গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশে গত ৪২ বছরে গণতন্ত্রের নিরীক্ষা এর অগ্রযাত্রার পথে যে সংকট তৈরি করেছে, বর্তমান নিবন্ধে তার উত্সমূলসমূহ অনুসন্ধান করা হয়েছে। উত্তর (অভ্যন্তরীণ) ঔপনিবেশিক বাস্তবতার বিষয়সমূহ বিবেচনায় না রেখে ঔপনিবেশিকতার সূত্রে প্রাপ্ত গণতান্ত্রিক ধারণা এবং কাঠামোসমূহকে  হুবহু অনুকরণ করার প্রচেষ্টাকে সংকটের উত্সমূল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে এ গণতন্ত্রের চর্চা একদিকে যেমন জন্ম দিয়েছে বিভাজিত জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে ডান সর্বাত্মকবাদী দল এবং গোষ্ঠীসমূহের অবস্থান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুসমুন্নত করেছে এবং এর পাশাপাশি গণতন্ত্রচর্চার যে অন্যতম মৌল উপাদান ‘সেক্যুলার’ মতাদর্শ, তার চর্চার ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করেছে। আর এ সবকিছুই বর্তমান বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: গণতন্ত্র, ডান সর্বাত্মকবাদ, জাতীয় এলিটবৃন্দ, প্রাকৃত জনগোষ্ঠী, উত্তর ঔপনিবেশিক কাঠামো, সেক্যুলার মতাদর্শ, বিভাজিত জাতীয়তাবাদ।

প্রারম্ভিক কথা

পেরি অ্যান্ডারসন তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতীয় গণতন্ত্রের বহুত্ববাদিতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের ধারণাকেই ত্রুটিযুক্ত বলেছেন। এর ফলে ভারত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক ন্যায়বিচার বা সামাজিক (সক্ষমতার) সমতা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। অ্যান্ডারসনের সমালোচনার কাঠামোর ভিত্তি হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপের গণতন্ত্রের মডেল। তিনি ইউরোপীয় গণতন্ত্রের এ মডেলকে বৈশ্বিক ধরে নিয়েছেন। পাশ্চাত্যের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মনীষী মনে করেন, রাষ্ট্র, সমাজ, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিরিখে সর্বক্ষেত্রে এ মডেল প্রযোজ্য। এ চিন্তায় যে বিষয়টাকে উপেক্ষা করা হয় তা হলো উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোসমূহে এ মডেল আদৌ প্রযোজ্য হবে কি না, বা কীভাবে এ মডেলটি এসব রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হবে সে প্রশ্নটি। এই প্রবন্ধের লক্ষ্য পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের মডেলের আলোকে ভারতীয় গণতন্ত্র কতটুকু সফল, সেটি বিশ্লেষণ করা নয়, বরং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মডেল নিয়ে বিয়াল্লিশ বছর ধরে যে চর্চা হয়েছে তাঁর বিচার-বিশ্লেষণ করা। এ বিশ্লেষণের লক্ষ্য হচ্ছে, অ্যান্ডারসন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে ধারণার কথা বলেছেন, সে ধারণাসমূহ উত্তর-‘অভ্যন্তরীণ’ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে কী রূপ লাভ করেছে তা দেখা এবং তা পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের মডেলের বিপরীতে উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বাস্তবতার আলোকে মূল্যায়ন করা।

