ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারতভাগ: জিন্নাহ ও গান্ধীর ভূমিকা

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

প্রথম আলো পুরস্কারপ্রাপ্ত আহমদ রফিকের দেশবিভাগ: ফিরে দেখা 

গ্রন্থ পাঠের প্রতিক্রিয়া এবং ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা।

বাংলাদেশের অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত আহমদ রফিকের লেখা দেশবিভাগ: ফিরে দেখা গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক কালের একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। বইটি বাংলা ১৪২০ সনে (২০১৫ ইং) ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্তিই এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হওয়ার একমাত্র বড় কথা নয়, বইটি নিজগুণেই আলোচিত-সমালোচিত বা মূল্যায়িত হতে পারে। পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশে দেশভাগ নিয়ে এ ধরনের বৃহত্ মাপের কাজ আগে হয়নি। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে মাথায় রেখে সুনির্দিষ্ট করে এই বাংলায় কোনো কাজ হয়নি বললেই সঠিক বলা হয়। পর্যবেক্ষণ বা গবেষণা গ্রন্থ রচনা দূরের কথা, সাধারণ মাপের কোনো ইতিহাস গ্রন্থও রচিত হয়নি। সেই বিচারে আহমদ রফিক তাঁর রচনার জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। লেখকের বইটির সঙ্গে পাঠক একমত হতে পারেন, দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন—কিন্তু মূলকথা হলো, তিনি দেশভাগ নিয়ে বৃহত্তর পাঠকসমাজকে নতুন করে চিন্তাভাবনার অবকাশ করে দিয়েছেন। কারণ, রফিক যে বইটি লিখেছেন, সেটা দুর্বোধ্য বা জটিল গ্রন্থ নয়—সহজ ভাষায় লেখা এই বইটি সাধারণ পাঠকেরা পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, যদিও বইটিতে প্রচুর পুনরাবৃত্তি রয়েছে। বইটি কোনো পক্ষের হয়েও তিনি লেখেননি। নিজের বিশ্বাস বা ধারণা, পর্যবেক্ষণ-অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত সূত্র ধরেই তিনি নিজের মতামতগুলো এই গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন।

বইটি পড়তে গিয়ে বোঝা যায়, রচয়িতাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। তিনি দেশভাগ সম্পর্কে একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করাতে সচেষ্ট ছিলেন। ভারতবর্ষের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ‘দেশভাগ’ সম্পর্কে এ ধরনের বই পড়তে গিয়ে বিভিন্ন পাঠকের মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জন্ম নেবে—এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান রচনাটি আহমদ রফিকের বই সম্পর্কে শুধু সমালোচনা বা মূল্যায়ন নয়, পাশাপাশি একজন পাঠকের প্রতিক্রিয়াও বটে। কখনো বইটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করা হয়েছে, কখনো কিছু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। কখনো বইটিকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নতুন প্রসঙ্গের অবতারণাও করা হয়েছে। প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ বইটিতে লেখক বিভিন্ন ধরনের যেসব তথ্য দিয়েছেন বা মন্তব্য করেছেন, বিভিন্ন শিরোনামে যেসব অধ্যায় লিখেছেন, স্বভাবতই তার সবগুলো নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। বক্ষ্যমাণ সমালোচনায় বা মূল্যায়নে গ্রন্থের সেই সব দিকে ব্যাপকভাবে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে, যা এখনো বিতর্কিত বিষয়। পৃষ্ঠাসংখ্যার বিবেচনায় সেখানেও নানা সীমাবদ্ধতা দেখা দেবে। ফলে সামান্য পরিসরে গ্রন্থটির মূলভাবটি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হবে। বহু ক্ষেত্রে লেখকের বক্তব্যের সমর্থনে নতুন তথ্য থাকবে। সব সময় লেখকের সঙ্গে যে একমত হওয়া যাবে বা ভিন্নমত থাকবে না, তা-ও নয়। সে ক্ষেত্রে নতুন তথ্য পরিবেশন করা হবে। সত্যিকারভাবে দেখতে গেলে, লেখকের সঙ্গে খুব বেশি দ্বিমত প্রকাশ করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিষয়বস্তু বা ঘটনাবলিকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিরাট পার্থক্য থাকবেই। প্রতিটি গ্রন্থের মধ্যে অনেক অব্যক্ত ভাবও লুকিয়ে থাকে। রফিক যা ব্যক্ত করেছেন আর যা অব্যক্ত রেখেছেন, তার বাইরেও নানা সত্য রয়ে গেছে। সত্য দ্রৌপদীর সেই শাড়িটির মতো, যার শেষ দেখা যায় না। সত্য একের পর এক এসে উপস্থিত হতে থাকে। আর ইতিহাসে তো চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই।

ইতিহাসের শেষ কথাটি বলা যাচ্ছে না বলেই ভারত ও ভারতের বাইরে দেশভাগ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। সারা ভারতের বিভিন্ন গবেষক যেমন লিখেছেন, ব্রিটিশদের রচিত নানা গবেষণামূলক বা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থেরও অভাব নেই। দেশভাগ নিয়ে রচিত গ্রন্থের প্রধান একটি দিক হলো এই যে বহুকাল পর্যন্ত দেশভাগের প্রধান দায় জিন্নাহর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিগত সালের সত্তর দশক পর্যন্ত ‘চল্লিশের লাহোর প্রস্তাব বা জিন্নাহর পাকিস্তান দাবিই’ দেশভাগের মূল কারণ বলে ব্যাপকভাবে চিহ্নিত ছিল। স্বভাবতই মুসলিম লীগ এবং জিন্নাহই সে সময় পর্যন্ত দেশভাগের প্রধান খলনায়ক। কিন্তু আবুল কালাম আজাদের ভারত স্বাধীন হলো গ্রন্থের অপ্রকাশিত ৩০ পৃষ্ঠা প্রকাশিত হওয়ার পর নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল বহু মানুষের মধ্যে। কারণ, আবুল কালাম আজাদের মতো কংগ্রেসের প্রথম সারির একজন নেতা যখন নতুন করে প্রকাশিত ৩০ পৃষ্ঠার মধ্যে দেশভাগ নিয়ে কিছু ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন, বোঝা গেল তালি এক হাতে বাজেনি। কিন্তু স্পষ্ট করে তখনো অনেক কথা বলা হয়নি। পরবর্তীকালে আশির দশকের শেষে যখন গান্ধীবাদী ও অহিংস নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক এবং গান্ধী আশ্রমের কর্মকর্তা, শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্না/পাকিস্তান: নতুন ভাবনা গ্রন্থটি লিখে প্রকাশ করলেন, খুব হইচই পড়ে গেল। জিন্নাহকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ পেলেন অনেকে, জানলেন ভারতভাগে কংগ্রেসের প্যাটেল, নেহরু প্রমুখের নেতিবাচক ভূমিকা সম্পর্কে। মুসলিম লীগ শুধু নয়, ভারতভাগে কংগ্রেসের ভূমিকার সমালোচনা আরম্ভ হলো। শাসক ইংরেজদের সমালোচনা তো রয়েছেই।

হ্যাঁ, সর্বপ্রথম পাকিস্তানের গবেষক আয়েশা জালাল জিন্নাহর পক্ষে শক্তভাবে কলম ধরেছিলেন, লিখেছিলেন জিন্নাহ ভারত ভাগ করতে চাননি। কিন্তু তাঁর কথা খুব গুরুত্ব পায়নি সব মহলে, কারণ তিনি পাকিস্তানি গবেষক। জিন্নাহর পক্ষে তিনি বলতেই পারেন। কিন্তু সব চিন্তাভাবনা আয়েশা জালাল পর্যন্ত এসে থেমে থাকল না। দেশভাগ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণকারী নতুন নতুন আরও গবেষকের দেখা পাওয়া গেল খোদ ভারতেই এবং পাকিস্তানে। সন্দেহ নেই, গবেষকদের মধ্যে আজাদের ৩০ পৃষ্ঠার মতো শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটিও নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছিল। বহুকাল পর্যন্ত ভারতীয় হিসেবে শৈলেশকুমারের লেখাটি ছিল ভিন্নমত হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত। ঠিক তারপর বোমা ফাটালেন বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিংহ, তাঁর গ্রন্থটি দ্বারা। মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে চিহ্নিত একটি দলের প্রধান সারির নেতা স্পষ্ট করে বলে বসলেন, ‘জিন্নাহ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন’। শুধু তা-ই নয়, দেশভাগের দায় চাপালেন নেহরু এবং কংগ্রেসের ঘাড়ে। কিন্তু ব্যাপারটা সেখানে থেমে থাকল না। জিন্নাহর পক্ষে কলম ধরলেন ভারতের বহু ইতিহাসবিদ, জিন্নাহবিরোধী বহু গবেষকের দেখা পাওয়া গেল পাকিস্তানে। নতুন শতকের শুরুতেই জয়া চট্টোপাধ্যায় লিখলেন আরও স্পষ্ট করে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ বাঙলা ভাগ হল। দেশভাগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন নিয়ে কংগ্রেসের নতুন মূর্তি রচিত হলো তাতে। হিন্দু ভদ্রলোকেরাই যে দেশভাগের জন্য, বিশেষ করে বাংলাভাগের জন্য দায়ী, তাঁর মতো প্রমাণপত্র দিয়ে স্পষ্ট করে আর কেউ সে কথা বলতে পারেননি।

বস্তুত, দেশভাগ নিয়ে এত দিন এককভাবে জিন্নাহকে দায়ী করা হচ্ছিল—কয়েক দশক ধরে সেসব ধারণাকে নতুন আলোয় বিচার করার চেষ্টা চলছে। জিন্নাহর ভূমিকার পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে। দেশভাগ নিয়ে কংগ্রেসের গান্ধী, নেহরু, প্যাটেলসহ আরও অনেকের সম্পর্কে নতুন সব প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। ঠিক এ রকম একটি পর্বে এসেই আহমদ রফিক লিখলেন, দেশবিভাগ: ফিরে দেখা। যখন দেশভাগ নিয়ে প্রচুর গ্রন্থ লেখা হয়ে গেছে, ঠিক তখন ৮০-৮৫ বছর বয়সে আহমদ রফিক এ রকম একটি গ্রন্থ লিখলেন কেন? স্বভাবতই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তিনি কি মনের গভীর থেকে জয়া চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য মেনে নিতে পারেননি? নাকি তাঁর নিজেরও কিছু বলার ছিল? নাকি নতুন করে সবকিছু মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন? বক্ষ্যমাণ মূল্যায়নে সেদিকটার দিকে নজর দেওয়া হবে। রফিক যে আয়েশা জালালের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন, সে কথা তিনি স্পষ্টই বলে দিয়েছেন। গ্রন্থকার বারবার আয়েশা জালালের মত খণ্ডন করার সুনির্দিষ্টভাবেই চেষ্টা করেছেন। তিনি আয়েশা জালালের মত খণ্ডন করার জন্য ‘জিন্নাহ পাকিস্তান চাননি: প্রশ্নবিদ্ধ মিথ’ নামে একটি অধ্যায়ও লিখেছেন।

গবেষক আয়েশা জালাল মনে করেন, জিন্নাহর দাবি ছিল, সবকিছুর আগে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃতি। নিশ্চয় এখানে আয়েশা জালালের সঙ্গে একমত হতে দ্বিধা করার কারণ নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে জিন্নাহ ব্যাপক মুসলমানের কথা ভেবেছিলেন, ব্যাপক মুসলমানের রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। জিন্নাহর জীবনে রাজনীতির শুরু মুসলমানদের নিয়েও নয়, তিনি রাজনীতি করেছেন ভারতের হিন্দু-মুসলিমসহ সব ভূস্বামী ও ধনীর পক্ষে। ইংরেজদের কাছ থেকে তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতা পাইয়ে দেওয়ার জন্য। ঘটনাচক্রে তিনি পরবর্তী সময়ে বাধ্য হয়েছিলেন শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থে রাজনীতির মাঠে নামতে, কিন্তু তিনি তখনো চিন্তা করেছিলেন উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলমান ধনিকদের স্বার্থ রক্ষা করার কথা। খুব স্বাভাবিক যে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হলে সাধারণ বা নিম্নবর্গের মুসলিমরা সেখানে স্থান পাবেই। কিন্তু মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্র বানানো আর সব শ্রেণির মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা দুটি এক কথা নয়। জিন্নাহ ধনী মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান বানানোর প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠতেই পারে যদি পাকিস্তান না হয়ে অখণ্ড ভারত রাষ্ট্র গড়ে উঠত, সেখানে কি সাধারণের স্বার্থ দেখা হতো? প্রশ্নই ওঠে না। গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরু, প্যাটেল, আজাদ প্রমুখ যে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পাল্টানোর জন্য রাজনীতি করেননি স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানে তা প্রমাণিত। সবার মূল লক্ষ্যটি ছিল ইংরেজশাসিত ভারত থেকে ইংরেজকে সরিয়ে তাঁদের জায়গাটা শুধু হাতবদল করা। ইংরেজদের আইন দিয়ে ইংরেজদের মতো করেই তাঁরা ভারতকে শাসন করতে চেয়েছেন। ভারত ভূখণ্ডে যদি ইংরেজদের মতোই সাধারণ মানুষ শাসিত ও নির্যাতিত হয়, তাহলে ভারত এক থাকল, কী খণ্ড খণ্ড হলো, তাতে সাধারণ জনতার কী আসে-যায়? শুরুতেই সে জন্য এই কথাটি বলে রাখা দরকার, ভারতভাগ নিয়ে যত কান্নাকাটি, সমালোচনা বা পক্ষপাত, সবই ঘটছে ভদ্রলোক সমাজে। সাধারণ জনতার রায় জানার সুযোগ পাওয়া যায়নি।

আগেই বলা হয়েছে, আহমদ রফিক কারও পক্ষ নিয়ে দেশবিভাগ: ফিরে দেখা গ্রন্থটি রচনা করেননি। কারও পক্ষ না নেওয়া, তাঁর বইয়ের এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, তার মানে তিনি কি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছেন? নিরপেক্ষতা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। সবার মধ্যেই নানাভাবে বিশ্বাসের কিছু জায়গা তৈরি হয়, সচেতনভাবে পক্ষপাতিত্ব না করেও সেখানে নিরপেক্ষ থাকাটা কঠিন। সন্দেহ নেই, আহমদ রফিক বর্তমান গ্রন্থে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন। তিনি গ্রন্থের ‘প্রারম্ভকথা’ অধ্যায়ে লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগ মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতির মতাদর্শ নিয়ে পথ চলেছে। হিন্দু মহাসভা চলেছে হিন্দুত্ববাদী অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নিয়ে। ঠিক বিপরীতে স্বপ্ন মুসলিম লীগের চল্লিশের দশকে পৌঁছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রদায়িকতা ধারে ভারে তাই অধিকতর শক্তিমান হয়ে ওঠে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনৈতিক বিকাশের দায় সবটুকুই স্থানীয় রাজনীতির, তথা লীগ, কংগ্রেসের ছিল না। ভারতশাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ব্রিটিশ রাজের এ বিষয়ে সিংহভাগ দায়—“ভাগ কর শাসন কর” নীতির সফল প্রয়োগে। এবং তা তাদের শাসনকালের শুরু থেকেই। ইতিহাস-লেখকগণ যে-যার মতো করে ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ শেষে এর দায় ত্রিভুজের তিন কোণে স্থাপন করেছেন। জিন্নাহ ও তাঁর সংগঠন মুসলিম লীগকে একপাশে রেখে ভারতীয় রাজনীতির যে নব মূল্যায়ন তার ফলে দেশভাগের দায় কংগ্রেসের ওপরেও বর্তাচ্ছে। বিশেষ করে শেষ পর্বে এ বিষয়ে অভিযুক্ত জওহরলাল নেহরু ও সরদার বল্লবভাই প্যাটেল। দায় হিন্দু মহাসভা ও তার সহযাত্রীদের কট্টর সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও তত্পরতা।’১

রচয়িতা তাঁর গ্রন্থে ভারতভাগের দায় মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা এবং ব্রিটিশ শাসক—সবার ওপরেই চাপিয়েছেন। স্বভাবতই তাঁর একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রন্থের শুরুতেই মিলে যায়। তিনি সেখানে আজাদের উদ্ধৃতি দিয়ে আরও লিখছেন, ‘দেশভাগ এড়ানো যেত যদি গান্ধী-নেহরু মুসলিম লীগ তথা জিন্নাহর দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে আরও কিছুটা উদার হতেন, সংশ্লিষ্ট ভাইসরয়গণ অধিকতর বিচক্ষণতা, নিরপেক্ষতা ও আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটাতেন। সর্বোপরি ত্রিপক্ষীয় সংলাপে জিন্নাহ যদি পাথুরে দৃঢ়তার পরিবর্তে কিছুটা নমনীয় হতেন। এই তিন “যদি”র কারণে অখণ্ড ভারতের সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।’২ তিনি ঠিক এরপরেই মন্তব্য করছেন, ‘এ বিষয়ে হডসনও কয়েকটি “যদি” ও “কিন্তু”র উল্লেখ করে দেশভাগ এড়ানোর কথা বলেছেন। যেমন ব্রিটিশরাজ যদি দু-দশ বছর আগে ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন, তাহলে ঘটনা অন্য রকম হতো, দেশভাগ এড়ানো যেত। লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব তখন অপরিবর্তনীয় অবস্থায় পৌঁছায়নি। কিন্তু তেমন মনোভাব ব্রিটিশ রাজ-এর ছিল না।’৩ ওপরের সব কথাই তিনি গ্রন্থের প্রারম্ভে বলেছেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় তিনি জিন্নাহর বিভিন্ন বক্তব্য এবং বিভিন্নজনের মতামতের ভিত্তিতে কমবেশি সেই কথাগুলোই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেশভাগের দায় ভারতের জাতীয় প্রধান নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রধানত জিন্নাহর ঘাড়ে ফেললেও কমবেশি এই দায় থেকে গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল ও এমনকি আবুল কালাম আজাদকেও রেহাই দেননি। সেই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শাসক ব্রিটিশ সরকারের দায় তো রয়েছেই। তিনি মূলত দেশভাগ সম্পর্কে তাঁর গ্রন্থে বিশেষ কয়েকজন ভারতীয় নেতার নেতিবাচক ভূমিকাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। মাউন্টব্যাটেন সেখানে বলতে গেলে তেমনভাবে সমালোচিত হননি। কিন্তু ভারতভাগে ব্রিটিশদের দায় যে সবচেয়ে প্রধান, সে কথা বহু আগে বলে গেছেন বিপান চন্দ্র তাঁর আধুনিক ভারত ও সাস্প্রদায়িকতাবাদ গ্রন্থের ‘ব্রিটিশ নীতির ভূমিকা অধ্যায়ে’।৪

বর্তমান গ্রন্থে আহমদ রফিক যে কাজটি করেছেন, তাকে বলা যায় বিভিন্ন মতের সমন্বয় সাধন, সেদিক থেকে গ্রন্থটি মূলত সংশ্লেষধর্মী। বেশ কিছু লেখকের চিন্তা বা মতামতকে তিনি বিশ্লেষণের সাহায্যে সমর্থন করার চেষ্টা করেছেন, ঠিক একইভাবে বহু লেখকের মতামত যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করার চেষ্টা নিয়েছেন। তিনি নিজেও চমত্কার চমত্কার সব মন্তব্য করে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘চল্লিশের দশকে বঙ্গদেশে রাজনীতির খেলা, লীগ-কংগ্রেসের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের বাহারি বেলুন, যা দেখে মুগ্ধ বাঙালি মুসলমান। এ মুগ্ধতার পেছনে আসলে ছিল বিরাজমান আর্থসামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তির স্বপ্ন। মুক্তি অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য...তাই বাঙালি মুসলমানশ্রেণি-নির্বিশেষে মুসলিম লীগ প্রধান জিন্নাহর পেছনে এককাট্টা। প্রচারের মহিমায় অভিভূত মুসলমান জনতা রাজনীতির খেলায় শ্রেণিস্বার্থের ফাঁকিটা বুঝতে পারেনি, পারার কথাও নয়। বিষয়টা আরও সহজ হয়েছিল হিন্দুপ্রধান জমিদারশ্রেণির প্রজাপীড়নে ও প্রজাশোষণের কারণে।’৫ খুব স্পষ্ট করেই এ পর্বের মুসলিম লীগের রাজনীতি, জিন্নাহর ভূমিকা এবং পাকিস্তানের জন্য সাধারণ মানুষের জিন্নাহর পেছনে দাঁড়ানোর সমালোচনা করেছেন লেখক। জিন্নাহর পাকিস্তান প্রস্তাব নিয়ে লেখক প্রশ্ন তোলেন, ‘লাহোর প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্যে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না এবং তা হলো ভারতীয় মুসলমানদের জন্য স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি আর তা ভারত ভাগ করে। কারণ? কারণ একটাই। হিন্দু-মুসলমান নানা দিক থেকে এত ভিন্ন যে তারা একসঙ্গে থাকতে পারে না। কথাটা জিন্নাহর। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বিগত শত শত বছর ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে এল কীভাবে?’

