অপ্রত্যাশিত কিউবা: নব্বই-উত্তর নীতি সংস্কারের গতিধারা

সারসংক্ষেপ

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশও বিপদে পড়ে। সাবেক সোভিয়েত ব্লকভুক্ত দেশগুলোর প্রায় সবাই পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তন করলেও, কিউবা সে পথ মাড়ায়নি। এর জন্য দেশটিকে কম মূল্যও দিতে হয়নি। চরম ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে দেশটি সমাজতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে। অবশ্য এর জন্য দেশটিকে নানা সংস্কার করতে হয়েছে। কমিকন (Council for Mutual Economic Assistance-COMECON) ট্রেডিং ব্লক ভেঙে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র-কিউবার পর্যবেক্ষকেরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পতন এই হলো বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কিউবাবিশারদেরা বলেছিলেন, দেশটিকে বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোর একগুঁয়ে মনোভাব ও পরবর্তীকালে রাউল কাস্ত্রোর সংস্কারের কারণে দেশটিতে এখনো সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা উড়ছে।

১৯৬২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি কিউবার ওপর অবরোধ আরোপ করলে সত্তর ও আশির দশকে কিউবা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দেশটিকে নানা সুবিধাও দিয়েছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবা আর সে সুবিধা পায়নি। এমনকি সাবেক কমিকনভুক্ত দেশগুলো ১৯৯০-এর দশকে যে সুবিধা পেয়েছে, তারা সেটাও পায়নি। ফলে কিউবাকে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করতে হয়েছে। এরপর তারা দেশে কিছু সংস্কার আনে। বেসরকারি খাতকেও তারা কিছুটা উত্সাহিত করে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ব্যক্তিদের দেশে ফেরার সুযোগ দেয়। আবার তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের ব্যাপারেও সচেষ্ট হয়।

এ সময় দেশটি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করে। ফলে দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও তার স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা এই অঞ্চলের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। এ থেকে বোঝা যায়, বৈপরীত্য ও সমস্যা থাকলেও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন মডেলের মধ্যেও বাজার ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আর সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সব নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে, তেমনটি মোটেই জরুরি নয়। অথবা পুঁজিবাদের পথে হাঁটতে হবে, সে কথাটিও শতসিদ্ধ নয়। প্রবন্ধটি মান্থলি রিভিউ জুলাই-আগস্ট ২০১৪ সংখ্যা থেকে অনূদিত।

মূখ্য শব্দগুচ্ছ: অবরোধ, কমিকন, কিউবাবিশারদ, মন্দা, ক্রান্তিকাল, বাজার ব্যবস্থাপক, শ্রমিক, ওয়াশিংটন কনসেনসাস (পিডব্লিউসি), ডে জিরো, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মৃত্যুহার, গড় আয়ু। 

প্রারম্ভিক কথা

সোভিয়েত ব্লকের পতনের সিকি শতাব্দী পর আজ কিউবার অর্থনীতি বিষয়ে কী রায় দেবেন? যে গল্পটা সাধারণত বলা হয়, তা খুবই সাধারণ, এর বার্তা খুবই পরিষ্কার। এই গল্পের বিষয় এ রকম: কিউবার অর্থনীতিতে সময় সময় নীতিগত পরিবর্তন হয়েছে, একবার প্রায়োগিকভাবেই বাজার অর্থনীতির শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করা হয়েছে, সে কারণে যদি কিছু উন্নতি হয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো আদর্শ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; যে কারণে অর্থনীতিতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।১ কমিকন ট্রেডিং ব্লক ভেঙে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র-কিউবার পর্যবেক্ষকেরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পতন আসন্ন। ‘কিউবার শক থেরাপি দরকার—দ্রুত বাজার অর্থনীতির দিকে যেতে হবে’, তারা ঘোষণা করে বসেন। দ্বীপরাষ্ট্রে পুঁজিবাদের পুনরুত্থান ‘অবশ্যম্ভাবী’; দেরি হলে কিউবার অর্থনীতিই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, মানবিক ক্ষতিও হবে বিপুল। এতে কিউবার সামাজিক অর্জনের সুনামহানি হবে। উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে ফিদেল কাস্ত্রো অত্যন্ত একগুঁয়ে অবস্থান নিলেও শেষমেশ তাঁর ‘শেষ সময়’ এসে গেছে।২

এই বিবরণের সমস্যা হচ্ছে, বাস্তবতা, খুবই দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে, ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মেলেনি। যদিও কিউবা খুবই ব্যতিক্রম বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে, তার অর্থনীতি সাবেক কমিকন দেশগুলোর অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এগিয়েছে। সোভিয়েত ব্লকের সদস্য হিসেবে সে বিশাল ধাক্কা খেয়েছে, যার মূলের ওপর তার নিজের হাত ছিল না। বহুদিনের মার্কিন বাণিজ্যবাধার কারণে এটা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাকে খুবই বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। তারপরও বিশ্বব্যাংকের কাছে যে ২৭টি দেশের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আছে, এতে তার অবস্থান ১৩। চিত্র ১-এ দেখা যায়, তার প্রবৃদ্ধির গতিমুখ ‘ক্রান্তিকালের অর্থনীতির’ সাধারণ প্রবণতা অনুসরণ করেছে। ১৯৯০-এর দশকে গভীর মন্দায় আক্রান্ত হয় দেশটি, এরপর শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। আর মাথাপিছু আয় ১৯৯০-এর পর্যায়ে যেতে প্রায় এক দশক লেগে যায়। আর খসড়া হিসেবে ২০১৩ সালের মধ্যে তা আরও ৪০ শতাংশ বাড়ে।৩ 

সন্দেহ নেই, কিউবার মানুষেরা ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রভূত কষ্ট করছে। কিন্তু সামাজিক উত্পাদনের দিক থেকে সাবেক কমিকন দেশগুলোর অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। চিত্র ২-এ দেখা যায়, কিউবার শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১১ জন। কমিকন দেশগুলোর তুলনায় সে সময়ই তা ভালো ছিল। আর ২০০০ সালের মধ্যে তা কমে দাঁড়ায় প্রতি হাজারে ছয়জন। সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকেই তা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কেন্দ্রীয় ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় ভালো। আর আজ সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে পাঁচজন, তা এমনকি জাতিসংঘের হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো, আর লাতিন আমেরিকার গড়ের তুলনায় অনেক ওপরে। চিত্র ৩-এর গড় আয়ুর বিবেচনায়ও একই চিত্র দেখা যায়, কিউবায় গড় আয়ু ১৯৯০-এর দশকে ৭৪ থেকে বেড়ে ৭৮-এ দাঁড়িয়েছে। যদিও এই দশকের সবচেয়ে কঠিন কয়েকটি বছরে মৃত্যুহার কিছুটা বেড়েছিল।৪ অন্যদিকে একই সময়ে অন্যান্য সাবেক কমিকন দেশে গড় আয়ু ৬৯ থেকে কমে ৬৮ হয়েছে। আজ সাবেক সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোর মধ্যে কিউবার মানুষের গড় আয়ু অন্যতম সর্বোচ্চ আর লাতিন আমেরিকার মধ্যে তা সর্বোচ্চ।

মিয়ামির মতামত

দ্বীপরাষ্ট্রটির বাইরে মূলধারার বিশেষজ্ঞ মতামতে এসব উপেক্ষিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রটি মূলত মার্কিনভিত্তিক, তাদের অর্থায়নেই এটি পরিচালিত হয়। আর অভিবাসী কিউবাবিশারদেরা বিপুল উত্সাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এটি পরিচালনা করে, তারা এভাবে নিজেদের স্টাইল তৈরি করেছে। তারা হাভানার ব্যাপারে অত্যন্ত বৈরী।৫ ১৯৭০-এর দশক থেকে এ ক্ষেত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা হচ্ছেন পিট্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কারমেলো মেসা লাগো, তাঁকে ‘দ্য ডিন অব কিউবান স্টাডিজ’ অভিধা দেওয়া হয়েছে। তাঁর ৩০টির বেশি বই আছে। তাঁর অনেক বইয়ের সহলেখক হচ্ছেন ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের পরিচালক জর্জ পেরেজ-লোপেজ, তিনিও এই কাতারে আছেন। তিনি নাফটার একজন নেতৃস্থানীয় মধ্যস্থতাকারী, দীর্ঘদিন ধরে তিনি অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব দ্য কিউবান ইকোনমির প্রধান। মিয়ামি থেকে প্রকাশিত এএসসিইর বার্ষিক প্রকাশনা কিউবা ইন ট্রানজিশন-এ কিউবার অর্থনীতিকে পুঁজিবাদী পথে আনার লক্ষ্যে বেশ কিছু পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে। জার্নালের শিরোনাম থেকে বোঝা যায়, কিউবাবিশারদেরা ‘ক্রান্তিকালের অর্থনীতির’ ধারণার আলোকে কাজ করেন। উন্নয়ন অর্থনীতির শাখা হিসেবে ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে এটি গড়ে ওঠে। এর লক্ষ্য ছিল সাবেক কমিকন দেশগুলোতে পশ্চিমা পুঁজির অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা। এই মডেল আবার পরিণামে ওয়াশিংটন মতৈক্য কাঠামোর আলোকে প্রণীত হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ১৯৮০-এর দশকে ঋণগ্রস্ত লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে যে সংস্কার চাপিয়ে দিয়েছিল, সেটাকে কেন্দ্র করেই এই মডেল দানা বেঁধে উঠেছিল।৬ এর নীতি পরামর্শের মূল কথা ছিল এ রকম: অর্থনীতিতে বৈশ্বিক পুঁজির অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া, মজুরি ও মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত আইন শিথিল ও সামাজিক ব্যয় কমানো। পূর্ব ও কেন্দ্রীয় ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত ব্লকের অনেক জায়গায় এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ইবিআরডি, ইউএসএইড ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের টেকনোক্র্যাটরা। এ ক্ষেত্রে পুরোধাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জানোস কোরনাইয়ের স্পষ্টত হাইয়েকিয়ান ‘দ্য রোড টু আ ফ্রি ইকোনমি’ (১৯৯০)। কয়েক বছরের মধ্যে এক ফুলে-ফেঁপে ওঠা ‘উত্তরণ’ শিল্প গড়ে ওঠে। এই শিল্প স্বতঃসিদ্ধরূপে ধরে নেয় যে অনুসরণ করার মতো একটি পথই আছে—পরিকল্পিত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজারের পুঁজিবাদ। এটা আটকানোর চেষ্টা শুধু নিষ্ফলই হবে না, তার মূল্যও হবে অনেক। কারণ, আংশিক সংস্কার করতে গেলে তা অনিবার্যভাবেই ব্যর্থ হবে।৭ ‘উত্তরণশীল দেশগুলো’ ১৯৯০-এর পর যখন মন্দার মুখে পড়ল, তখন সেই প্রতিবন্ধকতার দায় রাজনৈতিক অভিজাতদের ঘাড়ে চাপানো হয়। ‘স্পিড ও স্কেল’ ছিল এর মূল, সেই সময়ের ‘অসাধারণ রাজনীতির’ সুযোগ নেওয়া জরুরি ছিল।৮

এদিকে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এসে কিছু কারণে ‘উত্তরণ’বিষয়ক গোঁড়ামিতে পরিবর্তন আসে। প্রথমত, সাবেক সোভিয়েত ব্লকের বিভিন্ন দেশের পশ্চিমমুখী সরকারগুলো সে সময় কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জন করে। ফলে রাজনৈতিক অপরিহার্যতার ব্যাপারটি থিতিয়ে আসে। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া সাবেক কমিকন অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রপরিচালিত উন্নয়ন, নব্য শিল্পায়িত ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যকার পার্থক্য এত বেশি ছিল যে তা কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব ছিল না। আবার ওদিকে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোর কাঠামোগত সংস্কার ব্যর্থ হয়েছিল। বিকাশমান পোস্ট ওয়াশিংটন কনসেনসাসে (পিডব্লিউসি) প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও ‘সুশাসনের’ ওপর জোর দেওয়া হয়। উত্তরণবাদী অর্থনীতিবিদেরা এই পালাবদল ঘটাতে গিয়ে উন্নয়নবাদী অর্থনীতিবিদদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে প্রভাবশালী পাঠ্যবইগুলোতে এই অনুমান ও প্রকৃত ফলাফলের মধ্যকার পার্থক্য স্বীকার করে নেওয়া হয়, ফলে ‘দর্পচূর্ণ’ হয়। উত্তরণ পাঠগুলো নিজেদের পিডব্লিউসি গড়ে তোলে।৯ কিন্তু সংস্কারের গতিতে জোর কম দেওয়া হলেও ‘উত্তরণের অগ্রগতিকেই’ অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর সব সমস্যার দায় চাপানো হয় অযথাযথ উদারীকরণের ওপর।

মূলধারার কিউবাবিদ্যা মূলত ওয়াশিংটন মডেলের ভিত্তিতে প্রণীত। এই ঘরানার ভাষ্য হচ্ছে, কিউবার বাজারবিরোধী নীতির কারণেই ১৯৯০-৯৩ সালে সেখানে গভীর মন্দা সৃষ্টি হয়েছিল, বাইরের কারণগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আংশিক সংস্কারের সমালোচনা হিসেবে মেসা লাগো ১৯৯৪ সালের কিউবার পদক্ষেপকে ‘আধাখেঁচড়া’ ও ‘অপরিপক্ব’ আখ্যা দিয়ে আক্রমণ করেন।১০ কিউবার নীতির প্রচলিত ব্যাখ্যা খুবই সরল, এটা প্রেসিডেন্টের ‘কট্টর গোঁড়ামির’ ফসল। এর সঙ্গে আছে তাঁর ‘বাজার সংস্কারে অনীহা’, বিরোধীদের দমনের অভিপ্রায় ও পুরো জাতিকে সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছা। কয়েকজন ভাষ্যকার এই দোষটা আরও ছড়িয়ে দিলেন: রুবেন বেরিওস বৃদ্ধ নেতা ও কট্টর আমলাতন্ত্রের তীব্র নিন্দা করেন, যারা পুরোনো অভ্যাসকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। মরিসিও ডি মিরান্ডা বললেন, তিনি পুরো শাসক মহলের মধ্যেই সংস্কারের মধ্যে অনীহা দেখেন।১১ ‘উত্তরণ’ নীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে কিউবার অর্থনীতি দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বা সম্প্রতি সে কারণে দেশটি ভেনেজুয়েলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

হাভানার দৃষ্টিভঙ্গি

সাবেক কমিকন দেশগুলোর চেয়ে কিউবা ভিন্ন দুটি জায়গায়, পিট্সবার্গ-মিয়ামি অক্ষ এই বিষয় দুটিকে এড়িয়ে যেতে চায়। প্রথমটি হচ্ছে, প্রাক-কমিউনিজম যুগের চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা এবং এর সঙ্গে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির মুক্তবাজার অভিমুখে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণের তেমন আগ্রহ নেই। দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, মধ্য ইউরোপের ক্ষেত্রে ‘উত্তরণ’ ব্যাপারটা জাতীয়তাবাদী আবেগের বশে রাশিয়ার আধিপত্য থেকে মুক্ত হওয়ার ব্যাপার। আর রাশিয়া মনে করে, এটা ঐতিহাসিক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি। এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কিউবার অর্থনীতিবিদ ও নীতিপ্রণেতারা কাজ করছেন।১২ উপদেষ্টা ও কর্মকর্তারা ‘উত্তরণের’ পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলেন না, তাঁরা ‘সমন্বয়ের’ কথা বলেন। বহিঃস্থ পরিবেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক মানদণ্ডের আলোকে তাঁরা এই অবস্থান নেন। অর্থাত্ সংস্কার কর্মসূচি প্রত্যাখ্যানের পেছনে আদর্শ-অনুপ্রেরণার যে কথা কিউবাবিশারদেরা বলে থাকেন, সে তুলনায় এটা ইঙ্গিত দেয়, নীতিকাঠামো নমনীয়। এই কাঠামো কট্টর কিছু নয়। অর্থনীতিবিদ ও নীতিপ্রণেতারা একইভাবে প্রিনসিপিওর আলোকে এই মানদণ্ডের কথা বলে থাকেন। তাঁরা মার্ক্সবাদী, লেনিনবাদী গোঁড়ামি বা ‘পার্টি লাইনে’ কাজ করেন না। এই নীতি ব্যতিক্রমহীনভাবে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ঊর্ধ্বে তুলে ধরার কথা বলে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সমতা ও পূর্ণ কর্মসংস্থানের সফলতা ধরে রাখতে চায় এটা। কখনো কখনো সেটাকে লোস লোগরোস বলা হয়। এই নীতি ‘বিপ্লবী নৈতিকতা’ ধরে রাখার কথাও বলে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই নীতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়, জাঁকজমক অগ্রাহ্য করে।১৩ এই তত্ত্ব নীতি স্বাধীনতার ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে।

অর্থনৈতিক নীতিবিষয়ক অভ্যন্তরীণ যে বিতর্ক রয়েছে, তা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের চোখে ধরা পড়ে না বললেই চলে। মার্কিনভিত্তিক কিউবাবিশারদেরাও এর বাইরে নয়। এর আংশিক কারণ হচ্ছে, কিউবার বন্ধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও গণমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ। ফলে অনেক বিদেশি ভাষ্যকারই গুজবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্রে যে খবর পৌঁছায়, তার বেশির ভাগই আসে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর কাছ থেকে। এগুলোতে টাকা দেয় হয় প্রবাসী সংগঠনগুলো, না হয় মার্কিন কর্মসূচিগুলো। ফলে এদের সবার মধ্যে মতৈক্যের পূর্বকল্পনা সৃষ্টি হয়। আলোচনা, নীতি প্রণয়ন ও অভিযোজনের ব্যাপারটি বাইরের মানুষদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে নেতাদের ইচ্ছা সব সময় বিরাজ করে না। পোডার পপুলার কাঠামোর আলোয় একই সঙ্গে আশপাশে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একের পর এক বৈঠক হয়েছে, সেখানে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে নিরন্তর বিতর্ক হয়েছে, যা নীতি আলোচনার রসদ জুগিয়েছে।

অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেন্ত্রো দে এসতুদিওস দে লা ইকোমিয়া কিউবানা (সিইইসি), সেন্ত্রো দে ইনভেস্টিগেশনস সোব্রা লা ইকোনমিয়া ইন্টারন্যাশনাল (সিআইইসি), দ্য ইনস্টিটিউটো ন্যাশনাল দে ইনভেস্টিগেশনস ইকোনমিকাস (আইএসআইই) প্রভৃতির অর্থনীতিবিদেরা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সেন্ত্রো দ্য এসতুদিয়াস দে লা আমেরিকাস (সিইএ) নীতিপ্রণেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেছেন। তাঁরা বিরাজমান ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার দাওয়াই বের করতে নানা তর্ক-বিতর্ক করেছেন। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমের প্রতিষ্ঠিত ওয়ার্কিং গ্রুপ সমাজতন্ত্রের নানা মডেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, কিউবায় তার প্রয়োগ কীভাবে হবে তা নিয়ে কাজ করেছে। অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রের সমস্যা ও উদ্যোক্তা ব্যবস্থাপনার সংস্কার আর সোভিয়েত ব্লক পতনের রাজনৈতিক ও দার্শনিক তাত্পর্য কী—এসব নিয়েও কাজ করেছে তারা। সিআইএর ইকোনমিয়া কিউবানা: বোলেতিন ইনফরমেটিভো, আইএনআইইর কিউবা: ইনভেস্টিগেশন ইকোনমিকায় প্রকাশিত তাদের লেখা পত্রে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যই অনুসরণ করা হয়েছে। ফলে বাইরের পর্যবেক্ষকদের কাছে এর মাজেজা দুর্বোধ্য হয়ে যায়। নানা রকম ঐতিহাসিক বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণী অন্তর্দৃষ্টি হারিয়ে যায়। থাকে শুধু নেতাদের বক্তৃতার উদ্ধৃতি ও অর্জনের প্রশংসাস্তবক। শব্দভান্ডারও অপরিচিত, আইএমএফের পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার না করে কিউবার অর্থনীতিবিদেরা ‘অভিযোজন’, ‘আধুনিকায়ন’, ‘বাজারের কার্যসাধনপদ্ধতি’, নির্ধারিত মূল্যের ‘সমন্বয়’, ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ পদক্ষেপ ও ‘উত্থানশীল’ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া প্রভৃতি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে। কিউবাবিশারদদের ট্রানজিশন অর বাস্ট স্পেকটেকল পড়ুন, এটা কোনো বিতর্কের সৃষ্টি করে না। আর এতে তাদের এই সন্দেহ আরও পোক্ত হয় যে নীতি পুরোপুরিভাবে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছায় নির্ধারিত হয়।১৪

ওদিকে মূল ধারাভাষ্যের বাইরে এই দ্বীপরাষ্ট্রবিষয়ক নানা ভাষ্য রয়েছে। সেখানে তিন ধরনের মনোভঙ্গি লক্ষ করা যায়। প্রথম ঘরানাটি শাসনব্যবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল ও আত্মপক্ষ সমর্থনকারী, তারা কিউবাবিশারদদের নেতিবাচক প্রচারণার বিরোধিতা করে ও কিউবার বাস্তবতাকে রং পলিশ করে প্রকাশ করে। এই মতৈক্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে তারা প্রস্তাবটি পেশ করে পুঁজিবাদে উত্তরণ ও তার বিরোধিতার মধ্যকার বিকল্প হিসেবে পেশ করে। তারা এর প্রথম ব্যাপারটি উদ্যাপন করে আর বাজার খুলে দেওয়ার ব্যাপারটি ‘অনিবার্যের কাছে আত্মসমর্পণ’ হিসেবে বিলাপ করে থাকে।১৫ দ্বিতীয় দলটিকে সমালোচনামূলক বন্ধু হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। তারা কিউবার নীতিপ্রণেতাদের ব্যাপারে ইতিবাচক আর দেশটি যে সমস্যার মুখোমুখি হয়, সেটা তারা স্বীকার করতে রাজি। কিন্তু আবার কিউবাবিশারদদের মতো তারা ‘উত্তরণের’ অগ্রগতিকে অর্থনৈতিক পারফরম্যান্সের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়। তাদের মত হচ্ছে, কিউবার দুর্দশার কারণ হলো ‘ক্রমানুসারী পরিবর্তনের’ অভাব।১৬ শেষমেশ, খুব কম সংখ্যক অর্থনীতিবিদ কিউবার উন্নয়নকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, তুলনামূলক পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রকম পরম কারণের পূর্বানুমান ছাড়াই। এসব তদন্তের ভিত্তিতে হোসে মার্চ-পৌকেট বলেছেন, কিউবার অর্থনৈতিক নীতি ওসব ‘উত্তরণ’ দেশগুলোর জন্য বিকল্প হিসেবে হাজির করা যেতে পারে, যেটা চারিত্রিকভাবে বিবর্তনমূলক ও পরীক্ষামূলক। ভিয়েতনাম, চীন ও কেন্দ্রীয় ইউরোপের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করে চার্লস ব্রুনডেনিয়াসের পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এর ফলে ‘কিউবার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসমেত বাজার অর্থনীতি’ সৃষ্টি হতে পারে।১৭

কিউবার গতিপথ ও ‘উত্তরণ’ অর্থনীতিবিষয়ক মূলধারার ভাষ্যের মধ্যকার অন্তর্নিহিত তুলনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রকৃত তুলনামূলক পাঠ খুবই বিরল। যথোপযুক্ত সংখ্যক তথ্য চিহ্নিত করার সমস্যা থেকে এর উদ্ভব হতে পারে। কিন্তু এতে আবার বোঝা যায়, কিউবাবিশারদেরা শুধু নিজেদের দেশেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চান।১৮ একই সঙ্গে মূলধারার উত্তরণ অর্থনীতিবিদেরা কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপ, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা রাশিয়া-চীনের বৈপরীত্যে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখতে চান। এঁরা ব্যাপক হারে তুলনামূলক কাঠামো ব্যবহার করেন। কিউবার নিজস্ব পথ এতে যে আলো ফেলতে পারে, সেটা তাঁরা উপেক্ষা করেন। এরপর যা আসবে বিশ্লেষণী আখ্যান, তুলনামূলক পাঠের পরিপ্রেক্ষিতে কিউবার সমন্বয়নীতির সুলুক সন্ধান। এর পরিসর হবে শুরুর দিকের সংকট ব্যবস্থাপনা থেকে স্থিতিশীলতা অর্জন, পুনঃকাঠামো ও রাউল কাস্ত্রোর অধীনে সবচেয়ে সাম্প্রতিক সংস্কার পর্যন্ত।১৯

এটা শুধু বিদ্যমান ব্যাখ্যার সমস্যাগুলো তুলে ধরতে চায় না, বরং কিউবার পথ কী হবে সে-বিষয়ক ফলপ্রসূ আলোচনায়ও ভূমিকা রাখতে চায়। আর বিশ্বায়িত দুনিয়ায় নতুন করে বিকল্প উন্নয়ন কৌশল-সংক্রান্ত প্রশ্নেরও অবতারণা করতে চায়।

১. সংকট ব্যবস্থাপনা

সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেলে এ ব্লকভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়ে কিউবা। ১৯৭০ সালে একরকম বাধ্য হয়েই কমিকনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় কিউবা। এর কারণ ছিল মার্কিন অবরোধ, ১৯৬২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি যা আরোপ করেন। আগের বছরের সিআইএ-সমর্থিত সামরিক আগ্রাসনের ব্যর্থতাই ছিল এই নিষেধাজ্ঞার কারণ। ফলে কিউবা বৈদেশিক বাণিজ্যে এক পুরোনো বন্ধুকে হারিয়ে ফেলে। এতে করে সত্তর ও আশির দশকে কিউবা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর। কিউবার অর্থনীতিও চরমভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে চিনি রপ্তানির ওপর। চিনি রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছিল কিউবা। চিনিতে তার পাউন্ডপ্রতি আয় হচ্ছিল শূন্য দশমিক ৪২ ডলার করে, যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ছিল পাউন্ডে শূন্য দশমিক ০৯ ডলার। কিউবায় জিডিপির ৪০ শতাংশই খরচ হচ্ছিল আমদানির পেছনে। কিউবাকে রাষ্ট্রের মোট খাদ্য সরবরাহের ৫০ শতাংশ আর কৃষি ও উত্পাদন খাতের জন্য প্রয়োজনীয় তেল ও কাঁচামালের ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়া কিউবাকে সহজ শর্তে তিন বিলিয়ন ডলার করে ভর্তুকি দিচ্ছিল। ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে কমিকনের সঙ্গে করা চুক্তিগুলোকে কিউবা হার্ড কারেন্সি বাণিজ্যে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলে ১৯৯১ সালের মধ্যেই সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সব ধরনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ভেঙে যায়।২০ বাইরে থেকে খাদ্য, জ্বালানি আর কাঁচামাল আসা বন্ধ হয়ে যায়। রপ্তানি আয়, বৈদেশিক সাহায্য আর আমদানি সক্ষমতার তুলনামূলক উপাত্তগুলো দেখলেই বোঝা যায়, বাইরের চাপের মাত্রা কত তীব্র ছিল।

রপ্তানি আয়ে কিউবা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, এত দিন পর্যন্ত তারা বিশেষ লাভজনক দামে চিনি বিক্রি করে আসছিল, আর এই চিনি কোনোভাবে অন্য কোনো বাণিজ্য সহায়ক রাষ্ট্রে রপ্তানির সুযোগও ছিল খুব কম। সাবেক কমিকনভুক্ত প্রায় সব দেশই ১৯৯৩ সালের মধ্যেই রপ্তানি আয়ে ১৯৯০ সালের পর্যায়ে চলে যায়। এদিক থেকে কিউবা প্রায় ৭৯ শতাংশ পিছিয়ে ছিল। আয়ের অঙ্কটা ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে একেবারে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। বৈদেশিক বিনিয়োগেও হাভানা খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব বৈদেশিক সাহায্যের আচমকা হাওয়া হয়ে যাওয়া আর নতুন নতুন বিনিয়োগ ক্ষেত্রের অভাব—এই দুইয়ে মিলে অর্থনৈতিক ধাক্কার তীব্রতা একদম চরমে চলে যায়। এই ‘ক্রান্তিকালীন’ সময়ে যখন অন্য দেশগুলো আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক আর ইবিআরডির মতো প্রতিষ্ঠানের সাহায্য পাচ্ছিল, তখন মার্কিন হস্তক্ষেপে এসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল কিউবা। এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৯৯১-৯৬ সালে ‘ক্রান্তিকালীন/পরিবর্তনমূলক’ অর্থনীতির জন্য বাকিরা যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ পাচ্ছিল মাথাপিছু ১১২ ডলার, সেখানে কিউবার হাতে আসছিল মাত্র ২৬ ডলার করে।২১ হাভানাকে কোনো তৃতীয় দেশ যেন ঋণ না দেয়, সে লক্ষ্যে মার্কিন ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস অন্যদের ভীতি দেখিয়ে নিরস্ত করে। ফলে কিউবার এই সংকটকালে আর্থিক সাহায্য পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত হয়ে পড়ে।

রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক ঋণে ধস নামার ফলে কিউবার আমদানি সক্ষমতা ব্যাপক মাত্রায় কমে যায়। কমিকন থেকে বাদ পড়া আর কোনো দেশেই এমনটা দেখা যায়নি। ১৯৯০-১৯৯৩-এর মধ্যে কিউবার আমদানি খরচ ৭০ শতাংশ কমে যাওয়ায় দেশটির আমদানি-জিডিপি অনুপাত কমে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ। ইবিআরডির হিসাব অনুসারে, এটি খুবই কম। ১৯৯৩ সাল নাগাদ রাষ্ট্রের সব আমদানির চাহিদা মেটানোর জন্য কিউবার কাছে মজুত অর্থের পরিমাণ ছিল খুব কম। ১৯৯০ সালে কেবল জ্বালানি আর খাদ্য আমদানিতে যত ব্যয় হয়েছিল, এটা ছিল তার চেয়েও কম! এদিকে মার্কিন বাধার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হারকেও আগের মতো বাড়ানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিল। আমেরিকার এই বাধার কারণে কিউবার জন্য শুধু আমেরিকার বাজারই বন্ধ হয়ে যায়নি, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণ কিংবা উন্নয়ন-সহায়তা লাভ করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। বাণিজ্যিক বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পাওয়া খুবই ব্যয়বহুল ও কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে কিউবাকে সাবেক কমিকনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি অভাবে পড়তে হয়। ফলে আটকে যায় বিনিয়োগ ও উন্নতি। এতে বাণিজ্য চুক্তির কোনো শর্তে একটু পরিবর্তন হলেই কিংবা কৃষিজ ফলনে সামান্যতম হেরফের ঘটলেই একেবারে নাজুক হয়ে পড়েছিল দেশটি।

জরুরি পদক্ষেপসমূহ

কিউবাবিশারদেরা মনে করেন, কমিকন পতন-পরবর্তী ব্যাপক বিরূপ প্রভাব সত্ত্বেও নিজের পথে চলার কারণেই ১৯৯০-৯৩ সালে কিউবার অর্থনৈতিক সংকোচন ঘটে। তাদের কাছে মনে হয়েছে অর্থনৈতিক নীতিতে পরিবর্তন অথবা অনমনীয় থাকা—এর যেকোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে। ১৯৯০ সালের পর দেশটি  যে রাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে, তা প্রকৃতপক্ষে ১৯৮৬ সালের ‘বাজার বিমুখী’ সংশোধনবাদী কৌশলেরই একধরনের সম্প্রসারণ। যেখানে দুর্নীতিবিরোধী তত্পরতা, কৃষিবাজার নিয়ন্ত্রণসহ পর্যটন ও নানা রকম যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগের মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়। সব কমিকনভুক্ত দেশই ১৯৮০ সালের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বাঁচতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। এরপরও এমন চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সন্ধিক্ষণে যথার্থ পদক্ষেপ নিতে হাভানা ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।২২ কিন্তু ১৯৯০-৯১ সালে বহির্বিশ্বের কাছে এমন ধাক্কা খেয়ে কিউবার সরকার যে কিছুই করেনি, ব্যাপারটা এমন নয়। দ্রুত ফুরোতে থাকা সম্পদকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাধান্যে পরিণত করার জন্য বেশ কিছু জরুরি পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়। আসলে এই ধাক্কার তীব্রতায় পদ্ধতিগুলোতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাঁচামাল আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সব অর্থনৈতিক পরিকল্পনা স্থবির হয়ে যায়। কমিকনভুক্ত অন্যান্য সহযোগী দেশ যখন উদার নীতি ও বেসরকারীকরণের দিকে এগোচ্ছিল, কিউবা তখন তার টিকে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোগুলো রক্ষা করে সেগুলোকে আরও সামনে নিয়ে যাচ্ছিল। এগুলোর মধ্যে শুধু কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না, দর নিয়ন্ত্রণ, একচেটিয়াভাবে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন নিয়ন্ত্রণ ও উত্পাদনমাধ্যমগুলোর জাতীয়করণ ছাড়াও ছিল সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত কিছু গণ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করা ও একটি পদ্ধতিগত নীতির প্রতিক্রিয়া, যা জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ আর আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে একটা লাভজনক প্রথা আকারে কিউবায় দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছিল।

ফিদেল কাস্ত্রোর কাছে এই সংকটকাল ছিল ‘শান্তির এক বিশেষ কাল’। বহির্বিশ্বের পর্যবেক্ষকদের কাছে মনে হয়েছে, এটা স্রেফ সুভাষণ। কিন্তু এই শব্দগুলোর অর্থ কিউবার সবাই বুঝে যায়: দুর্যোগের সময়ে ও মার্কিন হামলা মোকাবিলা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত নাগরিক প্রতিরক্ষার প্রক্রিয়া। ১৯৯০ সালে অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে কারখানা, অফিস, আবাসিক ঘরবাড়ি, স্কুল আর হাসপাতালে অল্প সময়ের জন্য বিদ্যুত্ আর পানির সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হতো, যাতে জরুরি অবস্থার সময় খাপ খাওয়ানো যায়। সব প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সিতে অনুসৃত এই সামগ্রিক সমন্বয় অনেকটা হারিকেনের পূর্বপ্রস্তুতি ও সামরিক প্রতিরক্ষা অনুশীলনের মতোই। ১৯৯১ সালে গৃহীত খাদ্য কর্মসূচিতেও এই একই ধরনের উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। সেবার, খাদ্য উত্পাদন-প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য কৃষক ও শহরবাসী—সবার প্রতিই আহ্বান জানানো হয়েছিল। পুরোনো যন্ত্রপাতি নবায়ন করে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে একইভাবে যন্ত্রপাতি আমদানির বিকল্প হিসেবে অতিরিক্ত কলকবজা ফোরাম বানানো হয়। এরপর ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে নেওয়া হয় জ্বালানি পরিকল্পনা, যেখানে আবাসিক, উদ্যোক্তা আর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ—সবাই মিলে জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার রাস্তা বের করে।

পরিবর্তনমূলক/ক্রান্তিকালীন অর্থনীতির মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশগুলো থেকে একটি জায়গায় পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানে দেখা যায় কিউবাকে। ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে এসব জায়গায় যখন বেকার সমস্যা ২০ শতাংশে পৌঁছে, কিউবা তখনো কর্মসংস্থান আর সমাজকল্যাণ বজায় রাখার ও সব মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল২৩। কিউবাতে, যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে শতকরা ৯৮ ভাগ কর্মীর নিয়োগকর্তা হচ্ছে সরকার, সেখানে কর্মসংস্থানের সংখ্যা ১৯৯০-৯৩-এ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার; কিউবার অর্থনীতি এক-তৃতীয়াংশ কমে যাওয়ার পরও। সরকারি হিসাবে বেকারত্বের হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে।২৪ এ সময় রাষ্ট্র বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো বাতিল করে, জ্বালানি বণ্টন কমায়, গণপরিবহন কমিয়ে আনে, সাপ্তাহিক কর্মদিবস কমিয়ে দেয় (৫.৫ দিন থেকে ৫ দিন)। এমনকি তারা অনেক কারখানাই বন্ধ করে দেয়, আর চালালেও একেবারেই অল্প সময়ের জন্য তা খোলা রাখে। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে শ্রম ও সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ডিক্রি জারি করে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এই ডিক্রিতে শর্ত দেওয়া হয়, কাঁচামালের অভাবে যেসব কর্মীকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, তাদের পুনরায় কাজে ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত আগের বেতনের দুই-তৃতীয়াংশ দেওয়া হবে। শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে যে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হতো, বেকার ভাতার তুলনায় তা ছিল তুলনামূলকভাবে কম।

১৯৯০ সালের প্রথম দিকে চরম অভাব সত্ত্বেও খাদ্যের মৌলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। একোপিও নামের সরকারি বিতরণ সংস্থা কিউবার খামার ও আমদানি গুদাম থেকে খাদ্য সংগ্রহ করত। এসব খাদ্য তারা খাদ্য রেশনিং পদ্ধতিসহ অন্যান্য মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিত। ভিয়াস সোসিয়াল্যাসের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে, স্কুলে ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে বিনা মূল্যে কিংবা ভর্তুকিতে খাবার সরবরাহ করা হতো। রেশনিং পদ্ধতিতে নির্ধারিত মূল্যের কারণেই খাদ্যের মৌলিক চাহিদা মেটানোর মাসিক মাথাপিছু খরচ ৪০ পেসো, মাথাপিছু মাসিক সর্বনিম্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা ৮৫ পেসোর নিচে রাখা সম্ভব ছিল।২৫ এই সংকটের শুরুর দিকেই রাষ্ট্র পরিচালিত যে দোকানগুলোতে বাজারমূল্যের কাছাকাছি দামে রেশনবহির্ভূত খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা হতো, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।২৬ এই খাদ্য প্রকল্প জমি চাষে পশু ব্যবহার, জৈবিক সার, জৈব কীটনাশকের ব্যবহার এবং প্রান্তীয় জমি চাষাবাদে স্থানীয়ভাবে স্বতঃপ্রণোদিত আর ছোট মাত্রার পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে উত্সাহ দিয়েছে।২৭

বিকেন্দ্রীকরণ ও বিতর্ক

পরিস্থিতির পটপরিবর্তনের সঙ্গে এমনকি চরম জরুরি অবস্থাতেও কিউবা যেসব উপায়ে নিজেকে খাপ খাইয়েছে, তার সঙ্গে কিউবাবিশারদদের বর্ণিত কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক আসলে খুবই কম। এটি চূড়ান্ত পর্যায়ের এক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এর ভেতরে রেশনিং পদ্ধতিতে খাদ্য সরবরাহের মতো ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীভূত হয়ে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এ সময় ভিয়াস সোসিয়াল্যাসের মতো অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে থাকে।২৮ ফলে সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা স্থানীয় সরকারি এজেন্সিগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সিস্টেমা দে ভিজিল্যানসিয়া আলিমেনতারিয়া ই নিউট্রিশনাল (সিসভান), যারা পুষ্টির মান ও রেশনের অতিরিক্ত বণ্টন তদারক করত। তারা ইউনিসেফ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তায় মা ও শিশুদের সাহায্যের জন্য বিভিন্ন সহযোগিতামূলক নেটওয়ার্ক চালাত, যে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের সমাজের সবচেয়ে কমজোর মানুষদের চেনে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ১৯৯১ সালে গঠিত হয়েছিল কন্সেজোস পপুলারেস নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ি চিহ্নিতকরণ ও ত্রাণ প্রকল্পগুলোর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সাহায্য করত।২৯ অর্থনীতির ওপর থেকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সাধারণভাবে কিছুটা শিথিল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর এই রকমের অভিযোজন আর বিকেন্দ্রীকরণ ঘটতে থাকে। সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে উদ্যোক্তাদের ব্যবস্থাপকদের সমস্যার স্থানীয় সমাধান খুঁজে বের করতে হয়েছিল। অন্যদিকে এ সময়ে প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করা বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচামালের ওপর থেকে তাদের অতীতের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে শুরু করে, আর হাজার হাজার উদ্যোগের জন্য বাজার নিশ্চিত করে।৩০

গোটা আমেরিকা মহাদেশে একমাত্র ‘অগণতান্ত্রিক’ দেশ হিসেবে কিউবার বিপক্ষে প্রচারণা ছিল। যেসব গণসংগঠন কিউবায় অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিল, তাদের পক্ষে সেটা করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ১৯৯০-পরবর্তী ঘটনাক্রম বুঝতে হলে এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তখন সংকটের নানা মুহূর্তে সারা দেশে বেশ কিছু জাতীয় বিতর্কের সূত্রপাত হয়। দেশব্যাপী নানা অধিবেশন আয়োজন করা হয়। এ রকম কিছুই সাবেক কমিকনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দেখা যায়নি। ১৯৯০-এ যখন সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছিল, সে সময়েই কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ সম্মেলনের সব প্রস্তুতি শুরু হয়। অর্থনৈতিক সমস্যা যতই গভীর হচ্ছিল, সম্মেলনের আগে আলোচনার সুযোগ আরও বাড়ছিল। শুধু পিসিসির শাখাগুলোতেই না, এসব বিষয়ে কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে গণসংগঠনগুলোতেও হাজার হাজার বৈঠক হয়েছে।

কমিকন পুরোপুরি বিলোপ হওয়ার তিন মাসের মাথায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে অর্থনীতির জন্য ১৮টি পয়েন্ট-সংবলিত একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়। এটাই ছিল কিউবার নয়া কাঠামো নীতিবিষয়ক প্রথম পূর্ণাঙ্গ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য।৩১ পশ্চিমা উপদেষ্টাদের সহযোগিতায় অন্য কমিকনভুক্ত দেশগুলো পরিবর্তনের নতুন নতুন যেসব প্রকল্প হাজির করেছিল, এই প্রস্তাব ছিল তাদের থেকে একেবারেই আলাদা। পিসিসির এই প্রস্তাব উদারীকরণের নীলনকশা ছিল না। এটা ছিল বিশেষ কিছু নীতি আর লক্ষ্যের একটা তালিকা। সময়সীমা কিংবা পর্যায়ক্রম সম্পর্কে এতে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে কিউবাবিশারদেরা এই প্রস্তাবকে যেভাবে সরাসরি ‘বাজারবিমুখ’ বলেছেন তা বিভ্রান্তিকর। এই প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সার্বিক কাঠামো বজায় রেখেই সার্বভৌমত্ব আর সামাজিক নিরাপত্তার মূলনীতিগুলোর প্রতি বারবার অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এটি ছিল উদারনীতি আর রাষ্ট্র পরিচালিত প্রচেষ্টার এক মিশ্রণ। ‘পর্যটন উন্নয়ন’, ‘রপ্তানি বাড়ানো’, ‘আমদানি কমানো’, ‘বৈদেশিক বিনিয়োগের নতুন রাস্তা খোঁজা’, ‘রাষ্ট্রীয় ব্যয় আর অর্থ জোগান নিয়ন্ত্রণ’ করার মতো বিষয়গুলো দেখে মনে হচ্ছিল কিউবা নতুন সৃষ্ট আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আংশিকভাবে হলেও উদারনীতিরই পথ ধরেছিল। আবার ‘খাদ্য প্রকল্প জারি রাখা’, ‘স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে অধিক প্রাধান্য প্রদান’, ‘গণকল্যাণের পরিকল্পনার কেন্দ্রীকরণ’, ‘বিপ্লবের অর্জন রক্ষা করার’ মতো অন্য বিষয়গুলো থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্রের ভূমিকার পরিসর কমেনি। পরবর্তী বছরে সাংবিধানিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক প্রাধান্যগুলোকে নিশ্চিত করা হয়েছিল। যদিও নীতিগত জায়গায় সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো তখনো অস্পষ্টই থেকে গিয়েছিল। উভয় নথিপত্রেই ভিন্নমত ধারণ করার মতো নমনীয় প্রচেষ্টার একটি অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে, যা তৈরি হয়েছিল জটিল নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিউবার বাইরে এগুলোকে তেমন গুরুত্ব কেউ দেয়নি।৩২ কেবল একজন মার্কিন গবেষককেই এগুলো খুব যত্নের সঙ্গে নথিভুক্ত করতে দেখা গিয়েছে।

ভারসাম্যহীনতা আর স্থিতিশীলতা

সংকটের সময় কিউবা যে প্রাথমিক পর্যায়ের নীতি গ্রহণ করেছিল, তার সামর্থ্য ও দুর্বলতা উভয়ই দেখা যায় রাজস্বের হিসাবনিকাশ থেকে। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকা রাষ্ট্রগুলো যখন সরকারি ব্যয় সংকুচিত করে আনছিল, কিউবায় তখন এই ব্যয় কিছুটা বাড়তে দেখা যায়।৩৩ ১৯৯০ সালে যেখানে এই ব্যয় ছিল ১৪ দশমিক ২ বিলিয়ন পেসো, ১৯৯১-৯৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন পেসোতে। এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় স্বাস্থ্য এবং খাদ্য খাত। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বাড়তি খরচের (১৯ শতাংশ) ফলে চিকিত্সা খাতে কর্মী সংখ্যা বাড়ে ৪০ শতাংশ। ভর্তুকি বাড়ানোর (৮০ শতাংশ) ফলে ভর্তুকিনির্ভর খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা ভালোভাবেই রক্ষা করা সম্ভব হয়। প্রতিরক্ষা খাতে ১৯৮৯ ও ১৯৯৩ সালে প্রায় ৪৩ শতাংশ ব্যয় কমিয়ে অন্যান্য বিনিয়োগের হার প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে এনে এই বাড়তি ব্যয়ের কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। জিডিপি আর জাতীয় আয় কমে যাওয়ার কারণে রাজস্ব ঘাটতি ১৯৯৩ সাল নাগাদ ৩৪ শতাংশে পৌঁছায়, যা ১৯৯০ সালে জিডিপির ১০ শতাংশ ছিল।৩৪ প্রাথমিকভাবেই জরুরি অবস্থায় সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়টি তেমন একটা প্রাধান্য পায়নি। সংকটের সময়ে যেসব সুবিধা পাওয়ার জন্য ভর্তুকির পেছনে অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল, তা বেশ পরিষ্কারই ছিল। এই ব্যয় করা হয়েছে অর্থনৈতিক সংকোচন প্রশমিত করে বহির্বিশ্বের ধাক্কা সামলাতে আর সমাজকল্যাণের খরচ কমিয়ে আনার জন্য। যা হোক, এসব নীতি সুদূর ভবিষ্যতে সমস্যার পাহাড় তৈরি করছিল। বাইরের অর্থায়ন/বাণিজ্য/বিনিয়োগ এমনকি দেশীয় বিনিয়োগ/ বাণিজ্যিক/আর্থিক বাজার না থাকায় এই ঘাটতির আঘাত পড়ে মুদ্রার ওপর, পুরোপুরি। ফলে টাকার মান ব্যাপক হারে কমে যায়। ১৯৯০ সালে কালোবাজারে যেখানে এক ডলারের দাম ছিল ৭ পেসো, সেখানে ১৯৯৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ পেসোতে।

মুদ্রার মান কমে যাওয়া সাবেক কমিকনভুক্ত দেশগুলোর জন্য নতুন বিষয় ছিল না। কিন্তু কিউবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই যেহেতু নিজ নিয়ন্ত্রণে এই স্ফীতি চাপিয়ে দিয়েছিল, সেহেতু তুলনামূলক দ্রব্যমূল্য আর আয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ এক ধরন তৈরি হয়। অন্যান্য সাবেক কমিকনভুক্ত দেশে বেতন, মূল্য আর বিনিময় হারের উদারীকরণ মুদ্রার মূল্য পতন-স্ফীতি-মূলধন ঘাটতির মতো পাঁক থেকে তাদের রক্ষা করে। ফলে প্রকৃত পারিশ্রমিকের বেলায় বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের ক্ষেত্রে বিশাল ধস নামে। ফলত এসব দেশে প্রকৃত আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য খুব জোর গতিতেই ছড়িয়ে পড়ছিল। কিউবাতে পেসোর মূল্যে যে ধস নামে, তা সীমাবদ্ধ ছিল অনিয়মিত/বেসরকারি/রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু নিয়মিত/আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্র পরিচালিত অর্থনীতিতে প্রকৃত আয়ের অসাম্য সত্যিকার অর্থেই কমতে থাকে। কারণ, যাদের আয় ছিল অনেক বেশি, যারা আমদানি করা আর কালোবাজারের পণ্য ক্রয়ের সামর্থ্য রাখত, তাদের খুব চড়া দামে দ্রব্যমূল্য কিনতে হতো। কিন্তু উল্টো দিকে যাদের আয় ছিল সীমিত কিংবা যারা রাষ্ট্রের প্রদেয় ভাতার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং শুধু নির্ধারিত মূল্যের মৌলিক পণ্য কেনার সামর্থ্য রাখত, তাদের ক্ষেত্রে প্রথম দিকে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল।

যা হোক, পেসোর মান কমে যাওয়ার কারণে যাদের কাছে ডলার ছিল আর যারা পেসোতে আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তাদের মধ্যে ব্যাপক বিভেদ সৃষ্টি হয়। যত দিন যাচ্ছিল, সরকারি চাকুরেদের কাছে এই পার্থক্য ততই তীব্র হয়ে উঠছিল। বেসরকারি কালোবাজারি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আয় আর তাদের নিজেদের উপার্জনের মধ্যকার ফারাকে তারা চিন্তায় পড়ে যায়। তাই নানান জাগতিক উদ্দীপনা তাদের অনৈতিকতার পথে টানতে থাকে। যত দিন যাচ্ছিল, পেসোতে আয় করা কিউবানরা ততই দরিদ্র হয়ে পড়ছিল। তাদের অবস্থা কেবল আমেরিকায় প্রবাসে যাওয়া কিংবা দেশে আসা নতুন পর্যটকদের চেয়ে খারাপ ছিল না, কিউবার চোর আর শারীরকলাবিদদের চেয়েও খারাপ হয়ে যায়। এভাবে ডলারের বিপরীতে পেসোর বাজারমূল্য কমতে থাকায় কিউবার জাতীয় মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঐক্য আর দুর্ভোগ ভাগাভাগির রাষ্ট্রীয় আহ্বান আর নিত্যদিনের দারিদ্র্যের কারণে বৈষম্যের মধ্যেও যে ফারাক ছিল, সেটাও ক্রমে বাড়তে থাকে। বাকিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা হ্রাস পায়। কারণ, যারা আগে কালোবাজারের ভেতরে যেতেই চায়নি, এমনকি সেখান থেকে আসা পণ্য পর্যন্ত বর্জন করেছিল, তারাও নিজেদের বদলাতে বাধ্য হয়। তাদের এই অনিচ্ছাকৃত অংশগ্রহণ ছিল তাদের চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। তারা যে ভাষায় কৈফিয়ত দিত, সেই ভাষাতেই তাদের অনিচ্ছা প্রতিফলিত হয়।৩৫ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দ্বৈত ব্যবস্থা ছোটখাটো চুরিচামারি, ফাঁকিবাজি আর দুর্নীতির চাপ বাড়িয়ে দেয়, কর্ম-উদ্দীপনা এবং সামাজিক সংহতিকে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে আর রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে শুকিয়ে ফেলতে থাকে।

১৯৯৩-৯৪ সালে জরুরি ভিত্তিতে অর্থব্যবস্থায় পরিবর্তন নিয়ে আসায় তীব্র সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়। খাদ্য সরবরাহ প্রকল্পও তখন চরম আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছিল। ফলে রাষ্ট্রের ভিত্তি নড়ে যায়। রাজধানী হাভানায় এক ভয়ংকর দাঙ্গা লাগার মতো আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। তবু লোস লোগ্রোসকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হিসেবে অন্যান্য সাবেক কমিকন দেশের মতো পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ত্বরিত সমাধান প্যাকেজ হাতে নেয়নি কিউবা। পেসোর মান কমে যাওয়ার পেছনে সরকারের এই গোঁড়ামিকেই দায়ী করেছিলেন কিউবাবিশারদেরা। সরকার সমস্যা দেখেও না দেখার ভান করছিল বলেও তারা দাবি করে। যদিও সরকার এই সমস্যাকে কখনোই অস্বীকার করেনি। এই সংকটকে মূল্যস্ফীতির সমস্যা বলে স্বীকার করলে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ জানা যেত। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারকে সেটা সামাল দিতে হচ্ছিল। তাই এটাকে স্ফীতিজনিত সমস্যা না বলে সরকার একে ‘ঘাটতিজনিত’ সমস্যা বলে প্রচার করা শুরু করে। কিন্তু ১৯৯৩ সালে সংকট যখন সবচেয়ে বেশি ঘনীভূত হয়, তখন কিছু রেমিট্যান্সভোগী কর্মকর্তা ছাড়া আর সবাই যখন এই ভোগান্তিতে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, তখন আর কষ্ট করে কাউকে সমস্যা চিহ্নিত করে দিতে হচ্ছিল না। রাষ্ট্রনীতির ওপর আসতে থাকা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের ঘাম ঝরা শুরু করে।৩৬ ফলে ১৯৯৩-৯৪ সালে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঐক্যে আসার জন্য যে পরামর্শ ছিল, এই সংশোধনীগুলো সে অনুযায়ী না হওয়ায় কিউবাবিশারদেরা এগুলোকে অপর্যাপ্ত আখ্যা দিয়েছিলেন। যা হোক, পরিস্থিতি সামাল দিতে এগুলোর অসামান্য ভূমিকা ছিল।

