রাজনীতিতে দায়িত্বশীলতা ও গণতন্ত্রের শর্ত

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

মুক্ত গণতন্ত্র রুদ্ধ রাজনীতি (বাংলাদেশ ১৯৯২-২০১২)—মতিউর রহমান প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা (ফেব্রুয়ারি ২০১৪)

দেশ ও জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ এবং চূড়ান্ত অনিষ্ট করার সামর্থ্য বা ক্ষমতা রয়েছে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের। কোনো দেশের রাজনীতি যদি হয় নীতিহীন, পচনগ্রস্ত; তবে সে দেশটির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সেই সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। একইভাবে, কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার পরও, রাষ্ট্র পরিচালনব্যবস্থা হিসেবে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। কিংবা হয়তো আছে, অধিকতর ও কার্যকর গণতন্ত্র। দায়িত্বশীলতা যার প্রধান ও অপরিহার্য শর্ত। মতিউর রহমান তাঁর মুক্ত গণতন্ত্র রুদ্ধ রাজনীতি বইটির অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলোর মধ্য দিয়ে মূলত এই দায়িত্বশীল রাজনীতির আবশ্যকতার কথাই বলতে চেয়েছেন। ১৯৯১-এর অক্টোবর থেকে ২০১০-এর অক্টোবর পর্যন্ত দুই দশকের সময় পরিসরে সংবাদপত্রের মন্তব্য প্রতিবেদন হিসেবে এগুলো লিখিত হয়। এর মধ্যে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়ে লেখা প্রথম রচনাটি অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজ-এ প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি সব রচনাই তাঁর নিজের সম্পাদিত দৈনিক ভোরের কাগজ ও দৈনিক প্রথম আলো-র জন্য লেখা।

দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসানে এ দেশে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হওয়ার পরও যে তা বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং পড়ছে, তার জন্য লেখক দায়ী করেছেন প্রধানত আমাদের রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষ করে প্রধান দুটি দলের দায়িত্বশীলতার অভাব বা ব্যর্থতাকে। ১৯৯১ সালে জন-আকাঙ্ক্ষার মুখে ও দুটি দলের সমঝোতার ভিত্তিতে এ দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হলেও তা কখনো কার্যকর রূপ পায়নি। যদিও প্রতি আমলেই সরকারের তরফে বারবার সংসদকেই সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ঘোষণা এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তার জন্য অত্যাবশ্যক যে করণীয়গুলো, সে ব্যাপারে কখনোই কেউ আগ্রহ বা আন্তরিকতার পরিচয় দেয়নি। সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করা, পরিষদে বিরোধী দলকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া ও তাকে তার ভূমিকা পালন করতে দেওয়া, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষিত হয়নি। ফলে, সামরিক শাসনের অবসানের পরও দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এ দেশে যা চলছে, মতিউর রহমানের ভাষায় তা হলো ‘নির্বাচিত সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন’। তিনি তাঁর লেখায় বার কয়েকই এই অভিধাটি ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের চালু শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এখানে দলীয় নীতি, নির্বাচনী ঘোষণা—এসবের কোনো মূল্য নেই।... সংসদীয় দলের কোনো ভূমিকা থাকে না। দল ঢুকে যায় সরকারের ভেতরে, দল আর সরকার সমার্থক হয়ে যায়, সরকার চলে একজনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভিত্তিতে—তখন তিনিই সব’ (পৃ. ৬৬)।

সংসদের ভেতরেই হোক কিংবা বাইরে, বাংলাদেশের দুটি প্রধান দল ও তাদের জোটসঙ্গীদের সম্পর্ক সব সময় বিরোধিতা ও বৈরিতার। দেশের পাহাড়প্রমাণ সমস্যার মোকাবিলায় কোথাও দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতার লেশমাত্র নমুনা দেখা যায় না। বরং সবকিছুর জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মতিউর রহমানের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর সব সময় সব ব্যাপারে জেতার আগ্রহ এবং অপর পক্ষকে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা এর পেছনে কাজ করে (পৃ. ২২৫)।  লেখকের আশঙ্কা, সমস্যার মূলে না গিয়ে ও তা সমাধানের চেষ্টা না করে, কিংবা মূল ইস্যু থেকে চোখ ফিরিয়ে বা তাকে পাশ কাটিয়ে, এভাবে একে অপরকে দোষারোপ করার, পাল্টাপাল্টির যে ভয়ংকর রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠেছে, তা দেশকে প্রকৃতই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে (পৃ. ২০৫)। সরকার কিংবা বিরোধী দলে যে অবস্থানেই থাকুন, আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও যে কখনো কিছু দোষ করতে পারেন, তাঁদেরও যে কমবেশি ভুল হতে পারে, এটা তাঁরা মনে হয় বিশ্বাস করেন না। ফলে দোষ বা ভুল স্বীকারের, আত্মসমালোচনার এবং জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি এ দেশে আজও গড়ে ওঠেনি। আর নেতারা যেখানে অভ্রান্ত, নির্দোষ, ‘ফুলের মতো পবিত্র’, সেখানে কর্মী-সমর্থকদের তো দোষ স্বীকারের প্রশ্নই ওঠে না! যদিও, মতিউর রহমান ঠিকই লক্ষ করেছেন, ‘নেতা-নেত্রীদের মুখে যখন সামান্যও আত্মসমালোচনার কথা শুনেছে, দেশবাসী তা পছন্দ করেছে (পৃ. ১৭১)। এমনকি ওই দলটির প্রতি মানুষ সহানুভূতিও জানিয়েছে। দু-একবার নির্বাচনী ফলাফলেও যার প্রতিফলন ঘটেছে। উল্টো দিকে রাজনৈতিক দল বা তার নেতাদের দম্ভ ও ঔদ্ধত্যকে যে মানুষ পছন্দ করে না, তারও প্রমাণ এমনকি ভোটের ফলাফলেও আমরা দেখেছি। কিন্তু এসব দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা তাদের নেতারা কোনো শিক্ষা কি নিতে পেরেছেন? আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো স্থায়ী বা গুণগত পরিবর্তন কি তা ঘটাতে পেরেছে? মতিউর রহমানের এই মন্তব্য প্রতিবেদনগুলো পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে এ প্রশ্নগুলো বারবারই জাগবে বলে মনে হয়। নির্বাচনে অতিরিক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের ব্যাপারটিকেও লেখক অন্তত আমাদের দেশে গণতন্ত্রের জন্য একটা বড় বিপদ বা ঝুঁকি হিসেবে দেখেছেন। কারণ, তাতে দলীয় স্বেচ্ছাচার বা একনায়কতন্ত্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তিনি লিখেছেন, ‘যত বড় সংখ্যা তত বড় ঝুঁকি’ (পৃ. ৩৩৩)।

শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলতে গিয়েও লেখক এর জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বহীন রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন। নির্মাণকাজের টেন্ডার নিয়ে ছাত্রদলের দুটি গ্রুপের সশস্ত্র সংঘর্ষের শিকার হয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনির মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, ‘এখন দেশে যে ছাত্ররাজনীতি চলছে, তা চলতে দিয়ে আমাদের শিক্ষাজীবন, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়’ (পৃ. ১২৫)।   একইভাবে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের সংঘর্ষের বলি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিকের মৃত্যুর পর লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার পর প্রায় চার দশকজুড়ে ছাত্ররাজনীতির নামে বাংলাদেশকে এক সন্ত্রাসকবলিত বিপন্ন দেশে পরিণত করা হয়েছে।... অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির দোহাই দিয়ে এসব আর মেনে নেওয়া যায় না। এখন সময় হয়েছে প্রশ্ন তোলার যে ছাত্রসংগঠন ও ছাত্ররাজনীতির নামে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা আর কত দিন মেনে নেব?’ (পৃ. ৩৭৬) একই প্রসঙ্গে অন্যত্র লিখেছেন, সন্ত্রাস দমনের কাজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু করতে হবে (পৃ. ১১৮)।  দেশে জঙ্গি তত্পরতা সম্পর্কে লিখতে গিয়েও মতিউর রহমানের অভিমত, বড় দুই দলের ঝগড়ার সুযোগেই এই ধর্মীয় উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করছে, এবং ‘শুধু বিদেশি মদদে ও অর্থে নয়, যা সবচেয়ে বিপজ্জনক তা হলো, তারা এতে সমাজের কোনো কোনো অংশকে সম্পৃক্ত করতেও পেরেছে’ (পৃ. ২১৯)।  তাঁর মতে, ক্ষমতার রাজনীতি ও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বিভিন্ন সময় দুটি দলই কমবেশি জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একাধিক রচনায় তিনি ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা ও পরবর্তী ঘটনাক্রমে সে সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ভূমিকার যেমন সমালোচনা করেছেন, একইভাবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ফতোয়াকে বৈধতা দিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের চুক্তি স্বাক্ষরেরও নিন্দা করেছেন। লিখেছেন, ‘ওই সমঝোতার পক্ষে কোনো একটা যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়’ (পৃ. ২৪৪)। এবং, তাঁর মতে, ‘যেকোনো মূল্যে ক্ষমতার ক্ষুধা নিবারণের জন্য মরিয়া’ হয়ে ওঠা থেকেই ছিল সেদিন স্বৈরাচার ও মৌলবাদীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের সে ‘মহাজোট’ গঠন (পৃ. ২৪৫)। দেশে জঙ্গি তত্পরতার সূচনাপর্ব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আছে বইটিতে। লেখকের মতে, পাকিস্তান ও ভারত দুটি দেশই তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে এ দেশে জঙ্গিবাদকে মদদ দেয় (পৃ. ২৬০)। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা, তাদের অস্পষ্ট বা রহস্যময় ভূমিকা এবং কৌশলগত ভুলেরও সমালোচনা করেছেন লেখক। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জঙ্গিনেতা শায়খ আবদুর রহমান যে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে চেয়েছিলেন, লেখক মনে করেন, তাঁকে সে সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল (পৃ. ২১৮) তা না দিয়ে কিছু সত্য বা তথ্যকে যে চিরতরে ঢাকাচাপা দেওয়া হয়েছে, সে তো সহজেই বোধগম্য।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক প্রধান দুর্বলতা, ব্যর্থতার বড় প্রমাণ হিসেবে মতিউর রহমান যে সত্যটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা হলো, দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে যার পতন ঘটিয়ে এ দেশে গণতন্ত্র একদিন তার যাত্রা শুরু করেছিল, সেই ‘পতিত’ স্বৈরাচার আজও এ দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে আছে। পৃথিবীর আর কোথাও যার সমতুল্য উদাহারন খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি লিখেছেন, ‘স্বৈরাচারী আর দুর্নীতিবাজ এরশাদ আমাদের দেশের প্রধান দুই দল আর দুই নেত্রীর কাছে বেশ মূল্যবান রাজনৈতিক কেনাবেচার বস্তু হয়ে আছেন এখনো’ (পৃ. ৯৫)। সময়ে সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির মামলাগুলো চাঙা করা হয়, সে কেবল ‘চাপে ফেলে তাঁকে দলে ভেড়ানো’র জন্য (পৃ. ৯৬)। মতিউর রহমান কথাগুলো লিখেছিলেন ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে। এক যুগ পর আজও বাস্তবতাটি কি একই রয়ে যায়নি? এভাবে এরশাদের দুর্নীতির বিচার না করে, তার সঙ্গে আপস করে, আমাদের পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারগুলো তাদের প্রতিশ্রুত দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে। পরে নিজেরাও আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এরশাদের বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের বিবরণের পর তাই মতিউর রহমানকে আবার বিএনপির শাসনামলে হাওয়া ভবনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির মহোত্সব এবং আওয়ামী লীগ আমলে মিগ ক্রয়ে বিরাট দুর্নীতির প্রসঙ্গ নিয়ে লিখতে হয়।

এখানে বলা দরকার, আমাদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত কলাম জাতীয় রচনায় সাধারণত কোনো বিশেষ প্রসঙ্গে লেখকের অভিমত বা মন্তব্যই প্রকাশ পায়। সেই সঙ্গে হয়তো কারও কারও লেখায় কখনো কিছু তত্ত্বকথারও সংশ্লেষ ঘটে। সচরাচর তথ্য এসব রচনায় প্রাধান্য পায় না। মুক্ত গণতন্ত্র রুদ্ধ রাজনীতি গ্রন্থে সংকলিত রচনাগুলোকে হয়তো এই অর্থে ‘মন্তব্য প্রতিবেদন’ বলা হয়েছে যে এর অনেকগুলোতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকসুলভ তথ্য উদ্ঘাটন বা উপস্থাপনের পাশাপাশি সে-সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য বা অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। সাধারণ পাঠক তাঁদের এ যাবত্ অজানা অনেক তথ্য হয়তো এ বইটি পাঠেই প্রথম জানতে পারবেন। যেমন, এরশাদ যে বলে থাকেন, দেশকে গৃহযুদ্ধ বা অধিকতর রক্তপাতের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁর পদত্যাগের পূর্ববর্তী ঘটনাক্রম (প্রকাশ্য ও নেপথ্য) উল্লেখ করে মতিউর রহমান দেখিয়েছেন, কথাটা মোটেও সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে এরশাদের ক্ষমতার মূলভিত্তি সেনাবাহিনী তাঁর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এবং শেষ পর্যায়ে তাদের একরকম চাপের মুখেই তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন (পৃ. ৩৮৬-৮৯)। ক্ষমতায় থাকাকালে বিদেশে এরশাদের বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের তথ্য আছে বইটিতে। আছে পরবর্তী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ বা তাদের জোটশাসিত সরকারের আমলের দুর্নীতি ও অপশাসনের বেশকিছু তথ্যও। সেদিক থেকে গ্রন্থটি এ দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের তথ্যবিবরণী হিসেবে ভবিষ্যত্ পাঠকদের জানাশোনার পরিধিই শুধু বাড়াবে না, তাঁদের চিন্তার খোরাকও জোগাবে বলে আমাদের ধারণা।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাস্তবতার কথা বলতে গিয়ে বেশ কিছু অপ্রিয় সত্যকে লেখক বেশ কঠিন ভাষায়ই তুলে ধরেছেন। মনে মনে হলেও সে-কথাগুলোর সঙ্গে একমত না হয়ে আমাদের উপায় নেই। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক : (১) আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যাপারে বিদেশিদের নাক গলানোর আমরা সমালোচনা করি, যখন তাদের কোনো বক্তব্য আমাদের বিপক্ষে যায়। কিন্তু সেই আমরাই আবার যখন দরকার, তাদের কাছে ধরনা দিই, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের কাছে নালিশ জানাই, তাদের সালিস মানি। (২) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে দুর্নীতিতে শীর্ষ বলে যখন বাংলাদেশের নাম ওঠে, বিরোধী দলে থাকলে আমরা তাতে উল্লসিত হই, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তথ্যটিকে ব্যবহার করতে পেরে যারপরনাই আত্মপ্রসাদ লাভ করি, কিন্তু সেটাই যদি হয় নিজেদের আমলে তবে তার যথার্থতা বা পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলি। যেকোনো অবস্থায় ব্যাপারটি যে দেশ ও জাতির জন্য চূড়ান্ত লজ্জার, এটা কোনো পক্ষই যেন বুঝতে পারি না বা মনে রাখতে চাই না। (বাংলাদেশ তখন পর্যন্ত পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। এর মধ্যে চারবার ঘটে বিএনপির আমলে। কিন্তু শুরুটা যে আওয়ামী লীগের সময়ে, সে কথাটা এ প্রসঙ্গে লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন (পৃ. ৩৩১)। (৩) ক্ষমতার বাইরে থাকতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে, কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তাদের একমাত্র চাওয়া হয়ে দাঁড়ায়, প্রচারমাধ্যম সত্য প্রচারের দায়িত্ব পালন নয়, বরং তাদের পক্ষে থাকুক। এর ব্যত্যয় দেখলে রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা পত্রিকার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন (পৃ. ২২৫)। (এ দেশে প্রতিটি সরকারই তাদের সময়ে কোনো কোনোভাবে সংবাদপত্রসহ প্রচারমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। দেশে জঙ্গি তত্পরতা সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ ও আলোচনার মুখে বিএনপি-জামায়াত দলীয় সাংসদেরা যে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণে আইন চেয়েছিলেন, সে কথাটা লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন (পৃ. ২০৯)। 

সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ফলাফল নিজেদের পক্ষে না গেলেই সে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলব, ‘সূক্ষ্ম’ বা স্থূল কারচুপির অভিযোগ আনব, সংসদ অধিবেশনে অংশ নেব না বা লাগাতার বর্জনের মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর এবং মেয়াদ শেষের আগেই সরকারের পতন ঘটাতে সচেষ্ট হব; সরকারে থাকলে হরতালের বিরুদ্ধে কথা বলব, প্রতিটি হরতালে দেশের অর্থনীতির কী পরিমাণ ক্ষতি হয় জাতির সামনে তা তুলে ধরব, হরতালকেন্দ্রিক সন্ত্রাস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার নামে পাল্টা মিটিং-মিছিল করে তাদের আরও সন্ত্রস্ত করে তুলব, আর বিরোধী দলে গেলেই কথায় কথায় হরতালের ডাক দেব, বলব যে হরতাল ছাড়া উপায় নেই ; লেখকের মতে, এসব আর যা-ই হোক, দায়িত্বশীল রাজনীতির পরিচয় নয়। যদিও বছরের পর বছর এটাই হয়ে চলেছে আমাদের দেশে। হরতাল প্রসঙ্গে মতিউর রহমান লিখেছেন, রাজনৈতিক সংগ্রামের এক ‘চরম’ কর্মসূচিকে এভাবে ক্রমাগত অপব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমানে ‘সবচেয়ে সহজ কর্মসূচি’তে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এখন ডাকলেই হরতাল হয় (পৃ. ৫৪)। তিনি তথ্য দিয়েছেন, ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন পর্যন্ত চার বছর সময়কালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র তিন দিন হরতাল ডাকা হয়েছিল (পৃ. ৫৫)।  ১৯৬০ দশকের ছাত্র আন্দোলনের একজন অগ্রণী কর্মী হিসেবে মতিউর রহমান তাঁর সে সময়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এখনকার অবস্থার তুলনা করে লিখেছেন, ‘এখন তো রাজনৈতিক দল কোনো প্রচারপত্রও বিলি করে না, দাবিদাওয়াভিত্তিক পোস্টার দেয়ালে সাঁটে না, রাস্তার মোড়ে মোড়ে সভা অর্থাত্ স্ট্রিট কর্নার মিটিং করে না, মিছিল করে না—এমনকি জনসভাও করে কদাচিত্’ (পৃ. ৫৮)। দেশে সুস্থ ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু ও বিকাশের স্বার্থেই সংসদে ও সংসদের বাইরে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের বিকল্প উপায় অনুসন্ধান ও অনুসরণের কথা বলেছেন লেখক।

যদি একান্তভাবে দলান্ধ না হই, কিংবা শুধু তর্কের খাতিরে তর্ক করতে না চাই, তবে লেখকের অনেক মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণের সঙ্গেই আমাদের সহমত না হয়ে উপায় নেই। যেমন তিনি বলেছেন, বিগত সবকটি নির্বাচনেই যখন যারা জিতেছে, দেখা গেছে, তারা তাদের কোনো কাজ বা আচরণের দ্বারা সে বিজয় অর্জন করেনি, পূর্ববর্তী মেয়াদে ক্ষমতাসীন প্রতিদ্বন্দ্বী দলটির ব্যর্থতা বা অপশাসনেরই ফসল তুলেছে তারা। অর্থাত্ প্রধানত নেতিবাচক ভোটেই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। আর এ প্রসঙ্গে যা লক্ষণীয় তা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলটির প্রাপ্ত ভোটের হারের তুলনায় তাদের আসনপ্রাপ্তির হার বেশি (পৃ. ১০৩)। 

লেখক মনে করেন, জাতির বিভক্তি আজ একটি বাস্তবতা। একে অস্বীকার করার যেমন উপায় নেই, তেমনি এ কথাও আমাদের বুঝতে ও স্বীকার করতে হবে যে এই বাস্তবতা নিয়ে দেশ ও জাতিকে বেশি দূর অগ্রসর করে নেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না। অন্তত কিছু মৌলিক বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে ন্যূনতম একটা সমঝোতায় আমাদের পৌঁছতেই হবে। এরও অতিরিক্ত মতিউর রহমান যা মনে করেন তা হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দুটি বড় দলের আচরণ এবং ভবিষ্যতে তারা কতটা সংশোধিত হতে পারে তার ওপর নির্ভর করছে। এ প্রসঙ্গে ২০০০ সালের ২১ ডিসেম্বর লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত বা নিশ্চিহ্ন করার যত চিন্তাই করুক না কেন, সেটা সহজসাধ্য কোনো কাজ নয়। আমরা বিগত দুই নির্বাচনে দুই দলের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই সেটা বুঝতে পারব’ (পৃ. ৭৮)। তাঁর মতে, অন্য যেকোনো দেশের মতোই এ দেশেও গণতন্ত্রকে এগিয়ে যেতে হলে তাকে দুই পায়ের ওপর ভর করেই এগোতে হবে। আর সে দুই পায়ের একটি যদি আওয়ামী লীগ হয় তবে অন্যটি বিএনপি। এখন পর্যন্ত এটাই হলো বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে যারা গণতন্ত্রকে কার্যকর করার বা তাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার কথা বলেন, তাঁরা সে ব্যাপারে সত্যিসত্যি কতটা আন্তরিক, লেখক  সে-সম্পর্কে সন্দিহান।

অবশ্য দেশের বড় দুটি দলের মধ্যে কোনো ব্যাপারেই যে কোনো সমঝোতা নেই বা কখনো দেখা যায়নি, তা বলাও সত্যের অপলাপ হবে। ঐক্য বা সমঝোতার এমন দু-একটি ক্ষেত্রও লেখক শনাক্ত করেছেন। যেমন, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদটিকে ক্ষমতাহীন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করার ব্যাপারে উভয় দলের মধ্যে এই মতৈক্য দেখা গিয়েছিল (পৃ. ৪৯)।  বলা বাহুল্য দেশের জন্য যা মঙ্গলজনক হয়নি। একইভাবে নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট শক্তিশালী ও টেকসই হতে না দেওয়ার ব্যাপারেও যেন উভয় দলের মধ্যে একটা ঐক্য বা সমঝোতার মনোভাব কাজ করে (পৃ. ২৩৫-৬)। যদিও, এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই যে শুধু নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার মাধ্যমেই দেশ অনেক বিপদ-সংকট থেকে রক্ষা পেতে পারে। 

এক-এগারোর পরিবর্তন ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থক হিসেবে প্রথম আলো পত্রিকাটি তার অনুরাগী ও বিরোধী উভয় মহলে এক রকম পরিচিতি লাভ করে। বস্তুত এক চূড়ান্ত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসানে এক-এগারোর পরিবর্তন সেদিন প্রায় সমগ্র দেশবাসীর জন্যই স্বস্তি বয়ে এনেছিল। আর সদ্য-ক্ষমতাচ্যুত দলটি এবং ক্ষতিগ্রস্ত কিছু মহল ছাড়া সেদিন সবাই পরিবর্তনটিকে স্বাগত জানিয়েছিল। যদিও জাতির উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূতরা তাঁদের প্রতি ব্যাপক জনগণের সেই আস্থার মর্যাদা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি। গ্রন্থভুক্ত মন্তব্য প্রতিবেদনগুলো পাঠে দেখা যায়, এক-এগারোর পরিবর্তনের পর একেবারে শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নির্বাচন, উপদেষ্টাদের অনেক কথাবার্তা (তাঁদের পরস্পরবিরোধী এমনকি একই উপদেষ্টার স্ববিরোধী বক্তব্য) ও কাজকর্ম,  সেনাবাহিনীর ওপর অধিক নির্ভরশীলতা, দ্বৈত শাসন, অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দোদুল্যমানতা ও দীর্ঘসূত্রতা, নির্দলীয় সরকার হয়েও রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় তাদের সংশ্লিষ্টতা বা পৃষ্ঠপোষকতা, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আচরণে বাড়াবাড়ি, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর পরামর্শ গ্রহণে অধিক আগ্রহ, এ সবকিছুর সমালোচনাও করেছেন মতিউর রহমান সে সময় তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত এ লেখাগুলোতে। গোড়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের মধ্যে যে প্রত্যাশা জাগিয়েছিল, তা যখন দ্রুত আস্থাহীনতায় পর্যবসিত হতে থাকে, তখন তা নিয়ে কথা বলতেও লেখক দ্বিধা করেননি। এবং সেসব কথাও তিনি বেশ স্পষ্টভাবেই বলেছেন। যদিও সেই সঙ্গে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচকদেরও সমালোচনা করে লিখেছেন, ‘সেসব দিনের ভয়ংকর সব কথা এখন আমরা অনেকেই ভুলে যাচ্ছি। রাজনীতিবিদদের অনেকে এখন উল্টো সুরে কথা বলছেন, যেন দেশে ১১ জানুয়ারির পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন ছিল না, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো ভুল বা বাড়াবাড়ি ছিল না, কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না। ভাবখানা এমন যে দ্রুত একটা নির্বাচন দিয়ে অতীতের ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে’ (পৃ. ৩১১)। লেখকের মতে, বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে না নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একটা ‘ঐতিহাসিক’ ভুল করেছিল। পরবর্তী বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য যা বহুলাংশে দায়ী। আর এই দায় থেকে দলটি অব্যাহতি পেতে পারে না (পৃ. ২৪৯)।

গোড়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং নানা সংস্কারমূলক প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপ দেশবাসীর ব্যাপক অংশের মধ্যে যে প্রত্যাশা জাগিয়েছিল, মতিউর রহমানের লেখাগুলোতে হয়তো তারই প্রতিধ্বনি শুনি আমরা। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে আশাভঙ্গের অনুভূতি নিয়েও দেখা যায় তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আস্থা বজায় রাখতে চেয়েছেন, সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে তারা যেভাবে ভোটার তালিকা সংশোধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের মতো দুটো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে, সেভাবেই প্রতিশ্রুত অন্যান্য সংস্কারমূলক কাজও তারা সম্পন্ন করবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে সরকারকে বারবার তাগিদও দিয়েছেন। প্রশাসনিক সংস্কার, বিকেন্দ্রীকরণ এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও বলেছেন তিনি। যেহেতু, লেখকের মনে হয়েছে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে এই কাজগুলো করবে না। তাঁর সে ধারণা যে অমূলক ছিল না, সে তো আজ একটি প্রমাণিত সত্য। তা হলেও একটি অনির্বাচিত ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমনকি জাতির বৃহত্তর স্বার্থেও এত সব দায়িত্ব পালনের নৈতিক ভিত্তি বা সুযোগ আছে কি না, সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে। লেখক অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না, দেশের মানুষ যে দীর্ঘ সময় ধরে একটা অনির্বাচিত সরকারের অধীনে থাকতে চাইবে না, সে কথাও খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন (পৃ. ২৬৭)। এমনকি সে-সময় সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ দেশশাসন সম্পর্কে প্রকাশ্যে যেসব অভিমত দিতে শুরু করেছিলেন, তার সঙ্গে অনেক বিষয়ে একমত পোষণ করেও মতিউর রহমান প্রশ্ন তুলেছেন, সেনাপ্রধান হিসেবে তাঁর অবস্থান থেকে তিনি সেটা দিতে পারেন কি না (পৃ. ২৬৮)। এই ভূখণ্ডের সামরিক শাসনামলের ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, জনগণ চায় না, সেই ইতিহাস ফিরে আসুক (পৃ. ২৬৯)।

রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর জড়িত হওয়ার বিরুদ্ধেই তিনি শুধু মত ব্যক্ত করেননি, (পৃ. ৩৬০) এমনকি নির্বাচিত সরকারের আমলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় সেনাপ্রধান নিয়োগের তিনি সমালোচনা করেছেন। (পৃ. ৩৫৬) অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে কেন সেনাবাহিনী নিয়ে সংসদে বা সংসদের বাইরে কোনো কথা হবে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন লেখক। তাঁর মতে, এ অবস্থাটা কখনোই কারও জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। লিখেছেন, ‘যাদের ট্যাক্সে, যাদের অর্থে এবং যাদের রক্তে এই সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছে, তাদের এ সম্পর্কে কথা বলার অধিকার রয়েছে।... সমরাস্ত্র, সামরিক পরিকল্পনা এবং বিশেষ কোনো গোপনীয় বিষয় ছাড়া সবকিছু নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’ (পৃ. ৩৪) সরকারি প্রেসনোটের মতো সেনাবাহিনীসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে আইএসপিআরের ভাষ্য যে মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে না, বরং তারা ভাবে, ‘যা রটে তা কিছু বটে’, প্রসঙ্গত সে-কথাও উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন তিনি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর ভূমিকার সমালোচনা করতে গিয়ে। বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদের যে গুরুত্ব ও মর্যাদা, অন্ধ দলানুগত্য দ্বারা তিনি তাকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। রাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদটিকে বিতর্কিত করে তুলেছেন। আর এর জন্যও লেখক দায়ী করেছেন শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। যাঁরা রাষ্ট্রপতিকে তাঁর প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে দেননি। বরং তাঁকে তাঁদের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।

বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন, লেখক সে জন্য তাঁর প্রশংসা করেছেন। তবে সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, সংসদকে আস্থায় নিয়ে, বিরোধী দলসহ সবার সহযোগিতা ও জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে এবং দেশবাসীকে পুরো ঘটনা জানিয়ে এ রকম জাতীয় সংকট মোকাবিলা করা উচিত। লিখেছেন, ‘সরকার এককভাবে চাইলে অনেক কিছু নিশ্চয়ই করতে পারে। কিন্তু সবাই মিলে করলে আরও ভালো হয়। জাতীয় সমঝোতা গড়ার এ রকম উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য জরুরি।’ (পৃ. ৩৪৬) পাকিস্তানিদের নৃশংসতার কথা আমরা জানি, একাত্তরে সে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মতিউর রহমানের মন্তব্য: ‘আমরা একটি সহনশীল জাতি ও সমাজ বলে উচ্চ কণ্ঠে কত না কথা বলি দেশ-বিদেশে। কিন্তু সারা বিশ্ব অবাক দৃষ্টিতে দেখল, আমরা বাঙালিরা কত নিষ্ঠুর হতে পারি।’ (পৃ. ৩৪২) পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ‘দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মহল থেকে আজও তেমন কোনো গভীর অনুসন্ধানী পর্যালোচনা হলো না’ বলে লেখক আক্ষেপ ব্যক্ত করেছেন (পৃ. ১৩৬)। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বার্থেই, দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, এ ব্যাপারে ভাবনাচিন্তার সূত্রপাত হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।

সমালোচনার ক্ষেত্রে গত প্রায় দুই দশকে পালাক্রমে ক্ষমতায় আসা প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বা তাদের জোট এবং মধ্যবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাউকেই তিনি ছাড় দেননি। তেমনি কারও প্রতি বিশেষ অনুরাগ বা পক্ষপাতের প্রমাণও অন্তত গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলোতে পাওয়া যায় না। ১৯৯৯-এর ৯ মে যিনি লিখছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান’, তাঁকেই আবার ২০০১ সালের ১৭ নভেম্বর লিখতে দেখা যায়, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদলকে সামলান’। গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলোর (মোট সংখ্যা ৬২) আরও কয়েকটির শিরোনাম থেকেও আশা করি বিষয়টি স্পষ্ট হবে, যেমন: ‘বিএনপি কোন পথে?’, ‘বিএনপি কি পথ হারিয়ে ফেলেছে?’, ‘দুর্নীতি, এরশাদ ও দেশের প্রধান দুই দল’, ‘শেখ হাসিনা, মানুষের কথা শুনুন’, ‘ডা. বি. চৌধুরীর এই ট্র্যাজিক বিদায় কেন?’ ‘প্রসঙ্গ: সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিন হার্ট’, ‘কিবরিয়া ভাইকেও বাঁচতে দেওয়া হলো না’, ‘বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি নয়, আবিষ্কার’, ‘২১ আগস্ট, ১৭ আগস্ট এবং তারপর?’, ‘শেখ হাসিনা অসত্য বলেছেন’, ‘ড. ফখরুদ্দীনের কাছে প্রত্যাশা: উপদেষ্টা তালিকা উত্সাহজনক নয়’, ‘তারেকের দুর্নীতির বিচার হতে হবে’, ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’, ‘২১ আগস্টের হামলা: সত্য বেরিয়ে আসছে, আষাঢ়ে গল্পকারদের কী হবে?’, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলাতে পারলেন না?’, ‘হাসান মশহুদ চলে যাওয়ায় ক্ষতি কার?’, ‘খুনি চক্রকে রক্ষা করেছে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা সরকার’, ‘প্রধানমন্ত্রী, বকরের মা-বাবাকে কী বলবেন?’ ইত্যাদি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলের সমালোচনার ব্যাপারে লেখকের এই প্রায়-সমদর্শিতা কিংবা অন্যভাবে দেখলে সমদূরত্বের মনোভাব দৃষ্টে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, দল দুটির জন্মের ইতিহাস কিংবা দার্শনিক ভিত্তি কি লেখকের বিবেচনায় থাকা উচিত ছিল না? পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতেই পরে, একজন সাংবাদিকের কাজ কি ইতিহাসবিদের কিংবা দার্শনিকের? সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ ও বিশ্লেষণ করে তিনি কেবল তাঁর ভাষ্যই রচনা করতে পারেন। এমনকি ভবিষ্যদ্বক্তার ভূমিকাও নিতে পারেন না তিনি। বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্ম ও বিকাশ কঠিন আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্যাতনবরণের পথে। পক্ষান্তরে বিএনপির জন্ম সেনানিবাসে, ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায়, সামরিক শাসনের গর্ভ থেকে। এটা তো ঐতিহাসিক সত্য। ফলে জিয়ার মৃত্যুর পর এই দলটির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে, পত্রপত্রিকায় এমন কথা একসময় অনেকেই লিখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সে ভবিষ্যদ্বাণীকে ভুল প্রমাণ করে, রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিএনপি দেশের একটি বৃহত্ ও জনপ্রিয় দল হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করে। কিন্তু গত দুই দশকের আচরণ বা ভূমিকা বিচারে মতিউর রহমান আমাদের দেশের এই প্রধান দুটি দলের মধ্যে তেমন পার্থক্য লক্ষ করেননি। বিশেষ করে প্রশ্নটা যেখানে গণতন্ত্র ও দায়িত্বশীল রাজনীতির। তাঁর মুক্ত গণতন্ত্র রুদ্ধ রাজনীতি  পড়ে যে-কেউ এই ধারণাতেই উপনীত হবেন।

বইয়ের প্রথম রচনাটি বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় গ্রহণ উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে লিখিত। এতে লেখক রাষ্ট্রের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে ওই ‘ছোট দেহাকৃতির সরল মানুষ’টি যেভাবে তাঁর পদের মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন, যেভাবে সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, তার কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে শেষ পর্যন্ত তা একটি অননুকরণীয় দৃষ্টান্তই হয়ে রইল।  

পাঠক বইটিতে অনেক ঘটনার পুনরুল্লেখ, অনেক বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি পাবেন। কিন্তু সেটা এ কারণে যে একই ধরনের ঘটনা বা অঘটন এ দেশে বছরের পর বছর ধরে প্রায় একইভাবে ঘটে চলেছে। ইতিহাসের ব্যাখ্যায় আমরা প্রায়ই ‘ক্রান্তিকাল’ শব্দটি ব্যবহার করি। সংকট উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা ছাড়াই, নেতিবাচক অর্থে আমাদের দেশের বেলায় সেই ক্রান্তিকালটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।

বলা হয়, জনসাধারণের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। কথাটা আংশিক হলেও সত্যি। শাসকেরা সাধারণত জনগণের এই বিস্মৃতিপ্রবণতারই সুযোগ নেয়। সাময়িক প্রসঙ্গধর্মী হয়েও মতিউর রহমানের এই লেখাগুলো তাঁর তথ্যমূল্যে ও বিশ্লেষণী গুণে কেবল আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসের একটি কালপর্বের নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবেই গণ্য হবে না, পাঠকের স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখতেও সাহায্য করবে। গবেষকদের জন্যও এ বই হবে এক দরকারি সহায়ক গ্রন্থ।