দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তসীমান্ত 'রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ'-এর ধারণা ও ধরন যাচাই: নেপালের 'মাধেস আন্দোলন': পূর্বাপর

সারসংক্ষেপ

নেপালকে ভৌগোলিকভাবে তিন ভাগে ভাগ করা হয়: পর্বতময় চীন-সন্নিহিত অঞ্চল, স্বল্প উঁচু পাহাড়ি মধ্যাঞ্চল এবং ভারত-সন্নিহিত সমতল অঞ্চল। শেষোক্ত এলাকাটিই তরাই নামে পরিচিত। নেপালি ভাষায় ‘তরাই’ শব্দের অর্থ নিচু সমতলভূমি। সংস্কৃতে এর অর্থ ‘পাহাড়ের পাদদেশ’। পাহাড় আর পুরো সমতলের মাঝামাঝি হিসেবে এই এলাকাটি ‘মধ্যদেশ’ হিসেবে চিহ্নিত হতো অতীত থেকে। সেই ‘মধ্যদেশ’-এর বাসিন্দারাই কালক্রমে ‘মধ্যদেশি’ তথা ‘মাধেসি’। তরাইয়ের অ-পাহাড়িরাই মূলত মাধেসি ‘আইডেনটিটি’ ধারণ করে। এ প্রবন্ধে এই মাধেসিদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত, তরাইয়ের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য, ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, আন্দোলনের মূলধারা, মাওবাদীদের উত্থান-পতন, পাহাড়িদের ভূমিকা, প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে। মাধেসিরা মূলত তিনটি ধারায় আন্দোলন করে। নেপাল রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থাগুলোকে আক্রমণ করা; মাওবাদীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা এবং তরাইয়ের জনসমাজকে এমনভাবে বিভক্ত করে ফেলা, যাতে ‘মাধেসি বনাম অন্যান্য’ সমীকরণের আবহ তৈরি হয়। এ আন্দোলনের প্রধান দাবি এখন তিনটি : সকল মাধেসিকে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট দিতে হবে, পুরো মাধেসকে এক শাসনতান্ত্রিক ‘ইউনিট’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং সেই ইউনিটকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম দাবিটি অনেকাংশে পূরণ হয়েছে। বাকি দুটির ভবিষ্যত্ নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে তরাই এবং পুরো নেপালও।

মূখ্য শব্দগুচ্ছ: মাধেস আন্দোলন, থারু, তরাই, মাওবাদী, নেপাল ফেডারেশন অব নেশনালিটিজ, সিএ-টু।

প্রারম্ভিক কথা

বাংলাদেশের খুব দূরের দেশ নয় নেপাল। বৃহত্তর দিনাজপুর থেকে তো শীতের দিনে হিমালয়ের চূড়াও দেখা যায়। রাস্তার দূরত্ব পঞ্চাশ মাইলেরও কম। বাংলাদেশ-নেপাল সীমান্তের মাঝের ভারতীয় এলাকাটি স্বল্প দূরত্ব ও ভৌগোলিক ধরনের কারণে ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা এবং নেপালের কাকরভিটার মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগের ইতিহাসও বহু পুরোনো। যদিও মধ্যবর্তী অন্যদের অসহযোগিতায় তা স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি কখনোই। ভারত ও চীনের মাঝামাঝি থাকায় নেপাল বর্তমান বিশ্বে অন্যতম কৌশলগত ভূখণ্ড, তবে ‘ল্যান্ডলক কান্ট্রি’। মানচিত্র দেখলে মনে হয় ভারত-চীনের মাঝে চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে আছে ভূখণ্ডটি। ভারত আছে তার তিন দিকে, উত্তরে চীন। সুউচ্চ হিমালয়ের কারণে চীন-নেপাল যোগাযোগ ঐতিহাসিকভাবে কম। ঠিক উল্টোটি ঘটেছে ভারতের সঙ্গে। ভারত-নেপাল সীমান্ত সমতল, সহজ, অনেকখানি উন্মুক্ত। নেপালের ‘মাধেস’ সংকটেরও শুরু অনেকখানি এই যোগাযোগপর্বেরই পার্শ্বফল। ধীরে ধীরে আমরা যে আলোচনার দিকে এগোব।

এই লেখায় আমরা মূলত দেখতে চাইব কীভাবে আঞ্চলিক অশান্তি এবং তাতে প্রতিবেশী ভারতের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সংশ্লিষ্টতা নেপালকে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংকটে ফেলে রেখেছে। নেপালের এই ‘সংকট’-এর সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, শ্রীলঙ্কার জাফনা, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, ভারতের কাশ্মীর ইত্যাদি অঞ্চলের চলমান অস্থিরতার কিছু মিল লক্ষ করবেন। যদিও এসব প্রতিটি সংগ্রামেই ব্যাপক স্বাতন্ত্র্যও রয়েছে। একই সঙ্গে এই লেখার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তসীমান্ত রাজনৈতিক ‘প্রভাব’-এর ধারণা ও ধরনও যাচাই করে দেখা হবে।

নেপাল: পূর্ব ইতিহাস

নেপালের সুপরিচিত একটি এলাকা গোর্খা জেলা। বহু আগে (১৭৬৮ সালে) স্বাধীন গোর্খা রাজ্যের রাজা পৃথ্বি নারায়ণ শাহ আশপাশের ছোট-বড় বিভিন্ন রাজ্য জয় করে নেপাল নামের দেশটির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে দেশটি ‘শাহ’ বংশ দ্বারা শাসিত। এই শাহ রাজারা আবার একপর্যায়ে (১৮৮৬ থেকে) ‘রানা’ বংশজাত প্রধানমন্ত্রীদের কাছে পুতুল হয়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। এভাবে দেশটি দুই শক্তিশালী বংশের রাজত্বে কাটিয়েছে ইতিহাসের দীর্ঘ সময়। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি দেশটিতে গণতন্ত্রের সংগ্রাম শুরু হয় নেপালি কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। যার ফলে ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন হয় এবং বি পি কৈরালার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে কংগ্রেস। ১৯৬০-এ ডিসেম্বরে রাজা মহেন্দ্র আবারও সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে দেন। তারপর আবারও সংগ্রাম শুরু হয় এবং যার চূড়ান্ত অধ্যায়ে নির্বাহী রাজতন্ত্র উত্খাত হয় দেশটি থেকে।

