কিসিঞ্জারের বয়ানে পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থার রূপকল্প

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

ওয়ার্ল্ড অর্ডার: রিফ্লেকশনস অন দ্য ক্যারেক্টার অব নেশনস অ্যান্ড দ্য কোর্স অব হিস্ট্রি
হেনরি কিসিঞ্জার, পেঙ্গুইন প্রেস, নিউইয়র্ক, প্রথম সংস্করণ, ২০১৪, পৃষ্ঠা ২৪১।

বিশ্বরাজনীতি নানা দিক থেকে এক অস্থির সময় অতিক্রম করছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত-পরবর্তী অস্থিতিশীলতা, ফিলিস্তিন সংকট, ইরান ইস্যু, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার-পরবর্তী অবস্থা, ইউক্রেন সংকট—এ রকম বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্বনেতাদের মধ্যকার মতভিন্নতা স্পষ্ট। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের ক্ষণে সবাই যদিও অধিকতর স্থিতিশীল বিশ্বের আশা করেছিলেন, বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, গৃহযুদ্ধ, চীনের উত্থান, উগ্রবাদ—বিভিন্ন ইস্যু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে আসছে। ইসলামিক স্টেটের উত্থান মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই হুমকির সম্মুখীন করেছে। আলোচিত এ বিষয়গুলো কি শুধুই সাময়িক সংকটের প্রতিফলন? আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের ঐকমত্যে না আসতে পারা কি শুধু রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে চলমান প্রতিযোগিতা নির্দেশ করে? আন্তর্জাতিক ‘সিস্টেম’-এর ভিত্তি কি নড়বড়ে হয়ে পড়ছে? এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যাসংবলিত উত্তর সাবেক প্রতাপশালী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর ওয়ার্ল্ড অর্ডার: রিফ্লেকশনস অন দ্য ক্যারেক্টার অব নেশনস অ্যান্ড দ্য কোর্স অব হিস্ট্রি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বরাজনীতির মোড় পরিবর্তনকারী কিসিঞ্জার তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্বরাজনীতির বর্তমান সংকট ইতিহাসের দর্পণে বিম্বিত করে সহজভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন।

নয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইটিতে কিসিঞ্জার বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার উত্পত্তি, বিবর্তন, বর্তমান সংকট এবং ভবিষ্যতের আশঙ্কার কথা বিশদাকারে আলোচনা করেছেন। বিশ্বব্যবস্থার বর্তমান শক্তির বণ্টন নিয়ে রাষ্ট্রসমূহের অসন্তোষ ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে, যা বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। ভারসাম্যাবস্থায় অস্থিরতা দেখা দিলে রাষ্ট্রসমূহ আগের ব্যবস্থায় ফিরে যেতে তত্পর হয় অথবা শক্তির নতুন বিন্যাস খুঁজতে থাকে।১ বিশ্বরাজনীতি তদারক করার জন্য রাষ্ট্রের ওপর সার্বভৌম অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই—এ কথা সর্বজনবিদিত। তার পরও রাষ্ট্রসমূহের কিছু নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জাতীয় স্বার্থের ধারণার পরিবর্তন ঘটে, আর এ থেকে সৃষ্ট স্বার্থের সংঘাত সমগ্র ব্যবস্থাকেই প্রশ্নের সম্মুখীন করে। বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের নানাবিধ ব্যবহারে সচেষ্ট থাকায় তা স্বাভাবিকভাবেই অন্য অনেক রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করে। উপরন্তু গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রসার, পরিবেশবিপর্যয়, গণহত্যা এবং সন্ত্রাসবাদে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সার্বিক নিরাপত্তার ধারণাকে রাষ্ট্রসীমানার বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত করে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে অভিন্ন অবস্থান। কিন্তু যেখানে স্বাধীনতা, সার্বভৌম, জাতীয় স্বার্থ, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ—এসব মৌলিক ধারণার সংজ্ঞা পরিবর্তিত হচ্ছে তখন বিশ্বব্যবস্থায় শৃঙ্খলার অভাবের উত্থান অনিবার্য। কিসিঞ্জার তাঁর বইয়ের মাধ্যমে পাঠকদের এ বাস্তবতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

বইয়ের শুরুতে কিসিঞ্জার আন্তর্জাতিক রাজনীতির বর্তমান রূপ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বিশ্বব্যবস্থার প্রতি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপট আলোচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক সিস্টেমে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য এবং প্রকৃতি ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়।২ শক্তির ভারসাম্য আনয়নের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রসমূহের বোঝাপড়া, যার অভাব বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সমঝোতার প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির প্রতি অভিন্ন শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রসমূহের বিবর্তন এবং ইতিহাসের গতিধারা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এ ব্যাপারে কখনোই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অভিন্ন সুর ছিল না। আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অন্তর্নিহিত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ফলে বৈশ্বিক পর্যায়ে স্থিতিশীলতা বিরাজ করে, কিন্তু বর্তমানে তা এক দুর্বল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

১.

কিসিঞ্জার জাতিরাষ্ট্রসমূহের বিবর্তন উপস্থাপন করতে গিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রধারণা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আজকের সাফল্য হঠাত্ করে বেড়ে ওঠেনি। জাতিরাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভবের আগে ইউরোপের একক সত্তা ছিল না। চার্চের শক্তিচর্চার কারণে সেখানে একধরনের শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে বটে, কিন্তু যুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে পোপদের একচ্ছত্র আধিপত্য বেশি দিন টিকতে পারেনি। লেখক এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনটি বিষয়ের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, ছাপাখানার আবিষ্কার এবং খ্রিষ্টধর্মের অভ্যন্তরীণ বিবাদ (পৃষ্ঠা-১৯)। প্রোটেস্ট্যান্টদের সংস্কারবাদী আন্দোলন তত্কালীন ইউরোপীয় বিশ্বব্যবস্থার ধারণাকে পাল্টে দেয়। ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদের লড়াইয়ে সৃষ্ট ৩০ বছরের যুদ্ধ (১৬১৮-১৬৪৮) আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অনুপস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে। এ উপলব্ধি থেকে তত্কালীন বিশ্বনেতাদের প্রচেষ্টার ফলে ‘ওয়েস্টফালিয়ার চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং সে সময় থেকে আধুনিক রাষ্ট্রধারণার উদ্ভব ঘটে।

ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতি রক্ষার্থে তখন যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছিল, তার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপে স্বাভাবিক অবস্থাই বিরাজ করছিল। কিন্তু এ স্থিতিশীলতা তিনটি কারণে হোঁচট খায় বলে কিসিঞ্জার মনে করেন। এগুলো হচ্ছে জাতীয়তাবাদের উত্থান, ১৮৫৬ সালে বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া বিপ্লব এবং ১৮৫৩-১৮৫৬ সালে সংঘটিত ক্রাইমিয়ার যুদ্ধ (পৃষ্ঠা-৪৬)।

শক্তির ভারসাম্য নীতির কার্যকারিতা হারায় যখন রাষ্ট্রসমূহ জাতীয় স্বার্থের ওপর গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। রাষ্ট্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণহীন নীতি অনুসরণ করার পরিণামেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির মধ্য দিয়ে যদিও এ যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং লিগ অব নেশনসের সূচনা হয়, তবে চুক্তির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বিশ্ববাসীকে দুই দশক পরে আরেক বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন করে। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের অনিয়ন্ত্রিত আচরণকে তত্কালীন লিগ অব নেশনস সামলাতে পারেনি এবং ‘সম্মিলিত নিরাপত্তার’ ধারণা ব্যর্থ হলে প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসব ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক সিস্টেমের ভারসাম্যহীন অবস্থার ভয়াবহ রূপ তুলে ধরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে ইউরোপ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউরোপের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহের মতো রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট ‘কোল অ্যান্ড স্টিল কমিউনিটি’ আজ ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাম ধারণ করে সুসংহত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু ইউরোপের অবস্থান বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এখন গুরুত্ব বহন করলেও আঞ্চলিক সংহতির প্রতি তাদের অধিক মনোযোগের ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কতটুকু মর্যাদা থাকবে, এ নিয়ে কিসিঞ্জার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন (পৃষ্ঠা-৬০)।

২.

মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ইসলাম, খ্রিষ্ট, ইহুদি—এ তিন ধর্মের উত্পত্তিস্থল হিসেবে নীতিনির্ধারকদের কাছে এ অঞ্চল আলাদা গুরুত্ব পেয়ে আসছে। ধর্মীয় ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যবস্থার প্রতি পৃথক ধারণা পোষণ এ অঞ্চলের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। অতীত ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ আর ভবিষ্যতের কৌশলগত বিনির্মাণ—এ দুইয়ের মধ্যে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহ দোলাচলে থেকেছে। বর্তমানে এসেও গোষ্ঠীগত সংঘাত, আধিপত্যের লড়াই, পবিত্র যুদ্ধের (Holy War) ধারণা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। কেবল ভূরাজনৈতিক বিরোধ নয়, আদর্শিক মতপার্থক্য এ অঞ্চলের অস্থির রাজনীতির অন্যতম কারণ। ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেমের ন্যায় রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা আরব ইতিহাসে পরিলক্ষিত হয় না। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এ অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহ প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণার সম্মুখীন হয়। বর্তমানেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যকার অনৈক্য আন্তরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিকে ক্রমেই দীর্ঘায়িত করছে।৩ তত্কালীন বৃহত্ শক্তিসমূহ যে উপায়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে বিভক্ত করেছিল, তার মধ্যেই সুপ্ত ছিল ভবিষ্যতের বিরোধের বীজ। লিগ অব নেশনসের ম্যান্ডেট সিস্টেম এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীসমূহের ঐতিহাসিক গোষ্ঠীগত ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য আমলে নেয়নি। ব্রিটিশ সরকারের বেলফোর ঘোষণা ফিলিস্তিন সংকটের সূত্রপাত ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা কিছুটা সুসংহত হয়। কিন্তু বিরোধী মতকে সহ্য করতে না পারা, বহুমুখী সমাজের ধারণা মেনে না নেওয়ার প্রবণতা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অপরিণত করে রেখেছে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণ কারণে প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রসমূহ কঠিন সময় অতিক্রম করেছে।

কিসিঞ্জার মধ্যপ্রাচ্যের এসব সংকটের কারণ হিসেবে আদর্শিক কারণকেই বড় করে দেখছেন। তাঁর মতে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ইসলামের অনুসারী জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রকে সার্বভৌম শক্তি হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয়। যার ফলে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি হুমকিস্বরূপ বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী এ অঞ্চলে শক্তি সঞ্চার করেছে। উদাহরণস্বরূপ লেখক আল-কায়েদা, আল নুসরাহ ফ্রন্ট, তালেবান, হিযবুত তাহরীর, আইএস, বোকোহারাম—এসব সংগঠনের নাম উল্লেখ করে বলেছেন আদর্শিক কারণে আন্তর্জাতিক সিস্টেমের ধারণার প্রতি এদের অশ্রদ্ধার কথা (পৃষ্ঠা-৭৫)।

আরব বসন্তের ব্যাপক প্রসারের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রায়ণের যে আশা সৃষ্টি হয়েছিল, তা গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। স্বৈরাচারী শাসকদের পতন চাই—এ স্লোগান মধ্যপ্রাচ্যে জনজোয়ার তৈরি করলেও এর পরবর্তী বিকল্পের অনুপস্থিতি এ অঞ্চলকে আগের অবস্থাতেই নিয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনগণকে এক কাতার নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সংহতি নির্মাণ একটি আলাদা বিষয়। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান তাহরির স্কোয়ারের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই প্রতীয়মান হয়। সংখ্যালঘু বিরোধী মতকে দমন করার নীতি মুসলিম ব্রাদারহুডকে অজনপ্রিয় করে তোলে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদবিরোধী আন্দোলন মিসরের মোবারকবিরোধী আন্দোলনের মতো শুরু হলেও সিরিয়ার সংকটের মাত্রা আরও জটিল হয়ে প্রতীয়মান হয়। শিয়া-সুন্নি বিরোধ দেশটিতে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়, যার ফলে সিরিয়ার রাষ্ট্রকাঠামো আজ হুমকির সম্মুখীন হয়ে আছে। শুধু মিসর এবং সিরিয়াই নয়, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, মালি, বাহরাইনে ছড়িয়ে পড়া সংঘাতসমূহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের অপরিণামদর্শী গণতন্ত্রায়ণের নিরীক্ষার ফল বলে কিসিঞ্জার বইতে উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা-১৭৮)। তাঁর মতে, শৃঙ্খলা জনমতের ওপর ভিত্তি করে গড়ে না উঠলে তাকে চাপিয়ে দিলে তা বরং বিপর্যয় ডেকে আনে।

ফিলিস্তিন ইস্যুতে কিসিঞ্জারের লেখনীতে এক দক্ষ কূটনীতিকের ছায়া পরিলক্ষিত হয়। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যকার বিরোধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সম্ভবত সবচেয়ে জটিল একটি ইস্যুর নাম। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সিস্টেমের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য এই সংকট সমাধানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিসিঞ্জার এ সমস্যা নিরসনে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে এ দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিবর্তন, রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ এবং ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির ভবিষ্যতের গতিপথ (পৃষ্ঠা-৮১)। এ দুই দেশের সমস্যা সমাধানে স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশের ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারাও এ সংকটের দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ বলে লেখক মনে করেন। কিসিঞ্জার মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত্ স্থিতিশীলতার স্বার্থে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন। সিরিয়া এবং ইরাকের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়ে লেখক এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র যখন নিজস্ব জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার ওপর প্রভাব ফেলতে বাধ্য। মিসর, ইয়েমেন, লেবানন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সুদান, সোমালিয়া, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা আঞ্চলিক পর্যায় রাজনীতিতে উত্তাপের সৃষ্টি করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এমন অস্থির অবস্থার প্রেক্ষাপট প্রকটভাবে বিদ্যমান। ধর্মীয় বিভেদকে ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের সঙ্গে মিলিয়ে কৌশল নির্ধারণের ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের সমস্যার রাতারাতি সমাধানের সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয় না। গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রসারের যুগে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বজায়ের স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের মূল কারণ খতিয়ে দেখার জন্য কিসিঞ্জার নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দিয়েছেন।

ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের কর্মসূচির ভবিষ্যতের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য অনেকখানি নির্ভর করছে। পাশ্চাত্য দেশসমূহ ব্যাপক প্রচেষ্টা চালালেও ইরানের জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান পারমাণবিক অস্ত্রের পক্ষে বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ইরানের শক্তি অর্জন প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবসহ তুরস্ক এবং মিসরের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করবে বলে কিসিঞ্জার মত দিয়েছেন (পৃষ্ঠা-৯৯)। এ প্রেক্ষাপটে ইরানকে হুমকির বদলে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসে বিশ্বনেতাদের এ সমস্যা নিরসনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন।

৩.

পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেমের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি এ অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহের আস্থা রয়েছে বটে, কিন্তু বিদ্যমান শক্তি বণ্টন নিয়ে এখানে কিছুটা অসন্তোষও বিরাজ করে। জাতীয় স্বার্থের ক্রমবর্ধমান পরিধি থেকে সৃষ্ট সংঘাত এ অঞ্চলে মাঝেমধ্যেই অস্থির রাজনীতির সৃষ্টি করে।৪ চীন প্রাচীনকাল থেকেই আলাদা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থার প্রতি দেশটির পরিচয় খুব বেশি দিনের নয় বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব এত বেশি ছিল যে দেশটি অন্য কোনো দেশকে সমকক্ষ বলে কখনো মনে করেনি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে চীনা উত্থানের প্যাটার্ন লক্ষ্য করলে দেশটির জাতীয়তাবাদের ধারণার সঙ্গে ইতিহাসের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। মাও সেতুং চীনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শক্তির মাধ্যমে সুসংবদ্ধ করেন। দেশটির পরবর্তী শাসকেরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নীতির পরিবর্তনের মাধ্যমে চীনকে বিশ্বরাজনীতিতে অভূতপূর্ব অবস্থায় নিয়ে আসেন। বর্তমান আন্তর্জাতিক সিস্টেমের ‘রুলস অব দ্য গেম’ নির্ধারণে শুরুর দিকে চীনের অংশগ্রহণ না থাকলেও আন্তর্জাতিক সব ফোরামে দেশটি সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে (পৃষ্ঠা-১৩৩)। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে উদীয়মান শক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত শক্তির অলিখিত একধরনের প্রতিযোগিতা থাকে। সে প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধকে কেবল দুটি দেশের শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে বলে কিসিঞ্জার মনে করেন। তাঁর মতে, বিশ্বব্যবস্থার নীতিনির্ধারণে চীন সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে তার প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ ভূমিকাকে প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিচ্ছে। উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার প্রতি চীনের গুরুত্ব না দেওয়ার মনোভাব মার্কিন মূল্যবোধের ভিত্তিমূলকে আঘাত করে। লেখক স্পষ্ট করে লিখেছেন যে বিশ্বের ভবিষ্যত্ স্থিতিশীলতা অনেকাংশে নির্ভর করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শক্তির ভারসাম্যের ওপর, তবে তা অর্জনের জন্য প্রয়োজন সহযোগিতার মনোভাব। দুই দেশের রাষ্ট্রনায়কদের উপলব্ধিতে আনা প্রয়োজন যে বর্তমানে কোনো একক দেশের পক্ষে খবরদারি করা সম্ভব নয়।

বর্তমান সময়ে এসে জাপান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনে সক্রিয় হতে চায় বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চীনা উত্থান দেশটিকে প্রো-অ্যাকটিভ পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় প্রভাবিত করে। জাপান কত দিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার গ্যারান্টিভুক্ত হয়ে থাকতে চাইবে, সেটি একটি প্রশ্ন হয়ে আছে। পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যত্ স্থিতিশীলতার স্বার্থ জাপানের রাষ্ট্রনায়কদের ভাবনায় রাখতে হবে বলে কিসিঞ্জার মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারতকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে কিসিঞ্জার মনে করেন। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভারত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশটি সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতেও পিছিয়ে নেই। কিসিঞ্জার মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীল ভবিষ্যতের স্বার্থে ভারতের উচিত পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা (পৃষ্ঠা-১২১)। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ভারত পুরো অঞ্চলে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে চায় বলে প্রতীয়মান হয়। মোদির নেতৃত্বে ভারত পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থ অনুসরণে আরও তত্পর হবে বলে তিনি মনে করেন। এশিয়ায় আন্তর্জাতিক সিস্টেম কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, তা নির্ভর করবে এ অঞ্চলের দেশসমূহের সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার দক্ষতার ওপর। ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার বিবর্তনের ওপরও নীতিনির্ধারকের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে বলে কিসিঞ্জার মনে করেন। আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সংস্থা এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভৌগোলিক কারণেই পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দুই ধরনের আঞ্চলিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে উঠছে, তবে তার দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা নির্ভর করছে দেশগুলোর দায়িত্বশীল আচরণের ওপর।

৪.

আন্তর্জাতিক সিস্টেমে নিয়ে আলোচনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ব্যতীত হলে তা পূর্ণতা পায় না এবং এ ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই কিসিঞ্জার তাঁর বইয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। সাম্প্রতিক কালের বিশ্বব্যবস্থার স্বরূপ নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গণতন্ত্র, মুক্তি, মানবাধিকারের ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব পরিচালনার মূল ভিত্তি বলে মনে করে। মনরো ডকট্রিনের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র নিজ সীমানার বাইরে প্রভাববলয় বিস্তারের নীতি পরিচালনা করে আসছে।৫ মানবতার মুক্তি মার্কিন মূল্যবোধে নিহিত রয়েছে বলে মার্কিনিদের বিশ্বাস। কিসিঞ্জার এ বিষয়ে ঐতিহাসিক বিবর্তন আলোচনা করতে গিয়ে থিওডর রুজভেল্ট, উড্রো উইলসন এবং ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সময়কালীন মার্কিন আধিপত্যের রূপ তুলে ধরেছেন (পৃষ্ঠা-১৪৬-১৬০)। এ তিন রাষ্ট্রনায়কই মার্কিন জাতীয় স্বার্থকে সমপ্রসারিত করেছেন, যা আজও মার্কিন নীতিপ্রণেতাদের প্রভাবিত করে বলে কিসিঞ্জার পাঠকদের জানিয়েছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সিস্টেমে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালনে সব সময় সামনের সারিতে অবস্থান করেছে। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মার্কিনিরা নিজেদের অপরিহার্য বলে মনে করে থাকেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপীয় অর্থনীতির পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক সামরিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করে। মার্কিন বলয়ের দেশ রক্ষার্থে পরিচালিত নীতিকে যুক্তরাষ্ট্র নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বিরোধিতাকে দেশটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায়ের স্বার্থে প্রয়োজনীয় হিসেবে অভিহিত করে। কোরিয়ান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরাক ও আফগানিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র মূল্যবোধ রক্ষার ব্যাপারকেই বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে। দেশটি জাতীয় স্বার্থকে মানবতার মুক্তির স্বার্থের সঙ্গে এক করে উপস্থাপন করে। শক্তির সঙ্গে মূল্যবোধের এ সংযোগের মাধ্যমে দেশটির শাসকেরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের ভূমিকা চলমান রেখেছেন। তবে সব সময় যে তা সুফল বয়ে এনেছে তা নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রায়ণের নিরীক্ষা— এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যা চেয়েছিল, তা অর্জন করতে পারেনি। দেশটির সম্পৃক্ততা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে বলে কিসিঞ্জার স্বীকার করেছেন। ইরাকের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা আজ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্ত্রের বিস্তার সিরিয়াসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থলাভের বদলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে কিসিঞ্জার মনে করেন। নীতি প্রণয়নের জন্য দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের সাংস্কৃতিক, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলী হতে পারেনি বলে বিভিন্ন দেশে মার্কিন ভূমিকা সমালোচনার মুখে পড়ছে বলে লেখক মনে করেন, যা পক্ষান্তরে বিশ্বব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে সামনে নিয়ে আসে। বহুমাত্রিক এসব সংকট উত্তরণে দেশটির উচিত শক্তিধর অন্য দেশগুলোকে অভিন্ন অবস্থানে নিয়ে এসে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা— কিসিঞ্জার এমনটি মনে করেন এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় ভারসাম্য অবস্থা তৈরির দায়িত্ব দেশটির শাসকদের নিতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান সেসব যুগের নীতিনির্ধারণে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। মধ্যযুগে ধর্মের প্রভাব যেমন রাষ্ট্র পরিচালনায় অনস্বীকার্য ছিল, বর্তমানে তেমনি প্রযুক্তির প্রভাবকে কোনো রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না (পৃষ্ঠা-১৯২)। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার অকল্পনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় সীমানা আজ কোনো বাধা বলে মনে হয় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বজায়ের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রসার নীতিনির্ধারকদের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলো সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক অস্ত্র উত্পাদন প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ফলে একটি বাস্তবতা হয়ে দাড়াঁতে পারে—এ আশঙ্কাও রয়েছে। নন-স্টেট অ্যাক্টরদের তত্পরতা এবং আদর্শিক উগ্রপন্থা নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। দূরত্বগতভাবে আজকের বিশ্ব ছোট হয়ে এসেছে বটে, তবে ঝুঁকিও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। এ ব্যাপারে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা কাম্য। সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারেও কিসিঞ্জার যুগোপযোগী কৌশল প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্মার্টফোনের যুগে কোনো ব্যক্তি যদিও সাইবার তদারকির বাইরে নয়, তবু ব্যক্তিপর্যায়ে আন্তদেশীয় যোগাযোগের সহজলভ্যতা সন্ত্রাসবাদের পরিধিকে বিস্তৃত করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ কোনো দেশ চাইলেই এখন আর বন্ধ করে দিতে পারে না। বাস্তবতা হচ্ছে, সাইবারস্পেস এখন অনেকটাই অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে।৬ প্রযুক্তিনির্ভর সামরিক শক্তির যুগে সাইবার আক্রমণ বিশ্বপর্যায়ে প্রভাব ফেলতে পারে। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট নীতির অনুপস্থিতির ফলে অপ্রত্যাশিত কোনো পরিণাম থেকে সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অভিন্ন অবস্থান থাকা প্রয়োজন বলে কিসিঞ্জার মনে করেন।

৫.

কিসিঞ্জার বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার যে বহুমুখী আশঙ্কার কথা উপস্থাপন করেছেন, তা বাংলাদেশের জন্য বার্তা বহন করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্নায়ুযুদ্ধের কূটকৌশলগত কারণে কিসিঞ্জার প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন। চীন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার তাগিদে এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ নেমে এসেছিল, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকদের বিচলিত করেনি। নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন।৭ বাংলাদেশ সম্পর্কে কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়িবিষয়ক বক্তব্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু ৪৩ বছর পর কিসিঞ্জার আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে লিখতে বসে বাংলাদেশকে উপেক্ষা করতে পারেননি। দক্ষিণ এশিয়া আগামী দশকগুলোতে বৃহত্ শক্তিগুলোর মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এমন প্রেক্ষাপটে কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য ভারতকে পরামর্শ দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য ভারতের দায়িত্বশীল ভূমিকাই কাম্য। কিন্তু বাংলাদেশকে এড়িয়ে গিয়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারসাম্য অর্জিত হবে না—কিসিঞ্জার এ বাস্তবতা তাঁর বইয়ে স্বীকার করেছেন।

বর্তমান আন্তর্জাতিক সিস্টেমে আরও কৌশলী ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদেরও ভাবা প্রয়োজন। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের বদৌলতে বাংলাদেশ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। জনশক্তি রপ্তানি, পোশাক শিল্পের বিশ্বব্যাপী প্রসার, আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে ভালো অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের আলাদা ভাবমূর্তি অর্জিত হয়েছে। এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক সমপর্কের ক্ষেত্রে দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা পালন করা উচিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার এবং এ নিয়ে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি এখন আর অজানা নয়। ওবামা প্রশাসনের এশিয়াকেন্দ্রিক নীতির মূলে রয়েছে চীনের প্রভাব বিস্তারকে রোধ করা।৮ চীন এবং ভারতের নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং অব্যাহত সামরিক শক্তির বৃদ্ধি এ অঞ্চলের ভবিষ্যত্ প্রতিযোগিতার কথা জানান দেয়। জাপান, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশ তাদের নিরাপত্তাহীনতা এবং অসন্তোষের বার্তা দিচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগর ভূকৌশলগত দিক থেকে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করবে। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শক্তির দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান শক্তির বণ্টন নিয়ে অসন্তোষ এবং নতুন দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ভারসাম্য অর্জনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর যৌথ মহড়া, ভারতের ‘ব্লু নেভি’ প্রতিষ্ঠায় দৌড়ঝাঁপ, মিয়ানমারের পররাষ্ট্রনীতির দৃশ্যমান পরিবর্তন, রাশিয়া এবং জাপানের তত্পরতা—এ পদক্ষেপসমূহ এ অঞ্চলে এসব রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষাকেই নির্দেশ করে। ভূরাজনৈতিক এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ বৃহত্ শক্তিগুলোর নজরে রয়েছে।

বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনশীল পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কী করণীয়? বৃহত্ শক্তিগুলোর সঙ্গে কৌশলী ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশের কেমন প্রস্তুতি প্রয়োজন? কিসিঞ্জারের বই পাঠে অনুসন্ধিত্সু পাঠকের মনে এমন প্রশ্নের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি যুগোপযোগী এবং কৌশলী কর্মপরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। কোনো একটি নির্দিষ্ট শক্তির সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক না করে বংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সময়ের দাবি। চীন এবং জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে গিয়ে যেমন ভারতকে এড়িয়ে চলা কার্যকর কৌশল হবে না; তেমনি ভারতকেন্দ্রিক হয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব ভুললে তা সমীচীন হবে না। অন্যদিকে, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যেমন সুসম্পর্ক বজায় থাকা প্রয়োজন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও কৌশলগত বন্ধনের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ধরনের যোগাযোগ থাকা দরকার তা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্বের বৃহত্ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নজর এখন মিয়ানমারের দিকে। নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে এ দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান অমীমাংসিত সমস্যার দ্রুত সমাধান করে ভবিষ্যত্ সম্পর্কের টেকসই ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা। তা ছাড়া নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায়ের ক্ষেত্রেও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকদের লক্ষ্য থাকা দরকার। আন্তদেশীয় সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে তা দেশের বাজার সমপ্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের বাজারগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি বাংলাদেশের স্বার্থে কার্যকরী হবে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বিশ্বের ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার হলে বাংলাদেশ সে দেশের পুনর্বাসনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। যথাযথ পরিকল্পনা আর কৌশলের মাধ্যমে এসব সুযোগ বাংলাদেশের স্বার্থে কাজে লাগানো যেতে পারে। আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ নিজের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে কতটুকু কাজে লাগাতে পারে, তা নির্ভর করছে দেশটির প্রস্তুতির ওপর। তবে এর জন্য বিভিন্ন থিংক-ট্যাংক, একাডেমিয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মধ্যে যে ধরনের সমন্বয় থাকা প্রয়োজন, তা এখনো দৃশ্যমান নয়। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নিতে এখন থেকেই নীতিনির্ধারক এবং রাজনীতিবিদদের এ ব্যাপারে ভাবা প্রয়োজন।

বইয়ের শেষাংশে কিসিঞ্জার ইস্যুভিত্তিক সমস্যা সমাধানের ধারণা থেকে বের হয়ে ইতিহাস ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নীতি প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন। অবাধ তথ্যপ্রবাহ হয়তো মুহূর্তের খবর জানিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু জ্ঞানের গভীরতা বিপুল তথ্যের সম্ভারে নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনায় কতটুকু নিয়ে আসছেন—এ নিয়ে কিসিঞ্জার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বর্তমানের ধোঁয়াশা কাটিয়ে ভবিষ্যতের পথের আলোর দেখা পাওয়ার সার্থকতার মাঝে লুকিয়ে রয়েছে নীতি প্রণয়নের সফলতা। ডিজিটাল যুগে এসে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করে কিসিঞ্জার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনার ওপর জোর দিয়েছেন। বাস্তববাদ এবং আদর্শবাদের মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রেখে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করলে দেশে দেশে স্বার্থের সংঘাত কমে আসবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বজায়ের ক্ষেত্রে কিসিঞ্জার চারটি হুমকির কথা উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রের ধারণার পরিবর্তন, বিশ্বপর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, শক্তিধর দেশসমূহের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মতভিন্নতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তনশীল এভাব। এ জন্য আন্তর্জাতিক সিস্টেমের পুনর্গঠন জরুরি বলে লেখক মনে করেন।

সবশেষে বলা যায়, হেনরি কিসিঞ্জারের ওয়ার্ল্ড অর্ডার: রিফ্লেকশনস অন দ্য ক্যারেক্টার অব নেশনস অ্যান্ড দ্য কোর্স অব হিস্ট্রি বইটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিবর্তনের গতিপথ সম্পর্কে নির্মোহ আলোচনার এক অকাট্য দলিল। লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকলেও বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা উপস্থাপন করছেন। কেবল বর্তমানের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে লেখক সংকটের মূল কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, যা পাঠকদের বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে সহজে সামগ্রিক ধারণা দিতে সক্ষম। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখকের দুর্বলতাও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ কিংবা আফগানিস্তান যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুফল বয়ে আনেনি—এটি স্বীকার করলেও এসব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্তকে কিসিঞ্জার ভুল বলতে নারাজ। এ ছাড়া চীন, ভারত ও ইরান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেও বিশ্বব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে লেখকের কম বাক্য ব্যয় পাঠকের চোখে পড়ে। এসব সীমাবদ্ধতা ব্যতীত কিসিঞ্জার তাঁর এ বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বরাজনীতিকে একটি বইয়ের মাধ্যমে পাঠকের মাধ্যমে সহজে চিত্রায়িত করেছেন। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক যেকোনো পাঠকের মনের খোরাক জোগাতে বইটি অতুলনীয় ভূমিকা পালন করবে।

তথ্যসূত্র

1.      Hans J. Morgenthau, (2005) Politics Among Nations: The Struggle for Power and Peace, United States: McGraw-Hill, Seventh Edition, p. 180.

2.     Kenneth N. Waltz, (1979) Theory of International Politics, United States: Addison-Wesley, p. 67.

3.     Robert D. Kaplan, (2012) The Revenge of Geography: What the Map Tells Us About Coming Conflicts and the Battle Against Fate, New York: Random House, p. 181.

4.     Rana Mitter, (2013) China’s War with Japan, 1936-1945: The Struggle for Survival, London: Allien Lane Press.

5.     Howard Zinn,  (1980) A People’s History of the United States, New York: Longman.

6.     P.W. Singer, and A.Friedman, (2014) Cyber Security and Cyber War: What Everyone Needs to Know, Oxford: Oxford Universtity Press.

7.  Gary J. Bass, (2013) The Blood Telegram: Nixon, Kissinger and a Forgotten Genocide, India: Random House, p. 237.

8.     Robert D. Kaplan, (2014) Asia’s Cauldron: The South China Sea and the End of a Stable Pacific, New York: Random House.