গণতন্ত্র

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেশটির জনগোষ্ঠীর সামনে এর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসের নিরিখে গণতান্ত্রিক কাঠামো বিনির্মাণের এক অমিত সম্ভাবনা উপস্থাপন করে। কিন্তু ‘বাংলাদেশ বিপ্লবে’ নেতৃত্বদানকারী জাতীয় এলিটবৃন্দ অন্যান্য উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জাতীয় নেতাদের মতোই তাঁদের সামনে প্রস্তুতকৃত সহজলভ্য গণতান্ত্রিক কাঠামোর যে মডেলসমূহ রয়েছিল, সেখান থেকে একটি বেছে নিয়ে নতুন রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণ করতে উদ্যোগী হলেন। জাতীয় এলিটবৃন্দের সামনে গণতান্ত্রিক কাঠামো বিনির্মাণের যে দুটি সহজলভ্য মডেল ছিল মোটা দাগে তার একটি হলো ইউরোপীয় মডেলের গণতন্ত্র এবং আরেকটি আমেরিকান মডেলের গণতন্ত্র। এর বাইরে বাম জাতীয় এলিটবৃন্দ তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণচীনের সর্বাত্মকবাদী শাসনব্যবস্থা, যা সাধারণভাবে সমাজতান্ত্রিক মডেল হিসেবে পরিচিত ছিল, তার আলোকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণের কথা ভাবতেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ইউরো/আমেরিকান গণতান্ত্রিক এবং সর্বাত্মকবাদী (সমাজতান্ত্রিক) ব্যবস্থা—এ দুটি মডেলেরই উত্পত্তিস্থল হলো ইউরোপ; পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা এ মডেল দুটির জন্ম দিয়েছে। দুটি মডেলের প্রবক্তা এবং অনুসারীদের মধ্যে যে বিস্ময়কর সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয় তা হলো, তাঁরা মনে করেন এ দুটি মডেলই হলো বৈশ্বিক, ফলে দেশ-কালনির্বিশেষে যেকোনো রাষ্ট্রকাঠামোর জন্য এ মডেল দুটি প্রযোজ্য। তাঁরা আরও মনে করেন যে একমাত্র এ মডেল দুটির মাধ্যমেই উন্নয়ন, প্রাগ্রসরতা এবং আধুনিকতা কোনো জাতি বা রাষ্ট্র অর্জন করতে পারে, ফলে একটি জাতি বা রাষ্ট্রের পশ্চাত্পদতা/প্রাগ্রসরতা তাঁরা নিরূপণ করেন উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহ এ মডেল দুটি কতটা সফলতার সঙ্গে অনুকরণ করতে পারছে তার ওপর। এ মডেল দুটির বাইরে অন্য যেকোনো ব্যবস্থাকে তাঁরা ধরে নেন পশ্চাত্পদ এবং অনাধুনিকতা হিসেবে।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত এলিটবৃন্দ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করলেও মনোজগতে ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে তাঁরা তাদের সামনে সহজলভ্য ইউরোপীয় গণতন্ত্র এবং ইউরোপীয় সর্বাত্মক ব্যবস্থার বাইরে দেশীয় রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সমাজব্যবস্থার নিরিখে গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিনির্মাণ বা এ ধরনের কোনো ধারণা নির্মাণ করতে পারেনি। ফলে দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এর জাতীয় নেতারা পঙ্কজ মিশ্রর ভাষায়, ‘the iron cage of western interpretation categories’ থেকে নিজেদের স্বাধীন করতে পারেননি। আর পশ্চিমা বিশ্বের তৈরিকৃত ‘চিন্তার লৌহখাঁচা’ থেকে মুক্ত না হতে পারার ফল হলো, একটি দেশ স্বাধীন হলেও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো, যেটি কিনা পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে প্রাপ্ত, সেটি বিদ্যমান রেখে এবং তার সঙ্গে পাওয়া পুরো সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র বজায় রেখে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিনির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া। ঔপনিবেশিক কাঠামো এবং এর উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত আমলাতন্ত্র দিয়ে সদ্যস্বাধীন দেশে ওয়েস্টমিনস্টার টাইপে গণতন্ত্র বিনির্মাণের উদ্যোগ তাই শুরুতেই ধাক্কা খায়।

বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় এলিটবৃন্দ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাঠামোসমূহ, যেটি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী লালন করেছিলেন, সেগুলোকেই সদ্যস্বাধীন দেশের প্রেক্ষাপটে খাপ খাওয়াতে সচেষ্ট হলেন। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া কাঠামোসমূহ দীর্ঘদিনেও এ অঞ্চলের সমাজ, ঐতিহ্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। যে কাঠামোসমূহ ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে সফল হতে পারেনি, সে কাঠামোসমূহ এবং ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরতা বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক এলিটবৃন্দকে প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিট এবং আমলারা তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত কাঠামোসমূহ বজায় রেখেছেন। ফলে যে রাজনৈতিক এলিটবৃন্দ প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর স্বাধীনতার আগে বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন, অচিরেই প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর তাঁদের যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক নেতৃত্ব ছিল সেটি অপসৃত হয়। ফলে তাঁরা যে হেজিমনি প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর স্থাপন করতে পেরেছিলেন, সেটি সম্পূর্ণভাবে তাঁরা হারায়। এখানে উল্লেখ্য, তত্কালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটরা, আমরা দেখি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ঔপনিবেশিক কাঠামোসমূহকে ব্যবহার করে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সঙ্গে যুক্ত হতে, যেটি অন্যান্য কারণের সঙ্গে তাঁদের রাজনৈতিক হেজিমনি হারাতে বড় ভূমিকা পালন করে। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সূচনাপর্বেই আমরা প্রত্যক্ষ করি যে ইউরোপ কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া ঔপনিবেশিক কাঠামোসমূহ এ দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে শুধু ব্যর্থই হয়নি, গণতন্ত্রের যে মূল উপাদান জনগণকে রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, সেটি করতেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা সফলভাবে পরিচালনা করার মূল শর্ত হলো, সে ব্যবস্থার অধীন বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীকে এ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা; যদি কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা তার অধীনের জনগোষ্ঠীর ব্যাপকতম অংশকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারে বা ব্যাপক জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে নিজেদের বিযুক্ত মনে করে, সে ক্ষেত্রে এটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় এলিটবৃন্দ প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর তাঁদের যে রাজনৈতিক হেজিমনি, সেটি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে তাঁরা তাঁদের শাসনব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য ব্রিটিশ মডেলের আলোকে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, সেখান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে সোভিয়েত মডেলের আলোকে সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে উদ্যোগী হলেন। এর ফলে ঔপনিবেশিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত গণতন্ত্রের যে নিরীক্ষা সদ্যস্বাধীন দেশে শুরু হয়েছিল, তাঁর অকালমৃত্যু হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় গণতন্ত্রের অন্যতম মূল উপাদান বহুত্ববাদকে চর্চা করার যে ক্ষেত্র তৈরি করেছিল, সোভিয়েত মডেলের একদলীয় শাসন আকস্মিকভাবে তার অবসান ঘটায়। একদলীয় শাসন থেকে বাংলাদেশ দীর্ঘ সামরিক শাসনের কবলে পড়ে এবং সামরিক শাসকেরা তাঁদের শাসনক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য নানাভাবে বহুত্ববাদের চর্চা এবং বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। পাশাপাশি সামরিক শাসকেরা নানাভাবে বিভিন্ন ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী ডান সর্বাত্মকবাদী দল এবং গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিতে থাকে, যেন তাঁদের অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার প্রক্রিয়া পাকাপোক্ত হয়। সাধারণভাবে ‘ইসলামি মৌলবাদী’ বা ইসলামিস্ট হিসেবে পরিচিত এ ধরনের ডান সর্বাত্মকবাদী দল এবং গোষ্ঠীকে সামরিক শাসকেরা নানাভাবে মদদ দেওয়ার ফলে সামরিক শাসনোত্তীর্ণ সময়েও এসব দল এবং গোষ্ঠী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকে। এর অনিবার্য পরিণতিতে আজকের বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব এমন একটি মাত্রায় পৌঁছেছে, যা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তাত্পর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ভারতসহ ইউরোপ ও আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও আমরা সর্বাত্মকবাদী (বাম ও ডান) এবং ফ্যাসিবাদী দল এবং গোষ্ঠীসমূহের উপস্থিতি লক্ষ করি। তবে যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই কোনো সর্বাত্মকবাদী দল বা গোষ্ঠী যদি এ রকম প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে তারা রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়াকে উল্লেখযোগ্য হারে প্রভাবিত করতে পারে, তাহলে সে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে এ শক্তিগুলো একটি বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। ইউরোপ ও আমেরিকার ফ্যাসিবাদী এবং সর্বাত্মকবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের গোষ্ঠীগুলোর যে মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তা হলো ইউরোপ ও আমেরিকায় ওই গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অতীব প্রান্তে অবস্থান করার ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যখন ফ্যাসিস্ট সর্বাত্মকবাদী দলগুলো ইউরোপের কিছু দেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। তারা এসব দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। বাংলাদেশেও সামরিক শাসন-উত্তর গণতন্ত্রের যে নিরীক্ষা, সে নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এসব দল ও গোষ্ঠী আজ বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।