মাধেসের ভৌগোলিক ও জনতাত্ত্বিক ধরন

নেপালের জনসংখ্যা প্রায় ২.৭ কোটি। জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দুধর্মাবলম্বী, ১০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ৪.৫ শতাংশ মুসলমান। প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নেপালি ভাষায় কথা বলে। রাজতন্ত্র উত্খাত হওয়ার পর দেশটিকে ফেডারেল রিপাবলিক বলা যায়। রাজতন্ত্রের মধ্যেই ১৯৩৫-এ ‘প্রজা পরিষদ’ এবং ১৯৪৭-এ নেপালি কংগ্রেস নামে দুটি রাজনৈতিক পার্টি-সত্তা গড়ে উঠেছিল দেশটিতে। তবে আজও, আট দশক পরও, রাজনৈতিকভাবে ক্রান্তিকাল চলছে দেশটিতে। রাজনৈতিক প্রশাসনের চূড়ান্ত চেহারা এখনো সেখানে বাস্তব রূপ পায়নি। পাশাপাশি আছে সাংস্কৃতিক টানাপোড়েনও। একসময়কার ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ নেপালে রাজাকে বিষ্ণুর প্রতিনিধি মনে করা হতো। রাজতন্ত্রবিরোধী সংগ্রাম তাই দেশটির সংস্কৃতিতে সর্বগ্রাসী হিন্দুকরণের বিরুদ্ধে নৃগোষ্ঠীগুলোর সাংস্কৃতিক সংগ্রামও ছিল বটে। একশর অধিক নৃগোষ্ঠী রয়েছে নেপালে। তবে ‘মাধেসি’রা প্রচলিত অর্থে কোনো নৃগোষ্ঠী নয়। তাদের অবস্থান নেপালের তরাই অঞ্চলে।

পুরো নেপালকে সাধারণত ভৌগোলিকভাবে তিন ভাগে ভাগ করা হয়: পর্বতময় চীন-সন্নিহিত অঞ্চল, স্বল্প উঁচু পাহাড়ি মধ্যাঞ্চল এবং ভারত-সন্নিহিত সমতল অঞ্চল। শেষোক্ত এলাকাটিই তরাই নামে পরিচিত। নেপালি ভাষায় ‘তরাই’ শব্দের অর্থ নিচু সমতলভূমি। সংস্কৃতে এর অর্থ ‘পাহাড়ের পাদদেশ’। পাহাড় আর পুরো সমতলের মাঝামাঝি হিসেবে এই এলাকাটি ‘মধ্যদেশ’ হিসেবে চিহ্নিত হতো অতীত থেকে। সেই ‘মধ্যদেশ’-এর বাসিন্দারাই কালক্রমে ‘মধ্যদেশি’ তথা ‘মাধেসি’।

মাধেস বলতে কার্যত কোনো গ্রাম বা শহরের অস্তিত্ব নেই বা ছিল না। তরাইয়ের অ-পাহাড়িরাই মূলত মাধেসি ‘আইডেনটিটি’ ধারণ করে। অর্থাত্ যাঁরাই তরাইয়ের অপাহাড়ি এবং ভারত থেকে ১-২-৩ প্রজন্ম আগে তরাইয়ে এসেছেন তাঁরাই মাধেসি, পরিচয়টি এভাবেই গড়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু। গত শতাব্দীতে তরাইয়ে মূলত থারু জনগোষ্ঠীর বাস থাকলেও ধীরে ধীরে এখানে জমির সন্ধানে আসে পাহাড়িরাও। থারুরা তরাইয়ের সবচেয়ে পুরোনো জনগোষ্ঠী। দেশের জনসংখ্যার প্রায় সাত ভাগ তারা। সংখ্যার হিসাবে ১৭-১৮ লাখ হবে। ভারতের বিহারেও আছে থারুরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৮৭ ভাগ) থারু হিন্দুধর্মাবলম্বী। তা সত্ত্বেও স্বার্থের প্রশ্নে তরাইয়ের মাধেসিদের সঙ্গে প্রবল ভিন্নমত রয়েছে তাদের। পাহাড়ি হিন্দু ও মাধেসি হিন্দুদের সাংস্কৃতিক পার্থক্য অনেক। ১৮৫৪ সালে নেপালের তত্কালীন হিন্দু রাজা থারুদের প্রথাগত ভূমি অধিকার থেকে উচ্ছেদ করে। তাদের তখন অন্যত্র পুনর্বাসিত হতে হয়। সেই থেকে থারুরা দাসোচিত জীবন যাপন করছিল।

থারু ছাড়াও তরাইয়ে আছে দলিত মুসহর ও চামার জনগোষ্ঠী এবং মাছ ধরা যাদের পেশা সেই মাল্লাহ সমাজ। মুসলমানও আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। নেপালের মুসলমান জনগোষ্ঠীর (প্রায় ১০ লাখ) প্রায় ৮০ ভাগ তরাইবাসী। কপিলাবস্তু, বাংকে ইত্যাদি জেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছেন এই কৃষিজীবী ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।

তরাইয়ের উপরিউক্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ নৃ ও ধর্ম পরিচয়ের মধ্যে প্রধানত যারা পাহাড়ি উত্সজাত নন, সেসব হিন্দুর মাঝেই মাধেসি চেতনা অধিক তীব্রতায় লক্ষ করা যায়। যারা বিশেষভাবে মৈথালি, ভোজপুরি, বাজিকা ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে। তরাইয়ের রাজনীতিবিদদের অধিকাংশ মৈথালিভাষী। নেপালের ভাষাগত পরিসংখ্যানে মৈথালিদের হিস্যা প্রায় ১২ ভাগ। তরাইয়ের এই মৈথালিভাষীরা শিক্ষা-সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকার কারণে নিজেদের নেপালের সাধারণ পাহাড়ি সমাজের চেয়ে ‘উন্নত’ ভাবে। এটাও মাধেসি চেতনায় সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের একটা আবহ তৈরি করেছে। তবে মাধেসি সমাজে বর্ণপ্রথা ও অচ্ছুত সমস্যাও প্রবল। এটা মাধেসি জাতীয়তাবাদকে জটিল করে তোলে অনেক সময়। মুসলমানদের একাংশও তরাইয়ের মাধেসি আন্দোলনের সমর্থক।

নেপালের অর্থনীতিতে তরাইয়ের বৈশিষ্ট্যস্থল

চতুর্দিকে ভূমিবেষ্টিত বলে নেপাল অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর নয়। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশটি অনেকাংশে ভারতনির্ভর। আমদানি-রপ্তানির আকারও ছোট। দুই বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি করে নেপাল আর আমদানি করে সাত বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।

অর্থনীতির অন্যতম শক্তিকেন্দ্র তরাই। তরাইয়ের ভূমি খুব উর্বর। উদ্বৃত্ত খাদ্য উত্পাদিত হয় এ অঞ্চলে, যা দেশটির অন্য অংশের জন্যও অন্যতম ভরসা। পুরো নেপালের কর্মসংস্থানের ৭০ ভাগ জোগান দেয় কৃষি। জিডিপিতে কৃষির অবদান ৩৭ শতাংশ। তরাই কৃষি ছাড়া বৌদ্ধতীর্থ লুম্বিনী, চিতওয়ান পার্ক ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক পর্যটকও আকর্ষণ করে। নেপালের আয়-রোজগারে টুরিজমের রয়েছে মুখ্য ভূমিকা। বিশ্বের ১০টা উঁচু পর্বতশৃঙ্গের আটটিই নেপালে। কৃষির মতো নেপালের শিল্প স্থাপনার প্রধান অংশও তরাই অঞ্চলেই বিকশিত।

