গণমুখী জাতীয় আর্থরাজনৈতিক কৌশলপত্রের সন্ধানে একটি দলনিরপেক্ষ অনুসন্ধান

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশ একটি প্রতিশ্রুত উন্নয়নমুখী নেতৃত্বের মাধ্যমে দ্রুত স্বনির্ভর ও সমতামূলক উন্নয়নের জন্য বেশ সম্ভাবনাময় দেশ। এ দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন হলো, কীভাবে সফল নীতি চলমান রাখা যায় এবং ভবিষ্যতের জন্য আরো অধিক ভালো নীতি প্রণয়ন করা যায়। কৌশলগতভাবে দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করলে আমাদের অবশ্যই রাষ্ট্রের সব স্তরে দৃঢ়, দক্ষ ও প্রতিশ্রুত নেতৃত্বের মাধ্যমে কৌশলগত উন্মুক্ততা এবং স্বনির্ভরতার সমন্বয়সাধন জরুরি। বর্তমানের এই সম্যক হতাশাজনক চিত্রের কারণ হলো, স্বাধীনতার পর থেকে দেশপ্রেমিক ত্যাগী নেতৃত্বের অধীনে দেশ একটি স্বনির্ভর ও গণমুখী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালিত না হওয়া। কৌশলগতভাবে বর্তমানের সংঘাতমুখর রাজনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ প্রণোদনার মাধ্যমে বেসরকারি খাতে সত্যিকার অর্থে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির সংযোজনের পাশাপাশি সরকারি খাতে দক্ষ ও সমতামূলক সেবা প্রদান করতে হবে।

একই সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের তথাকথিত বিদেশি সহায়তার নামে অনাকাঙ্ক্ষিত ঋণের বোঝা ক্রমান্বয়ে কমানোর ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে যে ঋণের বেশির ভাগই উন্নত দেশের বৃহত্ পুঁজির ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং দেশে একটি দেশীয় পরজীবী খরিদ্দারতন্ত্র তৈরি করে। ইতিবাচকভাবে আমাদের অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো স্বাধীনতার আদর্শের প্রতিফলন ঘটায় এমন শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠনে জোর দিতে হবে। প্রগতিমুখী শিক্ষাগত এবং অন্য নীতি গ্রহণের মাধ্যমে মানবসম্পদ গঠনে কৌশলগত উন্মুক্ততা ও অভিনবত্বসহ নয়টি সুনির্দিষ্ট বিষয় এই গণমুখী অবস্থানপত্রে আলোচিত হয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: বাংলাদেশ উন্নয়ন কৌশল, বৈদেশিক সাহায্য, এনজিও, নব-উদ্ভাবন ও শিক্ষা।

প্রারম্ভিক কথা

একবিংশ শতাব্দী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের চেয়ে স্বনির্ভর শিল্পায়নপ্রক্রিয়ায় ব্যাপকতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এটা চলমান বৈশ্বিক আর্থিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। এই পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও বাস্তুতান্ত্রিক সংকট আবশ্যিকভাবে নতুন প্রাযুক্তিক ও শিল্পানুকূল রূপকল্প এবং বঙ্কিম পথের উন্মেষ ঘটাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক কাজ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতার পাশাপাশি বর্তমান শতাব্দীর প্রথম পঁচিশ বছরে মধ্যে অন্তত মধ্য স্তরের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনেরও সামর্থ্য আছে। ইতিবাচক দিক হলো, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সক্ষমতা অর্থনীতিতে ব্যাপক রূপান্তর ঘটিয়েছে। অস্বীকারের উপায় নেই, প্রবৃদ্ধির হার স্থিতভাবে বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য সফলতার কারণে বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর স্ববিশেষ সুনাম অর্জনে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ হারের মতো অন্য সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ এখন ওয়াশিংটনের সরলীকৃত উন্নয়ন পথের বিপরীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের সবচেয়ে উত্তম উন্নয়ন পথ পূর্ব-এশীয় ধরনে পদার্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই এই ধরনের উন্নয়নধারার কৌশলগত প্রধান বিষয়াবলি প্রথমে চিহ্নিতকরণ জরুরি। তারও আগে ‘উন্নয়ন-ধারণা’ স্বয়ং কী বস্তু, তা খোলাসা করার কাজটিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। এ লেখায় আমি মাঝেমধ্যে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম কিংবা মালয়েশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশের অর্থনীতির উল্লেখ করব, যার অনেক কিছুই বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক।

উন্নয়ন কী? বাংলাদেশে উন্নয়নের পর্যায়সমূহ এবং কিছু কৌশলগত বৈশিষ্ট্য

দ্ব্যর্থবোধকতা এবং বিভ্রান্তি এড়াতে এই প্রসঙ্গে ‘উন্নয়ন’ পদটির বিষয়ে কিছু স্পষ্টকরণ জরুরি। এই প্রবন্ধের বাকি অংশে উন্নয়নের তিনটি ধারণার অবতারণা করছি, যা পরোক্ষভাবে অনেকাংশে শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। প্রথম ধারণাটি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তনজনিত, যা কোনো দেশের উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। দ্বিতীয় ধারণাটি প্রবৃদ্ধির বণ্টনগত দিক, বিশেষত অসমতা ও দারিদ্র্য বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা পরোক্ষভাবে আজকাল এই উভয় ধারণাই পোষণ করছেন। ব্যাপকতর পরিসরের তৃতীয় ধারণাটি অমর্ত্য সেনের সার্বিক সক্ষমতা ধারণা এবং এর তত্পরবর্তী সংযোজনের ভিত্তিতে আলোচনার দাবি রাখে। এই ধারণায় উন্নয়নকে কালের সম্প্রসারণ ও ক্ষেত্রের (space) পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির স্বাধীনতার সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষত এটি ব্যক্তিকে এমন ইতিবাচক স্বাধীনতা দেয়, যা তাকে জীবনের মূল্য দিতে শেখায়। অবশ্য শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের প্রায়োগিক নমুনায় প্রত্যক্ষভাবে এ ধারণা বহুল প্রচলিত নয়। এখনো উন্নয়নে ‘সামষ্টিক কল্যাণের’ একটি প্রচলিত ধারণা আছে, যা আসলে পুরো শিল্পায়ন ও উন্নয়নের সামগ্রিক প্রকল্পের ভিত্তি। ‘স্বাধীনতা নিশ্চিতে উন্নয়ন’ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়নের ওপর লিখিত কিইউন লির (Keun Lee) প্রবন্ধটি প্রাসঙ্গিক। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে আমরা স্পষ্টতই এমন কিছু সুবিধামূলক বৈশিষ্ট্য দেখি, যেখানে কোনো নাগরিককে ইচ্ছাকৃত আটক এবং নির্যাতন করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এসব সুবিধা পেলেও তাদেরই এটা বেশি লঙ্ঘিত হয়। সত্যি—শক্তিশালী রাষ্ট্রের যেখানে এটি সঠিক হওয়ার কথা, সেখানেই প্রায় অধিকতর ভুল হয়। এভাবে ল্যাটিন আমেরিকা অতীতের স্বল্পমাত্রার সামরিক উত্তরাধিকার ছেড়ে এলেও তাইওয়ান ও কোরিয়া খুব পোক্তভাবেই অতীতের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের উত্তরাধিকার ছেড়ে এসেছে। ল্যাটিন আমেরিকা এবং তাইওয়ান-কোরিয়ার মধ্যে নিজ নিজ জাতীয় শিল্পের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কৌশলগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে স্পষ্টতই পার্থক্য আছে। বিষয় হলো, বর্তমানে যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এটি পছন্দ হতে পারে। এর মধ্যে কোরিয়া কিংবা পূর্ব এশিয়ার সাফল্যের নেপথ্যে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক স্থায়িত্ব।’ (লি ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৩)

সুতরাং মনে হয়, অন্যান্য বিষয়সহযোগে প্রবৃদ্ধি অর্জনের উন্নয়নচিন্তার সঙ্গে সত্তর-পরবর্তী উন্নয়নচিন্তার একটি পরোক্ষ সংযোগ আছে। যখন অন্যান্য বিষয়ের তালিকায় গবেষকভেদে ভিন্নতা আছে, তখন এই ক্ষেত্রের কোনো গবেষকই আজ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নকে সমানভাবে পরিমাপ করতে পারেননি। প্রায় সবাই এ বিষয়ে একমত যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। অনেক প্রাজ্ঞ গবেষক অবশ্য ‘প্রবৃদ্ধির এবং বণ্টনের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে’ অধিক গুরুত্ব দেন।

উচ্চ প্রবৃদ্ধির অভিজ্ঞতার সংশ্লেষণ এশীয় অর্থনীতির কিছু সাধারণ কৌশলগত বিষয়ের পাশাপাশি বাহ্যিক পারিপার্শ্বিকতা এবং নীতির রূপান্তরের প্রভাব প্রকাশ করে। এটি বহু-ভারসাম্য এবং পথ-নির্ভরতার অরৈখিক জটিল অর্থব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সময়ের আবর্তে যে কেউ একদিকে যেমন কিছু ক্ষেত্রে কাঠামোগত রূপান্তরের উত্থান পর্যবেক্ষণ করতে পারে, অপরদিকে প্রাথমিক অবস্থা, কৌশল, নীতি কিংবা বাহ্যিক পারিপার্শ্বিকতাসহ অন্য বিষয়ে স্থবিরতাও দেখতে পারেন। এখানে আলোচনার দিকগুলো হলো, এশীয় নমুনায় প্রত্যেকের মধ্যে অনেক সুনির্দিষ্ট ভিন্নতাও আছে। তবে নিচে বর্ণিত সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় মিলও আছে।

১. কৌশলগত উন্মুক্ততা: কৌশলগত উন্মুক্ততা হলো হংকং, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে ব্যাপক মাত্রায় উন্মুক্ত হওয়া। একই সঙ্গে ভিয়েতনামের বাণিজ্যিক অভিমুখ বিশেষত বস্ত্র খাতের নীতির সঙ্গে ন্যূনতম মাত্রায় সংযোগ স্থাপন। কিন্তু প্রথম দিককার কৌশলগত আমদানি বিকল্পের (SISI) বাইরে সব ক্ষেত্রে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি উন্নয়নে কৌশলগত অঙ্গীকার এবং অধিক মূল্য সংযোজনের দিকে মনোযোগী হওয়া। তবে মনে রাখা উচিত, সব উন্নয়নশীল দেশে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিমুখী নীতি গ্রহণের ব্যাপারে সাংগঠিক কূটাভাস (fallacy of composition) আছে। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক চাহিদা না থাকলে উন্নত দেশের রপ্তানি বাজারের আসন্ন প্রতিযোগিতায় উন্নয়নশীল দেশগুলো জয়ী কিংবা পরাজিত হতে পারে। সুতরাং ভবিষ্যতের জন্য উদ্যমী দেশগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বাজার উন্নয়ন এবং অন্য অনেক নীতি প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে গতিশীল তুলনামূলক সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।