সামরিক শাসকেরা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার প্রতিবন্ধক হিসেবে ডান সর্বাত্মকবাদী শক্তিগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি তাঁদের ক্ষমতার ভিতকে পাকাপোক্ত করা এবং অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়ার নিরিখে যে জাতীয় পরিচয় এবং জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার বিপরীতমুখী জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় পরিচয়ের জন্ম দেয়। মূলত ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, যার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ধারণার জন্ম হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল, সামরিক শাসকেরা তাঁদের অবৈধ শাসনক্ষমতা বজায় রাখার জন্য সে জাতীয়তাবাদকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেছিলেন, ফলে সে জাতীয়তাবাদকে মোকাবিলা করার জন্য সামরিক শাসকেরা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিনির্মিত রূপ হিসেবে ভূখণ্ড এবং প্রচ্ছন্নভাবে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে জাতি, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় পরিচয়ের ধারণাকে বিনির্মাণ করেন।

ইউরোপ ও আমেরিকায় গণতন্ত্রের যে মডেল, সে মডেলটি গড়ে উঠেছে জাতির ধারণা এবং সে জাতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জাতিরাষ্ট্রকে ঘিরে, সেখানে একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব জনগোষ্ঠীকে একটি বৃহত্ জাতীয় পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে কল্পনা করা হয়। এতে আরও ধরে নেওয়া হয়, একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব পরিচয়ের বদলে যে রাষ্ট্রে তারা বসবাস করে, সে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া পরিচয়কেই প্রাথমিক পরিচয় হিসেবে মেনে নেবে। এ ‘বৃহত্তর’ জাতিসত্তার বিনির্মাণে ইউরোপ ও আমেরিকায় সেক্যুলার মতাদর্শ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যদিও সেখানেও কোনো রাষ্ট্রই ধর্মীয় চিহ্ন বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি, কিন্তু ঔপনিবেশিকোত্তর অনেক রাষ্ট্রে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তা হলো ইউরোপীয় মডেলের গণতন্ত্র তারা অনুসরণ করতে চাইলেও ধর্মের প্রভাব এবং ভূমিকা থেকে এসব রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো মুক্ত হতে পারেনি। তাই ঔপনিবেশিকোত্তর অনেক রাষ্ট্রই শুধু ধর্মীয় চিহ্ন বা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় এই দুই পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে। রাষ্ট্র এবং জাতীয় রাজনীতিতে সীমিত পরিসরে ধর্মের ভূমিকা গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় কি না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কোনো জাতিরাষ্ট্রে বিভাজিত জাতীয় আত্মপরিচয় থাকলে সেটি যে গণতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি হচ্ছে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ জাতীয় আত্মপরিচয়গত বিভাজনের কারণেই সামরিক শাসনোত্তর বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে আমরা প্রধান দুটি বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে যথাক্রমে বাঙালি এবং বাংলাদেশি এ দুটি জাতীয় আত্মপরিচয়কে প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বা যেকোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতে প্রত্যক্ষ করেছি, যা গণতান্ত্রিক নীতি-নৈতিকতার ন্যূনতম মানদণ্ডকেও টিকে থাকতে দেয়নি। দুটো দলেরই লক্ষ্য হচ্ছে, তাদের বিনির্মিত জাতীয় আত্মপরিচয়ের নিরিখে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে পরিচিত করে তোলা। দুটো জাতীয়তাবাদই গড়ে উঠেছে ইউরোপীয় মডিউলের আলোকে। পার্থ চ্যাটার্জি মনে করেন, সারবত্তার দিক থেকে দুটো জাতীয়তাবাদী চিন্তাই প্রাচ্যতত্ত্বের আলোকে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। দুটো জাতীয়তাবাদ প্রাচ্যতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও দুটো জাতীয়তাবাদের মধ্যে মোটা দাগে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলো ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ, যার মূল লক্ষ্য ছিল অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। মূলত তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় এলিটবৃন্দ ও পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁরা রাষ্ট্রকাঠামোয় প্রান্তীয় অবস্থানে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। সে অবস্থা থেকে উত্তরণের নিরিখে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি মুসলিম জাতীয়তাবাদকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে লড়াই পরিচালনা করার জন্য সংগ্রামে হাতিয়ারস্বরূপ ধর্মীয় পরিচয়নির্বিশেষে এ জাতীয়তাবাদ বিনির্মাণ করেছিলেন। অপরদিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বিনির্মিত হয়েছিল অবৈধ সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য, আর এ জন্য যে দ্বিজাতিতত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছিল, সে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিনির্মিত রূপ হিসেবে আমরা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দেখতে পাই যেখানে প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে এ জাতীয়তাবাদী রূপকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সারবত্তার দিক থেকে দুটো জাতীয়তাবাদী রূপকল্পই বিভক্তিমূলক বা এক্সক্লুসিভ। তাতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ কোনো জাতীয়তাবাদী প্রকল্পই একটি ভূখণ্ডের সমগ্র জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়কে আত্মস্থ করতে পারে না। এ অর্থে সব জাতীয়তাবাদী প্রকল্পই এক্সক্লুসিভ, পার্থক্য হলো শুধু মাত্রাগত। যা হোক, মর্মগতভাবে দুটি জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে দ্বান্দ্বিক। দুটি বিপরীতমুখী, দ্বান্দ্বিক জাতীয়তাবাদ সমান্তরালভাবে একটি জাতিরাষ্ট্রে বিদ্যমান থাকলে সে জাতিরাষ্ট্রের পক্ষে গণতান্ত্রিক চর্চা এবং মূল্যবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