নেপালের প্রায় সাত বিলিয়ন ডলারের আমদানির ৮০ ভাগ ভারত থেকে হয়। বাকিটা চীন থেকে। চীনের প্রভাব এ ক্ষেত্রে বাড়ছে। অন্যদিকে রপ্তানির ৫০ ভাগও ভারতনির্ভর। যুক্তরাষ্ট্রের হিস্যা এ ক্ষেত্রে ২৫ ভাগ। দেশটিতে প্রায় ৮৩ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের সুযোগ থাকলেও এক হাজার মেগাওয়াটও উত্পাদন করার অবকাঠামো তৈরি হয়নি। বাজেটের অর্ধেক এখনো বিদেশি সহায়তানির্ভর। সরকারি হিসাবে জনসংখ্যার ২৫ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেসরকারি হিসাবে দারিদ্র্য আরও বেশি ব্যাপক। ইদানীং নেপালের প্রচুর কর্মজীবী বিদেশে যাচ্ছেন কর্মসূত্রে। এ ছাড়া বহু আগে থেকে নেপালের গোর্খারা ব্রিটেন ও ভারতে সৈনিকের পেশায় কাজ করছে। এসব সত্ত্বেও অর্থনীতিতে গতিশীলতা ক্ষীণ।

রাজতন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ পরিসরে এলেও দেশটির রাজনীতিবিদেরা প্রশাসনিক সংস্কার সাধনে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে না পারায় সমাজের নিচুতলার অর্থনৈতিক জীবনে ‘গণতন্ত্র’ কোনো নতুন উদ্দীপনা নিয়ে হাজির হতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় রাজতান্ত্রিক আমলের মতো প্রশাসনে এখনো জবাবদিহির সংস্কৃতি অনুপস্থিত।

আউটার ও ইনার তরাইয়ের সমীকরণ

যমুনা, কর্নালি নারায়ণী ইত্যাদি নদীবিধৌত ভূভাগ তরাই। এটা নেপালের অপেক্ষাকৃত সমতল অঞ্চল। ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহারসংলগ্ন। তরাইয়ের আবার দুটো দিক আছে: আউটার তরাই এবং ইনার তরাই। আউটার তরাইকে স্থানীয়ভাবে ‘নয়া মুলুক’ বলা হতো একসময়। নেপালের জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ থাকে আউটার তরাইয়ে। সংখ্যায় যা প্রায় এক কোটি হবে।

পুরো নেপালের ৭৫টি জেলার মধ্যে ২০-২৫টি জেলায় মাধেসিদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আউটার তরাইয়ের প্রধান প্রধান জেলা হলো মোরং, শুকসারি, কাঞ্চনপুর, কপিলাবস্তু, রুপান্দি, বাংকে, সাপতারি ইত্যাদি। আউটার তরাইয়ের এসব জেলায় ‘পাহাড়ি’দেরও উপস্থিতি রয়েছে, তবে তারা সংখ্যালঘু। মাধেসি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতিপক্ষ এই পাহাড়িরা। আউটার তরাইয়ের সব কটি জেলা ভারত সীমান্তসংলগ্ন।

অন্যদিকে, ইনার তরাই অপেক্ষাকৃত ভেতরে অবস্থিত। নেপালি ভাষায় একে বলা হয় ‘ভিতরি মধেস।’ পাঁচটি ভ্যালি আছে এই ‘ভিতরি মধেস’-এ। চিতওয়ান, দাঙ, উদয়পুর, সিন্দুলি, মাকওয়ান, সুরেট ইত্যাদি সাতটি জেলা এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বিরাটনগর, বীরগঞ্জ, ভরতপুর ইত্যাদি তরাইয়ের প্রধান প্রধান নগর হিসেবে পরিচিত।

তরাইয়ের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র

ভারত-নেপালের সীমান্ত অনেকখানিই উন্মুক্ত। ফলে মাধেসি জাতীয়তাবাদের ভারত-সংশ্লিষ্টতা শুরু থেকে। মাধেসি বলে দাবিদারদের খাবার, পোশাকসহ অন্যান্য সব সংস্কৃতিতে উত্তর প্রদেশ ও বিহারের প্রবল ছাপ। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এখানকার মানুষ ভারতমুখী। ভারত থেকেই এসেছে তারা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা। কেউ কাজের সন্ধানে, কেউ ঘোড়ার গাড়ি চালাতে, কেউ জিনিসপত্র বিক্রি করতে, কেউ চোরাচালানে যুক্ত হয়ে—কেউবা মূল ভারতে কোনো ফৌজদারি অপরাধ করে লুকাতে। উন্মুক্ত সীমান্ত কেবল যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগকে উন্মুক্ত রেখেছে, তা-ই নয়, প্রচুর অস্ত্রও আসে এই পথে, যা ২০০৭ পরবর্তীকালের জনবিস্ফোরণে সহিংসতার রসদ হয়েছিল।

ঐতিহাসিক এই উন্মুক্ত সীমান্ত মাধেসি সহিংসদের নিয়ন্ত্রণে নেপালের প্রশাসনকে অকার্যকর করে রেখেছে। কাঠমান্ডুর কর্তৃত্ব এখানে কম। ১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই নেপাল-ইন্ডিয়া ‘শান্তি চুক্তি’র অনুচ্ছেদ ৬ ও ৭ এই উন্মুক্ততাকে বৈধতা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নেপালে, বিশেষত তরাইয়ে ভারতীয়দের মাধেসি রূপে অবস্থান, অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা অবাধ রূপ নেয় এবং কালক্রমে তরাই রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নেপাল-ইন্ডিয়া ওই ‘চুক্তি’র পর ১৯৫৩ সালে কাঠমান্ডু থেকে বিহারসংলগ্ন বীরগঞ্জ পর্যন্ত হাইওয়ে নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির সরাসরি প্রভাব চলে আসে নেপালের রাজধানী পর্যন্ত।

বর্তমানে এখানে সীমান্তজুড়ে মানুষের নিয়মিত আসা-যাওয়া। ঘোড়ায় টানা ‘টঙ্গা’ গাড়ি হলো এ সীমান্তের পরিচিত বাহন। অনেকে এখানে আত্মীয়তা, বাজার, অর্থনীতি ইত্যাদি প্রয়োজনে নিয়মিত দুদেশজুড়ে চলাচল করেন। চোরাচালানও অবাধ। লিকার থেকে শুরু করে বন্দুক, আফিম পর্যন্ত প্রায় সব পণ্য গতিশীল অবাধে। দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্যের ৪০ ভাগ তরাই সীমান্ত দিয়েই হচ্ছে বলে দাবি নেপাল চেম্বারের। এতে রাজস্ব ক্ষতি প্রায় তিন বিলিয়ন রুপি বলে অনুমান করা হয়। অপহরণ-বাণিজ্যও নিয়মিত এক অভিজ্ঞতা এই সীমান্তে। চোরাচালান ও অপহরণ-বাণিজ্য সবই মূলত দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় তরাইয়ের রাজনীতিবিদদের দ্বারাই। যেহেতু সীমান্ত উন্মুক্ত এবং ‘শান্তি চুক্তি’র রাজনৈতিক আবরণ রয়েছে সে কারণে সীমান্তের দুই পাড়ে সহায়-সম্পদ নিয়ে সাবলীলভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছে ভারতীয় আগ্রহীরা। মাধেসে ভারতীয় কর্মজীবীদের সংখ্যাবৃদ্ধি বোঝা যায় বিশেষ করে শুমারির তথ্য থেকে। ১৯৫৪ সালে তরাইয়ের জনসংখ্যা ছিল নেপালের লোকসংখ্যার ৩৫ শতাংশ। এখন তা প্রায় ৫৮ শতাংশ।

