নবধারার নাগরিক আন্দোলন: প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

সারসংক্ষেপ

সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে নানা-তর্কবিতর্ক রয়েছে। এ প্রবন্ধে সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ ধারণার উত্পত্তি, বিবর্তন ও প্রয়োগের জায়গা থেকে সাম্প্রতিক বিশ্বব্যবস্থায় অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও বাজারের বাইরে এই তৃতীয় শক্তিটির সিভিল সমাজের ভূমিকা বাংলাদেশে কী, সেটির একটা চিত্র এখানে পাওয়া যায়। তাত্ত্বিকভাবে নাগরিক সমাজের ধারণাকে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী এর প্রায়োগিক উদাহরণের মাধ্যমে প্রবন্ধটি নাগরিক সমাজের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত এবং বর্তমানে কোন অবস্থায় রয়েছে, তার একটা পার্থক্য খুঁজে পেতে পাঠকদের সহায়তা করবে।

মুখ্য শব্দ: রাষ্ট্র, সিভিল সোসাইটি, বিশ্বায়ন, সামাজিক আন্দোলন, হেজিমনি, বঞ্চনা, নারীবাদী আন্দোলন।

প্রারম্ভিক কথা

ইংরেজি ভাষায় ‘সিভিল সোসাইটি’ বলতে যা বোঝায়, তার ভাষান্তর ‘সুশীল সমাজ’ নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এটাকে বরং জনসমাজ বা নাগরিক সমাজ বললে সিভিল সোসাইটির ব্যুত্পত্তিগত অর্থের অনেক কাছাকাছি যাওয়া যায়। সমাজে সবচেয়ে ক্রিয়াশীল এবং প্রভাবশালী দুটো শক্তি কেন্দ্র আছে। একটা হলো ‘রাষ্ট্র’, অন্যটা ‘বাজার’। এর বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি, স্রোত, ধারা অথবা প্রবণতা যা-ই বলা হোক না কেন, তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এই ধারা যত বেগবান হয়, যত সংহত হয়, যত প্রকাশমান হয়, ততই তার শক্তি উপলব্ধি করা যায়। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে, সচেতনভাবে এবং স্বেচ্ছায় জড়ো হয়ে একটা বুদ্বুদ বা ঢেউ তোলার প্রয়াস পায় যে জনগোষ্ঠী, সহজ কথায় তা হলো সিভিল সোসাইটি। আমি এর ভাষান্তর করতে চাই নাগরিক সমাজ হিসেবে। এর মধ্যে সুশীল-কুশীল উভয়ই থাকতে পারে। যেমন রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি হতে পারে সাধারণ মানুষ এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অথবা একটি সামরিক জান্তা। তেমনি বাজার দায়িত্বশীল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে, অথবা তা মাফিয়া চক্রের পকেটেও ঢুকে যেতে পারে। নাগরিক সমাজেও তেমন মিশেল থাকাটা বিচিত্র নয়। ‘ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন’ নাগরিক সমাজের একটা সহজ সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে: পরিবার, রাষ্ট্র এবং বাজারের বাইরে নিজেদের স্বার্থ তুলে ধরার জন্য সমবেত হওয়া।১ এর আওতায় কারা থাকবে তা নিয়েও মতভেদ আছে।

নাগরিক সমাজে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সম্মিলনগুলোর মধ্যে আছে বিদ্বজ্জন (্অ্যাকাডেমিয়া), দাতব্য প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (্এনজিও), স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন রকমের সামাজিক আন্দোলন (মানবাধিকার, জেন্ডার, পরিবেশ, শান্তি ইত্যাদি)।২ মোদ্দা কথা হচ্ছে, জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের এসব সম্মিলন বা সংগঠন রাষ্ট্রশক্তির বা রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার বা রাজনৈতিক দলের প্রতিপক্ষ নয়, তাদের পক্ষভুক্ত নয়।

সিভিল সমাজের ধারণা ও দর্শন বেশ পুরোনো।৩ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাগরিক, নাগরিকত্ববোধ এবং রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক অবস্থান। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এই দর্শন মূলত ইউরোপীয়। এ ক্ষেত্রে আমরা সক্রেটিসের উদাহরণ উল্লেখ করতে পারি। তিনি একটা ভালো সমাজ চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সমাজের মধ্যকার ঝগড়াঝাঁটি যৌক্তিক সংলাপের মধ্য দিয়েই মিটমাট হোক। এই সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে তিনি সত্যের সন্ধান করেছেন। যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়েই সমাজ অগ্রসর হবে, রাজনীতি ক্রমশ সভ্য ভব্য হবে এবং মানুষ উন্নত জীবনের অধিকারী হবে, এই ছিল তাঁর বক্তব্য।

আমাদের এই অঞ্চলে নাগরিক সমাজের বয়স নিতান্তই কম। সুলতানি আমল, মোগল আমল আর নবাবি আমলে ছিল এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী শাসন, যদিও আমরা অনেক সময় ইনিয়ে-বিনিয়ে আমাদের শাসকদের গুণকীর্তন করে থাকি। আমাদের দেশে আধুনিক অর্থে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে। আমাদের নাগরিক সমাজের শুরু তখন থেকেই।৪

২.

নাগরিক সমাজের অবস্থান এবং কার্যক্রম দুনিয়াজুড়ে এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার সঙ্গে এনার্কি তত্ত্বের সাযুজ্য লক্ষ করা যায়। আমাদের সাহিত্যে এই তত্ত্বের একটা সহজ অর্থ করা হয়েছে, নৈরাজ্যবাদ। এটা অনেক সময় নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। যেন এনার্কিস্টরা রাষ্ট্র, সমাজ, আইনকানুন কিছুই মানেন না। তাঁরা শুধু ভাঙেন, গড়েন না কিছুই। এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। নৈরাজ্যবাদ আসলে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক রাজনৈতিক মতবাদ। ইংরেজ সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক উইলিয়াম গডউইনকে (১৭৫৬-১৮৩৬) নৈরাজ্যবাদের প্রথম আধুনিক প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয়।৫ তাঁর দুটো বই An Enquiry Concerning Political Justice এবং Things as They Are অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল বিদ্রোহ। এই তন্ত্রের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য গুরু হলেন রাশিয়ার মিখাইল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬)। আজন্ম সংগ্রামী বাকুনিন তাঁর বক্তব্য অনেকটাই লিপিবদ্ধ করেছেন ঝঃধঃরংস ধহফ অহধত্পযু এবং ড়েফ ধহফ ঃযব ঝঃধঃব গ্রন্থে। কার্ল মার্ক্সের সমসাময়িক বাকুনিন মার্ক্সীয় ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ তত্ত্বের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর স্লোগান ছিল সর্বজনীন দ্রোহ, যা সব ধরনের ক্ষমতার খেলাকে দারুণভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিল।৬ ফলে তিনি মার্ক্স এবং তাঁর অনুসারীদের দ্বারা প্রথম আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হন। মার্ক্সীয় দর্শন, যা পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত রাষ্ট্রবাদিতায় রূপ পায় স্ট্যালিনের প্রায়োগিক কর্মকাণ্ডে, তা নতুন করে শৃঙ্খলিত করেছিল গরিব মানুষদের।

