বাংলাদেশ: একটি ইসলামি প্যারাডাইমের সন্ধানে

Your paradigm is so intrinsic to your mental process that you are hardly aware of its existence, until you try to communicate with someone with a different paradigm.³ -Donella Meadows

সারসংক্ষেপ

জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান এক সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু বিষয় এসব প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সেটি হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যত্। নতুন প্রজন্ম কোন ধারায় তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে সেই বিষয়টিও ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন এক ইসলামি ধারার উত্থান, যেটি বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চ্যালেঞ্জ করছে, সেটিই সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্বের জায়গাটি করে দিয়েছে। শুধু একটি মাত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে জাতিপরিচয় নির্ধারণ করার মাধ্যমে কেউ কেউ ধর্ম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। এদের মধ্যে ফরহাদ মজহার অন্যতম। তাঁর নিজের যুক্তি-তর্কের মধ্যে এমন অনেক অসংগতি পরিলক্ষিত হয় যার মাধ্যমে জনমনে জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম—উভয় সম্পর্কেই বিভ্রান্তির জন্ম হয়।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাম্রাজ্যবাদ, আধুনিকতা, আত্মপরিচয়, ভূকৌশলগত রাজনীতি, ফরহাদ মজহার।

প্রারম্ভিক কথা

বাংলাদেশ আজ এক আদর্শিক সংকটকাল পাড়ি দিচ্ছে। সেই সংকট মূলত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক। তার ওপর একটি মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এ প্রবন্ধটি লেখা হলো। যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে, তা থেকে উত্তরণে বিশেষ কোনো উত্কণ্ঠা রাজনৈতিক মহলে নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি বিকল্প চিন্তা আমাদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। যদিও সেটি সুগঠিত নয় এবং যদিও বিকল্প হিসেবে তার প্রণেতা তাকে কতটুকু দেখবেন, জানা কঠিন, তবু সেই বীক্ষণ নানাভাবে আমাদের ব্যক্তিচিন্তাকে এবং রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার কারও কাছে আজ আর কোনো নতুন খবর নয় বটে, কিন্তু তার ভিত্তিতে নতুন আদর্শিক বিকল্প গড়ে তোলার সবিনয় এই বিশেষ আকাঙ্ক্ষাটি কেন মনোযোগ দাবি করে, তার কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক ইসলামের যেসব ধারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তত্পর এবং যাদের অনেকগুলোই কোনো না কোনোভাবে ইসলামি মৌলবাদের বৈশ্বিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তারা কী কারণে বাংলাদেশকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র হতে হবে, তার যৌক্তিকতাকে কোনো স্থানিক তত্ত্ব দিয়ে তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি। আদর্শের স্থানীয়করণের সেই কাজটি এতকাল অসম্পূর্ণ থাকলেও এই বিকল্প আদর্শিক কাঠামো সেই অভাবটি পূরণ করেছে মূলত ফরহাদ মজহারের কল্যাণে। তবে ওই চিন্তায় নিহিত ব্যতিক্রমধর্মিতাই কিন্তু এই লেখার একমাত্র কারণ নয়। তার চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে, পুঞ্জীভূত আকারে সেখানে বাংলাদেশের আদর্শিক উত্থান-পতনের একটি সার্বিক চিত্র মেলে, নির্যাস আকারে সংকটের মূর্ত রূপ তো বটেই, সেই সঙ্গে আরও ধরা পড়ে ওই দীনতার একটি নয়, একাধিক প্রবণতা।

এই ভাবপ্রবাহটি সম্পর্কে কেন অবগত হওয়া জরুরি, তার দ্বিতীয় কারণ রয়েছে। সেটি হলো সেখানে বাম রাজনীতির এ দেশীয় সংস্করণের একটি প্যাটার্ন আঁচ করা যায়। সেই প্যাটার্নে আজ সংকটে নিমজ্জিত জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঙ্গে তার নৈকট্যের প্রকৃতিগত দিকটি কম গুরুত্বের নয়। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে এ দেশে যাঁরা দীর্ঘকাল সম্পৃক্ত ছিলেন বা আছেন, তাঁদের মনোজগতের পরিবর্তনটি অনেকেই লক্ষ করবেন। ঠিক মজহারের মতো গভীর বৈপরীত্যে ভরপুর। উত্তাল বিবর্তনের অপঘাতে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ওই আদর্শ আজ নতুন আঙ্গিকে ঘর গোছানোর শান্ত, নিদ্রালু প্রচেষ্টায় রত হলেও যে আদর্শিক ভগ্নাংশের ওপর দাঁড়িয়ে ওই নব্য ভাবনা বাসা বাঁধছে, সেখানে দুটি একে অপরের বিরোধী প্রবণতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার একটি হলো পুঁজিবাদ-সমাজবাদ দ্বন্দ্ব থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে নতুন আদর্শ গড়ার প্রচেষ্টা। অথবা পুঁজিবাদী বিকাশ যেসব পরিত্যক্ত বিষাক্ত উপাদান মানুষের জৈবিক অস্তিত্বকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে (পরিবেশ, গ্রিনহাউস গ্যাস), সেসব ইস্যুকে নিয়ে অথবা সমাজের শ্রেণী নয় বরং অধস্তন নাগরিক সংকটকে মূলধন করে ভিন্ন আদর্শিক ধারার জন্ম দেওয়া। বাম রাজনীতির ভিন্ন আরও একটি ধারা নতুন রাজনীতির ক্ষেত্র হিসেবে নাস্তিক-আস্তিক বিভক্তির দেয়ালকে কাজে লাগাতে চায়। নাস্তিক সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এবং ধর্মীয় আস্তিকতার দ্বন্দ্বে সংকটপীড়িত এই আদর্শ আকস্মিকভাবে আন্তর্জাতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে স্থানীয় জ্ঞানপ্রীতি দেখাতে উদগ্রীব, অনেকটা ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুঁকোর ঢঙে১। ইরানের আয়াতুল্লাহদের বিপ্লব (১৯৭৯ সালের) মিশেল ফুঁকোর মনে যে বিকল্প আবেগ সৃষ্টি করেছিল এবং আধুনিকতার বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে নতুন শিয়া আধ্যাত্মিকত্বকে আবিষ্কার করেছিল, সাবেক মার্ক্সবাদীদের অনেকেই ঠিক একই পথে পবিত্র ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ঘটিয়ে বাঙালি আধ্যাত্মিকতার নিজস্ব ঢং গড়ে তুলতে সচেষ্ট আছেন। প্রবণতাটি কেবল যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এ কথা ভাবলে ভুল হবে। আন্তর্জাতিকভাবে সোভিয়েত কমিউনিস্টরা ইতিমধ্যে পুঁজিবাদ ও ধর্মীয় ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এককালে আফগানিস্তানে যাঁরা কমিউনিস্ট ছিলেন, তাঁদের অনেকেই তালেবানের কৌশলগত নেতৃত্বে নিজেদের নতুন সত্তা আবিষ্কার করেছেন। বাংলাদেশি বামের চরিত্র সেদিক দিয়ে ভাবলে বিশেষ কোনো চমক সৃষ্টি করে না বটে, কিন্তু তারই এককালীন প্রতিনিধি ফরহাদ মজহারের নিজস্ব ডিগবাজির চারিত্রিক দুর্ধর্ষতা এবং দানবীয়তা নিঃসন্দেহে অবাক করে।

বাম ধারা ও জাতীয়তাবাদ

সাম্প্রদায়িকতা এবং আস্তিক-নাস্তিক বিভেদের দেয়াল সৃষ্টি করে বাংলাদেশি বামের একাংশ যে আদর্শিক বিকল্পের জন্ম দিচ্ছে, সেটি কিন্তু মৌলবাদী ইসলামের এক অভিন্ন মহাস্রোতেই মিশে যায়। আর সেই মহাস্রোতের আদর্শিক উত্সকে আংশিকভাবে হলেও খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদে। নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এ দেশের প্রধান সেই আদর্শ আমাদের মনোজাগতিক ক্ষুধার আংশিক সমাধান করে গেছে, সন্দেহ নেই। এবং এ কথাও তো সত্য যে ৪২ বছরের রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তন, জাতিপরিচয়ের পরিবর্তে ধর্মীয় মুসলিম পরিচয়ের প্রাধান্য এই আদর্শের দেহে রক্তের ছাপও রেখে গেছে। তা ছাড়া নিঃশেষিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিজেকেই কেবল নিঃশেষিত করেনি, প্রকৃতিগতভাবে ভয়ংকর এক সংকটও সে রেখে গেছে আমাদের জন্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যখন ধর্মনিরপেক্ষতাকে বুঝে কিংবা না বুঝে এ দেশের সংবিধানে স্থান করে দিয়েছিল ধর্মভীরু বাঙালিকে গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়ে, তখন তাকে ধর্মহীনতা হিসেবে বিবেচনা করে ওই ধর্মহীনতার আদর্শিক মোকাবিলার অন্যতম পথ হিসেবে দেশের বাম ও ডান বুদ্ধিজীবী মহল বেছে নিয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা আর ভারত-বিরোধিতাকে। ধর্মহীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তির এই আদর্শিক প্যারাডাইম পুরোনো, পাকিস্তানি সময়কালের অবশিষ্টাংশ হলেও সেটি জাতিসচেতন বাংলাদেশের জন্য কার্যকর একটি আদর্শে কেন পরিণত হয়ে গেল, তার জুতসই কোনো ব্যাখ্যা আজও আমাদের হাতে নেই। ২০১৩ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার ধরন থেকে যে চিত্র আমরা পাই, তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ওই সাম্প্রদায়িকতার প্রতীকী উপস্থিতি পুনরায় দৃশ্যমান। এই সহিংসতা বিশেষ উত্সাহ নিয়ে ঘটানো হয়েছিল ভারতীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে। ফলে বুঝে নিতে হবে, আগুন জ্বালিয়ে আদর্শিক সীমানা নির্ধারণের এই প্রয়াসকে কেবল আদর্শিকই নয়, তাকে আক্ষরিক অর্থে বুঝে বিরোধটিকে সংখ্যালঘু বনাম সংখ্যাগুরু, কল্পিত ইসলামি বাংলাদেশ বনাম হিন্দু ভারত হিসেবেও দেখতে হবে বৈকি২।

এই সাম্প্রদায়িকতার আরও বড় প্রাপ্তি হলো, সে কোনোভাবেই আজ আর একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলের সম্পত্তি নেই। সেখানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী যেন গঙ্গা, যমুনা, ধলেশ্বরীর স্রোতোধারার মতো এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে সাম্প্রদায়িকতার নোনাজলে অবগাহন করতে নৈতিক দিক দিয়ে অপরাধ বোধ করে না। গোত্রপরিচয়, পারিবারিক সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিস্তীর্ণ জালে আটকা পড়া ইদানীংকালীন বাঙালি মধ্যবিত্ত মনন বৈধব্যের জলে বাস করে; দ্বিধাহীনভাবে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নাগরিক অধিকারকে অবজ্ঞা করে, জাতিপরিচয় সেখানে নিতান্তই মামুলি ব্যাপার। হয়তোবা এই জাতীয়তাবাদ সংখ্যালঘু জাতির প্রতি (পাহাড়ি নামে পরিচিত) যে ব্রাহ্মণ্যবাদী আচরণ করে এসেছে, সে সম্পর্কে আমাদের সচেতনহীনতার মাশুল গুনতে হচ্ছে আজ, এভাবে। তবে এই অভিন্ন সাম্প্রদায়িকতা এবং এককালের অসাম্প্রদায়িক দলের সাম্প্রদায়িক হওয়ায় বাম বুদ্ধিজীবী মহলের কেউ কেউ আজ যে রাজনৈতিক আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে (দেখুন ফরহাদ মজহার, খালেদার জয় পরাজয়, ২১ জানুয়ারি ২০১৪) সেটিও আদর্শিক সংকটের প্রলম্বিত গভীরতাকে তুলে ধরে বৈকি। নিশ্চিত যে রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক গর্ভে আশ্রয় নিয়ে জাতীয়তাবাদী আদর্শ জাতির এই চরম দুর্যোগ মুহূর্তকে অবলোকন করছে বিদ্রূপের হাসি হেসে।

বাম আদর্শ এবং জাতীয়তাবাদী ডান আদর্শের এই বিরল মিলন কীভাবে সম্ভব হলো, তার ব্যাখ্যা যে নেই তা নয়। উভয় আদর্শ মানুষের আত্মপরিচয়কে একটিমাত্র পরিচয় দিয়ে চিহ্নিত করে এসেছে। বাম আদর্শ শ্রেণী অবস্থানকে মানুষের একমাত্র পরিচয় হিসেবে মেনে নিয়ে সবার জন্য যে গোষ্ঠীপরিচয় নির্ধারণ করে দেয়, তাতে করে মানুষের বাকি সব পরিচয় নগণ্য অথবা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। জাতীয়তাবাদ জাতিপরিচয়কে আত্মপরিচয়ের একমাত্র মানদণ্ডের মর্যাদা দিয়ে মানুষের বাকি পরিচয়গুলোকে তার কাছে অধস্তন রাখে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ওই একই কথা। অমর্ত্য সেন তাঁর আইডেনটিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স নামক গ্রন্থে এই সমস্যা তুলে ধরেছেন রুয়ান্ডার হুতু ও তুতসিদের৩ বিরোধের প্রেক্ষাপটে। হুতু এবং তুতসি দুই গোত্র তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালায়। মানুষের বহু পরিচয়ের মধ্যে ওই একটি পরিচয়কে আত্মপরিচয়ের একমাত্র উত্স হিসেবে বেছে নিয়ে এবং সেই পরিচয়কে গোষ্ঠীপরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ সন্ত্রাস ব্যতীত যে সম্ভব নয়, সেটি অমর্ত্য সেন ভালোভাবেই দেখিয়েছেন। বিশেষ একটি পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাম রাজনীতি অথবা ধর্মীয় রাজনীতি অভিন্ন। এই আদর্শের ধারক যখন একটি পরিচয়ের ব্যর্থতায় হতাশ হয় এবং আদর্শিক স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তখন এক পরিচয় থেকে অন্য পরিচয়ে যাওয়াটা ঠিক মজহারের মতো, যেভাবে তিনি বাম থেকে জাতীয়তাবাদ এবং তা থেকে ধর্মীয় ভাবাদর্শের প্রণেতা হয়েছেন, বড় কঠিন কোনো কাজ থাকে না।

আদর্শিক ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী ইসলাম কিন্তু জাতীয়তাবাদের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ ও অকার্যকর। সে কারণে বাম বা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মতো তার দেহও জর্জরিত এবং ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৯ সালে যে সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং রাজনৈতিক ইসলামকে ধীরে ধীরে জঙ্গি রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার ফলে আমেরিকা-সমর্থিত মুজাহিদিন এবং আল-কায়েদার ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েতবিরোধী মহাজোট আফগানিস্তানের মাটিতে এক বিশেষ সুন্নি ইসলামি ধারার জন্ম দিয়েছিল। সেই ধারায় স্থান পাওয়া হানাফি, সালাফি, ওয়াহাবি, আল-কায়েদা, হেফাজতি, তালেবানি আদর্শ একে অপরের বিরোধী হয়ে রক্তের বন্যা বইয়েছে। শিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে সুন্নি ইসলামের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অভ্যন্তরীণ অসহিষ্ণুতাকে জাগিয়ে তুলতে ব্যস্ত রয়েছে (‘ইরাকে জঙ্গি নির্মমতা’ শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোয় ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে প্রকাশিত খবর হলো নামাজ পড়তে বাধ্য করে শিয়া নিশ্চিত হওয়ার পর হত্যা)। ওই অসহিষ্ণুতা জাতিবিভেদের কর্কশ এবং মারাত্মক বাস্তবতায় ইরানি, ইরাকি, দ্রুজ, আলায়ি, লেবাননি হিজবুল্লা, আশুরা ইত্যাদি বিপরীতমুখী এবং একে অপরের ধ্বংসকারী ধারা-উপধারায় বিভক্ত হয়ে ইসলাম ধর্মের একতাকেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে। অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো বাংলাদেশেও চলছে রাজনৈতিক ইসলামের দেহে নীরব রক্তক্ষরণ, বিভক্তির অনন্ত প্রবাহ। এই আন্দোলন এ দেশে একটি নীরব সংগ্রাম হিসেবে স্বাধীনতা-উত্তরকালে টিকে ছিল। কোনো রকমে নাকটা পানির ওপর উঁচু রেখে ওই সংগ্রামে তার কলঙ্কময় ও সর্বজননিন্দিত ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সৈয়দ কুতুব এবং ভারতবর্ষে মাওলানা মওদুদির আদর্শের ওপর ভর করে গণভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর চেষ্টাও নিয়েছিল। কিন্তু আকস্মিকভাবে তার সেই গণমুখী চেহারা পাল্টে গিয়েছে। ফুটে উঠেছে মৌলবাদী রাজনৈতিক ইসলামের চরম সংকট।