তরাইয়ের রাজনৈতিক হতাশার ঐতিহাসিক উত্স

তরাই যদিও অতীতে পার্লামেন্টে প্রায় ৪৩ ভাগ প্রতিনিধিত্ব করেছে, কিন্তু মাধেসিদের প্রতিনিধিত্ব সেখানে এক-পঞ্চমাংশের বেশি নয়। সামরিক বাহিনী, সিভিল প্রশাসন, বিদেশ মন্ত্রণালয়, পুলিশ বাহিনী ইত্যাদিতেও মাধেসিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অতিনগণ্য। পাহাড়ি এলিটদের আধিপত্য ছিল সর্বত্র। পাহাড় এখানে চিহ্নিত ‘খাস এরিয়া’ নামে। মাধেসিদের বঞ্চনাবোধের এটাই হলো প্রধান পটভূমি। ঐতিহাসিকভাবে কাঠমান্ডুর শাসকেরা মাধেসিদের বিশেষভাবে ঘৃণা করতেন এ কারণে যে তারা ১৮১৬-এর যুদ্ধে ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিল। ফল হিসেবে পরবর্তীকালে দীর্ঘ সময় মাধেসিদের কাঠমান্ডু প্রবেশে একধরনের পাস প্রথাও চালু ছিল। মাধেসে হিন্দির আধিপত্যেও নেপালি শাসক এলিটরা বিরক্ত। ১৯৫৯-এ প্রথম হিন্দি এখানে কারিকুলামে ঠাঁই পায়। সরকারি পোশাকের নেপালীকরণও মাধেসিদের মাঝে বঞ্চনাবোধ উসকে দেয়। ১৯৯০ পর্যন্ত রাজতান্ত্রিক শাসনে এসব হতাশা চাপা পড়ে ছিল। ‘গণতান্ত্রিক আবহ’ আসার সঙ্গে সঙ্গে হতাশা ক্ষোভে রূপ নিতে শুরু করে।

তরাইয়ের আন্দোলনের মূল ইস্যু

২০০৬-এর এপ্রিলে এবং ২০০৭-এর জানুয়ারিতে এখানে প্রায় দুই মাসব্যাপী এক জন-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। শেষোক্ত আন্দোলন স্থায়ী হয় প্রায় ২১ দিন। মাধেসি জন-অধিকার ফোরাম এর নেতৃত্ব দেয়। এতে প্রথমবারের মতো মাধেসি পরিচয়ের বিশেষ স্ফুরণ ঘটে। বিক্ষোভ একপর্যায়ে সশস্ত্র রূপ নেয়। এ সময় অন্তত ২৪ জন পাহাড়ি খুন হয়। মাধেসিরা মনে করে তাদের সব সমস্যার জন্য পাহাড়িরা দায়ী। মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএন-এম) ২৭ জন কর্মীকেও মাধেসিরা হত্যা করে ২০০৭-এর ২১ মার্চ। এই মাওবাদীরা সবাই ছিল পাহাড়ি।

পাহাড়িদের মাধেস ছাড়তে হবে এটাও মাধেসি জাতীয়তাবাদের অন্যতম এক দাবি। অন্য আরেকটি প্রবল দাবি ‘স্বশাসন’ এবং সেনাবাহিনীতে আরও বেশি প্রতিনিধিত্বের সুযোগ, যা আবার প্রতিরক্ষা কাঠামোর রাজনীতিকীকরণের অনিবার্য এক আশঙ্কা তৈরি করেছে। ২০০৬ ও ২০০৭-এর আন্দোলনকালে তরাইয়ের অনেক পাহাড়িকে স্বল্প মূল্যে তাদের বাড়িঘর বিক্রি করে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তৃণমূল থেকে পাহাড়িদের এভাবে উচ্ছেদ তরাইয়ের অনেকের জন্য আর্থিক ও সম্পদগত পরিসর বাড়াতে সহায়ক হয়। ফলে এই আন্দোলনকে তারা উত্সাহ জোগায়। অর্থাত্ পাহাড়িবিরোধিতা মাধেস আন্দোলনের অন্যতম সমাবেশীকরণ কৌশল ছিল এবং আছে। কাঠমান্ডুর রাজনীতিবিদেরা মাধেস ধারণার প্রতি যত কঠোর হবেন, ততই তরাইয়ের পাহাড়িদের জন্য পরিস্থিতি কঠোরতর হবে।

মাধেসিরা মূলত তিনটি ধারায় আন্দোলন করে:

ক.        নেপাল রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থাগুলোকে আক্রমণ করা;

খ.        মাওবাদীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা এবং

গ.         তরাইয়ের জনসমাজকে এমনভাবে বিভক্ত করে ফেলা যাতে ‘মাধেসি বনাম অন্যান্য’ সমীকরণের আবহ তৈরি হয়। প্রথম থেকে এই আন্দোলনের প্রধান স্লোগান ছিল: ‘এক মাধেস—এক প্রদেশ।’

মাওবাদী উত্থান-পতন ও মাধেস আন্দোলন

নেপালজুড়ে মাওবাদী রাজনীতির উত্থান চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার মুখেই ২০০৬ থেকে তরাইয়ে মাধেসিবাদের উত্থান। এই দুটোর তাই আন্তসম্পর্ক রয়েছে। ২০১৫ সালে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ‘জনযুদ্ধ’-এর ২০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। তবে নয় বছর আগে ১২ দফা চুক্তির মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করে মাওবাদীরা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় শামিল হয়।

২০০৮-এর প্রথম সংবিধানসভার নির্বাচনে তারা প্রধান দলে পরিণত হলেও যখন তারা ভূমি সংস্কারে হাত দিতে যাচ্ছিল তখনই তরাইয়ে বিশেষভাবে ‘মাধেসি জাতীয়তাবাদ’দের প্রচার শুরু হয়। মাওবাদীরা প্রথম দিকে ‘একক নেপাল’ ধারণার সমর্থক হওয়ায় মাধেসি জাতীয়তাবাদীরা রাজনৈতিকভাবে তাদের একঘরে করে ফেলতে সমর্থ হয়। সিপিএন (এম) ভূমিহীনদের জন্য জমি সংগ্রহে মাধেসের এমন অনেক ভূস্বামীর জমি কেড়ে নিতে উদ্যত হয়, যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। শেষোক্তরা তখন কৌশলে মাধেসি জাতীয়তাবাদের চেতনা ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হন। এভাবেই সেখানে ভূমি সংস্কারকে মোকাবিলা করা হয়। আবার মাওবাদীরা ভূমি সংস্কারের প্রতিজ্ঞায় হেরে যাওয়ায় তাদের প্রতি সমাজের নিচুতলার আকাঙ্ক্ষাও ঘা খায় তাতে।

