পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা সম্পদ: প্রামাণ্য মূল্যায়ন

সারসংক্ষেপ

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল এই ২৪ বছর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হয়। পাকিস্তান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, আমদানি-রপ্তানি নীতি, বৈদেশিক সাহায্য নীতি তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার প্রবণতা বরাবর লক্ষণীয় ছিল। ভূখণ্ড-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বলে। ভূখণ্ডের ওপর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন: রাজনৈতিক নিষ্পত্তি, স্বেচ্ছা একত্রীকরণ, ভূখণ্ডের হস্তান্তর, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীনতা অর্জন ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের সব সুবিধা অর্জনের অধিকারী। দ্বিপক্ষীয় পর্যায় এবং জরুরি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি। পাকিস্তানি শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ঘোষিত সম্পত্তির হিসাব এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পাওনার সমন্বয় করেও এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। পাকিস্তান মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসিকে এবং মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে যে অকূটনৈতিকসুলভ আচরণ করছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের কাছে প্রাপ্ত সম্পদের দাবি আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপিত করা বাংলাদেশ সরকারের জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশেও এ ব্যাপারে জনমত গঠন করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের সোচ্চার হতে হবে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: অর্থ ও সম্পত্তির দাবি, রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার, দায় গ্রহণ, সম্পদ বণ্টন, আন্তর্জাতিক আইন, কূটনৈতিক তত্পরতা।

ভূমিকা

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পদ বণ্টন বিষয় অমীমাংসিত সমস্যা। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশ বিভক্ত হয়ে পড়লে বা স্বাধীন হলে দেশটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও বণ্টন হয়ে থাকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের একটি অংশ বাংলাদেশের প্রাপ্য হলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও বাংলাদেশ কোনো সম্পদ পাকিস্তানের কাছ থেকে পায়নি। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের অনীহার কারণে উচ্চপর্যায়ে কিছু আলোচনা ও কমিটি গঠন ছাড়া কোনো অগ্রগতি হয়নি। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জোরালো তত্পরতার অভাবে বিষয়টি পাকিস্তান আমলে আনেনি। এর ফলে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেমন সন্দেহ ও সংশয়মুক্ত হতে পারেনি, অন্যদিকে বাংলাদেশ সম্পদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে হয়েছে বঞ্চিত। বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে: প্রথমত, বাংলাদেশের পাকিস্তানের কাছে অর্থ ও সম্পদ দাবির ভিত্তি তুলে ধরা, দ্বিতীয়ত, সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন উপস্থাপনা এবং তৃতীয়ত, সম্পদ বণ্টন বিষয় দুদেশের মধ্যে এযাবত্ যেসব কূটনৈতিক তত্পরতা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা।

এক. বাংলাদেশের পাকিস্তানের কাছে অর্থ ও সম্পত্তি দাবির ভিত্তি

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল এই ২৪ বছর বাংলাদেশ বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার হয়। পাকিস্তান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, আমদানি-রপ্তানি নীতি, বৈদেশিক সাহায্য নীতি তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার প্রবণতা বরাবর লক্ষণীয় ছিল। যে কারণে তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশের মাথাপিছু আয়, উন্নয়ন-ব্যয়, রাজস্ব খাতে ব্যয়, বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তপ্রাদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে বিশাল বৈষম্য গড়ে ওঠে। বৈষম্য নিরসনে সরকারের উদ্যোগের অভাব, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব পূর্বাঞ্চলের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে। যে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল একটি বিপর্যস্ত ভূখণ্ড। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ। ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যক্রম পরিচালনা কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ১২৪৯ কোটি টাকা।১

এ প্রসঙ্গে ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত কয়েকটি খাতের বৈষম্য তুলে ধরলে দাবিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে চূড়ান্ত ও আপেক্ষিকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৪৯ সালে দুই অঞ্চলের ব্যবধান ছিল যেখানে ৬৩ টাকা (২১.৯%), তা ২০ বছরের ব্যবধানে ১৯৬৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২০২ টাকায় (৬১.০৫)।২ দ্বিতীয়ত, রাজস্ব খাতে আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য নীতি প্রকটভাবে দেখা যায়। ১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত ৭২৮.৫ কোটি টাকা আয় করে খরচের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পূর্ব পাকিস্তান রাজস্ব ও উন্নয়ন খাত থেকে বরাদ্দ পায় ১৩৩৬.২ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান ১৭৮১.৭ কোটি টাকা আয় করে ব্যয়ের জন্য পায় ২৭৬৭.১ কোটি টাকা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়ন খাতে পায় যথাক্রমে ৮৫১.৫ কোটি ও ১১০৭.৬ কোটি টাকা।৩ এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য ঘাটতি পূরণ ও বৈদেশিক সাহায্য বণ্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষণীয়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ৭৬৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পেলেও পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে ২০২৪ মিলিয়ন ডলার বা ২৬.৬ শতাংশ।৪ অবশ্য এ ঋণের ৬৪৩৯ মিলিয়ন ডলার কাজে লাগানো হয় এবং বাংলাদেশ পায় ১৯৪১ মিলিয়ন ডলার বা ৩০ শতাংশ।৫ অথচ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের ৫৬ শতাংশ কিংবা সমবণ্টনের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ ঋণ প্রাপ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। চতুর্থত, পাকিস্তানের বাণিজ্যনীতির মধ্যেও শোষণের বীজ রোপিত ছিল। ১৯৪৭-৭০ সালের মধ্যে মোট রপ্তানির ৫৪.৭ শতাংশ আয় করেছে পূর্ব পাকিস্তান, এর পরিমাণ ছিল ২৫,৫৫৯ মিলিয়ন টাকা অর্থাত্ ৫,৩৭০ মিলিয়ন ডলার (৩১.১ শতাংশ)। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান আয় করেছে ২১,১৩৭ মিলিয়ন টাকা (৪,৪৪০ মিলিয়ন ডলার)। মোট রপ্তানি আয়ের ৪৬,৬৯৬ মিলিয়ন টাকার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আমদানির জন্য এ সময় বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ২০,০৬৭ মিলিয়ন টাকা অর্থাত্ ৪,২২৬ মিলিয়ন ডলার এবং পশ্চিম পাকিস্তান পেয়েছে ৯,৩১২ মিলিয়ন ডলার।৬ এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের উদ্বৃত্ত ৪৪২২ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করা হয়। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, রপ্তানি আয় থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ হবে ২০০০ মিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক শোষণের আরও একটি ক্ষেত্র ছিল দুই অঞ্চলের বাণিজ্য। ১৯৪৭-৬৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি হয় ১৭৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করতে হয় ৩৩০৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।৭ এমনিভাবে দুটি অঞ্চল বাণিজ্যের নামে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন ও অর্থ পাচার করে। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল সরকার-নিয়ন্ত্রিত দৈনিক বাংলা দাবি করে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের ৫০০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।