ফলে বাংলাদেশকে আজ পুরোনো আদর্শের এক বিশেষ ধ্বংসস্তূপ হিসেবে ভাবতে দোষ নেই। সে ধ্বংসস্তূপে স্থান করে নিয়েছে রাজনৈতিক ইসলাম, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, বামপন্থী রাজনীতি। এ যেন ঠিক সেই চিত্র, যেখানে পোস্টমডার্নিস্টরা আধুনিকতাবাদের তত্ত্বীয় কাঠামোকে ধ্বংস করে ইউরোপে নতুন পোস্টমডার্ন ধারা সৃষ্টিতে ব্রত হয়েছিল দার্শনিক নিেসর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে৪। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজ প্রগতি, ধর্মীয় বিশ্বাস জগত্, সমতার আদর্শিক কাঠামো, ভ্রাতৃত্ববোধের মতো সব প্রত্যয়; যা আধুনিক প্রজেক্টের মূল ভিতে স্থান করে নিয়েছিল, তাকে ভেঙেচুরে ফেলা। সে প্রজেক্ট ইউরোপে সফল হয়নি। কিন্তু আদর্শের বাংলাদেশীয় এই ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে মনে হতে পারে আর কেউ না হলেও আমরা সেই ইউরোপীয় পোস্টমডার্ন প্রজেক্টের সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তোলা মজহারীয় প্রজেক্ট অর্থাত্ বাংলাদেশের জন্য বিকল্প আদর্শ কতটুকু কার্যকর, সেটিই বিচার্য।

মজহারীয় আদর্শ: প্রাক্কথন

ফরহাদ মজহারের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন অভিজ্ঞতায় একটি দিকই চিরন্তন হিসেবে ধরে নিতে হবে, সেটি হলো পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনপ্রবাহে দুটি প্রবণতা সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া জরুরি। কারণ তাতে করে পাঠকের পক্ষে আগেভাগেই তাঁর আদর্শিক গতিপথের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অব্যর্থভাবে সুবিধাবাদের সুস্পষ্ট ছাপ প্রত্যক্ষ করবেন যেকোনো বিজ্ঞজন। রাজনীতির ঘোড়দৌড়ে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করা তাঁর চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। যেভাবেই হোক, নিজেকে রাজনীতির উজ্জ্বল আলোর সামনে দাঁড় করানো, সেখানে প্রতিবাদী অথচ গতানুগতিক নয় এমন কোনো অবস্থানে নিজেকে হাজির করা, যেন, সে অবস্থান যতই সারশূন্য বা অন্তর্বিরোধী হোক না কেন, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল কট্টর বাম ধারার সংস্পর্শে এসে, ঠিক যখন চীন-সোভিয়েত বিভেদ তুঙ্গে। বাংলাদেশি বামেরা তখন বড় সংখ্যায় চীন পন্থার দিকে ঝুঁকছে। সর্বহারা পার্টির নেতা হয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পদ্ধতির চুলচেরা বিশ্লেষণে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা এবং আদর্শিক সততা দেখিয়ে প্রতিবিপ্লবীদের সংখ্যা কানায় কানায় পূর্ণ করেছিলেন। বিভেদপীড়িত বাম আন্দোলনের ধূম্রজালে তাঁর প্রয়াস যখন ধূসর হতে চলেছে, তখন আদর্শিক যাত্রার মোড় জাতীয়তাবাদী ধারার দিকে ঘুরিয়ে নিতে তিনি কালবিলম্ব করেননি। শেখ হাসিনাকে রাজকুমারী বলে সম্মানিত করে নিজ আদর্শের একটি সামাজিক বন্দর নির্মাণে ক্ষীণকাল উত্সাহী হয়েছিলেন, কিন্তু সুবিধার ঘাটতি ঘটায় পুনরায় দিক পরিবর্তন করে ইসলামি জাতীয়তাবাদী আদর্শের চোরা স্রোতোধারায় নিজের অবস্থানকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। সেপ্টেম্বর ৯-এর টুইন টাওয়ার আক্রমণের পর সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা যখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, তখন ওসামা বিন লাদেনকে বর্তমানকালের চে গুয়েভারার সম্মানে ভূষিত করেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লাদেনীয় উগ্রতার একনিষ্ঠ সঙ্গী মজহার তাঁর আদর্শিক নৌকাকে শেষমেশ কট্টর রাজনৈতিক ইসলামের বিপজ্জনক বেলাভূমিতে নোঙর করেন। অর্থাত্ এককালের নাস্তিক মজহার রূপান্তরিত হয়ে যান আস্তিক মজহারে। অধ্যাপক সামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত৫ তাঁকে এ ক্ষেত্রে কতটুকু উদ্বুদ্ধ করেছিল বলা কঠিন হবে। যদিও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্বকে মার্কিন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে খ্রিষ্টীয় সভ্যতার আদর্শিক ঘাঁটিতে আঘাত করার সংগ্রাম কিন্তু সঠিকভাবেই তাঁর ওই আদর্শিক সংঘর্ষের ফ্রেমওয়ার্কে বেশ ভালোই খেটে যায়৬। চরাই-উতরাইয়ে ভরপুর এই সুদীর্ঘ অভিযাত্রা সুবিধাবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে আজ আর বাধা নেই। কারণ পৌনঃপুনিক অবস্থান বদলের গুণাবলিসমৃদ্ধ এই রাজনৈতিক জীবনটি সবার কাছে যেকোনো সময়ের চেয়ে আজ অনেক বেশি স্বচ্ছ।

প্রাক্সিসের এই রঙিন এবং বিনোদনী জগতের বাইরেও আরও এক নন্দিত জগত্ তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন, পরিসরগত এবং সুবিধাবাদের বিচারে যেটি কম বিস্তীর্ণ নয়। জ্ঞানের স্থানীয়তার ওপর জোর দিতে গিয়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে জেহাদি সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। সেই প্রয়াসে প্রথমেই ভাষাতত্ত্বের জগতে আঘাত বাংলা ভাষার ইসলামীকরণের প্রজেক্ট হাতে নিয়ে। ‘উন্নয়ন রাজনীতি’ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব যখন মাতোয়ারা, তখন এক বিকল্প উন্নয়নধারার জন্ম দিতে তিনি উত্সাহ দেখিয়েছেন। ওষুধনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন তাঁর কাম্য ছিল। সে উদ্দেশ্যে গণস্বাস্থ্যভিত্তিক বিকল্প স্বাস্থ্যনীতির পক্ষে ওকালতি করেছেন। ‘নবকৃষি আন্দোলন’ শুরু করে কৃষি উত্পাদনে স্থানীয় লোকজ্ঞানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে যে জ্ঞানভান্ডার তিনি গড়ে তোলেন, সেটি বহুজাতিক করপোরেশনকে, তাঁর ধারণায়, এক হাত দেখে নিয়েছেন বটে। কিন্তু সেই প্রয়াসের অর্থ এসেছে সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান থেকে। ভাবাদর্শের দেশীয় জগত্ও তাঁর প্রভাবমুক্ত থাকেনি। বাংলার মাটির আপন সন্তানদের আধ্যাত্মিক ভুবন বিশেষ করে লালনকে অবলম্বন করে তিনি জাতিপরিচয়ের নতুন সীমানা আঁকতে সচেষ্ট হয়েছেন। নিজ প্রচেষ্টাকে আধ্যাত্মিক জগতের বলয়ে সীমিত না রেখে লালনের জন্মস্থানে তিনি গড়ে তুলেছেন এনজিওভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, যা কিনা অর্থ উপার্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে বেশ সুফল দিয়েছে। অর্থাত্ প্রতিভাধর এই ব্যক্তি এমন একটি আদর্শিক এবং ব্যবহারিক ভুবন গড়ে তুলেছেন, যে ভুবনে মানুষ ভুল করে স্বদেশপ্রেম ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার গভীর বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করে থাকেন।

ফরহাদ মজহারের আদর্শিক কাঠামোতে সমন্বয়ী বা মিশ্র কৌশল কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে আছে, এটি আবিষ্কার করা কঠিন কোনো কাজ নয়। তবে সমন্বয়ী বলে তাঁকে অপাঙেক্তয় ভাবা শ্রেয় হবে না। যে দেশে তিনটি মৌলিক আদর্শের কোনোটিই কার্যকরী শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি, সে দেশে সমন্বয়ের কৌশলী উপস্থাপন কিছুটা কার্যকর হলেও হতে পারে, এমন আশাবাদ অবান্তর হবেই বা কেন। সমন্বয়ী পদ্ধতির নানা প্রয়োগ আমরা ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি একটি কৃষিপ্রধান সমাজে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে সামাজিক সমতার ধারণাকে গ্রহণযোগ্য করার আন্দোলনে। এককালে তথাকথিত ‘ধর্মহীনতার’ অপবাদকে পাশ কাটানোর লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শুনেছি রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডকে ধর্মের হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখার পরামর্শে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুষঙ্গ হিসেবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মের সেই সমন্বয়ী কৌশল কতটুকু সফল হয়েছিল, তা পরিমাপের কোনো মানদণ্ড নেই। কিন্তু বিশ্ব পরিসরে সমাজতন্ত্রের আপাত ব্যর্থতাকে নির্ণায়ক হিসেবে ধরলে তার পরিধি পরিমাপের জন্য পণ্ডিতি মেধার প্রয়োজন হয় না। আজ ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির কৌশলগত ভ্রান্তি এই ধারা উপলব্ধি করে। আর সেই ভ্রান্তি সংশোধনে ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে অসাম্প্রদায়িক শব্দটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় আরও একটি সমন্বয়ী পথ লক্ষ করা গিয়েছিল মওলানা ভাসানীর মতো জাতীয় এবং জনপ্রিয় নেতার কৌশলে। ইসলামি বাক্যবিন্যাসের সহায়তা নিয়ে তিনি ধর্ম সম্পর্কে সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তেতো ভাবটা কিছুটা হলেও লঘু করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। মানুষের শ্রদ্ধাও কুড়িয়েছিলেন সযত্নে। কিন্তু সহযাত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাঁকে অপদস্থ করার ষড়যন্ত্রে ওই প্রয়াসের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। মওলানা সাহেব নিজেও বিভিন্ন সময়ে স্ববিরোধী এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে নিজের প্রচেষ্টাকে নিজেই লঘু করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর সেই কৌশল ব্যর্থ হয়েছিল সফল হওয়ার আগেই। তবে স্বীকার করতেই হবে যে সমন্বয়ধর্মী চিন্তাকাঠামো নিয়ে পরীক্ষণের যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনি রয়েছে ঝুঁকি। ঝুঁকি হলো এখানে ধর্মকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরে নিয়ে তার গায়ে সমাজবাদের রং মিশিয়ে সমন্বয়ের যে ভাব সৃষ্টি করা হয়, সেখানে দুই আদর্শ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অবস্থান করে। ফলে আপত্কালীন দুর্যোগের মুখে সমাজবাদকে ত্যাগ করে ধর্মের রাজনৈতিক আশ্রয়ে যাওয়ার লোভ সংবরণ করা অনেকের পক্ষে কঠিন হয়। মিশ্রের আরো যে সুবিধা নেই তা নয়। তাকে নানাভাবে ব্যবহার করা যায়। বহু উপাদান নিয়ে গড়ার কারণে কোনো এক দিকের দুর্বলতাকে সমালোচনায় কাবু করা গেলেও সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিককে হাজির করে সমালোচনার যুক্তিকে খণ্ডন করা সম্ভব হয় বলে। ফলে পদ্ধতিগত দিক থেকে মিশ্র আদর্শের থাকে এক নয়, একাধিক প্রতিরোধের দেয়াল।

ফরহাদ মজহার তাঁর মিশ্রতাত্ত্বিক অবস্থানের বিপদ সম্পর্কে কতটুকু সচেতন বা তাঁর অবস্থান কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ, সেটি পরিষ্কার নয়। তাঁর সেই মিশ্র ভাব যদি নিজেই বড় বিপদের কারণ হয় অর্থাত্ সরষের ভেতরেই যদি ভূতের আস্তানা থাকে, তাহলে সেটি সবারই মাথাব্যথার কারণ হবে বৈকি। কারণ মজহারীয় আদর্শের কোথাও রয়েছে সমাজতন্ত্রের কথা, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, নগর সভ্যতার বিরোধিতা, আবার পরিপূর্ণ নাগরিক না হওয়া নিয়ে দোষারোপ ও হাহুতাশ৭, সামাজিক আশ্রয় হিসেবে হেফাজতে ইসলামের দ্বারস্থ হওয়া, জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক ইসলামসহ ইসলাম নাম ব্যবহারকারী অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করার অমিত আকাঙ্ক্ষা। সেখানে মধ্যবিত্ত-বিরোধিতা রয়েছে, একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রামের বিরোধিতা আছে, দেশজ আদর্শ এবং ভাবের কথা আছে, আউল-বাউলের ভিত্তিমূলকে আদর্শিক তৃণমূল হিসেবে স্থান দেওয়ার নৈতিক তাগিদ আছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে এর সবকিছুর মূল লক্ষ্য ফ্যাসিবাদী একটি ইসলামি রাষ্ট্র, যার চারণভূমি জামায়াতে ইসলামীর মতো সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী রাজনীতি বা হেফাজতে ইসলাম আন্দোলন। হিটলার যেমন জাতীয় সমাজতন্ত্রের আশ্রয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন আদর্শিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মানবতার শত্রু তৃতীয় রাইখ, বিকল্প আদর্শ সৃষ্টির নামে মজহারের লক্ষ্য এবং পথটাও অনেকটা সে রকমের।

অবশ্য তাঁর ভাবগত অবস্থানের আকর্ষণশক্তি যে নেই, তা নয়। নিজের অবস্থানকে বিশুদ্ধভাবে বিদেশজাত তত্ত্ব থেকে দূরে রেখে তিনি, তাঁর দাবি অনুসারে বাংলার মাটির ওপর দিয়ে নানা ভাবের যে প্রবাহ এতকাল বয়ে গেছে, সেই ভাবকে ব্যবহার করেছেন। পদ্ধতিগত দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। দেশীয় আদর্শ দিয়ে দেশীয় সমস্যার সমাধান অবশ্যই আত্মতৃপ্তির কারণ হতে পারে। তা ছাড়া দেশীয় ওই ভাববৃক্ষের পরতে পরতে তিনি লক্ষ করেছেন বিপ্লবী চরিত্রের উপস্থিতি, যে কারণে সে কেবল ভাবাদর্শই নয়, সমাজ পরিবর্তনের অনুঘটকও বটে। দেশীয় আদর্শ নিয়ে এই উত্সাহ সহজ কথা নয়, সেখানেও যে রয়ে গেছে নানা চ্যালেঞ্জ, সে উপলব্ধি এসেছে অতি দ্রুত। প্রথমত, ওই ভাবকে ব্যবহারোপযোগী করতে হলে তাকে ইতিহাসের গহ্বর থেকে উদ্ধার করা চাই। চাই তাকে মাটি-বালি থেকে মুক্ত করে তার প্রকৃত চেহারাকে উন্মোচিত করা। সমস্যাটি কেন দেখা দিল, তার কারণ রয়েছে। তাঁর মতে, বাঙালি জাতি নিজের ভাবজগতের প্রতি বিশেষ কোনো মনোযোগ দেখায়নি কখনো, তার প্রতি বেখেয়ালি এবং উদাসীন থেকে বরং উপেক্ষা করে এসেছে বিদেশজাত নানা ভাবের প্রতি অনুরাগ দেখিয়ে, অনেকটা মাইকেল মধুসূধনীয় অভিজ্ঞতার মতো করে। আজ দেশীয় তত্ত্বের ঝাঁজ অনুভব করার সময় এসেছে, এসেছে আত্মশুদ্ধির। সেই প্রয়োজনটি উপলব্ধি করে অনেকটা দক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো তিনি নিজেই ওই দীর্ঘ পরিত্যক্ত ভাবজগতের বৈপ্লবিক চরিত্র উদ্ধারে ব্রত হয়েছেন। বাংলার ভবিষ্যত্ পথনির্দেশনায় সঠিক মর্যাদা দেখিয়ে তিনি তাকে ব্যবহার করতে চান। আর সেখানেই রয়ে যায় তাঁর চিন্তার মৌলিকত্ব। তবে জটিলতা রয়ে যায় অন্যখানে। অণুবীক্ষণীয় বিশ্লেষণে তাঁর সৃষ্ট সেই তাত্ত্বিক কাঠামোটিতে ধরা পড়ে বিরাট সব গলদ। গলদটি কোনো অসতর্কতার ফসল নয়, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেখানে রয়েছে জাদুকরি ফাঁকি, অভাবনীয় স্ববিরোধিতা, কথা এবং কাজের অমার্জনীয় বৈষম্য। ফাঁকিগুলো বাংলাদেশে সামাজিক-রাজনৈতিক মেরুকরণ যতই তীব্র এবং ঘনীভূত হচ্ছে, ততই প্রস্ফুটিত হচ্ছে। এই স্ববিরোধী অবস্থান এতকাল কেন বা কীভাবে ধামাচাপা রইল, কেন সচেতন পাঠকের কাছে তা ধরা পড়ল না, সেটি বিস্ময়কর।

