স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও গণতন্ত্র

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস—কামাল হোসেন
দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১৩।

আমি ও আমিত্বকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রেখে কামাল হোসেন ইতিহাস নির্মাণ করেছেন। ইতিহাস এমন জিনিস, যা একটু ঝেড়েমুছে নিলেই ঝকঝকে হয়ে ওঠে। জাতির ইতিহাসের ঝকঝকে ষাটের দশকের অন্যতম বরপুত্র কামাল হোসেনের হাতে ঝকঝকে হয়ে ওঠা সেই ইতিহাস। কত তথ্য এখনো অজানা। এই সেদিন আমি তাঁকে অবাক করতে পেরে আনন্দিত হলাম। তিনি যখন জেলে তখন অক্সফোর্ডে তাঁর ওয়ার্ডেন চিঠি লিখেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিবকে। ব্রিটিশ আর্কাইভস থেকে পাওয়া সেই চিঠি আমি তাঁর হাতে তুলে দিলাম। এমনকি তাঁকে এমন একটি নথি দিলাম, যেখানে তথ্য আছে যে লন্ডনের পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে কামাল হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে! ভাগ্যিস পরদিন ভুল সংশোধনী ছাপা হয়েছে।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাকশালে ম্লান একজন কামাল হোসেন মন্ত্রিসভা থেকে ‘ছুটি’ নিয়ে অক্সফোর্ডের অল সউলস কলেজে ফেলোশিপ পেয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেখানেই বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস লেখার সূচনা। বইটি ইউপিএল প্রকাশ করেছে ২০১৩ সালে।

১৯৫৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্ ঘটেছিল। সেই থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট মাঝখানে কয়েক সপ্তাহের বিরতিতে তাঁরা একত্রেই ছিলেন। ১৪টি পরিচ্ছেদের ঝাঁপিতে তিনি বন্দী করেছেন বাঙালির ইতিহাস। ১৮৭১ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত যে ছয়টি চ্যাপ্টার, যেখানে উত্তাল ষাটের দশক মূর্ত সেগুলো নিয়ে আমি আলোচনা করব। সপ্তম চ্যাপ্টারে ক্র্যাকডাউন ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, অষ্টমে রাষ্ট্রগঠনের চ্যালেঞ্জ, নবমে সংবিধান তৈরি, দশমে পররাষ্ট্রনীতিতে স্বাধীনতার আগের প্রবণতা, একাদশে বৈদেশিক সম্পর্কের উন্নয়ন, দ্বাদশে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, ত্রয়োদশে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ও সবশেষ চতুর্দশে জাতিসংঘে বাংলাদেশ।

আগেই স্বীকার করে নিই, এই আলোচনাটার একটা তির্যক ধারা আমি যথাসাধ্য রক্ষা করতে চাই, সেটা মূলত আত্মজিজ্ঞাসার একটা জায়গা থেকে। বিনয়ের কারণে নয়, অক্ষমতার ছোঁয়া যে থাকবেই, তাতে সন্দেহ অত্যল্প, আর সে জন্য লেখক ও পাঠক উভয় কুলের কাছেই করজোরে ক্ষমা চেয়ে নিই। হতে পারে এটা একটা জবরদস্তি। কারণ আমাদের সব মহত্ অর্জন আমরা এত পরিপাটি করে বুঝতে চাই যে, যাতে মনে হয় সেসব এতখানি মসৃণ ও মনোমুগ্ধকর হলে আমাদের আজকের এতটা রাজনৈতিক অধোগতি কেন। অবিভক্ত পাকিস্তান একটি অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচন করেছিল, যেন কেবল স্বাধীনতা হারানোর জন্যই। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ২৩ বছরে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে না পারার অপারগতার কারণেই কি পাকিস্তান টেকেনি? চারপাশের জগত্ অনেকটা বুঝে ওঠার আগ পর্যন্ত ‘পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী’ বলতে কল্পনায় খেলা করত এরা বুঝি রংচঙেও কিম্ভূতকিমাকার হবে। এরা বুঝি ভিনগ্রহের কেউ হবে। আমরা এদের চিনি না। ওঁরা আমাদের আত্মীয় নন। নাহলে বিনা রক্তপাতে আনা স্বাধীনতা কেউ এভাবে হারায়? কেবল ‘আমরা’ যদি রাষ্ট্র পাই, তাহলে সেখানে গণতন্ত্রের নহর বইবে। মানবসভ্যতা কত শত বছর আগে স্বায়ত্তশাসন, ফেডারেল সরকারব্যবস্থার মধ্যে বিকেন্দ্রীকরণ করা সরকারব্যবস্থা করার বুদ্ধি বের করে ফেলেছে। বহুজাতিগত, বহুধর্মগত ও বহুভাষাভাষী অর্থাত্ বহুত্ববাদী একটি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন ও তা থেকে সুফল লাভ করার কত শতাব্দী পর পাকিস্তান স্বাধীনতা পেয়েছে। সুতরাং গণতন্ত্রকে না বুঝতে পারা নয়, সমস্যা ছিল বুঝতে না চাওয়ার। ওরা গণতন্ত্রের কিচ্ছু বোঝেনি, আমরাই কেবল বুঝেছিলাম, এটা ত্রুটিপূর্ণভাবে সত্য, প্রকৃত সত্য হলে আমাদের কি এই দশা হয়!

জাতীয়তাবাদে আমাদের আনুগত্য আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠের বড়াই। আমরা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দিয়ে প্রথম গণতন্ত্রের সবক নিয়েছি। ১৯৫২ সালেই আমরা দাবি তুলতে পরতাম, কেবল বাংলা নয়, পাকিস্তানে উচ্চারিত সব মাতৃভাষা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

আমরা বলেছি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আমরা কখনো লক্ষ করিনি কেউ আহত হলো কি না। হলোই বা সংখ্যায় ওরা কত! এই সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র আমাদের বিরাট সর্বনাশ করেছে। আমাদের অন্ধ করে দিয়েছে। ৯০ ভাগের বেশি মুসলিম তাই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলে কুচ পরোয়া নেই। এই সমাজে এই বিষয়ে একধরনের কৃত্রিম মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করার ভান চলছে। ঠেকায় পড়লে অন্যের কাঁধে দোষ চাপায়, ভেতরে সমান রাঙা।

আমরা আমাদের পুরো মনোজগত্ তৈরি করেছি সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে। জাতিসত্তায় সংখ্যাতত্ত্বের প্রভাব তাই অতীব প্রকট। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সংখ্যালঘু হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর দাদাগিরি করে, এটা চলতে দেওয়া যায় না। আমরা সর্বস্ব দিয়ে এই একটি বিষয় পরাস্ত করতে চেয়েছি বলেই তো প্রতীয়মান হয়। ওয়ান ইউনিট ও প্যারিটির জিঞ্জির ভেঙে দিতে হয়তো এর বিকল্প ছিল না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, বিকল্প পথের সন্ধান করার মতো দলীয় গণতন্ত্র আমরা চর্চা করতে প্রস্তুত ছিলাম কি না? আমরা কি বহুমত ও বহুপথের দিশা খোঁজার চেয়ে ব্যক্তির প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে গণতন্ত্র বুঝিনি? এই বিষয়ে একটা গৌরচন্দ্রিকা দিয়ে রাখলাম, কারণ বই পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমি এদিকেই একটু বেশি হাঁটব।

বাংলাদেশের মতো একটি সমাজব্যবস্থা, যেটি এখনো প্রচণ্ড রকমের ভাঙচুর ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ইতিহাসনির্ভর কোনো বইয়ের পর্যালোচনা ও মূল্যায়নে সেসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা জরুরি, যেগুলো অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধ এবং ভবিষ্যতের পথচলায় একটা নির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমি ড. কামাল হোসেনের নতুন বই, যেটি লেখা শুরু হয়েছিল বিদেশ-বিভুঁইয়ে, সেটির পরিচ্ছেদওয়ারি আলোচনায় যাচ্ছি।

বইটির শুরু হয়েছে এটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যে সিকি শতাব্দীর ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের সন্ধানে দুটি নতুন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। উভয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘অগ্রসরমান মধ্যবিত্ত’ থেকে এসেছে। তিনি লিখেছেন, গত শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে বাংলায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানে মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছে। এটা আজ বেশি করে নজর দেওয়ার বিষয় যে, ১৯৭১ সালটি যে আমাদের জীবনে ঘনিয়ে এল সেটির প্রেক্ষাপটকে আমরা যদি কেবলই পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও বঞ্চনার আলোকে দেখি, তাহলে আমাদের জনগোষ্ঠীর বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা দুরূহ হতে পারে। কারণ সেটা খণ্ডিত হবে। আমরা কী পরিস্থিতিতে কী ধরনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় পশ্চিমের বৈষম্যের সঙ্গে লড়াই করেছি, সেটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। কারণ, বৈষম্য থাকলেই ছয় দফার মতো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। বিশ্বের বহু জনগোষ্ঠী চরম বৈষম্যমূলক অবস্থায় থেকেও ছয় দফা এবং বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে ধরে সামনে পথ চলতে পারেনি।

সুতরাং ড. কামাল হোসেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট কী করে সবার অলক্ষ্যে বাঙালি মুসলমানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বীজ বপন করেছিল। বাংলার মুসলমানরা তাদের সংখ্যার ভিত্তিতে প্রাদেশিক পরিষদে স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব এবং সব সরকারি পদে ৫৫ ভাগ সংরক্ষিত করে চুক্তি করেছিল ওই প্যাক্টে। গান্ধী ও সোহরাওয়ার্দী উভয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের অবিস্মরণীয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সুতরাং আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আজ বিক্রমপুরের সিআর দাশকে মাথায় তুলে নিতে হবে।

আমরা কি লক্ষ করব যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিকে সমতার অনুভূতি দিতে ‘বিশ ও ত্রিশ দশকের অগ্রসর হিন্দু ও বিরক্ত মুসলমানরা’ যেভাবে চুক্তি করেছিল সে রকম একটা আপস আমরা করতে পেরেছি কি না কিংবা সেটা করার জন্য একটা পরিবেশ সমাজে বিরাজমান রয়েছে কি না। সাতচল্লিশের আগে প্রভাবশালী হিন্দুরা নিশ্চয় খুশি হতেন, যদি মুসলমানসহ সব জাতপাতের মানুষ কেবল ‘ভারতীয়’ পরিচয়ে ভারতের মধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা ছিল না। কারণ নেতৃত্ব সর্বজনীন হতে পারেনি এবং তারা তা হতে কতটা উতলা ছিলেন সেটা এক বিরাট প্রশ্ন।