২. স্থিতিশীলতার জন্য বিকাশমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন: বর্তমান বিশ্বে চীন ও ভারত সবচেয়ে বিকাশমান অর্থনীতির দেশ। অবশ্য থাইল্যান্ডের তুলনায় তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও কোরিয়া অধিকতর মিশ্র বিকাশমান অর্থনৈতিক নীতির চর্চা করে। এমনকি আর্থিক দিক থেকে হংকং ও সিঙ্গাপুরও একই সঙ্গে ভিন্ন নীতি অনুসরণ করে। মনে হয় চীন, ভারত, কোরিয়া, মালয়েশিয়া কিংবা ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর উন্নয়নশীল অর্থনীতির অভিজ্ঞতায় পুরো অঞ্চলই ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক মডেল দৃঢ়ভাবে পরিহার করবে।

৩. উত্পাদনশীল বিনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণ: উত্পাদনশীল বিনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে কোরিয়াই মনে হয় সবচেয়ে অগ্রগামী। ষাটের দশকে কোরিয়া সংস্কারসাধনের মাধ্যমে কতিপয় পর্যায়ক্রমিক স্তর পার করেছে এবং এখন দেশটি ২০৫০ সালের তথ্য এবং জৈব ও ন্যানো প্রযুক্তির সম্মিলনে যথাযথ প্রাযুক্তিক উত্কর্ষে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণে এখনো রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রাধান্যশীল। উত্পাদনশীল বিনিয়োগ উপযোগী প্রতিষ্ঠান নির্মাণে বোধ হয় চীনেরই কেবল সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মসূচি আছে, যা পরে একটি বিশেষ কেস স্টাডির মাধ্যমে আলোচনা করা হবে।

৪. কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন: কৃষিভিত্তিক উন্নয়নে কম-বেশি প্রায় সব দেশই জোর দেয়। কেবল চীন ও ভিয়েতনামে সম্ভবত প্রথম দিকে কৃষিতে সমতাভিত্তিক কৃষকমুখী উন্নয়ননীতি গৃহীত হয়েছে। জাপানি উপনিবেশের অবসানের পর কোরিয়া ও তাইওয়ানেও সমতামূলক ভূমি সংস্কার সাধিত হয়েছিল।

ওয়ারের (Warr) আলোচনায় তাইওয়ানে কৃষির গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে, বিশ্লেষণের ফল নির্দেশ করে থাইল্যান্ডের মোট প্রকৃত উত্পাদন বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এর সবচেয়ে বড় অবদান হলো কৃষিভিত্তিক উত্পাদন বৃদ্ধির বিপরীতে এটি অন্যত্র উত্পাদনশীলভাবে সম্পদের চাপ কমাতে অবদান রেখেছে। অন্যান্য খাতের তুলনায় কৃষিতে উত্পাদন প্রবৃদ্ধি ধীরগতির, এমন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে থাইল্যান্ডের কৃষিকে স্থিত বলে চিত্রায়িত করা সম্পূর্ণ ভুল। যদি কৃষি খাত সত্যিই ‘স্থবির’ হয় তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কম হবে। কারণ, কৃষির উত্পাদনশীলতা যথেষ্ট পরিমাণ উন্নীত করা কিংবা ব্যাপকভাবে সম্পদের ওপর চাপ কমানোর নীতি গ্রহণ কখনো ভারসাম্যপূর্ণ উত্পাদন প্রবৃদ্ধিকে সম্ভবপর করবে না। অথচ থাইল্যান্ড এখনো তা-ই অব্যাহত রেখেছে।

থোবার্নের (Thoburn) লেখায় ভিয়েতনামের কৃষি সংস্কার সম্পর্কে মূল্যায়ন পাওয়া যায়। সেখান থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা তুলে ধরছি:

ভিয়েতনামের কৃষি সংস্কারে ধান সত্যিই বিরাট সাফল্যগাথা নিয়ে আসে। দেশটি সহজেই আশির দশকের চালের একক আমদানিকারক অভিধা বদলে নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্ চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে আবির্ভূত হয়। যদিও অন্যান্য পণ্যের তুলনায় নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত চালের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি খুব একটা উন্নীত হয়নি। এই ঘাটতি আবশ্যিকভাবে চমকপ্রদও নয় অথবা ব্যর্থতার নমুনা নয়। নব্বই দশকের শেষের দিকে চাল রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যেখানে শিখরে ছিল, সেখানে অন্যান্য উত্পাদনের মাত্র ১৫ শতাংশ রপ্তানি হতো। যে অর্থনীতির প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষই একই সঙ্গে চালের ভোক্তা ও উত্পাদক, সেখানে অভ্যন্তরীণ উত্পাদনের ওঠানামায় প্রাথমিকভাবে চাল উত্পাদন এবং রপ্তানি মানুষের গ্রামীণ আয় ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাষ্ট্র নিজেই কাজুবাদাম এবং পরবর্তী সময়ে কফির মতো নতুন শস্য উত্পাদনে উত্সাহ দিয়েছে। কফি উত্পাদন সরাসরি কোনো সাফল্যগাথা না আনলেও নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে কতিপয় আন্তর্জাতিক দাম পড়তিতে ভিয়েতনামের কফি রপ্তানি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

৫. শিল্পভিত্তিক উন্নয়ন ও কাঠামোগত পরিবর্তন: শিল্পভিত্তিক উন্নয়ন ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মতো বিষয়ের কৌশলগত পরিপ্র্রেক্ষিত আমাদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাপকমাত্রায় সফল দেশগুলোর ধারাবাহিক উন্মোচিত গতিশীল নীতি গ্রহণের বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়। নিরন্তর পর্যালোচনামূলক প্রচেষ্টা আমাদের এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ গল্প বলে, যা সাধারণত নব্যধ্রুপদি অর্থনৈতিক (new classic economy) মূলনীতির মাধ্যমে কতিপয় ভালো সূচক অনুসরণে একটি সম্পূর্ণ অবরোহণমূলক চিত্রে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে জোমো (Jomo) এবং উইর (Wee) মালয়েশিয়া কেস স্টাডিটা খুবই উত্তম ও জুতসই প্রতি-উদাহরণ। এই দুজন গবেষক নির্দিষ্ট সময়সীমা মাথায় রেখে মালয়েশিয়ার কৌশলগত ও নীতিগত কতিপয় পরিবর্তন আলোচনা করেছেন।

বছরের পর বছর সরকার মালয়েশিয়ায় শিল্পায়নপ্রক্রিয়ার কৌশল পরিবর্তন করেছে। সমস্যা এবং নতুন অগ্রাধিকার চিহ্নিত করে সেখানে সরকার ১৯৮৬-১৯৯৫-এর প্রথম শিল্প মহাপরিকল্পনা পরিবর্তন করে ১৯৯৬-২০০৫-এর জন্য নতুন দ্বিতীয় শিল্প মহাপরিকল্পনা ঘোষণা করে। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে সে দেশের সরকার নির্দিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি বিনিয়োগ প্রসারে মাল্টিমিডিয়া সুপার করিডর (এমএসসি) নির্মাণ করে। একই সঙ্গে সরকার এই উদ্যোগকে সফল করতে অবকাঠামোগত উন্নয়নে তাত্ক্ষণিক ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় এবং এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন প্রণয়নসহ অধিকতর উদারনৈতিক প্রণোদনা প্রদান করে।

এভাবে আশির দশকের মাঝামাঝিতে দেশটি নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি এবং শিল্পায়নপ্রক্রিয়ায় সফলতা লাভ করে। তখন থেকে নতুন নীতি গ্রহণের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি আধুনিকায়ন ও শিল্পায়নের পথ সুগম করতে ২০২০ সাল পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে। যদিও সেখানে মধ্য নব্বই দশক নাগাদ বৃহত্তর অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়িয়ে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায়ই শূন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তবু ১৯৯৭-১৯৯৮ অর্থবছরের আঞ্চলিক সংকটের কারণে সে দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই গতি পায়নি। সহযোগী রাষ্ট্রের সাড়ায় কিছু বিবেচনাহীন নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সংকটের গভীরতা ও উত্তরণের জটিলতা আরও খারাপের দিকে যায়। যদিও ওই সহযোগী রাষ্ট্রের নির্দেশনা সংকট উত্তরণে তেমন কাজে আসেনি।

পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের বাস্তবতায় ওই দেশ ষাট ও সত্তরের দশকে আরও কিছু পরিবর্তন সাধন করে। ষাটের দশকে রাবারের দরপতন নিঃসন্দেহে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও নীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা, বিশেষত ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় আমদানি বিকল্প শিল্পায়নের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার নিরীক্ষা অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলো মূল ভূমিকা পালন করে। এমনকি এই নিরীক্ষা উত্তর-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অভিজ্ঞতা, যেখানে রপ্তানি উন্নয়নে কার্যকর সুরক্ষা শর্তাধীন থাকে—তা থেকেও ভিন্ন। অবশ্য সত্তরের দশকে দেশটি নিট তেল আমদানিকারক থেকে রপ্তানিকারক দেশে উন্নীত হয়, যখন পেট্রোলিয়ামের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। তখন দেশটির সরকার ১৯৮০ সালের ভলকার (Volker) হস্তক্ষেপে প্রকৃত সুদহার বৃদ্ধি এবং পণ্য দরপতনে বৈশ্বিক মন্দায় নিপতিত না হওয়া পর্যন্ত বাইরে থেকে কম দামে পেট্রোডলার ধার করার অনুমতি দিয়েছিল। (জোমো এবং উই, পৃষ্ঠা ১৪)

ভিয়েতনামের কেস স্টাডিও তাত্ক্ষণিক ও সাময়িক নীতি আপাততভাবে প্রথম দিককার সফল উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পেরেছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করে। এ ক্ষেত্রে সম্পদ বণ্টনে ভ্রান্তি এড়াতে সার্বক্ষণিক তদারকি ও নীতি পর্যালোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান নীতি কাজ না করার কারণ সন্ধান করাই একটা শিক্ষা হতে পারে।