নৈরাজ্যবাদ তত্ত্বের ছোঁয়া আমরা দেখতে পাই খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে চীনের তাওবাদী দার্শনিক লাওত্সুর লেখায়। তাঁর সমাজদর্শনের সারকথা হলো, ‘রাষ্ট্র হবে দুর্বল, সমাজ হবে সবল’।৭ কনফুসিয়াসের মতাদর্শ ঠিক এর উল্টো, যার প্রতিফলন আমরা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে দেখি।

সমাজের সব ধরনের আধিপত্যবাদ বা হেজিমনির বিরুদ্ধে লাওত্সু, সক্রেটিস ও বাকুনিন সোচ্চার ছিলেন। তারই পরম্পরা আমরা দেখতে পাই বিশ ও একুশ শতকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নাগরিকদের সামাজিক আন্দোলনে। তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চান না, ক্ষমতার অংশীদারও হতে চান না। তাঁরা চান রাষ্ট্রকে বদলে দিতে। মূলকথা হলো, ক্ষমতার দিক থেকে রাষ্ট্র হবে দুর্বল এবং ছোট, দায়িত্ব ও সেবার দিক থেকে রাষ্ট্র হবে সবল ও বড়। রাষ্ট্র থাকবে, তবে তার সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্কে একটা র্যাডিক্যাল পরিবর্তন আসতে হবে। রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য রাষ্ট্র। সংবিধানে কী লেখা আছে, সেটা বড় কথা নয়, সংবিধানের প্রয়োগটাই আসল কথা। এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়, বদলায় মানুষের চরিত্রও। এরা একে অপরের ওপর ক্রিয়াশীল। কখনো নাগরিক সমাজ, কখনোবা রাষ্ট্র, এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে নবরূপে আবির্ভূত হয়। এই সময়ের একটা বড় আন্দোলন হলো এনার্কা-ফেমিনিজম। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় Mujeres Libres (মুক্ত নারী) নামের একটি গোষ্ঠী নৈরাজ্যবাদ ও নারীবাদকে সমন্বিত করে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নারীমুক্তি আন্দোলনে সমর্পিত হয়েছিল। রাশিয়াতেও এ ধরনের আন্দোলন তৈরি হচ্ছিল। তবে তা স্ট্যালিনের লালফৌজ বুটের তলায় থেঁতলে দিয়েছিল পুরোপুরি।৮ এনার্কা-ফেমিনিজমের দ্বিতীয় ঢেউ আমরা দেখতে পাই ষাটের দশকে। এ সময় আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্মগুলোকে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পেরেছিল।

৩.

বিশ শতকের শেষে এবং একুশ শতকের প্রথম দিকে নাগরিক সমাজের আন্দোলন নতুন মাত্রা পায় ধনবাদী বিশ্বায়নবিরোধী চরিত্র অর্জনের মাধ্যমে। এই সময়ে এক্সিস অব ইভিল বা ত্রিপক্ষীয় অপশক্তি—বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিরুদ্ধে দেশে দেশে নাগরিক সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম’-এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘বিশ্ব সামাজিক ফোরাম’-এর অভ্যুদয় ঘটে। এই প্রক্রিয়ার শুরুতেই ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজ বরাবরই ন্যায়, দ্রোহ ও উত্থানের অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। এর প্রমাণ আমরা দেখি শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকদের আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবির আন্দোলন, বিশ্ব নারী দিবসের সূত্রপাত, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী সবচেয়ে বড় সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন এবং ১৯৯৯ সালে সিয়াটলে তরুণদের সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ। সিয়াটল এক নবযাত্রার উদ্ভাসন ঘটায়, যার ফলে বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এর প্রমাণ আমরা পরবর্তী সময়ে দেখি রোম, কানকুন, হংকংয়ে।

সিয়াটলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের এই সম্মেলনে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমতা ও ন্যায্যতার আন্দোলন। এর ধারাবাহিকতায় প্রথম বিশ্ব সামাজিক ফোরাম (ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম) আয়োজন করা হয় ব্রাজিলের পোর্তো এলেগ্রে শহরে, ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর সম্মেলন ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম’-এর সমান্তরাল একটি নাগরিক বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিশ্ব সামাজিক ফোরাম বিবেচিত হয়ে আসছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম) সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক একটি ‘অলাভজনক’ ফাউন্ডেশন। দাভোস শহরে এরা প্রতিবছর একটা সভার আয়োজন করে থাকে। জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনের অধ্যাপক ক্লস শাব (Klaus Schwab) ১৯৭১ সালে এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মসূত্রে তিনি জার্মানি। প্রথমে এই ফোরামের নাম ছিল ‘ইউরোপিয়ান ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’। পশ্চিম ইউরোপের ধনবাদী দেশগুলো থেকে আমন্ত্রিতরা এর বার্ষিক সভায় যোগ দিতেন। ১৯৮৭ সালে এর রূপান্তর ঘটে, নাম হয় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এই ফোরামে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী কুশীলবেরা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সমালোচনা শুরু হয় ১৯৯০ সাল থেকেই। সমালোচনা ছিল যে এই সংস্থাগুলো ধনবাদী বিশ্বায়নের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংস করছে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে। ‘বিশ্বায়ন’ যদিও একটা আগ্রহজাগানিয়া শব্দ, নোয়াম চমস্কির ভাষায়, এটা হলো সুবিধাভোগী এলিট লগ্নিকারীদের একটা আঁতাত। বিশ্বায়ন হলো তাদের একটি বিকৃত প্রচার। যাঁরা এর বিরোধী, তাঁরা সত্যিকার অর্থে বিশ্বায়নবিরোধী নন। তাঁরা হলেন আধিপত্যবাদবিরোধী। কেননা বিশ্ব সামাজিক ফোরামে অংশগ্রহণকারীরাও বিশ্বায়নের পক্ষে। তবে সেটা পুঁজি লগ্নিকারীদের স্বার্থে বাজার দখলের বিশ্বায়ন নয়।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বিরুদ্ধে প্রথম বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে। এক হাজার মানুষ দাভোস শহরে মিছিল করে একটা ম্যাকডোনাল্ড দোকানের জানালার কাচ ভাঙচুর করে। হাজার হাজার পুলিশ দিয়ে আলপাইনের সম্মেলন কেন্দ্র থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়। সুইজারল্যান্ডের অন্যান্য শহরেও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