এখানে এ কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজম—এ ধারণাগুলোর জন্ম হয়েছিল এক্সক্লুসিভলি পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায়। এ প্রত্যয়গুলো যখন উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোসমূহে আমদানি করে হুবহু প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয়েছে, তখন কাঙ্ক্ষিত যে আকাঙ্ক্ষা থেকে এ ধারণাগুলো প্রয়োগ করা হয়েছে যে, এ রাষ্ট্রগুলোও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মতো হবে, বাস্তবে তা না হয়ে পঙ্কজ মিশ্রর ভাষায় একধরনের ‘Quasi Hybrid Political Forms’-এর জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের রাষ্ট্রকাঠামোসমূহ ইউরোপ এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলোর রাজনৈতিক বাস্তবতার কোনোটাকেই পুরোপুরি ধারণ না করে কিছু ইউরোপীয় উপাদান এবং কিছু ঔপনিবেশিকোত্তর রাষ্ট্রগুলোর বাস্তবতাকে ধারণ করেছে, কিন্তু এ হাইব্রিড মডেল কোনোভাবেই ঔপনিবেশিকোত্তর রাষ্ট্রগুলোর সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারছে না, আর এটিই হলো এসব রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সংকট। বর্তমান আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রও এ সংকট থেকে মুক্ত নয়। আর এ মুক্ত না হওয়ার ফলে আমরা যখন প্রতিনিধিত্বশীলতাকে গণতন্ত্রের অন্যতম একটি মূল উপাদান ধরি, বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বশীলতার একটি ভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই, যেটি ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইউরোপীয় গণতন্ত্রে সাধারণত যাঁরা ক্ষমতার বাইরে থাকেন তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত মনে করেন না, কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এর বিপরীত চিত্র প্রত্যক্ষ করি। এখানে একটি জাতীয়তাবাদকে সমর্থনকারী রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন অপর জাতীয়তাবাদকে সমর্থনকারী রাজনৈতিক দল এবং এর অনুসারীরা নিজেদের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত মনে করেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা সচেষ্ট থাকে অপর রাজনৈতিক দল এবং এর সমর্থকদের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে যতটা সম্ভব বিযুক্ত রাখা যায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, একটি বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সব সময় বিযুক্ত মনে করেছে। এ বিযুক্ততা যে শুধু দুটো জাতীয়তাবাদ বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয়, এর বাইরে রাষ্ট্র ও সমাজে যারা অর্থনৈতিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় বা ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়কে ধারণ করে, যারা ।রাষ্ট্র ও সমাজের প্রান্তে অবস্থান করে তারাও নিজেদের বিযুক্ত ভেবে এসেছে। ফলে আমরা দেখি, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক মডেল থেকে প্রাপ্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে যারা প্রান্তীয় অবস্থানে অবস্থান করছে, অর্থাত্ দরিদ্র জনগোষ্ঠী—দরিদ্র এবং হতদরিদ্র মিলে বাংলাদেশে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ—নিম্নমধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র নারী, সনাতন ধর্ম এবং ইসলাম ভিন্ন অন্যান্য ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত ধর্মাবলম্বীরা, আদিবাসী এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তায় পরিচিত জাতিগোষ্ঠীগুলো সব সময়ই নিজেদের কম-বেশি এ গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বিযুক্ত ভেবে এসেছে।