রফিকের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায়, জিন্নাহর ভারতভাগের পেছনের সব যুক্তি যে বাস্তবসম্মত ছিল না সেটা পরিষ্কার। জিন্নাহর কিছু যুক্তি ছিল খুবই হাস্যকর এবং খেলো। তিনি মুসলমানদের জন্য যে আলাদা ভূখণ্ডের কথা বলেছেন, সেটা ছিল একটি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ, ইংরেজদের শাসন থেকে মুক্তিলাভের পর শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে এবং ভারতে হিন্দু-মুসলমানকে পাশাপাশি থাকতে হয়েছিল। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান শুধু মুসলমানের দেশ হয়ে যায়নি আবার ভারতও শুধু হিন্দু বসবাসকারীদের ঠিকানা ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে যেমন মুসলমানের পাশাপাশি সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায় বাস করছিলেন, ঠিক তেমনি তিন-চার কোটি মুসলমান ভারতে থেকে গিয়েছিলেন। কথাটা আহমদ রফিক বারবার তাঁর গ্রন্থে বলেছেন। কিন্তু তাঁর এ বক্তব্য একেবারেই ঠিক নয় যে লাহোর প্রস্তাবে ভারতভাগের কথা ছিল। সেখানে ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা—পাকিস্তান শব্দটিও সেখানে উচ্চারিত হয়নি। ভারত ভাগের প্রশ্নটি তখনো আসেনি। লাহোর প্রস্তাবে চাওয়া হয়েছিল মুসলমানদের জন্য সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক অধিকার।

ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা থেকে রফিক বলছেন, জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের বাহারি বেলুন দেখে বাঙালি মুসলমান মুগ্ধ। রফিকের এই বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, বাংলার কত ভাগ মুসলমান বাহারি বেলুন দেখে মুগ্ধ ছিলেন? বা বেলুনটা দেখতে পেয়েছিলেন কত ভাগ লোক? দেশভাগের ইতিহাস রচনায় এখানেই একটা গলদ রয়ে গেছে। সবাই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে খুব বড় করে দেখে থাকেন। মনে করেন, বিরাটসংখ্যক মানুষ এই সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের প্রথমার্ধের গোড়ার দিকে দেখা গেল মুসলমানরা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভয়ে ভীত আর হিন্দুরা মুসলমানদের দিক থেকে বিপদের আশঙ্কায় আতঙ্কিত।’৬ কথাটা নেহরু বলেছিলেন ঠিকই কিন্তু সেটা ছিল সুবিধাভোগীদের মধ্যকার সমস্যা। তিনি যে মিথ্যা বলেছিলেন তা নয়। কিন্তু যখন নেহরু এই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, আজাদ-হিন্দ বাহিনী তখন হিন্দু-মুসলমান-শিখদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল। আজাদ-হিন্দ বাহিনীর বিচারের বিরুদ্ধে বা নৌ-বিদ্রোহের পক্ষে হিন্দু-মুসলমান ছাত্র-শ্রমিকেরা একসঙ্গে মিছিল করেছেন। যখন বাংলা ভাগ হচ্ছে, হিন্দু-মুসলমান ক্ষুদ্র-ভূমিহীন কৃষকেরা তখন ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে তেভাগার জন্য আন্দোলন করছেন। বাংলায় দেখা গেছে সেখানে নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমানরা এক পক্ষে, ঠিক বিপরীত পক্ষে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এককাট্টা। মুসলিম লীগ এবং মুসলমান সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো তেভাগা আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রচার করতে লাগল—তেভাগা কেন, চৌভাগা হবে—আগে পাকিস্তান হোক। সন্দেহ নেই সেই প্রচারে কিছু মুসলমান চাষি নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সব মুসলমান কৃষক সাম্প্রদায়িক পতাকার তলে দাঁড়াননি। কৃষক সমিতির নেতৃত্বে যেখানে তেভাগা আন্দোলন চলছিল, সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে পারেনি। নীলফামারীর মতো জায়গায় বা কুষ্টিয়াতে কৃষক-শ্রমিকের একতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামিয়ে দিয়েছিল। ত্রিপুরা সীমান্তে কৃষকেরা দাঙ্গা রুখে দিয়েছেন, কুমিল্লা জেলায় দাঙ্গা ছড়াতে দেননি। পূর্ব ও উত্তর বাংলায় দাঙ্গা ছড়াতে পারেনি। ব্যতিক্রম ছিল শুধু নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর অঞ্চল। কিন্তু সেখানে কুমিল্লার কৃষকনেতা ইয়াকুব মিঞা এবং কৃষ্ণসুন্দরের নেতৃত্বে প্রধানত মুসলিম কৃষকেরাই পার্শ্ববর্তী কোনো অঞ্চলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে দেননি।৭ ফলে রফিক যখন বলেন, বাংলার মুসলমানরা পাকিস্তান লাভের জন্য জিন্নাহর পক্ষে এক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, কথাটা বিভ্রান্তি বা বিতর্ক সৃষ্টি করে।

জওহরলাল নেহরু শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেন, হিন্দু-মুসলিম এই সব বিরোধ নিয়ে বৃহত্তর জনগণের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি বলেন, যেসব উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রায়ই জাতীয় ঐক্য ও প্রগতির প্রতিবন্ধক ছিলেন, সংকীর্ণ রাজনৈতিক দাবি সেই উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি ক্ষুদ্র অংশের পক্ষে হয়তো লাভজনক ছিল, কিন্তু জনগণের জন্য নয়। কিন্তু সুকৌশলে এটাকে একটি জনগোষ্ঠীর দাবি বলে চালানো হচ্ছে।৮ ধর্মনিরপেক্ষ লেখকেরা সাম্প্রদায়িকতাবাদকে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ কথা কেবল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে সত্য। কারণ, ঘটনার বাস্তবতায় বহুসংখ্যক সাধারণ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সঙ্গে জড়িয়ে যেতে বাধ্য হতো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অংশগ্রহণকারী ও শিকার যারা—সাধারণত তারা হতো লুম্পেন গুন্ডা প্রকৃতির ও শহরের দরিদ্র মানুষ। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রামের কৃষকেরাও জড়িত ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সংঘাতটা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ছিল না; বরং রাজনৈতিক সংঘাতটা ছিল সুবিধাভোগী মুসলিম মধ্যবিত্ত ও ভূস্বামীদের সঙ্গে হিন্দু মধ্যবিত্ত ও ভূস্বামীদের মধ্যে। নিম্নমধ্যবিত্তরাও কখনো কখনো সে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ বা নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমানরা সর্বদাই এর বাইরে ছিলেন।

সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই সাম্প্রদায়িক বিভেদকে সামনে আনা দরকার ছিল। জিন্নাহ, গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল প্রমুখ ছিলেন এই সুবিধাভোগীদেরই প্রতিনিধি। সাম্প্রদায়িক বিভেদে সাধারণ মানুষ বা শ্রমজীবী মানুষের কোনো স্বার্থ ছিল না—এই ধারণা স্পষ্ট হওয়া দরকার। সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুর তত্ত্বের মধ্যেই একটা বিরাট গোলমাল রয়ে গেছে। হিন্দুরা সংখ্যাগুরু আর মুসলমানরা সংখ্যালঘু—এই তত্ত্ব ভুল। সুবিধাভোগীদের তত্ত্ব এটা। সত্যিকার অর্থে সংখ্যালঘুরাই ক্ষমতায় থাকে। সংখ্যাগুরুদের লড়তে হয় সংখ্যালঘু শাসকদের বিরুদ্ধে। ভারতে সংখ্যালঘু তাই মুসলিমরা নয়। শাসকেরা। হিন্দু-মুসলিম-শিখ সব সম্প্রদায়ের ভূস্বামী ও ধনিকেরা সংখ্যালঘু এবং তাঁরাই শাসকশ্রেণি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে, নিম্নবর্গের হিন্দু ও মুসলমানরা, নিম্নবর্গের বৌদ্ধরা—অর্থাত্ নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলিম-শিখ-জৈন-বৌদ্ধরা সবাই মিলিতভাবে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ। জিন্নাহ সাধারণ বা শ্রমজীবীদের জননেতা না হওয়ার কারণেই সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু চিহ্নিত করতে ভুল করেছেন। ঠিক একই ভুল করেছেন হিন্দুত্ববাদী নেতারা। বহুদিনের প্রচলিত সেই ধারণাই এখন অনেকে বিশ্বাস করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের মহাপরিদর্শক নজরুল ইসলাম মুসলমানদের করণীয় নামে একটি গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ভারতের সাধারণ হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধ নেই। কারণ, ভূমিপুত্র শূদ্ররাই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন।৯ ফলে বাংলার ভূমিপুত্র শূদ্র বা শ্রমজীবীরাই ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।

স্মরণ রাখা দরকার জিন্নাহ, নেহরু, প্যাটেলরা ভারতের মূল জনসংখ্যার মাত্র ১১ থেকে ১৪ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করতেন। কারণ, ১৯৩৭ সালের ভারত শাসন আইনের পর ১১ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার পেয়েছিলেন। পরে সেটা ১৪ শতাংশ হয়েছিল। ভারতের সব জনগণের তখন ভোটাধিকার ছিল না। নির্দিষ্ট মানের শিক্ষালাভ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দেওয়ার ওপর ভোটাধিকার পাওয়া নির্ভর করত। কাজেই বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলেও সাধারণ মুসলমান বা শূদ্র ভোটারের সংখ্যা ছিলেন নগণ্য। ভারতের ভোটাধিকারপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ এবং

শিখ-মুসলিম ভূস্বামী—এই রকম কতিপয় ক্ষুদ্র অংশেরই নেতা ছিলেন কংগ্রেস-মুসলিম লীগ নেতারা। ভোটাধিকার প্রাপ্ত এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীরই স্বার্থ রক্ষা করত মুখ্যত সাম্প্রদায়িক নেতৃবৃন্দ। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কখনো সর্বসাধারণের ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম করেনি। বাংলা, তথা ভারতে কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ এমন কোনো গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বা গড়ে তুলতে চায়নি যে বৃহত্তর জনগণ ক্ষমতা হস্তান্তর-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। মুসলিম লীগ কোনো রকম সরকারবিরোধী গণ-আন্দোলনে ছিল না। কংগ্রেস যেকোনো গণসংগ্রাম ব্যাপকতা পেতে দেখলে বা সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস হয়ে উঠতে দেখলে মাঝপথে থামিয়ে দিত। স্বভাবতই কংগ্রেস মুসলিম লীগ আমলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান দেখা গেলেও তা চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি উচ্চবর্গের অনীহার কারণে। জালিয়ানওয়ালাবাগের গণসমাবেশ ছিল শহুরে সাধারণ মানুষের বিরাট অভ্যুত্থানের ঘটনা। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যখন সত্যিই ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী ধারার আন্দোলনের সূচনা ঘটতে যাচ্ছিল, গান্ধী বা কংগ্রেস তা থামিয়ে দিল। হ্যাঁ, সেটা ছিল ১৯১৯ সালের ঘটনা। জিন্নাহ-গান্ধী দুজনেই তখন কংগ্রেসের সদস্য। কিন্তু চাইলেন না ভারতে জনসাধারণের ব্যাপক সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি হোক। ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে গণ-অভ্যুত্থান ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে ভীতিপ্রদ। কারণ, তাহলে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতাদের স্বার্থমতো ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হতো না।

জিন্নাহর ভূমিকা ছিল এসব ব্যাপারে ভীষণ রকম রক্ষণশীল। জিন্নাহ ছিলেন অত্যন্ত তীক্ষ বুদ্ধির চুলচেরা আইনজ্ঞ। সবাই জানতেন, তাঁর আইনজ্ঞান ছিল খুব পরিপক্ব। নিজ পেশায় তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন কংগ্রেস দলের অপ্রতিহত প্রাধান্য। জিন্নাহ রাজনীতি করার জন্য সেই কংগ্রেস দলেই যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন এবং ভয়াবহ রকম দাম্ভিক। খুব কম লোককেই তিনি নিজের সমকক্ষ ভাবতেন। রাজনীতির অঙ্গনে যে মানুষগুলোর কাছে তিনি পয়গম্বরের সম্মান পেয়েছিলেন, তিনি নিজে সে মানুষগুলোর প্রতি সামান্য সমাদর দেখাতে পারেননি। ময়লা পোশাক পরা সাধারণ মানুষগুলোকে তিনি রীতিমতো হেয় জ্ঞান করতেন। গান্ধী আবার এ ব্যাপারে ছিলেন জিন্নাহর বিপরীত। তিনি সমাজের অস্পৃশ্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা-খানাপিনা করতে পারতেন। দুর্গন্ধযুক্ত বস্তির মধ্যে বসে গরিব মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতেন, দরিদ্রদের সেবা করার মানসিকতা নিয়ে তাঁদের দুঃখকষ্টের কথা শুনতেন। কংগ্রেসের নেতাদের আর কারও এ গুণটি ছিল না। গান্ধী তাই খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। জিন্নাহ কিন্তু হিন্দু হোক বা মুসলমান হোক, ছোটলোকদের সঙ্গে মেলামেশা করার কিংবা পূতিগন্ধময় বস্তিতে বসে তাঁদের দুঃখকষ্ট শোনার কোনো যুক্তিই খুঁজে পেতেন না। জিন্নাহর তা দরকারও হতো না। জিন্নাহ কেন, তেমনটিই ছিলেন আজাদ বা প্যাটেল বা ঠিক নেহরু। কংগ্রেসের এই সব মহান নেতাই ছিলেন ভারতের ভাগ্যবিধাতা। তাঁদের মাথার ওপরে ছিলেন ব্রিটিশ শাসকেরা।

জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনের রয়েছে দীর্ঘ কালপর্ব। কংগ্রেসে জিন্নাহ উল্লিখিত সময়ে সবার মধ্যে ছিলেন জ্যেষ্ঠ সদস্য। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ মিলিয়ে ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবন জিন্নাহর। কিন্তু শত বিচার-বিশ্লেষণ করে জিন্নাহকে জননেতা বানানো যাচ্ছে না। কারাগারও ভোগ করেননি কখনো। জিন্নাহকে জননেতা না বানানো গেলেও ভারতের কংগ্রেসের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন জিন্নাহ। রফিক এক জায়গায় লিখেছেন, ‘আসলে গান্ধী ও জিন্নাহ দুজনেই অর্ধসত্য পুঁজি নিয়ে রাজনীতিতে তত্পর হয়েছিলেন। একজন অখণ্ড ভারতের নামে, অন্যজন বিভক্ত ভারতের পাকিস্তানের টানে।’ কথাটা একেবারে সত্যি নয়, নির্জলা মিথ্যা। ভূস্বামীদের স্বার্থের প্রতিভূ জিন্নাহ রাজনীতির মধ্যে খুব বেশি আন্দোলনের কথা ছিল না। কিন্তু তিনি অখণ্ড ভারতের স্বায়ত্তশাসনের জন্যই রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তিনি বাস্তবসম্মত মানুষ হিসেবে মনে করেছেন, কংগ্রেসে ভারতের সব সুবিধাভোগী-শিক্ষিত হিন্দু-মুসলিম-শিখ বা আরও সব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইংরেজদের তাহলে ক্ষমতা প্রদান ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। তিনি রক্তপাতের মধ্যে যেতে চাননি, হঠকারিতা করেননি। বুঝেছিলেন, ভদ্রলোকেরা রক্তপাতের মধ্যে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। রক্তপাত ছাড়াই শিক্ষিত সমাজের ঐক্যবদ্ধ দাবির মুখে, চাপের মধ্যে ইংরেজকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তিনি লক্ষ্য স্থির করে ধীরে ধীরে এগোতে চেয়েছেন। তিনি ভদ্রলোকদের রাজনীতি করেছেন, কিন্তু সামান্যতম সাম্প্রদায়িক ছিলেন না।

মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারের মাধ্যমে ১৯০৯ সালে সর্বপ্রথম সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের সূত্রপাত হয়েছিল। মুসলমানদের জন্য জনসংখ্যার হারের তুলনায় অধিক আসন বা সংরক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল এই প্রস্তাবে। জিন্নাহ এবং কংগ্রেস এই আইনের বিরোধিতা করে। বলা হলো বিশেষ ধর্মমতে অনুগামীদের মাত্রাতিরিক্ত প্রতিনিধিত্ব দেওয়া একান্তভাবে অনুচিত। কিন্তু তাবত্ আপত্তি সত্ত্বেও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ভারতবাসী মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারকে প্রত্যাখ্যান করেনি। ১৯১০ সালের ২৫ জানুয়ারি জিন্নাহ ভারতের রাজধানী কলকাতায় বড়লাটের কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে আসন গ্রহণ করেন। তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে বড়লাটের সঙ্গে এক বাগ্যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতবাসীদের স্বাধিকার আন্দোলনের সমর্থন করেন। তিনি বক্তব্যটি শেষ করেন প্রায় এভাবে, ‘মাই লর্ড, গোড়াতেই আমি এমন একটি বিষয় সম্বন্ধে বলতে চাই, যা অত্যন্ত বেদনাজনক। বিষয়টি হলো, দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতবাসীর প্রতি অত্যন্ত রূঢ় ও নিষ্ঠুর আচরণ।’ বড়লাট মিন্টো তখন বলেছিলেন, ‘মান্যবর মহোদয়কে শান্ত হতে বলা হচ্ছে। আমার মতে, “নিষ্ঠুরতা” শব্দটি অত্যন্ত কঠোর।’ জিন্নাহ তখন উত্তরে বলেছিলেন, ‘মাই লর্ড, আমার আরও কঠোর শব্দ প্রয়োগের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমি এই কাউন্সিলের বিধান সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন এবং তাই আমি এক মুহূর্তের জন্যও সে বিধান ভঙ্গ করতে চাই না।’ জিন্নাহ তাঁর সেই বক্তৃতা প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িক নির্বাচনব্যবস্থার বিরোধিতা করেন।১০

জিন্নাহ বুঝেছিলেন, কংগ্রেস আর মুসলমান আলাদা আলাদাভাবে কাজ করলে ইংরেজরা সাম্প্রদায়িক বিভেদের সুযোগ নেবে। জিন্নাহ চার সালে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন এবং সভাপতি গোখেলের খুব প্রিয়ভাজন হিসেবে দেখা দেন। কয়েক বছর পর মুসলিম লীগ জিন্নাহকে তাদের সভ্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। জিন্নাহ গোখেলের কাছে মুসলিম লীগের সভ্য হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। কংগ্রেসের একজন প্রধান সারির নেতা মুসলিম লীগের সভ্য হতে চাইছেন জেনে গোখেল বিস্মিত হয়েছিলেন। জিন্নাহ বলেন, হিন্দু-মুসলমান শিক্ষিতদের মধ্যে যে ধরনের নানা বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে, তা দূর না করা গেলে ভারতকে স্বাধীন করা যাবে না। জিন্নাহ জানান, দুই পক্ষকে একত্র করা তাঁর রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য এবং দুই পক্ষকে কাছে টানতে হলে তাঁর কংগ্রেসের মতো মুসলিম লীগের সদস্য হওয়া দরকার। জিন্নাহ শর্ত সাপেক্ষে মুসলিম লীগের সদস্য হয়েছিলেন। সদস্য হওয়ার আগে মুসলিম লীগের নেতাদের শর্ত দিয়েছিলেন, লীগ কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবে। যা-ই হোক, জিন্নাহ মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে কংগ্রেসের কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।১১ গোখেল জিন্নাহ সম্পর্কে বলতেন, তিনি হলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। সরোজিনী নাইডু জিন্নাহর হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির জন্যই মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিয়ে ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ কবিতাটি লিখেছিলেন। জিন্নাহ সেকালের মুসলমান সমাজের গোঁড়ামিকে অগ্রাহ্য করে পর্দাবিহীন নিজ পত্নীকে সভা-সমিতি এবং এমনকি লাট ভবনেও নিয়ে যেতেন। জিন্নাহর দুর্ভাগ্য গোখেলের দ্রুত মৃত্যু। জিন্নাহ একজন রাজনৈতিক বন্ধু হারালেন।

গান্ধী কংগ্রেসে যোগদানের কয়েক বছরের মধ্যেই জিন্নাহ কংগ্রেস ছেড়ে চলে যান গান্ধীর নানা ধরনের হঠকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য। জিন্নাহ ভারতের রাজনীতিতে গান্ধীর চেয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ, গান্ধী ভারতের রাজনীতিতে অংশ নেন জিন্নাহর ১২ বছর পর। খিলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের যোগদান এবং গান্ধীর অসহযোগ নীতির বিরোধিতা করেন জিন্নাহ। শ্রীমতী বেসান্ত এবং অন্য উদারনীতিকেরা যে কারণে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকে বিপজ্জনক মনে করতেন, জিন্নাহও সেই কারণে তার বিরোধী ছিলেন। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মুসলমানদের ওপর খিলাফত আন্দোলনের সম্ভাব্য পরিণাম নিয়ে তাঁর মনে দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অজ্ঞ ও ধর্মান্ধ মুসলমানদের আন্দোলনের সহকর্মী করাকে তিনি একান্তভাবে অবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে করতেন।১২ রফিক হডসনের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, রাজনৈতিক ঘটনায় জিন্নাহ কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত দেখে নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিতেন।১৩ কথাটা কতটুকু সত্যি? জিন্নাহ সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ শাসকেরা একটা চাল দিলে গান্ধীজি দিতেন তার পাল্টা চাল। আর গান্ধীজি একটা চাল দিলে জিন্নাহ সাহেব দিতেন তার পাল্টা চাল। মনে হতো জিন্নাহ সাহেব যেন ব্রিটিশ পক্ষের ডামি। সেটা কিন্তু ঠিক নয়। তিনি ছিলেন স্বাধীন খেলোয়াড়। ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে পদ দিয়ে বা উপাধি দিয়ে কিনে নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন আনপারচেজেবল। ইনকরাপটিবল। অবিকল গান্ধীজির মতো।’ সংবিধানপন্থী জিন্নাহ গান্ধীর অসহযোগ কর্মসূচির সঙ্গে একমত হতে না পেরে কংগ্রেসের ভবিষ্যত্ সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৯২১ সালে নাগপুর সম্মেলনের পর কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন।

