সারসংক্ষেপ
আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিকসম্পর্কিত সামাজিক বিষয়ের অগ্রগতি হয়নি। ক্রেতানির্দেশিত উত্পাদন চেইনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে প্রক্রিয়াগত এবং উত্পাদনগত উন্নয়নপ্রক্রিয়ায়। এ উন্নয়নে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে উন্নত বিশ্বের বাজারসুবিধা এবং সরকারি বিভিন্ন সুবিধা, যা উদ্যোক্তাকে বিনিয়োগের দীর্ঘমেয়াদি দিকনির্দেশনা দিয়েছে। স্বল্প খরচে পোশাকশ্রমিকের প্রাপ্যতাও এ ক্ষেত্রে শ্রমনির্ভর উত্পাদনপ্রক্রিয়া বিস্তারে সহায়তা করেছে। কিন্তু শ্রমিকসম্পর্কিত সামাজিক এবং ভৌত কমপ্লায়েন্সের অগ্রগতি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ছিল না। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বিতর্ক, ওভারটাইম ভাতা প্রদান সমস্যা এবং অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে। দুর্বল কর্মপরিবেশ এখন পোশাক খাতের বড় প্রশ্ন। দ্রুত বর্ধনশীল এ খাতে যথাযথ নিরাপত্তার মান না মানা এ জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে তদারককারী সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের সুশাসনগত দুর্বলতা দায়ী। বর্তমানে কর্মপরিবেশের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম চলছে। যথাযথভাবে নির্দিষ্ট সময়ে এসব সংস্কার কার্যক্রম শেষ করা শ্রমিকের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার জন্য জরুরি। দীর্ঘ মেয়াদে তৈরি পোশাক খাতের উত্পাদন চেইনের জন্য এমন নীতিকাঠামো প্রয়োজন, যেখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পর্যাপ্ত সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: উত্পাদন চেইন, পোশাক খাত, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, কমপ্লায়েন্স, শ্রমিক অধিকার, সামাজিক ইস্যু।
১. প্রারম্ভিক কথা
আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে স্বল্পোন্নত দেশের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। এর মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে অংশগ্রহণ আরও কম। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এ দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত শুধু আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে অংশ নিচ্ছে তা নয়, এ খাত প্রতিযোগিতা সক্ষম এবং এর উত্তরোত্তর উন্নতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্ব পোশাক রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। তবে বিগত তিন দশকে পোশাক খাতের উত্পাদন চেইনে পণ্য উত্পাদনে গুণগত ও পরিমাণগত প্রবৃদ্ধি হলেও শ্রমিকসম্পর্কিত সামাজিক ইস্যুর অগ্রগতি বেশ কম (ভট্টাচার্য ও মোয়াজ্জেম, ২০১৩)। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং স্বল্পোন্নত দেশের শিল্প খাতের অধিকাংশ উত্পাদন চেইনে প্রায়ই সামাজিক ইস্যুর ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিদ্যমান।
বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হিসেবে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের অর্জিত অগ্রগতি এবং এর অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও সম্ভাবনা সার্বিকভাবে জাতীয় আয়, শিল্প খাতের প্রসার ও প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলে। বর্তমানে এ শিল্পের মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন, রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অর্জন এবং শিল্প খাতের প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। রপ্তানিতে কতিপয় পোশাকপণ্যের প্রাধান্য থাকলেও বাড়ছে পণ্যবৈচিত্র্য, ব্যবহূত কাঁচামালের বৈচিত্র্য, পরিবর্তন হচ্ছে উত্পাদন কৌশল এবং সার্বিকভাবে উন্নত হচ্ছে পণ্যের গুণগত মান। উল্লিখিত পরিবর্তনসমূহ দেশের পোশাকশিল্পের প্রক্রিয়াগত ও উত্পাদগত পর্যায়ে ধারাবাহিক উন্নতি নির্দেশ করে।
অন্যদিকে, পোশাক খাতের উত্পাদন চেইনে সামাজিক ইস্যুতে অগ্রগতি তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। সামাজিক কমপ্লায়েন্সের কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা, শ্রম অধিকার এবং মজুরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রায়ই শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, বিশেষত সাম্প্রতিক কালে তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন এবং রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে উত্পাদন চেইনের অভ্যন্ত্তরীণ শাসনকাঠামোর দুর্বলতা নিয়ে, বিশেষত দেশীয় আইনের দুর্বলতা, তার প্রয়োগে শিথিলতা, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের নির্দেশকৃত নীতিকাঠামোর (কোড অব কনডাক্ট) ঘাটতি এবং দুর্বলতা নিয়ে। একটি আন্তর্জাতিক মানের উত্পাদন চেইনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা এবং সামাজিক অগ্রগতির মধ্যকার টানাপোড়েন অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ইঙ্গিত করে।
আলোচ্য প্রবন্ধে পোশাক খাতের সার্বিক অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে শ্রমিকসংক্রান্ত বিষয়ের সামাজিক অগ্রগতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেকশন ২-এ আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে সামাজিক ইস্যুর অবস্থানের একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। সেকশন ৩-এ পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেকশন ৪-এ পোশাক খাতের উত্পাদন চেইনে উন্নয়নের বিচ্ছিন্ন পর্যায় আলোচিত হয়েছে। সেকশন ৫-এ প্রতিযোগিতা সক্ষমতার চ্যালেঞ্জের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সেকশন ৬-এ পোশাক খাতের সামাজিক অগ্রগতির বিভিন্ন ইস্যু, বিশেষত সামাজিক এবং ভৌত কমপ্লায়েন্স নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সেকশন ৬-এ শ্রমিকসংক্রান্ত সামাজিক ইস্যুতে বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। সবশেষে সেকশন ৭-এ ক্রেতা, উদ্যোক্তা এবং শ্রমিকসম্পর্ক বিশ্লেষণ করে পোশাক খাতের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে পরামর্শমূলক মন্তব্য করা হয়েছে।