ওপরের আলোচনা থেকে যে বিষয়টা স্পষ্ট তা হলো ঔপনিবেশিকতা সূত্রে প্রাপ্ত ইউরোপীয় গণতন্ত্রের যে চর্চা বাংলাদেশ করে আসছে, তা এ দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যেমন নিশ্চিত করতে পারেনি, পাশাপাশি জাতি-জাতীয়তাবাদসংক্রান্ত দুটো সমান্তরাল দ্বান্দ্বিক রূপকল্প তৈরি করেছে, যা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, এ ধরনের গণতন্ত্রের নিরীক্ষা নানাবিধ কারণে ডান সর্বাত্মকবাদী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করলেও আদর্শগতভাবে গণতান্ত্রিক ধারণা এবং চর্চার বিরোধী। কেননা গণতান্ত্রিক ধারণা যে দুটি মৌল আদর্শ বহুত্ববাদ ও সেক্যুলার মতাদর্শের (এ দুটো আবার একে অন্যের পরিপূরক, ফলে একটির অনুপস্থিতি অপরটিকে নিশ্চিত করতে পারে না) ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, এ দুটো মৌল আদর্শেরই তারা বিরোধী।

ধর্মনিরপেক্ষতা

ঔপনিবেশিকোত্তর রাষ্ট্রকাঠামোর ইউরোপীয় ধারণাগুলোর হুবহু প্রতিস্থাপন কী সংকট তৈরি করতে পারে, তার আরেকটি উদাহরণ হলো সংবিধানে সেক্যুলার প্রত্যয়টির বাংলা ধর্মনিরপেক্ষ করা। সেক্যুলার শব্দটি ইউরোপীয় হওয়াতে তার প্রত্যয়গত অর্থ আপামর জনগোষ্ঠীর কাছে বোধগম্য হয়নি। কেননা দেশের জনগোষ্ঠীর খুব অল্প অংশই সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুদের ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। ফলে বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী এলিটরা ইউরোপীয় কমিউনিস্ট, কমিউনিজম, কমরেড, বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত ইত্যাদি প্রত্যয়সমূহকে সৃজনশীলভাবে ভাষান্তর করতে পারেননি, যার ফলে আপামর জনগোষ্ঠী তো বটেই, বাম রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক সংখ্যক কর্মীর মধ্যেও এ প্রত্যয়গুলোর আভিধানিক অর্থ অজ্ঞাত থেকেছে। তেমনি সেক্যুলার শব্দটি বিদেশি শব্দ বলে প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর কাছে বোধগম্য না হওয়াতে, ডান সর্বাত্মকবাদী গোষ্ঠীগুলো এটিকে নাস্তিকতার সমার্থক হিসেবে প্রচার করতে সমর্থ হয়েছে। পাশাপাশি সেক্যুলার শব্দের বঙ্গানুবাদ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ করার ফলে তারা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল করাতে সমর্থ হয়েছে যে এ প্রত্যয়টি প্রকারান্তরে নাস্তিকতা প্রত্যয়টির সমার্থক। এর পাশাপাশি যে প্রশ্নটি দাঁড়ায় তা হলো সেক্যুলার শব্দের বাংলা প্রত্যয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্র ধারণ করলে অর্থাত্ রাষ্ট্র যদি সব ধর্ম বা ধর্মীয় বিষয় থেকে নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে কি রাষ্ট্রের অন্তর্গত ধর্মীয়ভাবে যারা মূলধারার ধর্ম পালন করেন না তাঁদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক সম-অধিকার সে রাষ্ট্রের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব? ধর্মনিরপেক্ষ বলা হলে আপনা-আপনি ধর্মীয় যেকোনো বিষয় থেকে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে, এ ধারণা চলে আসে। ফলে প্রত্যয়গতভাবেই একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারীরা যখন অন্য ধর্মের অনুসারীদের দ্বারা নির্যাতিত হয় তখন কি ‘নিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের পক্ষে নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব বা নির্যাতনের কারণগুলো রোধ করা সম্ভব? তাহলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ না হয়ে সেক্যুলারের ভাষান্তর ‘ধর্মসহিষ্ণু’ হলে এর অর্থ হয়তো বৃহত্ জনগোষ্ঠীর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতো এবং তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুসৃত ধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম এবং ধর্মসংক্রান্ত নানা মতবাদ চর্চার নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারত।

বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় এলিটরা ইউরোপীয় সেক্যুলারিজমের ভিত্তিতে নিজেদের হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে পারার ব্যর্থতার ফলে, পরবর্তী সময়ে অবৈধ সামরিক শাসকেরা তাঁদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দানের পদ্ধতি হিসেবে সেক্যুলার ধারণাকে সংবিধান থেকে প্রতিস্থাপন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুসৃত ধর্ম বিশ্বাসের (ইসলামের) প্রতি আনুগত্যের ধারণাকে পুনঃস্থাপন করেন। বস্তুত এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সেক্যুলার, ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মসহিষ্ণু সব চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকের চরিত্র লাভ করে। ক্রমান্বয়ে অবৈধ সামরিক শাসকদের অধীনে রাষ্ট্র এ চরিত্রটিকে আরও স্পষ্ট করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার মাধ্যমে। রাষ্ট্রকে ধর্মীয় চরিত্র দেওয়ার ধারণাটি বাংলাদেশের নিজস্ব অঞ্চলে উদ্ভূত ধারণা নয়, এটি বাংলাদেশের অবৈধ সামরিক শাসক দেশটির সাবেক অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ পাকিস্তান থেকে ধার করেছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অবশিষ্ট পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালে তাঁর ব্যর্থ নেতৃত্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্য বিতর্কের মোড় অন্যদিকে ঘোরানোর নিমিত্তে ১৯৭৩ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার মাধ্যমে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিকে রূপান্তর করে।১০ যা হোক, পরবর্তী সময়ে সেক্যুলার নেতৃত্বের দাবিদার রাজনৈতিক এলিটরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলেও সেক্যুলার মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের ওপর তাঁদের রাজনৈতিক হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে না পারার ফলে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বজায় রেখে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা পুনঃস্থাপন করেন। এ বিপরীতমুখী চিন্তার সহাবস্থানের ফলে বাংলাদেশের সংবিধান এক বিশেষ সংশ্লেষিত রূপ লাভ করেছে। এ বিশেষ সংশ্লেষিত সংবিধানে  যারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মপালন করে না, তাদের ধর্মীয় এবং এর পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম-অধিকার পালনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে কি না, সে তাত্ত্বিক প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