৬. তথ্যপ্রযুক্তির সক্ষমতা অর্জন: প্রাযুক্তিক সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পুরো প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথপরিক্রমার বঙ্কিম রেখায় কোরিয়া একটি ভালো নমুনা সৃষ্টি করেছে। লির ভাষায়: ‘সক্ষমতার বিভিন্ন দিকের মধ্যে প্রাযুক্তিক সামর্থ্যের দিকে জোর দেওয়া উচিত। কেননা এটা ছাড়া কোনো টেকসই প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। এই উন্মুক্ত বাজার প্রতিযোগিতার যুগে ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোকে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সস্তা পণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় এবং এই সস্তা পণ্যগুলোর প্রাযুক্তিক অভিনবতায় বাড়তি উন্নয়ন ঘটিয়ে উচ্চমূল্য আরোপ করে মূল্যশৃঙ্খলে (value chain) পরিচালনা করতে হয়। অধিকন্তু ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোকে যতটা সম্ভব স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় কোম্পানি হিসেবে থাকাটাই শ্রেয়তর, কোনোভাবেই বিদেশি নিয়ন্ত্রিত বহুজাতিক কোম্পানির শাখা হিসেবে থাকা উচিত নয়। বহুজাতিক কোম্পানির শাখাগুলো সব সময় বিশ্বব্যাপী স্বল্প মজুরি এবং বৃহত্তর বাজারের অন্বেষণে থাকে। সুতরাং এসব কোম্পানি কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা দেশের টেকসই প্রবৃদ্ধি গঠনে নির্ভরযোগ্য হতে পারে না; তবে এসব কোম্পানি জ্ঞান বিনিময় এবং শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উত্স হিসেবে সেবা প্রদান করে।’

জোমো এবং উইয়ের যৌথ উদ্যোগে করা মালয়েশিয়ার কেস স্টাডিও মধ্য মেয়াদ থেকে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় প্রাযুক্তিক সক্ষমতা সৃষ্টির কৌশলগত দিকটিকে আবশ্যিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের বেলায়ও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং এখনো বিবেচিত হচ্ছে।

৭. প্রাযুক্তিক জ্ঞান অর্জন এবং নব-উদ্ভাবন: কোনো দেশের জাতীয় উদ্ভাবনব্যবস্থা সৃষ্টিতে বছরের পর বছর নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং প্রাযুক্তিক জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রাখা জরুরি। দেশে উন্নয়ন যদি কাঙ্ক্ষিত ধাপ অতিক্রম করে তখন নতুন নতুন নীতিগ্রহণের চ্যালেঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিষয়টি বোঝার ক্ষেত্রে কোরিয়ার ওপর লির কাজটি বেশ কাজ দেবে। প্রয়োজনীয় অংশ পাঠকের সুবিধার্থে উদ্ধৃত করলাম:

সুতরাং স্থানীয় ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উন্নয়নের মানদণ্ডে উন্নীত করতে হলে অগ্রণী এজেন্সির মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে নির্দেশনা প্রদান এবং সমন্বয়সাধনের প্রয়োজন হয়। এটা প্রয়োজন হয় এ কারণে, প্রধান সম্পদ এতই অপ্রতুল যে এসব সম্পদকেই বিভিন্ন সেক্টর বা প্রজেক্টে বারবার ব্যবহার করা লাগে। বিষয়টি বুঝতে গারসেনক্রন (Gerschenkron) খুব কাজ দেয়; যিনি বিশ্লেষণ করেছেন জার্মানি ও রাশিয়ার পরে আসা শিল্পায়নে বৃহত্ রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ ব্যাংক পুরো প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। এটা এমন অনুঘটক, যা শিল্পায়নপ্রত্যাশী দেশের বিভিন্ন ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে। প্রতিটি পূর্ব-এশীয় দেশই এ রকম সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে, যা পুরো শিল্পায়নপ্রক্রিয়ার দেখভাল করে। কোরিয়া ষাটের দশকে পার্ক শাসনামলে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পর্ষদ, শিল্পনীতি ও রপ্তানি সহায়তায় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং অর্থসংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠাসহ এ রকম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গঠন করে।

উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ উভয়কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। অবশ্য, প্রথম দিকে রাষ্ট্রকেই আবশ্যিকভাবে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হয়। পরবর্তী পর্যায়ে প্রযুক্তিগত সামর্থ্য সৃষ্টিতে উদ্ভাবনের প্রাক্-প্রতিযোগিতামূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক সময়ে বেসরকারি-সরকারি অংশীদারির ওপর নির্ভর করতে হয়। (খান ২০০৪)

৮. প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি সহায়তা: প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও সহায়তা উপরিউক্ত দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে সম্ভবত বেশি ভূমিকা রেখেছে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে। সহায়তার তুলনায় বোধ হয় বাইরের বিনিয়োগ অধিকতর তাত্পর্যবহ। এমনকি অভ্যন্তরীণ ও রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উত্পাদন খাতের মতো বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। খাতওয়ারি হিসেবে উত্পাদন খাত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। ১৯৮৮-২০০৬ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনামে বিদেশি প্রত্যক্ষ পুঁজির ৫২ শতাংশ, পরিবহন, স্টোরেজ এবং যোগাযোগের ৯৬ শতাংশ, প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ এবং আবাসনের ৮ শতাংশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। (থোবার্ন ২০০৮, পৃষ্ঠা ৮)

থোবার্নের লেখায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগই যে উন্নয়নের একমাত্র চাবি নয়, তারও প্রমাণ মেলে। স্ববিরোধী হলেও সত্য, ভিয়েতনাম গতানুগতিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও প্রতিযোগিতার পদক্ষেপে খুব একটা ভালো করছে না, তবু এখনো পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের কাছে বেশ সমাদৃত। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস (Doing Business) জরিপে ভিয়েতনাম ব্যবসাবান্ধব ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১৪৪তম স্থানে আছে। ২০০৭ সালের ভিডিআর থেকে জানা যায়, জাপানি বিনিয়োগকারীরা ভিয়েতনামকে বিশ্বের তৃতীয় আকর্ষণীয় বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে। মনে হয়, আন্তর্জাতিক জরিপগুলোতে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সবিস্তার বর্ণনার বিষয়টিতে ভিয়েতনামের স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ, উচ্চমান ও নিম্ন শ্রম ব্যয় এবং নিম্ন অপরাধ হার অধিকতর গুরুত্বসহযোগে বিবেচিত হচ্ছে (থোবার্ন ২০০৮, পৃষ্ঠা ৭)। বিদেশি সহায়তা, সুনির্দিষ্টভাবে বললে, জাপানি সহায়তা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এশীয় দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের জন্য সহায়তার আসল পরিমাণ থেকে এর সুবিধা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

৯. দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল: প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে দারিদ্র্য বিমোচনের মতো বিবিধ নীতি নির্ধারণ বেশ ফল দেয়। যদিও প্রবৃদ্ধি স্বয়ং দারিদ্র্য বিমোচনের মতো কৌশলগত অনুষঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তবু সব ক্ষেত্রে গ্রামীণ ও শহুরে দারিদ্র্য কমাতে সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ জরুরি। অবশ্য চীনের ক্ষেত্রে ১৯৯৫ সময় নাগাদ এসব বিষয় খুব উপেক্ষিত বা বিপরীত ছিল, যদিও বর্তমান নেতৃত্ব এসব বিষয়ে বেশ যত্নবান এবং একই সঙ্গে এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আবার থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম সরকারের একটি ভারসাম্যপূর্ণ সামঞ্জস্যশীল দরিদ্র জনগোষ্ঠীমুখী উন্নয়ন কৌশল গ্রহণে যথেষ্ট মনোযোগ আছে। এটাকে বিবেচনা করা হয় উন্নয়নের ‘উদ্বৃত্ত প্রবৃদ্ধি’ কৌশল হিসেবে (ওয়েস ও খান ২০০৬)। ওপরে আলোচিত নয় ধরনের অনুঘটের বাইরেও কিছু তাত্ক্ষণিক অথচ ঐতিহাসিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুঘটক আলোচনার দাবি রাখে। মালয়েশিয়ার কেস স্টাডির ক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে এসব অনুঘটকের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে। এমনকি অন্যান্য ক্ষেত্রে ত্বরিত দৃষ্টি দিলেও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ঘটনা যেমন বিপ্লব কিংবা যুদ্ধের মতো ঘটনায়ও অধিক পরিবর্তন যে হতে পারে তার ইঙ্গিত দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, ষাটের দশকে কোরিয়ায় পার্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অধিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। জোমো ও ইউর গবেষণা থেকে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন সময়ে পাঁচ ভিন্ন রকম নীতির শিক্ষা পাওয়া যায়।

কোনো তাত্ক্ষণিক অর্থনৈতিক সক্ষমতার ভিত্তিতে কোন নীতি সফল কি ব্যর্থ, তা মূল্যায়ন করা কঠিন। মালয়েশিয়া খুব উন্মুক্ত অর্থনীতির দেশ হওয়ায় অনেক সময় অনির্ধারিতভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়।

১৯৮৫ সালের প্লাজা অ্যাকর্ডে ইয়েন শক্তিশালী হওয়ায় মালয়েশিয়ার সার্বভৌম বিদেশি ঋণ (sovereign foreign debt) ইয়েন-নিয়ন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল। আশির দশকের আর্থিক মন্দা মালয়েশিয়ায় ব্যাংকিং সংকট তৈরি করেছিল, যা ১৯৯৭-৯৮ সালে চরমে পৌঁছেছিল। পরবর্তী সময়ে এই সংকট উত্তরণে দেশটি ব্যাংকব্যবস্থায় ব্যাপক সংশোধন করে, যা প্রথম দিককার আর্থিক উদারনীতিকরণ-জনিত অনিয়ম ঠেকাতে বেশ কাজে লেগেছিল। আশির দশকের শেষের দিকের নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্কার দেশটির বাইরের ব্যক্তি খাতের অর্থঋণকে সঠিকভাবে উত্সাহিত করে ওই খাতের অরক্ষণীয়তা কমিয়ে দিয়েছিল। রাশিয়া ও এলটিসিএম (LTCM) সংকট অনুসরণে আটানব্বই সালের শেষ পাদের পূর্ব এশীয় অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের সফলতা মাহাথিরের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে তাঁর ডেপুটিকে রাজনৈতিকভাবে নিঃশেষ করার বিতর্কিত পদক্ষেপের প্রভাবে ম্লান হয়ে যায়।