শুরু হয় নতুন চিন্তাভাবনা। নাগরিক সমাজের একটা বৈশ্বিক সম্মেলনের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বার্ষিক সভা হয় প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে। সে সময় বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন সমান্তরাল বা পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে থাকে একই শহরে। এই উদ্যোগগুলো হয় ছোট আকারে এবং তার একটা তাত্ক্ষণিক প্রভাব সম্মেলনস্থল ছাড়া অন্য কোথাও, অন্য সময় দেখা যায় না। এ রকম একটা প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সামাজিক ফোরাম বা ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের পরিকল্পনা করা হয়। মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ওদেদ গ্রাজো, চিকো হোয়াইটকার ও বার্নাড ক্যাসেন। ফোরাম অনুষ্ঠিত হলো ব্রাজিলের পোর্তো এলেগ্রে শহরে ২০০১ সালের ২৫-৩০ জানুয়ারি। ফোরাম আয়োজনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করল নগরের স্থানীয় সরকার এবং ব্রাজিলের ওয়ার্কার্স পার্টি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ১২ হাজার নাগরিক প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করলেন। ব্রাজিলে এ সময় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা লুই ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা পরবর্তী সময়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সারা দক্ষিণ আমেরিকায় পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। নয়া উদারবাদবিরোধী সামাজিক আন্দোলনগুলো একে একে সংহত হয় আর ক্ষমতার পালাবদল ঘটে পেরু, আর্জেন্টিনা ও চিলিতে। ভেনেজুয়েলায় তো রীতিমতো বিপ্লব ঘটে যায় হুগো শাভেজের ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে। লাতিন আমেরিকার ‘বানানা রিপাবলিকগুলো’ যেন নিমেষেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম নাগরিক সমাজের জন্য এক নতুন দিকের সূচনা করে, তাদের জন্য তৈরি করে এক ব্যতিক্রমী প্ল্যাটফর্ম। এখানে কোনো সভাপতি নেই, কোনো সমন্বয়ক নেই, কোনো নির্বাহী কমিটি নেই। একমত হওয়ার প্রয়োজনও নেই। নয়া উদারবাদী ও আধিপত্যবাদী বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার, তারা সবাই এই প্ল্যাটফর্মে অংশ নেওয়ার অধিকারী। এটা হলো বিশ্বের নাগরিক সমাজের এক সম্মিলনস্থল, পয়েন্ট অব কনভারজেন্স, যেখানে সবাই এককাট্টা হয়ে আওয়াজ তোলেন, অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড ইজ পসিবল, যুদ্ধবাজ নিপাত যাক, মানুষে মানুষে এবং দেশে দেশে বৈষম্যের অবসান হোক, দারিদ্র্য ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বদলাতে হবে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মোড়লিপনা চলবে না। এই ফোরামের চেষ্টা ছিল আগ্রাসী পুঁজিবাদ এবং কমিউনিস্ট মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটি নতুন ধারা তৈরি করা।

ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম একটি অহিংস সামাজিক ধারণা ও আন্দোলন। প্রথাগত বিক্ষোভের ভাষা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই এখানে। ২০০১ সালে অবশ্য এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলে একটা নেতিবাচক প্রচার হয়েছিল এই ফোরাম সম্পর্কে। ২৬ জানুয়ারি একদল অংশগ্রহণকারী বহুজাতিক বায়োটেকনোলজি করপোরেশন ‘মনসান্তো’র একটি পরীক্ষামূলক প্ল্যান্টেশন আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়।

ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম ১১ বছর অতিক্রম করল। প্রায় প্রতিবছর এই সম্মেলন হয়। কখনো বৈশ্বিক, কখনো বা আঞ্চলিক ভিত্তিতে। একটি প্রক্রিয়া যখন দীর্ঘদিন ধরে চলে, তাতে ঘুণ ধরে যায়। অনেক আগাছাও জন্মায়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। সামাজিক আন্দোলনগুলো নেপথ্যে চলে যাচ্ছে। তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল ও প্রভাবশালী এনজিওগুলো। সমাজের এই বৈশ্বিক প্রক্রিয়া, যার প্রাণশক্তির জোগান দিত সামাজিক আন্দোলনগুলো, আজ তা অনেকাংশেই অন্তর্হিত। করপোরেট এনজিওগুলো চলে এসেছে সামনের সারিতে। সম্মেলনের চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে।

৪.

বৈশ্বিক রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুছে যাওয়ার পর থেকেই সারা দুনিয়ায় ‘গণতন্ত্রের’ জয়জয়কার। পুঁজিবাদী দুনিয়া এটা বোঝাতে চাইছে, পুঁজিবাদের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপত্র হিসেবে ‘গণতন্ত্র’ও অদ্বিতীয়। একসময় যারা সামরিক জান্তার কাঁধে বন্দুক রেখে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করত, আজ তারা কৌশল পাল্টে ফেলেছে। ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ লগ্নে এসে তারা তাদের তৈরি দৈত্যগুলো বোতলে ভরে ফেলেছে। দৃশ্যপট থেকে ভিখিরির মতো একে একে বিদায় নিয়েছেন রেজা শাহ্, মার্কোস, সুহার্তো। পৃষ্ঠপোষকদের কাছে তাঁদের প্রয়োজন তত দিনে ফুরিয়ে গেছে। সে সময় ওই দেশগুলোতে রাজনৈতিক আন্দোলন এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলন প্রবহমান ছিল, পাশাপাশি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো একধরনের র্যাডিক্যাল ভূমিকা পালন করেছিল। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণজোয়ারে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ইরান ও ইন্দোনেশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা ধর্মীয় পুনর্জাগরণের মাধ্যমে ভাষা খুঁজে পেল। ফিলিপাইনে চার্চের আন্দোলন ছিল অসামান্য। একদিকে কমিউনিস্ট আন্দোলন, অন্যদিকে কার্ডিনাল সিনের নেতৃত্বে গির্জার অনড় অবস্থান। ফলে মার্কোসকে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো। শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর একক প্রচেষ্টায় এই পরিবর্তনগুলো হয়তো হতো না। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এখানে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ও প্রতিক্রিয়াশীল। তাই দেখা যায়, গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তারা প্রায় সব সময় জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

সামাজিক আন্দোলনের নানা ধরন। এগুলোকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখা সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হয়েও নাগরিক সংগঠনগুলো বিশেষ একটা রাজনৈতিক অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। অদলীয় রাজনীতির ধ্যানধারণা নতুন নয়। দল না করেও রাজনীতি করা যায়, রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে জনসম্পৃক্ত হওয়া যায়।

৫.

সামাজিক আন্দোলনের জমি তৈরি হয় বঞ্চনা আর ক্ষোভ থেকে। কেউ যদি মনে করেন তাঁর কিছু প্রাপ্য ছিল, কিন্তু তিনি তা পাচ্ছেন না, তখন এই না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে ক্ষোভ তৈরি হয়। একটি এলাকায় যদি সারা রাত বিজলি বাতি জ্বলে আর তার পাশের এলাকায় ক্রমাগত লোডশেডিং চলতে থাকে, তাহলে যারা বিদ্যুত্ পাচ্ছে না, তারা বিক্ষুব্ধ হতেই পারে। এটাকে আপেক্ষিক বঞ্চনা হিসেবে দেখা হয়।৯ এই বঞ্চনা ও ক্ষোভ সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করে। একপর্যায়ে তা সহিংস হয়ে উঠতে পারে। এমনকি পরিণতিতে বেধে যেতে পারে দাঙ্গা এবং গৃহযুদ্ধ, অপরাধতত্ত্বের ভাষায় যা হলো অন্যায়।১০ কেননা এ ধরনের আচরণ সামাজিক প্রথা ও অনুশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।১১ একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে।

ধরা যাক, একটি নাগরিক সংগঠনের উদ্যোগে নিরাপদ পানির জন্য অথবা শিক্ষা ব্যয় কমানোর দাবিতে মিছিল বের হলো। ব্যানার-ফেস্টুনে সব দাবি-দাওয়া লেখা। একপর্যায়ে মিছিলে উত্তেজনা দেখা গেল। তারপর গাড়ি ভাঙচুর, দোকানে হামলা ও লুটপাট। আমরা এই দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত। আন্দোলন তখন তার চরিত্র হারায়।

তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামাকে আন্দোলন বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, তাকে গৌরবান্বিত করা হয়। অন্যভাবে বলা চলে, আন্দোলন দানা বাঁধার আগেই দাঙ্গায় রূপান্তরিত হয়। হরতালকে এ ধরনের ‘আন্দোলন’ হিসেবে দেখানো যেতে পারে। যদিও একে ‘গণতান্ত্রিক’ কিংবা সাংবিধানিক অধিকার বলে দাবি করার লোকের অভাব নেই। সামাজিক আন্দোলনকে পেছন থেকে ছুরি মারার জন্য কায়েমি স্বার্থবাদীরা নানান ছলছুতার আশ্রয় নেয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো অহিংস প্রতিবাদকে সহিংস দাঙ্গায় পরিণত করা। অবশ্য আবেগাশ্রয়ী হয়ে আপাতনিরীহ মানুষও এই ফাঁদে পা দেয়, উত্তেজনার বশে অন্যকে আঘাত করে। এ রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর প্রদেশে চৌরিচৌরা নামক স্থানে। একটা পুলিশ চৌকিতে বিক্ষোভকারীরা ২২ জন পুলিশকে পুড়িয়ে মেরেছিল। গান্ধী তাত্ক্ষণিকভাবে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন এবং তাঁর ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন এ রকম ‘হত্যাগ্রহ’তে রূপান্তরিত হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।১২

আপেক্ষিক বঞ্চনাতত্ত্বের উল্টো দিকে আছে প্রকৃত বঞ্চনাতত্ত্ব। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম উপাদানগুলো না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে ক্ষোভের জন্ম হয়। আমরা এর সঙ্গে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা মিলিয়ে দেখতে পারি। প্রচলিত অর্থে দারিদ্র্য মানে বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদানগুলোর অভাব। এর মধ্যে আছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শিক্ষা, চিকিত্সা, পানি ও পয়োসুবিধা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকরভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ। এর সঙ্গে মৌলিক চাহিদা নীতির সাযুজ্য রয়েছে। এটা স্থান ও কালভেদে পরিবর্তিত হয়।১৩ প্রকৃত বঞ্চনার বিষয়টি নাগরিক সমাজের এজেন্ডায় থাকলেও এ নিয়ে তেমন সামাজিক আন্দোলন নেই। যেটা আছে, তা হলো এনজিও পরিচালিত দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি। এনজিওগুলো নাগরিক সমাজের অংশ, যারা সঙ্গে থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নানা রকম সেবা দিয়ে থাকে। এ নিয়ে প্রকল্প আছে, আন্দোলন নেই।

১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে কোপেনহেগেনে জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনে সামাজিক উন্নয়নের জন্য ১০ দফা অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন বিশ্বনেতারা। কোপেনহেগেন ঘোষণায় সম্মতি দিয়েছিল অধিকাংশ দেশ। ২০০০ সালে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে। অন্যতম লক্ষ্য ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ন্যূনতম অর্ধেকে নামিয়ে আনা। অধিকাংশ দেশ এখনো এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওভিত্তিক একটি সংগঠন সোশ্যাল ওয়াচ প্রতিবছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কোন দেশ কতটুকু অর্জন করতে পারল, তা পর্যালোচনা করে দেখা হয়। কিন্তু এ নিয়ে জোরালো কোনো আন্দোলন আজ পর্যন্ত কোনো দেশে দেখা যায়নি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার পেছনে প্রধান দুটো কারণ হলো জাতীয় সরকারগুলোর অবহেলা ও অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ব্যর্থতা এবং অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়া।

নবধারার সামাজিক আন্দোলনতত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এর নেতৃত্ব আসবে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্য থেকে, গরিবদের মধ্য থেকে নয়। পাশ্চাত্যের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে (পোস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমি) ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়।১৪ এসব দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের সমস্যা নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট হয়েছে এবং জীবনযাত্রার সাধারণ মানেরও উন্নতি হয়েছে। এসব দেশে নাগরিক সমাজের চিন্তাভাবনা, আলোচনা ও আন্দোলনের বিষয়ে বৈচিত্র্য এসেছে। তাদের এজেন্ডায় ওপরের দিকে রয়েছে মানবাধিকার, পরিবেশ ইত্যাদি। মানবাধিকার আন্দোলনে এসেছে বিষয়গত পরিবর্তন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গর্ভপাতের অধিকার, সমলিঙ্গের বিয়ের অধিকার ইত্যাদি। নারীবাদী আন্দোলনেও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম (১৯৮০-৯০) অনেকটাই ঝুঁকেছে রাজনীতিতে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে নারীর অধিক হারে অংশগ্রহণের দাবিতে।

পাশ্চাত্যের উত্তর-আধুনিক সমাজের তুলনায় আমরা বেশ পিছিয়ে। আমাদের সমাজে শিল্পোন্নয়নের স্বয়ংযাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র। জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে গেলেও আমরা এখনো কৃষিসমাজেই বসবাস করছি। এ রকম প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্যের উত্তর-আধুনিক মানবাধিকার আন্দোলনের নতুন বিষয়গুলো চটজলদি চলে আসছে আমাদের দেশে। তবে তা আসছে অত্যন্ত সীমিত আকারে। কনফারেন্স কক্ষের চার দেয়ালের ভেতর কিংবা বার্ষিক প্রতিবেদনে অনেক এনজিও এলজিবিটি অধিকার নিয়ে কথা বলে। প্রকাশ্যে এসব বলার মতো পরিবেশ নেই, প্রয়োজন কতটুকু, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, যে দেশে তিন-পঞ্চমাংশ মানুষ সাধারণ মানের পয়োসুবিধা থেকে বঞ্চিত, যে দেশের শিশুরা পুষ্টিহীনতায় এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিচে, সে দেশে সমকামী বিয়ের অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে প্রচার করার ঝুঁকি আছে।

নবধারার সামাজিক আন্দোলন বামঘেঁষা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তত্ত্বের দিক থেকে এর অভিযাত্রা আসলেই নয়া বাম বা নবধারার বাম। এই সংজ্ঞায়িত শব্দাবলি ষাট ও সত্তরের দশকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলনের কর্মী, বিক্ষোভকারী এবং তাদের প্রণোদনা দানকারী নেতৃত্বকে বোঝাত। মার্ক্সীয় ঘরানা থেকে এরা আলাদা। হিপ্পি আন্দোলনের সঙ্গে এর যোগসূত্র ছিল।১৫ মুশকিল হলো, পাশ্চাত্যে যা র্যাডিক্যাল, যা তারুণ্যের প্রতিবাদে ভরপুর, প্রাচ্যের অনেক দেশে তা অপরাজনীতি বা অপসংস্কৃতি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশগুলোর অবস্থান তাদের মধ্যে পার্থক্যের সীমা টেনে দিয়েছে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে মানুষের পারসেপশন বিভিন্ন রকম হয়। একই বস্তু বা প্রবণতা কারও কাছে কালো, কারও কাছে সাদা। ইউরোপের সব দেশে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত হয়েছে। এশিয়ায় নেপাল ছাড়া আর সব দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। উভয় ক্ষেত্রেই মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তবে দু রকমভাবে।

৭.