এর মধ্যে এটা আমরা দেখি যে অনগ্রসর মুসলিম সমাজকে টেনে তুলতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের ক্ষমতায়নকে ব্যবহার করা হয়েছে। মার্লো-মান্টোর সাংবিধানিক সংস্কার কমিশনে মুসলমানদের জন্য আলাদা ইলেক্টরেট বা পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করা হয়েছিল।

বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩) বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক বিভেদ সমাধানের লক্ষ্যে সম্পাদিত চুক্তি। সেই চুক্তির মডেল, বিশেষ করে তার চেতনা আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। সুতরাং সিআর দাশদের মতো যাঁরা আছেন তাঁদের পাঠ্যপুস্তকে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের ঐতিহ্যের গল্প কেবল ভাষা আন্দোলন থেকে উত্সারিত হয়নি। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বা কট্টর জাতীয়তাবাদ সব সময় খুব ভালো কিছু নয়। এটাকে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের পীড়নে পরিণত করেছি। বায়ান্নর সূতিকাগার বাংলাদেশের মহান অর্জন চূড়ান্ত মহিমা ছড়িয়েছে হিমালয়ের দেশ নেপাল। তারা এবার তার নতুন সংবিধানে লিখেছে, নেপালে উচ্চারিত সব ভাষা হবে নেপালের জাতীয় ভাষা। আমরা যদি এই বাক্যটি বাহাত্তরের সংবিধানে লিখতাম তাহলেই শহীদের আত্মা বেশি শান্তি পেত। আমরা এতকাল ভেবেছি, বাংলা রাষ্ট্রভাষা লিখে এবং পাহাড়িদের বাঙালি পরিচয় দিতে বাধ্য করে আমরা বুঝি ভালো কিছু করেছি। আসলে কালের পরিক্রমায় এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুত্ করে উপজাতিদের চোখের পানিতে বিদ্যুত্ বানিয়ে আমরা আত্মতৃপ্তি পেয়েছি। কিন্তু তা কৃত্রিম ছিল। অনগ্রসর অংশ, বিশেষ করে জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বায়ত্তশাসন না দিয়ে আমরাই খাল কেটে কুমির আনার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি। আমরা সার্বভৌমত্ব ও অন্যবিধ যুক্তিতে নীরবে শাসকদের সমর্থন দিয়েছি। অথচ ঐতিহাসিক ছয় দফা তা সমর্থন করে না।

চিত্তরঞ্জন দাশ প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারির নীতিতে আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার অংশীদারির ধারণার তীব্র খরা চলছে। হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে একদা যে দ্বেষ ছিল, তাই যেন এখন ভিন্নরূপে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে ফিরে এসেছে। কিন্তু পার্থক্য হলো বিশ্বসভ্যতা এগিয়েছে, কিন্তু বাংলায় অন্তত এই ক্ষেত্রে থমকে গেছে। ক্ষমতার ভাগাভাগি, তা নিয়ে আন্তদলের মধ্যেও বিরাট ঘাটতি। ক্ষমতার অংশীদারি দূরে থাক, ক্ষমতা কেবল ভোগ করলেই হবে না, তাকে নিরঙ্কুশভাবে ব্যবহার করতে হবে। চিত্তরঞ্জন দাশ যা এই একই ভূখণ্ডে পরাধীন ভারতে করতে পেরেছিলেন, তা এখন স্বাধীন ভূখণ্ডে অনেকের জন্য কল্পনা করাও কঠিন। ১৯৪৩ সালের শেষ দিকে বেঙ্গল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবুল হাশিম যে ধারার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে কামারুদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, উপমহাদেশে সেই সময়ের মুসলিম লীগপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে এই ধারাটিই ছিল সবচেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ।

আজ যখন কেবল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ঘটনাবলির দিকে তাকিয়ে অনেকে পূর্ব বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির অনুসন্ধান করেন, তখন তা যথাযথ বলে মনে হয় না, বরং দ্বন্দ্ব বাড়ে। তবে দেখার বিষয় হলো আবুল হাশিমরা মুসলিম লীগে থেকে এসব করে বেশি জুত করতে পারেননি। এমনকি কোণঠাসা হয়ে পড়েন, কামাল হোসেন যাকে আগাম অবসরে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে মুসলিম লীগের ভেতরে থেকেও একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যে সেই ধারার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেন তার অনুপম উদাহরণ আবুল হাশিম। সুতরাং সিআর দাশ ও আবুল হাশিমরা চিরসবুজ নায়ক। অথচ আমাদের দৈনন্দিন আলাপচারিতায় এই নায়কেরা এবং তাঁদের কর্মগাথা অনুপস্থিত।

ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘অসমতার’ ইস্যু ষাটের দশকে সব থেকে বিস্ফোরণোন্মুখ বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এখন আমাদের যেটা ঘাটতি সেটা হলো ষাটের দশক স্মরণ করতে গিয়ে ব্যক্তির ভূমিকা এতটাই বড় হয়ে আসে যে, সেই ‘অসমতা’ স্বাধীনতার পরে এই ভূখণ্ডের মানুষের, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে, তা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হওয়া বাকি থেকে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ‘অসমতা’কে দূর করার জন্য যে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা করা হয়নি, তার বড় উদাহরণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সৃষ্টি হওয়া এবং পার্বত্য চুক্তির পরে তা বাস্তবায়িত হতে না পারা। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনগ্রসর বঞ্চিত বাঙালির যে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি দানা বেঁধেছিল, তা একাত্তরের ডিসেম্বরের পরের বাংলাদেশে নতুন করে ফিরে এসেছে। ২২ পরিবারের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যায়নি। তার প্রমাণ ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ১১ লাখ লোক আয়কর প্রদান করে। এই অবস্থার বড় কারণ স্বাধীন বাংলাদেশ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে যেমন, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসনকে রাজনৈতিকভাবে অস্বীকার করেছে। এর ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার শরিকানা ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে শেখানোই হয়েছে তাদের উন্নতি মানে ‘আগের তুলনায়’ মানে বাপচাচাদের তুলনায় ভালো থাকা-খাওয়া। ভোট এলে শুধু ভোট দিবা। প্রার্থীরা কী প্রক্রিয়ায় আসবে-যাবে সেখানে তোমার ভোট লাগবে না। ষাটের দশকের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা ও বর্তমানে মন্ত্রী লেখককে বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমলে তো দলীয়ভাবেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হতো। আইয়ুব এসে বেসিক ডেমোক্রেসি করে সেটা বিলোপ করলেন। আমরা এখন সেটাই ফিরিয়ে আনছি।’ কিন্তু তিনি যেটা বলেননি সেটা হলো স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলিক গণতন্ত্র অর্থাত্ অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিজেদের লোক বাছাইয়ের চেষ্টাটাই বড় আকারে চোখে পড়ে। দলীয় ভিত্তিতে আনা হয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অধিকতর জনপ্রতিনিধিত্বশীল বা জনসম্পৃক্ত করার চিন্তা থেকে নয়, এটা মূলত রাজনৈতিক কৌশল। ম্যাকিয়াভেলিয়ান রাজনীতিই এর অন্তর্নিহিত দর্শন।

বাংলাভাষী ও বাঙালির রাষ্ট্রগঠনের জাত্যভিমান ও সংখ্যাগরিষ্ঠের বলদর্পী মনোভাব তাকে অনেক মৌলিক ক্ষেত্রে অন্ধ করে দিয়েছিল। সেই অন্ধত্ব আজও নানা ক্ষেত্রে চলছে। সামাজিক অসমতা দূর করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টাকে স্বাধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ঋণ ও নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসর্বস্ব বিষয় হিসেবে দেখেছে। শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলগত ধ্যানধারণায় দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী প্রধানত ষাটের দশকের ‘পূর্ব পাকিস্তানি’ হয়ে আছে। তারা বলছে, উন্নয়ন নাও, গণতন্ত্র দিতে পারব না। যদিও কথাটা ইদানীং শাসক দল তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে বলছে বলে বলাবলি হচ্ছে, আসলে এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। এই একই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দুই প্রধান ধারার শাসকগোষ্ঠী ষাটের দশকের ‘পূর্ব পাকিস্তানিদের’ জন্য বড় বড় দালানকোঠা ও বেশি বেতন-ভাতা ধরনের উন্নয়ন দিচ্ছে। সম্প্রতি আকস্মিকভাবে তারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনকে দলীয় ভিত্তিতে এনেছে এবং বিএনপি এর বিরোধিতা করছে কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনায় আগেও যা ছিল না এবং এখনো যা নেই, তা হলো অনগ্রসর মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্ন। তারা এমন কোনো কোটাব্যবস্থায় যেতে নারাজ যেখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তাদের ভূমি বিষয়ে নিরাপদ বোধ করতে পারে। সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি প্রভাবশালী মহল আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর পদ্ধতি দাবি করেছে। এটা এমন একটি প্রেক্ষাপটে, যখন উচ্চ আদালত এক রায়ে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আওতায় পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদকে দেওয়া স্বায়ত্তশাসনকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেওয়া হয়েছে।

জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ফেরেন্স গেওরেস তাঁর বই দ্য পলিটিক্যাল ডিসকোর্স অব স্পেশিয়াল ডিসপ্যারিটিস: জিওগ্রাফিক্যাল ইনইক্যুলিটিস বিটুইন সায়েন্স অ্যান্ড প্রোপাগান্ডাতে দেখিয়েছেন হাজার হাজার বছর ধরে সামাজিক অসমতার প্রশ্নটি ‘চিরসবুজ’ হয়ে আছে। তাঁর কথায়, ‘কারও এটা স্বীকার করা উচিত যে রাজনৈতিক মতাদর্শগত প্রশ্নে সমতার ইস্যুই মুখ্য ভূমিকা পালন করে’ (পৃ. ৫৭)। কিন্তু বাংলাদেশের রুগ্ণ রাজনীতিতে সত্যিকারের মতাদর্শগত বিভেদে ‘সমতার ইস্যু’ ছাড়া অন্যান্য উটকো যত বিষয় আছে তাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