ওপরের আলোচনার সূত্র ধরে আমি মনে করি, আপেক্ষিকভাবে অধিক সামঞ্জস্যশীল অনুঘটকগুলো বিবেচনায় রেখে একুশ শতকের উন্নয়ন ও শিল্পায়নের সমস্যা মোকাবিলায় বাস্তবধর্মী ও উত্তরণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। একই সঙ্গে ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করাও জরুরি। বাজারসহ অন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাও সমানভাবে কমানো গুরুত্বপূর্ণ। ব্যর্থতা এড়াতে বৃহত্ ও পূর্বনির্ধারিত উন্নয়ননীতি গ্রহণের বিপরীতে বিভিন্ন বিপরীতধর্মী নীতি গ্রহণের ইচ্ছাই হবে সর্বোত্তম উন্নয়ন রেসিপি। এশীয় দেশগুলোর প্রতিষ্ঠান নির্মাণের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই আকার দেওয়ার চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালো কাজের তালিকাকরণেই তারা বেশি মনোযোগী। প্রকৃত প্রস্তাবে, এখানে জটিলতার সঙ্গে সংগতি বিধান করে একই কাজ অনেক প্রতিষ্ঠান করে থাকে। এশীয় দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট, এখানে প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পত্তির তাত্ক্ষণিকমতো নিরাপত্তা, চুক্তির কার্যকারিতা এবং বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত করাসহ স্থিত কৌশলগত প্রলুব্ধকর নীতির বিপরীতে কেবল উপরি পর্যায়ে আপাতনিশ্চয়তা দেয়। তা ছাড়া এসব দেশ আবশ্যিকভাবে কঠোর রক্ষণশীল আর্থিক অবস্থান ছাড়াই সামাজিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করে। সময়ের আবর্তে প্রদত্ত পর্যাপ্ত আর্থিক উন্নয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি খাতের মধ্যবর্তীদের আর্থিক ঝুঁকি গ্রহণের নিশ্চয়তা দেবে। সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধির উন্নয়নে সামাজিক বীমা এবং নিরাপত্তা সুরক্ষা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে এবং একই সঙ্গে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু সেখানে সব-কাজে-জুতসই হয় এমন কোনো একক পদ্ধতি থাকবে না।

প্রতিযোগিতার দিক থেকে বাংলাদেশ কোথায়?

বৃহত্তর রাজনৈতিক অর্থনীতিতে কৌশলগত পরিপ্রেক্ষিতের শক্তি ও দুর্বলতাগুলো দেখা হয়েছে এখানে। অতীতে ব্যাপক অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও এক দশকের অধিক সময় থেকে বাংলাদেশে বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপি ৫ শতাংশ বা তারও বেশিতে থাকছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে (এডিবি) কর্মরত সময় আমি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে কিছু প্রতিবেদন লিখেছি। এসব গভীর গবেষণার ভিত্তিতে আমি দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার কথা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি। ফলপ্রসূ জনসংখ্যা পরিকল্পনা নীতিসহ কিছু দেশপ্রেমিক কর্মী ও আওয়ামী লীগের নেতা এবং তাদের মিত্রের তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন-প্রচেষ্টা অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক সাফল্য নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের কিছু সূচকে দারুণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার অধিক ঘোরতর সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার আগে বাংলাদেশের শক্তি-সামর্থ্যের একটি সংক্ষিপ্তসার তৈরি করব।

বাংলাদেশের শক্তিসমূহ:

১. আপেক্ষিকভাবে সমজাতীয় জনসংখ্যা, তবে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকতর সুরক্ষার প্রয়োজন।

২. ঐতিহাসিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও সহনশীল জনগোষ্ঠী, তবে ১৯৭৫-পরবর্তী কিছু সমস্যা বিদ্যমান।

৩. প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুতসহ বিকাশমান ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অর্থনীতির সন্নিবেশ।

৪. যোগাযোগব্যবস্থা ও বাহ্যিক অবকাঠামোর উন্নয়ন।

৫. ক্ষুদ্রঋণ এবং অন্যান্য দারিদ্র্য বিমোচন নীতিতে সাফল্য।

৬. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতিতে সাফল্য।

৭. দেশের ভেতরে অর্ধদক্ষ শ্রমিকের ক্রমবর্ধিত সংখ্যা এবং ব্যাপকসংখ্যক দক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিকের বাইরে গমন।

৮. অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সঞ্চয়; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওতে মানবসম্পদ এবং বিবিধ প্রতিষ্ঠানগত ও পেশাগত ক্ষেত্রে মানবসম্পদের সম্মিলন।

৯. ঐতিহাসিক পরিপ্র্রেক্ষিত থেকে জনপ্রিয় সংস্কৃতি, চেতনা এবং সামাজিক চর্চার বৃহত্তর অংশ এখনো গোঁড়ামি, কঠোরতা ও অসহিষ্ণুতা থেকে মুক্ত। বাঙালির খুব ক্ষুদ্র একটা অংশের মধ্যে এসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই ক্ষুদ্র অংশ ক্ষমতা ও ধ্বংসযজ্ঞের উপায়ের দিক থেকে ধ্বংসাত্মক ও পীড়নকারী। ন্যায্যতার সঙ্গে বলা যায়, অধিকাংশ বাঙালি এসব ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞ কোনোমতেই সমর্থন করে না। এই বিবৃতি সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী নীতির ব্যাপক সমর্থনের প্রমাণের সঙ্গে প্রতিপাদনযোগ্য।

১০. ব্রিটিশরাজ এবং পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার মতো অধিকতর শক্তিশালী অথচ অন্যায্য রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাস বিদ্যমান। এসব সফল সংগ্রাম আমাদের শিক্ষা দেয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অভিনবত্বের সুপ্ত শক্তি আছে। তবু আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি, এই অভিনবত্বের জন্য পূর্বশর্তসমূহ কী?

বাংলাদেশের উন্নয়নের কিছু কৌশলগত সমস্যা

পাঁচ প্রধান কৌশলগত সমস্যা: আমি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কৌশলগতভাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যেগুলোকে মনে করি, প্রথমে সেগুলোতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। তারপর আমি বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষয়টি কৌশলগত গুরুত্বের জায়গা থেকে আলোচনা করব, যাতে আমরা সংকট-তাড়িত সমাধানে পৌঁছাতে পরি। পরিশেষে, আমাদের প্রগতিশীল সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক শক্তিকে কৌশলগত জায়গা থেকে সংযুক্ত করে এমন দশটি প্রশ্ন উত্থাপন করব। কৌশলগত সমস্যাগুলো নিম্নরূপ:

১. সংসদীয় সাংবিধানিক রাজনীতির সমস্যা—প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা।

২. অর্থনৈতিক ন্যায্যতা, শ্রেণী, লিঙ্গ, নৃতাত্ত্বিক ও সংখ্যালঘুদের সমস্যা।

৩. সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং নতুন ধনিক শ্রেণী ও সর্বহারা শ্রেণীসহ পেছনে পড়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যকার পৃথকীকরণের সমস্যা।

৪. বলিষ্ঠ নাগরিক সমাজ সৃষ্টিতে সমস্যা।

৫. আন্তর্জাতিকভাবে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সঙ্গে সংযুক্তি এবং গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিসমূহ থেকে বিযুক্তির সমস্যা।

অনেক জটিল ঐতিহাসিক কারণে এসব সমস্যা অমীমাংসিত থাকা বা বিগত কিছু দশকে বড়জোর এসব সমস্যা সমাধানে আংশিক প্রচেষ্টার বিষয়টি গভীর বিতর্কের বিষয়বস্তু। এই বিতর্কে না জড়িয়ে আমি রাজনৈতিক ও নাগরিক সংস্কৃতি বিনির্মাণের সমস্যা সম্পর্কে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই, যার সমাধান না করে বিশ্বের কোথাও গণতন্ত্র কাজ করতে পারে না। আমি এটা করছি এ কারণে নয় যে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জিনের মতো এ সংস্কৃতি অপরিবর্তনীয় কোনো বিষয় নয়। বরং জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে সংস্কৃতি সৃষ্টি করা সম্ভব। বলা যায় এটি মানবসৃষ্ট। অধিকন্তু সেখানে যুক্তি-তর্কের ঐতিহ্যসহ দেশীয় সম্পদ আছে, যা অমর্ত্য সেন এবং অন্যরা বিশেষভাবে লক্ষ করেছেন।

সম্ভবত, সূক্ষ্ম পর্যায়ে এ সমস্যার সর্বোত্তম চিত্রায়নণ দেখা যায় অধ্যাপক আহরাব আহমেদের লেখায়। তাঁর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের সমস্যা কোন দল রাষ্ট্র পরিচালনা করে তা নয়, বরং কোন শ্রেণী থেকে নেতৃত্ব আসে এবং তারা আচরণগত বা দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে কোন ধরনকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি, যেখানে অভিজাতদের অস্বাভাবিক ভোগ, ঔদ্ধত্য, সংস্কৃতি, হতাশাবাদ এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আইনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ‘মর্যাদা ও ক্ষমতার’ নমুনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি এমন একটি পরিবেশ যেখানে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি সমানভাবে জায়মান।’

আমাদের নেতারা তাঁদের সঙ্গে মতের অমিল হওয়া যেকোনো ব্যক্তির দেশপ্রেমে সংশয় প্রকাশ করেন, তাঁরা তাঁদের বাকসর্বস্ব জবানিতে ষড়যন্ত্র শব্দটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন এবং বিরোধী পক্ষকে অবজ্ঞাসূচক অসহিষ্ণুতা এবং ক্ষুদ্র প্রতিহিংসার মাধ্যমে হেনস্তা করেন।

নেতারা ভাষার অলংকারের মাধ্যমে যেভাবে নিজেদের উপস্থাপন করেন এবং পরে কীর্তিকলাপে উদাহরণ সৃষ্টি করেন, তার মধ্যে প্রায় স্ববিরোধিতা দেখা দেয়। নমুনাস্বরূপ, আপাতভাবাবেগে তাঁরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কথা বললেও সন্তানদের পাঠান ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, তাঁরা পরিবেশগত সংকটে ব্যাপক উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন কিন্তু নাগরিক যাতনার ব্যাপারে কোনো রূপ কর্ণপাত না করে উঁচু উঁচু দালান নির্মাণ করেন। তাঁরা নৈতিক স্বচ্ছতার কথা হরহামেশা বলে থাকেন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অবৈধ সুবিধা এবং ঘুষ গ্রহণের নৈতিক টিকিটিকে উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখেন না।

