যেকোনো শান্তিরক্ষা মিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে মাইন অপসারণ প্রায় ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ব্যবসা এবং এ রকম লাভজনক খাতের ব্যাপারে বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানসমূহের উত্সাহ ও অংশগ্রহণ খুব একটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয়।৩৮ এ রকম দক্ষ, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন পশ্চিমা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখা ভবিষ্যতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে নারীদের অংশগ্রহণ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিত প্রস্তাবনা ২১২২-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে জাতিসংঘ শান্তি মিশনসমূহে আরও বেশি সংখ্যক নারী সদস্যের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য, ২০০০ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবনা ১৩২৫ পাস করে, যার মাধ্যমে সংঘাতময় পরিস্থিতি উত্তরণের ক্ষেত্রে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়।৩৯ জাতিসংঘ কর্তৃক বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও ২০১৩ সালের মার্চ মাস অবধি শান্তিরক্ষা মিশনসমূহের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশেরও নিচে নারী সদস্য ছিল। প্রস্তাবনা ২১২২-এর ফলে ভবিষ্যত্ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্য এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশ হাইতিতে একটি পূর্ণাঙ্গ নারী ফর্মড পুলিশ ইউনিট মোতায়েন করেছে এবং সেনাবাহিনীর নারী সদস্যরাও বিভিন্ন মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন। এতত্সত্ত্বেও বাংলাদেশকে আরও বেশি সংখ্যক নারী শান্তিরক্ষী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও মোতায়েনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে, যার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে পড়তে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, নারী শান্তিরক্ষীদের সংখ্যা বৃদ্ধির অর্থ শুধু সংখ্যার কোনো তারতম্য বা পরিবর্তন নয়, বরং সমাজে বিদ্যমান সামাজিক বিধান ও বৈষম্যগুলো, যা লিঙ্গবৈষম্যকে লালন করে তাদেরও এক যুগান্তকারী পরিবর্তন, যা সহজে অনেকে মেনে নিতে নাও পারে।

সর্বক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতে শান্তিরক্ষা মিশনসমূহ শুধু শান্তিরক্ষায় সীমিত না থেকে রাষ্ট্রগঠন এবং ভঙ্গুর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। স্থায়ী শান্তি এবং সমাজে আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা এবং তাদের মধ্যকার সম্পূরক সম্পর্কটি যত বেশি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তত বেশি পুলিশ সদস্যদের জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনসমূহে এবং পদে নিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই পরিস্থিতি একদিকে যেমন এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়, ঠিক তেমনি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে। সম্ভাবনা এই কারণে যে বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ স্থানে নিয়োজিত হয়ে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছেন। তবে এই সম্ভাবনার জন্য একটি বড় অন্তরায় এই যে বেশির ভাগ রাষ্ট্রই পুলিশ সদস্য নিয়োগের ব্যাপারে কিছুটা গররাজি। কারণ, প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজস্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সর্বদা সচেতন থাকে এবং তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দক্ষ ও পেশাদার পুলিশের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বেশি। এমতাবস্থায় শান্তিরক্ষী সরবরাহকারী রাষ্ট্র অথবা সরকার প্রায়ই মিশনসমূহে দক্ষ পুলিশ সদস্য নিয়োগের ব্যাপারে কিছুটা হলেও দ্বিধান্বিত থাকে। পুলিশ নিয়োগের বিষয়টি যত প্রাধান্য পাবে তত আরও একটি বিষয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশকে ভাবতে হবে। বর্তমানে মানবাধিকার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো সংবাদ খুব দ্রুত পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও বহুল ব্যবহারের কারণে। এ রকম অবস্থায় বাংলাদেশের পুলিশ ও সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো অত্যন্ত দক্ষভাবে এবং দ্রুত মোকাবিলা করতে হবে এবং এই বিষয়গুলো যেন না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এ বিষয়ে আরও মনে রাখা দরকার, পুলিশ সদস্যদের সেনাসদস্যদের মতো শান্তিরক্ষার বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ এখনো এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিংয়ের (বিপসট) মতো বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা এবং তার মাধ্যমে দক্ষ প্রশিক্ষণ দেওয়া ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জিং মিশনসমূহে পুলিশের নিয়োগ নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশকে দ্রুত ও গভীরভাবে ভাবতে হবে।