অনগ্রসর মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে আজকের সংসদ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাঠামোতে তারা অপাঙেক্তয়। ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, পাঞ্জাবি সেনা ও আমলা প্রভাবাধীন ক্ষমতাকাঠামো শুধুই সামন্ত স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়, সেখানে একটি ধেয়ে আসা পুঁজিপতিদের পৃষ্ঠপোষকতাও আছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রে একটি প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারে ‘ক্ষমতা ভাগাভাগি’ কেবলই প্রতারণামাত্র।

কেন্দ্র থেকে অঞ্চলে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণই ছিল ছয় দফার মূলকথা। আর স্বাধীন বাংলাদেশ মোটা দাগে ওই একই সমস্যায় ভুগছে, কোথাও কেউ বিকেন্দ্রীকরণের ধারণাকে বিকশিত করতে নারাজ। এর বড় প্রমাণ কোনো একটি ক্রান্তিকালে আমাদের দেশটি একটি জাতীয় সরকার গঠনে অপারগ থাকতে পারে। কারণ ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা এতটাই পুঞ্জীভূত করা হয়েছে যে এখানে সমতার নীতি একেবারেই অস্বীকৃত রয়েছে। আর নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে তা বিরোধী দলকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পাঁচটি মন্ত্রণালয় দেওয়ার শর্তও তাই যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ মনে করা হয় না।

ড. কামাল তাঁর দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে ছয় দফা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তবে সেখানে যে বিষয়টি অনুপস্থিত তা হলো লাহোর প্রস্তাবের যথাযথ প্রতিফলন বাহাত্তরের সংবিধানে করতে না পারা। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তান কী কী পারল না তার বিবরণ আছে। কিন্তু আজ আমাদের দরকার আরও বেশি অনুভব করা আমাদের কী করার কথা ছিল, আমরা কেন করিনি। বা কেন করতে পারিনি ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সত্যিকারের ফেডারেশন’। বাহাত্তরে আমরা সমগোত্রীয়ের কথা বলে ফেডারেশনের ধারণাই পরিত্যাগ করলাম। বললাম সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে এটা হবে এককেন্দ্রিক। ক্ষুদ্র জাতিগত সংখ্যালঘুকে আমরা কেবলই সংখ্যার জোরে পরিমাপ করলাম। এমনকি একজন মানবেন্দ্র লারমা যখন মাথা ফুঁড়ে দাঁড়ালেন, তখনো আমাদের হুঁশ হলো না। কিংবা আমরা কত তাড়াতাড়ি পাহাড়িদের জীবনে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবি হিসেবে আবির্ভূত হলাম। আমরা কত তাড়াতাড়ি বদলে গিয়ে বুঝলাম এবং বললাম স্বায়ত্তশাসন আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য তা হুমকি বয়ে আনতে পারে। অথচ ছয় দফা বলেছিল লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন ঘটাবে। সার্বভৌম ইউনিটটির ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা সংবিধানে কেন স্থানীয় শাসন নামে একটি নতুন চ্যাপ্টার লিখেছিলেন তার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। কেবল ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লেখককে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘আমরা প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন চেয়েছিলাম। প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিট হবে লিটল রিপাবলিক। আসলে এর দিকে তাকালে এখন মনে হয় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যদি সংবিধান লেখা হতো তাহলে এ দেশকে আমরা বাহাত্তরেই বহুভাষাগত বহুবর্ণগত বহুজাতিগত একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারতাম। যেটা সম্প্রতি নেপাল করেছে। আমাদের নেতারা সংবিধানে কী বিধান লিখেছিলেন, যাতে অর্পিত সম্পত্তির দিকে নজরদানকারীরা নিবৃত্ত হন।

আর এখানে জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টি বেশ প্রাধান্য পেয়েছে। আজ দেখার বিষয় হলো পূর্ব বাংলার দক্ষিণ, বাম ও মধ্যপন্থীদের মধ্যে ঐক্য করার প্রশ্নে কী ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছিল। আমাদের এই কৌশল রপ্ত করতে হবে। সেখানে অভিন্ন লক্ষ্য ছিল আইয়ুবের ওপর চাপ বাড়ানোর। তাই পাঞ্জাবি রাজনীতিক মুশতাক আহমেদ গুরমানি, মোহাম্মদ দৌলতানা, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের রক্ষক। কিন্তু তারা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের সঙ্গে একাত্ম হতে চাইলেন এই ভেবে যে তাহলে স্বৈরশাসকের ওপর চাপ বাড়ানো সম্ভব। তাই তারা একটি সম্মিলিত বিরোধী দল করতে চাইলেন। মুজিবের কাছে পৌঁছাতে মানিক মিয়াকে ধরলেন।

তবে কী আশ্চর্য ইতিহাসের কীভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাংলাদেশ ইতিহাস বারবার এই প্রশ্নের মুখে পড়েছে যে কাকে বাদ দিয়ে কাকে আনা হবে আর তাতে কী লাভ হবে। এই ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে ওই ব্যক্তিকে আনলে কোনো লাভ নেই, সেটা ষাটের দশকের অভিজ্ঞতা।

কামালের বর্ণনায় মানিক মিয়া এটা জানতেন যে ঢাকায় তাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে যে আইয়ুবকে সরিয়ে পাঞ্জাবি রাজনীতিকদের আরেকটি গ্রুপকে ক্ষমতায় বসালে তাতে বাঙালির লাভ কী। আমরা কতগুলো পরিহাস লক্ষ করব। স্বাধীন বাংলাদেশ যেহেতু গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে নজর দেয়নি, তাই সব সময় ব্যক্তিকে ওঠানো ও নামানের রাজনীতিটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই একদলীয় নয়, বাংলাদেশ আসলে ব্যক্তির শাসনের সংকটে বেশি ভুগছে। কারণ চীন দেখিয়েছে যে একদলীয় শাসন ও এক ব্যক্তির মধ্যে কী পার্থক্য সৃষ্টি করা সম্ভব। একদলীয় শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং তাকে গতিশীল করতে হলে তার ভেতরে গণতন্ত্র অনুশীলন করতেই হবে। কারণ নইলে এটা টিকবে না। চীনের শীর্ষ নেতাকে কখনো কোনো বড় বিপর্যয়ের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ করা হয় না। তাকে কৈফিয়ত দিতেও হয় না। কারণ তিনি মিডিয়ায় প্রতিদিনই শিরোনাম হন না। বাংলাদেশের মতো কিছু দেশের নাম্বার ওয়ান ব্যক্তি গণমাধ্যমের মূল আকর্ষণে থাকতেন। একটানা অনেক দিন তাঁর বাণী না থাকলে, কেমন পানসে মনে হয়। এই যে অবস্থা আমরা একটি কর্তৃত্বপরায়ণ ও নামসর্বস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি, এটাই একটা বিরাট বাধা। এবং আমরা খেয়াল করব যে আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়া, শেখ মুজিব, এরশাদ এভাবে ব্যক্তির নাম ধরে ধরে আমাদের শাসনামলগুলোর সাফল্য-ব্যর্থতা চিত্রিত হয়ে থাকে। এটার জন্য প্রচলিত প্রক্রিয়া ও সংস্কৃতি দায়ী হয়ে থাকলে প্রধান দায়টা সম্ভবত শীর্ষ নেতাকেই নিতে হবে। কারণ তিনি নিজেকে মিডিয়ায় কীভাবে দেখাতে চান, সে বিষয়ে কোনো নীতিমালা করতে চান না। তিনি মিডিয়ার মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্নতার বদনাম ঘোচাতে চান। আর সে কারণে মাঝেমধ্যেই অমুককে গ্রেপ্তারে কড়া নির্দেশ ও তদন্তের আগেই ফলাফল প্রকাশের মতো আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায় নিজেকে তিনি সম্পৃক্ত করে ফেলেন। আর তাঁর চারপাশের ব্যক্তিরা প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলেন। মন থেকে না চাইলেও মোসাহেবি করা প্রতিযোগিতায় তাকে অংশ নিতে হয়। কারণ নইলে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি থাকে। সুতরাং ব্যক্তিবাদ বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্য বিরাট হুমকি। জেনারেল জিয়ার পরে এরশাদ ক্ষমতায় থেকে দল করেছেন। কিন্তু এসব দলে কখনো গণতন্ত্র ছিল না। আর স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগ ক্রমাগতভাবে গোপন ব্যালটে দলের কমিটি গঠনের ধারা বেগবান করার পরিবর্তে পকেট বিপ্লব করে ফেলেছে। ইদানীং তারা তীব্র ও ব্যাপকভিত্তিক উপদলীয় কোন্দলের কারণে পকেট কমিটিও আর করতে পারছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ১৫ অক্টোবর প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন, আগে বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যেত না। কারণ নির্বাচন ছিল নির্দলীয়। এখন এটা করা যাবে। এর মানে দাঁড়াল দলের প্রার্থী বাছাইয়ে গণতন্ত্র থাকবে না। কিন্তু বহিষ্কারের বেলায় দল তার ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাবে। ইত্তেফাক খবর দিয়েছে, প্রস্তাবিত প্রার্থী মনোয়নন বোর্ডের প্রধান থাকবেন এমপি। এর মানে ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা কেন্দ্রীয় নেতার রাজনৈতিক এজেন্ট হিসেবে স্বীকৃত এমপি স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণটা করবেন। এর আগে আমরা দেখেছি উপজেলা পরিষদের স্বায়ত্তশাসন এমপি, মানে ৭০ অনুচ্ছেদের এজেন্ট দিয়েই খর্ব করা হয়েছে।

পাঞ্জাবিরা কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে প্রাদেশিক সরকার দিয়ে বাংলা শাসন করেছিল, সেই পাঞ্জাবিরা ব্যবস্থাটা রেখে গেছে। এবং আমরা তা গ্রহণ করেছি। প্রাদেশিক সরকারের পুরো কাঠামোটা অবিকল আমরা গ্রহণ করেছিলাম। অনেক ক্ষেত্রে সেই নব্য পাঞ্জাবিরা শাসন করছেন।