তাঁরা উত্তেজনা, সংঘর্ষ ও নৈরাজ্যের রাজনীতির চরম নিন্দা করলেও প্রথম সুযোগে আবার তাঁরাই তাতে যুক্ত হন। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে গৌরবান্বিত করে অথচ সংসদকে অবমাননা করতে দ্বিধা করেন না, তাঁরা ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে মসজিদ ও রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট দেয়ালের কথা বলে অথচ সৌদি আরবে তাঁদের ঘন ঘন সফর নিশ্চিত করেন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। তাঁরা জনগণের সঙ্গে চিরকালীন সংহতি প্রকাশ করেন কিন্তু জনগণের ওপর আরোপিত নীতি এবং রাজনৈতিক কৌশলের কারণে সৃষ্ট ভোগান্তির ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করেন না। তাঁরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ব্যাপক সোচ্চার অথচ সাংবাদিকদের লেখনীতে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য বেরিয়ে এলে সাংবাদিক পেটাতে এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে দ্বিধা করেন না। তাঁরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অন্যের প্রতি আদর্শিক অঙ্গীকারকে উত্সাহ দেন কিন্তু নিজেকে হীন ঝগড়াঝাঁটি এবং অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নিবৃত্ত করেন না। একই সঙ্গে পরিবর্তনশীল মৈত্রী এবং ভাসমান আনুগত্যের মাধ্যমে তাত্ক্ষণিক সুযোগ-সুবিধার জন্য ‘বহুরূপী’ হিসেবে নিজেদের ভোল পাল্টাতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। রাজনৈতিক অভিভাবকেরা সহজেই বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যকে জলাঞ্জলি দেন এবং অন্যের কাজকে ভণ্ডামি তকমা দিয়ে তাকে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ প্রতিপন্ন করেন। তাঁরা এতই ক্ষমতালোভী যে কোনো নৈতিক কর্তৃত্বের ধার ধারেন না। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই অসাধারণ ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বও আছে। যা হোক, সাধারণত তাঁদের সামষ্টিক প্রয়াসে উত্তরাধিকারভিত্তিক চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে একটি সহযোগী পুঁজিবাদের উন্মেষ ঘটে এবং রাজস্বপ্রত্যাশী শোষক রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটে। যেটি পুরোপুরি ‘ব্যর্থ’ না হয়ে কিছু সময় ধরে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। একই নেতৃত্বদানকারী শ্রেণীর হাতে একই নির্দেশনায় এই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। যদি আমরা শিয়ালের হাতে মুরগির খোঁয়াড় রক্ষার দায়িত্ব দিই, তাতে কোন দল ক্ষমতায় আসে, প্রশাসনিক কী পরিবর্তন হয় এবং কোনো জায়গায় কোনো কার্যবিধি কার্যকর হয় কি না, তা চিন্তিত হওয়ার কি কোনো মানে হয়? আর যদি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা অভিজাতদের কর্মকাণ্ড, আচার-আচরণ এবং মূল্যবোধসহ সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে বিশ্বাসযোগ্য উপায় বের করতে না পারি, তবে গণতান্ত্রিক সম্প্রীতি সন্দেহজনক হবে। এটা মনে রেখে আমাদের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যেক টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য করতে আমি দশটি কৌশলগত প্রশ্ন উপস্থাপন করছি, যার উত্তর না মিলিয়ে আমরা সামনে এগোতে পারব না:

১. নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্র কীভাবে জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও করপোরেট গোষ্ঠীর সম্পত্তির সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেবে?

২. কীভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায় এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসা যায়?

৩. নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা কীভাবে প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা যায়?

৪. কীভাবে সংসদীয় ব্যবস্থাকে কার্যকর করা যায়?

৫. অবকাঠামো, শিল্পায়ন এবং সার্বিক মানব উন্নয়নে কীভাবে সর্বোচ্চ সামাজিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যায়?

৬. কীভাবে আমলাতন্ত্র, সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীকে জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসা যায়?

৭. জনগণের ক্ষমতায়ন এবং সেবা প্রদানে স্থানীয় সরকারকে কীভাবে কার্যকর করা যায়?

৮. স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ শক্তিশালী করে কীভাবে দুর্নীতি ও লোভ পদ্ধতিগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?

৯. উত্পাদনশীল এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন নাগরিক তৈরিতে কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করা যায়?

১০. সার্বিক মানব ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে কীভাবে দারিদ্র্য কমিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থবহভাবে পুরো উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করানো যায়?

বাংলাদেশ পূর্ব এশীয় কৌশলগত পথে নেই অথচ সে পথে যাওয়া দরকার

আশির দশকের মাঝামাঝি না হলেও মধ্য নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। অবশ্য প্রতিবছর দেশকে ৫-৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারে উন্নীত করতে পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় কঠিন কিছু নয়। তবে পূর্ব এশীয় প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রীয় দিক, বিশেষত মাধ্যমিক ও চূড়ান্ত পর্যায়ে শিল্পায়নপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে উত্পাদন ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করে ব্যাপকভিত্তিক কাঠামোগত পরিবর্তনের দিক থেকে বাংলাদেশ অনেকখানিই পিছিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব এশীয় প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়নকে এগিয়ে নিতে কৃষির বোঝাস্বরূপ জনশক্তিকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছিল। এ রকম কৌশল কৃষির শ্রম উত্পাদনশীলতা ও অর্থনীতির অন্য খাতের শ্রম উত্পাদনশীলতার মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে এনেছিল। এমনকি আমরা যদি জাতীয় হিসাবের পদ্ধতিগত পরিবর্তন করি, যার ফলে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় দ্বিগুণের চেয়ে অধিক হয়েও যায় এবং বিনিয়োগ হার অব্যাহত ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার বিষয়টিকে উপভোগ করি, তবু পূর্ব এশীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সঞ্চয়ী বিনিয়োগের কার্যকারিতা কম। যেখানে পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে ব্যাপক ঊর্ধ্বমুখী বিনিয়োগ কালেস্কিয়ান ভঙ্গিতে (Kaleckian fashion) অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়কে বাড়িয়ে তুলেছে, সেখানে ধীরে ধীরে লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের দুর্বল প্রণোদনা ও লাভযোগ্যতার শক্তিশালী অবস্থানগত প্রামাণিক ঘাটতির কারণে যথেষ্ট পরিমাণ সঞ্চয়ও পুঁজি পাচারে পর্যবসিত হয়। উন্নয়নের তুলনামূলক পর্যায়ে পূর্ব এশীয় বিনিয়োগ হার প্রত্যক্ষভাবে উত্পাদনশীল খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং বৃহত্ উত্পাদনশীল অবকাঠামো নির্মাণে অর্থ জোগান দিয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, বাংলাদেশে অপ্রতুল বিনিয়োগই হলো প্রত্যক্ষ উত্পাদনশীল খাত এবং সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে প্রধান বাধা। বাংলাদেশে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি পরিমাণগত দিক থেকে যথেষ্ট। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, এ ক্ষেত্রে পূর্ব এশীয় রপ্তানি প্রবৃদ্ধির তুলনায় বৈচিত্র্য ও পুনঃপুন ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তনের দিক থেকে ঘাটতি আছে। অবশ্য বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে, সুরক্ষিত বাজারব্যবস্থায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের রপ্তানি ছিল একটি ঐতিহাসিক দুর্বিপাক, যা বর্তমান বাণিজ্যিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করতে পারে। এই খাতটি আর বেশি দীর্ঘস্থায়ীভাবে টেকসই হবে না। অধিকন্তু, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং ধারাবাহিক বিদেশি সহায়তানির্ভরতা কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সম্পদ অভিশাপ প্রপঞ্চ তৈরি করছে, যা অতীতে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে যথাযথভাবে মোকাবিলা করা হয়নি।

চীন বাদে পূর্ব এশীয় অগ্রগামী দেশগুলো অসমতা দূর করে মাথাপিছু জিডিপি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়। তবে বাংলাদেশে আয়ের দিক থেকে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেলেও সম্পদের অসমতা বিদ্যমান। এটার অর্থ হলো, কোনো নির্দিষ্ট প্রবৃদ্ধি হারের তুলনায় দারিদ্র্য তুলনামূলক কম হারে কমছে, যা পূর্ব এশীয় দেশের চেয়ে ভিন্ন।

জনসংখ্যার দিক থেকে যদিও বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দশকে জন্মহার প্রশংসনীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে, তবু এই অর্জনের বিস্তারের ব্যাপারে কিছু অনিশ্চয়তা আছে। এমনকি যদি এই অনিশ্চয়তা তিরোহিতও হয়, তবু একটি তুলনামূলক বিচারে দেখা যায়, উন্নয়নের তুলনামূলক স্তরে পূর্ব এশীয় অর্থনীতি যে ধরনের জনমিতিক রূপান্তরে সমর্থ হয়েছিল, বাংলাদেশ সে ধরনের জনমিতিক রূপান্তর ঘটাতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।

অবশ্যই এটা নিঃসংকোচে স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশের অনুসরণকৃত উন্নয়ন পথ আর পূর্ব এশীয় দেশগুলোর উন্নয়নধারা একই নয়। বাংলাদেশকে অবশ্যই নিছক বৃদ্ধির অকৌশল পরিত্যাগ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পূর্ব এশীয় কৌশল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার মানে কী হতে পারে?

বাংলাদেশ অর্থনীতির একজন চিন্তাশীল পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে, ‘স্বাধীনতার সময় থেকে বাংলাদেশ সব মানের দিক থেকে একটি আমদানি-বিকল্প শিল্পায়নপ্রক্রিয়ার (ISI) উত্তরাধিকারী। অতি মূল্যের বিনিময় হার, আমদানি কোটা, অভ্যন্তরীণ বাজারে শিল্পের উন্নয়নে উঁচু অথচ বিভিন্ন হারের সার্বিক সুরক্ষা এবং রপ্তানির বিপরীতে শক্তিশালী বৈষম্য (যা আসলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে রপ্তানি বোনাস স্কিম বাতিল হওয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত পণ্যের রপ্তানির অনুমোদন প্রাথমিক অর্থনীতিকে অবমূল্যায়নের দিকে নিয়ে যায়)। এই অর্থনীতি পণ্য এবং ফ্যাক্টর মার্কেট পরিচালনায় ব্যাপক প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেছিল। এ ক্ষেত্রে শিল্প ও আধুনিক সেবা উদ্যোগের গণমালিকানা ছিল ব্যাপক, আরোপিত দাম এবং বণ্টনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ছিল সর্বব্যাপী, আধুনিক খাতে সুদের হার এবং মজুরি ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং ব্যক্তি খাত বিবিধ নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল।’

এটা স্পষ্টভাবে বলা যায়, সত্তরের দশক এবং তত্পরবর্তী সংস্কারপ্রক্রিয়া অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি এনেছিল। নব্বই দশকের বাণিজ্যব্যবস্থা কোটার বিলোপ, শুল্ক হারের ব্যাপক হ্রাসসহ বিনিময় হারের উদারনীতিকরণ ঘটিয়েছিল।

আইএসআই পদ্ধতির প্রণোদনার ব্যাপারে চূড়ান্ত বিরতির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যক্তি খাত ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে জোর এবং অধিকাংশ শিল্পকারখানা, ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির বেসরকারীকরণের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নব্বই দশক থেকে রেশনব্যবস্থাসহ খাদ্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের গণবণ্টন বিলুপ্ত হয়। আর্থিক দিক থেকে দেশে বাজার হারের সঙ্গে সংগতি রেখে আসল সুদের হার বেড়ে গিয়েছিল এবং কৃষি ভর্তুকি কমে গিয়েছিল। যদিও এসব পদক্ষেপের বিপরীতে বিকল্প সামঞ্জস্যশীল নীতি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। এ ক্ষেত্রে এ আর খানের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য:

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অনুপ্রেরণায় অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সংস্কার কার্যক্রম হিসেবে উচ্ছেদন কাজ সমাপ্ত করার টার্গেট নির্ধারণ করে। এ সংস্কারের পেছনে যে গোঁড়ামি আসলে কাজ করে তা হলো কোনো বিকল্পই জরুরি নয়: দাম, সুদ এবং মজুরির ‘সঠিক’ হার প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সঠিক সঞ্চয়, বাইরে থেকে পুঁজি আহরণ এবং বিনিয়োগের লাভযোগ্যতাকে উত্সাহ প্রদান করে। এখানে একে অপরের কাজকর্মে অল্প-স্বল্প প্রণোদনা এবং নির্দিষ্ট ধরনের রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্বাচিত সহায়তা থাকে। কিন্তু এখন অতীতের আইএসআই প্রক্রিয়ায় প্রণোদনার বিপরীতে ক্ষতির ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট কম। একই সঙ্গে শিল্পের বিকাশকালে যে ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা পরিবর্তনেও প্রণোদনা কম। এমনকি আমদানির বিপরীতে রপ্তানিতে কার্যকর বিনিময় হার প্রদানের ব্যাপারে আদৌ বাণিজ্যব্যবস্থার কার্যকর উদ্যোগ থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।

সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকটের পর এটা স্পষ্ট যে ওপরের তাত্ক্ষণিক দৃষ্টিভঙ্গি বাজারব্যবস্থার ফলপ্রসূতা সম্পর্কে সরল বিশ্বাস মারাত্মকভাবে মহাদুর্ভোগের কারণ হচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে ওয়াশিংটন মতৈক্যের (Washington Consensus) এসব আরোপণ মুক্তবাজারে কার্যকর সম্পদ বণ্টনের মাধ্যমে তাদের নির্ধারিত প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে খানের যুক্তি দেখা যাক: ‘অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস এমন এক আদিম গোঁড়ামিতে পড়ে আছে, যা আমাদের শেখায় কেবল মুক্তবাজার ও মুক্তবাণিজ্যমুখী সংস্কারই পর্যাপ্ত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। অর্থনৈতিক তত্ত্বে বাস্তবে এমন অনেক অনুমানও আছে, যা মুক্তবাজারে ‘বাজার ব্যর্থতার’ সর্বব্যাপী প্রপঞ্চের কথা বলে। অবশ্য এসবের অধিকাংশই উন্নয়নশীল অর্থনীতির বেলায় প্রযোজ্য। পুরো উন্নয়নের ইতিহাসে এমন কোনো সফল উন্নয়ন নমুনা পাওয়া যাবে না, যা উন্নয়ন তথা শিল্পায়নপ্রক্রিয়ায় ব্যাপক প্রণোদনা দাবি করে। বিষয় হলো, বাংলাদেশে বাজার সংস্কার বাস্তবায়িত হলেও তা একটি সমন্বিত প্রণোদনাব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্পায়ন এবং রপ্তানির উন্নয়ন ঘটায়নি। বস্তুত শিল্পপ্রক্রিয়ার উন্নয়নে আইএসআই ব্যবস্থা ছিল একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা। যখন বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুরক্ষিত শিল্পের উচ্চ লাভযোগ্যতা এবং রাজস্বের যথাযথ প্রয়োগে সঞ্চয় বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখন উচ্চ মুনাফা হারের এই সুরক্ষিত সঞ্চিত সম্পদ প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে কাজে লেগেছিল। সমস্যা হলো, এটা অদক্ষতা এবং অসম সুরক্ষায় অপচয়মূলক সম্পদ বণ্টন, রপ্তানি-প্রতিকূল বৈষম্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের বিযুক্তিকে ত্বরান্বিত করে। আইএসআই ব্যবস্থা বিলোপের অধিকার নিঃসন্দেহে আছে। তবে এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিপরীতে বিভ্রান্তি এবং অদক্ষতা এড়াতে একটি অগ্রগতিমূলক পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে।’

অধিকন্তু, এরশাদ কিংবা বিএনপি আমলের প্রথম দিককার ‘সংস্কার’ তাদের সমর্থকদের দাবির বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ঐতিহাসিক দলিল থেকে প্রতীয়মান হয়, সম্পদ বণ্টনেও যথেষ্ট অদক্ষতা ছিল। কোরনাই (Kornai) দেখিয়েছেন, যদি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে এজেন্টকে উদারীকৃত মূল্যে সাড়া দিতে উত্সাহ দেয়, তবে মূল্য সংস্কার বিপরীতমুখী ফল নিয়ে আসে, এটাই বোধ হয় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে (কোরনাই, ১৯৮০)। এ ক্ষেত্রে নিচের মতটি মনোযোগ দাবি করে:

তিনি যুক্তি দেখান মূল্য সংস্কার অর্থহীন যখন ‘নমনীয় বাজেট বাধা’ সর্বব্যাপী ভূমিকায় অর্থনৈতিক অনুঘটককে কার্যকরী হতে বাধা তৈরি করে। যে কেউ তর্ক তুলতে পারে অন্যান্য সংস্কারমূলক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে মূল্য সংস্কার এবং প্রণোদনার নির্দেশকগুলো সর্বব্যাপী আবেদন তৈরি করতে পারেনি এবং মৌলিক অনুঘটকের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সূচক তৈরির জন্য সম্পূরক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে পারেনি। নামমাত্র সুদ হারের ঊর্ধ্বমুখী অভিযোজনের একটি উদাহরণ বাজার দামে প্রতিফলিত ক্রেডিটের আসল দাম নিশ্চিত করতে পারে। এ জন্য ক্রেডিট বণ্টনের লক্ষ্যটি অধিকতর কার্যকরী হয়েছিল। অবশ্য ধারকারীর ক্রেডিট দামের দিক থেকে ওই উদ্দেশ্যের ফল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার করার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ঋণ-বাধ্যবাধকতার সঙ্গে কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি নিশ্চিত করে না। প্রায়ই পৌনে শতাব্দীজুড়ে এই রকম বিচ্যুতি শাস্তির আওতায় আসেনি, যদিও পর্যায়ক্রমিক সরকারের আলংকারিক অনুশাসনে এ রকম আচরণে শাস্তির বিধান আছে। সাম্প্রতিক দশকের ইতিহাস প্রমাণ করে, সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তো নেই, উপরন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী বিভিন্ন গোষ্ঠীর ইচ্ছায় এটি তৈরি করতে আগ্রহীও নয়। ফলে দাম ও প্রণোদনা সংস্কারের বিষয়টির আইনি দিকগুলো অকার্যকর থেকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সেবায় মূল্য সংস্কারের অন্য উদাহরণ সেবা প্রদান পদ্ধতির সম্পূর্ণ নিঃশেষ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।

আইএসআই পদ্ধতির বিরুদ্ধে অন্যতম যুক্তি ছিল, এ ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক রাজস্ব আহরণে অভ্যন্তরীণ দাম এবং আন্তর্জাতিক দামের মধ্যে যে সংযোগস্থলটি (wedge) ভূমিকা রেখেছিল সেটি ছিল দুর্নীতি, অদক্ষতা ও উচ্চ লেনদেন খরচের উত্স। আইএসআইয়ের বিলোপ এবং ইচ্ছামূলক বাজারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ কমানো প্রিমিয়ামের স্বল্পতা এবং অপব্যয়মূলক রাজস্ব আহরণ দূর করেছিল। এর মাধ্যমে বাস্তবে কেবল রাজস্ব আহরণের প্রকৃতিই পরিবর্তিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমদানি লাইসেন্সের প্রিমিয়াম আত্মসাতের স্থানে ব্যাপক পরিমাণ ‘এজেন্সি ফি’ আত্মসাতের বিষয়টির কেবল বদল হয়েছে। ফলে, যেখানে সরবরাহকারীদের বিদেশি সহায়তা নির্ভরতার চেয়ে রাষ্ট্রীয় আমদানি দাম নিম্নতম পর্যায়ে রাখার জন্য নিলামে প্রতিযোগিতা করার কথা, সেখানে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতাপুষ্ট স্থানীয় এজেন্টদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। অস্বচ্ছ সংগ্রহব্যবস্থা এসব আমদানির ওপর ব্যাপক প্রিমিয়ামস্বল্পতা তৈরি করে। রাষ্ট্রীয় সেবা প্রদানে অসংখ্য সংঘ সৃষ্টি এবং সর্বব্যাপী বিধি আরোপের মাধ্যমেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে পুরো অর্থনীতির ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীর ওপর উচ্চ লেনদেন ব্যয় আরোপ করা হয়েছে। একজন বিনিয়োগকারী কার্যক্রমের প্রতিটি স্তরে এসব খরচ প্রদানে বাধ্য: টেলিফোন সংযোগ পেতে, নির্মাণ অনুমতি পেতে, সরকারের ক্ষমতাপুষ্ট মাস্তানদের মাধ্যমে অবৈধভাবে পণ্য পরিবহনে এবং সর্বোপরি উপযোগিতা বিল ও কর প্রদানসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে খরচ প্রদানে বাধ্য হয়। আসলে এই লেনদেন হলো সুপ্ত মুনাফার মোটা রকম অংশ এবং এটিই পুঁজি পাচারের শক্তিশালী নেতিবাচক প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে।