সরল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘গান্ধীকে নরমপন্থী অথবা চরমপন্থী অথবা জাতীয় বিপ্লবী আখ্যায় ভূষিত করা যায় না। ভারতে আগমনের তিন বছরের মধ্যেই গান্ধীজি জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় সংগ্রামে নতুন অধ্যায় সূচনা করেছিল।’১৪ দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর আন্দোলনের সাফল্য তাঁকে ভারতেও অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তিনি কৃষক আন্দোলনের ভেতর দিয়েই ভারতে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। ভারতের জাতীয় আন্দোলনে এত দিন উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন, গান্ধীর যোগদানের পর সাধারণ মানুষও কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে শুরু করেন। সাহেবদের পোশাক পরা কেতাদুরস্ত বুদ্ধিজীবী নেতাদের চেয়ে ধুতি পরিহিত গান্ধীকে তাঁরা রাজনৈতিক নেতার চেয়ে একজন সন্ত বা পুণ্যাত্মা হিসেবে অধিক মর্যাদা দিতেন। গান্ধীকে নিয়ে কৃষক-সাধারণের মধ্যে নানা অলৌকিক গল্প প্রচলিত ছিল।১৫ কিন্তু গান্ধী সাধারণ মানুষকে রাজনীতিতে টেনে নিয়ে এলেও তাঁর রাজনীতি ছিল মহাজন-ভূস্বামী ও ধনিকদের স্বার্থে। ধরা যাক, কুখ্যাত রাওলাট আইনবিরোধী আন্দোলনের কথা। গান্ধী এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। গান্ধীর সঙ্গে সরোজিনী নাইডু, বল্লভভাই প্যাটেল প্রমুখ ৪০ জন নেতা রাওলাট আইনবিরোধী ঘোষণায় স্বাক্ষর করলেন। গান্ধীকে সভাপতি করে সত্যাগ্রহ সভায় এক দিনের জন্য হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয়। সেই অনুযায়ী ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসে একদিন সারা ভারতে অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে হরতাল পালিত হয়। দিল্লির পুলিশ জনতার ওপর গুলি চালায়। সংঘর্ষ ও অসন্তোষ দিল্লি থেকে অমৃতসরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রাওলাট আইনবিরোধী আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠলে গান্ধী এই আন্দোলন স্থগিত রাখতে আহ্বান জানান। তিনি ঘোষণা করলেন, সত্যাগ্রহ আন্দোলনে হিংসার স্থান নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আন্দোলন পশ্চিম ভারতে সহিংস আকার ধারণ করে। গান্ধী এর পরিপ্রেক্ষিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেওয়াকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। গণ-আন্দোলন কি সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ যে তা খুব সুশৃঙ্খলভাবে চলবে, আর জনগণের ওপর পুলিশের গুলি চললেও জনগণকে চুপচাপ তা মেনে নিতে হবে? এই ছিল গান্ধীর গণ-আন্দোলনের চরিত্র।’

রাওলাট আইন নিয়ে জিন্নাহর ভূমিকা অনেক গঠনমূলক ছিল গান্ধীর চেয়ে। রাওলাট আইন যখন গৃহীত হয়, জিন্নাহ তখন ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য হিসেবে যুক্তিজাল বিস্তার করে এর ব্যাপক বিরোধিতা করেন। কিন্তু তাবত্ ভারতীয়র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এই আইন অনুমোদিত হলো। জিন্নাহ সঙ্গে সঙ্গে ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলের সদস্যপদে ইস্তফা দিয়ে বড়লাটকে কঠোর ভাষায় পত্র লিখে জানালেন, ‘এই বিল পাস করা এবং যেভাবে তা পাস করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে আমার ইস্তফা পাঠাচ্ছি। কারণ, আমি মনে করি, বর্তমান অবস্থায় কাউন্সিলে থেকে আমি দেশের জনসাধারণের কোনো কাজে লাগব না।...আমার মতে যে সরকার শান্তির সময়ে এ-জাতীয় আইন প্রণয়ন করে, সে আর নিজেকে সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে না।’১৬ জিন্নাহ ক্ষমতালোভী ছিলেন না, ব্রিটিশদের দালালও ছিলেন না। তিনি আইনের ছাত্র হিসেবে মনে করতেন, আইনের শক্তিতে সাংবিধানিকভাবেই ব্রিটিশ শাসনকে প্রতিহত করতে হবে। সে জন্য তিনি সবচেয়ে গুরুত্ব দিতেন হিন্দু-মুসলমানসহ সব শিক্ষিত-মেধাবীর একসঙ্গে পথচলাকে। তিনি যেমন দরিদ্রদের স্বার্থে রাজনীতি করেননি, ঠিক তেমনি তিনি কখনো নিম্নবর্গের মানুষকে আন্দোলনের ডাক দিয়ে মাঠে নামাননি—তাঁদের শাসকচক্রের বুলেটের সামনে দাঁড় করাননি। তিনি নিম্নবর্গের মানুষকে শাসকদের বুলেটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ধনীদের স্বার্থ উদ্ধারের খেলা খেলেননি। তিনি চেয়েছেন সাংবিধানিক শক্তিকে কাজে লাগাতে।

রাওলাট আইনবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরেই জালিয়ানওয়ালাবাগে অমৃতসরের জনতা সম্মিলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো রকম হুঁশিয়ারি না দিয়ে জেনারেল ডায়ার ১০ হাজার জনতার ওপর গুলি চালায়। জালিয়ানওয়ালাবাগ ক্ষুদ্র উদ্যানে প্রবেশ ও প্রস্থানের একটি মাত্র পথ ছিল। ফলে গুলিবর্ষণে ১ হাজার ২০০-এর মতো লোক নিহত হন এবং আরও বহু মানুষ আহত হয়েছিলেন। প্রাণ বাঁচাতে কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে বহু লোক প্রাণ দেন। পরদিন সামরিক শাসন জারি করে জনতার ওপর আরও অত্যাচার আরম্ভ হয়। কিন্তু গান্ধী সহিংসতার কথা বলে এই আন্দোলন তুলে নেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া তাঁর স্যার উপাধি ত্যাগ করেন। কিন্তু কংগ্রেস এই ঘটনার পর নীরব ভূমিকা পালন করে। এই রকম বিরাট হত্যাকাণ্ডের পর কী করে গান্ধী বা কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে অহিংসার নামে নীরব হয়ে গেল! যদিও জিন্নাহ সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে ডাক দেননি, তবু তিনি ঘটনার নিন্দা জানান। গান্ধী আর অন্যরা জনতার আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন নানা বাহানায়। শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বাড়তে দিলেন না। সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও আন্দোলনকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়ার জন্য গান্ধীকে অনেকে সমালোচনা করেছিলেন। জিন্নাহ সাংবিধানিক পদ্ধতির বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো গণ-আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন না। আর গান্ধীর গণ-আন্দোলনের চরিত্র কী ছিল? সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে মাঠে নামিয়ে, বুলেটের সামনে জনগণ প্রাণ দেওয়ার পর তিনি মনে করলেন, জনগণের এবার আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া দরকার। বারবার তিনি এই কাণ্ড করেছেন।১৭

রাওলাটবিরোধী আন্দোলনের এক বছর পর কলকাতায় যখন কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসে মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলন তখন তুঙ্গে। গান্ধী সে সময়ে একজন রাজনৈতিক নেতার চেয়ে পুণ্যাত্মা হিসেবে আবির্ভূত এবং বেশ জনপ্রিয়। জনগণের মধ্যে গান্ধীর সন্তসুলভ প্রভাবকে কংগ্রেস নেতারা দলের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইলেন। গান্ধীও চাইলেন ভারতের অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠতে। কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধীর নেতৃত্ব দৃঢ়ভাবে স্বীকৃত হয় এবং অধিবেশনে গান্ধী মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে বসেন। তিনি ভারতীয় হিন্দুদের খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন দিতে আহ্বান জানান। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাবে সাত দফা বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। যেমন সরকারি খেতাব প্রত্যাখ্যান, সরকার মনোনীত সদস্যদের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন হতে পদত্যাগ, সর্বপ্রকার জাঁকজমকপূর্ণ সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট, সরকার পরিচালিত বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় বর্জন, ব্রিটিশের আদালত বর্জন, মেসোপটেমিয়ায় ব্রিটিশের সামরিক চাকরি প্রত্যাখ্যান, আইনসভার নির্বাচন ও ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বয়কট ইত্যাদি।

জিন্নাহ আবেগ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে বাস্তবসম্মত বুদ্ধি প্রয়োগ করে এটা বুঝেছিলেন, শুধু তুরস্কের সুলতান বা খলিফার কর্তৃত্বচ্যুতিকে কেন্দ্র করে ভাবাবেগের দ্বারা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে স্থায়ী করা যায় না। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে সুদৃঢ় করতে হলে ঐক্যবিরোধী যেসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে, তার অবসান ঘটানো দরকার। ফলে জিন্নাহ গান্ধীর ওই প্রবাহে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। বিষয় নির্বাচনী সভার মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র জিন্নাহই ছিলেন এর বিরোধী। কংগ্রেসের বিরাট বিরাট নেতার সামনে দাঁড়িয়ে জিন্নাহ বললেন, ‘খিলাফত সম্মেলনের সমর্থন নিয়ে মহাত্মা তাঁর অসহযোগ কর্মসূচি উপস্থিত করেছেন। এবার আপনাদেরই স্থির করতে হবে যে আপনারা ওই মূল কর্মসূচির মূলনীতি অনুমোদন করেন কি না? আর করলে বিস্তারিতভাবে এর কার্যক্রম স্বীকার করেন কি না, তাও ভাবতে হবে।...তবে একবার যদি আপনারা সামনের দিকে কুচকাওয়াজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে কোনো অবস্থাতেই আর যেন পশ্চাদপসরণ না করেন।’ সবাই তখন ‘না না কখনোই না’ বলে চিত্কার করলেন জিন্নাহ তখন বললেন, ‘বসে পড়ার পূর্বে কেবল এটুকু বলতে চাই যে মনে রাখবেন—সম্মিলিত হলে আমরা খাড়া থাকব আর বিভাজিত হলে ধরাশায়ী হব।’ সবাই ‘সাধু সাধু’ বলে এবং করতালি দিয়ে জিন্নাহকে সম্মান জানালেন।১৮ জিন্নাহ যখন ওই বক্তৃতা দেন, নিশ্চয় তখন তাঁর মনে ছিল রাওলাট আইনবিরোধী আন্দোলন থেকে গান্ধী কীভাবে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন।

ঠিক এই ঘটনার সময়েই ভারত সরকারের ‘সিভিল সার্ভিস’ ত্যাগ করে সদ্য ইংল্যান্ডফেরত সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীর কাছে জানতে চান সাত দফার ভেতর দিয়ে কী করে ইংরেজরা ভারতীয়দের রাজনৈতিক দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবেন? গান্ধী তাঁকে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে না পারায় তিনি হতাশ হন।১৯ গান্ধীর অহিংস অসহযোগের সাত দফার সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাশ একমত হতে পারেননি। মতিলাল নেহরু ও চিত্তরঞ্জন দাশ মনে করতেন, ১৯১৯ সালের শাসন সংস্কার আইনে নবগঠিত আইনসভাগুলোয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং জয়লাভ করে আইনসভার ভেতর গিয়ে সরকারের কাজে প্রবল বাধা সৃষ্টি করাটাই যুক্তিযুক্ত। ঠিক সে কারণে সাড়ে তিন মাস পর নাগপুরে যখন কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হয়, চিত্তরঞ্জন দলবলসহ অসহযোগের বিরোধিতা করতে উপস্থিত হলেন। কিন্তু গান্ধীর প্রভাববলয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসলেন। জিন্নাহ কিন্তু তা করলেন না। নাগপুর সম্মেলনের কংগ্রেস অধিবেশনে তখন গান্ধীপ্লাবন বা গান্ধীপূজা চলছে—গান্ধীর মতের বিরুদ্ধে কথা বলা এক কঠিন ব্যাপার। জিন্নাহ তার মধ্যে দাঁড়িয়েই সম্পূর্ণ এককভাবে অসহযোগ প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। জিন্নাহর মতে, অসহযোগ কর্মসূচি দেশের পক্ষে কেবল বিপজ্জনকই নয়, এর জনক গান্ধী বরাবরই সংগঠনে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। তিনি কলকাতায় গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ সম্বোধন করেছিলেন এবার সম্বোধন করলেন ‘মিস্টার গান্ধী’ বলে। প্রতিনিধিরা তাঁর বক্তৃতায় বারবার বাধা দিয়ে গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ বলার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন।২০ কিন্তু জিন্নাহ অবিচল। প্রতিনিধিদের সমর্থন উপেক্ষা করেও গান্ধী পূজার প্রবল প্লাবনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিশ্বাসের কথাগুলো বলতে দ্বিধা করলেন না। জিন্নাহ খিলাফত আন্দোলনকে নিন্দা করে বলেন, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গান্ধী একদল ধর্মান্ধ মোল্লা ও উলেমাকে রাজনীতির প্রথম সারিতে নিয়ে এসেছেন। জিন্নাহর মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গান্ধীর খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি।২১

কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে অসহিষ্ণু প্রতিনিধিদের অসম্মানজনক এবং অগণতান্ত্রিক আচরণে ক্ষুব্ধ-দুঃখিত জিন্নাহ অধিবেশন বর্জন করে সেই রাতেই মুম্বাই চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনের একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটল। কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা হিসেবে জিন্নাহ সুখে-দুঃখে যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় ২০ বছর যুক্ত ছিলেন, দলে গান্ধীর স্বৈরাচারী ভূমিকার কারণে সে সংগঠন ছেড়ে চলে গেলেন। মনে রাখতে হবে, গান্ধী ব্যক্তিগত ইমেজ দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক দলের দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জায়গায় ব্যক্তিপূজার যে ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, দলের ভেতর সব মতকে ধারণ না করার বিরাট যে ক্ষতি সাধন করে গেলেন, তার কুফল এখনো ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে বহন করতে হচ্ছে। নিজের পূজনীয় আসনটি ছেড়ে কখনো গান্ধী দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা করার সুযোগ সৃষ্টি করেননি। হয়তো ভারতভাগের সেটাও এক বড় কারণ। কিন্তু গান্ধীকেও একদিন ছুড়ে ফেলা হয়েছিল দল থেকে, প্যাটেল আর নেহরুই করেছিলেন কাজটা।

গান্ধী মনে করেছিলেন, খিলাফত আন্দোলনে হিন্দুদের যোগদানের ভেতর দিয়ে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হবে এবং তিনি মুসলমানদের নেতৃত্বের আসন লাভ করবেন। গান্ধীর সেই কৌশল বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছিল। খিলাফত আন্দোলন ব্যাপকভাবে ভারতের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তা কখনো কখনো হিংসাত্মক হয়ে ওঠে এবং কৃষকদের দাবিদাওয়া এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। খিলাফত সর্বস্তরে ব্যাপকতা লাভ করলে হসরত মোহনী জঙ্গি উলেমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে প্রস্তাব দেন যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দুই সংগঠনেরই পূর্ণ স্বরাজের জন্য আন্তরিক প্রয়াস চালানো উচিত এবং তার জন্য ব্রিটিশ সরকার যদি দেশে সামরিক আইন জারি করে, তবে মুসলমানদের হয় অসহযোগের পথ পরিহার করতে হবে অথবা বুলেটের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয় পথটি গ্রহণ করলে আত্মরক্ষার জন্য হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করা অপরিহার্য হয়ে উঠবে। কিন্তু তা হবে গান্ধীর অহিংস নীতির পরিপন্থী। তাই গান্ধী এই নীতির বিরোধিতা করে বসলেন। হসরত মোহনীর খাজনা বন্ধ আন্দোলনের প্রস্তাবটিও গৃহীত হলো না। ব্রিটিশ সরকারের ভয় ছিল, খাজনা বন্ধ আন্দোলন গৃহীত হলে তারা বিপদে পড়বে—গান্ধী সরকারকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করলেন। বহু জেলা থেকে খাজনা বন্ধ আন্দোলন স্থানীয়ভাবে পরিচালনার জন্য গান্ধীর কাছে অনুমতি চাওয়া হলো। গান্ধী তাঁদের ভর্ত্সনা করলেন।২২

গান্ধী দেখতে পাচ্ছিলেন, সাত দফার অসহযোগ ক্রমে ক্রমে কৃষক-জনতার আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে। গান্ধী চাইছিলেন না তাঁর হাত থেকে খিলাফত-অসহযোগের নিয়ন্ত্রণ সাধারণ মানুষের হাতে চলে যাক। তিনি সে জন্য আন্দোলন বন্ধ করার সুযোগ খুঁজছিলেন। ঠিক তখনই চৌরিচৌরা গ্রামের সংঘর্ষের ঘটনার খবর আসে। চৌরিচৌরা গ্রামের কৃষকদের সমাবেশের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে কৃষকেরা থানা আক্রমণ করেন, কৃষকদের হাতে ২২ জন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু ঘটে। গান্ধী আন্দোলন বন্ধ করার সুযোগ পেলেন, তিনি চৌরিচৌরার হিংসাত্মক ঘটনাকে কারণ দেখিয়ে আন্দোলন বন্ধ করলেন। জঙ্গি উলেমার দল এই ঘটনায় গান্ধীর ওপর অসন্তুষ্ট হন। মুসলমানরা মনে করলেন, গান্ধী তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভেঙে গেল, বিপরীতে সারা দেশে দেখা দিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। জিন্নাহ এই ভয় করছিলেন এবং তিনি শুরুতে তা গান্ধীকে এবং কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সতর্ক করে দিয়েছিলেন। খিলাফত দাবিগুলোর গায়ে ধর্মীয় আবরণ থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে এটা ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু খিলাফতের গণজাগরণকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আখ্যা দেওয়ার অসুবিধা এই যে ১৯২২ সালে কামাল পাশা খিলাফত তুলে দিলে আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। মুসলিমদের দিক থেকে ধর্মীয় কারণেই এর শুরু, ধর্মীয় কারণেই এর শেষ। জিন্নাহর কথাই ঠিক হলো, খিলাফতের পর থেকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক খারাপ হতে থাকল। হিন্দু উগ্রবাদী দলগুলো মাথা চাড়া দিল, বিপরীত দিকে নানা ইসলামি সংগঠন দাঁড়িয়ে গেল।

জিন্নাহ কংগ্রেস ছেড়ে চলে গেলেও কোনো হীনম্মন্যতার পরিচয় দেননি। জিন্নাহ ১৯২৪ সালে লীগ নেতৃত্বের একাংশের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও মুম্বাইয়ের লীগ অধিবেশনে কংগ্রেসের বহু হিন্দু নেতাকে আমন্ত্রণ জানান এবং লীগ প্রতিনিধিদের সামনে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ দেন। অনুরূপভাবে গান্ধীর সভাপতিত্বে ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন জিন্নাহ। যখন ১৯২৫ সালে মাহমুদাবাদের রাজা, যিনি নিজেকে প্রথমে মুসলমান বলে ঘোষণা দেন, জিন্নাহ তখন তাঁকে কঠোরভাবে বলেছিলেন, ‘না, তিনি প্রথমে ভারতবাসী পরে নিজেকে মুসলমান বিবেচনা করবেন।’২৩ তিনি ১৯২৭ সালে লীগ অধিবেশনে কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেমিশে শাসন সংস্কারের কাজে হাত দেন এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের পথ বাতলান। জিন্নাহ ১৯৩৪ সালেও নিজেকে প্রথম ভারতবাসী এবং পরে মুসলমান বলে দাবি করছেন। তিনি খুব যুক্তিসংগতভাবে তখনো বলছেন, ‘মুসলমানদের স্বার্থ উপেক্ষা করলে কোনো ভারতবাসী কখনো তাঁর স্বদেশের সেবা করতে সমর্থ হবেন না। কারণ, মুসলমানদের উত্সাহ দিয়ে এবং তাঁদের রাষ্ট্রের জন্য সুযোগ্য নাগরিক সৃষ্টি করেই কেবল আপনারা স্বদেশের সেবা করতে সক্ষম হবেন।’২৪ জিন্নাহর এই বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হবে, ব্রিটিশদের বিভাজন নীতি ভারতে যেভাবে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে তুলছিল, তিনি তার বাস্তবতা এবং ভবিষ্যত্ রূপটা বুঝতে পারছিলেন। সেই দূরদর্শিতার কারণেই ভারতের জনসংখ্যার এক বড় অংশ মুসলমানরা যাতে কখনো আহত না হন, নিজেদের নির্যাতিত সংখ্যালঘু না ভাবেন, সেই জন্যই তিনি মুসলমানদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এর পেছনে তাঁর সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা করে ব্রিটিশ শক্তিকে হিন্দু-মুসলিমবিরোধ কাজে লাগানোর সুযোগ না দিতে।