সুতরাং যাঁরা বলেন, একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হয়নি, তাঁরা ঠিকই বলেন, কিন্তু তার ব্যাপকতা আছে। তাদের তালিকা নিয়ে ধরে ধরে মূল্যায়ন করা দরকার, ছয় দফার মধ্যে কয়টি বাস্তবায়িত হয়েছে। একই হাতে তালিকা নিতে হবে যে একটি রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণের প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে ‘স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের’ সন্ধান করা যায় কি না। স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার জনগণকে দিতে হলে অবশ্যই পার্টি লাগবে। গত দুই দশকে বিশ্বে যেখানেই নতুন সংবিধান হয়েছে তার একটি অন্যতম ধারা হলো রাজনৈতিক দলের জবাবদিহি ও নিরীক্ষার প্রশ্নটিকে পাদপ্রদীপে নিয়ে আসা। অথচ বাংলাদেশে এটা অনুপস্থিত। এখানে এক-এগারোতে জবরদস্তি দলের নিবন্ধন ও জবাবদিহির নামে কতিপয় শিথিল বিধানাবলির প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু তা কেউ মানে না। নির্বাচন কমিশন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্বাস করে না যে এই বিধানাবলির কড়াকড়িভাবে আরোপ করার মতো গণতান্ত্রিক সহনশীল পরিবেশ বাংলাদেশে বিরাজমান রয়েছে।

এই প্রসঙ্গের অবতারণা এই কারণে যে ড. কামাল হোসেন যা বলছেন, সে আলোকে আমরা কোথায় ছিলাম কোথায় আছি। তিনি লিখেছেন, মানিক মিয়া দৌলতানাকে বললেন, আইয়ুবকে তো সরাব বুঝলাম। তাহলে তাঁর পরিবর্তে পাঞ্জাবিদের যে নতুন শাসকেরা আসবেন, তাঁরা কি সেই তথাকথিত ‘প্যারিটি’ সরিয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্বশীলতা মানবেন।

মানিক মিয়া বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকার কি পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজি স্থানান্তর করবে? অর্থাত্ বাঙালি নির্বাচিতদের হাতে পুঁজি খরচ করতে দেবে। মূলধন দিতে ভয় পেত তারা। ভাবত বাঙালি কী করে টাকাপয়সা খরচ করবে। ওদের বিশ্বাস করা যায় না। টাকাপয়সা যেটুকু দিত তাও তাদের খাস আমলাদের তদারকিতে খরচ হতো। সেই দৃষ্টিভঙ্গি আজও অটুট।

সেই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আজও উপেক্ষিত। আজও ‘কেন্দ্রীয় শাসক ও আমলারা’ ভাবেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যথেষ্ট কর্মক্ষম নয়, কিংবা ওদের বিশ্বাস করা যায় না। তাই স্থানীয় সরকার কাঠামোতে তারা যে পরিবর্তনই আনুক বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একমত যে ওদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যাবে না। তার ফল এই শাসনে যে যখনই থেকেছে স্থানীয় সরকার দিয়ে উন্নয়ন বাজেটের দুই শতাংশ খরচ করা হচ্ছে আর পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় দলের ভিত্তিতে নির্বাচন হয়, সেই যুক্তি দিচ্ছে এটা গোপন রেখে যে তারা তাদের উন্নয়ন বাজেটের ৩০ থেকে ৪০ ভাগ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে খরচ করছে (সাক্ষাত্কার ১৩ অক্টোবর ড. তোফায়েল আহমেদ)। মূলত সেই একই মনোভাব, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিশ্বাস করা যাবে না।

জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় যখন দুই নেত্রীকে সামনে রেখে আন্দোলন গড়ে উঠল তখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির একচ্ছত্র প্রভাবকে ক্ষতিকর মনে করা হয়নি। সে কারণে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রশ্নটি অনুচ্চারিত থেকেছে। বলা হয়েছে আগে এরশাদকে অপসারণ করা হোক। তারপর অন্যসব দেখা যাবে। বলা হয়েছে এটাকে অপসারণ করলেই অন্যান্য সব পথ খুলে যাবে। ইতিহাস আবারও শিখিয়েছে সরানোর প্রক্রিয়াটা যদি গণতান্ত্রিক এবং অহিংস হতো তাহলে অন্য অনেক জট খুলত। আমরা এখনো সেই একই জট ও সংকটের মুখোমুখি। বেগম খালেদা জিয়া ৯২ দিনের একটি সহিংস কর্মসূচি দিলেন, দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হলেন, কিন্তু সেই কারণে তাঁর দল থেকে পদত্যাগের হিড়িক পড়েনি। দলটি মানুষকে এখনো বোঝাতে পারছে যে নির্বাচন না করতে পারার কারণেই যত দুর্যোগ। একটা নির্বাচন হোক তাহলেই সমস্যা মিটে যাবে। তার মুখে সংস্কারের কোনো কথা নেই। গণমাধ্যম প্রথাগতভাবে দুই প্রধান দলের মূল নেতৃত্বের প্রতি কমবেশি আস্থাশীল থেকেই বাকস্বাধীনতা চর্চা করে থাকে। এর একটা বড় প্রমাণ হলো, রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলের খবর প্রকাশে যদি একটি সমীক্ষা চালানো হয় তাহলেই এই চিত্রটি ফুটে উঠবে যে সংবাদপত্র তাদেরই কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে যারা জনপ্রিয়, যারা নির্বাচনে বেশি ভোট পায়। তাই এ দেশে পরিবর্তন ও সংস্কারের বিষয়টি বড় ধরনের কোনো জনবিতর্কের বিষয়ে পরিণত হতে পারছে না। এর ফলে ‘গণতান্ত্রিক ঘাটতি’ বেড়ে যাচ্ছে।

ওয়ান ইউনিট ও প্যারিটি এই উভয় রাজনৈতিক মতবাদ পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের তরফে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরার মূলে ছিল স্বায়ত্তশাসনকে অস্বীকার করা। মানুষের অধিকারকে নাকচ করা। নাম যা-ই হোক না কেন, মূলকথা ছিল একটি ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠী বা অলিগার্কিকে (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যাকে বলেন কতিপয়তন্ত্র) সুরক্ষা দেওয়া।

প্রথম দফা: সরকার হবে ফেডারেল, সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে। আমরা ফেডারেল সরকার করতে পারি। বহুদেশ আমাদের চেয়ে কম আয়তনের দেশের ফেডারেল কাঠামো আছে। ৭০ অনুচ্ছেদের মতো কোনো অনুচ্ছেদ সংবিধানে ঢোকানোর কথা ছিল না। আরও অনেক কারণে সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা বাকি রয়ে গেছে। সংসদ সরকার নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল। কিন্তু সরকার বহু ক্ষেত্রে সংসদকে নিয়ন্ত্রণ করে।

দ্বিতীয় দফা: প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র ছাড়া আর সব বিষয় আঞ্চলিক সরকার করবে। এর নির্যাস নিয়ে বলতে পারি, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বা সরকারব্যবস্থায় এর যতটা প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব ছিল, তা বাস্তবায়নের কোনো চেষ্টা চোখে পড়েনি। এমনকি বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বায়ত্তশাসন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো জোরালো ভিত্তি পায়নি। শাসকগোষ্ঠী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে কাজে লাগে না এমন সব বিতর্কে লিপ্ত থেকেছে এবং সেই ধারা অব্যাহত আছে। চীন একদলীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে থেকেও শিনচিয়াংকে ১৯৫৫ সালে স্বায়ত্তশাসন দেয়। উল্লেখযোগ্য আইন ও বিধিবিধান এবং নীতি প্রাদেশিক সরকার, সংসদ ও দল নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। ৬০ বছরে ১১৫ গুণের বেশি জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। কোনো খাসজমি কাউকে ইজারা দিতে হলে কোনো পৌরসভাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল যুগ আসার পরও স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা শাসকেরা মুখে আনছে না। এমনকি দলীয় ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা করেও তারা ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ শব্দটি মুখে আনছে না। কারণ তারা তৃণমূলের দল ও তার নেতাদেরও বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে কেন্দ্রশাসিত আমলাদের। সে কারণে কোনো পৌরসভা বা ইউপির মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে জনপ্রতিনিধিরা অপসারিত হবেন। সেখানে বসবেন কেন্দ্রশাসিত আমলা। এভাবে ছয় দফা যেখানে ছিল স্বায়ত্তশাসনের মূর্ত প্রতীক এবং যাকে ১২১৫ সালে প্রণীত ব্রিটিশ শান্তি চুক্তি ম্যাগনাকার্টার সঙ্গে (যাকে পরবর্তীকালের সব লিখিত সংবিধানের মৌলিক মানবাধিকারের মৌলিক উত্স মনে করা হয়) তুলনা করা হয়, তার চেতনা থেকে বাংলাদেশ বিচ্যুত হয়েছে। সর্বত্র স্বায়ত্তশাসন ধারণার বিরোধিতা করা হয়েছে।

৬৫ বছর পর আমাদের আবারও ফিরে তাকাতে হবে পাকিস্তানি ২৩ বছর যেখানে দুটি প্রধান ধারা ছিল, সামরিক শাসন বা স্বৈরশাসনকে প্রলম্বিত করা এবং মৌলিক গণতন্ত্র করে কার্যত রাজনৈতিক দলকে অসম্মান করা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অমর্যাদা করা। আইয়ুব খান রাজনৈতিক দলকে ভয় পেতেন, তার কারণ রাজনৈতিক দল বলে নয়, তার কারণ সেই পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ভুটোর পিপিপি যেকোনো অনির্বাচিত ও অরাজনৈতিক শাসকের জন্য বিরাট হুমকি ছিল। সে কারণে আইয়ুব খান দেখলেন কেবল বন্দুকের নল দিয়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা যাবে না। সে কারণে তিনি মৌলিক গণতন্ত্রে গেলেন। তাঁর প্রবর্তিত পদ্ধতিটি যে তখন বিশ্বের দেশে দেশে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট আগ্রহ জন্ম দিয়েছিল, এই বিষয়টি এই লেখক গভীরভাবে অনুধাবন করেন, যখন তিনি মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানায় দেখেন যে ওই সময়ে দুই পাকিস্তানে থাকা মার্কিন কনস্যুলেটগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মাঠপর্যায়ে এই নতুন ব্যবস্থা কী কাজ দিয়েছে তা তদারক করেছেন। ষাটের দশকে অর্চার ব্লাডও ঢাকার বাইরে গ্রামে গিয়ে মৌলিক গণতন্ত্র কেমন কী কাজ দিচ্ছে সে বিষয়ে বিস্তারিত ফিল্ড রিপোর্ট দিয়েছেন।

