সারসংক্ষেপ
আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৭১ সাল একটি অতীব তাত্পর্যপূর্ণ বছর। এই বছরই বাংলাদেশ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামধারী কিছু নরপশু। দীর্ঘদিন পর হলেও বর্তমানে এসব রাজাকার, আলবদর নেতার বিচার হচ্ছে। এই বিচার চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাঠে নেমেছে। এই বিকৃতির অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত নির্মম গণহত্যায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা। যদিও যেকোনো গণহত্যাতেই সংখ্যা প্রধান বিচার্য বিষয় নয়, তারপরও সংখ্যার একটি সাংকেতিক তাত্পর্য রয়েই যায়। এই প্রবন্ধে যুক্তি দেখানো হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখের কম নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম এবং গবেষণাপত্র ব্যবহার করে এই দাবির সত্যতা উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৭১-এর গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে ‘৩ লক্ষ বনাম ৩ মিলিয়ন’ শিরোনামে যে বিতর্ক করা হয়, তার জবাবও খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। এ ছাড়া দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে মারা যাওয়া মানুষদের কেন গণহত্যার শিকার বিবেচনা করা উচিত, সে যুক্তিগুলোও প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরিশেষে বিশ্বের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গণহত্যার সঙ্গে তুলনামূলক ব্যাখ্যার সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যায় যে ৩০ লাখের অধিক বাঙালি গণহত্যার শিকার হওয়া কোনো মিথ নয়, বরং বাস্তবতা তা তুলে ধরা হয়েছে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ
১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, ৩০ লাখ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শরণার্থী, বঙ্গবন্ধু।
প্রারম্ভিক কথা
‘১৯৭১ সালের যুদ্ধটা নিয়ে সব সময়ই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়। সে সময় এমন বড় কিছুই হয়নি, সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটু শায়েস্তা করেছে, এই যা। ভারত ষড়যন্ত্র করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলমান দেশকে ভেঙে দুই ভাগ করেছে। যাঁরা দাবি করেন একাত্তরের গন্ডগোলের সময় ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বড়জোর তিন লাখ, এমনকি কমও হতে পারে। আর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা তিরিশ লাখ, এই আষাঢ়ে গল্পের প্রবক্তা শেখ মুজিব। আর সেই আষাঢ়ে গল্পটা প্রথম মঞ্চস্থ হয় বাহাত্তরের আটই জানুয়ারি, মুজিব যখন পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন। সেখানে সাংবাদিকেরা মুক্তিযুদ্ধে দেশের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চান। শেখ মুজিব একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজি ভালো জানতেন না। শেখ মুজিব দেশে আসার সময় বিমানবন্দরে তাকে বিদেশি সাংবাদিকেরা যখন ক্ষয়ক্ষতির কথা জিজ্ঞাসা করে তখন ‘স্বল্পশিক্ষিত’ মুজিব (তাদের মতে) মৃতের সংখ্যা “থ্রি লাখ” বলতে গিয়ে “থ্রি মিলিয়ন” বলে ফেলেন। সেই থেকে দেশের সব মানুষ এই সংখ্যাটাকে সঠিক ধরে নিয়েছে, যার আসলে কোনো ভিত্তি নেই।’
ওপরের লেখাটা নিয়ে যদি আজও আপনি এ দেশের ঘরে ঘরে যান তাহলে অন্তত মোট দশ ভাগের চার ভাগ মানুষ এই লেখার কিছুটা অংশের সঙ্গে হলেও একমত হবে। বাকি চার ভাগ মানুষের তিন ভাগ এই লেখাটা দেখামাত্র ছুড়ে ফেলে দেবেন আর বাদবাকি দুই ভাগ মানুষ হবেন বিভ্রান্ত। আজকের লেখা এই বিভ্রান্ত মানুষদের জন্য। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও স্বাধীনতার অনেক মৌলিক প্রশ্নে আমরা মতৈক্যে পৌঁছাতে পারিনি। সরকারের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের লাগাতার অপপ্রচারের কারণে এসব মৌলিক প্রশ্নে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এই নিবন্ধের পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন স্তরে আমরা এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।
একাত্তরে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই বঙ্গবন্ধুর ‘থ্রি লাখ’ ‘থ্রি মিলিয়ন’ বিভ্রান্তির গল্প বলা হয়। প্রথমেই এই মিথটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। দেখব বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার আগেই দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রে ৩০ লক্ষাধিক শহীদের খবর ছাপা হয়েছিল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেই একটা খবর সত্য হয়ে যায় না, আর সে জন্যই এখানে উদ্ধৃত করেছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দৈনিকে শহীদের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ার তুলনামূলক চিত্র। যেটাতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার সুযোগ নেই কোনো পক্ষেরই, যেটা প্রমাণ করবে ৩০ লাখ সংখ্যাটা কোনো স্বপ্নে পাওয়া সংখ্যা নয়, বাস্তবসম্পন্ন পরিসংখ্যান।
যেহেতু সংবাদপত্র কখনোই বিভ্রান্তির ওপরে নয়, সে জন্য আলোচনা করেছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদের সংখ্যা নিয়ে করা বেশ কয়েকটি গবেষণার কথা। উল্লেখ করব বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘের পরিসংখ্যান, বিভিন্ন এনসাইক্লোপিডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা সম্পর্কে মতামত এবং কয়েকজন গণহত্যা গবেষকের পর্যালোচনা। এরপর একজন গণহত্যা গবেষকের সম্পূর্ণ গবেষণাপদ্ধতি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর গবেষণার পুরো চিত্র তুলে ধরব। এরপর ৫০ বছর ধরে আমাদের দেশের মৃত্যুহারের তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরব। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাওয়া মৃত্যুহারের সঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া মৃত্যুহারের তুলনা করে দেখানো সম্ভব ১৯৭১ সালে শহীদের সম্ভাব্য সংখ্যাটি। যাঁরা দাবি করেন এত কম সৈনিক এত কম সময়ে এত বেশি মানুষকে মেরে ফেলতে পারে না, তাদের জন্য বিভিন্ন যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এবং সময়ের
সাপেক্ষে সৈনিক ও হতাহতের তুলনা করা হবে। শেষে আলোচনা করব শরণার্থী শিবিরে মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়ে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা এবং গবেষকদের গবেষণা থেকে আমরা ধারণা করে নিয়েছি, ১৯৭১ সালে ভারতে চলে যাওয়া প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শরণার্থীর ভেতর ৬ থেকে ১২ লাখের ভাগ্যে মৃত্যু নেমে এসেছিল।