ব্রিটিশ সরকার শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার উদ্দেশ্যে ১৯২৭ সালে সাইমন কমিশন গঠন করে। ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দল সাইমন কমিশনকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং মতিলাল নেহরুকে একটি পৃথক খসড়া শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিমদের একটি বড় অংশ পৃথক নির্বাচনের পরিবর্তে শর্ত সাপেক্ষে যুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা গ্রহণে রাজি হয়। জিন্নাহর শর্ত কংগ্রেস মেনে কথা বললেও সংবিধান রচনার সময়ে হিন্দু মহাসভা ও শিখদের বিরোধিতায় মতিলাল তা করতে পারলেন না। জিন্নাহর ঐক্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি মুসলিম লীগের রাজানুগত মহম্মদ শফি, আগা খানদের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলনে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল দুটো বিষয়ের ওপর—আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের মতো ভারতে স্বশাসনের প্রচলন হোক এবং সংবিধানে যত দিন পর্যন্ত মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি সংযুক্ত না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা বজায় থাকুক। ১৯২৯ সালেই মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার্থে জিন্নাহর বিখ্যাত ১৪ দফা দাবি উত্থাপিত হয়। জিন্নাহ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বাইরে থেকে ভারতীয় মুসলমানদের একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। কিন্তু মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গেও তাঁর ঠিক বনিবনা হচ্ছিল না। জিন্নাহ একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে রাজনীতি ছেড়ে লন্ডনে বসবাস করতে থাকেন।

জিন্নাহ ১৯৩৪ সালে লন্ডন থেকে স্থায়ীভাবে ভারতে ফিরে এসে মুসলিম লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিন্নাহ মূলত রাজনীতি একেবারে ছেড়ে দিয়েই লন্ডনে থাকার জন্য মনস্থির করে ফেলেছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগের কতিপয় ব্যক্তির অনুরোধে তিনি ভারতে ফিরে এসে মুসলিম লীগের হাল ধরলেন। জিন্নাহ তখন ভিন্ন এক মানুষ, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যদিও ১৯৩৪ থেকে ’৩৭ সাল পর্যন্ত জিন্নাহ কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ’৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ খুব খারাপ ফল করা সত্ত্বেও তিনি মনে করেছিলেন কংগ্রেসের মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগকে রাখা হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে কংগ্রেস উদারতা না দেখালে জিন্নাহ ভিন্নপথে হাঁটতে শুরু করলেন। জিন্নাহ মনে করতে শুরু করলেন, হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে ঐক্য সম্ভব নয়। যা করার মুসলমানদের নিয়ে আলাদাভাবেই করতে হবে।

রফিক লিখেছেন, ‘বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে এদিক থেকে কংগ্রেসের দায়িত্ব ছিল কিছুটা বেশি। কিন্তু কংগ্রেসের উচ্চমন্যতা, মুসলিম লীগকে বিশেষ করে জিন্নাহর প্রাথমিক প্রস্তাবগুলোকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। কংগ্রেস মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনা ও জিন্নাহর অবমূল্যায়ন করেছিল।’ তিনি এ পর্যন্ত নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করছেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবোধ ও বিরোধ সামনে নিয়ে ভারতীয় রাজনীতির পার্শ্বপরিবর্তন এবং দুই ভিন্ন পথ ধরে চলার দায় কি এককভাবে জিন্নাহর?’২৫ জিন্নাহ সম্পর্কে তিনি লিখছেন, নওরোজি, গোখেলের ভাবশিষ্য জিন্নাহ তাঁর ৪০ বছর বয়সে জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকাকালীন ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিতে দ্বিধা করছেন না। ১৯২৪ সালের মে মাসে লাহোরে অবস্থিত মুসলিম লীগের এক সভায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ভারতে ইংরেজ শাসনের স্থায়িত্বের কারণ হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্য।২৬ রফিক খুব সচেতনভাবে সত্যি কথাগুলো বলতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলছেন জওহরলাল নেহরুর অপরিণামদর্শী নানা বক্তব্য সম্পর্কে, যেখানে নেহরু বলেন, ‘ভারতীয় রাজনীতিতে এখন একমাত্র দুটো পার্টিই রয়েছে, যথা কংগ্রেস ও ব্রিটিশরাজ। সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহ উত্তর ছুড়ে দেন এই বলে যে মুসলিম লীগ তৃতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসের সমান যুক্তিসংগত সমান অংশীদার।’২৭

রফিক স্বীকার করেন, নেহরু এ ধরনের অপরিণামদর্শী মন্তব্য আরও করেছেন। তিনি এ কথাও বলেন, বারবার জওহরলাল নেহরুর এ ধরনের অদূরদর্শী, অরাজনৈতিক মন্তব্য ভারতভাগকে অনিবার্য করে তোলে। এমনকি বারবার জওহরলাল নেহরুর এই ধরনের বক্তব্যে আজাদ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কখনো কখনো গান্ধীও অপরিণামদর্শী মন্তব্য করেছেন। গ্রন্থাকার এসব বিবরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সততা ও নিরপেক্ষতা রক্ষা করছেন। কিন্তু তিনি কংগ্রেস রাজনীতির একটি বিশেষ অধ্যায় নিয়ে কিছু বলছেন না। যখন জিন্নাহ কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আসেন সেই সময়ে গান্ধী ও কংগ্রেস দলের সঙ্গে জিন্নাহর বিরোধটা কোথায় ছিল? তিনি বলেননি রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেসের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের কথা। বলেননি কগ্রেসের সব বড় নেতা গান্ধী নামক এক ব্যক্তির জিম্মায় দলটিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। জিন্নাহ কেন কংগ্রেস ছাড়লেন? কারণ, কংগ্রেসের পুরোনো এই নেতা দেখতে পেলেন দলের গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে গান্ধী নামক এক ব্যক্তির কাছে। গান্ধীর প্রতি এটা জিন্নাহর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল না। প্রথম দিকে গান্ধীকে জিন্নাহ মহাত্মা গান্ধী বলতেন। পরে মহাত্মার ক্ষমতার লোভ দেখে চমকে উঠলেন। জিন্নাহ দেখলেন, গান্ধী নামক মহাত্মাটি কংগ্রেসকে তাঁর ব্যক্তিগত রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে তুলতে চাইছেন। জিন্নাহ এটা মেনে নিতে পারেননি।

গান্ধীর জনপ্রিয়তা তখন এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে কংগ্রেস কর্মপরিষদের সর্বময় কর্তৃত্ব গান্ধীর ওপর অর্পণ করা হয়। গান্ধী এ ব্যাপারে সামান্য আপত্তি তুললেন না। তিনি কংগ্রেসের মতো একটি দলে গণতন্ত্রের চর্চা হতে না দিয়ে নিজের কর্তৃত্বকে বড় করে দেখলেন। ভয়াবহ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় এখানে এসে, আর তা হলো, অখণ্ড ভারত মানেই কি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র? যারা অখণ্ড ভারত চাইছে সেই দলের মধ্যেই তো গণতন্ত্র ছিল না। দলের ভেতর সব রকম গণতন্ত্র বিদায় দিয়ে বলা হলো গান্ধীর কথাই দলের জন্য আইন। গান্ধী যাঁকে দলের সভাপতি করবেন, তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। দলের ভেতর গান্ধীর এই স্বৈরাচার মানতে চাননি সুভাষচন্দ্র বসু। গান্ধী সে জন্য দ্বিতীয়বার সুভাষ বসুকে দলের সভাপতি হতে দিতে চাননি। সেটা ১৯৩৯ সালের ঘটনা।

সত্যি বলতে, আহমদ রফিক ১৯৩৭ থেকে ’৪৭ সাল পর্যন্ত সময়কালকেই প্রধানত তাঁর গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। ’৩৭ সাল দিয়েই তিনি গ্রন্থের আলোচনা শুরু করেছেন। ’৩৭ সাল থেকে তিনি সামনে এগিয়ে গেছেন, কখনো কখনো বা পেছনে ফিরে অতীতের ঘটনাবলির প্রসঙ্গ টেনেছেন। গ্রন্থের শুরুর দিকের কিছু ভূমিকা বাদ দিলে ’৩৭ সালের নির্বাচন দিয়েই তাঁর গ্রন্থের যবনিকা উত্তোলন। বিশেষ করে বঙ্গের কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হক এবং কংগ্রেস প্রসঙ্গ এই ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। তিনি দেখান, কংগ্রেসের বিভ্রান্তিকর ভূমিকার কারণে মুসলিম লীগ কীভাবে বাংলায় প্রভাব বিস্তার শুরু করে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস বঙ্গে আসন লাভ করে ৫২টি, বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ৩৯টি, কৃষক প্রজা পার্টি ৩৬টি, স্বতন্ত্র ৪৩টি এবং ত্রিপুরা কৃষক সমিতি ৫টি। কৃষক প্রজা পার্টির প্রধান ফজলুল হক কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস তাতে রাজি না হলে ফজলুল হক বাধ্য হন মুসলিম লীগের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করতে। কংগ্রেস কেন রাজি হয়নি? বিপান চন্দ্র এ সম্পর্কে বলছেন, ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস যে কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করতে পারল না, তার কারণ কৃষক প্রজা পার্টির প্রস্তাবিত কৃষি আইন সমর্থনে কংগ্রেসের অনীহা ছিল। কংগ্রেস দলে জমিদারদের প্রভাবের দরুন বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের বড় অংশ কৃষি সংস্কারের বিরোধিতা করে। হিন্দু ভূস্বামীদের একাংশ, প্রধানত ছোট জমিদারেরা কংগ্রেসকে সমর্থন করতেন এবং নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীদের ওপর নির্ভর করতেন।২৮

কংগ্রেস যে মূলত ভূস্বামী এবং সুবিধাভোগীদের সংগঠন বা রাজনৈতিক দল ছিল, গবেষক মহলে এ নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। কংগ্রেস সে কারণেই জমিদারদের স্বার্থরক্ষার জন্য ফজলুল হকের মতো অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি এবং কৃষক প্রজা পার্টির মতো অসাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে সরকার গঠনে যোগ দেয়নি। মুসলিম লীগকে কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে যুক্তভাবে সরকার গঠন করতে দিয়ে কংগ্রেস ভূস্বামীদের স্বার্থে মুসলিম লীগের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। মুসলিম লীগও ছিল ঠিক একইভাবে জমিদার ও জায়গিরদারদের দল। হক মন্ত্রিসভা কৃষকদের স্বার্থে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করে, কিন্তু মুসলিম নেতৃত্ব তাঁকে খুব বেশিদূর এগোতে দেয় না। মুসলিম লীগ শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয়বার যখন কৃষক প্রজা পার্টি কংগ্রেসের সাহায্য চায়, একইভাবে কংগ্রেস নেতারা পুনরায় ব্যাপারটাকে অগ্রাহ্য করেন এবং ফজলুল হক দ্বিতীয়বার বাধ্য হন হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি হিন্দু মহাসভার সদস্যদের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করতে। আহমদ রফিক ১৯৩৭ সালের নির্বাচন এবং ফজলুল হকের দু-দুবার সরকার গঠনের ঘটনাগুলো সুন্দরভাবে বর্ণনা করলেও কংগ্রেসের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে যোগ না দেওয়ার মূল কারণটি ব্যাখ্যা করেননি, যে কারণটির কথা বলেছেন বিপান চন্দ্র। কিন্তু এই ঘটনার ভেতর দিয়ে যে বাংলায় মুসলিম লীগের শক্তি ও জনপ্রিয়তা পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পায়, তা চমত্কারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন রফিক। কিন্তু পুনরায় স্মরণ রাখতে হবে মুসলিম লীগের এই সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছিল বিশেষ একটি মহলের মধ্যে, সব জনসাধারণের মধ্যে নয়।

রফিক লিখেছেন, ‘লক্ষণীয় যে ফজলুল হক ও প্রজা পার্টিকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে সুস্থ ধারা বিকশিত হচ্ছিল, তা কংগ্রেসের চিত্তরঞ্জন-সুভাষপন্থী ধারার সঙ্গে মিলে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী ধারার বিকাশ ঘটাতে পারত। আর তা শুধু বঙ্গীয় রাজনীতিরই নয়, সর্বভারতীয় রাজনীতির জন্য ভিন্ন পথনির্দেশ করতে পারতো।’২৯ ‘বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়ে অসাম্প্রদায়িক যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের একটা বড় সুযোগ তৈরি হয় এবং বঙ্গের সংসদীয় রাজনীতির সম্প্রদায়নির্ভর ধারাবদলের সুযোগ কংগ্রেস দলের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য হাতছাড়া হয়ে যায়। ফজলুল হকের প্রজা পার্টি তৃণমূল স্তরের মুসলমান ও নমঃশূদ্র হিন্দু সমর্থনে একটি অসাম্প্রদায়িক দল। নীতিগত দিক থেকে মুসলিম লীগের চেয়ে কংগ্রেসের কাছাকাছি।...হুমায়ুন কবিরের বক্তব্যও এদিক থেকে ভিন্ন নয়। তাঁর ভাষায়, ফজলুল হকের অব্যাহত আহ্বানে সাড়া দেয়নি বলে বঙ্গে একটি অসাম্প্রদায়িক মন্ত্রিসভা গঠনের সব সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। ফজললু হককে ঠেলে দেওয়া হয় মুসলিম লীগের দিকে।’৩০ লেখক এরপর যে ভয়াবহ সত্যটি বলেন তা হলো, কংগ্রেসের এই আঘাত বঙ্গে মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে, দেশবিভাগের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

গ্রন্থটিতে একটি বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে পরিষ্কার যে লেখক নিজে দেশভাগের পক্ষে নন এবং পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধে। প্রথম দিকে দেশভাগ চাননি গান্ধী-নেহরু এবং কংগ্রেস। যদিও ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষ তখন বেশ কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই প্রতিটি প্রদেশ যদি আলাদা আলাদাভাবে স্বাধীনতা চাইত, সমস্যা কী ছিল? প্রশ্নটি অবশ্যই গুরুত্ববহ। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রসঙ্গে। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ইউরোপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলের জাতিগুলো কিন্তু প্রায় প্রতিটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। ইতিহাসে সে জন্যই সেই সময়কে ইউরোপের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ, রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিষ্টান পোপের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে প্রতিটি জাতি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবেই নিজেদের দেখতে চেয়েছিল। বিরাট ভারতবর্ষও তেমনি অনেকগুলো জাতিতে বিভক্ত ছিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রশ্নে তাদের সবারই আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কথাটা ভাবাই স্বাভাবিক ছিল। ভারতবর্ষ কি একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হতে পারে? ভাষা-সংস্কৃতি ও নৃতাত্ত্বিকভাবে পারে না। বহুকাল ধরে ভারতবর্ষ নামক ভূখণ্ডটি কতকগুলো রাজার রাজ্যে বিভক্ত ছিল। কখনো কখনো সাম্রাজ্য শক্তির দ্বারা বিজিত হয়েছে—বিশেষ করে করদ রাজ্য হিসেবে।

মোঘলদের পর ইংরেজরা ভারতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য জাতীয়তাবাদী কোনো আন্দোলন কি এখানে হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে, সেই জাতীয়তার ভিত্তি কী ছিল। ভাষাকে ঘিরে, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্টকে ঘিরে সেটা হয়নি। পাশ্চাত্যের পরিভাষায় ‘জাতি’ বলতে যা বোঝায়, ব্রিটিশ শাসনের আগে ভারতে সেই রকম ধারণা বিকাশ লাভ করেনি। রাজা বা সামন্তশাসিত ভারতের মানুষের মনে ছিল ‘রাজ্য’ বা ‘দেশ’ সম্পর্কে চেতনা। নিঃসন্দেহে এই দেশ চেতনার মধ্যেও সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু বিভিন্ন আর্থ-রাজনৈতিক কারণে সেখানে ভারত বিচ্ছিন্নতার কোনো স্থান ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে ‘জাতি’ গঠনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেখানেও ভারত ভূখণ্ডের ধারণা ছিল। জাতিসত্তার প্রশ্নটি ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলন আর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এক নয়। ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তবে স্বরূপটি কী? কিসের ভিত্তিতে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ দানা বেঁধেছিল? রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে, জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, ভাষা, ধর্ম বা সংস্কৃতিকে ঘিরে। ভারতবর্ষের মানুষ কোন ধারণাটির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল? সে প্রশ্নের জবাব কী? কংগ্রেস নিজেকে যতই জাতীয়তাবাদী দল বলুক না কেন কংগ্রেস এই প্রশ্নের সমাধান করতে পারেনি।

ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গোড়াতেই নানা সমস্যা রয়ে গিয়েছিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম পর্বে তাই হিন্দুত্বের জাগরণ দেখা যায়। পরে কংগ্রেস হিন্দু মহাসভার সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। সত্যিকার অর্থে ভারতবর্ষকে অখণ্ড জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে দেখার সুযোগ থাকে হিন্দুধর্মকে ঘিরেই। না হলে আর কোনো বিষয়ই নেই, যাকে ঘিরে ভারত এক ভূখণ্ডে মিলিত হতে পারত। সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গান্ধীকে তাই রামরাজত্বের কথা বলতে হয়। হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিদের কংগ্রেস তাই কখনো অবহেলা করতে বা দল থেকে বাদ দিতে পারেনি। হিন্দু মহাসভার সাভারকার ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে বলেছিলেন, ভারতের হিন্দু জাতীয়তার মূল বনিয়াদ হলো: হিন্দু, হিন্দুধর্ম, হিন্দুত্ব ও হিন্দুরাজ।৩১ জিন্নাহর তিন বছর আগেই তিনি আরও বলেন, ভারতের জনসাধারণকে সমসদৃশ্য দুই জাতি বলে গণ্য করা যায় না। বলতে হয় দুই জাতি—হিন্দু-মুসলমান। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা নন। কথাটা রফিকও স্বীকার করেছেন, কিন্তু বলেননি জিন্নাহর আগে আর কে কখন সেই তত্ত্বটি দিয়েছিলেন। মুসলমানরা যখন জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করেন, সাভারকার তখন আগের মত পাল্টে হিন্দুদের পবিত্র ভূমির ওপর দাবি উত্থাপনকারী মুসলমানদের ‘বিদেশি’ আখ্যা দিয়ে ‘অখণ্ড ভারত’ ধ্বনি তোলেন। সাভারকারের মতে, ‘ভারতমাতা’ এক এবং অবিভাজ্য। ফলে সেই ভারতমাতাকে বিভক্ত করা হিন্দুরা বরদাশত করবেন না। কংগ্রেস বা গান্ধী সে সময় কী ভূমিকা নিলেন? গান্ধী তখন সাভারকারের মতের বিরুদ্ধে বলতে চেষ্টা করেন, ভারতবর্ষে ইংরেজ আবির্ভাবের আগে থেকেই হিন্দু-মুসলমান এক জাতি। তিনি আরও বলেন, আর যদি ভারতে কোনো রাষ্ট্র হিন্দুরাষ্ট্রই হয়, তাহলে হিন্দুধর্মের পরমতসহিষ্ণুতা সেখানে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের স্থান পাকা করে দেবে। গান্ধীও শেষ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের পরমতসহিষ্ণুতার কথাই বললেন। হিন্দুত্বেরই জয়গান গাইলেন। কথাগুলো গান্ধী লিখেছিলেন ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায়। হিন্দুদের মহত্ত্বকে তিনি মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। কিন্তু হিন্দু মহাসভাকে ছাড়তে পারলেন না।

ভারতের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চরিত্র প্রশ্নবোধক। সত্যিই কি এটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল? সব সময়ই দেখা গেছে, সংগ্রামের নামে আসলে ব্রিটিশ সরকারের কাছে কিছু দাবিদাওয়া পেশ করা। মুসলিম লীগ তো বটেই, এমনকি কখনো পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের জন্য ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেসও কোনো আন্দোলনে নামেনি। কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনও ছিল সরকারের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করে কিছু সুবিধা আদায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে পটপরিবর্তন হয়, তার ঢেউ লাগে ভারতীয় রাজনীতিতে। কংগ্রেস এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সুবিধা আদায়ের জন্য ব্রিটিশের সঙ্গে দর-কষাকষি শুরু করে। ইংল্যান্ডকে যুদ্ধে সাহায্য করার পরিবর্তে কংগ্রেসকে ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে দাবিদাওয়া রাখে। যার মধ্যে ছিল ‘জাতীয় সরকারের’ দাবি। সংগ্রামের পথ পরিহার করে সেই পুরোনো ইংরেজদের দয়া-দাক্ষিণ্য চাওয়া—এই হলো কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নমুনা। কংগ্রেসের কিছু কিছু নেতার মতের বিরুদ্ধে গান্ধী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করলেন। কিন্তু কংগ্রেস এই আন্দোলন থেকে কিছুই পায়নি, গান্ধীর বা আন্দোলনের নেতাদের নরমপন্থী চরিত্রের জন্যই সরকার কঠোরভাবে তা দমন করে। মুসলমানদের বড় অংশ এই আন্দোলনে যুক্তই হয়নি। মুসলিম লীগ এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল। গান্ধীর এসব হঠকারী আন্দোলনের আহ্বানের শেষ পরিণতি সবাই জানতেন। কিছু সাধারণ মানুষ গান্ধীর কথায় রক্ত দেবে, অত্যাচার সহ্য করবে, অতঃপর গান্ধী আন্দোলন থামিয়ে দেবেন। ব্রিটিশ সরকার নিজের সিংহাসনে অটল থাকবে।

বিপান চন্দ্র প্রমুখ লিখেছিলেন, ১৯৪৫ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি কংগ্রেস নেতারা জেল থেকে বের হয়ে ভেবেছিলেন, ১৯৪২ সালের চূড়ান্ত অত্যাচারের ফলে জনতা হয়তো হতোদ্যম হয়ে নিস্পৃহ রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছিলেন জনতা। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নেতারা এমন এক জনতাকে দেখতে পেলেন, যাঁরা ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে কিছু করার জন্য উদ্গ্রীব এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বস্তুতপক্ষে, জনতার এই তীব্র ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব নেতৃত্বের কাছে যুগপত্ উত্সাহ ও আশঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে কংগ্রেস নেতারা বুঝতে পারছিলেন না এই জনতাকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা কী হবে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয়ত যে ঘটনাটি ঘটে, তা হলো আজাদ-হিন্দ বাহিনীর কয়েকজন সেনানীর বিচার শুরু করল ব্রিটিশ সরকার দিল্লির লালকেল্লায়। সারা দেশ আজাদ-হিন্দ বাহিনীর সমর্থনে ও ব্রিটিশবিরোধিতায় ক্ষোভে ফেটে পড়ল। পরিহাস এমনই যে ব্রিটিশরা আজাদ-হিন্দ বাহিনীর যে তিনজনকে বিচারের জন্য বন্দী করেছিল, তাঁদের একজন হিন্দু পি কে সায়গল, একজন মুসলমান শাহনেওয়াজ খান এবং আর একজন শিখ গুরু বক্স সিং ধিলোন। ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলনের পর ৫ থেকে ১১ নভেম্বর ব্রিটিশ বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়, তবে তা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু যে ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে স্তম্ভিত করে দেয়, তা হলো ১৯৪৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির নৌ-বিদ্রোহ।

সবচেয়ে লক্ষণীয় যে বিদ্রোহীরা জাহাজের মাস্তুলে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্টদের পতাকা একসঙ্গে উড়িয়ে দেন। অর্থনৈতিক দাবির সঙ্গে জড়িত হয় রাজনৈতিক দাবি। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল ভালো খাদ্য ও সম্মানজনক ব্যবহার, আজাদ-হিন্দ ফৌজ তথা সব রাজবন্দীর মুক্তি, ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার প্রভৃতি।৩২ মুম্বাই, কলকাতা ও করাচিতে বিদ্রোহীদের সমর্থনে লাখ লাখ লোক রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন এবং ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত ও নিহত হয়েছিলেন শত শত মানুষ। ধর্মঘট চালানোর জন্য যে পর্ষদ গঠিত হয়, তার নেতা ছিলেন এম এস খান। রাজকীয় নৌবহরের নাম পাল্টে রাখা হয় ‘ভারতীয় জাতীয় নৌবাহিনী’। কিন্তু নেতৃত্ব কে দেবেন? বিদ্রোহী নেতারা আকুল হয়ে কংগ্রেস, লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি সবার কাছে আবেদন জানালেন। কিন্তু কংগ্রেস আবার নতুন করে হিংসার নিন্দা ও অহিংসার কথা বলতে লাগল। সত্যিকার অর্থেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভ ঘটেনি। ব্রিটিশরাজ বা তাঁর প্রতিনিধি মাউন্টব্যাটেনের দয়ার ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে মাত্র।

রফিক লিখেছেন, ‘বিপ্লবে নয়, বিদ্রোহে নয়, ভারতের ক্ষমতার হস্তান্তর আপসবাদী পথে। ব্রিটিশরাজের প্রতিনিধি হিসেবে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন তাঁর চতুর হিসাবমাফিক ভারত বিভাগের মাধ্যমে তাদের ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন।...কংগ্রেস ও লীগের পক্ষে এ অনুষ্ঠানের নায়ক যথাক্রমে জওহরলাল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।...ইতিহাস পর্যালোচনায় এ সত্য অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত যে জিন্নাহই দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা নন। লাহোর প্রস্তাবের বছর দুই-তিন আগে উগ্র হিন্দুত্ববাদী হিন্দু মহাসভা নেতা সাভারকারের বক্তব্যে শোনা গেছে এমন দাবি যে “হিন্দু-মুসলমান স্বতন্ত্র জাতি”।’৩৩ জিন্নাহকে গ্রন্থের লেখক আগের অধ্যায়গুলোয় দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল প্রবক্তা হিসেবে চিহ্নিত করে বর্তমান অধ্যায়ে সাভারকারের প্রসঙ্গটি টেনে নিরপেক্ষ একটি জায়গায় থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি শেষবিচারে জিন্নাহকেই খলনায়ক বানিয়েছেন। ফলে তিনি নিরপেক্ষ হতে চেয়েও একপক্ষে রয়ে গেছেন। তিনি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’—এ রকম একটা জায়গায় থেকে বহু সত্য স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। বা সেই সব তথ্য তাঁর জানা ছিল না। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদীরা অহিংস গান্ধীকে এমন পূজনীয় করে তুলেছিলেন যে জিন্নাহ তাঁর পাশে খলনায়ক ছাড়া কিছুই ছিলেন না। সময়ের কালপ্রবাহে গান্ধীর কর্ম বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে, জিন্নাহকে জানার কিছুটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

রফিকের গ্রন্থটির বিশেষ কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। দুর্বলতার মধ্যে প্রধান একটি হচ্ছে পুনরাবৃত্তি। যদিও গ্রন্থের শুরুতে লেখক এই পুনরাবৃত্তির কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু পুনরাবৃত্তি এক-দুবার নয়—কখনো তা এতসংখ্যকবার যে গ্রন্থটি পড়তে বিরক্তি ধরে যায়। বইয়ে কিছু কিছু মন্তব্য বা ঘটনা তিনি দু-চারবার নয়, সাত-আট বা দশবার পর্যন্ত করেছেন। না হলে বইটির পৃষ্ঠার সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমানো যেত। গ্রন্থটি ধারাবাহিকভাবে বহুদিন ধরে লেখা হয়। সে কারণে পুনরাবৃত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। পুনরাবৃত্তি বৃদ্ধির আরেকটি কারণ লেখক তাঁর ধারণা বা বিশ্বাসগুলোকে বারবার উপস্থিত করে পাঠকের মনে গেঁথে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু সেটা দোষের মনে হতো না যদি পুনরাবৃত্তিগুলোর বারবার ব্যবহারে তা বিরক্তিকর না হয়ে উঠত। প্রথম দিকে যত দ্রুত বইটি পাঠ করে এগোনো যায়, পুনরাবৃত্তির কারণে কিছুদূর এগোনোর পর আর সেটা হয় না। বিশেষ করে যাঁরা ভারতভাগ নিয়ে ইতিমধ্যে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন বা ভারতভাগের তথ্যগুলো যাঁদের কমবেশি জানা, পুনরাবৃত্তিগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের বিরক্তি উদ্রেক করবে। কিন্তু লেখককে এ ব্যাপারে ছাড় দিতে হয় তাঁর বয়সের কারণে। ৮৪-৮৫ বছর বয়সে এই ধরনের একটি বৃহত্ বই লেখাই বিরাট ধৈর্যের ব্যাপার। নিশ্চয় সে কারণেই ধারাবাহিকভাবে দেশভাগ নিয়ে লেখাগুলো গ্রন্থটি প্রকাশকালে খুব যত্ন নিয়ে সম্পাদনা করা গ্রন্থাকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু গ্রন্থের এটি দুর্বলতা। গ্রন্থের দ্বিতীয় দুর্বলতা হচ্ছে, তিনি যেমন নানা ঘটনার বহুল পুনরাবৃত্তি করেছেন, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য প্রদান করেননি। সে জন্য দেশভাগ সম্পর্কে নতুন পাঠকদের পক্ষে জিন্নাহকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা কঠিন হবে। জিন্নাহকে ভুল বোঝার অনেক অবকাশ থেকে যাবে।

জিন্নাহ যে ধনী মুসলমানদের স্বার্থে পাকিস্তান চেয়েছেন, সেটা মিথ্যা নয়। যখন কংগ্রেস দলের বিরাট ব্যক্তিত্ব জিন্নাহকে ছুড়ে ফেলে দেয়, মুসলমান ধনীরা তাঁকে মুসলিম লীগের প্রধান আসনে বসিয়ে তাঁর পুরোনো সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্বভাবতই জিন্নাহ তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। যাঁদের মাধ্যমে তিনি তাঁর হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছিলেন, তিনি তাঁদের স্বার্থরক্ষার জন্য লড়বেন, এটাই তো স্বাভাবিক। জিন্নাহ তবু পাকিস্তানের দাবি তোলেননি। চেয়েছিলেন মুসলমানদের জন্য কিছু অধিকার, কিন্তু কংগ্রেস তা মেনে নিতে রাজি ছিল না। জিন্নাহ এবং ভারতের এক-চতুর্থাংশ মুসলমানকে তাঁরা শক্তি হিসেবে দেখতেই রাজি ছিলেন না। জিন্নাহর জেদ বেড়ে গেল। শেক্সপিয়ারের নাটকের কোরিওলেনাসের মতো নিজের এবং মুসলমানের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। রফিকও লিখেছেন সে কথা। রফিক রাখঢাক না করেই বলেন, তখন জিন্নাহর একটাই লক্ষ্য, যেকোনো মূল্যে মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিচ্ছিন্ন মুসলিম রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তা না হলে হিন্দুপ্রধান কংগ্রেস রাজনীতির দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলা যাবে না।৩৪

বারবার দেখা যাবে তিনি সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে জিন্নাহ, গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, আজাদ প্রমুখ কাউকে দেশভাগের দায় এড়াতে দেননি। কিন্তু পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না, তিনি আজাদকে এর দায় থেকে অনেকটা মুক্ত রেখেছেন—ঠিক একইভাবে ভারতভাগের মূল দায়টি চাপিয়েছেন জিন্নাহর ঘাড়ে। তিনি দেশভাগের দায় থেকে ব্রািটশ শাসকদের মুক্তি দেননি, কিন্তু প্রধান খলনায়ক বা খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন জিন্নাহকে। রচয়িতা দেশবিভাগ: ফিরে দেখা গ্রন্থে জিন্নাহর ওপর তাঁর ব্যক্তিগত ক্রোধ লুকাতে পারেননি। তিনি সেটা চেষ্টাও করেননি। জিন্নাহ সম্পর্কে আয়েশা জালালের গবেষণাকে তিনি সামান্যতম বিবেচনার মধ্যে রাখতে চান না। যদি কেউ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, আহমদ রফিকের রচনাটি প্রধানত আয়েশা জালালের বক্তব্যের একটি বিরোধী তত্ত্ব হিসেবে আবির্ভূত। এ ব্যাপারে সামান্য ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে। রফিক লিখেছেন, ‘আয়েশা জালাল এবং পাকিস্তানবাদী লেখকদের এমন বক্তব্য যুক্তিনিষ্ঠ নয় যে জিন্নার পাকিস্তান প্রস্তাব বা দ্বিজাতিতত্ত্ব কংগ্রেস ও “রাজ’-এর সঙ্গে রাজনৈতিক চাপ ও দেনদরবারের হাতিয়ার।’৩৫ কিন্তু আয়েশা জালালের বক্তব্যকে জয়া ব্যাখ্যা করছেন এভাবে, ‘এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জিন্নাহকে মনে হয়, তিনি পাকিস্তানের ধারণাকে একটা “দর-কষাকষির প্রতিঘাত” হিসেবে প্রসারিত করেছেন। বলা হয়, জিন্নাহ ধারণা করেছিলেন যে কংগ্রেস দেশ বিভাগ এড়াতে খুবই উদ্বিগ্ন এবং ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোকে রাখার জন্য তিনি প্রয়োজনীয় যেকোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত।’৩৬

সত্যি হলো এই যে জিন্নাহর মনে যা-ই থাকুক না কেন, তিনি মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রদায়গত জাতীয়তাবোধের চেতনা জাগ্রত করেন। ইতিহাসে খুব কম গবেষকই জিন্নাহকে এ দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু জিন্নাহর রাজনৈতিক ইতিহাস হঠাত্ মাঝপথ থেকে শুরু করলে সেটা খুব বিচার-বিবেচনার বিষয় হয় না। তিনি কী করে এক বিরাট সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বিরাট ব্যক্তিত্ব হয়ে দাঁড়ালেন, সেটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। জিন্নাহর পুরোনো দিনের রাজনীতি সম্পর্কে লেখক তাঁর গ্রন্থে কিছুই বলেননি। তিনি কয়েকবার সরোজিনী নাইডু যে জিন্নাহকে ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত বলেছেন’, তাও স্বীকার করছেন। কিন্তু কী কারণে, কোন প্রেক্ষাপটে সরোজিনী নাইডু জিন্নাহ সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছিলেন, তা বলছেন না। যিনি একদা হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত ছিলেন, তিনি কেন হঠাত্ মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চাইছেন, তার ব্যাখা নেই সারা গ্রন্থের কোথাও।

ইতিহাসের গতিপথে শুধু ব্যক্তি জিন্নাহ বলে কিছু নেই। সমাজের কারও না কারও দাবির বাহন হচ্ছে সেখানে ব্যক্তি। জিন্নাহ মুসলমানদের আলাদা জাতি বলার জন্য বহুজনের কাছে খলনায়ক হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু জিন্নাহর বহু আগেই এই কথা উচ্চারিত হয়েছে ভারতে হিন্দু-মুসলমান আলাদা জাতি। কিন্তু পয়সার সে পিঠ উল্টে দেখতে চান না অনেকে। সম্প্রদায়গত রোয়েদাদের পর হিন্দু ভদ্রলোকদের সুযোগ-সুবিধা কমে গেল। বিশ শতক পর্যন্ত হিন্দু ভদ্রলোক এবং জমিদারদের জন্য যেসব মর্যাদার ভিত দীর্ঘদিন ধরে অক্ষুণ্ন ছিল, তা দৃশ্যত ভেঙে পড়তে শুরু করল। লর্ড জেটল্যান্ডের কাছে প্রেরিত বাংলার সব নামীদামি ও বড় বড় হিন্দু নেতার স্বাক্ষরিত এবং ব্যাপকভাবে প্রচারিত এক স্মারকলিপিতে বলা হলো, ‘বাঙলার হিন্দু সম্প্রদায়; তারা হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং সে কারণে অন্যান্য প্রদেশের সংখ্যালঘুদের প্রদত্ত নিরাপত্তার মতো তারাও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী। বাঙলার সংখ্যালঘু হিন্দুরা স্বীকৃত সংখ্যালঘুর অধিকার হিসেবে তাদের প্রাপ্য যথার্থ প্রতিনিধিত্বের দাবি করছে।’৩৭ যখন সংখ্যালঘু ভদ্রলোকেরা জেটল্যান্ডের কাছে সংখ্যালঘু হিসেবে নিরাপত্তা দাবি করেন, সেটা দোষের কিছু নয়, যখন জিন্নাহ মুসলমান সংখ্যালঘুদের হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে দেনদরবার করেন, সেটা হয়ে দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িকতা।

জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক ভূমিকাকে খাটো করে দেখার ইচ্ছা নিয়ে এই বিতর্ক সৃষ্টি করা নয়—ইতিহাসের বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে আসার এটা একটা প্রচেষ্টা। মূল বক্তব্য হলো সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজ নিজ চাহিদা থাকে। ইতিহাসে ব্যক্তির বা নেতার কর্মসূচি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা দরকার। যিনি ইতিহাস জানেন, তাঁর সত্য বলার দায়বদ্ধতা রয়েছে। ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রকাশ জিন্নাহর লাহোর প্রস্তাবের প্রায় ১০ বছর আগেই ঘটে গেছে। সেবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে কলকাতা টাউন হলের এক সভায় হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যোগদান করেন। সেখানে রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের অনেক মিল রয়েছে। তিনি বলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানদের পৃথক সাংস্কৃতিক সংশ্লিষ্টতা, তাদের শিক্ষা, ব্যক্তিগত আইন এবং অনুরূপ বিষয়ের প্রেক্ষিতে তাদের পৃথক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে...এ ধরনের যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণাই বাংলার জন্য উপযোগী হতে পারে।’৩৮ মুখোপাধ্যায়ের উত্থাপিত প্রস্তাবে হিন্দু-মুসলমান দুই জাতির ধারণা থেকে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের পার্থক্য কতটুকু? বরং হিন্দু-মুসলিম আইনের প্রশ্ন তুলে দ্বিজাতি বিষয়টিকে আরও জোরদার করা হয়। সন্দেহ নেই এটা ছিল সমগ্র বাংলার হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের গভীর হতাশা ও ক্রোধ এবং রোয়েদাদের চরম অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু শাসকদের আঘাত না করে সেটা পরিচালিত হয়েছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং শিক্ষিত হিন্দুরা মুসলমানদের তাঁদের থেকে আলাদা জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন জিন্নাহর দাবির ১০ বছর আগে।

স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতবাসীদের মধ্যকার এই লড়াই সম্পর্কে বহু কথা বলেছেন আহমদ রফিক তাঁর গ্রন্থে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বিরোধের বাইরে তিনি তাঁর আলোচনাকে বিস্তৃত করেননি। কিংবা বিস্তৃত করার মতো তথ্য তাঁর হাতে ছিল না। বর্তমানে দেশভাগের গবেষণা বা দেশভাগ সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি বহুদূর প্রসারিত হয়েছে। শুধু ধনিক শ্রেণির হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতির বাইরে আরও নানা দিকে তাঁরা দৃষ্টি চালিত করেছেন। সেখানে হিন্দু উচ্চবর্গের সঙ্গে হিন্দু নিম্নবর্গের বিরোধটাও গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে বাংলার নেতৃস্থানীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থরা ছিলেন মোট জনসংখার মাত্র ৬ শতাংশের মতো। বাকি চুরানব্বই শতাংশ হিন্দু শূদ্র বা শূদ্রদের থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি। ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিংশ শতকের ত্রিশের দশকেও মুসলমানরা জাতীয় স্তরে সম্প্রদায়ে পরিণত হননি। বিশেষ করে বাংলা ও পাঞ্জাবে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দায় সব মানুষের কাছেই অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো প্রাধান্য পায়।৩৯ সেগুলোকে সাম্প্রদায়িকতা বলা ঠিক নয়। মুসলমানরা নিজেদের আর্থিক সুবিধালাভের দিকে তাকিয়েছিলেন, হিন্দুধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেননি। জয়া চট্টোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন যে ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বর্ণভিত্তিক সমাজের পুরোহিততন্ত্রের কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ১৯৩৩ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় এম সি রাজা অস্পৃশ্যতা বিলোপ বিল উত্থাপন করলে বাংলার প্রত্যেক হিন্দু সদস্য ওই বিলের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। পণ্ডিত সত্যেন্দ্রনাথ মনে করেন, ‘তাদের পেশা, তাদের আচার-আচরণ ও তাদের সংস্কৃতির জন্য তারা কখনো বর্ণহিন্দুদের সমপর্যায়ে আসতে পারে না।’ অমরনাথ দত্ত ঘোষণা করেন, ‘এই লোকগুলো আগে অধিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হোক, অধিক পবিত্র হোক এবং জীবনের উত্তম আদর্শ লালন করুক...তখন আমি তাদের সঙ্গে মেলামেশা করব।’ বি পি সিংহ রায় বিলকে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তা ‘হিন্দুদের ধর্মীয় অধিকারের ওপর অনধিকার প্রবেশ এবং হিন্দু সমাজের ভিত্তিকে অবমূল্যায়ন করার প্রয়াস’।৪০ ফলে অস্পৃশ্যরা বর্ণহিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে যেতে চেয়েছিলেন। মুসলমানদের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও সাম্প্রদায়িক বিভেদের তাহলে আরও কারণ ছিল।

আগেই রফিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। গ্রন্থের শেষের দিকে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা নিয়ে কিছুটা কথা বলা যেতে পারে। প্রথমত, তাঁর শেষ অধ্যায়ের কয়েকটি পঙিক্ত তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি সেখানে বলছেন, ‘বিভাগোত্তর ছয় দশকেরও বেশি সময়-পর্বের রাজনৈতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে আজ প্রশ্ন উঠতে পারে, পূর্বোক্ত পরিস্থিতি কি এতটাই নিয়তিনির্ধারিত ছিল যে দেশ বিভাগের কোনো বিকল্প ছিল না? পথ কি মাত্র একটিই ছিল যে অন্য কোনো পথে ক্ষমতার হস্তান্তর সম্ভব ছিল না?’ মন্ত্রী মিশন প্রস্তাবে আজাদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল...মুসলিম স্বার্থে জিন্নাকে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও ভারতের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা করা হোক। কখনো কখনো গান্ধীও এমন ধারণা পোষণ করেছেন। কিন্তু কংগ্রেসি চরমপন্থীরা ভারতমাতাকে খণ্ডিত করতে রাজি, তবু শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা হাতছাড়া করতে রাজি নন। প্যাটেল তাঁদের মধ্যমণি।...আর জিন্নাহর পথ তো একটাই ছিল যে পথের শেষে একটি মাত্র মাইলফলকে চাঁদতারাসহ আট অক্ষরে খোদিত শব্দ “পাকিস্তান”।’৪১ কথাগুলো রফিক ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই নতুন কথা নয়। যাঁরা দেশভাগ নিয়ে গবেষণা করছেন বা প্রচুর পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা সবাই জানেন বহু বছর ধরেই এসব বক্তব্য আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু রফিকের বলা সত্যের ভিন্ন দিকও রয়েছে।

নতুন গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের জায়গায় শুরু হয় হিন্দুত্ববাদের জয়গান, যা শুরু থেকেই শিক্ষিত মুসলমানদের হিন্দুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ব্রাহ্মসমাজ, প্রার্থনা সমাজ বা আর্যসমাজ বা পরে গঠিত হিন্দুসভা, হিন্দু মহাসভা—সবই পরিচালিত হতো উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা। বিশেষ করে হিন্দু মহাসভা সচেতন হয়েই নানাভাবে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল, মুসলমানদের সম্প্রদায়গতভাবে খাটো করার চেষ্টা করেছিল। উচ্চবর্গের হিন্দুদের তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের মুসলমান শাসকদের সম্পর্কেও নানা ধরনের কুত্সা এবং মনগড়া নেতিবাচক কথা বলে মুসলিমদের সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার কাজটি করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ কোনো ধর্মরক্ষার সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়নি, মুসলিম লীগ ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার সংগঠন। ধর্ম হিসেবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার বা হিন্দুত্বকে খাটো করার চেষ্টা কখনো মুসলিম লীগের ছিল না। জিন্নাহ যখন মুসলিম লীগের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র বা পাকিস্তান দাবি করেন, তখনো তিনি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সামান্যতম কটু মন্তব্য করেননি। কংগ্রেসও ইসলাম সম্পর্কে কখনো সামান্য কটূক্তি করেনি। না গান্ধী, না নেহরু, না প্যাটেল। কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃত্বের মধ্যকার হিন্দু মহাসভার নেতারা বহু সময় মুসলমানদের সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন।

মুসলিম লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সাংবিধানিক প্রশ্নে, মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে—কিন্তু ধর্মীয় প্রশ্নে নয়। কংগ্রেস কখনো মুসলমানদের বা ইসলাম ধর্মকে আঘাত করেনি। মুসলিম লীগ সম্পর্কেও ঠিক সেই রকম কোনো অভিযোগ তোলা যাবে না যে সম্প্রদায়গত প্রশ্নের বাইরে তারা কারও ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করেছে। কখনোই না। ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সম্পর্কে এটা সর্বাগ্রে মনে রাখতে হবে, ভারতে যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ, সেটা সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক-সামাজিক বা বৈষয়িক স্বার্থকে ঘিরে, কখনোই ধর্মকে ঘিরে নয়। হিন্দু মহাসভা যে কাজটি বারবার করেছে, তা হলো ধর্মকে আক্রমণ। নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার এবং ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা। ফলে ধর্মীয় বিশ্বাসের সমন্বয়কে যেসব মুসলিম নেতৃত্ব সমর্থন করতেন, তাঁরাও ক্রমেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়তে থাকেন।৪২ স্বভাবতই মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রথম দায়ভার শিক্ষিত হিন্দুদেরই নিতে হবে। জিন্নাহর দায়ভার সে তুলনায় কম। কারণ, বর্ণহিন্দুদের দ্বারা নিগৃহীত মুসলমান সম্প্রদায়ের একজন হয়েও তিনিই প্রথম হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। জিন্নাহর উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, পরে তাঁর রাজনীতি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত জাতীয়তাবোধের চেতনা জাগ্রত করে, যা আবশ্যিকভাবে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ, ঘৃণা ও উগ্রতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। ফলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টিতে জিন্নাহর দায় কম নয়।

জিন্নাহর মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে বাড়তে সাহায্য করেছিল। কিন্তু জিন্নাহ মুসলিম লীগকে আগের মতোই অসাম্প্রদায়িক হিসেবে দাঁড় করতে পারতেন। তিনি তা করেননি। মুসলিম লীগের রাজনীতি খাকসার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার জনভিত্তিকে প্রসারিত করতে দ্রুত সাহায্য করল। সুনীল চন্দর বলছেন, এরপর থেকে মুসলিম লীগ তৃণমূল পর্যায়ে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অবস্থায় আসে। লীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা কংগ্রেসের মতো ‘ইউনিফর্ম’ ব্যবহার শুরু করলেন এবং বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুললেন। তাঁদের সঙ্গে থাকত ছুরি ও ছোরা। ১৯৩৯ সালের শেষ নাগাদ লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা ১৫ হাজার থেকে বেড়ে সাড়ে ১৮ হাজার হয়েছিল।৪৩ লীগের সাম্প্রদায়িক প্রচার গুরুত্ব পেয়ে যায় কংগ্রেসের কিছু প্রতীক বা স্লোগানের জন্য, যথা বন্দেমাতরম, বিদ্যামন্দির এবং রামরাজ্য। গান্ধীর রামরাজ্যর তাত্পর্য সাধারণ মুসলমানদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। হিন্দুদের সম্পর্কে মুসলমানদের ভীতি আরও বৃদ্ধি পেল, যখন হিন্দু মহাসভার বালাকৃষ্ণান শিবরাম মুসলমানদের প্রতিরোধ করার জন্য এক জাতীয় সামরিক বাহিনী বা ‘রামসেনা’ গঠনের আহ্বান জানালেন। প্রত্যুত্তরে জিন্নাহ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ জাতীয় বাহিনী গঠনের কথা বললেন।৪৪ নিঃসন্দেহে এর দায় জিন্নাহর একার নয়।

কিন্তু তারপরও সাম্প্রদায়িক বিভেদ বর্জন করা যেত। অথচ কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেই পথে যায়নি। ১৯৪৬ সালে আজাদ-হিন্দ বাহিনীর বিচার ও নৌ-বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে জনতার মধ্যে যে জাগরণ আরম্ভ হয়েছিল, মুন এই সময়কার আন্দোলনগুলো পর্যালোচনা করে বলেছিলেন, ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আজ আগ্নেয়গিরির কিনারায়। বিদ্রোহীরা প্রথমে গেলেন অরুণা আসফ আলীর কাছে, যিনি বিয়াল্লিশ আন্দোলনে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির হয়ে পালন করেছিলেন অগ্নিময় ভূমিকা। তিনি আশা করেছিলেন, কংগ্রেস এই হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে কাজে লাগাবে। কিন্তু জাতীয় নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? পুনা থেকে ১৯৪৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গান্ধী এক বিবৃতিতে বললেন, ‘হিন্দু, মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য এই যে “মিলন”, তা অশুভ।...এ বিক্ষোভের শক্তি সীমাহীন সন্দেহ নেই, কিন্তু এর ব্যবহার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে দেওয়া ঠিক নয়।’ নাবিকদের বিদ্রোহী পর্ষদ যখন মুম্বাইয়ের মানুষকে সাধারণ ধর্মঘট পালনের আবেদন জানায়, তখন ক্রুদ্ধ নেহরু বলেন, ‘ধর্মঘট কমিটির এ ধরনের আবেদনের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি এ সমস্ত জিনিস সহ্য করব না।’৪৫ তিনি নৌবাহিনীর বীরত্বের প্রশংসা করে বলেন, ‘সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা রক্ষা করাই মূলকথা এবং নৌ-বিদ্রোহীরা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করুক।’ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রথম থেকেই এর বিরোধী ছিলেন। তিনি বললেন, ‘কেন জনসাধারণ বিদ্রোহ ও বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছে, তা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। কংগ্রেসের নাম করে যে সমস্ত কংগ্রেসের লোক জনসাধারণকে বিদ্রোহের জন্য উস্কানি দিচ্ছে, আমি তাঁদের সম্বন্ধেও দেশবাসীকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি।’৪৬ কী রকম ভণ্ডামি আর ইংরেজদের দাসত্ব আর নিজ ভাইদের সঙ্গে বেইমানি, যা মীর জাফরকে হার মানায়। অরুণা আসফ আলী বলেছিলেন, দেশে এই পরিস্থিতিতে ব্যারিকেড লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সংহতি ফিরে আসতে পারে। তিনি ঠিকই বলেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানদের ঘৃণাটা মিলিতভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবাহিত হলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ অনেকটা ঘুঁচে যেত। কিন্তু গান্ধী অরুণা আসফকে বিরোধিতা করে বললেন, যখন ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলছে, তখন এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্তে তা বিলম্বিত হতে পারে। বিদ্রোহীদের তোপের মুখে ফেলে গান্ধীর কাছে ক্ষমতা লাভ তখন প্রধান হয়ে দাঁড়াল। বিদ্রোহ বা বিদ্রোহের পক্ষে জনতার আন্দোলন যে ন্যায়সংগত ছিল, সেটা বলতেও তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন। স্বাধীনতার পক্ষের মানুষগুলোকে বলির পাঁঠা বানানো হলো ক্ষমতা লাভ করে মন্ত্রী হওয়ার জন্য।

বাংলাভাগ তথা দেশভাগ ভারতের রাজনীতিতে নানা কারণেই গুরুত্ব পেয়েছে। বহুজন এই দিকের প্রতি নজর দিয়েছেন। দেশভাগ আর স্বাধীনতা একই সঙ্গে ঘটে। ব্যাপারটা একসময়ে এমন হয়ে দাঁড়াল যে দেশভাগ না হলে ভারত স্বাধীন হতে পারছে না। খুব জটিল সমীকরণ চলছিল তখন ভারতের অন্দরমহলে। ব্রিটেনের নবনির্বাচিত লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ভারতের বড়লাট ওয়াভেলকে বিলেতে ডেকে নিয়ে তাঁকে দিয়েই প্রকাশ্যে ভারতবর্ষকে অবিলম্বে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৯৪৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু সে বছর ভারতের ভাগ্যে স্বাধীনতা ঘটেনি, আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হলো। কিন্তু এই দুই বছর ভারতবাসীকে প্রতিপক্ষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়নি। ইরেজদের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছিল, ক্ষমতা হস্তান্তর কীভাবে সম্পন্ন করা হবে, সে ব্যাপারে ভারতবাসীর নিজেদের মধ্যে যে মুহূর্তে ঐকমত্য স্থাপিত হবে, সেই মুহূর্তেই ব্রিটেন ভারত ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুত।৪৭ ব্রিটিশ শাসকেরা এ কথাও বলেছিলেন, ভারতবাসীর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে তাঁরা খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে রাজি নন। ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কি না, এটা আর আলোচনার বিষয় ছিল না; বরং কত দ্রুত, কার কাছে এবং কী শর্তে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে, এটাই ছিল আলোচনার বিষয়। ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের ভেতর থেকেই একটা প্রকট তাগিদ ছিল। অথচ ইতিহাসের কী নিদারুণ পরিহাস, ইংরেজ প্রবলভাবে ভারত ছেড়ে যেতে চাইলেও ভারতীয়দের অনেক প্রভাবশালী অংশই তাঁদের মনেপ্রাণে বিদায় দিতে চাননি। ঠিক এই রকম এক জনগোষ্ঠীর নেতা জগজীবন রাম বড়লাট ওয়াভেলকে বলেন, ইংরেজ ভারত ত্যাগ করলে তাঁদের মতো তফসিলি জাতির মানুষের বর্ণহিন্দুদের উত্কট আধিপত্য সহ্য করে দিনাতিপাত করতে হবে। তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে অন্তত তাঁদের সমাজভুক্ত মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য ইংরেজদের আরও ১০ বছরের আগে ভারত ত্যাগ করা উচিত হবে না।৪৯

ঠান্ডা মাথায় দেশ বিভাগ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখা যাবে, সমস্যাটা শুধু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছিল না। দেশভাগ শুধু জিন্নাহর পাকিস্তান প্রস্তাবের কারণেও হয়নি, যা ছিল বহুকাল পর্যন্ত দেশ বিভাগের প্রধান তত্ত্ব। জিন্নাহ যেমন হিন্দুদের শাসনে থাকতে চাননি, ঠিক একইভাবে জগজীবন রাম হিন্দুদের শাসনে থাকতে চাননি। হিন্দুদের শাসনে থাকতে চাননি আম্বেদকর। বর্ণহিন্দুদের প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে ১৯৩৫ সালে আম্বেদকার নিজ সম্প্রদায়কে নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।৫০ গান্ধীর অনশনের কারণে তিনি মত বদলান। বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতার ব্যাপারে গান্ধীর ধারণার সঙ্গে তফসিলি সম্প্রদায়ের মতভেদ ছিল। বর্ণহিন্দুরা বা গান্ধী মনে করতেন, তফসিলিরা হিন্দুসমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু তফসিলিরা বর্ণহিন্দু-প্রভাবিত রাজনৈতিক সম্প্রদায়ে একীভূত হওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানায়। বি আর আম্বেদকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ধর্ম ও রাজনীতির বিষয়ে হিন্দু পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরই কেবল নিম্নশ্রেণির হিন্দুরা তাঁদের অবস্থার উন্নতি করতে পারবেন। তিনি যুক্তি দেখান, ‘হিন্দু ও মুসলমান, হিন্দু ও শিখ এবং হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের মধ্যকার মনোমালিন্য হিন্দু ও অস্পৃশ্যদের মধ্যকার মনোমালিন্যের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এই মনোমালিন্য ব্যাপক ও গভীর। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যকার মনোমালিন্য ধর্মীয়—সামাজিক নয়। আর হিন্দু ও অস্পৃশ্যদের মনোমালিন্য ধর্মীয় ও সামাজিক...।’৫১

বর্ণহিন্দুদের শোষণ থেকে মুক্তি বা আলাদা হওয়া শুধু জিন্নাহর একার দাবি ছিল না। দেখা যায় আরও অনেকে উচ্চবর্গের হিন্দুর থেকে আলাদা হতে চেয়েছিলেন। প্রশ্নটা হলো এই, কংগ্রেস ভারতীয়দের বা ভারতীয় সব সম্প্রদায়ের সংগঠন ছিল না। মুসলিমদের প্রশ্নে নেহরু বা কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল, তার প্রমাণ মেলে আজাদের সংরক্ষিত ৩০ পৃষ্ঠার মধ্যে। সেটা মোটেই সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিল না। খুব স্পষ্ট করে সেটা দেখিয়ে দেয়, এসব রাজনীতিবিদ নিজেদের সুযোগ-সুবিধামতো যেকোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতেন। ১৯৩৫ থেকে ’৩৭ সাল পর্যন্ত জিন্নাহ চেষ্টা করেছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে একটা আপসের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে। কংগ্রেসের অহম সেটা হতে দেয়নি বলে জিন্নাহ ভিন্ন রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলেন। জিন্নাহ তো একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, জোর করে আমাকে মুসলমানের দলে ঠেলে দেওয়া হলো। ইতিহাসের এসব সত্যিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সে কারণে অনেকেই ভারতভাগের দায় থেকে জিন্নাহকে মুক্তি দিতে চান। জিন্নাহর ব্যাপারটা না হয় বাদ দেওয়া গেল। মুসলমান ছাড়াও তফসিলি মানুষ, হরিজন, শিখ প্রভৃতি কোনো পক্ষই অপর পক্ষের সঙ্গে সহমত হতে পারছিল না। ফলে ইংরেজ যে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়, সেই স্বাধীনতার প্রকরণ ও সীমানা স্থির করার জন্য ভারতবাসী নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু করেছিল।

মাওলানা আজাদ সম্পর্কে রফিক মন্তব্য করছেন, ‘দুটো বিষয়ে তিনি নীতিগতভাবে অটল ও অনড়। যেমন সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতায়, তেমনি পাকিস্তান বিরোধিতায়। নেহরু-প্যাটেল যখন পাকিস্তান দাবির কাছে নতি স্বীকার করছেন, গান্ধী নীরব, গাফফার খান প্রবল প্রতিবাদী, তখন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সহকর্মীদের নীতিভঙ্গে ক্ষুব্ধ, আহত আজাদ নিঃশব্দে ঘরের এক কোণে বসে ক্রমাগত সিগারেট টেনে চলেছেন মনের অস্থিরতা চাপা দিতে।...ভারতের অখণ্ডতা বজায় রেখে ক্ষমতা হস্তান্তরবিষয়ক আজাদের কোনো প্রস্তাবই গান্ধী বা নেহরু বা কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মনঃপূত হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে নেহরু-প্যাটেল-প্রসাদ প্রমুখ সহকর্মী সবাই ক্ষমতার জন্য অস্থির হয়ে বরাবরের নীতি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, সেখানে তাঁর একক প্রতিবাদ গ্রাহ্য হবে না। তাই ওই অমোঘ দিনটিতে নীরবতাই প্রশস্ত মনে করেছেন আজাদ। গান্ধীও অবস্থাদৃষ্টে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেননি। তবে নেহরুকে আজাদ বলেছিলেন: “দেশভাগ মেনে নেওয়ার জন্য ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না”। কিন্তু নেহরু সে নীতিকথায় কান দেননি।৫২ মাউন্টব্যাটেনের দেশভাগসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রথম গ্রহণ করেন বল্লভভাই প্যাটেল। ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই তিনি প্রকাশ্যে বলতে থাকেন, মুসলিম লীগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য ভারতের একাংশ ছেড়ে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। আজাদ লিখেছেন, ‘এ কথা বলা বোধ হয় অন্যায় হবে না যে ভারত বিভাজনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল।’৫৩

যশোবন্ত সিং বলেই দিয়েছেন, ভারতভাগের পেছনের মূল কারণ জিন্নাহ বা তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব নয়। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, কংগ্রেস নেতৃত্বের ব্যর্থতাই এর জন্য বহুল পরিমাণে দায়ী। তিনি প্রধানত দোষী করেছেন জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেলকে। গান্ধী সম্পর্কেও তাঁর সমালোচনা রয়েছে। যশোবন্ত সিং বলতে চেয়েছেন, দেশভাগের জন্য বা পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য জিন্নাহকে যতই দোষ দেওয়া হোক, তিনি এভাবে দেশ বিভক্ত করতে চাননি। কংগ্রেসি নেতারা নিজেদের বাইরে অন্য কারও সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চাননি বলেই শেষ পর্যন্ত জিন্নাহকে দেশভাগের পথে ঠেলে দেওয়া হয়। জিন্নাহ চেয়েছিলেন, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ—মুসলিম-প্রধান অঞ্চলগুলোয় মুসলিম লীগের অধীনে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনসহ সরকার গঠনের অধিকার। ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার একমাত্র প্রতিনিধি মুসলিম লীগ—তিনি তাঁর এই দাবির স্বীকৃতিও চেয়েছিলেন। মুসলিম লীগের বাইরের কোনো মুসলমানকে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মুখপাত্র হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না। যশোবন্তের অনেক কথাই সঠিক। কিন্তু জিন্নাহর শেষের দাবি দুটির পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। তিনি গায়ের জোরে সব মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব দাবি করতে পারেন না। বিশেষ করে তিনি ছিলেন কিছু ধনী মুসলমানের প্রতিনিধি। সকল ধনী মুসলমানও তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। জিন্নাহ এ ব্যাপারে যথেষ্ট গোঁড়ামির পরিচয় দেন। যুক্তির বাইরে গিয়ে নিজের স্বেচ্ছাচারকে প্রাধান্য দিতে থাকেন। কিন্তু তারপরও দেশভাগের সেটা আসল কারণ নয়।

রফিক দেখাচ্ছেন, যখন দেশভাগ হচ্ছে, তখন নেহরু কংগ্রেসের সভাপতি হলেও প্যাটেলের ক্ষমতা তাঁর চেয়ে বেশি। এমনকি প্যাটেল তখন গান্ধীর চেয়ে বেশি ক্ষমতা ধারণ করছেন। তিনি লিখছেন, ‘সেই ক্রান্তিকালে কংগ্রেস রাজনীতিতে সরদারজিই দুই নম্বর নেতা, কিন্তু শেষ চালে তিনি গান্ধীকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ধীরস্থির স্বল্পবাক প্যাটেল।’৫৪ প্যাটেল যে কংগ্রেসের অলিখিত প্রধান নেতা তখন, এই বক্তব্যটি ভীষণ রকম সত্য। বলতে গেলে গান্ধীর হত্যার পেছনেও রয়েছে তাঁর হাত। গান্ধীকে যখন হত্যা করা হয়, প্যাটেল তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গান্ধী সম্বন্ধে আরেকটি সত্য উচ্চারণ করেছেন লেখক। তিনি বলছেন, গান্ধীর ভাবমূর্তি শুধু ভারতের একটি সম্প্রদায়কে মাতিয়েছিল—তিনি মুসলমান সমাজকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করতে পারেননি। যিনি নিজেকে ‘সনাতনপন্থী’ বলে জানান দেন এবং ‘গোরক্ষাকে তার ধর্ম’ বলে ঘোষণা দেন, তার পক্ষে কী করে মুসলমান হূদয় জয় করা সম্ভব? রফিক আরও বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সুতোটা হাতে তুলে নিয়েও তা ধরে রাখতে পারেননি গান্ধী তাঁর হিন্দুত্ববাদী প্রবণতা ও মহাসভাপন্থী সতীর্থদের প্রভাবে।৫৪

বিপান চন্দ্র, অমলেশ ত্রিপাঠি, বরুণ দে প্রমুখ তাঁদের ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম পুস্তকের প্রাসঙ্গিক অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন, এই সময়ে গান্ধীর অসহায়তার কারণ জিন্নাহর উগ্র দাবি কিংবা জিন্নাহ-অনুসারীদের ক্ষমতালিপ্সার মধ্যে পাওয়া যাবে না। যার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে, সেটি হলো তাঁর নিজের লোকদের সাম্প্রদায়িক চরিত্রের মধ্যে। ১৯৪৭ সালের ৪ জুন গান্ধী তাঁর প্রার্থনাসভায় নিজের লোকদের বলেছিলেন, ‘দেশভাগের দাবি গৃহীত হয়েছে যেহেতু তোমরা সেটি চেয়েছিলে। কংগ্রেস কখনো চায়নি এ রকম হোক। কিন্তু কংগ্রেস জনতার দাবি বুঝতে পারছে। কংগ্রেস অনুভব করছে হিন্দু ও খালসা শিখরা এটা চাইছে।’৫৪ প্রার্থনাসভায় গান্ধীর এই ভাষণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো হিন্দু ও শিখরা এই দেশভাগ চেয়েছিলেন। পাঞ্জাব ভাগে যেমন শিখদের ভূমিকা ছিল, বাংলা ভাগে ঠিক একইভাবে হিন্দুদের ভূমিকা ছিল। হ্যাঁ, তাদের পক্ষে যুক্তি এই যে পাকিস্তানের অন্তর্গত পাঞ্জাব এবং বাংলায় শিখ ও হিন্দুরা মুসলমানদের শাসনে থাকতে চাননি। নিশ্চয় তাহলে একই প্রশ্ন ঠিক এভাবেও করা যেতে পারে, উত্তর প্রদেশে ও দক্ষিণ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানরা কি হিন্দুদের শাসনে থাকবেন না? মূলকথাটি হলো, বাংলা বা পাঞ্জাব ভাগের দায় জিন্নাহ বা মুসলিম লীগের নয়।

মাউন্টব্যাটেন ভারতের ভাইসরয় হয়ে আসার পর গান্ধী ৩১ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত দিল্লির বড়লাটের সঙ্গে আলোচনা করলেন। ভারতের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য তিনি এক দুঃসাহসিক প্রস্তাব দিলেন ভাইসরয়কে। বললেন যে বড়লাট যেন তদানীন্তন অন্তর্বর্তী সরকারকে ভঙ্গ করে দিয়ে জিন্নাহকেই নিজ মনোমত সদস্যদের নিয়ে নূতন সরকার গঠন করতে আমন্ত্রণ জানান। জিন্নাহকে শুধু কথা দিতে হবে যে তাঁর মন্ত্রিসভা ভারতীয় জনগণের সামগ্রিক স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করবে। গান্ধী প্রতিশ্রুতি দেন যে যত দিন সেই সরকার ভারতবাসীর মঙ্গলজনক পন্থা অনুসরণ করবে, তত দিন কংগ্রেস যাতে জিন্নাহর সরকারকে আন্তরিক সমর্থন দেয়, তার ব্যবস্থা তিনি করবেন। কিন্তু কোন পন্থা দেশবাসীর জন্য হিতকর হতে পারে বা স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে, তার বিচারের ভার থাকবে স্বয়ং মাউন্টব্যাটেনের হাতে।৫৫ ৫ এপ্রিল থেকে জিন্নাহর সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের যে আলোচনা হয়, সে সময়ে তিনি জিন্নাহর কাছে গান্ধীর প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেননি। সম্ভাব্য কারণ, নেহরু গান্ধীর প্রস্তাব জানার পর এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত না থাকার ফলে গান্ধী এই রকম অবাস্তব সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন। গান্ধী অবশ্য ১১ এপ্রিল বড়লাটকে পত্র দিয়ে জানান যে কংগ্রেস তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।৫৬ গান্ধীর প্রস্তাবের পক্ষ সমর্থনকারী আজাদ পরবর্তীকালে জানান, দুর্ভাগ্যজনক যে প্যাটেল-নেহরু গান্ধীকে এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন।

জিন্নাহর সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের টানা এক সপ্তাহ আলোচনার পর বড়লাটের ধারণা হয়, ‘জিন্নাহ মানসিক রোগগ্রস্ত’। মাউন্টব্যাটেন তাঁর সচিবের কাছে মন্তব্য করেন, প্রথম দিনের আলোচনায় মাউন্টব্যাটেন একটানা যুক্ত ভারতবর্ষের পক্ষে যুক্তির জাল বিস্তার করেন। জিন্নাহ কোনো বিরুদ্ধ যুক্তি দেখাননি। তিনি এমন ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন যে কোনো কথা যেন তিনি শুনতেই পাচ্ছিলেন না। তিনি তাঁর মনস্থির করেই রেখেছিলেন। জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাত্কারের আগে মাউন্টব্যাটেন কখনো চিন্তা করতে পারেননি যে ‘এ-জাতীয় সম্পূর্ণ দায়িত্ববোধের অভাববিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির পক্ষে তাঁর মতো অত ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া’ সম্ভব। মাউন্টব্যাটেনের পক্ষেই জিন্নাহকে বাতিকগ্রস্ত মনে হওয়া সম্ভব। কারণ, নিজের চোখ দিয়ে তিনি নিজেকে দেখতে পাননি। মাউন্টব্যাটেন ভুলে গেছেন, জিন্নাহকে তাঁর মত গিলাতে পারলে তিনি মহানায়ক হয়ে ফিরে যেতে পারতেন। জিন্নাহ কি ভারতকে মাউন্টব্যাটেনের চেয়ে কম বুঝতেন? বিরাট জনগোষ্ঠী নির্বোধ বলেই কি জিন্নাহকে নেতা বলে মেনে নিয়েছিলেন। জিন্নাহ মুসলিম লীগের দায়িত্ব গ্রহণের আগের ২৫ বছরে মুসলিম লীগের সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ১ হাজার ৩০০। জিন্নাহ দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দুই বছরে সদস্যসংখ্যা দাঁড়াল এক লাখে। জিন্নাহর রাজনীতি বোঝার সাধ্য মাউন্টব্যাটেনের থাকার কথা নয়। তিনি সরকারের কাছ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক উন্নাসিক আমলা, জিন্নাহ সেখানে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত।

জিন্নাহর নীরব থাকাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নিজ লক্ষ্যে তিনি অবিচল—হতে পারে সেটা ভুল কিংবা ঠিক। বহু বছরে যার সমাধান হয়নি, মাউন্টব্যাটেন তা সমাধান করে দেবেন, জিন্নাহ তা বিশ্বাস করবেন কী করে। সবচেয়ে বড় কথা মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের পরেই ছিলেন জওহরলাল নেহরুর দূত। মাউন্টব্যাটেন ভারতে পা দেওয়ার আগেই লন্ডনে নেহরুর বিশ্বাসভাজন কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে কিছু আলাপ সেরেই এসেছিলেন। মাউন্টব্যাটেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে পরিচিত হন। লন্ডনে মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কৃষ্ণ মেননের সাক্ষাত্ ঘটে মার্চের ১৩ তারিখে। সেদিনের সাক্ষাতে মাউন্টব্যাটেনকে মেনন জানিয়েছিলেন, ‘পরিস্থিতির সমাধান হলো উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দুটি “পাকিস্তান” প্রতিষ্ঠা।’ কলকাতার বদলে পূর্ব পাকিস্তানের যে বন্দরের প্রয়োজন হবে, তার জন্য যতই ব্যয় হোক, চট্টগ্রামকে উন্নত করে পাকিস্তানের হাতে দেওয়া উচিত—এই অভিপ্রায় কৃষ্ণ মেনন ব্যক্ত করেছিলেন। কৃষ্ণ মেনন এরপরও বহুবার জওহরলালের প্রতিনিধি হিসেবে বড়লাট ও অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন।৫৭

বাংলাভাগের পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনার বহু আগেই হয়ে ছিল। জিন্নাহর সঙ্গে ভারতে মাউন্টব্যাটেনের যে আলোচনা হয়, সেই আলোচনার শেষে মাউন্টব্যাটেন স্পষ্ট করেই জিন্নাহকে জানান যে জিন্নাহকে হয় ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব স্বীকার করতে হবে আর না হলে খণ্ডিত পাঞ্জাব ও বিভক্ত বঙ্গসহ পাকিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। জিন্নাহ বললেন, পাঞ্জাব ও বঙ্গবিভাজনের দাবি কংগ্রেসের বড় ‘ধাপ্পা’। তিনি ভাইসরয়কে মিনতি করেন যাতে প্রদেশ দুটিকে বিভক্ত করা না হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘ইয়োর এক্সিলেনসি বোধ হয় জানেন না যে একজন মানুষ আগে একজন পাঞ্জাবি বা বাঙালি, পরে সে হিন্দু বা মুসলমান। ধর্ম যা-ই হোক, তার পরিচয়, সে বাঙালি বা পাঞ্জাবি। তার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, তার অর্থনীতি সবই এক। সে ক্ষেত্রে পাঞ্জাব বা বাংলা ভাগ করা মানে পাঞ্জাবি বা বাঙালিদের ভাগ করা। এর ফলে নতুন করে রক্তপাত হবে, দাঙ্গা হবে।’৫৮ জিন্নাহ এ কথাও বলেছিলেন, বাংলা যদি পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন অবিভক্ত থাকে, তিনি খুশি হবেন।৫৯ সোহরাওয়ার্দীও জিন্নাহর সঙ্গে একমত ছিলেন। কিন্তু বাধা এল হিন্দু-মুসলমান দুই পক্ষ থেকেই। লীগের ভেতর থেকে আকরম খাঁ প্রভৃতিরা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাতে থাকেন। জিন্নাহ তখন উপায় না দেখে দাবি করলেন, পাঞ্জাবকে বিভক্ত না করে পাকিস্তানে দেওয়া হোক। পুরো পাঞ্জাব পেলে তিনি বঙ্গের ওপর দাবি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে তাঁকে খলনায়ক বানানো হলো।

স্বাধীন বঙ্গের প্রস্তাবটি কংগ্রেস নেতারা মনে করলেন তফসিলি সম্প্রদায় ও হিন্দুদের দ্বিধাবিভক্ত করার চাল। শরত্ বসুও স্বাধীন ও অবিভক্ত বাংলার পক্ষে ছিলেন। গান্ধী শরত্ বসুকে লেখেন, ‘এটা আমার মনে হয় অর্জন করা তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না...তোমার উচিত হবে বাংলার অখণ্ডতার জন্য সংগ্রাম পরিত্যাগ করা এবং বঙ্গভঙ্গের জন্য যে পরিবেশ রচিত হয়েছে তাতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না করা।’৬০ পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের দায় সত্যিকার অর্থে কাকে নিতে হবে? রফিক আহমেদ তাঁর গ্রন্থে বহু সত্য কথা বললেও, খুব নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করলেও, বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগের প্রশ্নে বহু সত্য বলে যেতে পারেননি। গ্রন্থের রচয়িতা রফিক বলছেন, ‘ঘটনা স্পষ্টই বলে দেয় মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব, তথা ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত ভাগ করেছিলেন।’ কথাটি কি সত্যি? তিনি নিজেই তো বলছেন, ‘প্যাটেলদের মতো রক্ষণশীল সনাতনপন্থীরাও একই হাতির পিঠের সওয়ার।’ লেখকের পরের কথাটি কি প্রথম বক্তব্যকে নস্যাত্ করে দেয় না?

মাউন্টব্যাটেনকে লেখক ভারত ভাগের দায় থেকে রক্ষা করতে চাইছেন। কংগ্রেসকে ভারত ভাগের জন্য মৃদু তিরস্কার করে দেশবিভাগের সব দায় চাপাতে চাইছেন জিন্নাহর ওপর। কিন্তু জিন্নাহ কে, কতটুকু শক্তি তাঁর মাউন্টব্যাটেনের বিরুদ্ধে। মাউন্টব্যাটেনই তো বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগের হোতা। মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাগের জন্য বর্ণহিন্দুরা নানা রকম পথ বেছে নিয়েছেন। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের প্রধান দায় যে হিন্দু ভদ্রলোকদের, এ নিয়ে বিতর্ক নেই। জয়া চট্টোপাধ্যায় সেখানে নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে স্পষ্টই দেখাচ্ছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য আগে থেকেই যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল ভদ্রলোকদের। জয়া মনগড়াভাবে কিছু বলছেন না, বহু ভয়াবহ সব তথ্য দিচ্ছেন, যা বহুকাল জানা ছিল না। মাউন্টব্যাটেন যখন জিন্নাহর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলা-পাঞ্জাব ভাগ করতে পেরেছেন, তিনি ভারত বিভাগও ঠেকাতে পারতেন। মাউন্টব্যাটেন ভারতের সবগুলো প্রদেশকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে কে আপত্তি করত। ব্রিটিশরা চায়নি বলেই সেটা ঘটেনি—ভারত ভাগ হয়েছে। দেশ বিভাগের প্রধান দায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের। খলনায়ক তারাই। পাকিস্তান সৃষ্টিতে এবং দেশ ভাগের জন্য জিন্নাহর আচরণকে সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু জিন্নাহকে খলনায়ক বানানো যুক্তিসংগত নয়। মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহকে নয়, কংগ্রেসকে খুশি করতে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করেছিলেন। ব্রিটিশরা যদি ভারতবাসীর ওপর রোয়েদাদ চাপিয়ে দিতে পারে, ভারত ছাড় আন্দোলনে কংগ্রেসের সব নেতাকে জেলে পুরতে পারে, সেসব যদি নির্বিঘ্নে করতে পারে, ভারতকে স্বাধীনতা দিতে গিয়ে এত নাটক করতে হলো কেন?

রফিক বিচ্ছিন্নভাবে হঠাত্ এক জায়গায় মন্তব্য করেন, বাংলার ক্ষেত্রে নেহরুর ভূমিকা বিস্ময়করভাবে বাংলাবিরোধী। গ্রন্থাকার মিথ্যা বলেননি। ভারতের রাজনীতিতে বাংলার যে অগ্রণী ভূমিকা ছিল বাংলা যেভাবে একদা ভারতের রাজনীতিতে নেতৃত্বের স্থান দখল করেছিল, সেখান থেকে ভারতের অবস্থান নড়বড়ে করতে চায় দিল্লি এবং উত্তর ভারত-মহারাষ্ট্র। বাংলার বিরুদ্ধে বহু আগেই বিদ্বেষ প্রকাশ করেছিলেন সৈয়দ আহমদ। তিনি যেমন বলেছিলেন, ‘মুসলিম ও হিন্দু, উভয়কে একত্রে নিয়ে, তাদের প্রশ্ন করি, তারা কি বাঙালিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে, না পারবে না? অতি অবশ্যই না।...ফলাফল কী হবে যদি সমস্ত নিয়োগ করা হতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে। সমস্ত জাতির ওপর, কেবল মুসলিমদের ওপর নয়, বরং উচ্চ মর্যাদাশালী রাজাদের এবং যে বীরত্বব্যঞ্জক রাজপুতরা, যাঁরা পূর্বপূরুষের তরবারির কথা ভোলেননি, তাঁদেরও শাসনকর্তা হিসেবে রাখা হবে এক বাঙালিকে...সুতরাং, যদি আপনারা কেউ—সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষেরা, ধনী ব্যক্তিরা, মধ্যশ্রেণির মানুষেরা, অভিজাত পরিবারের মানুষ যাঁদের ঈশ্বর দিয়েছেন মর্যাদাবোধের অনুভুতি—আপনারা যদি স্বীকার করে নেন যে দেশ গোছাতে থাকবে বাঙালি শাসনের জোয়াল পরে, এবং দেশের জনগণ বাঙালিদের জুতো চাটবে...।’৬১ ব্যাপারটা বোঝাই যায় বাংলা সম্পর্কে বাইরের প্রদেশগুলো একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে নিয়েছিল এবং সেটা স্বাভাবিক ছিল। বাংলার অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে চাওয়া হয়েছিল নিজ নিজ প্রদেশের স্বার্থে।

রফিক তাঁর গ্রন্থে বারবার সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কথা বলছেন। গ্রন্থটি পাঠ করে মনে হয়, তিনি মনে করেন সাম্প্রদায়িক বিভেদ শুধু ধর্মকেই ঘিরে হতে পারে। ব্যাপারটা তা নয়, ভাষা বা আরও নানা প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে। বাঙালি-বিহারিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল ধর্মকে ঘিরে নয়। কারণ, উভয় পক্ষই ছিল মুসলমান। সামাজিক-প্রশাসনিক স্বার্থ নিয়ে দাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক মানসিকতা চাড়া দিতে পারে, বাংলা সম্পর্কে সৈয়দ আহমদের বক্তব্যে সেই দিকটাই টের পাওয়া যায়। সেখানে ধর্ম নয়, চাকরি-বাকরি সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে তিনি বাঙালিদের বিরোধী হয়ে ওঠেন। বাঙালিদের অধীন না থাকার জন্য তিনি বাংলার বাইরের হিন্দু-মুসলমান-রাজপুত সবাইকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চান। কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল? বিভিন্ন প্রদেশের কিছু নেতা বাংলা সম্পর্কে কিছুটা বিদ্বেষ প্রকাশ করতে আরম্ভ করল। স্বভাবতই বিভিন্ন প্রদেশের সাধারণ মানুষ তা করেনি, করেছিল অভিজাত এবং মধ্যশ্রেণি মিলিতভাবে। মুসলিম লীগের রাজনীতি ১৯৩৭ সাল থেকেই বাংলাকে গ্রাস করে এবং বাংলার সংখ্যাগুরু মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে ওঠে। জিন্নাহর পাকিস্তান দাবি বাংলা থেকেই সবচেয়ে জোর কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে। ঘটনাপরম্পরায় বাংলাভাগের দিকে ভারতের ইতিহাস ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে। কথাগুলো রফিকের। কিন্তু ইতিহাসের আশ্চর্য বৈপরীত্য হলো, মাত্র ৪২ বছর আগে ১৯০৫ সালে যে বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য দাবি উঠেছিল, কংগ্রেস এবং বাংলার হিন্দু নেতৃত্ব সেই বাংলাভাগে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান চাইলেও ১৯৪৭ সালে বাংলাভাগ চায়নি।

১৯৪৬ সালের দাঙ্গা সম্পর্কে মুসলিম লীগকে দোষারোপ করা হলেও বাংলাভাগে হিন্দু ভদ্রলোকদের কতিপয়ের দায়দায়িত্ব যে অনেক বেশি, সেটা বহুদিন ধরে স্বীকৃত। কারণ, এ বিষয়ে বহু দলিলপত্র রয়েছে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, বাংলার সাধারণ হিন্দুরা নয়, বর্ণহিন্দুরা বা সুবিধাভোগীরা ছিলেন এর জন্য দায়ী। বিশেষ করে হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং কংগ্রেসের ভদ্রলোক হিন্দু নেতারা মুসলিম লীগের শাসনে অবিভক্ত বাংলায় থাকতে চাননি। বাংলা কংগ্রেসের শরত্ বসুর ভূমিকা ছিল ভিন্ন, তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলাকে ভাগ করা থেকে বিরত ছিলেন। বাংলাভাগ সম্পর্কে হিন্দু ভদ্রলোকদের ভূমিকা নিয়ে মাত্র এক যুগ আগে চমত্কার সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছেন জয়া চট্টোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলা আবার ভাগ হয়। কিন্তু এ সময় প্রায় কারও কণ্ঠেই প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হল না, বরং, দ্বিতীয় বার বাংলা ভাগ নিশ্চিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে একটা সংঘবদ্ধ আন্দোলন পরিচালিত হল—যার লক্ষ্য ছিল ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশকে ভাগ করা।’৬২ তিনি তাঁর বিশ্লেষণে এমন সব তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন, যা ভয়াবহ। ফলে বাংলাভাগ বা দেশভাগ নিয়ে নতুন করে বহু পুরোনো মত বা ধারণাগুলো পাল্টে ফেলতে হয়।