উপসংহার

ভারত ইউরোপীয় গণতন্ত্র হুবহু ইউরোপীয় আদলে অনুশীলন করতে না পারার জন্য পেরি অ্যান্ডারসন এর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ঔপনিবেশিকতা সূত্র থেকে প্রাপ্ত গণতন্ত্র উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোয় কীভাবে হুবহু ইউরোপীয় আদলে খাপ খাবে তা আলোচনা করেননি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা ঔপনিবেশিকতার সূত্রে প্রাপ্ত গণতন্ত্রকে উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোয় খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করার ফলে এর নানাবিধ সংকট দেখি। আর এ সংকটের ফলে এ গণতন্ত্র একদিকে যেমন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারেনি, তেমনি পাশাপাশি জন্ম দিয়েছে বিভাজিত জাতীয়তাবাদ, যা কিনা সার্বিকভাবে গণতন্ত্রকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। গণতন্ত্রের নিরীক্ষার প্রক্রিয়া আরও জন্ম দিয়েছে শক্তিশালী গণসর্বাত্মকবাদী দল ও গোষ্ঠীগুলোর, যারা উল্লেখযোগ্যভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে সক্ষম এবং সারবত্তার দিক থেকে এসব দল ও গোষ্ঠী সেক্যুলার মতাদর্শ এবং গণতান্ত্রিক ধারণারই বিরোধী। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের যে নিরীক্ষা, সে নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবও একটি বড় প্রতিবন্ধক। বস্তুত ইউরোপীয় গণতন্ত্রের নিরীক্ষা বাংলাদেশে গণতন্ত্রবিরোধী যেসব উপাদানের জন্ম দিয়েছে বা সংকট তৈরি করেছে, সেগুলো বাংলাদেশের জাতীয় এলিটরা কতটা সৃজনশীলভাবে বাংলাদেশের বাস্তবতা মাথায় রেখে মোকাবিলা করতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার ভবিষ্যত্।

তথ্যসূত্র

১. Perry Anderson, The Indian Ideology (Vl: Verson, 2013), Three Essays Collective, 2012.

২. অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের ধারণার জন্য দেখুন, Pablo Gonzalez Cosonova, ‘Internal Colonialism and National Development,’ Studies in Comparative International Development, Vol. 1, No 4, 1965, pp 27-37.

৩. তালুকদার মনিরুজ্জামান বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিকে বাংলাদেশ বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন। দেখুন, Talukdar Moniruzzamn, The Bangladesh Revolution and Its Aftermath (Dhaka: University Press Ltd., 1980).

৪. মনোজগতে উপনিবেশবাদের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, Ashis Nandy, The Intimate Enemy: Loss and Recovery of Self under Colonialism (Delhi: Oxford University Press, 1988). 

৫. Pankoj Mishra, ‘India and Ideology: Why Western Thinkers Struggle with the Subcontinent,’ Foreign Affairs, Vol. 92, No. 6, 2013, p 146

৬. এখানে হেজিমনি বলতে আন্তোনিও গ্রামসি যে সাংস্কৃতিক হেজিমনির কথা বলেছেন তা বলা হচ্ছে। এ প্রবন্ধে হেজিমনির ধারণা গ্রামসির হেজিমনির তত্ত্বের আলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। হেজিমনি সংক্রান্ত বিস্তারিত ধারণার জন্য দেখুন: K. J. Holsti, The Dividing Discipline, Hegemony and Diversity in International Theory, (UK: Harper Collins Publishers Ltd; 1985).

৭. Partha Chatterjee, Empire and Nation, (New York: Columbia University Press, 2001), p. 42.

৮. দেখুন Mishra, পূর্বোক্ত p. ১৪৭.

৯. এখানে উল্লেখ্য যে নিবন্ধের লেখক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং জেলা পর্যায়ের নেতাদের এ প্রত্যয়গুলোর অর্থ জিজ্ঞাসা করলে কেউই লেখককে এর প্রত্যয়সমূহের অর্থ বলতে পারেননি।

১০. এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করা হলেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এর দ্বারা যারা শুধু সুন্নি ইসলামের বিভিন্ন ধারার অনুসারী শুধু তাদের স্বার্থ ও পরিচয় রাষ্ট্র বহন করবে এটি প্রচ্ছন্নভাবে বিধৃত হয়েছে। ফলে পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ শতাংশ শিয়া ইসলামের অনুসারী হওয়ায় তারা শুধু নিজেদের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বিযুক্তই ভাবেনি, পাশাপাশি বিভিন্ন সময় তারা রাষ্ট্র এবং নানা সুন্নি সংগঠন কর্তৃক নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হলেও রাষ্ট্রকে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। একই সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্র আহমদিয়া জামাত এবং যারা ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করেন না তাঁদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় কখনো অপারগ এবং কখনো ব্যর্থ হয়েছে। কম-বেশি বাংলদেশেও আমরা একই চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি।