সম্পাদকীয়

২০১৫ সালটির শুরু এক নৈরাজ্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের নামে এই সহিংস পরিস্থিতি বিগত তিনটি মাস লাগাতার চলেছিল। স্থানীয় সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্বাভাবিক অবস্থাটি কত দিন থাকবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। বিষয়টি মাথায় রেখে বদরুল আলম খান বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একটি তাত্ত্বিক কাঠামোগত বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। তাঁর প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে উদারনীতিবিহীন গণতন্ত্র (Illiberal Democracy) হিসেবে আখ্যায়িত করতে পেরেছেন। তিনি গণতন্ত্রের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক পূর্বশর্তগুলো আমাদের দেশে পূরণ না করেই গণতন্ত্রের কথা ভাবছি কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একই সঙ্গে গণতন্ত্রের সাধারণ নীতিমালার প্রতি এলিট গোষ্ঠীর অঙ্গীকার এবং তাদের আন্তসম্পর্কগত সমঝোতা অর্থাত্ এলিট সমঝোতার তত্ত্ব কিংবা রাজনৈতিক ঐক্য ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, সেখানকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, মানবাধিকার অবস্থা ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের জাতীয় অঙ্গনে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ডিসকোর্স পর্যালোচনায় অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠদের আধিপত্য বিষয়ে আলোচিত প্রবন্ধটি লিখেছেন লাইলুফার ইয়াসমিন। পরিচয়ের বিষয়টি প্রত্যেক জাতি ও নৃগোষ্ঠীর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পরিচয়ের রাজনীতি জাতিগঠনে এবং রাষ্ট্রভাঙনে উল্লেখযোগ্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় ভূমিকা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় এই অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এখানকার পরিচয়ের রাজনীতি এবং শাসনপ্রক্রিয়া কীভাবে পরিচালিত হয় তা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য জানাটা অপরিহার্য।

নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী উন্নয়নের প্রধান শর্ত—নারীর প্রান্তিকায়ন ও অবদমনের ক্ষেত্রগুলো উন্মোচিত করা। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর ভূমিকা এবং তার ওপর পরিচালিত শোষণ ও বঞ্চনার জায়গাগুলো যত বেশি সামনে তুলে ধরা যাবে, ততই

ভালো প্রতিকারের পথ খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। নারীর সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক থাকায় নারী যেমন শোষিত হয় এবং ভঙ্গুর অবস্থায় পতিত হয়, তেমনি পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন কৌশল হিসেবে নারীর এই সহজাত প্রকৃতি-সংশ্লিষ্টতা কাজে লাগানো যাবে। ‘গ্রামীণ নারীর পরিবেশ সচেতনতা ও পরিবেশ অবনয়নের বিরুদ্ধে সাড়া প্রদান’ শিরোনামে সাবেকুন নাজমুন সে বিষয়ে একটি প্রারম্ভিক আলোচনা তুলে ধরেছেন।

সম্প্রতি পেরিয়ে গেল অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জন্মশতবর্ষ। নিজে লিখেছেন খুবই কম। তবে তাঁর পড়াশোনার পরিধি ও প্রজ্ঞার কারণে তাঁর এক কিংবদন্তি ইমেজ গড়ে ওঠে। তিনটি প্রজন্মকে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট তিন প্রজন্মের জ্ঞানচর্চায় তাঁর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা ছিল তাদের পাথেয়। জাতীয় জীবনের উত্থানপর্বের তিনি ছিলেন পর্যবেক্ষক ও ক্ষেত্রবিশেষে অভিভাবক স্থানীয়। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে প্রতিচিন্তার পাঠকদের সামনে তাঁর অভিসন্দর্ভের অনুদিত অংশবিশেষ পুনর্মুদ্রণ করা হলো।

আগামী ২০১৯ সালে আনোয়ারা বাহার চৌধুরী জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে। আমরা অগ্রিম এই মুসলিম নারীর প্রতিকৃতি ও ঢাকায় তাঁর শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উদ্যোগের অন্তরঙ্গ বয়ান তুলে ধরেছি। তাঁর এ সাক্ষাত্কারে নিজের জীবনের রেখাচিত্রের পাশাপাশি ঢাকার বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ ও নারীর শিক্ষা-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার ইতিহাসের নানা উদ্যোগ ও ব্যক্তিদের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বাঙালি মুসলিম সমাজের এমন একজন নারীর জীবনকথা তুলে ধরতে পেরে আমরা আনন্দিত। এই সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ। সাক্ষাত্কারটি প্রতিচিন্তায় প্রথমবারের মতো ছাপা হলো।

বাংলাদেশের বয়নশিল্পে জামদানি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত গুরুত্বের জন্যই নয়, বাণিজ্যিক তাত্পর্য বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিক স্বত্বাধিকার আদায়ের একটি অন্যতম জায়গা এই জামদানি। বর্তমান সময়ে জামদানির স্বত্ববিষয়ক মতবিরোধ এবং এর অর্থনীতি-রাজনীতি বুঝতে প্রবন্ধটি ছাপাতে উত্সাহিত করেছে। ইফতেখার ইকবাল জামদানির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভৌগোলিক নির্দেশনা নামক লেখায় ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন যে জামদানির উত্পত্তিস্থল ঢাকা।

অধ্যাপক মীজান রহমান নামটি এক মুক্তচিন্তক, সমাজসচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশি ছিলেন। অতিসম্প্রতি এমন একজন চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বাইরে থাকলেও দেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও আবেগ বারবার টেনে এনেছে মাতৃভূমিতে। মৃত্যুর মাস ছয়েক আগে তাঁর এই লেখাটি আমাদের হাতে আসে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘জ্ঞান সারথিকে শ্রদ্ধা’ এই শিরোনামে ছাপতে পেরে আমরা বিশেষ  সম্মানিত বোধ করছি।