সারসংক্ষেপ
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল এই ২৪ বছর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হয়। পাকিস্তান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, আমদানি-রপ্তানি নীতি, বৈদেশিক সাহায্য নীতি তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার প্রবণতা বরাবর লক্ষণীয় ছিল। ভূখণ্ড-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বলে। ভূখণ্ডের ওপর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন: রাজনৈতিক নিষ্পত্তি, স্বেচ্ছা একত্রীকরণ, ভূখণ্ডের হস্তান্তর, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীনতা অর্জন ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের সব সুবিধা অর্জনের অধিকারী। দ্বিপক্ষীয় পর্যায় এবং জরুরি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি। পাকিস্তানি শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ঘোষিত সম্পত্তির হিসাব এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পাওনার সমন্বয় করেও এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। পাকিস্তান মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসিকে এবং মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে যে অকূটনৈতিকসুলভ আচরণ করছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের কাছে প্রাপ্ত সম্পদের দাবি আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপিত করা বাংলাদেশ সরকারের জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশেও এ ব্যাপারে জনমত গঠন করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের সোচ্চার হতে হবে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: অর্থ ও সম্পত্তির দাবি, রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার, দায় গ্রহণ, সম্পদ বণ্টন, আন্তর্জাতিক আইন, কূটনৈতিক তত্পরতা।
ভূমিকা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পদ বণ্টন বিষয় অমীমাংসিত সমস্যা। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশ বিভক্ত হয়ে পড়লে বা স্বাধীন হলে দেশটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও বণ্টন হয়ে থাকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের একটি অংশ বাংলাদেশের প্রাপ্য হলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও বাংলাদেশ কোনো সম্পদ পাকিস্তানের কাছ থেকে পায়নি। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের অনীহার কারণে উচ্চপর্যায়ে কিছু আলোচনা ও কমিটি গঠন ছাড়া কোনো অগ্রগতি হয়নি। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জোরালো তত্পরতার অভাবে বিষয়টি পাকিস্তান আমলে আনেনি। এর ফলে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেমন সন্দেহ ও সংশয়মুক্ত হতে পারেনি, অন্যদিকে বাংলাদেশ সম্পদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে হয়েছে বঞ্চিত। বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে: প্রথমত, বাংলাদেশের পাকিস্তানের কাছে অর্থ ও সম্পদ দাবির ভিত্তি তুলে ধরা, দ্বিতীয়ত, সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন উপস্থাপনা এবং তৃতীয়ত, সম্পদ বণ্টন বিষয় দুদেশের মধ্যে এযাবত্ যেসব কূটনৈতিক তত্পরতা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা।
এক. বাংলাদেশের পাকিস্তানের কাছে অর্থ ও সম্পত্তি দাবির ভিত্তি
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল এই ২৪ বছর বাংলাদেশ বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার হয়। পাকিস্তান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, আমদানি-রপ্তানি নীতি, বৈদেশিক সাহায্য নীতি তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার প্রবণতা বরাবর লক্ষণীয় ছিল। যে কারণে তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশের মাথাপিছু আয়, উন্নয়ন-ব্যয়, রাজস্ব খাতে ব্যয়, বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তপ্রাদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে বিশাল বৈষম্য গড়ে ওঠে। বৈষম্য নিরসনে সরকারের উদ্যোগের অভাব, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব পূর্বাঞ্চলের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে। যে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল একটি বিপর্যস্ত ভূখণ্ড। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ। ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যক্রম পরিচালনা কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ১২৪৯ কোটি টাকা।১
এ প্রসঙ্গে ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত কয়েকটি খাতের বৈষম্য তুলে ধরলে দাবিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে চূড়ান্ত ও আপেক্ষিকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৪৯ সালে দুই অঞ্চলের ব্যবধান ছিল যেখানে ৬৩ টাকা (২১.৯%), তা ২০ বছরের ব্যবধানে ১৯৬৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২০২ টাকায় (৬১.০৫)।২ দ্বিতীয়ত, রাজস্ব খাতে আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য নীতি প্রকটভাবে দেখা যায়। ১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত ৭২৮.৫ কোটি টাকা আয় করে খরচের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পূর্ব পাকিস্তান রাজস্ব ও উন্নয়ন খাত থেকে বরাদ্দ পায় ১৩৩৬.২ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান ১৭৮১.৭ কোটি টাকা আয় করে ব্যয়ের জন্য পায় ২৭৬৭.১ কোটি টাকা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়ন খাতে পায় যথাক্রমে ৮৫১.৫ কোটি ও ১১০৭.৬ কোটি টাকা।৩ এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য ঘাটতি পূরণ ও বৈদেশিক সাহায্য বণ্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষণীয়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ৭৬৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পেলেও পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে ২০২৪ মিলিয়ন ডলার বা ২৬.৬ শতাংশ।৪ অবশ্য এ ঋণের ৬৪৩৯ মিলিয়ন ডলার কাজে লাগানো হয় এবং বাংলাদেশ পায় ১৯৪১ মিলিয়ন ডলার বা ৩০ শতাংশ।৫ অথচ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের ৫৬ শতাংশ কিংবা সমবণ্টনের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ ঋণ প্রাপ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। চতুর্থত, পাকিস্তানের বাণিজ্যনীতির মধ্যেও শোষণের বীজ রোপিত ছিল। ১৯৪৭-৭০ সালের মধ্যে মোট রপ্তানির ৫৪.৭ শতাংশ আয় করেছে পূর্ব পাকিস্তান, এর পরিমাণ ছিল ২৫,৫৫৯ মিলিয়ন টাকা অর্থাত্ ৫,৩৭০ মিলিয়ন ডলার (৩১.১ শতাংশ)। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান আয় করেছে ২১,১৩৭ মিলিয়ন টাকা (৪,৪৪০ মিলিয়ন ডলার)। মোট রপ্তানি আয়ের ৪৬,৬৯৬ মিলিয়ন টাকার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আমদানির জন্য এ সময় বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ২০,০৬৭ মিলিয়ন টাকা অর্থাত্ ৪,২২৬ মিলিয়ন ডলার এবং পশ্চিম পাকিস্তান পেয়েছে ৯,৩১২ মিলিয়ন ডলার।৬ এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের উদ্বৃত্ত ৪৪২২ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করা হয়। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, রপ্তানি আয় থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ হবে ২০০০ মিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক শোষণের আরও একটি ক্ষেত্র ছিল দুই অঞ্চলের বাণিজ্য। ১৯৪৭-৬৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি হয় ১৭৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করতে হয় ৩৩০৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।৭ এমনিভাবে দুটি অঞ্চল বাণিজ্যের নামে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন ও অর্থ পাচার করে। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল সরকার-নিয়ন্ত্রিত দৈনিক বাংলা দাবি করে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের ৫০০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।