তবে তাই বলে তাঁকে যে চরম খেসারত দিতে হয়নি তা কিন্তু নয়। শেষমেশ ককটেলের মতো এক জাতীয় সমন্বয়ী আদর্শ সৃষ্টি ছাড়া তাঁর আদর্শিক জিহাদ বেশি দূর এগোতে পারেনি, যার মিশ্র কারুকার্যে বিপরীতমুখী উপাদানের অভাবনীয় সমাবেশ; সামাজিক সমতার মোহনীয় অঙ্গীকার; ভেদমুক্তির প্রতিশ্রুতি, বাংলা-আরবি শব্দের খেয়ালি অথচ সচেতন মিশ্রণ; বাঙালি স্বকীয়তার অন্তরালে বাঙালিত্বকে ইসলাম হিসেবে জাহির করার দুরূহ প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। শব্দের ভোজবাজি, পাকা জাদুকরি পারদর্শিতা দিয়ে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশেষ শব্দ লহঙ্গ, যা আর কিছু না হোক, এ দেশীয় আদর্শিক লড়াইয়ে একটি অশনিসংকেত বটে। বাংলাদেশকে তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভাষায় বোঝা এবং তার ভিত্তিতে উপযুক্ত আদর্শ গড়ার কৃতিত্ব দাবি করতে গিয়ে তিনি যে মিশ্র ভাবদর্শনের ছদ্মাবরণ ব্যবহার করেছেন, সেখানে লুকিয়ে রয়েছে জঙ্গিবাদী এক ইসলামি রাষ্ট্রের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের আবছায়া ধরা পড়ে তাঁর লেখায় ও রাজনৈতিক প্রাক্সিসে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা

ফরহাদ মজহারের বিশেষ ঘৃণা রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি। তাঁকে তিনি তুচ্ছজ্ঞান করে ইসলামি সমাজ গড়ার বিকল্প পথের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইসলাম ধর্মকে বাদ দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে ভাবতে তিনি নারাজ। কারণ ইসলাম ও বাঙালির আত্মিক সম্পৃক্তিকরণ যাকে সিনেরজি বলে, তাঁর মতে, তৈরি হয়েছে ইসলামের প্রতিবাদী ঐতিহ্য, ভেদবিরোধী প্রকৃতির কারণে। তিনি লিখেছেন, ‘ধর্ম ‘আধ্যাত্মিক’ ব্যাপার হয়ে চিন্তার পর্যালোচনা, ভাবচর্চা ও রাজনীতি থেকে আলাদা হয়ে থাকুক এই অবাস্তব ও আজগবি অবস্থান নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা পুরানা ডুগডুগি বেদম পিটিয়ে যাচ্ছে। জাতীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক বাস্তবতা তাকে নতুন করে কিছুই ভাবতে শেখায় নি। বরং তার অবস্থান আগের মতোই ঘোর সাম্প্রদায়িক। বাঙালিত্বকে ইসলামের বিপরীতে স্থাপন করার পুরানা সাম্প্রদায়িক অভ্যাস সে এখনো ত্যাগ করে নি’ (মজহার, ২০০৬ পৃষ্ঠা ২৭)। অর্থাত্ তাঁর ধারণায় বাঙালির নাগরিক পরিচয় ধর্ম দিয়ে সংজ্ঞায়িত হতে হবে, জাতিপরিচয় দিয়ে অথবা অন্য কোনো পরিচয় দিয়ে নয়।

আত্মপরিচয়ের এই দিকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এমন সব রাষ্ট্রে বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। ধর্মের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক কী হওয়া উচিত, সেটি ঠিক ফরহাদ মজহারের মতো করে নির্ণয়ের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে আমরা লক্ষ করেছি অন্যান্য দেশে ও সমাজে। সে অভিজ্ঞতা বিশেষ মধুর নয়। বিশ্বের সব মুসলিম রাষ্ট্রকে নিয়ে একটি উম্মা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা জন্মেছিল ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক দিনগুলোতে। সেই উম্মা গঠনে নানান অপ্রত্যাশিত বাধা এসে হাজির হয়েছিল এবং সেগুলোর সমাধান খুঁজে বের করা ইসলামের পক্ষে সেকালে সম্ভব হয়নি। হজরত মোহাম্মদ (দ.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম ধর্মে শিয়া ও সুন্নি বিভক্তি গভীর খাদের সৃষ্টি করে। নানা অধ্যায় পেরিয়ে সেই বিরোধ জাতিগত ও সংস্কৃতিগত বিরোধে রূপান্তরিত হয়ে মুসলিম জগেক রক্তাক্ত অন্তর্দ্বন্দ্বে বিভক্ত করে রাখে। ইরাক-ইরান সংঘর্ষ, সৌদি আরবের সঙ্গে অন্যান্য মুসলিম দেশের সংঘাত, পাকিস্তান-বাংলাদেশ দ্বন্দ্ব ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ ধ্বংসকারী শক্তির উদ্বেগপূর্ণ উত্থানের কারণে মুসলিম উম্মার ধারণাকে পরিত্যাগ করতে হয়েছিল শেষমেশ। সেই ব্যর্থতার কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়ার ইদানীংকালীন কৌশল হিসেবে আমরা একক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সংঘবদ্ধ করা, তাদের নাগরিক পরিচয়কে ইসলামি পরিচয় হিসেবে দাঁড় করানোকে দেখি। বাধা সে ক্ষেত্রেও যে কম তা নয়। অভ্যন্তরীণ বিভেদের বিমিশ্র রংধনু ঐক্যের বদলে আজও জন্ম দিচ্ছে রাজনৈতিক ইসলামি সহিংসতার। শিয়া-সুন্নি বিভেদের তীব্রতা, সুফি-সালাফি বিভেদ উভয় কুলের ভক্তদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। আল-কায়েদা, হানাফি, ওয়াহাবি এবং তালেবানি বিভেদ মুসলমানদের মধ্যে মিত্রতার চেয়ে শত্রুতার জন্ম দিয়েছে। সগোত্রীয়ের বিরুদ্ধে মুসলমানরা দাঁড়িয়েছে ক্ষুদ্র ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে উপলক্ষ করে। এতকাল অভিন্ন ইসলামের কথা বলা হলেও রাজনীতির আশ্রয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সেই ‘অভিন্ন ইসলাম’ ইতিমধ্যে এমন সব আগাছা ও পরগাছার জন্ম দিচ্ছে, যেখানে সত্যিকার ধর্মভীরু মানুষ নিজের আত্মরক্ষার সংগ্রামে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার প্রশ্নটি রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা আজ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলে আজ আধ্যাত্মিকতাবর্জিত এক বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শ নির্মাণ করা হচ্ছে, যার চাপে ধর্ম ও সমাজ উভয়ই ধ্বংসের মুখোমুখি। রাজনৈতিকীকরণের নেতিবাচক প্রভাব থেকে ধর্মকে যদি মুক্ত করতেই হয়, তাহলে সেটি একটি যুদ্ধও বটে, জিহাদ বলাই শ্রেয়, যেখানে জিহাদের অর্থ মনের বিশুদ্ধতার সংগ্রাম এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মর্মবাণী দিয়ে তাকে বুঝলে সে সংগ্রাম ইদানীংকার তালেবানি জেহাদের চেয়ে শত গুণে বিশুদ্ধ৮। ঠিক সেই জাতীয় সংগ্রাম হিসেবে, যেটি কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনের যুদ্ধ হতে পারে, পারে অন্তরের যুদ্ধ হতে—প্লেটোর ‘নো দাইসেলফ’৯ -এর মতো ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মশুদ্ধির আন্দোলন দাঁড় করিয়ে।

ফরহাদ মজহার তাঁর ভাব আন্দোলনের পুরো নকশা এই ঐতিহাসিক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে এঁকেছেন। সে কারণে তাঁর নিজের অবস্থানটি এই রাজনৈতিক বিভক্তির খণ্ডিত সাম্রাজ্যে কোথায় অবস্থান করে, তা পরিষ্কার করে তিনি জনগণকে অবহিত করেছেন কি না, সেটি আগেভাগে যাচাই করে নিতে হবে। ইসলাম বলতে তিনি কোন রাজনৈতিক ইসলামকে বুঝিয়েছেন, প্রশ্ন সেখানে। এক বাংলাদেশেই রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, হরকাতুল জেহাদ ই ইসলাম, জামাআতুল মুজাহিদীন, জাগ্রত মুসলিম জনতা, বাংলাদেশ সাহাদাত এ হিকমা, হারকাতুল জিহাদ, হারকাতুল ইসলামিয়া, জামিয়াত কোরানিয়া আরাবিয়া এবং আল খিদমাতের মতো নম্র ও উগ্রপন্থী কয়েক শ রাজনৈতিক ইসলামি ধারা। পবিত্র কোরআনের সূরা আল-ইমরানে (আয়াত ১০৩) মুসলমানদের ওপর সৃষ্টিকর্তার দেওয়া একটি বিশেষ নির্দেশ শর্তেও বিভক্ত জীবনে অতি উত্সাহ, ইসলামি দাবি করে একে অপরকে ধ্বংসের পথ অনুসরণ করা কেন, সে প্রশ্ন হয়তো এখানে নাইবা টেনে আনা হলো, কিন্তু সেই বহুমুখী জীবনপ্রবাহে ফরহাদ মজহারের অবস্থানটি কোথায়, সেটি না জানিয়ে ‘ইসলাম’ সাইনবোর্ড ব্যবহার করা নৈতিকভাবে প্রশ্নবোধক।

পাশাপাশি ধর্মকে আত্মপরিচয়ের একমাত্র উত্স হিসেবে দেখার ও তার প্রবক্তা হওয়ার বিপদ মজহার নিজেই হয়তো একসময় উপলব্ধি করবেন। কারণ নিজেকে স্থানীয় চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তিনি নিজেই এক দ্বন্দ্বে পড়েছেন। সেই স্থানীয়করণ প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক, তাঁর কাছে, বাঙালির ব্যবহারিক জীবনের প্রতীকী ব্যবহার। তার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তিনি লুঙ্গি পরেন, গায়ে সওদাগরি কুর্তা জড়ান, কাঁধে গামছা রাখেন। ঠিক একজন বাঙালি কৃষক বা ব্যবসায়ীর ঢঙে নিজ অবয়বকে গড়ে তোলার ছলে। প্রতীকী এই দিক তাঁর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু এ দিয়ে তাঁর পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব তিনি এ দেশের সাধারণ মানুষেরই একজন, তাঁর আদর্শ ও দর্শন একেবারে এ দেশের মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে প্রতীক যদি সত্যিই গুরুত্ববহ হয় এবং যদি তাকে তিনি অপরিহার্য বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে ইসলামি আদর্শের একজন প্রধান প্রবক্তা হয়ে এবং ধর্মকে আত্মপরিচয়ের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে দেখেও তিনি কেন ইসলামি আইনের আওতায় প্রাত্যহিক করণীয় কাজগুলোকে নিজের জীবন থেকে নির্বাসন দিয়েছেন, প্রশ্ন সেখানে। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য তো বটেই, তা ছাড়া মজহারকে প্রমাণ করতে হবে ধর্মের বাইরে তাঁর নিজের আর কোনো বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ পরিচয় নেই। অন্যথায় আদর্শ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মনে তাঁকে নিয়ে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা কৌতূহল সৃষ্টি হবে তাঁর উত্তর দেওয়া মজহারের পক্ষে কঠিন হতে বাধ্য।

তবে ‘ইসলামি আদর্শকেন্দ্রিক’ তাঁর ভাব আন্দোলন সামাজিক ভেদের প্রশ্নকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, ভাব আন্দোলনকে ‘সাদা/কালো, প্রাচ্য/পাশ্চাত্যের ভেদ’ অবসানের অনুঘটক হিসেবে দেখার পরামর্শ দেন। সেদিক থেকে ভাব সম্পর্কে সাধারণভাবে নেওয়া এই অবস্থান কিন্তু দার্শনিক দিক থেকে তাত্পর্যপূর্ণ। মানুষের সব কর্মকাণ্ডের মূলে কান্ডারির মতো ভাবের একটি নিকট উপস্থিতি থাকে, উপলব্ধি করা হোক বা না হোক। ওই ভাবকে সার্বিক অর্থে দেখা সম্ভব হলেও তাকে তিনি বাংলাদেশের বিশেষ পরিবেশে প্রয়োগ করা, সেই প্রয়োগকে যথোপযুক্ত করা কীভাবে সম্ভব, সে দিকটি বিশেষভাবে ভেবেছেন এবং কয়েকটি ধাপ নির্ণয় করেছেন। সে ক্ষেত্রে, তাঁর মতে, প্রথম করণীয় হবে বাঙালির ভাবজগতের মর্মবাণীকে উপলব্ধি করা, তাঁকে কীভাবে এখানকার মুক্তির আন্দোলনে ব্যবহার করা যায় তার কৌশল উদ্ভাবন করা। এই উভয় কাজের সফলতার প্রশ্নে তিনি অতিমাত্রায় আশাবাদী। কারণ ভেদবিরোধিতার গভীর শেকড় তিনি ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন স্থানীয় ভাব আন্দোলনে। বিশাল আদর্শিক ঐশ্বর্যে ভরপুর এ দেশের ভাবজগতের ইতিহাসটাই তাঁর মতে, একান্তভাবে ‘জাতপাত বিরোধী, নারীপুরুষ ভেদ মানে না, জালিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ও অসাম্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী।’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৫)। অর্থাত্ বাংলাদেশের পরিবেশে কোনো প্রয়োজন নেই আদর্শগত দিক থেকে নতুন কিছু উদ্ভাবনের। স্থানীয় ভাবের অন্তর্নিহিত সাম্যবাদী দর্শনকে চিহ্নিত করা গেলেই হলো। এই সাম্যবাদী ভাব-ঐতিহ্য তিনি আরও লক্ষ করেছেন, ইতিমধ্যে ‘বাংলাদেশকে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহণ করতে’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৫-২৬) সাহায্য করেছে। ফলে যারা তাঁর মতো একনিষ্ঠ লড়াকু, তাদের গুরুদায়িত্ব হলো ‘এই লড়াই-সংগ্রাম ও মানবেতিহাসের মহত্ অর্জনগুলো ভাবগত পর্যালোচনায় আত্মস্থ করা’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৫-২৬)। কারণ ‘এই রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা বা টিকে থাকা কেবল এই ভাবচর্চার মাধ্যমেই সম্ভব’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৫-২৬)। অতি মহত্ একটি প্রয়াস বটে।

কিন্তু সমস্যা হলো জাতিগতভাবে, ফরহাদ মজহার লক্ষ করেছেন, বাঙালি তার নিজের ভাবজগেক সঠিক অর্থে উপলব্ধি করতে শেখেনি। প্রচণ্ড অবহেলা দেখিয়ে এই জাতি তার নিজের ভাবজগেক উপেক্ষা করে এসেছে। সেই ব্যর্থতা, তাঁর ধারণায় উদ্বেগকর এবং জাতির জন্য দুর্যোগপূর্ণ। কারণ ‘বাংলার জাতপাত বিরোধী, শ্রেণী বিরোধী নারী-পুরুষ ভেদ বিরোধী লড়াই-সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভাবগত ইতিহাস ধরতে না পারলে বাঙালির অধঃপতন অনিবার্য’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৫-২৬)। এই ব্যর্থতা এবং অবজ্ঞার পরিধি জরিপ করে তিনি দেখেছেন যে ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের পরিগঠনের নতুন কর্তব্য নির্ণয় ও সম্পন্ন করা অনেক কঠিন।...বাংলার ভাবান্দোলনের মোকাবিলার জায়গাগুলো পরিচ্ছন্ন করা গেলে একাত্তরে আমাদের ঐতিহাসিক অর্জনকে বিশ্বের সভায় নিয়ে যাওয়া মোটেও কঠিন কাজ হবে না।...বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা, ভাব ও ভাবুকতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় নাই বললেই চলে। তাদের ভাষা, ভাব ও চিন্তার খবর আমরা নিতেই পারি নি’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩১)। ভাব আন্দোলন সম্পর্কে ধারণার অপরিচ্ছন্নতার মাশুল দিতে হচ্ছে বাঙালি জাতিকে, সেটি মজহারীয় দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু তার চেয়েও আরও উদ্বেগকর হলো, বাঙালির জাতীয়তাবাদী আদর্শ বা ভাব, যে আদর্শ ও ভাব আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। ওই জাতীয়তাবাদ তাঁর ক্ষেত্রে এমনই উত্কণ্ঠার কারণ যে আজ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্য ঘৃণা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং সর্বোপরি সমাজে সুবিধাবাদী অবস্থান নেওয়া সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হয়ে ওঠার সময় এসেছে। ‘ধর্ম ‘ব্যক্তিগত’ ব্যাপার—ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করবার এই প্রয়াস আসলে ধর্মতাত্ত্বিক পরিমণ্ডলেই সম্ভব, কারণ এই প্রয়াস ধর্মতত্ত্বকে অতিক্রম করে না, তাকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত করে মাত্র’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৬)।