নাগরিক সমাজের তাত্ত্বিক আলোচনায় যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের অনেকেই উঠে এসেছেন মার্ক্সীয় ঘরানা থেকে। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইতালির বিশিষ্ট রাজনীতিক-লেখক আন্তনিও গ্রামসি। গ্রামসি (১৮৯১-১৯৩৭) বিশ শতকের একজন উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদ। তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ’-এর মূলে আছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র কীভাবে টিকে থাকে তার আলোচনা। গ্রামসি সমাজে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি হলো, সব মানুষই বুদ্ধিজীবী, সবাই যাঁর যাঁর মতো করে বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগ করেন, যদিও সবাই বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন না।১৬ তাঁর মতে, বুদ্ধিজীবীদের কাজ শুধু কথা বলা নয়, তাঁরা শিক্ষা কিংবা গণমাধ্যম ব্যবহার করে আদর্শগত প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। বুদ্ধিজীবীদের কাজ জনবিচ্ছিন্ন থেকে শুধু তত্ত্ব আওড়ানো নয়, জনগণের মধ্যে থেকে, তাদের মনের কথাগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে তাদের পক্ষে উপস্থাপন করা, সনাতন ও প্রথাগত গবেষকদের মতো সূক্ষ্ম নিয়মের ছাঁচে ঢেলে থিসিস উপস্থাপন করা নয়। নবধারার এই বুদ্ধিজীবীদের তিনি বলেছেন অর্গানিক ইনটেলেকচুয়াল। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে ক্রিটিক্যাল পেডাগজি বা পপুলার এডুকেশনের ধারণার মিল আছে, যার উদ্ভাবক হলেন ব্রাজিলের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সংগঠক পাওলো ফ্রেইরি এবং ফরাসি দার্শনিক ও লেখক ফ্রাঁয ফানো।

গ্রামসি রাষ্ট্রকে সংকীর্ণ অর্থে বিচার করেননি। তিনি একে দুই ভাগ করে দেখিয়েছেন। এক ভাগ হলো ‘রাজনৈতিক সমাজ’। এর মধ্যে আছে পুলিশ, সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি, যা নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংগঠনগুলো। অন্য একটি ভাগ হলো ‘নাগরিক সমাজ’। এর অংশ হলো পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, শ্রমিক ইউনিয়ন ইত্যাদি। এই ভাগটি হলো বেসরকারি বা রাষ্ট্রবহির্ভূত। তাঁর মতে, এই বিভাজন সম্পূর্ণ ধারণাগত, বাস্তবে এই দুইয়ের মিশেল থাকতেই পারে। গ্রামসির মতে, একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ‘শক্তি’ এবং ‘সম্মতি’র সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক সমাজ শক্তি প্রয়োগ করে এবং সম্মতির জায়গাটি হলো নাগরিক সমাজ। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়—এ ধরনের জলো স্লোগানের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রামসির। তিনি সব ধরনের রাষ্ট্রপূজার বিরোধী, যা উদ্ভূত হয় রাজনৈতিক সমাজ থেকে। শক্তিশালী রাষ্ট্রের চিন্তা ফ্যাসিবাদের প্রকাশ ঘটায়। গ্রামসি বিশ্বাস করেন, সর্বহারা শ্রেণীর ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুশৃঙ্খল সমাজ তৈরি করা এবং রাষ্ট্র বিলুপ্ত হলেই নাগরিক সমাজ সত্যিকারের আত্মনিয়ন্ত্রণের স্তরে পৌঁছাতে পারবে।

গ্রামসির তত্ত্ব ও ধারণা বিশ শতকের শেষার্ধ থেকে দুনিয়াজুড়ে নাগরিক সমাজের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদনা দিয়ে আসছে। গ্রামসি মার্ক্সকে অস্বীকার করেননি। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে তিনি মার্ক্সীয় তত্ত্বকে নবজীবন দান করেছেন। তাঁর তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই অগ্রসর হয়েছে ইউরো কমিউনিজমের ধারণা।১৭ যাঁদের ইতিহাস ও সমাজচিন্তা মার্ক্স পর্যন্ত এসে থেমে গেছে, তাঁরা এই পরিবর্তনের নিয়ামকগুলো বুঝতে অক্ষম। এঁদের একটা বড় অংশ বর্তমান বিশ্বের নাগরিক আন্দোলনগুলো থেকে শুধু বিচ্ছিন্নই নয়, এর বিরোধিতাও করে থাকে। তারা সবকিছুতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত দেখতে পায়। এরাই কমিউনিস্ট মৌলবাদের ধারক ও বাহক। আমরা আশপাশে তাকালে এর দু-চারটা নমুনা দেখি।

৮.

নাগরিক সমাজের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে নারীবাদী আন্দোলন। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৮৭২ সালে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে, ১৮৯০ সালে যুক্তরাজ্যে এবং ১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও নারী অধিকার নিয়ে কথাবার্তা চলছিল আরও আগে থেকেই। আঠারো শতককে বলা হয় ‘এজ অব এনলাইটেনমেন্ট’ বা আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার যুগ। এ সময় যাঁরা নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জেরেমি বেনথাম, মারকুই দ্য কনদোরেত, মেরি ওলস্টোনক্লাফট, ক্যাথরিন ম্যাকলে, হেদবিগ চালোতা, নর্দেন ফ্লিশট প্রমুখ।১৮

নারীবাদী আন্দোলনের তিনটি পর্যায় চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়টি উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের গোড়ার সময়টুকু নিয়ে। এ সময় যুক্তরাজ্য, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং আরও কয়েকটি দেশে যেসব দাবি-দাওয়া ও আন্দোলন ছিল, তা মূলত আইনি সংস্কার নিয়ে। মূল লক্ষ্য ছিল নারীর সর্বজনীন ভোটাধিকার। প্রাপ্তবয়স্ক সব নারীর ভোটাধিকার সর্বপ্রথম স্বীকৃত হয় নিউজিল্যান্ডে, ১৮৯৩ সালে। আন্তর্জাতিক নারী ভোটাধিকার জোট গঠন করা হয় ১৯০৪ সালে।১৯ যুক্তরাজ্যে নারীরা সর্বজনীন ভোটাধিকার পান ১৯১৮ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে। ইউরোপে অবশ্য প্রথম এই অধিকার পান ১৯১৩ সালে নরওয়ের নারীরা।

নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এবং তা চলে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। এই পর্যায়ে নারী অধিকারের পরিসর আরও বিস্তৃত হয়। ভোটের অধিকার আর সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গে যুক্ত হয় নানা ধরনের পরিবারিক ও সামাজিক বৈষম্য, যৌনতা, প্রজনন অধিকার ইত্যাদি।২০ সিমন দ্য ব্যুয়োভর রচিত Le Deuxieme Sexe (the second sex) প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। এই বই মনোজগতে রীতিমতো ঝড় তোলে। বেটি ফ্রিডম্যান লেখেন ঞযব ঋবসরহরহব গুংঃরয়ঁব, প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এটাও ছিল নারীর সনাতন ভূমিকার বিপরীতে নারীশক্তির আবাহনের চ্যালেঞ্জ। এ সময় বিবাহজাত ধর্ষণ, তালাক, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে র্যাডিক্যাল চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটে, যা প্রচলিত মনমানসিকতার মূলে আঘাত হানে।

নারী আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে, যার শুরু আশির দশক থেকে, দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যর্থতাগুলো অতিক্রম করার চেষ্টা চলতে থাকে। নারীবাদ আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ তত্ত্বের মোড়কে আবির্ভূত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নারীত্বের উত্তর-আধুনিক ধ্যানধারণা, নারীশক্তি, ইকো-ফেমিনিজম, ট্রান্সজেন্ডার রাজনীতি ও ইতিবাচক যৌনতা। যৌনতা একই সঙ্গে নির্যাতন ও ক্ষমতার প্রতীক। এ প্রসঙ্গে পর্নোগ্রাফি এবং যৌনকর্মী সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাস ও ধারণার বিপরীতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ করা যেতে পারে। যৌনকর্মী আর দশজন শ্রমজীবীর মতোই। সে পতিতা নয়।২১

নারীবাদী আন্দোলন আমাদের এই অঞ্চলে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা পুরুষতান্ত্রিকতার ভিত তেমন নাড়াতে পারেনি। তবে জেন্ডার সমতা আন্দোলন, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, বেশ গতিশীল। নাগরিক সমাজের উদারবাদী অংশ এটাকে মানবাধিকার আন্দোলনের সহজাত অনুষঙ্গ হিসেবে দেখে। তবে এর প্রতি বিরূপ জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে অধিক শক্তিশালী। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক উদারবাদীদের সঙ্গে গোঁড়া জনগোষ্ঠীর আঁতাতও বেশ স্পষ্ট। ভোটের রাজনীতিতে উদারবাদ তেমন সোচ্চার হতে পারে না। পদে পদে তাকে আপস করতে হয়।

বেগম রোকেয়া প্রায় শত বছর আগে যে র্যাডিক্যাল নারীবাদী লেখা লিখেছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সমাজ এখনো অনগ্রসর এবং তাত্ত্বিক আলোচনা এখনো রোকেয়াকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

৯.

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নাগরিক সমাজের আন্দোলন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছিল তুঙ্গে। এগুলো একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সহযাত্রী ছিল, অন্যদিকে তা ছিল নয়া উদারবাদী রাজনীতির প্রচণ্ড সমালোচক। রাজনীতিকেরা যখন তাঁদের সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত পাকাপোক্ত করার জন্য নির্বাচনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, নাগরিক সংগঠনগুলো তখন আরও গভীরে গিয়ে কাঠামোগত সংস্কারের জোরালো দাবি তোলে এবং নাগরিকদের সংগঠিত করার প্রয়াস পায়।

থাইল্যান্ডে রেড শার্ট আন্দোলন ছিল ক্ষমতাসীন রাজতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের আঁতাতের বিরুদ্ধে নয়া উদারবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। এর বিপরীতে থাই তরুণদের সাইবার গণতন্ত্রের আন্দোলন ছিল অনেক শাণিত। তারা সামরিকতন্ত্র ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করছিল ইন্টারনেট মিডিয়ার মাধ্যমে।২২

যেসব দেশ ঠান্ডা যুদ্ধের বলি হয়েছে সবচেয়ে বেশি, তার অন্যতম হলো কোরিয়া। আমরা যেমন ভোট দিয়ে ভারত ভাগ করেছিলাম, তারা তা করেনি। এর বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ ছিল বরাবরই। কিন্তু তা কখনোই সহিংস হয়ে ওঠেনি। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেকগুলো নাগরিক সংগঠন আছে, যারা একত্রীকরণের শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে।২৩ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শান্তির অন্বেষণ বাড়ছে, বাড়ছে দুই কোরিয়ার মিলনের আকাঙ্ক্ষা। এটা এখন সময়ের ব্যাপার।

কোরিয়ায় আরেকটি নাগরিক আন্দোলন বেশ জোরালো। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে কোরিয়ার একদল পরিবেশবাদী ও নারী সংগঠন একজোট হয়ে দুর্নীতিবিরোধী প্রচার ও আন্দোলন শুরু করে। এর নাম ছিল নাকচন-নাকসন বা কালো তালিকা বানানোর আন্দোলন। তারা সমাজের উঁচুতলার অনেক দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীর একটা তালিকা তৈরি করে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলে। তাদের একটি প্রধান দাবি ছিল, দুর্নীতিবাজদের নির্বাচনে যাতে মনোনয়ন না দেওয়া হয়। এ জন্য তারা প্রচুর চাপ সৃষ্টি করে। এটার ইংরেজি নাম হলো Civil Action for General Election। আন্দোলনটি সফল হয়। কালো তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের ৬৯ শতাংশই নির্বাচনে পরাজিত হয়। সিউল মহানগরে এসব পরাজিত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৯৫ শতাংশ।২৪

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর একটি হলো ফিলিপাইন। দুর্নীতির কারণেই এই ঋণগ্রস্ততা। ফিলিপাইনের নাগরিক সংগঠনগুলোর একটি জোট  Freedom from Debt Coalition সেসব ঋণ, যা স্বৈরাচারী মার্কোস সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছিল, তার দায় একতরফাভাবে বাতিল করে দেওয়ার জন্য জনমত সংগ্রহ করে এবং সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। দায় বাতিল হয়নি। কিন্তু ফিলিপাইনের সিনেটে তারা একটা কমিটি করতে সক্ষম হয়, যারা বৈদেশিক ঋণের নেতিবাচক দিকগুলো পরীক্ষা করে দেখবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঋণ আর না নেওয়া হয়, এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে।২৫

১০.

বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের বিকাশ আর এ দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান একই সময়ের। তবে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী যত না অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত, তারা চেয়ে অনেক কম হলো সাংস্কৃতিক মধ্যবিত্ত। ফলে এ দেশে নাগরিক সমাজের আন্দোলনে তেমন ধারাবাহিকতা নেই, প্রভাব-প্রতিপত্তিও কম।

১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে বলা যায় এ দেশের নাগরিক সমাজের প্রথম আন্দোলন। এ আন্দোলন ছিল মূলত সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, যার চরিত্র ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু নেতৃত্ব ছিল ছাত্র-শিক্ষক-সাংস্কৃতিক কর্মীদের হাতে। অংশগ্রহণও ছিল তাঁদের বেশি।

নাগরিক সমাজের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য আন্দোলনটি ছিল অনেকটা সাংগঠনিক ও প্রচারধর্মী। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে নাগরিক সমাজের একটা অংশ একত্র হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তখন আত্ম-আবিষ্কারের বর্ম। এর উপজাত ফসল হলো ছায়ানট, যা এ দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।

সাংস্কৃতিক  উপনিবেশবাদের মাধ্যমে পাকিস্তানি এসটাবলিশমেন্ট বাঙালিকে আঘাত করার জন্য বেছে নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের রবীন্দ্রবিরোধী মন্তব্য উসকে দিয়েছিল বিতর্ক। বাঙালি নাগরিক সমাজের অগ্রগণ্য কয়েকজন সদস্য নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে এর প্রতিবাদে তাত্ক্ষণিকভাবে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তাঁরা সরকারি গণমাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের প্রতিবাদ করেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেন মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, এম এ বারী, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ, সিকান্দার আবু জাফর, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ, নীলিমা ইব্রাহিম, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। বিবৃতিটি ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে নাগরিক সমাজের মধ্যে নানা রকম আলোচনা হতে থাকে। সরকারি নীতির প্রতিবাদে ঢাকায় কয়েকটা মিছিল হয়।২৬

এ সময় জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীন সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং র্যাডিক্যাল চিন্তাভাবনার এক অপূর্ব সম্পর্কের স্ফুরণ ঘটে বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায়। ১৯৭০ সালে সমকাল পত্রিকায় আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’-এর ১৪টি সনেট ছাপা হয়।। এ রকম কবিতা এ দেশে আগে কেউ লেখেননি।

আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন

পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ

এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ

যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।

নতুন প্রজন্মের এক ঝাঁক কবির আবির্ভাব হলো। এঁরা চালচলনে বোহেমিয়ান, চোখে পৃথিবী পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন। এঁদের মধ্যে আছেন নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু, নির্মলেন্দু গুণ, মাশুক চৌধুরী, হুমায়ুন কবির, সাবদার সিদ্দিকী প্রমুখ।

স্বাধীন বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের আন্দোলনের প্রথম সংগঠিত প্রকাশ দেখা যায় ১৯৭৪ সালে, যখন রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তপ্ত। অধ্যাপক আহমদ শরীফের নেতৃত্বে পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি নাগরিক কমিটি হয়েছিল। নাগরিক কমিটি নাম দিয়ে অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে বিশেষ কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের সম্ভবত এ দেশে এটাই প্রথম উদ্যোগ।

দেশে নারী অধিকার আন্দোলনে অগ্রপথিকের ভূমিকায় যে নাগরিক সংগঠনটি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে, তার নাম বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ নামে এটি জন্ম নেয় ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল। এর সদস্যসংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। সাংবিধানিক সংস্কার, ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড, যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান, জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন, এসব ক্ষেত্রে এ দেশে যা কিছু অর্জন, তাতে মহিলা পরিষদের ভূমিকা অনন্য।২৭

পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আন্দোলনে কতিপয় নাগরিক সংগঠন জোরালো ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম সফল আন্দোলনের রূপকার ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি অল্প কয়েকজনকে সঙ্গী করে ওসমানী উদ্যানে গাছ কেটে সম্মেলন কেন্দ্র বানানোর সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কোনো দাতা সংস্থার অনুদান ছাড়া নিজেদের শ্রম, ঘাম দিয়ে এ রকম একটি আন্দোলন সফল করে তোলার উদাহরণ সম্ভবত এটাই প্রথম। তখন স্লোগান ছিল, নাগরিকদের জন্য খোলা জায়গা চাই, মুক্ত পরিবেশ চাই, বিশুদ্ধ বাতাস চাই। এই আন্দোলনের ফলে প্রস্তাবিত সম্মেলন কেন্দ্রটি (বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র) শেরেবাংলা নগরে স্থানান্তরিত হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন এ রকম আরেকটি প্রয়াস, যা শুরু হয়েছিল বুড়িগঙ্গা নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার জন্য। বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই জোট প্রায় ১০ বছর ধরে প্রচার চালিয়ে আসছে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়নি। এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন, এমনকি সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতা একপর্যায়ে এসে আপসের চোরাগলিতে হারিয়ে গেছে।

এ ছাড়া অনেক সামাজিক আন্দোলনে বিভিন্ন পেশার মানুষ সমবেত হচ্ছেন, অংশ নিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু এসব আন্দোলনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিদেশ থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া এনজিওগুলো।

এ দেশে এনজিওগুলোর যেমন অনেক ইতিবাচক ভূমিকা আছে, তেমনি আছে এমন সব কাজ, যার সঙ্গে সামাজিক শক্তিগুলোকে সংঘবদ্ধ করার কোনো প্রচেষ্টা নেই। তাঁরা নাগরিকদের সংগঠিত করেন না। তাঁরা তাঁদের নির্ধারিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। তাঁদের জবাবদিহিও থাকে দাতা সংস্থা এবং নিজস্ব সংস্থার পরিচালকমণ্ডলীর কাছে। এসব এনজিওর অনেকেই সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট, আবার অনেকে দাতা সংস্থার অনুগ্রহপুষ্ট। এদের বলা হয় পেটোয়া সংস্থা।

স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদাহরণ আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। এ দেশে একসময় অ্যাসিড-সন্ত্রাস খুব বেড়ে গিয়েছিল। সন্ত্রাসের শিকার হতো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারী। এটা চরমে পৌঁছে ২০০২ সালে। ১৯৯৯ সালে দাতা সংস্থার অনুদানে যাত্রা শুরু করে অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন। পরের বছর (২০০০) এক দিনের বেতন দান করে প্রথম আলোর সাংবাদিক কর্মীরা প্রথম আলো সহায়ক তহবিল তৈরি করেন। গণমাধ্যমে প্রচার ও অন্যান্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী প্রচার জোরদার হয়, নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে। প্রথম আলোর তহবিলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও করপোরেট সংস্থা আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ফলে তাদের পক্ষে সম্ভব হয় অ্যাসিড-আক্রান্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে সাহায্য করা।২৮ ক্রমাগত প্রচারণার ফলে সরকার অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাস করে ২০০২ সালে। এর পর থেকে অ্যাসিড-সন্ত্রাস হ্রাস পেতে থাকে, যদিও তা এখনো নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।

আরেকটি দেশজ আন্দোলনের উদাহরণ হলো তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কার্যক্রম। জাতীয় সম্পদ, বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদ যাতে দেশের মানুষের প্রয়োজনে লাগে, এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে যাতে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ে। এ জন্য তারা ধারাবাহিকভাবে প্রচার ও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এ কাজে তারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরও শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো বেসরকারি সেবামূলক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো, যারা এনজিও নামে পরিচিত। এরা অনেকেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্ষুদ্রঋণসংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে, যার মূল দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার ম্যান্ডেট অনুযায়ী কাজ করে না বলেই এনজিওগুলো সেবা খাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারছে। রাষ্ট্রের কাছ থেকে সেবা আদায় করে নেওয়ার জন্য জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করা হলে হয়তো রাষ্ট্রের চরিত্র বদলানো যেত এবং সমাজে গুণগত পরিবর্তন আসত। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এনজিওগুলো কখনো সহায়ক, কখনো বা প্রতিযোগী হিসেবে সরকারের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের আমলাতন্ত্র, অস্বচ্ছ আচরণ ও দুর্নীতির কারণে শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অনুদান এনজিওগুলোর মাধ্যমে প্রবাহিত করতে পছন্দ করে। ফলে ওই দেশগুলোর সরকার ও নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে এ দেশের এনজিওগুলোর একটা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এদের কার্যক্রমে সরকার অনেক সময় বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ করে থাকে।

১১.

বঞ্চনা আর অত্যাচার থেকে ক্ষোভের জন্ম হয়, মানুষ বিদ্রোহী হয়। সমাজে বিদ্রোহ আপনাআপনি সংগঠিত হয় না। এ জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে হয়। যারা এই ভূমিকা পালন করে, মানুষের কল্যাণই তাদের লক্ষ্য।

১৮৩৫ সালের আগস্ট মাসে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় কার্ল মার্ক্স একটি রচনা লিখেছিলেন। রচনার শিরোনাম: একজন তরুণ পেশা নির্বাচন করবে কীভাবে। পেশা নির্বাচনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত তা হলো, কী করে মানুষের কল্যাণ করা যায় এবং তার নিজেরও বিকাশ ঘটে পরিপূর্ণতার দিকে। শুধু নিজের জন্য যে বাঁচে, সে হয়তো ব্যক্তিগত খ্যাতি অর্জন করতে পারে, একজন পণ্ডিত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে, হতে পারে একজন চমত্কার কবি। কিন্তু কখনোই সে একজন মহত্ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। সাধারণের কল্যাণের জন্য যাঁর প্রাণ নিবেদিত, তিনিই মহাত্মা।২৯

মার্ক্স এমনতর অনুঘটকের কথা কল্পনা করেছেন, যিনি মানবজাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করবেন। তাঁর কল্পনায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন সম্ভবত প্রমিথিউস। মার্ক্স তাঁর পিএইচডি থিসিসের ভূমিকায় ঈশ্বরের দাস হার্মেসের প্রতি প্রমিথিউসের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন।

জেনে রাখো তোমার গোলামি

কখনো মেনে নেব না আমি

নফর হব নিছক পাথরের

তবু হব না অনুগত দেবতা জিউসের।৩০

মার্ক্স প্রমিথিউসকে আখ্যায়িত করেছেন ইতিহাসের প্রথম বীর এবং প্রথম শহীদ হিসেবে। প্রমিথিউস একটি পৌরাণিক চরিত্র। প্রতীকী অর্থে সমাজের অসামঞ্জস্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তিনিই নেতা। আমরা আধুনিক সমাজের জটিল অবয়বে ও বুননে যে ক্ষুদ্রতা, শঠতা, নিপীড়ন ও লুণ্ঠন দেখি, সেখানে নাগরিক সমাজের উপলব্ধি ও কর্মকাণ্ডে প্রমিথিউসীয় আবেগ, অঙ্গীকার ও সততার বড়ই প্রয়োজন। এর অনুপস্থিতি এবং সুবিধাবাদের দৌরাত্ম্যে আমরা সমাজে অনেক আন্দোলন দেখলেও পরিবর্তন দেখি না। মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ক্ষমতার পালাবদল দেখি।

প্রমিথিউস একটি একক সত্তা, এক ব্যক্তি। বাংলার কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’র প্রেক্ষাপটে একজন ব্যক্তি, তিনিই সব। অন্যায়, অবিচার, ক্ষমতার দম্ভ ভেঙেচুরে তিনি সাম্য প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু বাস্তবে সামাজিক পরিবর্তন ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয় না। সামাজিক শক্তিকে এগিয়ে আসতে হয়। সামাজিক শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হয়। তাকে সংগঠিত করতে হয়। আধুনিক বিশ্বে নাগরিক সমাজের আন্দোলন হলো যূথবদ্ধ প্রয়াস। কোনো একজন পণ্ডিত বা বিদগ্ধ লোকের পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি এখানে অপরিহার্য নয়। অনেকেই ভাবেন, অমুক একজনের জন্ম না হলে এটা হতো না, সেটা হতো না—এ ধারণা অবৈজ্ঞানিক ও ভ্রান্ত।

১২.

নাগরিক সমাজের আন্দোলন তখনই বেগবান হয়, যখন অধিকসংখ্যক নাগরিক সেই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষার বাইরে নেতৃত্বের কোনো গোপন এজেন্ডা থাকে না। নাগরিক আন্দোলনকে তার নিজস্ব সীমানা মেনে চলতে হয়, নইলে তা আর নাগরিক সমাজের আন্দোলন হয় না। প্রকৃতপক্ষে তা হয় রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য বা গোপন লেজুড়বৃত্তি। এ ধরনের এজেন্ডা নিয়ে আমাদের দেশে অনেকেই নাগরিক কমিটি নাম দিয়ে রাজনীতি করেন। এ কাজ নাগরিক সমাজের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাকে বেপথে নিয়ে যায়। এ ধরনের রাজনৈতিক তত্পরতার কারণে এ দেশে এনজিওগুলোর সমন্বয়কারী সংস্থা এডাব এবং পুরো এনজিও খাত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

নাগরিক সমাজের একটি রাজনৈতিক অবস্থান থাকা জরুরি। কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর কোনো একটির পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার তো কোনো প্রয়োজন নেই। নাগরিক সমাজের দৃষ্টি থাকবে সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে। এ পরিবর্তন হতে হবে প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে। কাকে সরিয়ে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেই বিবাদে যুক্ত হয়ে পড়া নাগরিক সমাজের কাজ নয়। নাগরিক সমাজের আন্দোলন হবে নাগরিক শক্তির আবাহন করে সমাজের মানুষের পরিপূর্ণ ক্ষমতায়নের। এটাকে ক্ষুদ্র বুদ্ধির মানুষেরা ইউটোপিয়া বলে যতই গালমন্দ করুক, একদিন না একদিন ওই পরিবর্তন আসবেই। দিনক্ষণ ঠিক করে এই পরিবর্তন আসবে না, তার প্রয়োজনই বা কী। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।

তথ্যসূত্র

১. CIVICUS, Civil Society Index Methodology and Conceptnal Framework, www.civicus.org

২. Center for Civil Society, Philippine Normal University, 2004.

৩. খন্দকার সাখাওয়াত আলী, আন্তোনিও গ্রামসির জীবন সংগ্রাম ও তত্ত্ব, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১।

৪. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্টাল প্রকাশন, কলিকাতা, ১৯৮৩।

৫. Peter Kropotkin, ‘Anarchism,’ Encyclopaedia Britannica, 1910.

৬. Michail Bakunin, Statism and Anarchy, Cambridge University Press, 1991.

৭. Mohuuddin Ahmad, Seaul Diary, Ayan Parokashani, Dhaka, 2009.

৮. Ian Birchall, Sartre Against Stalinism, Berghahn Books, 2004.

৯. Iain Walker, Heather J. Smith, Relative Deprivation: Specification, Development and  Integration, Cambridge University Press, 2001.

১০. Tedd Robert Gurr, Why Men Rebal, Princeton University Press, 1970.

১১. Macionis, J and Gerber, L (2010). Socioloty.

১২. Shahid Amin, Event, Metaphor, Memory, Chauri Chaura, 1922-1992, Barkely, University of California Press, 1995.

১৩. Canadian Council on Social Development, Defining and Re-Defining Poverty: A CCSD Perspective, 2001.

১৪. Nelson A. Pichardo, ‘New Social Movements: A Critical Review,’ Annual Review of Sociology Vol.23. Annual Reviews Inc, CA, 1997.

১৫. Cynthia Kaufman,  Ideas for Action: Relevant Theory for Radical Change, South End Press, Cambridge, MA, 2003.

১৬. Antonio Gramsci, Selection from Prison Books, Lawrence and Wishart, 1982.

১৭. Joseph A. Buttigieg, The Contemporory Discourse on Civil Society: A Gramscian Critique Boundry 2, Duke University Press, 2005.

১৮. Patricia Phillips, The Scientific Lady: A Social History of Women’s Scientific Interests 1520-1918, St Martins, N.Y, 1990.

১৯. Allison Sneider, ‘The New Suffrage History: Voting Rights in International Perspective,’ History Campass vol, 8, issue, 7, 2010.

২০. www.britannica. com (EBchecked/topic/647122/womens-Movement.

২১. Jhonson, Merri, Lisa, ed,  No Turning Back: The History of Feminism and Future of Women, London, Ballantine Books, 2002.

২২. Mohiuddin Ahmad, ‘Breaking the Barrier: Inter Asia Reader on Democratization and Social Movements,’ Development & Social Movement Institute, Sungkonghoe University, Seoul, 2008.

২৩. Ibid

২৪. Ibid

২৫. Ibid

২৬. আবুল কাসেম ফজলুল হক, মুক্তিসংগ্রাম, প্রথম পর্ব, ১৯৭২। 

২৭. Asiatic Society of Bangladesh, Banglapedia, National Encyclopedia of Bangladesh, 2006.

২৮. www.prothom-alo.org.

২৯.Karl Marx and Fredrick Engels, Collected Works, Volume-1, Progress Publishers, Moscow, 1975.

৩০. মহিউদ্দিন আহমদ, কার্ল মার্ক্সের কবিতা, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৫।