সম্পাদকীয়

ষাট দশক বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত ঐতিহাসিক ছয় দফা ব্যাপকভাবে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত। এ ছয় দফার ভিত্তি রচিত হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে এ অঞ্চলের প্রথিতযশা তত্কালীন সময়ের তরুণ অর্থনীতিবিদেরা যখন দুই অর্থনীতি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম তাঁর ‘দুই অর্থনীতি: ছয় দফার ভিত্তি’ প্রবন্ধে এ তত্ত্ব সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার মাধ্যমে সঠিক ইতিহাস জানানোর প্রয়াস পেয়েছেন। লেখাটি তাঁর গ্রন্থ মেকিং অব এ নেশন বাংলাদেশ: এন ইকোনমিস্ট’স টেল থেকে অনূদিত হয়েছে।

পাকিস্তানি শাসনের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির ৪৪ বছর পার করতে চলেছি আমরা। মানবতাবিরোধীদের বিচারকার্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসক ও সেনাবাহিনীর এদেশীয় তাদের সহযোগীদের দ্বারা নির্যাতন ও অনাচারের যাতনা কিছুটা হলেও লোপ পাবে। মুক্তির স্বাদ পরিপূর্ণ করতে তা অপরিহার্য। কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে আমাদের যে রাষ্ট্রীয় পাওনা রয়েছে তা যে আদায় হয়নি, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তানের কাছে কী পরিমাণ সম্পদ পাবে এবং তা আদায়ের মাধ্যম কী হতে পারে, সে সম্পর্কে এদেশের মানুষের ধারণা থাকা দরকার। আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন তাঁর লেখায় সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিকীসহ লেবার পার্টি থেকে তিনজন বাঙালি বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের সংসদ সদস্য এবার নির্বাচিত হয়েছেন। যেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর নাতনি নির্বাচিত হয়েছেন, সেই টাওয়ার হ্যামলেট ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি সত্তার সঙ্গে একীভূত এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। টাওয়ার হ্যামলেটের ভূমিকা এবং সেখানে বাংলাদেশের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রতিচিন্তার পাঠকদের জানানোর উদ্দেশ্যে সারাহ গ্লিনের এই প্রবন্ধটি ছাপাতে উত্সাহী হলাম।

‘১৮৭৪-১৯৪৭ কালপর্বে বাংলা-আসামের সীমান্তে অদলবদল এবং সিলেটের গণভোটের ইতিহাস’ লেখাটি ঐতিহাসিক কিছু প্রশ্ন সামনে রেখে তার তাত্পর্য তুলে ধরতে সহায়ক হবে। আশফাক হোসেন সেই নির্দিষ্ট সময়ে আসাম ও সিলেটের সার্বিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ভূমিকার বিশ্লেষণ তুলে এনেছেন। সীমান্ত ইতিহাসের ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিকটি বিবেচনায় নিয়ে লেখাটি ছাপানো হলো।

‘ইভ টিজিং’ বাংলাদেশের একটি অন্যতম সামাজিক সমস্যা হলেও দেশের আর্থ-রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য কুফল রয়েছে। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইভ টিজিংয়ের ফলে তাদের শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ব্যাহত করে। ‘বাংলাদেশে কিশোরীদের যৌন হয়রানি এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা’ প্রবন্ধে ইভ টিজিং সম্পর্কে গবেষণালব্ধ ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে, যা এ বিষয়ের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।

সংগীতজ্ঞ আবদুল আহাদ এ দেশের সংগীত অঙ্গনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। দেশভাগের পরে সংগীত জগতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের সাধারণ সংগীতপ্রেমী মানুষ ও সংগীত গবেষকদের জন্য আবদুল আহাদ সম্পর্কে জানা জরুরি। এ দেশের সংগীতোন্নয়নে তা তাত্পর্যপূর্ণ হবে বলে আশা করি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের আওতায় আবদুল আহাদের সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করেছিলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মুস্তফা নূরউল ইসলাম। উল্লেখ্য যে, তাঁর জবানিতে আমাদের জাতীয় সংগীত-বিষয়ক এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে তুলে আনা হলো।

বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি ছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে শাসকেরা তা বাস্তবায়নে কখনোই মনোযোগী হননি। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বদলে ক্ষমতা কেন্দ্রে কুক্ষিগত করে রাখাই নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সরাসরি রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় স্থানীয় নির্বাচন আইন হতে চলেছে। সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এ প্রেক্ষাপটে কামাল হোসেনের বই বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস-এর আলোকে সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ‘স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও গণতন্ত্র’ নামে পর্যালোচনা নিবন্ধটি লিখেছেন। লেখাটি পাঠককে এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে সহায়তা করবে।

বর্তমান বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতির পেছনে বিভিন্ন সময়ে শাসক দল ভূমিকা রেখেছে। শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, অনাচার, শোষণ ও দুর্নীতির চর্চাকে অব্যাহত রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে আতঙ্ক ও সন্ত্রাস। যার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এক ভয়ের সংস্কৃতি। এ বিষয়ে বুঝতে হলে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আলী রীয়াজের ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি গ্রন্থটি অনবদ্য ভূমিকা রাখবে। তরুণ গবেষক রেজাউল হক এই বইটি আলোচনা করেছেন।