ফরহাদ মজহার আরও লক্ষ করেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ উচ্চবর্ণনির্ভর এবং অভিজাত শ্রেণীর হাতে বন্দী। সেটিই অবশ্য তাঁর একমাত্র কলঙ্ক নয়। সেই অভিজাত শ্রেণী আবার বাংলাদেশের নয়, বরং কলকাতাকেন্দ্রিক, কলকাতাকে অনুকরণ করে নিজের ভাবজগেক সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করার ধৃষ্টতা দেখায়। ফলে তাঁর মনোভাবনার জগতে বাসা বেঁধেছে ঔপনিবেশিক মানসিকতা। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা জাতীয়তাবাদীরা দাবি করেছে উচ্চবর্ণ ও অভিজাত শ্রেণীর হাতে যে বাংলা ভাষা ও চিন্তা সেটিই নাকি বাঙালির চিন্তা। মূলধারা। এর বাইরে যদি কিছু থাকে তাহলে তা ‘লোকায়ত’, ‘অনাধুনিক’ ইত্যাদি।...তারা ঔপনিবেশিক কলকাতাকেই তাদের মনোগঠনের তীর্থভূমি ধরে নিয়ে বাংলার বিশাল ভাবের ঐশ্বর্য অন্বেষণের কাজকে বাধাগ্রস্ত করেছে’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩১)। সংগত কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা তার নৈতিক অবস্থান নির্ণয়ে প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদই বাঙালির আত্মবিকাশের সবচেয়ে বড়ো বাধা। অথচ দরকার ছিল বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের আন্তর্জাতিকতা এবং সার্বজনীনতাকে শনাক্ত ও উপলব্ধি করা। সাম্প্রদায়িক ও অভিজাত বাঙালিপনা বা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই পরাজিত করবার প্রয়োজন ছিল। এই কাজ সম্পন্ন হয় নি বলে ইসলাম ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ার যে রক্তাক্ত ‘অনন্ত যুদ্ধ’ শুরু করেছে আমাদের আশংতা এই ক্ষয়িষ্ণু ধারা ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের চিরাচরিত ঘৃণার কারণে সাম্রাজ্যবাদেরই পক্ষালম্বন করবে’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩০) । এখানে আমরা উপলব্ধি করি ফরহাদ মজহারের ভাবান্দোলনের প্রকৃত চেহারা। বস্তুত বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িক ও অভিজাত শেকড়কে উপড়ে ফেলে তিনি নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চান। সেই নতুন ধারা বলতে একটি ইসলামি ধর্মীয় আন্দোলনকে বোঝায়, কারণ সেখানে তাঁর বিশ্বাস এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হবে—একদিকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, অন্যদিকে ভেদমুক্ত সমাজ গড়া, যেটি প্রতিষ্ঠা করতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ব্যর্থ হয়েছে।

ইসলাম সম্পর্কে তাঁর যুক্তিটি তিনি অপরিচ্ছন্ন রাখেননি। ওই প্রসঙ্গে তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, ‘ইসলামের প্রতি এই দেশের মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে দলিতদের মুক্তির কথা ইসলাম শুনিয়েছে বলেই, দোজখের ভয়ে বা বেহেশতের লোভে নয়। শূদ্র যদি বেদ শোনে তবে তার কানে গরম সীসা ঢেলে দেবার ইতিহাস অতিক্রম করে আসতে হয়েছে এই জনগোষ্ঠীকে। কোন কিছুতেই যার কোন অধিকার নাই—সমাজের সেই তলানি থেকে উঠে আসা মানুষদের রাজনীতিই ভাবান্দোলনের ইতিহাস, তার বিকাশ ঘটেছে লড়াই থেকেই। এই রাজনীতিটুকু না বুঝলে ভাবান্দোলনের ‘ভক্তি’ ব্যাপারটা আসলে কী, কিম্বা ‘নদিয়ার ভাব’ কেন বৈপ্লবিক আমরা তা ধরতে পারব না। ভক্তদের এই বইটি তার প্রাথমিক নজির মাত্র। জাতপাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদ বিরোধী লড়াইয়ের ধারাই বাংলার ভাবান্দোলনের মূল ধারা’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৫)। অর্থাত্ ভেদবিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা উভয়ই জন্ম নিয়েছে ইসলামের গর্ভে। ইসলাম সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন, ‘যে জন্ম, রক্ত, গোত্র, গোষ্ঠি, জাত, পাতসহ সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে নীচু জাতের মানুষের যে ডাক, ‘ইসলাম’ ডাকনামের মধ্যে তারই প্রতিধ্বনী ঘটেছিল বলে ইসলাম এই দেশে স্থায়ী আসন পেয়েছে। অতএব এই ডাকের ভাব ও রাজনীতি অস্বীকার করলে, ভুলে গেলে কিম্বা তার তাত্পর্য ধরতে না পারলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের বেড়ে ওঠা বা পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৫)। আর সে কারণে ‘জাতপাত বিরোধী লড়াইয়ের ভাব ও ইতিহাসের মধ্যে আমি আমার জনগোষ্ঠিকে আবিষ্কার করার তাগিদ বোধ করি। এখানেই ইসলামের জাতপাত বিরোধিতা আর নিম্নবর্ণের মানুষের লড়াই এক বিন্দুতে এসে নানান সময়ে মিশেছে। এই মুহূর্তগুলো শনাক্ত না করা গেলে বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতির পুনর্গঠন অসম্ভব। ধর্ম সূত্রে আমরা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিম্বা স্রেফ নাস্তিক হতে পারি, কিন্তু ইসলামের এই ভাবগত ও রাজনৈতিক লড়ায়ের সঙ্গে নিম্ন বর্ণের মানুষের সংগ্রামের তাত্পর্য বিচার না করলে, আর যাই হোক নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ দাবি করা যাবে না’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৫-১৬)।

ইসলাম সম্পর্কে তাঁর অবস্থানটি এতই গোলমেলে যে তিনি নিজেই এক বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘ধর্মের যদি ‘মানবিক’ চরিত্র থাকেই তাহলে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারে আপত্তি থাকার যুক্তি কি?...ইতিহাসে ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে নির্যাতিত শ্রেণী বা জাতি তার মুক্তির জন্য ধর্মের ঝাণ্ডা তুলে ধরেছে। ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব থেকে শোষকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বয়ান তৈরি করেছে। আমাদের ইতিহাসে—প্রজাস্বত্ব আন্দোলন, জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে, মহাজনী শোষণের যাতাকল থেকে মুক্তির রাজনীতিতে ধর্মীয় আত্মপরিচয় আশ্রয়ের কারণেই তা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেল? পাকিস্তান আন্দোলন কি ধর্মীয় আন্দোলন?’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৭) ‘ধর্মকে ইহলৌকিক পর্যালোচনা ও বিচার বিবেচনা থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা রাখবার আজগবি ও অবাস্তব চিন্তা। লক্ষ করার বিষয় ফিলিস্তিনীদের মুক্তিযুদ্ধকেও কতো অবলীলায় ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় বাঙালির ভাবচর্চার বিকাশ ঘটাতে হলে এই বাঙালিবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাড়া বাঙালির আর কোন পথ আছে বলে আমরা মনে করি না। এই লড়াইটা এখন প্রকাশ্য, কাজেই কাজেই ক্রমশ তীব্র হতে বাধ্য’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৮)। ভালো কথা। মানতে আপত্তি নেই, ইসলাম এককালে বাংলায় নির্যাতিত মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের মঙ্গল কামনা করেছে। তার অর্থ এই নয় যে ইসলাম কেবল শোষিতের পক্ষাবলম্বন করে, শোষককে পরিত্যাগ করে। তার অর্থ এই নয় যে ওই বিপ্লবী ইসলাম রাজনৈতিক ইসলামে রূপান্তরিত হয়ে পরবর্তী সময়ে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সহায়ক আদর্শে পরিণত হয়নি, নিজেকে জাতিগত নিপীড়নের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করেনি। ইসলাম ও রাজনৈতিক ইসলামের অভ্যন্তরে এই ভেদরেখাটি নির্ণয় না করে, তাকে উপেক্ষা করে বা সুচিন্তিতভাবে এড়িয়ে গিয়ে ফরহাদ মজহার তত্ত্বগতভাবে এক বিশাল ভ্রান্তির জগতে অনুপ্রবেশ করেছেন।

ইসলামের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার আগে দেখা যাক সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার প্রসঙ্গটি। বিষয়টি কালিক কোনো আকস্মিক ইস্যু নয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা আমাদের দেশের মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চালিত। সে কারণে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইদানীংকালের ‘সাম্রাজ্যবাদপ্রীতি’কে পছন্দ না করা মজহারের পক্ষে যুক্তিসংগত। সাম্প্রদায়িক ও অভিজাত বাঙালিপনা বা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই পরাজিত করতে চান। কারণ সেই পরাজয়ের মানেই হলো জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারকে পরাজিত করা এবং তাদের পরিচালিত ‘রক্তাক্ত অনন্ত যুদ্ধে’ ইসলাম ধর্মকে উদ্ধার করা। অর্থাত্ মজহারীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার মূলে রয়েছে আমেরিকা বা ব্রিটিশ নেতাদের ইসলামবিরোধিতার বিষয়টি। সমস্যা হলো, যে ইসলামকে তিনি সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ থেকে বাঁচাতে চান এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে তলোয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান, সেই রাজনৈতিক ইসলাম গোটা তিন দশক ধরে (বিশেষ করে ১৯৭৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত) সাম্রাজ্যবাদের অতি কাছের মানুষ ছিল। এই ইসলাম বিলিয়ন বিলিয়ন সাম্রাজ্যবাদী ডলার সাহায্য ভোগ করেছে১০। আফগান যুদ্ধে মার্কিন প্রশিক্ষকদের হাতে শিক্ষা নিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গা মাখামাখি করে দীর্ঘকাল তাদের রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। শুনেছি আফগান যুদ্ধে মুজাহিদিনদের আরও বেশি করে রুশবিরোধী নীতিতে আকৃষ্ট করতে মার্কিনদের পরামর্শেই আফগান ও পাকিস্তানের মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে জিহাদ শব্দ ও তার প্রত্যয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সে সময় মজহারের মতো ‘ইসলামি’ বুদ্ধিচর্চায় নিযুক্ত বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী মার্কিন হস্তক্ষেপের কোনো বিরোধিতা করেনি। ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে, ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা না করার উপদেশ দিয়ে তিনি এক বিশেষ প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত ওই বিপদকে উপেক্ষা করে। রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সখ্যতা কারও অজানা নয় বটে কিন্তু তার পরও তাঁর সেই অবয়বটি তিনি কেন সযত্নে লুকিয়ে রাখতে চান অথবা কেন ইসলামকে পুনরায় রাজনীতিতে ব্যবহার করতে উত্সুক, সেটি বোধগম্য নয়। বস্তুত এখানেই ধরা পড়ে মজহারের সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার প্রকৃত রূপ।

রাজনৈতিক ইসলাম বা তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিতান্তই বিমূর্ত ইতিহাসহীন আদর্শ হিসেবে দেখা গুরুতর অপরাধ। এই দেখার ধরনে অবশ্য অনেক সুবিধা রয়েছে। কারণ সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিক ইসলামের ভূমিকাকে এড়িয়ে গণহত্যার দোষ পাকিস্তানি শাসকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো যায়, এমন ভাব দেখিয়ে যেন সে সময়কার পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে রাজনৈতিক ইসলামের কস্মিনকালে কোনো সম্পর্ক ছিল না, যেন রাজনৈতিক ইসলাম রাষ্ট্রপরিচালনার বলয় থেকে দূরে ছিল, যেন সেই বিশেষ ইসলাম স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে এক স্বর্গীয় নিরপেক্ষতা বজায় রেখে এসেছে, যেন সাম্রাজ্যবাদ ও রাজনৈতিক ইসলাম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্তে একে অপরের পিঠ চাপড়ায়নি, বাঙালির রক্তে হাত রাঙায়নি। মজহার লিখেছেন, ‘পাকিস্তানী শাসকদের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে পাকিস্তানী শাসকদের মতাদর্শ আর ইসলাম যে আলাদা, সেই ভেদ জ্ঞান এই জাতীয়তাবাদ নির্ণয় করতে চায় না। জানেও না। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সে ক্রমাগত হাজির করে খেয়ে না খেয়ে একটা ইসলাম বিরোধী সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ হিশাবে’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৫)।

বিমূর্ত ভাবকে কখনো সমাজস্বাধীন বা সমাজনিরপেক্ষ ভাবা কঠিন। বাঘা বাঘা যেসব ভাববাদীর সঙ্গে আমরা পরিচিত (হেগেল বা প্লেটো), তাঁরা ভাবকে কেবল অতীন্দ্রিয়তার কোঠরে আবদ্ধ রাখেননি, সামাজিক উপযোগিতার কথাও ভেবেছেন। পদ্ধতিগত দিক থেকে সেখানে মজহারের গলদটা চিত্তাকর্ষক। রাজনৈতিক ইসলামকে সমাজ বাস্তবতার বাইরে রেখেও নিজের ভাব-পরিকল্পনার সামাজিক কর্তব্য বা ইসলামে ভেদমুক্তির আন্দোলনী ধারার প্রতি মৌখিক সম্মতিতে কার্পণ্য করেন না। ধর্মকেন্দ্রিক মজহারীয় ভাবজগত্ যে কতটুকু বিভ্রান্তিকর সেটি আমরা লক্ষ করি তাঁর বেশ কিছু মন্তব্যে। ‘মোকাবেলা’ নামক প্রবন্ধ সংকলনে তিনি লিখেছেন, ‘পুঁজি তার আগের সব নীতিনৈতিকতা, ধর্মতত্ত্ব, বিশ্বাস, আচার আচরণ, সংস্কার—অর্থাত্ যা কিছুই তার পুঞ্জিভবন, আত্মস্ফীতি ও বিস্তারের পথে বাধা মনে করে, সবকিছুকে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে চলে, ধ্বংস করে। পুঁজির বিস্তারের সামনে সব পুরানা ধর্ম, ধর্মতত্ত্ব, নীতিনৈতিকতার বিনাশ অনিবার্য। কিন্তু পুরানা ধর্মের জায়গায় পুঁজি কায়েম করে পুঁজির ধর্ম। সেটা কেমন? সেটা হচ্ছে মানুষের সকল ধর্ম ও নীতিনৈতিকতাকে পুঁজি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নির্বাসন দেয়, ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা পুঁজি অস্বীকার করে। পুঁজির দাবী ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। পুঁজি ধর্মকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নির্বাসন না দিয়ে টিকে থাকতে পারে না। বুর্জোয়া শ্রেণীর ধর্মনিরপেক্ষতার ধর্মীয় রহস্য আসলে এখানেই’ (ফরহাদ মজহার, ২০০৬, পৃষ্ঠা ১৯-২০)।

ধর্ম ও পুঁজির এই বিশ্লেষণ পদ্ধতিগতভাবে বাত্সল্যজনিত রোগে আক্রান্ত। পুঁজি ধর্মকে আক্রমণ করে না। ধর্মকে ধ্বংস করতে চায় না। ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আধ্যাত্মিকতা বা লিপিবদ্ধ নৈতিক কাঠামো পুঁজির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নয়। পুঁজির স্বর্গরাজ্য মার্কিন মুলুকে পুঁজি ধর্মকে আক্রমণ করেনি। সেখানে পুঁজি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে উত্সাহিত করে, কারণ তার ফলে পুঁজির বিস্তার সম্ভব হয় বলে, ব্যক্তিকে ভোক্তা হিসেবে তৈরি করে। ব্যক্তির ধর্ম ও বিশ্বাস সেখানে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নয়। ধর্মকে পুঁজি তার প্রয়োজনেই ব্যবহার করে। ইসলামি পুঁজি (সৌদি আরব, বাংলাদেশ বা অন্যান্য দেশে) ধর্মকে আক্রমণ করেছে কি না বা মার্কিন পুঁজি সৌদি মুলুকে বা বাংলাদেশি ‘ইসলামি’ পুঁজি ধর্মকে বর্জন করেছে বলে কিছু শোনা যায়নি। বরং তাকে পুরোদস্তুর ব্যবহার করেছে বলেই জানি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ সালে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আমেরিকার নির্দেশে রাজনৈতিক ইসলাম যে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছিল, সে জিহাদ ধর্মকে ধ্বংস করার জন্য নয়। মার্কিন পুঁজি সোভিয়েত একনায়কতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, কারণ মার্কিন বা পশ্চিমা পুঁজির অনুপ্রবেশ বিস্তীর্ণ পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক বলয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল বলে। পুঁজি ধর্মের বিরোধিতা যে করে না তা নয়। কিন্তু সে বিরোধিতা ধর্মের নিয়মকানুনের বিরোধিতা নয়, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন, বাইবেল, বেদ, ত্রিপিটক, টোরাকে বাতিল করার সংগ্রামে নয়, তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ধর্মের সামাজিক অবস্থান। সেই ভূমিকা সামাজিক সম্পর্ক থেকে সৃষ্ট। তাকে সে আক্রমণ করে, পারলে ধ্বংস করে, যদি তা পুঁজির সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দেখা দেয়। ইউরোপে পুঁজি তার প্রাথমিক বিকাশে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিল। কারণ তত্কালীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ সৃষ্ট সামাজিক বৈষম্য, পুঁজির ধারক উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীকে রাজনৈতিক অধিকারহীন করে রেখেছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে টিকিয়ে রাখার আদর্শিক অস্ত্র হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে, পোপ ও রাজতন্ত্রের সঙ্গে আঁতাত করে, নিপীড়ন ও শোষণের মাধ্যম হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে। নিজ বিকাশের প্রয়োজনে পুঁজির ধর্মমিশ্রিত সামাজিক সম্পর্ককে আক্রমণ করা আর ধর্মকে আক্রমণ করা ভিন্ন জিনিস। পুঁজি এক থলে টাকা বা ডলার নয়। মার্ক্স পুঁজিকে সে অর্থে ভাবেননি, দেখেননি। তিনি পুঁজিকে দেখেছেন একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে, সমাজের শ্রেণী কাঠামোর নির্মাতা হিসেবে। এই সম্পর্কের বাইরে পুঁজি পুঁজিই থাকে না, থাকে নিতান্তই অলস হয়ে পড়ে থাকা কিছু মিনটেড মেটাল হিসেবে। সেই সামাজিক সম্পর্কের দিকটি আত্মস্থ না করে পুঁজিকে যেমন বোঝা যায় না, তেমনি বোঝা যায় না পুঁজি ও ধর্মের আন্তসম্পর্ককে। সেখানে পুঁজি ধর্মকে ধ্বংস করতে আগ্রহী নয়, সে চায় ধর্মের সামাজিক সম্পর্ককে আক্রমণ করতে, সেই সম্পর্ক পুঁজির বিকাশের পথে বাধা তৈরি করে বলে। এই দিকটি না বোঝার কারণে মজহারের উক্তি করা সম্ভব হয় যে, ‘আল্লাখোদার জায়গায় পুঁজি নিজেকে স্থাপন না করে নিজের পুঞ্জীভবন, স্ফীতি ও বিস্তার নিশ্চিত করতে পারে না। আল্লাকে তার আরশ থেকে না সরিয়ে পুঁজি সেই আরশে বসে কি করে? তাহলে একালের আস্তিকতা-নাস্তিকতা লড়াইয়ের বৈষয়িক ভিত্তি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই’ (মজহার, ২০০৬, পৃষ্ঠা ২১-২২)।

ধর্মের সামাজিক সম্পর্ক বলতে ধর্মকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান যেমন: মসজিদ, মন্দির, চার্চ, গির্জা, সিনেগগ, বৌদ্ধ মন্দির ইত্যাদিকে বোঝায়। এসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে মওলানা, পুরোহিত, বিশপ-রেভারেন্ডদের সঙ্গে ধর্ম পালনকারী মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনকল্যাণমূলক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মগ্রন্থ শিক্ষাকেন্দ্রভিত্তিক যে সামাজিক সম্পর্কের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে, পুঁজি তাকে ধ্বংস করে না। কিন্তু সে সামাজিক সম্পর্কের এই নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তখনই, যখন এই নেটওয়ার্ক পুঁজির সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যথায় পুঁজির সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। মধ্যযুগে বিরোধ হয়েছিল। সে সময় ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে পুঁজির বিকাশ সম্ভব ছিল না। মানবতাবাদী দর্শন দিয়ে সমাজভাবনার এবং সমাজকাঠামোর নতুন ধারা সৃষ্টি করা ওই সংগ্রামের আদর্শিক হাতিয়ার ছিল। তবে প্রয়োজনে পুঁজি তার নিজের সৃষ্ট ওই মানবতাবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও কুণ্ঠিত হয়নি। নিজেকে সে মানবতার শত্রুতে পরিণত করে, যদি তা তার বিস্তারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। লাতিন আমেরিকায় মানবতাবিরোধী মার্কিন ভূমিকায় সামরিক ক্যু, ক্ষমতায় ফ্যাসিবাদী জেনারেলদের বসানো এবং গণহত্যায় মদদ দেওয়া—সবই ছিল পুঁজির পথকে বাধামুক্ত রাখতে। এই আপেক্ষিক দিকটি না বোঝার কারণে মজহারের পক্ষে পুঁজিকে আক্রমণ করা সহজ হয়, সস্তা জনপ্রিয়তা লাভে আগের বিপ্লবী এবং জিহাদি জোশের স্ফুলিঙ্গ উদ্গারিত করে পুঁজি বা ধর্মের সম্পর্ককে তুলে ধরেন পুঁজির অন্তর্নিহিত ওই সম্পর্কের দিককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। সে কারণে তাঁর পক্ষে দাবি করা সহজ হয়, ‘একবার যদি মানুষ তার মেধা, কল্পনা ও সংকল্পের শক্তি সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারে তাহলে পুঁজির একদিন কি মানুষের একদিন। এই আর্তনাদ ও হাহাকার বাদ দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার দাফন কাফন সম্পন্ন করে নিজের ধর্ম ঠিকই নিজে মানুষ কায়েম করবে’ (মজহার, ২০০৬, পৃষ্ঠা ২৪)। অথবা ‘একালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড মাত্রই ধর্ম আর ধর্ম মাত্রই বৈপ্লবিকতা। পুঁজির ধর্মের বিপরীতে মানুষের ধর্ম বিপ্লবী রূপ নিয়ে আবার হাজির। হতে বাধ্য। সেই ধর্ম কায়েমের শর্ত একমাত্র পুঁজির বিনাশ ছাড়া অসম্ভব...এতএব এই কালের বিপ্লবের প্রশ্ন একান্তই ধর্মের প্রশ্ন ছাড়া আর কি?...ধর্মের কবর দেওয়া আর মানুষের কবর দাফন সম্পন্ন করা একই কথা’ (মজহার, ২০০৬, পৃষ্ঠা ২৪-২৫)। মজহারের এই স্তুতি বুদ্ধিবৃত্তিক আবর্জনা, ইংরেজিতে যাকে ঃত্ধংয বলে।

পুঁজির সামাজিক সম্পর্ক সম্বন্ধে এই অজ্ঞতার কারণে ইসলামের সমতা বাণী নিয়েও তাঁর বাগাড়ম্বর নিতান্তই শব্দধ্বনি হয়ে থাকে। ইসলামে সমতার কথা আছে সত্য, কিন্তু সেই সমতা আদি পর্যায়ে লক্ষ করা গেলেও পরবর্তী সময়ে অসমতায় পরিণত হয় সামাজিক বাস্তবতা, রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবের কারণে। এই একই ভাগ্য আমরা খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রেও দেখি। হেফাজতে ইসলামের মাওলানা শফী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হলে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা (নারী) প্রথম ধাক্কাতেই সামাজিক অসমতার বাধনে বাঁধা পড়বেন। সংখ্যালঘুরাও যাপন করবেন বঞ্চিত এবং সম-অধিকারহীন জীবন। কারণ নিজের ধর্মকে তিনি সবার ওপরে দেখবেন, তাকে শ্রেষ্ঠ ভাববেন, অন্যান্য ধর্মের মানুষকে নিকৃষ্ট ভাববেন এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করবেন। ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবজাত। বর্ণভেদ প্রথা এককালে বাঙালি মুসলিম সমাজে একটি পাঁচমিশালি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে সৈয়দ (হজরত মোহাম্মদের কন্যা ফাতিমার বংশধর) এবং আলিম (যারা পণ্ডিত ব্যক্তি), শেখ বা পীরের ভেদাভেদ যেমন ছিল, তেমনি ছিল শিয়া-সুন্নি বিভেদ, আশরাফ-আতরাফের মধ্যে রেষারেষি। ক্রীতদাস বা স্বাধীন, গলা, জলা, পিথারি, কাবারি, তিরকার, কাগজি, কসাই ইত্যাদি পেশা ওই একই বিভেদের অন্য দিক। (পঞ্চানন সাহা, ১৯৯৭ থেকে নেওয়া) এসব ভেদাভেদ বিভিন্ন পণ্ডিতের লেখায়ও স্বীকৃতি পেয়েছে। অমলেন্দু দে দেখিয়েছেন, এমনকি আজলাফ শ্রেণীর (অর্থাত্ নিম্নবর্ণের মুসলমান) মধ্যে চারটি ভাগ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেগুলো ছিল এরূপ: ১. কৃষিকর্মে নিযুক্ত শেখ মুসলমান, আজলাফ সম্প্রদায়ে এদের স্থানই ছিল উঁচুতে। ২. দরজি জোলা ফকির ও রঙ্গ বেজ ৩. ভাতিয়ারা, ছিক, চুড়িদার, দাই, ধাওয়া, দুনিয়া, গদ্দি, কালাল, কসাই ৪. আব্দাল, বাখো, বেদিয়া, ভটি, দাফালি, ধোবি, হাজাম, মুচি ইত্যাদি। এসব নিম্নবর্ণের মুসলমানের এমনকি মসজিদে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল (দেখুন পঞ্চানন সাহা, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ২৯)। আজও সেই বিভেদের দরজা যে বন্ধ হয়েছে, দাবি করা কঠিন।

যাই হোক, ফিরে আসা যাক বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোচনায়। সেখানে মজহার বেশ কয়েকটি দোষ লক্ষ করেছেন, যেগুলোর কারণে ওই আদর্শের সঙ্গে বাঙালি জাতির সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়া উচিত বলে জোর দাবি করেছেন। ইতিহাসের ধারায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের দেহে আধুনিক এবং সে অর্থে নেতিবাচক অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। তাঁর দাবি, সেই পরিবর্তন বাঙালির আবহমান সংস্কৃতিতে ছেদ এনেছে। তিনি লিখেছেন, ‘যারা এতোকাল পাঞ্জাবি পায়জামা লালপেড়ে শাড়ি ও কপালে টিপ দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে আমাদের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ শিক্ষা দিচ্ছিলেন, তারা নিজেরাও এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না। তারা ‘আবহমান বাঙালি’র সাধনা করছিলেন এই ভেবে যে ‘বাঙালি’ নামক স্থিরবস্তু কিছু একটা আবহমানকাল যেমন ছিল বা হয়ে আসছে তেমনি বুঝি চিরকালটিই থাকবে। যে শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতির তাঁরা পূজা করে আসছিলেন, সেই বাঙালিও পুঁজিতান্ত্রিক গোলোকায়নের তোড়ে কীবোর্ড, গিটার, ড্রাম নিয়ে মঞ্চ ফাটিয়ে মিস্টিরিয়াস আবহমানতায় ছেদ ঘটিয়ে দিয়েছে’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৮)। মন্তব্যটির প্রতি সীমিত গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন এই কারণে যে একটু পরই আমরা দেখব, তিনি তাঁর এই অবস্থানকে নিজেই অস্বীকার করেছেন। জাতীয়তাবাদের আরও কিছু দুর্বলতা তাঁর চোখে পড়েছে, যার মধ্যে তাঁর অনৈতিহাসিক চরিত্র, ইসলামবিরোধিতা এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব অন্যতম। এই তিনটি অভিযোগ উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ‘ধর্মের দিক থেকে হিন্দু ধর্ম বাঙালির স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হলেও ইসলামকে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা সবসময়ই দুশমন হিশাবেই গণ্য করেছে। তাদের কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে ইসলামমুক্ত করবার সাধনাই হচ্ছে ‘বাঙালি’ হবার সাধনা।...‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ শুধু সাম্প্রদায়িক নয়, বরং ঘোরতর ভাবে অনৈতিহাসিক। ইতিহাসের বিপরীতে তার অবস্থান’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৪)।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ অনৈতিহাসিক কেন, তার কারণ হলো, ‘যারা এই জাতীয়তাবাদের ধারক তারা দেখাতে চায় যে ‘যেন ‘বাঙালি’র কোন ধর্মীয় অতীত নাই, সনাতনী হিন্দু, ইসলাম অথবা জেন বা বৌদ্ধ—কারো সঙ্গেই যেন ধর্ম হিশাবে কোন সম্পর্ক নাই, যেন ধর্মীয় উপাদান রুপ-রসে পুষ্ট হয়ে এর শরীর পরিগঠিত হয় নি। ‘বাঙালি’ ব্যাপারটা যেন হাওয়াই জিনিস। যে কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ‘বাঙালি’ ব্যাপারটার রাজনৈতিক ইতিহাস ’৫২ সাল থেকে শুরু, যার কোন ‘আগে’ নাই ‘পরে’ও নাই।...এই অনৈতিহাসিকতার কারণে বা ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে বলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কোন সাংস্কৃতিক ভিত্তি নাই। প্রতিষ্ঠার তাগিদ বোধও নাই। নিজের দাবি অনুযায়ী তাই ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা ভুঁইফোড় ব্যাপার’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৪)। বাঙালির অতীত জীবন ধর্মীয় প্রভাবসমৃদ্ধ, সেটি ঐতিহাসিক সত্য। সে সত্য তুলে ধরতে আপত্তি নেই। কিন্তু সে প্রভাবকে একতরফা ইসলাম ধর্মের প্রভাব হিসেবে দেখা বা ইসলামের সঙ্গে তার অতীত সম্পর্কের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে উপস্থাপন করা ঘোরতর ইতিহাসবিরোধী। সনাতনী হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, সুফি ধারার মিশ্র উপাদানের প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি নির্মিত (যদিও মজহার সেটি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সে প্রভাবকে এড়িয়ে ইসলামের প্রভাবকে বিশেষভাবে সামনে এনেছেন), আর সে কারণে তাঁকে এক বিশেষ মিশ্র সংস্কৃতি হিসেবে দেখাতে হবে। বাঙালি জাতিকে যদি ইতিহাসের আলোকে মূল্যায়ন করতেই হয়, তাহলে তাকে তার ইসলাম-পূর্ব অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কী কারণ, বোধগম্য নয়। অবশ্য তার অর্থ দাঁড়ায়, তাকে হিন্দু বা বৌদ্ধ বা লৌকিক ধর্মের উপাদান ও প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করা। হিন্দু সনাতনী অথবা ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শের বিশ্বাসকাঠামো থেকে পূর্ববঙ্গের বাঙালিকে বিচ্ছিন্ন করার অর্থ, বাঙালি জাতিকে বিশুদ্ধ ইসলামি মৌলবাদী আদলে গড়ে তোলা। ইতিহাসের প্রতি নিরপেক্ষ হলে বাঙালি জাতির পরবর্তী ঐতিহাসিক বিবর্তনকে কটাক্ষ করাও যৌক্তিক নয়। তিনি যেমন লিখেছেন, ‘বাঙালি উর্দুর বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু হিন্দিকে তার ড্রইংরুমে টেনে নিতে আপত্তি করলো না। বাঙালিয়ানার অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠল ঢাকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোরই ভাড়া খাটা কয়েকটি এডভারটাইজিং কোম্পানি, আর সেই কোম্পানিগুলোর জন্যই বিজ্ঞাপন ও পণ্যের প্রসারের তাগিদ।...তারা ইতিহাসের মঞ্চে অভিনয় করবার চেয়েও অভিনয় করতে চেয়েছিল মহিলা সমিতি বা গার্লস গাইড মিলনায়তনে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এখানে পুঁজির বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধের সংস্কৃতি আমরা দেখি নি’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৯)।

বিশ্বায়নের কারণে বাঙালিত্ব প্রভাবিত হচ্ছে। সেই প্রভাবগুলোর চিহ্ন মজহার সাহেব লক্ষ করলেও সেখানে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি রীতিমতো একপেশে। তিনি সেসব প্রভাবের প্রতি বিরূপ যেগুলো প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের অথবা পশ্চিমা বিশ্বের। কিন্তু সেটিই তার দেহে একমাত্র পরিবর্তন নয়। বিজাতীয় মধ্যপ্রাচ্যের লোকপ্রিয় সংস্কৃতির প্রভাবকে কেন ভুলে যেতে হবে? সে প্রভাব তো আর রাখা ঢাকা কিছু নয়। আজ বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদে সেই প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে ভাষাতে। আরবি উপাদানের লক্ষণীয় প্রাধান্যে ঘোমটার বদলে হিজাব বা নানা সংস্করণের বোরকার ব্যবহার আজ বাঙালির একাংশের সংস্কৃতির গণ্ডিকে চিহ্নিত করছে। সে সম্পর্কে মজহারীয় নির্বাকতা যথাযথ কী, যদি বাঙালিত্বের জাতিগত বিশুদ্ধতা নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন হন? ইউরোপীয় বা ভারতীয় পুঁজির পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যীয় ‘ইসলামি পুঁজি’র আগমন কি এখানে থেমে আছে? যে জাতি উর্দু ভাষার বিরোধিতা করেছিল, সেই জাতি আজ হিন্দি ছবির অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার নয় কেন, সেটি হয়তো মজহার সাহেবকে হতবাক করে। কিন্তু সংস্কৃতির বাজারে হিন্দি সিনেমার আধিপত্য বাঙালি সংস্কৃতির বিবর্তনের কারণেই। হিন্দি সিনেমাপ্রীতি এমন কোনো আজব ঘটনা নয়, যেটি কেবল আমাদের দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হিন্দি ছবির একচেটিয়া আধিপত্য উর্দু ভাষার আদি জন্মভূমি পাকিস্তানও ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্য বা মধ্য এশিয়ার কথা না হয় ঊহ্য থাকল। আর উর্দু ভাষার বিরোধিতা করা এক কথা, বাঙালি জীবনে হিন্দি সিনেমার প্রভাব ভিন্ন জিনিস। একটি হলো, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা থেকে বাঙালিদের বঞ্চিত করা, অন্যটি হলো বিশ্বায়নের কারণে বিভিন্ন ভাষার আন্তপ্রভাবের বাস্তবতা। মজহার সাহেবের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অনুভূতি যদি এতই সূক্ষ্ম হয়ে থাকে তাহলে তাঁর পক্ষে ইংরেজির প্রভাবকেও বরদাশত করা উচিত নয়, নয় পশ্চিমা প্রভাবকে। সেই অর্থে তিনি নিজে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লেখা বন্ধ করে বা এনজিও চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে বা ইংরেজি গান শোনা বন্ধ করে বা ইন্টারনেট ব্যবহারে ক্ষান্ত দিয়ে তাঁর প্রকৃত বিজাতীয় বিরোধী অবস্থানকে আরও একটু ঝালাই করে নিতে উত্সাহিত হতে পারেন বৈকি।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ফরহাদ মজহারের দ্বিতীয় ভ্রান্তি হলো, তিনি বাঙালি জাতি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখতে অভ্যস্ত। সেটি এক মারাত্মক বিভ্রান্তি। বাঙালি জাতি একটি নরগোষ্ঠীর স্থায়ী রূপ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি বিশেষ অনুভূতি মাত্র। সে অনুভূতির ইতিহাস সুদীর্ঘ হলেও সেটি ওই ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্ত মাত্র, বাঙালিত্বকে পুরোপুরি বোঝার ক্ষেত্রে তাকে একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা অযৌক্তিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দেখতে হবে একটি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে। সেই আদর্শকে সমালোচনা করতে আপত্তি নেই। সে সমালোচনা যদিও এই কারণে নয় যে ওই জাতীয়তাবাদ ইসলাম ধর্মকে তার আদর্শ হিসেবে দেখেনি। যাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলেন, তাঁরা তাঁদের মুসলমান ধর্মবিশ্বাসকে বাতিল করে জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেননি। ১৯৪৭ সালে এই একই বাঙালি জাতি মুসলিম জাতীয়তাবাদের অধীনে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। সে সময় মুসলিম জাতীয়তাবাদী আদর্শে সিক্ত যারা, তারা তাদের বাঙালিত্বকে হারায়নি। মুসলিম জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণ ছিল মুসলিম পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া, জাতিপরিচয়ের চেয়ে মুসলিম পরিচয়ের প্রাধান্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা। সেই ভাবনার জন্ম হয়েছিল উপমহাদেশীয় রাজনীতি, ব্রিটিশবিরোধিতার বিশেষ সময়কালীন বাস্তবতার কারণে। থাকতে পারে আরও হাজার সহস্র কারণ। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদী হয়ে বাঙালি যেমন তার বাঙালি পরিচয়কে হারায়নি, তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সে তার মুসলিম পরিচয়কে হারায়নি। ১৯৫২ সাল থেকে ঘটেছে উল্টো। সে সময় থেকে মুসলিম পরিচয়ের দোহাই দিয়ে তাকে শোষণের জাঁতাকলে আবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে প্রতিবাদের প্রশ্ন এসেছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সেই প্রতিবাদে অংশ নেয়নি। কারণ সে নিজেই ছিল বাঙালি জাতির নিপীড়ক। সেখানে তার জাতিপরিচয় তার সাহায্যে এসেছে। সে কারণে সে ভেবেছে, জাতি হিসেবে সে সমষ্টিবদ্ধভাবে শোষিত এবং সেই শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে তাকে ওই শোষক জাতি থেকে তার ভিন্নতাকে প্রমাণ করতে হবে। সেই তাড়না থেকে সে তার পার্থক্য চিহ্নিত করেছে, ভাষাকে ব্যবহার করেছে, তার সংস্কৃতি যে পাঞ্জাবি, বেলুচি, পাঠান বা সিন্ধ থেকে ভিন্ন, সেটি সে প্রমাণ করেছে। তার অর্থ এই নয় যে সে তার মুসলিম পরিচয়কে হারিয়েছে। বাঙালি পরিচয় দিয়ে মুসলিম শোষণকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক মুক্তির হাতিয়ারে। রাজনৈতিক ইসলাম সেদিন তার পাশে দাঁড়ায়নি।

তবে মজহারের পক্ষে এই দিকটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে সামাজিক শ্রেণীর প্রসঙ্গ টেনে। তিনি লিখেছেন, ‘গণমানুষের রাজনীতি যাঁরা করেছেন—উচ্চবর্ণ, আশরাফ বা অভিজাত শ্রেণী এবং জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়ে আসছিলেন একাত্তরে তাঁদের রাজনীতির জয় হয় নি। জয় হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সেই অংশের যাদের কাছে বাঙালি মানে সেই পুরানা ঔপনিবেশিক বাংলায় গড়ে ওঠা শ্রেণীরই আত্মপরিচয়। যে পরিচয়ের মধ্যে শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ অনুপস্থিত, যে পরিচয় ইসলামকে তার শত্রু হিশাবেই জ্ঞান করতে শিখেছে—তার সঙ্গে ভাবগত বা সাংস্কৃতিক মোকাবিলার প্রয়োজন বোধ করে নি। ধর্মের সঙ্গে ভাষা, ভাব ও সংস্কৃতির জটিল সম্পর্ককে যে পরিচয় ক্রমাগত অস্বীকার করেছে। বাঙালি হবার ধারণাকে হাজির করেছে ইসলামের বিপরীতে আত্মপরিচয় নির্মাণ হিশাবে। বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় বিপ্লবী রাজনীতির ধারা মার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণমানুষের ভাষা, ভাব ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক বিকাশের প্রতিশ্রুতিও মার খেয়ে গেল’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৪১-৪২)। সব মিলিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বর্জনের প্রশ্নটি তাঁর কাছে এতই তাত্পর্যপূর্ণ যে তিনি ওই বর্জনের স্ট্র্যাটেজি হিসেবে বাঙালিত্বকে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে সমীকরণ করে দেখার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ‘মুসলমান’ বলে ইসলাম আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, এই তর্ক সঠিক নয়। বরং খুবই ভুল ও বিপজ্জনক তর্ক। বরং বাঙালির লড়াই-সংগ্রাম ও ভাবুকতার সুনির্দিষ্ট ইতিহাসের মধ্য দিয়েই ইসলাম বাঙালির অবিচ্ছেদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ইসলাম প্রশ্ন বাদ দিয়ে বাঙালির কোন ইতিহাস নাই। থাকতে পারে না। অর্থাত্ আমরা বাঙালি বলেই ইসলামের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আত্মিক—ধর্ম সূত্রে বা জন্মসূত্রে ‘মুসলমান’ বলে নয়’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৬)। অর্থাত্ ইসলাম ধর্মের লড়াকু চরিত্রের জন্যই বাঙালি জাতি মুসলমান; ধর্মীয় বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। সে ক্ষেত্রে কোরআন এবং সুন্নার নীতিমালা নয়, বরং মুসলমান হওয়ার মানদণ্ড তাঁর ধারণায় হচ্ছে সংগ্রামী মনোভাব। এক আল্লাহ এবং রাসুলের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে নয়। অতিমাত্রায় দুর্ধর্ষ এবং ধর্মবিরোধী এই যুক্তি ইসলামের শত্রু হওয়ার জন্য যথেষ্ট হলেও রাজনৈতিক ইসলামিরা এখনো তাকে বাতিল ঘোষণা করেনি কেন, কেন বরং সসম্মানে তাকে আগলে রেখেছে, সেটি এক ধাঁধার ব্যাপার। 

আধুনিকতা ও মজহারীয় দৃষ্টিভঙ্গি

ফরহাদ মজহারের আক্রমণের একটি বিশেষ ক্ষেত্র হলো আধুনিকতা। তিনি মনে করেন আধুনিকতা মানুষকে যান্ত্রিক করে গড়ে তোলে। আধুনিক শিক্ষা কেবল জীবিকা উপার্জনের লক্ষ্য নিয়ে মানুষকে শিক্ষা দেয়। সেখানে আধ্যাত্মিকতা অনুপস্থিত। ওই শিক্ষার অধীনে মানুষ বন্দী থাকে এবং সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সম্ভব হয়, তার শোষণকাজকে চালিয়ে যাওয়া। কারণ আধুনিক শিক্ষার উত্স পুঁজিবাদী সমাজ, পুঁজিবাদ তো রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত করে। ফলে আজ বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ও সেখানে তার অবদান কী এবং কতটুকু, সেটি নির্ভর করছে কত দ্রুত ওই আধুনিক শিক্ষার একটি বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা উদ্ভাবন করা যায়।

বিশ্ব ভাবান্দোলনে আধুনিকতাবিরোধী তত্ত্বের দুষ্প্রাপ্যতা নিয়ে কখনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি। সে ক্ষেত্রে মজহারীয় অবস্থান নিতান্তই চমকহীন। ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান কেন হলো, কেন বর্বরতা স্থান করে নিল, কেন লাখ লাখ ইহুদি নিধন সম্ভব হলো, ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল নামে বুদ্ধিজীবীদের এক গোষ্ঠী এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন, যাঁদের মধ্যে পরিচিত নাম বলতে আমরা শুনি মারকিউজ, এডোরনো, হরখেইমার, এরিক ফ্রম, হেবারমাসের১১। তাঁরা দেখিয়েছেন আধুনিক সভ্যতা যান্ত্রিক মানসিকতার জন্ম দেয়। সেখানে ভাব বা আধ্যাত্মিকতার স্থান খুবই ম্লান। ওই যান্ত্রিক চেতনা মানুষকে কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ, সে শিক্ষায় শিক্ষিত না করে যুক্তিবাদী মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। এর ফল হয় ভয়াবহ। এই চিন্তাকাঠামোটি ফরহাদ মজহারও রপ্ত করেছেন পুরোদস্তুর এবং এক বিশেষ আত্মতৃপ্তিবোধ নিয়ে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে যথেষ্ট গুণগান করেছেন। কারণ ওই ব্যবস্থার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা। অনেকটা আফগানি বা পাকিস্তানি তালেবানিদের মতো করে আঘাতটি আধুনিক শিক্ষার বিরুদ্ধে হওয়া চাই। ওই মাদ্রাসাশিক্ষায় আধ্যাত্মিকতার বিপুলতা এতই যে তার ওপর ভর করে একটি আধ্যাত্মিকমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব বলেও তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। আধ্যাত্মিকতা বলতে মজহারীয় ধারণাটি কী, সেটি অবশ্য বোঝা কঠিন। তথাকথিত আধ্যাত্মিকতার মধ্যে পুরো দেহ-মনকে ডুবিয়ে রেখেও অনেক শক্তি ইতিহাসে বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে গেছে। ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানে সামরিক কর্মকর্তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ১৯৭১ সালে হত্যা করেছে। বর্বরতা বা যান্ত্রিকতা কি কেবল আধুনিক শিক্ষারই ফসল?

আধুনিক এবং কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থার দ্বৈততা তাঁর ভুবনে যথেষ্ট স্পষ্ট। আধুনিক শিক্ষাকে তিনি দেখেছেন আধ্যাত্মিক এবং দিব্যগুণবর্জিত এক ব্যবস্থা হিসেবে, যেখানে শিক্ষার নামে কলকারখানা, অফিস-আদালতের জন্য শ্রমিক সরবরাহ করার কারখানা নির্মাণ করা...মানুষকে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার গোলামে পরিণত করা...। মানুষকে জীবজন্তুর পর্যায়ে রাখা। কারণ শুধু শ্রমিক তৈরি হওয়ার দিক থেকে না, মানুষকে নীতি-নৈতিকতাবর্জিত ভোগী হিসেবে তৈরি না করলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না...(মজহার, শিক্ষা ও কওমি মাদ্রাসার রাজনীতি, ২৫ এপ্রিল ২০১৩)  এরই বিপরীতে কওমি মাদ্রাসা জীবের বৃত্তিসম্পন্ন ভোগী মানুষের শিক্ষা দেয় না...তাকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব গণ্য করে, সাচ্চা মুসলমান এবং মানুষ বানায়...(মজহার, শিক্ষা ও কওমি মাদ্রাসার রাজনীতি, ২৫ এপ্রিল ২০১৩)। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প ব্যবস্থা বলতে সেই শিক্ষাকে বোঝায় যেখানে নারী তেঁতুল তুলনীয়। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় যেকোনো আধুনিকায়নকে তিনি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন, ‘যে ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য মাদ্রাসাশিক্ষার ‘বৈপ্লবিক দিককে’ আড়াল করে বিদ্যমান ব্যবস্থার অধীনে অধীনস্থ করা বোঝায়। মজহারের ধারণায় এর সর্বোপরি উদ্দেশ্য, সেপ্টেম্বর এগারোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে ও পেন্টাগনে হামলার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে অনন্ত যুদ্ধ শুরু হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে...সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের টার্গেট বানানো...মাদ্রাসায় যা পড়ানো হয়, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বদলে দিয়ে চায়।’ আধুনিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড় করিয়ে মজহারের পক্ষে বিশেষ রাজনৈতিক ফায়দা লোটা সম্ভব হয়। ফরহাদ মজহার নিজেই তো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, সেই আধ্যাত্মিকতাবর্জিত শিক্ষা নিয়েও তাঁর পক্ষে বাংলার আধ্যাত্মিক জগতে একটি বিশেষ ভাবান্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, কেন তাঁর নিজের আধুনিক শিক্ষা সে ক্ষেত্রে কোনো বাধা হচ্ছে না, বোধগম্য নয়।

পুঁজিবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী সমাজ আধ্যাত্মিকতামুক্ত, আর ধর্মীয় মাদ্রাসাশিক্ষা আধ্যাত্মিক—এ যুক্তি অগ্রহণীয়। বুর্জোয়া শ্রেণী কেবল যান্ত্রিক শিক্ষার প্রতি ঝোঁকে না। সে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকেও ব্যবহার করে তার নিজ প্রয়োজনে। মার্ক্স কিন্তু ধর্মের আদর্শিক ও রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন।

ধর্মকে আফিম বলার মূল লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থে ধর্ম এবং বিদ্যমান আধ্যাত্মিকতা ব্যবহারের প্রতিবাদ করা। গ্রামসি কি দেখাননি, যেকোনো শ্রেণীসংগ্রামে বুর্জোয়া শ্রেণী কীভাবে ধর্ম, ঐতিহ্য, প্রথার ব্যবহার দিয়ে শ্রেণী শাসন বজায় রাখে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তো ইসলাম ধর্মের আধ্যাত্মিকতাকে কাজে লাগিয়েই সোভিয়েত শাসনের পতন ঘটিয়েছিল। আধুনিক শহর সভ্যতার বিরুদ্ধে ফরহাদ মজহার ওই একই কৌশল অবলম্বন করেছেন। সেখানেও শহর-গ্রাম দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে নগর সভ্যতার ঘরে আগুন লাগাতে চেয়েছেন। নষ্ট শহরে হেফাজতের গণবিস্ফোরণে (৯ এপ্রিল, ২০১৩) তিনি শহরকে একহাত নিয়েছেন অথচ বাঙালি সমাজে মানুষ এখনো নাগরিক না হওয়ায় আক্ষেপ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু নানা কারণে রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া বিকাশের দরকারে ব্যক্তির সার্বভৌম মহিমা, মর্যাদা ও অধিকার কায়েম করতে পারে নি। যার নজির আমরা ইউরোপের বিপ্লবে দেখি।...বুর্জোয়া রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সার্বজনীন নাগরিকতার অভিষেক ঘটে নি বাংলাদেশে।...ব্যক্তির উপলব্ধি ঘটেছে প্রধানত ভোগের জায়গা থেকে’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩২-৩৩)। যে শহর সভ্যতা ব্যতীত নাগরিক হওয়া যায় না, যে নাগরিক প্রত্যয় শহর সভ্যতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, সেই শহরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা, আবার বাংলাদেশে নাগরিক ধারণা কেন বিকশিত হয়নি তার জন্য আক্ষেপ—কি অস্বাভাবিক স্ববিরোধী মজহারীয় এই জগত্!

প্রাক্সিসের জগত্ ও মজহারীয় ভাবান্দোলন

ফরহাদ মজহারের আদর্শিক অবস্থানের সঙ্গে তাঁর প্রাক্সিসের গরমিল অত্যন্ত প্রবল। নিজের ভাবান্দোলনকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন তাঁর ব্যুত্পত্তিগত অর্থে, ভূ হওয়া বা হয়ে ওঠার অর্থে, তাকে রাজনীতি জাতপাত নারী-পুরুষ ভেদ ও শ্রেণী সংগ্রামের জায়গায় দাঁড়িয়ে, রাজনৈতিকভাবে বিশেষত বৈপ্লবিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির জায়গায় দাঁড়িয়ে১২। সমাজের ভেদচিহ্নগুলোকে মুছে ফেলার লক্ষ্য যে ভাবজগতের, সে জগত্ ভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে নয়, একটি সামাজিক শক্তির আশ্রয়ে ওই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে। মজহারের ভাবান্দোলন সামাজিক ও ধর্মীয় আশ্রয় হিসেবে খুঁজে নিয়েছে হেফাজতে ইসলামকে বা রাজনৈতিক ইসলামভিত্তিক দলগুলোকে। এসব সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সংহতি প্রকাশ থেকে ধরে নেওয়া যায় যে তাদের আদর্শের সঙ্গেও তিনি একমত পোষণ করেন। তাহলে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি, যেখানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধের ঘোষণা আছে এবং পাদটিকা হিসেবে তেঁতুলতত্ত্ব নামে পরিচিত যে অশালীন, কুরুচিসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত আছে, তার প্রতি মজহারের ভাবদর্শনের নাড়ির বাঁধন রয়েছে। নারীকে পুরুষের ভোগের বস্তু, তার লালসা নিবৃত্তির মাধ্যম ব্যতীত তেমন কোনো সামাজিক দায়িত্ব যে আন্দোলন দেখে না এবং যে সংগঠনের প্রধান মাওলানা শফীর নারীকেন্দ্রিক ইউটিউবীয় মন্তব্যে নারীর জন্য যে সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে মজহার নিশ্চয় একমত। তা না হলে হেফাজতের পক্ষ নিয়ে এত অধীর আগ্রহে মানবাধিকারের কুয়াশাচ্ছন্নতার আশ্রয়ে পুলিশি অত্যাচার, নিপীড়ন এবং হত্যার প্রতিবাদে তিনি নিজের কণ্ঠকে প্রসারিত করবেন।

আল্লামা শফী সাহেবের ধর্মীয় আন্দোলনকে মজহার সমীকরণ করেছেন নিপীড়িত শ্রেণীর সংগ্রামের সঙ্গে। কাগজে-কলমে তিনি তাঁর আন্দোলনকে দেখিয়েছেন শ্রেণী সংগ্রামের বিষয় হিসেবে, ‘বিভিন্ন শ্রেণীর দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে...শাসক শ্রেণীর সাংস্কৃতিক মানদণ্ড ও বয়ান থেকে বেরিয়ে আসার...বৈপ্লবিক চিন্তার সংগ্রাম, স্ফূর্তি ও বিকাশের ধারা’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩৮) হিসেবে। শব্দের ফুলঝুরি; শব্দের লহর, শব্দের চাটুকারিতা, সামাজিক ভেদরেখাকে বিশেষ করে লিঙ্গবিভেদকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার এই মহতী গোয়েবলসীয় প্রয়াসের বাইরে মজহারের ভাবান্দোলন শ্রেণী সংগ্রামের আন্দোলন এবং নারী-পুরুষ ভেদবিরোধিতার আন্দোলন চিন্তা করতে অপারগ। তার শ্রেণীভেদতত্ত্বের স্ফটিক স্বচ্ছ দুর্বলতাকে তিনি বোঝেন। কীভাবে সেই দুর্বলতাকে ধামাচাপা দেওয়া যায়, সেটি আঁচ করা যায় তার ২৫ এপ্রিল ২০১৩ সালে ইকোনমিক টাইমস তথ্যসূত্রে প্রাপ্ত ‘শিক্ষা ও কওমি মাদ্রাসার রাজনীতি’ লেখাতে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘এখানে শুধু শিক্ষণীয় দিকটি হলো ইসলামপন্থী সামাজিক সংগঠন বা রাজনৈতিক দলগুলিকে এককাট্টা একই রকম ভাববার কোন কারণ নেই। তাদের মধ্যে মতাদর্শিক বিরোধ যেমন আছে, তেমনি স্বার্থের সংঘাতও রয়েছে। ফলে তাদের দাবিদাওয়া দেখে শ্রেণী ও শক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তাদের চরিত্র বুঝতে যাওয়া ভুল হবে।’ (মজহার, শিক্ষা ও কওমি মাদ্রাসার রাজনীতি, ২৫ এপ্রিল ২০১৩) প্রশ্ন হলো, তাদের দাবি-দাওয়া যদি তাদের সামাজিক এবং শ্রেণী অবস্থানের নির্ণায়ক না হয়, সামাজিক অবস্থান যদি রাজনৈতিক অবস্থান থেকে জাত না হয়, তাহলে কেন লেখা, ‘কউমি মাদ্রাসার গুরুত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফীর সুনাম এবং মান্যতা। তাকে ঘিরে অতি সহজেই বাংলাদেশের আলেম-উলেমারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটি ব্যাপক ও শক্তিশালী ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছেন। তার মানে সমাজে যে শ্রেণীগুলোর একাধিপত্য আমরা দেখে আসছি, সেখানে বেশ ক্ষয় ঘটেছে এবং অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণী তাদের আকুতি ও আকাঙ্ক্ষা সরবে হাজির করতে আগের চেয়েও আরও অনেক বেশি সক্ষম। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই ধর্মীয় সংগঠনটি এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হাজির হয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রতি ঘৃণা ও ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং আতঙ্কের কারণে শহুরে সেক্যুলার মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী যত সহজে এখন এই শক্তিকে উপেক্ষা করতে চাইছে, বাস্তবতা অত সহজ বা সরল নয়। মাওলানা-মাশায়েখদের প্রতি তাদের বদ্ধমূল শ্রেণী ঘৃণা উগরে দিয়েই তারা ভাবছে এই শক্তিকে মোকাবিলা করা যাবে। আসলে তা হবে না। উচিত বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব অনুধাবন ও সঠিক বিশ্লেষণ’ (মজহার, শিক্ষা ও কওমি মাদ্রাসার রাজনীতি, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩)।

ভেদমুক্তির দোহাই দিয়ে যে ফ্যাসিবাদী ব্যক্তিস্বাধীনতাবিরোধী সমাজ নির্মাণের কথা তিনি ভাবছেন, সেই তত্ত্বে লালনকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় স্থান করে দেওয়ার মজহারীয় দুরভিসন্ধিও পরিষ্কার। সমাজবাদী ভাবজগতে বৃহত্তর মানবতাবাদের লালনীয় আবেদন, আবেগ ও চাওয়া-পাওয়া, যেটি দেশ-কাল-পাত্র, নারী-পুরুষ, জাতপাতের ঊর্ধ্বে, তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা লালনকে অসম্মান করা বোঝায়। লালনকেন্দ্রিক কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন বাংলায় গড়ে ওঠেনি। কারণ এতকাল মানুষ লালনের বিশ্ব মানবতার বাণীকে নিতান্তই পরিচ্ছন্ন রেখেছে, তাঁর আদি পরিচিতিকে কলুষিত হতে না দিয়ে। সেই পরিচ্ছন্ন ভাবের জগত্ থেকে সব শ্রেণী এবং ধর্মের মানুষ তৃপ্তিসুধা লাভ করেছে। লালনের ওই মানবতাবাদী এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণীকে মজহার তাঁর আন্দোলনের ভাবগত উেস পরিণত করতে চান। আর সেই উদ্দেশে লালনীয় দর্শনের যেটুকু ইসলামি, সেটুকুকে খুঁজে বের করে তাঁর রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো উদ্দেশ্য। এতকাল যেভাবেই হোক না কেন লালনের ভাবজগতের স্নিগ্ধ সুধাধারা সমাজের কোনো বিশেষ গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহূত হয়নি, কোনো সংকীর্ণ স্বার্থের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেনি। আর সে কারণে তাঁর পবিত্রতা এতকাল ছিল অকলুষিত। তাঁকে কলুষিত করার সেই দায়িত্বটি ফরহাদ মজহার নিজে গ্রহণ করেছেন। তাঁকে আজ ব্যবহার করা চাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, বিদ্যমান জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকল্প শক্তি নির্মাণে। তিনি লিখেছেন, ‘বিশেষত ফকির লালন শাহ আমাদের যতোটা কাজে আসেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের উপাস্য ব্যক্তিরা ততোটা কাজে আসেন না। ফকির লালন শাহ ও বাংলার ভাবান্দোলনের প্রতি এই কারণেই আমাদের বিশেষ রাজনৈতিক আগ্রহ’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩১)।

লালনকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুখোমুখি শক্তি হিসেবে উপস্থাপনের মজহারীয় চক্রান্তও বেশ সূক্ষ্ম। সেখানে আবেদনটি যুবসমাজের প্রতি। তাঁর মতে, যুবসমাজের বেশ বড় একটি অংশ হতাশ এবং সে কারণে বিরক্ত হয়ে বাঙালি সমাজের মধ্যবিত্তের এক বিশেষ অংশ লালন শাহের ভাবের জগতে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। মধ্যবিত্তের মধ্যে এই প্রবণতা দেখে একদিকে তিনি যেমন খুশি, তেমনি উদ্বিগ্ন। কারণ, ‘শিক্ষিত ও অপেক্ষাকৃত সচ্ছল তরুণদের ফকির লালন শাহ সম্পর্কে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠা প্রধানত অধিপতি শ্রেণীর সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের লক্ষণ। কলকাতার বাবুসংস্কৃতির অনুকরণে যে ঢাকাকেন্দ্রিক ‘আধুনিকতা’ ও সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে, সেই ধারার চেহারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩৯)। কারণ সেই আকর্ষণ অতিনিমেষে গাঁজা বা নেশাগ্রস্ততায় পরিণত হতে পারে। তিনি আরও লক্ষ করেছেন, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার সাংস্কৃতিক ক্ষুধা মিটাতে ব্যর্থ হওয়ায় তরুণদের বড়ো একটা অংশ বসে থাকে নি। নিজেরা যা পেরেছে তৈরি করেছে, আমাদের শুনিয়েছে। নিজেদের পুঁজি ফুরিয়ে যাচ্ছে দেখে বাউল ফকির বয়াতিদের দ্বারস্থ হয়েছে। এই শখ বা ক্রেইজ বেশিদিন থাকবে না। কিন্তু যদি বাংলার ভাবান্দোলনের পরিচয় আমরা ঠিক মতো নিতে পারি—নিছকই জ্ঞান হিশাবে নয়—জ্ঞানচর্চা বা ভাবচর্চার ধারা হিশাবে—তাহলে বাংলার ভাব ও ভাবুকতার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটতে বাধ্য’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩২)। সে কারণে তাঁকে কেবল ধর্মতাত্ত্বিকতার অবস্থান থেকে বিচার করতে তিনি নারাজ। লালনকে, তাঁর উপদেশ মতে, দেখতে হবে নদিয়ার ঐতিহ্যে, তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনমুখী চরিত্রের আলোকে, যেটি এতকাল কেউ তাঁর মতো করে ভাবেননি। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আউল-বাউল, ফকির-ফ্যাকড়া, দরবেশ, উদাসী, বয়াতি, পালাকার ইত্যাদি নানান নামে গণমানুষের চিন্তার যে লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস দেখি তাকে এক কথায় বাংলার ‘ভাব’ বলি। ভাবুকতার এই আন্দোলন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম থেকে আলাদা কিছু নয়।...নিরক্ষরের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে বাংলার চিন্তা বা ভাবচর্চার যে প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ রূপটা আমরা দেখি বাংলার দর্শনচর্চার ভিত্তি নির্মাণের কাজ সেখান থেকেই আরম্ভ করতে হবে’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২১)। কারণ ‘যদি বাংলার চিন্তা বা ভাবের বৈপ্লবিক দিকগুলো আমরা ধরতে না পারি তাহলে রাজনৈতিক ভাবে যতোই আমরা বিপ্লবের কথা আওড়াই, তাতে কোথাও কোন কূটাটিও নড়বে না’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩৮)।

শ্রেণী সংগ্রামের সঙ্গে লালন এবং লালনের সঙ্গে ইসলামকে যুক্ত করে তিনি এই কালপুরুষকে ইসলামি আন্দোলনের পুরোধা বানাতে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নাস্তিক হওয়া খুব সহজ বলে এই বিরক্তিকর উপদ্রব প্রায়ই হাজির হয়। এর জ্বালাতন প্রায়ই আমাদের সহ্য করতে হয়।...নিজেকে ‘প্রগতিশীল’ প্রমাণ করা সস্তা পথ। মুশকিল হচ্ছে নব্য মধ্যবিত্ত ‘বাউল’ বা বয়াতিদের মধ্যে পুরানা বাতিকে নাস্তিকতাই অন্বেষণ করে বেড়ায় এবং বিক্ষিপ্ত ভাবে একটি দুটি গানের কলির মধ্যে তাদের নজির দেখে খুবই আহ্লাদ বোধ করে। পরক্ষণেই আবার এদের মধ্যেই জিকির, আল্লাহ দৈন্য, নবীতত্ত্ব, গৌরগান, কীর্তন, গোষ্ঠগান দেখে নব্য মধ্যবিত্ত হতভম্ব হয়ে যায়—মেলাতে পারে না। বাংলার ভাবান্দোলন আস্তিকতা/নাস্তিকতা এই ভেদরেখার বহাল রাখার লড়াই নয়’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩৩)। কিন্তু লালনকে ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার মজহারীয় প্রকল্প যে তাঁর নিজের অসংলগ্ন অবস্থানকে আরও বেশি উচ্চারিত করে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মজহারীয় লিয়াজোঁ এবং ওই রাজনৈতিক শক্তিকে পুরোপুরি ব্যবহার করার মজহারীয় ষড়যন্ত্র যে বুমেরাং হয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসবে না, সেটি নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তার কারণ জামায়াতে ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে লালনীয় ভাব এবং পীর-ফকির তত্ত্বের বিরুদ্ধবাদী একটি আন্দোলন। সুফিবাদবিরোধী, পীরতত্ত্ববিরোধী, কবর জিয়ারতবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে মজহারের সখ্যতা তাঁর নিজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বময় জীবন এবং আদর্শকেই আরও বেশি স্বচ্ছভাবে তুলে ধরে।

তিনি লিখেছেন, ‘গরিবের সম্পদ বড়োলোক চুরি করে এটা নতুন কিছু নয়, সেটাও না হয় সহ্য করা গেল। তারা রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান বা সুর এক অক্ষর এদিক-ওদিক করতে পারেন না, কিন্তু এই শ্রেণীর ধৃষ্টতা হোল বাউল ও বয়াতিদের গানের কথা ও সুর তাদের খুশিমতো বদলানো। বিকৃত করতেও তাদের বাধে নি। তখন বোঝা যায় বাংলার ভাবান্দোলনের প্রতি অধিপতি শ্রেণীর মনোরঞ্জকদের শ্রদ্ধা দূরের কথা এগুলো তাদের কাছে নিছকই কাঁচামাল ছাড়া অধিক কিছুই নয়। কাউকে না বলে এবং কারও কাছে জবাবদিহী না করে তারা যেমন খুশি তেমন এই মাল ব্যবহার করতে পারে। লালনের সঙ্গে খেটে খাওয়া মানুষকে যুক্ত করে অথবা লালনের গানের সুর বদলানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করে এক সাম্প্রদায়িক রং মিশিয়ে লালনকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করার সস্তা সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে নারাজ।

ভূকৌশলগত রাজনীতি ও মজহারীয় অবস্থান

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বিদ্যমান ত্রিভুজ প্রেমকে (বাংলাদেশকে নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে) উপলক্ষ করে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার এক নতুন সংস্করণের জন্ম হচ্ছে এবং সেখানে মজহারের বিশেষ ভূমিকা উপেক্ষা করার নয়। এতকাল বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বলতে ইউরোপ ও আমেরিকাকে আমরা বুঝে এসেছি। আজ সেই বোঝার ক্ষেত্রে বেশ দৃশ্যমান এবং গভীর পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বার্লিন দেয়াল যেদিন ভেঙে পড়ল এবং গোটা ইউরোপ অভিন্ন রাষ্ট্রপুঞ্জের পথে পা বাড়াল, সেদিন থেকে ঠান্ডা লড়াই-ই কেবল শেষ হলো না, এর সঙ্গে এতকাল টিকে থাকা দ্বিকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটল। ওই সমাপ্তির সঙ্গে পুরোনো সব আদর্শিক ও তাত্ত্বিক কাঠামো এবং অভিব্যক্তি জঞ্জালে পরিণত হলো। সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দী ধরে আমরা দুই পরাশক্তির মধ্যকার আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং প্রক্সি যুদ্ধ দেখে এসেছি। সেই বিশেষ বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের হয় এদিকে, নয় ওদিকে দাঁড় করাতে হয়েছে ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছায়। আর তার ফলে অপরিসীমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বহু রাষ্ট্র তাদের দিকনির্দেশনা হারিয়েছে। আজ সেই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এসেছে। দ্বিকেন্দ্রিক (আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন) ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককালীন একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সে আধিপত্য ক্ষণিক প্রমাণিত হচ্ছে। এককেন্দ্রিক বিশ্বের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে বহুকেন্দ্রিক এক বিশ্বব্যবস্থা। সেই বহুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় যে দুই পরাশক্তির আবির্ভাব আমরা আশা করছি, তারা এশিয়াতে অবস্থিত। চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি তাদের অচিরেই বিশ্ব মহাশক্তিতে পরিণত করবে বলে বিজ্ঞজনেরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সেদিক থেকে ভাবলে ভারতবর্ষ পরিণত হতে চলেছে এক বিশেষ অঞ্চলে, যার ভূকৌশলগত মূল্য অপরিসীম। চীন ও ভারতের মধ্যে অতীত সম্পর্ক কখনো ভালো ছিল না। তারা ১৯৬২ সালে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আজও সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রয়েছে। তার ওপর রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হওয়াকে ভালো চোখে দেখে না। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে, সেই আশঙ্কা আজ আমেরিকার। সে কারণে বৈশ্বিক রাজনীতির কৌশল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে আঁতাত করবে, সেটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতির প্রশ্ন যখন আসে, যেখানে ভারতের পাশাপাশি রয়েছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য রাষ্ট্র; তখন এই অঞ্চলের ওপর ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখা মার্কিন স্বার্থের জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।

এই বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক এবং ভূকৌশলগত প্রজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিচার করা দায়িত্বশীল কাজ। বিশ্বায়নের যুগে রাষ্ট্রপুঞ্জের অতিমাত্রিক নিকটবর্তিতা এবং একে অপরের মধ্যে আদান-প্রদানের ঘনত্ব বৃদ্ধিকে মূলধন করে এবং আঞ্চলিক রাজনীতিকে ভারতবিরোধিতার রঙে রঙিন করে এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ নির্মাণ করা কতটুকু যৌক্তিক, সে প্রশ্ন রয়ে যায়। সেদিক থেকে ভাবলে মৌলবাদী ইসলামের এই মজহারীয় স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক ধারায় বিকশিত দেশীয় বামের ঘনিষ্ঠ গ্র্যান্ড আঁতাত একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির এক সংকটের জন্ম দিচ্ছে। এই গ্র্যান্ড আঁতাতের কি কোনো নিকট যোগসূত্র আছে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির দাবা খেলায়? এমন কি হতে পারে যে সাম্প্রদায়িক এবং উগ্র ইসলামি আন্দোলনকে ওই দাবা খেলায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? ভারত যদি বাংলাদেশকে উগ্র ইসলামি এবং সন্ত্রাসী রাজনীতির প্রভাবমুক্ত একটি দেশ হিসেবে আশা করে তাহলে এ অঞ্চলে ভারতের প্রভাবকে খর্ব করার লক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে ভারতের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যুকে নিয়েই খেলবে। সেখানে সন্ত্রাসী ইসলামি আন্দোলন হতে পারে এক বিশেষ মারণাস্ত্র। সেই ফ্রেমওয়ার্কে ভাবলে জঙ্গি ইসলামের প্রতি ফরহাদ মজহারের পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ সমর্থন এ অঞ্চলে আমেরিকান এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নির্ধারিত দিল্লির রণনীতি এবং শেখ হাসিনার রণরঙ্গিনী মূর্তি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে, শাহবাগ আন্দোলনকে দিল্লির রণনীতির শক্তিশালী যুক্তি, সাতক্ষীরায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর যোগসূত্র খোঁজার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার ওই আবহ তৈরি হচ্ছে মজহারীয় কলমে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক রাজনীতিতে আল-কায়েদা জাতীয় সন্ত্রাস এবং গেরিলা স্টাইল থেকে জন্ম নেওয়া যে সন্ত্রাস ও তাণ্ডবলীলা দেশ প্রত্যক্ষ করল, তার পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমত্বসংক্রান্ত প্রাচীন ধারণার পরিবর্তে সহজভাবে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের সাম্প্রতিক উদাহরণ টেনে মজহারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামের নাম ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো (ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ, ইসলামপন্থীরা তাদের জন্য হুমকি), যা কিনা মার্কিন ভূকৌশলগত রাজনীতির সঙ্গে বেশ মিলে যায়।

শেষ কথা

বাংলাদেশের মাটি নরম। এখানকার মানুষ ধর্মভীরু। এখানে ভারী কোনো আদর্শ মানুষ পছন্দ করে না, সে আদর্শ মৌলবাদী রাজনৈতিক ইসলাম হোক, মার্ক্সবাদী হোক বা হোক উগ্র জাতীয়তাবাদী। একটি আধুনিক, উদারপন্থী মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা আমাদের কর্তব্য। সেখানে বিপ্লব ভাবনা বেশি দূর এগোবে না। সংস্কার দিয়ে সমাজকে মধ্য পন্থার একটি গণকল্যাণধর্মী সমাজ গড়ে তোলাই বিকল্প আদর্শ ভাবনা হতে পারে। ফরহাদ মজহার বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদী ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহার দিয়ে যেসব সমাজ এই পরীক্ষণ করেছে, সেখানে ধ্বংস এবং বিভেদ ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তিউনিশিয়া, মিসর, লিবিয়া তার প্রমাণ। মজহার যে জঙ্গি ইসলামি প্যারাডাইম ব্যবহার করেছেন, সেটি বৈপরীত্যে ডুবে আছে। মানুষের বুঝতে বাকি নেই তাঁর শ্রেণী অবস্থান; ভেদমুক্তির আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা সবই কথার কথা। কেবল হয়তোবা কথার কথাও নয়, বরং তাঁর নিজ জীবনের নানা ডিগবাজি এবং উল্লম্ফনকে যৌক্তিক রূপ দেওয়া ছাড়া ওই সব শব্দ বাগাড়ম্বর, বিশেষ কোনো মূল্য বহন করে না।

[প্রবন্ধটি লেখার ক্ষেত্রে নানাভাবে সাহায্য করার জন্য খন্দকার সাখাওয়াত আলী (প্রতিচিন্তা), খলিলউল্লাহ্ (প্রতিচিন্তা) এবং ইফতেখার মাহমুদকে (প্রথম আলো) ধন্যবাদ।]

টিকা

১। Michel Foucault moving from a postmodern position considered it as the renewal of an entire nation’s total existence through the resumption of a spiritual experience found at the heart of Shi’I Islam³ (see, Richard, Y. 1991: 267). Later Foucault would also mention that Iranian revolution was indeed the first postmodern revolution of our time. Informed by the way modern man is said to have redefined its relationship with truth, Foucault’s position challenges the backbone and substance of the Western tradition (Hollingdale, 1977: 9).

২। ফরহাদ মজহারের ‘খালেদার জয়-পরাজয়,’ চিন্তা য় প্রকাশিত হয়।

৩। ফরহাদ মজহার, ‘এখন ঘুরে দাঁড়াবার সময়,’ এপ্রিল-৬, ২০১৩, অনলাইন থেকে নেয়া।

৪। অমর্ত্য সেন লিখেছেন, A Hutu labourer from Kigali may be pressed to see himself only as a Hutu and incited to kill Tutsis, and yet he is not ony a Hutu, but also a Kigalian, a Rwandan, an African, a labourer, and a human being (Sen, A, 2006: 4)|

ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে তিনি লিখেছেন, In partitioning the population of the world into those belonging to the Islamic World, the Western World, the Hindu World, the Buddhist World, the decisive power of classificatory priority is implicitly used to place people firmly inside a unique set of rigid boxes. Other divisions (say, between the rich and the poor, between members of different classes and occupations, between people of different politics, between distinct nationalities and residential locations, between language groups, etc.) are all submerged by this allegedly primal way of seeing the differences between people. (Amryta Sen, 2006:11).

৫। লিয়াটারডের মতে, মানবমুক্তি, আত্মতৃপ্তি এবং সামাজিক প্রগতিসংক্রান্ত আধুনিকবাদী ধারণাগুলো পোস্টমডার্ন পর্যায়ে এসে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ এই সমাজে আর বিশ্বাস করে না যে প্রজ্ঞা দিয়ে কুসংস্কার দূর করা যাবে, মানুষকে নিখুঁত করা যাবে অথবা রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি নিখুঁত সমাজ উপহার দেবে। পোস্টমডার্ন সমাজে দুটি দিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ—একটি হলো কোনো অনন্ত সত্য নেই এবং সে কারণে সত্য অনুসন্ধানে যে জ্ঞান ব্যবহার করা হয়, সে জ্ঞান একক জ্ঞান না হয়ে বিভিন্ন শাখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বৃদ্ধি পাবে। দ্বিতীয়ত, প্রায়োগিক কৌশলগত জ্ঞানের প্রসার ঘটবে (দেখুন Lyotard, J. F (1984: p. XXVI) । 

৬। সামুয়েল হান্টিংটন লিখেছেন, It is my hypothesis that the fundamental source of conflict in this new world will not be primarily ideological or primarily economic. The great divisions among humankind and the dominating source of conflict will be cultural. Nation states will remain the most powerful actors in world affairs, but the principal conflicts of global politics will occur between nations and groups of different civilizations. The clash of civilizations will dominate global politics. The fault lines between civilizations will be the battle lines of the future. (Samuel Huntington, The Clash of Civilisations? Foreign Affairs, Summer volume 72, no. 3 1993, p.22).

৭। জিহাদ সম্পর্কে নিবিড়ভাবে গবেষণা করে Reuven Firestone লিখেছেন, The semantic meaning of the Arabic term jihad has no relationship to holy war or even war in general. It derives, rather from the root j.h.d., the meaning of which is to strive, exert oneself, or take extraordinary pains. Jihad is a verbal noun of the third Arabic form of the root jahada, which is defined classically a exerting ine’s utmost power, efforts, endeavors or ability in contending with an object of disapprobation. Such an object is often categorized in the literature as deriving from one of three sources: a visible enemy, the devil, and aspect of one’s own self. There are, therefore, many kinds of jihad, and most have nothing to do with warfare. Jihad of the heart, for example, denotes struggle against one’s own sinful inclinations, while Jihad of the tongue requires speaking on behalf of the good and forbidding evil (Firestone, R, 1999: 16-17).

৮। পবিত্র কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, And hold fast, All together, by the rope which Allah (stretched out for you), and be not divided among yourselves; And remember with gratitude Allah’s favour on you; for ye were enemies and he joined your hearts in love, so that by His grace, ye became brithren; And ye were on the brink of the pit of fire, and He saved you from it. Thus doth Allah make His signs clear to you; that you may be guided. (Translation by Yousuf Ali)

৯। তিনি লিখেছেন, ‘এই ভাবকে প্রথমে বুঝতে হচ্ছে এর ব্যুত্পত্তিগত অর্থে—ভূ হওয়া বা হয়ে ওঠার অর্থে। আমাদের হয়ে ওঠার কাজ হিশাবে। দ্বিতীয়ত তার রাজনীতি জাত, পাত, নারীপুরুষ ভেদ ও শ্রেণী সংগ্রামের জায়গায় দাঁড়িয়ে বোঝাবুঝি। যদি লড়াই-সংগ্রামের জায়গা থেকে আমরা বাংলার ভাবুকতাকে বুঝতে না পারি তাহলে গোলোকায়ন বা সাম্রাজ্যবাদের এই যুগে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে মানুষের সত্যিকারের ইতিহাসের শুরু করবার যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে সেই আয়োজনে আমরা পিছিয়ে থাকব।...রাজনৈতিক ভাবে, বিশেষত বৈপ্লবিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলার ভাবান্দোলনকে নতুন করে বোঝা ও বিচারের কাজ মোটেও সহজ কাজ নয়। কিন্তু সেই দিকেই আমাদের আগ্রহ’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩৪)।

১০। কুলি লেখেন, In cooperation with Zia al Haqus military and intelligence services, the CIA, with Saudi finance as well as Pakistani logisticsal support, managed the raising, training, equipping, paying and sending into battle against the Red Army in Pakistan of a mercenary army of Islamic volunteers. Eventualy this army would be drawn not only from Arab and Muslim states everywhere, but also from minority Muslim communities in Western countries, including the United States. Many of those from the African or Asian continents were religious, political or criminal fugitives from their own governments. Others were simply soldiers of fortune. G.. In 1989, under the presidency of George Herbert Bush (1989-1993), the CIA celebrated its victory with champagne. Nevertheless, the Holy alliance of the Americans and the Islamist forces against the Russians in South and Central Asia had ended in a series of distinctly unholy clan and tribal wars, affecting much more than the ex-Soviet Union. Afghanistan itself lay in ruins, wasted by the jihad. Its society and people were ravaged by drug, poverty, and horrific war injuries from fighting and landmines. (Cooley, J., 2002, Unholy Wars: Afghanistan, America and International terrorism, London: Pluto Press).

১১। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল মার্ক্সবাদকে পূর্ণতা দেওয়া; সেই কাজে বিশেষ করে মার্ক্সের সঙ্গে ফ্রয়েডের মিশ্রণ ঘটিয়ে এক বিশেষ সমালোচনাধর্মী তত্ত্ব সৃষ্টি করা। তবে সেই প্রকল্প দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণে বিশেষভাবে ব্যাহত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের ইহুধি নিধনকে তত্ত্বগতভাবে বোঝা কঠিন ছিল। এনলাইটেনমেন্টের প্রভাবে যেখানে সমাজ জীবন নির্মিত, সেখানে কীভাবে সম্ভব হলো এই ধরনের বর্বরতার। এর কারণ অনুসন্ধানে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল বিশেষভাবে মেক্স ভেবারের ইনস্ট্রুমেনটাল র্যাশনালিটির ওপর জোর দেয়। দেখা যায় যে উন্নত পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে ফরমাল র্যাশনালিটি ইতিমধ্যে মূল্যবোধের ওপর প্রভুত্ব সৃষ্টি করেছে। তবে ভেবার এই প্রভুত্বকে কেবল রাষ্ট্রকাঠামো এবং ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন কীভাবে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র প্রজ্ঞাভিত্তিক চিন্তাকে পারপোসিভ র্যাশনালিটি-এর পর্যায়ে রেখে তাকে সমাজের মূল্যবোধ বা কী ধরনের সমাজ ভালো বা মন্দ সে ধরনের কোনো ব্যবস্থাপত্র অনুমোদন করে না। মজহার ভেবারের তত্ত্বের পার্থক্যকে বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়ায় তাঁর কাছে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা আধ্যাত্মিকতাহীনতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, অনেকটা ভুল বুঝে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।

১২। ওই একই চিন্তাকে আরও একটু কঠোরভাবে তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদীর এই পশ্চাতপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেবার দরকার আছে।...এই শেকড়হীনতার মধ্যে আমরা বাংলাদেশের জন্য ভয়ানক বিপদ দেখি। বাহ্যিক জৌলুস ও ডামাডোলের পেছনে নিজের অন্তঃসারশূন্যতা সম্পর্কে এই ধারার নিজেরই এক করুণ ও পরাজিতের উপলব্ধি আছে। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি বা সংখ্যাগরিষ্ঠের চিন্তাচেতনায় ও রাজনীতিতে তার আর স্থান হবে না। যার কারণে তাকে টিকে থাকতে হবে অনিবার্য ভাবেই জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ স্থানীয় বরকন্দাজ হয়ে। ইসলামের বিরুদ্ধে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র সিভিলাইজিং মিশন হওয়া ছাড়া বাংলাদেশে তার আর কোন সাংস্কৃতিক বা ভাবগত ভূমিকা রইল না। আফসোস। ইসলামী জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড পরিচালনার মধ্যেই সে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে এখন বদ্ধপরিকর’ (মজহার, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩৭)।

গ্রন্থপঞ্জি

Sen, Amryta. 2006. Identity and Violence: Illusion of Destiny. New York: W.W.Norton.
Firestone, R. 1999. Jihad: The Origin of Holy War in Islam. Oxford: Oxford University Press.
Cooley, J. 2002. Unholy Wars: Afghanistan, America and International Terrorism. London: Pluto Press.
Lyotard, J. F. 1984. The Postmodern Condition. Manchester University Press, Manchester.  

মজহার, ফরহাদ। ২০০৮। ভাবান্দোলন। ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স।

মজহার, ফরহাদ। ২০০৬। মোকাবেলা। ঢাকা, বাংলায়ন।

মজহার, ফরহাদ। ২১ জানুয়ারি ২০১৪। ‘খালেদার জয়-পরাজয়,’ চিন্তা  (ওয়েব থেকে নেওয়া)।