সভ্যতার সংঘাত ধারণার জন্য বিখ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি হান্টিংটন পলিটিক্যাল অর্ডার ইন চেঞ্জিং সোসাইটিজ বইয়ে (পৃ. ২৪৩) লিখেছেন, ‘দল’ সম্পর্কে আইয়ুব খান জর্জ ওয়াশিংটনের প্রতিধ্বনি তুলে বলেছিলেন, দল জনগণকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করে এবং অশুচ বাগাড়ম্বরকারীদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। সংসদ হওয়া উচিত উচ্চ মর্যাদা ও প্রজ্ঞাবানদের দিয়ে যাঁরা কোনো দলের হবেন না। মিসরের নেতা নাসের যিনি ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে ব্যবহারকারী ট্যাংক সরবরাহ করেছিলেন, তিনিও দল সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করতেন। নাসেরের মতে, এটা সমাজকে বিভক্ত করতে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতিয়ার। ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর আইয়ুব এক সেমিনারে বলেছিলেন, (সূত্র ডন, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪) ইস্কান্দার মির্জার ‘কন্ট্রোলড ডেমোক্রেসি’, আইয়ুবের ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’ ও জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ‘টেইলরড ডেমোক্রেসি’র সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক সত্যি আলগা ছিল’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। সবারই লক্ষ্য ছিল মধ্যস্থতাকারী বা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কথায় হেনশমেন বা তল্পিবাহক সৃষ্টি করা।

পাকিস্তানি রাজনীতির উত্তরাধিকার আমরা বহু ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করে চলছি। ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করা হলো (পৃ. ১১), ১৯৬২তে এল নতুন সংবিধান। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার এল। পরোক্ষ নির্বাচন এল এবং গঠিত হলো একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বাঙালিকে কার্যকরভাবে নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারল (পৃ. ১১)।

জেনারেল এরশাদ যেভাবে ক্ষমতা নেওয়ার আগে পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছিলেন, সেভাবে আইয়ুব খানও ক্ষমতা দখলের চার বছর আগে ১৯৫৪ সালে নিবন্ধ লিখেন।

যদিও এ কথা সত্য যে ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো হলেই তা গণতান্ত্রিক হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে এ কথা সাধারণভাবে সত্য যে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চেয়ে ফেডারেল ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। বিশ্বের ছয়টি দেশ কাঠামোগতভাবে ফেডারেল কিন্তু সেখানে নির্বাচনী গণতন্ত্র নেই। এগুলো হচ্ছে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, ইথিওপিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ফেডারেল ডেমোক্রেসিস, মাইকেল বার্জেস ও অ্যালান-জি গ্যানিয়ন সম্পাদিত, পৃ. ৩১৬)।

মাইকেল বার্জেস ও গ্যানিয়ন মনে করেন, ‘এটা স্পষ্ট নয় যে ফেডারেলবাদ একট কার্যকর হাতিয়ার কিংবা অগণতান্ত্রিক শাসনকে তীব্রতা দেয়। ফেডারেশন একদলীয় কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন বা সামরিক জান্তা একটি ডি জুরে ফেডারেলিজমকে নাকচ করে ডি ফ্যাক্টো ইউনিটারিজম আরোপ করে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন হলো তারই একটি ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত, যেটি একটি দল দ্বারা স্বৈরতান্ত্রিকভাবে শাসিত হয়েছে। তবে কথা হলো ফেডারেলিজম হলো সে ব্যবস্থা যা আসলে একটি কার্যকর হাতিয়ার ও গণতান্ত্রিক শাসনকে তা গতিময় করে বলেই প্রতীয়মান হয় (ফেডারেল ডেমোক্রেসিস, পৃ. ৩১৬)।’

অনেকে যুক্তি দেন যে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের আবাসভূমিটি তো ফেডারেল কাঠামো পরিচালনার উপযোগী ছিল না। এই যুক্তির ভিত্তি দুর্বল। ওই লেখকদ্বয় এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘নীতিগতভাবে একটি ফেডারেশনের ভূখণ্ডগত কোনো আয়তনের সীমারেখা নেই, এমনকি ফেডারেল অঙ্গসমূহকে একত্রে যুক্ত থাকতে হবে তারও কোনো যুক্তি নেই (যেমন আলাস্কা ও হাওয়াই যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন)।

ড. কামাল হোসেন তাঁর ছয় দফার পরিচ্ছেদে স্মরণ করেছেন কী করে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে নিপীড়নের শিকার হলেন, তা থেকে মুক্তি পেতে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। ১৯৬৬ সালের মধ্যভাগের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘সে ধরনের নিপীড়নের মুখে আন্দোলনটি সংকটে পড়ল, আমাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হলো বিষয়টিকে আদালতে নিয়ে যাওয়া। আমরা একটি রিট আবেদনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাফাজ্জাল হোসেন মানিক মিয়ার আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলাম (পৃ. ২৬)।’

৫ দশক পরে এসে আমরা দেখি, যেকোনো ধরনের আন্দোলন ধরপাকড়ের কারণে সংকটে পড়ে এবং আদালতেও তা চ্যালেঞ্জ হয়। কিন্তু দুই অবস্থার মধ্যে একটি গুণগত মৌলিক ফারাক ঘটে গেছে। সেটা কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক? অগ্রগতি বা পরিবর্তনটা ঋণাত্মক হলে তা নিয়ে সমাজে কোনো আলোচনা আছে কি না? যদি না থেকে থাকে তাহলে সেটা বদ্ধ সমাজের লক্ষণ কি না?

১৯৬৬ সালের সেই উত্তাল দিনগুলোতে ছাত্রজনতার আন্দোলনের কারণে সরকারের টলমল অবস্থা হয়েছিল। সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ কিন্তু দায়িত্বহীন আচরণ করেনি। তার প্রমাণ ড. কামাল হোসেনদের রিটের ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

হাইকোর্টের যে রিট বেঞ্চে ওই আবেদন করা হয়েছিল সেখানে তিনজন বিচারপতি ছিলেন। বিচারপতি মাকসুমুল হাকিম, আবদুল হাকিম ও আবদুল্লাহ। সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রিট আবেদনটি অগ্রাহ্য হলো। কিন্তু বিচারপতি আবদুল্লাহ ঠিকই বাকস্বাধীনতার সপক্ষে ভিন্নমত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর নয়। আর আজ সাধারণ নির্বাচন চাওয়াটাও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর ও অদরকারি বলে দায়িত্বশীলেরা মনে করতে পারেন। এরপর ইত্তেফাক মামলার ফলাফলকে ড. কামাল বলছেন, ‘অধিকতর বর্ণিল ইতিহাস।’ এর সঙ্গে আমরা আজ খুব কি কিছু তুলনা করতে পারি। হাইকোর্ট বেঞ্চ ইত্তেফাক বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ নাকচ করলেন। এরপর নতুন আইন দিয়ে তা ঠেকাতে গেলে চ্যালেঞ্জ হলো। আর তখনো ৩: ১ ভোটদৃশ্য আমরা পেলাম। বিচারপতি সিদ্দিকী ও বিচারপতি সালাহ উদ্দিন আহমেদ রিট আবেদন নাকচ করলেন। আর বিচারপতি সায়েম ভিন্নমত দিলেন যে বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ অবৈধ।

বইটির তৃতীয় পরিচ্ছেদ হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে গোলটেবিল সম্মেলন (পৃ. ২৯)। সময়কাল ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর থেকে মার্চ ১৯৬৯। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি শওকত আলী বই লিখেছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র সত্য মামলা। এর প্রধান দুটি দিক নতুন প্রজন্মকে নির্মোহভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। সরকার তখন আমাদের জাতীয় নেতাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছিল তা যদি ‘সত্য’ হয়ে থাকে তাহলে আমাদের দেখতে হবে যে তখন আমাদের নেতাদের সামনে মামলা পরিচালনায় কী কী বিকল্প খোলা ছিল। ড. কামাল হোসেনের বিবরণ অনুযায়ী, এই ঘটনায় প্রথম যিনি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন তিনি আমীর-উল ইসলাম। তিনি তাঁর এক মক্কেলের (নেভাল কমান্ডো কামালউদ্দিন আহমেদ) সাক্ষাত্কার নিয়ে জানতে পারেন যে জেলে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁর শরীরে তিনি আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান (পৃ. ২৯)। তাহলে কি এ ধরনের নির্যাতন ও লাঞ্ছনা এড়ানোর জন্যই আমরা সেদিন সেই ‘সত্য’ প্রকাশ করতে অক্ষম ছিলাম? তখন ‘সত্য’ প্রকাশিত হলে কি জাতীয় নেতাদের ফাঁসির কাষ্ঠে প্রাণদান অবধারিত ছিল? আমরা যে সেদিন ‘কৌশলগতভাবে’ পুরো বিষয়টিকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছি, বিশ্বের অন্যান্য জাতি একই ধরনের অবস্থায় মুক্তির জন্য কী পথ বেছে নিয়েছে? বড় প্রশ্ন, এটাই একমাত্র পথ ছিল কিনা? এই পথ অনুসরণ করাই কি একমাত্র উত্তম বিকল্প ছিল? তার চেয়েও বড় কথা, পুরো ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখানোর এই রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করা বা না করা নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলে কি যথেষ্ট আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনার কোনো উল্লেখ ড. কামাল হোসেনের বইয়ে নেই। সেখানে কি সেদিন কেউ ভিন্নমত দিয়েছিলেন? যে জাতি মাত্র দুবছর পরেই মৃত্যুর জন্য বুক পেতে দিয়েছে, সেখানে কি কেউ ফাঁসির মঞ্চে যেতে চায়নি? সত্য প্রকাশ করে কেউ আত্মঘাতী হতে চায়নি?

অনেক সময় আইনজীবীদের কাছে তাঁদের মক্কেলেরা তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে ‘সত্য’ প্রকাশ করে থাকে। আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা লড়তে গিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের কাছে তা কতটা পরিষ্কার ছিল। তারা কি এমন কোনো কৌশল নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন যেখানে ‘সত্য’কে বাঁচানোর কোনো প্রচেষ্টা থাকতে পারত? মামলা লড়াইয়ের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টার টম উইলিয়ামসকে আনা হয়েছিল। ড. কামাল হোসেন দেখিয়েছেন কী করে টম উইলিয়ামসকে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী উত্ত্যক্ত করেছিল।

তিনি রাষ্ট্রের পক্ষের বিরুদ্ধাচরণকারীদের আইনজীবী। ঢাকায় তাঁর গাড়ি অনুসরণ করা হয়েছে। নিকৃষ্ট যেটা ঘটেছে সেটা হলো তার রুমের তালা ভেঙে ফাইলপত্র তছনছ করা হয়েছে। বেশ বোঝাই যায়, তাঁর জন্য সরকারি বাহিনী এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছিল যাতে তিনি পালিয়ে বাঁচেন। এ থেকে পরিষ্কার যে আদালতের পবিত্রতায় সরকার বিশ্বাসী ছিল না। এখন প্রশ্ন হলো সরকারের যাঁরা প্রতিপক্ষ তাঁরা কতখানি এই পবিত্রতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আমরা তো স্পষ্ট দেখি যে ড. কামাল হোসেন এবং আমীর-উল ইসলাম রিট করার যে ধারার সূচনা ষাটের দশকে কিংবা তাঁদের পেশাগত জীবনের সূচনায় করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতা তো আজও চলছে। সেখানে কতটা গুণগত মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। পক্ষ ও প্রতিপক্ষের মধ্যে বিশেষ করে যেখানে প্রচণ্ড রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত সেখানে আইনের শাসনের চেতনা কতটা উজ্জীবিত? আমরা আমাদের রাজনীতিকদের মুখে কথায় কথায় পাকিস্তানি ২৩ বছরের নানা উপাখ্যান বলতে শুনি, সেটা কেন? সেটি কি এটাই নির্দেশ করে যে ওই সাংস্কৃতিক মানের উত্তরাধিকার আমরা আজও বহন করে চলেছি?

কোনো বিদেশি আইনজীবীকে আদালতের আঙিনায় ঢুকতে দেওয়া এবং না দেওয়ার ব্যাপারে আমরা কি অতীতের স্পর্শকাতরতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছি।

টম উইলিয়ামসের কাছে কি আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলার ‘সত্য’ দিকটি প্রকাশ করা হয়েছিল? তাঁকে কেন আনা হয়েছিল?

ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘তাঁর সফর এবং এই মামলায় তাঁর অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্য পূরণ করেছে (পৃ. ৩১)।’ 

এটা লক্ষণীয় যে এ রকম একটি মামলায় যখন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলো তখন কিন্তু কেবলই অবাঙালিদের দিয়ে তা গঠন করা হয়নি। কারণ বিশ্বকে দেখানোর মতো একটা তাড়না সেই সামরিক জান্তারও ছিল।

১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারির (এর তিন দিন পরে আসাদ নিহত হয়) তারিখ আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়ন করব। কারণ আমার জানামতে এই প্রথম ড. কামাল হোসেন এই তারিখ এবং পর্বটিকে অন্যান্য ঘটনা থেকে পৃথক করেছেন। উভয় অংশের শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিকেরা মিলে গঠন করেছিলেন আইয়ুববিরোধী ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি। কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘ড্যাক নেতারা বায়তুল মোকাররমে প্রতীকীভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেন। আসগর খান সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি দাঙ্গা পুলিশের টার্গেট হলেন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর রঙিন পানি ছিটিয়েছিল। এই সমাবেশের তাত্পর্য ছিল সেটাই যে সাংবিধানিক রাজনীতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ নেতারা সুচিন্তিতভাবে আইন ভঙ্গ করলেন। আর ছাত্রদের মধ্যে যারা দ্রোহি অংশের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, তাঁরা প্রতীকী আন্দোলনের মধ্যে আটকে ছিলেন না (পৃ. ৩৫)।’ তার মানে এটা পরিষ্কার যে ছাত্ররা রাজনীতিকদের অতিক্রম করে গিয়েছিল। সুতরাং এ থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক পর্ব আমরা নিজেদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাব যে রাজনীতিকেরা এর বিপদ বুঝতে পেরেছিলেন কি না? তাঁরা কি ধরেই নিয়েছিলেন যে ছাত্ররা আইয়ুব হটিয়ে কেবল তাঁদের ক্ষমতায় বসিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো বইখাতা হাতে স্কুলে ফিরে যাবে? তাঁরা কি সেটা ভেবে তাঁদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা কি ভেবেছিলেন যে নেতৃত্ব কোনোভাবেই যাতে ছাত্রদের হাতে না যায়। এর একটা কারণ কি এই ছিল যে রাজনীতিকেরা তাঁদের চূড়ান্ত গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। ছাত্র নেতৃত্ব ছিল। পতাকা উত্তোলনের মতো নানা ঘটনাতেও আমরা দেখি রাজনীতিকেরা ছাত্রদের অনুসরণ করেছে। আর সেটা মনে রাখলে এটা ভাবতে সুবিধা হয় যে এরশাদকে হটাতে হঠাত্ করে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গজিয়ে ওঠেনি। ওই বীজ ওই মাটিতে আগেই বপন করা ছিল। একজন মেজর জিয়াই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম রাজনীতিকদের ছাড়িয়ে যেতে চানানি। পতাকা তুলে এবং মুজিবকে অনেক কিছুতেই বাধ্য করে ছাত্ররা রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক কর্তৃত্বকে ‘খর্ব’ কিংবা কারও মতে হয়তো ‘মহীয়ান’ করে তুলেছে।

আমরা কখনো সত্যের মুখোমুখি নিজেদের দাঁড় করাইনি। আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ব। একটা ন্যূনতম গণতন্ত্রচর্চা লাগবে। আমরা চীনের মতো একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ব। আমাদের ন্যূনতম একটা গণতন্ত্রচর্চা লাগবে। শুধু মুখের কথায় হবে না। খাতাপত্র লাগবে। আমরা অবাক হই যে আমরা বিভিন্ন দফার হিসাব রাখি কিন্তু খাতার হিসাব রাখি না। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র আছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো আর্কাইভ নেই। ষাটের দশকের বড় বড় ঘটনার কোনো রেজল্যুশনের কপি নেই। তাই ভিন্নমতের রেকর্ড নেই। সাম্প্রতিক ইতিহাসেরও তেমন কোনো রেকর্ড নেই। কেবল সিদ্ধান্তগুলো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। প্রেস রিলিজ মিলতে পারে। সুতরাং কে কখন কোন বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’কে না করেছেন, বা ‘না’কে হ্যাঁ করেছেন, তা নির্দিষ্টভাবে জানা যাবে না। আর এই প্রক্রিয়াতেই সব সময় স্বৈরশাসন বা এক ব্যক্তির শাসনকে টিকিয়ে রাখতে ধারাবাহিকভাবে আনুকূল্য দেওয়া হচ্ছে। বলা হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া হবে। কিন্তু দল পরিচালনায় আনুষ্ঠানিক ও গঠনমূলকভাবে ডিজিটাল বা আধুনিক কিছু ঘটে না। উদাহরণ দিই, সংসদীয় বিশেষ কমিটি সামান্য সংশোধনসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকার টিকিয়ে রাখল। কিন্তু তা পরে কীভাবে বাতিল হলো তা জানা যায় না। বলা হয়, দলের অমুক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সেই সভার কোনো কার্যবিবরণী আপনি পাবেন না, পেলেও সেখানে কী যুক্তিতর্ক কে কীভাবে দিয়েছিল, তা আপনি বুঝতে পারবেন না। এটা যদিও ‘ওসব কমিউনিস্টরা’ করে, আমাদের লাগে না বলেন, আসলে তাঁরা সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পান। এটা তাঁরা করেন কারণ তাঁরা জবাবদিহির কবলে পড়তে চান না। স্বচ্ছতায় তাঁদের কোনো বিশ্বাস নেই। তাঁরা সরকারি আমলা পোষেন, তাঁদের দ্বারা নথিপত্র সংরক্ষণে তাঁদের গভীর আস্থা। তখন আর ‘কমিউনিস্টরা করে’ বলে মুখ ঘুরিয়ে নেন না। জনপ্রশাসন চালাতে ওটা লাগে। কিন্তু দলীয় প্রশাসন চালাতে নথিপত্র সংরক্ষণ লাগে না। এর ফলে যা দাঁড়ায় সেটা হলো আমলারা দলীয় রাজনীতিকদের ওপর সহজে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

এটা মানা ভালো যে আমরা একাত্তরে স্ব্বাধীনতা লাভের পরে ছাত্রদের আর ক্যাম্পাস জীবনে ফিরিয়ে নিতে চাইনি। কাজটা খুবই কঠিন ছিল অথচ শুরুই করা হয়নি। বরং আমরা প্রতিনিয়ত বিনা শর্তে এবং কোনো পরিণাম বিবেচনা না করেই ফলাও করে নতুন প্রজন্মকে শেখাই যে ছাত্ররাই তাদের লেখাপড়াসংক্রান্ত নিজস্ব ১১ দফার মধ্যে ছয় দফা ঢুকিয়ে তাকে বেগ দিয়েছিল। ছাত্ররাই শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিল। অন্য পেশাজীবীরা তা পারেনি।

আমরা স্লোগানের মতো করে জানি, আইয়ুব খান গণ-অভ্যুত্থানে বিদায় নিয়েছিলেন। সত্যি। কিন্তু সত্যেরও নানা রূপ আছে। জেনারেল এরশাদকে আমরা ‘গণ-অভ্যুত্থানে’ বিদায় দিয়েছিলাম। সেটাই সব সত্যি? নাকি দুই অবস্থার মধ্যে একটি মিল হলো, যারা তাদের অগণতান্ত্রিক ও ছিনতাই করা শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছিল, তারা হঠাত্ উপলব্ধিতে নিয়েছে এদের টিকিয়ে রাখাটা আর সার্বিক বিবেচনায় ভায়াবেল নয়। তারা না বলার পরে তারা নেই হয়ে যায়। কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই ১৮ বছর সামরিক বাহিনীর প্রধান থাকার পরে তিনি তাদের দ্বারা ত্যাজ্য হলেন।’ কথিতমতে তিনি একজন সফররত বিদেশি প্রতিনিধিকে বলেছেন, ‘সম্ভবত তারা আমার মুখ দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।’ জেনারেল এরশাদও এই একই উক্তি করেছিলেন। কারণ ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর মধ্যে কোনো মৌলিক কাঠামোগত ফারাক সৃষ্টি হয়নি। অনেকের মতে, অসাংবিধানিক শাসন বা সংবিধান ভেঙে পড়ার বিষয়টি বুঝি কেবলই ‘ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়। আসলে তা নয়। ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলো যারা প্রতিষ্ঠান গড়েছে সেখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চাইলেই সংবিধানকে দুমড়ে দিতে পারে না। এটা এতটাই অসম্ভব যে সেখানে ষড়যন্ত্র চলে কিন্তু তাতে সংবিধান দুমড়ে যায় না। রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র কমবেশি থাকবে। কিন্তু যেসব দেশে ন্যূনতম জবাবদিহি ও স্বচ্ছতাসংবলিত রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা থাকে না, সেখানে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব মাথা কুটে মরতে বাধ্য, আর রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব না থাকলে এমনসব ষড়যন্ত্র চলে, যাতে সংবিধান থেকে ছিটকে পড়ার মতো ঝুঁকি থাকে।

আমাদের এই আত্মজিজ্ঞাসা থাকা দরকার একাত্তরের আগে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তম হয়েছিল বললেকিংবা সেটা স্বীকার করলে এটা প্রমাণিত হয় কি না যে তখন আওয়ামী লীগ ব্যক্তি ও কতিপয়তন্ত্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলেছে, নাকি দলকে ভবিষ্যতের স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী করে তুলতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চিন্তা করা হয়েছিল। আমার বিশ্বাস, এটা তেমনভাবে করাই হয়নি, এমনকি তেমন কোনো দূরদর্শিতাও দেখানো হয়নি। সবটাই ছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সফল করতে। আজও সেই ধারা চলছে কি না? সেটাই বেগবান কিনা? বিএনপি দল গোছাতে পারে না। কিন্তু সেই দুর্বলতাকে তার পুনরায় বেশি ভোট পেয়ে সরকার গঠন করার সম্ভাবনার পথে বড় বাধা হিসেবে দেখা হয় না। সুতরাং আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠনই করে অনেকটা এই নিয়তি মাথায় নিয়ে যে সে তার চলার পথে ছিটকে পড়তে পারে। যখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিল তখনো কেউ দল গড়েনি। যখন নেই তখনো কেউ দল গড়েনি। তারা দলের ভেতরে ব্যালটে বিশ্বাস করে না। কারণ তারা তেমন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে না। তাই জাতীয় নির্বাচনও তারা সুষ্ঠুভাবে করতে পারে না।

ড. কামাল গোলটেবিল নিয়ে চতুর্থ পরিচ্ছেদ করেছেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন যে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের আলোচনার অংশ হিসেবে সংবিধান সংশোধনীর বিষয়ে আগাম সমঝোতা প্রতিষ্ঠা প্রত্যাশিত। জেনারেল এরশাদের পতনের পরে আমরা দ্বাদশ সংশোধনী পাস করেছিলাম। যদি এই সংশোধনীটা নিয়ে বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আলোচনা করতে পারত তাহলে তার দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া সম্ভব ছিল। এমনকি ক্ষমতাসীন দল জাতীয় পার্টিও তা পেত। ড. কামাল হোসেনের বইটি একটি জ্বলন্ত সাক্ষ্য হয়ে আছে যে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ ও জবাবদিহি প্রশ্ন সব থেকে কম গুরুত্ব পেয়েছে। গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান আকর্ষণ ছিল স্বায়ত্তশাসন। মানে রাজনীতিকদের ক্ষমতায়ন। প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর নুরুল ইসলাম, প্রফেসর মোজাফফর আহমেদরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন কী করে অর্থনৈতিক গোলামির জিঞ্জিরটা ভাঙা যায়। কিন্তু সেটা যারা ভাঙবে তারা সেসবের সুবিধা কী করে গণতান্ত্রিকভাবে বিলাবেন তা আলোচনার বিষয় ছিল না। এক ইউনিট ভেঙে যাবে। পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসন পাবে। কিন্তু প্রাদেশিক সরকার কী করে তৃণমূলে ও কেন্দ্রে প্রার্থী বাছাই করবে তার কোনো রূপকল্প তৈরি করা হয়নি। এ নিয়ে কখনো আলোচনা হয়নি। স্থানীয় সরকারের পবির্তনগুলো সেই সাক্ষ্য দেবে। এ দেশে কখনো ক্ষমতার পৃথক্করণ বা ক্ষমতার বন্ধন নিয়ে আলোচনা হয়নি। আলোচনা চলে এডিপির সাইজ কী হবে না হবে তার ওপর। আমরা শুনতে পাই তারা এডিপি বাস্তবায়ন করতে পারে না। তবুও তারা দল ও সরকারের সামর্থ্য বাড়ানোর কোনো কাঠামোগত আলোচনা একই সঙ্গে শুরু ও বাস্তবায়ন করার গরজ অনুভব হয় না। 

আমি এটা মানব না যে দল চালানো নিয়ে তখন সময় ছিল না। কারণ এই সময় তারা কখনো পায়নি। সামনে কবে পাবে তা পরিষ্কার নয়। এরশাদের আমলে যখন সংস্কারের কথা বলেছি, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের কথা বলেছি, তখন বলা হয়েছে এরা দালাল। সম্প্রতি একজন মন্ত্রী যখন বললেন, বিএনপিকে স্বরাষ্ট্রসহ পাঁচটি দপ্তর দেওয়ার কথা বললেও তারা নির্বাচনে আসেনি। আসন্ন নির্বাচনেও দেবেন তা তিনি বলতে নারাজ। অর্থাত্ কোনো সংস্কারে তাদের বিশ্বাস নেই। কৌশল, কৌশল আর কৌশল। এটাই চরম সত্য।

পঞ্চম পরিচ্ছেদে ‘সামরিক শাসন থেকে সাধারণ নির্বাচন ও এরপর’। মার্চ ১৯৬৯ থেকে মার্চ ১৯৭১। কামাল হোসেন লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু একটি গণপরিষদের প্রস্তাব করলেন। এর ৫৬ ভাগ আসন ৫৬ ভাগ জনসংখ্যার ভোটে নির্বাচিত হবে। এটা সবারই জানা এবং বহুল আলোচিত যে সত্তরের নির্বাচনে ইয়াহিয়া ও তার প্রশাসন ভেবেছিল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তাই নির্বাচন তারা অবাধ করেছিল। কিন্তু গণপরিষদ কী করে বহুজাতিগত ও বহুধর্মগত ও বর্ণগতভাবে তার কোনো রূপকল্প ছিল না। আর বহুজাতিগত কোনো প্রতিনিধিত্ব ছাড়া প্রকৃত গণতান্ত্রিক গণপরিষদ হতে পারে না। স্বাধীনতার পর বিতর্ক করা হয়েছে আমরা অবিভক্ত পাকিস্তানের আওতায় গণপরিষদ করেছিলাম; সেটা কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান লিখবে। অথচ মূল বিতর্ক হওয়া উচিত ছিল সত্তরের গণপরিষদ কি বহুজাতিগত ও বহুধর্মগত ছিল? সেটা কি একান্তভাবে বাঙালির, মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের করা হয়েছিল কি না? যদি তাই করা হয়ে থাকে তাহলে সেটাই ছিল বাহাত্তরের গণপরিষদের বড় গলদ। কারণ বাহাত্তরের সংবিধান পাহাড়িদের বাঙালি করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর কুঠারাঘাত করেছিল। এটা বাঙালি টের পেয়েছে বহু পরে যখন তারা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের পূর্ণগ্রাস’ অনুভব করতে শুরু করেছিল। পাহাড়িকে বাঙালি বানাতে তাদের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। নিজের ঘাড়ে গরম নিশ্বাস অনুভব করার আগ পর্যন্ত তারা কেবল পাকিস্তান না বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্ক করেছে। বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজনেও নয়, তার ব্যাখ্যা লিখতে গিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের জাত্যভিমানকে অহেতুক আঘাত দেওয়া হয়েছিল। যেমন ইসলাম নামকরণ গ্রহণ করে কোনো দলই থাকতে পারবে না। এর কোনো দরকার ছিল না। সেটা যে ভুল ছিল তার প্রমাণ আওয়ামী লীগ ১৫তম সংশোধনীতে অযথা স্ববিরোধিতা ও অসহায় আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে দেখিয়েছে।

৩১৩ আসনের সংসদ ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আওয়ামী লীগ পেয়েছিল। রাজা ত্রিদিব রায় ও মুসলিম লিগ নেতা নুরুল আমীনের বিজয়ের তাত্পর্য আওয়ামী লীগ অনুভব করতে পারেনি। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের জোশ দেখেছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে তারা দুটি প্রধান ধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী মুসলিম লীগের একটি আসন বিএনপিকে পরে দুশর বেশি আসন দিয়েছে। আজও আমরা আলোচনা করি না যে ১৬৯ আসনের মনোনয়ন কী প্রক্রিয়ায় হয়েছিল। একটি আসনের বিপরীতে কারা মনোনয়ন চেয়েছিল, আর তা কী প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়েছিল। কামাল হোসেনের বইয়ে এর উত্তর নেই। এটা উত্তর নয় যে সবাই তা মেনে নিয়েছিল। কোনো শান্তিভঙ্গ ঘটেনি। কোনো বোমা ফাটেনি। টাকার খেলা হয়নি। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আজও এই হাতবাছাইয়ের যুগে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে না। কিন্তু তাই বলে তাকে আমরা গণতান্ত্রিক বলে মানতে পারি না। আমার সন্দেহ দলের শক্তির বহিঃপ্রকাশ না থাকলে পর্দার আড়ালের শক্তি আরও বেশি শক্তিমান হয়ে ওঠে। আর সেটা না হলেও জনগণ নানা সন্দেহ করে। মার্চের আলোচনা কোথায় কীভাবে কেন ভেঙে গিয়েছিল, তা কামাল হোসেন চিত্রিত করেছেন। কিন্তু সব মুখ্য বিষয় এখানে আসেনি। এটা মোটেই অতীতের বিষয় নয়। বাংলাদেশ সংবিধানের যে সংস্কারের কথা বলছি তা কোনো দিন বাস্তবায়ন করতে হলে আওয়ামী লীগ ১৯৬২ সালের সংবিধানের কেন, কোথায় কী সংশোধনী চেয়েছিল, তা দফাওয়ারি বিতর্কের কেন্দ্রে আনতে হবে। ১৯৭২ থেকে আলোচনা করলে হবে না। ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান নিয়ে কোনো মতবিরোধ ছিল কি না তা জানা যায় না। মুসলমান ছাড়া রাষ্ট্রপতি হবেন না, এই বিধান নিয়েও বিরোধ হয়নি। এটা সত্যি হলে মনে হতেই পারে লড়াইটা গণতন্ত্রের নাকি ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছিল? ওই দুই বিধানে আওয়ামী লীগের কোনো সমস্যা না থাকলে আমরা কি এটাই সন্দেহ করব যে আওয়ামী লীগ উন্নয়নকে (স্বায়ত্তশাসনের অপর নাম) গণতন্ত্র ও ন্যায় থেকে আলাদা করে যে দেখছে সেটা নতুন নয়। এটা তাঁর অতি পুরোনো রুগ্ণ মতাদর্শ!

পিন্ডি ভাগ করে ক্ষমতা এনে ‘স্বায়ত্তশাসন’ করব ঠিক আছে, কিন্তু সেটা কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হবে সেটা কবে কোথায় বলা হয়েছিল? সেটা হয়নি এবং তার চিন্তারাজ্যেও তা ছিল না। তার প্রমাণ রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ কোনো প্রকারের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ২৩ বছর ধরে অগণতান্ত্রিকভাবে গড়ে তোলা প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনিক বিন্যাসে কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে তার লোকবলসহ তা কবুল করে নিল।

কামাল হোসেন দুটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। যা থেকে প্রমাণ মিলবে যে একটা অ্যাডহক ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রথম দিন থেকেই চালু করা হলো। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়েছেন। এখন তাঁরা কাজ করবেন কোথায়। প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা ভাবলেন তাঁরা নতুন সেনাবাহিনীতে ঠাঁই পাবেন। কিন্তু তা হলো না। বঙ্গবন্ধু ভাবলেন তাঁদের একটা ঠাঁই করে দেবেন বিডিআরে। কিন্তু সেখানে নীরবে আমাদের ইতিহাসের প্রথম নীরব পিলখানা বিদ্রোহ হলো। বিডিআর তাদের নেবে না। মুজিব সেখানে ছুটলেন। কিন্তু তাদের রাজি করানো গেল না। ফিরে এসেই তিনি রক্ষীবাহিনী গঠন করলেন। নুরুল ইসলামের বরাতে দুর্দান্ত তথ্য প্রকাশ করেছেন কামাল হোসেন। নুরুল ইসলাম চাইলেন এমন একটি পরিকল্পনা কমিশন, যেখানে পাকিস্তানিদের মতো আমলারা নীতিনির্ধারণে ছড়ি ঘোরাবেন না। কিন্তু আমলারা রীতিমতো তা প্রতিহত করলেন। তাঁরা এমনকি তাঁদের মাথার ওপরে নয়া রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেন। সন্দিগ্ধ আওয়ামী লীগ কেবল আমলাদের তোষণ করতেই বিচার বিভাগকে চূড়ান্তভাবে পৃথক করা থেকে বিরত থাকলেন। বড় নেতারা এসব মেনে নিলেন কারণ তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যে করেই হোক ক্ষমতায় অনেক দিন থাকবেন। তাই আমলাদের অন্যায় আবদারের সঙ্গে তাঁদের বিনা শর্তে সন্ধি করতে হলো।

কামাল হোসেন ভুট্টোর প্রতি বাঙালিদের সন্দেহের কথা বলেছেন। লিখেছেন ‘ভুট্টোর সঙ্গে আর্মির যোগসূত্র থাকার বিষয়ে কিছু সত্যতা থাকতে পারে।...হামিদ, উমর, গুল ও পীরজাদার মতো হকিশ জেনারেলরা ভুট্টোকে ‘জাতীয় স্বার্থের’ ধারকবাহক হিসেবে মনে করলেন (পৃ. ৭৫)।’

এই ধারণা সত্যি হলে তার মানে দাঁড়ায় এই যে জেনারেলরা একদা ‘জাতীয় স্বার্থে’ ভুট্টোকে তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মুজিবকে শায়েস্তা করা বা পথের কাঁটা দূর করার কাজে সাহায্য করেছিলেন, জেনারেলরাই পরে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। শেখ মুজিব ভুট্টোকে বলেছিলেন, সামরিক বাহিনীর ক্রীড়নক না হতে। বলেছিলেন, ব্যবহার করার পরে তাঁরা তোমাকে গিলে খাবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। এসব কথা সাধারণত লেখালেখি হয়। কিন্তু যেটা হয় না তা হলো আমলারা সবার আগে টের পায় যে রাজনীতিকেরা দলের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত জোরে নয়, তারা আমলাদের যথেচ্ছ ব্যবহার করার জোরে টিকে থাকতে চায়। সুতরাং এই রাজনীতিকেরাই ঝানু আমলাদের চোখে ক্রমশ বোঝা হয়ে ওঠেন। আর তখন তাঁরা ‘জাতীয় স্বার্থের’ সংজ্ঞাটা বদলে নেন। এটা বদলাতে যেটা করতে হবে সেটা হলো, জনপ্রশাসনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আমলা নিয়োগ ও পদোন্নতির পাশাপাশি মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দলীয় নেতা নির্বাচন ও তাঁদেরই আমলাদের নেতা বানানোর প্রক্রিয়া প্রবর্তন করতে হবে।

জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, দলীয় শাসন নির্বিশেষে এমনভাবে চালানো হয় যেখানে জনপ্রতিনিধিরা কখনো ডিসি ও টিএনওদের প্রভাববলয়ের বাইরে যেতে পারে না। মানুষও জেনে গেছে, ডিসি, এসপি ও টিএনওরাই সর্বেসর্বা। নির্বাচিতরা বড় নেতা ও বড় আমলা উভয়ের তল্পিবাহক।

বইটির ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে একাত্তরের ১ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন বর্ণিত হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি টানা ৯২ দিন অসহযোগ আন্দোলন করেছেন। সন্ত্রাস ও সহিংসতা ছাড়া আর কোনো ধরনের রাজনৈতিক অর্জন আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। এই দেউলিয়াপনা কেবল একটি দলের নয়, এটা বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন। সুতরাং কেবল বিএনপির নিন্দা ও সমালোচনা প্রাপ্য নয়, এই লজ্জা ও ব্যর্থতা রুগ্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া দুটোই সন্ত্রাসপ্রবণ হয়ে পড়েছে। জনগণ যদি সম্পৃক্ত থাকে তাহলে একটি শাসনব্যবস্থা কীভাবে গণমুখী হতে পারে তার একটি ধ্রুপদি নজির হলো মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলো।

সরকারকে অচল করা আর জনজীবনকে অচল করার মধ্যে পার্থক্য আনা হলো। টানা চার দিন সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত হরতাল হলো। তাও আবার ডাকঘর, রেলসহ সব ধরনের সরকারি ও বেসরকারি পরিবহন, কলকারখানাকে এর বাইরে রাখা হলো। তখন নেতারা চাইলেই টানা চার দিন হরতাল ডাকতে পারতেন। সেটা অসফল হতো না। তবে দেখার বিষয় হলো সেই কর্মসূচি ঠিক করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিরা। এখন কী প্রক্রিয়ায় কর্মসূচি দেওয়া হয় এবং কোথায় কীভাবে কারা সিদ্ধান্ত দেয় তা বোঝা কঠিন। তাহলে আমরা দেখি, দখলদার বাহিনী হটাতেও জনস্বার্থ মাথায় ছিল। আর স্বাধীন দেশে হরতাল ডাকা শুরুই হলো সব ধরনের পরিবহন ও কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়ার টার্গেট নিয়ে।

ড. কামাল হোসেনের বইটি যদিও আমাদের আলো দেখায় না যে বাকশাল কেন ও কী কারণে গঠন করা হয়েছিল। তবে এটা পরিষ্কার করে যে দলের পুনর্গঠনের চিন্তা তাজউদ্দীন আহমদ করেছিলেন, কিন্তু তা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ধরনের বহু তথ্য রয়েছে, যা আমাদের ইতিহাস নির্মোহভাবে অনুধাবনে গুরুত্বপূর্ণ। কামাল হোসেন তাঁর দিকের ঐতিহাসিক দায়িত্বটি নিশ্চয় অনেকখানি পালন করেছেন। কোথাও বলেননি, কিন্তু পাঠক পড়তে গিয়ে বুঝবেন যে তিনি ঐতিহাসিক ঘটনার সুতো গেঁথেছেন সমকালীন ঘটনাকে স্মরণ রেখেই। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে দলের গণতন্ত্রায়ণই মূলকথা। বর্তমানে সবচেয়ে অনীহা হলো অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্নটিকে অন্তত হাজার মাইল দূরে রাখা। দলের গণতন্ত্রই বাংলাদেশকে বাঁচাতে পারে। প্রথাগত সাধারণ নির্বাচন এর সমাধান দেবে না। অথচ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে ব্যক্তি বা কতিপয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গড়ে তোলার কথা আজও ভাবা হয়।

এত ঘটনা থাকতে ড. কামাল হোসেনের মনে পড়েছে একজন ইকবাল আতহারকে। এই ইকবালের গল্প দিয়ে শেষ করি। তিনি লিখেছেন, ‘ইকবাল অবাঙালি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি করা হয়। স্বাধীনতার পরপরই কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খলিকজ্জামানকে তৃণমূলের বাংলাদেশ দেখতে পাঠানো হয়েছিল। ওই ভদ্রলোক ইকবালের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে তাঁকে হেড অফিস থেকে পাঠানো হয়েছে মুসলিম লীগের সব স্থানীয় কমিটি বাতিল করে নতুন করে কমিটি গঠন করতে। এর লক্ষ্য কেন্দ্রের প্রতি অনুগতদের দিয়ে কমিটি গঠন করা (পৃ. ৭)।’ ইকবাল বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরে সপক্ষ ত্যাগ করেছিলেন। ইতালিতে তিনি আমাদের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

আমার কোনো সন্দেহ নেই যে দলীয় গণতন্ত্র প্রশ্নে আমরা যত কথাই বলি না কেন, আমরা ১৯৪৭ সালেই পড়ে আছি। এক-এগারোতে জবরদস্তি দলের নিবন্ধন ও তাদের অডিট ব্যবস্থা চালু করেছি, কিন্তু ওসবে কারও বিশ্বাস নেই। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয়ভাবে করার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির উপরে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। স্বায়ত্তশাসন যেটুকু তলানিতে জমত, তাও চেটেপুটে নিঃশেষ করা হবে। সর্বত্র আমাদের লোক চাই। এবার ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ’। আমার অনুগত লোক চাই। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, হাজার হাজার চৌধুরী খলিকজ্জামান সারা বাংলাদেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা কানে কানে বলছে, ‘অনুগত থাকো। হলে তোমারই হবে!’