দুই অর্থনীতির তত্ত্বের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে চিন্তার সূত্রপাত হয়, কীভাবে সে অঞ্চলের অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষা করা যায় এবং অর্থনীতির শ্লথ প্রবৃদ্ধির চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। এই নিম্ন প্রবৃদ্ধির কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানের আর্থনীতিক কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে যথাযথ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণী ও ধারণাগত কাঠামো হিসেবে এই তত্ত্ব পেশ করা হয়েছিল।
একই সঙ্গে, রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যার পরিণতিতে ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের কার্যত মৃত্যু হয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারায় দলটির এ পরিণতি হয়, ফলে ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিষয়টি উঠে আসে।
এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হচ্ছে, দুই অর্থনীতির তত্ত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া এবং তার প্রকৃত ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করা। পাকিস্তানের উন্নয়নের এই কাঠামোর উত্স নিয়ে গত কয়েক বছরে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, যার মধ্যে অনেক কথাই ভুল ও অযথাযথ। কিন্তু ছয় দফার—যার মূল অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ ছিল এই ধারণা—ভিত্তিতে পরিচালিত স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষমেশ সফল না হলে এই যুগান্তকারী ধারণা হয়তো মহাফেজখানায় পোকার খাদ্যে পরিণত হতো, সেটা এতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করত না। সর্বোপরি, মানুষ সফলতার ভাগীদার হতে চায়, ব্যর্থতার নয়।
পাকিস্তানে যে দুটি অর্থনীতি বিরাজ করছে, এই ধারণা প্রথম তোলা হয় ১৯৫৬ সালে। পাকিস্তানের প্রথম খসড়া পঞ্চবার্ষিক (১৯৫৬-১৯৬০) পরিকল্পনার জন্য উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের বিশেষ সম্মেলনে এই ধারণাটি পেশ করা হয়। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে ঢাকায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের বিশেষ প্রতিবেদনে এই ধারণার মূল দিকগুলো বিস্তৃত করা হয়, যে প্রতিবেদন ১৯৫৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের কাছে পেশ করা হয়। পুরো প্রতিবেদনটি আমার বই বাংলাদেশ—মেকিং অব আ নেশন-এ পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের যে অংশটি নিচে উদ্ধৃত করছি, সেটার আর অধিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই: ‘পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে, বিশেষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য, দেশটিকে দুটি ইউনিটে ভাগ করতে হবে। পাকিস্তানের দুটি ইউনিটের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করলেই তার উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যায়, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের অধিক জনসংখ্যা, তুলনামূলক অধিক বেকারত্ব এবং দুটি ইউনিটের মধ্যে শ্রমিকদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় একেবারেই না যাওয়া—এসব বিষয় আমলে নিতে হবে’। ‘আমাদের মতে, পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রাথমিক অপরিহার্যতা হচ্ছে, দুটি অংশের পরিসংখ্যান আলাদা আলাদাভাবে দেখানো, যেমন: জাতীয় আয়, ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও আর্থিক সম্পদ—অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক’। ১০ জন অর্থনীতিবিদ এটি প্রণয়ন ও স্বাক্ষর করেছিলেন, আর সস্মেলন তা অনুমোদনও করে। এই ১০ জনের মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, তার আগের বছরই অর্থাত্ ১৯৫৫ সালে আমি হার্ভার্ড থেকে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছি। অন্যান্য অর্থনীতিবিদ হচ্ছেন: এম এন হুদা, মাজহারুল হক, এ রাজ্জাক, নুরুল ইসলাম, এ সাদেক, এ ফারুক, এ এন এম মাহমুদ, মো. সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ হোসেন ও শফিকুর রহমান। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই মানুষদের মধ্যে একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। ১৯৫৯-৬০ সালে দ্রব্যমূল্যের দ্রুত বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে গঠিত প্রাইস কমিশনের প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সময় আমি উপর্যুক্ত কাঠামোটি বাজিয়ে দেখতে পেরেছিলাম। কমিশনে আমিই ছিলাম একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ সদস্য। দুই অর্থনীতি তত্ত্বের মৌলিক প্রস্তাব ছিল, দাম বাড়াসহ সব অর্থনৈতিক বিষয়ই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে, পৃথকভাবে বিবেচনা করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির মাত্রা ছিল অনেক বেশি। আর এর কারণ ও তা থেকে পরিত্রাণের উপায়ও দুই পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভিন্ন। কমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা এর কঠোর বিরোধিতা করেন। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে নতুনভাবে দেখার ব্যাপারটা তাঁদের কাছে ছিল অভিশপ্ত ব্যাপারের মতো, এর মধ্যে তাঁরা বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ পেয়েছেন। কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি অতিরিক্ত ও পৃথক নোট দিয়ে আমি বাধিত হয়েছিলাম।