যদিও কোনো সযত্ন সংখ্যাতত্ত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তবু যে কেউ সুশীল সমাজের সাম্প্রতিক দশকগুলোর বিবর্তিত আলোচনা থেকে এই ধারণা পেতে পারে যে দুর্নীতি বৃদ্ধি ও সুশাসনের অভাবে সেখানে এই রকম লেনদেন ব্যয় ব্যাপক পরিমাণ বেড়ে গেছে। এই সমস্যার সারসত্তা হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা মুনাফা অর্জনে ক্ষমতার ইচ্ছামূলক চর্চাকে অনুমতি দেয়। আইএসআইয়ের অধীনে এটা আমদানি লাইসেন্স এবং বণ্টন পারমিটসহ প্রিমিয়াম আত্মসাতের ধরনে রূপ নেয়। এখন যে অর্থনৈতিক সংস্কার সাধিত হয়েছে, সেটাও ‘গতানুগতিক’ প্রিমিয়াম ধরনের মাধ্যমে নতুন আবিষ্কৃত পন্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আরও ব্যাপক হারে রাজস্ব আত্মসাত্ করে। এই পদ্ধতি আইএসআই পদ্ধতির চেয়ে অধিকতর লুণ্ঠনমূলক। উল্লিখিত সব অদক্ষতা সত্ত্বেও আইএসআইয়ের অধীনে রাজস্ব আত্মসাতের পদ্ধতি, যা আসলে রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে পুষ্ট করে, এর বিপরীতে সুরক্ষিত অভ্যন্তরীণ শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগের শক্তিশালী প্রণোদনা দেয়, এমন উদ্যোক্তাও আছে। আজকের রাজস্ব আত্মসাতের সর্বব্যাপী পদ্ধতি বিনিয়োগকারীদের ওপর ব্যাপক পরিমাণ লেনদেন ব্যয় আরোপ করে এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পুঁজি পাচারে শক্তিশালী প্রণোদনা সৃষ্টি করে। আমি দুর্নীতির বিশালত্বের চেয়ে এই প্রবৃদ্ধি-প্রতিকূল দুর্নীতির ওপর বেশি জোর দিতে চাই।

শিক্ষা এই যে রাজস্ব আত্মসাত্, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকগুলো আপনা-আপনি আসে না। বরং সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও লক্ষ্যাভিমুখী পরিকল্পনার অভাবে এই প্রবণতাগুলো তৈরি হয়। আইএসআইয়ের অধীনে এই কল্পনাসাধ্য রাজস্ব আত্মসাত্কারী ব্যবস্থা সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি লাইসেন্সের নিলাম এবং বাজার-উদ্দীপক অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কমানো সম্ভব। বিপরীতক্রমে, উদারনৈতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও আবশ্যিকভাবে রাজস্ব আত্মসাত্ এবং দুর্নীতি কমাতে পারে না। এমনকি যদি সরকার প্রিমিয়াম আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং বাজারবহির্ভূত পদ্ধতিতে এটার প্রবেশ অব্যাহত রাখে, তবে কোনোভাবে রাজস্ব আত্মসাত্ এবং দুর্নীতি কমানো যাবে না। অভিজ্ঞতা বলে, এ রকম সুযোগ-সুবিধা অশেষ। সুরক্ষিত প্রতিরক্ষায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে অদক্ষতা ও অসমতার মতো অসংখ্য যৌক্তিক পাটাতনে আইএসআই পদ্ধতি সহজেই বাতিলযোগ্য। যদিও আইএসআইয়ের পরিবর্তে উদার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আপনা-আপনি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি এবং রাজস্ব আত্মসাত্ ও দুর্নীতির সমাপ্তি ঘটবে, এমন ভাবাটাও খুব বোকামো হবে।

ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, সংস্কারের ব্যর্থতা কেবল দ্রুত শিল্পায়নকে প্রবর্তন করেনি বরং বর্ধিত অসমতাবিশেষ ব্যাপক রাজস্ব আত্মসাতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পূর্ব এশীয় নীতিগুলোর তুলনামূলক আলোচনায় অসম প্রবৃদ্ধির অধিকতর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে প্রাথমিক ভূমি পুনর্বণ্টন হয়নি। যে কেউ এই ভুলের ন্যায্যতার মুখোমুখি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তি দেওয়া হয়, পূর্ব এশীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের শর্তাবলি অনুকূলে নয়। যখন এই যুক্তি যথেষ্ট সত্যতা অর্জন করতে পারে, তখন বাংলাদেশের কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমি সংস্কারের সুযোগটি এড়িয়ে যাওয়া উচিত ছিল না। ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে যুক্তি প্রচলন আছে, দেশে ভূমির স্বল্পতা বিশেষত পুনর্বণ্টিত জমি এত কম যে তা ভূমি সংস্কারের জন্য খুবই অপ্রতুল। সে সময়ে বাংলাদেশের মতো কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীনে জমিস্বল্পতা থাকলেও সেসব দেশ ভূমি সংস্কার অব্যাহত রেখেছে। জমির পর্যাপ্ততার তুলনায় যেখানে জমির স্বল্পতা বিদ্যমান, সেখানে সমতাভিত্তিক জমি বণ্টন খুবই জরুরি। এ কারণে জমিস্বল্পতা জমির সমানাধিকারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ অবস্থায় অসম জমি বণ্টন কৃষিভিত্তিক আয়ের অসম বণ্টনেরই ইঙ্গিত দেয়। ভূমি সংস্কারের দ্বিতীয় যুক্তি, যেটি বাংলাদেশের জন্য বেশি উপযোগী তা হলো, কোরিয়ায় যেমন পূর্বতন জাপানি মালিকানার সম্পদ ও জমিগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করে জনগণের মাঝে সমভাবে বণ্টন করা হয়েছিল, সে পথে বাংলাদেশেরও যাওয়া উচিত। এখানে বাংলাদেশ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানসহ অন্য দেশগুলোর চেয়ে খুব বেশি সুবিধা পায় না। স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশ পূর্বতন পাকিস্তানি মালিকানার একটা বিরাট অংশ রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করেছিল। এই সম্পদগুলো পূর্ব এশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে বণ্টিত হলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারত। এই সম্পদ লুণ্ঠন এবং জাতীয়করণের নামে ব্যাপক অব্যবস্থাপনায় পতিত হয়।

বাংলাদেশে ভূমি বণ্টন চরম অসমভাবে চলমান। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে বর্গাজমির বৃহত্তর সমতা ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে প্রত্যক্ষ খামার আয় ব্যাপকভাবে উন্নীত হয়, যদিও অসম রাজস্ব আয়ের কারণে এর মোট আয়ের বড় অংশই নিম্নমুখী হয়।

নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান এবং স্বচ্ছন্দ কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে বাধা তৈরি করে। খানের ভাষায়, ‘অসমতা সৃষ্টিতে অন্য অনুঘটক হলো কারখানা ও আধুনিক উচ্চতর কাজের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যর্থতা। আগেই আলোচনা করা হয়েছে, মজুরি হলো আয়ের কতিপয় উপাদানের অন্যতম, যা বাংলাদেশে আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতামূলক প্রভাব রাখে। এখানে কেবল শিল্প খাতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয় তা নয়, বরং এটি কর্মসংস্থান-বৈরী পরিবেশ তৈরিকেও ত্বরান্বিত করে। সংস্কারের মাধ্যমে মুক্তবাণিজ্য সৃষ্টির পর শিল্প প্রবৃদ্ধিতে কর্মসংস্থাপন-বৈরিতা তৈরি হওয়ার বিষয়টি শ্রমঘন অর্থনীতির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির অর্থনৈতিক তত্ত্বের বিপরীতে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? মনে হয়, অতীতের রাষ্ট্রীয় মালিকানার সময়কার শিল্প খাতের প্রাথমিক শর্তের মধ্যেই এর ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে, যখন দক্ষতার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছিল। ১৯৯০-৯১ এবং ১৯৯৯-২০০০ সালের জনশক্তিসম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট জরিপে উত্পাদন খাতে কর্মসংস্থানের ব্যাপক হ্রাসে পুরো কর্মসংস্থানপ্রক্রিয়ায় নিম্নতম প্রবৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরে। এটা সর্বতোভাবে পূর্বেকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উদ্বৃত্ত-শ্রমের ছায়ার কারণে হয়েছিল। এই সংস্কারের প্রতিকূল বণ্টনগত প্রভাব পরিবর্তনে সযত্ন-ক্ষতিপূরণমূলক নীতি প্রণয়ন জরুরি ছিল। কিন্তু সেখানে এ রকম তেমন কোনো নীতিই গৃহীত হয়নি। শিল্প খাতে নিম্ন কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো নিম্ন শিল্প প্রবৃদ্ধি। শিল্প খাত যদি ব্যাপক পরিমাণে গড়ে ওঠে তবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে উদ্বৃত্ত ব্যক্তিগত সামগ্রিক বেতনের রূপান্তর সমস্যা দূর করা সহজতর হবে। পূর্ব এশীয় দেশগুলো এবং বাংলাদেশের বণ্টনগত নীতির অন্য পার্থক্য হলো, মানবপুঁজির সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে দুর্বল সক্ষমতা। নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উত্পাদনশীলতা উন্নয়নে প্রধান বাধা।’

সুশাসন সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক এবং অন্য সংস্থাগুলো অনেক কথা বলে। নিঃসন্দেহে সুশাসন জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের চ্যালেঞ্জ হলো উত্তম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবসম্মত দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। অনেক কিছুই করা বাকি থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিকভাবে সচেতন নবপ্রজন্ম সামাজিক ন্যায়বিচার, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত্ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা এবং বিদেশনির্ভরতা কাটাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কৃষকদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ দেশকে সংহত রাজনৈতিক অর্থনীতি গঠনে বহুদূর নিয়ে যাবে। শহরে মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী শ্রেণী এবং গ্রামীণ কৃষক ও জমি-ধনের অধিকারী দেশপ্রেমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তি গঠনে অবশ্যই নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। এসব শ্রেণীর সার্বিক সহযোগিতায় সক্ষমতা বৃদ্ধির উন্নয়ন প্রবণতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করা জরুরি। জাতি গঠনের জন্য সমাজ থেকে জনবিরোধী উপাদান দূর করে বিদ্যমান দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী নেতৃত্বের সঙ্গে একদল তরুণ নেতৃত্ব গঠন মুক্তিসংগ্রামে শহীদদের কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গঠন সম্ভবপর করবে।

অনুবাদ: হুমায়ুন কবির

গ্রন্থপঞ্জি

Bangladesh Bureau of Statistics, National Accounts Statistics (Gross Domestic Product, 2000-2001), Dhaka June 2001.