গ্রন্থকার আহমদ রফিক জয়া চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণার এক যুগ পর লিখছেন তাঁর দেশবিভাগ: ফিরে দেখা। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, তিনি কি নতুন করে কিছু জানাতে চাইছেন পাঠকদের? গ্রন্থটির রচয়িতা রফিক তাঁর রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ‘প্রারম্ভকথা’য় জানাচ্ছেন, ‘দেশভাগ ও ক্ষমতার হস্তান্তরবিষয়ক রচনার পক্ষে সুযোগ বৃদ্ধি করেছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধিকতর তথ্যাদির প্রকাশ, নয়া দলিলপত্র, তত্কালীন শাসনকর্তাদের গোপন চিঠিপত্র, দিনলিপি, তারবার্তা, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। সেই সঙ্গে নব্য সমাজচিন্তার আলোয় বিষয়টি নিয়ে নানামাত্রিক পুনর্বিবেচনাও নতুন করে লেখার কারণ বা প্রেরণা দুই-ই।’৬৩ তিনি নতুন কী বলতে পেরেছেন, তা সাধারণ পাঠকদের কাছে খুব গ্রাহ্য না হলেও একজন গবেষক বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কারণ, দেশভাগ নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু দেশভাগ নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পেতে গবেষকমাত্রই আগ্রহী। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা সম্পর্কে রফিক তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করলেও কেন যেন তিনি জয়ার দেওয়া তথ্যগুলো ব্যবহার করেননি। তিনি শুধু বহু পুরোনো বিশ্বাসের মতো দাঙ্গার সব দায় সোহরাওয়ার্দী আর নাজিমউদ্দীনের ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছেন। জয়ার দেওয়া তথ্য জানার আগে পর্যন্ত বহু মানুষের সে ধারণাই ছিল। কিন্তু বাংলাভাগে জয়ার দেওয়া নানা তথ্য মানুষকে নতুন করে ভাবনাচিন্তার সুযোগ করে দিয়েছে।

জয়া চট্টোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন যে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার জন্য সোহরাওয়ার্দীকে দায়ী করা হয়। কিন্তু হিন্দু নেতারাও যে এই ঘটনায় গভীরভাবে জড়িত ছিল, এ সত্যটা তেমন সুবিদিত নয়। সেবারের দাঙ্গায় হিন্দুর চেয়ে অনেক বেশি মুসলমান নিহত হন। প্যাটেল ছিলেন নিরুদ্বিগ্ন এবং তিনি বিষয়টিকে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন, ‘হিন্দুরা এতে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হয়েছেন’। জয়া বলছেন, শক্তির এই বীভত্স প্রতিযোগিতায় ১৯৪৬ সালে হিন্দুদের প্রস্তুতি কম ছিল না। কারণ মনে রাখা দরকার, চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে কলকাতা ও মফস্বল শহরগুলোয় হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপের সংগঠন প্রতিষ্ঠার আধিক্য দেখা যায়। এই সব প্রতিষ্ঠান ভদ্রলোক যুবকদের দৈহিক যোগ্যতা অর্জন করতে এবং আধা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে উত্সাহ দিত। সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে সুসংগঠিত সংগঠন ছিল ভারত সেবাশ্রম সংঘ—এটা ছিল হিন্দু মহাসভার স্বেচ্ছাসেবক শাখা।৬৪ বাংলায় যখন দাঙ্গা সত্যি সত্যি আসন্ন হয়ে দাঁড়াল, তখন মহাসভার স্বেচ্ছাসেবীরা প্রস্তুত ছিলেন বাঁশের লাঠি, ছোরা ও দেশীয় পিস্তল নিয়ে নেতাদের পরামর্শমতো কাজ করতে। মুসলমানদের মতো হিন্দুরাও ১৬ আগস্ট যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, উভয় পক্ষই ছিল অস্ত্রসজ্জিত, তবে দলেবলে হিন্দুদেরই ভারী দেখা যায়। মুসলমান দাঙ্গাকারীদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিলেন পল্লি এলাকা থেকে শহরে আসা ভাসমান শ্রেণির লোক। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যে দাঙ্গায় জড়িত থাকায় বহু ভদ্রলোক হিন্দুকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নজরুল ইসলাম বলেন, বলা হয় মুসলমানরা বাংলা ভাগ করেছেন। বাংলাকে মুসলমানরা ভাগ করেননি, শূদ্ররাও ভাগ করেননি। নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য বাংলা ভাগ করেছেন ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ নেতারা। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্যাটেল ও নেহরুকে চিঠিতে লেখেন যে, পাকিস্তান হোক আর নাই হোক, বাংলার সীমানার মধ্য থেকে দুটো রাজ্য তৈরি করতেই হবে। কংগ্রেসের নেতা বি সি সিনহা লিখলেন, পুরো বাংলা ভারতে থেকে গেলেও মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় বাংলায় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। হিন্দুদের নেতৃত্ব স্থাপিত হবে না। কাজেই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাকে ভাগ করতেই হবে। বাংলাকে ভাগ করার জন্য কংগ্রেসের হিন্দু নেতারা হিন্দু মহাসভার সঙ্গে একত্রে আন্দোলন করেছিলেন।৬৫

দাঙ্গায় জড়িত হিন্দু জনতার গঠন সম্পর্কে আলোচনাকালে সুরঞ্জন দাশ লক্ষ করেন যে বাঙালি হিন্দু ছাত্র ও অন্যান্য পেশাজীবী বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক সক্রিয় ছিলেন। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী সওদাগর, শিল্পী, দোকানদার দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। মধ্য কলকাতায় একটি সভা ভেঙে দেওয়ার জন্য সাধারণের সঙ্গে ভদ্রলোকেরাও অংশগ্রহণ করেন। চক্ষুচিকিত্সক মোহাম্মদ জামাল হত্যাকারী জনতার মধ্যে ছিলেন শিক্ষিত যুবকেরাও, যাঁরা পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন।৬৬ বিস্ময়ের ব্যাপার যে হত্যাযজ্ঞের পর অব্যাহতভাবে অসন্তোষের মধ্যে মুসলমান জনতার মাঝে বোমা নিক্ষেপের জন্য হিন্দুদের মধ্য থেকে গ্রেপ্তারকৃত একজন ছিলেন বর্ধমানের বিশিষ্ট চিকিত্সক মহেন্দ্রনাথ সরকার। তিনি স্বীকার করেন, ‘এখন আমি একজন কংগ্রেস নেতা। আগে ছিলাম হিন্দু মহাসভার সদস্য। বাংলা বিভাগের পক্ষে আমি এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছি।’ জয়া ঘটনা বিশ্লেষণ করে বলেন, এটাই বাংলা বিভাগ এবং একটা পৃথক হিন্দু আবাসভূমি গঠনের জন্য হিন্দু আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। জয়া আরও জানাচ্ছেন, কিন্তু হিন্দুদের এই জঘন্য কাজকে কখনো স্বীকার করা হয়নি। হিন্দু সংবাদপত্র এই আক্রমণের জন্য দোষারোপ করে সোহরাওয়ার্দী সরকার ও মুসলিম লীগকে; আর এই হত্যাযজ্ঞকে গণ্য করা হয় ভবিষ্যতে মুসলমান শাসনের অধীনে বাঙালি হিন্দুদের ভাগ্যের ভয়াবহ অশুভ লক্ষণ হিসেবে।৬৭

জয়া চট্টোপাধ্যায় আবিষ্কার করেছেন, হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের প্রাদেশিক শাখাগুলোর সহায়তায় বাংলার অধিক সংখ্যক হিন্দু ১৯৪৭ সালে বাংলাভাগ ও ভারতের অভ্যন্তরে একটা পৃথক হিন্দু প্রদেশ গঠনের জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার চালান। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন গ্রহণে একশ্রেণির হিন্দুদের অস্বীকৃতি ছিল।৬৮ হিন্দুরা ভারত ভাগ করে হলেও মুসলমান শাসনের অধীন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং এই দাবিকে ন্যায্য মনে করতেন। কিন্তু এই বর্ণহিন্দুরা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ মেনে নিতে চাননি আর হিন্দুদের কর্তৃত্ব পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। তখন বঙ্গভঙ্গ তাঁরা চাননি, কারণ বাংলার শাসনক্ষমতায় তখন ইংরেজদের পর হিন্দুদেরই প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ১৯৪৬-৪৭ সালে বর্ণহিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। নিশ্চয় বর্ণহিন্দুদের যুক্তি ছিল। বাংলাকে পাকিস্তান বানাতে চাইলে, হিন্দু বাঙালিদের পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে চিরকালের জন্য রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারানো এবং তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অধীন থাকা। ফলে বাংলার ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। রফিক বাংলা ও পাঞ্জাবভাগ নিয়ে, বিশেষ করে দাঙ্গায় প্রাণনাশ, মানুষের অসম্মান ইত্যাদি ব্যাপারে কথা বলেছেন, কিন্তু যে সত্যটা বলতে পারেননি, তা হলো বাংলা ও পাঞ্জাবভাগের জন্য সামান্যতম দায়ী ছিলেন না জিন্নাহ। ভারতভাগের জন্য জিন্নাহকে কমবেশি দায়ী করা গেলেও বাংলাভাগের সম্পূর্ণ দায় ছিল মাউন্টব্যাটেন, নেহরু ও প্যাটেল এবং পশ্চিমবঙ্গের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়সহ বর্ণহিন্দুদের। পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে কথাটা প্রায় একইভাবে সত্য। জিন্নাহই তো একমাত্র জোরালোভাবে পাঞ্জাব আর বাংলাভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। বলতে হবে, হয় এই সত্য গ্রন্থকারের জানা ছিল না, নতুবা এখানে তিনি নিরপেক্ষ হতে পারেননি। জিন্নাহর যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা ছিল প্রদেশ দুটিকে ভাগ না করার ব্যাপারে।

জয়ার মতো বাংলাভাগ তথা ভারত বিভাগ সম্পর্কে নতুন কথা শোনাচ্ছেন বহুজন। নতুনভাবে বিশ্লেষণ করছেন ভারতভাগের ঘটনাকে। বাংলাকে ভাগ করেছিলেন বর্ণহিন্দুদের একটি বড় অংশ, ঠিক তেমনিভাবে ভারতভাগ ও বাংলাভাগ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা—জিন্নাহকে দায়মুক্ত করে সত্যি কথা বলা, নিরপেক্ষ ইতিহাস লেখার কাজটিও করেছে বর্ণহিন্দুদের নতুন প্রজন্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন মহাভারতের খলনায়ক দুর্যোধনের পক্ষে কলম ধরেন ‘গান্ধারীর শেষ আবেদন’ রচনায়, মধুসূদন দত্ত যেমন রামায়ণের খলনায়ক রাবণকে মহত্ হিসেবে প্রমাণ করে রামকে পররাজ্য গ্রাসকারী বলে প্রতিষ্ঠা দেন, ভারতভাগের খলনায়ক জিন্নাহর সম্পর্কে না জানা বহু সত্য বলে গিয়েছেন বর্ণহিন্দু পরিবারে জন্ম নেওয়া ইতিহাসবিদেরা এবং আরও অনেকে। উল্লিখিত ইতিহাসবিদদের সেই উদারতা শ্রদ্ধা পাওয়ার ব্যাপার তো বটেই, একই সঙ্গে তুলনাহীন। শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে শাইলককে বহুদিন পর্যন্ত খলনায়ক মনে করা হতো। সেভাবেই অভিনয় করতেন অভিনেতারা। কিন্তু লরেন্স যখন শাইলকের ভূমিকায় অভিনয় করলেন, শাইলকের জন্য দর্শকের চোখে জল এসে যেত। লরেন্স শেক্সপিয়ারের নাটককে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে দেখালেন, ইহুদি শাইলকের নিষ্ঠুরতার কারণ। দিনের পর দিন খ্রিষ্টানদের দ্বারা অপমানিত হতে হতে তাদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

জিন্নাহর রাজনীতির প্রথম দিকটি আর গান্ধীর রাজনীতির শেষ দিকটি সবার মনোযোগের অকর্ষণের বিষয় হতে পারে। রাজনীতির শুরুতে জিন্নাহর আর রাজনীতির শেষে গান্ধীর ছিল খুবই প্রগতিশীল ভূমিকা। গান্ধী প্রাণ দেন দেশভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রাপ্য সম্পদের ভাগ পাকিস্তানকে অর্পণ করার দাবি জানিয়ে—সে ভিন্ন ইতিহাস। বিশাল ব্যক্তিত্ব, ভীষণ জনপ্রিয় ভারতের জাতির পিতার শেষ পরিণাম বড়ই নির্মম। স্বাধীনতার পরপরই প্রাণ দেন গান্ধী, জিন্নাহ প্রাণ দেন স্বাধীনতার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। জিন্নাহ প্রাণ দেন আততায়ীর হাতে, গান্ধী প্রাণ দেন অসুস্থ অবস্থায় এবং খুবই অবহেলার মধ্যে। জিন্নাহর মৃতদেহ বিমানবন্দরে পড়ে ছিল বেওয়ারিশ লাশের মতো। বিশাল ব্যক্তিত্বের এই পরিণতি কে বিশ্বাস করবে! জিন্নাহ-গান্ধীর মধ্যে কে কতটা খারাপ আর ভালো, সে বিচারে না গিয়ে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য ভারতীয় ভদ্রলোকদের রাজনৈতিক ঘটনাবলির ভিন্ন একটি দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। জিন্নাহ জীবনের প্রথম দিকে যখন প্রগতিশীল রাজনীতি করেন, তিনি তখন সেভাবে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে দেখা দিতে পারেননি। তিনি জোরালোভাবে ভারতের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রসার ঘটাতে গিয়ে নানা ধরনের অবহেলার শিকার হয়েছেন, কখনো অপমানিত হয়েছেন। পুণ্যাত্মা গান্ধীর সামনে যুক্তি নিয়ে দাঁড়াতেই পারলেন না। কিন্তু যেইমাত্র তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বা বিভেদের রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়লেন, যুক্তির বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে উঠলেন অবিসংবাদী নেতা। যখন তিনি সমগ্র ভারতের জন্য স্বরাজ দাবি করলেন, কংগ্রেসে তাঁর জায়গা হলো নিচের সারিতে। রাজনীতি থেকে একবার অবসর নিয়ে পুনরায় যেই মাত্র জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য খণ্ডিতভাবে স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বললেন, তিনি হয়ে উঠলেন ‘কায়েদে আযম’। ব্রিটিশ শাসকেরা পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করতে শুরু করলেন। গান্ধীর ক্ষেত্রে কী ঘটল? যখন তিনি ভূস্বামীদের স্বার্থে ভারতের শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতির বিপক্ষে ‘রামরাজত্ব’ গড়তে চাইলেন, তিনি হলেন সর্বমান্য। ঠিক জীবনের শেষে এসে যখন তিনি অখণ্ড ভারতের জন্য জিন্নাহকে শাসনক্ষমতায় বসার মতো উদারতা দেখালেন, ভারতভাগের পর পাকিস্তানের জনগণের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে চাইলেন—কংগ্রেস তাঁকে ছুড়ে ফেলল। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক নেতা প্রাণ দিলেন দুর্ভাগ্যজনকভাবে। কংগ্রেসের তখন আর তাঁকে দরকার নেই।

ফিরে আসা যাক আবার আহমদ রফিকের গ্রন্থ প্রসঙ্গে। তিনি গ্রন্থে দেশভাগের পর দাঙ্গা, হত্যা ও হাজার হাজার নারীর অপমান নিয়ে দুঃখবেদনার কথা বলেছেন, নিশ্চয় সব পাঠক তাঁর সঙ্গে একমত হবেন। হতেই হবে, দেশভাগের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা সেটাই। মানুষের সেই হাহাকার, সেই সব আর্তি ভারতভাগের ইতিহাস থেকে কখনো মুছে ফেলা যাবে না। গ্রন্থের শেষে এসে লেখকও স্বীকার করছেন, বিষয়টা আসলে জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন। বহুজাতি ও বহুভাষী-অধ্যুষিত বিরাট জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। তিনি দেশভাগের সবটাকে নেতিবাচক মনে করছেন না। কিছু অর্জন তিনি দেখতে পান, আর তা হলো স্বদেশি রাজনীতিকদের হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু তিনি শেষ কথা বলছেন এভাবে, বিদেশি শাসকদের মর্জিমাফিক একটি দেশকে বিভক্ত করা হয়। জিন্নাহ ও গান্ধীর মনে যে এ কারণে দেশভাগের পর অনুতাপ হয়েছিল, তিনি সে কথাও উপসংহারে এসে পাঠকদের বলতে ভুলে যাননি। গ্রন্থকার সবার শেষে দেশভাগ সঠিক ছিল কি ছিল না, সেই বিচারের ভার ছেড়ে দেন পাঠকদের ওপর। গ্রন্থটির মাহাত্ম্য এখানেই। গ্রন্থকার আহমদ রফিক দেশভাগ নিয়ে পাঠকদের মধ্যে আবার যে চিন্তার সূত্রটি ধরিয়ে দেন, সে জন্য তাঁর রচনাটি বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। 

তথ্যসূত্র

১.         আহমদ রফিক, দেশবিভাগ: ফিরে দেখা, ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৫, পৃৃ. ১১-১২

২.         ওই, পৃ. ১৪-১৫

৩.        ওই, পৃ. ১৫

৪.         দ্রষ্টব্য, বিপান চন্দ্র, আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতা, কুনাল চট্টোপাধ্যায় অনূদিত, কলকাতা: কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, ১৯৮৯, পৃ. ২৪৭-২৯৯

৫.         আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭-১৮

৬.        দ্রষ্টব্য, এ জি বেলস্কি, ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদ: ঐতিহাসিক উত্স এবং তত্ত্বাদর্শগত ও রাজনৈতিক নীতি’, হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সমাজ, সুনীল ঘোষ ও প্রদ্যোত গুহ অনূদিত, কলকাতা: ভস্তক ১৯৯১, পৃ. ৩৮-৩৯

৭.         অবনী লাহিড়ী, তিরিশ চল্লিশের বাংলা, কলকাতা: সেরিবান ২০০৬, পৃ. ৯৩

৮.        দ্রষ্টব্য, এ জি বেলস্কি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০

৯.         নজরুল ইসলাম, মুসলমানদের করণীয়, কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ ১৪১৯, পৃ. ৩০, ৪১

১০.       শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, জিন্না: পাকিস্তান নতুন ভাবনা, কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. ১৩৯৪, পৃ. ১৯

১১.       ওই, পৃ. ১৯

১২.       ওই, পৃ. ৫

১৩.      আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬১

১৪.       সরল চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুস্তক পর্ষদ, পৃ. ১৫৫

১৫.       সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, আধুনিক ভারত: পলাশী থেকে নেহরু, কলকাতা: প্রগতিশীল প্রকাশক ২০১১, পৃ. ৫৬৭-৫৭০

১৬.      শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৩

১৭.       সরল চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৮

১৮.      শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭

১৯.      সরল চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭১

২০.       শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭

২১.       সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস, কলকাতা: প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স ২০১২, পৃ. ৬৯৪

২২.       সরল চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৫

২৩.      ওই

২৪.       শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬২

২৫.       আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬

২৬.      ওই, পৃ. ৩৬

২৭.       ওই, পৃ. ৩৭

২৮.      বিপান চন্দ্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৯

২৯.       আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৯

৩০.      ওই, পৃ. ৪২

৩১.      এ জি বেলস্কি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৪

৩২.      বলাই দত্ত, নৌবিদ্রোহ, পান্নালাল দাশগুপ্ত অনূদিত, কলকাতা ১৯৫৮, পৃ. ৫৩

৩৩.      ওই, পৃ. ৪৪৫-৪৪৬

৩৪.      আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৬

৩৫.      ওই, পৃ. ৩৭২

৩৬.     জয়া চ্যাটার্জী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬৪

৩৭.      ওই, পৃ. ২৯

৩৮.     ওই

৩৯.      শুচিব্রত সেন ও অমিয় ঘোষ, আধুনিক ভারত, কলকাতা: মিত্রম ২০০৮, পৃ. ২৭৪

৪০.       জয়া চ্যাটার্জী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২-৪৩

৪১.       আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫৬-৪৫৭

৪২.       শুচিব্রত সেন ও অমিয় ঘোষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮৯

৪৩.      ওই, পৃ. ৪১৭

৪৪.       ওই, পৃ. ৪১৭-৪১৮

৪৫.       দ্রষ্টব্য, সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৯৫

৪৬.      দ্রষ্টব্য, শুচিব্রত সেন ও অমিয় ঘোষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২৬

৪৭.       লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং ২০০৪, পৃ. ৯

৪৮.      জয়া চ্যাটার্জী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৯

৪৯.      লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯

৫০.       নজরুল ইসলাম, মুসলমানদের করণীয়, কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ ১৪১৯, পৃ. ৩৮

৫১.       জয়া চ্যাটার্জী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭

৫২.       আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮৫

৫৩.      দ্রষ্টব্য, সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯১১

৫৪.       আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮৫

৫৫.       ওই, পৃ. ৩৬৯

৫৬.      দ্রষ্টব্য. শুচিব্রত সেন ও অমিয় ঘোষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৯৪

৫৭.       লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১

৫৮.      শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬১-২৬২

৫৯.      ওই, পৃ. ২৬১

৬০.      ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়ের, ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, রবিশেখর সেনগুপ্ত অনূদিত, কলকাতা: এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড ১৩৯৭, পৃ. ১২৩

৬১.      শুচিব্রত সেন ও অমিয় ঘোষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৪৪

৬২.      ওই, পৃ. ৪৪৫

৬৩.     দ্রষ্টব্য, বিপান চন্দ্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৩-৯৪

৬৪.      জয়া চ্যাটার্জী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১

৬৫.      আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯

৬৬.     জয়া চ্যাটার্জী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭১-২৭২

৬৭.      নজরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬১-৬৩

৬৮.     জয়া চ্যাটার্জী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৬-২৭৭

৬৯.      ওই, ২৭৭

৭০.       জয়া চ্যাটার্জী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬৬