বাগান থেকে মহাকাশ

[জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত এমন খুবই কম সংখ্যক বাংলাদেশি ব্যক্তি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অধ্যাপক মীজান রহমান তেমনই এক ব্যক্তি, যিনি আজীবন জ্ঞানচর্চায় সম্পৃক্ত ছিলেন। মূলত তিনি গণিতবিদ। তবে গণিতবিদ্যা ছাড়াও বাংলাদেশের যে কয়জন একাডেমিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন, বাংলাদেশকে পরিচিত করতে পেরেছেন দর্পভরে বিশ্বের অঙ্গনে তার মধ্যে মীজান রহমান অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন তিনি; এরপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমএ) এবং কানাডার ব্রান্সউইকে (পিএইচডি)। তারপর সেই ১৯৬৫ সালে কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে একটানা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গণিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষকের সম্মানসহ বহু সম্মানেই তিনি ভূষিত হয়েছেন।

শুধু শিক্ষক হিসেবে তিনি খ্যাতিমান তা নন, শিক্ষায়তনে সাফল্য পেতে হলে যা যা দরকার, সবই তাঁর ঝুলিতে ছিল। গণিতের বিখ্যাত জার্নালগুলোতে খুঁজলেই যে কেউ পাবেন তাঁর অসংখ্য গবেষণাপত্রের হদিস; পাশাপাশি কিছুদিন আগে গণিতশাস্ত্রের পণ্ডিত জর্জ গ্যাসপারের সঙ্গে লিখেছেন মহামূল্যবান একটি পাঠ্যপুস্তক বেসিক হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজ (১৯৯০) শিরোনামে, যেটা প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই গণিতের ছাত্রদের জন্য অবশ্যপাঠ্য পুস্তক হিসেবে বিবেচিত।

ড. মীজান বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক আলবার্তো গুনবাম এবং নেদারল্যান্ডসের গণিতবিদ এরিখ কোয়েলিংক প্রমুখের সঙ্গেও গণিতবিষয়ক বহু গবেষণা করেছেন। গণিতে তাঁর অবদান এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ১৯৯৮ সালে কানাডার ওই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তাঁকে ‘ইমেরিটাস অধ্যাপক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

অধ্যাপক মীজান পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘Distinguished Research Professor’-এর খেতাবও পেয়েছিলেন। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড এশকি নাকি তাঁকে সিম্বলিক ক্যালকুলেশনের ক্ষেত্রে ‘মাস্টার’ হিসেবে ডাকতেন। গণিত বিষয়ে বাংলাদেশের কিংবদন্তির তালিকা কেউ বানাতে বসলে মীজান রহমানকে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু গণিতের কাঠখোট্টা জগতের বাইরেও তাঁর আরেকটা পরিচিতি ছিল। তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক। তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাস লাল নদী (২০০১) পড়ে আলোড়িত হয়েছিলাম সে সময় যা এক সমাজসচেতন প্রগতিশীল সুলেখকের প্রতিচ্ছবি। আরও কিছু বই রয়েছে তীর্থ আমার গ্রাম, প্রসঙ্গ নারী, অ্যালবাম, অন্যান্য আমার দেশ, আনন্দ নিকেতন, দুর্যোগের পূর্বাভাস, ভাবনার আত্মকথন, শুধু মাটি নয় প্রভৃতি। (তাঁর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন অভিজিত্ রায়ের ‘অধ্যাপক মীজান রহমান: এক নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ’)। অধ্যাপক মীজান রহমান শুধু একজন গণিতবিদ ও শিক্ষাবিদ ছিলেন না। তিনি একই সঙ্গে মুক্তচিন্তক ও সমাজসচেতন। প্রতিচিন্তার প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। দূর থেকে এ উদ্যোগের তিনি একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মৃত্যুর ছয় মাস আগে প্রতিচিন্তার জন্য তিনি এ লেখাটি পাঠিয়েছিলেন। প্রতিচিন্তা মূলত সমাজবিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল। তাই তাঁর লেখাটি ছাপার ব্যাপারে আমাদের দ্বিধা ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর এই লেখাটি ছাপার মধ্য দিয়ে তাঁর বহুমাত্রিক জ্ঞান অনুশীলনের প্রতি রইল, আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। সম্পাদক]

এক.

ছোটবেলা থেকেই দুটি ফলবৃক্ষের গল্প শুনে এসেছি আমরা। একটি আদম-হাওয়ার ‘নিষিদ্ধ’ ফলের গল্প, আরেকটি আইজ্যাক নিউটনের গাছ থেকে আপেল পড়ার গল্প। ‘নিষিদ্ধ’ ফল বলতে যে আসলে ‘জ্ঞান’ বোঝায়, সেটা বুঝতে বেশ সময় লেগেছিল, যদিও সে যুগের (এবং এ যুগেও) লোকেরা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই মেনে নিয়েছিলেন গল্পটা (এবং যার সত্যতা বিষয়ে ধর্মগুরুরা যেমন নিঃসন্দেহ, আধুনিক বিজ্ঞানীরা ঠিক তেমনই সন্দিহান)। তবে আপেলের গল্পটি তুলনামূলকভাবে অনেক ইহজাগতিক। অতএব, বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু আসলেই কী ঘটেছিল ব্যাপারটা? আসলেই কি নিউটনের মাথাবরাবর হতভাগা আপেলটি পড়ে গিয়েছিল গাছ থেকে?

মহত্ লোকদের নিয়ে চুটকি-চাটকি গল্প সবারই পছন্দ। আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব আমরা কজন বুঝি, সেটা ভাবার বিষয়, কিন্তু তাঁর কাল্পনিক যানে করে মহাকাশ ভ্রমণের চিত্তাকর্ষক কাহিনি শুনতে কার না ভালো লাগবে বলুন। এটা চমক লাগানোর মতো গল্প তো বটেই যে বড় ভাই শূন্যে ভ্রমণের পর থেকে ফিরে এসে দেখেন ছোট ভাইয়ের বয়স তাঁর চেয়ে বেশি! এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কী হতে পারে! আপেক্ষিক তত্ত্বের এটুকু রহস্যই আমাদের জন্য যথেষ্ট—আইনস্টাইন চিরকালের জন্য আমাদের মনে গেঁথে রইলেন। সত্য-মিথ্যা কী আসে-যায়! গল্প মজার হলেই হলো।

প্রাচীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন সিরাকিউজের গ্রিক পণ্ডিত আর্কিমিডিস (খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৭-২১২)। একাধারে পদার্থবিদ, প্রকৌশলী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং সর্বোপরি সে সময়কার শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে কীভাবে? একটি শব্দ দিয়ে: ‘ইউরেকা’। মানে, ‘পেয়েছি’। আর মনে রেখেছে শব্দটা উচ্চারণ করতে করতে তাঁর বিবস্ত্র হয়ে বেরিয়ে পড়া বাড়ি থেকে। আমরা সাধারণ মানুষ যেমন লাখ টাকার লটারি জিতে ফেলতে পারলে ন্যাংটা হয়ে রাস্তায় বেরোনোর উপক্রম হই, তিনি সে রকম কোনো লটারি জেতেননি, কেবল একটা বড় আইডিয়া মাথায় এসে গিয়েছিল টবের পানিতে স্নানরত অবস্থায়। গল্পটা রসাল তাতে সন্দেহ নেই এবং সাধারণ মানুষের জন্য সেটাই যথেষ্ট। কার কী গরজ পড়ে গেছে জানার যে তিনি ছিলেন প্রকৌশলীদের অবশ্যপাঠ্য বিষয় স্ট্যাটিকস ও হাইড্রোস্ট্যাটিকসের জনক, ছিলেন পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব তত্ত্বের (specific gravity) উদ্ভাবক এবং এই আপেক্ষিক গুরুত্বের আইডিয়াটিই তাঁকে উত্তেজনার চরম শিখরে পৌঁছে দিয়ে গোসলের জায়গা থেকে বের করে দিগম্বর অবস্থায় রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিল। অনেকে হয়তো জানেও না যে রোমানদের বিরুদ্ধে গ্রিকপক্ষের যুদ্ধকালে এক মূর্খ রোমান সেনার অস্ত্রাঘাতে এই মহান ব্যক্তিটির প্রাণহানি হয়েছিল।

আইজ্যাক নিউটনের আপেলপতনের গল্পটি তেমন মজাদার না হলেও একটা চমকপ্রদ রোমান্টিকতা ছিল এতেও। আপেলের বাগান, তরুণ নিউটন ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে ডুবে আছেন তাঁর কল্পনার জগতে। এমন সময় গাছ থেকে টুপ করে একটা পাকা আপেল পড়ে গেল ঠিক তাঁর কপাল বরাবর। আর অমনি দৈববাণীর মতো তাঁর মাথায় উদয় হলো এক অসাধারণ চিন্তা—তাই তো, এ তো মহাবিশ্বব্যাপী এক গূঢ় মহাশক্তির উপস্থিতিকে ঘোষণা করছে; অনেকটা যেন ধর্মগ্রন্থের অহি নাজিলের মতোই প্রেরণা জাগানো। আসলে নিউটন নিজেই নাকি ওই আপেলবৃক্ষটিকে আদিসৃষ্টির সেই বাইবেল-বর্ণিত ‘জ্ঞানবৃক্ষ’ বলে ধারণা করে বসেছিলেন (গল্পটি বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এটা সত্য যে মহামতি নিউটন অতিশয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন এবং প্রচলিত ভূতপ্রেতজাতীয় গল্পের প্রতি যথেষ্ট দুর্বলতাও ছিল তাঁর)। যা-ই হোক, এ নিবন্ধের প্রাথমিক আলোচ্য বিষয় হলো গল্পগুলো কতখানি সত্য এবং কতটুকুই-বা পুরোপুরি বানোয়াট। নিউটনের বাগানে কি সত্যি সত্যি আপেল পড়েছিল তাঁর মাথায়? নাকি আর্কিমিডিসের গল্পের মতোই সন্দেহসংকুল?

সম্ভবত আপেলের ঘটনাটি আসলেই ঘটেছিল নিউটনের গ্রামের বাড়িতে। তাঁর অন্তত দুটি ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। প্রথম সাক্ষ্য এসেছে তাঁরই ভাইঝির স্বামী জন কনডুইট নামক এক যুবকের লিখিত বয়ান থেকে—কনডুইট পরবর্তীকালে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সহযোগী ছিলেন ইংল্যান্ডের টাঁকশালায় পরিচালকের পদে নিযুক্ত থাকাকালে। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, ১৬৬৬ সালে ব্রিটেনের ব্যাপক মহামারির সময় নিউটন কেমব্রিজ থেকে তাঁর গ্রামের বাড়ি লিঙ্কনশায়ারে মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন। ছুটিছাটায় বরাবরই তা করতেন তিনি। একদিন ভাবাকুল অবস্থায় বাগানে হাঁটাহাঁটি করার সময় গাছ থেকে একটি পাকা আপেল টুপ করে মাটিতে পড়ে তাঁর চোখের সামনে। আর অমনি তাঁর মন ছুটে গেল অন্য জগতে। এই পড়াটা অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ মনে হলো তাঁর কাছে। নিচে পড়ছে কেন? এবং ঠিক লম্বালম্বিভাবে, কোনাকুনি বা আঁকাবাঁকা হয়ে নয়। এ থেকে তিনটি জিনিস প্রতীয়মান হয়ে উঠল তাঁর মনে। এক. আপেল নিচে পড়ে, ওপরে ওঠে না, কারণ নিচের দিকেই আকর্ষণধর্মী একটা শক্তি তাকে টেনে নেয়। দুই. কোনাকুনি বা বাঁকানো পথে পড়ে না, তার কারণ আকর্ষণটি পৃথিবীর ঠিক কেন্দ্রের দিকে। অর্থাত্, মাধ্যাকর্ষণ একটি কেন্দ্রিক শক্তি (central force), যার একটা গভীর তাত্পর্য আছে। তিন. এই আকর্ষণ কেবল আপেলের বেলায় কাজ করে তা নয়, এটাই বিশ্বপ্রকৃতি—সব বস্তুর ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। প্রতিটি ভরযুক্ত বস্তুই আসলে একে অন্যকে এভাবে আকর্ষণ করে। ছোট বস্তুর বেলায় এটা লক্ষণীয় নয়, বড় বস্তু, যেমন ভূমণ্ডল, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষণীয়।