সিপিএন(এম) তাদের সংগ্রামী সময়ে অনেক শক্তিশালী মাধেসি গ্যাংয়ের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল। সেটাও মাওবাদীদের প্রতি ওই সব শক্তির আক্রোশের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে এবং একপর্যায়ে প্রকাশ্যে তারা মাওবাদীদের কাছ থেকে সেসব অস্ত্র ফেরত চেয়েছে। ইতিমধ্যে ‘চুক্তি’র মাধ্যমে মাওবাদীরা তাদের ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ও পরিত্যাগ করে এবং জাতিসংঘের তদারকিতে তাদের ১৯ হাজার ৬১ ‘গেরিলা’ নিরস্ত্র হয়ে ১ হাজার ৪০০ জন সেনাবাহিনীতে এবং বাকিরা জনসমাজে ফিরে যায়। এভাবে কার্যত মাধেসি সশস্ত্রতার মুখে মাওবাদীরা একপর্যায়ে হতবিহ্বল এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে।

তরাইয়ে এভাবে মাধেসি আন্দোলনকারীদের কাছে রাজনৈতিক ও সামরিক কোণঠাসা হওয়াকে মাওবাদীরা ভারতীয় ষড়যন্ত্র এবং স্থানীয়দের চেতনার নিচু মানজনিত সমস্যা হিসেবেই সাধারণভাবে চিহ্নিত করে থাকে। যদিও সিপিএন (এম) যখন সরকার গঠন করেছিল তখন মাধেসি আন্দোলনের মুখ্য নেতা উপেন্দ্র যাদবকে এক দফা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয় জোটগত বাধ্যবাধকতার কারণে। অথচ এই উপেন্দ্র যাদবের বিরুদ্ধে ২৭ জন মাওবাদীকে হত্যা ও অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পোড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। মাধেসি আন্দোলন নিয়ে মাওবাদীদের এরূপ নীতিগত বিচ্যুতি অমাধেসিদের মধ্যেও তাদের নিয়ে হতাশা তৈরি করেছে। অন্যদিকে সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করে সাংবিধানিক রাজনীতিতে আসার পর মাওবাদীদের আদর্শিক ও শক্তি-সামর্থ্যের অবক্ষয়ও লক্ষণীয়। বর্তমানে তারা অন্তত তিনটি প্রধান উপদলে বিভক্ত। যদিও প্রধান ধারাটির নেতৃত্বে রয়েছেন আগের মতো পুষ্পকুমার দাহাল এবং বাবুরাম ভট্টরাই।

মাধেস আন্দোলনের প্রধান প্রধান নেতা

১৯৯০ পর্যন্ত মাধেস আইডেনটিটি ভোটের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব না ফেললেও এখন চিত্র অনেকখানি পাল্টে গেছে। ১৯৯৭ সালে উপেন্দ্র যাদব মাধেসি জন-অধিকার ফোরাম (এমজেএফ) গড়ে তুলেছিলেন। সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য প্রথমে মাওবাদীদের সঙ্গেই ছিলেন তিনি। আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা রাজেন্দ্র মাহাতোও মাওবাদীদের সঙ্গে ছিলেন আগে। প্রথম দিকে একাডেমিক একটা মঞ্চ হিসেবে যাত্রা হলেও বিভিন্ন সূত্রে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেয়ে এমজেএফ দ্রুত ব্যাপক সংখ্যক কর্মীকে তার এজেন্ডায় সমবেত করতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে চরমপন্থী-নরমপন্থী এরূপ নানান বিবেচনাও বিদ্যমান। উপেন্দ্র যাদবের ব্যাপারে ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) বিশেষ সহানুভূতি রয়েছে। ভারতের গণমাধ্যমে অনেক সময় এমন সংবাদচিত্র দেখা গেছে যাদব আরএসএস নেতাদের সঙ্গে দেখা করছেন। এই আন্দোলনের আরেকজন কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়প্রকাশ গুপ্ত। নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে একসময় এমজেএফের কো-চেয়ারম্যান হন। পরে উপেন্দ্র যাদবের সঙ্গে ভিন্নমত হলে গড়ে তোলেন মাধেসি জন-অধিকার ফোরাম-রিপাবলিক। বর্তমানে তরাই মাধেস ন্যাশনাল ক্যাম্পেনের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। অন্যদিকে রাজেন্দ্র মাহাতো বর্তমানে নেপাল সদভাবনা পার্টির একটি অংশের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

তরাইয়ের মাধেস আন্দোলনে স্থানীয় পাহাড়িদের ভূমিকা

মাধেসিদের আক্রমণাত্মক রূপ সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি পাহাড়িদের অনুরূপ কোনো আক্রোশ নেই বা দাবি নেই। অন্যদিকে থারু জনগোষ্ঠী, যারা তরাইয়ের পশ্চিমাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য একটি নৃগোষ্ঠী, তারাও চাইছে না এখানে নেপাল সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে মাধেসিদের ‘স্বায়ত্তশাসিত’ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। পাহাড়িদের তরফ থেকে এমনও অভিমত রয়েছে, আজকের মাধেসিরা মূলত নেপালে এসেছে ১৯৫৫-এর পর। আগে পাহাড়িরাই তরাইকে আবাদযোগ্য করেছে।

তবে ১৯৯০-এর আগে-পরে কিছুদিন দেশটি বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গ্রুপে সংগঠিত হয়ে তরাইয়ের মাধেসিদের বিরুদ্ধে এই বলে একটি অবস্থান নিয়েছিল যে এরা (মাধেসিরা) ‘অদেশীয়’। এই নৃগোষ্ঠীগুলো তখন নেপাল ফেডারেশন অব নেশনালিটিজ (এনএফএন) গড়ে তোলে।

উল্লেখ্য, তরাইয়ে অনেক ছোট ছোট নৃগোষ্ঠী রয়েছে, মাধেসি আন্দোলনকারীরা তাদের সংগ্রামে এদের ভয়কে দূর করতে পারেনি। এভাবে এটা এক বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে যে তরাই স্বায়ত্তশাসন পেলে স্থানীয় অন্য নৃগোষ্ঠীগুলোর কী হবে। এর মধ্যে থারুদের সঙ্গে ইতিমধ্যে মাধেসপন্থীদের খুবই তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