দুই. রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার, দায় গ্রহণ ও সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইন

ভূখণ্ড-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বলে। ভূখণ্ডের ওপর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন: রাজনৈতিক নিষ্পত্তি, স্বেচ্ছা একত্রীকরণ, ভূখণ্ডের হস্তান্তর, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীনতা অর্জন ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের সব সুবিধা অর্জনের অধিকারী।

রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার দুটো আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এগুলো হচ্ছে চুক্তি-সংক্রান্ত ১৯৭৮ সালের ২৩ আগস্ট এবং ১৯৮৩ সালের ৭ এপ্রিল প্রণীত ‘ভিয়েনা কনভেনশন’। ১৯৮৩ সালের কনভেনশনের ৪০-৪১ ধারায় দায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের অংশবিশেষ একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ হয়ে একাধিক রাষ্ট্রের অংশে পরিণত হয় তখন বিভক্ত রাষ্ট্র বা ভূখণ্ডের ঋণও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ হবে। সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইনের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে হস্তান্তরিত ভূখণ্ডে অবস্থিত বা হস্তান্তরিত ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত সব স্থাবর ও অস্থাবর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি এবং তহবিলের অধিকার উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রের ওপর বর্তাবে। এই বিধান সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা লাভ করেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত আন্তর্জাতিক আদালত ও স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত এবং অভিমতেও অনুরূপ স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এমনকি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পূর্ববর্তী রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে বা বিদেশে অবস্থিত হলেও তা যদি হস্তান্তরিত ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয় তাহলে তার অধিকার উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রের। তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের উত্তরাধিকারীর অধিকার এক কথায় এভাবে প্রকাশ করা যায় যা ১৯৭৮ সালের ‘ভিয়েনা কনভেনশনের’ আর্টিক্যাল ২-এ বর্ণিত আছে। এতে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার পূর্ববর্তী রাষ্ট্রের তহবিল এবং অস্থাবরসহ সব বিষয়ে সম্পত্তিতে হিস্যার অধিকারী।৮ আন্তর্জাতিক আইনের এসব ধারার ভিত্তিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা, স্থাবর সম্পত্তি, বিমান (পিআইএ), ব্যাংক-বিমা, রেলওয়ে, শিল্পসহ অন্যান্য খাতে অর্থ দাবি করতে পারে। এমনকি ১৯৭১ সালের আগে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের অনেক সম্পত্তি বিদেশের মাটিতে ছিল, যেমন দূতাবাসের ভবন বা ভবন স্থানে অনেক অস্থাবর সম্পত্তি ছিল। আন্তর্জাতিক আইনের ওই কনভেনশনের ১৭-১৮ ধারায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে এই সম্পদ পাওয়ার অধিকারী। এ ক্ষেত্রে আইনে পূর্ববর্তী বা সাবেক রাষ্ট্রের ঋণের দায় গ্রহণও জরুরি।৯ আন্তর্জাতিক আইনে যেহেতু নতুন রাষ্ট্রকে উত্তরাধিকার রাষ্ট্র হিসেবে দেখা হয়, তাই বাংলাদেশের মতো যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের সম্পদের পরিমাণ নির্ধারণ ও বণ্টনের জন্য একটি চুক্তি সম্পাদন করা জরুরি।

অবশ্য পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের মধ্যে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট ৫০৬.৭৬১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩.৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের দায় গ্রহণ করে।১০ এ ছাড়া চলমান প্রকল্পের ১৪৫.৮৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩৬.১২১ মিলিয়ন ডলারের দায়ও বাংলাদেশ গ্রহণ করে। পাকিস্তান এত দিনের দাবি বৈদেশিক ঋণের এক-তৃতীয়াংশ পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয়ের যে হিসাব দেখানো হতো বাংলাদেশের ঋণের দায় গ্রহণের ফলে বৈদেশিক ঋণ-সংক্রান্ত দুদেশের টানাপোড়েনের অবসান ঘটে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর ঋণ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যত তত্পর ছিল বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে সম্পদ প্রাপ্তির ব্যাপারে ততটা তত্পরতা দেখায়নি।

তিন. সম্পদ বণ্টন বিষয়ে গৃহীত উদ্যোগ ও কূটনৈতিক তত্পরতা, ১৯৭২-২০১৫

স্বাধীনতার পর সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি বাংলাদেশ বিক্ষিপ্তভাবে উত্থাপন করলেও ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ এ ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়। মূলত বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়সহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তির স্বার্থে সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপপ্রচার খণ্ডনে ব্যস্ত থাকায় এত দিন বাংলাদেশ এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। ১৯৭৪ সালের জুন মাসের মধ্যেই পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণ পরিশোধে বিশ্বব্যাংক ও দাতাদেশগুলোর নির্ণীত ফর্মুলার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সমঝোতায় পৌঁছালে তার পক্ষ থেকে সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারটি আরও গুরুত্ব পায়। সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশ গুরুত্ব দেওয়ার পর থেকে পাকিস্তান অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করে। পাকিস্তান সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের কাছে সম্পদ বণ্টনের জোরালো দাবি না করলেও স্বাধীনতার পর অর্থাত্ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা (স্বাধীনতার আগে যাদের বাংলাদেশে ব্যবসা ছিল) সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের কাছে সম্পদ দাবি করতে থাকে। এভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে পাকিস্তান আগাম প্রতিষেধক নেয়, যাতে করে বাংলাদেশ সম্পদ বণ্টনে কোনো রকম জোরালো দাবি না করতে পারে। অবশ্য বাংলাদেশের দাবি আন্তর্জাতিক আইনে যতটা জোরালো ছিল তার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের দাবি টেকানো ছিল কষ্টকর। তাই সম্পদ বণ্টনে পাকিস্তান সরকার কার্যত মৌনভাব অবলম্বনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিষ্ক্রিয় রাখার নীতি গ্রহণ করে।

তবে এটা ঠিক, পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক অবাঙালিরা যুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতার প্রাক্কালে তাদের সম্পত্তি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান রেখেই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্পত্তি প্রথমে পরিত্যক্ত এবং পরে জাতীয়করণ করে সরকারের অধীনে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে করাচিতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ ঢাকা ও করাচির স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির হিসাবের ওপর ভিত্তি করে একটি সমীক্ষা চালায়। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে এই সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন যে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের ২১০ কোটি রুপির সম্পত্তি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৯৮ কোটি রুপি পাট শিল্প, ২৫ কোটি রুপি কাগজ ও বোর্ড শিল্প, ২২ কোটি রুপি বিদ্যুত্ ও তেল, ২০ কোটি রুপি রেয়ন ও সিনথেটিক এবং ১৭ কোটি রুপি সুতা বয়ন খাতে। অবশ্য এই হিসাবে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের পাওনার একটি ভিন্ন খতিয়ান এই সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়। দেখা যায় যে ৪৯৮৩.৮৫ লাখ রুপি বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যবসা ও শিল্পের দাবির সঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ২১০ কোটি রুপির সম্পদ যোগ করলে মোট দাবির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১৯৩.৮৫ কোটি রুপি।১১ এই সমীক্ষাটি সরকারি পর্যায়ে সম্পন্ন না হলেও এর পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের দাবির বিপরীতে এ রকম একটি আগাম প্রতিষেধক নিয়ে রাখা। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের শেষদিক থেকে অস্পষ্টভাবে পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদের দাবির বিষয়টি উত্থাপন করতে শুরু করে। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যেকোনো দেশকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেনে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেন।১২ অবশ্য এখানে অর্থনৈতিক লেনদেন বলতে তিনি সম্পদ বণ্টনকে বুঝিয়েছেন কি না সেটা স্পষ্ট নয়। তাঁর ওই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে এ সময় বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদেশগুলোর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ওপর ঋণের দায় চাপানোর পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ের নিষ্পত্তিরও তিনি ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারেন। অবশ্য বাংলাদেশ স্বীকৃতিসহ বিহারিদের প্রত্যাবাসন, পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যতটুকু সোচ্চার ছিল, সম্পদ বণ্টনের দাবিতে ততটা ছিল না। হয়তো এ লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য ইচ্ছেকৃতভাবেই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছে। অবশ্য ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে জাপান সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের এ সম্পর্কে বলেন, ‘ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছেন এ কারণে যে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশকে সম্পদের অংশ দিতে বাধ্য হবেন। পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের সব সম্পদ নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের কোনো জাহাজ ও বিমান পর্যন্ত রেখে যায়নি। তাদের উচিত দ্রুত স্বীকৃতি ও আমাদের প্রাপ্য সম্পদ ফেরত দেওয়া। আমি আন্তর্জাতিক আইনে ন্যায়সংগত প্রাপ্য ছাড়া পাকিস্তানের কাছ থেকে আর কিছুই চাই না।’১৩

অবশ্য ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভের পর বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সচেতন হয়। এত দিন পাকিস্তানের স্বীকৃতির ব্যাপারটিকে সামনে রেখে এ বিষয়ে তেমন জোর না দিলেও এ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। এ বছর ৬ মার্চ অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, পাকিস্তানের স্বীকৃতি তার কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব সম্পত্তির হিস্যা আদায়ের পথ প্রশস্ত করেছে।১৪ ৫-৯ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান আলোচনায় বসে। সম্পদ বণ্টন ইস্যুটি বৈঠকে উপস্থাপিত হবে, বৈঠকের প্রাক্কালে এমন ধারণা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচিত হয়। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন দিল্লি যাওয়ার প্রাক্কালে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে, এ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেন। বৈঠকের দুই দিন আগে সরকার-নিয়ন্ত্রিত দৈনিক বাংলা পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদের ওপর বিস্তারিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনার পরিমাণ ৫০০০ কোটি টাকা। এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর (১৯৪৭) থেকে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তত্কালীন পাকিস্তান বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ২৪৪৬ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার টাকা অর্জন করে। অন্যদিকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্জন করে ২৮৫৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর থেকে দেখা যায়, এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তান আমদানি করে ৪১২ কোটি ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বেশি অর্জন করেছে। অথচ ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান আমদানি করে ৪৮৬১ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার টাকার পণ্য। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানি করা হয় মাত্র ২৩৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৫১ হাজার টাকার পণ্য। সুতরাং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে হিসাব করা হলে বৈদেশিক বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ২৯৩৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া উচিত ছিল। এটা শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাওনার পরিমাণ। স্বাধীনতার পর মুদ্রামানের ৬৪ শতাংশ হ্রাসের কারণে ১৯৭৪ সালে সেটা দাঁড়ায় ৫০০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের সঙ্গে দুটি দেশের উন্নয়ন-ব্যয়সহ মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি ধরা হলে পাওনা আরও বেড়ে যায়।১৫ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে শুধু ত্রিমুখী প্রত্যাবাসনকে প্রাধান্য দেওয়ায় শেষত সম্পদ বণ্টন ইস্যুটি আর উত্থাপিত হয়নি। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে দুটি দেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক অমীমাংসিত বিষয় যেমন বিহারিদের প্রত্যাবাসন ও সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে পাকিস্তানের ইতিবাচক উদ্যোগের ওপরই নির্ভরশীল। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে আশ্বাস দেন যে দুটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর এ বিষয় একটি সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হবে। তাঁর এই বক্তব্যে ভুট্টোর আসন্ন ঢাকা সফরে এ বিষয়ে মীমাংসায় উপনীত হওয়ার যথেষ্ট ইঙ্গিত ছিল। তবে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের পর সরকারি ও বেসরকারি মহলে এ বিষয় আলোচনা হতে থাকে।

বাংলাদেশে তখন ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট চলছিল এবং বাংলাদেশ সরকার তার প্রাপ্য সম্পদের অন্তত কিছু অংশ লাভের মাধ্যমে যেন সংকট থেকে উত্তরণের কথাই ভাবছিল। যদিও এই দাবি তোলা যত সহজ ছিল তার অর্জন ছিল তার চেয়ে বহুগুণে কঠিন। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসেই পাকিস্তানের কোনো কোনো মহল ও গণমাধ্যম থেকে বাংলাদেশের কাছে পাল্টা সম্পদ দাবি করা হয়। উর্দু পত্রিকা নওয়া-ই-ওয়াক্ত ১৯ এপ্রিল এক প্রতিবেদনে দাবি করে, শুধু বিহারিদের বাংলাদেশে ৫৫০০ কোটি রুপি সম্পদ রয়েছে এবং বাংলাদেশের উচিত পাকিস্তানকে ওই অর্থ ফেরত দেওয়া।১৬ এই প্রতিবেদনের হিসাব থেকে বুঝতে কঠিন হয় না যে বাংলাদেশের ৫০০০ কোটি টাকার দাবির বিপরীতে ৫৫০০ কোটি রুপির পাল্টা দাবির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সম্পদ দাবির ভিত্তিকে দুর্বল করা। এ মাসের শেষদিকে অবশ্য পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দাবি করে বাংলাদেশে অবাঙালি ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও বিহারিরা অন্তত ৩০০ মিলিয়ন ডলার সম্পদ ফেলে এসেছে।১৭ অবশ্য কিসের ভিত্তিতে এই হিসাব করা হয়েছে, তার কোনো উল্লেখ করা হয়নি। মে মাসে পাকিস্তানি ব্যবসায়ী সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তানি ব্যবসায়ী সমিতি’ করাচি স্টক এক্সচেঞ্জ ট্রেডিং হলের এক সভায় অনতিবিলম্বে বাংলাদেশে তাদের ফেলে আসা ৪০০-৫০০ কোটি রুপির সম্পদ উদ্ধারে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করে।১৮ এপ্রিল মাসে দৈনিক বাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা ও ব্যবসায়ীদের সম্পদ দাবির অতি-উত্সাহী মনোভাবের পেছনে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিকে দুর্বল করে দেওয়াই যে উদ্দেশ্য ছিল সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। পাকিস্তানের এই উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভুট্টোর ঢাকা সফরকালে ১৯৭৪ সালের জুন মাসে প্রথম আনুষ্ঠানিভাবে সম্পদের হিস্যা দাবি করে। তাঁর সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশন ১৯৭১ সালের পাকিস্তান সরকারের পরিসংখ্যানকেই বিবেচনায় রাখে এবং সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে চারটি নীতি নির্ধারণ করে। এগুলো হলো:

১. জনসংখ্যা নীতি: এই নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ শতাংশ সম্পদ দাবি করতে পারে, ২. সমতার নীতি: এই নীতিতে বাংলাদেশ ৫০ শতাংশ দাবি করতে পারে, ৩. বৈদেশিক মুদ্রানীতি: তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক অর্জিত মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ভিত্তিতে ৫৪ শতাংশ সম্পদের দাবি করতে পারে, ৪. সমগ্র দেশের সম্পদের অনুপাতের নীতি: এই নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৪৪ শতাংশ সম্পদ দাবি করতে পারে।

সারণি-১

জনসংখ্যার ভিত্তিতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের মোট দাবি

খাত

টাকারপরিমাণ (কোটি টাকায়)

  1. কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রমের ওপর দাবি

২১৯৯.০৮

  1. কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করপোরেশনসমূহের হিসাবের ওপর দাবি

২৪৬.৮৭

  1. যুদ্ধজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবি

৩২৪০.০০

মোট

৫৬৮৫.৯৫

সূত্র: মতিউর রহমান, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক একটি প্রকাশিত হিসাব’, সাপ্তাহিক সন্ধানী, ঈদসংখ্যা, মে ১৯৯৮, পৃ. ২৩।

এই হিসাব প্রণয়নে পাকিস্তান সরকারের চলতি ব্যয়, পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত ব্যয়, প্রতিরক্ষা ও প্রতিরক্ষা খাতে প্রদত্ত বৈদেশিক সাহায্যকেও বিবেচনায় রাখা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সেটিও বিবেচনায় আনা হয়। এই হিসাবে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী যে ধ্বংসসাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করে তাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের এই হিসাবে মূলত তিনটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের পাওনার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় এবং এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় মোট ৫৬৮৫.৯৫ কোটি টাকা (সারণি-১)। অবশ্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের পাওনার একটি হিসাব এতে দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান ১০.৮৮ কোটি টাকা পাবে (সারণি-২)।২০ যদিও বাংলাদেশের পাওনা সম্পদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দুজন পশ্চিমা গবেষক পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৩৯৭৫ মিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করেন (সারণি-৩)। যদিও এ হিসাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি ধরা হয়নি।

সারণি-২

পাকিস্তানেরকাছেবাংলাদেশেরদায়

পাকিস্তান

টাকার পরিমাণ  (কোটি রুপি)

  1. ইকুইটি পার্টিসিপেশন ফান্ড (ইপিএফ)

২.৬৩

  1. হাউস বিল্ডিং করপোরেশন (এইচবিএফপি)

৮.৮৮

মোট

১০.৮৮

Source: Syed Serajul Islam, Bangladesh-Pakistan Relations: From Conflict to Cooperation, in Emajuddin Ahmed (Ed.) Foreign Policy of Bangladesh: A Small States Imperative, Dacca: UPL, 1981, p.59.

১৯৭৪ সালের জুনের শেষদিকে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরকালে দুটি দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে যে খসড়া দলিল দেওয়া হয়, তাতে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। বৈঠকে বাংলাদেশ স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ১১,০০০,০০০ ডলারসহ মোট ৪০০০ মিলিয়ন ডলার সম্পদ দাবি করে।২২ অবশ্য প্রথমদিকে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনা করতেই রাজি হয়নি। ভুট্টো মনে করেন, তাঁর সফরসঙ্গীর ১০০ জনের মধ্যে কোনো বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। বাংলাদেশের চাপে পাকিস্তান এ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত একটি কমিটি গঠনে রাজি হয়। তবে পাকিস্তান এ কথাও জানিয়ে দেয় যে নীতিগতভাবে সে এই প্রস্তাব গ্রহণে প্রস্তুত নয়।২৩ এর থেকে এই ইস্যুতে ভুট্টোর কমিটি গঠনের প্রস্তাবটি যে সময় ক্ষেপণের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

সারণি-

সমতারভিত্তিতেবাংলাদেশেরপাকিস্তানেরকাছেপাওনাপরিমাণ (১৯৭১সালপর্যন্ত)

  1. অভ্যন্তরীণ উত্পাদনশীল সম্পদের মূল্যমানে

১৪,৬০০

৬,৪৫০

২১,০৫০

  1. বৈদেশিক ঋণ

৮৫০

১৫০

১,০০০

  1. বৈদেশিক ঋণ

স্বাধীনতার আগে মোট সম্পদ (১+৩-২)

৫০০

১৪,২৫০

-

৬,৩০০

৫,০০০

২০,৫৫০

সমবণ্টনের ভিত্তিতে সম্পদ হওয়া উচিত

১০,২৭৫

১০,২৭৫

২০,৫৫০

এই ভিত্তিতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা

-৩,৯৭৫

+৩৯৭৫

-

Source: Just Faaland and J. R. Parkinson. Bangladesh the Test Case of Development, London: C Hurst & Company, 1976, p.190.

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকে বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা, অস্থাবর সম্পত্তি, শিপিং, বিমানসহ সব সম্পদ নিয়ে গিয়েছে। তাই তিনি শুধু মজুত স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার খাতে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ কিছু অর্থ দুই মাসের মধ্যে দেওয়ার প্রস্তাব করেন।২৪ পাকিস্তান এই প্রস্তাব শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং কোনো কোনো উত্স থেকে ভুট্টোর বাংলাদেশের কাছে বৈদেশিক ঋণ খাতে পাল্টা ৪-৬ বিলিয়ন ডলার দাবির প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়।২৫ পাকিস্তানের এই অনমনীয় মনোভাবের ফলে অমীমাংসিত ইস্যু বিশেষ করে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি এবং বাংলাদেশের দৃষ্টিতে সফরটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যদিও পাকিস্তানের দৃষ্টিতে অমীমাংসিত ইস্যু মীমাংসার লক্ষ্য থেকে নয়, বরং সফরটি ছিল মূলত অনুসন্ধানমূলক এবং তাই এটি সফল।

অবশ্য পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী দলগুলো স্বাধীনতার পর স্বীকৃতির বিরুদ্ধে অন্যতম যুক্তি হিসেবে বাংলাদেশের পাওনা সম্পদ-সংক্রান্ত দাবিকে তুলে ধরে। ভুট্টোর সফরের সময় তারা বাংলাদেশের এই দাবির সমালোচনায় আবারও মুখর হয়ে ওঠে। স্বয়ং ভুট্টো ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা এলেও সফরের ব্যর্থতার বিষয়টি আড়াল করতে দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের দাবির সমালোচনায় এসব দলের সঙ্গে একাত্ম হন। ১৯৭৪ সালের ২০ ডিসেম্বর ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তানকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন সম্পদ বণ্টনের নতুন বিষয় উত্থাপন করছে। আমি খুশি হতাম যদি সম্পদ বণ্টনের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ এবং তার দায়-দায়িত্বের বিষয় নিয়েও আলোচনা হতো। কিন্তু তারা শুধু সম্পদ চায়, দায় গ্রহণ করতে চায় না। এর অর্থ দাঁড়ায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে তারা ৫৬ শতাংশ সম্পদ পাবে এবং পাকিস্তান তাদের তা দিয়ে দেবে। যা আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো অসম্ভব এবং এর ফলে সম্পর্ক স্থাপন বাধাগ্রস্ত হবে।২৬ ১৯৭৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে জাপানের দৈনিক মিয়ানচি পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বাংলাদেশের সম্পদ দাবির সমালোচনা করেন।২৭ অন্যদিকে পাকিস্তান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে পূর্বশর্ত হিসেবে সম্পদ বণ্টন ও অবাঙালি প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়। এ বিষয়ে দুটি দেশের দৃষ্টিভঙ্গিগত অমিলের কারণেই শেখ মুজিব আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশ ইস্যুটির অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের চেষ্টা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পথে ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর লন্ডনে হিথরো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতি অমীমাংসিত সমস্যাবলির সমাধানের ওপর নির্ভরশীল। আমরা আমাদের সম্পদের ন্যায্য হিস্যা চাই। আমরা তো কারও কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি না।২৮

 ১৯৭৫ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত জ্যামাইকার রাজধানী কিংসটনে কমনওয়েলথ সরকার-প্রধানদের বৈঠকে সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যুটির সমাধানে আলাদাভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেলমন্ত্রী ওতেইবা ১৮ জুন ঢাকা সফর শেষে পাকিস্তান সফর করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে জেদ্দায় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যুটি উত্থাপন করার সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ফিরেই বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এমন একটি ধারণাও দেন।২৯ বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখে এবং কুয়েত, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের মধ্যে যেকোনো একটি দেশের মধ্যস্থতা কামনা করে। ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের উদ্যোগের কারণে তিনটি বিষয় সফল হয়: প্রথমত, পাকিস্তানের অপচেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম দেশ, বিশেষ করে আরব দেশগুলো সম্পদ বণ্টন বিষয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ আরব বিশ্বের পূর্ণ আস্থা অর্জন করে; তৃতীয়ত, পাকিস্তানের অপপ্রচার ব্যর্থ হয় এবং সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে আসন্ন জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে আবারও আলোচনা হবে।৩০ অবশ্য পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের সম্পদ বণ্টন ইস্যু উপস্থাপনের সমালোচনা করে মন্তব্য করা হয় যে যেহেতু বিষয়টি খুবই জটিল, তাই বাংলাদেশের প্রথম সহজ সমস্যাগুলোর সমাধান করে এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।৩১ অবশ্য পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত অপর ইস্যু অর্থাত্ বিহারি প্রত্যাবাসনও ছিল একই ধরনের জটিল সমস্যা এবং বাংলাদেশ সম্পর্কের পূর্বশর্ত হিসেবে এ দুটো বিষয়কেই চিহ্নিত করে। তাই পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো নিছক সমালোচনার স্বার্থে সমালোচনা করলেও সমস্যা সমাধানে কোনো পথ দেখায়নি।

১৯৭৫ পরবর্তী সম্পদ বণ্টন ইস্যু

তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের ফলে আগস্টে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে পূর্ব নির্ধারিত সম্পদ বণ্টন ইস্যুটি উত্থাপিত হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্রুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে অতি-উত্সাহের কারণে বাংলাদেশের নতুন শাসকেরা সম্পদ বণ্টনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়াই সঠিক মনে করেন। এমনকি সম্পদ বণ্টনের দাবি প্রত্যাহারেও রাজি হয় এবং সেই শর্তেই অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার সুফল ঘরে আনতে ব্যর্থ হয় এবং লেনদেনে এবারও বঞ্চিত হয়। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ এক সরকারি ঘোষণায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে খুশি হয়, কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বড় অংশই তাদের মালিকানাধীন ছিল এবং এ খাতে বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সরকারের কাছে পাওনা ছিল প্রায় ৫০.৫ মিলিয়ন ডলার, যার বড় অংশই ছিল পাকিস্তানিদের।৩২ বাংলাদেশে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হওয়া সত্ত্বেও সরকার ১৯৭৮ সাল থেকে কিছু কিছু পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দিতে থাকে।

১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে সরকারের এক আদেশে পরিত্যক্ত সম্পদের মালিকানা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সাপেক্ষে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দাবি করে হাইকোর্টে রিট আবেদনের সুযোগ পান। এই অধ্যাদেশে যেসব অবাঙালি প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি মালিকানা বাঙালিদের হাতে ন্যস্ত সে সমস্ত সম্পত্তির বেলায় আলাদা নিয়ম জারি করা হয়। এ নিয়ম অনুযায়ী পরিত্যক্ত সম্পত্তির বাঙালি মালিকদের অংশ বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ অধ্যাদেশের পরপর দুই প্রক্রিয়ায় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরোনো নন-জুডিশিয়াল স্টাম্পে পাকিস্তান মালিকানাধীন পরিত্যক্ত শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি মালিকানা বাঙালিদের অনেকে নিজেদের নামে লিখিয়ে আনে ও পরবর্তীকালে সেসব সম্পত্তির ওপর নিজেদের অধিকার দাবি করে। অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি মালিকেরাও ঢাকা এসে নিজেদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পুরোনো দলিলের মাধ্যমে কম ক্ষেত্রে পাকিস্তানি মালিকেরাও ঢাকা এসে নিজেদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পুরোনো দলিলের মাধ্যমে কম দামে বিক্রি করে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বহু অবাঙালি মালিক এ সুযোগে ঢাকা এসে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট, নন অপশন সার্টিফিকেট ইত্যাদি বের করে নিজেরাই রিটের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্পত্তি ফিরে পাওয়া অবাঙালি ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে। এসব অবাঙালি টাকা পাকিস্তান বা অন্যত্র পাচার করে। এভাবে আইনের ফাঁকে অবৈধভাবে বাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি নতুনভাবে হস্তান্তরিত হওয়ায় কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রার আকারে দেশের বাইরে পাচার হয়। অথচ কোনো বাঙালি পাকিস্তানে অবস্থিত তাদের সম্পত্তির ওপর মালিকানা ফিরে পায়নি।৩৩

অবশ্য বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও পাকিস্তান স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার নীতি অব্যাহত রাখে। ফলে বাংলাদেশের আশাবাদ নিরাশায় পরিণত হয়। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগা শাহী ঢাকা সফরে এলে বিষয়টি প্রথমবারের মতো নতুন সরকারের আমলে উত্থাপিত হলে তিনিও বিষয়টির ওপর বিস্তারিত মূল্যায়ন প্রয়োজন বলে তাঁর পূর্বসূরিদের মতো তা এড়িয়ে যান। ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব তবারক হোসেনের পাকিস্তান সফরকালে সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গটি আবারও উত্থাপন করা হলে জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক সংকটের দোহাই দিয়ে বিষয়টি আবারও এড়িয়ে যায়। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া পাকিস্তান সফরকালে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় সম্মত বলে উল্লেখ করা হয়।৩৪ তবে আগা শাহীর একটি মন্তব্য থেকে বোঝা যায় এ বিষয় পাকিস্তান কতটুকু আন্তরিক ছিল। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, বাংলাদেশ যেহেতু উত্তরাধিকার রাষ্ট্র নয় তাই সে সম্পদের দাবি করতে পারে না। বাংলাদেশ এই মন্তব্যের তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ করে এবং সমতার ভিত্তিতে সম্পদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে।৩৫ বাংলাদেশের এই প্রতিবাদের কোনো জবাব পাকিস্তান না দিলেও বাংলাদেশ তার সম্পদের হিস্যার দাবিতে অনড় থাকে। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শামস-উল-হক পাকিস্তানের কাছে এ বিষয়টি উত্থাপন করলে তারা জানায়, পাক পররাষ্ট্রসচিবের আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় সচিব পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আগা শাহী না আসায় দীর্ঘদিন আর এ নিয়ে আলোচনা হয়নি।

দুই বছর পর পাকিস্তানের নতুন পররাষ্ট্রসচিব রিয়াজ পিরচা ১৯৮০ সালের ২৪ অক্টোবর তিন দিনের সফরে ঢাকা এলে বিষয়টি উত্থাপিত হয়। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, দুটি দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এবং দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের কাছে প্রেরিত রিপোর্টের ভিত্তিতে শিগগিরই ইসলামাবাদের সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এরপর দুদেশের পররাষ্ট্রসচিবদের কাছে রিপোর্ট পেশ করবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এম এ এস কিবরিয়া সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে বৈঠক ও সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করলেও৩৬ সে যাত্রায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৯৮০ সালে এ ব্যাপারে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করলেও সম্পদ ভাগ-বাঁটোয়ারার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এরপর ১৯৮১ সালের মধ্যে পাকিস্তানের অসহযোগিতার কারণে এ সম্পর্কিত কোনো বৈঠকই হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব কাঠমান্ডু সফরকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবকে বৈঠক ডাকার আহ্বান জানালে দেশে ফিরে তিনি বৈঠকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরও এ ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে দুরকমের বক্তব্য দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে একটি যৌথ কমিশন গঠন-সংক্রান্ত বাংলাদেশের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৮১ সালের ২৪ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে এটা একটা আলোচনাসাপেক্ষ ব্যাপার। এ ব্যাপারে আলোচনায় উভয় সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে।৩৭ এ থেকে বোঝা যায় যে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে কার্যত কোনো রকম অগ্রগতি হয়নি, বরং জিয়ার মৃত্যুর পরপর টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করে যে বাংলাদেশ সম্পদের দাবি প্রত্যাহার করেছে। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র একে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। সূত্রটি আরও উল্লেখ করে, ইতিমধ্যে ১৯৮০ সালে যে ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের সদস্যদের নাম পাকিস্তানকে জানানো হয়েছে এবং কমিটি শিগগিরই কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।৩৮

এরপর ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তান সফরে গেলে তাঁকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হলেও সম্পদ বণ্টন বিষয় কোনো আলোচনা হয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও খুব বেশি চাপ পাকিস্তানের ওপর ছিল না তা জেনারেল এরশাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের ১৯৮৯ সালের ৮ জুনের একটি বিবৃতি থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদের সঠিক ও স্বীকৃত পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে চালানো হচ্ছে।৩৯ একই বছর অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ঢাকা সফরে এলে ‘বাংলাদেশের যখনই প্রয়োজন হবে পাকিস্তানিরা আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে’—এ ধরনের গালভরা মন্তব্য করলেও সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে যুক্ত বিবৃতিতে দায়সারা গোছের কয়েক লাইন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এ বিষয়ে একটি সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে উভয় সম্মত হন বলে শুধু উল্লেখ করা হয়। এরপরও একই ধারার বিবৃতি দিয়ে সব সময় পাকিস্তান পাশ কাটিয়ে যায়। বিষয়টিকে বরাবর জটিল হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও জটিলতা নিরসনে কখনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তিন বছর দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে দেশে ফেরার প্রাক্কালে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার রিয়াজ হোসেনের মন্তব্যে এর প্রতিফলন ঘটে। তিনি বলেন, I don’t think it will beg easy solution. These are very complicated and complex issues. But given the goodwill and understanding on both sides some sort of a solution could be found out.

নব্বইয়ের দশকে এসেও সম্পদ বণ্টন বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের তত্পরতার অভাবে শুধু উভয় দেশের নেতাদের সফরকালে বিক্ষিপ্তভাবে বিষয়টি কখনো কখনো হালকাভাবে আলোচিত হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ১৯৯০ সালের মার্চে ঢাকা সফরে এলে অমীমাংসিত বিহারি সমস্যা প্রসঙ্গে আলোচনা করলেও সম্পদ বণ্টন বিষয় গুরুত্ব পায়নি। তিনিও তাঁর পূর্বসূরিদের মতো বলেন, ‘সম্পদ ভাগাভাগির ব্যাপারটি অত্যন্ত জটিল। এ প্রশ্নে আরও অনেক আলোচনা করতে হবে। ত্বরিত কোনো সমাধান যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তা আশাপ্রদ নয়।’ একই বক্তব্য দেন পরের বছর এপ্রিলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত যোগাযোগমন্ত্রী মীর হাজাম খান। ঢাকা সফরে এসে তিনি সম্পদ বণ্টনের এমন সমাধান চেয়েছেন, যাতে উভয় দেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক দৃঢ় হবে। কিন্তু এই ভ্রাতৃত্ব কীভাবে দৃঢ় করা যায়—দাবিটি করে, নাকি প্রত্যাহার করে তা তিনি উল্লেখ করেননি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান সফরের প্রাক্কালে পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয় উপস্থাপনার ব্যাপারটি বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনায় আসে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং মন্তব্য করেন সম্পদ বণ্টন বিষয়টি আলোচনায় আসবে। ৫২ জন সফরসঙ্গী নিয়ে তিনি পাকিস্তান সফরে গেলেও এ ব্যাপারে যুক্ত ঘোষণায় এক লাইনের গতানুগতিক বিবৃতি ছাড়া প্রাপ্তিযোগ কিছুই ঘটেনি। যদিও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এ ব্যাপারে অগ্রগতিকে কিছুটা বাড়িয়ে বলার চেষ্টা করেন। তিনি মন্তব্য করেন উভয় দেশ দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান এ সমস্যার দ্রুত সমাধানে উপনীত হতে সম্মত হয়েছে।

দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৬ সালে সম্পদ বণ্টন বিষয় আবারও কিছু আলোচনা হয়। এ বছর আগস্ট মাসের ৯-১১ তারিখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব পাকিস্তান সফরকালে এবং ১৬-১৮ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব নাজিমুদ্দিন শেখ ঢাকা সফরকালে সম্পদ বণ্টন বিষয় আলোচনা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের মন্তব্য থেকে এ বিষয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, সম্পদ বণ্টন ব্যাপারে পাকিস্তানের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যে কারণে খুব দ্রুত এর সমাধান সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ বিষয় অগ্রগতি হবে, পর্যবেক্ষক মহল বেশ আশাবাদ ব্যক্ত করলেও ১৯৯৭ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তান সফর শেষে দেশে ফিরে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করেন।৪০ কোনো অগ্রগতি যে হয়নি তা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকেই প্রমাণ হয়। ২০০২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ঢাকা সফরে এলে আবারও হালকাভাবে সম্পদ বণ্টন বিষয়টি উপস্থাপিত হয়। উভয় দেশ তাঁর সফরে সন্তোষ প্রকাশ করলেও সম্পদ বণ্টন বিষয়টি ছিল ফলশূন্য।

২০০৬ সালের ১২-১৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সফর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাঁর সফরের প্রাক্কালে ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসন্ন পাকিস্তান সফরকালে বিহারি প্রত্যাবাসন ও সম্পদ বণ্টন বিষয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা করবেন বলে জানান। যদিও খালেদা জিয়ার সফরকালে চারটি সমঝোতা স্মারক, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সমঝোতা হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত সহযোগিতা বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। দেশে ফিরে খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান মনের মাধুরী মিশিয়ে আগের সব সফরের মতো ১৫ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, We’ve been discussing the issue and it will continue.৪১ এমনিভাবে অমীমাংসিত বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো চাপ না থাকায় দিনের পর দিন পাকিস্তান বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী শাসনামলেও এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি।

অমীমাংসিত সম্পদ বণ্টন বিষয়ে উপসংহারে বলা যায় যে বিগত সাড়ে তিন দশক দুদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উভয় দেশ সফর এবং বিভিন্ন বৈঠকে সম্পদ বণ্টন বিষয় আলোচনায় উঠলেও কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উভয় দেশের এসব সফরকালে সফরের বিপুল সাফল্য পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে প্রচার করা হলেও বিধি মোতাবেক কোনো আলোচনা হয়নি। নামে মাত্র একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন পর্যায়ে তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও ওয়ার্কিং গ্রুপের কোনো সভাই অনুষ্ঠিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ করে কমনওয়েলথ ও ইসলামি সম্মেলন সংস্থায় তোলা হলেও ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের সরকারগুলো দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে বিশেষ তত্পর হয়নি। বাংলাদেশ বরং পাকিস্তানি শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ঘোষিত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ ও কোনো কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান জিয়ার আমলে ফিরিয়ে দেয়। বাংলাদেশ এ সময় ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়ে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু দেশে নয়, জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন সংস্থায় ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও পাকিস্তানের ব্যাপারে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। আমাদের দেশে গণমাধ্যমও সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে তেমন তত্পরতা দেখায়নি। বুদ্ধিজীবী, ছাত্রসংগঠনসহ কোনো সংগঠনও এ ব্যাপারে সচেতনতা দেখায়নি। যে কারণে বাংলাদেশের কোনো সরকারই এ ব্যাপারে চাপের মুখোমুখি হয়নি। এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে পাকিস্তান বিষয়টিতে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়েছে, কখনো পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছে, যার সম্মিলিত ফল হচ্ছে দাবিটির অপমৃত্যু। ১৯৭৪ সালে দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৪০০০ মিলিয়ন ডলার। তখন ডলারের মূল্যমান ছিল ৮ টাকা, এখন যা ৭৮ টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের বর্তমানে পাওনা দাঁড়ায় ৩০০০০০ মিলিয়ন ডলার। দ্বিপক্ষীয় পর্যায় এবং জরুরি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি। পাকিস্তানি শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ঘোষিত সম্পত্তির হিসাব এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পাওনার সমন্বয় করেও এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। পাকিস্তান মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসিকে এবং মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে যে অকূটনৈতিকসুলভ আচরণ করছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের কাছে প্রাপ্ত সম্পদের দাবি আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপিত করা বাংলাদেশ সরকারের জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশেও এ ব্যাপারে জনমত গঠন করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের সোচ্চার হতে হবে।

তথ্যসূত্র

১.         তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ, ঢাকা: ১৯৭২, পৃ. ৯৪-৯৫।

২.         রেহমান সোবহান, “বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি,” দ্রষ্টব্য সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ১৯৯৩, পৃ. ৬১৯।

৩.        Rehmen Sobhan, “The Balance Sheet of Disparity,” The Forum, 14 November 1970.

৪.         Report on Economic Relation Between East and West Pakistan, Karachi : 1961, pp. 48-50.

৫.         M. Nazrul Islam, Pakistan Malaysia, A Comparative Study in National Integration, Dhaka: Academic Publishes, 1990, p.55.

৬.        Central Statistical Office, Monthly Foreign Trade Statistics, June 1970, Karachi: Government of Pakistan Press, 1970, p.1.

৭.         Economic Survey of East Pakistan 1967-70. Dacca: Government of East Pakistan Press, 1969, p.22.

৮.        H. O. Agarwal, Intenational Law, Allahabad : Allahabad Law Agency, 1987, p. 146.

৯.         উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের জন্যও চুক্তি জরুরি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় এমনি একটি চুক্তি হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুটি দেশের সম্পদ বণ্টনের জন্য গভর্নর আর. জি. কেসিকে পার্টিশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। যদিও এই অর্থ বণ্টনে দুটি দেশই কৌশলের আশ্রয় নেয়। তাই দেখা যায় যে, সম্পদ বণ্টনে আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও তা উদ্ধার অত্যন্ত জটিল। এ সম্পর্কিত আলোচনা জন্য দ্রষ্টব্য V.B. Kulkarni, Pakistan, Its Origin and Relation with India, Dhaka: Academic Publishers, p. 108. AviI `ËÓ¡eÅ Lok Sobha Debath, Vol-32, 1973, p. 57.

১০.       বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিতর্ক খণ্ড ২, সংখ্যা ১৪, ৮ জুন ১৯৭৯, পৃ. ৮৫৭-৮৬৩।

১১.       Hindustan Standard, 27 June 1974.

১২.       Pakistan Horizon, Vol. XXV, No. 4, 1972, p. 86.

১৩.      Asian Recorder, Vol, XIX, No. 51, 1973, p. 11749.

১৪.       দৈনিক বাংলা, ৭ মার্চ ১৯৭৪।

১৫.       ঐ, ৪ এপ্রিল ১৯৭৪।

১৬.      POT Pakistan Series, Vol. 11, Part 46, 24 April, 1974, p. 265.

১৭.       Economist, 27 April, 1974.

১৮.      Morning Weekly (Karachi), 19 May 1974.

১৯.      মতিউর রহমান, “বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক একটি অপ্রকাশিত হিসাব,” সাপ্তাহিক সন্ধানী, ঈদসংখ্যা মে ১৯৮৮, পৃ. ২২। পরিকল্পনা কমিশনের এই দাবিসংক্রান্ত সরকারি দলিল পাওয়া যায়নি। মতিউর রহমানের এই প্রবন্ধ ছাড়া সাপ্তাহিক রোববার এ “বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক,” ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সংখ্যার এক প্রতিবেদনে কর্পোরেশনসমূহের কাছে জনসংখ্যা ও সমতার ভিত্তিতে প্রাপ্য অর্থের একটি বিশদ তালিকা পাওয়া যায়। এ দুটি প্রতিবেদন এবং মতিউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে এই হিসেব বের করা হয়েছে। মতিউর রহমান বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক।

২০.       Syed Serajul Islam, “Bangladesh-Pakistan Relations : From Conflict to Cooperation,” in Emajuddin Ahmed (ed), Foreign Policy of Bangladesh : Small States Imperative, Dacca: UPL, 1948, p. 59.

21.      Just Faaland J.R. Parkinson, Bangladesh The Test Case of Development, London: C. Hurst and Company, 1976, p. 190.

22.      Denis Wright, Bangladesh Origin and Indian Ocean Relations (1971-1975), Dhaka: Academic Publishers, 1988, p. 198.

23.      Dilara Chowdhury, Bangladesh and South Asian International System, Dhaka: Academic Publishers.

24.      New York Times, 9 July 1974.

25.      Ibid, 29 June 1974.

26.      POT Pakistan Service, Vol. II, 30 December 1974, p, 956.

27.      Pakistan Times, 18 February 197.

২৮.      দৈনিক বাংলা, ৫ অক্টোবর ১৯৭৪।

২৯.       POT Pakistan Services, Vol, III Part 4, 16 July 1975, p. 433.

30.      Iftekhar A. Chowdhury, “Bangladesh’s External Relations: the Strategy of Small Power in A sub-System,” Unpublishet Phd. Thesis, Canberra : Australian National University, 1979, p. 124.

31.      POT Pakistan Series, op.cit, p. 433.

৩২.      মতিউর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬।

৩৩.      জগলুল আলম, “করাচিতে লেনদেন ২০ কোটি টাকার লোকসান”, সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১৯৮১, পৃ. ২১-২২।

৩৪.      দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭৭।

৩৫.      Mohammad Shamsul Haq, Bangladesh in International Politics the Dilemmas of the Weak States, Dhaka: UPL, 1993, p. 156.

36.      The Hindu, 28 October 1980.

৩৭.      দৈনিক সংবাদ, ২৫ এপ্রিল ১৯৮১।

৩৮.     দৈনিক বাংলা, ২৫ জুন ১৯৮১।

৩৯.      দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ জুন ১৯৮৯।

৪০.       ঐ, ২৫ মার্চ ১৯৯৭।

৪১.       Bangladesh Observer, 16 February 2006.