দ্বিতীয় সাক্ষ্য আমরা পাই নিউটনের ব্যক্তিগত বন্ধু (লোকটার বিশাল প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল বটে সমগ্র দেশে, কিন্তু বন্ধুসংখ্যা ছিল হাতে গোনার মতো) উইলিয়াম স্টুকলি (১৬৮৭-১৭৬৫) ও বিশিষ্ট জীবনীকার ও ইতিহাসবিদ, তাঁর বিখ্যাত বন্ধুর জীবনীতে লিখে গেছেন যে আপেলের গল্পটি তাঁর বন্ধুর নিজের মুখ থেকে শোনা—১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে, অর্থাত্ নিউটনের মৃত্যুর এক বছর আগে লন্ডনের কেনসিংটন পার্কে বসে দুজনে ঘনিষ্ঠ আলাপ করাকালে। এবং তাঁর বর্ণনার সঙ্গে জন কনডুইটের বর্ণনা প্রায় হুবহু মিলে যায়। তাতে মনে হয়, বিজ্ঞানের অন্তত এই গল্প হয়তো একেবারে মনগড়া নয়।

কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। বিজ্ঞানের তো ধারাই এটা। কোনো কিছুই চূড়ান্তভাবে মিটে যায় না। আপাতদৃষ্টিতে একটা প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেলে নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়, অনেক সময় সেই সমাধান থেকেই প্রশ্নের উদ্রেক হয়। আপেলের ঘটনা সত্য হলেও প্রশ্ন ওঠে, সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণের ধারণাটা কি হঠাত্ করে দৈববাণীর মতো পেয়ে গিয়েছিলেন নিউটন, না, আগেও একটা ইতিহাস ছিল বা ছিল কোনো বৈজ্ঞানিক আভাস-ইঙ্গিত। সাধারণত, বিজ্ঞানের কোনো বড় আইডিয়া হঠাত্ করে আকাশ থেকে পড়ে যায় না। প্রচণ্ড রকম মেধাবী কোনো ব্যক্তি একদিন ঘুম থেকে উঠে ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ বলে ঘরের বাইরে চলে যান না তাঁর সদ্যপ্রাপ্ত বৃহত্ আইডিয়া নিয়ে। বিজ্ঞানের রীতিটাই এমন যে সব সৃষ্টির পেছনেই একটা দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি লাগে, লাগে একটা চিন্তাভাবনার ধারাবাহিকতা, সেটা মৌলিক চিন্তাই হোক আর যৌক্তিক চিন্তাই হোক। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের পেছনে ৩০০ বছর আগে ছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি, যাঁর নিজেরও এক প্রকার আপেক্ষিক তত্ত্ব ছিল, যা আইনস্টাইনের চিন্তাজগতে যথেষ্ট খোরাক জুগিয়েছিল। তদুপরি ছিল নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, যা না থাকলে চট করে এত সব যুগান্তকারী ভাবনা তাঁর মাথায় প্রবেশ করার সুযোগ পেত কি না সন্দেহ। শুধু তা-ই নয়, তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় সহায় অন্য বিজ্ঞানীদের তত্ত্বকথা নয়, ফলিত বিজ্ঞানীদের পরীক্ষালব্ধ ল্যাবরেটরিজাত তথ্যসমূহ।

নিউটন কেবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্বই উপলব্ধি করে ক্ষান্ত হননি, তার প্রকৃতিও পূর্ণভাবে নিরূপণ করে গিয়েছিলেন। দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে ঠিকই, কিন্তু সেই আকর্ষণের মাত্রা কমতে শুরু করে বস্তুদ্বয়ের দূরত্বের সঙ্গে, ওটা প্রায় সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝার মতো, কিন্তু এই কমে যাওয়ার পরিমাণটা যে দূরত্বের বিপরীত বর্গের অনুপাতে, সেটা বুঝে ফেলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। নিউটন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন সহজেই। কিন্তু কীভাবে বুঝেছিলেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি কি না বিপরীত বর্গনীতি আবিষ্কারের, তারও একটা পশ্চাত্কাহিনি আছে।

মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে মানুষের কৌতূহল আজকের নয়, পুরাকাল থেকেই। বর্তমান যুগে আমরা যেমন অমাবস্যার রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে সপ্তর্ষিমণ্ডল আর নক্ষত্ররাজির মিটিমিটি আলোর রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করি, আদিযুগের মানুষও ঠিক একইভাবে তারাদের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করতেন। এ যুগে আমাদের হাতে হাজারটা যন্ত্র আছে দূর দূর নক্ষত্র, যা খালি চোখে দেখা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়, সেটা দুরবিন দিয়ে অনায়াসে দেখতে পারার। সে যুগের মানুষ তাই খালি চোখে যা দেখতেন, তারই ওপর ভরসা করে প্রকৃতির ধারা-প্রকৃতি সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতেন। তাঁরা দেখতেন চন্দ্রগ্রহ কীভাবে প্রতি মাসে নিয়মিত উদয় হচ্ছে আকাশে ছোট্ট কাস্তের আকারে, তারপর দুই সপ্তাহের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে পেতে পূর্ণ গোলাকার মূর্তিতে আকাশ-পাতাল উজাড় করে দিচ্ছে আলোয় আলোয়। সেই যে সুনির্দিষ্ট সময়ান্তর প্রতি মাসে একইভাবে উদয় হওয়া, পূর্ণ হওয়া আবার বুজে যাওয়া, সেই পর্যবেক্ষণ থেকেই জন্ম নেয় চান্দ্র বত্সর। প্রাচীন যুগে প্রায় সব দেশেই চান্দ্র বত্সরের ব্যবহার ছিল। এখন কোথাও তা ব্যবহার করা হয় না, যদিও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে প্রায় প্রতিটি মুসলিমপ্রধান ও ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলে চান্দ্রিক বত্সর অবধারিতভাবে প্রচলিত আজ পর্যন্ত। ইহুদিদের ইহুদি পঞ্জিকা আর মুসলমানদের হিজরি পঞ্জিকা পুরোপুরিই চন্দ্রানুসারী।

আধুনিক যুগে যেমন পাশ্চাত্য সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রেই অগ্রসর প্রাচ্যের অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায়, মধ্যযুগের আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল ঠিক তার বিপরীত—পশ্চিমই বরং ছিল অনেক পশ্চাতে। বিশেষ করে ভারত, চীন এবং সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের তুলনায়। সে সময় ইসলামিক সভ্যতার স্বর্ণযুগ—জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্ববিষয়ে তাঁরাই ছিলেন নেতৃস্থানীয়। ওদিকে ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ আর্যভট্ট ৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের পরিবর্তে একটি সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের মডেল তুলে ধরলেন সর্বসমক্ষে। শুধু তা-ই নয়, তিনি এও বললেন যে পৃথিবী কেবল সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণই করে না, প্রতিদিন নিজেরই একটা কক্ষপথে একবার করে ঘুরপাক খায়। তারপর ১০০০ সালে আরব জগতের বিখ্যাত গবেষক আবু রায়হান বিরুনি প্রায় একই প্রস্তাব দাঁড় করালেন সুধীসমাজে, সম্ভবত আর্যভট্টের ঘোষণা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনবহিত থেকেই (সেকালে ইন্টারনেটের গুগুল সার্চ মেশিন দূরে থাক, কাগজের ব্যবহারই শুরু হয়নি)। দুঃখের বিষয় যে পরবর্তী সময়ে বিরুনি তাঁর অগ্রমুখী মতামত থেকে দূরে সরে গিয়ে গতানুগতিক বিশ্বাস, অর্থাত্ বিশ্বকেন্দ্রিকতা এবং চান্দ্র বত্সরে ফিরে গেলেন। তারপর ১৩০০ সালের দিকে নাজম আল-দিন আল-কাতিবি নামে এক গবেষক নানা রকম ছবিটবি এঁকে প্রমাণ করতে চাইলেন যে পৃথিবী আসলেই সূর্যের চারদিকে ঘোরে, উল্টোটা নয়। কিন্তু তিনিই-বা কী কারণে বিরুনির মতো গতানুগতিক ধারায় ফিরে গেলেন, সেও এক রহস্য বটে।

এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা কি সব বিফল ছিল তাহলে? একবার এটা, একবার ওটাতে বিশ্বাস করে তাঁরা কি মানুষকে বিভ্রান্ত করছিলেন? মোটেও না। গবেষণা কখনোই ব্যর্থ হয় না, যদিও তার ফলাফল সব সময় সত্য নাও হতে পারে। দেখা গেল যে আল-কাতিবির সেই বর্জিত আঁকাজোকাগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যবহার করেছিলেন পোল্যান্ডের নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) নামের এক বিজ্ঞানমনস্ক জ্যোতির্বিদ, যদিও কথাটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি কোথাও (তাঁর নিজের আঁকা ছবির সঙ্গে কাতিবির ছবিগুলো অবিকল মিলে যাওয়াতেই বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকেরা এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন)। কোপারনিকাসের প্রণীত গ্রন্থ On the Revolution of Celestial Spheres (১৫৪৩) বলতে গেলে পশ্চিমা বিশ্বে এক অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা করে। খ্রিষ্টান চার্চের তত্কালীন টলেমি ও অ্যারিস্টোটলভিত্তিক ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বের অনড় বিশ্বাসের ভিত্তি নড়িয়ে তিনিই প্রথম স্থির বিশ্বাসের ওপর বুদ্ধি ও যুক্তির প্রাধান্য স্থাপন করে দিলেন। বইটি প্রকাশলাভের অব্যবহিত পরই তিনি মারা যান। সম্ভবত মৃত্যু তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল চার্চের অপরিসীম লাঞ্ছনা, এমনকি দৈহিক অত্যাচারের কবল থেকে। তাঁর মতামত সমর্থন করার কারণেই সমসাময়িক বেশ কজন খ্যাতনামা ব্যক্তির ভাগ্যে অসীম দুর্ভোগ নেমে এসেছিল, মহামান্য গ্যালিলিও তা থেকে রেহাই পাননি। কিন্তু চার্চ রুদ্ধ করতে পারেননি প্রগতির পথ। বুদ্ধিকে যদি তার নিজস্ব নির্বাধ পথে অগ্রসর হতে না দেওয়া হয়, তাহলে সে জাতি আত্মদহনে কালে কালে নির্বাপিত হয়ে যেতে বাধ্য। ইউরোপীয় সভ্যতা তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। কেবল ইউরোপিয়ানই-বা বলব কেন, প্রাক-মধ্যযুগের ইসলামিক সভ্যতারও তো প্রায় একই ইতিহাস। ইসলামের যে বর্তমান বাধার দেয়াল দাঁড় করানো, জ্ঞান-সাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই বাধা-নিষেধগুলো সে সময় ছিল না। এবং ছিল না বলেই আজকে আমরা ‘ইসলামিক সভ্যতা’ বলে একটা যুগের কথা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করতে পারি।

এবার আসুন আমরা সেই পুরোনো প্রশ্নে ফিরে যাই—কার আগে কে কী করেছিলেন। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং বিশেষ করে বিপরীত বর্গনীতি, উভয় আবিষ্কারের জন্যই আদি জনক হলেন রবার্ট হুক। অথচ নিউটন যখন তাঁর মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব এবং অন্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো সুবিন্যস্তভাবে প্রকাশ করেন ১৬৮৭ সালের ৫ জুলাই, তাতে তিনি হুক সাহেবের নাম উল্লেখ করেছিলেন বটে, কিন্তু ‘জনক’-এর গৌরব তাঁর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত ছিলেন না। বেচারা হুক। বিপরীত বর্গনীতি, আসলে কি নিউটন সাহেব নিজে থেকেই টের পেয়েছিলেন বাগানের গাছ থেকে আপেল পড়ার পর, না, তাঁর পেছনে একটা কাহিনি ছিল, যা তাঁকে সাহায্য করেছিল সেটাকে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। দেখা যায় যে রবার্ট হুক নামের এক সহব্রিটন (আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে ‘হুকস ল’ নামে একটা সূত্র অধ্যয়ন করেছি, তাদের কাছে নামটি মোটেও অপরিচিত নয়) মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্বন্ধে কেবল অবহিতই ছিলেন না, এ শক্তি যে বিপরীত বর্গনীতি পালন করে, সেই মর্মে পেপারও লিখেছিলেন এবং সে পেপার ব্রিটেনের সম্মানিত প্রতিষ্ঠান ‘রয়েল সোসাইটি’তে পাঠ করেছিলেন ১৬৭০ সালের ২১ মার্চ। তদুপরি পেপারটি তিনি স্বয়ং আইজ্যাক নিউটনের কাছে ডাকযোগে প্রেরণ করেছিলেন ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। এতে কি প্রমাণিত হয় যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সত্যিকার জনক ছিলেন রবার্ট হুক, নিউটন নন? নিউটনের বৈজ্ঞানিক নিবন্ধসমূহ (মাধ্যাকর্ষণ শক্তিসহ) মুদ্রিত আকারে প্রকাশলাভ করে ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ Philosophiae Naturalis Principia Mathematica -তে। তাতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও বিপরীত বর্গনীতির আইডিয়াটির আদ্যোপান্ত ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন এবং হুক সাহেবের যেটুকু কৃতিত্ব প্রাপ্য বলে মনে হয়েছিল, সেটুকু স্বীকৃতি দেওয়ায় মোটেও কার্পণ্য করেননি। রবার্ট হুকের রয়েল সোসাইটিতে পড়া পেপার এবং তাঁর ব্যক্তিগত পত্র সবই তিনি উল্লেখ করেছেন, যা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন যেকোনো গবেষকের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং পেশাগতভাবে শোভন ও অভীষ্ট। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, বিপরীত বর্গতত্ত্ব এবং এ-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যের মূল আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর নিজস্ব দাবি প্রত্যাহার করতে রাজি ছিলেন না। তাঁর যুক্তিটা ছিল এ রকম: ঠিক আছে, মানছি যে রবার্ট হুক এবং তাঁর আগে আরও দু-একজন গবেষক এই শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন, এমনকি এই শক্তি যে দূরত্বের সঙ্গে বিপরীত বর্গের নিয়মে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, সেটাও তাঁদের কাজের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এই তথ্যগুলো যে সত্যি সত্যি প্রকৃতির সব পদার্থের বেলায় প্রযোজ্য, তার কোনো প্রমাণ তাঁরা দেননি। কোনো গাণিতিক গণনাকার্য দ্বারা তাঁদের সিদ্ধান্তগুলো সুদৃঢ় যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পারেননি। তিনি বললেন যে তত্ত্বগুলোর নির্ভুল প্রমাণের জন্যে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার। যেহেতু মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই গ্রহ-নক্ষত্রের নিত্য এবং নিয়মিত প্রদক্ষিণ, বিশেষ করে আমাদের সৌরমণ্ডলের সূর্যের চারদিকে পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহের বার্ষিক আবর্তন, সেসব চাক্ষুষ তথ্যাবলির সঙ্গে হুবহু না হলেও অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো তত্ত্বই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে না। তিনি যেসব তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন, সেই কাজ অত্যন্ত সফলভাবে করে, কিন্তু হুক বা তাঁর পূর্ববর্তী অন্য গবেষকেরা সে ধরনের পাকাপাকি কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে পারেননি। উপরন্তু, নিউটন যুক্তিসংগতভাবেই দাবি করলেন যে তিনি বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইউহান কেপলারের (১৫৭১-১৬৩০) প্রামাণিক তথ্যসমূহ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে তাঁর গাণিতিক ফলাফলের সঙ্গে সেগুলো সুন্দরভাবে মিলে যায়। সর্বোপরি, তিনি গণিতের যে অংশটি আবশ্যিকভাবেই ব্যবহার করেছিলেন, সেটা তাঁর আগে কেউ ব্যবহার করতে পারেননি। কারণ, তাঁর প্রণেতা নিউটন স্বয়ং ক্যালকুলাস বা কলনশাস্ত্র।

কিন্তু কেপলারের পরীক্ষিত তথ্যগুলো কী, সেটা তো বলা হলো না এখনো। কেপলার সম্পূর্ণ নিজের কল্পনাতেই সৌরমণ্ডলের গ্রহ-উপগ্রহগুলোর গতিবিধি নির্ধারণ করতে পেরেছিলেন তা নয়। সেকালের বড় মাপের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কেপলারের পূর্বসূরি ছিলেন টাইকো ব্রাহি (১৫৪৬-১৬০১) নামের এক অসাধারণ প্রতিভাধর বিজ্ঞানী। তাঁর জন্ম ডেনমার্কে, যদিও তাঁর জন্মস্থানটি বর্তমানে সুইডেনের অংশ। তিনি ছিলেন দুরবিনের পোকা—সারাক্ষণ দুরবিন নিয়ে মজে থাকতেন আকাশের তারাদের গতিপথ আবিষ্কারের আশায়। একটু রগচটা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক—কারও সঙ্গেই খুব একটা সুসম্পর্ক রাখতে পারতেন না। এমনকি ডেনমার্কের রাজার সঙ্গেও রাগারাগি করে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগ শহরে। সেখানে তাঁকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয় মনের খুশিতে গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে দুরবিন উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকার। বেশ বড় রকমের একটা প্রেক্ষাগৃহও তৈরি করে দিয়েছিলেন প্রাগের তত্কালীন শাসনকর্তা। একা একা সব কাজ কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না বলে ইউহান কেপলার নামের এক মেধাবী জার্মান তরুণকে নিযুক্ত করলেন সহকারী হিসেবে। সেটা ছিল ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ। শুরুতেই দুই প্রতিভার ঠোকাঠুকি লেগে গেল, প্রধানত কেপলারের পারিতোষিক নিয়ে। যা-ই হোক, সেটা মীমাংসা হয়ে যাওয়ার পর দুই বিজ্ঞানী উঠে-পড়ে লেগে গেলেন সৌরমণ্ডলের সঠিক প্রকৃতি নির্ধারণ করার কাজে। ভাগ্যের এমনই লিখন যে তার ঠিক এক বছর পরই মান্যবর ব্রাহি অন্তর্ধান করেন। তাঁর অবর্তমানে প্রাগের বিচক্ষণ শাসনকর্তা কেপলারকেই নিযুক্ত করে ফেললেন ব্রাহির স্থলে। কেপলার ব্রাহির দুরবিনলব্ধ বেশ কিছু তথ্য সৌরমণ্ডলের নিয়মকানুন হিসেবে গ্রহণ করে দুটি সূত্রের ওপর আস্থা স্থাপন করেন। সেগুলো এ রকম:

১. সৌরমণ্ডলের সব গ্রহ (পৃথিবীসহ) অধিবৃত্ত পথে প্রদক্ষিণ করে সূর্যের চারপাশে (কোপারনিকাসের ধারণা ছিল, গ্রহপথগুলো বৃত্তাকার। বৃত্তের প্রতি পুরাকাল থেকেই মনীষীদের একটা দারুণ পক্ষপাতিত্ব ছিল। তাঁরা ভাবতেন যে বৃত্ত, গোলক—এগুলো হলো ‘নিখুঁত’, এবং যেহেতু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনায় খুঁত থাকা সম্ভব নয় সেহেতু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যাবতীয় জ্যামিতিক আকৃতিকেও নিখুঁত হতে হবে। কোপারনিকাস নিজেও সেই আদর্শ বিশ্বাস করতেন)।

২. এই প্রদক্ষিণের বেগটা এমন যে গ্রহ থেকে সূর্য বরাবর একটি সরলরেখা আঁকতে পারলে দেখা যাবে, রেখাটি সমান সমান সময়ে সমান সমান এলাকা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

তিনি দাবি করেন যে সূত্রগুলো দুরবিনের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ দ্বারা দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ঘোষণার সময় ছিল ১৬০৯ সাল। কেপলারের তৃতীয় একটি সূত্র আছে:

৩. সূর্যের চারপাশে পুরো একবার ঘূর্ণনের জন্য যে সময় ক্ষেপণ হয় তার বর্গ হলো তার অধিবৃত্তটির পরাক্ষের অর্ধাংশ নিয়ে তার তৃতীয় মাত্রার সমানুপাতিক সম্পর্কে সংযুক্ত। এতে করে প্রতিটি গ্রহের সৌরবত্সরের সঙ্গে তাঁর জ্যামিতিক অধিবৃত্তের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। অর্থাত্ সূর্য থেকে দূরত্ব যত হবে, ততই লম্বা হবে তার বত্সর। সেটা হয়তো সাধারণ বুদ্ধিতেই বুঝে নেওয়া যায়, কিন্তু ঠিক কী নিয়মে তা ঘটে, কেপলারের দুরবিন তাঁকে সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। উল্লেখ্য, এই সূত্র পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁকে পুরো ১০ বছর ধরে চিন্তাভাবনা করতে হয়েছিল। এর প্রকাশকাল ছিল ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দ।

এখন কথা হলো, রবার্ট হুক কেপলারের সূত্রগুলো সম্বন্ধে জানতেন কি না কিছু। যদি-বা জেনে থাকেন, তার ব্যবহার প্রকাশ পায়নি তাঁর সপ্তদশ শতকের সপ্তম দশকের প্রকাশিত গবেষণার মধ্যে। খুব সম্ভব উপায়ও ছিল না তাঁর এবং সে কারণেই হয়তো তাঁর বৈজ্ঞানিক ঘোষণাগুলো কোনো পরীক্ষাগারিক তথ্য দ্বারা সমর্থন করতে সক্ষম হননি। নিউটন তা পেরেছিলেন। কারণ, তাঁর হাতে তখন এক মোক্ষম হাতিয়ার তৈরি হয়েছিল, যার নাম ক্যালকুলাস, যেটা তাঁর নিজেরই আবিষ্কার। উপরন্তু, তাঁর কাছে দ্বিতীয় আরেকটি মোক্ষম অস্ত্র ছিল—বস্তুর গতিসূত্রত্রয় (Three laws of Motion), যা নিউটনের নিজেরই উদ্ভাবন। ক্যালকুলাসের সঙ্গে গতির ত্রিসূত্র ব্যবহার করে তিনি অনায়াসে দেখিয়ে দিলেন যে গাণিতিক গণনার সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীত বর্গসূত্র জুড়ে দিলে কেপলারের সৌরমণ্ডলের গতিবিষয়ক তিনটি সূত্রই অনায়াসে বের হয়ে আসে, যা বর্তমান যুগের স্নাতক শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা ঘরে বসেই কষে ফেলতে পারে। ইউনিভার্সিটির ফলিত গণিতের ক্লাসে আমি নিজেও করেছি সেটা। অবশ্য নিউটন গোড়াতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন কেপলারের সূত্র প্রমাণ করতে, তাতে ক্যালকুলাস প্রয়োগ করা হয়নি, প্রয়োগ করেছিলেন সেকালের জনপ্রিয় জ্যামিতিক পদ্ধতি। সেটা আজকের ছেলেমেয়েদের জন্য চট করে বুঝে ফেলা সহজ হবে না। বলা যায়, তাঁর জ্যামিতিক যুক্তিগুলো বেশ জটিলই মনে হবে এ যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে।

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, গ্রামের বাড়ির আপেলবাগানে যখন গাছ থেকে আপেল পড়ে গেল তাঁর মস্তক বরাবর, তখন কি তিনি আগেকার গবেষকদের মাধ্যাকর্ষণবিষয়ক চিন্তাভাবনার কথা জানতেন? সে সময় তাঁর বয়স ২৪, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা ও গণিতের সেরা ছাত্র। ফ্রান্সের ইসমায়েল আর আরব বিজ্ঞানীদের কাজের কথা শুনেও থাকতে পারেন। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যে বিপরীত বর্গের আইন পালন করে, সেটা কেউ হলফ করে বলতে পারেননি। কারণ, তাঁদের কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীরা কেউ কেউ অনুমান করে বলেছেন বিপরীত বর্গের কথা, এমনকি কেপলার এমন মতামত রেখে গেছেন যে আইনটি সম্ভবত বিপরীত বর্গ নয়, শুধু বিপরীত মাত্রাই। অর্থাত্ দূরত্ব যত বাড়বে, আকর্ষণের তীব্রতা ততই কমবে, তবে ভগ্নাংশটি ১/(দূরত্ব) অনুসারে, ১/(দূরত্ব)*২ অনুসারে নয়। সমস্যা হলো যে কেপলার সাহেবও কোনো প্রমাণ দাঁড় করাতে পারেননি।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আপেলপতনের দৃশ্য থেকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রকৃতি সম্বন্ধে নিউটনের মনে যে প্রেরণা উদয় হয়, সেটা ছিল পুরোপুরি মৌলিক, কারও কাছ থেকে ধার করা নয় এবং তাতে তাঁর তীক্ষ ধীশক্তির পরিচয়ই শুধু প্রকাশ পায় না, তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণশক্তি ও অবরোহী ক্ষমতার স্বাক্ষর বহন করে। মানুষটি আপাদমস্তক একজন বিশুদ্ধ সৃষ্টিশীল প্রতিভাধর ছিলেন, যাঁর সমকক্ষ বিজ্ঞানী হাজার বছরে একজন হয় না।

আমার নিজের অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে, ছাত্রাবস্থায়, কল্পনা করেছি এমন কোন শক্তির অস্তিত্ব প্রকৃতির মধ্যে, যেখানে আকর্ষণ বা বিকর্ষণের শক্তি বর্গের নিয়মে ঘটে না, সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়মে চলে। অর্বাচীন মন, যৌবনের আকাশকুসুম কল্পনা। এখন বুঝি যে প্রকৃতির নিয়মগুলো এমনই যে তার থেকে একটু উনিশ-বিশ হলেই আমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকত না। নিউটন তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত গাণিতিক পদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে কেপলারের সৌরমণ্ডলসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো সত্য হলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিপরীত বর্গ পালন করতে বাধ্য। তার উল্টোদিক থেকে ভাবতে গেলে বিপরীত বর্গের একমাত্র ফলাফলই হলো কেপলারের সূত্র নির্ভুল।

মজার ব্যাপার হলো যে এই বিপরীত বর্গের প্রতি প্রকৃতির যেন একটা বিশেষ পক্ষপাতিত্ব আছে। পদার্থের পারস্পরিক আকর্ষণের ক্ষেত্রেই কেবল নয়, চুম্বক, স্থিত তড়িত্ (Static Electricity), আলো বিকিরণ—এসবের মধ্যেও সেই একই নিয়মের প্রভাব দেখা যায়। দুটি বিদ্যুত্কণা যেমন একে অন্যকে টানে বিপরীত বর্গের নিয়মে, দুটি চুম্বককণাও ঠিক সেভাবেই টানে বা ঠেলে দেয় (বিপরীত মেরু বা সমমেরু অনুসারে)। অনুরূপভাবে, একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে টর্চলাইট জ্বেলে যদি সে আলোর বিকিরণ লক্ষ করা হয় গোলাকার (যার কেন্দ্র হচ্ছে সেই আলোর উত্সটি) কোনো পাতের ওপর, তাহলে দেখা যাবে পাতটি যতই দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই আলোর বিন্দু থেকে ততই তার জ্যোতি কমে যাচ্ছে ঠিক সেই অনুপাতেই, অর্থাত্ বর্গের নিয়মে। এর একটা সহজবোধ্য কারণও আছে—কেন্দ্র থেকে পাতটির মাঝখান পর্যন্ত যে দূরত্ব, সেটি হলো গোলকের ব্যাসার্ধ এবং ওই গোলকাংশটুকুর আয়তন সেই ব্যাসার্ধের বর্গেরই অনুপাতে; অতএব এটা সহজেই অনুমানসাপেক্ষ যে ওই টর্চের আলো থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মির তীব্রতা হ্রাস পাবে বিপরীত বর্গেরই অনুসারে, যতই তার দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে আলোর উত্স থেকে। অর্থাত্ এখানেও সেই একই বিপরীত বর্গনীতির প্রযোজ্যতা প্রকাশ পেল।

নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আর বিপরীত বর্গনীতির সঙ্গে পূর্ববর্তী গবেষকদের একটা জায়গায় বড় পার্থক্য—অন্যেরা এই তত্ত্বের প্রয়োগশীলতা যে কেবল স্থানীয় পরিবেশে অবস্থিত দুটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ঊর্ধ্বাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রসহ সমগ্র বিশ্বচরাচরেই সমানভাবে প্রযোজ্য, সেটা তাঁরা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি, সম্ভবত তাঁদের কাছে কোনো পরীক্ষিত প্রমাণ ছিল না বলেই। কিন্তু নিউটনের তা ছিল এবং সে কারণেই তাঁর তত্ত্বে ছিল বিশেষভাবে আকর্ষণীয় একটি উপাদান—সর্বজনীনতা, যা তাঁদের তত্ত্বে ছিল না।

কথা হলো, নিউটনের তত্ত্ব কি একেবারেই নিখুঁত, নির্ভুল? বহুলাংশে তা-ই। সাধারণ ব্যবহারের জন্য তাঁর প্রদত্ত তথ্যসমূহ এখনো পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়, এমনকি বর্তমান যুগের মহাশূন্যযানের প্রকৌশলশাস্ত্রেও। তবে সংসারের অন্যান্য বিষয়ের মতো বিজ্ঞানেরও বিবর্তন বলে একটা কথা আছে—সময়ের সঙ্গে তার অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনাগুলো নতুন যুগের আলোকে পুনঃপরীক্ষার বিষয় হয়ে ওঠে। উঠে আসে উন্নততর যন্ত্রপাতি, তৈরি হয় আধুনিকতর গবেষণাগার। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে বিজ্ঞানীদের উপলব্ধির নাগালে এসে গেল যে নিউটনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তত্ত্বে একটা জিনিস স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও যে আলোর গতি অসীম। সেটা আসলে সত্য নয়—আলবার্ট আইনস্টাইনের গবেষণা থেকে সেটা অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ফুটে উঠেছে। তদুপরি তাঁর গবেষণা প্রকাশলাভের বেশ আগেই আমেরিকান পদার্থবিদ মাইকেলসন আর মর্লির পর্যবেক্ষণে সেই একই তথ্য পরিষ্কারভাবে বের হয়ে এসেছে। তবে কথাটা হলো: এই নবার্জিত জ্ঞান কি নিউটনের বলবিজ্ঞান, বিপরীত বর্গনীতিসহ মাধ্যাকর্ষণবিষয়ক যাবতীয় তত্ত্বকে একেবার নাকচ করে দেয়? মোটেও না। সাধারণ ব্যবহারের জন্য নিউটন এখনো রাজার আসনে বসে আছেন এবং সম্ভবত থাকবেনও আজীবন। পরিবর্তন যা হয়েছে, সেটা কতগুলো ছোটখাটো বিষয়ে, যেমন বুধ গ্রহটির গতিপরিক্রমায় একটা সূক্ষ্ম ব্যাপার ছিল, যা নিউটনের তত্ত্বের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছিল না, কিন্তু আইনস্টাইনের অভিনব তত্ত্ব প্রদত্ত গণনায় সেগুলো প্রায় নিখুঁতভাবে মিলে যায়। তদুপরি নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো সীমা নেই, আইনস্টাইন বলছেন, না, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য নয়। সীমা আছে বৈকি, মহাবিশ্বের সীমানা সেখানে যত দূর আলোকরশ্মি ভ্রমণ করতে পারে অপ্রতিহত অবস্থায়। তাঁর যুগান্তকারী যুক্তিসমূহের মধ্যে একটি হলো যে আলো ভরশূন্য হলেও বড় নক্ষত্র দ্বারা প্রভাবিত, আলো তার কাছে এসে বেঁকে যায়, কারণ সেই নক্ষত্রটি তাকে টেনে নিচ্ছে, যেমন নেয় ভরযুক্ত বস্তুকে। স্বভাবতই এসব সূক্ষ্ম বিষয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একেবারেই প্রযোজ্য নয়, আমরা নিউটনকে পেয়েই খুশি।

দুই.

নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো এই যে এতে কেবল দুটি বস্তুর পারস্পরিক আকর্ষণের কথা বলা হয়েছে। যতক্ষণ আমরা দুই বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি, ততক্ষণ নিউটন অপরাজেয়। তাঁর বিপরীত বর্গনীতি আর গতিসূত্র—দুয়ে মিলে উভয় বস্তুর গতিপথ নিখুঁতভাবে বের করে দেবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দুই বস্তুর মধ্যে সীমিত থাকা ঘটনা কত আর দেখা যায়। বিশেষ করে গ্রহ-নক্ষত্রের বেলায় এটা জলের মতো পরিষ্কার যে একটা গ্রহ বা উপগ্রহ একাধিক বিশাল ভরবিশিষ্ট বস্তুর নৈকট্য দ্বারা প্রভাবিত। যেমন ধরুন, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী চন্দ্র গ্রহ—বেচারা আমাদের উপগ্রহের উপাধি পেয়েছে। কারণ, তার কপালটিই এ রকম যে ক্ষুদ্র হওয়ার অপরাধে তাকে সূর্যের চারদিকে নয়, পৃথিবীরই চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে।

কিন্তু তাতে বিষয়টা সরল হয়ে যায় না, বরং নতুন এক জটিলতার মাত্রা যোগ হয়। এখন একই পাড়ায় দুটি নয়, তিনটে নায়ক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে—একদিকে সর্বাধিনায়কের আসনে নিজ গাম্ভীর্যময় আলোকসত্তা নিয়ে বসে আছেন সূর্যদেব। আরেক দিকে তাঁরই অমোঘ আকর্ষণের বলয়ে আবদ্ধ হয়ে আছেন আমাদের পৃথিবী, অপর দিকে রয়েছেন ক্ষুদ্রতর চন্দ্র গ্রহ, যাঁর আকার ছোট হলেও তাঁরও আকর্ষণ নেহাত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো নয়। সুতরাং, মহাকাশের একই পরিবেশের মধ্যে দুটি নয়, তিনটি খেলোয়াড় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, নিউটনের তত্ত্ব যদি দুই বস্তুর সীমানায় আবদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও অকেজো হয়ে যায় এই ত্রিদেহী জটের মধ্যে? না, সৌভাগ্যবশত তা হয় না, এখানেও দ্বিদেহী ক্রিয়ার মতো মাধ্যাকর্ষণ শক্তিসহ নিউটনের বলবিদ্যার সমীকরণসমূহ সমভাবে প্রযোজ্য। সমস্যা যেটা দাঁড়ায়, সেটা হলো যে দ্বিদেহী তত্ত্বের মতো বস্তুগুলোর গতিপথ চট করে বেরিয়ে আসে না দু-চারটে অঙ্ক কষার পর। আসলে চট করে দূরে থাক, আদৌ বের হয় কি না সন্দেহ। প্রথম দিকে নবীন-প্রবীণ সব রকম গবেষকদের ধারণা ছিল, এটা কোনো সমস্যা হলো? নিউটনের গতিবিষয়ক সমীকরণগুলো থাকতে চিন্তা কিসের। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। যুগে যুগে বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ মাথা ঘামিয়েছেন ত্রিদেহী সমস্যার সমাধান পেতে। ইংরেজিতে একে বলা হয় থ্রি-বডি প্রবলেম, যা নিউটনের সময়কার টু-বডি প্রবলেম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং যার জটিলতার মাত্রা একবারে সীমা ছাড়ানো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষক এ সমস্যার বিশেষ বিশেষ সমাধান বের করেছেন সীমিত শর্তাদি ব্যবহার করে এবং অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো কাজেও লেগেছে। কিন্তু কোনো রকম শর্ত আরোপ না করে পূর্ণ প্রয়োগযোগ্যতাশীল সমাধান বের করতে, অন্তত নিউটনের কলনশাস্ত্র ব্যবহার করে, আজ পর্যন্ত কেউই সক্ষম হননি।

তর্কের খাতিরে প্রশ্ন তোলা যায়, আচ্ছা, আমরা থাকি এই মহাবিশ্বে, মাধ্যাকর্ষণ বলয়ের বাইরে কোনো দিনই আমাদের যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, অতএব আমাদের সাধারণ জীবনধারণের জন্য একাধিক গ্রহের পারস্পরিক ঠোকাঠুকি নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারই-বা কী! অনর্থক একটা কাল্পনিক বিষয় নিয়ে অজস্র টাকা খরচ করে কী লাভ হবে আমাদের। এ প্রশ্নের অন্তত দুটি উত্তর, যা মানবকুলের সবার জন্যই প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়। প্রথমটি হলো আমাদের জ্ঞানের সীমানা কোথায়, সেটা তন্নতন্ন করে খুঁজে নেওয়ার অন্তহীন প্রচেষ্টা আমাদের মনুষ্যত্বকে একটা ভিন্ন মাত্রা দান করে। এই যে প্রতিদিন রাতের আকাশে এত এত গ্রহ-নক্ষত্রের সমাবেশ, যা কবি আর বিজ্ঞানীকে সমভাবে অনুপ্রাণিত করে গেছে অনাদিকাল থেকে, তাদের সঙ্গে আমাদের এই ভূখণ্ডটির আসল সম্পর্কটা কী? এটা যদি জানতে পারি, তাহলে আমাদের আদি ইতিহাস—আমাদের অস্তিত্বের আগাগোড়া পরিক্রমা—কোথায় আমাদের যাত্রা শুরু, কোথায়ই-বা শেষ, তার কিছুটা হদিস হয়তো পাওয়া যেতে পারে।

তবে দ্বিতীয় একটি মাত্রা আছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জরুরি—শূন্যে ভ্রমণ। বলবেন, শূন্যেই-বা যেতে হবে ভ্রমণের জন্য কে বলল? লোকে ফ্লোরিডা যায়, মেক্সিকো যায়, বড়জোর ইউরোপে। শূন্যে যাবে কোন পাগল? হ্যাঁ, পাগল বটে। বড় বড় বিজ্ঞানী ও গবেষক আসলেই পাগল। পাগল না হলে কি জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দিনরাত ল্যাবের ঘিঞ্জি ঘরের ভেতর যন্ত্রপাতি নিয়ে সময় কাটান? কী জানেন? তাঁরা কাটান বলেই আমাদের জীবন আজকে এত আরাম-আয়েশময় বিলাসদ্রব্য দ্বারা পরিপূর্ণ হতে পেরেছে। এত সব ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের মহাপ্লাবনে ভেসে যাচ্ছে আমাদের জীবন, সেই পাগলগুলোর কারণেই। তা ছাড়া আমরা সবাই জানি, ১৯৬৯ সালে মানুষ সশরীরে চন্দ্র গ্রহে গেছে মহাকাশের শূন্যযানে করে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মঙ্গল গ্রহেও যাওয়া হয়ে যাবে। এই যে শূন্যে ভ্রমণের ব্যাপারটি, এখানেই অনিবার্যভাবে দাঁড়িয়ে যায় বহুদেহী আকর্ষণ তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা। আমরা দূরদর্শনেই দেখেছি, ঊর্ধ্বলোকের একটা উচ্চতায় পৌঁছানোর পর যাত্রীরা কার্যত ‘ওজনহীন’ অবস্থায় দাঁড়িয়ে যায়—যানের অভ্যন্তরে তারা ভাসতে শুরু করে নদীর মাছের মতো। এরপর যতই ওপরে উঠতে থাকে, ততই নতুন গ্রহ-উপগ্রহদের পরিপাশে চলে আসে একসময়। তখন আবার নতুন করে ভিন্ন রকম মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বলয়ের মধ্যে নিজেদের অবস্থিতি উপলব্ধি হতে শুরু করে। হয়তো একটি নয়, একাধিক বিপুলদেহী বস্তুর টানে তারা এক প্রকার দিশেহারা হয়ে যায়—সে টানে এদিকে, ও টানে ওদিকে। অর্থাত্ একটি অতিবাস্তব বহুদেহী পরিস্থিতি। এর মাঝে নিউটনের বিপরীত বর্গনীতি অকেজো হয়ে যায় তা নয়, কিন্তু শূন্যযানের যাত্রাপথের মানচিত্রটি চট করে অঙ্ক কষে বের করে ফেলা একরকম দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। অথচ মহাশূন্যে যান প্রেরণের আগেই তার যাত্রাপথ সঠিকভাবে নিরূপণ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার মানে, যে করেই হোক একটা নিখুঁত বা প্রায় নিখুঁত মানচিত্র দাঁড় করাতেই হবে, সেটাই হলো যাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের জ্ঞানী-গুণী বিজ্ঞানীদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

কিন্তু তার উপায় কী? নিউটনের মতো সোজা অঙ্ক কষে যদি সেটা জানা সম্ভব না হয়, তাহলে বিকল্প আর কী পন্থা আছে?

সেসব কারণে ত্রিদেহী এবং বহুদেহী তত্ত্বের প্রতি গাণিতিকদের মনোযোগ একটা জরুরি পর্যায়ে পৌঁছে যায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। তাঁরা উঠেপড়ে লেগে যান প্রথম তিন বস্তু, পরে বহু বস্তুসংবলিত সমাবেশে তাদের গতিপথের প্রকৃতি কী হবে, তা গণিতের মাধ্যমেই উদ্ধার করা। রীতিমতো একটা থমথমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায় বলবিদ্যাবিষয়ক গণিতের গবেষণায়। ঠিক এই সময় ঘটে এক অভিনব ঘটনা।

তিন.

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তত্কালীন যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন আর নরওয়ের রাজা তৃতীয় অস্কার তাঁর ষষ্ঠ দশম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটা এককালীন পুরস্কার ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজা অস্কার ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞনের প্রতি দারুণ আকৃষ্ট। বিশেষ করে গণিতের প্রতি। বর্তমান যুগের রাজা-বাদশাদের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্যজনক মনে হলেও এটা সত্য যে সে যুগে জ্ঞানের প্রতি প্রচণ্ড একটা আকর্ষণ ছিল অনেক নৃপতিরই। সে সুবাদেই তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সে সময়কার সুইডেন, তথা সারা ইউরোপের সেরা গাণিতিকদের মধ্যে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব মিটাগ-লেফ্লার (১৮৪৬-১৯২৭)। নামটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে হয়তো। মিটাগ তাঁর প্রথম নাম আর লেফ্লার পারিবারিক, নাকি উল্টোটা? আসলে কোনোটাই না। লোকটা সত্যি সত্যি একটু ভিন্ন প্রকৃতির পুরুষ ছিলেন। ঠিক নারীবাদী না হলেও নারীর সমান অধিকার এবং সামাজিক সম্মানের প্রতি ছিলেন দারুণ সহানুভূতিশীল এবং সে সময়কার চিন্তাধারার পরিপ্রেক্ষিতে ভীষণ মুক্তমনা। তাঁর বাবার নাম ছিল মিটাগ আর মায়ের অবিবাহিত নামটি ছিল লেফ্লার। জন্মকালে মিটাগ হলেও পরে তাঁর সঙ্গে মায়ের নামটি নিজেই যুক্ত করে নিলেন—হয়ে গেলেন মিটাগ-লেফ্লার। গণিতজগতের অত্যন্ত সম্মানিত একটি নাম। সুইডেনের অধিবাসীদের কাছে তিনি একজন জাতীয় হিরো।

মিটাগ-লেফ্লার সেকালের সর্বাধুনিক অমীমাংসিত গাণিতিক সমস্যাগুলো সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন। জানতেন যে দাঁত-বসানো-শক্ত এমন সব সমস্যার মধ্যে একেবারে চূড়ায় বসে আছে ভরযুক্ত বস্তুর ত্রিদেহী, তথা বহুদেহী সমস্যা। তাই এটিই হোক রাজার জন্মদিনের নির্বাচিত সমস্যা, মনে মনে ঠিক করে ফেললেন তিনি। রাজা অস্কারের কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন এবং সে অনুযায়ী গণিতজগতে বিস্তারিতভাবে সিদ্ধান্তটি প্রচারিত হয়ে গেল।

প্রতিভার স্বভাবটাই এমন যে সমস্যা যত কঠিন হবে, তার প্রতি আকর্ষণটাও তেমন প্রবল হবে। তারা চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে। সেকালের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টিকারী গাণিতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে ত্রিদেহী সমস্যা ছিল একেবারে প্রথম সারিতে। অতএব, ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশ-বিদেশের মেধাবী গবেষকদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। একে তো সমস্যাটি এমনিতেই আকর্ষণীয়, তার ওপর পুরস্কার। সে তো আরও উত্তেজনার ব্যাপার। প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল তুমুল বিক্রমে।

এই প্রতিযোগীদের মধ্যে একজন ছিলেন ফ্রান্সের তত্কালীন তরুণ গাণিতিকদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব আনরি পয়েনক্লেয়ার (১৮৫৪-১৯১২)। তিনি ছিলেন মূলত বলবিদ্যাবিশারদ—নিউটন থেকে শুরু করে, অয়লার, লাগ্রাঞ্জ, হ্যামিলটন, জ্যাকবি, এঁদের মতো শীর্ষস্থানীয় গবেষকের যাবতীয় মৌলিক কাজের সঙ্গে সুপরিচিত। তিনি ত্রিদেহী সমস্যা নিয়ে আগেও অনেক ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। পুরস্কার ঘোষণার পর সেটা মনোযোগের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। কিছুদিন একনিষ্ঠ গবেষণা করে তাঁর মনে হলো উত্তর পেয়ে গেছেন—এত দিনের দাঁত-বসানো-শক্ত সমস্যাটির পূর্ণ সমাধান তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে! কাজটি একটু গোছগাছ করে সাজিয়ে মিটাগ-লেফ্লারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। মিটাগ-লেফ্লার বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়লেন পেপারটি। কোনো রকম ফাঁকফোকর কোথাও আছে বলে মনে হলো না। তা ছাড়া গাণিতিক হিসেবে পয়েনক্লেয়ারের সুনাম সম্বন্ধে আগে থেকেই সচেতন ছিলেন তিনি—এ লোক কোনো কাঁচা কাজ করবে না, সে বিশ্বাস তাঁর যথেষ্টই ছিল। দুরূহ সমস্যার সাবলীল সমাধান পেয়ে মিটাগ-লেফ্লার মহাখুশি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, পুরস্কারের সুযোগ্য প্রাপক আনরি পয়েনক্লেয়ার। এই মর্মে ঘোষণা প্রচার হয়ে গেল গণিতজগতে। সাড়া পড়ে গেল চতুর্দিকে। বিজ্ঞানজগতের উত্তেজনা রাজনৈতিক উত্তেজনার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। নিশ্চয়ই কালজয়ী প্রতিভা হবে লোকটা—পয়েনক্লেয়ারের সুনাম আরও শত গুণে ছড়িয়ে পড়ল গণিতের ঊর্ধ্বমহলে। রাজপ্রাসাদে যথাযথ আড়ম্বরের সঙ্গে পুরস্কার প্রদানের পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর পেপারটি মিটাগ-লেফ্লার সাহেব ছাপার জন্য পাঠিয়ে দেন তাঁর নিজেরই প্রতিষ্ঠিত সে সময়কার এক শীর্ষস্থানীয় গাণিতিক জার্নালে। সেটার ভুলভ্রান্তি কিছু পেলে সেগুলো শুধরে প্রুফ দেখার ভার দেওয়া হলো অ্যাডভ্যান ফ্র্যাগমেনের কাছে (এই ভদ্রলোক বয়সে তখন খুব তরুণ হলেও ভবিষ্যতের বিরাট সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে মিটাগ-লেফ্লারের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন)। ফ্র্যাগমেন প্রুফ দেখাকালে পয়েনক্লেয়ারের থেওরেমের প্রমাণটিতে যৌক্তিক স্খলন দেখতে পেলেন কিছুটা এবং সে মর্মে মঁসিয়ে পয়েনক্লেয়ারের কাছে একটি পত্র পাঠিয়ে দিলেন, যদিও পেপার প্রকাশের ব্যাপারে কোনো সমস্যা আছে—এমন কোনো দুর্বিনীত ইঙ্গিত ছিল না তাঁর প্রুফ দেখাতে। যথাসময়ে পেপার ছাপা হয়ে গেল এবং অত্যন্ত তীক্ষ দৃষ্টিতে না দেখলে তাতে কারোরই কোনো ফাঁকফোকর চোখে পড়ার কথা নয়, যেমন পড়েনি স্বয়ং মিটাগ-লেফ্লারের চোখে। কিন্তু ফ্র্যাগমেনের চিঠি পড়ার পর পয়েনক্লেয়ার যখন দ্বিতীয়বার তাঁর কাজটি নেড়েচেড়ে দেখলেন, তখন তাঁর মাথা ঘুরে গেল—সর্বনাশ, এ তো ডাহা ভুল! গোটা ব্যাপারটাই, প্রমাণের যুক্তিই কেবল নয়, প্রমাণিতব্য সিদ্ধান্তটিও। মানে নিউটনের কলনশাস্ত্র আর প্রথাগত কলাকৌশলগুলো ব্যবহার করে যে ফলাফল তিনি পেয়েছিলেন তা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগত মনে হলেও আসলে তা নয়। সে কী লজ্জা পয়েনক্লেয়ার সাহেবের—পত্রিকা বের হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সবাই জেনে গেছে ত্রিদেহী সমস্যার চূড়ান্ত মীমাংসা হয়ে গেছে। তিনি তখন তাড়াহুড়ো করে সম্পাদক মিটাগ-লেফ্লারের কাছে খবর পাঠালেন যে প্রকাশিত পেপারটি তিনি প্রত্যাহার করছেন এবং সংশোধিত কাজ শেষ হয়ে গেলে তার পুনঃপ্রকাশের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তিনি নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বহন করবেন। মিটাগ-লেফ্লার আগ্রহসহকারেই রাজি হয়ে গেলেন তাঁর প্রস্তাবে।

পরবর্তী কাহিনি গণিতজগতের এক যুগান্তকারী ঘটনা। পয়েনক্লেয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন যে গতানুতিক গাণিতিক পদ্ধতিতে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ নতুন চিন্তার সূচনা না হলে ত্রিদেহী বা বহুদেহী বিশ্বের দ্বারোদ্ঘাটন হবে না। কলনশাস্ত্র আর বীজগণিতের পথ এড়িয়ে তিনি জ্যামিতির শরণাপন্ন হলেন। এবং তাতেই হলো অভীষ্টসিদ্ধি—ধীরে ধীরে প্রকৃতি তাঁর অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত করতে শুরু করল। কিছুদিন দিনরাত খাটাখাটি করে আনরি পয়েনক্লেয়ার এক অপূর্ব উপহার নিয়ে এলেন গণিতের বিচিত্র জগতে। তাঁর সমাধানের মধ্য দিয়ে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা ধাবিত গতির যে সূক্ষ্ম বিষয়গুলো কিছুতেই ধরা দিতে চাচ্ছিল না, তাঁর দ্বিদেহী তত্ত্বের বলয়ে, তার পূর্ণ সমাধান অবিশ্বাস্য এক রূপসীর রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হলো। এবং সেটা হলো এমনই এক নতুন সজ্জায় যে তাতে করে জ্যামিতিক গণিতের একটা পুরোপুরি নতুন শাখাই সৃষ্টি হয়ে গেল বলতে গেলে। শাখাটির নাম ‘টপলজি’, যার সঠিক বাংলা আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই (পরাজ্যামিতি বলা ঠিক হবে কি?)। এই নতুন জ্যামিতি অনুযায়ী একটি বর্গক্ষেত্র আর একটি বৃত্তের মধ্যে (দুয়ের ভেতরটা যেন একই রকমভাবে ফাঁকা থাকে) প্রকৃতিগত কোনো প্রভেদ নেই—দুটোই টেনেটুনে ছোট আকারে সংকুচিত করে করে বিন্দুতে পরিণত করা যায়। সুতরাং, পরাজ্যামিতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা অভিন্ন। স্পষ্টতই গতানুগতিক ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাত।

কিন্তু তার চেয়েও বড় যে জিনিসটি পরিষ্কার ভাষায় ফুটে উঠেছে, সেটা হলো বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে পয়েনক্লেয়ারের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ অনুধাবন, যেন সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁর সন্ধানী দৃষ্টির তীক্ষবাণে বিদ্ধ হয়ে অবশেষে নতশিরে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল এই যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যতই জটিল হোক (এবং আকর্ষণ-বিকর্ষণের অমোঘ বিধান দ্বারা নিবদ্ধ বস্তুর সংখ্যা নিউটনের দ্বিদেহী সংস্থার গণ্ডি পার হয়ে তিন বা তারও ঊর্ধ্ব সংখ্যায় পৌঁছে গেলে), যতই জটিল থেকে জটিলতর পথ পরিক্রম করুক না কেন, ‘শেষ পর্যন্ত’ প্রতিটি চলমান বস্তুই তার যাত্রাবিন্দুতে প্রত্যাবর্তন করে, সাময়িকভাবে হলেও। শর্ত হলো যে তাদের পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতের নিরন্তর প্রক্রিয়াটি অবিরাম যেন চলতে থাকে। সেখানে কোনো রকম বিরতি ঘটলে চলার শকটটিও স্থিতাবস্থায় সমাপ্ত হয়ে যাবে। কিছুটা ঘড়ির কাঁটার মতো। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে আমি একটা গুরুত্ব আরোপ করেছি ‘শেষ পর্যন্ত’ শব্দযুগলের ওপর—তার কারণ এই যে ফিরে আসাটা, এটি কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে মোটেও টের পাওয়া যাবে না। আসলে অধিকাংশ গতিই এ রকম প্রত্যাবর্তী আচরণ প্রদর্শন করে না—অনেক অনেক কাল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারলে তবেই সে ধরা দেবে। অবশ্য সব বস্তু পূর্বাবস্থানে ফিরে এসে অন্তহীন পরিক্রমায় ঘুরতে থাকবে তাও নয়—কিন্তু যারা আসে তাদের প্রতিই আমাদের বেশি জোর দিতে হয়। যেমন সূর্যের চারপাশে নিত্য ঘূর্ণমান পৃথিবী একবার ঘুরে এসে আবারও ঠিক একই পথে চলতে শুরু করে। পয়েনক্লেয়ার সে কথাটার ওপরই জোর দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর নিজেরই ভাষায়: ‘The reason the periodic solutions are so precious to us is that they are the only opening by which we can enter this inaccessible fortress.’ (এই পৌনঃপুনিক সমাধানগুলো এত মূল্যবান আমাদের কাছে, কারণ এই একটিমাত্র উপায় আমাদের, যাতে করে আমরা প্রকৃতির দুর্ভেদ্যে রহস্যপুরীতে প্রবেশ করতে পারি) জটিল গণিতের সাধকেরাও যে কখনো কখনো কাব্যিক ভাষায় তাঁদের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন, এই পঙিক্ত যেন তারই খানিক ইঙ্গিত দেয়।

আমরা সাধারণ মানুষ হয়তো বিজ্ঞের মতো মুচকি হেসে বলব, এগুলো সব পাগল গাণিতিকের উর্বর কল্পনার উদ্ভট আবিষ্কার ছাড়া কিছু নয়। এর সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক কী? হ্যাঁ, আছে। আমরা অজ্ঞ বলেই বুঝেও বুঝি না, দেখেও দেখি না। পয়েনক্লেয়ারের কথাগুলো যে বর্ণে বর্ণে সত্য, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো আমাদের চোখের সামনে—রোজই ডগডগ করে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। মানে আমাদেরই চিরপরিচিত সূর্য-চন্দ্র-পৃথিবী নিয়ে যে ত্রিদেহী সমাবেশটি ঊর্ধ্বগগনে, আমি তারই কথা বলছি। এরা তো তিনটিতে মিলে সেই একই দৃশ্যের অবতারণা করে চলেছে অনাদিকাল ধরে—একে অন্যকে টানছে নিজ নিজ ভরমাফিক ক্ষমতা দিয়ে, অতএব তিনটিরই তো কিছু না কিছু নড়াচড়া হওয়ার কথা ওই কারণে। হয়ও। তবে সূর্য তারকাটি আকারে এত বিশাল অন্য দুটির তুলনায় যে তার গায়ে বলতে গেলে সামান্য একটু আঁচড়ও লাগে না। লাগে অপর দুটির গায়ে। লাগে বলে পৃথিবী বছরে একবার করে সূর্যের চারদিকে ঘোরে আর চন্দ্র ঘোরে পৃথিবীর চারদিকে মাসে একবার। ওদের মধ্যে যে ইতিমধ্যে নানা রকম টানাটুনি হয়ে যাচ্ছে, তা আমরা খালি চোখে টেরও পাচ্ছি না। তবে নভোদর্শীরা পান তাঁদের শক্তিশালী দুরবিনের সাহায্যে। তাঁরাই কেবল টের পান যে প্রায় প্রতিবছরই পৃথিবী ও চন্দ্র, দুটিই সামান্য পরিমাণে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে তাদের গ্রহপথ থেকে, যদিও পয়েনক্লেয়ারের সেই ‘দীর্ঘকাল অপেক্ষা’র পর দেখা যায়, তারা আবার সেই একই জায়গায় ফিরে এসেছে। এভাবেই বিশ্বচরাচর তার চিরকালীন স্থিতিস্থাপকতা অক্ষুণ্ন রেখে চলেছে।

পয়েনক্লেয়ারের যুগান্তকারী আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির আরও এক বিচিত্র বৈশিষ্ট্য একটু উঁকি মারতে শুরু করেছে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় কেয়স (Chaos), সাধারণ অর্থে যাকে আমরা চরম বিশৃঙ্খলা হিসেবে বুঝি। এর বৈজ্ঞানিক অর্থ তার চেয়ে অনেকটাই গভীর—বর্তমান যুগে ফলিত গণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পরিণত হয়েছে বলা যায়। যেখানেই বহু বস্তুর যুগপত্ সংঘাতের ব্যাপার সেখানেই কেয়সের সম্ভাবনা। ঢাকা শহরের বহু-আলোচিত, প্রায়-কিংবদন্তিতে পরিণত-হওয়া যানজটের সঙ্গেই তুলনীয় বলা চলে। শব্দটির বিজ্ঞানসম্মত কোনো বাংলা প্রতিশব্দ বেরিয়েছে কি না জানি না, তবে শব্দটির বৈজ্ঞানিক অর্থের সঙ্গে সাধারণ ব্যবহারিক অর্থের এতটাই দূরত্ব যে আমার মনে হয়, এর কোনো তরজমাই হওয়া ঠিক হবে না।

যা-ই হোক, ওপরের কথাগুলোর সারমর্ম এই যে পয়েনক্লেয়ারের গবেষণার একটি উপরি প্রাপ্তি বিজ্ঞানের এই নতুন চিন্তার ধারাটি। কিন্তু এটা হলো তাঁর পরোক্ষ ফলাফল, প্রত্যক্ষ নয়। প্রত্যক্ষটি হলো ভরযুক্ত বস্তুর গতি বিশ্লেষণের এক অভিনব পন্থার আবিষ্কার—জ্যামিতিক পন্থা। নিউটন আমাদের শিখিয়েছিলেন কীভাবে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে বস্তুর ত্বরণ সমীকরণীকৃত করে কলনবিদ্যার রীতিনীতি (যা নিউটনের নিজেরই আবিষ্কৃত) দ্বারা সোজা অঙ্ক কষে বের করে ফেলা যায় আদ্যোপান্ত সব সমস্যার সমাধান। অবশ্য এখানে বলে রাখা দরকার যে জ্যামিতির পদ্ধতিতে আঁকা চিত্র চিত্রায়ণের এই প্রক্রিয়া গতানুগতিক ইউক্লিডিয়ান ছবির মতো ঠিক নয়। এগুলো সাধারণত অবস্থানভিত্তিক স্পেসে আঁকা নয়, অবস্থান ও গতি—দুটোকেই সমান মর্যাদা দেওয়া স্পেসে, যাকে গণিতের ভাষায় বলা হয় ‘ফেজ স্পেস’। এখানে বস্তুর অবস্থানকে দেওয়া হয় একটি অক্ষ, আরেকটি থাকে গতির দখলে। অর্থাত্ এই মানচিত্রে একটা বিন্দু দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ইত্যাদি সূচিত করে না, করে একটি চলমান বস্তুটি তার চলার পথে এ মুহূর্তে কোথায় অবস্থিত এবং এর গতিবেগ কত। এই চিত্রে একটি পরীক্ষমাণ বস্তুর গতিবিধি অনুসরণ করে কী ধরনের ছবি সৃষ্টি করে যাচ্ছে, তার গোটা ইতিহাসই কেবল বোঝা যায় না, এই গতির প্রকৃতিটাও পরিমাপন করা যায়—স্থিতিশীল, সুশৃঙ্খল না, একেবারেই এলোমেলো, বিভ্রাটময় (অর্থাত্ কেয়টিক)। বহুমাত্রিক এবং বহুদেহী পরিস্থিতিতে এই তথ্যটুকু অত্যন্ত প্রয়োজন।

চার.

প্রাচীনকালে দর্শনশাস্ত্রের সঙ্গে গণিত আর বিজ্ঞানের বড় একটা বৈষম্য ছিল না—একই বিষয়ের এপিঠ-ওপিঠ। প্লেটো, অ্যারিস্টোটল (বিশেষ করে অ্যারিস্টোটল), উভয়ই কেবল বড় দার্শনিকই ছিলেন না, বড় গাণিতিক-বিজ্ঞানীও ছিলেন বটে। অ্যারিস্টোটল যে প্রাণীবিজ্ঞানের আদি জনক, সেটা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। শুধু প্রাচীন যুগের কথাই বলি কেমন করে, মধ্যযুগের বেলায়ও অনেকটা প্রযোজ্য কথাটি। ওমর খৈয়ামের রুবায়েতে যে গভীর জীবনদর্শন প্রকাশ পায়, তা অদ্যাবধি মানুষকে দোলা দেয়। ওদিকে তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের গাণিতিক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির কথা বলতে শুরু করলে তো এক বেলায় শেষ হবে না। তাঁর মতো শতমুখী প্রতিভা পৃথিবীতে বোধ হয় হাজার বছরে একটি জন্মায়। সাধারণ মানুষ কেবল তাঁর ‘মোনালিসা’র দিকেই চেয়ে রইল এতটা কাল, তাঁর অন্যান্য কাজের দিকে ফিরেও তাকাল না। তিনি একাধারে মানবদেহ তত্ত্বের (Human Anatomy) অবিসংবাদিত জনক, উড়োজাহাজের প্রথম মডেল তাঁরই হাতে গড়া, তিনি ভাস্কর, তিনি স্থপতি, তিনি গণিতের একনিষ্ঠ সাধক। উপরন্তু, তিনি মানবচরিত্র সম্বন্ধে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী রেখে গিয়েছিলেন, তা বর্তমান যুগের দিকে তাকালে অবিশ্বাস্য মনে হবে—এতটাই মিল।

পাঠক হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন, এসবের সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কী সম্পর্ক। আছে। আছে বলেই এটুকু ভূমিকার অবতারণা। নিউটনের সময়কালে এটা ধরেই নেওয়া হতো যে প্রকৃতি কোনো ‘ভুল’ করতে পারে না, এখানে মনুষ্যসুলভ বিভ্রান্তিকর বালখিল্যের প্রশ্রয় নেই, কারণ মহান সৃষ্টিকর্তার সুপরিকল্পিত মানচিত্রে এসবের স্থান নেই। সংসারে কোনো ঘটনাই ঘটা সম্ভব নয় একটা নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া। ধর্মগ্রন্থে পরিষ্কার লেখা আছে, ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের তুচ্ছ পাতাও নড়ে না। এই সহজবোধ্য ধ্যানধারণার সঙ্গে নিউটনীয় কার্যকারণসম্বন্ধীয় চিন্তাধারা পুরোপুরি মিলে যায়। নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী একটা বস্তু, যত ক্ষুদ্র বা বৃহত্ই হোক, এক মুহূর্ত থেকে পরের মুহূর্তে বা আরও অনেক পরের মুহূর্তে কোথায় যাবে তা নির্ভর করে বস্তুটি যাত্রাকালে কোথায় ছিল, কতটা বেগ ছিল তার তখন এবং কিসের তাড়নায় তার চলন, এগুলো জানা থাকলে এর ভবিষ্যত্ গতিবিধির নিখুঁত মানচিত্র এঁকে দেওয়া সম্ভব। সৌভাগ্যবশত আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের তাগিদে যা কিছু জানা দরকার, সেগুলো এভাবেই জেনে নেওয়া হয়। লন্ডন থেকে ঢাকাগামী একটি প্লেন বেলা তিনটায় রওনা হলে ঠিক কয়টার সময় ঢাকার বিমানবন্দরে পৌঁছাবে, সেটা আগে থেকে জানা থাকে। কারণ, প্লেন মোটামুটিভাবে নিউটন এবং আধুনিক বিমানবিজ্ঞানীদের গণনা অনুসারে অত্যন্ত আজ্ঞানুবর্তিতার সঙ্গে সব নিয়মকানুন পালন করে চলে।

কিন্তু প্রকৃতি সব সময় এমন সুশীল আজ্ঞাবহতার ধার ধারে না। আগের অধ্যায়ে এর একটা ছোট্ট আভাস দিয়েছি—ত্রিদেহী সমস্যা নিয়ে পয়েনক্লেয়ার সাহেবের যে মাথা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছিল, তার উত্সটাই তো সেখানে। দুটির বদলে তিনটি মিলে একে অন্যকে টানাটানি শুরু করলে কে কোন দিকে যাবে, সেটা স্বয়ং নিউটন সাহেবও হয়তো হলফ করে বলতে পারতেন না। আসলে এটা কোনো পারিবারিক ঝগড়াঝাঁটির মতো নয়, এটাই প্রকৃতির মৌলিক চরিত্র। এই যে ছোট ছোট বিশৃঙ্খলা থেকে একসময় লাগামছাড়া বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া, যেটা একসময় পূর্ণমাত্রা কেয়সের আকার ধারণ করে, তা প্রকৃতির বিকার নয়, স্বরূপ।

কার্যকারণ সম্পর্কহীনতা যে কেবল বহুদেহী ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। অনেক সময় একটিমাত্র বস্তুর গতিতেও এ রকম আপাতবিকারগ্রস্ততা পরিলক্ষিত হয়—নির্ভর করে বস্তুটি কী রকম আধারে ধারণ করা হয়েছে, কেমন তার পরিবেশ ইত্যাদি। বাচ্চাদের খেলার মাঠে একটা দোলনায়-চড়া শিশু প্রায় কখনোই বেসামাল গতিতে চলতে শুরু করবে না—এটা কার্যকারণের আওতার ভেতরই পড়ে। একটি গোলাকার পাত্রের কথা ভাবুন। এবং ধরা যাক, পাত্রটির ভেতরকার দেয়ালটি খুবই মজবুত, একেবারে মসৃণ মেঝের মতো চকচকে। এবার কল্পনায় তার ভেতরে একটা ছোট্ট বল ছুড়ে দিলেন একটা কৌণিক লক্ষ্য বরাবর এবং ঠিক কতটা কোণে সেটা ছুড়লেন, সেটা সঠিক জেনে রাখুন। বস্তুটি সেই কোণের মাত্রা অনুযায়ী আরেকটা দিকে প্রতিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। সেখান থেকে ওটা সেই গোলাকার পাত্রেরই একটা বিশেষ বিন্দুতে গিয়ে ঘা খেয়ে তত্ক্ষণাত্ নিক্ষিপ্ত হবে ঠিক একই কোণের অন্যত্র। আরম্ভের কোণটা যদি ৩৬০ ডিগ্রির একটি ভগ্নাংশের গুণক হয়, তাহলে একসময় সে-ই প্রথম বিন্দুটিতে প্রত্যাবর্তন করে আবার নতুন পথে চলতে শুরু করবে। ছবিটা একটি গোলাকার (কাল্পনিক যদিও) পিং পং টেবিলের ওপর বলটির অন্তহীন লাফালাফি করার মতো। তবে গোড়ার কোণের পরিমাণটি যদি ৩৬০ ডিগ্রির ভগ্নাংশ (rational number) না হয়, তাহলে কিন্তু বলটা তার অন্তহীন চলার পথে কখনোই আর আগের বিন্দুটিতে ফিরে আসবে না। তথাপি একটা সত্য থেকে যায়—একটি কোণ কেবল একটা পথই (সরলরেখা, যদি তার চিত্র আঁকা হতো) নির্দেশ করে। পাত্রের আধারখানি গোলাকার না হয়ে যদি অধিবৃত্তের আকারে হতো, তাহলেও গতিপ্রকৃতি মূলত একই থাকত, কেবল চিত্র, মানে গ্রাফ আঁকতে গেলে সেটা সরলরেখা না হয়ে বাঁকা হয়ে যেত।

এই উদাহরণ দুটির মধ্যে মৌলিক মিল যেখানে, সেটা হলো কার্যকারণ সম্পর্ক। অর্থাত্ হেতুবাদ অক্ষুণ্ন থাকছে দুটিতেই। মূল সংখ্যাটি যা হবে, পরবর্তী সংখ্যাগুলো সে অনুসারেই তৈরি হবে। অর্থাত্ কারণ যে রকম, ফলটাও সে রকম। নিউটন তত্ত্বের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এই সরলচিত্র একেবারেই ওলট-পালট হয়ে যায়, যখন সেই আধারটির জ্যামিতিক প্রকৃতি আগাগোড়া বদলে যায়। ওটা যত জটিল হবে, বলটির গতিপ্রকৃতিও ঠিক সেই পরিমাণে জটিল হতে শুরু করবে। তখন এমন হয় যে বলসংখ্যা মাত্র একটি হলেও তার গতিপথের যে ছবি উঠে আসে, তা আর একটি সরলরেখা বা বক্ররেখা না হয়ে একটা হযবরল ধরনের জগাখিচুড়ি বা কুজ্ঝটিকাজাতীয় অস্পষ্ট জিনিস বের হয়ে আসে। যেন একটা মেঘের দলা। অর্থাত্ একটা পুরোদস্তুর কেয়স। বিষয়টি আমার এই চিত্রবিহীন সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় ভালো করে হয়তো ফুটে উঠল না। তাই কৌতূহলী পাঠকদের আমি উত্সাহ দিচ্ছি যেন ইভার একল্যান্ড-প্রণীত গ্রন্থ: The Best of All Worlds (1) বা জেমস গ্লাইকের লেখা কেয়সবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ বই Chaos (2) -এর পাতা উল্টিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। এটি বর্তমান যুগের বিজ্ঞানজগতে একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়। এতে একাধারে উঁচুমানের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন, সব একসঙ্গে মিলে একটা রহস্যময় জগত্ তৈরি হয়ে গেছে।

পাঁচ.

এবার আমাদের পুরোনো প্রশ্নে ফিরে আসা যাক—বহুদেহী বস্তুর সমাবেশে প্রকৃতির নিয়মকানুন কোথায় দাঁড়ায়। আগেই বলেছি, এই কঠিন প্রশ্নটিতে কীভাবে বারবার ব্যাহত হয়েছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঘা বাঘা প্রতিভা। এবং স্বয়ং পয়েনক্লেয়ার সাহেবও (যিনি ওই শতাব্দীর, অনেকের মতে, সর্বকালের, অন্যতম শ্রেষ্ঠ গাণিতিক হিসেবে পরিচিত) চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলেন এই দুরূহ সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে—পেপার ছাপা হওয়ার পর তাতে সম্পূর্ণ ভুল উপপাদ্যের ‘প্রমাণ’ আবিষ্কার করা যে কী লজ্জা, সেটা আমি কিছুটা বুঝি। ভাগ্য ভালো যে সময় থাকতে ফ্রাগম্যানের মতো একজন শ্যেনদৃষ্টিসম্পন্ন তুখোড় এবং তরুণ গাণিতিকের হাতে গিয়ে পড়েছিল তাঁর পেপারটি, নইলে হয়তো সেই ভুল অবস্থাতেই পয়েনক্লেয়ারের পেপার বলে পরিচিত একটি অসত্য ‘উপপাদ্য’ গণিতশাস্ত্রের এক কলঙ্কিত ইতিহাস হয়ে থাকত।

যা-ই হোক, অবশেষে ওই পেপারের শেষরক্ষাই হয়নি কেবল, পয়েনক্লেয়ারের অসাধারণ গাণিতিক চিন্তাচেতনার এক সুবর্ণ দলিল হিসেবে তাঁর পরিবর্তিত পেপারটি অমরত্ব লাভ করেছে। এতে তিনি যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে অতি সহজবোধ্যভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন যে নিউটন সাহেবের তত্ত্বাবলি অক্ষুণ্ন থাকা সত্ত্বেও তাঁরই সৃষ্ট কলনপদ্ধতি দিয়ে ঊর্ধ্বাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রাদির চালচলন বুঝে ওঠা সম্ভব নয়, সেখানে সব সময় সরল বুদ্ধি কার্যকারণ সম্পর্ক কাজ করে না। বরং ইউক্লিড-বহির্ভূত একপ্রকার অদ্ভুত জ্যামিতিই যেন সেখানকার প্রচলিত ভাষা। এই অভিনব ভাষারই প্রাথমিক আভাস উঁকি দিয়েছিল পয়েনক্লেয়ারের পরিমার্জিত পেপারে, যা পরবর্তী সময়ে টপলজিতে পল্লবিত হয়। তারও কিঞ্চিত্ আভাস আমি দিয়েছি এ রচনার গোড়ার দিকেই। বিষয়টি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞান ও গণিতের এক প্রসিদ্ধ লেখক ইয়ান স্টুয়ার্ট। আমি এ নিবন্ধে প্রধানত তাঁর বিবরণই (৩) অনুসরণ করেছি, অধিকাংশ সময় আমার বক্তব্য পেশ করার জন্য।

পয়েনক্লেয়ার শুরুতে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন ত্রিদেহী গতিরেখার ছবি আঁকতে গিয়ে। সূর্যকে স্থির রেখেও চন্দ্র আর পৃথিবী মিলে অবিশ্বাস্য জটিলতা সৃষ্টি করে দেয়—ওদের গতিপথগুলো অসংখ্যবার পরস্পরকে ছেদ করে, যার ফলে ওদের গতির হদিস রাখা একেবারে সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে। সে সময় যে কথাটি তাঁর মাথায় হয়তো পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠেনি, তা হলো যে এই অসংখ্য ঠোকাঠুকির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল কেয়সের পূর্বাভাস। পরে অবশ্য কেয়স শব্দটি স্পষ্ট করে খুলে না বললেও অন্যরা ওই সূত্র ধরে পুরো আইডিয়াটি সংজ্ঞাবদ্ধ করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আরও একটি ঘটনা ঘটে, কচিত্-কদাচিত্ যদিও, সেটি হলো যে একটা আবদ্ধ গতিপথ তৈরি হয়ে যায়, অর্থাত্ সেখানে গতির পৌনঃপুনিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়। মানবজাতির স্থিতিস্থাপকতার দিক থেকে ভাবতে গেলে এই পৌনঃপুনিকতাই আমাদের অস্তিত্বের শেষ ভরসা। সে কারণেই সূর্য-চন্দ্র-বিশ্ব এই ত্রিশক্তির মধ্যেও আমাদের জীবনে বছর ঘুরে বছর আসে, অধিবর্ষ হয় প্রায় ঘড়ির কাঁটা ধরে এবং বিজ্ঞানীরা দূর ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিতে পারেন। এই পৌনঃপুনিকতার সন্ধান, এই অধিবৃত্তিক গ্রহপথের সন্ধানই ছিল পয়েনক্লেয়ার সাহেবের ইউক্লিডের বাইরে নতুন জ্যামিতি সৃষ্টি করতে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য।

আমরা যত দিন পৃথিবীপৃষ্ঠে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করেই সন্তুষ্ট ততক্ষণ অন্য কোনো বড় সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা তেমন নেই। কিন্তু মানুষ কখনোই এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না—অজানাকে জানার স্পৃহা আমাদের অন্তহীন। তাই মানুষ উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে, বেলুনে করে আকাশ ভ্রমণ করতে চেয়েছে, শেষে এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টারই রূপায়ণ ঘটেছে চন্দ্র গ্রহের অভিযানে। প্রথমে চালকবিহীন, পরে চালকসহ—এক নয় একাধিক। প্রশ্ন হলো, ওই প্রথমবার যখন শূন্যযান পাঠানো হয় চাঁদের দিকে, তখন নাসার প্রকৌশলীরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যানটিকে কোন রাস্তা ধরে চালিত করবেন? এবং তাঁদের সেই সিদ্ধান্তগুলোর পেছনে কী সব যুক্তি তৈরি করা হয়েছিল? সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হতে পারে, কেন, সোজা চাঁদ বরাবর ছুড়ে মারলেই তো হয়। না, ব্যাপারটি তত সহজ নয়। প্রথমত, ‘চাঁদ বরাবর সোজা দিক’ বলে কোনো দিক নেই। ভুলে গেলে চলবে না যে চাঁদ আমাদের চারপাশে ঘুরছে, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ঘুরছি পৃথিবীর চারপাশে। অতএব আমাদের সোজা দিকটিকে ঠিকমতো বাঁকাতে না পারলে কখনো ওটা গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাবে না। দ্বিতীয়ত, ভূপৃষ্ঠ থেকে চন্দ্র গ্রহের দূরত্ব ৩,৫৮,০০০ কিলোমিটার (২,২১,৮০০ মাইল) থেকে ৪,০৮,৩০০ কিলোমিটার (২,৫২,৫০০ মাইল) পর্যন্ত ওঠানামা করে, আমাদের থেকে সূর্যের দূরত্ব যেমন গ্রীষ্মে কমে যায় আর শীতে বাড়ে। দুটোরই মূল কারণ হলো অধিবৃত্তাকার কক্ষপথ উভয়েরই। সুতরাং, এতটা পথ মহাশূন্যের অচেনা পথে ভ্রমণ করার এমন একটা রাস্তা খুঁজতে হয় যাতে, এক. সবচেয়ে কম খরচে উদ্দেশ্য সাধন করা যেতে পারে; দুই. সময় বাঁচানো, বিশেষ করে যদি এক বা একাধিক চালক থাকে সঙ্গে (তাদের স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে হবে, তাদের খাবারদাবার, তাদের নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা বিষয় ওদের বিবেচনায় রাখতে হয়); তিন. যাতে ফেরার পথে অনায়াসে ফেরা যায় চাঁদের আকর্ষণের বলয় থেকে বের হয়ে এবং যাতে ওজনহীন অবস্থায় কিছুক্ষণ ঝুলে থাকার পর বিনা ঝাঁকুনিতে পৃথিবীর আকর্ষণ ক্ষেত্রে প্রবেশ করা যায় নিশ্চিন্তে। এগুলো ছোটখাটো প্রশ্ন নয়—কমান্ড সেন্টারের বাঘা-বাঘা বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ এগুলো আদ্যোপান্ত বিবেচনা না করে মানুষচালিত যান আকাশে উড্ডীন হতে দেবেন না।

চাঁদে যেতে সোজা তাক করে যাত্রা শুরু করার বড় সমস্যা হলো প্রচণ্ড রকম জ্বালানি তেল খরচ হয় তাতে—গোটা মিশনটা তখন ব্যয়সাধ্যতার বাইরে চলে যায়। ভুলে গেলে চলবে না যে পৃথিবী থেকে চাঁদের পথে রওনা হতে প্রথম তার আকর্ষণের বলয় অতিক্রম করতে হয় এবং সেখানেই জ্বালানিশক্তি ব্যয় হয় সবচেয়ে বেশি। এই সমস্যার একটা ছোটখাটো সমাধান বের হয়েছে তথাকথিত হোম্যান অধিবৃত্ত বদল তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। আইডিয়াটি এ রকম। পৃথিবী থেকে এক টানে সোজা ওপরে চলার পরিবর্তে প্রথমে ঊর্ধ্বমুখী হতে হতে পাশে, বৃত্তাকারে পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে তারপর আস্তে আস্তে চাঁদের দিকে অগ্রসর হওয়া—সরলরেখায় নয়, একটি চিকন অধিবৃত্তের রেখা ধরে, এতে কম তেল খরচ হয়। তারপর একটা জায়গায় এসে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ দুর্বল হতে হতে যানটিকে ওজনহীন অবস্থায় এনে দেয়। অর্থাত্ তখন পৃথিবী আর চন্দ্র দুইয়ের আকর্ষণ থেকেই অপেক্ষাকৃত মুক্ত আমাদের শূন্যযানটি—সেটা বেশ আরামের সময়ই, তেল প্রায় একেবারেই খরচ হয় না। তারপর ওকে আস্তে আস্তে চাঁদের দিকে চলতে শুরু করতে হবে। তবে একবারে নয়। প্রথমে চাঁদের চারদিকে একবার চক্কর দেওয়া—ঠিক পৃথিবীর চারপাশে যেমন ঘোরা হয়েছিল একবার। সেটাও ওই একই উদ্দেশ্যে—জ্বালানির খরচ কমানো। শেষে ধীরে ধীরে কক্ষ বদল করে চাঁদের দিকে অগ্রসর হওয়া। ১৯৬০ আর ১৯৭০ সালের মাঝে যে কবার চাঁদে ভ্রমণ করা হয়েছিল, তার সবই এই নীতি পালন করেছে।

কিন্তু আধুনিক যুগের শূন্যযাত্রীদের জন্য চন্দ্র গ্রহ এখন প্রায় ডালভাত। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল দুটিই হু হু করে এগিয়ে গেছে। এতটাই অগ্রসর এ যুগের প্রযুক্তি যে অতি সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহে একটি অনুসন্ধানী (যন্ত্রচালিত স্বভাবতই) যান পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। সেখানে ব্যাপারটি তত সোজা নয়। প্রথমত, মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব গড়ে প্রায় ২২৫ মিলিয়ন কিলোমিটার এবং গ্রহটির আকার এত বিশাল যে সেখানে একটি ৩৬৫ দিনবিশিষ্ট বছরের যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি, তার তুলনায় ওটা ৬৮৭ দিন। সেখান থেকে আলোরশ্মি পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতে লাগে তিন মিনিট, যেতে লাগে আরও তিন মিনিট। সেখানে যেতে কেবল নিউটন সাহেবের দ্বিদেহী তত্ত্বের ওপর ভরসা করে যাওয়া যাবে না। কারণ, ওই দীর্ঘ পথে ভ্রমণ করতে গিয়ে পথিমধ্যে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হবে। সেখানে সাধারণ ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতিও বড় একটা কাজে আসে না। তার চেয়ে পয়েনক্লেয়ার সাহেবের নতুন তত্ত্ব ব্যবহার করা অনেক লাভজনক। যা-ই হোক, আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গের জন্য এসব জটিল প্রশ্ন যতই আকর্ষণীয় হোক, খুব একটা প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না। আমার মনে হয়, আগ্রহী পাঠকের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এ বিষয়ের সত্যিকার বিশেষজ্ঞ যাঁরা, তাঁদের প্রণীত গ্রন্থাদি খোঁজা উচিত—আজকাল বাজারে অনেক বই-ই বের হয়েছে এসব বিষয়ের ওপর। সহজবোধ্য পাঠের জন্য গ্রন্থসূত্রে যে দুটি বই (৪ ও ৫) আমি উল্লেখ করেছি, তার পৃষ্ঠাগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেও হয়তো কিছুট ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

এ লেখাটি আমি শেষ করে দেব ভবিষ্যতে যাঁরা শূন্যে ভ্রমণ করার ইচ্ছা পোষণ করেন, তাঁদের জন্য কিছু টুকিটাকি খবর তুলে ধরে। মহাশূন্যে ভ্রমণ করতে গেলে এটা ধরেই নিতে হবে যে একটা জায়গায় গিয়ে যাত্রীদের কোনো ওজন বলে কিছু থাকবে না—ভর থাকবে, কিন্তু ওজন কাটাকুটি হয়ে শূনে চলে যাবে। কিন্তু সে অবস্থাটি কতক্ষণ বজায় থাকবে, সেটা নির্ভর করবে যানের গতি, অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের নৈকট্য কত দূর এবং তাদের আকর্ষণ শক্তির জোর কতটা। শুধু তা-ই নয়, গ্রহ-উপগ্রহ কি একটি, না একাধিক, এবং একাধিক হলে তার সংখ্যা কত। সাধারণত ঊর্ধ্বাকাশে বহুসংখ্যক গ্রহ-উপগ্রহ এমনকি উল্কা, ধূমকেতু এগুলোর সাক্ষাত্ পাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। কথা হলো, সে অবস্থায় শূন্যযানের চালককে কী ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হয়। মনে রাখতে হবে, তেল বাঁচানো একটা জরুরি বিষয়—কোনোক্রমে যদি তেল ফুরিয়ে যায় এক লাখ মাইল ওপরে, তাহলে আপনাকে সরাসরি বিধাতার দরবারে পৌঁছে যেতে হবে—স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের মুখ দেখার ভাগ্য হবে না আর। কিন্তু তেল বাঁচাতে কী করতে হয়? সে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন প্রকৌশলীরা, যাঁরা পাহাড়ি রাস্তায় রেলগাড়ি চালানোর জন্য পাহাড়ের গায়ে রেল না বসিয়ে পাহাড়ের ভেতরে গর্ত করে সুড়ঙ্গ তৈরি করেন। উদ্দেশ্য একই, এতে খরচ বাঁচে অনেক গুণ। আধুনিক নগরজীবনে অনেকেই পাতালট্রেন ব্যবহার করেন। পাতালট্রেন তৈরি করা হলো কেন? কেবল যানবাহনের ভিড় লাঘব করার উদ্দেশ্যেই নয়, খরচ বাঁচানোর জন্যও অনেকখানি। অনুরূপভাবে শূন্যে ভ্রমণের বেলায়ও আজকাল ‘পাতালট্রেন’ বলে একটা অদ্ভুত আইডিয়া আলোচিত হচ্ছে। পাঠক নিশ্চয়ই সন্দিহান হয়ে উঠছেন ইতিমধ্যে, শূন্যে আবার পাতাল এল কী করে? ঠিকই ধরেছেন, জাগতিক অর্থে পাতাল নেইও সেখানে, কিন্তু এখানে ‘পাতাল’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে ভাবার্থে। এর সত্যিকার কোনো অস্তিত্ব নেই, গাণিতিকের কল্পনায় মাত্র। শুধু তা-ই নয়, এর মাত্রাসংখ্যা তিনের চেয়ে বেশি, সাধারণত পাঁচ থেকে সাত পর্যন্ত যেতে পারে (মাত্রা বলতে আমি ইংরেজির ডাইমেনশনকে বোঝাচ্ছি)। আসল ব্যাপারটা হলো, শূন্যের ‘পাতালপথ’ মানে যেখানে জ্বালানি খুব কমই ব্যবহার করতে হয় অন্যান্য পথের তুলনায় এবং যেখান থেকে এক গ্রহের কক্ষপথ বদল করে অন্য গ্রহের কক্ষপথে স্থানান্তরিত হওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। অনেকটা টরন্টো-মন্ট্রিয়ল-নিউইয়র্কের পাতালট্রেনের এক লাইনে করে একটা স্টেশনে যাওয়ার পর সেখানে নেমে অন্য লাইনের ট্রেনে উঠে গন্তব্যে পৌঁছানোর মতো। এতে গোটা যাত্রাটি খুব অল্প সময় ও ব্যয়ে শেষ করা সম্ভব হয়। আমাদের শূন্যে ভ্রমণের জন্য ‘পাতালট্রেন’-এর ধারণাটিও অনেকটা সে রকম। কম ঝামেলা, কম খরচ।

অবশ্য এসবই এ মুহূর্তে কল্পকাহিনি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আজকে যেটা কল্পনা, ১০ থেকে ১৫ বছর পর যে সেটা বাস্তবে পরিণত হবে না, কে বলবে সে কথা? অতীতের অনেক উদ্ভট কল্পকাহিনিই তো বাস্তবে রূপ পেয়ে গেল এ যুগের প্রযুক্তির কল্যাণে। ভবিষ্যতে আরও কত-কী ঘটবে কে জানে!

তথ্যসূত্র

        Ivar Ekeland, The Best of All Possible Worlds, University of Chicago Press, 2006; Paperback edition, 2007.

       James Gleick, Chaos, Penguin Books paperback edition, 1988.

       Ian Stewart, In Pursuit of the Unknown, Basic Books, 2012.

       Douglas Adams, The Hitchhiker’s Guide to the Galaxy, Published by Del Ray, 2005.

       Beth Revis, Across the Universe, Published by Razorbill, 2011.

       Internet.

      অটোয়া (মুক্তিসন ’৪১), কানাডা

     (রচনাটি ২০১২ সালের ২২ আগস্ট লেখা)