মাধেস আন্দোলনকেন্দ্রিক দুদফা চুক্তি

২০০৬ ও ২০০৭-এর ‘মাধেস আন্দোলন’ নেপালের ফেডারেলধর্মী এক নতুন ধারার শাসনকাঠামোর পক্ষে শাসক এলিটদের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল। অন্তত কাঠমান্ডুভিত্তিক জাতীয় দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পাদিত দুটি চুক্তিতে ‘স্বশাসিত মাধেস’ ধারণাকে পরোক্ষে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তবে এসব অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া বেশ জটিল হবে বলেই মনে হয়। কারণ মাধেস বলতে কতটুকু ভূখণ্ডকে বোঝানো হবে সেটা এখনো চরম বিতর্কিত এক বিষয় হয়ে আছে। পাশাপাশি ‘স্বশাসন’ বলতে ঠিক কী বোঝানো হবে, সেটাও ফয়সালা হয়নি এখনো। এরূপ প্রথম ‘অ্যাগ্রিমেন্ট’ হয় ২০০৭-এর ৩১ আগস্ট। যেখানে সরকার ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে মাধেসিদের আনুপাতিক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি এবং প্রদেশভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন দিয়ে নেপালকে পুনর্গঠনের বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল। তবে প্রদেশ ও কেন্দ্রের অধিকার ও দায়িত্বের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি সাংবিধানিক সভার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই অ্যাগ্রিমেন্টের পর দীর্ঘ সাত বছর পরও সাংবিধানিক সভা ওই বিতর্ক নিয়ে ২০১৫-এর শুরুতেও মতৈক্যে আসতে পারছে না।

২০০৭-এর চুক্তির মতো ২০০৮-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক মাধেসি ফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে নেপালের কেন্দ্রীয় সরকারের আরেকটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তিটি ছিল আট দফা। এতে মাধেসিদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন রাজেন্দ্র মাহাতো এবং উপেন্দ্র যাদব। এই চুক্তিতেও নেপালে একটি ফেডারেল ব্যবস্থার অঙ্গীকার করা হয় এবং সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থায় নিয়োগে মাধেসিদের প্রতি আনুপাতিক ন্যায্যতা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

তবে সামগ্রিকভাবে এখন প্রতীয়মান হচ্ছে, নেপালের রাজনীতির কেন্দ্রীয় দলগুলো মাধেস অঞ্চলটি নিয়ে একক কোনো প্রদেশ গঠন এবং তাকে স্বশাসন দেওয়ার বিরোধী। কেন্দ্রীয় এসব দল অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এরূপ অভিমত ব্যক্ত করে থাকে যে মাধেস আন্দোলন অন্য দেশের রাজনীতিবিদ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর অঙ্গুলি হেলনে সৃষ্ট মাত্র। তারপরও তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ২০০৭-এর আগস্টে এবং ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারিতে দুদফা চুক্তি করেছে মূলত নেপালের অর্থনীতির অতিরিক্ত মাধেস-নির্ভরতার কারণে এবং জাতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে ভারত প্রশ্নে কৌশলগত অনৈক্যের কারণে।

মাধেস আন্দোলনের কৌশল ও তার জাতীয় ফলাফল

এই আন্দোলনের শক্তিগুলো সব সময়ই ‘মাধেসি বনাম পাহাড়ি’ সমীকরণে স্থানীয় আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে মেরুকরণ করতে চেয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকখানি সফলও। ফলে মাওবাদীদের রাজনীতি এ অঞ্চলে দুর্বল হয়ে গেছে। এমনকি মাধেসিদের এই আন্দোলন পুরো নেপালের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দুর্বল করে দিয়েছে। মাধেসি নেতাদের চূড়ান্ত দাবি মাধেস অঞ্চলে একক স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গড়ে তুলতে হবে। কাঠমান্ডুর জন্য এটা মেনে নেওয়া স্পর্শকাতর। এর ফলে দেশটির অন্যত্রও আঞ্চলিকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিদ্যমান বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা ও অবিশ্বাসের পরিবেশও বৃদ্ধি পাবে তাতে। ইতিমধ্যে মাধেসিদের আন্দোলনে ‘প্যান-নেপাল’ আইডেনটিটি অনেকখানি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে কেবল মাওবাদীদেরই নয়, তরাই অঞ্চলে মাধেসি আন্দোলন নেপালি কংগ্রেসের মতো পুরোনো দলগুলোকেও সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই আন্দোলনের আরও একটি এবং বস্তুতপক্ষে সবচেয়ে বিধ্বংসী ফল হলো মাধেসি জাতীয়তাবাদের নামে তরাইয়ে সন্ত্রাসের বিস্তার। তরাই আর্মি, জনগণতান্ত্রিক তরাই মুক্তিমঞ্চের (জেটিএমএম) জাওয়ালা সিংহ গ্রুপ ইত্যাদি সংগঠন এই আন্দোলনের আড়ালে শিল্পাঞ্চলগুলোতে ব্যাপক চাঁদাবাজি, অপহরণ করত।

অন্যদিকে মাধেসি থিংক-ট্যাংক সব সময় রাষ্ট্র ও সরকারে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটি উত্থাপন করে থাকে। এরূপ দাবি মূলত নেপালের নীতিনির্ধারণী পরিসরে পাহাড়িদের কোণঠাসা করার একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে, যা কার্যত সুদূরপ্রসারী বিবেচনায় দেশটিতে একটি জাতীয় বিভেদরেখার বীজ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

মাধেস আন্দোলন ও ভারতের ভূমিকা

নেপালের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে দুই বৃহত্ দেশ—চীন ও ভারতের। এর মধ্যে হিমালয়ের দেয়ালতুল্য ভূমিকার কারণে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত নয়। সেই তুলনায় ভারত নেপালে রয়েছে সর্বগ্রাসী রূপে। তবে দুটি দেশের সম্পর্ক বেশ জটিল। ১৯৫০-এ ‘পিস ও ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি’ হলেও অনেক নেপালি মনে করে ওই চুক্তি কার্যত দেশটির স্বাধীনতা হরণ করেছে। চুক্তির অনেকগুলো ধারা নেপালের সার্বভৌমত্ব স্পষ্টত প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে কখনো সাধারণ নাগরিকদের মতামত নেওয়া হয়নি।

চুক্তি অনুযায়ী (অনুচ্ছেদ ৫) নেপালকে নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, হয় ভারত থেকে অথবা ভারতের মাধ্যমেই আসতে হবে সেটা! অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী নেপালে ভারতীয়রা পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, সম্পত্তির মালিক হতে পারবে, যেকোনো চুক্তিনামায় যুক্ত হতে পারবে এবং বসবাস করতে পারবে। এই সুযোগ নেপালের নাগরিকদের জন্যও প্রযোজ্য বলা হলেও বাস্তবতা হলো এর পূর্ণ প্রয়োগ করেছে নেপালে ভারতীয়রাই। স্বাক্ষরের পর থেকে নেপালের ‘পাহাড়ি’ সমাজে এই চুক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও তরাইয়ে বসবাসকারীরা তাতে উল্লসিত ছিল।

মাওবাদীরাও এই চুক্তির ঘোর বিরোধী ছিল। ২০০৮-এর ২৪ এপ্রিল মাওবাদী নেতা পুষ্পকুমার দহল চুক্তিটি বাতিলের অঙ্গীকার করেছিলেন। ফলে তাদের উত্থান পরবর্তীকালে মাধেসি আন্দোলন সৃষ্টির গভীর যোগসূত্র দেখেন অনেক স্থানীয় পর্যবেক্ষক। তবে ক্ষমতায় আসার পর চুক্তি বাতিল বা সংশোধনের সপক্ষে মাওবাদীরা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

এ ছাড়া মাধেসি আন্দোলনকালে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো যেভাবে উত্তর প্রদেশ ও বিহারে আশ্রয় পেয়েছে সেটাও এই আন্দোলনের প্রতি ভারতের সহানুভূতিকে স্পষ্ট করেছে। এই প্রেক্ষাপটে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী পি এম কৈরালার মন্তব্যটি বিশেষ অর্থবহ: ‘ভারত-নেপাল যৌথ উদ্যোগ ছাড়া মাধেস আন্দোলন নিয়ে মীমাংসায় আসা যাবে না।’ স্পষ্টত এই মন্তব্যে ছিল একধরনের আত্মসমর্পণের সুর। মাধেস আন্দোলনের প্রধান নেতা উপেন্দ্র যাদব কর্তৃক কয়েকবার ভারতের দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকও মাধেস আন্দোলনের প্রতি ভারতীয় বিশেষ মহলের সহানুভূতির স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এরূপ এক বৈঠক শেষেই তিনি বলেছিলেন, ‘নেপালকে আবার হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ফিরে পেতে কাজ করতে চান তিনি।’

নেপালকে ঘিরে প্রতিবেশীদের টানাপোড়েন

এই লেখা যখন তৈরি হচ্ছে ২০১৫ সালের শুরুতে, তখন নেপালজুড়ে তীব্র রাজনৈতিক-সাংবিধানিক ক্রান্তিকাল চলছিল। দীর্ঘ চেষ্টার পরও নেপালের অন্তর্বর্তীকালীন দ্বিতীয় সংবিধান সভা সর্বসম্মত কোনো সংবিধান তৈরি করতে পারেনি। যদিও এর জন্য সর্বশেষ নির্ধারিত তারিখ ছিল ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি। নতুনভাবে গত মে মাসের (২০১৫) মধ্যে সংবিধান তৈরির তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালে রাজতন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অভূতপূর্ব ঐক্য ছিল এবং ২০০৬ সালে মাওবাদীদের অস্ত্র সমর্পণের পর দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠার পক্ষে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এসে সেই আশাবাদী ঐক্যবদ্ধ অবস্থা আর কার্যকর দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র পুরোপুরি উত্খাতের পরও দেশটি কার্যত কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। ২০১২ সালের মধ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ বহু আগেই তামাদি হয়ে গেছে। প্রথম সংবিধান সভার ব্যর্থতার পর ২০১৩-এর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দ্বিতীয় সংবিধান সভাও এ ক্ষেত্রে এখনো কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি।

সংবিধান সভায় বর্তমানে বিবাদের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে তরাইয়ের প্রশাসনিক মর্যাদা তথা দেশটিতে কীরূপ ফেডারেল ব্যবস্থা থাকবে তা নিয়ে রাজনৈতিক ভিন্নমত। মাধেসিদের পাশাপাশি এখন মাওবাদীরাও দেশটির প্রদেশভিত্তিক সর্বোচ্চ বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে। তাদের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ‘জনজাতি গ্রুপ’ নামে আদিবাসীদের একটি শক্তিশালী জোটও। তবে এই তিন শক্তিই দেশটির সংবিধান সভায় সংখ্যালঘু।

উল্লেখ্য, দেশটিতে ‘সিএ-টু’ নামে ৬০১ সদস্যবিশিষ্ট যে দ্বিতীয় সংবিধান সভা চলছে তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালি কংগ্রেস ও ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) দেশটির অধিকতর বিকেন্দ্রীকরণের বিপক্ষে। মাওবাদী ও মাধেসিরা দেশটিকে ১০টি প্রদেশে বিভক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। এটা অনুমোদিত হলে ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিকভাবে কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। অন্যদিকে নেপালি কংগ্রেস সর্বোচ্চ সাতটি প্রদেশ গঠনের পক্ষে, যাতে পাহাড়ি সমাজের বর্তমান রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রায় অক্ষুণ্ন থাকবে।

এ পর্যায়ে কৌতূহল উদ্দীপক দিক হলো শুরু থেকে দিল্লির ক্ষমতাধর মহল মাধেসিদের আন্দোলনে নানানভাবে জ্বালানি সরবরাহ করলেও বর্তমানে তারা নেপালে মাওবাদী ও মাধেসিদের ১০ প্রদেশ ধারণার বিরোধিতা করছে। পাশাপাশি চীনও নৃগোষ্ঠীভিত্তিক প্রদেশ ধারণার বিরোধিতার কথা নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোকে জানিয়েছে। চীন মনে করে প্রদেশভিত্তিক কাঠামো, বিশেষত সেটা যদি হয় জাতিগত আইডেনটিটিভিত্তিক, তাহলে ভবিষ্যতের নেপালকে চূড়ান্ত বিবেচনায় তা দুর্বল করবে। একই সঙ্গে মাধেসিদের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে ভারতের নিশ্চিত প্রভাব নিয়েও চীন উদ্বিগ্ন। তাদের বিবেচনায় এটা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কর্তৃত্বের পরিধি আরও বাড়াবে।

ভারত ও চীন উভয়ে এ ক্ষেত্রে তাদের দেশের সীমান্তবর্তী শক্তিশালী নৃগোষ্ঠীগুলোর সাংস্কৃতিক ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্যচেতনা বৃদ্ধির বিপদ হিসেবে দেখছে। তাদের অবস্থানের স্ববিরোধী দিক হলো চীন নেপালে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে বললেও নিজ দেশে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীকে তিব্বতসহ অন্তত পাঁচটি অটোনোমাস অঞ্চল করে দিয়েছে। অন্যদিকে ভারত কিছুদিন আগে তেলেঙ্গানা নামক নতুন আরেকটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশের দাবি অনুমোদন করেছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় শক্তিসমূহ নেপালের সর্বোচ্চ বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে। চীন ও ভারত উভয় এটাকেও সুনজরে দেখছে না। চীন মনে করে তিব্বতকে ঘিরে পশ্চিমা শক্তিসমূহের বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামরিক নকশার বাস্তবায়ন সহজ হবে অতিরিক্ত বিকেন্দ্রীকৃত নেপালকে হাতে পাওয়া গেলে।

সর্বশেষ অবস্থা

দেশজুড়ে তীব্র আলোড়ন সত্ত্বেও আপাতত নেপালের রাজনৈতিক সমস্যার কোনো চূড়ান্ত সমাধান আশা করা দুরূহ। তবে দেশটিতে বিতর্ক এখন আর এ জায়গায় নেই যে ভবিষ্যত্ নেপাল প্রদেশভিত্তিক হবে নাকি এককেন্দ্রিক একটি রাষ্ট্র হবে। বরং প্রদেশ কয়টি হবে এবং প্রদেশকাঠামো নৃগোষ্ঠীকেন্দ্রিক নাকি ভৌগোলিক বিবেচনাভিত্তিক হবে সে নিয়েই এখন বিতর্ক চলছে। তবে প্রদেশের সংখ্যা যতগুলো হোক তার সীমানা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও বিবাদ প্রায় অবধারিত। প্রধান প্রধান সব নৃগোষ্ঠীই সব প্রদেশে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চাইবে এবং একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোও প্রদেশের সীমানা নির্ধারণ-প্রক্রিয়ায় নিজেদের ক্ষমতার বিবেচনা কাজে লাগাবে।

বর্তমানে সংবিধান সভা কাজ করলেও সাধারণভাবে নেপালের ২০৫ আসনের পার্লামেন্টে তরাই এলাকা ৮৮টি আসন দখল করে আছে। মাধেসি অধ্যুষিত জেলাগুলোর মধ্যে এমন কয়েকটি জেলা রয়েছে, যেখানে মাধেসিদের কর্তৃত্ব অত্যধিক। যার মধ্যে রয়েছে সপ্তরি, সিরাহা, দানুশা, মাহুতারি এবং সারলাহি। কিন্তু অনেক জেলা রয়েছে যেখানে অন্য নৃগোষ্ঠীও সংখ্যায় কম নয়। এসবই জটিল এক সমীকরণের জন্ম দেবে অদূর ভবিষ্যতে।

উল্লেখ্য, সংবিধান প্রণয়ন মূল দায়িত্ব হলেও নেপালের সংবিধান সভা সাধারণ পার্লামেন্ট হিসেবেও কাজ করছে। প্রধান দলগুলোর মধ্যে মাওবাদীরা রয়েছে বিরোধী দলের ভূমিকায়। সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে সুশীল কৈরালার নেতৃত্বে নেপালি কংগ্রেস ও ইউএমএল পার্টি। শাসক দুটি দলই বর্তমানে ভারতের বিশেষ মিত্র হিসেবে স্বীকৃত। সর্বশেষ নির্বাচনে কংগ্রেস ১৯৬টি আসন পেয়ে দেশের প্রধান দলে পরিণত হয়। দ্বিতীয় প্রধান দলে পরিণত হয় ইউএমএল, তারা আসন পায় ১৭৫টি।

বর্তমান সংবিধান সভায় মাধেসের প্রাদেশিক মর্যাদা নিয়ে বিবাদ চলমান অবস্থাতে মাধেসি জন-অধিকার ফোরাম (এমজেএফ) তরাই-মাধেস লোকতান্ত্রিক পার্টি (টিএমএলএফ) ও নেপাল সদভাবনা পার্টির (এসপি) সঙ্গে মিলে ইতিমধ্যে গঠন করেছে ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক মাধেসি ফ্রন্ট (ইউডিএমএফ)। এটা অনেকটা রাজনৈতিক মঞ্চের মতো। তরাইয়ের রাজনীতিতে এরাই এখনো মূল খেলোয়াড়। একসময় মাওবাদীদের সঙ্গে চরম বৈরী সম্পর্ক থাকলেও এখন এরা আবার মাওবাদীদের মিত্র। তরাইয়ের রাজনীতির এটা প্রায় স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। প্রধান দলগুলোর তরফ থেকে ক্ষমতার ভাগ পেয়ে জাতীয় দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য ও ভাঙনের খেলায় লিপ্ত হয় তারা। এ ক্ষেত্রে তাদের মূল ‘প্রোডাক্ট’ জাতীয়তাবাদী এক সাংস্কৃতিক আবেগ।

মাধেসি আন্দোলনের সংগঠকেরা এ হুমকি বরাবর দিয়ে যাচ্ছে যে তাঁদের দাবি মানা না হলে তাঁরা ‘নেপালের সঙ্গে’ থাকবেন না। এমনকি কোনো অবস্থায় নেপালের সেনাবাহিনীকে এখানে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে মোতায়েনেরও ঘোর বিরোধী তাঁরা। আগেই বলা হয়েছে, বিতর্কের কেন্দ্রে আবর্তিত হচ্ছে ফেডারেলইজম। অর্থাত্ ভবিষ্যতের নেপালে মাধেসিরা কীভাবে স্বায়ত্তশাসনের চর্চা করতে পারবে সেই বিবেচনা। প্রধান দাবি এখন তিনটি তাদের: সকল মাধেসিকে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট দিতে হবে, পুরো মাধেসকে এক শাসনতান্ত্রিক ‘ইউনিট’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং সেই ইউনিটকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম দাবিটি অনেকাংশে পূরণ হয়েছে। বাকি দুটির ভবিষ্যত্ নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে তরাই এবং পুরো নেপালও। তবে সম্ভবত তার আগে নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মতৈক্যে আসতে হবে সীমান্তবহির্ভূত অনেক আন্তর্জাতিক শক্তিকে।

তথ্যসূত্র

1.       Magnus Hatlebakk, Economic and social structures that may explain the recent conflicts in the Madhesh of Nepal, CMI, Norway, 2007.

          http://www.cmi.no/publications/file/2662-economic-and-social-structures-that-may-explain.pdf (retrieved on 20th January 2014.)

2.       Indo-Nepal Treaty of Peace and Friendship, 1950 and British-Nepal Sugali Treaty 1815.

3.       Krisshna Hachhethu, Madheshi Nationalism and Restructuring the Nepali State, Tribhuvan University, Nepal, 2007.

4.       http://en.wikipedia.org/wiki/Terai (retrieved on 10th January 2014.)

5.       International Crisis Group, Nepal’s Troubled Tarai Region, Asia Report 136, 9 July 2007.

6.       Nationalism and Ethnic Conflict in Nepal: Identities and Mobilization after 1990. Edited by Mahendra Lawoti and others, Routledge, 2013, USA.

7.       Kristen Zipperer, Smugglers’ paradise, Himal, Nepal, 27 May 2013.

8.       Nepal profile: A chronology of key events,

          http://www.bbc.com/news/world-south-asia-12499391(retrieved on 15th February 2015.)

9.       Emily Wann, Violence in the Terai Region and the Madhesi Movement: Prospects for Peace in Nepal, United States Institute of Peace, August 3, 2007.

10.      Violence in Terai as former Maoists begin fresh 'war', Hindustan Times, India. http://www.hindustantimes.com/world-news/violence-in-terai-as-former-maoists-begin-fresh-war/article1-209481.aspx (retrieved on 10th January 2015.)

11.      Insurgency in Nepal, http://www.globalsecurity.org/military/world/war/nepal_insurgency.htm (retrieved on 05th April 2015.)

12.      Prashant Jha, Battles of the New Republic: A Contemporary History of Nepal, Hurst and Company, London, 2015.

13.      Rajesh Joshi, Why China's influence on Nepal worries India, BBC.http://www.bbc.com/news/world-asia-22365488 (retrieved on 20th March 2015.)

14.      Jibanath Khanal, Nepal: Indian hegemony has been institutionalized already, Telegraph Nepal.

          http://www.telegraphnepal.com/opinion/2012-02-15/nepal:-indian-hegemony-has-been-institutionalized-already (retrieved on 7th april 2015.)