Bruton, 1998. Bruton, Henry J., “A Reconsideration of Import Substitution”, Journal of Economic Literature, Vol. 36, No.2.

Chang, 2002. Chang, Ha-Joon, Kicking Away the Ladder: Development Strategy in Historical Perspective, London, Anthem Press.

Chang, H.-J. ed.(2007) Institutional Change and Economic Development, UNU press, Tokyo.

Cline, William R. (1982). “Can the East Asian Export Model of Development Be Generalized?”, World Development, Vol.10, no.2 pp.81-90.

Emmerij, 1987. Emmerij, Louis (Editor), Development Policies and the Crisis of the 1980s, OECD, Paris 1987.

Fields, 2001. Fields, Gary S., Distribution and Development, a New Look at the Developing World, The MIT Press, Cambridge.

Government of Bangladesh, Ministry of Finance (GOB, MOF), Bangladesh Economic Survey, 2000, 2003 and 2007.

GOB, MOF, 2003. GOB, MOF (Economic Relations Division), Bangladesh: A National Strategy for Economic Growth, Poverty Reduction and Social Development, Dhaka, March 2003.

Griffin, Khan and Ickowitz, 2002. Griffin, Keith, A. R. Khan and A. Ickowitz, “Poverty and Distribution of Land”, Journal of Agrarian Change, July 2002.

Griffin, Khan and Ickowitz, 2004. Griffin, Keith, A. R. Khan and A. Ickowitz, “In Defence of Neo-Classical Neo-Populism”, Journal of Agrarian Change, July 2004.

Islam, 2007. Islam, Rizwanul, “What Kind of Economic Growth is Bangladesh Attaining?”, ILO, Geneva.

Jomo K. S. ed. (2007). Malaysian Industrial Policy. Singapore University Press, Singapore, and University of Hawaii Press, Honolulu.

Jomo K. S., Chang Y. T., Khoo K. J. with others (2004). Deforesting Malaysia: The Political Economy and Social Ecology of Agricultural Expansion and Commercial Logging. Zed Books, London.

Jomo K. S. ed. (1995). Privatizing Malaysia: Rents, Rhetoric, Realities. Westview Press, Boulder.

Jomo K. S. with Shyamala Nagaraj eds. (2001). Globalization Versus Development: Heterodox Perspectives. Palgrave, Houndmills.

Jomo, K.S. and Wee (2008) “Lessons From Post-Colonial Malaysian Economic Development”,
paper prepared for WIDER conference on Country Role Models for Development Success, June13-14, Helsinki

Khan, 1988. A. R. Khan, “Population Growth and Access to Land”, in Lee, Ronald D. et. al. (editors), Population, Food, and Rural Development, Clarendon Press, Oxford.

Khan and Hossain, 1989. Khan, A. R. and M. Hossain, The Strategy of Development in Bangladesh, Macmillan and OECD Development Centre, London.

Khan and Riskin, 2001. Khan, A. R. and Carl Riskin, Inequality and Poverty in China in the Age of Globalization, Oxford University Press, New York.

Khan and Sen, 2001, Khan, A. R. and Binayak Sen, “Inequality and Its Sources in Bangladesh, 1991/92 to 1995/96: An Analysis Based on Household Expenditure Surveys”, The Bangladesh Development Studies, March 2001. 30

Khan and Sen, 2006. Khan, A. R. and Binayak Sen, “The Structure and Distribution of Personal Income and Poverty Reduction: A Case Sudy of Bangladesh during the 1990s”,
in Boyce, James et al. (editors), Human Development in the Era of Globalization, Essays in Honor of Keith Griffin, Edward Elgar, Cheltenham, UK and Northampton, MA, USA.

Keynes, J. M.(1971-79), The Collected Writings of John Maynard Keynes, 29 vols., ed., D. E. Moggridge for the Royal Economic Society, London: Macmillan.

Khan HA (2008a). “Building an Innovative Economy through Managed Creative Destruction: A Theory with Applications to South Korea”. Accessed April 2008 at:
http://econpapers.repec.org/paper/pramprapa/7713.htm

Khan ,H.A. (2008b) “Making Globalization Work: Towards Global Economic Justice”, Cosmopolis, May 2008 http://ideas.repec.org/p/pra/mprapa/7864.html

Khan,H. A. (2008c) “China’s Development Strategy and Energy Security”, WIDER research Paper http://www.wider.unu.edu/ publications/working-papers/research-papers/2008/en_GB/ research_papers_2008/

Khan, H. A. 2005, “Case Studies in Globalization, Convergence, and Superconvergence of Emerging Technologies”, presentation at the International Workshop on Emerging Technologies: The Global Challenges of Convergence, Bangkok,14-15 Dec.2005.
http://www.apecforesight.org/emerging_tech/docs/HaiderPresentation_Dec05.ppt

Khan, H. A (2002) “Innovation and Growth in a Schumpeterian Model”, Oxford Development Studies, Vol. 30, no. 3, 2002: 289-306.

Khan HA (2004a). Innovation and Growth in East Asia: The Future of Miracles. Houndsmills and New York: Macmillan/Palgrave.

Khan HA (2004b). Global Markets and Financial Crisis in Asia: Towards a Theory for the Twenty First Century. Houndsmills and New York:Macmillan/Palgrave.

Khan HA (2003a). “Technology and Modernity: Creating Social Capabilities in a POLIS,” In Misa T ed. Technology and Modernity, Cambridge: The MIT Press, Chapter12.
———-(2003b) “What can the African Countries Learn from the Macroeconomics of Foreign Aid in Southeast Asia?”, Aryeetey, E., Court, J., Nissanke, M. and Weder, B., Asia and Africa in the Global Economy, Tokyo, UNU Press.

Khan HA (1998). Technology, Development and Democracy: Limits to National Innovation Systems in the Age of Postmodernism. Cheltenham, United Kingdom: Edward Elgar.

Khan HA (1997). Technology, Energy and Development: The South Korean Transition. Cheltenham, United Kingdom: Edward Elgar.

Khan HA(1983) “Technology, Energy, Distribution and Balance of Payments:A Macroeconomic Framework”, Unpublished dissertation, Cornell University, Ithaca, New York.

Kornai, 1980. Kornai, J., Economics of Shortage, New York, North-Holland.

Lee, Keun (2008) “Can Korea be a Role Model for Development? A “Capability-based View” on Korea”, paper prepared for WIDER Conference on Country Role Models for Development Success,
June13-14, Helsinki

Lee, Keun, 2006, “The Washington Consensus and East Asian Sequencing : Understanding Reform in East and South Asia,” in J. Fanelli and G. McMahon, eds. Understanding Market Reforms Vol. 2: Palgrave, 2006 .

Lee, Keun A., 2006, “Understanding Reform in 6 Asian Countries: Washington Consensus vs. East Asian Sequencing,” J. Fanelli and G. McMahon, eds. Understanding Market Reforms Vol. 2: Palgrave.

Lee, K., Hanh D., and Yifu Lin J., 2002, “Is China following the East Asian Model? A Comparative Institutional Analysis Perspective”, China Review 2: no.1.

Lee K., 2006 b , “China’s Economic Catch-up: Washington Consensus or the Bejing Consensus”, Selected Papers from the 2nd World Forum on China Studies (Abstracts), Panel 2, Exploration into the Theory and Practice of the Mode of China’s Development, in http://unpan1.un.org/intradoc/groups/public/documents/ APCITY/UNPAN024930.pdf
Li-Hua R., 2008,, China’s science and technology capacity building: global perspective and challenging issues (book review), Journal: Journal of Technology Management in China
Vol : 3 Issue: 1

Li-Hua R. and Simon D., 2007, Benchmarking China firm competitiveness: a strategic framework, Journal of Technology Management in China. Bradford: 2007. Vol. 2, Iss. 2.

Mahajan, 2007. Mahajan, Sandeep, Bangladesh: Strategy for Sustained Growth, World Bank (web.worldbank.org/WBSITE/ EXTERNAL/COUNTRIES/SOUTHASIAEXT/O)
Rahman, 2007. Rahman, Rushidan Islam, “Pro-Poor Growth: Recent Evidence from HIES Data”, Preliminary Draft, BIDS, Dhaka.

Razmi, Arslan and Robert Blecker (2006). “Developing Country Exports of Manufactures:moving up the export ladder to escape the fallacy of composition?”, Journal of Development Studies, Vol.44, No.1, January:21-48.

Thoburn, J.T. (2008), “Viet Nam”, paper prepared for WIDER conference on Country Role Models for Development Success, June13-14, Helsinki.

Thoburn, J.T., K. Sutherland and Nguyen Thi Hoa (2007), “Globalisation and restructuring in the textiles sector on households in Vietnam: impacts on households?” Journal of the Asia Pacific Economy, vol.12, no.3, August,: 345-366

Warr, Peter (2008) “Thailand’s Development Strategy and Growth Performance”, paper prepared for WIDER conference on Country Role Models for Development Success, June13-14, Helsinki

Warr, Peter (1993), “The Thai Economy,” in Peter Warr (ed.) The Thai Economy in Transition, Cambridge University Press, Cambridge, 1-80.

Warr, Peter (1999). ‘What Happened to Thailand?’, The World Economy, 22 (July), 631-650.

Warr, Peter (2005), “Boom, Bust and Beyond,” in Peter Warr (ed.) Thailand Beyond the Crisis, Routledge, London, 3-65.

Weiss, John and H. A. Khan eds.(2006) Poverty Strategies in Asia: A Growth Plus Approach, Cheltenham: Edward Elgar and ADBI.

World Bank, 2006. “Poverty trends and patterns: preliminary results from the HIES 2005”, August 13, 2006 (Transcript of Powerpoint presentation).

World Bank, 2007. World Development Indicator, 2007.