ডলারের ফিরে আসা

মুদ্রার মান পড়ে যাওয়া ঠেকানো বা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এই সংশোধনীগুলোর উদ্দেশ্য ছিল না। কালোবাজারি কর্মকাণ্ডকে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির অধীনে নিয়ে এসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়ানো এবং জাতীয় আয় বাড়িয়ে রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আনার পদ্ধতি হিসেবেই এগুলো চিহ্নিত করা হয়। মার্কিন ডলার আটকে রাখার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার মাধমে ১৯৯৩ সালের জুন মাসে সংশোধনীগুলোর প্রথম পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়। তখন থেকে শুরু হয় ডলার থেকে পেসোতে আর পেসো থেকে ডলারে রূপান্তর-প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত লেনদেন পর্যন্ত এর পরিধি ব্যাপ্ত হয়েছিল। এর আগ পর্যন্ত কিউবার অর্থনীতিতে শুধু একটি মুদ্রা, অর্থাত্ পেসোরই প্রচলন ছিল। এর ব্যতিক্রম দেখা যেত কূটনীতিকদের জন্য তৈরি ডিপ্লটিন্ডাস নামক রাষ্ট্রায়ত্ত দোকানে। এতে বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থী আর কিছু কিউবানের মধ্যে যারা মূলত ছিল সংগীতশিল্পী আর খেলোয়াড়, যারা বৈদেশিক মুদ্রায় আয় করত, তাদের জন্য বানানো হয়েছিল।

এ সময়ে বেশ কিছু কিউবান তাদের পরিবারের মাধ্যমে ডলারে রেমিট্যান্স পাচ্ছিল কিংবা বেসরকারি অথবা বেআইনিভাবে পর্যটন-বাণিজ্য থেকে ডলার কামাচ্ছিল। কথা ছিল, তারা সরকারি হারেই এগুলো পেসো থেকে ডলারে রূপান্তর করবে। কিন্তু তত দিনে পেসোর দাম অনেক কমে যাওয়ায়, তাদের অধিকাংশই সেগুলো দিয়ে দালালদের দিয়ে ডিপ্লটিন্ডাসে কেনাকাটা করত কিংবা কালোবাজারে সেগুলো বদলে নিত। মুদ্রার মানের এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের কারণে ডলারের ওপর আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর কারণে পুলিশেরও যথেষ্ট সময় অপচয় হচ্ছিল, ছোটখাটো দুর্নীতি আর অস্থিরতা বাড়িয়ে এই পরিস্থিতি বেশ কিছু কিউবানকে তাদের ডলার ব্যয়ের জন্য আইন ভঙ্গ করতে বাধ্য করছিল। প্রথমে ডলারকে বৈধ করা হয়। এর ফলে রূপান্তরযোগ্য পেসো বানানো হয়, এর ফলেই মুদ্রার বিনিময় সম্ভব হয়। ১৯৯৫ সালে গঠিত হয়েছিল রাষ্ট্র পরিচালিত কাডেকাস বা কাসাস দে কাম্বিও। এর মধ্য দিয়ে সরকার বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নতুন মাধ্যম হিসেবে রেমিট্যান্সকে উত্সাহিত করতে থাকে। এই পদক্ষেপের কারণে ডলারের দোকান থেকে আসা বিক্রয় কর বাবদ রাজস্ব আয় বাড়তে থাকে। কিউবানদের ডলার ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার জন্য সরকার ক্রমশ যেসব অকার্যকর প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছিল, তার ফলে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হয়েছিল তাও কমে আসে।

কিউবায় এই সংশোধনের যে ফল দেখা যায়, সাবেক কমিকনভুক্ত দেশগুলোতে তা দেখা যায়নি। মার্কিন অভিভাবকত্বের অধীনে এই দেশগুলোতে তখন মুদ্রাবাজারের ব্যাপক উদারীকরণ চলছিল। কিন্তু কিউবার মুদ্রাবাজারে এমনটা হয়নি, এই সংশোধনী সীমাবদ্ধ ছিল কেবল দেশীয় অর্থনীতির ভেতরে ব্যক্তিগত লেনদেনের মধ্যেই। অন্য সব বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হতো রাষ্ট্রের অধীনেই। এটা স্বীকার করেই নিতে হয় যে সুযোগ আর কার্যকারণের সীমাবদ্ধতা সঙ্গে নিয়েই এই সংশোধন মুদ্রার দ্বৈত ব্যবস্থাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরেছিল। কালোবাজার আর বৈধ ক্ষেত্রের মধ্যে যে দ্বিবিভাজন ছিল তাও শেষ হয়ে যায়। এই বিভাজন টিকে ছিল শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে লেনদেনের ক্ষেত্রেই। এ ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের লেনদেন করা যেত কাডেকাসের মাধ্যমে বেসরকারি ১০০ পেসোতে ১ ডলার রেটে। কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রসমূহে এই ডলার/পেসো লেনদেন নির্ধারিত বিনিময় হারেই করা হতো।

কিউবা এই মুদ্রাবাজার সংস্কারে অন্যান্য সাবেক কমিকনভুক্ত দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। কারণ, সেসব দেশে পশ্চিমা ব্যবস্থাপনায় এই সংস্কার হয়েছে। মার্কিন অভিভাবকত্বে এই দেশগুলোতে তখন মুদ্রাবাজারের ব্যাপক উদারীকরণ চলছিল। কিন্তু কিউবার মুদ্রাবাজারে এমনটি হয়নি, এই সংশোধন সীমাবদ্ধ ছিল কেবল দেশীয় অর্থনীতির ভেতরে ব্যক্তিগত লেনদেনের মধ্যেই। অন্য সব বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হতো রাষ্ট্রের অধীনেই। এটা স্বীকার করেই নিতে হয়, সুযোগ আর কার্যকারণের সীমাবদ্ধতা সঙ্গে নিয়েই এই সংশোধন মুদ্রার দ্বৈত ব্যবস্থাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরেছিল। কালোবাজার আর বৈধ ক্ষেত্রের মধ্যে যে ফারাক ছিল তারও অবসান হয়। এই বিভাজন টিকে ছিল শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে লেনদেনের ক্ষেত্রেই। এ ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের লেনদেন করা যেত কাডেকাসের মাধ্যমে, বেসরকারি পর্যায়ে ১০০ পেসোতে ১ ডলার হারে। কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রে এই ডলার/পেসো লেনদেন নির্ধারিত বিনিময় হারেই করা হতো।

দ্বৈত মুদ্রাব্যবস্থার বৈপরীত্য প্রতিভাত হওয়ায় প্রকৃত আয়ের ঘাটতি নিয়ে কিউবানদের বোঝাপড়ার মধ্যেও পরিবর্তন নিয়ে আসে কাডেকাস। কারণ, কোনোভাবেই তখন দিনে দিনে পেসোর মান কমে যেতে থাকার ব্যাপারটা আর অস্বীকার করা যাচ্ছিল না। ক্রয়সক্ষমতার অভাবের কারণ হিসেবে ঘাটতির চেয়ে অভাবের প্রশ্নটাই আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে চলে আসে। যে অল্পসংখ্যক লোক ডলার পাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে বাকিদের ফারাকটাও ব্যাপক হারে বাড়ছিল। এই ফারাকে অবৈধতার চেয়ে বৈষম্যই প্রধান সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই সময়েই প্রকৃত আয় আর জনগণের জীবনের মান আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটাকে একটু অন্যভাবে দেখা শুরু হয়েছিল। এই কাজ সমন্বয় করতে গিয়ে দেখা যায়, পেসোর বাজারমূল্য ফিরিয়ে আনা খুব প্রয়োজন। অর্থাত্ মুদ্রাব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে হতো। এই কাজের জন্য সামনে দুটি পথ উঠে এসেছিল—প্রথমত, রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আনা, দ্বিতীয়টি ছিল খাদ্য সরবরাহ, বিশেষ করে পেসোতে যেসব খাবার কেনা যেত সেগুলোর পরিমাণ বাড়ানো।

দ্বিতীয় পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। ১৪১ নম্বর অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, এতে স্বকর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে যায়। এ ধরনের সুয়েনটাপ্রোপিসটাধর্মী (স্বকর্মসংস্থান) তত্পরতার পরিসর ৪১ নম্বর থেকে বেড়ে ১৫৮ পর্যন্ত পৌঁছায়। এর ফলে যারা আত্মকর্মসংস্থান শুরু করছিল, আর এর জন্য নথিভুক্ত হচ্ছিল, তাদের সংখ্যাও ব্যাপক মাত্রায় বাড়তে থাকে। ১৯৯২ সালের শেষে যেটা ছিল ১৫ হাজার, সেটা ১৯৯৯ সাল নাগাদ ১৫ লাখে পৌঁছায়। এই পদক্ষেপ উদারীকরণের একটা ধাপ হিসেবে কিউবাবিশারদদের কাছে প্রশংসিত হলেও সুযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে তা সমালোচিতও হয়। তখনো আত্মকর্মসংস্থানের হার মোট কর্মী বাহিনীর কেবল ৫ শতাংশ ছিল। এর নিবন্ধনের আয়ু ছিল মাত্র দুই বছর, আর এগুলো সংগ্রহ করতে হতো শ্রম মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় কার্যালয় থেকে। এ ক্ষেত্রে যেসব ধরনের কাজের অনুমতি দেওয়া হতো, তার পরিধিও ছিল খুবই ছোট, এর দৌড় ছিল কেবল ব্যক্তিক গণ্ডি পর্যন্তই। যা-ই হোক, তবু এই ছোটখাটো ব্যবসাগুলোর কারণেই এই পদক্ষেপ রাষ্ট্রের জন্য কিছু কর আদায়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রারম্ভিক পর্যায়ে যেটা মনে হচ্ছিল স্থির, খুবই পশ্চাত্গামী ও একরৈখিক মানের একটা কাঠামো, সেটাই পরবর্তীকালে বেশ উন্নত হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা সংগ্রহ ও তার হিসাব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছিল।

পরামর্শ

যখন ডিক্রির মাধ্যমে ডলার ব্যবহারে শাস্তি রদ করা হয় এবং আত্মকর্মসংস্থান শুরু হয়, সে সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ রাজস্ব সমন্বয়ের সব ব্যাপারেই বেশ সচেতন হয়ে ওঠে। এ কারণে ১৯৯৩ সালের জাতীয় অধিবেশনে এই সচেতনতাকে একটা প্রয়োজনীয়তা বলেই চিহ্নিত করা হয়। ব্যয় হ্রাসে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের প্যাকেজ গ্রহণ না করে এসে আবারও একটি জাতীয় বিতর্কের আয়োজন করে। জাতীয় প্রতিনিধিদের একটা সভার ব্যবস্থা করে। যাঁরা পার্লামেন্টস ওবরেরস (শ্রম সংসদ) নামে পরিচিত ছিলেন আর যাঁদের এই সভায় বসানো হয়েছিল এসব পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক করার জন্য। ব্যয় কমানোর প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য বেশ কয়েক মাস ধরেই এই ফোরামগুলোর সভা আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালের মে মাসে সব বিচার-বিবেচনা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত শেষ প্যাকেজটি সামনে আনা হয়নি। কিন্তু যাঁরা ভবিষ্যত্ কিউবার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন, তাঁদের কাছে এই অপেক্ষা মোটেই বোধগম্য হচ্ছিল না। তাঁরা একটা সুস্থিতিশীল অবস্থার জরুরত নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু সবকিছুর সমন্বয় সাধনের জন্য এই প্রতিনিধি সভাগুলো খুবই দরকারি ছিল। এই পদ্ধতির কিছু ভুলচুক তো থাকবেই, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এই ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া সরকারের জন্য সহজ বিষয় ছিল না যে তারা চাইল আর কাগজে সিল মেরে দিল! কারণ, অনেক প্রস্তাবিত কাটছাঁটই বিরোধিতার মুখে বাদ দেওয়া হয়।

যখন নীতিগতভাবে আয়কর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তখন সরকারি কর্মকর্তাদের এর আওতার বাইরে রাখা হয়। আবার যখন মাত্রাতিরিক্তভাবে সিগারেট, মদ, পেট্রল, বিদ্যুত্সহ আরও কিছু যানবাহনের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়৩৭, তখনো মৌলিক পণ্যের দাম নির্ধারিত মূল্যের নিচেই রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মুদ্রানীতির ওপরে এর ঠিক কেমন প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে কোনো বিশেষ বিবেচনা না করেই। এটাও ঠিক করা হয়েছিল যে যদি কাজ মজুত রাখা হয় তবে সেটা এমন একটা ক্রমিক প্রক্রিয়ায় করা হবে, যাতে করে যেসব অতিরিক্ত শ্রমিক বেকার বসে ছিল, তাদের কাজে ফিরিয়ে আনা যায়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে কাজের নিশ্চয়তা দুর্বল অবস্থায় থাকার পরও শ্রমিকদের এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ তাদের অটুট অঙ্গীকারকেই স্পষ্ট করছিল। হিসাব-নিকাশের পর হঠাত্ই ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে কৃষিবাজার আবার খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এই পদক্ষেপও বিশেষ ভূমিকা রাখে, যদিও এটার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ঠিক এমনটা ছিল না। এই বিষয়ে রাষ্ট্রনেতাদের আলোচনার খুঁটিনাটি জনগণের সামনে আনা হয়নি। যদিও অধিকাংশ লোকই এটা বিশ্বাস করতেন যে ফিদেল কাস্ত্রো এই ঘোষণার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এই বাজার ভবিষ্যতে খুব ক্ষতিকর কিছুর আশ্রয়দাতা হিসেবেই কাজ করবে। কিন্তু রাউল আর এএনএপি এটাকে খাদ্য সরবরাহ বাড়ানোর৩৮ একটি ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে সমর্থন করেছিলেন। আবারও পিট্সবার্গ আর মায়ামিতে বসে যাঁরা কিউবাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলেন, তাঁদের কাছে এই সংস্কারকে অপর্যাপ্ত মনে হয়েছিল। কৃষিজ পণ্যের বাজারের কেবল আংশিক উদারীকরণ হয়েছিল বলেই তাঁরা এমনটা বলছিলেন। মৌলিক চাহিদার সর্বজনীন চাহিদা মেটাতে তখনো রাষ্ট্র তার খাদ্য বণ্টন প্রকল্প জারি রেখেছিল। রেশনিং ব্যবস্থা টিকে ছিল, কৃষকেরা তখনো একোপিওতে (গুদামে) একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল সরবরাহ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। আর শুধু অতিরিক্ত উত্পাদনটুকুই তাঁরা এই বাজারে বিক্রি করতে পারতেন। এই নতুন বাজারগুলোকেও ব্যাপক মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ, নিরীক্ষণ আর করের চাপের মধ্যে রাখা হয়েছিল। কার্যত চাহিদা আর সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনভাবেই পণ্যমূল্য ওঠানামা করত, কিন্তু রাষ্ট্র মাঝে মাঝেই এই বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে দাম বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিয়ে নিজের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রেখেছিল।

রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি আর মুদ্রানীতিতে স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে এই চারটি নীতি বেশ মজবুত একটা কাঠামো তৈরি করেছিল। এই কাঠামোর সব ঠিকঠাক করতে যেসব উপায় হাতে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর সঙ্গে সাবেক কমিকনভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি ব্যবস্থার মধ্যে বেশ কিছু বৈপরীত্য দেখা যায়। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপের মতোই রাষ্ট্রীয় ব্যয় না কমিয়ে মূলত জাতীয় আয় বাড়িয়ে কিউবা এই ঘাটতি পূরণ করছিল। ১৯৯৩ থেকে ’৯৫ সালের মধ্যে ন্যূনতম জাতীয় আয় বেড়েছিল ৩৭ শতাংশ, যেখানে জাতীয় ব্যয় কমেছিল মাত্র ৫ শতাংশ। এই নতুন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আয়ের দুই-তৃতীয়াংশই আসছিল রাষ্ট্রায়ত্ত নতুন ডলারের দোকানগুলো থেকে। তখন সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল Tiendas de Recaudacuion de Divisas (TRD)। আর বাকি আয়টা আসছিল নতুন আরোপিত পরোক্ষ কর আর ব্যবহার ভাড়া থেকে। দ্বিতীয় পার্থক্য হিসেবে দেখা গিয়েছিল যখন কিউবার সমাজকল্যাণ বাজেট অক্ষত থেকে গিয়েছিল। কারণ কিউবা শুধু তাদের সামরিক খাতে, প্রশাসনিক খাতে আর শিল্পোদ্যোগের ভর্তুকির ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন করছিল।৩৯ জিডিপি বাড়ার সঙ্গে জাতীয় ব্যয় স্থিতিশীল রাখার কারণে কিউবার জাতীয় ব্যয় ও জিডিপি অনুপাত বেশ কমে যায়। ফলে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যেই জিডিপি ৮৭ শতাংশের চূড়া থেকে নেমে আসে ৫৭ শতাংশে। পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে থাকা রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে এই অঙ্ক অবশ্য বেশিই ছিল, কারণ, সেখানে তখন গড় জিডিপি ছিল ৪০ শতাংশ।৪০ এই পদ্ধতিতে রাজস্ব ঘাটতি যখন ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন পেসো থেকে কমে ৮০০ মিলিয়ন পেসোতে নেমে এসেছিল, তখনো কিউবা তার সব সামাজিক নিরাপত্তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই মৌলিক সফলতার পরিসর ছিল অনেক বড়, তুলনামূলকভাবে। সাবেক কমিকনভুক্ত দেশগুলোর গড় ঘাটতি ৮ দশমিক ৮ শতাংশের তুলনায় ১৯৯১-৯৩ সালে কিউবার রাজস্ব ঘাটতি ছিল জিডিপির ৩০ শতাংশ। কিন্তু ১৯৯৫ সাল নাগাদ তা কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশে, আর সেটা স্থির হয়েছিল ৩ শতাংশে এসে।৪১

১৯৯৩-৯৪ সালে গৃহীত পদক্ষেপগুলো পেসোর মান স্থিতিশীল রাখতে যথেষ্ট সহায়তা করে। ডলারের অবমুক্তকরণের ফলে দেশে নতুনভাবে মুদ্রার প্রবাহ সৃষ্টি হয়। আত্মকর্মসংস্থান নতুন নতুন কাজের জোগান সৃষ্টি করেছিল। জাতীয় আয় সমন্বয়ের কারণে নির্দিষ্ট সরকারি ব্যয়ের ঘাটতি কমে আসে। আর খাদ্য ঘাটতি৪২ আর তার মূল্য কমিয়ে আনে কৃষিবাজার৪৩। ১৯৯৪ সাল নাগাদ মুদ্রার মান হ্রাসে লাগাম দেওয়া সম্ভব হয়, এমনকি মুদ্রা তখন আংশিক ঘুরে দাঁড়াতেও সক্ষম হয়। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতেও যেখানে ডলারের দাম ছিল ১৫০ পেসো, পরবর্তীকালে প্রতি ডলারের মূল্য প্রায় অর্ধেক কমে হয় ৬০ পেসো। পরবর্তী ১৮ মাস এই ধারা অব্যাহত থাকে। ফলে ডলারের দাম কমতে কমতে ১৯৯৬-এর মাঝামাঝিতে ১৮ পেসোতে এসে পৌঁছায়। অন্য কোনো ক্রান্তিকালীন রাষ্ট্রে মুদ্রার মান এমনভাবে সংহত হয়নি।৪৪ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা শুধু স্ফীতিকে একটা পর্যায় পর্যন্ত আটকে রাখতেই সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু তা ঘুরিয়ে দিতে পারেনি। যদিও কিউবার মুদ্রাস্ফীতি একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়, কিন্তু পেসোর মান তখনো ১৯৯০ সালে যা ছিল তার চেয়ে কম থাকায় তীব্র মুদ্রাবৈষম্য টিকেই ছিল। এর অর্থ হলো রাষ্ট্রীয় বেতন আর সরকার-নির্ধারিত মূল্য, যা ন্যূনতম শর্তে সুস্থিত অবস্থায় ধরে রাখা হয়েছিল, তা ডলার আর বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ যখন অতীব জরুরি নিট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত ছিল, তখন কাডেকাসের মাধ্যমে অবমূল্যায়িত হারেই সম্মিলিত কষ্টের ভেতর দিয়ে পরবর্তী এক দশকে আমদানির চাহিদা পূরণ করা হয়েছে।

মার্কিন শত্রুতা

অর্থনীতি একদিকে স্থিতিশীল হলেও আরেক দিকে বাইরের পরিবেশ খারাপ হয়। ১৯৬২ সালে কেনেডি যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তা আরও কয়েক দশক জারি রাখা হয়। কিন্তু ১৯৯২ সালে টরিসেলি আইনের মাধ্যমে সেটা আইনে পরিণত করা হয়। ১৯৯৬ সালে এই নিষেধাজ্ঞা আরও তীব্র হয়। সে সময় ক্লিনটন হেলমস-বারটন বিলে সই করলে তা আইনে পরিণত হয়। সেখানে তৃতীয় দেশের যেসব প্রতিষ্ঠান ১৯৫৯ সালে বাজেয়াপ্ত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সম্পদ পাচার করেছে, তাদের দণ্ড বাড়ানো হয়। আর সেসব ফার্মের সঙ্গে যারা কাজ করেছে, তাদের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নিউইয়র্ক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ডলারে পরিশোধের প্রক্রিয়াও এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে, এমনকি এই লেনদেনে মার্কিন কোনো সংস্থা জড়িত না থাকলেও। যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করে—এই আইনের মাধ্যমে তাদের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করা হয় যে তারা কিউবা থেকে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী উপাদান সংগ্রহ করছে না।৪৫

কিউবায় জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তায় যে জোর দেওয়া হয়, এই পরিপ্রেক্ষিতে তার কারণ বোধগম্য। এমনকি তা অভ্যন্তরীণ আলোচনায়ও নানা ক্ষতিকর প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে। হেলমস-বারটন আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কিউবা নিজের ‘মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব পুনরায় দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে’ পাল্টা এক আইন করে। এতে দেশটির নাগরিকদের যেকোনো তথ্য, বিশেষ করে অর্থনৈতিক তথ্য প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর একটি ফলাফল হচ্ছে সেন্ট্রো দে এসতুদিয়াস দে লাস আমেরিকাসে (সিইএ) গবেষণা প্রকল্প শুরু হওয়া। সংস্থাটির গবেষকেরা কিউবার সমন্বয়-সংক্রান্ত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আলোচনা ইংরেজিতে প্রকাশ করার পর এটি শুরু হয়।৪৬ এ ধরনের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানের কারণে কিউবার পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সৃজনশীলভাবে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা কমে যায়। এদিকে সংস্থাটির গবেষকেরা কিউবার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও তাঁরা ছিলেন সমালোচনামূলক বিপ্লবী।

৩. পুনর্গঠন

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় কিউবা অন্যান্য সাবেক কমিকন দেশের মতো অত টাকা পায়নি। তাকে নিজের সম্পদ দিয়েই শিল্পায়ন করতে হয়েছে। মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল খুবই কম, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ৮৫ শতাংশ পড়ে যায়। জাতীয় আয়ের দাপ্তরিক হিসাব অনুসারে, ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৯৯০ সালের তুলনায় অর্ধেক। আর বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ছিল ১০ শতাংশ। অন্যদিকে অন্য সাবেক কমিকন সদস্যদেশের ক্ষেত্রে এ অনুপাত ছিল ২০-২৫ শতাংশ।৪৭ বিনিয়োগের অনুপাত এত কম হওয়া সত্ত্বেও কিউবার মোট জাতীয় আয়ে পুনরুদ্ধার ও প্রবৃদ্ধি এসব দেশের সমপর্যায়ে আছে, ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর। নীতি প্রণয়ন করে রপ্তানির নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো হয়েছে, খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো হয়েছে, নতুন বাজার সন্ধান ও নতুন বৈদেশিক অর্থায়নের উত্স সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এসবই করা হয়েছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই। অর্থায়নের ক্ষেত্রে তারা যে আপেক্ষিক সফলতা পেয়েছে, তার কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালিত ‘বিজয়ী সংগ্রহের’ মনোভঙ্গি।

বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ

নিষেধাজ্ঞার কারণে কিউবার পক্ষে বিনিয়োগের টাকা জোটানোর একমাত্র ও সবচেয়ে সস্তা উপায় হচ্ছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। এর ফলে কিউবার কর্মকর্তারা বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা করার সুযোগ পান। এর মাধ্যমে তাঁরা মার্কিন অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোলের নজর এড়াতে পেরেছেন। এই প্রক্রিয়া বিনিয়োগকারীদের সন্দেহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। এমনকি কিউবার সরকারের ভেতরেও এ-বিষয়ক অনাগ্রহ দেখা গেছে। ফিদেল হতাশা নিয়ে ১৯৯৭ সালের পিসিসি কংগ্রেসের কাছে স্বীকার করেছিলেন। এরপর তিনি এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন, কিউবার আইনি, আর্থিক ও প্রাযুক্তিক কাঠামো পরিবর্তনের কথা বলেছেন। ১৯৯০ সাল থেকে যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আইন গড়ে উঠেছে, তা এসব প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।৪৮ মনোভাব, বিধিবিধান, হিসাবরক্ষণ, সালিস, বিমা, শ্রম আইন—কিউবা কমিকন অংশীদারদের হারানোর পর থেকেই এসব বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। ১৯৮২ সালে বিদেশি বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে ব্যবসা করার বিধান করা হয়। প্রথম পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয় ১৯৮৮ সালে। কিন্তু নতুন চুক্তি করার প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের মধ্যে ৫০টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯২ সালের সংবিধান সংস্কারে ‘উত্পাদনের মৌলিক’ খাতের ওপর রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। আর ১৯৯৫ সালে বিদেশি বিনিয়োগ আইনে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো আরও জঞ্জালমুক্ত করা হয়।

কিন্তু নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্য থাকলেও কিউবা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেনি। তারা এফডিআইয়ের সুযোগ সীমিত রাখার নীতি গ্রহণ করে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিদেশি মালিকানায় নেওয়া সহজ ছিল না। এর জন্য মন্ত্রিসভার নির্বাহী কমিটিকে সন্তুষ্ট করতে হতো, যে এটা ‘দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াবে, টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখবে। এর ভিত্তি হবে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা। তার জন্য এফডিআইকে নতুন পুঁজি, নতুন বাজার, প্রযুক্তি, দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত করতে হবে। অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, বিগত বছরগুলোতে অনেকগুলো প্রস্তাব খারিজ করা হয়েছে। চলমান নীতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে এটা করা হয়েছে। বিধান করে নিশ্চিত করা হয়েছে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে এফডিআই খোলা হয়েছে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে দেরি বা ভুল-বোঝাবুঝির জন্য কিছু সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। আর একবার সমস্যা চিহ্নিত হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ প্রক্রিয়া আরও গতিশীল করে। ১৯৯৭ সালের মধ্যে বিদেশি মুদ্রার চাহিদা কমাতে দেশটির আমদানি সক্ষমতা অনেকাংশে পুনরুদ্ধার করা হয়, আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুত্সাহিত করতে হেলমস-বারটন আইন প্রয়োগ করা হয়। ফলে ১৯৯৭ সালের পিসিসি কংগ্রেসে প্রত্যক্ষ বিদেশি আইনে আরও কোনো উদারীকরণ ঘটে না। সেটা ছিল বিদ্যমান মনোভঙ্গির সত্যায়ন মাত্র। এটা ঠিক করা হয় যে অবকাঠামো, খনি ও জ্বালানি উন্নয়নের জন্য পুঁজি খোঁজা হবে। এরপর আসে বড় প্রকল্প গ্রহণের যুগ, ফলে ছোট বিনিয়োগকারীদের চুক্তি নবায়ন বন্ধ হয়ে যায়। কিউবাবিশারদেরা নীতি উলটপালটের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করলেও এফডিআই কৌশল অপরিবর্তিত থাকে। ওদিকে যৌথ উদ্যোগের চুক্তি বছর বছর কমতে থাকে, ১৯৯১-৯৭ পর্যায়ে তা ছিল গড়ে ৪০, আর দশকের শেষে তা দাঁড়ায় ৪০-এ। বড় চুক্তির ফলে বার্ষিক পুঁজিপ্রবাহের পরিমাণ বেড়ে যায়, ১৯৯৩-৯৬ পর্যায়ে যা ছিল ১৮০ মিলিয়ন ডলার, ১৯৯৭-২০০০ পর্যায়ে তা দাঁড়ায় ৩২০ মিলিয়ন ডলারে।

এই সময়েই কিউবায় প্রথম বেসরকারীকরণ ঘটে। ১৯৯৯ সালে ফরাসি কোম্পানি আলতাদিস ৫০ মিলিয়ন ডলারে হাবানোসের ৫০ ভাগ শেয়ার কিনে নেয়, এই সংস্থাটি কিউবার সিগারের আন্তর্জাতিক বিতরণকারী। আর পানারমার একটি কোম্পানি ১৫ মিলিয়ন ডলারে একটি বিদ্যুত্ কারখানা স্থাপন করে, এটাই ছিল কিউবার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বেসরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি। এরপর ২০০১-০৮ পর্যায়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবার সম্পর্কের অবনতি হয়, ফলে এফডিআইও ব্যাহত হয়। রিগ্যান প্রশাসন কিউবাকে সন্ত্রাসের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক আখ্যা দিয়েছিল। সে সময় নজরদারি ও মামলা-মোকদ্দমাও বৃদ্ধি পায়। জুনিয়র বুশ কমিউনিজম-উত্তর কিউবার জন্য কিউবা ট্রানজিশন প্রকল্পও চালু করেন। আর স্টেট ডিপার্টমেন্ট মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের ঘটনা চিহ্নিত এবং তার বিচার করতে নানা তোড়জোড় শুরু করে। ২০০৪ সালে ওয়াশিংটন কিউবাকে ডলার বিল সরবরাহের অভিযোগে সুইস ব্যাংক ইউবিএসকে ১০০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় হাভানা তাদের অভ্যন্তরীণ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ডলারের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। যদিও ১০ শতাংশ সারচার্জ দিয়ে ডলার রাখা ও বিনিময়ের সুযোগ রাখা হয়েছিল। সে সময় ভেনেজুয়েলার সঙ্গে কিউবার সম্পর্কের বহুমুখী উন্নয়ন হয়। বিরোধী নেতা হিসেবে হুগো শাভেজকে ১৯৯৪ সালে হাভানা সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। শাভেজ ১৯৯৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হন। ২০০২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ক্যুয়ের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়, এমনকি তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাপনা ধর্মঘটও ব্যর্থ হয় সে সময়। এরপর থেকে দেশ দুটির মধ্যকার আন্তবাণিজ্য বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে দেশ দুটির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় দৈনিক ৫৩ হাজার ব্যারেল ভেনেজুয়েলার তেলের বিনিময়ে কিউবা সে দেশটিকে নানা পেশাদার সেবা দেবে। যেমন স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষক দিয়ে তারা ভেনেজুয়েলাকে সহায়তা করবে। ১৯৯০ সালের এই প্রথম কিউবা অনুকূল শর্তে বিপুল পরিমাণ টাকা পায়, এতে দেশটির বিনিয়োগ ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়ে যায়। ২০০৫-০৭ সালে কিউবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত হয়। ভেনেজুয়েলাকে সঙ্গে করে কিউবা নতুন এক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করে। এর অন্য সদস্যরা হচ্ছে বলিভিয়া, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া ও চারটি ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র। ২০০৫-০৭ সালে বার্ষিক রপ্তানি বৃদ্ধির গড় হার দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ, আগের দশকে যার হার ছিল ৯ শতাংশ।

যদিও কিউবায় বিনিয়োগ হওয়া আন্তর্জাতিক পুঁজিবিষয়ক তথ্য খুবই অপ্রতুল, প্রাপ্তিসাধ্য তথ্যে দেখা যায়, সামান্য বিনিয়োগেই কিউবার উত্পাদনব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকেই কিউবায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ। অন্যদিকে সাবেক কমিকন দেশগুলোতে এর পরিমাণ ছিল ৪ শতাংশ।৪৯ সরাসরি চুক্তি করে ও বিজয়ীদের বেছে নেওয়ার মাধ্যমে হাভানা প্রতি ডলার বিনিয়োগ থেকে বিপুল মুনাফা করে। কিন্তু তারপরও ফলাফল হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিউবার পুনঃপ্রবেশে নেতৃত্ব দিয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র শিল্প। চিত্র ৪ ও ৫-এ দেখা যায়, ১৯৯০ সালের পর থেকে কিউবার অর্থনীতির পুনঃকাঠামো নির্মাণ ও নিরাময়ের ভিত্তি ছিল খুবই সংকীর্ণ। চিত্র ৪-এ ১৯৯০ পরবর্তীকালের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবৃদ্ধির প্রধান খাতগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে: প্রথমত, পর্যটন, এরপর নিকেল ও জ্বালানি, আর গত দশকে পেশাদার সেবা প্রদানই পুনরুদ্ধারের পথে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছে। কমিকন দেশগুলোর রপ্তানি আয়ের ৭৩ শতাংশই এসেছে চিনি থেকে, তাদের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর ২০১২ সালের মধ্যে রপ্তানি আয়ে চিনির অবদান দাঁড়ায় মাত্র ৩ শতাংশে। আর নব বিকশিত পর্যটন, নিকেল, তেল প্রক্রিয়াকরণ, পেশাদার সেবা প্রদান প্রভৃতি খাত থেকে পণ্য বিক্রি ও সেবার ক্ষেত্রে বার্ষিক বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। পর্যটনশিল্প ও নিকেলের খনিতে এফডিআইয়ের মাধ্যমে নতুন করে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়। এটা হয়েছে ২০০৪ সালের কিউবা-ভেনেজুয়েলা চুক্তির আওতায়, তেল প্রক্রিয়াকরণ ও পেশাদার সেবা প্রদানের মাধ্যমে। এই শেষোক্তটি থেকে সর্বাধিক বিদেশি মুদ্রা এসেছে। ২০০৫ সালের পর থেকে পণ্য বিক্রির চেয়েও বড় হয়ে ওঠে এই সেবা বিক্রয় খাতটি। যদিও ২০০৮ সালের পর থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি এসেছে তেল শোধন থেকে, এটা কিউবা ও ভেনেজুয়েলার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়। জৈবপ্রযুক্তি খাত সম্প্রতি বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, সব আশা এ খাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এ খাতের রপ্তানি ২০০৮-১২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু তা মোট রপ্তানি আয়ের মাত্র ৩ শতাংশ, ফলে অর্থনীতিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা এটা অর্জন করেনি। ২০১২ সালের মধ্যে রেমিট্যান্সসহ কিউবার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেড়ে ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এতে দেশটি যথেষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পেরেছে। চিত্র ৪-এ আনুমানিক ‘নেট বাহ্যিক অর্থায়নের’ নেতিবাচক ভারসাম্য দিয়ে এটা চিহ্নিত করা হয়েছে।

চিত্র ৫-এ রপ্তানির ভৌগোলিক গন্তব্য দেখানো হয়েছে। এতে বোঝা যায়, কিউবার পণ্য বাণিজ্যে কীভাবে নতুন বিন্যাস এসেছে। ১৯৯০ সালে দেশটির রপ্তানির ৭৫ শতাংশই যেত সাবেক কমিকন দেশগুলোতে, কিন্তু ২০১২ সালের মধ্যে এর হার দাঁড়ায় ৫ শতাংশে। ২০০০ সালের মধ্যে কিউবা তার রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যাপক বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হয়: পশ্চিম ইউরোপে তার রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২ শতাংশ, সাবেক কমিকন দেশগুলোতে ২৭ শতাংশ, কানাডায় ১৭ শতাংশ, এশিয়ায় ১২ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত আমেরিকায় ১০ শতাংশ। তারপর থেকে একটিমাত্র দেশে রপ্তানির পরিমাণ আবারও বাড়ে, ২০১২ সালে ভেনেজুয়েলাতেই তার রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশ। এর বিপুল পরিমাণই ছিল তেল, সিয়েনফিউগোস শোধনাগারের তেল। আর দেশটি পর্যটন ব্যতীত অন্যান্য সেবাও ভেনেজুয়েলাতে রপ্তানি করে থাকে।

 ৪. রাউলের সংস্কার

২০০৫-০৭ সময়ে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে কিউবা ব্যাপক পরিমাণে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করার ফলে দেশটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু ২০০৮ সালে রাউল কাস্ত্রো ও তাঁর দল ক্ষমতায় আরোহণ করার পর এই উচ্ছ্বাস কমে আসে। তিনটি অতি শক্তিশালী হারিকেন ঝড় ও বিশ্বমন্দার কারণে নিকেলের দাম পড়ে যাওয়ায় কিউবার বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যায়। ফলে কিউবা তার ঋণের বাধ্যবাধকতা মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়ে। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত, মুদ্রা সরবরাহ স্থিতিশীল থাকা, রাজস্বের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার হওয়া সত্ত্বেও কিউবার পেসোকে আগের জায়গায় আনতে স্রেফ বৈদেশিক মুদ্রা আয় আগের ধারায় ফিরিয়ে আনাই যথেষ্ট ছিল না। আর এর মাধ্যমে মজুরির প্রকৃত মূল্য পুনরুদ্ধার, সুবিধা ও মূল্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। মুদ্রার ভারসাম্যহীনতা স্থায়ী রূপ নেয়। দুই ধরনের মূল্য, আয় ও বিনিময় হার, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ও খোলাবাজারের সহাবস্থানের ফলে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থনীতির অঙ্গীভূতকরণ ব্যাহত হয়। ফলে উত্পাদনের এক ভারসাম্যহীন ও বিকৃত কাঠামো গড়ে ওঠে। বাস্তবে কিউবার সরকারি বেতনের হার বহুদিন ধরে ১৯৯০ সালের পর্যায়ের নিচে ছিল। বর্তমানে ক্যাডেকা বিনিময় হারে ২৪ পেসোতে এক ডলার, আর ১৯৯০ সালের কালোবাজারে তা ছিল ৭ পেসো (চিত্র ৬ ও ৭ দেখুন)। অসমতা ও বিকৃত প্রণোদনার ব্যাপার জারি থাকে। জনসংখ্যার খুব ছোট অংশের হাতেই নগদ অর্থ ছিল, তারা খোলাবাজার থেকে কিনতে পারত। অন্যদের ক্ষেত্রে নতুন রাষ্ট্রীয় খাত থেকে যে সম্পদ ‘চুইয়ে পড়বে’, সে ব্যবস্থাও ছিল দুর্বল, পরোক্ষ। এটা হয়েছে মূলত কর সংগ্রহের মাধ্যমে, জনকল্যাণে তা ব্যয় করা হয়েছে।

এই নতুন ও এক অঙ্কের বিনিময় হারের বিষয়টি কী হবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। বর্তমানে ক্যাডেকা হার হচ্ছে ২৪ পেসোতে ১ ডলার, এতে পেসো অবমূল্যায়িত হয়, তারপরও এটি সবচেয়ে কম ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী প্রতিপন্ন হতে পারে, আর সরকারি বিনিময় হারের ব্যাপক অবমূল্যায়ন করায় এটা উদ্যোক্তাদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিতে পারে। এর ফলে কিউবার অর্থনীতি খুবই কম মজুরির অর্থনীতির হিসেবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবেশ করবে আর কিউবার পেসো পে-স্কেল ও সাবেক সিইউসি আয়ের মধ্যে এক অসংযত ব্যবধান সৃষ্টি করবে। ২০, ১৫ ও এমনকি ১০ পেসোয় এক সিইউসি/ডলারের এই হার আপেক্ষিক প্রকৃত আয়ের ক্ষেত্রে আংশিক সংশোধনী আনবে। এর ফলে একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা বাড়বে। আর সবকিছু একবার ঠিক হয়ে গেলে ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার হলে নতুন করে সমন্বয় করা সম্ভব হবে।৫০

লেখার সময় ডায়া সেরোর তারিখ দেওয়া হয়নি আর কীভাবে পেসোর পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থাপনা হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সতর্কতার সঙ্গে মুদ্রা একীভূতকরণের মনোভঙ্গি নেওয়ার কারণে সরকার পরিষ্কারভাবেই আশা করছে, মূল্য পুনর্নির্ধারণের ব্যয়ভার কমানো সম্ভব হবে। কিউবার ক্ষেত্রে তুলনীয় কিছু নেই। কারণ, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে মুদ্রা একীভূতকরণ হয়েছে তখনই, যখন বাণিজ্য ভারসাম্য ইতিবাচক থাকায় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকে। অন্যদের ক্ষেত্রে বাহ্যিক সমর্থনও ছিল। ফলে কেউই কিউবার মতো এমন অদ্ভুত ভাঙা বাজার ও মূল্যের কবলে পড়েনি। কিউবার পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে মুদ্রাসংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত না থাকায় আমরা শুধু পরিবর্তনের অবস্থা নিয়ে সন্দেহই করতে পারি। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে আগামী কয়েক বছরে এই পরিবর্তনের অনেক সুদূরপ্রসারী ফলাফল অনুভূত হবে, না শুধু আপেক্ষিক মূল্য ও উপার্জন বিতরণের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, কিউবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শক্তির জন্যও।

সামাজিক বিভাজন

এটা বোঝা সহজ নয়, জনগণের কী পরিমাণ অংশের সিইউসি ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তির সুযোগ আছে, আর কোন অঙ্কে। কিছু ধারণার ভাষ্য হচ্ছে, অর্ধেক জনগণের সিইউসি আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই অঙ্ক খুবই কম। ব্যাংকে সঞ্চয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু যারা কালোবাজারি করে সফল হয়েছে, তারা তাদের টাকা ব্যাংকে রাখে না, অন্য কোথাও রাখে। একটি ব্যাপার নিশ্চয়তার সঙ্গে নিরূপণ করা যায়, সিইউসিতে কোনো সামাজিক গ্রুপের সবচেয়ে বেশি প্রবেশাধিকার আছে, আর কাদের নেই। যারা পারিবারিক সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রীয় পেনশন ও সামাজিক সহায়তার ওপর নির্ভর করে, তারাই সবচেয়ে গরিব। পেনশন দিয়ে কোনোরকমে জীবন টিকিয়ে রাখা যায়। ফলে যাদের পরিবার নেই বা পরিবার খুব গরিব, তাদের সামাজিক সেবার ওপর ভর করে চলতে হয়। যদিও হাভানার চারদিকে প্রচুর টাকা ওড়ে, ফলে তরুণ ও যোগ্য মানুষদের টাকা উপার্জনের সুযোগও অধিক। যে বুড়ো মানুষেরা নড়াচড়া করতে পারে না, তাদের জন্য এটা সবচেয়ে খারাপ জায়গা। কারণ, বাজারে পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। যারা নিম্ন বেতনের সরকারি চাকরি করে, যাদের বোনাস ও চুরি করার সুযোগ নেই বা রেমিট্যান্সের সুযোগ নেই, তারা শুধু একরকম বেঁচে থাকে।

এরপর যারা কোনোভাবে সরকারি চাকরির আয়ের সঙ্গে কিছু যোগ করতে পারে, তারা হাতে-মুখে বেঁচে থাকে। তাদের সঞ্চয়ের সামর্থ্য নেই। এরা জনগণের অর্ধেকেরও বেশি। সরকারি কর্মকর্তারা এ শ্রেণিভুক্ত। যারা সামান্য রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে বা বৈধ বা অবৈধভাবে ছোটখাটো ব্যক্তিগত ব্যবসা করে, তারাও এর মধ্যে আছে।

অসমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থনীতির দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরজীবী অনানুষ্ঠানিক খাত গড়ে ওঠে, এর ফলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এটা দক্ষ শ্রমিকদের নানা প্রণোদনা দিয়ে আনুষ্ঠানিক খাত থেকে সম্পদ সরিয়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে শিক্ষকেরাও আছে। তারা সিইউসি মজুরির জন্য এসব নিম্ন দক্ষতার চাকরি নিয়েছে। এতে তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি করে কালোবাজারে উচ্চ দামে বিক্রিতে উত্সাহ জুগিয়েছে। দুর্নীতি ও ক্রমবর্ধমান অসমতা উদারতার ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করেছে, সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতার বিশ্বাসযোগ্যতা বিনষ্ট করেছে। এই ব্যাপারটি আরও পরিপুষ্ট হওয়ার কারণ হচ্ছে, কিউবার ধনীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া শুরু করেছে। এসব সুবিধার জন্য তারা অনানুষ্ঠানিক পথে টাকাও দেয়। অন্যদিকে ভর্তুকির কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত হয়েছে।

লিনিয়ামেন্টস

অর্থমন্ত্রী মারিনো মুরিলোর নেতৃত্বে রাউল কাস্ত্রোর নতুন দলের প্রধান সমস্যা ছিল, ২০০৮ সালের ধসের পর বাহ্যিক ভারসাম্য অর্জন করা। আমদানি ব্যাপক হারে কমিয়ে দিয়ে এটা অর্জন করা সম্ভব হয়, এতে প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। এরপর থেকে অর্থনৈতিক কৌশলের মানে দাঁড়ায় মডেলের ‘আধুনিকায়ন’, উত্পাদনের বহুমুখীকরণ, পুঁজিহীন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, মূল্য, বিনিময় হার ও আয় পুনর্নির্ধারণ করা। তারা স্রেফ চীনা স্টাইলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পুঁজিবাদী কায়দায় পুঁজি আহরণের দিকে যায়নি। রাউলের স্টাইল তাঁর ভাইয়ের চেয়ে ভিন্ন হলেও তাঁর নীতি যেন ফিদেলের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে, সে ব্যাপারেও তিনি সতর্ক ছিলেন। তিনি বারবার ফিদেলের বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দিতেন।৫১ শুরুর দিকে সংস্কারে তিনি সংযত থাকলেও ২০১১ সালের পার্টির কংগ্রেসের আগে তিনি জাতীয় পরিসরে আলোচনার সূত্রপাত করে ব্যাপক সংস্কারের ভিত্তি প্রস্তুত করেন। দেশব্যাপী নানা বৈঠকে আলোচনার জন্য ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে দশটি নথির খসড়া ছাড়েন তিনি, এর শিরোনাম ছিল ‘লিনিয়ামেন্টস দে লা পলিটিকা ইকোনমিয়া ই সোশ্যাল লা রেভল্যুশন’। সেসব বৈঠকে এর ওপর নানা মন্তব্য ও সংশোধনী আসে, সেগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়। কংগ্রেসে এরপর আরেকটি খসড়া পেশ করা হয়, এতে কিছু সংশোধনী আনার পর ২০১১ সালের মে মাসে তা প্রকাশ করা হয়।৫২ যদিও লক্ষ্য ছিল এই নির্দেশনা ২০১৬ সাল পর্যন্ত পথ দেখাবে, এতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লেশমাত্র ছিল না। ১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাবের মতো এতে কিছু নীতি ও লক্ষ্যের দিকনির্দেশনা ছিল, এতে সংস্কার কর্মসূচির রূপরেখা ছিল না।

কিউবার অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার যত দুর্বলতাই থাকুক না কেন, এটা তারপরও সরকারি নীতির প্রতিবন্ধক ও চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে যায়। সরকারি খাতে বড় রকমের ছাঁটাইয়ের ব্যাপারটি যেভাবে পুনর্বিবেচনা করা হয়, তাতেই এটা বোঝা যায়। এতে নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়নগুলো অংশ নিয়েছিল। সরকারি শ্রমিকেরা সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়ায় অতি দ্রুতগতি এবং যে অবাস্তব ও অসম উপায়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে, তার বিরোধিতা করেছে। এই ঘটনা দেখে বোঝা যায়, কিউবার ট্রেড ইউনিয়নগুলো কোনোভাবে স্বাধীন না হলেও তারা নীতিসীমা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একই সঙ্গে তারা ‘যৌক্তিকীকরণের’ বাস্তব প্রয়োগ ও বিভিন্ন উদ্যোগ বন্ধ করতে ভূমিকা রেখেছে।৫৩ দিকনির্দেশনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত গ্রহণের সুযোগ রাখেনি, ফলে চূড়ান্ত নথিপত্রে বেশ পরিবর্তন আসে। ২০১১ সালের মে থেকে বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া মুরিলোর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করা হয়েছে। এর অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে পার্টি ও সংসদের কাছে পেশ করা হয়েছে। তারপরও এ কাজে বিভিন্ন সংস্থা জড়িত ছিল। পার্টি সরকার এবং বিশেষজ্ঞ কমিশনের জটিল আন্তক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ প্রক্রিয়া এগিয়েছে। বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ার মধ্যে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। বিভিন্ন পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে পুনরায় প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও মনিটরিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

‘নির্দেশনা’ ও আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় বাজারের ‘কর্মকৌশল’ গ্রহণের ব্যাপারটি ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু এটাকে রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করুন। এটা ঠিক নব্য উদারনৈতিক মতবাদের নয়, যাতে উত্তরণের কৌশলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোতে উদারীকরণের উপাদান আছে। যেমন অরাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাপ্তি, বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো, বিশেষ উন্নয়ন জোনের ক্ষেত্রে কর মওকুফ ও গৃহায়ণ, পুরোনো গাড়ির বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল। কিন্তু সরকার নিজের পর্যবেক্ষণ সংহত করতে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি খাতে ছেড়ে না দিয়ে এর সঙ্গে আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। রাউল ক্ষমতায় আসার পর কম্পট্রোলার জেনারেল গ্ল্যাডিস বেজেরানো সম্পদ ও কর্তৃত্ব বাড়িয়েছে, যাকে এত দিন বাইরের ভাষ্যকারেরা উপেক্ষা করেছে। তার কাজ শুধু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শক্তিশালী করা নয়, মানুষকে তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে কর প্রদানে উত্সাহিত করাও তার অন্যতম প্রধান কাজ। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে উচ্চপর্যায়ের অনিয়মের তদন্ত করা হয়েছে, এর ফলে অনেক বড় কর্তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কর সংগ্রহের লক্ষ্যে দেশব্যাপী কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, হিসাবরক্ষক ও স্বনিয়োজিত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাত্ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে আনুষ্ঠানিক খাতের দক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার নির্মাণ করা হয়েছে, সংস্কৃতি সৃষ্টি করা হয়েছে। যেখানে বাজার আগের চেয়ে আরও বড় ভূমিকা পালন করছে।

বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার পর থেকে কিউবার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো যাচ্ছে না, বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩-এর কোঠায় নেমে এসেছে। বারবারই লক্ষ্য অধরা থেকে যাচ্ছে। ভেনেজুয়েলা থেকে সহায়তা আসছে ঠিকই, তবে প্রথম দিকে তা কিউবার অর্থনীতিকে যেভাবে সঞ্জীবিত করেছে, ২০০৮ সালের দিকে তা অনেকটাই থিতিয়ে আসে। আর মার্কিন বাজারে ঢুকতে না পারা ও আন্তর্জাতিক অর্থবাজারের বিনিয়োগ তার প্রবৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রীয় খাতের প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ঠিকই, স্বাস্থ্যসেবায় সেটা তেমন বাড়েনি, যদিও ২০১৪ সালে এ খাতের মজুরি কিছুটা বেড়েছিল। কৃষির উত্পাদন তেমন একটা বাড়েনি, এটা সত্যিই হতাশার কারণ হয়ে উঠেছে। তবে বেসরকারি খামারগুলোকে জমি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের আরও অধিক হারে প্রণোদনা দেওয়া, বিতরণব্যবস্থার উন্নতি, ইনপুট বাড়ানো ও অর্থ সরবরাহ ঠিক রাখার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তুলনা করলে দেখা যায়, ২০০৮ সাল থেকে কিউবার প্রবৃদ্ধির হার ‘উত্তরণ’ অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় খারাপ নয়। সরকারি খাতের বেতন-ভাতা ব্যাপক হারে কমানো হলেও সমন্বয়-প্রক্রিয়ার গতি ছিল বেশ ধীর, যাতে চাহিদা পড়ে না যায় এবং বেকারত্ব না বাড়ে। কিন্তু ২০১১ সালের সংস্কারের প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। বিধিবিধান নিয়ে আনাড়ির মতো নাড়াচাড়া না করে নতুন বাজারকে আরও কার্যকর করতে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি চিন্তা করা হচ্ছে, যাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে এবং দ্বৈত মুদ্রাব্যবস্থার সমস্যাসমূহ মোকাবিলা করা যায়।

সবচেয়ে সাম্প্রতিক পদক্ষেপ হচ্ছে মারেই বন্দরের উন্নয়ন, এটি হাভানা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে। এই প্রকল্প একটি যৌথ উদ্যোগ, এটি শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে, ব্রাজিলীয় উন্নয়ন ব্যাংক বিএনডিইএসের অর্থায়নে এটি পরিচালিত হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর অবকাঠামো খাতে এটিই সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। এই পোতাশ্রয়ের গভীরতা ১৮ মিটার, ফলে ২০১৫ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়ে গেলে পণ্যবাহী বিশাল আকৃতির ‘পোস্ট প্যান্যাম্যাক্স’ জাহাজ এখানে সহজে ঢুকতে পারবে, যেখান থেকে এই জাহাজ পানামা খাল অভিমুখে যাত্রা করতে পারবে। বর্তমানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে শুধু কিউবা থেকে সব আমদানি বন্ধই হয়নি, কিউবার জাহাজঘাটে কোনো জাহাজ ভিড়লে সেটা ছয় মাসের জন্য মার্কিন ঘাটে ভিড়তে পারবে না। এসব নিষেধাজ্ঞা আংশিকভাবে তুলে নেওয়া হলেও ম্যারিয়েল বন্দরের তত্পরতা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। আর এই প্রকল্প হয়তো কিউবার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত, অংশত। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলেও এই বন্দর চীনা, ব্রাজিল ও ইউরোপের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের কাজে লাগতে পারে। এটা একটা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে পারে, যেখান থেকে কনটেইনার ছোট জাহাজে তুলে আঞ্চলিক বন্দরগুলোতে পাঠানো যেতে পারে।

দ্বিতীয় উদ্যোগটি হচ্ছে ২০১৩ সালের শেষের দিকে ম্যারিয়েলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্মুক্ত করা, নতুন একটি রেললাইনের মাধ্যমে এটি যুক্ত করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে ‘শিল্প অঞ্চলকে’ পরিচিত করানো, বন্দরের আশপাশে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণের লক্ষ্যে এটি করা হয়েছে। আর দেশের বাজারে সেবা প্রদানকারী কিউবার ও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করা। এই দুটি নতুন ঘটনার সঙ্গে আছে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আইন। বহু বছরের আলোচনার পর এটি ২০১৪ সালের জুনের শেষের দিকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। কিউবাবিশারদদের হতাশার কারণ হচ্ছে, এটা ১৯৯৫ সালের আইনের স্রেফ সংশোধন। এতে কর ও অন্যান্য প্রণোদনার মতো বিষয়গুলোর সংস্কারের প্রসঙ্গ ও মার্কিনভিত্তিক বিনিয়োগকারীদের প্রতি আরও উন্মুক্ত আহ্বান থাকলেও মূল নীতি অক্ষুণ্ন থাকছে: কিউবার রাষ্ট্রই সবকিছু দেখভাল করবে, আর তাকে এ মর্মে সন্তুষ্ট করতে হবে যে প্রতিটি বিদেশি বিনিয়োগই উন্নয়নের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

ডে জিরো

তথাপি, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলে বিকৃত একটি প্রবৃদ্ধির মডেল চিরস্থায়িত্ব পেতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত বিনিময় হারের পার্থক্য একগুচ্ছ আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক, ডলার অরূপান্তরযোগ্য পেসো মূল্য নির্ধারণ করছে। এটা দেশীয় ও বাইরের অর্থনীতির মিলনে ব্যাঘাত ঘটায়। এর মধ্যে আছে পেসো-সিইউসি-ডলার সমতা এবং অনানুষ্ঠানিক কিন্তু বৈধ ক্যাডেকা হার, ২৪ পেসোয় সিইউসি/ডলার। অরাষ্ট্রীয় খাত বিকশিত হওয়ায় এটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছে যে তুলনামূলকভাবে অদক্ষ বেসরকারি উদ্যোগ দেশজ অর্থনীতির মধ্যেই বিকশিত হতে পারে। কারণ, তাদের শ্রমিকসহ কিউবার পেসোর খরচ ক্যাডেকা/সিইউসি হারে অবমূল্যায়িত হয়, যার মাধ্যমে তারা তাদের বিনিময় করে থাকে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় খাতের উদ্যোগগুলোকে অতিমূল্যায়িত দাপ্তরিক হারে কাজ করতে হয়েছে, ফলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। একধরনের ‘অর্থভ্রান্তি’ বিনিয়োগের জন্য টাকা তুলতে পারে না। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের উত্পাদনশীলতা অনেক কম হলেও তারা রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি উপভোগ করে, যদিও তাদের অনেক কর দিতে হয়।

২০১১ সালের ‘লিনিয়ামেন্টস’ ৫৫ অনুসারে, দ্বৈত মুদ্রাব্যবস্থার রাশ টানতে হবে। কিন্তু যা লেখা হয়েছে তা খুবই দুর্বোধ্য আর পরিবর্তনের গতিও খুব ধীর।৫৪ ঝুঁকি এড়াতে গিয়ে এই শ্লথগতি সৃষ্টি হয়েছে। মুদ্রার কোনো রকম পুনর্বিন্যাস ঘটাতে হলে পুনর্মূল্যায়ন করতে হতো, সেটা খুবই ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারত। আর ১৯৯০-এর শুরুর দিকে পেসোর মান যেভাবে পড়ে যায়, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থিতিশীলতা রক্ষায় জোর দেয়। নতুন করে কষ্ট করতে হবে—এই ভয়ে সবাই সতর্ক হয়ে যায়। শুধু সরকার ও আমলাতন্ত্রই নয়, জনগণও সতর্ক হয়ে যায়। অনেক পরিবারই বিকৃত পারিবারিক কাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে নেয়, ফলে তারা তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্রমিক উন্নয়নের ধারণাই মধ্য ’৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মুদ্রানীতির ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনে জল ঢেলে দেয়, কিন্তু পরবর্তীকালের ধীরগতির কারণে বিষয়টি সামনে চলে আসে।

শেষমেশ, ২০১৩ সালের শুরুর দিকে প্রথম পদক্ষেপ গৃহীত হয়। দুই বছরের গবেষণার পর একটি পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগগুলোকে সিইউপি-সিইউসি হার ব্যবহারের অনুমতি দেয়, ১০ পেসোয় এক সিইউসি। অভ্যন্তরীণ সরবরাহকারী অর্থাত্ রাষ্ট্র, সমবায় ও বেসরকারি খাত থেকে কেনার জন্য এটা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে সরকার ঘোষণা করে, মুদ্রা সংস্কারের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের মার্চে এটা মূল্য নির্ধারণের বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করে, ডে জিরোর হিসাব মেলানোরও নির্দেশনা প্রদান করে; যখন সিইউসি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে।৫৫ কিউবার পেসোকে তখন অনুমেয়ভাবেই বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরযোগ্য করা হয়, যদিও বিনিময়ের বিস্তারিত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা যায়নি। বিঘ্নের হার কমানোর জন্য রাষ্ট্র পেসোর মূল্যের নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করবে, আর প্রাথমিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভর্তুকি দেবে। একক মুদ্রায় যে নতুন মূল্য প্রাধান্য বিস্তার করবে, সেখানে ১৯৯০ সালের পর থেকে পেসোর আন্তর্জাতিক ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের ব্যাপারটি প্রতিফলিত হবে। আর ১৯৯০ সালের পর থেকে বেসরকারি খাতে যে গোপন ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তা তুলে নেওয়া হবে।

মজুরির তারতম্য বেশ চোখে পড়ার মতোই। কিন্তু ভোগের ক্ষেত্রে সেটাই প্রধান নির্ধারক নয়, সেটা নির্ভর করে সিইউসিএসএর লভ্যতার ওপর। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে, তারা অনেকেই পিসিসি সদস্য ও কর্মকর্তা। তাদের অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার কথা নয়। তারা হয়তো সহূদয়তার মতো অগ্রাধিকার পেতে পারে, কিন্তু আয়ের ক্ষেত্রে তেমন কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিছু পেশাদারের ক্ষেত্রে দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করে প্রচুর টাকা উপার্জনের সুযোগ আছে, সেই টাকায় বাড়িঘর সংস্কারের মতো কাজ তারা করতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কর্মীদের অতিরিক্ত বোনাস অর্জনের সুযোগ আছে। প্রথমত, সেখানে মৌলিক পণ্য যেমন টুথপেস্ট ও ব্লিচের সুযোগ আছে। এখন ১০-২৫ সিইউসিএস বোনাস কমবেশি সাধারণ হয়ে গেছে। গত এক দশকে অনেক পরিবারের আয় বেড়েছে, ফলে তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে, বাড়িঘর সংস্কার করতে পারে ও পুরোনো গাড়িও কিনতে পারে। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে গড়পড়তা আয় বাড়েনি, ফলে যারা শুধু পেসোর বেতনের ওপর নির্ভর করে, তাদের জীবন খুবই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

ধনীরা সেখানে সংখ্যালঘু, স্বতন্ত্র এক গোষ্ঠী। তারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ভাগ্যবান গোষ্ঠী, তারা বৈধ ও অবৈধভাবে অরাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মালিক। এদের মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যবস্থাপক, আর অসত্ সরকারি কর্মকর্তা। তার মানে, তারা সরকারের কাছ থেকে এসব অগ্রাধিকার পায় না। তারা এক ভিন্ন জগতে বাস করে, সিংহভাগ জনগণের বাইরে তাদের অবস্থান। এই গোষ্ঠী-বিষয়ক নীতি হচ্ছে, অর্থনৈতিক অপরাধ চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা ও করকাঠামো শক্তিশালী করা। যাতে উচ্চ আয়ের মানুষদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করা যায়, আয় ও খুচরা অন্যান্য খাত থেকেও এই কর সংগ্রহ করার লক্ষ্য আছে তাদের। কিন্তু সরকার বৈধ খাত থেকে উচ্চ আয় করার ব্যাপারে আর হস্তক্ষেপ করছে না। ফলে বেসবল খেলোয়াড়দের বিদেশে খেলার ওপর আর নিষেধাজ্ঞা থাকল না। কিউবার মানুষেরা এখন বিদেশে ভ্রমণ ও কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাধীন, এমনকি তারপর তারা দেশেও ফিরে আসতে পারে।

সিংহভাগ জনগণের ক্ষেত্রে জীবনমান উন্নয়নের হার খুব নগণ্য, গতিও খুব ধীর। হাভানায় আবার বহু মানুষ অসত্ পন্থায় টাকা কামাই করেছে, ফলে সেসব হাড়ভাঙা খাটুনি করা মানুষের জন্য এটা খুব অসহনীয়। মৌলিক পণ্যে এখনো ভর্তুকি দেওয়া হয়, কিন্তু রেশন থেকে অনেক প্রধান খাবারই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেগুলো এখন কৃষিবাজার থেকে কিনতে হয়। এটা ছিল খুবই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, এর সঙ্গে বেতন বেড়েছেও সামান্য, বোনাস পাওয়া মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে শম্বুকগতিতে। বিদ্যুত্ সরবরাহ উন্নত হয়েছে। কিন্তু পানি ও বিদ্যুতের মতো পরিষেবার খরচ বাড়ায় মজুরির বৃদ্ধি আর গায়ে লাগে না। ফলে অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই জীবনমানের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো নয়। তারপরও নিরাপত্তা জাল জারি আছে, অবকাঠামো ও সরকারি সেবা নিশ্চিতভাবে আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। এতে যে সরকার নতুন উপার্জন ও পেশাদারি সেবা রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত কর ব্যয় করতে চায়, সেটি প্রতিফলিত হয়।

বিকল্প?

রাউল কাস্ত্রোর দ্বিতীয় দফা রাষ্ট্রপতিত্বের মেয়াদ শেষ হবে খুব বেশি হলে ২০১৮ সালে। ২০১৬ সালে বর্তমান নির্দেশনার আলোকে ‘হালনাগাদকরণ’ শেষ হবে, ফলে তখন অর্থনীতির লক্ষ্য হবে একটি বৃহত্ উত্পাদন খাত ও বড় বেসরকারি খাত নির্মাণ করা। আবার সার্বিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জনকল্যাণের জায়গাগুলো ঠিক রাখাও এই উদ্দেশ্যের আওতায় পড়ে। এটা অর্জন করতে গেলে বিনিয়োগের হার বাড়াতে হবে। নতুন বন্ধু যেমন চীন, ব্রাজিল ও রাশিয়ার সঙ্গে কিউবার আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখার সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা তার পক্ষে সম্ভব হবেই বলে আশা করা যায়। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কার্যকারিতা ও গতিশীলতা বজায় রাখাই হবে কঠিন কাজ। আবার একই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য ও সামাজিক বিভাজন ঠেকানোই কঠিন কাজ হবে, যা রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রকল্পের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।

কিউবাকে ফুরিয়ে যাওয়া শক্তি হিসেবে বাতিল করার আগে আজ পর্যন্ত তার অর্জনের বিশালত্ব স্বীকার করে নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য ও গতিশীলতা আসে, এটা স্বীকার করে নিলেও কিউবার নীতিপ্রণেতারা পূর্ণাঙ্গ বেসরকারীকরণ ও উদারীকরণের সম্ভাবনা একদম খারিজ করে দেননি। তাঁরা সব সময় এর সামাজিক খরচের ব্যাপারে মনোযোগী। এই মনোভঙ্গি গড়ে ওঠার পেছনে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কোনো ভূমিকা নেই। বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সুরক্ষার সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে এটা ওয়াশিংটন কনসেনসাসের ভবিষ্যদ্বাণীকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের সাবেক কমিকন সদস্য এবং চীন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করলেও কিউবার উন্নয়নের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে।

প্রথমত, সংকটের সময়ও কিউবা তার সামাজিক সুরক্ষা খাত বজায় রেখেছে, এ ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে তার পার্থক্য খুবই দৃশ্যমান। এই দ্বীপরাষ্ট্রটির ওপর বাইরের যে চাপ ছিল, তা অনন্য। তাকে বৈরিতাও সামলাতে হয়েছে অনেক। কিন্তু সর্বজনীন জনকল্যাণের প্রতি তার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, সে কারণে তার পক্ষে সামাজিক দুর্দশা সামলানো সম্ভব হয়েছে। এর সঙ্গে তারা প্রচুর মানুষের পরামর্শ নিয়েছে, বিশেষ করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে—সংকটের শুরুতে, স্থিতিশীল হওয়ার পর্যায়ে আর রাউল কাস্ত্রোর সমন্বয়ের নতুন পর্যায়ের আগে। তৃতীয়ত, ধাক্কা এবং তা সামলানোর শুরুর দিকে মূল্য ও মজুরির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে মূল্যস্ফীতিতে লাগাম দেওয়া সম্ভব হয়েছে, ফলে খুব দ্রুতই স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। মজুরি ও মূল্য নির্ধারণের কারণে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির দ্রুত বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক খাতে তেমন ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি, আর সেখানে আয়বৈষম্যও কমানো সম্ভব হয়েছে। দুটি ব্যাপার একদম আলাদা হলেও এর সঙ্গে চীনের ‘ডুয়েল ট্র্যাক’ ব্যবস্থার মিল রয়েছে। যেখানে একটি পরিকল্পিত ‘পথ’ থাকলেও এর সঙ্গে আরেকটি ‘বাজার’ সৃষ্টি হয়। এতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও শিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিভ্রান্তি ও অকার্যকারিতা থাকা সত্ত্বেও কিউবার ‘বিভক্তিকরণ’ ও ‘দ্বিতীয় অর্থনীতি’ দেশটিকে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সহায়তা করেছে।

চতুর্থত, রাষ্ট্র অর্থনৈতিক পুনঃকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতেই রাখে। এতে রাষ্ট্র কষ্টার্জিত টাকা কিছু নির্ধারিত শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ব্যাপক সফলতা আসে, লভ্য পুঁজির সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল আপেক্ষিক। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে কিউবার পরিকল্পনাবিদেরা ‘শেখার সুযোগ’ পেয়েছেন। ব্যবস্থাপক ও শ্রমিকেরা চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছেন, কীভাবে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায়। এই মনোভঙ্গির কারণে যে রপ্তানির ক্ষেত্র তৈরি হয়, তার মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ এটি ছিল খুবই সংকীর্ণ। কিন্তু সংকটকালের পর সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে এটা কার্যকর হয়েছিল। শেষমেশ কিউবা মূলধারার ‘পুঁজিবাদে উত্তরণের’ পথ পরিহার করায় সমন্বয়-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। একজন কর্মকর্তা এটাকে ‘চিরস্থায়ী বিবর্তন’৫৭ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এটা স্থিতিস্থাপক, কিউবার পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতার প্রতি সংবেদনশীল। অন্য কমিকন দেশগুলোতে উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণের পরামর্শকেরা যে বাঁধাধরা রেসিপি দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এর পার্থক্য যোজন যোজন। কিউবা একটি দরিদ্র দেশ। কিন্তু তার স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা এই অঞ্চলের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। এর মনোভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, বৈপরীত্য ও সমস্যা থাকলেও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন মডেলের মধ্যেও বাজার ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ফল বেশ ইতিবাচক। এর ফলে পরবর্তী প্রশ্নের উদয় হয়—আমাদের এটা কেন ধরে নিতে হবে যে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন থেকে রাষ্ট্রকে সরে আসতে হবে। অথবা তা না হলে রাষ্ট্রকে পুঁজিবাদে উত্তরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে।

তথ্যসূত্র ও টীকা

১.         Carmelo Mesa-Lago, ‘Economic and Ideological Cycles in Cuba: Policy and Performance, 1959–2002’, in Archibald Ritter, ed., The Cuban Economy, Pittsburgh 2004.

2.       Eliana Cardoso and Ann Helwege, Cuba after Communism, Cambridge, ma 1992, pp. 51, 1, 11; Andrés Oppenheimer, Castro’s Final Hour, New York 1992.

3.         বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার পর আমেরিকান বাজারে প্রবেশ বাতিল হলে কিউবা পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহায়তা কাউন্সিল বা কমিকনে (COMECON) ১৯৭০ সালে যোগ দেয়। ১৯৮৯ সালের অন্য সদস্যগুলো হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং ভিয়েতনাম, ‘ক্রান্তিকালীন অর্থনীতি’তে মঙ্গোলিয়া ও ভিয়েতনাম ছাড়া সব কমিকন সদস্য রয়েছে।

4.         See Manuel Franco et al., ‘Impact of Energy Intake, Physical Activity and Population-wide Weight Loss on Cardiovascular Disease and Diabetes Mortality in Cuba, 1980–2005’, American Journal of Epidemiology, vol. 166, no. 12, September 2007.

৫.         স্নায়ুযুদ্ধকালীন ক্রেমলিনোলজির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭০ সালে কিউবানোলজি শব্দটির উত্পত্তি করা হয় : Helen Yaffe, Che Guevara: The Economics of Revolution, Basingstoke 2009, p. 4. Yaffe itemizes the research commissioned by the Pentagon, Special Operations Research Office, cia, ‘National Defence Education’ and the Cuban-American National Foundation, the powerful émigré lobby.

6.       See John Williamson, ‘What Washington Means by Policy Reform’, in John Williamson, ed., Latin American Adjustment: How Much Has Happened?’, Washington, dc 1990.

7.       János Kornai, The Road to a Free Economy, New York 1990, p. 31.

8.       Anders Åslund, ‘Principles of privatization for formerly socialist countries’, Stockholm Institute of Soviet and East European Economics Working Paper 18, 1991; Leszek Balcerowicz, ‘Common fallacies in the debate on the transition to a market economy’, Economic Policy, vol. 9, no. 19, December 1994.

9.       Gérard Roland, Transition and Economics: Politics, Markets and Firms, Cambridge, ma 2000, p. 14.

10.      ‘Anti-market features’: Mesa-Lago, ‘The Economic Effects on Cuba of the Downfall of Socialism in the ussr and Eastern Europe’, in Mesa-Lago, ed., Cuba after the Cold War, Pittsburgh 1993, p. 176; ‘half-baked’: Mesa-Lago, Are Economic Reforms Propelling Cuba to the Market?, Miami 1994, pp. 70–1.

11.      Mesa-Lago, Cuba after the Cold War, pp. 246–7; Rubén Berríos, ‘Cuba’s Economic Restructuring, 1990–1995’, Communist Economies and Economic Transformation, vol. 9, no. 1, 1997, p. 117; Mauricio de Miranda Parrondo, ‘The Cuban Economy: Amid Economic Stagnation and Reversal of Reforms’, Canadian Foundation for the Americas, Ontario 2005.

12.       ১৯৯৫ সালে পরিচালিত অনেকগুলো গবেষণার সময় মিনিস্ট্রি অব ফরেন ইনভেস্টমেন্ট (মিনভেক), মিনিস্ট্রি অব টুরিজম (মিনটুর) চেম্বার অব কমার্স, মিনিস্ট্রি অব বেসিক ইন্ডাস্ট্রি, মিনিস্ট্রি অব ফরেন ট্রেড এবং কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক; হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং তাবাজেস্ট ও কিউবানিকেলের ম্যানেজারদের সঙ্গে সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছে।

13.       যদিও কিউবায় প্রভাব খাটানো এবং অবৈধ সম্পদ বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে, তবে নৈতিক অবস্থা বজায় রাখার প্রবল চেষ্টা শুধু সরকারি কর্মচারী এবং দলীয় সদস্যদের আনুষ্ঠানিক নিয়ম এবং যারা দুর্নীতিতে ধরা পড়ে, তাদের কঠিন শাস্তির মধ্যেই দৃশ্যমান নয় বরং বেশির ভাগ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর কার্যাবলিতেও দেখা যায়। বিস্তর একটি গবেষণার মাধ্যমে কিউবায় দুর্নীতির মাত্রা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সেখানে দুর্নীতির উল্টো চিত্র ও তা দমনে প্রচেষ্টার মাত্রা পাওয়া গেছে: Sergio Diaz-Briquets and orge Pérez-López, Corruption in Cuba: Castro and Beyond, Austin 2006. কিউবা বিশ্বব্যাংক ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি পরিমাপ সূচকে ভালো স্কোর করেছে।

14.       For example, Cardoso and Helwege, Cuba after Communism, pp. 44–6.

15.      Richard Gott, Cuba: A New History, New Haven, ct 2004, p. 325. See also Isaac Saney, Cuba: A Revolution in Motion, London and New York 2004; Antonio Carmona Báez, State Resistance to Globalization in Cuba, London 2004.

16.      Manuel Pastor and Andrew Zimbalist, ‘Waiting for Change: Adjustment and Reform in Cuba’, World Development, vol. 23, no. 5, 1995. See also Jorge Domínguez and Daniel Erikson, ‘Cuba’s Economic Future: A Dozen Comparative Lessons’, in Shahid Javed Burki and Daniel Erikson, eds, Transforming Socialist Economies: Lessons for Cuba and Beyond, Basingstoke 2005; Susan Eckstein, Back from the Future: Cuba under Castro, New Brunswick 1994.

17.      José March-Poquet, ‘What Type of Transition Is Cuba Undergoing?’, Post-Communist Economies, vol. 12, no. 1, 2000; Claes Brundenius, ‘Whither the Cuban Economy after Recovery?’, Journal of Latin American Studies, vol. 34, no. 2, May 2002.

18.      An exception is a cursory comparison between Cuba and transition economies by Mesa-Lago and Pérez López (Cuba’s Aborted Reform: Socioeconomic Effects, International Comparisons, and Transition Policies, Gainsville, fl 2005, pp. 158–164). তাদের তথ্যে দেখা যায় যে কিউবার জিডিপি ক্রান্তিকালীন অর্থনীতির কাছাকাছি চলে গেছে। কিন্তু আলোচনাটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর তুলনায় কিউবার দুর্বলতা দেখায় এবং কোনোভাবে যে কিউবার নীতি তার প্রবৃদ্ধিকে উপকৃত করতে পারত সে সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়। 

১৯.      দানি রদ্রিক ও অন্যান্য—বিশেষ করে ইয়েঙ্গি কিয়ান একটি ‘বিশ্লেষণাত্মক আখ্যান’ অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে কীভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শর্তাবলি নীতি ফলাফলকে নির্ধারণ করেছে তা দিয়ে রূপান্তরের সম্ভাব্য পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন, ‘How Reform Worked in China,' in Rodrick, ed., In Search of Prosperity: Analytic Narratives on Economic Growth, Princeton and Oxford 2003.

20.      See José Luis Rodríguez García’s report, ‘La Economía de Cuba ante la cambiante coyuntura internacional’, in Economía Cubana, vol. 1, nos. 1 and 2, 1991 and 1992.

21.      oecd, Geographical Distribution of Financial Flows to Developing Countries, 1998.

22.      On post-crisis strategy as rectificación, see the contributions by Mesa-Lago, Svejnar and Pérez López in Mesa-Lago’s Cuba after the Cold War; Jorge Pérez López, ‘Castro Tries Survival Strategy’, Transition, World Bank 1995. On failure to address the crisis: Marifeli Pérez-Stable, The Cuban Revolution: Origins, Course and Legacy, Oxford 1999, p. 176.

23.      Nauro Campos and Fabrizio Coricelli, ‘Growth in Transition: What We Know, What We Don’t and What We Should’, Journal of Economic Literature, vol. 40, no. 3, September 2002, Table 6.

24.      Economía Cubana: Boletín Informativo, vol. 1, no. 2, p. 21 and vol. 1, no. 7, p. 22, 1992.

25.      José Alvarez, ‘Overview of Cuba’s Food Rationing System’, Gainsville, fl 2004, p. 4.

26.      Paul Collins, ‘Cuba’s Food Distribution System’, in Sandor Halebsky et al., Cuba in Transition: Crisis and Transformation, Boulder, co 1992.

27.      Julia Wright, Sustainable Agriculture and Food Security in an Era of Oil Scarcity: Lessons from Cuba, London 2008.

28.      Efforts to sustain basic nutrition are described by Angela Ferriol Muruaga in ‘La seguridad alimentaria en Cuba’, Economía Cubana: Boletín Informativo, vol. 2, no. 3, 1996; ‘Pobreza en condiciones de reforma económica: el reto a la equidad en Cuba’, Cuba: Investigación Económica 4, no. 1, inie, 1998; ‘Política social cubana: situación y transformaciones’, Temas, 1998; and ‘Retos de la política social’, Cuba: Investigación Económica 11, no. 2, 2005.

29.      Antoni Kapcia, Cuba in Revolution: A History Since the Fifties, London 2008, p. 165, describes the creation of the Consejos Populares, ‘a new level of barrio-level political representation’.

30.      Elena Álvarez, ‘Características de la Apertura Externa Cubana (I)’, Economía Cubana: Boletín Informativo, vol. 1, no. 26, 1996.

31.      pcc, iv Congreso del Partido Comunista de Cuba: Discursos y Documentos, Havana 1992.

32.      For the account, see Gail Reed, Island in the Storm: The Cuban Communist Party’s Fourth Congress, Melbourne and New York 1992.

33.      Campos and Corricelli, ‘Growth in Transition: What We Know’, Table 10.

34.      Joseph Stiglitz, Globalization and Its Discontents, London 2002, pp. 133–65; see also Branko Milanovic´, ‘Income, Inequality and Poverty during the Transition from Planned to Market Economy’, World Bank Regional and Sectoral Studies, Washington, dc 1998.

35.      Marisa Wilson, ‘No Tenemos Viandas! Cultural Ideas of Scarcity and Need’, International Journal of Cuban Studies 3, June 2009.

36.      Early 1990s editions of Economía Cubana: Boletín Informativo trace the shifting preoccupations and responses.

37.      George Carriazo, ‘Cuba: Apertura y adaptación a una nueva realidad’, Economía Cubana: Boletín Informativo 15, May 1994.

38.      Fidel Castro, Por el camino correcto: Recopilación de textos, Havana 1986, quoted in Díaz-Briquets and Pérez-López, Corruption in Cuba, p. 164. ১৯৮৬ সালে র্যাটিফিকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে বন্ধ হওয়া কৃষক বাজার আবার খুলে দেওয়ার একটি প্রস্তাব ১৯৯১ সালে পিসিসি কংগ্রেস দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে; সম্প্রতি ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি আরেকটি পুনঃ প্রবর্তন প্রস্তাব বরখাস্ত করেছে। এই বিষয়টি পার্লামেন্টোস ওবরেরোস জানু-মে ১৯৯৪-এর আলোচ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

39.       Carriazo, ‘Cuba: Apertura y adaptación a una nueva realidad’.

40.      Campos and Coricelli, ‘Growth in Transition: What We Know’, Table 6.

41.      onei; World Bank, World Development Indicators.

42.      Average calorie intake was back at pre-crisis level by 1999: Franco et al, ‘Impact of Energy Intake’.

43.       ১৯৯০-৯৪ সালে পেসোর মূল্য নিম্নমুখী থাকার সময় ভোক্তার মূল্যসূচক প্রকাশিত হয়নি, তাই আনুষ্ঠানিক কোনো মজুরি ইনডেক্স নেই। নিম্ন খাদ্যমূল্য ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে সরকারি ভোক্তা মূল্যসূচক যথাক্রমে ১১.৫ ও ৪.৯ শতাংশ কমিয়েছে।

44.       ১৯৯৭-২০০০ সালে কিউবার আনুষ্ঠানিক বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির গড় ছিল শূন্য এবং ২০০০-১২ সালে মাত্র ২ শতাংশ যেখানে ক্রান্তিকালীন অর্থনীতির দেশগুলোয় ৯০ দশকের শেষে গড়ে ২৮ শতাংশ এবং ২০০০-১২তে ৮ শতাংশ ছিল। কিউবার সরকারি মূল্যহার নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে; গৃহস্থালিগুলোর মধ্যে প্রকৃত জীবনযাত্রার ব্যয়ে ভিন্নতা রয়েছে যা কোন ধরনের বাজারে তারা কত পরিমাণ ব্যয় করেছে তার ওপর নির্ভর করে—সরকারি বা বেসরকারি, শহুরে বা গ্রামীণ, পেসো বা স্থিত মুদ্রা। আবার মূল্যও অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। যাহোক, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে যদিও ক্রয়ক্ষমতা কমতে পারত, কিন্তু গৃহস্থালিগুলোর প্রকৃত ভোগ এমন হারে কমেনি যা ‘৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ক্রান্তিকালীন অর্থনীতির দেশগুলোর গড় মুদ্রাস্ফীতির সমান হতে পারত।

45.       এসব আত্মস্বীকৃত রাষ্ট্রবহির্ভূত ক্ষমতা মার্কিন মিত্রদের অনেকগুলোর মধ্যে একটি প্রতিবাদ জাগিয়েছিল: ইইউ ডব্লিউটিওতে হেলমস-বার্টনের ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং তখনই শুধু সরে দাঁড়ায় যখন যুক্তরাষ্ট্র ইইউ দেশগুলোর বিচার করবে না বলে রাজি হয়। কানাডা, মেক্সিকো, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি এবং নেদারল্যান্ডস কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যায়; কানাডার কোম্পানি শেরিত ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

46.       Julio Carranza Valdés, Luis Gutiérrez Urdaneta, and Pedro Monreal González, Cuba: Restructuring the Economy: A Contribution to the Debate, London 1996. The sequence of events is documented in Mauricio Guilliano, El Caso de cea: Intelectuales e Inquisidores en Cuba. ¿Perestroika en la Isla?, Miami 1998.

47.      Investment rates of the 1990s are provided by Campos and Coricelli, ‘Growth in Transition: What We Know’; more recent data is provided by the undp and World Bank World Development Indicators.

48.      fdi policy is discussed more fully in Emily Morris, ‘Cuba’s New Relationship with Foreign Capital: Economic Policy-Making since 1990’, Journal of Latin American Studies, vol. 40, no. 4, 2008.

49.      World Bank (data are for Central and Eastern Europe).

50.       কিউবার প্রকৃত জিডিপি সিরিজটি ১৯৯৭ সালের মূল্য ও মূল্য সংশোধনীর ওপর নির্ভর করে করা হয়েছে। তাই বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হারে কিছুটা গরমিল থাকতে পারে, যদিও তা সামগ্রিক চিত্রে তেমন কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। শুরুতে জর্গ পেরেজ-লোপেজ এবং কারমেলা মেসা-লাগো ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত একটি প্রবৃদ্ধির উত্থানের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে এবং সেটাকে ‘পরম্পরতাহীন, ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা ও ধাঁধা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল : ঝবব ‘See ‘Cuban GDP statistics under special Period,' Cuba in Transition 2009, ASCE, PP. 153-66. তারা আনুষ্ঠানিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির চিত্র গ্রহণ করতে তখনই রাজি হয়েছিল, যখন সে চিত্রে স্থবিরতা প্রদর্শন করছিল।

51.       ‘‘Revolution senses the historical moment; it changes everything that must be changed’: Fidel Castro, 1 May 2000.

52.      Partido Comunista de Cuba, ‘Proyecto de Lineamientos de la Política Económica y Social del Partido y la Revolución’, 2011.

53.      On the role of trade unions see Steve Ludlam, ‘Cuban Labour at 50: What About the Workers?’, Bulletin of Latin American Research, vol. 28, no. 4, 2009, and ‘Aspects of Cuba’s Strategy to Revive Socialist Values’, Science and Society, vol. 76, no. 1, 2012, pp. 41–65. সরকার ও ইউনিয়নের সর্বশেষ আলোচনার ফলাফল ছিল লেবার কোড (ল’১১৬) যা ২.৮ মিলিয়ন শ্রমিকের সঙ্গে আলোচনা করে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অনুমোদিত হয়েছে।

54.       আক্ষরিক অনুবাদ: ‘আর্থিক একত্রীকরণে অগ্রগতি, শ্রমিকদের উত্পাদনক্ষমতা এবং বণ্টন ও পুনঃবণ্টন প্রক্রিয়া কার্যকারিতাকে গ্রহণ করার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে। এর জটিলতার কারণে এই প্রক্রিয়ায় অবজেক্টিভ ও সাবজেক্টিভ দুই পর্যায়েই কঠোর প্রস্তুতি ও কার্যোদ্ধার প্রয়োজন।’

55.       Gaceta Oficial, 6 March 2014.

56.      For further details, see ‘Cuba prepares for exchange-rate reform’, Economist Intelligence Unit, 12 March 2014.

57.      Interview, Minister for Foreign Investment and Economic Cooperation, Havana, June 1996.