বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

১৯৭১: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ —শ্রীনাথ রাঘবন
(নিউ দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্লাক, ২০১৩), আইএসবিএন ৮১-৭৮২৪-৩৮০-৬


শ্রীনাথ রাঘবনের ১৯৭১: এ গ্লোবাল  হিস্ট্রি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ গ্রন্থটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গভীর ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা প্রদান করে। পূর্বকথন এবং এপিলগ ছাড়া বইটিতে ১০টি অধ্যায় রয়েছে। তাঁর এ গবেষণাগ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিরাজমান ইতিহাসতত্ত্বকে সমালোচনা করেছেন।

রাঘবন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেশ বিভাগ-পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো এ রকম খুব কমসংখ্যক যুদ্ধেরই এমন বৈশ্বিক গুরুত্ব রয়েছে। এর প্রথম গুরুত্ব হলো এটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মতো একটি বড় ও জনবহুল দেশ সৃষ্টি করেছে।

পেশাদার এবং অপেশাদার ইতিহাসবিদসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ইতিহাসবিদই নিজেদের যুক্ত করেছেন আবেগের সঙ্গে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ সন্ধান করেছেন নিতান্তই কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: কে ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা? আবার বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের কিছু কিছু সামরিক অফিসার তাঁদের মতো করে যুদ্ধের স্মৃতিকথা ও বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন। অনেকে এসব স্মৃতিকথাকেই ইতিহাস ভেবে থাকেন। এটা ঠিক, যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব ব্যক্তির স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস লেখায় গুরুত্বপূর্ণ উত্স হতে পারে। এসব স্মৃতি এমনকি অনেক সময় ইতিহাস রচনায় নিয়ামক ভূমিকা রাখতে পারে। সংঘর্ষ বা সাংঘর্ষিক অঞ্চল বা যুদ্ধের ইতিহাস রচনা ইতিহাসবিদদের জন্য খুব একটা সহজ কাজ নয়। সংঘর্ষ বা যুদ্ধের কারণে ইতিহাস রচনার প্রথাগত এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উত্স, আর্কাইভসের লিখিত দলিল-দস্তাবেজ পাওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। ইতিহাসবিদদের তাই অন্যান্য উেসর ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে এসব উত্স ব্যবহার করায় ঝুঁকি রয়েছে। যুদ্ধের এসব স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে নিজস্ব ধ্যানধারণা, আত্মপক্ষ সমর্থন ও ঘটনা আড়াল করার প্রবণতা থাকতে পারে ও আছে।

সম্প্রতি কিছু কিছু ইতিহাসবিদ মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস সন্ধানে সচেষ্ট হয়েছেন। তবে যাঁরা এসব ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন, তাঁরাও গতানুগতিক ঘটনা বর্ণনা থেকে বেরোতে পারেননি। আঞ্চলিক যোদ্ধাদের জাতীয় ইতিহাসে স্থাপন করার কোনো প্রচেষ্টা তাঁরা নেননি বা এটি কীভাবে করতে হয় সে পদ্ধতি তাঁদের জানা নেই। তাঁদের ইতিহাস শুধু ঘটনার বয়ান। যুক্তি, তর্ক ও বিশ্লেষণের জায়গা সেখানে নেই। তাঁদের ইতিহাস রচনার উত্সও একপক্ষীয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যাঁরা লড়েছিলেন, শুধু তাঁদের সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে এ ইতিহাস রচিত। এককথায় বলতে গেলে এটি কথ্য ইতিহাস এবং একপক্ষীয় কথ্য ইতিহাস। যুদ্ধে জড়িত অন্য পক্ষের কণ্ঠ সেখানে নেই বা ইতিহাসের কোনো দালিলিক প্রমাণ দ্বারা তা যাচাই করা হয় না। এটা ঠিক, যুদ্ধকালীন দালিলিক প্রমাণ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।

 এসব সাধারণ প্রবণতার বাইরে এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অন্য আলোয় দেখতে চেষ্টা করেছেন বদরুদ্দীন উমর। দুই খণ্ডে রচিত The Emergence of Bangladesh গ্রন্থে এ অঞ্চলে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে শ্রমিক ও কৃষকের অংশগ্রহণ দেখিয়েছেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট চমত্কারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। বদরুদ্দীন উমর ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সময়কালকে দেখেছেন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেণিসংগ্রাম হিসেবে। এ অংশে তিনি বিভিন্ন মিল-কারখানা ও ট্রেড ইউনিয়ন এবং কৃষকসংগ্রামের কথা লিখেছেন। গ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি আলোচনা করেছেন ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে। এ সময়কালকে তিনি চিহ্নিত করেছেন জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে। উমর তাঁর এ গ্রন্থে বিভিন্ন প্রকার মৌলিক উত্স ও নিজের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছেন। তবে গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো লেখক প্রধানত একজন রাজনীতিবিদ হওয়ায় কোনো কোনো ঘটনা নির্মোহ বিশ্লেষণের চেয়ে নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করতে গিয়ে পদ্ধতিগত ইতিহাস চর্চা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন।

বাংলাদেশের নাগরিক নন, এমন কিছু ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিকও বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন পদ্ধতিগতভাবে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিগত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করতে। আবার কেউ কেউ একপক্ষীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পদ্ধতিগতভাবে ভুল ইতিহাস রচনা করেছেন। এর অন্যতম উদাহরণ শর্মিলা বোসের দ্য ডেড রেকনিং।

এ পর্যন্ত রচিত বেশির ভাগ ইতিহাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে একটি বছর, অর্থাত্ ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির মধ্যে। যেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে কেবল ১৯৭১ সালের নয় মাসের যুদ্ধের ফলেই। আর কিছু কিছু ইতিহাসবিদ রয়েছেন, যাঁরা গতানুগতিকভাবে ঘটনাপরম্পরাকে যুক্ত করেছেন। এ পর্যন্ত বেশির ভাগ ইতিহাবিদই ব্যর্থ হয়েছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনের রাজনৈতিক কারণ ব্যাখ্যা করতে: কী কারণে, কী পরিস্থিতিতে, কখন থেকে এ অঞ্চলের মানুষ একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এবং কারাই বা প্রথম স্বপ্ন দেখা শুরু করেন।  ভারতীয় উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগির সমীকরণে বড় উপমহাদেশটি বিভক্ত হয়ে যায় দুটি দেশে: ভারত ও পাকিস্তান।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত প্রায় সব ইতিহাসেই কৃষক-শ্রমজীবী মানুষ উপেক্ষিত হয়েছে। পূর্ববাংলার কৃষকেরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তো বটেই, উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেও তাঁদের অধিকার ও দাবি আদায়ের আন্দোলনে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৪০-এর দশক থেকে পূর্ববঙ্গ আলোড়িত ছিল টঙ্ক, তেভাগা ও নানকার বিদ্রোহের মতো শক্তিশালী বিদ্রোহে। ইতিহাসবিদ এড্রিয়েন কুপার তাঁর গবেষণাগ্রন্থ Sharecropping and sharecroppers’ Struggle in Bengal-এ দেখিয়েছেন কীভাবে প্রায় ২০ বছর ভাগচাষিরা অবিশ্রাম লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন জমিদার, জোতদার এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে।

পাকিস্তান আন্দোলনের কারণে কৃষক সংগ্রাম সাময়িক সময়ের জন্য ম্লান হয়ে গেলেও তা একেবারে থেমে যায়নি। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন কাঠামোয় তা চলতে থাকে। কৃষক এবং নিম্নবর্গের মানুষেরা উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেও পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। শোষিত কৃষকেরা মনে করেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্র হবে তাঁদের প্রত্যাশিত রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে হিন্দু জমিদার-জোতদারদের শোষণ থেকে তাঁরা মুক্তি পাবেন। কিন্তু এ প্রত্যাশার মোহভঙ্গ ঘটতে তাঁদের বেশি দেরি হয়নি। তাজুল ইসলাম হাশমী তাঁর Peasant Utopia: The Communalization of Class Politics in East Bengal 1927, 1974 গ্রন্থে পূর্ববঙ্গের কৃষকদের চৈতন্যের একটি দিককে পিজেন্ট ইউটোপিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম এবং উচ্চবর্গের রাজনৈতিক সমাবেশে কৃষক ও শ্রমিকেরা অংশ নিতেন। যুক্তফ্রন্ট, আওয়ামী লীগ এসব দলের সঙ্গে মিশেও তাঁরা তাঁদের দাবি-দাওয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পেয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম হলেও কৃষক ও শ্রমিক তাদের কল্পিত রাষ্ট্রের দেখা পাননি। তাঁদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বভাবতই তাঁদের আশাভঙ্গ হতে থাকে, যে মুসলিম লিগ ঔপনিবেশিক ভারতের শেষ নির্বাচনে বাংলায় বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েছিল, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ১৯৫৪ সালে দলের ভরাডুবি ঘটে। এরপর মুসলিম লিগ বাংলায় আর মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারেনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক সবাই ভোটাধিকার পেয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগই তখন ছিলেন কৃষক। কৃষকেরা তাঁদের মোহভঙ্গের প্রথম প্রতিশোধ নিলেন ১৯৫৪ সালে মুসলিম লিগের কবর রচনা করে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কৃষক ও শ্রমিকদের যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আরেকটি কারণও ছিল। কৃষকদের সমাবেশে যুক্ত করতে তাঁদের অনেক দাবি-দাওয়াই তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করতে হয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৬ সালের ছয় দফার ক্ষেত্রেও। রাজনীতিকেরা তখন বুঝেছিলেন, কৃষক-শ্রমিক অন্য কথায় নিম্নবর্গের মানুষেরাই শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে বড় শক্তি ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, কৃষক, শ্রমিক এবং নিম্নবর্গের মানুষেরা ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কখনো স্বতন্ত্রভাবে আবার কখনো উচ্চবর্গের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কালে টেক্সটাইল, সিমেন্ট, ডক ও অন্য শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি আদায়ের সংগ্রামে মুখর ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এসব নিম্নবর্গের মানুষের কণ্ঠ খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রাম ইতিহাসে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিম্নবর্গের মানুষের চৈতন্য ও অবদানের কথা লিখেছেন।

রাঘবনের ১৯৭১: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ গ্রন্থটি এই প্রথম কোনো বিদেশি ইতিহাসবিদের লিখিত ইতিহাসসম্মত গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ করে লিখিত পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ উত্স ব্যবহার করেছেন। রাঘবনের মতে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত বেশির ভাগ ইতিহাসই অসম্পৃক্ত নয়। তবে দু-একটি ইতিহাসকর্ম যে এই দোষ উত্তীর্ণ হতে পারেনি, তা নয়। এ ক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ হলো রিচার্ড সিশন এবং লিও রোজেসের War and Secession। গ্রন্থটিতে লেখকেরা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে একটি চমত্কার ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ ইতিহাস উপস্থাপন করেছেন।

সিশন তাঁদের বইটি প্রকাশ করার পর গত ২০ বছরে যুদ্ধ-সংক্রান্ত অনেক দলিল প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু কোনো ইতিহাসবিদই এসব দলিল-দস্তাবেজের পূর্ণ ব্যবহার করতে পারেননি। রাঘবনের মতে, এর একটি কারণ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার পেশাদার ইতিহাসবিদেরা ১৯৪৭ সালের পরের ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ দেখাননি। এ ছাড়া দুই দশক ধরে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাস দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এর ফলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইতিহাস উপেক্ষিত হয়েছে। এটা আশ্চর্যের বিষয় নয়, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে দেখতে চেষ্টা করেছেন স্মৃতি, সংঘর্ষ এবং আইডেনটিটি বা পরিচয়ের দিক থেকে (পৃ. ৫)।

রাঘবনের মতে, এখনো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন নতুন অনেক কাজ হচ্ছে কিন্তু এই নতুন গবেষণা পুরোনো গবেষণার মূল বর্ণনাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারেনি। বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে যা লেখালেখি হয়েছে, সেগুলোর প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একপক্ষীয় এবং আদিষ্টবাদ বা ডিটারমিনিজম। বেশির ভাগ বই লেখা হয়েছে একটি পক্ষকে সমর্থন করে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয়তাবাদী প্রভাব। এভাবে যেসব বই পাকিস্তানি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা হয়েছে, তাতে যুদ্ধকে দেখা হয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাজ হিসেবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের আবসভূমি পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে। এসব বইয়ে বাঙালিদের  উপস্থাপন করা হয়েছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে (পৃ. ৫)।

অন্যদিকে, রাঘবনের মতে বাংলাদেশিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছে, তাতে যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির লড়াই হিসেবে দেখা হয়েছে। এসব গ্রন্থে গল্প বলা হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ উদ্ভব ও বিকাশের। বেশির ভাগ ভারতীয় গ্রন্থে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে দেখা হয় তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে। এই গ্রন্থগুলোর মতে, যুদ্ধে ভারতীয় বিজয় শুধু পাকিস্তান ভেঙে টুকরোই করেনি, বরং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে যে আদর্শিক মন্ত্র ছিল তাও এ যুদ্ধ ভেঙে খান খান করে দেওয়া হয়। এসব গ্রন্থের বয়ানগুলোই যে শুধু সমস্যাপূর্ণই তা নয়। এসব গ্রন্থে লেখকেরা যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাবের কথা বলতে গেলে বিবেচনাই করেননি। এমনকি সবচেয়ে ভালো যে কাজ, সিশন ও রোসের বইতেও, যুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রভাবকে খাটো করে দেখা হয়েছে (পৃ. ৬)।

বিভিন্ন বিষয়ে মতের পার্থক্য থাকলেও এসব গ্রন্থে একটি ধারণা পোষণ করা হয়ে থাকে: পাকিস্তানের ভাঙন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ঘটনাকে দেখা হয় নিয়তি হিসেবে। সালমান রুশদীর উপন্যাস সেইম-এ নিয়তি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বদরুদ্দীন উমরও এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরোতে পারেননি। উমরের মতে, পাকিস্তানের শুরু থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল অস্থিতিশীল। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব এবং দুই অংশের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক জীবন ও ঐতিহ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল উল্লেখ করার মতো। এসব ব্যাপার শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক গন্তব্য খুঁজে নিয়েছিল, যা যৌক্তিক এবং অপরিহার্যভাবেই পাকিস্তান ভাঙার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। একইভাবে আনাতল লিয়েভেনের মতে, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একেবারে আলাদা এবং এক হাজার মাইল শত্রু রাষ্ট্র ভারত দ্বারা খণ্ডিত দুটি ডানা হিসেবে হয়তো বেশি দিনই টিকে ছিল। এমনকি যেসব পণ্ডিত সরাসরি এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেন না, তাঁরাও কোনো না কোনোভাবে বলতে চেয়েছেন যে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোই ছিল এমন যে এটি ভেঙে যাবে। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম অনেকটা এ রকম হয়ে যায় যে এটি ঘটনাপঞ্জি এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা ইতিহাস (পৃ. ৬)।

এটা ঠিক, পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ছাড়াও অনেক ভিন্নতা ছিল। প্রথমেই আসে ভাষার প্রশ্ন। শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা এবং মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি বাংলা ভাষাকে একটি অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ দাবিকে মেনে নিতে তীব্র অনীহা প্রকাশ করে।

দ্বিতীয় এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অর্থনৈতিক প্রশ্ন। দেশ বিভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলার অন্যান্য অঞ্চল এবং আসামের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উল্লেখ্য, দেশ বিভাগের আগে পূর্ব বাংলার সঙ্গে বাংলার অন্যান্য অংশ এবং আসামের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক যোগাযোগ ছিল। পূর্ব বাংলার অন্যতম অর্থনৈতিক ফসল ছিল পাট এবং একসময় এই পাটই ছিল এখানকার কৃষকশ্রেণি এবং উঠতি মধ্য শ্রেণির জীবন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে অপরিহার্যভাবে জড়িত। পাটের মাধ্যমেই বাংলার, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার অর্থনীতি যুক্ত হয়েছিল বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে। দেশ বিভাগ যে সমস্যা তৈরি করেছিল তা আরও গুরুতর হয় পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে। এখন পূর্ব পাকিস্তানে উত্পাদিত প্রধান বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য পাটের মাধ্যমে যে বৈদেশিক অর্থ আয় হতো, তা ব্যবহার করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়নের জন্য। এ ছাড়া দেশ বিভাগ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান যেসব বৈদেশিক সাহায্য পেত, তার বেশির ভাগ অংশই পাচার করা হতো পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে। এমনকি ১৯৫০-এর দশকে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছিল, তখনো পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল বিস্তর। পূর্ব পাকিস্তানের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার যদিও ১৯৫৪-৫৫ থেকে ১৯৫৯-৬০ সালে ১ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ১৯৫৯-৬০ থেকে ১৯৬৪-৬৫ সালে ৫ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল, কিন্তু তা পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ থেকে ছিল অনেক কম। একই সময়ে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ২ শতাংশ (পৃ. ৭)।

একটি যুক্তি অনেকেই দিয়ে থাকেন যে পাকিস্তানের ভাগ্য নিদেনপক্ষে ১৯৫০ দশকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এই যুক্তি আসলে বাঙালি রাজনীতিবিদদের যুক্ত পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে থাকার যে প্রচেষ্টা ছিল, তাকে খাটো করে দেখে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দাবিদাওয়া, অধিকার উত্থাপনের মাধ্যমে বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা চেষ্টা করেছিলেন ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে কাজ করে যেতে। পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যার হার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশি হওয়ায় জাতীয় রাজনৈতিক পর্যায়ে/কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দ্বারা তাঁরা প্রথমে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো—‘কখন এবং কেন বাঙালিরা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে’ এ প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল (পৃ. ৮)।

পাকিস্তান ভাঙার অনিবার্যতা তত্ত্বের বিপরীতে গিয়ে এই বইয়ে বলতে চেষ্টা করা হয়েছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম কোনো অনিবার্য ঘটনা ছিল না। বাংলাদেশের জন্ম আগে থেকে ঠিক করা কোনো বিষয় তো ছিলই না, বরং এটি হলো বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটা একটি ঘটনা। পাকিস্তান কেন তার আধিপত্য ও কর্তৃত্ব হারাল তা বোঝতে হলে আমাদের আরও সংক্ষিপ্ত সময় অর্থাত্ ১৯৬০-এর দশকের শেষ সময়ের ওপর দৃষ্টি দিতে হবে। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন একটি আপসহীন দাবি হিসেবে জোরালো হয়ে ওঠে। সামরিক সরকার নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করছিল। তারপরও রাজনৈতিক সমাধান না হলেও খুব সহজেই পাকিস্তান ভেঙে যায়নি। এই বইয়ে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় যুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশের বিজয় কোনো নির্ধারিত বিষয় ছিল না বরং এই যুদ্ধে অনেক অপ্রত্যাশিত বাঁক পরিবর্তন হয়েছে (পৃ. ৮)। লেখক বলতে চেষ্টা করেছেন, পাকিস্তানের ভাঙন শুধু বোঝা যাবে এই ঘটনাগুলোকে বৈশ্বিক পরিসরে স্থাপন করে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও রাজনীতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

১৯৬০-এর এবং ১৯৭০-এর দশকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট তিনটি বড় ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া দ্বারা গঠিত। সবগুলোই একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের ব্যুপনিবেশায়ন, যা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় এটি গতির সঞ্চার করেছিল। তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব বিশ্বের ভূগোল উল্টে দিয়েছিল। তা ছাড়া ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে সংকট আঁচ করা যায়। ঔপনিবেশিক একনায়কতন্ত্রের (authoritarian) উত্তরাধিকার, নতুন শাসকশ্রেণির দুর্নীতি এবং অদক্ষতার ফলে এশিয়া এবং আফ্রিকায় একের পর এক স্বৈরাচারী সামরিক শাসকের আবির্ভাব হয়েছে।

এরপর রয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ, যা ইউরোপে শুরু হয়েছিল আদর্শগত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি নিরাপত্তা প্রতিযোগিতা হিসেবে। এই স্নায়ুযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থক সহযোগী রাষ্ট্রগুলোও ছিল।

এবার নির্দিষ্টভাবে দৃষ্টি দেওয়া যাক বইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের ওপর। প্রথম অধ্যায়ে, অধ্যায়ের শিরোনাম ‘টার্নিং পয়েন্ট’, লেখক আলোচনা করেছেন ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে। লেখকের মতে, ১৯৬৮ সালে ছাত্র-আন্দোলন সারা বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল। বিশ্বজুড়েই শুরু হয়েছিল ছাত্র-আন্দোলন। বিশ্বের প্রায় ২০টিরও বেশি দেশ ছাত্র-আন্দোলন দ্বারা আন্দোলিত হয়েছিল: উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপ, চীন এবং পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব এবং পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা, কোনো দেশই ছাত্র-আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারেনি। ১৯৬৮-এর ছাত্র-আন্দোলন সদ্য শুরু হওয়া বিশ্বায়নের প্রভাব এবং প্রতিফলন বলা যায়। এ ছাড়া অন্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যেমন, ষাটের দশকে স্নায়ুযুদ্ধ এবং ব্যু-পনিবেশায়ন প্রক্রিয়াও এসব আন্দোলন প্রভাবিত করেছে বলে লেখক মনে করেন। পাকিস্তানে সে সময় যে আন্দোলন চলছিল তার রূপ এবং প্রকৃতি অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বের অন্যান্য জায়গার সমসাময়িক আন্দোলনের সঙ্গে মিলে যায় বলে লেখক মনে করেন (পৃ.১৪-৩৩)।

 রাঘবনের মতে, ছাত্র-আন্দোলনের মূল কারণ ছিল পঞ্চাশ এবং ষাটের এ দুই দশকে উচ্চশিক্ষার প্রসার। বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল এ সময়ে। উদাহরণ হিসেবে লেখক টেনেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। ১৯৬৮ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫০ হাজার, যাদের মধ্যে সাত হাজার শিক্ষার্থীই থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে লেখক বলছেন, পূর্ববর্তী শিক্ষা আন্দোলন, যা থেকে ১৯৬৮ সালের আন্দোলন প্রেরণা নিয়েছিল। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান গঠিত শিক্ষা কমিশন যখন স্নাতক শিক্ষাকে দুই বছর থেকে তিন বছর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছাত্ররা তখন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষার্থীরা ভেবেছিলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত শুধু চাকরিতে ঢোকার ক্ষেত্রেই তাঁদের দেরি করিয়ে দেবে না বরং তাদের ভবিষ্যত্ সম্ভাবনাকেও মাটি করে দেবে (পৃ. ১৫-১৬)।

১৯৬৮ সালের ব্যাপক বিক্ষোভের তৃতীয় যে কারণটির কথা লেখক বলছেন তা হলো অর্থনৈতিক। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পশ্চিম ইউরোপ, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিপতিরা বেশ পুঁজির মুখ দেখেছিল। পাকিস্তানেও আইয়ুব খানের অধীনে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। তবে এ উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করেছিল ছোট বেসরকারি খাত। এটি অপরিকল্পিত কোনো ফলাফল ছিল না: আইয়ুব খানের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজানো ও বাস্তবায়ন করা হয়েছিল পশ্চিমা সহযোগিতায় এবং এর উদ্দেশ্য ছিল বুর্জোয়াদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৮ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯ দশমিক ৩৩ মিলিয়নে দাঁড়ায়। পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ যখন আবিষ্কার করলেন যে দেশের ৬৬ শতাংশ শিল্পসম্পদ এবং ৮৭ শতাংশ ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স নিয়ন্ত্রিত হয় শুধু ২২ পরিবার দ্বারা, তখনই এ বিষয়ে জনসচেতনতা এবং অসন্তোষ তৈরি হয়। সে সময় ছাত্র-আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘২২ পরিবার’ (পৃ. ১৬)।

চতুর্থত, অন্যান্য জায়গার মতো প্রজন্মপরম্পরায় আন্দোলনের মাত্রা পরিবর্তিত হয়েছিল। শহরের পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাঁদের মা-বাবার সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন এই জ্ঞানার্থীদের মা-বাবাদের শিক্ষার সুযোগ খুব কম ছিল, বলতে গেলে ছিলই না। এসব ছাত্ররা শহরে আসায় পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বন্ধন দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া তরুণ প্রজন্মের এসব ছাত্ররা তাঁদের মুরব্বিদের মতো পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তীব্র অনুরাগ ধারণ করতেন না। তাঁদের মা-বাবারা এমন এক প্রজন্মের মানুষ ছিলেন, যাঁরা পাকিস্তান আনার জন্য লড়াই করেছেন কিন্তু নতুন শিক্ষার্থীরা ছিলেন এমন এক প্রজন্মের, যাঁরা বড় হয়েছিলেন আইয়ুব খানের স্বৈরাচারিতার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে কাজ করার যে আগ্রহ পুরোনো প্রজন্মের ছিল, তা নতুন প্রজন্ম কখনো সহ্য করতে পারত না। পঞ্চম যে কারণটির কথা লেখক বলছেন তা হলো নতুন প্রজন্মের এই তরুণদের একটি নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। ষাটের দশকে সংরক্ষণশীল পুরোনো সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তরুণদের প্রতি সংস্কৃতি বেশ উর্বর হয়ে উঠেছিল (পৃ. ১৭)।

এ ছাড়া পাকিস্তান ভাঙার অন্যতম যে বড় কারণের কথা লেখক বলছেন তা হলো পাকিস্তানে ছাত্র-আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য জায়গার আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এসব ছাত্র-আন্দোলনের ভাষা এবং তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল আন্তর্জাতিক। বেশির ভাগ ছাত্রনেতাই পরিচিত ছিলেন মার্কস, লেনিন এবং মাওয়ের লেখাজোখার সঙ্গে (পৃ. ১৭)।

রাঘবনের মতে, এ সবকিছু সম্ভব হয়েছিল প্রযুক্তিগত উন্নতির দরুন। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে সংবাদ অন্য প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে ইংরেজি এবং পাকিস্তানের ভার্নেকুলার সংবাদপত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলের আন্দোলনের সংবাদ ছবিসহ বিশদভাবে প্রকাশ করত। ১৯৬৭ সালেই প্রথম পাকিস্তানে টেলিভিশন আসে। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, লাহোর এবং রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম টেলিভিশন কেন্দ্র করা হয়। ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় একটি টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এটা ঠিক যে সেই সময় সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করা হতো, কিন্তু তারপরও এসব গণমাধ্যমে গোটা বিশ্বের খবর প্রচার করা হতো (পৃ. ১৮-১৯)। এভাবে ১৯৬০-এর দশককে, বিশেষ করে ১৯৬৮ সালকে, রাঘবন একটি বিশেষ সময় হিসেবে মনে করেন যখন থেকে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের অসন্তোষ তীব্রভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল, ঘন ঘন আন্দোলন হচ্ছিল, শোনা যাচ্ছিল ভাঙনের ধ্বনি।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিজয় এবং ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের টালবাহানার কথা আলোচনা করা হয়েছে। নির্বাচনের ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এই গড়িমসিকে নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, মিছিল এবং ধর্মঘট হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। শেষ পর্যন্ত গণ-আন্দোলন দমাতে সামরিক পদক্ষেপ, অপারেশন সার্চলাইট ছিল পাকিস্তান ভাঙনে শেষ কুঠারাঘাত।

তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশের অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে লেখক তাঁর যুক্তি ও বিশ্লেষণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রাথমিক উত্স ব্যবহার করেছেন। ১৯৭১ সালের মার্চজুড়েই শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন উদ্বিগ্ন। শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন সুজাত আলিকে মার্চের ১৪ তারিখে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছিল সংকটাপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিশেষ সাহায্যের আবেদন নিয়ে।

পাকিস্তান কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আড়াই ডিভিশন সেনাবাহিনী উড়িয়ে এনেছিল পাকিস্তানের পশ্চিম ফ্রন্ট থেকে। ভারতীয় কূটনৈতিক নথিতে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান যে পরিস্থিতিতে এখন আছে, সেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। ভারতীয় নেতাদের কাছে একবার সাহায্যের আবেদন পাঠিয়েই মুজিব ক্ষান্ত হননি। ১৪ মার্চের আগে এবং পরে, বহুবার তিনি ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ৫ এবং ৬ তারিখে ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কেসি সেনগুপ্তের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে এবং স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় এবং অন্যান্য সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না তা খতিয়ে দেখেছিলেন (পৃ. ৫৫)। ভারতীয় নীরবতা মুজিবকে ভীষণ বিরক্ত করেছিল। নতুন দিল্লি প্রথম দিকে কেন মুজিবকে সহযোগিতা করছিল না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন লেখক। বাঙালিদের সহযোগিতা করাই কি সংগত ছিল না? পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনা যখন তুঙ্গে ছিল, ভারত তখন ব্যস্ত ছিল নির্বাচন নিয়ে। নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই নির্বাচন দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এ ছাড়া পশ্চিম বাংলায় নকশাল আন্দোলন নিয়েও বিপাকে ছিল ভারত সরকার। ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব, ত্রিলোকি নাথ কাউল, একমত হয়েছিলেন, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে উত্সাহিত করার প্রয়োজন নেই, স্বাভাবিকভাবেই এই বিচ্ছেদকে এড়ানো যাবে না। পররাষ্ট্রসচিবের মত যে অমূলক ছিল না তা বোঝা যায় সেসময়ে ভারতীয় অন্য কর্মকর্তাদের আলোচনা থেকেও। পররাষ্ট্রবিষয়ক পার্লামেন্টারি কমিটির একটি সভায় বালরাজ মাধক উপস্থিত সবাইকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং পশ্চিম বাংলা ভারত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত আসামও ভারত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে... রাশিয়া এবং চীনপন্থীরা এদের মদদ দিচ্ছে। ভারতের গবেষণা সংস্থা আর অ্যান্ড এ ডব্লিউ বর্তমানে RAW তথ্য দিচ্ছিল পাকিস্তানের ভাঙনই অনিবার্য। মুজিবও এ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এর বাইরে ছয় দফা থেকে বেরোনের কোনো উপায় মুজিবের ছিল না। জাতীয় পরিষদের সভা বাতিলের পর আওয়ামী লীগের সদস্যরা আর অ্যান্ড এ ডব্লিউর কাছে তাদের চাহিদা মোতাবেক মেশিনগান, মর্টার, তিন মিলিয়ন টন খাদ্য সরবরাহ, ওষুধ, যোগাযোগ উপকরণ, ভারতের ভেতরে দ্রুত যোগাযোগের পরিবহন, ছোট বিমান এবং হেলিকপ্টার, ব্রডকাস্টিং সুবিধাসহ রেডিও ট্রান্সমিটারের চাহিদার কথা জানিয়েছিল (পৃ. ৫৭-৫৮)।

এ ক্ষেত্রেও ভারত তেমন দ্রুত সাড়া দেয়নি। ভারতের ভেতরে অভ্যন্তরীণ সমস্যা, যেমন নকশাল আন্দোলন, এর একটি কারণ ছিল। এ ছাড়া বালারাজ মাধক যে ভয়টা পাচ্ছিলেন, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রাম ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন উসকে দিতে পারে এবং যুক্ত বাংলার একটি সম্ভাবনাও তৈরি করতে পারে, সেই আশঙ্কাও কাজ করেছিল। এ ছাড়া  কমিউনিস্ট রাশিয়া ও চীনভীতি তো ছিলই। কমিউনিস্টভীতি থেকেই ভারত চেয়েছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হোক। এ ছাড়া ভারতের দেরি করে সাড়া দেওয়ার পেছনে মুজিবের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান দূরত্বও দায়ী ছিল। এটি শেখ মুজিবুর রহমানও পরবর্তীকালে স্বীকার করেছিলেন। আগরতলা ষড়ষন্ত্র মামলার পর থেকে মুজিব ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব সতর্ক ছিলেন। ভারত যখন কিছুতেই সাড়া দিচ্ছিল না মুজিব তখন সেনগুপ্তর মাধ্যমে ভারত সরকারকে সংবাদ পাঠালেন, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত তাঁদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে যেতে চাইছে যে বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপ যদি তাঁরা সাত বছরের জন্য দিয়ে দেয়, তাহলে আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করবে। এ অবস্থায় ভারত যদি এগিয়ে না আসে তাহলে মুজিবের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। মুজিবের এই বার্তায় ভারতীয় কর্মকর্তারা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল (পৃ. ৫৮-৫৯)। ভারত কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়াল এ অধ্যায়ে এর বিস্তারিত আলোচনা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে।

চতুর্থ এবং পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার ভূমিকার কথা। রাঘবন দেখাচ্ছেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া বেশ প্রভাব রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে আর রাশিয়ার সমর্থন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি। যদিও প্রথম দিকে রাশিয়া এই যুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে চায়নি, তবে শেষের দিকে রাশিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে সক্রিয় সমর্থন দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিষয়ক পরিকল্পনা ও কূটনীতির প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার ও প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। কিসিঞ্জার ছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্র ও কৌশলগত বিষয়ের প্রধান উপদেষ্টা। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে তিনি তিনটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। প্রথম পরিকল্পনাটি হলো পশ্চিম পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদান করা। দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি ছিল নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং তৃতীয় পরিকল্পনাটি ছিল ইয়াহিয়া খানকে যুদ্ধ শেষ করতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি করা যে জায়গা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। রাঘবনের মতে, কোনো জায়গায় উল্লেখ না করলেও তৃতীয় পরিকল্পনার প্রতি কিসিঞ্জারের ঝোঁক আঁচ করা যায়। লেখকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যদিও পাকিস্তানকে সহযোগিতা দিয়েছিল, তবুও হেনরি কিসিঞ্জারের তৃতীয় পরিকল্পনাটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। ১৯৭১ সালের মে মাসের ২ তারিখে প্রেসিডেন্ট নিক্সন তৃতীয় পরিকল্পনাটি অনুমোদন করেছিলেন এবং তাতে নিজের লেখা ছোট কয়েক লাইন নোট জুড়ে দিয়েছিলন: ‘ইয়াহিয়া ডু নট স্কুইজ অ্যাট দিস টাইম’ এবং ‘ডু নট’-এর নিচে তিনটি আন্ডার লাইন করা ছিল এর গুরুত্ব বোঝাতে (পৃ. ৮০-৮১)।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে চীনের ভূমিকা নিয়ে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে সম্পৃক্ত হওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল চীন। প্রথম থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার পক্ষে ভেড়াতে চেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বারবার উত্সাহ এবং তাগাদা দিয়েছিল ভারত সীমান্তে সেনা সমাবেশ করায় এবং সম্ভব হলে ভারতে অনুপ্রবেশ করায়। কিন্তু এ কাজে শুরু থেকেই চীন ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্বে।

একেবারে শেষ অধ্যায়ে, যুদ্ধে বাংলাদেশের জয়কে একটি আশ্চর্য জয় হিসেবে আখ্যার্িয়ত করেছেন লেখক। মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা ও দেশের মানুষের আভ্যন্তরীন উদ্যোগ লেখকের চোখে তেমনভাবে ধরা পড়েনি। তাই তথ্য বিন্যাস ও ব্যাখ্যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে শেষ অব্দি পর্যবেসিত হয়েছে। যার ফলে এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা ততটা স্থান পায়নি।  এত দ্রুত এবং যে মাত্রায় বিজয় অর্জন করেছিল মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনী, তাতে অনেক পণ্ডিতরা মনে করে থাকেন, এই বিজয় আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। সিশন এবং রোসও মতামত দিয়েছেন, যুদ্ধের ফলাফল অনেকটা পূর্বনির্ধারিতই ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী ছিল খুবই বিশাল। জল, স্থল এবং আকাশ— তিনটি শাখায়ই এর আধিপত্য ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছিল অনেক বেশি। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে তারা গোয়েন্দাসহ সর্বপ্রকার সুবিধা পেত। অপর দিকে স্থানীয় মানুষের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল সম্পূর্ণ বৈরী এবং শত্রু বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল একটি বৈরী পরিবেশে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বও ছিল অনেক দক্ষ। রাঘবনের মতে, এটা ঠিক এসব বিষয় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বিজয় পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বিজয় যে অনিবার্য ছিল তা নয়। এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীও যুদ্ধ শুরু করার আগে এ রকম ভাবেনি। তাদের বিভিন্ন কৌশল এবং পরিকল্পনা শুধু অপরেশনালই ছিল না বরং রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হতো। একইভাবে যুদ্ধের ফলাফলও বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল বিশ্বরাজনীতির ওপর। রাঘবনের মতে, অনেক দিক থেকেই এটি ছিল একটি আশ্চর্য বিজয়। যেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব ফ্রন্টে আত্মসমর্পণ করেছিল, সেদিনই নতুন দিল্লি পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল এবং এই ঘোষণা কার্যকর হয় ১৭ ডিসেম্বর থেকে। এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা অবশ্যই এসেছিল পূর্ববর্তী কয়েক দিনের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবে।

শ্রীনাথ রাঘবনের গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৈশ্বিক প্রভাব খুঁজতে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অনেক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দেখেছেন এবং এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে খাটো করে দেখেছেন। শুরু থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র খুঁড়িয়ে চলছিল। ইন্টার ডমিনিয়ন বিভিন্ন বাদানুবাদ নিয়ে পাকিস্তান ছিল ব্যস্ত। এ ছাড়া পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল বিকারগ্রস্ত প্যারানয়েড নেতৃত্ব দ্বারা চালিত, যারা সব সময়ই ভয় এবং উদ্বিগ্নতার মধ্যে থাকত। সব সময়ই এরা ভারত জুজু দ্বারা ভীত ছিল এবং বাঙালিদের দেখত সন্দেহের চোখে। এসব ভয় এবং মাত্রাতিরিক্ত উদ্বিগ্নতার ফলে পাকিস্তান শুরু থেকেই পরিণত হয়েছিল ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অখণ্ডতা থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল প্রথম থেকেই। আর এজন্য পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মনে সন্দেহ ও ভয় কাজ করত।

 রাঘবন পূর্ব পাকিস্তানে উপনিবেশ-পরবর্তী শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষিত শ্রেণি সৃষ্টি ও নতুন নতুন আন্দোলনের সৃষ্টি এবং এই আন্দোলনে শুধু শিক্ষিত শ্রেণির যে ভূমিকার কথা বলছেন তা পুরোপুরি ঠিক না। পূর্ব বাংলায় নতুন জাতীয়তাবাদের বিস্তারকে হয়তো লেখক বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ‘ইমাজিন্ড কমিউনিটি’ তত্ত্বের আলোকে দেখতে চেয়েছেন। এন্ডারসনের তত্ত্ব অনুযায়ী, শুধু ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাত ধরেই তৃতীয় বিশ্বে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে।৯ তিনি তৃতীয় বিশ্বে জাতীয়তাবাদের ‘অফিশিয়াল ন্যাশনালিজমে’ (যেখানে ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সংখ্যায় অল্প নেটিভ শিক্ষিত মানুষের দ্বারা জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে দেখানো হয়) নামিয়ে আনায় অনেক ইতিহাসবিদ সমালোচনা করেছেন।১০ এন্ডারসনের তত্ত্বের মতোই দেখা যায়, পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদ বিস্তারে লেখক নব্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং গণমাধ্যমকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষ যেখানে নিরক্ষর ছিল, সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনের আওতার বাইরে ছিল সেখানে গণমাধ্যম কতোটা ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে মতভেদ থেকে যায়। এছাড়া গণমাধ্যম ছিল কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনের মধ্যে।

তথ্যসূত্র

১. দেখুন, Badruddin Umar, The Emergence of Bangladesh: Class Struggle in East Pakistan, 1947-1958, vol. I (Karachi: Oxford University Press, 2004); Umar, The Emergence  of Bangladesh: Rise of Bengali Nationalism, 1958-1971, vol. II (Karachi: Oxford University Press, 2006).

২. Sarmila Bose, Dead Reckoning: Memoirs of the 1971 Bangladesh War (New York: Columbia University Press, 2011)   

৩. দেখুন, Adrienne Cooper, Sharecropping and Sharecroppers' Struggles in Bengal, 1930-1950 (Calcutta: KP Bagchi & Company, 1998).

৪. দেখুন, Taj Ul-Islam Hashmi, Peasant Utopia: The Communalization of Class Politics in East Bengal, 1920-1947 (Dhaka: University Press Limited, 1994).

৫. দেখুন, Richard Sisson and Leo Rose, War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh (Berkely: University of California Press, 1990), রাঘবনের বই থেকে উদ্বৃত।

৬. Umar, The Emergence of Bangladesh, vol. I, p.x.

৭. Anatal Lieven, Pakistan: A Hard Country (London: Allen Lane, 2011), p. 10. রাঘবনের বইয়ে উদ্বৃত।

৮. দেখুন এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা Tariq Omar Ali, ‘The Envelope of Global Trade: The Political Economy and Intellectual History of Jute in the Bengal Delta, 1850s to 1950s’ (PhD Diss. Cambridge Massachusetts: Harvard University, 2012).

৯. বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন Benedict Anderson, Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism (London: Verso, 1993).

১০. পার্থ চট্টোপাধ্যায় বেনেডিক্ট এন্ডারসনের তত্বের সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। দেখুন Partha Chatterjee, 'Whose Imagined Community' in Sekhar Bandyopadhay (ed.), Nationalist Movement in India: A Reader (New Delhi: Oxford University Press, 2009), 3-13.