বাংলাদেশ: এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস-মওদুদ আহমদ, ইউপিএল ২০১২মওদুদ আহমদ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র। বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসজুড়ে তাঁর রাজনৈতিক উপস্থিতি লক্ষণীয়। তিনি কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত। আমরা মওদুদ আহমদের বইয়ের আলোচনায় প্রবেশের আগে তাঁর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থান স্মরণ করে নিতে পারি। কারণ তিনি এমন একটি সময়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন, যখন তিনি নিজেই অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নিপীড়িত হয়েছেন। অবশ্য রাজনীতির বোদ্ধারা সাধারণত এটা কবুল করে থাকেন যে মওদুদ রাজনীতিতে কখন কী (সুবিধাবাদিতা এর অন্যতম) করছেন, আর তিনি সে সম্পর্কে কী লিখছেন, তাকে এক করে দেখা যাবে না। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে তিনি যতটা সম্ভব নির্মোহ অবস্থানে থেকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন।অবশ্য দেশে তাঁর এই মিশ্র অবয়ব সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেকেই, বিশেষ করে অস্ট্রেলীয়-ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক জন পিলজার—নোয়াম চমস্কি যার কাজকে বলেছেন অন্ধকারে আলোকসংকেত, আবার উইলিয়াম শোক্রসের মতে ইংরেজি ভাষার অন্যতম লেখক—মওদুদের গুণমুগ্ধ। এক-এগারোতে লেখনীর মাধ্যমে পিলজার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মওদুদের পাশে দাঁড়ান। এমনকি তাঁর জামিন চেয়ে ফখরুদ্দীন আহমদকে পাঠানো পিলজারের ই-মেইল আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল। গ্রানাডা টিভির হয়ে একাত্তরে যুদ্ধ কভার করতে এসে মওদুদের সঙ্গে পিলজারের এক ‘চন্দ্র অনালোকিত রাতে’ দেখা হয়েছিল। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মিরর-এর সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকা পিলজারের চোখে মওদুদ সাহসী, আদর্শস্থানীয় রাজনীতিক। এমনকি তিনি তাঁকে টমাস পেইনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর অ্যাংলো-আমেরিকান পেইন রাজনীতির তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও বিপ্লবী ছিলেন। দণ্ডিত হয়েছেন, জেল খেটেছেন বহুবার। ফরাসি বিপ্লবে যোগ দিয়েছেন, আমেরিকার স্বাধীনতার জন্য লিখেছেন প্যামফ্লেট। পিলজার মওদুদের জন্য ২০০৮ সালে লিখেছেন, সেই লেখাটিই সময়োপযোগী করে পুনরায় লিখেছেন গার্ডিয়ান-এ (১৫ ডিসেম্বর ২০১৩)। উভয় লেখায় একজন বন্দী মওদুদের কারামুক্তির ওপরই বিশেষ জোর দিয়েছেন পিলজার। কিন্তু যেটা এখানে প্রতিপাদ্য সেটা হলো, পিলজারের বর্ণনায় মওদুদ বিরাট মাপের গণতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধাচরণের এক অবিসংবাদিত সিপাহসালার। ধরে নিতে পারি পিলজার তাঁর বন্ধু মওদুদকে যেভাবে চিনেছেন, চিত্রিত করেছেন, সেই পরিচয়ে পরিচিত হতে, স্বীকৃতি পেতেই মওদুদের ঝোঁক থাকতে পারে। কিন্তু সেটা যে আসলে একটি খণ্ডিত চিত্র তা অনেকেই মানবেন।মওদুদের এই বইয়ের আলোচনায় পিলজারকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা এ কারণে যে মওদুদ নিজেকে গণতন্ত্রের বরপুত্র ভাবতে পছন্দ করেন। তাঁর ধূসর রাজনৈতিক জীবনের কোনো ব্যাখ্যা আমরা তাঁর বইয়ে পাই না। এমন একজন চিন্তাবিদের কাছ থেকে আমরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ আলোচনা ও বিশ্লেষণ পাচ্ছি। পিলজার লিখেছেন, ‘মুজিবের আমলে মওদুদ গণতন্ত্রের একজন “অতন্দ্রিত রক্ষী” হওয়ায় কারাবরণ করেছিলেন। আর পরবর্তী সময়ে হত্যা, অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের রাজনীতিতে মওদুদ নিজেকে কারাগার ও সংসদের মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছেন। কারাগারে থেকেও তিনি সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালের অধিকাংশ সময় ফিউডালিস্ট ও ডেমোক্র্যাটদের এবং সম্প্রতি ফান্ডামেন্টালিস্টদের মধ্যে লড়াই চলেছে।’ গণতন্ত্রের লড়াই নিশ্চয় বাংলাদেশে চলছে। মওদুদ এই লড়াইয়ে সব সময় গণতন্ত্রীদের পক্ষে ছিলেন কি? বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে জেলে পোরা কি শেখ হাসিনাই প্রথম করেছেন? কবি হাসনা মওদুদ পিলজারকে বলেছেন, বিশ্বকে জানতে হবে যে গোটা দেশটা কারাগারে পরিণত হয়েছে। এটা অসত্য নয়। কিন্তু বিএনপি আমলে যখন ঘটেছে তখন তাতে মওদুদের ভূমিকা কী ছিল।