উপসংহার: ভবিষ্যত্ সম্ভাবনার সূত্রপাত

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মতো একটি সুশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনী যেকোনো জায়গায় জাতিসংঘের ম্যান্ডেটে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক এবং সক্ষম—এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ক্ষমতা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনীতিবিদদের ও অন্য সবার নিরঙ্কুশ সহযোগিতা এই সক্ষমতাকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার ও সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে নতুন অস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণসামগ্রী ক্রয়ে সর্বদাই ইচ্ছুক। এই মনোভাব জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আরও প্রভাবিত করবে।

এতত্সত্ত্বেও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো আলোচনার দাবি রাখে এবং বাংলাদেশের অংশগ্রহণকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। প্রথমত, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ দুঃসাধ্য। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা, বিশেষ করে এর অস্ত্রভান্ডার ও অন্যান্য উপকরণের বহর হয়তো প্রাচীন নয়। কিন্তু ভবিষ্যতের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রকৃতি অনুযায়ী তা প্রস্তুত কি না এ বিষয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত শত্রু মোকাবিলায় শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে এখনো প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব পরিলক্ষিত হয়। সবশেষে, বাংলাদেশে সেনা প্রেরণসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে জাতিসংঘ মিশনগুলোতে ক্রমবর্ধমান বহুমুখী কারণে যেভাবে বেসামরিক বিশেষজ্ঞের ব্যবহার বাড়ছে, তা এই সিদ্ধান্ত প্রণয়ন-প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সর্বোপরি এই পরিবর্তন বাংলাদেশের বর্তমান অংশগ্রহণের প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে। এই বিষয়ে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহকে এখনই এ বিষয়গুলো অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি কূটনৈতিক তত্পরতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যেসব দেশে মিশনে অংশগ্রহণ করেছে সেসব দেশে কূটনৈতিক মিশন খোলাসহ সব ধরনের যোগাযোগ রক্ষায় ও ভবিষ্যত্ সম্ভাবনার পথ খোলার লক্ষ্যে জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এভাবে বাংলাদেশ আফ্রিকার দেশগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে এই ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলার জন্য এগিয়ে আসার পথ সুগম করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনকে (যেমন: এফবিসিসিআই) স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ওপরে বর্ণিত আলোচনার সূত্র ধরে বাংলাদেশকে ভবিষ্যত্ মিশনের জন্য আরও দক্ষ পুলিশ বাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া বেসামরিক কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে আমাদের সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনীকে সে মোতাবেক দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় বেসামরিক দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে একটি যৌথ টেকসই প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে এনজিওর অবদান সর্বজনস্বীকৃত এবং আমাদের এই সফলতা আমরা মিশন-পরবর্তী ভঙ্গুর রাষ্ট্র বিনির্মাণে কাজে লাগাতে পারি। সবশেষে সশস্ত্র, পুলিশ বাহিনী ও একাডেমিক গবেষকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দলকে সর্বদা শান্তিরক্ষা মিশনের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ-সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করতে হবে এবং এ জন্য সরকারকে ও বেসরকারি খাতকে সম্ভাবনার সব প্রয়াস নিতে হবে। এভাবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে এক অনন্য ও যুগোপযোগী অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

তথ্যসূত্র

১. Kabilan Krishnasamy, ‘Bangladesh and UN Peacekeeping: The Participation of a “Small” State,’ Commonwealth and Comparative Politics, 41:1 (2003), p. 32.

২. Ilyas Iftekhar Rasul, 'Bangladesh's Contribution to United Nations Peacekeeping Missions in Africa,' paper presented at a seminar on Look Africa: An Emerging Foreign Policy Option for Bangladesh.
       (Dhaka: Bangladesh Institute of International And Strategic Studies, 2 December 2010), p. 4.

৩. Paul D. Williams, War and Conflict in Africa (Cambridge: Polity Press, 2011), pp. 199-200.

৪. Rasul, 'Bangladesh's Contribution to United Nations Peacekeeping Missions in Africa,' p. 4.

৫. ‘Freetown seeks investment in garment, textile, President Kabbah leaves today, thanks Dhaka for peacekeeping in Sierra Leone,’ The Daily Star, 23 October 2003, at http.//www.thedailystar.net/ 2003/10/23/d3102301022.htm (accessed 19 May 2012).

৬. এ ক্ষেত্রে ব্যবহূত তথ্যউত্স আইআইএসএস, ‘দ্যা মিলিটারি ব্যালেন্স ২০১৩’ (লন্ডন: আইআইএসএস/রাউটলেড্স, ২০১৩)।

৭. বাজেটের তথ্যউত্স—Sentinel Security Assessment- South Asia’, Jane’s Sentinel Country Risk Assessments, 11 April 2012.

৮. সশস্ত্র খাতে গড় ব্যয় (মোট ব্যয়/সেন্যসংখ্যা) হলো সশস্ত্র খাতে সর্বমোট ব্যয়কে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সব সেনাসংখ্যা দ্বারা ভাগ করে প্রাপ্ত ফলাফল। সর্বশেষ তথ্যসূত্র IISS, ‘The Military Balance 2013’.

৯. See UN DPKO, UN Mission’s Summary Detailed by Country, at http://www.un.org/en/peacekeeping/contributors/2013/apr13_3.pdf (accessed 10 May 2013).

১০. Armed Forces Division, ‘Bangladesh in UN Peacekeeping Missions,’at http://www.afd.gov.bd/images/supp/Brochure-UN%20DAY.jpg  (accessed 10 May 2013). 

১১. Armed Forces Division, ‘Special Supplement on International Day of UN Peacekeepers 2011,’ 29 May 2011, at http://www.afd.gov.bd/?q=node/56 (accessed 05 April 2013).

১২. See UN Police Magazine, 10th Edition, January 2013, at http://www.un.org/en/peacekeeping/publications/unpolmag/unpolmag_10.pdf (accessed 10 May 2013).

১৩.‘Bangladeshi Peacekeepers get UN medal in Haiti,’ New Age, 16 May 2012, at http://www.newagebd.com/detail.php?date=2012-05-16&nid=10477 (accessed 19 May 2012).

১৪. ২০০৫ সালে ওভারসিজ অপারেশনস ডিরেকটরেট স্থাপন করা হয় এবং এ রকম বিশেষায়িত সংস্থা তৈরির মাধ্যমে মিলিটারি অপারেশনস ডিরেকটরেটকে জাতিসংঘে সেনা প্রেরণবিষয়ক অতিরিক্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত করা হয়। লেখকদ্বয়ের ডি পি কে ও অফিসারের সঙ্গে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।

১৫. ৩ মে, ২০১২ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের সঙ্গে ওয়াশিংটন ডিসিতে লেখকদ্বয়ের সাক্ষাত্কার। সেই কূটনীতিক জুলাই ২০১১ থেকে জুন ২০১২ সালের মধ্যে সৈন্য প্রেরণকারী দেশগুলোর সঙ্গে ৮৫ মার্কিন ডলারের এককালীন সম্পূরক অর্থ প্রদানের বিধান রেখে একটি আলোচনার ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে যারা দরকষাকষি করবেন তাদের নেতৃত্বের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন।  See UN General Assembly, A/RES/65/289, 8 September 2011, p.9.

১৬. BIPSOT, Shanti Doot 3 (Dhaka: BIPSOT/GPO/Bangladesh Army/USPACOM, March 2012). At http://www.bipsot.net/ download/Magazine_SD3.pdf (accessed 29 April 2012).

১৭. World Bank Country Data, at http://data.worldbank.org /country/bangladesh (accessed 8 May 2013).

১৮.'Role of BD Armed Forces in UN Peacekeeping Missions', Restricted Bangladesh Army document (no date, anonymous author).

১৯. Prime Minister Sheikh Hasina’s message, ‘Special Supplement on International Day of UN Peacekeepers 2011,’ 29 May 2011, at http://www.afd.gov.bd/?q=node/56 (accessed 05 April 2013).

২০. ‘Dhaka, UN for newer areas of partnership’, New Age, 14 November 2011, at http://newagebd.com/newspaper1/archive_details.php?date=2011-11-14&nid=40076 (accessed 9 May 2013).

২১. ‘Supply-side peacekeeping: The UN finds an unusual way to exert influence,’ The Economist, 21 February 2007, at http://www.economist.com/node/8730316 (accessed 9 May 2012).

২২. See BIPSOT, http://www.bipsot.net/

২৩. Motiar Rahman, 'Blue Beret in the UN Peacekeeping Process: The Case of Bangladesh Police,' The Indian Journal of Politics 14, No.1, 2009, 36; Nurul Islam, 'The Army, UN Peacekeeping Mission and Democracy in Bangladesh,' Economic & Political Weekly, XLV:29 (17 July 2010), pp.77-85; Shekh Mohammad Altafur Rahman, 'Impact of Human Security Approach in the Post UN Peace Keeping Mission: A Case Study of Bangladesh,' ( Paper presented on The 4th International Conference on Human Rights & Human Development Critical Connections: Human Rights, Human Development and Human Security, 18-19 June 2011 Thailand, University of Mahidol, 2011) at http://www.humanrightsmu.org/attachments/article/88/Altaf_Paper.pdf (accessed 28 March 2013); and, Rashed Zaman & Niloy R. Biswas, 'Bangladesh,' in A.J. Bellamy & P.D. Williams (eds.), Providing Peacekeepers: The Politics, Challenges, and Future of United Nations Peacekeeping Contributions (Oxford University Press, 2013).

২৪. বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন চাকরিরত কর্মকর্তার সঙ্গে লেখকদ্বয়ের সাক্ষাত্কার, ঢাকা, ২ এপ্রিল, ২০১২।

২৫. Rahman, 'Impact of Human Security Approach in the Post UN Peace Keeping Mission: A Case Study of Bangladesh', p.11.

 ২৬. ‘Arms deal with Russia crucial for UN Peacekeeping: Army’ The Financial Express, 22 January 2013, at http:// www.thefinancialexpress-bd.com /index.php? ref=MjBfMDFfMjJfMTNfMV84OF8xNTc2OTc (accessed 28 March 2013).

২৭. See Transparency International UK, Government Defence Anticorruption Index 2013, at http://government.defenceindex.org /sites/default/files/documents/GI-exec-summary-english.pdf (accessed 28 March 2013).

২৮. Stephen Blank, ‘What Do Russia’s Arms Sales to Bangladesh Mean?’ Eurasia Daily Monitor, Volume: 10 Issue: 17, at http://www.jamestown.org/single/?no_cache=1&tx_ttnews%5btt_news%5d=40386&tx_ttnews%5bbackPid%5d=228&cHash=fc37665afa0c271fb24ef0e2ee9e6494#.Uc1kn201hMs (accessed 28 March 2013).

২৯. Nurul Islam, ‘The Army, UN Peacekeeping Mission and Democracy in Bangladesh’, pp.81-2.

৩০. Syed Imtiaz Ahmed, ‘Civilian Supremacy in Democracies with ‘Fault Lines’: The Role of the Parliamentary Standing Committee on Defence in Bangladesh,’ Democratization, 13:2 (2006), pp.283–302.

৩১. ‘Close podium or face Dhaka march, says Khaleda,’ New Age, 16 March 2013, at http://www.newagebd.com/detail.php?date=2013-03-16&nid=43127#.Uc1l6201hMu (accessed 14 April 2013).

৩২. ‘Hasina warns Khaleda against bloodshed,’ Bdnews24.com, 2013-03-18, at http://bdnews24.com/politics/2013/03/18/hasina-warns-khaleda-against-bloodshed (accessed 14 April 2013).

৩৩. Lovlu Ansar, ‘UN increases Bangladeshi peacekeepers,’ bdnews24.com, 11 May 2013, at http://bdnews24.com/bangladesh/ 2013/05/11/un-increases-bangladeshi-peacekeepers (accessed 15 May 2013).

৩৪. Hana S. Ahmed, ‘Disregarding the Jumma,’ Himal South Asia, July 2011, at http://www.himalmag.com/component/content/article/4528-disregarding-the-jumma.html (accessed 12 May 2012).

৩৫. BIISS-এর ওয়েবসাইট দেখুন। www.biiss.org

৩৬. See, for example, Ilyas Iftekhar Rasul, ‘International Day for UN Peacekeepers,’ The Daily Star, 29 May 2011; Staff Correspondent, ‘Bangladesh to bolster peacekeeping missions, President lauds peacekeepers on Int’l Day,’ The Daily Sun, 30 May 2012; ‘Dhaka largest troops-contributor to UN missions, Int’l Day of UN Peacekeepers today,’ The New Age, 29 May 2011; and Brig Gen Md. Abdul Hakim Aziz, psc, ‘Heroes beyond national frontiers,’ The Daily Star, 18 June 2011.

৩৭. Ian Richards, ‘The UN Must Stop Outsourcing Peacekeepers,’ Huffington Post, at www.huffingtonpost.com/ian-richards/the-un-must-stop-outsoureing-b.3874641.html.

৩৮. Alex J. Bellamy and Paul D. Williams, Understanding Peacekeeping, (Cambridge: Polity Press, 2nd edition, 2010), p.327.

৩৯. ‘UN passes new resolution on women’s role in peace process,’ The Guardian, 21 October 2013, at www.theguardian.com/ global-development/2013/oct/21/un-resolution-2122-women-peaceprocess.